উপেক্ষিতা - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়


উপেক্ষিতা
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়


পথে যেতে যেতেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়।
সে বোধ হয় বাংলা দুই কী তিন সালের কথা। নতুন কলেজ থেকে বার হয়েছি, এমন সময় বাবা মারা গেলেন। সংসারের অবস্থা ভালো ছিল না, স্কুলমাস্টারি নিয়ে গেলুম হুগলি জেলার একটা পাড়াগাঁয়ে। …গ্রামটির অবস্থা একসময়ে খুব ভালো থাকলেও আমি যখন গেলুম তখন তার অবস্থা খুব শোচনীয়। খুব বড়ো গ্রাম, অনেকগুলি পাড়া, গ্রামের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত বোধ হয় এক ক্রোশেরও ওপর। প্রাচীন আম-কাঁটালের বনে সমস্ত গ্রামটি অন্ধকার।
আমি ওগ্রামে থাকতুম না। গ্রাম থেকে প্রায় এক মাইল দূরে সে-গ্রামের রেলস্টেশন। স্টেশনমাস্টারের একটি ছেলে পড়ানোর ভার নিয়ে সেই রেলের P.W.D.-এর একটা পরিত্যক্ত বাংলোয় থাকতুম। চারিদিকে নির্জন মাঠ, মাঝে মাঝে তালবাগান। স্কুলটি ছিল গ্রামের ও-প্রান্তে। মাঠের মধ্যে নেমে হেঁটে যেতুম প্রায় এক ক্রোশ।
একদিন বর্ষাকাল, বেলা দশটা প্রায় বাজে, স্কুলে যাচ্ছি। সোজা রাস্তা দিয়ে না গিয়ে একটু শীঘ্র যাবার জন্য পাড়ার ভেতর দিয়ে একটা রাস্তা নেমে গিয়েছে সেইটে দিয়ে যাচ্ছি। সমস্ত পথটা বড়ো বড়ো আম-কাঁটালের ছায়ায় ভরা। একটু আগে খুব একপশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল, আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন ছিল। গাছের ডাল থেকে টুপটুপ করে বৃষ্টির জল ঝরে পড়ছিল। একটা জীর্ণ ভাঙা ঘাটওয়ালা প্রাচীন পুকুরের ধার দিয়ে রাস্তা। সেই রাস্তা বেয়ে যাচ্ছি, সেই সময় কে একটি স্ত্রীলোক, খুব টকটকে রংটা, হাতে বালা অনন্ত, পরনে চওড়া লালপাড় শাড়ি, বয়স চব্বিশ পঁচিশ হবে, পাশের একটা সরু রাস্তা দিয়ে ঘড়া নিয়ে উঠলেন আমার সামনের রাস্তায়। বোধ হয় পুকুরে যাচ্ছিলেন জল আনবার জন্যে। আমায় দেখে ঘোমটা টেনে পথের পাশে দাঁড়ালেন। আমি পাশকাটিয়ে জোরে চলে গেলুম। আমার এখন স্বীকার করতে লজ্জা হয়, কিন্তু তখন আমি ইউনিভার্সিটির সদ্যপ্রসূত গ্র্যাজুয়েট, বয়স সবে কুড়ি, অবিবাহিত। সংস্কৃত কাব্যসাহিত্যের পাতায় পাতায় যেসব তরলিকা, মঞ্জুলিকা, বাসন্তী—উজ্জয়িনীবাসিনী অগুরু-বাস-মোদিত-কেশা তরুণী অভিসারিকার দল, তারা—আর তাদের সঙ্গে ইংরেজি কাব্যের কত Althea, কত Genevieve, Theosebia তাদের নীল নয়ন আর তুষারধবল কোমল বাহুবল্লি নিয়ে আমার তরুণ মনের মধ্যে রাতদিন একটা সুমিষ্ট কল্পলোকের সৃষ্টি করে রেখেছিল। তাই সেদিন সেই সুশ্রী তরুণী রূপ, তাঁর বালা অনন্ত-পরা অনাবৃত হাতদুটির সুঠাম সৌন্দর্য আর সকলের ওপর তাঁর পরনের শাড়ি দ্বারা নির্দিষ্ট তাঁর সমস্ত দেহের একটা মহিমান্বিত সীমারেখা আমাকে মুগ্ধ এবং অভিভূত করে ফেললে। আমার মনের ভিতর এক প্রকারের নূতন অনুভূতি, আমার বুকের রক্তের তালে তালে সেদিন একটা নূতন স্পন্দন আমার কাছে বড়ড়া স্পষ্ট হয়ে উঠল।
বিকালবেলা রেললাইনের ধারে মাঠে গিয়ে চুপ করে বসে রইলুম। তালবাগানের মাথার ওপর সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। বেগুনি রং-এর মেঘগুলো দেখতে দেখতে ক্রমে ধূসর, পরেই আবার কালো হয়ে উঠতে লাগল। আকাশের অনেকটা জুড়ে মেঘগুলো দেখতে হয়েছিল যেন একটা আদিম যুগের জগতের উপরিভাগের বিস্তীর্ণ মহাসাগর। …বেশ কল্পনা করে নেওয়া যাচ্ছিল, সেই সমুদ্রের চারিপাশে একটা গাঢ় রহস্যভরা অজ্ঞাত মহাদেশ, যার অন্ধকারময় বিশাল অরণ্যানীর মধ্যে প্রাচীন যুগের লুপ্ত অতিকায় প্রাণীরা সব ঘুরে বেড়াচ্ছে।
দিন কেটে গিয়ে রাত হল। বাসায় এসে Keats পড়তে শুরু করলুম। পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, মাটির প্রদীপের বুক পুড়ে উঠে প্রদীপ কখন নিভে গিয়েছে। অনেক রাত্রে উঠে দেখলুম বাইরে টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে… আকাশ মেঘে অন্ধকার।…
তার পরদিনও পাড়ার ভেতর দিয়ে গেলুম। সেদিন কিন্তু তাঁকে দেখলুম না। আসবার সময়ও সেখান দিয়েই এলুম, কাউকে দেখলুম না। পরদিন ছিল রবিবার। সোমবার দিন আবার সেই পথ দিয়েই গেলুম। পুকুরটার কাছাকাছি গিয়েই দেখি যে তিনি জল নিয়ে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন, আমায় দেখে ঘোমটা টেনে দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।… আমার বুকের রক্তটা যেন দুলে উঠল, খুব জোরে হেঁটে বেরিয়ে গেলুম।…রাস্তার বাঁকের কাছে গিয়ে ইচ্ছা আর দমন করতে না-পেরে একবার পিছন ফিরে তাকালুম, দেখি তিনি ঘাটের ওপর উঠে ঘোমটা খুলে কৌতূহলী নেত্রে আমার দিকেই চেয়ে রয়েছেন, আমি চাইতেই ঘোমটা আবার টেনে দিলেন।
ওপরের পথটা ছেড়েই দিলুম একেবারে। পুকুরের পথ দিয়েই রোজ যাই। দু একদিন পরে আবার একদিন তাঁকে দেখতে পেলুম। আমার মনে হল সেদিনও তিনি আমায় একটু আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ করলেন। এইভাবে পনেরো-কুড়ি দিন কেটে গেল। কোনোদিন তাঁকে দেখতে পাই, কোনোদিন পাই না। আমার কিন্তু বেশ মনে হতে লাগল, তিনি আমার প্রতি দিন দিন আগ্রহান্বিতা হয়ে উঠছেন। আজকাল ততটা স্তভাবে ঘোমটা দেন না। আমারও কি হল—তাঁর গতি-ভঙ্গির একটা মধুর শ্রী, তাঁর দেহের একটা শান্ত কমনীয়তা, আমায় দিন দিন যেন অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ফেলতে লাগল।
একদিন তখন আশ্বিন মাসের প্রথম, শরৎ পড়ে গিয়েছে… নীল আকাশের সাদা সাদা লঘু মেঘখণ্ড উড়ে যাচ্ছে… চারিদিকে খুব রৌদ্র ফুটে উঠেছে… রাস্তার পাশের বনকচু, ভাঁট শ্যাওড়া, কুঁচলতার ঝোপ থেকে একটা কটুতিক্ত গন্ধ উঠছে।… শনিবার সকাল সকাল স্কুল থেকে ফিরছি। রাস্তা নির্জন, কেউ কোনো দিকে নেই। পুকুরটার পথ ধরেছি, একদল ছাতারে পাখি পুকুরের ওপারের ঝোপের মাথায় কিচ কিচ করছিল, পুকুরের জলের নীল ফুলের দলগুলো রৌদ্রতাপে মুড়ে ছিল। আমি আশা করিনি এমনসময় তিনি পুকুরের ঘাটে আসবেন। কিন্তু দেখলুম তিনি জল ভরে উঠে আসছেন। এর আগে চার-পাঁচ দিন তাঁকে দেখিনি, হঠাৎ মনে কী হল, একটা বড়ো দুঃসাহসের কাজ করে বসলুম। তাঁর কাছে গিয়ে বললুম— দেখুন, কিছু মনে করবেন না আপনি। আমি এখানকার স্কুলে কাজ করি, রোজ এই পথে যেতে যেতে আপনাকে দেখতে পাই, আমার বড় ইচ্ছে করে আপনি আমার বোন হন। আমি আপনাকে বউদিদি বলব, আমি আপনার ছোটো ভাই। কেমন তো? তিনি আমার কথার প্রথম অংশটায় হঠাৎ চমকে উঠে কেমন জড়োসড়ো হয়ে উঠেছিলেন, দ্বিতীয় অংশটায় তাঁর সে চমকানো ভাবটা একটু দূর হল। ঘড়া-কাঁখে নীচু চোখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি যুক্তকরে প্রণাম করে বললুম-বউদিদি, আমার এ ইচ্ছা আপনাকে পূর্ণ করতে হবে। আমাকে ছোটো ভাইয়ের অধিকার দিতেই হবে আপনাকে।
তিনি ঘোমটা অর্ধেকটা খুলে একটা স্থির শান্তদৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলেন। সুশ্রী মুখ যে আমি কখনো দেখিনি তা নয়, তবুও মনে হল তাঁর ডাগর কালো চোখদুটির শান্তভাব আর তাঁর ঠোঁটের নীচের একটা বিশেষ ভাঁজ, এই দুটিতে মিলে তাঁর সুন্দর মুখের গড়নে এমন এক বৈচিত্র্য এনেছে, যা সচরাচর চোখে পড়ে না।
খানিকক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইলুম। তারপর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন তোমার বাড়ি কোথায়?
আনন্দে সারা গা কেমন শিউরে উঠল। বললুম-কলকাতার কাছে, চব্বিশ পরগনা জেলায়। এখানে স্টেশনে থাকি।
তিনি জিজ্ঞাসা করলেন—তোমার নাম কী?
নাম বললুম।
তিনি বললেন—তোমার বাড়িতে কে কে আছেন?
বললুম—এখন বাড়িতে শুধু মা আর দুটি ছোটো ছোটো ভাই আছে। বাবা এই দু-বৎসর মারা গিয়েছেন।
তিনি একটু যেন আগ্রহের সুরে বললেন—তোমার কোনো বোন নেই?
আমি বললুম—না। আমার দুজন বড়ো বোন ছিলেন, তাঁরা অনেকদিন মারা গিয়েছেন। বড়দি যখন মারা যান তখন আমি খুব ছোটো, মেজদি পাঁচ-ছ বৎসর মারা গিয়েছেন। আমি এই মেজদিকেই জানতুম, তিনি আমায় বড়ো ভালোবাসতেন। তিনি আমার চেয়েও ছয় বৎসরের বড়ো ছিলেন।
তাঁর দৃষ্টি একটু ব্যথা-কাতর হয়ে এল, জিজ্ঞাসা করলেন—তোমার মেজদি থাকলে এখন তাঁর বয়স হত কত?
বললুম—এই ছাব্বিশ বছর।
তিনি একটু মৃদু হাসির সঙ্গে বললেন—তাই বুঝি ভাইটির আমার একজন বোন খুঁজে বেড়ানো হচ্ছে, না?
কী মিষ্টি হাসি! কী মধুর শান্ত ভাব! মাথা নীচু করে প্রণাম করে তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে বললুম—তা হলে ভাইয়ের অধিকার দিলেন তো আপনি?
তিনি শান্ত হাসিমাখা মুখে চুপ করে রইলেন।
আমি বললুম-বউদি, আমি জানতুম আমি পাব। আগ্রহের সঙ্গে খুঁজলে ভগবানও নাকি ধরা দেন, আমি একজন বোন অনায়াসেই পাব। আচ্ছা এখন আসি। আপনি কিন্তু ভুলে যাবেন না বউদি, আপনার যেন দেখা পাই। রবিবার বাদে আমি দু-বেলাই এ রাস্তা দিয়ে যাব।
আমার মাঠের ধারের তালবাগানটার পাখিগুলো রোজই সকাল-বিকাল ডাকে। একটা কী পাখি তার সুর খাদ থেকে ধাপে ধাপে তুলে একেবারে পঞ্চমে চড়িয়ে আনে। মন যেদিন ভারী থাকে সেদিন সে সুরের উদাস মাধুর্য প্রাণের মধ্যে কোনো সাড়া দেয় না।… আজ দেখলুম পাখিটার গানের সুরের স্তরে স্তরে হৃদয়টা কেমন লঘু থেকে লঘুতর হয়ে উঠছে।… মনে হতে লাগল জীবনটা কেবল কতকগুলো স্নিগ্ধ ছায়াশীতল পাখির গানে ভরা অপরাহের সমষ্টি, আর পৃথিবীটা শুধু নীল আকাশের তলায় ইতস্তত বর্ধিত অযত্ন-সম্ভুত তাল-নারিকেল গাছের বন দিয়ে তৈরি—যাদের ঈষৎ কম্পমান দীর্ঘ শ্যামল পত্ৰশীর্ষ অপরাহ্রে অবসন্ন রৌদ্রে চিকচিক করছে।
তার পরদিন বউদিদির সঙ্গে দেখা হল ছুটির পর বিকালবেলা। বউদিদি যেন চাপা হাসির সুরে জিজ্ঞাসা করলেন—এই যে, বিমলের বুঝি আজ খুব সকাল সকাল স্কুলে যাওয়া হয়েছিল!
আমি উত্তর দিলুম—বেশ বউদি, আমি ওবেলা তো ঠিক সময়েই গেলুম— আপনিই ছিলেন না, এখন দোষটা বুঝি আমার ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে, না? আর বউদি, ঘাটে ওবেলা আরও সব মেয়েরা ছিলেন।
বউদিদি হেসে ফেললেন, বললেন—তাই তো! ভাইটির আমার ওবেলা তো বড়ো বিপদ গিয়েছে তা হলে!
আমার একটু লজ্জা হল, ভালো করে জবাব দিতে না-পেরে বললুম—তা নয় বউদি, আমি এখানে অপরিচিত, পাড়ার মধ্যে দিয়ে পথ—পাছে কেউ কিছু মনে করে!
বউদিদির চোখের কৌতুক-দৃষ্টি তখনও যায়নি, তিনি বললেন—আমি ওবেলা ঘাটের জলেই ছিলাম বিমল। তুমি ওই চটকা গাছটার তলায় গিয়ে একবার ঘাটের দিকে চেয়ে দেখলে, আমায় তুমি দেখতে পাওনি।
আমি জিজ্ঞাসা করলুম—বউদি, আপনার বাপেরবাড়ি কোথায়?
বউদিদি উত্তর দিলেন, খোলাপোতা চেনো? সেই খোলাপোতায়।
আমি ইতস্তত করছি দেখে আমায় আর একটু বিশদ সংবাদ দিয়ে বললেন, ওই যে খোলাপোতার রাস! বউদিদির হাসিভরা দৃষ্টি যেন একটু গর্বমিশ্রিত হয়ে উঠল। কিন্তু বলা আবশ্যক যে, খোলাপোতা বলে কোনো গ্রামের নাম এই আমি প্রথম শুনলুম। অথচ বউদির বাপেরবাড়ি, যেখানে এমন রাস হয়, সেই বিশ্ববিশ্রুত খোলাপাতার ভৌগোলিক অবস্থান সম্বন্ধে আমার অজ্ঞতা পাছে তাঁর মনে ব্যথা দেয়, এই ভয়ে বলে ফেললুম—ও! সেই খোলাপোতায়? ওটা কোন জেলায় ভালো…
বউদিদির কাছ থেকে সাহায্য পাবার প্রত্যাশা করেছিলুম কিন্তু দেখলুম তিনি সে বিষয়ে নির্বিকার। তাঁর হাসিভরা সরল মুখখানির দিকে চেয়ে আমার করুণা হল, এ-সমস্ত জটিল ভৌগোলিক তত্বের মীমাংসা নিয়ে তাঁকে পীড়িত করতে আর আমার মন সরল না।
বললুম—আচ্ছা বউদি, আসি তাহলে।
বউদিদি তাড়াতাড়ি ঘড়ার মুখ থেকে কলার পাতে মোড়া কী বার করলেন। সেইটে আমার হাতে দিয়ে বললেন—কাল চাপড়া ষষ্ঠীর জন্যে ক্ষীরের পুতুল তৈরি করেছিলাম, আর গোটাকতক কলার বড়া আছে, বাসায় গিয়ে খেও।
চার-পাঁচ দিন জ্বর ভোগের পর একদিন পথ্য পেয়ে স্কুলে যাচ্ছি, বউদিদির সঙ্গে দেখা। আমায় আসতে দেখে বউদিদি উৎসুক দৃষ্টিতে অনেকদ্দূর থেকে আমার দিকে চেয়েছিলেন। নিকটে যেতে জিজ্ঞাসা করলেন—এ কি বিমল, এমন মুখ শুকনো কেন?
বললুম-জ্বর হয়েছিল বউদিদি।
বউদিদি উদবেগের সুরে বললেন—ও, তাই তুমি চার-পাঁচদিন আসনি বটে। আমি ভাবলাম, বোধ হয় কীসের ছুটি আছে। আহা তাই তো, বড্ড রোগা হয়ে গিয়েছ যে বিমল।
তাঁর চোখের দৃষ্টিতে একটা সত্যিকারের ব্যথামিশ্রিত স্নেহের আত্মপ্রকাশ বেশ বুঝতে পেরে মনের মধ্যে একটা নিবিড় আনন্দ পেলুম। হেসে বললুম—যে দেশ আপনাদের বউদি, একবার অতিথি হলে আপ্যায়নের চোটে একেবারে অস্থির করে তুলবে।
বউদিদি জিজ্ঞাসা করলেন—আচ্ছা বিমল, ওখানে তোমায় বেঁধে দেয় কে?
আমি বললুম—কে আর রাঁধবে, আমি নিজেই।
বউদিদি একটু চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন—আচ্ছা বিমল, এক কাজ করো না কেন?
আমি জিজ্ঞাসা করলুম—কী বউদি?
তিনি বললেন—মাকে এই পুজোর ছুটির পর নিয়ে এসো। এরকমভাবে কী করে বিদেশে কাটাবে বিমল? লক্ষ্মীটি, ছুটির পর মাকে অবিশ্যি করে নিয়ে এসো। এই গাঁয়ের ভেতর অনেক বাড়ি পাওয়া যাবে। আমাদের পাড়াতেই আছে। না হলে অসুখ হলে কে একটু জল দেয়? আচ্ছা হ্যাঁ বিমল, আজ যে পথ্য করলে, কে বেঁধে দিলে?
আমার হাসি পেল, বললুম—কে আবার দেবে বউদি? নিজেই করলুম।
তিনি আমার দিকে যেন কেমনভাবে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলেন। তাঁর সেদিনকার সেই সহানুভূতি-বিগলিত স্নেহমাখানো মাতৃমুখের জলভরা কালো চোখদুটি পরবর্তী জীবনে আমার অনেকদিন পর্যন্ত মনে ছিল।…
সেদিন স্কুল থেকে আসবার সময় দেখি, বউদিদি যেন আমার জন্যেই অপেক্ষা করছেন। আমায় দেখে কলার পাতায় মোড়া কী একটা আমার হাতে দিয়ে বললেন—শরীরটা একটু না–সারলে, রাত্রে গিয়ে রান্না, সে পেরে উঠবে না বিমল। এই খাবার দিলাম, রাত্রে খেও…।
বোধ হয় একটু আগেই তৈরি করে এনেছিলেন, আমি হাতে বেশ গরম পেলুম। বাসায় এসে কলার পাতা খুলে দেখি, খানকতক রুটি, মোহনভোগ, আর মাছের একটা ডালনা মতো।
তার পরদিন ছুটির পর আসবার সময়ও দেখি বউদিদি খাবার হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, আমার হাতে দিয়ে বললেন—বিমল, তুমি তোমার ওখানে দুধ নাও?
আমি বললুম—কেন, তাহলে দুধও খানিকটা করে দেন বুঝি? সত্যি বলছি বউদি, আপনি আমার জন্য অনর্থক এ কষ্ট করবেন না, তা হলে এ রাস্তায় আমি আর আসছি না।
বউদিদির গলা ভারী হয়ে এল, আমার ডান হাতটা আস্তে আস্তে এসে ধরে ফেললেন, বললেন—লক্ষ্মী ভাই, ছিঃ ও-কথা বোলো না। আচ্ছা, আমি যদি তোমার মেজদিই হতাম, তা হলে এ কথা কী আজ আমায় বলতে পারতে? আমার মাথার দিব্যি রইল, এ পথে রোজ যেতেই হবে।
সেই দিন থেকেই বউদিদি রোজ রাত্রের খাবার দেওয়া শুরু করলেন। সাত আট দিন পরে রুটির বদলে কোনোদিন লুচি, কোনোদিন পরোটা দেখা দিতে লাগল। তাঁর সে আগ্রহভরা মুখের দিকে চেয়ে আমি তাঁর সেসব স্নেহের দান ঠিক অস্বীকারও করতে পারতুম না, অথচ এই ভেবে অস্বস্তি বোধ করতুম যে আমার এই নিত্য খাবার জোগাতে না-জানি বউদিদিকে কত অসুবিধাই পোহাতে হচ্ছে। তার পরই আশ্বিন মাসের শেষে পুজোর ছুটি এসে পড়াতে আমি নিষ্কৃতি পেলুম।
সমস্ত পুজোর ছুটিটা কী নিবিড় আনন্দেই কাটল সেবার। আমার আকাশ-বাতাস যেন রাতদিন আফিমের রঙিন ধূমে আচ্ছন্ন থাকত। ভোরবেলা উঠোনের শিউলিগাছের সাদাফুল বিছানো তলাটা দেখলে—হেমন্ত রাত্রির শিশিরে ভেজা ঘাসগুলোর গা যেমন শিউরে আছে, ওইরকম আমার গা শিউরে উঠত…কার ওপর আমার জীবনের সমস্ত ভার অসীম নির্ভরতার সঙ্গে চাপিয়ে দিয়ে আমার মন যেন শরতের জলভরা নামানো হালকা মেঘের মতো একটা সীমাহারা হাওয়ার রাজ্যে ভেসে বেড়াতে লাগল।
ছুটি ফুরিয়ে গেল। প্রথম স্কুল খোলবার দিন পথে তাঁকে দেখলুম না। বিকালে যখন ফিরি, তখন শীতল হাওয়া একটু একটু দিচ্ছে।…পথের ধারের এক জায়গায় খানিকটা মাটি কারা বর্ষাকালে তুলে নিয়েছিল, সেখানটায় এখন বনকচু, কাল কাসুন্দা, ধুতুরা, কুচকাঁটা, ঝুমকো লতার দল পরস্পর জড়াজড়ি করে একটুখানি ছোটো ছোটো ঝোপ মতো তৈরি করেছে…শীতল হেমন্ত অপরাহের ছায়া-সবুজ ঝোপটির ওপর নেমে এসেছে…এমন একটা মিষ্টি নির্মল গন্ধ গাছগুলো থেকে উঠছে, এমন সুন্দর শ্রী হয়েছে ঝোপটির, সমস্ত ঝোপটি যেন বনলক্ষ্মীর শ্যামলা শাড়ির একটা অঞ্চল-প্রান্তের মতো।
তার পরদিন তাঁকে দেখলুম। তিনি আমায় লক্ষ করেননি, আপন-মনে ঘাটের চাতালে উঠতে যাচ্ছিলেন। আমি ডাকলুম-বউদি!…বউদিদি কেমন হঠাৎ চমকে উঠে আমার দিকে ফিরলেন।
—এ কি বিমল! কবে এলে? আজ কী স্কুল খুলল? কীরকম আছ?…সেই পরিচিত প্রিয় কণ্ঠস্বরটি। সেই স্নেহ-ঝরা শান্ত চোখ দুটি! বউদিদি আমার মনে
ছুটির আগে যে স্থান অধিকার করেছিলেন, ছুটির পরের স্থানটা তার চেয়ে আরও ওপরে।… আমি সমস্ত ছুটিটা তাঁকে ভেবেছি, নানামূর্তিতে নানা অবস্থায় তাঁকে কল্পনা করেছি, নানা গুণ তাঁতে আরোপ করেছি, তাঁকে নিয়ে আমার মুগ্ধ মনের মধ্যে অনেক ভাঙা-গড়া করেছি। আমার মনের মন্দিরে আমারই শ্রদ্ধা ভালোবাসায় গড়া তাঁর কল্পনামূর্তিকে অনেক অর্ঘ্যচন্দনে চৰ্চিত করেছি। তাই সেদিন যে বউদিদিকে দেখলুম, তিনি পূজার ছুটির আগেকার সে বউদিদি নন, তিনি আমার সেই নির্মলা, পূহৃদয়া পূণ্যময়ী মানসী প্রতিমা, আমার পার্থিব বউদিদিকে তিনি তাঁর মহিমাখচিত দিব্য বসনের আচ্ছাদনে আবৃত করে রেখেছিলেন, তাঁর স্নেহ করুণার জ্যোতির্বাষ্পে বউদিদির রক্তমাংসের দেহটার একটা আড়াল সৃষ্টি করেছিলেন।
আমার মাথা শ্রদ্ধায় সম্ভমে নত হয়ে পড়ল, আমি তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করলুম। বউদিদি বললেন—এসো এসো ভাই, আর প্রণাম করতে হবে না, আশীর্বাদ করছি এমনিই—রাজা হও। আচ্ছা বিমল, বাড়ি গিয়ে আমার কথা মনে ছিল?
মনে এলেও বাইরে আর বলতে পারলুম না—কে তবে আমার মগ্ন চৈতন্যকে আশ্রয় করে আমার নিত্যসুষুপ্তির মধ্যেও আমার সঙ্গিনী ছিল বউদি?…শুধু একটু হেসে চুপ করে রইলুম। বউদিদি জিজ্ঞাসা করলেন—মা ভালো আছেন?
আমি উত্তর দিলুম—হ্যাঁ বউদি, তিনি ভালো আছেন। তাঁকে আপনার কথা বললুম।
বউদিদি আগ্রহের সুরে বললেন—তিনি কী বললেন?
আমি বললুম—শুনে মার দুই চোখ জলে ভরে এল, বললেন—একবার দেখাবি তাকে বিমল? আমার নলিনীর শোক বোধ হয় তাকে দেখলে অনেকটা নিবারণ হয়।
বউদিদিরও দেখলুম দুই চোখ ছলছল করে এল, আমায় বললেন, হ্যাঁ বিমল, তা মাকে এই মাসে নিয়ে এলে না কেন?
আমি বললুম—সে এখন হয় না বউদি।
বউদিদি একটু ক্ষুব্ধ হলেন, বললেন—বিমল, জানো তো সেবার কীরকম কষ্টটা পেয়েছ! এই বিদেশ বিভুই, মাকে আনলে এই মিথ্যে কষ্টটা তো আর ভোগ করতে হয় না!
আমি উত্তর দিলুম—বউদি, আমি তো আর ভাবিনি যে আমি বিদেশে আছি, যেখানে আমার বউদি রয়েছেন, সে দেশ আমার বিদেশ নয়। মা না-থাকলেও আমার এখানে ভাবনা কীসের বউদি?
বউদিদির চোখে লজ্জা ঘনিয়ে এল, আমার দিকে ভালো করে চাইতে পারলেন, বললেন—হ্যাঁ, আমি তো সবই করছি। আমার কী কিছু করবার জো আছে? কত পরাধীন আমরা তা জানো তো ভাই! ওসব নয়, তুমি এই মাসেই মাকে আনো।
আমি কথাটাকে কোনোরকমে চাপা দিয়ে সেদিন চলে এলুম।
তার পরদিন ছুটির পর বউদিদির সঙ্গে দেখা। অন্যান্য কথাবার্তার পর আসবার সময় তিনি কলারপাতে মোড়া আবার কী একটা বার করলেন। তাঁর হাতে কলারপাত দেখলেই আমার ভয় হয়; আমি শঙ্কিতচিত্তে বলে উঠলুম—ও আবার কী বউদি? আবার সেই…
বউদিদি বাধা দিয়ে বললেন—আমার কি কোনো সাধ নেই বিমল? ভাইফোঁটাটা অমনি অমনি গেল, কিছু কী করতে পারলুম? কলার পাতা মোড়া রহস্যটি আমার হাতে দিয়ে বললেন—এতে একটু মিষ্টিমুখ করো, আর এইটে নাও—একখানা কাপড় কিনে নিও।
কথাটা ভালো করে শেষ না-করেই বউদি আমার হাতে একখানা দশ টাকার নোট দিতে এলেন। আমি চমকে উঠলুম, বললুম—এ কী বউদি, না না, এ কিছুতেই হবে না; খাবার আমি নিচ্ছি, কিন্তু টাকা নিতে পারব না।
আমার কথাটার স্বর বোধ হয় একটু তীব্র হয়ে পড়েছিল, বউদিদি হঠাৎ থতোমতো খেয়ে গেলেন, তাঁর প্রসারিত হাতখানা ভালো করে যেন গুটিয়ে নিতেও সময় পেলেন না, যেন কেমন হয়ে গেলেন। তারপর একটুখানি অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকবার পরই তাঁর টানা কালো চোখদুটি ছাপিয়ে বাঁধ ভাঙা বন্যার স্রোতের মতো জল গড়িয়ে পড়ল; আমার বুকে যেন কীসের খোঁচা বিঁধল।
এই নিতান্ত সরলা মেয়েটির আগ্রহভরা স্নেহ-উপহার রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে তাঁর বুকে যে লজ্জা আর ব্যথার শূল বিদ্ধ করলুম, সে ব্যথার প্রতিঘাত
অদৃশ্যভাবে আমার নিজের বুকে গিয়েও বাজল!
আমি তাড়াতাড়ি দুই হাতে তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে তাঁর হাত থেকে নোটখানা ও খাবার দুই-নিয়ে বললুম—বউদি, ভাই বলে এ অপরাধ এবারটা মাপ করুন আমার। আর কখনো আপনার কথার অবাধ্য হব না।
বউদিদির চোখের জল তখনও থামেনি।
দুই চোখ জলে ভরা সে তরুণী দেবীমূর্তির দিকে ভালো করে চাইতে না-পেরে আমি মাথা নীচু করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রইলুম।
বাড়ি এসে দেখলুম, কলারপাতের মধ্যে কতকগুলো দুগ্ধশুভ্র চন্দ্রপুলি, সুন্দর করে তৈরি। সমস্ত রাত ঘুমের ঘোরে বউদিদির বিষণ্ণ-কাতর দৃষ্টি বারবার চোখের সামনে ভাসতে লাগল।
মাসখানেক কেটে গেল।
প্রায়ই বউদিদির সঙ্গে দেখা হত। এখন আমরা ভাই-বোনের মতো হয়ে উঠেছিলুম, সেই রকমই পরস্পরকে ভাবতুম। একদিন আসছি, ফ্লানেল শার্টের একটা বোতাম আমার ছিল না। বউদি জিজ্ঞাসা করলেন—এ কী, বোতাম কোথায় গেল?
আমি বললুম—সে কোথায় গিয়েছে বউদি, বোতাম পরাতে জানিনে কাজেই ওই অবস্থা।
তার পরদিন দেখলুম, তিনি ছুঁচ-সুতো-বোতাম সমেতই এসেছেন। আমি বললুম—বউদি, এটা ঘাটের পথ, আপনি বোতাম পরাতে পরাতে কেউ যদি দেখে তো কী মনে করবে! আপনি বরং চুঁচটা আমায় দিন, আমি বাড়ি গিয়ে চেষ্টা করব এখন।
বউদিদি হেসে বললেন—তুমি চেষ্টা করে যা করবে তা আমি জানি, নাও সরে এসো এদিকে।
বাধ্য হয়ে সরেই গেলুম। তিনি বেশ নিশ্চিন্তভাবেই বোতাম পরাতে লাগলেন। ভয়টা দেখলুম তাঁর চেয়ে আমারই হল বেশি। ভাবলুম, বউদির তো সে কাণ্ডজ্ঞান নেই, কিন্তু যদি কেউ দেখে তো এর সমস্ত কষ্টটা ওঁকেই ভুগতে হবে।
একদিন বউদিদি জিজ্ঞাসা করলেন—বিমল, গোকুলপিঠে খেয়েছ?
আমার মা খুব ভালো গোকুলপিঠে তৈরি করতেন, কাজেই ও জিনিসটা আমি খুব খেয়েছি। কিন্তু বউদিদিকে একটু আনন্দ দেওয়ার জন্য বললুম—সে কীরকম বউদি?
আর রক্ষা নেই। তার পরদিনই বিকাল বেলা বউদিদি কলার পাতে মোড়া পিঠে নিয়ে হাজির।
আমায় বললেন—তুমি এখানে আমার সামনেই খাও। ঘড়ার জলে হাত ধুয়ে ফেলো এখন।
আমি বললুম—সর্বনাশ বউদি, এই এতগুলো পিঠে খেতে খেতে এ পথে লোক এসে পড়বে, সে হয় না, আমি বাড়ি গিয়েই খাব।
বউদি ছাড়বার পাত্রীই নন, বললেন—না, কেউ আসবে না বিমল। তুমি এখানেই খাও।
খেলুম, পিঠে খুব ভালো হয়নি। আমার মায়ের নিপুণ হাতের তৈরি পিঠের মতো নয়। বোধ হয় নতুন করতে শিখেছেন, ধারগুলো পুড়ে গিয়েছে, আস্বাদও ভালো নয়। বললুম—বাঃ বউদি, বড়ো সুন্দর তো! এ কোথায় তৈরি করতে শিখলেন? আপনার বাপেরবাড়ির দেশে বুঝি?
বউদির মুখে আর হাসি ধরে না। হাসিমুখে বললেন—এ আমি, আমাদের গুরুমা এসেছিলেন, তিনি শহরের মেয়ে, অনেক ভালো খাবার করতে জানেন, তাঁর কাছে শিখে নিয়েছিলাম।
তারপর সারা শীতকাল অন্যান্য পিঠের সঙ্গে গোকুলপিঠের পুনরাবৃত্তি চলল। ওই যে বলেছি, আমার ভালো লেগেছে, আর রক্ষা নেই।
একটা কথা আছে।
কিছুদিন ধরে আমার মনের মধ্যে একটা আগ্রহ একটু একটু করে জমছিল, জীবনটাকে খুব বড়ো করে অনুভব করবার জন্যে। আমার এ কুড়ি-একুশ বছর বয়সে এই ক্ষুদ্র পাড়াগাঁয়ে খাঁচার পাখির মতো আবদ্ধ থাকা ক্রমেই অসহ্য হয়ে উঠছিল। চলেও যেতাম এতদিন। এখানকার একমাত্র বন্ধন হয়েছিলেন বউদিদি। তাঁরই আগ্রহে স্নেহ-যত্নে সে অশান্ত ইচ্ছাটা কিছুদিন চাপা ছিল। এমন সময় মাঘ মাসের শেষের দিকে আমার এক আত্মীয় আমায় লিখলেন যে, তাঁদের কারখানা থেকে কাচের কাজ শেখবার জন্যে ইউরোপ আমেরিকায় ছেলে পাঠানো হবে, অতএব আমি যদি জীবনে কিছু করতে চাই, তবে শীঘ্ৰ যেন মোরাদাবাদ গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। তিনি সেখানকার কাচের কারখানার ম্যানেজার।
পত্র পেয়ে সমস্ত রাত আমার ঘুম হল না। ইউরোপ-আমেরিকা! সে কত ঊর্মি-সংগীত-মুখরিত শ্যামল সমুদ্রতট…কত অকূল সাগরের নীল জলরাশি, দূরে সবুজ বিন্দুর মতো ছোটো ছোটো দ্বীপ, ওই সিসিল! নতুন আকাশ, নতুন অনুভুতি…ডোভারের সাদা খড়ির পাহাড়—প্রশস্ত রাজপথে জনতার দ্রুত পাদচরণ, লাডগেট সার্কাস, টটেনহাম কোর্ট রোডবার্চ-উইলো পপলার মেপলগাছের সে কত শ্যামল পত্রসম্ভার, আমার কল্পলোকের সঙ্গিনী কনককেশিনী কত ক্লারা, কত মেরি, কত ইউজিনী।…
পরদিন সকালে পত্র লিখলুম—আমি খুব শীঘ্রই রওনা হব। স্কুলে সেদিনই নোটিশ দিলুম, পনেরো দিন পরে কাজ ছেড়ে দেব।
মন বড়ো ভালো ছিল না, উপরের পথটা দিয়ে কয়েকদিন গেলুম। দশ-বারো দিন পরে নীচের পথটা দিয়ে যেতে যেতে একদিন বউদিদির সঙ্গে দেখা। বউদিদি একটু অভিমান প্রকাশ করলেন—বিমল, বড়ো গুণের ভাই তো! আজ চার-পাঁচ দিনের মধ্যে বোনটা বাঁচল কী ম’ল তা খোঁজ করলে না?
আমি বললাম—বউদিদি, করলে সেটাই অস্বাভাবিক হত! বোনেরাই ভাইদের জন্যে কেঁদে মরে, ভাইয়েদের দায় পড়েছে বোনেদের ভাবনা ভাবতে। দুনিয়াসুদ্ধ ভাই-বোনেরই এই অবস্থা।
বউদিদি খিলখিল করে হেসে উঠলেন। এই তরুণীর হাসিটি বালিকার মত এমন মিষ্ট নির্মল যে এ শুধু লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতের জ্যোৎস্নার মতো উপভোগ করবার জিনিস, বর্ণনা করবার নয়। বললেন—তা জানি, জানি, নাও, আর গুমোর করতে হবে না, সে গুণ যে তোমাদের আছে তা কী আমরা ভেতরে ভেতরে বুঝি না? কিন্তু বুঝে কী করব, উপায় নেই। হ্যাঁ, তা সত্যি সত্যি মাকে কবে আনছ?
আমার কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা আমি বউদিদিকে কিছু বলিনি। সেকথা বললে যে তিনি মনে অত্যন্ত আঘাত পাবেন, এ আমি বুঝতে পেরেছিলুম। একবার ভাবলুম, সেই তো জানাতেই হবে, একদিন বলে ফেলি। কিন্তু অমন সরল হাসিভরা মুখ, অমন নিশ্চিন্ত শান্তির ভাব—বলতে বড়ো বাধল। মনে মনে বললুম, তোমরা কেবল বুঝি স্নেহ ঢেলে দিতেই জানো? তোমাদের স্নেহ-পাত্রদের বিদায়ের বাজনা যে বেজে উঠেছে এ সম্বন্ধে এ রকম অজ্ঞান কেন?
জিজ্ঞাসা করলুম—বউদি, একটা কথা বলি, আপনি আমায় এই অল্পদিনে এত ভালোবাসলেন কী করে? আচ্ছা আপনারা কী ভালোবাসার পাত্র-পাত্রীও দেখেন না? আমি কে বউদি যে আমার জন্যে এত করেন?
বউদিদির মুখ গম্ভীর হয়ে এল। তাঁর ওই এক বড়ো আশ্চর্য ছিল, মুখ গম্ভীর হলে প্রায়ই চোখে জল আসবে, জল কেটে গেল তো আবার হাসি ফুটবে। শরতের আকাশে রোদ-বৃষ্টি খেলার মতো। বললেন—এতদিন তোমায় বলিনি বিমল, আজ পাঁচ বছর হল আমারও ছোটো ভাই আমার মায়া কাটিয়ে চলে গিয়েছে, তারও নাম ছিল বিমল। থাকলে সে তোমারই মতো হত এতদিন। আর তোমারই মতো দেখতে। তুমি যেদিন প্রথম এ রাস্তা দিয়ে যাও, তোমায় দেখেই আমার মনের মধ্যে সমুদ্র উথলে উঠল, সেদিন বাড়ি গিয়ে আপন মনে কত কেঁদেছিলাম। তুমি এখান দিয়ে যেতে, রোজ তোমাকে দেখতাম। যেদিন তুমি আপনা হতেই দিদি বলে ডাকলে, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত যে কী সুখে আছি তা বলতে পারিনে। তোমায় যত্ন করে, তুমি যে বড়ো বোনের মতো ভালোবাসো, তাতে আমি বিমলের শোক অনেকটা ভুলেছি। ওই এক ভাই ছিল আমার। তুলসীতলায় রোজ সন্ধ্যাবেলা কত প্রণাম করি, বলি, ঠাকুর এক বিমলকে তো পায়ে টেনে নিয়েছ, আর এক বিমলকে যদি দিলে তো এর মঙ্গল করো, একে আমার কাছে রাখো।
চোখের জলে বউদিদির গলা আড়ষ্ট হয়ে গেল। আমি কিছু বললাম না। বলব কী!
একটু পরে বউদিদি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে জলভরা চোখ দুটি তুলে আমার মুখের দিকে চাইলেন। কী সুন্দর তাঁকে দেখাচ্ছিল। কালো চোখ দুটি ছল ছল করছে, টানা ভুরু যেন আরও নেমে এসেছে, চিবুকের ভাঁজটি আরও পরিস্ফুট, যেন কোন নিপুণ প্রতিমাকারক সরু বাঁশের চেঁচাড়ি দিয়ে কেটে তৈরি করেছে।…পথের পাশেই প্রথম ফাল্গুনের মুগ্ধ আকাশের তলায় আঁকোড় ফুলের একটা ঝোপে কাঁটাওয়ালা ডালগুলিতে থোলো থোলো সাদা ফুল ফুটে ছিল…মনের ফাঁকে ফাঁকে নেশা জমিয়ে আনে, এমনি তার মিষ্টি গন্ধ!
দুজনে অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলুম না। খানিক পরে বউদিদি বললেন
সেইজন্যেই বলছি ভাই, মাকে আনো। আমাদের পাড়ায় চৌধুরীদের বাড়িটা পড়ে আছে। ওরা এখানে থাকে না। খুব ভালো বাড়ি, কোনো অসুবিধা হবে না, তুমি মাকে নিয়ে এসো, ওখানেই থাকো, সে তাঁদের পত্র লিখলেই তাঁরা রাজি হবেন, বাড়ি তো এমনি পড়ে আছে। তোমার বোন পরাধীন, কিছু করবার তো ক্ষমতা নেই। তোমার সঙ্গে এসব দেখাশোনা, এসব লুকিয়ে, বাড়ির কেউ জানে না। তুমি দু-বেলা ঘাটের পথ দিয়ে যেও, দেখেই আমি শান্তি পাব ভাই। মাকে এ মাসেই আনো।
কেমন করে তা হবে?
একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলুম—বউদি, আমি এখানে থাকলে কী আপনি খুব সুখী হন?
বউদিদি বললেন—কী বলব বিমল? মাকে আনলে তোমার কষ্টটাও কম হয়, তা বুঝেও আমার সুখ! আর বেশ দুটি ভাই-বোন এক জায়গায় থাকব, বারো মাস দু-বেলা দেখা হবে, কী বলো?
আমি বললুম—ভাই যদি কোনো গুরুতর অপরাধ করে আপনার কাছে, তাকে ক্ষমা করতে পারবেন?
বউদিদি বললেন—শোনো কথার ভঙ্গি ভাইটির আমার, আমার কাছে তোমার আবার অপরাধটা কীসের শুনি?
আমি জোর করে বললুম—না বউদি, ধরুন যদি করি তাহলে?
বউদিদি আবার হেসে বললেন—না না, তা হলেও না। ছোটো ভাইটির কোনো কিছুতেই অপরাধ নেই আমার কাছে, আমি যে বড়ো বোন।
চোখে জল এসে পড়ল। আড়ষ্ট গলায় বললুম-ঠিক বউদি, ঠিক!
বউদি অবাক হয়ে গেলেন, বললেন—বিমল, কী হয়েছে ভাই! অমন করছ কেন?
মুখ ফিরিয়ে আনতে উদ্যত হলুম, বললুম—কিছু না বউদি, অমনি বলছি।
বউদিদি বললেন—তবুও ভালো। ভাইটির আমার এখনও ছেলেমানুষি যায়নি। হ্যাঁ ভালো কথা বিমল, তুমি ভালোবাস বলে বাগানের কলার কাঁদি আজ কাটিয়ে রেখেছি, পাকলে একদিন ভালো করে দেব এখন।
তার পরদিনই আমার নোটিশ অনুসারে স্কুলের কাজের শেষদিন। গিয়ে শুনলাম আমার জায়গায় নতুন লোক নেওয়া ঠিক হয়ে গিয়েছে। স্কুলে সকলের কাছে বিদায় নিয়ে চলে এলুম।
শুধু একবার শেষ দেখা করবার জন্যেই তার পরদিন পুকুরের ঘাটে ঠিক সময়ে গেলুম। তাঁর দেখা পেলে যে কী বলব তা ঠিক করে সেখানে যাইনি, সত্য কথা সব খুলে বলতে বোধ হয় পারতুম সেদিন—কিন্তু দেখা হল না! সব দিন তো দেখা হত না, প্রায়ই দু-তিন দিন অন্তর দেখা হত, আবার কিছুদিন ধরে হয়তো রোজই দেখা হত। সেদিন বিকালে গেলুম, তার পরদিন সকালেও গেলুম, কিন্তু দেখা পেলুম না।
সেদিন চলে আসবার সময় সেখানকার মাটি একটু কাগজে মুড়ে পকেটে নিলুম, যেখানে তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয় হবার দিন তিনি দাঁড়িয়েছিলেন।…
সেইদিনই বিকালে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে চিরদিনের মতো সে গ্রাম পরিত্যাগ করলুম।
মাঠের কোলে ছাতিম গাছের বনের মধ্যে কোথায় ঘুঘু ডাকছিল।–
সেসব আজ পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর আগেকার কথা।
তারপর জীবনে কত ঘটনা ঘটে গেল। ভগবানের কী অসীম করুণার দানই আমাদের এই জীবনটুকু! উপভোগ করে দেখলুম, এ কী মধু! কত নতুন দেশ, নতুন মুখ, কত জ্যোৎস্না-রাত্রি, নতুন নব-ঝোপের নতুন ফুল, কত সুঁইফুলের মতো শুভ্র নির্মল হৃদয়, কান্নাজড়ানো কত সে মধুর স্মৃতি!…
কাকার কাছে মোরাদাবাদে কাচের কারখানায় গেলুম। বছরখানেক পরে তারা আমায় পাঠিয়ে দিলে জার্মানিতে কাচের কাজ শিখতে। তারপর কোলেয়োঁ গেলুম, কাটা বেলোয়ারি কাচের কারখানার কাজ শেখবার জন্যে। কোলেয়োঁ অনেক দিন রইলুম। সেখানে থাকতে একজন আমেরিকান যুবকের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হল, তিনি ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট। শিকাগো ইটার-ওশ্যন কাগজের তিনি ফ্রান্স দেশস্থ সংবাদদাতা। কোলোয়ে সবসময়না-থাকলেও তিনি প্রায়ই ওখানে আসতেন। তাঁরই পরামর্শে তাঁর সঙ্গে আমেরিকায় গেলুম। তাঁর সাহায্যে দু-তিনটে বড়ো বড়ো কাচের কারখানার কাজ দেখবার সুযোগ পেলাম…পিটসবার্গে কর্নেগীর ওখানে প্রায় ছ-মাস রইলুম, নতুন ধরনের ব্লাস্টফার্নেসের কাজ ভালো করে বোঝবার জন্য।…মিডল ওয়েস্টের একটা কাচের কারখানায় প্রভাত দে কী বসু বলে একজন বাঙালি যুবকের সঙ্গে দেখা হল, তাঁরও বাড়ি চব্বিশ পরগনা জেলায়। সে ভদ্রলোক নিঃসম্বলে জাপান থেকে আমেরিকায় গিয়ে মহা হাবুডুবু খাচ্ছিলেন, তাঁরই মুখে শুনলুম, সেয়াটল-এ একটা নতুন কাচের কারখানা খোলা হচ্ছে। আমি জাপান দিয়ে আসব স্থির করেছিলুম, কাজেই আসবার সময় সেয়াটল গেলুম। তারপর জাপান ঘুরে দেশে এলুম।…মা ইতিমধ্যে মারা গিয়েছিলেন। ভাইদুটিকে নিয়ে গেলুম মোরাদাবাদে। বেশিদিন ওখানে থাকতে হল না। বম্বেতে বিয়ে করেছি, আমার শ্বশুর এখানে ডাক্তারি করতেন। সেই থেকে বম্বে অঞ্চলেরই অধিবাসী হয়ে পড়েছি।
বহুদিন বাংলা দেশে যাইনি, প্রায় ষোলো-সতেরো বছর হল। বাংলা দেশের জলমাটি গাছপালার জন্যে মনটা তৃষিত আছে। তাই আজ সন্ধ্যার সময় সমুদ্রের ধারে বসে আমার সবুজ শাড়ি-পরা বাংলা মায়ের কথাই ভাবছিলুম।…রাজাবাই টাওয়ারের মাথার ওপর এখনও একটু একটু রোদ আছে। বন্দরের নীল জলে মেসাজেরি মারিতিমদের একখানা জাহাজ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে, এ-খানা এখুনি ছেড়ে যাবে। বাঁ-ধারে খুব দূরে এলিফ্যান্টার নীল সীমারেখা। ভাবতে ভাবতে প্রথম যৌবনের একটা বিস্মৃতপ্রায় ঝাপসা ছবি বড়ো স্পষ্ট হয়ে মনে এল। পঁচিশ বছর পূর্বের এমনি এক সন্ধ্যায় দূর বাংলা দেশের এক নিভৃত পল্লিগ্রামের জীর্ণ শানবাঁধানো পুকুরের ঘাট বেয়ে উঠেছে আর্দ্রবসনা তরুণী এক পল্লিবধূ!…মাটির পথের বুকে বুকে লক্ষ্মীর চরণচিহ্নের মতো তার জলসিক্ত পা দু খানির রেখা আঁকা…আঁধার সন্ধ্যায় তার পথের ধারের বেণুকুঞ্জে লক্ষ্মীপেঁচা ডাকছে। তার স্নেহভরা পবিত্র বুকখানি বাইরের জগৎ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত অনিশ্চয়তায় ভরা। আম-কাঁটালের বনের মাথার ওপরকার নীলাকাশে দু-একটা নক্ষত্র উঠে সরলা স্নেহ-দুর্বলা বধূটির ওপর সস্নেহ কৃপাদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তারপর এক শান্ত আঙিনায় তুলসী মঞ্চমূলে স্নেহাস্পদের মঙ্গলপ্রার্থিনী সে কোন প্রণাম-নিরতা মাতৃমূর্তি, করুণামাখা অশ্রু ছল ছল।…
ওগো লক্ষ্মী, ওগো স্নেহময়ী পল্লিবধু, তুমি আজও কী আছ? এই সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর পরে আজও তুমি কি সেই পুকুরের ভাঙা ঘাটে সেইরকম জল আনতে যাও? আজ সে কতকালের কথা হল, তারপর জীবনে আবার কত কী দেখলুম, আবার কত কী পেলুম… আজ কতদিন পরে আবার তোমার কথা মনে পড়ল…তোমায় আবার দেখতে বড়ো ইচ্ছে করছে দিদিমণি, তুমি আজও কি আছে? মনে আসছে, অনেক দূরের যেন কোন খড়ের ঘর…মিটমিটে মাটির প্রদীপের আলো…মৌন সন্ধ্যা…নীরব ব্যথার অশ্রু…শান্ত সৌন্দর্য—স্নেহমাখা রাঙা শাড়ির আঁচল।…
আরব সমুদ্রের জলে এমন করুণ সূর্যাস্ত কখনো হয়নি!

কনে দেখা - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়


কনে দেখা
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়


সকালবেলা বৈঠকখানার গাছপালার হাটে ঘুরছিলাম।
গত মাসে হাটে কতকগুলি গোলাপের কলম কিনেছিলাম, তার মধ্যে বেশিরভাগ পোকা লেগে নষ্ট হয়ে গেছে। নার্সারির লোক আমার জানাশুননা, তাদের বললাম,-কীরকম কলম দিয়েছিলে হে! সে যে টবে বসাতে দেরি সইল না! তা ছাড়া আবদুল কাদের বলে বিক্রি করলে, এখন সবাই বলছে আবদুল কাদের নয় ও, অত্যন্ত মামুলি জাতের টি রোজ। ব্যাপার কী তোমাদের?
নার্সারির পুরোনো লোকটাই আজ আছে। সেদিন এ ছিল না, তাই ঠকেছিলাম। এই লোকটা খুব অপ্রতিভ হল। বললে—বাবু, এই হয়েছে কী জানেন? বাগানের মালিকেরা আজকাল আছেন কলকাতায়। আমি একা সব দিক দেখতে পারিনে, ঠিকে উড়ে মালী নিয়ে হয়েছে কাজ। তাদের বিশ্বাস করলে চলে না, আবার না করলেও চলে না। আমি তো সবদিন হাট সামলাতে পারিনে বাবু, ওদেরই ধরে পাঠাতে হয়। আমি বুনেছিলাম টি রোজ তিনডজন, আমি তো তার কাছ থেকে টি রোজেরই দাম নেব? এখানে এসে যদি আবদুল কাদের বলে বিক্রি করে তো তারই লাভ। বাড়তি পয়সা আমার নয়, তার। বুঝলেন না বাবু?
বাজার খুব জেঁকেছে। বর্ষার নওয়ালির মুখ, নানাধরনের গাছের আমদানি হয়েচে। বড়ো বড়ো বিলিতি দোপাটি, মতিয়া, বেল, অতসীলতা, রাস্তার ধারের সারিতে নানাধরনের পাম, ছোটো ছোটো পাম থেকে ফ্যান পাম ও বড়ো টবে ভালো এরিকা পামও আছে। সূর্যমুখীর যদিও এ সময় নয়, কিন্তু সূর্যমুখী এসেছে অনেক। তা ছাড়া কলকাতার রাস্তায় অনভিজ্ঞ লোকদের কাছে অর্কিড বলে যা বিক্রি হয়, সেই নারকেলের ছোবড়া ও তার-বাঁধা ফার্ন ও রঙিন আগাছা যথেষ্ট বিক্রি হচ্ছে। লোকের ভিড়ও বেশ।
হঠাৎ দেখি আমার অনেকদিন আগেকার পুরোনো রুমমেট হিমাংশু। ৭/৩নং কানাই সরকারের লেনে মেসে তার সঙ্গে অনেক দিন একঘরে কাটিয়েছি। সে আজ সাত-আট বছর আগেকার কথা—তারপর সে কলকাতা ছেড়ে চলে যায়। আর তার কোনো খবর রাখিনি আজকাল।
—এই যে হিমাংশু? চিনতে পারো?
হিমাংশু চমকে পেছন ফিরে চাইলে এবং কয়েক সেকেন্ড সবিস্ময়ে আমার দিকে চেয়ে থাকবার পরে সে আমার চিনলে। হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এল হাসিমুখে।
-আরে জগদীশবাবু যে! তারপর? ওঃ আপনার সঙ্গে একযুগ পরে ওঃ! তারপর আছেন কেমন বলুন!
আমি বললাম তোমার গাছপালার শখ দেখচি আছে হিমাংশু, সেই মনে আছে দুজনে কতদিন এখানে হাটে আসতাম?
হিমাংশু হেসে বললে—তা আর মনে নেই? সেই আপনি দার্জিলিংয়ের লিলি কিনলেন? আপনার তো খুব শখ ছিল লিলির। এখনও আছে? আসুন, আসুন, অন্য কোথাও গিয়ে একটু বসি। ও মেসটার কোনো খবর আর রাখেন নাকি? আচ্ছা সেই অনাদিবাবু কোথায় গেল খোঁজ রাখেন? আর সেই যে মেয়েটি স্টোভ জ্বালাতে গিয়ে গা-হাত পুড়িয়ে ফেললে, মনে আছে? তার বিয়ে হয়েছে?
দুজনে গিয়ে একটা চায়ের দোকানে বসলাম। এগল্প-ওগল্প—নানা পুরোনো দিনের কথা। তার কথাবার্তার ভাবে বুঝলাম সে কলকাতায় এসেছে অনেক দিন পরে।
জিজ্ঞেস করলাম—আজকাল কোথায় থাকো হিমাংশু?
সে বললে—বি. এন. আর.-এর একটি স্টেশনে বুকিং-ক্লার্ক ছিলাম। টাটানগরের ওদিকে, কিছুদিন থাকবার পর দেখলাম জায়গাটার মাটিতে ভারি চমৎকার ফুল জন্মায়, জমিও সস্তা। সেইখানেই এখন আছি—ফুলের বাগান করেচি—তুমি তো জানো বাগানের শখ আমার চিরকাল। কিছু চাষবাসের জমি নিয়েছি, তাতেই চলে যায়। কিন্তু সেসব কথা থাক—আজ এখন একটা গল্প করি শোনো। গল্পের মতো শোনাবে, কিন্তু আসলে সত্যি ঘটনা। আর আশ্চর্য এই, দশ বছর আগে যখন তোমাদের মেসে থাকতাম তখন এ গল্পের শুরু, এবং এর সমাপ্তি ঘটেছে গতকাল। আমি বললাম—ব্যাপার কী, তোমার কথা শুনে মনে হচ্চে নিশ্চয়ই প্রেমের কাহিনি জড়ানো আছে এর সঙ্গে। বলো বলো। সে বললে—না, সেসব নয়। অন্য এক ব্যাপার, কিন্তু আমার পক্ষে কোনো প্রণয়কাহিনির চেয়ে তা কম।
মধুর নয়। শোনো বলি। আচ্ছা তোমার মনে আছে—মেসে থাকতে আমি একটা এরিকা পাম কিনেছিলাম, আমাদের ঘরের সামনে টবে বসানো ছিল, মনে আছে? আচ্ছা তা হলে শোনো।
তারপর আধঘণ্টা বসে হিমাংশু তার গল্পটা বলে গেল। আমরা আরও দু-বার চা খেলাম, একবাক্স সিগারেট পোড়ালাম। বউবাজারের মোড়ে গির্জার ঘড়িটায় সাড়ে ন-টা যখন বাজল, তখন হিমাংশু গল্প শেষ করে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
তার গল্পটা আমি আমার নিজের কথায় বলব, কেননা হিমাংশু সম্বন্ধে কিছু জানা থাকা দরকার, গল্পটা ঠিক বুঝতে হলে, সেটা আমাকে গোড়াতেই বলে দিতে হবে।
হিমাংশু যখন আমার সঙ্গে থাকত, তখন তার চালচলন দেখলে মনে হবার কথা যে, সে বেশ অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। সে যে আহার-বিহারে বা বেশভূষায় খুব বেশি শৌখিন ছিল তা নয়, তার শখ ছিল নানা ধরনের এবং এই শখের পেছনে সে পয়সা ব্যয় করত নিতান্ত বেআন্দাজি।
তার প্রধান শখ ছিল গাছপালা ও ফুলের। আমার ফুলের শখটা হিমাংশুর কাছ থেকেই পাওয়া এ কথা বলতে আমার কোনো লজ্জা নেই। কারণ যত তুচ্ছ, যত অকিঞ্চিৎকর জিনিসই হোক না-কেন, যেখানে সত্যি কোনো আগ্রহ বা ভালোবাসার সন্ধান পাওয়া যায়—তাকে শ্রদ্ধা না-করে পারা যায় না।
হিমাংশুর গাছপালার ওপর ভালোবাসা ছিল সত্যিকার জিনিস। সে ভালো খেত, ভালো কাপড়জামা কখনো দেখিনি তার গায়ে—কিন্তু ও ধরনের সুখস্বাচ্ছন্দ্য তার কাম্যও ছিল না। তার পয়সার সচ্ছলতা ছিল না কখনো, টুইশনি করে দিন চালাত, তাও আবার সবসময় জুটত না, তখন বন্ধুবান্ধবদের কাছে ধার করত। যখন ধারও মিলত না তখন দিনকতক চন্দননগরে এক মাসির বাড়ি গিয়ে মাসখানেক, মাস-দুই কাটিয়ে আসত। কিন্তু পয়সা হাতে-হলে কাপড়–জামা না কিনুক, খাওয়া-দাওয়ায় ব্যয় করুক-না-করুক, ভালো গাছপালা দেখলে কিনবেই।
মেসে আমাদের ঘরের সামনে ছোটো একটা অপরিসর বারান্দাতে সে তার গাছপালার টবগুলো রাখত। গোলাপের ওপর তার তত ঝোঁক ছিল না, সে ভালোবাসত নানাজাতীয় পাম—আর ভালোবাসত দেশি-বিদেশি লতা— উইস্টারিয়া, অতসী, মাধবীলতা, বোগেনভিলিয়া ইত্যাদি। কত পয়সাই যে এদের পিছনে খরচ করেছে!
সকালে উঠে ওর কাজই ছিল গাছের পাট করতে বসা। শুকনো ডালপালা ভেঙে দিচ্ছে, গাছ ঘেঁটে দিচ্ছে, এ-টবের মাটি ও-টবে ঢালচে। পুরোনো টব ফেলে দিয়ে নতুন টবে গাছ বসাচ্ছে, মাটি বদলাচ্ছে। আবার মাঝে মাঝে মাটির সঙ্গে নানারকমের সার মিশিয়ে পরীক্ষা করছে। এসব সম্বন্ধে ইংরেজি বাংলা নানা বই কিনত—একবার কী একটা উপায়ে ও একই লতায় নীলকলমি ও সাদাকলমি ফোটালে। ভায়োলেটের ছিট ছিট দেওয়া অতসী অনেক কষ্টে তৈরি করেছিল। বেগুনি রং-এর ক্রাইসেনথিমামের জন্যে অনেক পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয় করেছিল, সুবিধে হয়নি।
তা ছাড়া ও ধরনের মানুষ আমি খুব বেশি দেখিনি, যে একটা খেয়াল বা শখের পেছনে সমস্ত মনপ্রাণ ঢেলে দিতে পারে। মানুষের মনের শক্তির সে একটা বড়ো পরিচয়। হিমাংশু বলত—সেদিন একটা পাড়াগাঁয়ে একজনদের বাড়ি গিয়েছি, বুঝলেন?…তাদের গোলার কাছে তিন বছরের পুরোনো নারকেল গাছ হয়ে আছে। সে যে কী সুন্দর দেখাচ্চে! একটা প্রকাণ্ড তাজা, সতেজ, সবুজ পাম! সমুদ্রের ধারে নাকি নারকেলের বন আছে—পাম-এর সৌন্দর্য দেখতে হলে সেখানে যেতে হয়।
হিমাংশু প্রায়ই পাম আর অর্কিড দেখতে শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে যেত। আর এসে তাদের উচ্ছ্বসিত বর্ণনা করত।
একবার সে একটা এরিকা পাম কিনে আনলে। খুব ছোটো নয়, মাঝারিগগাছের মাটির টবে বসানো—কিন্তু এমন সুন্দর, এমন সতেজ গাছ বাজারে সাধারণত দেখা যায় না। সে সন্ধান করে করে দমদমায় কোনো বাগানের মালিকে ঘুষ দিয়ে সেখান থেকে কেনে। কলকাতার মেসের বারান্দায় গাছ বাঁচিয়ে রাখা যে কত শক্ত কাজ, যাঁদের অভিজ্ঞতা আছে তাঁরা সহজেই বুঝতে পারবেন। গোবি মরুভূমিতে গাছ বাঁচিয়ে রাখা এর চেয়ে সহজ। একবার সে আর আমি দিন-কুড়ি-বাইশের জন্যে কলকাতায় বাইরে যাই; চাকরকে আগাম পয়সা পর্যন্ত হিমাংশু দিয়ে গেল গাছে জল দেবার জন্যে, ফিরে এসে দেখা গেল ছ-সাতটা ফ্যান পাম শুকিয়ে পাখা হয়ে গেছে।
সকালে-বিকালে হিমাংশু বালতি বালতি জল টানত একতলা থেকে তেতলায়
টবে দেবার জন্যে। গাছ বাড়ছে না কেন এর কারণ অনুসন্ধান করতে তার উদবেগের অন্ত ছিল না। অন্যসব গাছের চেয়ে কিন্তু ওই এরিকা পাম গাছটার ওপর তার মায়া ছিল বেশি, তার খাতা ছিল—তাতে লেখা থাকত কোন কোন মাসে কত তারিখে গাছটা নতুন ডাল ছাড়লে। গাছটাও হয়ে পড়ল প্রকাণ্ড, মাটির টব বদলে তাকে পিপে-কাটা কাঠের টবে বসাতে হল। মেসের বারান্দা থেকে নামিয়ে একতলায় উঠোনে বসাতে হল। এসবে লাগল বছর পাঁচ-ছয়।
সেবার বাড়িওয়ালার সঙ্গে বনিবনাও না-হতে আমাদের মেস ভেঙে গেল।
দুজনে আর একত্র থাকবার সুবিধে হল না, আমি চলে গেলাম ভবানীপুর। হিমাংশু গিয়ে উঠল শ্যামবাজারে আর একটা মেসে। একদিন আমায় এসে বিমর্ষ মুখে বললে—কী করি জগদীশবাবু, ও মেসে আমার টবগুলো রাখবার জায়গা হচ্ছে না—অন্য অন্য টবের না-হয় কিনারা করতে পারি, কিন্তু সেই এরিকা পামটা সেখানে রাখা একেবারে অসম্ভব। একটা পরামর্শ দিতে পারেন? অনেকগুলো মেস দেখলাম, অত বড়ো গাছ রাখবার সুবিধে কোথাও হয় না। আর টানাটানির খরচাও বড়ো বেশি।
আমি তাকে কোনো পরামর্শ দিতে পারিনি বা তারপর থেকে আমার সঙ্গে আজকার দিনটি ছাড়া আর কোনোদিন দেখাও হয়নি।
বাকিটা হিমাংশুর মুখে আজই শুনেছি।
কোনো উপায় না-দেখে হিমাংশু শেষে কোনো বন্ধুর পরামর্শে ধর্মতলার এক নীলামওয়ালার কাছে এরিকা পামের টবটা রেখে দেয়। রোজ একবার করে গিয়ে দেখে আসত, খদ্দের পাওয়া গেল কিনা। শুধু যে খদ্দেরের সন্ধানে যেত তা নয়, ওটা তার একটা ওজুহাত মাত্র—আসলে যেত গাছটা দেখতে।
হিমাংশু কিন্তু নিজের কাছে সেটা স্বীকার করতে চাইত না। দু-দিন পরে যা পরের হয়ে যাবে, তার জন্যে মায়া কীসের?
তবুও একদিন যখন গিয়ে দেখলে, গাছটার সে নধর, সতেজ-শ্ৰী যেন ম্লান হয়ে এসেছে, নীলামওয়ালারা গাছে জল দেয়নি, তেমন যত্ন করেনি—সে লজ্জিত মুখে দোকানের মালিক একজন ফিরিঙ্গি ছোকরাকে বললে—গাছটার তেমন তেজ নেই —এই গরমে জল না-পেলে, দেখতে ভালো না-দেখালে বিক্রি হবে কেন? জল কোথায় আছে, আমি নিজে না-হয়—কারণ দু-পয়সা আসে, আমারই তো আসবে–
তারপর থেকে যেন পয়সার জন্যেই করছে, এই অছিলায় রোজ বিকেলে নীলামওয়ালার দোকানে গিয়ে গাছে জল দিত। এক-একদিন দেখত দোকানের চাকরেরা আগে থেকেই জল দিয়েছে।
রোজ নীলামের ডাকের সময় সে সেখানে উপস্থিত থাকত। তার গাছটার দিকে কেউ চেয়েও দেখে না—লোকে চেয়ার, টেবিল, সোফা, আলমারি কিনচে, ভাঙা পুরোনো ক্লক ঘড়ি পর্যন্ত বিক্রি হয়ে গেল, কিন্তু গাছের শখ খুব বেশি লোকের নেই, গাছটা আর বিক্রি হয় না। একদিন নীলামওয়ালা বললে—বাবু, গাছটার তো সুবিধে হচ্ছে না, তুমি নিয়ে যাবে ফেরত?
কিন্তু ফেরত নিয়ে গিয়ে তার রাখবার জায়গা নেই, থাকলে এখানে সে বিক্রির জন্যে দিয়েই বা যাবে কেন? সে-সময় তার অত্যন্ত খারাপ যাচ্চে, চাকুরির চেষ্টায় আকাশ-পাতাল হাতড়ে কোথাও কিছু মিলছে না—নিজের থাকবার জায়গা নেই তো পিপে-কাটা কাঠের টবে বসানো অত বড়ো গাছ রাখে কোথায়?
মাসখানেক পরে হিমাংশুর অবস্থা এমন হল যে আর কলকাতায় থাকাই চলে। কলকাতার বাইরে যাবার আগে গাছটার একটা কিনারা হয়ে গেলেও মনে শান্তি পেত। কিন্তু আজও যা, কালও তাই—নীলামওয়ালাকে কমিশনের রেট আরও বাড়িয়ে দিতে হয়েছে গাছটা রাখবার জন্যে, নইলে সে দোকানে রাখতে চায় না। কিন্তু হিমাংশুর দুর্ভাবনা এই যে, ও কলকাতা ছেড়ে চলে গেলে গাছটার আর যত্ন হবে না, নীলামওয়ালার দায় পড়েছে, কোথাকার একটা এরিকা পামগাছ বাঁচল কী মোলো—অত তদারক করবার তার গরজ নেই।
কিন্তু শেষে বাধ্য হয়ে কলকাতা ছাড়তে হল হিমাংশুকে।
অনেকদিন পরে সে আবার এল কলকাতায়। নীলামওয়ালার দোকানে বিকেলে গেল গাছ দেখতে। গাছটা নেই, বিক্রি হয়ে গিয়েছে সাড়ে সাত টাকায়। কমিশন বাদ দিয়ে হিমাংশুর বিশেষ কিছু রইল না। কিন্তু টাকার জন্যে ওর তত দুঃখ নেই, এত দিন পরে সত্যি সত্যিই গাছটা পরের হয়ে গেল!
তার প্রবল আগ্রহ হল গাছটা সে দেখে আসে। নীলামওয়ালা সাহেব প্রথমে ঠিকানা দিতে রাজি নয়, নানা আপত্তি তুললে—বহু কষ্টে তাকে বুঝিয়ে ঠিকানা জোগাড় করলে। সার্কুলার রোডের এক সাহেবের বাড়িতে গাছটা বিক্রি হয়েছে, হিমাংশু পরদিন সকালে সেখানে গেল। সার্কুলার রোডের ধারেই বাড়ি, ছোটো গেটওয়ালা কম্পাউন্ড, উঠোনের একধারে একটা বাতাবি লেবুগাছ, গেটের কাছে একটা চারা পাকুড়গাছ। সাহেবের গাছপালার শখ আছে—পাম অনেকরকম রেখেছে, তার মধ্যে ওর পামটাই সকলের বড়ো। হিমাংশু বলে, সে হাজারটা পামের মধ্যে নিজেরটা চিনে নিতে পারে। কম্পাউন্ডে ঢুকবার দরকার হল না, রাস্তার ফুটপাত থেকেই বেশ দেখা যায়, বারান্দায় উঠবার পৈঠার ধারেই তার। পিপে-কাটা টবসুদ্ধ পামগাছটা বসানো রয়েছে। গাছের চেহারা ভালো—তবে তার কাছে থাকবার সময় আরও বেশি সতেজ, সবুজ ছিল।
হিমাংশুর মনে পড়ল এই গাছটার কবে কোন ডাল গজালো—তার খাতায় নোট করা থাকত। ও বলতে পারে প্রত্যেকটি ডালের জন্মকাহিনি—একদিন তাই ওর মনে ভারি কষ্ট হল, সেদিন দেখলে সাহেবের মালি নীচের দিকের ডালগুলো সব কেটে দিয়েছে। মালিকে ডাকিয়ে বললে—ডালগুলো ওরকম কেটেচ কেন? মালিটা ভালো মানুষ। বললে—আমি কাটিনি বাবু, সাহেব বলে দিল নীচের ডাল না-কাটলে ওপরের কচি ডাল জোর পাবে না। বললে, টবের গাছ না-হলে ও ডালগুলো আপনা থেকেই ঝরে পড়ে যেত।
হিমাংশু বললে—তোমার সাহেব কিছু জানে না। যা ঝরে যাবার তা তো গিয়েচে, অত বড়ো গুঁড়িটা বার হয়েছে তবে কী করে? আর ভেঙো না।
বছর তিন-চার কেটে গেল। হিমাংশু গাছের কথা ভুলেচে। সে গালুডি না ঘাটশিলার ওদিকে কোথাও জমি নিয়ে বসবাস করে ফেলেছে ইতিমধ্যে।
গাছপালার মধ্যে দিয়েই ভগবান তার উপজীবিকার উপায় করে দিলেন। এখানে হিমাংশু ফুলের চাষ আরম্ভ করে দিলে সুবর্ণরেখার তীরে। মাটির দেয়াল তুলে খড়ের বাংলো বাঁধলে। একদিকে দূরে অনুচ্চ পাহাড়, নিকটে দূরে শালবন, কাঁকর মাটির লাল রাস্তা, অপূর্ব সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত।
ফুলের চাষে সে উন্নতি করে ফেললে খুব শিগগির। ফুলের চেয়েও বেশি উন্নতি করেচে চিনা ঘাস ও ল্যাভেন্ডার ঘাসের চাষে। এই জীবনই তার চিরদিনের কাম্য ছিল, ওজায়গা ছেড়ে শহরে আসতে ইচ্ছেও হত না। বছর-দুই কাটল আরও, ইতিমধ্যেই সে বিবাহ করেছে, সস্ত্রীক ওখানেই থাকে।
আজ তিন দিন হল সে কলকাতায় এসেছে প্রায় পাঁচ-ছ-বছর পরে।
কাজকর্ম সেরে কেমন একটা ইচ্ছে হল, ভাবলে—দেখি তো সেই সাহেবের বাড়িতে আমার সেই গাছটা আছে কিনা?
বাড়িটা চিনে নিতে কষ্ট হল না কিন্তু অবাক হয়ে গেল—বাড়ির সে শ্ৰী আর নেই। বাড়িটাতে বোধ হয় মানুষ বাস করেনি বছর-দুই—কী তার বেশি। উঠোনে বন হয়ে গিয়েছে। পৈঠাগুলো ভাঙা, বাতাবি লেবুগাছে মাকড়সার জাল, বারান্দার রেলিংগুলো খসে পড়েছে। তার সেই এরিকা পামটা আছে, কিন্তু কী চেহারাই হয়েছে। আরও বড় হয়েছে বটে কিন্তু সে তেজ নেই, শ্রী নেই, নীচের ডালগুলো
শুকিয়ে পাখা হয়ে আছে, ধুলো আর মাকড়সার জালে ভরতি। যায় যায় অবস্থা। টবও বদলানো হয়নি আর।
হিমাংশু বললে—ভাই সত্যি সত্যি তোমায় বলচি, গাছটা যেন আমায় চিনতে পারলে। আমার মনে হল ও যেন বলচে আমায় এখান থেকে নিয়ে যাও, আমি তোমার কাছে গেলে হয়তো এখনও বাঁচব! ছেড়ে যেও না এবার। আমায় বাঁচাও।
রাত্রে হিমাংশুর ভালো ঘুম হল না। আবার সার্কুলার রোডে গেল, সন্ধান নিয়ে জানলে সাহেব মারা গিয়েছে। বুড়ি মেম আছে ইলিয়ট রোডে, পয়সার অভাবে বাড়ি সারাতে পারে না, তাই ভাড়াও হচ্ছে না। এই বাজারে ভাঙা বাড়ি কেনার খদ্দেরও নেই।
মেমকে টাকা দিয়ে গাছটা ও কিনে নিলে। এখন ও সার্কুলার রোডের বাড়িটাতেই আছে, কাল ও গালুডিতে ফিরে যাবে, গাছটাকে নিয়ে যাচ্চে সঙ্গে করে।
বিদায় নেবার সময় হিমাংশু বললে—বৈঠকখানা বাজারে এসেছিলাম কেন জানো? আমার সাধ হয়েচে ওর বিয়ে দেব। তাই একটা ছোটোখাটো, অল্প বয়সের, দেখতে ভালো পাম খুঁজছিলাম। হি-হি—পাগল নয় হে পাগল নয়, ভালোবাসার জিনিস হত তো বুঝতে।

মানবপুত্র- বিমল কর-


মানবপুত্র

শালবনীর মেলায় আবার দেখা।
ডাক শুনে মুখ ফেরাতেই কে যেন খপ করে হাত ধরে ফেলল কেষ্টর। কাবহিডের। মরা-জ্যোৎস্নায় সে-মুখের দিকে তাকিয়ে কেষ্ট অবাক। ঠিক ঠাওর হয় না। এ কে ?। কাঁচপােকার টিপ কপালে, চোখে কাজল, পরনে রঙিন শাড়ি। সাজনী নয় তাে ? সাজনার কথা মনে হতেই গায়ে-কাঁটা কেষ্ট দাঁড়িয়ে থাকে, চেষ্টা করে হাত ছাড়িয়ে। নেবার।
হাত ছাড়ে না টিপ-কপালী। কাজল-চোখ আরও ডাগর করে, কথার সুরে টান। দিয়ে বলে, “ভালছিস কি ? লারছিস ঠাওরাতে ? আমি রে, আমি—কিষ্টো, গঙ্গামণি।” নামের চেন্নায় নিমেষে মনে পড়ল গঙ্গামণিকে। কিন্তু ঠিক চেনা গেল না।
মেলার বাইরে এসে কাবইিডের আলাে-মােছা, কার্তিক-পূণিমার কুয়াশা-ভেজা। জ্যোৎস্নায় গঙ্গামণিকে নিষ্পলক নয়নে দেখতে থাকল কেষ্ট।
হঠাৎ বুঝি খেয়াল হল গঙ্গামণির, কেষ্ট তার সঙ্গে একটাও কথা বলেনি। খেয়াল হাতেই সােজাসুজি চোখ তুলে তাকাল গঙ্গামণি। বললে, রা কাড়ছিস না যে- ? চিনতে লারলি ?”
কেষ্ট তবু চুপ। একটু পরে বললে, “তুই হেথায় ক্যানে ?”
"বিটিছেলা আমি, জুয়া চালতে আসি নাই। মানসিক দিব যে, তাও লয়। পয়সা। কুথায় রে কিষ্টো, ফুটা-কড়িও সাথে নাই।” একটু থামে গঙ্গামণি। ঠাণ্ডা হাওয়ায়। কাপুনি লেগেছে। শাড়ির আঁচলটা আরও ঘন করে গায়ে-মাথায় জড়িয়ে নিয়ে বলে। “সাধ তাে কতাে লয় মনে, পুজাথানে আজ মানসিক দিয়ে পেরথনা করি রাত। পােয়ালে ভাতে-পাতে হয় ঠাকুর গাে, আর কিছু লয়।” গঙ্গামণি কথার শেষে হঠাৎ। থামল। দীর্ঘ করুণ একটা টান দিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। 
 কে তাকাল। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় গঙ্গামণির চোখের কাজল, কপালের টিপ বুঝি। ধুয়ে যাচ্ছে আস্তে-আস্তে। কৃশকরুণ কতকগুলাে রেখা কুঞ্চিত, শীর্ণ, অস্থিসর্বস্ব একটি। মুখকে ফুটিয়ে তুলছে—সেই আলােয়, সেই হাওয়ায়। | গঙ্গামণি গলার সুর আরও করুণ করে আবার বললে, “বুঝে দ্যাখ ক্যানে রে—চাপার ঠেঙে সাজ দিলাম, শাড়ি নিলাম হাতে-পায়ে ধরে।” গঙ্গামণি আঁচলে বাঁধা শালপাতার মােড়ক খুলে ধরল, “মাথা কুটে তার ঠেঙে পানও লিয়েছি দশ খিলি—দশ গণ্ডা পয়সা দিতে হবে কাল সুয্যি ওঠার মুখে-মুখেই,—কিন্তুক এক খিলি। পান লিলে না কোন হতভাগা। ” গঙ্গামণির সবঙ্গি থরথর করে কেঁপে উঠল ঠাণ্ডা হাওয়ায়, না উত্তেজনায়, কে জানে। কথাটাও ও শেষ করল ঠিক মিনমিনে সুরে নয়, বরং তিক্ত কর্কশভাবেই। 
শালপাতায় মােড়া পানের খিলির দিকে বােকার মতাে চেয়ে থাকল কেষ্ট। একেবারেই বােবা হয়ে।
অনেকক্ষণ পরে কেষ্ট জানতে চাইল, "থাকিস কুথায় আজকাল ?”।
“ভাগাড়ে।” তিক্ত সুরেই জবাব দিল গঙ্গামণি, “কপাল বটেক আমার, পাটরানীর কপাল রে কিষ্টো আজ হেথায় কাল হােথায়, কেউ দিলেক শুতে তাে ঢাকায় শুলাম, দিলে তাে নালায়। শেয়াল-কুকুরের পারা দিন কাটাই । গঙ্গামণি থামল। তিক্ত সুর ওর মুখকে আরও বিকৃত, বীভৎস করে তুলেছে।
কেঃ চুপ। মনে মনে তার অনেক কথাই জমছে আস্তে আস্তে। গঙ্গামণির চেনা। রূপটাও সেই সঙ্গে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে তার কাছে।
কেষ্টর শীত করছিল। পা পা করে সে মেলার দিকে আবার এগুতে লাগল। গঙ্গামণিও।
মেলার প্রায় কাছাকাছি এসে গঙ্গামণি প্রশ্ন করলে, "এদিক পানে যাস কুথায় ?”।
“ঠাণ্ডা লাগে বড়। উই যে কোণে চায়ের দোকান দিয়েছে শেতল—দ খুরি গরম। চা খেয়ে লি উর দোকানে। ”
“মন্দ লয়।” গঙ্গামণিও চা খাবার লােভে আনমনা হয়ে উঠল। বললে, “তুই। ক্যানে চায়ের দোকান দিলি না কিষ্টো। দু পয়সা তুর আসতাে।" সে কথার কোনাে জবাব দিল না কেষ্ট।
দোকানের বাইরে, একটু তফাতে চায়ের খুরিতে ঠোট ঠেকিয়ে গঙ্গামণির লােভ। বাড়লাে আরও। বললে, “বুঝলি নাকি রে, কিষ্টো—তুর ই চা-পানিতে পেটের
লনটা আগুন ধরাই দিলে।" একটু থেমে আবার, “বুঝ ক্যানে, চারবেলা পেটে। ভাত লাই। সে তুর কন সকালে দুটা ফুলারু খেলাম, সকবনেশে খিদায় পেট দুমড়ায়, তিতা আল কাটে মুখে।" কথার মাঝে থেমে গঙ্গামণি সটান হাত পাতলাে। কাকুতি। করে বললে, “দে না ক্যানে গুটেক পয়সা। মুড়ি-চিড়া কিনা খাই।” । 
কথা বলার মতাে কিছু খুঁজে পেল না কেষ্ট। পকেট থেকে একটা সিকি বের করে। গঙ্গামণির হাতে দিল। 
সিকি তাে নয়, যেন সাত রাজার ধন এক মানিক—খুরির গরম চা-টুকু এক চুমুকে নিঃশেষ করে গঙ্গামণি সিকিটা মুঠির মধ্যে জোরে চেপে ধরল। শীতের কাপুনির মধ্যেও বেশ একটু গরম পেয়েছে সে। চায়ে, না সিকিতে, কে জানে। 
মেলার এদিক-ওদিক তীক্ষ্ণ চোখে নজর করে গঙ্গামণি দ্রুতনিশ্বাসে বলে, “তু দাঁড়া। কিষ্টো হেথায় । হুই একটা ময়রার দোকান দেখি খুলা আছে। চট করে এলাম আমি । ”
প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না রেখেই গঙ্গামণি হাওয়ার বেগে ছুট দিল। চোখের পলকে অদৃশ্য।
সেদিকপানে তাকিয়ে গঙ্গামণিকে হঠাৎ চেন্না-দেওয়া জিনিসের মতােই চেনা গেল। স্পষ্ট, সহজভাবেই। কাবইিডের ফ্যাকাশে আলাে-ছড়ানাে এই মেলার ভিড়েই। মনে পড়ল কেষ্টর সেই পুরনাে গঙ্গামণিকে ; সেই চিল-চোখ, হাভাতে, হ্যাংলা, লােভী, দস্যি মেয়েটাকে। আর মনে পড়ল গত সনের কথাও। যে-সনে আকাল হল ; চাল গেল, চুলাে গেল গঙ্গামণিদের ; জাত গেল, ধর্ম গেল ; প্রাণও। জলের মতােই মনে পড়ছে সে-সমস্ত কথা।
চচুরিয়াতেই প্রথম দেখা, গঙ্গামণি আর কেষ্টর। তখন ওদিক পানে আকাল। লেগেছে। চালের আকাল। আকাল যদি চালের হয়, বাকি থাকে কি ? গােড়া। শুকোলাে তাে গাছের মরল, ফুল-পাতা মুড়ােল।
তেমনি। রাক্ষুসে একটা টান দিয়ে কেউ যেন ওদের পায়ের মাটি দিয়ে দিলে ।। ছুড়ে ফেলে দিলে মাথার চালা। দলে দলে গঙ্গামণিরা বেরিয়ে পড়ল গ্রাম ছেড়ে, ভিটেয়-ভিটেয় পিত্তবমির থুথু ছিটিয়ে। 
দেড়বিত্তের শহর চাঁচুরিয়া। সেই শহরই দেখতে দেখতে ভরে গেল হাভাতেদের। ভিড়। এ শহরেও তখন চাল বাড়ন্ত। ইট-টালির কারখানার স্টোর থেকে পিছল চড়া দরে চাল এনে আরও চড়া দরে বাজারে বিক্রি করছে মহাজনের তুটকো। দালালরা। রেল-রেশনের গুদাম থেকেও আসছে চোরা পথে ; সে চাল তাে চাল নয়, । যেন সাদা হাড়-বাঁধানাে পালিশ-দেওয়া খুরাে গুঁড়াে। 
জনমানুষের কমতি নেই চাঁচুরিয়ায়। যারা আছে, তাদেরই ভাতের পাতে টান ; তার ওপর এই নতুন উপসর্গ। ঘরের চৌকাঠে ওদের মাথা ঠুকতে দেখলেই গৃহস্থজন খেকিয়ে ওঠে, ওরে, ও হারামজাদার দল, বলি চাল কি এখানে আকাশ থেকে বৃষ্টি
প্রথম প্রথম ওরাও জবাব কাটতে। বলত, গায়ে শুনলাম, হেথা রাজায় গােলা বাঁধলেক ধানের। ঠাকুর গাে, দু মুঠা ভাতের লেগে এলাম হেথায়। ইটিশনের মালগুদামে কাঁড়ি কাঁড়ি চাল, কারখানার ফটক-ঘরে বস্তা বস্তা চাল—আপন চোখে। দেখলাম, ঠাকুর। হেথা 'আকাল হবেক ক্যানে কও ।।
ঠিক। চাঁচুরিয়াতে রাজায় গােলাই বেঁধেছে বটে। তবে সে গােলাতেই যা না, । হতভাগার দল। মরতে বাড়িতে, পথে-ঘাটে পেট চিতিয়ে পড়ে থাকিস কেন?
পড়েই থাকে ওরা। পথে, ঘাটে, পাথর-বাঁধানাে মালগুদামের রাস্তায়, সেশনের। ওভারব্রিজের তলায়। রােদুরে, ঝড়ে, বৃষ্টিতে, কলেরা-বসন্তর মধ্যেই।
দিন যায়। দু-দশ জন সরে পড়ে, রেলের চাকার তলায় গলা দেয় কজন, একদল যায় কলেরায়, একদল বসন্তে, না খেয়ে-খেয়ে ঘিয়ে-ভাজা কুকুরের মতাে কুৎসিত, নগ্ন ধড়টাকে রাস্তায় ফেলে রেখে কেউ কেউ আবার স্বর্গবাসী হয় ।
তবু যদি ওরা একসাথে সব কটা গিয়ে দামােদরের জলে ডুবে মরে, কি অন্যত্র চলে যায়, যেখানে ব্লাজায় ধানের গােলা বাঁধেনি। তা যাবে না।
এখানেই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে, হাড়গিলে রুগ্ন গরুর মতাে ধুকে ধুকে খাস টানবে, কথা বলবে, কাঁদবে। ঠিক মনে হবে, কাঁচা পথ দিয়ে বলদটানা গাড়ির চাকায় শব্দ উঠছেকাতরানাে, কশ, করুণ। ওরা কচ্ছপের মতাে মুখ লুকিয়েছে বুকের তলায়। গায়ে চামড়া-পােড়া গন্ধ। 
সারা শহরটা ওরা বিষিয়ে দিলে । আবর্জনায়, নােংরায়, মূলমূত্র আর প্রকাশ্য ব্যভিচারে। 
‘টাউন রেস্টুরেন্টের টেবিলে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে কেষ্ট সবই দেখতাে। আজ তিন বছর সে এখানে—এই চ'চুরিয়ায় চায়ের দেকানে কাজ করছে। মালিক বদল হল দোকানের, কলি ফিরল, সাইনবোের্ড উঠল মাথায়, টেবিল-চেয়ারও এলাে-কেই কিন্তু সেই কেষ্টই। তার আর কোথাও বদল নেই। সেই ময়লা নীল হাফপ্যান্ট আর আহাতা গেঞ্জি। এই চায়ের দােকানে আগে খদ্দের ছিল না, এখন খদ্দেরে ভিড় কত। সকাল থেকে চা দিয়ে দিয়ে, মামলেট ভেজে কেষ্টর হাতটাও অবশ হয়ে আসে আজকাল। নতুন একজন কারিগর এসেছে দোকানে। এতদিন একলাই ছিল কেষ্ট। এখন দু'জন। নতুন কারিগর চপ-কাটলেট ভাজে, মাংস রাধে, ডিমের ঝােল ।। 
 কোথায় ছিল এতদিন এইসব খদ্দেররা ? চপ কাটলেট আর ডিমের ঝােল যারা তারিয়ে তারিয়ে খায় সিগারেট ফোঁকে, চায়ের কাপে ঠোট ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে কথা বলে ? চোখের টোপ নিয়ে বসে আছে সর্বক্ষণ ? 
তাজব লাগে কেষ্টর । সতেরাে-আঠারাে বছর বয়সের ছেলে—চায়ের লিকার দেখে দেখে আর কাপ ধুয়ে ধুয়ে, যার মনটাই জলে-জলাে হয়ে থাকল, সেই কেষ্ট ভেবেই পায় না, চালের আকালে দেশটাই যখন জল-ভিক্ষু চাতক পাখির মতাে শূন্য। চোখে চেয়ে রয়েছে, তখন এই বাবুরা কেমন করে, কোথা থেকে আসে, চকমক করে, কাটলেট মুখে পুরে দিব্যি চিবােয়, মাংস খেয়ে হাড়গুলাে তুড়ে জুড়ে দেয় পথে। ঘূণি। বয়ে যায় হাভাতেদের সেই হাড় কুড়ােনাের পাল্লায়।
ভাবতে বসলে কেষ্টকে ‘সুসমাচার' খুলে বসতে হয়। মথি, যােহনের সুসমাচার আজও আছে কেষ্টর কাছে। আছে একটা ছেড়া-ফাটা বাইবেল। কাজের শেষে রাতে, দোকান বন্ধ হলে রেস্টুরেন্টেরই এক চিলতে পদা-ফেলে আড়াল-করা রান্নাঘর থেকে কেষ্ট তার বিছানাপাটি নামিয়ে নিয়ে বেঞ্চি জোড়া দিয়ে শুয়ে পড়ে। তখন কেরােসিনের কুপি। সেই কুপির আলােয় কেষ্ট ততন্ন করে খোঁজে মথি, লুক যােহনের সুসমাচারের কোথায় আছে এদের কথা। এরা—যারা চচুরিয়ায় এসেছে। ক্ষুধার তাড়নায়, আর ওরা—যারা ডিমের লালচে ঝোল চামচে ডুবিয়ে হুসংস করে থায়।
কুপির আলাে ধরে কেষ্ট যীশুর ছবিও দেখে। মিশনারি থেকে দিয়েছিল কবে, কোন্ যুগে, সেই ছেলেবেলায়—কেষ্ট যখন মিশনারির বাগানে ছিল, কাজ করত মালিদের সাথে। সে ছবি আজ কালিতে-ধুলােতে ময়লা, বিবর্ণ। কিন্তু তবু আছে—কেষ্টর কাছে, রেস্টুরেন্টের খুপরিতে দেওয়ালে আঠা দিয়ে আঁটা। 
মাথায় কাঁটার মুকুট, কপালে রিক্ত-বিন্দুকরুণ নেত্র, যীশু চেয়ে আছেন উপানে। খুপির শিস্ ওঠা লালচে আলােতে সে মুখ, সে চোখ, সে নগ্নগাত্র যীশু কেষ্টর কাছে আজকাল আরও রহস্যময় মনে হয়।
আঠারাে বছরের কেষ্ট-ভাল করে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যে অরফানেজে মানুষ মিশনারি কুঠিতে গতর দিয়েছে, রুটি খেয়েছে, লাল টালি ছাওয়া গীর্জয় অগানের সুরে সুরে প্লেয়ার করেছে ঠোঁট নেড়ে—সেই কেষ্টপদ দাস অবশেষে বুঝি একটা সান্ত্বনা খুজে পেল। ঊর্ধনেত্র যীশুর ছবির দিকে চেয়ে চেয়ে কেষ্ট যেন বুঝতে পারল, এ অন্যায়ের বিচার স্বর্গে।
আর এই যে তছনছ অবস্থা, কদর্য ভিড়, খেয়ােখেয়ি, ঘিনঘিনে নােংরামি, এ আর কিছু নয় অপতে-পাওয়া অবস্থা। বেলসেবুরের সাত অনুচরসাত শয়তান অট্টহাস্য হাসছে। তাদের দাপটে মেঘ হল না আকাশে, বৃষ্টি নেই, জল নেই। শয়তানদের নিশ্বাসে ধানের শীষ শুকিয়ে গেল, ফসল ফুরাল মাঠে-মাঠে। এমনই হবে না ? আকাশ থেকে আগুন আর গন্ধকের বৃষ্টি নেমে এসে প্লাবন বয়ে যাবে। নিশ্চিহ্ন হবে পাপ ; তবেই মনুষ্য-পুত্র আত্মপ্রকাশ করবেন। 
সেই আগুন আর গন্ধকের বৃষ্টিতেই না চাঁচুরিয়ার প্লাবন ডেকেছে। তীব্র জ্বলনে, কছু গন্ধে এর আকাশ-বাতাস ভরা। সাত শয়তানের ছিটিয়ে দেওয়া আবর্জনায় । মানুষের গায়ে নােংরা, মনে নােংরা ।
ঠিক এমন সময়ই গঙ্গামণির সঙ্গে দেখা। চাঁচুরিয়া যখন আর চাঁচুরিয়া নয় ; নরক। নরক। 
ভােলাবাবুদের গদিতে চায়ের অডার ছিল। বাবুদের চা খাইয়ে হাতের আঙুলে। এটো চায়ের কাপ আর কেটলি ঝুলিয়ে কেষ্ট বাজারের রাস্তা দিয়ে আসছে। এমন সময় চোখে পড়ল দৃশ্যটা। কালীময়রার দোকান থেকে তার কর্মচারী নিতাই এটোকাটার আর ছেড়-পাতার জঞ্জাল ফেলা টিনটা হাতে করে রাস্তায় নামতেই চারপাশ থেকে ভিখিরি ছেলে-ছােকরাগুলাে তাকে ঘিরে ধরল। রাস্তার ওপাশে। নর্মদা। ওপারে গিয়ে গালগুলাে ফেলে দেবে নিতাই। কিন্তু কার সাধ্য এক পা। এগােয়। ছিনে জোঁকের মতাে তাকে আটকে ধরেছে।
গালাগাল দিতে দিতে নিতাই দু-এক পা মাত্র এগিয়েছে, এমন সময় কে বুঝি। বেকায়দায় আটকাতে গিয়ে নিতাইয়ের পায়ে পা জড়িয়ে ফেলল। টাল সামলাতে গিয়ে নিতাইয়ের হাতের টিন ছিটকে পড়ল রাস্তায়, ঠিক মাঝ রাস্তাতেই। মারমুখাে
লতাহ ঘুরে দাড়াতেই ভিখিরির বাচ্চাগুলাে দু পা হটে এলাে। আবার এগুবে এগুবে করছে, এমন সময় কপা দুরেই মাল বােঝাই লরি। সরে গেল নিতাই, পথ। ছেড়ে পালাল ভিখিরির বাচ্চাগুলাে। রাস্তা ফাঁকা। উচ্ছিষ্ট ছিটোনাে, পাতা ছিটোনাে টিনটা পড়ে আছে মাঝ রাস্তাতেই। হঠাৎ কোন এক অদৃশ্য কোণ থেকে একটা চিল। ঝাপিয়ে পড়ল সেই উচ্ছিষ্ট ভতি টিনটার উপরেই। চেচিয়ে উঠল পথ চলতি লােকজন। মালগুদামের রাস্তা থেকে বেরিয়ে মােড় ঘুরে সবেমাত্র গিয়ার বদলেছিল। পরীটা। পুরােদমে ব্রেক কষলাে। চাকা ঘষড়ানাের তীক্ষ, কর্কশ, আওয়াজ উঠল, বুক কাঁপানাের আওয়াজ।
সবাই কিন্তু অবাক। উচ্ছিষ্ট-ভর্তি টিন সামনে ছড়ানোে ; যা পেয়েছে, সল্টে-সাল্টে অাঁচলে তুলে, হাতে পুরে চোখের নিমেষে লিকলিকে বেতের মতাে মেয়েটা উধাও ।। ঠিক যেন একটা ছিল চোখের পলকে ছোঁ মেরে আবার উড়ে গেল। আশপাশে কোথাও তার চিহ্ন নেই। 
কেষ্টর বুক ধক ধক করে উঠেছিল। সে কাঁপন থামল দোকানে ফিরে জল খেয়ে। পরের দিন আবার দেখা। ওভারব্রিজের তলায়, একাগাড়ির স্ট্যান্ডে। দেখার। সাথে সাথেই চিনতে পারল কেষ্ট। সেই কালাে ছিল। 
স্টেশন থেকে ফিরছে কেষ্ট টিকিট বাবুদের চা-টো খাইয়ে, খবরের কাগজ আর পাঁউরুটি-বিস্কুটের হাত-ঝােলানাে ঝুড়িটা নিয়ে। 
কেষ্টর হাতের ঝুড়ির দিকেই তাকাচ্ছিল মেয়েটা সােজাসুজি। রােজই হয়তাে তাকায়। কিন্তু আগে কোনদিন কেষ্ট এই সাধারণ ব্যাপারটা বিশেষভাবে লক্ষ করেনি। আজ করল। দাড়াল কেষ্ট। তাকাল একটু। তারপর কাছে ডাকল। কালাে চিল কাছে এল। একেবারে গায়ের কাছেই।
“তুর নাম কি ?" কেষ্ট প্রশ্ন করলে। 
“গঙ্গামণি। চটপট জবাব গঙ্গামণির। 
“নামটা তাে তেমন টগবগে লয়। এলি কোন্ গাঁ থেকে ?” 
“ধলগাঁ। নদী-পারে ছষ্টিপুর, তার পাশেই বটে'গ। ”
“বটেক, ধলগা ?” কেষ্ট এক মুহূর্তে নীরবে কি ভাবল যেন। 
গঙ্গামণিকে দেখল নজর করে। কালাে চিলকেই। কাঠি গা, তবু গড়নে, চোখে, চুলে ছিটেফোঁটা রূপ আছে।
“ধলগা চিনি। দু’কোশ তফাতে গাঁ আমার কাঁকুড়গাছি।" কেষ্ট আবার একটু থেমে প্রশ্ন করলে, “উদিক পানেও আকাল ?”
কুথায় লয় ?” গঙ্গামণি ধারালাে দৃষ্টিতে কেষ্টকে যেন ব্যঙ্গ করে বললে, “সগগ, মত্ত, পাতাল সরবত্রই। তুর গাঁ আমার গাঁ সতন্তর লয়, পিরথিবী ভরেই আকাল।” 
কেষ্ট চুপ। একটু সরে এদিক-ওদিক তাকিয়ে রেস্টুরেন্টের পাঁউরুটি-বিস্কুটের ঝুড়ি থেকে দুটো মিষ্টি বিস্কুট ফেলে দিয়ে বললে, “কাল তুই অমন করে গাড়ির সামনে কাপাই পড়লি যে-ভাগ্যি জোরে বেঁচে গেলি নয়ত কাটা যেতিস। তুর কি ভয় ডর নাই রে ?”
বিস্কুটে দীত বসিয়ে গঙ্গামণি ঠোঁট বেঁকালাে। জবাব দিলে, “কাটা পড়লে নিশ্চিন্ত হতুম গ। পেরান গেলে পেট থাকত লাই। পেটের জ্বালা সর্বনেশে জ্বালা ; কেউটে সাপের কামড়। সে এলনের কাছে মরণ ডরায়।” কথার শেষে গঙ্গামণি কুকুরের। মতাে অদ্ভুত এক শব্দ করে হাসল । 
গঙ্গামণির হাসি কেষ্টর মরমে এসে বিধল। ঠাই পেল বরাবরের জন্যই। অন্তরঙ্গ হল এই পরিচয় দিনে দিনে। 
কেষ্টর তরফে বলার কথা সামান্য। কেষ্টপদ দাস অল্পবয়স থেকেই অনাথ। মিশনারীদের কাছে থেকেছে, খেয়েছে, পরেছে। তারপর হেথা-হেথা ঘুরে এখানে এলাে, চ'চুরিয়ায় তিন বছর আগে। সেই থেকে সে চায়ের দোকানে কাজ করে। ও কিন্তু কৃস্টান।
কেষ্টর সঙ্গে ভাব হওয়ার পর গঙ্গামণির কষ্ট একটু তবু খুচলাে। আগে নিত্য অনশন, এখন তবু টুকটাক জুটে যায় কেষ্টর কল্যাণে। রেস্টুরেন্টেরই আশপাশে চিল-চোখে সর্বক্ষণ সে টহল দিচ্ছে। ও এলাকাটা যেন ওর। সেখানে আর কাউকে হাত বাড়াতে দেখলেই চুলােচুলি শুরু করে। এদিকে মালিক আর কারিগরের চোখ বাঁচিয়ে কেষ্ট গঙ্গামণির আঁচলে এটা-ওটা ফেলে দেয়। ফাঁক পেলেই এই দয়া-দাক্ষিণ্য। | রােজকার ব্যবস্থাটা কিন্তু ছিল রাত্রেই, মালিক যখন চলে যায়, কারিগর বিদেয় নেয়, তখন। গলির পথ দিয়ে গঙ্গামণি রেস্টুরেন্টের পেছন দরজায় হাজির। “কি-ই-ষ্টো, উ কিষ্টো। আস্তে আস্তে নীচু গলায় ডাক দেয় গঙ্গামণি।
কেষ্ট মুখে কোনাে শব্দ করে না। নীরবে রেস্টুরেন্টের পড়তি বা বাড়তি মালের খানিকটা জালির ফুটো দিয়ে গঙ্গামণির ভাঙা টিনের থালায় ঢেলে দেয়। . খুশি গলায় গঙ্গামণি বলে, “তুর মতাে মনুয্যি নাই রে ই জগতে।
ক'দিনেই গঙ্গামশির লােভ আরও বেড়ে ওঠে, “উ কিষ্টো, গুটেক মাস দে-না।
কাল তাে শুধুই কাদা পারা টোনাে'ঝােল দিলি । ভাত লাই একটুকুনও।” 
নিজের ভাত থেকেই কেষ্ট খানিকটা ভাত দিয়ে দেয়। না বললেও সে যে দেয়।
, তা নয়। তবে রােজ হয়ে ওঠে না। মালিক মাপ করে চাল দিয়ে দেয় কেষ্টকে হপ্তাভােরের। আগেভাগে ফুরােলে কিনে খাও।।
আশ্চর্য মেয়ে এই গঙ্গামণি। কেষ্ট দেখত আর ভাবত। আর ওর লােভ, পেটের। জ্বালা—তা এতাে উগ্র, তীব্র যার বুঝি তুলনা নেই। লােভের আভায় গঙ্গামণির চোখ। দগদগে ঘায়ের মতাে জ্বলত ।। . গঙ্গামণিকে দেখে কেষ্টর মাঝে মাঝে মনে হত, মেয়েটা যেন গন্ধকেরই ঝড়। কটু। তীব্র, বিষাক্ত। 
তবু গঙ্গামণিকে কেষ্ট ভালবাসত। কেন যে, কে জানে ? প্রতিবেশী গ্রামের মেয়ে বলে কি? না, আরও কিছু ? 
এ রকম ভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন। বাধ সাধল গঙ্গামণি নিজেই। তার নিত্য। নতুন ফন্দি-ফিকির করে রেস্টুরেন্টের দরজা ঘেঁষে এসে দাঁড়ানাে, আর প্রত্যহ এটা-ওটা চাওয়া সমস্ত ব্যাপারটাকেই ফাঁসিয়ে দিলে মালিকের কাছে। কারিগর ব্যাটা। সন্দেহ করতে শুরু করেছিল আগে থেকেই, ইতর রসিকতাও করত কেষ্টার সঙ্গে তা। নিয়ে। শেষাবধি মালিককে চুগলি। হাতে নাতে বামাল ধরা পড়েনি কেষ্ট এই যা। রক্ষে। শাসানি, ধমকানি খেয়ে কেষ্ট হাত টান করলে। 
গঙ্গামণির জিবে তার জন্মে গেছে ততদিনে। সে ছটফটিয়ে ঘুরে মরতে লাগল। রেস্টুরেন্টের এপাশ ওপাশ।
এমন সময় হঠাৎ কদিন গঙ্গামণি উধাও। পাত্তা নেই তার। দিন চারেক পরে। ওভারব্রিজের তলাতেই দেখা।
“হঠাৎ করে গেলি কুথায় তুই ?” কেষ্ট প্রশ্ন করলে। গঙ্গামণির গায়ে একটা নতুন কোরা শাড়ি। মাথার চুলগুলাে তেল-চকচকে। “চাকরি নিলাম রে, কিষ্টো। বাবুর বাসায়।” খুশিতে গঙ্গামণি ঢলে পড়ছে। “কোন্ বাবু ?” “লাম-টাম জানি নাই। উ-ই যে বাবু, তুর দোকানে ঝুড়িঝুড়ি খাবার খেতে আসে রে। দুবলা গােছের, চোখে কাচ, সাদা পারা দেখতে । ” ।
রােগা, চশমাপরা, ফসা বাবুটি যে কে, কেষ্ট বুঝতে পারল না প্রথমে। পরে বুঝল। বাবু নতুন। একেবারেই নতুন এ শহরে। “বাবুর বাড়ি কুথায় ?” “হুই যে, রেলপারে, যেথায় সাঁকো আছে।” কেষ্ট মনে মনে জায়গাটা ভেবে নিলে। বাবুটিকেও ভাল করে মনে করল। তারপর বললে, “বাবুর বাসায় কোন্ কোন্ জন থাকে ?”
“কেউ লয়। ফাঁকা।” জবাব দিলে গঙ্গামণি, “আর ও জাতটাতও মানে না রে, কিষ্টো। আমার হাতের ছোঁয়া খায়। তিনদিন পেটপুরে ভাত খেলাম।” গঙ্গামণি এমন একটা মুখভঙ্গী করলে যেন ওর মুখে এখনাে সেই ভাতের গন্ধ।
কেষ্ট একটা বিড়ি ধরিয়ে গঙ্গামণিকে ভাল করে নজর করল আবার । গঙ্গামণির গা-গতরে একটু যেন ঢল নেমেছে আজকাল।
* দেখ, গঙ্গামণি । " কেষ্ট বললে ভেবে চিন্তে, “এই আকালে শহরে অনেক টকো লােক এলাে। অনেক ভদ্দরলােক বাবু। কিন্তু মানুষগুলােকে মনে লয় না। মন্দ ঠেকে। বরং ই তাের পথঘাটই ভাল ছিল রে।”
কেষ্টর কথায় গঙ্গামণি বাধা দিলে।
“আবকের কথা কাড়িস না, কিষ্টো। শাড়ি দিলেক, ভাত দিলেক, মানুষটা মন্দ হবে কিসের লেগে ? উ দেবতার বংশ।”
কেষ্ট চুপ করে গেল।
গঙ্গামশির সঙ্গে আর দেখা হল না। সপ্তাহ কাটল, মাস কাটল। সেই ফসা মতন। চশমা চোখে বাবুটিও আর আসে না। একদিন কেষ্ট গেল গঙ্গামণির খোঁজ নিতে। সাঁকোর কাছে বাড়ি আছে বটে, তবে সেখানে গঙ্গামণি নেই, সেই বাবুটিও না। কেষ্ট ফিরে এল। মনে পড়ছিল গঙ্গামণির কথা : শাড়ি দিলেক, ভাত দিলেক, মানুষ মন্দ হবে কিসের লেগে ? উ দেবতার বংশ।
সেই শেষ। কেষ্টর মনে গঙ্গামণির রং দিনে দিনে ফিকে হয়ে আসছিল। হঠাৎ আবার এই নতুন করে দেখা—শালবনীর মেলায়, কার্তিক পূর্ণিমার রাত্রে, কাবহিডের আলােয়। সেই গঙ্গামণি । হাত ধরতে কেষ্ট চমকে উঠল।
“পালালি কুথায়, তুই ? খুঁজে খুঁজে হেদায় গেলাম।” গঙ্গামণি আবার এসে কেষ্টর হাত ধরেছে।
পুরােনাে কথা ভাবতে ভাবতে কেষ্ট কখন যেন মেলা ছেড়ে ফাঁকায় ফাঁকায় ঘুরে মন্দিরের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। “খেলি তুই?”
“হাঁ। ফুরাইছিলাে সব। চারগণ্ডা পয়সাকী যে ছাতা-মাথা দিলেক রে কেষ্ট, গলাতেই সোঁদাই গেল। দে বিড়ি দে একটা। শীত করে বড়।"
শীত করছিল কেষ্টরও। গঙ্গামণিকে বিড়ি দিয়ে কেঃ আশপাশে একটু ঢাকা জায়গা
খুঁজে নিল।
পাশাপাশি বসল দুজনে, কেষ্ট আর গঙ্গামণি। মন্দিরের ভেতরে তখন পক্ষকাল চীদের কলার হিসেব-মত-থালা দেউটিকে ঘিরে শত শত মানসিক করা প্রদীপ জ্বলে হলে নিস্তেজ হয়ে আসছে।
দুজনেই চুপ করে বসে থাকল। কুয়াশা আরও ঘন হয়েছে, ফুটফুটে চাঁদের আলাে এবার যেন শীতের দাপটে সাদা কাপড় জড়ালাে গায়। দামােদরের চর থেকে ভিজে গন্ধ ভেসে আসছে। সোঁদা, বুনাে গন্ধ। গঙ্গামণির কাঁচপােকার টিপ খুলে পড়ে গেছে কোথায়। “হঠাৎ করে তুই শহর ছেড়ে গেলি কুথায় রে, গঙ্গামণি ?” কেষ্ট প্রশ্ন করলে। চট করে এবার আর জবাব দিতে পারল না গঙ্গামণি। মুখ বুজে বসে থাকল অনেকক্ষণ। পরে, কথার জবাব দিতে বসে ওর দু-চোখ জলভরা হয়ে উঠল। সমস্ত কথা খুলে বললে গঙ্গামণি কেষ্টর পাশে বসে। একে একে। সেই হারামজাদা শয়তন মিনস্টো ভুলিয়ে ভালিয়ে ভাতের লােভ দেখিয়ে তাকে শহর থেকে। সরিয়ে নিয়ে গেল। হেথায় হেথায় করে কাটাল কিছুদিন। তারপর একদিন পালিয়ে গেল। গঙ্গামণি একা। বিদেশ বিভুয়ে, গ্রামে গ্রামে পথ ঘাট মাঠ করে ও ঘুরে। বেড়াতে লাগল ভিক্ষে চেয়ে চেয়ে, ভাতের জন্য হাত পেতে পেতে। গাঁয়ে গাঁয়ে। ধানের গােলা আজও শূন্য, আজও আকাল মেটেনি। পেটের তাড়ায় ঘুরতে ঘুরতে। শেষ পর্যন্ত গঙ্গামণি এসে উঠল হাতামােড়ায়। সেইখানেই ছিল গঙ্গামণি আজ দুদু। মাস। চাঁপাদের কাছেই। ওদের কথায়, ওদের সাথেই এই মেলায় এল, শালবনীর। মেলায়। কথার শেষে গঙ্গামণি কেষ্টর হাত জড়িয়ে ধরে কাকুতিতে কেঁদে উঠল।
“আর লারি, কিষ্টো। ব্যাধি হল শরীলে, বল নাই। এ ফলন সামলাতে লারি।। তুই সাথে লিয়ে চল আমায়।”
হাত সরিয়ে দিলে না কেষ্ট গঙ্গামণির। কান পেতে শুনল সব কথা। প্রথম। আলাপের সেই হাসি মরমে গাঁথা ছিল, এবার গাঁথা হল এই অনুনয়। নিরুত্তরে কেষ্ট। শুধু তাকিয়ে থাকল মন্দিরের দিকে। শেষ রাতের দুধ-আলাে চুড়াে-ভাঙা, শ্যাওলামাখ্যা মন্দিরের গায়ে গা মিশিয়ে দিয়ে যেন নিঃসাড়ে সােহাগ জানাচ্ছে।
ভাের হল। সূর্য ওঠার মুখেই গঙ্গামণি চাঁপার শাড়ি, জামা চুপিসারে ফেলে রেখে। একায় এসে উঠল। পাশে কেষ্ট। গঙ্গামণির দিকে তাকাল কেষ্ট। ভােরের আলােয় 
গঙ্গামণি ছেড়া-ফাটা, চিট-নােঙরা শাড়িতে গা গতর ঢেকে এসেছে কায়ক্লেশে। শীতের হাওয়ায় কাঁপছে ঠকঠকিয়ে।
সেদিক পানে তাকিয়ে তাকিয়ে কেষ্ট প্রথমটায় কেমন যেন অবাক তারপর অপ্রত। একটা বেদনায় মন ভার হয়ে বসে থাকল।
কেষ্টর চোখে গঙ্গামণির লুকোনাে লজ্জাটা ধরা পড়ে গেছে। ছেড়া-ফাটা শাড়ির আঁটুনিতেও ঢাকা পড়েনি সে কলঙ্ক চিহ্নটা।
একা ততক্ষণে এগিয়ে চলছে পলাশবনীর পথ ধরে। লাল গুলাে উড়ে পথের পাশে পলাশ আকন্দের পাতায় রং ধরাচ্ছে ধূসর। শূন্য প্রান্তরে একটানা ঘন্টি বাজছে। ঘােড়ার গলায় বাঁধা ঘণ্টিগুলাের। সামনে পিছনে আরও কত একা, কত মেলা ফিরতি। মানুষজন।
একার ঝাঁকুনি খেতে খেতে সহসা কেষ্ট বুঝতে পারল সাজনীর সাজে সেজে এসেও গঙ্গামণি কাল রাত্তিরে পানের মােড়ক বাঁধা আঁচলের গিট খুলতে পারেনি কেন ।
আবার সেই চাঁচুরিয়ায় ফিরে এল গঙ্গামণি। এসে দেখে, অবস্থার হেরফের তেমন কিছু হয়নি। মরে, পালিয়ে বেঁচেবর্তে শেষ পর্যন্ত যারা টিকে গেছে তারা প্রায় সকলেই ঠাঁই নিয়েছে ওভারব্রিজের নিচে, একা স্ট্যান্ডের ছাউনির তলায়। ঘােড়ায়, কুকুরে, মানুষে মিলে-মিশে রাতটুকু নিশ্চিন্তে ওরা কাটিয়ে দেয়। ভােরের মুখ দেখার সাথে। সাথেই যে যার মতাে বেরিয়ে পড়ে পথে। গঙ্গামণিও এসে মাথা খুঁজলাে সেই ছাউনিতে। আসার পথেই কেষ্ট সাবধান করে দিয়েছে গঙ্গামণিকে। খবরদার, দিনের বেলায়।
রেস্টুরেন্টের আশেপাশে গঙ্গামণি যেন ঘুরঘুর না করে । রাত্রে সেই আগের মতােই। গুগলিপথ দিয়ে লুকিয়ে গিয়ে পিছন দরজায় এসে ডাক দিলেই হবে। সজাগ থাকবে। কেষ্ট।
এবার আর কেষ্টর কথা অমান্য করতে সাহস করল না গঙ্গামণি। সারা দিন পরে। সিকিপেটা, আধপেটা যাই হােক, যেমন হােক খাবারটা জোটে কেষ্টর কাছেই। তা কি। বন্ধ হতে দেওয়া যায় ? 
খুব সাবধান হয়েছে এবার গঙ্গামণি। যতক্ষণ দিনের আলাে আছে, বাজার-পথে। ওর ছায়া দেখবে না কেউ। সারা দিন লাইনধারে, স্টেশনে, প্যাসেঞ্জার গাড়ির কামরায়। কামরায় ভিক্ষে চেয়ে বেড়ায়। 
রাত হলে ওর পা আর বাধা মনতাে না। বাজারে ঢুকতিপথে অন্ধকার মতাে একটা। জায়গায় চুপ করে দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকত রেস্টুরেন্টের দিকে। কতক্ষণে ভিড়। কমে, মালিক চলে যায়, দোকানের দরজা বন্ধ করে দেয় কেষ্ট। অগ্রহায়ণের হিমে। গঙ্গামণির সঙ্গি কনকনিয়ে আসে—তবু পা নড়ে না, চোখ ফেরে না অন্যদিকে । রেস্টুরেন্টের বাতিটা নিভে যাবার অপেক্ষায় তার দু চোথ ঠায় জেগে থাকে।।
রেস্টুরেন্টের বাতি নিভে গেলে পা-পা করে গঙ্গামণি গলির পথ ধরে। ছাই, জঞ্জাল, ফণিমনসা ঢাকা এক মানুষ-গা অন্ধকার গলি। সেই গলি দিয়ে নিঃশব্দে পা। টিপে টিপে গঙ্গামণি রেস্টুরেন্টের পিছন দরজায় এসে থামে। জলের ফুকরি দিয়ে উকি মারে। আস্তে আস্তে ডাকে—“কিষ্টো, উ কিষ্টো।” 
কেষ্ট সজাগ। ডাক শুনে গঙ্গামণির জন্যে লুকিয়ে রাখা খাবার আছে অনেক ফুকরির কাছে এসে দাঁড়ায় । 
কালিঝুলি মাখা হালের ফুকরির গায়ে গঙ্গামণির জ্বলজ্বলে চোখ দুটো বেড়ালের। চোখের মতাে জ্বলতে থাকে। হাপর-টানার মতাে শব্দ ওঠে ওর নিশ্বাসের। আবছা । একটা ছায়া জালের ওপাশে মুখ ঘষে। 
লুকিয়ে রাখা পাত্রটা ঝটপট টেনে নেয় কেষ্ট। ফাঁক দিয়ে গঙ্গামণির থালায় উজাড়। করে ঢেলে দেয় সঞ্চিত খাদ্যবস্তুগুলাে। 
কথা বলার অবসর নেই গঙ্গামণির। অন্ধকারেই একটা হাত তার থালা থেকে মুখে। এসে উঠেছে।
চুপ—সব চুপ। দূরে কুকুর ডাকছে। কেরােসিনের লালচে আলােয় রেস্টুরেন্টের মধ্যে দাঁড়িয়ে কেষ্ট। বাইরে অন্ধকার । আবর্জনার গন্ধ ভাসছে। খেতে খেতে গঙ্গামণির গলা বন্ধ হয়ে আসে, বিষম লাগে। কাশির দমকে বুক ছিড়ে যাবার যােগাড়।
ধমক দেয় কেষ্ট। ধরা পড়ার ভয়ে ওর গা ছমছম করে। তাড়াতাড়ি জল দিয়ে বিদেয় করে দেয় গঙ্গামণিকে।
নিত্যই এই। কোনাে রকমফের নেই। রাত্রে নিদেনপক্ষে একটি দুটি কথা হয়। নয়তাে সব কিছুই চুপি চুপি ; নিঃসাড়ে । কথার পাট দিনের বেলায়। কাজের ফাঁকে কেষ্ট স্টেশনে এলে।
দেখতে দেখতে অগ্রহায়ণ শেষ হল। পৌষ এল শীতের প্রচণ্ড দাপট নিয়ে। সে পেীষও শেষ। মাঘ মাসে গঙ্গামণি একা স্ট্যান্ডের ছাউনির তলায় শীতের রােদুরে চুপচাপ বসে থাকে আর হাঁপায়। গায়ে বল পায় না। প্যাসেঞ্জার ট্রেন এলে কোনরকমে শরীরটাকে টেনে-টুনে প্লাটফর্ম পর্যন্ত নিয়ে যায়। তাও যেন পারে না। রােজ। মাথা ঘােরে চরকিপাকে, দম বন্ধ হয়ে আসে, হাপ ওঠে। চড়চড়িয়ে টান। পড়ে পেটে, পেট মােচড় দিয়ে ওঠে। গা গুলােয়, মাথা গুলােয়।।
শরীরটা যতই নিস্তেজ হয়ে আসে, ততই যেন গঙ্গামণির পেটের খিদে জিভ ঠেলে। বেরিয়ে আসে। কুকুরের মতাে পাত চেটে বেড়ায় ও একা স্ট্যান্ডের এখানে ওখানে ।।
এদিকে রেস্টুরেন্টে ফোর রেষারেষি বেধে গেছে কারিগর আর কেষ্টতে। ক্যাশ। থেকে টাকা চুরি করেছিল কারিগর। ধরা পড়ে দোষ চাপাল কেষ্টর ঘাড়ে। তা ছাড়া। বেশ খানিকটা হাত টান ছিল কারিগর ছােকরার। ধরা পড়লেই কেষ্টকে কোনঠাসা । করে দিত। বাবুকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলত, “হবে না কেন মালে কমতি ? সেই শালী। তাে আবার এসেছে—পিরীতের বােষ্টমী কেষ্টার। উর পাতেই তাে যায়।” 
গােলমেলে ব্যাপার দেখে কেষ্ট গঙ্গামণির আসা বন্ধ করে দিলে। বললে, “ঝামেলা। বাঁধাইছে রে, গঙ্গামণি। উ শালা লটবরের শয়তানি সব। তুই আর আমার ঠেছে। রেতে যাস নে। থাক হেথায়। লুকাই চুরাই দিব ক্যানে কিছু।” ।
সেই থেকে গঙ্গামণির দুকুল যেতে বসল। দুর্বল শরীর নিয়ে বসে থেকে পাত চাটলে পেট ভরে না ; কেষ্টর প্রত্যাশায় পথ চেয়ে চেয়ে হদ্দ হয়ে গেলেও তেমন কিছু জোটে না আজকাল। রােজ তাে নয়ই। বাধ্য হয়েই গঙ্গামণিকে এবার স্টেশন বাজার সর্বত্রই ককিয়ে, কেপে, হাতে-পায়ে ধরে পেটের জ্বালা মেটাবার চেষ্টায় বেরােতে হল। _ আরও কিছুদিন কাটল এইভাবেই। গঙ্গামণি আর পারে না। শরীরে কুলােয় না । একেই, তায় আবার যা জোটে এটোকটিা তাতে ওর অরুচি।।
কেষ্টর সঙ্গে পথে-ঘাটে দেখা হলেই গঙ্গামণি ওর পথ আটকে ধরে ।। “আর তােলারি রে, কিষ্টো। ভাল তুই ভাল। দয়ামায়া কুথায় গেল রে তুর ?  ই শরীলে আমার থাকল কি ক ?
কেঃ চুপটি করে সব শােনে। কথা বলার মতাে কিছু খুজে পায় না। কিই বা। আছে বলার !
আর একদিন দেখা। প্লেট-ঢাকা খাবার নিয়ে কেষ্ট যাচ্ছিল স্টেশনে, বুকিং। অফিসে।
“যাস কুথায় রে, কিষ্টো ?” গঙ্গামণি পথ আড়াল করে দাঁড়াল, “কি আছে রে উতে ?”
“চ”। ” জবাব দিলে কেষ্ট, টিকিটবাবুর চেনা-জানা লােক এল। অড়রি দিলেক। _ চপের প্লেটের দিকে লােভাতুর দৃষ্টিতে গঙ্গামণি তাকিয়ে থাকল, “মাসের চপ, না কি। রে ?” জিভে জল এসে পড়েছে ওর।
“হী ; মাসের । ” কে পা বাড়াল। “শুন, শুন কিষ্টো ;—টিকিটবাবুরা সবটাই কি খাবেক আর টুকটা ফেলাছড়া থাকলে দিস ক্যানে আমায়। আমি হেথায় আছি।” গঙ্গামণি চপের গন্ধ শুকতে। শুকতে যেন অবশ হয়ে এল। 
চলে গেল কেষ্ট চপের প্লেট হাতে নিয়ে। 
কিন্তু ছাড়া পেলে না। সেই থেকে গঙ্গামণুির সাথে দেখা হলেই ও নাছােড়বান্দা।
“উ কিষ্টো। খাওয়া ক্যানে একটা চপ রে? কতোই তাে হয় তুদের রােজ। বড় সাধ লাগে। ই জিবে আর সােয়াদ নাই রে। পায়ে পড়ি কিষ্টো তুর, একটা মাসের চপ খাওয়া আমায় । ” 
কেষ্ট কত বােঝায়। বলে, “বড় কড়াকড়ি রে, গঙ্গামণি। মালিক নিজের হাতে সব গুণে রাখে, হিসেব নেয়। চপ্ তােকে খাওয়াই কি করে ? একটু সবুর কর, ফাঁক পেলেই খাওয়াবাে।” 
গঙ্গামণির কপাল ভাল । অল্প কদিনের মধ্যেই হঠাৎ একটা সুযােগ জুটে গেল। মাঘের শেষ তখন। বাজারে আলুর আড়ৎ যার সেই নন্দীবাবুদের মেয়ের বিয়ে। দু হাতে পয়সা ঢেলে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে নন্দীবাবু। বােষ্টম লােক। বাড়িতে মাছ মাংস একেবারেই অচল। অথচ বরযাত্রীদের জন্যে খাবার ব্যবস্থাটা মাংসের পর্যায়ে না তুললেই নয়। মদনবাবুর রেস্টুরেন্টে ঢালাও অডার হল মাংস আর চপের।
মাঘের প্রচণ্ড শীত। বিয়ের লগ্ন মাঝ-রাতে। সেই দুরন্ত শীতে নিমন্ত্রিতদের পাতে গরম চপ আর মাংস তুলে দেওয়ার পাট চুকোতে-চুকোতে বিয়ের লগ্ন পেরিয়ে গেল । ক্লান্ত মদনবাবু বিদায় নিলে। চলে গেল কারিগর গামছার একটা মােটা রকমের পুঁটুলি বেঁধে। রেস্টুরেন্টের ধােয়ামােছা শেষ করে কেষ্ট উনুনটায় কয়লা ঢেলে দিলে। রাত তাে প্রায় শেষ হতে চলল। ভাের না হতেই গরম জল দরকার চায়ের। 
হাতমুখ ধুয়ে অল্প একটু বিশ্রাম নিল কেষ্ট। সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনীতে সমস্ত শরীরটা অবসন্ন হয়ে এসেছে। পর পর দুটো বিড়ি খেয়ে হাই তুলল। ঘুম পাচ্ছে ওর ; ভীষণ ঘুম। রাতের গােড়ায় জোর খিদে পেয়েছিল ; এখন আর দীতে কুটো কাটতেও ইচ্ছে করে না।
বেঞ্চি জোড়া দিয়ে কেষ্ট তার বিছানাটা বিছিয়ে নিল রেস্টুরেন্ট ঘরে। একটা কালাে ময়লা পদ লুলত রেস্টুরেন্টের রান্না ঘর আর এই চেয়ার টেবিল সাজানাে ঘরের মধ্যে। পদটিা গুটিয়ে দিলে কেষ্ট। উনুনে আঁচ উঠে গেছে। এই প্রচণ্ড শীতে ওই অচের তাপটা বেশ লাগে।
চায়ের জল-গরমের টিনটা উনুনে চাপিয়ে জল ভর্তি করে দিল। ফুটুক এখন। ঠিক এমন সময় জালের ফুকরি দিয়ে ডাক শােনা গেল, “কিষ্টো—উ কিষ্টো। ” এই ডাকেরই অপেক্ষা করছিল কেষ্ট। গঙ্গামণিকে আজ সে আসতে বলেছে। হৈ-হট্টগােলের মধ্যে না হলে আর সুযােগ জুটত না। কতদিন মেয়েটা একটা চপের জন্যে বায়না ধরেছে, মাথা খুঁড়ছে কেষ্টর পায় । আজকের এই রাশি রাশি খাবারের মধ্যে ও যদি দুটো খায় কেউ জানতে পারবে না, ধরতে পারবে না। বেচারী গঙ্গামণি। কতকাল পেট ভরে খায়নি, কতদিন ওর মুখে এটোকাটা আর নােঙরা ছাড়া কিছু ওঠেনি। কেষ্টর ভরসা করেই গঙ্গামণি এখানে এসেছিল এবার, এই চাঁচুরিয়ায়—কিন্তু কেষ্টও পারল না। পারল না গঙ্গামণিকে নিত্য একবেলা এক মুঠিও হাতে তুলে। দিতে।
জালের ফুকরির পাশে পিছন-দরজা। সেই দরজাটার থিল খুলে কেষ্ট ডাকল, “আয়—ভেতরে আয়।”
গঙ্গামণিকে দ্বিতীয়বার বলতে হল না। অন্ধকারের গুহা থেকে লােভাত একটা ভীরু পণ্ড যেন ঘরে এসে ঢুকল। শীতের দাপটে কাঁহে হি হি করে। 
কেরােসিনের খুপির আলােয় সেই ফোলা ফোলা বীভৎস মূর্তির দিকে তাকিয়ে কেষ্ট। আবার দরজার খিল এটে দিল।
“রাতটা শেষ করেই এলাম রে।” গঙ্গামণি এক কোণে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তীক্ষ চোখে নজর করছে।
“ভালােই করলি।" কেষ্ট কি যেন ভাবল একটু। তার নিজের পাত্রটা টেনে নিলে। দেওয়াল-তা থেকে। গঙ্গামণির জন্যে লুকিয়ে রেখেছিল দুটো চপ, কহতা মাংস।
খাবারের পাত্রটা এগিয়ে দেবার আগে কেষ্ট বললে, “শীতে তুই বড় কাপছিস। গঙ্গামণি, একটু আগুন পুইয়ে নে। না হলে খাবি কি, কেঁপেই মরবি।”
“আগ সেকে কাজ নাই। তু দেখ ক্যানে—আমি হদ হন করে খেয়ে লিব। সারা। রাত ঠায় চোখ ফাবড়ে বসে আছি তাে বসেই আছি। ই বাবা, এত কি যজ্ঞি রে কিষ্টো, মানুষগুলা খায় তাে রাত ভাের করেই খায় সব।” গঙ্গামণি অধৈর্য হয়ে আঁচল পাতল। “লিতে হবে না। বােস তুই, উখানেই বােস। বােসে বােসে খা।” কেষ্টর কথায় গঙ্গামণি বােধহয় একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল প্রথমটায়। কিন্তু। অতশত ভাববার সময় নেই তার। পেট থেকে জল টানছে জিবে। মাটিতে বসে পড়ল গঙ্গামণি।
হাতের পাত্রটা কেষ্ট এগিয়ে দিল। সেদিক পানে তাকিয়ে গঙ্গামশির চোখের পাতা। আর পড়তে চায় না। ঠোট দুটো ফাঁক হয়ে থাকে, হা হয়ে থাকে মুখ। জিভ দিয়ে। জল গড়িয়ে পড়ে ঘি-ভাতের ওপর। _ বিয়ে বাড়িতে পরিবেশন শেষ করে আসার পথে কারিগর নটবর ওদের ভাগ নিয়ে। এসেছিল-লুচি, মাছ, ঘিভাত কত কিছু। কেষ্টকেও দিয়ে গেছে খানিক খানিক। সবই ভােলা ছিল। কেষ্ট থালাটাই এগিয়ে দিয়েছে গঙ্গামণিকে। এর ওপর মাংস আর চল। | Wীবনে কোনােদিন এত খাবার দেখেনি গঙ্গামণি। জিতে স্বাদ জানে না অনেক। কিছুরই। কোটা কি, মিষ্টি না ঝাল, টক না মােনতা, কিছুই তার জানা নেই। কোন্টা আগে ছোবে, কি যে আগে খাবে গঙ্গামণি তা ভেবেই পায় না। চোখ দুটো তার থালার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকে।
কেষ্টর তাগিদে গঙ্গামণির বিমূঢ় 'ভাবটা কাটল। 
হাত বাড়াল গঙ্গামণি, "ভাতে মিষ্টি কেন রে কিষ্টো? লং ক্যানে ইয়াতে ? মাগাে মা, ঘিয়ে চপচপায় ! ক্যাওটের বিটি আমি, বাপের কালেও মাছের সােয়াদ জ্ঞান হল না ইর। পারা রে কিষ্টো। কী সুয়াদ—জিভে জড়ায় যায় গ।” 
বিড়ি ধরিয়ে কেষ্ট একদৃষ্টে তাকিয়েছিল গঙ্গামশির দিকে। গঙ্গামণিকেই সে দেখছে। দেখার মতই না দৃশ্যটা। পা ছড়িয়ে, মুখ থুবড়ে থালার ওপর লুটিয়ে পড়েছে গঙ্গামণি। হাতের আঙুলগুলাে তার পাগল হয়ে ছুটোছুটি করছে পাতের ওপর। বিরাম নেই এস আর গলাধঃকরণের। চোখ তুলে চায় না—সােজা করে না দেহটাকে। অদ্ভুত। অদ্ভুত দেখাচ্ছে গঙ্গামণিকে। দু-পাঁচ ক্রোশ ছুটে আসার পর ঘাড়-মুখ গুঁজে ঘােড়াগুলাে ঠিক এমনিভাবেই দানা খায় না।
দশ্যটাকে কে জানে কেন, কের ভালাে লাগছে না। এমন হবে জানলে গঙ্গামণিকে ঘরের মধ্যে ডেকে নিত না ; খাওয়াত না চোখের সামনে বসিয়ে । কি যে খেয়াল হয়েছিল কেষ্টর, ইচ্ছে জেগেছিল ভীষণ–গঙ্গামণিকে সামনে বসিয়ে ভালােমন্দ দিয়ে পেটপুরে খাওয়াবে। এই প্রচণ্ড শীতে ঘরের মধ্যে উনুনের আঁচের আরাম কি কম! সেই আরামে নিশ্চিন্তে বসে গঙ্গামণি ধীরে ধীরে খাক না কেন সব—যত তার পাতে আছে।খাওয়ার খুশিতে গঙ্গামণির মুখে আনন্দ উপচে উঠুক, ক্ষুধা-তৃপ্তির। সেই আরাম আর সুখ, যে আরাম, সুখ ও ভুলে গেছে অনেক কাল, অনেক শীত আগেই। অনেক সাধ ছিলাে কেষ্টর, প্রবল বাসনাই, গঙ্গামণির সেই খুশি, পরিতৃপ্ত, চিরতার্থ মুখখানি আজ ও দেখবে। আর সেই সঙ্গে একথাও বুঝুক গঙ্গামণি, কেষ্ট নিরুপায় ; নয়তাে গঙ্গামণিকে খাওয়াতে তার কি কিছু কম সাধ ? | কিন্তু কই খাওয়ানাের সেই সুখ পাচ্ছে না তাে কেষ্ট। গঙ্গামণির মুখ-ঘাড় গুঁজে বসা ওই দেহের কোথাও কি খাওয়ার আনন্দ আছে, কি সুখ?
আশ্চর্য! কেষ্ট অবাক মানছে মনে মনে। অপদেবতায় সূর্যের আলাে মুছে দেয়, গাছের সবুজ পাতা এক নিশ্বাসে ঝরিয়ে ফেলে, সমুদ্রের জল শুকিয়ে আগুনের ঝড় তােলে, যশ ঝড়; তেমনি কি–তেমনি কি, আকালের ঝড় মানুষের মুখ থেকে খাওয়ার খুশিও মুছে নিয়ে গেল। 
সেদিক পানে তাকিয়ে তাকিয়ে বেলসেবুবের সাত অনুচরসাত অপদেবতাকে কেষ্ট যেন হঠাৎ রেস্টুরেন্টের এই ঘরে অস্পষ্টভাবে দেখতে পেল। অনুভব করতে পারল তাদের বিষনিশ্বাস। সেই তীব্র কটু গন্ধকের হাওয়া দিয়েছে আবার। পুরনাে চাঁচুরিয়া আর গঙ্গামণি, গঙ্গামণির দল মনের নাগরদোলায় ওঠানামা করছে। 
কে ? কেষ্ট চমকে উঠল। পাত থেকে হাত গুটিয়ে গঙ্গামণিও তাকাল চোখ
রেস্টুরেন্টেরর বাইরের দরজায় ভীষণ জোরে ধাক্কা মারছে কে ? কান পেতে শব্দটা শুনতেই কেষ্টর মুখ শুকিয়ে এল। টিপ টিপ করে উঠল বুক।
বাইরের দরজায় ধাক্কা মারার শব্দটা থেমেছে। গঙ্গামণি তখনাে পাত আগলে বসে। মাংসটা তবু একটু খেয়েছে, কিন্তু বড় সাধের চপ দুটো তখনাে তার পাতে।। তারিয়ে তারিয়ে খাবে শেষ-পাতে, সেই ইচ্ছেতেই একপাশে সরিয়ে রেখেছিল।
ইঙ্গিতে কেষ্ট গঙ্গামণিকে উঠতে বললে চটপট। ফিসফিসিয়ে জানাল, পিছু-দরজা দিয়ে পালিয়ে যেতে। 
মাংস আর চপ ছেড়ে পালিয়ে যেতে মন চাইছিল না গঙ্গামণির। চুপি গলায় সে বললে, “ডরাস ক্যানে ? উ কিছু লয়। বাতাস হবে, কি কুকুর-টুকুর। 
দরজায় ধাক্কা মারছে না আর কেউ। শব্দ নেই কোথাও। কেষ্ট অপেক্ষা করলে। তবে ? ও কি বেলসেবুব ? কেষ্টর ভয় কমল না এতটুকুও। “কাজ কি ঝামেলায় ? তুই যা গঙ্গামণি ?”
প্রচণ্ড অনিচ্ছা, তবু গঙ্গামণিকে যেতে হবে। রাগ হল তার খুব। চপ দুটো চট করে তুলে নিল । একটা কামড় বসিয়ে গরগর করতে লাগল রাগে আর বিরক্তিতে। আস্তে আস্তে খিল খুলল কেষ্ট পিছন-দরজার। কপাটের একটু ফাঁক দিয়ে এক চিলতে অন্ধকার চোখে ঠেকেনি তখনাে, হঠাৎ কে যেন বাইরে থেকে দড়াম করে।
একলাথি মেরে কপাট দুটো হাট করে দিল।
কপালে ঠোকর লাগল কেষ্টর, জোর ঠোক্কর কপাটের। ঝিম ঝিম করে উঠল। মাথাটা। 
কপালে হাত বুলাতে বুলােতে কেষ্ট এক চোখে চাইল। সেই চাওয়াতেই তার। সবঙ্গি অসাড়, পাথর হয়ে যায়। স্বপ্ন নয়, নটবরও নয়, বাবু স্বয়ং-মদনবাবু। একেবারে দরজার ওপরেই।
মদনবাবু এক নজরে সব দেখে নিলেন। আগেও দেখেছেন জালের যুকরি দিয়ে ।। পিছন দরজার কপাটটা বন্ধ করে খিল তুলে দিলেন মদনবাবু। ঝাপিয়ে পড়ে গলা। টিপে ধরলেন কেষ্টর।
“নেমকহারাম, জোচ্চোর, সােয়াইন—আমার ব্যাগ কোথায় বল? তারপর দেখছি। সব” 
দম বন্ধ হয়ে আসার যােগাড় হয়েছিল কেষ্টর। মদনবাবুর হাত থেকে গলা ছাড়াবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল কেষ্ট। গলা দিয়ে দমবন্ধ হবার মতাে ঘড়ঘড় শব্দ। উঠল। গলা ছেড়ে দিলেন মদনবাবু। দম নিতে লাগল কেষ্ট। গলা তার শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। মুখ পাংশু। “কোথায় আমার ব্যাগ ?” মদনবাবু এক থাপ্পড় লাগালেন কেষ্টর গালে।। দু-পা হঠে আসতে হল কেষ্টকে। “জানি না বাবু।” “শালা, শুয়ার, ব্যাগ জানাে না তুমি ? জানাচ্ছি, দাঁড়াও ?”
কেষ্টর চুলের মুঠি নেড়ে আর এক থাপ্পড় কষালেন তার গালে। কেষ্ট দেওয়ালের। গা খেয়ে ছিটকে এল। _ এক লাফে মদনবাবু এগিয়ে গেলেন ক্যাশের দিকে। ক্যাশের চাবি খােলা! টানাটা। উঠোতেই ব্যাগটা হাতে ঠেকল। নিত্যদিন যেভাবে ব্যাগটা পড়ে থাকে, ঠিক। সেইভাবেই পড়ে আছে। যথেষ্ট ভারী। হ্যাঁ, নন্দীবাবুর টাকায় ভারী হয়েছিল বলেই।
এই শীতের শেষরাতে ব্যাগের কথা মনে পড়ল বিছানায় শুয়ে। আর যেই-না মনে। পড়া ছুটতে ছুটতে তিনি এলেন দোকানে। হাজার কাজে, ভিড়ে, বিয়ে বাড়ির খাবার। পাঠানাের তদারকে কখন যেন ভুলেই ব্যাগটা দোকানে রেখে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। মনে পড়তেই ছুটে এলেন। বাইরে থেকে দরজায় ধাক্কা দিলেন। কোনাে শব্দ নেই। এলেন পিছন-দরজায়। জালের ফুকরি দিয়ে তাকালেন অন্দরে। ঘুমন্ত কেষ্টকে ডাক। দেবেন বলেই। কিন্তু তাকিয়ে যে দৃশ্যটা চোখে পড়ল তাতে আপাদমস্তক গলে উঠল। মদনবাবুর। নটবরের কথাই তা হলে ঠিক। এমনিভাবে কে? রোজ তার দােকানের। খাবার চুরি করে ডিটাকে খাওয়ায়। টাকা-পয়সাও যে আজকাল ক্যাশ থেকে মাঝে। মাঝে চুরি যায়—সেটাও তাহলে কেষ্টর কীতি । বিশ্বাস কি ? আর ব্যাগ। ব্যাগটাও কি। তিনি সত্যি তুলে দোকানে ফেলে গেছেন না হাতিয়ে নিয়েছে কে৪। পলকে তার। বিচারবুদ্ধি লােপ পেল।
ব্যাগটা হাতে করেই মদনবাবু আবার কেষ্টর কাছে এসে দাঁড়ালেন। নােটগুলাে। বের করে গুলে নিচ্ছেন এমন সময় খুট করে শব্দ হল। গঙ্গামণি পিছন দরজার খিলখুলে ফেলেছে। পালাবার জন্যে পা বাড়িয়েছে সবে।
মদনবাবু ছুটে এসে গঙ্গামণির হাত ধরে ফেললেন।
“শার্থী, হারামজাদী, লুঠতে এসেছিস এখানে? তাের চোদ্দ ভাতারের জমিদারি এটা। রা—রাখ শীঘ্রি চ—নামিয়ে রাখু, ফেলে দে।”
হ্যাঁচকা টান দিলেন মদনবাবু। গঙ্গামণি সেই টানে ছিটকে কেষ্টর কাছে গিয়ে দেওয়ালে ধাক্কা খেলে। . ব্যাগটা মদনবাবু ততক্ষণে পকেটে পুরে ফেলেছেন।
গঙ্গামণিও ছাড়ার মেয়ে নয়। তার সেই বহুদিন আগেকার বেপরােয়া ভাবটা হঠাৎ যেন ভর করল তাকে। চপ্ সে রাখবে না। হাতের মুঠিটা আরও জোর করে গঙ্গামণি। চপ চেপে ধরল। যেন হাতের মুঠিতে আগলে রেখেছে তার জীবন।
“গাল দিয়াে নাই । থুবাে নাই চপ্‌।” গঙ্গামণি দরজার দিকে আবার এগিয়ে চলল।
মদনবাবু সাপ্টে ধরলেন গঙ্গামণিকে। চল্, তিনি কেড়ে নেবেনই। রােখ চেপে গেছে। ধস্তাধস্তিতে, কাড়াকাড়িতে গঙ্গামণির চ গুঁড়াে গুঁড়াে হয়ে মাটিতে ছড়িয়ে ছিটকে পড়ল। বাঁ হাতের চপটা তখনও বাঁচিয়ে রেখেছে ও। 
‘হেলানী মাগি, চপ্ তােকে রাখতেই হবে। খেতে দেবাে না। দেখি কেমন করে খাস তুই। ” মদনবাবু গঙ্গামণির বাঁ হাত চেপে ধরে মােচড় দিলেন।
“চামার”-কাতরে উঠে গঙ্গামণি মদনবাবুর বুকের পাশেই কামড়ে ধরল।
আর্তনাদ করে মদনবাবু হাত ছেড়ে দিলেন। গঙ্গামণি ছুটে পালাতে যাবে, আবার হাত বাড়ালেন মদনবাবু। শাড়ির ছেড়া আঁচলটা হাতে এল। টান দিতেই বাধা পেল গঙ্গামণি ; ছেড়া শাড়ি ছিড়ে গেল ; এক টুকরাে তাে কাপড়, গা খুলে কোমর খুলল।
সমস্ত জোর দিয়েই বুঝি একটা লাথি মেরেছিলেন পেটে মদনবাবু, গঙ্গামণি তীব্র আর্তনাদ করে ঘুরে পড়ল উনুনের ওপর। হুমড়ি খেয়েই পড়েছিল গঙ্গামণি।।
গরম-জল-ভরা টিনটা লাগল কোমরে—উল্টে পড়ল উনুনের পাশেই। উনুনে জল পড়ে ভ্যাপসা কটু গন্ধ ভেসে উঠল, বিশ্রী একটা শব্দ হল আগুনে জল পড়ার। বাকি জলটা গড়িয়ে পড়ল উনুন বয়ে মাটিতে। গঙ্গামণিও টলতে টলতে লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে, অসহ্য কাতরানিতে কঁকিয়ে কেঁদে উঠল । 
কেষ্ট পাথরের মত এক কোণে দাঁড়িয়ে। তার কোনাে সম্বিত নেই। কাঠের মত দাড়িয়ে সে শুধু দেখেই যাচ্ছে। কি ঘটছে তা অনুভব করার বােধটুকুও লুপ্ত তার ।। রণশেষে মদনবাবু বিজয়ীর মতাে দাঁড়িয়ে ক্লান্তশ্বাস ফেলতে ফেলতে গঙ্গামণিকে। দেখছেন। নিষ্ঠুর, কদর্য একটা হাসি তার মুখে। চোখ দুটো তখনাে হিংস্র, অপ্রকৃতিস্থ।
“চপ্ খাবে-- ? হারামজাদী মাগী ! খা চপ।” মদনবাবু কেষ্টর দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন।
“আর ব্যাটাচ্ছেলে, রাস্কেল, জোচ্চোর,—তুই! তাের বাপের দোকান এটা ? পিরীত করে রাস্তার ভুড়ি ধরে এনে চ কাটলেট খাওয়াবি ? শুয়ােরের বাচ্চা, এক আধ দিন নয়—বচ্ছর ধরে তুমি এই রকম চালাচ্ছ ?
মদনবাবু কেষ্টকে আরও কয়েক ঘা কাবার জন্যে এগিয়ে যাচ্ছিলেন হঠাৎ গঙ্গামণির মমাস্তিক একটা আর্তনাদ শুনে ঘুরে দাঁড়ালেন। কেমন যেন মনে হল! এক। পা সুকে তা চোখে নজর করলেন। কেরােসিনের খুপির লালচে আলােতেও রং। ভুল হয় না। রক্তই। কাপড়ে, উরুতে, মেঝেতে। ফিনকি দিয়ে ছুটছে। _ কী বীভৎস। মদনবাবুর সবঙ্গি শিরশিরিয়ে উঠল। অদ্ভুত একটা ভয় বুকের হাড়ে। হাড়ে জমাট বাধল, হৃৎপিণ্ডটা যেন নিজের কানের কাছেই উঠে এসেছে। পাংশু মুখে। মদনবাবু চোখ ফিরিয়ে নিলেন। কেষ্টকেই আবার তাঁর নজরে পড়ল। দু মুহূর্ত। আকাশ-পাতাল কি যেন ভাবলেন মদনবাবু কেষ্টর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। তারপর। হঠাৎ মানিব্যাগ থেকে কতকগুলাে নােট পকেটে পুরে ব্যাগটা তাগ করে ছুড়ে দিলেন। কেষ্টর বিছানার ওপর। অন্ধকারে, কথার ভাঁজে ব্যাগটা হারিয়ে গেল।
"ও! এই-" মদনবাবু কেষ্টর দিকে তাকিয়ে শাসানাের ভঙ্গিতেই কথাটা বলবার। চেষ্টা করলেন, কিন্তু গলার স্বরে জোর এল না, “এখানে এই সমস্ত হচ্ছে ? পেট। খসানাে। আচ্ছা দাঁড়াও, ব্যবস্থা করছি তােমার। যাচ্ছি থানায়। মানুষ মারার । চেষ্টা ! শয়তান
পরমুহূর্তেই মদনবাবু গঙ্গামণির দিকে এক পলক তাকিয়ে পিছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। গলির অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁডিয়ে তিনি যে দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিলেন কেষ্ট তা বুঝতে পারল। 
কেরােসিনের খুপির লালচে ম্লান আলােতে রেস্টুরেন্ট ঘরের দেওয়াল, বালতি, হাঁড়ি, কুঁড়ি যেন তালগােল পাকিয়ে হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে। উনুনের অচের আভা যেন আভা নয় একটা চিতাই হবে। তেমনি হিংস্রভাবে তাপ ছড়াচ্ছে ঘরের বাতাসে। কাটা ছাগলের মতাে লুটোপুটি খাচ্ছে গঙ্গামণি। কী করুণ, অসহনীয়, মমন্তিক তার। গােঙানি। রেস্টুরেন্ট ঘরের বদ্ধ বাতাসও সে কান্নায় ককিয়ে উঠেছে।
কেষ্ট পাথর। ভয়ঙ্কর এক জগতে নিঃসঙ্গ দাড়িয়ে সে। বেলসেলুবের সাত অনুচর-সাত অপদেবতায় ঘেরা এই শ্মশান থেকে পালিয়ে যাওয়ার মতাে পায়ে জোর নেই তার। ক্ষমতা নেই, এতটুকু। পথ হাঁটতে হাঁটতে কেঃ চলে এসেছে সেই মরুভূমিতে, যেখানে ঝড় উঠিয়ে, সাপ ছেড়ে, আগুন বৃষ্টি করে বেলসেতুব ভােজের উল্লাসে মত্ত। গন্ধকের সেই কটু বিষাক্ত হাওয়া ফুলে ফুলে ভূতের নাচ নাচছে। গঙ্গামণির পায়ের কাছে, পেটের কাছে, গায়ে, হাতে, মাথায়। গন্ধকের সেই গরম হাওয়া। ভােজের আগে খানিকটা মাংসই সেঁকে নিচ্ছে নাকি শয়তানরা? |
“কিষ্টো—কিষ্টো রে, আর লারি। উ মাগাে, দায়ে গতর কাটে কোন চামারে ? পেট কোমর কাটে ; বাঁচারে আমায় । বাঁচা। টুকুন জল দে।” 
জল ? কেষ্ট তবু খানিকটা সম্বিত ফিরে পেল এই জল চাওয়ায়। গেলাসে করে। জল এগিয়ে দিলে গঙ্গামণিকে। জল খাওয়ার চেষ্টা করলে গঙ্গামণি, পারলে না।। আবার লুটিয়ে পড়ল। বাঁ হাতের মুঠিতে তখনও তার আধখানা চত্।
গঙ্গামণির কটিতটের দিকে এতক্ষণে ভাল করে চাইল কেষ্ট। দ হাতের ব্যবধান থেকে। চেয়েই চোখ বন্ধ করলে। সবঙ্গি শিহরিত হবার অস্ফুট একটা শব্দ শােনা গেল তার জিবে আর ঠোটে। মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। পিছু হটে ধপ করে বসে পড়ল কেষ্ট দু হাতে মুখ ঢেকে।
হঠাৎ একটা ডাক ছাড়া, ডুকরে ওঠা কান্নার শব্দে চমকে উঠে কেষ্ট তাকাল গঙ্গামনির দিকে। আধুলি পিথুলি থেমে গেছে গঙ্গামণির। কাটা ছাগল যেমন শেষ ডাক দিয়ে থেমে যায়, তেমনি।
কেষ্টর সবঙ্গ অসাড় হয়ে গেল সেই মুহূর্তেই। বিশ্বরিত, নিপলক-নয়ন, বিমাট চিত্ত সে। পরমাশ্চর্য একটি জীবনকে সে দেখতে পেয়েছে। কেরােসিনের লালচে বিবর্ণ আলােয় অস্পষ্ট একটা মাংসপিণ্ডকে। কোন যাদুবলে হঠাৎ গঙ্গামণির জানুদেশে এসে ঠাঁই নিল এ প্রাণ, এই পিণ্ড ? বুকের ওপর দিয়ে যেন রেল গাড়ির চাকা চলে যাচ্ছে কেষ্টর। অব্যক্ত যন্ত্রণা আর গুরু গুরু। দেহের সমস্ত রক্তবিন্দু পাগল হয়ে হৃৎপিণ্ডের কাছে ছুটে আসছে। 
আলােছায়ার সেই অতল রহস্যের পাতায় গঙ্গামণির শত নাড়ির রক্তের আল্পনা অাঁকা ছিল—অদ্ভুত আল্পনা, সেই আল্পনার রেহ-পিড়িতে নিশ্চিন্ত একটি প্রাণ নিঃশব্দে পড়ে থাকল।
গঙ্গামণি একটু থেমে একবার উঠে বসার চেষ্টা করে কাতরে, ককিয়ে আবার। নেতিয়ে পড়ল। 
ছটফট করছে কেষ্ট। পায়চারি করছে পাগলের মতাে। গঙ্গামণি নিশ্চল, নিম্পন্দ। তবে কি সে মরে গেল ? চলে গেল এই পিয়াজ-রসুনের গন্ধভরা বন্ধ রেস্টুরেন্ট ঘরের দেওয়াল ডিঙিয়ে, ওই ফুকরি কাটা জালের মধ্যে দিয়ে বাইরের হাওয়ায় আকাশে ?
বিমূঢ় কেষ্ট কি করবে বুঝতে না পেরে এক মগ জল নিয়ে গঙ্গামণির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ঠক ঠক করে তার পা কাঁপছে, হাত কাঁপছে। খানিকটা জল ছলকে পড়ল গঙ্গামণির পেটে, পায়েসদ্যজাতের গায়ে। বাকি জলটা কেষ্ট গঙ্গামণির মুখে মাথায় ঢেলে দিয়ে হাঁপাতে লাগল।
দেখছে কেষ্ট। দেখছে এক মনে ; দু চোখে অজস্র মমতা আর উদ্বেগ ভরে, গঙ্গামণি একটু কেঁপে ওঠে কি না ! আর একবার কাতরে ওঠে কি না।
গঙ্গামণি কেঁপেই উঠল । আর হঠাৎ-হঠাৎ সেই অস্পষ্ট মাংসপিণ্ডটা কোন অজেয় শক্তি বলে কেঁদে উঠল এতক্ষণে, এই প্রথম, দুর্বল, অসহায় গলায় ।।
কেষ্টর সর্বদেহ শিহরিত হল সেই কান্নার শব্দে। আরও বিহুল, বিমূঢ় হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল ও। যেন বনের পথে পথ-ভুলে হাতড়ে মরছে একটা আলাের নিশানা।
কেমন করে যেন অকস্মাৎ অতর্কিতে কেষ্টর চোখ পড়ল দেওয়ালে আঠা দিয়ে আঁটা সেই ধূলি-ধোঁয়া-মলিন, বিবর্ণ যীশুর ছবির ওপর। চোখ পড়ে তাে থমকেই থাকে, নড়ে না আর। কেষ্ট যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছে। আজ এই মুহূর্তে কেমন উজ্জ্বল দেখাচ্ছে ছবিটা ! উনুনের আঁচের লাল আভার খানিকটা তিক রেখায় বিচ্ছুরিত হচ্ছে ছবির গায়—সেই অভায় যীশু আজ আলােকিত।
কেঃ পলকহীন। চোখে তার অগাধ বিস্ময়। মন তার হাওয়ায় হাওয়ায় কোথায় বুঝি ভেসে গেছে। মনে পড়ছে অনেক কাল আগেকার একটি দৃশ্য : দোপাটি ফুলের বাগান ঘেরা ইটরঙের কাদামাটির চার্চ। কেষ্টরা গিয়ে বসেছে চার্চের ভেতর। সাদা লম্বা জামা গায়ে পাথী বুড়াে বাইবেল পড়ছে। চশমাটা নাকের তলায় নামানাে। কয়েকটা মােমবাতি জ্বলছে, কাঁপছে তার শিখা। সে আলােয় যীশুর প্রকাণ্ড ছবিটার।
অন্ধকার ঘােচে না। মুখটা থাকে অস্পষ্ট। পাদ্রী বুড়াে সেই দিকে বার বার চায় আর চাপা গলায় পড়ে—ঠিক এই রকমই হবে। যখন দেখবে ওই সমস্ত দুর্ঘটনা ঘটছে। তখন নিশ্চিত জানতে পারবে যে, ধর্মরাজ্য হাতের কাছে এসেছে। আমার কথা। বিশ্বাস কর। মাটি এবং আকাশ লােপ পেতে পারে কিন্তু আমার কথার অন্যথা হবে।
। সে সময় সেই দুর্ঘটনার পর সূর্য অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে, চাঁদ আর আলাে দেবে। , এবং সমস্ত নক্ষত্র আকাশ থেকে খসে খসে পড়বে। আকাশের জ্যোতিষ্কমণ্ডল। কাঁপতে থাকবে। তারপর আকাশে মনুষ্যপুত্রের নিদর্শন দেখতে পাওয়া যাবে । পৃথিবীর সকল জাতি তখন অনুশােচনা করতে থাকবে। তারা দেখতে পাবে। মনুষ্যপুত্র মহামণ্ডিত হয়ে আকাশের মেঘের ওপর দিয়ে আসছে। 
কী এক অদ্ভুত, তীব্র অনুভূতিতে বেদনায় আকুল হয়ে কেষ্ট তাকাল নীচে। রসুন-পিয়াজ, মাংস-মশলা এটো-কাঁটা ছড়ানাে ধোঁয়া-কয়লার কটু বাষ্পভরা। রেস্টুরেন্টের আধাে-অন্ধকার মাটির দিকে, গঙ্গামণির রক্ত আল্পনার পাত্রে সাজানাে। মাংস পিণ্ডটা যেখানে কঁকিয়ে উঠছে থেকে থেকে।
বিমুঢ়, বিচলিত, বিহুল কেষ্ট সেখানে কি যেন দেখছে, কি যেন খুজছে !