ময়মনসিংহ গীতিকা


ময়মনসিংহ গীতিকা


ময়মনসিংহের অধিবাসী চন্দ্রকুমার দে (১৮৮৯-১৯৪৬)-র প্রচেষ্টায় সংগৃহীত ও ‘সৌরভ' পত্রিকায় প্রকাশিত “ময়মনসিংহ গীতিকা’ দেখে আকৃষ্ট হয়ে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৮৬-১৯৩৯) ময়মনসিংহ গীতিকা”ম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। এরপর আরাে কয়েকটি খণ্ড ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা' নামে প্রকাশিত হয়। সময় গীতিকা সংকলনই 'পূর্ববঙ্গ গীতিকা' নামে প্রচলিত। কালের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘকাল আগে ময়মনসিংহে উদ্ভূত এর কাহিনিগুলির ভাষারও বিবর্তন ঘটেছে, তাই সুনিশ্চিত করে এর উদ্ভবকাল নির্ণয় প্রায় অসম্ভব। কাহিনিগুলিতে বৈচিত্র্যময়, সরল, স্বত:স্ফুর্ত, আন্তরিকতাপূর্ণ, সম্প্রীতির আদর্শে উদ্বুদ্ধ গ্রামজীবনের অনবদ্য ছবি ধরা পরেছে। আধ্যাত্মিকতা ও অলৌকিকতার স্পর্শরহিত সমাজজীবনের এই ছবি মূলত ধর্মনির্ভর মধ্যযুগীয় কাব্যধারা থেকে স্বতন্ত্র। গীতিকবিতার এক বিশিষ্টভঙ্গি পূর্ববঙ্গ গীতিকায় লক্ষরা যায়। দ্বিজ কানাই, নয়নাদ ঘােষ, দ্বিজ ঈশান, রঘুসুত, চন্দ্রাবতী, ফকির ফৈজু, মনসুর বয়াতি প্রমুখে বচনায় গীতিকা-সাহিত্য উজ্জ্বল। কবিরা তাদের রচনায় তৎকালীন সমাজ ইতিহাসের যেমন প্রতিফলন ঘটিয়েছেন, পুরাণ-দর্শন-ধর্মতত্ত্বের অনুবর্তনও ঘটিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—“ময়মনসিংহ গীতিকাবাঙ্গালার পল্লীহৃদয়ের গভীরস্তর থেকে স্বত: উচ্ছ্বসিত উৎস, অকৃত্রিম বেদনার স্বচ্ছ ধারা। নানা ইতিকথা অবলম্বনে গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের কথা কবিত্বময় ও সুসংহত আকারে গীতিকাগুলিতে উৎসারিত হয়েছে। এর বিভিন্ন পালার মধ্যে উল্লেখযােগ্য কয়েকটি হলাে—আধা বধু, ‘মহুয়া", ‘মলুয়া', 'কমলা', 'কঙ্ক ও লীলা’ ‘দস্যু কেনারাম’ প্রভৃতি।

বাংলা সাহিত্যের উন্মেষ ধর্মসাধনা তথা ঈশ্বর-উপাসনাকে ভিত্তি করে। তাই সাধন-পদ্ধতির বৈচিত্র্যের প্রতিফলন সাহিত্যে অনিবার্যভাবেই এসেছে। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দী থেকে শুরু করে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি লক্ষ করলে তাতে বাংলাদেশে ধর্মসাধনার বহু বিচিত্র প্রকাশকে অনায়াসে সুচিহ্নিত করা যায়। যেমন— 'তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম, নাথধর্ম, সহজিয়া বৈষুব সম্প্রদায়, বাউল সম্প্রদায় প্রভৃতি। এছাড়াও অসংখ্য লৌকিক দেব-দেবীর উদ্ভবও সে সময়ে ঘটেছে। এইসব ধর্মসাধন-পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে 'আধুনিক যুগের কাছাকাছি সময় পর্যন্ত সাহিত্য রচিত হয়েছে। তান্ত্রিক বৌদ্ধদের চর্যাপদ, শৈব ও শাক্তদের অন্নদামঙ্গল, কালিকামাল, শিবায়বন, শাক্তগীতি, বৈষুবদের পদাবলি, কৃষ্ণমাল, চরিতকাব্য, নাথপন্থীদের গােরক্ষবিজয়, সহজিয়াদের সাধনাসংগীত প্রভৃতি মূলত ধর্মনির্ভর মধ্যযুগের সাহিত্যে একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী রচনা বলতে ছিল কিছু প্রণয় কাহিনি-নির্ভর আখ্যান, ময়মনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং অন্যান্য লােকসংগীত। খ্রিস্টীয় ষােড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে পাঠান রাজত্বের অবসানে বাঙালির রাষ্টনৈতিক অধিকার ক্ষু হয়। মােগল যুগে এদেশে এক নতুন জমিদার শ্রেণির সৃষ্টি হলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে। হােসেন-শাহী বংশের অবনতির সময় থেকে বহির্বাণিজ্য বাঙালির হাতছাড়া হতে থাকে এবং বিদেশি বণিকদের অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে। তাই, সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে সাধারণ বাঙালি ভূমি-উপজীবী হয়ে পড়ে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিদেশি বণিকদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কাজকর্ম করে অল্প কিছুসংখ্যক লােক বেশ লাভবান হল এবং তাদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে লাগল। সমাজের উচ্চস্তরের এই অন্ত:সারশূন্য অস্থির ও বিলাস ব্যসনের চিত্র 'ভারতচন্দ্রের কাব্যে প্রতিফলিত হয়েছে। খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে মােগল রাজশক্তির পতনের সময়কালে বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রদেশের নবাবদের মধ্যেও স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের ফলে তাদের বিলাসী উজ্জ্বলতায় এবং অক্ষম শাসনে বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র অরাজকতা ও দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। বর্গির হাঙ্গামা সমাজকে অস্থির ও সন্ত্রস্ত করে তুলল। পর্তুগিজ, ফরাসি, ইংরেজ প্রভৃতি পাশ্চাত্য শক্তি ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে নিজেদের ক্ষমতাবৃদ্ধিও আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। অবশেষে, ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধে সিরাজদৌল্লার পরাজয়ে ভারতবর্ষইংরেজ শাসনাধীন হয়ে পড়ে। যুদ্ধবিধ্বস্ত শিথিল সমাজজীবনে উন্নত সাহিত্যচর্চা ছিল কল্পনাতীত। অবক্ষয়ের সেই যুগে নবদ্বীপের মহারাজ কৃচন্দ্র রায়ের (১৭১০-১৮৮৩ খ্রি:) পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতচন্দ্র রায় রামপ্রসাদ সেনের মতেকবিরীকাব্যরচনা করেছেন। এই সময়পর্বে বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য কবিদের মধ্যে ধর্মমঙ্গলেরকবিঘনরাম চক্রবর্তী ও শিবায়নেরকবিরামেশ্বর ভট্টাচার্যের নাম উল্লেখযােগ্য।  



এছাড়া এই সময়ের কিছু বৈকবিতা, চরিতকাব্যগ্রন্থ, বৈষুব নিবন্ধ-পদসংকলন, রামায়ণ-মহাভারত ও ভাগবতের অনুবাদ, বিদ্যাসুন্দরকাব্য, সত্যনারায়ণ পাঁচালি, শৈযােগী সম্প্রদায়ের ছড়া ও গাথা, নীতিকথা, ঐতিহাসিক গাথা, গণিতের আর্যা, ইসলামি বাংলায় রচিত আরবি-ফারসি উপাখ্যান-আশ্রয়ী কিসসার সন্ধান পাওয়া যায়। এছাড়া, ভাষাশিক্ষার প্রয়ােজনে বিদেশি ধর্মপ্রচারক ও বণিকেরা বাংলা শব্দকোষ সংকলন করেন এবং বাংলা ভাষার ব্যাকরণ

নাথ সাহিত্য



নাথ সাহিত্য

মঙ্গলকাব্য ছাড়া ‘নাথ সাহিত্য” নামে পরিচিত আরেক শ্রেণির কাব্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল। বাংলাদেশে সুপ্রাচীনকাল থেকে বর্তমান শিব-উপাসক এক যােগী সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠিত ধমহি হল নাথধর্ম। বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব কালক্রমে স্তিমিত হয়ে এলে তার সঙ্গে শৈবধর্মের মিশ্রণের ফলেই এই নাথধর্মের উৎপত্তি। নাথ ধর্মসম্প্রদায়ের যােগ-মাহাত্ম্যই নাথ সাহিত্যের বিষয়, কীভাবে যােগের শক্তিতে দুঃখ বিপদ অতিক্রম করা যায়, জয় করা যায় মৃত্যুকে পর্যন্ত—নাথসাহিত্যে সে কথাই বর্ণিত হয়েছে। এই নাথসাহিত্যের দুটি ভাগ। সেগুলি হল (১) শিষ্য গােরক্ষনাথ কীভাবে গুরু মীননাখাকে উদ্ধার করলেন সেই কাহিনি অর্থাৎ সংসারের মায়ায় আবদ্ধ মীননাথকে যােগী করে তােলার কাহিনি আর (২) রানি ময়নামতী আর তার পুত্র গোবিন্দচরে কাহিনি। যে আলাদা ছড়া-পাঁচালির আকারে মীননাথ-গোরক্ষনাথের কাহিনি রয়েছে, তার নাম ‘গােরক্ষবিজয় বা 'মীন-চেতন; আর, যে কাহিনিতে রানি ময়নামতী-গোবিন্দচন্দ্রের বৃত্তান্ত পাওয়া যায় তা 'ময়নামতীর গান' বা 'গােপীচন্দ্রের গান নামে পরিচিত। সুপ্রাচীন কাল থেকে নানা প্রক্ষেপের মধ্য দিয়ে এসব কাহিনির মূল রূপটি বর্তমানে বহুল-পরিবর্তিত, এমনকি, এর বহু পুথিতে চৈতন্য প্রভাবের স্পষ্ট প্রমাণ মেলে। এই নাথসাহিত্য-গােরক্ষবিজয়’ আর ‘গােপীচন্দ্রের গান’ গ্রাম্য কবিদের রচনা। যে কারণে এতে না আছে পাণ্ডিত্যের আড়ম্বর, না আছে সংস্কৃত 'অলংকারশাস্ত্রের প্রভাব। সহজ, সরল, অনাড়ম্বর ভাষা-রীতিই নাথসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য। তবুও এতে ধর্মতত্ত্ব, দার্শনিকতার সঙ্গে কবিত্বের সূরণও লক্ষ করা যায়। করুণ রসাত্মক গােপীচন্দ্রে গানে প্রাচীন বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনচিত্রের সহজ ৰূপায়ণ ঘটেছে, সামাজিক রীতিনীতি, অর্থনৈতিক অবস্থার পরিচয় রয়েছে, গ্রাম্য ছড়া-প্রবাদ-প্রকৃতির বিবরণও এতে লিপিবদ্ধ হয়েছে। গানগুলিতে বৌদ্ধ ও ব্রাক্ষ্মণ্যধর্মের প্রভাব নানাভাবে এসেছে। এসেছে অতিপ্রাকৃত তথা অলৌকিকতার স্পর্শ। বাংলার বাইরে গানগুলির প্রচারের উদ্দেশ্যে এগুলিকে মারাঠি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, ওড়িয়া—প্রভৃতি ভাষায় অনুবাদও করা হয়েছিল। বহুকবি “গােরক্ষবিজয়” এবং “গােপীচন্দ্রের গান রচনা করেছেন। অষ্টাদশ শতকের আগে লেখা মীননাথ-গােরক্ষনাথের কাহিনির কোনাে পুথি পাওয়া যায়নি। গােরক্ষবিজয়ের প্রাচীনতম কবিদের মধ্যে রয়েছেন ভীমসেন রায়, শ্যামদাস সেন, শেখ ফয়জুল্লা প্রমুখ।ময়নামতীর গানের প্রাপ্ত পুথির মধ্যে কোনােটিসপ্তদশ শতকেরআগে রচিত নয়। এ কাহিনির উল্লেখযােগ্য কবি হলেন-দুর্লভ মল্লিক, ভবানী দাস, সুকুর মামুদ প্রমুখ।

নীলধ্বজের প্রতি জনা - মাইকেল মধুসূদন দত্ত



নীলধ্বজের প্রতি জনা
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
বাজিছে রাজ-তোরনে রণবাদ্য আজি;
হ্রেষে অশ্ব; গর্জ্জে গজ; উড়িছে আকাশে
রাজকেতু; মুহুর্মুহুঃ হুঙ্কারিছে মাতি
রণমদে রাজসৈন্য ;—কিন্তু কোন্‌ হেতু?
সাজিছ কি, নররাজ, যুঝিতে সদলে—
প্রবীর পুত্রের মৃত্যু প্রতিবিধিৎসিতে
নিবাইতে এ শোকাগ্নি ফাল্পুনির লোহে ?
এই তো সাজে তোমারে, ক্ষত্রমনি তুমি,
মহাবাহু! যাও বেগে গজরাজ যথা
যমদণ্ডসম শুণ্ড আস্ফালি নিনাদে!
টুট কিরীটীর গর্ব্ব আজি রণস্থলে!
খণ্ডমুণ্ড তার আন শূল-দণ্ড-শিরে!
অন্যায় সমরে মূঢ় নাশিল বালকে;
নাশ, মহাষ্বাস, তারে! ভুলিব এ জ্বালা,
এ বিষম জ্বালা, দেব, ভুলিব সত্বরে!
জন্মে মৃত্যু ;—বিধাতার এ বিধি জগতে।
ক্ষত্রকুল-রত্ম পুত্র প্রবীর সুমতি,
সম্মুখসমরে পড়ি, গেছে স্বর্গধামে,—
কি কাজ বিলাপে, প্রভু? পাল, মহীপাল,
ক্ষত্রধর্ম্ম, ক্ষত্রকর্ম্ম সাধ ভুজবলে।
হায়, পাগলিনী জনা! তব সভামাঝে
নাচিছে নর্ত্তকী আজি, গায়ক গাইছে,
উথলিছে বীণাধ্বনি! তব সিংহাসনে
বসিছে পুত্রহা রিপু—মিত্রোত্তম এবে’
সেবিছ যতনে তুমি অতিথি-রতনে।—
কি লজ্জা! দুঃখের কথা, হায়, কব কারে?
হতজ্ঞান আজি কি হে পুত্রের বিহনে,
মাহেশ্বরী-পুরীশ্বর নীলধ্বজ রথী?
যে দারুণ বিধি, রাজা, আঁধারিলা আজি
রাজ্য, হরি পুত্রধনে, হরিলা কি তিনি
জ্ঞান তব? তা না হলে, কহ মোরে, কেন
এ পাষণ্ড পাণ্ডুরথী পার্থ তব পুরে
অতিথি? কেমনে তুমি, হায়, মিত্রভাবে
পরশ সে কর, যাহা প্রবীরের লোহে
লোহিত? ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম এই কি, নৃমণি?
কোথা ধনু, কোথা তুণ, কোথা চর্ম্ম, অসি?
না ভেদি রিপুর বক্ষ তীক্ষ্ণতম শরে
রণক্ষেত্রে, মিষ্টালাপে তুষিছ কি তুমি
কর্ণ তার সভাতলে? কি কহিবে, কহ,
যবে দেশ-দেশান্তরে জনরব লবে
এ কাহিনী,— কি কহিবে ক্ষত্রপতি যত?
নররারায়ণ-জ্ঞানে, শুনিনু পূজিছ
পার্থে রাজা, ভক্তিভাবে ;—এ কি ভ্রান্তি তব?
হায়, ভোজবালা কুন্তী—কে না জানে, তারে,
স্বৈরিণী? তনয় তার জারজ অর্জ্জুনে
(কি লজ্জা), কি গুণে তুমি পূজ, রাজরথি,
নরনারায়ণ-জ্ঞানে? রে দারুণ বিধি,
এ কি লীলাখেলা তোর, বুঝিব কেমনে?
একমাত্র পুত্র দিয়া নিলি পুনঃ তারে
অকালে! আছিল মান,— তাও কি নাশিলি?
নরনারায়ণ পার্থ? কুলটা যে নারী—
বেশ্যা—গর্ভে তার কি হে জনমিলা আসি
হৃষীকেশ? কোন্‌ শাস্ত্রে, কোন্‌ বেদে লেখে—
কি পুরাণে—এ কাহিনী? দ্বৈপায়ন ঋষি
পাণ্ডব-কীর্ত্তন গান গায়েন সতত।
সত্যবতীসুত ব্যাস বিখ্যাত জগতে!
ধীবরী জননী, পিতা ব্রাহ্মণ! করিলা
কামকেলি লয়ে কোলে ভ্রাতৃবধূদ্বয়ে
ধর্ম্মমতি! কি দেখিয়া, বুঝাও দাসীরে,
গ্রাহ্য কর তাঁর কথা, কুলাচার্য্য তিনি
কু-কুলের? তবে যদি অবতীর্ণ ভবে
পার্থরূপে পীতাম্বর, কোথা পদ্মালয়া
ইন্দিরা? দ্রৌপদী বুঝি? আঃ মরি, কি সতী!
শাশুড়ীর যোগ্য বধূ! পৌরব-সরসে
নলিনী! অলির সখী, রবির অধীনী,
সমীরণ-প্রিয়া! ধিক্‌। হাসি আসে মুখে
(হেন দুঃখে) ভাবি যদি পাঞ্চালীর কথা!
লোক-মাতা রমা কি হে এ ভ্রষ্টা রমণী?
জানি আমি কহে লোক রথীকুল-পতি
পার্থ! মিথ্যা কথা, নাথ! বিবেচনা কর,
সূক্ষ্ম বিবেচক তুমি বিখ্যাত জগতে।—
ছদ্মবেশে লক্ষ রাজে ছলিল দুর্ম্মতি
স্বয়ম্বরে। যথাসাধ্য যে যুঝিল, কহ,
ব্রাহ্মণ ভাবিয়া তারে, কোন্‌ ক্ষত্ররথী,
সে সংগ্রামে? রাজদলে তেঁই সে জিতিল!
দহিল খাণ্ডব দুষ্ট কৃষ্ণের সহায়ে।
শিখণ্ডীর সহকারে কুরুক্ষেত্র রণে
পৌরব-গৌরব ভীষ্ম বৃদ্ধ পিতামহে
সংহারিল মহাপাপী! দ্রোণাচার্য্য গুরু,—
কি কুছলে নরাধম বধিল তাঁহারে,
দেখ স্মরি? বসুন্ধরা গ্রাসিলা সরোষে
রথচক্র যবে, হায়; যবে ব্রহ্মশাপে
বিকল সমরে, মরি, কর্ণ মহাযশাঃ
নাশিল বর্ব্বর তাঁরে। কহ মোরে, শুনি,
মহারথী-প্রথা কি হে এই মহারথি?
আনায়-মাঝারে আনি মৃগেন্দ্রে কৌশলে
বধে ভীরুচিত ব্যাধ; সে মৃগেন্দ্র যবে
নাশে রিপু, আক্রমে সে নিজ পরাক্রমে!
কি না তুমি জান রাজা? কি কব তোমারে
জানিয়া শুনিয়া তবে কি ছলনে ভুল
আত্মশ্লাঘা১০, মহারথি? হায় রে কি পাপে,
রাজ-শিরোমণি রাজা নীলধ্বজ আজি
নতশির,—হে বিধাতঃ!—পার্থের সমীপে?
কোথা বীরদর্প তব? মানদর্প কোথা?
চণ্ডালের পদধূলি ব্রাহ্মণের ভালে?
কুরঙ্গীর অশ্রুবারি নিবায় কি কভু
দাবানলে? কোকিলের কাকলী-লহরী
উচ্চনাদী প্রভঞ্জনে নীরবয়ে১১ কবে?
ভীরুতার সাধনা কি মানে বলবাহু?
কিন্তু বৃথা এ গঞ্জনা১২। গুরুজন তুমি;
পড়িব বিষম পাপে গঞ্জিলে তোমারে।
কুলনারী আমি, নাথ, বিধির বিধানে
পরাধীনা! নাহি শক্তি মিটাই স্ববলে
এ পোড়া মনের বাঞ্ছা! দুরন্ত ফাল্পুনি
(এ কৌন্তেয় যোধে ধাতা সৃজিলা নাশিতে
বিশ্বসুখ!) নিঃসন্তানা করিল আমারে!
তুমি পতি, ভাগ্যদোষে বাম মম প্রতি
তুমি! কোন্‌ সাধে প্রাণ ধরি ধরাধামে?
হায় রে, এ জনাকীর্ণ ভবস্থল আজি
বিজন জনার পক্ষে! এ পোড়া ললাটে
লিখিলা বিধাতা যাহা, ফলিল তা কালে!—
হা প্রবীর! এই হেতু ধরিনু কি তোরে,
দশ মাস দশ দিন নানা যত্ম সয়ে,
এ উদরে? কোন্‌ জন্মে, কোন্‌ পাপে পাপী
তোর কাছে অভাগিনী, তাই দিলি বাছা,
এ তাপ? আশার লতা তাই রে ছিঁড়িলি?
হা পুত্র। শোধিলি কি রে তুই এইরূপে,
মাতৃধার? এই কি রে ছিল তেরা মনে?—
কেন বৃথা, পোড়া আঁখি, বরষিস্‌ ১৩ আজি
বারিধারা? রে অবোধ, কে মুছিবে তোরে?
কেন বা জ্বলিস্‌, মনঃ? কে জুড়ারে আজি
বাক্য-সুধারসে তোরে? পাণ্ডবের শরে
খণ্ড শিরোমণি তোর; বিবরে ১৪ লুকায়ে,
কাঁদি খেদে, মর্‌, অরে মণিহারা ফণি!—
যাও চলি, মহাবল, যাও কুরুপুরে
নব মিত্র পার্থ সহ! মহাযাত্রা করি
চলিল অভাগা জনা পুত্রের উদ্দেশে!
ক্ষত্র-কুলবালা আমি; ক্ষত্র-কুল বধু;
কেমনে এ অপমান সব ধৈর্য্য ধরি?
ছাড়িব এ পোড়া প্রাণ জাহ্নবীর জলে;
দেখিব বিস্মৃতি যদি কৃতান্তনগরে
লভি অন্তে! যাচি চির বিদায় ও পদে!
ফিরি যবে রাজপুরে প্রবেশিবে আসি,
নরেশ্বর, “কোথা জনা?” বলি ডাক যদি
উত্তরিবে প্রতিধ্বনি “কোথা জনা?” বলি!
ইতি শ্রীবীরাঙ্গনাকাব্যে জনাপত্রিকা নাম
একাদশঃ সর্গঃ।

দরখাস্ত নমুনা

অসুস্থতাজনিত কারণে ছুটির আবেদন

মাননীয় প্রধান শিক্ষক, 
বিরাটী হাই স্কুল, 
বিরাটী, কলকাতা-৭০০০৫১ 

বিষয় : অসুস্থতাজনিত কারণে ছুটির আবেদন 
মহাশয়,
আমি সৈকত বিশ্বাস, আপনার বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ‘ক’ বিভাগের ছাত্র। আমার ক্রমিক সংখ্যা ৬। আমি আজ খুব জ্বর নিয়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়েছি। কারণ আজ আমাদের শ্রেণিতে ইতিহাসের পরীক্ষা ছিল। অসুস্থতা নিয়েই আমি পরীক্ষা দিয়েছি। কিন্তু এখন ক্রমশ আমার শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। তাই শ্রেণিকক্ষে আর স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছি না।  
আপনার কাছে আমার বিনীত আবেদন এই যে, আপনি ছুটির অনুমতি দিলে আমি একান্তভাবে কৃতজ্ঞ থাকব। 

আপনার একান্ত অনুগত ছাত্র।
সৈকত বিশ্বাস।
স্থান : বিরাটী
বিনীত তারিখ : ০৫/০৯/২০১৮ 






----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------


শিক্ষামূলক ভ্রমণে অংশগ্রহণ করার আবেদন


মাননীয়, 
প্রধান শিক্ষক মহাশয় সমীপেষু, 
বিধাননগর গভ: হাই স্কুল 
বিধাননগর, কলকাতা – ৭০০০৬৪ 
বিষয় : শিক্ষামূলক ভ্রমণে অংশগ্রহণ করার আবেদন
মহাশয়,
আমি আপনার বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ক’ বিভাগের ছাত্রী। আমার ক্রমিক নং–২। আগামী ২৫ ডিসেম্বর আমাদের বিদ্যালয় থেকে শিক্ষামূলক ভ্রমণে অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাসগৃহ দেউলটি যাওয়া হচ্ছে তাতে আমি অংশগ্রহণ করতে চাই। আমার অভিভাবকের কোনাে আপত্তি নেই। আমার বাবা সম্মতি জানিয়ে লিখে দিয়েছেন। আপনি যদি অনুগ্রহ করে সম্মতি জানিয়ে আমাকে সুযােগ দেন, আমি আপনার কাছে বাধিত থাকব।
বিনীত —
সায়ন দাস,
বিধাননগর গভ. হাইস্কুল সপ্তম শ্রেণি, ‘ক’ বিভাগ, ক্রমিক নং -২
তারিখ : ২২/০৭/২০১৯
 স্থান : কলকাতা

madhyamik examination routine -2020

WEST BENGAL BOARD OF SECONDARY EDUCATION
NIVEDITA BHAWAN, DJ-8, SECTOR – II, SALT LAKE, KOLKATA – 700 091
No. EMU/C/35 Date: 06.06.2019
NOTIFICATION
It is notified for all concerned that the Madhyamik Pariksha (Secondary Examination), 2020 (both Regular & External) will be held as per the following programme.
The examination will be held in only one paper on each day from 11.45 a.m. to 3 p.m. (First 15 minutes for reading the Question Papers only). The dates & corresponding subjects are as under.
PROGRAMME
DAYDATESUBJECT
TUESDAY18th FEBRUARY, 2020FIRST LANGUAGES *
WEDNESDAY19th FEBRUARY, 2020SECOND LANGUAGES **
THURSDAY20th FEBRUARY, 2020GEOGRAPHY
SATURDAY22nd FEBRUARY, 2020HISTORY
MONDAY24TH FEBRUARY, 2020MATHEMATICS
TUESDAY25th FEBRUARY, 2020PHYSICAL SCIENCE
WEDNESDAY26th FEBRUARY, 2020LIFE SCIENCE
THURSDAY27TH FEBRUARY, 2020OPTIONAL ELECTIVE SUBJECTS
N.B.: The dates for Physical Education & Social Service & Work Education will be announced later.
* First Languages: Bengali, English, Gujarati, Hindi, Modern Tibetan, Nepali, Odia, Gurmukhi (Punjabi), Telugu, Tamil, Urdu and Santali.
** Second languages: 1) English, if any language other than English is offered as First Language.
2) Bengali or Nepali, if English is the First Language.
(a) Examination in shorthand & Typewriting will be held at Kolkata and Siliguri only. The venue and date will be announced later.
(b) Examination in Sewing and Needle Work will be of four hours fifteen minutes duration.
(c) Examination in Music Vocal & Music Instrumental will be of two hours fifteen minutes duration for Theoretical Portion. The venue, date and hour of the Practical Examination in these subjects (which will be held at Kolkata, Burdwan & North Bengal Regions only) will be announced later.
(d) Examination on Computer Application will be of two hours forty five minutes duration on theoretical Examination. Practical Examination on this subject will be taken by individual schools.
(e) Examination on Vocational Subjects (under NSQF Project) will be of one hour forty five minutes duration on theoretical Examination. Practical Examination on these subjects will be taken by the Sector Skill Council or individual schools.
Sd/- MAUSUMI BANERJEE (BHADRA)
DY. SECRETARY (EXAMINATION)

Higher Secondary Examination Routine - 2020

WEST BENGAL COUNCIL OF HIGHER SECONDARY EDUCATION
VIDYASAGAR BHAVAN
9/2, BLOCK-DJ, SECTOR-II, SALTLAKE
KOLKATA – 700091
Memo No. DS(Exam)/23/2019 Date: 07/06/2019
Examination Programme
Higher Secondary Examination: 2020
NEW SYLLABUS
DateDayFrom 10.00 a.m. to 1.15 p.m. (MORNING)
12.03.2020ThursdayBengali (A), English (A), Hindi (A), Nepali (A), Urdu, Santhali, Odia, Telugu, Gujrati, Punjabi
14.03.2020SaturdayEnglish (B), Bengali (B), Hindi (B), Nepali (B), Alternative English
16.03.2020MondayBiological Science, Business Studies, Political Science
17.03.2020Tuesday#Health Care, #Automobile, #Organised Retailing, #Security, #IT and ITES -VOCATIONAL SUBJECTS
18.03.2020WednesdayMathematics, Psychology, Anthropology, Agronomy, History
19.03.2020ThursdayComputer Science, Modern Computer Application, Environmental Studies, #Health & Physical Education, #Music, #Visual Arts
21.03.2020SaturdayCommercial Law and Preliminaries of Auditing, Philosophy, Sociology
23.03.2020MondayPhysics, Nutrition, Education, Accountancy
25.03.2020WednesdayChemistry, Economics, Journalism & Mass Communication, Sanskrit, Persian, Arabic, French
27.03.2020FridayStatistics, Geography, Costing and Taxation, Home Management and Family Resource Management
The Examination will be held in only one paper on each day from 10.00 a.m. to 1.15 p.m. (3 hours and 15 minutes time is allotted both for reading question paper and writing answer) except Health & Physical Education, Visual Arts, Music and Vocational Subjects.
#The Examination of these subjects will be of two hours duration.
a) Date Schedule of H.S. Practical Examination 2020 of all Lab-Based subjects excluding MUSIC, VISUAL ARTS and HEALTH & PHYSICAL EDUCATION: 02.12.2019 to 24.12.2019 (Including Hill Area).
b) Date Schedule of H.S. Practical Examination 2020 of MUSIC, VISUAL ARTS and HEALTH & PHYSICAL EDUCATION: 16.12.2019 to 24.12.2019 (Including Hill Area).
The Council may, if necessary, change the above dates with due intimation to all concerned.
Deputy Secretary (Examination)
W.B Council of H.S Education

ডাকাতের মা - সতীনাথ ভাদুড়ী


ডাকাতের মা
সতীনাথ ভাদুড়ী
আগে সে ছিল ডাকাতের বউ। সৌখীর বাপ মরে যাবার পর থেকে তার পরিচয় ডাকাতের মা বলে। ...ডাকাতের মায়ের ঘুম কি পাতলা না হলে চলে। রাতবিরেতে কখন দরজায় টোকা পড়বে তার কি ঠিক আছে। টকটক করে দু-টোকার শব্দ থেমে থেমে তিনবার হলে বুঝতে হবে দলের লােক টাকা দিতে এসেছে। তিনবারের পর আরও একবার হলে বুঝতে হবে যে, সৌখী নিজে বাড়ি ফিরল। ছেলের আবার কড়া হুকুম- ‘তখনই দরজা খুলবি না হুট করে! খবরদার! দশবার নিশ্বাস ফেলতে যতক্ষণ সময় লাগে ততক্ষণ অপেক্ষা করবি। তারপর দরজা খুলবি। ...আরও কত রকমের টোকা মারবার রকমফের আছে। কতবার হয়েছে, কতবার বদলেছে। দুনিয়ায় বিশ্বাস করবে কাকে; পুলিশকে ঠেকানাে যায়; কিন্তু দলের কারও মনে যখন পাপ ঢােকে তখন তাকে ঠেকানাে হয় মুশকিল। দিনকালই পড়েছে অন্যরকম! সৌখীর বাপের মুখে শােনা যে, সেকালে দলের কে যেন জখম হয়ে ধরা পড়বার পর, নিজের হাতে নিজের জিব কেটে ফেলেছিল- পাছে পুলিশের কাছে দলের সম্বন্ধে কিছু বলে ফেলে সেই ভয়ে। আর আজকাল তিন বছর থেকে আর দেয় না। এ কী কখনও হতে পারত 'আগেকার কালে? ন্যায়-অন্যায় কর্তব্য-অকর্তব্যের পটিই কী একেবারে উঠে গেল দুনিয়া থেকে? সৌখীর বাপ কতবার জেলে গিয়েছে; সৌখীরও তাে এর আগে দু-বার কয়েদ হয়েছে; কখনও তাে দলের লােকে এর আগে এমন ব্যবহার করেনি। মাস না যেতেই হাতে টাকা এসে পৌছেছেকখনও বা আগাম—তিন-চার মাসের একসঙ্গে। কিন্তু এবার দেখাে তাে কাণ্ড! একটা সংসার পয়সার অভাবে ভেসে গেল কিনা তা একবার উঁকি মেরে দেখল না দলের লােক! আগের বউমার শরীরটা ছিল ভালাে। সৌখীর এবারকার বউটা রােগা-রােগা। তার উপর ছেলে হবার পর একেবারে ভেঙে গিয়েছে শরীর। সৌখী যখন একবার ধরা পড়ে, তখন বউমার ছেলে পেটে। হ্যা, নাতিটার বয়স চার-পাঁচ বছর হল বইকি। কী কপাল নিয়ে এসেছিল। যার বাপের নামে চৌকিদারসাহেব কাপে, দারােগাসাহেব পর্যন্ত যার বাপকে তুইতােকারি করতে সাহস করেননি কোনােদিন, তারই কিনা দু-বেলা ভাত জোটে না! হায় রে কপাল! এ বউ যে খাটতে পারে না ওই রােগা শরীর নিয়ে। আমি বুড়াে মানুষ, কোনােরকমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দুটো খই-মুড়ি বেচে আসি। তা দিয়ে নিজের পেট চালানােই শক্ত। সাধে কী আর বউমাকে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে হল! তাছাড়া গয়লাবাড়ির মেয়ে। ঝি-চাকরের কাজও তাে আমরা করতে পারি না। করলেই বা রাখত কে? সৌখীর মা-বউকে কি কেউ বিশ্বাস পায়! নইলে আমার কি ইচ্ছা করে না যে, বউ-নাতিকে নিয়ে ঘর করি! বেয়াইয়ের দুটো মোষআছে। তবু বউ-নাতিটার পেটে একটু একটু দুধ পড়ছে। ওদের শরীরে দরকার দুধের। আর বছরখানেক বাদেই তাে সৌখী ছাড় পাবে। তখন বউকে নিয়ে এসে রুপাের গয়না দিয়ে মুড়ে দেবে। দেখিয়ে দেব। পাড়ার লােকদের যে, সৌখীর মায়ের নাতি পথের ভিখিরি নয়। আসতে দাও না সৌখীকে! দলের ওই বদলােকগুলােকেও ঠান্ডা করতে হবে। আমি বলি, এসব একলসেঁড়ে লােকদের দলে না নিলেই হয়। ওরা কী ডাকাত নামের যুগ্যি; চোর, ছিচকে চোর! ওই যেটা টাকা দিতে আসত, সেটার চেহারা দেখেছ? তালপাতার সেপাই। থুতনির নীচে দু-গাছা দাড়ি! কালি-ঝুলিই মাখাে, আর মশালই হাতে নাও, ওই রােগা-পটকাকে দেখে কেউ ভয় পাবে কস্মিনকালে?...

ঘুম আর আসতে চায় না। রােজ রাতেই এই অবস্থা। মাথা পর্যন্ত কম্বলের মধ্যে ঢুকিয়ে না নিলে তার কোনাে কালেই ঘুম হয় না শীতের দিনে।...একবার সৌখী কোথা থেকে রাত-দুপুরে ফিরে এসে টোকার সাড়া না পেয়ে, কী মারই মেরেছিল মাকে! বলে দিয়েছিল যে ফের যদি কোনােদিন নাকমুখ ঢেকে শুতে দেখি, তাহলে খুন করে ফেলে দেব! বাপের বেটা, তাই মেজাজ অমন কড়া। আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দিয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমুলেও একটা বকুনি দেবার লােক পর্যন্ত নেই বাড়িতে, গেল পাঁচ বছরের মধ্যে! এ কী কম দুঃখের কথা...।

ঘুমের অসুবিধা হলেও, ছেলের কথা মনে করে সে এক দিনের জন্যও নাকমুখ ঢেকে শােয়নি পাঁচ বছরের মধ্যে।

...বাইরে নােনা আতা গাছতলায় শুকনাে পাতার উপর একটু খড়খড়ি করে শব্দ হল। গন্ধগোকুল কিংবা শিয়ালটিয়াল হবে বােধ হয়। কী খেতে যে এরা আসে বােঝা দায় ...বুড়াে হয়ে শীত বেড়েছে। আগে একখান কম্বলে কেমন দিব্যি চলে যেত। এ কম্বলখানা হয়েছে অনেক কালের পুরােনাে। এর আগের বার সৌখী জেল থেকে এনেছিল। সে কী আজকের কথা!
কম্বলখানার বয়স ক-বছর হবে তার হিসাব করতে গিয়ে বাধা পড়ে। টকটক করে টোকা পড়ার মতাে শব্দ যেন কানে এল। টিকটিকির ডাক বােধ হয়! হাতি পাঁকে পড়লে ব্যাঙেও লাথি মারে। টিকটিকিটা সুদ্ধ খুনশুড়ি আরম্ভ করেছে মজা দেখবার জন্য। করে নে।
টকটক করে আবার দরজায় দুটো টোকা পড়ল। ...না। তাহলে টিকটিকি না তাে। আওয়াজটা খনখনে—টিনের কপাটের উপর টোকা মারবার শব্দ।
বুড়ি উঠে বসে। ঘর গরম রাখার জন্য সে আগুন করেছিল মেঝেতে, সেটা কখন নিভে গিয়েছে; কিন্তু তার ধোঁয়া ঘরের অন্ধকারকে আরও জমাট করে তুলেছে।... এতদিনে কী তাহলে দলের হতভাগাগুলাের মনে পড়েছে সৌখীর মায়ের কথা ?
আবার দরজায় দুটো টোকা পড়ল। আর সন্দেহ নেই। অনেক দিনের অনভ্যাসের পর এই সামান্য। ব্যাপারটা বুড়ির মনের মধ্যে একটু উত্তেজনা এনেছে।
...তবু বলা যায় না। ...কে না কে...
সৌখীর মা আস্তে আস্তে উঠে দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বন্ধ কপাটের ফাক দিয়ে বাইরের লােকটাকে দেখবার চেষ্টা করল। ...লােকটাও বােধ হয় কপাটের ফাঁক দিয়ে ভিতরে দেখবার চেষ্টা করছে। বাইরেও ঘুটঘুটে অন্ধকার, কিছু দেখা যায় না। বিড়ির গন্ধ নাকে আসছে। ..আবার টোকা পড়ল দুটো। এবার একেবারে কানের কাছে। এ টোকা পড়বার কথা ছিল না। অবাক কাণ্ড! তাহলে তাে লােকটা টাকা দিতে আসেনি! পুলিশের লােকটোক নয় তাে? টোকা মারবার নিয়মকানুনগুলাে হয়তাে ভালাে জানে না! ...সৌখীর ছাড়া পাবার যে এখনও বহু দেরি! ...নিশ্চয়ই পুলিশের লােক। তবে তুমি যে-ই হও, টাকা দিলে নিশ্চয়ই নিয়ে নেব; তারপর অন্য কথা। ...কথা বলতে হবে সাবধানে; দলের কারও নামধাম আবার মুখ দিয়ে বেরিয়ে না পড়ে অজান্তে ।...
হঠাৎ মনে পড়ল, হুড়কো খুলবার আগে দশবার নিশ্বাস ফেলবার কথা। মানসিক উত্তেজনায় নিশ্বাস পড়ছেই না তা গুনবে কী।...বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করছে। বুড়ি তাড়াতাড়ি দশবার নিশ্বাস ফেলে নিয়মরক্ষা করে নিল।
দরজা খুলে সম্মুখে এক লম্বাচওড়া লােককে দেখে ডাকাতের মায়েরও গা ছমছম করে।। ‘ঘর যে একবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঢুকি কী করে? ‘কে, সৌখী। ওমা তুই। আমি ভাবি কে না কে।
বুড়ি ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছে।...এ ছেলে বুড়াে হয়েও সেই একই রকম থেকে গেল। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ফিরছে; বুক ফুলিয়ে পাড়া জাগিয়ে ঢুকতে পারত বাড়িতে অনায়াসে। কিন্তু দরজায় টোকা মেরে মা-র সঙ্গে খুনশুড়ি হচ্ছিল এতক্ষণ।...এ আনন্দ তার রাখবার জায়গা নেই।..
‘লাটসাহেব জেল দেখতে গিয়েছিল। আমার কাজ দেখে খুশি হয়ে ছেড়ে দেবার হুকুম দিয়ে দিল। খুশি আর কী। হেড জমাদার সাহেবকে টাকা খাইয়েছিলম। সেই সুপারিশ করে দিয়েছিল জেলারবাবুর কাছে। তাই বেশি রেমিশন পেয়ে গেলাম। আচ্ছা, তুই কুপিটা জ্বাল তাে আগে। তারপর সব কথা হবে।
দরকারের চাইতেও জোরে কথাগুলাে বলল সৌখী যাতে ঘরের অন্য সকলেও শুনতে পায়। তারপর মাকে কেরােসিন তেলের টেমিটাকে খুজতে সাহায্য করবার জন্য দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে তুলে ধরে।
বুড়ি এতক্ষণে আলােতে মুখ দেখতে পেল ছেলের। চুলে বেশ পাক ধরেছে এবার; তাই বাপের মুখের আদল ধরা পড়ছে ছেলের মুখে। রােগা-রােগা লাগছে যেন। সেখীটার তাে বাপের মতাে জেলে গেলে শরীর ভালাে হয়। তবে এবার এমন কেন? ছেলের চোখের চাউনি ঘরের দুর দেয়াল পর্যন্ত কী যেন খুঁজছে। কাদের খুঁজছে সে কথা আর বুড়িকে বুঝিয়ে বলে দিতে হবে না।...
‘হারে, জেলে তাের অসুখ-বিসুখ করেছিল নাকি? সৌখী এ প্রশ্ন কানে তুলতে চায় না; জিজ্ঞাসা করে, ‘এদের কাউকে দেখছি না?” প্রতি মুহুর্তে বুড়ি এই প্রশ্নের ভয়ই করছিল। জানা কথা যে, জিজ্ঞাসা করবেই; ...তবু. ‘বউ বাপের বাড়ি গিয়েছে। ‘হঠাৎ বাপের বাড়ি ?
...এতদিন পর বাড়ি ফিরেছে ছেলে। এখনই সব কথা খুলে বলে তার মেজাজ খারাপ করে দিতে চায় না। মরদের রাগ। শুনেই এখনই হয়তাে ছুটবে রাগের মাথায় দলের লােকের সঙ্গে বােঝাপড়া করতে।
...নাতি আর বউয়ের শরীর খারাপের কথাও এখনই বলে কাজ নেই। ছেলে ছেলে করে মরে সৌখী। আগের বউটার ছেলেপিলে হয়ইনি। এ বউয়ের ওই একটিই তাে টিমটিম করছে। তার শরীর খারাপের কথা শুনলে হয়তাে সৌখী এখানে আর একদিনও থাকবে না। এতদিন পর এল। একদিনও কাছে রাখতে পারব। না? খেয়ে-দেয়ে জিরিয়ে সুস্থির হয়ে থাকুক এক-আধদিন। তারপর সব কথা আস্তে আস্তে বলা যাবে।..
“কেন, মেয়েদের কী মা বাপকে দেখতে ইচ্ছে করে না একবারও?' | ‘না না, তাই কী বলছি নাকি?’ অপ্রতিভের চেয়ে হতাশ হয়েছে বেশি সৌখী। তার বাড়ি ফিরবার আনন্দ অর্ধেক হয়ে গিয়েছে মুহূর্তের মধ্যে। ছেলেটা কেমন দেখতে হয়েছে, তাই নিয়ে কত কল্পনার ছবি এঁকেছে জেলে বসে বসে। ছেলে কেমন করে গল্প করে মায়ের সঙ্গে তাই শুনবার জন্য টোকা মারবার আগে দরজায় কান ঠেকিয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। ভেবেছিল রাত নটার মধ্যে দুরন্ত ছেলেটা নিশ্চয়ই ঘুমােবে না। সে মনে মনে ঠিক করে ফেলে যে...কালই সে যাবে শ্বশুরবাড়ি বউছেলেকে নিয়ে আসতে। এ কথা এখনই মাকে বলে ফেলা ভালাে দেখায় না; নইলে মা আবার ভাববে যে নতুন বউ এসে ছেলেকে পর করে নিয়েছে। ...মা কত কী বলে চলেছে; এতক্ষণে শেষের কথাটা কানে গেল।
‘নে, হাতমুখ ধুয়ে নে। “না না। আমি খেয়ে এসেছি। এই রাত করে আর তােক রাঁধতে বসতে হবে না।' ‘না, রাঁধছে কে। খইমুড়ি আছে। খেয়েনে। তুই যে কত খেয়ে এসেছিস, সে আর আমি জানি না।
ব্যবসার পুজি খইমুড়িগুলাে শেষ করে শােয়ার সময় তার হঠাৎ নজর গেল মা-র গায়ের ছেড়া কম্বলখানার দিকে।
‘ওখান আমাকে দে।” আপত্তি ঠেলে সৌখী নিজের গায়ের নতুন কম্বলখানা মায়ের গায়ে জড়িয়ে দিল।
নতুন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েও বুড়ির ঘুম আসতে চায় না। পা কিছুতেই গরম হয় না, রাজ্যের দুশ্চিন্তায় মাথা গরম হয়ে উঠেছে। সৌখীর নাকডাকানির একঘেয়ে শব্দ কানে আসছে। এতদিন পর ছেলে বাড়ি এল; কোথায় নিশ্চিন্ত হবে, তা নয়, সৌখীকে কী খেতে দেবে কাল সকালে, সেই হয়েছে বুড়ির মস্ত ভাবনা। আজকের রাতটা না হয় বিক্রির খইমুড়ি দিয়ে কোনােরকমে চলে গেল।...যদি বলত দুটো ভাত খেতে ইচ্ছা। করছে, তাহলেই আর উপায় ছিল না, সব কথা না বলে। ...আলু-চচ্চড়ি খেতে কী ভালােই বাসে সৌখাটা! কতকাল হয়তাে জেলে খেতে পায়নি। আলু, চাল, সরষের তেল সবই কিনতে হবে। অত পয়সা পাব কোথায় ? ভােরে উঠেই কী ছেলেকে বলা যায় যে, আগে পয়সা জোগাড় করে আন, তবে বেঁধে দেব!...।
..কাছারির ঘড়িতে দুটো বাজল। ...ভেবে কূলকিনারা পাওয়া যায় না।..
মনে পড়ল যে, পেশকারসাহেবের বাড়ি রাজমিস্ত্রি লেগেছে। আজ যখন মুড়ি বেচতে গিয়েছিল তখন দেখেছে যে, পড়ে যাওয়া উত্তরের পাঁচিলটা গাঁথা হচ্ছে। বুড়ি বিছানা থেকে উঠে পা টিপে টিপে বেরােল ঘর থেকে।
...নাতি আর বউয়ের শরীর খারাপের কথাও এখনই বলে কাজ নেই। ছেলে ছেলে করে মরে সৌখী। আগের বউটার ছেলেপিলে হয়ইনি। এ বউয়ের ওই একটিই তাে টিমটিম করছে। তার শরীর খারাপের কথা শুনলে হয়তাে সৌখী এখানে আর একদিনও থাকবে না। এতদিন পর এল। একদিনও কাছে রাখতে পারব। না? খেয়ে-দেয়ে জিরিয়ে সুস্থির হয়ে থাকুক এক-আধদিন। তারপর সব কথা আস্তে আস্তে বলা যাবে।..
“কেন, মেয়েদের কী মা বাপকে দেখতে ইচ্ছে করে না একবারও?'  
‘না না, তাই কী বলছি নাকি?’ অপ্রতিভের চেয়ে হতাশ হয়েছে বেশি সৌখী। তার বাড়ি ফিরবার আনন্দ অর্ধেক হয়ে গিয়েছে মুহূর্তের মধ্যে। ছেলেটা কেমন দেখতে হয়েছে, তাই নিয়ে কত কল্পনার ছবি এঁকেছে জেলে বসে বসে। ছেলে কেমন করে গল্প করে মায়ের সঙ্গে তাই শুনবার জন্য টোকা মারবার আগে দরজায় কান ঠেকিয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। ভেবেছিল রাত নটার মধ্যে দুরন্ত ছেলেটা নিশ্চয়ই ঘুমােবে না। সে মনে মনে ঠিক করে ফেলে যে...কালই সে যাবে শ্বশুরবাড়ি বউছেলেকে নিয়ে আসতে। এ কথা এখনই মাকে বলে ফেলা ভালাে দেখায় না; নইলে মা আবার ভাববে যে নতুন বউ এসে ছেলেকে পর করে নিয়েছে। ...মা কত কী বলে চলেছে; এতক্ষণে শেষের কথাটা কানে গেল।
‘নে, হাতমুখ ধুয়ে নে। “না না। আমি খেয়ে এসেছি। এই রাত করে আর তােক রাঁধতে বসতে হবে না।' ‘না, রাঁধছে কে। খইমুড়ি আছে। খেয়েনে। তুই যে কত খেয়ে এসেছিস, সে আর আমি জানি না।
ব্যবসার পুজি খইমুড়িগুলাে শেষ করে শােয়ার সময় তার হঠাৎ নজর গেল মা-র গায়ের ছেড়া কম্বলখানার দিকে।
‘ওখান আমাকে দে।” আপত্তি ঠেলে সৌখী নিজের গায়ের নতুন কম্বলখানা মায়ের গায়ে জড়িয়ে দিল।
নতুন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েও বুড়ির ঘুম আসতে চায় না। পা কিছুতেই গরম হয় না, রাজ্যের দুশ্চিন্তায় মাথা গরম হয়ে উঠেছে। সৌখীর নাকডাকানির একঘেয়ে শব্দ কানে আসছে। এতদিন পর ছেলে বাড়ি এল; কোথায় নিশ্চিন্ত হবে, তা নয়, সৌখীকে কী খেতে দেবে কাল সকালে, সেই হয়েছে বুড়ির মস্ত ভাবনা। আজকের রাতটা না হয় বিক্রির খইমুড়ি দিয়ে কোনােরকমে চলে গেল।...যদি বলত দুটো ভাত খেতে ইচ্ছা। করছে, তাহলেই আর উপায় ছিল না, সব কথা না বলে। ...আলু-চচ্চড়ি খেতে কী ভালােই বাসে সৌখাটা! কতকাল হয়তাে জেলে খেতে পায়নি। আলু, চাল, সরষের তেল সবই কিনতে হবে। অত পয়সা পাব কোথায় ? ভােরে উঠেই কী ছেলেকে বলা যায় যে, আগে পয়সা জোগাড় করে আন, তবে বেঁধে দেব!...।
..কাছারির ঘড়িতে দুটো বাজল। ...ভেবে কূলকিনারা পাওয়া যায় না।..
মনে পড়ল যে, পেশকারসাহেবের বাড়ি রাজমিস্ত্রি লেগেছে। আজ যখন মুড়ি বেচতে গিয়েছিল তখন দেখেছে যে, পড়ে যাওয়া উত্তরের পাঁচিলটা গাঁথা হচ্ছে। বুড়ি বিছানা থেকে উঠে পা টিপে টিপে বেরােল ঘর থেকে।
মাতাদিন পেশকারের বাড়ি বেশি দূরে নয়। পাঁচিল সেদিন হাত দুই-আড়াই উঁচু পর্যন্ত গাঁথা হয়েছে। মাটি আর ভাঙা ইটের পাহাড় নীচে পড়ে থাকায়, সে পাঁচিল ভাঙতে বুড়ির বিশেষ অসুবিধা হল না।.. বাড়ি নিশুতি!
অন্ধকারে কী কোথায় আছে ঠাহর করা শক্ত। বারান্দায় দোরগােড়ায় গুছিয়ে রাখা রয়েছে পেশকার সাহেবের খড়মজোড়া, আর জলভরা ঘটি—ভােরে উঠেই দরকার লাগবে বলে।
ভয়ে বুড়ি উঠোনের আর কোথায় কী আছে, হাতড়ে হাতড়ে খুঁজবার চেষ্টা করল না। ঘটিটি তুলে নিয়ে পাঁচিল টপকে বাইরে বেরিয়ে এল নিঃশব্দে। জলটুকু পর্যন্ত ফেলেনি। এখন রাতদুপুরে লােটা হাতে যেতে দেখলেও কেউ সন্দেহ করবে না।
এদেশে লােটা বিনা সংসার অচল। দিনে বারকয়েক লােটা না মাজলে মাতাদিন পেশকারের হাত নিশপিশ করে। সেইজন্য হুলস্থুল পড়ে গেল তার বাড়িতে সকালবেলায়।
খােকার মা নাকে কেঁদে স্বামীকে মনে করিয়ে দিলেন যে, লােটা হল বাড়ির লক্ষ্মী; ...এখনই আর একটি কিনে আনা দরকার বাড়ির লক্ষ্মীশ্রী ফিরিয়ে আনতে হলে। কর্তার মেজাজ তখন তিরিক্ষি হয়ে আছে চোরের উপর রাগে।‘বাজে বক্ কোরাে না। তােমাদের তাে কেবল এই আইনের ধারায় স্পষ্ট লেখা আছে যে, চুরির খবর পুলিশকে না দিলে জেল পর্যন্ত হতে পারে; সে খবর রাখাে? 
 আইনচ মাতাদিন আরও অনেক ঝাঝালাে কথা খােকার মাকে শােনাতে শােনাতে বাড়ি থেকে বার হয়ে গেলেন থানায় খবর দেবার জন্য।
ফিরতিমুখে তিনি এলেন বাসনের দোকানে। নানা রকম ঘটি দেখাল দোকানদার; কিন্তু পছন্দসই কিছুতেই পাওয়া গেল না। পেশকারসাহেব বড়াে খুঁতখুতে লােটা সম্বন্ধে। তিনি চান খুরাে-দেওয়া লােটা—বুঝলেন কিনা—এই এত বড়াে সাইজের—মুখ হওয়া চাই বেশ ফাদালাে—যাতে বেশ হৃষ্টপুষ্ট মেয়েমানুষের এতখানি মােটা রুপাের কাকনসুস্থ হাত অনায়াসে ঢোকানাে যায়, ভিতরটা মাজবার জন্য। ...দোকানদার শেষকালে হাল ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করে—পুরােনাে হলে চলবে? নামেই পুরােনাে। সস্তায় পাবেন। আড়াই টাকায়।
পুরােনাে বাসনও বিক্রি হয় নাকি এখানে? দেখি।
ঘটি দেখেই তার খটকা লাগল। পকেট থেকে চশমা জোড়া বার করে নাকের ডগায় বসালেন। ...খুরাের নীচে ঠিক সেই তারা আঁকা! আর সন্দেহ নেই !..  
মাতাদিন পেশকার আইনের ধারা ভুলে গিয়ে দোকানদারের টুটি চেপে ধরেন।—'বল! এ লােটা কোখেকে পেলি? দিনে করিস দোকানদারি—আর রাতে বার হস সিঁধকাঠি নিয়ে!
একেবারে হই-হই-রইরই কাণ্ড। দোকানে লােক জড় হয়ে গেল। দোকানদার বলে যে, সে কিনেছে এই ঘটি নগদ চোদ্দো আনা পয়সা গুনে, সৌখীর মায়ের কাছ থেকে—এই কিছুক্ষণ মাত্র আগে।
‘চোদ্দো আনায় এই ঘটি পাওয়া যায় ? চোরাই মাল জেনেই কিনেছিস! চোরাই মাল রাখবার ফৌজদারি ধারা জানিস ?”
পেশকারসাহেব থানায় পাঠিয়ে দিলেন একজন ছােকরাকে, দারােগাকে ডেকে আনবার জন্য। চোর ধরা পড়বার পর দারােগাসাহেবের কাজে আর ঢিলেমি নেই। তখনই সাইকেলে এসে হাজির। সব ব্যাপার
শুনে তিনি সদলবলে সৌখীর বাড়িতে গিয়ে ঠেলে উঠলেন। সৌখীর মা আলুর তরকারি চড়িয়েছে উনােনে। ছেলে তখনও ওঠেনি বিছানা ছেড়ে।
অনেককাল জেলে ঘড়ি ধরে সকাল সকাল উঠতে হয়েছে; নতুন পাওয়া স্বাধীনতা উপভােগ করবার জন্য সৌখী মনে মনে ঠিক করেছে যে বেলা বারােটার আগে সে কিছুতেই আজ বিছানা ছেড়ে উঠবে না।
দারােগা-পুলিশ দেখে বুড়ির বুক কেঁপে ওঠে। পুলিশ দেখে ভয় পাবার লােক সে নয়; এর আগে কতবার সময়ে অসময়ে পুলিশকে তাদের বাড়িতে হানা দিতে দেখেছে। কিন্তু আজ যে ব্যাপার অন্য। মাতাদিন পেশকার আর বাসনওয়ালা যে পুলিশের সঙ্গে রয়েছে। তার যে ধারণা ছিল, বাসনওলা পুরােনাে বাসনগুলােকে রং-চং দিয়ে নতুনের মতাে না করে নিয়ে বিক্রি করে না.. পাঁচ-সাত বছর আগে পুলিশ একবার ভােররাত্রে তাদের বাড়ি ঘেরাও করছিল, বন্দুকের খোঁজে। তখন তাে মাথা হেঁট হয়নি তার। ডাকাতি করা তার স্বামী পুত্রের হকের নেশা। সে তাে মরদের কাজ; গর্বের জিনিস। জেলে যাওয়া সেক্ষেত্রে দূরদৃষ্টি মাত্র—তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। কিন্তু এ যে চুরি! ...ছিচকে চোরের কাজ, শেষকালে...
লজ্জায় সৌখীর মা অভিযােগ অস্বীকার করতে পর্যন্ত ভুলে গিয়েছে।
দারােগাসাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, তাকে, ‘তুই এই লােটা আজ বাজারে বাসনের দোকানে চোদ্দো আনায় বিক্রি করেছিস।
কোনাে জবাব বেরােল না বুড়ির মুখ দিয়ে। শুধু একবার ছেলের দিকে তাকিয়ে সে মাথা হেঁট করে নিল।
এতক্ষণে বােঝে সৌখী ব্যাপারটা। চোদ্দো আনা পয়সার জন্য মা শেষকালে একটা ঘটি চুরি করল! ...কেন মা তাকে বলল না! .এতদিন তার ডিউটি ছিল জেলখানার গুদামে। জেলের ঠিকেদারদের কাছ থেকে সে নব্বই টাকা রােজগার করে এনেছে। এখনও সে টাকা তার কোমরের বাটুয়ায় রয়েছে। মা তার কাছ থেকে চেয়ে নিল না কেন? মেয়েমানুষের আর কত আক্কেল হবে! হয়তাে ঘরদোরের দিকে তাকিয়ে এক নজরেই সংসারের দৈন্যদশার কথা আঁচ করে নেওয়া উচিত ছিল তার।... বুঝে, নিজে থেকেই মায়ের হাতে টাকা দেওয়া উচিত ছিল।..কিন্তু সে সময় পেল কই? রাতে এসে শুয়েছে; এতক্ষণ তাে। বিছানা ছেড়ে ওঠেইনি।...শেষ পর্যন্ত লােটা চুরি! জেলের মধ্যে ওই সব ছিচকে 'কদুচোর’দের সঙ্গে সে যে পারতপক্ষে কথা বলেনি কোনাে দিন!... ডাকাতরা জেলে আলাপ-সালাপ করে 'লাইফারদের সঙ্গে, এ কথা তাে মায়ের অজানা নয়। কদুচোরদের যে মাত্র দু-মাস তিন মাসের সাজা হয় ... মা কি জানে না যে...।
“এই বুড়ি! আমার কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন? বল। জবাব দে। বুড়ি নির্বাক। দারােগাবাবুর প্রশ্ন কানে গেল কী না, সে কথা বােঝাও যার না তার মুখ দেখে। আর থাকতে পারল না সৌখী। ‘দারােগাসাহেব, মেয়েমানুষকে নিয়ে টানাটানি করছেন কেন? আমি ঘটি চুরি করেছি কাল রাত্রে।
বিজ্ঞ দারােগাবাবু তার অনুচরদের দিকে বিজয়ীর দৃষ্টি হেনে ভাব দেখাতে চাইলেন যে, এত বেলা পর্যন্ত সৌখীদের ঘুমােতে দেখে, এ তিনি আগেই বুঝেছিলেন; শুধু বুড়ির মুখ দিয়ে কথাটা বার করে নিতে চাচ্ছিলেন এতক্ষণ।
এইবার সৌখীর মা ভেঙে পড়ল।...ছেলের নামে কলক এনেছে সে।...
‘না না কারােগাসাহেব! সৌখী করেনি, আমি করেছি। ওকে গ্রেপ্তার করবেন না। আমাকে করুন। ও কিছু জানে না। ও যে ঘুমুচ্ছিল। ওকে ছেড়ে দিন দারােগাসাহেব। এখনও যে বউ-ছেলের সঙ্গে দেখা হয়নি ওর।..
দারােগাবাবুর পায়ের উপর মাথা কুটছে বুড়ি। 
কিন্তু তিনি বাসনওলা কিংবা এই বুড়িটাকে নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না; তার দরকার আসল অপরাধীকে নিয়ে।
সৌখী যাবার সময় কোমর থেকে বাটুয়াটা বার করে রেখে দিয়ে গেল খাটিয়ার উপর।

মা তখনও মেঝেতে পড়ে ডুকরে ডুকরে কাদছে। উনােনে চড়ানাে আলুর তরকারির পোড়া গন্ধ সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়েছে।