সমাস


সমাস

সংজ্ঞাঃ শব্দকে সুন্দর করে বলবার জন্য পরস্পর অর্থ সম্বন্ধযুক্ত দুই বা ততোধিক শব্দকে একপদে পরিনত করার রীতি সমাস।

সমাস মূলত ৮ প্রকার-

  1. দ্বন্দ্ব সমাস
  2. দ্বিগু সমাস
  3. তৎপুরুষ সমাস
  4. বহুব্রীহি সমাস
  5. কর্মধারায় সমাস
  6. অলোপ সমাস
  7. নিত্য সমাস
  8. বাক্যাশ্রয়ী সমাস




দ্বন্দ্ব সমাস - যে সমাসে দুই বা ততোধিক অর্থ সম্বন্ধযুক্ত সমস্যমান পদ সংযোজক অব্যয় দ্বারা যুক্ত হয়ে সমস্তপদে পরিনত হয় এবং সমস্তপদে সমস্যমান প্রতিটি পদের অর্থই প্রধান রূপে প্রতীয়মান হয়, তাকে দ্বন্দ্ব সমাস বলে।
যেমন-
আসে ও যায় - আসে যায়
রবি ও শশী - রবিশশী

দ্বিগু সমাস - যে তৎপুরুষ জাতীয় সমাসের পূর্বপদ সংখ্যাবাচক বিশেষণের সঙ্গে বিশেষ্য জাতীয় উত্তরপদের সমাস হয় তাকে দ্বিগু সমাস বলে। দ্বিগু সমাসে সমস্ত পদটি বিশেষ্য হয়। 
যেমন-
চার মাথার সমাহার - চৌমাথা
সে ( তিন) তারের সমাহার - সেতার

তৎপুরুষ সমাস - যে সমাসে পূর্বপদের কর্ম - করণ - অপাদান ইত্যাদি কারকের বিভক্তি চিহ্ন কিংবা অনুসর্গের লোপ হয় , এবং পরপদের প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয় , তাকে তৎপুরুষ সমাস বলে। 
যেমন-
রথকে দেখা - রথ দেখা
দেবকে আশ্রিত - দেবাশ্রিত
.শ্রী দ্বারা যুক্ত - শ্রীযুক্ত
বিয়ের জন্য পাগলা - বিয়ে পাগলা
স্নাতক হতে উত্তর - স্নাতকোত্তর
মৌ এর চাক - মৌচাক
পথে চলা - পথ চলা
নয় সভ্য - অসভ্য
পঙ্কে জন্মে যা - পঙ্কজ
চিরকাল ব্যাপী সুখী - চিরসুখী
দৃঢ় ভাবে বদ্ধ - দৃঢ়বদ্ধ
প্রকৃষ্ট রূপে ভাত - প্রভাত

বহুব্রীহি সমাস -  যে সমাসে সমস্যমান পদ গুলির মধ্যে কোনো পদেরই অর্থ বিশেষ ভাবে প্রাধান্য পায় না অথচ উভয়পদ সম্মিলিত ভাবে তৃতীয় কোনো বস্তুকে প্রকাশ করে, তাকে বহুব্রীহি সমাস বলে। 
যেমন-
পানিতে জন্মেছে যে ফল - পানিফল
কানে কানে যে কথা - কানাকানি
স্ত্রীর সঙ্গে বর্তমান - সস্ত্রীক 
নাই পদার্থ যার - অপদার্থ 
এক চোখ যার - একচোখা
দশ আনন যার - দশানন

কর্মধারয় সমাস -   বিশেষণ  বিশেষণ পদে কিংবা বিশেষ  বিশেষণ পদে যে সমাস হয় এবং পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায় তাকে কর্মধারয় সমাস বলা হয় 
যেমন-
যিনি দেব তিনই ঋষি - দেবর্ষি
প্রানী বিষয়ক বিদ্যা - প্রানীবিদ্যা
বাবু ফুলের মত - ফুলবাবু
কাজলের মত কালো - কাজলকালো


অলোপ সমাস - যে সমাসে সমস্তপদে পূর্ব পদের বিভক্তি লোপ পায় না তাকে অলোপ সমাস বলে ।
যেমন-
হাটে ও ঘাটে - হাটে ঘাটে
তেলে ও বেগুনে - তেলে বেগুনে

নিত্য সমাসযে সমাসে সমস্যমান পদ গুলি নিত্য বা সবসময় এক রকম থাকে তাকে নিত্য সমাস বলে। 
যেমন-
অন্য মত - মতান্তর
অন্য পাঠ - পাঠান্তর
অন্য দেশ - দেশান্তর

বাক্যাশ্রয়ী সমাস - কখনো কখনো একটি সম্পূর্ণ বাক্য সমাসের মত ব্যবহৃত হয় । যাকে বাক্যাশ্রয়ী সমাস বলে। 
যেমন- 
বসে আঁকো প্রতিযোগিতা










অনুশীলনী
সমাস নির্ণয় করোঃ-

  1. খে-চর
  2. গড়ের মাঠ
  3. হতভাগা
  4. আসমুদ্র
  5. হাতছানি
  6. কালবৈশাখী
  7. হাতাহাতি
  8. বিমাতা
  9. নিমরাজি
  10. আধময়লা
  11. জলে চড়ে যে
  12. পেশ করে যে
  13. রাজ্য পালন করেন যিনি
  14. অমৃতের ন্যায় মধুর
  15. ধ্বনির সদৃশ
  16. হাতে কলমে
  17. তেপান্তর
  18. লোক লজ্জা
  19. পাতে পড়া
  20. ঘানির তেল
  21. দু- পন
  22. অচিন্ত্য
  23. অনর্থক
  24. সোজাসুজি
  25. বইটই
  26. গানবাজনা
  27. অনুতাপ
  28. সত্যবাদী
  29. পারিজাত
  30. চা -গরম


form

ebanglaschools

First name:

Last name:



মাধ্যমিক ২০২০ - প্রশ্নপত্র ২


ebanglaschools
Madhyamik 
Mock test 2
Full Marks - 25    Time: 50 munites
[ হাতের লেখা পরিস্কার বাঞ্ছনীয়। বানান ভূল হলে নম্বর কাটা যাবে ]

১। নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর দাও।    ৫ x ১
ক। দোয়াত কলম কত প্রকারের হয়?
খ। আফ্রিকা কবিতাটি কোন কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে?
গ। দিগম্বরের জটায় কে হাসে?
ঘ। “রত্নের মূল্য জহুরির কাছেই” –জহুরি বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে?
ঙ। অলোপ দ্বন্দ্ব সমাস কাকে বলে?

২। নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর দাও।  ২ x ৫
ক। অভিষেক কবিতা অবলম্বনে রাবণ চরিত্র আলোচনা করো।
খ। বিস্ফোরণ। কলম বিস্ফোরণ।”- কলমের বিস্ফোরণ বলতে লেখক কি বুঝিয়েছেন?

৩।
 নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর দাও।  ১ x ৫
ক। প্রবল বৃষ্টিতে বানভাসি মেদিনীপুর এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন রচনা করো।

৪।
 নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর দাও।  ৫ x
ক।
মামার বাড়িতে এসেছে তপন। ( কারক ও বিভক্তি )
খ। ছেলেটা এখনও পেমেন্টের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। ( কারক ও বিভক্তি )
গ। সে আজকে বিরিয়ানি খাবে। ( ন-ঞরথক বাক্যে রূপান্তর )
ঘ। তুমি আজকে সাদা কালো জামাটা পড়ে আসবে । ( সমাস নির্ণয় )
ঙ। রাজপথে আজ সাইকেল চলছে। ( সমাস নির্ণয় )
***
This questions in PDF format

বি.দ্র- অসদ উপায় অবলম্বন না করে যথাযথ ভাবে উত্তর পত্র তৈরী করে গৃহশিক্ষক কে দেখিয়ে তোমার বর্তমান স্থান সম্পর্কে সচেতন হও। 

উচ্চ মাধ্যমিক ২০২০ প্রশ্নপত্র ২

ebanglaschools
Mock test 2
Higher Secondary
Full Marks - 25    Time: 50ৃ munites
[ হাতের লেখা পরিস্কার বাঞ্ছনীয়। বানান ভূল হলে নম্বর কাটা যাবে ]

১। নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর দাও।    ৫ x ১
ক। ' রাতে রাতে কাজ সারতে হবে'- কোন কাজ সারার কথা বলা হয়েছে?
খ। পউষে বাদলা সম্পর্কে ডাক পুরুষের বচন কি?
গ। ' সে রীতিমত কাবু হয়ে পড়েছে - কে কি ভাবে কাবু হয়ে পড়েছে?
ঘ। 'ঘুরে ফিরে ঘরে আসে ' কার কথা বলা হয়েছে?
ঙ। তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞান কি?

২। নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর দাও।  ২ x ৫ ( আন্তর্জাতিক গল্প ও কবিতা )
ক। কত সব খবর কত সব প্রশ্ন - কবিতায় উল্লেখিত খবর ও প্রশ্ন গুলি উল্লেখ করো। 
খ। গল্পটা আমাদের স্কুলে শোনানো হতো -গল্পটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। 


৩। নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর দাও।  ১ x ৫ (আমার বাংলা)

ক। পচিশ ত্রিশ বছর আগের কথা- কোন কথা? কথাটি সংক্ষেপে আলোচনা করো।

৪। নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর দাও।  ৫ x ২


ক। শব্দার্থ পরিবর্তনের মূল কারণ আলোচনা করো।

খ। বাংলা চিত্রকলায় নন্দলাল বসুর অবদান আলোচনা করো। 
***
This questions in PDF format
বি.দ্র- অসদ উপায় অবলম্বন না করে যথাযথ ভাবে উত্তর পত্র তৈরী করে গৃহশিক্ষক কে দেখিয়ে তোমার বর্তমান স্থান সম্পর্কে সচেতন হও। 

চিন্তাশীল - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


চিন্তাশীল


প্রথম দৃশ্য
 নরহরি চিন্তায় নিমগ্ন। ভাত শুকাইতেছে। মা মাছি তাড়াইতেছেন

মা। অত ভেবো না, মাথার ব্যামো হবে বাছা!

নরহরি। আচ্ছা মা, ‘ বাছা ' শব্দের ধাতু কী বলো দেখি।

মা। কী জানি বাপু!

নরহরি। ‘ বৎ স '। আজ তুমি বলছ ‘ বাছা ' — দু-হাজার বৎ সর আগে বলত ‘ বৎ স ' — এই কথাটা একবার ভালো করে ভেবে দেখো দেখি মা! কথাটা বড়ো সামান্য নয়। এ কথা যতই ভাববে ততই ভাবনার শেষ হবে না।

পুনরায় চিন্তায় মগ্ন

মা। যে ভাবনা শেষ হয় না এমন ভাবনার দরকার কী বাপ! ভাবনা তো তোর চিরকাল থাকবে, ভাত যে শুকোয়। লক্ষী আমার, একবার ওঠ্‌।

নরহরি। ( চমকিয়া) কী বললে মা? লক্ষ্মী? কী আশ্চর্য! এক কালে লক্ষ্মী বলতে দেবী-বিশেষকে বোঝাত। পরে লক্ষ্মীর গুণ অনুসারে সুশীলা স্ত্রীলোককে লক্ষ্মী বলত, কালক্রমে দেখো পুরুষের প্রতিও লক্ষ্মী শব্দের প্রয়োগ হচ্ছে! একবার ভেবে দেখো মা, আস্তে আস্তে ভাষার কেমন পরিবর্তন হয়! ভাবলে আশ্চর্য হতে হবে।

ভাবনায় দ্বিতীয় ডুব

মা। আমার আর কি কোনো ভাবনা নেই নরু? আচ্ছা, তুই তো এত ভাবিস, তুইই বল্‌ দেখি উপস্থিত কাজ উপস্থিত ভাবনা ছেড়ে কি এই-সব বাজে ভাবনা নিয়ে থাকা ভালো? সকল ভাবনারই তো সময় আছে।

নরহরি। এ কথাটা বড়ো গুরুতর মা! আমি হঠাৎ এর উত্তর দিতে পারব না। এটা কিছুদিন ভাবতে হবে, ভেবে পরে বলব।

মা। আমি যে কথাই বলি তোর ভাবনা তাতে কেবল বেড়েই ওঠে, কিছুতেই আর কমে না। কাজ নেই বাপু, আমি আর-কাউকে পাঠিয়ে দিই।

[ প্রস্থান ]

মাসিমা। ছি নরু, তুই কি পাগল হলি? ছেঁড়া চাদর, একমুখ দাড়ি — সমুখে ভাত নিয়ে ভাবনা! সুবলের মা তোকে দেখে হেসেই কুরুক্ষেত্র!

নরহরি। কুরুক্ষেত্র! আমাদের আর্যগৌরবের শ্মাশানক্ষেত্র! মনে পড়লে কি শরীর লোমাঞ্চিত হয় না! অন্তঃকরণ অধীর হয়ে ওঠে না! আহা, কত কথা মনে পড়ে! কত ভাবনাই জেগে ওঠে! বলো কী মাসি! হেসেই কুরুক্ষেত্র! তার চেয়ে বলো-না কেন কেঁদেই কুরুক্ষেত্র!

অশ্রুনিপাত

মাসিমা। ওমা, এ যে কাঁদতে বসল! আমাদের কথা শুনলেই এর শোক উপস্থিত হয়। কাজ নেই বাপু!

[ প্রস্থান]
দিদিমার প্রবেশ

দিদিমা। ও নরু, সূর্য যে অস্ত যায়!

নরহরি। ছি দিদিমা, সূর্য অস্ত যায় না। পৃথিবীই উলটে যায়। রোসো, আমি তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। ( চারি দিকে চাহিয়া) একটা গোল জিনিস কোথাও নেই?

দিদিমা। এই তোমার মাথা আছে — মুণ্ডু আছে।

নরহরি। কিন্তু মাথা যে বদ্ধ, মাথা যে ঘোরে না।

দিদিমা। তোমারই ঘোরে না, তোমার রকম দেখে পাড়াসুদ্ধ লোকের মাথা ঘুরছে! নাও, আর তোমায় বোঝাতে হবে না, এ দিকে ভাত জুড়িয়ে গেল, মাছি ভন্‌ ভন্‌ করছে।

নরহরি। ছি দিদিমা, এটা যে তুমি উলটো কথা বললে! মাছি তো ভন্‌ ভন্‌ করে না। মাছির ডানা থেকেই এইরকম শব্দ হয়। রোসো, আমি তোমাকে প্রমাণ করে দিচ্ছি —

দিদিমা। কাজ নেই তোমার প্রমাণ করে।

[ প্রস্থান


দ্বিতীয় দৃশ্য


নরহরি চিন্তামগ্ন। ভাবনা ভাঙাইবার উদ্দেশে নরহরির শিশু ভাগিনেয়কে কোলে করিয়া মাতার প্রবেশ

মা। ( শিশুর প্রতি) জাদু, তোমার মামাকে দণ্ডবৎ করো।

নরহরি। ছি মা, ওকে ভুল শিখিয়ো না। একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবে, ব্যাকরণ-অনুসারে দণ্ডবৎ করা হতেই পারে না — দণ্ডবৎ হওয়া বলে। কেন বুঝতে পেরেছ মা? কেননা দণ্ডবৎ মানে-

মা। না বাবা, আমাকে পরে বুঝিয়ে দিলেই হবে। তোমার ভাগ্‌নেকে এখন একটু আদর করো।

নরহরি। আদর করব? আচ্ছা, এসো আদর করি। ( শিশুকে কোলে লইয়া) কী করে আদর আরম্ভ করি? রোসো, একটু ভাবি।

চিন্তামগ্ন

মা। আদর করবি, তাতেও ভাবতে হবে নরু?

নরহরি। ভাবতে হবে না মা? বল কী! ছেলেবেলাকার আদরের উপরে ছেলের সমস্ত ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তা কি জান? ছেলেবেলাকার এক-একটা সামান্য ঘটনার ছায়া বৃহৎ আকার ধরে আমাদের সমস্ত যৌবনকালকে, আমাদের সমস্ত জীবনকে আচ্ছন্ন করে রাখে এটা যখন ভেবে দেখা যায় — তখন কি ছেলেকে আদর করা একটা সামান্য কাজ বলে মনে করা যায়? এইটে একবার ভেবে দেখো দেখি মা!

মা। থাক্‌ বাবা, সে কথা আর-একটু পরে ভাবব, এখন তোমার ভাগ্‌নেটির সঙ্গে দুটো কথা কও দেখি।

নরহরি। ওদের সঙ্গে এমন কথা কওয়া উচিত যাতে ওদের আমোদ এবং শিক্ষা দুই হয়। আচ্ছা, হরিদাস, তোমার নামের সমাস কী বলো দেখি।
হরিদাস। আমি চমা কাব।

মা। দেখো দেখি বাছা, ওকে এ-সব কথা জিগেস কর কেন? ও কী জানে!

নরহরি। না, ওকে এই বেলা থেকে এইরকম করে অল্পে অল্পে মুখস্থ করিয়ে দেব।

মা। ( ছেলে তুলিয়া লইয়া) না বাবা, কাজ নেই তোমার আদর করে।

নরহরি মাথায় হাত দিয়া পুনশ্চ চিন্তায় মগ্ন

(কাতর হইয়া ) বাবা, আমায় কাশী পাঠিয়ে দে, আমি কাশীবাসী হব।

নরহরি। তা যাও-না মা! তোমার ইচ্ছে হয়েছে, আমি বাধা দেব না।

মা। ( স্বগত) নরু আমার সকল কথাতেই ভেবে অস্থির হয়ে পড়ে, এটাতে বড়ো বেশি ভাবতে হল না। ( প্রকাশ্যে) তা হলে তো আমাকে মাসে মাসে কিছু টাকার বন্দোবস্ত করে দিতে হবে।

নরহরি। সত্যি নাকি? তা হলে আমাকে আর কিছুদিন ধরে ভাবতে হবে। একথা নিতান্ত সহজ নয়। আমি এক হপ্তা ভেবে পরে বলব।

মা। ( ব্যস্ত হইয়া) না বাবা, তোমার আর ভাবতে হবে না — আমার কাশী গিয়ে কাজ নেই।

ডাকঘর - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


ডাকঘর


মাধব দত্ত। মুশকিলে পড়ে গেছি। যখন ও ছিল না, তখন ছিলই না– কোনো ভাবনাই ছিল না। এখন ও কোথা থেকে এসে আমার ঘর জুড়ে বসল; ও চলে গেলে আমার এ ঘর যেন আর ঘরই থাকবে না। কবিরাজমশায়, আপনি কি মনে করেন ওকে–

কবিরাজ। ওর ভাগ্যে যদি আয়ু থাকে, তা হলে দীর্ঘকাল বাঁচতেও পারে; কিন্তু আয়ুর্বেদে যেরকম লিখছে তাতে তো –

মাধব দত্ত। বলেন কী!

কবিরাজ। শাস্ত্র বলছেন, পৈত্তিকান্‌ সন্নিপাতজান্‌ কফবাতসমুদ্‌ভবান্‌—

মাধব দত্ত। থাক্‌ থাক্‌, আপনি আর ঐ শ্লোকগুলো আওড়াবেন না —ওতে আরো আমার ভয় বেড়ে যায়। এখন কী করতে হবে সেইটে বলে দিন।

কবিরাজ। (নস্য লইয়া) খুব সাবধানে রাখতে হবে।

মাধব দত্ত। সে তো ঠিক কথা, কিন্তু কী বিষয়ে সাবধান হতে হবে সেইটে স্থির করে দিয়ে যান।

কবিরাজ। আমি তো পূর্বেই বলেছি, ওকে বাইরে একেবারে যেতে দিতে পারবেন না।

মাধব দত্ত। ছেলেমানুষ, ওকে দিনরাত ঘরের মধ্যে ধরে রাখা যে ভারি শক্ত।

কবিরাজ। তা কী করবেন বলেন। এই শরৎকালের রৌদ্র আর বায়ু দুই-ই ঐ বালকের পক্ষে বিষবৎ— কারণ কিনা শাস্ত্রে বলছে, অপস্মারে জ্বরে কাশে কামলায়াং হলীমকে—

মাধব দত্ত। থাক্‌ থাক্‌, আপনার শাস্ত্র থাক্‌। তা হলে ওকে বন্ধ করেই রেখে দিতে হবে —অন্য কোনো উপায় নেই?

কবিরাজ। কিছু না, কারণ, পবনে তপনে চৈব –

মাধব দত্ত। আপনার ও চৈব নিয়ে আমার কী হবে বলেন তো। ও থাক্‌-না —কী করতে হবে সেইটে বলে
দিন। কিন্তু আপনার ব্যবস্থা বড়ো কঠোর। রোগের সমস্ত দুঃখ ও-বেচারা চুপ করে সহ্য করে —কিন্তু আপনার ওষুধ খাবার সময় ওর কষ্ট দেখে আমার বুক ফেটে যায়।

কবিরাজ। সেই কষ্ট যত প্রবল তার ফলও তত বেশি —তাই তো মহর্ষি চ্যবন বলেছেন, ভেষজং হিতবাক্যঞ্চ তিক্তং আশুফলপ্রদং। আজ তবে উঠি দত্তমশায়!

[ প্রস্থান ঠাকুরদার প্রবেশ]

মাধব দত্ত। ঐ রে ঠাকুরদা এসেছে! সর্বনাশ করলে!

ঠাকুরদা। কেন? আমাকে তোমার ভয় কিসের?

মাধব দত্ত। তুমি যে ছেলে খেপাবার সদ্দার।

ঠাকুরদা। তুমি তো ছেলেও নও, তোমার ঘরেও ছেলে নেই —তোমার খেপবার বয়সও গেছে —তোমার ভাবনা কী।

মাধব দত্ত। ঘরে যে ছেলে একটি এনেছি।

ঠাকুরদা। সে কিরকম।

মাধব দত্ত। আমার স্ত্রী যে পোষ্যপুত্র নেবার জন্যে ক্ষেপে উঠেছিল।

ঠাকুরদা। সে তো অনেকদিন থেকে শুনছি, কিন্তু তুমি যে নিতে চাও না।

মাধব দত্ত। জান তো ভাই, অনেক কষ্টে টাকা করেছি, কোথা থেকে পরের ছেলে এসে আমার বহু পরিশ্রমের ধন বিনা পরিশ্রমে ক্ষয় করতে থাকবে, সে কথা মনে করলেও আমার খারাপ লাগত। কিন্তু এই ছেলেটিকে আমার যে কিরকম লেগে গিয়েছে–

ঠাকুরদা। তাই এর জন্যে টাকা যতই খরচ করছ, ততই মনে করছ, সে যেন টাকার পরম ভাগ্য।
মাধব দত্ত। আগে টাকা রোজগার করতুম, সে কেবল একটা নেশার মতো ছিল —না করে কোনোমতে থাকতে পারতুম না। কিন্তু এখন যা টাকা করছি, সবই ঐ ছেলে পাবে জেনে উপার্জনে ভারি একটা আনন্দ পাচ্ছি।

ঠাকুরদা। বেশ, বেশ ভাই, ছেলেটি কোথায় পেলে বলো দেখি।

মাধব দত্ত। আমার স্ত্রীর গ্রামসম্পর্কে ভাইপো। ছোটোবেলা থেকে বেচারার মা নেই। আবার সেদিন তার বাপও মারা গেছে।

ঠাকুরদা। আহা! তবে তো আমাকে তার দরকার আছে।

মাধব দত্ত। কবিরাজ বলছে তার ঐটুকু শরীরে একসঙ্গে বাত পিত্ত শ্লেষ্মা যে-রকম প্রকুপিত হয়ে উঠেছে, তাতে তার আর বড়ো আশা নেই। এখন একমাত্র উপায় তাকে কোনোরকমে এই শরতের রৌদ্র আর বাতাস থেকে বাঁচিয়ে ঘরে বন্ধ করে রাখা। ছেলেগুলোকে ঘরের বার করাই তোমার এই বুড়োবয়সের খেলা —তাই তোমাকে ভয় করি।
ঠাকুরদা। মিছে বল নি —একেবারে ভয়ানক হয়ে উঠেছি আমি, শরতের রৌদ্র আর হাওয়ারই মতো। কিন্তু ভাই, ঘরে ধরে রাখবার মতো খেলাও আমি কিছু জানি। আমার কাজকর্ম একটু সেরে আসি, তার পরে ঐ ছেলেটির সঙ্গে ভাব করে নেব।

[ প্রস্থান অমল গুপ্তের প্রবেশ]

অমল। পিসেমশায়!

মাধব দত্ত। কী অমল?

অমল। আমি কি ঐ উঠোনটাতেও যেতে পারব না?

মাধব দত্ত। না বাবা!

অমল। ঐ যেখানটাতে পিসিমা জাঁতা দিয়ে ডাল ভাঙেন। ঐ দেখো-না, যেখানে ভাঙা ডালের খুদগুলি দুই হাতে তুলে নিয়ে লেজের উপর ভর দিয়ে বসে কাঠবিড়ালি কুটুস কুটুস করে খাচ্ছে —ওখানে আমি যেতে পারব না?

মাধব দত্ত। না বাবা!

অমল। আমি যদি কাঠবিড়ালি হতুম তবে বেশ হত। কিন্তু পিসেমশায়, আমাকে কেন বেরোতে দেবে না?

মাধব দত্ত। কবিরাজ যে বলেছে বাইরে গেলে তোমার অসুখ করবে।

অমল। কবিরাজ কেমন করে জানলে?

মাধব দত্ত। বল কী অমল! কবিরাজ জানবে না! সে যে এত বড়ো বড়ো পুঁথি পড়ে ফেলেছে!

অমল। পুঁথি পড়লেই কি সমস্ত জানতে পারে?

মাধব দত্ত। বেশ! তাও বুঝি জান না!

অমল। (দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া) আমি যে পুঁথি কিছুই পড়ি নি —তাই জানি নে।

মাধব দত্ত। দেখো, বড়ো বড়ো পণ্ডিতেরা সব তোমারই মতো —তারা ঘর থেকে তো বেরোয় না।

অমল। বেরোয় না?

মাধব দত্ত। না, কখন বেরোবে বলো। তারা বসে বসে কেবল পুঁথি পড়ে —আর-কোনো দিকেই তাদের চোখ নেই। অমলবাবু, তুমিও বড়ো হলে পণ্ডিত হবে—বসে বসে এই এত বড়ো বড়ো সব পুথিঁ পড়বে – সেবাই দেখে আশ্চর্য হয়ে যাবে।

অমল। না, না পিসেমশায়, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমি পণ্ডিত হব না —পিসেমশায়, আমি পণ্ডিত হব না।

মাধব দত্ত। সে কী কথা অমল! যদি পণ্ডিত হতে পারতুম, তা হলে আমি তো বেঁচে যেতুম।

অমল। আমি, যা আছে সব দেখব —কেবলই দেখে বেড়াব।

মাধব দত্ত। শোনো একবার! দেখবে কী? দেখবার এত আছেই বা কী?

অমল। আমাদের জানলার কাছে বসে সেই-যে দূরে পাহাড় দেখা যায় —আমার ভারি ইচ্ছে করে ঐ পাহাড়টা পার হয়ে চলে যাই।

মাধব দত্ত। কী পাগলের মতো কথা! কাজ নেই কর্ম নেই, খামকা পাহাড়টা পার হয়ে চলে যাই! কী যে বলে তার ঠিক নেই। পাহাড়টা যখন মস্ত বেড়ার মতো উঁচু হয়ে আছে তখন তো বুঝতে হবে ওটা পেরিয়ে যাওয়া বারণ – নইলে এত বড়ো বড়ো পাথর জড়ো করে এতবড়ো একটা কাণ্ড করার দরকার কী ছিল!

অমল। পিসেমশায়, তোমার কি মনে হয় ও বারণ করছে? আমার ঠিক বোধ হয় পৃথিবীটা কথা কইতে পারে না, তাই অমনি করে নীল আকাশে হাত তুলে ডাকছে। অনেক দূরের যারা ঘরের মধ্যে বসে থাকে তারাও দুপুরবেলা একলা জানলার ধারে বসে ঐ ডাক শুনতে পায়। পণ্ডিতরা বুঝি শুনতে পায় না?

মাধব দত্ত। তারা তো তোমার মতো খেপা নয়—তারা শুনতে চায়ও না।

অমল। আমার মতো খেপা আমি কালকে একজনকে দেখেছিলুম।

মাধব দত্ত। সত্যি নাকি? কী রকম শুনি।

অমল। তার কাঁধে এক বাঁশের লাঠি। লাঠির আগায় একটা পুঁটুলি বাঁধা। তার বাঁ হাতে একটা ঘটি। পুরানো একজোড়া নাগরাজুতো পরে সে এই মাঠের পথ দিয়ে ঐ পাহাড়ের দিকেই যাচ্ছিল। আমি তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলুম, তুমি কোথায় যাচ্ছ? সে বললে, কী জানি, যেখানে হয়। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, কেন যাচ্ছ? সে বললে, কাজ খুঁজতে যাচ্ছি। আচ্ছা পিসেমশায়, কাজ কি খুঁজতে হয়?

মাধব দত্ত। হয় বৈকি। কত লোক কাজ খুঁজে বেড়ায়।

অমল। বেশ তো। আমিও তাদের মতো কাজ খুঁজে বেড়াব।

মাধব দত্ত। খুঁজে যদি না পাও?

অমল। খুঁজে যদি না পাই তো আবার খুঁজব। তার পরে সেই নাগরাজুতো পরা লোকটা চলে গেল —আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলুম। সেই যেখানে ডুমুরগাছের তলা দিয়ে ঝরনা বয়ে যাচ্ছে, সেইখানে সে লাঠি নামিয়ে রেখে ঝরনার জলে আস্তে আস্তে পা ধুয়ে নিলে —তার পরে পুঁটুলি খুলে ছাতু বের করে জল দিয়ে মেখে নিয়ে খেতে লাগল। খাওয়া হয়ে গেলে আবার পুঁটুলি বেঁধে ঘাড়ে করে নিলে —পায়ের কাপড় গুটিয়ে নিয়ে সেই ঝরনার ভিতর নেমে জল কেটে কেটে কেমন পার হয়ে চলে গেল। পিসিমাকে বলে রেখেছি ঐ ঝরনার ধারে গিয়ে একদিন আমি ছাতু খাব।

মাধব দত্ত। পিসিমা কী বললে?

অমল। পিসিমা বললেন, তুমি ভালো হও, তার পর তোমাকে ঐ ঝরনার ধারে নিয়ে গিয়ে ছাতু খাইয়ে আনব। কবে আমি ভালো হব?

মাধব দত্ত। আর তো দেরি নেই বাবা!

অমল। দেরি নেই? ভালো হলেই কিন্তু আমি চলে যাব।

মাধব দত্ত। কোথায় যাবে?

অমল। কত বাঁকা বাঁকা ঝরনার জলে আমি পা ডুবিয়ে ডুবিয়ে পার হতে হতে চলে যাব —দুপুরবেলায় সবাই যখন ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে, তখন আমি কোথায় কতদূরে কেবল কাজ খুঁজে খুঁজে বেড়াতে বেড়াতে চলে যাব।

মাধব দত্ত। আচ্ছা বেশ, আগে তুমি ভালো হও, তার পরে তুমি —

অমল। তার পরে আমাকে পণ্ডিত হতে বোলো না পিসেমশায়!

মাধব দত্ত। তুমি কী হতে চাও বলো।

অমল। এখন আমার কিছু মনে পড়ছে না —আচ্ছা আমি ভেবে বলব।

মাধব দত্ত। কিন্তু তুমি অমন করে যে-সে বিদেশী লোককে ডেকে ডেকে কথা বোলো না।

অমল। বিদেশী লোক আমার ভারি ভালো লাগে।

মাধব দত্ত। যদি তোমাকে ধরে নিয়ে যেত?

অমল। তা হলে তো সে বেশ হত। কিন্তু আমাকে তো কেউ ধরে নিয়ে যায় না —সব্বাই কেবল বসিয়ে রেখে দেয়।

মাধব দত্ত। আমার কাজ আছে আমি চললুম —কিন্তু বাবা দেখো, বাইরে যেন বেরিয়ে যেয়ো না।

অমল। যাব না। কিন্তু পিসেমশায়, রাস্তার ধারের এই ঘরটিতে আমি বসে থাকব।



দইওআলা। দই —দই —ভালো দই!

অমল। দইওআলা, দইওআলা, ও দইওআলা!

দইওআলা। ডাকছ কেন? দই কিনবে?

অমল। কেমন করে কিনব! আমার তো পয়সা নেই।

দইওআলা। কেমন ছেলে তুমি। কিনবে না তো আমার বেলা বইয়ে দাও কেন?

অমল। আমি যদি তোমার সঙ্গে চলে যেতে পারতুম তো যেতুম।

দইওআলা। আমার সঙ্গে!

অমল। হাঁ। তুমি যে কত দূর থেকে হাঁকতে হাঁকতে চলে যাচ্ছ শুনে, আমার মন কেমন করছে।

দইওআলা। (দধির বাঁক নামাইয়া) বাবা, তুমি এখানে বসে কী করছ?

অমল। কবিরাজ আমাকে বেরোতে বারণ করেছে, তাই আমি সারাদিন এইখেনেই বসে থাকি।

দইওআলা। আহা, বাছা তোমার কী হয়েছে?
অমল। আমি জানি নে। আমি তো কিচ্ছু পড়ি নি, তাই আমি জানি নে আমার কী হয়েছে। দইওআলা, তুমি কোথা থেকে আসছ?

দইওআলা। আমাদের গ্রাম থেকে আসছি।

অমল। তোমাদের গ্রাম? অনে—ক দূরে তোমাদের গ্রাম?

দইওআলা। আমাদের গ্রাম সেই পাঁচমুড়া পাহাড়ের তলায়। শামলী নদীর ধারে।

অমল। পাঁচমুড়া পাহাড় —শামলী নদী —কী জানি,হয়তো তোমাদের গ্রাম দেখেছি —কবে সে আমার মনে পড়ে না।

দইওআলা। তুমি দেখেছ? পাহাড়তলায় কোনোদিন গিয়েছিলে নাকি?

অমল। না, কোনোদিন যাই নি। কিন্তু আমার মনে হয় যেন আমি দেখেছি। অনেক পুরোনোকালের খুব বড়ো বড়ো গাছের তলায় তোমাদের গ্রাম —একটি লাল রঙের রাস্তার ধারে। না?

দইওআলা। ঠিক বলেছ বাবা।

অমল। সেখানে পাহাড়ের গায়ে সব গোরু চরে বেড়াচ্ছে।

দইওআলা। কী আশ্চর্য! ঠিক বলছ। আমাদের গ্রামে গোরু চরে বৈকি, খুব চরে।

অমল। মেয়েরা সব নদী থেকে জল তুলে মাথায় কলসী করে নিয়ে যায় – তাদের লাল শাড়ি পরা।

দইওআলা। বা! বা! ঠিক কথা। আমাদের সব গয়লাপাড়ার মেয়েরা নদী থেকে জল তুলে তো নিয়ে যায়ই। তবে কিনা তারা সবাই যে লাল শাড়ি পরে তা নয় —কিন্তু বাবা, তুমি নিশ্চয় কোনোদিন সেখানে বেড়াতে গিয়েছিলে!

অমল। সত্যি বলছি দইওআলা, আমি একদিনও যাই নি। কবিরাজ যেদিন আমাকে বাইরে যেতে বলবে সেদিন তুমি নিয়ে যাবে তোমাদের গ্রামে?

দইওআলা। যাব বই কি বাবা, খুব নিয়ে যাব!

অমল। আমাকে তোমার মতো ঐরকম দই বেচতে শিখিয়ে দিয়ো। ঐরকম বাঁক কাঁধে নিয়ে —ঐরকম খুব দূরের রাস্তা দিয়ে।

দইওআলা। মরে যাই! দই বেচতে যাবে কেন বাবা? এত এত পুঁথি পড়ে তুমি পণ্ডিত হয়ে উঠবে।

অমল। না, না, আমি কক্‌খনো পণ্ডিত হব না। আমি তোমাদের রাঙা রাস্তার ধারে তোমাদের বুড়ো বটের তলায় গোয়ালপাড়া থেকে দই নিয়ে এসে দূরে দূরে গ্রামে গ্রামে বেচে বেচে বেড়াব। কী রকম করে তুমি বল, দই, দই, দই —ভালো দই। আমাকে সুরটা শিখিয়ে দাও।

দইওআলা। হায় পোড়াকপাল! এ সুরও কি শেখবার সুর!

অমল। না, না, ও আমার শুনতে খুব ভালো লাগে। আকাশের খুব শেষ থেকে যেমন পাখির ডাক শুনলে মন উদাস হয়ে যায় —তেমনি ঐ রাস্তার মোড় থেকে ঐ গাছের সারির মধ্যে দিয়ে যখন তোমার ডাক আসছিল, আমার মনে হচ্ছিল —কী জানি কী মনে হচ্ছিল!

দইওআলা। বাবা, এক ভাঁড় দুই তুমি খাও।

অমল। আমার তো পয়সা নেই।

দইওআলা। না না না না —পয়সার কথা বোলো না। তুমি আমার দই একটু খেলে আমি কত খুশি হব।

অমল। তোমার কি অনেক দেরি হয়ে গেল?

ইওআলা। কিচ্ছু দেরি হয় নি বাবা, আমার কোনো লোকসান হয় নি। দই বেচতে যে কত সুখ সে তোমার কাছে শিখে নিলুম।

[ প্রস্থান ]

অমল। (সুর করিয়া), দই, দই, দই, ভালো দই! সেই পাঁচমুড়া পাহাড়ের তলায় শামলী নদীর ধারে গয়লাদের বাড়ির দই। তারা ভোরের বেলায় গাছের তলায় গোরু দাঁড় করিয়ে দুধ দোয়, সন্ধ্যাবেলায় মেয়েরা দই পাতে, সেই দই। দই, দই, দই —ই, ভালো দই! এই-যে রাস্তায় প্রহরী পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। প্রহরী, প্রহরী, একটিবার শুনে যাওনা প্রহরী!


[প্রহরীর প্রবেশ]


প্রহরী। অমন করে ডাকাডাকি করছ কেন? আমাকে ভয় কর না তুমি?

অমল। কেন, তোমাকে কেন ভয় করব?

প্রহরী। যদি তোমাকে ধরে নিয়ে যাই।

অমল। কোথায় ধরে নিয়ে যাবে? অনেক দূরে? ঐ পাহাড় পেরিয়ে?

প্রহরী। একেবারে রাজার কাছে যদি নিয়ে যাই।

অমল। রাজার কাছে? নিয়ে যাও-না আমাকে। কিন্তু আমাকে যে করিরাজ বাইরে যেতে বারণ করেছে। আমাকে কেউ কোত্থাও ধরে নিয়ে যেতে পারবে না —আমাকে কেবল দিনরাত্রি এখানেই বসে থাকতে হবে।

প্রহরী। কবিরাজ বারণ করেছে? আহা, তাই বটে —তোমার মুখ যেন সাদা হয়ে গেছে। চোখের কোলে কালি পড়েছে। তোমার হাত দুখানিতে শিরগুলি দেখা যাচ্ছে।

অমল। তুমি ঘণ্টা বাজাবে না প্রহরী?

প্রহরী। এখনো সময় হয় নি।

অমল। কেউ বলে ‘সময় বয়ে যাচ্ছে’, কেউ বলে ‘সময় হয় নি’। আচ্ছা, তুমি ঘণ্টা বাজিয়ে দিলেই তো সময় হবে?

প্রহরী। সে কি হয়! সময় হলে তবে আমি ঘণ্টা বাজিয়ে দিই।

অমল। বেশ লাগে তোমার ঘণ্টা— আমার শুনতে ভারি ভালো লাগে— দুপুরবেলা আমাদের বাড়িতে যখন সকলেরই খাওয়া হয়ে যায়— পিসেমশায় কোথায় কাজ করতে বেরিয়ে যান, পিসিমা রামায়ণ পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েন, আমাদের খুদে কুকুরটা উঠোনে ঐ কোণের ছায়ায় লেজের মধ্যে মুখ গুঁজে ঘুমোতে থাকে – তখন তোমার ঐ ঘণ্টা বাজে – ঢং ঢং ঢং, ঢং ঢং ঢং। তোমার ঘণ্টা কেন বাজে?

প্রহরী। ঘণ্টা এই কথা সবাইকে বলে, সময় বসে নেই, সময় কেবলই চলে যাচ্ছে।

অমল। কোথায় চলে যাচ্ছে? কোন্‌ দেশে?

প্রহরী। সে কথা কেউ জানে না।

অমল। সে দেশ বুঝি কেউ দেখে আসে নি? আমার ভারি ইচ্ছে করছে ঐ সময়ের সঙ্গে চলে যাই —যে দেশের কথা কেউ জানে না সেই অনেক দূরে।

প্রহরী। সে দেশে সবাইকে যেতে হবে বাবা!

অমল। আমাকেও যেতে হবে?
প্রহরী। হবে বৈকি!

অমল। কিন্তু কবিরাজ যে আমাকে বাইরে যেতে বারণ করেছে।

প্রহরী। কোন্‌‌‍দিন কবিরাজই হয়তো স্বয়ং হাতে ধরে নিয়ে যাবেন!

অমল। না না, তুমি তাকে জান না, সে কেবলই ধরে রেখে দেয়।

প্রহরী। তার চেয়ে ভালো কবিরাজ যিনি আছেন, তিনি এসে ছেড়ে দিয়ে যান।

অমল। আমার সেই ভালো কবিরাজ কবে আসবেন? আমার যে আর বসে থাকতে ভালো লাগছে না।

প্রহরী। অমন কথা বলতে নেই বাবা!

অমল। না —আমি তো বসেই আছি —যেখানে আমাকে বসিয়ে রেখেছে সেখান থেকে আমি তো বেরোই নে —কিন্তু তোমার ঐ ঘণ্টা বাজে ঢং ঢং ঢং —আর আমার মন-কেমন করে। আচ্ছা প্রহরী!

প্রহরী। কী বাবা?

অমল। আচ্ছা, ঐ-যে রাস্তার ওপারের বড়ো বাড়িতে নিশেন উড়িয়ে দিয়েছে, আর ওখানে সব লোকজন কেবলই আসছে যাচ্ছে —ওখানে কী হয়েছে?

প্রহরী। ওখানে নতুন ডাকঘর বসেছে।

অমল। ডাকঘর? কার ডাকঘর?

প্রহরী। ডাকঘর আর কার হবে? রাজার ডাকঘর। —এ ছেলেটি ভারি মজার।

অমল। রাজার ডাকঘরে রাজার কাছ থেকে সব চিঠি আসে?

প্রহরী। আসে বৈকি। দেখো, একদিন তোমার নামেও চিঠি আসবে।

অমল। আমার নামেও চিঠি আসবে? আমি যে ছেলেমানুষ।

প্রহরী। ছেলেমানুষকে রাজা এতটুকু-টুকু ছোট্ট ছোট্ট চিঠি লেখেন।

অমল। বেশ হবে। আমি কবে চিঠি পাব? আমাকেও তিনি চিঠি লিখবেন তুমি কেমন করে জানলে?

প্রহরী। তা নইলে তিনি ঠিক তোমার এই খোলা জানলাটার সামনেই অতবড়ো একটা সোনালি রঙের নিশেন উড়িয়ে ডাকঘর খুলতে যাবেন কেন? —ছেলেটাকে আমার বেশ লাগছে।

অমল। আচ্ছা, রাজার কাছ থেকে আমার চিঠি এলে আমাকে কে এনে দেবে?

প্রহরী। রাজার যে অনেক ডাক-হরকরা আছে —দেখ নি বুকে গোল গোল সোনার তক্‌মা প’রে তারা ঘুরে বেড়ায়।

অমল। আচ্ছা, কোথায় তারা ঘোরে?

প্রহরী। ঘরে ঘরে, দেশে দেশে। —এর প্রশ্ন শুনলে হাসি পায়।

অমল। বড়ো হলে আমি রাজার ডাক-হরকরা হব।

প্রহরী। হা হা হা হা! ডাক-হরকরা! সে ভারি মস্ত কাজ! রোদ নেই বৃষ্টি নেই, গরিব নেই বড়োমানুষ নেই, সকলের ঘরে ঘরে চিঠি বিলি করে বেড়ানো —সে খুব জবর কাজ!

অমল। তুমি হাসছ কেন! আমার ঐ কাজটাই সকলের চেয়ে ভালো লাগছে। না না, তোমার কাজও খুব ভালো –দুপুরবেলা যখন রোদ্দুর ঝাঁঝাঁ করে, তখন ঘণ্টা বাজে ঢং ঢং ঢং —আবার এক-এক দিন রাত্রে হঠাৎ বিছানায় জেগে উঠে দেখি ঘরের প্রদীপ নিবে গেছে, বাইরের কোন্‌ অন্ধকারের ভিতর দিয়ে ঘণ্টা বাজছে ঢং ঢং ঢং।

প্রহরী। ঐ যে মোড়ল আসছে —আমি এবার পালাই। ও যদি দেখতে পায় তোমার সঙ্গে গল্প করছি, তা হলেই মুশকিল বাধাবে।

অমল। কই মোড়ল, কই,কই?

প্রহরী। ঐ যে, অনেক দূরে। মাথায় একটা মস্ত গোলপাতার ছাতি।

অমল। ওকে বুঝি রাজা মোড়ল করে দিয়েছে?

প্রহরী। আরে না। ও আপনি মোড়লি করে। যে ওকে না মানতে চায় ও তার সঙ্গে দিনরাত এমনি লাগে যে ওকে সকলেই ভয় করে। কেবল সকলের সঙ্গে শত্রুতা করেই ও আপনার ব্যবসা চালায়। আজ তবে যাই, আমার কাজ কামাই যাচ্ছে। আমি আবার কাল সকালে এসে তোমাকে সমস্ত শহরের খবর শুনিয়ে যাব।

[ প্রস্থান]


অমল। রাজার কাছ থেকে রোজ একটা করে চিঠি যদি পাই তা হলে বেশ হয় —এই জানলার কাছে বসে বসে পড়ি। কিন্তু আমি তো পড়তে পারি নে! কে পড়ে দেবে? পিসিমা তো রামায়ণ পড়ে। পিসিমা কি রাজার লেখা পড়তে
পারে? কেউ যদি পড়তে না পারে জমিয়ে রেখে দেব, আমি বড়ো হলে পড়ব। কিন্তু ডাক-হরকরা যদি আমাকে না চেনে! মোড়লমশায়, ও মোড়লমশায় —একটা কথা শুনে যাও।

[মোড়লের প্রবেশ]


মোড়ল। কে রে! রাস্তার মধ্যে আমাকে ডাকাডাকি করে! কোথাকার বাঁদর এটা!

অমল। তুমি মোড়লমশায়, তোমাকে তো সবাই মানে।

মোড়ল। (খুশি হইয়া) হাঁ, হাঁ, মানে বৈকি। খুব মানে।

অমল। রাজার ডাক-হরকরা তোমার কথা শোনে?

মোড়ল। না শুনে তার প্রাণ বাঁচে? বাস রে, সাধ্য কী!

অমল। তুমি ডাক-হরকরাকে বলে দেবে আমারই নাম অমল —আমি এই জানলার কাছটাতে বসে থাকি।

মোড়ল। কেন বলো দেখি।

অমল। আমার নামে যদি চিঠি আসে –

মোড়ল। তোমার নামে চিঠি! তোমাকে কে চিঠি লিখবে?

অমল। রাজা যদি চিঠি লেখে তা হলে –

মোড়ল। হা হা হা হা! এ ছেলেটা তো কম নয়। হা হা হা হা! রাজা তোমাকে চিঠি লিখবে! তা লিখবে বৈকি! তুমি যে তাঁর পরম বন্ধু! কদিন তোমার সঙ্গে দেখা না হয়ে রাজা শুকিয়ে যাচ্ছে, খবর পেয়েছি। আর বেশি দেরি নেই, চিঠি হয়তো আজই আসে কি কালই আসে।

অমল। মোড়লমশায়, তুমি অমন করে কথা কচ্ছ কেন! তুমি কি আমার উপর রাগ করেছ?

মোড়ল। বাস রে। তোমার উপর রাগ করব! এত সাহস আমার! রাজার সঙ্গে তোমার চিঠি চলে! —মাধব দত্তের বড়ো বাড় হয়েছে দেখছি। দু-পয়সা জমিয়েছে কিনা, এখন তার ঘরে রাজা-বাদশার কথা ছাড়া আর কথা নেই। রোসো-না, ওকে মজা দেখাচ্ছি। ওরে ছোঁড়া, বেশ, শীঘ্রই যাতে রাজার চিঠি তোদের বাড়িতে আসে, আমি তার বন্দোবস্ত করছি।

অমল। না, না, তোমাকে কিছু করতে হবে না।

মোড়ল। কেন রে? তোর খবর আমি রাজাকে জানিয়ে দেব —তিনি তা হলে আর দেরি করতে পারবেন না —তোমাদের খবর নেওয়ার জন্যে এখনই পাইক পাঠিয়ে দেবেন! —না, মাধব দত্তর ভারি আস্পর্ধা —রাজার কানে একবার উঠলে দুরস্ত হয়ে যাবে।

[ প্রস্থান]

অমল। কে তুমি মল ঝম্‌ ঝম্‌ করতে করতে চলেছ —একটু দাঁড়াও-না ভাই।


[বালিকার প্রবেশ]


বালিকা। আমার কি দাঁড়াবার জো আছে! বেলা বয়ে যায় যে।

অমল। তোমার দাঁড়াতে ইচ্ছা করছে না —আমারও এখানে আর বসে থাকতে ইচ্ছা করে না।

বালিকা। তোমাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে যেন সকালবেলাকার তারা —তোমার কী হয়েছে বলো তো।

অমল। জানি নে কী হয়েছে, কবিরাজ আমাকে বেরোতে বারণ করেছে।

বালিকা। আহা, তবে বেরিয়ো না —কবিরাজের কথা মেনে চলতে হয় —দুরন্তপনা করতে নেই, তা হলে লোকে দুষ্টু বলবে। বাইরের দিকে তাকিয়ে তোমার মন ছটফট করছে, আমি বরঞ্চ তোমার এই আধখানা দরজা বন্ধ করে দিই।

অমল। না, না, বন্ধ কোরা না —এখানে আমার আর-সব বন্ধ কেবল এইটুকু খোলা। তুমি কে বলো-না —আমি তো তোমাকে চিনি নে!

বালিকা। আমি সুধা।

অমল। সুধা?

সুধা। জান না? আমি এখানকার মালিনীর মেয়ে।

অমল। তুমি কী কর?

সুধা। সাজি ভরে ফুল তুলে নিয়ে এসে মালা গাঁথি। এখন ফুল তুলতে চলেছি।

অমল। ফুল তুলতে চলেছ? তাই তোমার পা দুটি অমন খুশি হয়ে উঠেছে – যতই চলেছ, মল বাজছে ঝম্‌ ঝম্‌ ঝম্‌। আমি যদি তোমার সঙ্গে যেতে পারতুম তা হলে উঁচু ডালে যেখানে দেখা যায় না সেইখান থেকে আমি তোমাকে ফুল পেড়ে দিতুম।

সুধা। তাই বৈকি! ফুলের খবর আমার চেয়ে তুমি নাকি বেশি জান!

অমল। জানি, আমি খুব জানি। আমি সাত ভাই চম্পার খবর জানি। আমার মনে হয়, আমাকে যদি সবাই ছেড়ে দেয় তা হলে আমি চলে যেতে পারি খুব ঘন বনের মধ্যে যেখানে রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায় না। সরু ডালের সব-আগায় যেখানে মনুয়া পাখি বসে বসে দোলা খায় সেইখানে আমি চাঁপা হয়ে ফুটতে পারি। তুমি আমার পারুলদিদি হবে?

সুধা। কী বুদ্ধি তোমার! পারুলদিদি আমি কী করে হব! আমি যে সুধা —আমি শশী মালিনীর মেয়ে। আমাকে রোজ এত এত মালা গাঁথতে হয়। আমি যদি তোমার মতো এইখানে বসে থাকতে পারতুম তা হলে কেমন মজা হত!

অমল। তা হলে সমস্ত দিন কী করতে?

সুধা। আমার বেনে-বউ পুতুল আছে, তার বিয়ে দিতুম। আমার পুষি মেনি আছে, তাকে নিয়ে —যাই, বেলা বয়ে যাচ্ছে, দেরি হলে ফুল আর থাকবে না।

অমল। আমার সঙ্গে আর-একটু গল্প করো-না, আমার খুব ভালো লাগছে।
সুধা। আচ্ছা বেশ, তুমি দুষ্টুমি কোরো না, লক্ষ্মী ছেলে হয়ে এইখানে স্থির হয়ে বসে থাকো, আমি ফুল তুলে ফেরবার পথে তোমার সঙ্গে গল্প করে যাব।

অমল। আর আমাকে একটি ফুল দিয়ে যাবে?

সুধা। ফুল অমনি কেমন করে দেব? দাম দিতে হবে যে।

অমল। আমি যখন বড়ো হব তখন তোমাকে দাম দেব। আমি কাজ খুঁজতে চলে যাব ঐ ঝরনা পার হয়ে, তখন তোমাকে দাম দিয়ে যাব।

সুধা। আচ্ছা বেশ।

অমল। তুমি তা হলে ফুল তুলে আসবে?

সুধা। আসব।

অমল। আসবে?

সুধা। আসব।

অমল। আমাকে ভুলে যাবে না? আমার নাম অমল। মনে থাকবে তোমার?

সুধা। না, ভুলব না। দেখো, মনে থাকবে।

[ প্রস্থান ]
[ছেলের দলের প্রবেশ]

অমল। ভাই, তোমরা সব কোথায় যাচ্ছ ভাই? একবার একটুখানি এইখানে দাঁড়াও-না।

ছেলেরা। আমরা খেলতে চলেছি।

অমল। কী খেলবে তোমরা ভাই?

ছেলেরা। আমরা চাষ-খেলা খেলব।

প্রথম। (লাঠি দেখাইয়া) এই যে আমাদের লাঙল।

দ্বিতীয়। আমরা দুজনে দুই গোরু হব।

অমল। সমস্ত দিন খেলবে?

ছেলেরা। হাঁ, সমস্ত দি —ন।

অমল। তার পরে সন্ধ্যায় সময় নদীর ধার দিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে আসবে?

ছেলেরা। হাঁ, সন্ধ্যার সময় ফিরব।

অমল। আমার এই ঘরের সামনে দিয়েই ফিরো ভাই।

ছেলেরা। তুমি বেরিয়ে এসো-না, খেলবে চলো।

অমল। কবিরাজ আমাকে বেরিয়ে যেতে মানা করেছে।

ছেলেরা। কবিরাজ! কবিরাজের মানা তুমি শোন বুঝি! চল্‌ ভাই চল্‌, আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

অমল। না ভাই, তোমরা আমার এই জানলার সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটু খেলা করো —আমি একটু দেখি।

ছেলেরা। এখেনে কী নিয়ে খেলব?

অমল। এই যে আমার সব খেলনা পড়ে রয়েছে —এ-সব তোমরাই নাও ভাই—ঘরের ভিতরে একলা খেলতে ভালো লাগেনা —এ-সব ধুলোয় ছড়ানো পড়েই থাকে —এ আমার কোনো কাজে লাগে না।
ছেলেরা। বা, বা, বা, কী চমৎকার খেলনা! এ যে জাহাজ! এ যে জটাইবুড়ি! দেখছিস ভাই? কেমন সুন্দর সেপাই! —এ-সব তুমি আমাদের দিয়ে দিলে? তোমার কষ্ট হচ্ছে না?

অমল। না, কিছু কষ্ট হচ্ছে না, সব তোমাদের দিলুম।

ছেলেরা। আর কিন্তু ফিরিয়ে দেব না।

অমল। না, ফিরিয়ে দিতে হবে না।

ছেলেরা। কেউ তো বকবে না?

অমল। কেউ না, কেউ না। কিন্তু রোজ সকালে তোমরা এই খেলনাগুলো নিয়ে আমার এই দরজার সামনে খানিকক্ষণ ধরে খেলো। আবার এগুলো যখন পুরোনো হয়ে যাবে আমি নতুন খেলনা আনিয়ে দেব।

ছেলেরা। বেশ ভাই, আমরা রোজ এখানে খেলে যাব। ও ভাই, সেপাইগুলোকে এখানে সব সাজা —আমরা লড়াই-লড়াই খেলি। বন্দুক কোথায় পাই? ঐ-যে একটা মস্ত শরকাঠি পড়ে আছে —ঐটেকে ভেঙে ভেঙে নিয়ে আমরা বন্দুক বানাই। কিন্তু ভাই, তুমি যে ঘুমিয়ে পড়ছ!

অমল। হাঁ, আমার ভারি ঘুম পেয়ে আসছে। জানি নে কেন আমার থেকে থেকে ঘুম পায়। অনেকক্ষণ বসে আছি আমি, আর বসে থাকতে পারছি নে —আমার পিঠ ব্যথা করছে।

ছেলেরা। এখন যে সবে এক প্রহর বেলা —এখনই তোমার ঘুম পায় কেন? ঐ শোনো এক প্রহরের ঘণ্টা বাজছে।

অমল। হাঁ, ঐ যে বাজছে ঢং ঢং ঢং —আমাকে ঘুমোতে যেতে ডাকছে।

ছেলেরা। তবে আমরা এখন যাই, আবার কাল সকালে আসব।

অমল। যাবার আগে তোমাদের একটা কথা আমি জিজ্ঞাসা করি ভাই। তোমরা তো বাইরে থাক, তোমরা ঐ রাজার ডাকঘরের ডাক-হরকরাদের চেন?

ছেলেরা। হাঁ চিনি বৈকি, খুব চিনি।

অমল। কে তারা, নাম কী?

ছেলেরা। একজন আছে বাদল হরকরা, একজন আছে শরৎ —আরো কত আছে।

অমল। আচ্ছা, আমার নামে যদি চিঠি আসে তারা কি আমাকে চিনতে পারবে?

ছেলেরা। কেন পারবে না? চিঠিতে তোমার নাম থাকলেই তারা তোমাকে ঠিক চিনে নেবে।

অমল। কাল সকালে যখন আসবে তাদের একজনকে ডেকে এনে আমাকে চিনিয়ে দিয়ো না।

ছেলেরা। আচ্ছা দেব।

অমল শয্যাগত

অমল। পিসেমশায়, আজ আর আমার সেই জানলার কাছেও যেতে পারব না? কবিরাজ বারণ করেছে?

মাধব দত্ত। হাঁ বাবা। সেখানে রোজ রোজ বসে থেকেই তো তোমার ব্যামো বেড়ে গেছে।

অমল। না পিসেমশায়, না —আমার ব্যামোর কথা আমি কিছুই জানি নে কিন্তু সেখানে থাকলে আমি খুব ভালো থাকি।

মাধব দত্ত। সেখানে বসে বসে তুমি এই শহরের যত রাজ্যের ছেলেবুড়ো সকলের সঙ্গেই ভাব করে নিয়েছ –আমার দরজার কাছে রোজ যেন একটা মস্ত মেলা বসে যায় —এতেও কি কখনো শরীর টেকে! দেখো দেখি, আজ তোমার মুখখানা কী রকম ফ্যাকাশে হয়ে গেছে!

অমল। পিসেমশায়, আমার সেই ফকির হয়তো আজ আমাকে জানলার কাছে না দেখতে পেয়ে চলে যাবে।

মাধব দত্ত। তোমার আবার ফকির কে?

অমল। সেই যে রোজ আমার কাছে এসে নানা দেশবিদেশের কথা বলে যায় —শুনতে আমার ভারি ভালো লাগে।

মাধব দত্ত। কই আমি তো কোনো ফকিরকে জানি নে।

অমল। এই ঠিক তার আসবার সময় হয়েছে —তোমার পায়ে পড়ি, তুমি তাকে একবার বলে এসো-না, সে যেন আমার ঘরে এসে একবার বসে।


ফকিরবেশে ঠাকুরদার প্রবেশ
অমল। এই-যে, এই-যে ফকির —এসো আমার বিছানায় এসে বসো।

মাধব দত্ত।এ কী।এ যে –

ঠাকুরদা। (চোখ ঠারিয়া) আমি ফকির।

মাধব দত্ত। তুমি যে কী নও তা তো ভেবে পাই নে!

অমল। এবারে তুমি কোথায় গিয়েছিলে ফকির?

ফকির। আমি ক্রৌঞ্চদ্বীপে গিয়েছিলুম —সেইখান থেকেই এইমাত্র আসছি।

মাধব দত্ত। ক্রৌঞ্চদ্বীপে?

ফকির। এতে আশ্চর্য হও কেন? তোমাদের মতো আমাকে পেয়েছ? আমার তো যেতে কোনো খরচ নেই। আমি যেখানে খুশি যেতে পারি।

অমল। (হাততালি দিয়া) তোমার ভারি মজা। আমি যখন ভালো হব তখন তুমি আমাকে চেলা করে নেবে বলেছিলে, মনে আছে ফকির?

ঠাকুরদা। খুব মনে আছে। বেড়াবার এমন সব মন্ত্র শিখিয়ে দেব যে সমুদ্রে পাহাড়ে অরণ্যে কোথাও কিছুতে বাধা দিতে পারবে না।

মাধব দত্ত। এ-সব কী পাগলের মতো কথা হচ্ছে তোমাদের!

ঠাকুরদা। বাবা অমল, পাহাড়-পর্বত-সমুদ্রকে ভয় করি নে —কিন্তু তোমার এই পিসেটির সঙ্গে যদি আবার কবিরাজ এসেজোটেন তা হলে আমার মন্ত্রকে হার মানতে হবে।
অমল। না, না, পিসেমশায়, তুমি কবিরাজকে কিছু বোলো না। —এখন আমি এইখানেই শুয়ে থাকব, কিচ্ছু করব না —কিন্তু যেদিন আমি ভালো হব সেইদিনই আমি ফকিরের মন্ত্র নিয়ে চলে যাব —নদী-পাহাড় সমুদ্রে আমাকে আর ধরে রাখতে পারবে না।

মাধব দত্ত। ছি, বাবা, কেবলই অমন যাই-যাই করতে নেই —শুনলে আমার মন কেমন খারাপ হয়ে যায়।

অমল। ক্রৌঞ্চদ্বীপ কিরকম দ্বীপ আমাকে বলো-না ফকির!

ঠাকুরদা। সে ভারি আশ্চর্য জায়গা। সে পাখিদের দেশ —সেখানে মানুষ নেই। তারা কথা কয় না, চলে না, তারা গান গায় আর ওড়ে।

অমল। বাঃ, কী চমৎকার! সমুদ্রের ধারে?

ঠাকুরদা। সমুদ্রের ধারে বৈকি।

অমল। সব নীল রঙের পাহাড় আছে?

ঠাকুরদা। নীল পাহাড়েই তো তাদের বাসা। সন্ধের সময় সেই পাহাড়ের উপর সূর্যাস্তের আলো এসে পড়ে আর ঝাঁকে ঝাঁকে সবুজ রঙের পাখি তাদের বাসায় ফিরে আসতে থাকে —সেই আকাশের রঙে পাখির রঙে পাহাড়ের রঙে সে এক কাণ্ড হয়ে ওঠে।

অমল। পাহাড়ে ঝরনা আছে?

ঠাকুরদা। বিলক্ষণ! ঝরনা না থাকলে কি চলে! একেবারে হীরে গালিয়ে ঢেলে দিচ্ছে। আর, তার কী নৃত্য! নুড়িগুলোকে ঠুং-ঠাং ঠুং-ঠাং করে বাজাতে বাজাতে কেবই কল্‌ কল্‌ ঝর্ ঝর্ করতে করতে ঝরনাটি সমুদ্রের মধ্যে গিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ছে। কোনো কবিরাজের বাবার সাধ্য নেই তাকে একদণ্ড কোথাও আটকে রাখে। পাখিগুলো আমাকে নিতান্ত তুচ্ছ একটা মানুষ বলে যদি একঘরে করে না রাখত তা হলে ঐ ঝরনার ধারে তাদের হাজার হাজার বাসার একপাশে বাসা বেঁধে সমুদ্রের ঢেউ দেখে দেখে সমস্ত দিনটা কাটিয়ে দিতুম।

অমল। আমি যদি পাখি হতুম তা হলে –

ঠাকুরদা। তা হলে একটা ভারি মুশকিল হত। শুনলুম, তুমি নাকি দইওআলাকে বলে রেখেছ বড়ো হলে তুমি দই বিক্রি করবে —পাখিদের মধ্যে তোমার দইয়ের ব্যবসাটা তেমন বেশ জমত না। বোধ হয় ওতে তোমার কিছু লোকসানই হত।

মাধব দত্ত। আর তো আমার চলল না। আমাকে সুদ্ধ তোমরা খেপিয়ে দেবে দেখছি। আমি চললুম।

অমল। পিসেমশায়, আমার দইওআলা এসে চলে গেছে?

মাধব দত্ত। গেছে বৈকি। তোমার ঐ শখের ফকিরের তলপি বয়ে ক্রৌঞ্চদ্বীপের পাখির বাসায় উড়ে বেড়ালে তার তো পেট চলে না। সে তোমার জন্য এক ভাঁড় দই রেখে গেছে। বলে গেছে, তাদের গ্রামে তার বোনঝির বিয়ে —তাই সে কলমিপাড়ায় বাঁশির ফরমাশ দিতে যাচ্ছে —তাই বড়ো ব্যস্ত আছে।

অমল। সে যে বলেছিল, আমার সঙ্গে তার ছোটো বোনঝিটির বিয়ে দেবে।

ঠাকুরদা। তবে তো বড়ো মুশকিল দেখছি।

অমল। বলেছিল, সে আমার টুকটুকে বউ হবে —তার নাকে নোলক, তার লাল ডুরে শাড়ি। সে সকালবেলা নিজের হাতে কালো গোরু দুইয়ে নতুন মাটির ভাঁড়ে আমাকে ফেনাসুদ্ধ দুধ খাওয়াবে, আর সন্ধের সময় গোয়ালঘরে প্রদীপ দেখিয়ে এসে আমার কাছে বসে সাত ভাই চম্পার গল্প করবে।
ঠাকুরদা। বা, বা, খাসা বউ তো! আমি যে ফকির মানুষ আমারই লোভ হয়। তা বাবা ভয় নেই, এবারকার মতো বিয়ে দিক-না, আমি তোমাকে বলছি, তোমার দরকার হলে কোনোদিন ওর ঘরে বোনঝির অভাব হবে না।

মাধব দত্ত। যাও, যাও। আর তো পারা যায় না।

[ প্রস্থান
অমল। ফকির, পিসেমশাই তো গিয়েছেন —এইবার আমাকে চুপিচুপি বলো না ডাকঘরে কি আমার নামে রাজার চিঠি এসেছে।

ঠাকুরদা। শুনেছি তো তাঁর চিঠি রওনা হয়ে বেরিয়েছে। সে-চিঠি এখন পথে আছে।

অমল। পথে? কোন্‌ পথে! সেই যে বৃষ্টি হয়ে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেলে অনেক দূরে দেখা যায়, সেই ঘন বনের পথে?

ঠাকুরদা। তবে তো তুমি সব জান দেখছি, সেই পথেই তো।

অমল। আমি সব জানি ফকির!

ঠাকুরদা। তাই তো দেখতে পাচ্ছি —কেমন করে জানলে?

অমল। তা আমি জানি নে। আমি যেন চোখের সামনে দেখতে পাই —মনে হয় যেন আমি অনেকবার দেখেছি —সে অনেকদিন আগে —কতদিন তা মনে পড়ে না। বলব? আমি দেখতে পাচ্ছি, রাজার ডাক-হরকরা পাহাড়ের উপর থেকে একলা কেবলই নেমে আসছে —বাঁ হাতে তার লণ্ঠন, কাঁধে তার চিঠির থলি। কত দিন কত রাত ধরে সে কেবলই নেমে আসছে। পাহাড়ের পায়ের কাছে ঝরনার পথ যেখানে ফুরিয়েছে সেখানে বাঁকা নদীর পথ ধরে সে কেবলই চলে আসছে —নদীর ধারে জোয়ারির খেত, তারই সরু গলির ভেতর দিয়ে দিয়ে সে কেবল আসছে —তার পরে আখের খেত —সেই আখের খেতের পাশ দিয়ে উঁচু আল চলে গিয়েছে, সেই আলের উপর দিয়ে সে কেবলই চলে আসছে —রাতদিন একলাটি চলে আসছে; খেতের মধ্যে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে —নদীর ধারে একটিও মানুষ নেই, কেবল কাদাখোঁচা লেজ দুলিয়ে দুলিয়ে বেড়াচ্ছে —আমি সমস্ত দেখতে পাচ্ছি। যতই সে আসছে দেখছি, আমার বুকের ভিতরে ভারি খুশি হয়ে হয়ে উঠছে।

ঠাকুরদা। অমন নবীন চোখ তো আমার নেই তবু তোমার দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমিও দেখতে পাচ্ছি।

অমল। আচ্ছা ফকির, যাঁর ডাকঘর তুমি সেই রাজাকে জান?

ঠাকুরদা। জানি বৈকি। আমি যে তাঁর কাছে রোজ ভিক্ষা নিতে যাই।

অমল। সে তো বেশ! আমি ভালো হয়ে উঠলে আমিও তাঁর কাছে ভিক্ষা নিতে যাব। পারব না যেতে?

ঠাকুরদা। বাবা, তোমার আর ভিক্ষার দরকার হবে না, তিনি তোমাকে যা দেবেন অমনিই দিয়ে দেবেন।

অমল। না, না, আমি তাঁর দরজার সামনে পথের ধারে দাঁড়িয়ে জয় হোক বলে ভিক্ষা চাইব —আমি খঞ্জনি বাজিয়ে নাচব —সে বেশ হবে, না?

ঠাকুরদা। সে খুব ভালো হবে। তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলে আমারও পেট ভরে ভিক্ষা মিলবে। তুমি কী ভিক্ষা চাইবে?

অমল। আমি বলব, আমাকে তোমার ডাক-হরকরা করে দাও, আমি অমনি লণ্ঠন হাতে ঘরে ঘরে তোমার চিঠি বিলি করে বেড়াব। জান ফকির, আমাকে একজন বলেছে আমি ভালো হয়ে উঠলে সে আমাকে ভিক্ষা করতে শেখাবে। আমি তার সঙ্গে যেখানে খুশি ভিক্ষা করে বেড়াব।

ঠাকুরদা। কে বলো দেখি?

অমল। ছিদাম।

ঠাকুরদা। কোন্‌ ছিদাম?

অমল। সেই যে অন্ধ খোঁড়া। সে রোজ আমার জানলার কাছে আসে। ঠিক আমার মতো একজন ছেলে তাকে চাকার গাড়িতে করে ঠেলে ঠেলে নিয়ে বেড়ায়। আমি তাকে বলেছি, আমি ভালো হয়ে উঠলে তাকে ঠেলে নিয়ে বেড়াব।

ঠাকুরদা। সে তো বেশ মজা হবে দেখছি।

অমল। সেই আমাকে বলেছে কেমন করে ভিক্ষা করতে হয় আমাকে শিখিয়ে দেবে। পিসেমশায়কে আমি বলি ওকে ভিক্ষা দিতে, তিনি বলেন ও মিথ্যা কানা, মিথ্যা খোঁড়া। আচ্ছা, ও যেন মিথ্যা কানা-ই হল, কিন্তু চোখে দেখতে পায় না —সেটা তো সত্যি।

ঠাকুরদা। ঠিক বলেছ বাবা, ওর মধ্যে সত্যি হচ্ছে ওইটুকু যে, ও চোখে দেখতে পায় না —তা ওকে কানা বল আর না-ই বল। তা ও ভিক্ষা পায় না, তবে তোমার কাছে বসে থাকে কী করতে।

অমল। ওকে যে আমি শোনাই কোথায় কী আছে। বেচারা দেখতে পায় না। তুমি যে-সব দেশের কথা আমাকে বল সে-সব আমি ওকে শুনিয়ে দিই। তুমি সেদিন আমাকে সেই যে হালকা দেশের কথা বলেছিলে, যেখানে কোনো জিনিসের কোনো ভার নেই —যেখানে একটু লাফ দিলেই অমনি পাহাড় ডিঙিয়ে চলে যাওয়া যায়,সেই হালকা দেশের কথা শুনে ও ভারি খুশি হয়ে উঠেছিল। আচ্ছা ফকির, সে দেশে কোন্‌ দিক দিয়ে যাওয়া যায়?

ঠাকুরদা। ভিতরের দিক দিয়ে সে একটা রাস্তা আছে, সে হয়তো খুঁজে পাওয়া শক্ত।

অমল। ও বেচারা যে অন্ধ, ও হয়তো দেখতেই পাবে না —ওকে কেবল ভিক্ষাই করে বেড়াতে হবে। তাই নিয়ে ও দুঃখ করছিল —আমি ওকে বললুম ভিক্ষা করতে গিয়ে তুমি যে কত বেড়াতে পাও, সবাই তো সে পায় না।

ঠাকুরদা। বাবা, ঘরে বসে থাকলেই বা এত কিসের দুঃখ?

অমল। না, না, দুঃখ নেই। প্রথমে যখন আমাকে ঘরের মধ্যে বসিয়ে রেখে দিয়েছিল আমার মনে হয়েছিল যেন দিন ফুরোচ্ছে না, আমাদের রাজার ডাকঘর দেখে অবধি এখন আমার রোজই ভালো লাগে —এই ঘরের মধ্যে বসে বসেই ভালো লাগে —একদিন আমার চিঠি এসে পৌঁছোবে, সে কথা মনে করলেই আমি খুব খুশি হয়ে চুপ করে বসে থাকতে পারি। কিন্তু রাজার চিঠিতে কী যে লেখা থাকবে তা তো আমি জানি নে।

ঠাকুরদা। তা না-ই জানলে। তোমার নামটি তো লেখা থাকবে —তা হলেই হল।


মাধব দত্তের প্রবেশ
মাধব দত্ত। তোমরা দুজনে মিলে এ কী ফেসাদ বাধিয়ে বসে আছ বলো দেখি?

ঠাকুরদা। কেন, হয়েছে কী?

মাধব দত্ত। শুনছি, তোমরা নাকি রটিয়েছ, রাজা তোমাদেরই চিঠি লিখবেন বলে ডাকঘর বসিয়েছেন।

ঠাকুরদা। তাতে হয়েছে কী?

মাধব দত্ত। আমাদের পঞ্চানন মোড়ল সেই কথাটি রাজার কাছে লাগিয়ে বেনামি চিঠি লিখে দিয়েছে।

ঠাকুরদা। সকল কথাই রাজার কানে ওঠে, সে কি আমরা জানি নে?

মাধব দত্ত। তবে সামলে-চল না কেন। রাজাবাদশার নাম করে অমন যা-তা কথা মুখে আনো কেন? তোমরা যে আমাকে সুদ্ধ মুশকিলে ফেলবে।
অমল। ফকির, রাজা কি রাগ করবে?

ঠাকুরদা। অমনি বললেই হল! রাগ করবে! কেমন রাগ করে দেখি-না। আমার মতো ফকির আর তোমার মতো ছেলের উপর রাগ করে সে কেমন রাজাগিরি ফলায় তা দেখা যাবে।

অমল। দেখো ফকির, আজ সকালবেলা থেকে আমার চোখের উপর থেকে-থেকে অন্ধকার হয়ে আসছে; মনে হচ্ছে সব যেন স্বপ্ন। একেবারে চুপ করে থাকতে ইচ্ছে করছে। কথা কইতে আর ইচ্ছে করছে না। রাজার চিঠি কি আসবে না? এখনই এই ঘর যদি সব মিলিয়ে যায় —যদি –

ঠাকুরদা। (অমলকে বাতাস করিতে করিতে) আসবে, চিঠি আজই আসবে।

কবিরাজের প্রবেশ
কবিরাজ। আজ কেমন ঠেকছে?

অমল। কবিরাজমশায়, আজ খুব ভালো বোধ হচ্ছে – মনে হচ্ছে যেন সব বেদনা চলে গেছে।

কবিরাজ। (জনান্তিকে মাধব দত্তের প্রতি) ঐ হাসিটি তো ভালো ঠেকছে না। ঐ যে বলছে খুব ভালো বোধ হচ্ছে ঐটেই হল খারাপ লক্ষণ। আমাদের চক্রধর দত্ত বলছেন —

মাধব দত্ত। দোহাই কবিরাজমশায়, চক্রধর দত্তের কথা রেখে দিন। এখন বলুন ব্যাপারখানা কী।

কবিরাজ। বোধ হচ্ছে, আর ধরে রাখা যাবে না। আমি তো নিষেধ করে গিয়েছিলুম কিন্তু বোধ হচ্ছে বাইরের হাওয়া লেগেছে।

মাধব দত্ত। না কবিরাজমশায়, আমি ওকে খুব করেই চারি দিক থেকে আগলে সামলে রেখেছি। ওকে বাইরে যেতে দিই নে —দরজা তো প্রায়ই বন্ধই রাখি।

কবিরাজ। হঠাৎ আজ একটা কেমন হাওয়া দিয়েছে —আমি দেখে এলুম, তোমাদের সদর-দরজার ভিতর দিয়ে হু হু করে হাওয়া বইছে। ওটা একেবারেই ভালো নয়। ও-দরজাটা বেশ ভালো করে তালাচাবি-বন্ধ করে দাও। না-হয় দিন দুই-তিন তোমাদের এখানে লোক-আনাগোনা বন্ধই থাক্‌ না। যদি কেউ এসে পড়ে খিড়কি-দরজা আছে। ঐ-যে জানলা দিয়ে সূর্যাস্তের আভাটা আসছে, ওটাও বন্ধ করে দাও, ওতে রোগীকে বড়ো জাগিয়ে রেখে দেয়।

মাধব দত্ত। অমল চোখ বুজে রয়েছে, বোধ হয় ঘুমোচ্ছে। ওর মুখ দেখে মনে হয় যেন —কবিরাজমশায়, যে আপনার নয় তাকে ঘরে এনে রাখলুম, তাকে ভালোবাসলুম, এখন বুঝি আর তাকে রাখতে পারব না।

কবিরাজ। ওকী তোমার ঘরে যে মোড়ল আসছে! এ কী উৎপাত! আমি আসি ভাই! কিন্তু তুমি যাও, এখনই ভালো করে দরজাটা বন্ধ করে দাও। আমি বাড়ি গিয়েই একটা বিষবড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি —সেইটে খাইয়ে দেখো -যদি রাখবার হয় তো সেইটেতেই টেনে রাখতে পারবে।

[ মাধব দত্ত ও কবিরাজের প্রস্থান
মোড়লের প্রবেশ
মোড়ল। কী রে ছোঁড়া!

ঠাকুরদা। (তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইয়া) আরে আরে, চুপ চুপ!

অমল। না ফকির, তুমি ভাবছ আমি ঘুমোচ্ছি। আমি ঘুমোই নি। আমি সব শুনছি। আমি যেন অনেক দূরের কথাও শুনতে পাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে, আমার মা আমার বাবা যেন শিয়রের কাছে কথা কচ্ছেন।
মাধব দত্তের প্রবেশ
মোড়ল। ওহে মাধব দত্ত, আজকাল তোমাদের যে খুব বড়ো বড়ো লোকের সঙ্গে সম্বন্ধ!

মাধব দত্ত। বলেন কী, মোড়লমশায়! এমন পরিহাস করবেন না। আমরা নিতান্তই সামান্য লোক।

মোড়ল। তোমাদের এই ছেলেটি যে রাজার চিঠির জন্যে অপেক্ষা করে আছে।

মাধব দত্ত। ও ছেলেমানুষ, ও পাগল, ওর কথা কি ধরতে আছে!

মোড়ল। না-না, এতে আর আশ্চর্য কী? তোমাদের মতো এমন যোগ্য ঘর রাজা পাবেন কোথায়? সেইজন্যেই দেখছ- না, ঠিক তোমাদের জানলার সামনেই রাজার নতুন ডাকঘর বসেছে? ওরে ছোঁড়া, তোর নামে রাজার চিঠি এসেছে যে।

অমল। (চমকিয়া উঠিয়া) সত্যি!

মোড়ল। এ কি সত্যি না হয়ে যায়! তোমার সঙ্গে রাজার বন্ধুত্ব! (একখানা অক্ষরশূন্য কাগজ দিয়া) হা হা হা হা, এই যে তাঁর চিঠি।

অমল। আমাকে ঠাট্টা কোরো না। ফকির, ফকির, তুমি বলো-না, এই কি সত্যি তাঁর চিঠি?

ঠাকুরদা। হাঁ বাবা, আমি ফকির তোমাকে বলছি এই সত্য তাঁর চিঠি।

অমল। কিন্তু,আমি যে এতে কিছুই দেখতে পাচ্ছি নে —আমার চোখে আজ সব সাদা হয়ে গেছে! মোড়লমশায়, বলে দাও-না, এ-চিঠিতে কী লেখা আছে।

মোড়ল। রাজা লিখছেন, আমি আজকালের মধ্যেই তোমাদের বাড়িতে যাচ্ছি, আমার জন্যে তোমাদের মুড়ি-মুড়কির ভোগ তৈরি করে রেখো —রাজভবন আর আমার এক দণ্ড ভালো লাগছে না। হা হা হা হা!

মাধব দত্ত। (হাত জোড় করিয়া) মোড়লমশায়, দোহাই আপনার, এ-সব কথা নিয়ে পরিহাস করিবেন না।

ঠাকুরদা। পরিহাস! কিসের পরিহাস! পরিহাস করেন, এমন সাধ্য আছে ওঁর!

মাধব। আরে! ঠাকুরদা, তুমিও খেপে গেলে নাকি!

ঠাকুরদা। হাঁ, আমি খেপেছি। তাই আজ এই সাদা কাগজে অক্ষর দেখতে পাচ্ছি। রাজা লিখছেন তিনি স্বয়ং অমলকে দেখতে আসছেন, তিনি তাঁর রাজকবিরাজকেও সঙ্গে করে আনছেন।

অমল। ফকির, ঐ-যে, ফকির, তাঁর বাজনা বাজছে, শুনতে পাচ্ছ না?

মোড়ল। হা হা হা হা! উনি আরো একটু না খেপলে তো শুনতে পাবেন না।

অমল। মোড়লমশায়, আমি মনে করতুম,তুমি আমার উপর রাগ করেছ —তুমি আমাকে ভালোবাস না। তুমি যে সত্যি রাজার চিঠি আনবে এ আমি মনে করি নি—দাও, আমাকে তোমার পায়ের ধুলো দাও।

মোড়ল। না, এ ছেলেটার ভক্তিশ্রদ্ধা আছে। বুদ্ধি নেই বটে, কিন্তু মনটা ভালো।

অমল। এতক্ষণে চার প্রহর হয়ে গেছে বোধ হয়। ঐ যে ঢং ঢং ঢং —ঢং ঢং ঢং। সন্ধ্যাতারা কি উঠেছে ফকির? আমি কেন দেখতে পাচ্ছি নে?

ঠাকুরদা। ওরা যে জানলা বন্ধ করে দিয়েছে, আমি খুলে দিচ্ছি।
বাহিরে দ্বারে আঘাত
মাধব দত্ত। ওকি ও! ও কে ও! এ কী উৎপাত?

(বাহির হইতে) খোলো দ্বার।

মাধব দত্ত। কে তোমরা?

(বাহির হইতে) খোলো দ্বার।

মাধব দত্ত। মোড়লমশায়, এ তো ডাকাত নয়!

মোড়ল। কে রে? আমি পঞ্চানন মোড়ল। তোদের মনে ভয় নেই নাকি? দেখো একবার, শব্দ থেমেছে। পঞ্চাননের আওয়াজ পেলে আর রক্ষা নেই যত বড়ো ডাকাতই হোক না –

মাধব দত্ত। (জানলা দিয়া মুখ বাড়াইয়া) দ্বার যে ভেঙে ফেলেছে, তাই আর শব্দ নেই।


রাজদূতের প্রবেশ
রাজদূত। মহারাজ আজ রাত্রে আসবেন।

মোড়ল। কী সর্বনাশ!

অমল। কত রাত্রে দূত? কত রাত্রে?

দূত। আজ দুই প্রহর রাত্রে।

অমল। যখন আমার বন্ধু প্রহরী নগরের সিংহদ্বারে ঘণ্টা বাজাবে ঢং ঢং ঢং, ঢং ঢং ঢং —তখন?

দূত। হাঁ, তখন। রাজা তাঁর বালক-বন্ধুটিকে দেখবার জন্যে তাঁর সকলের চেয়ে বড়ো কবিরাজকে পাঠিয়েছেন।


রাজকবিরাজের প্রবেশ
রাজকবিরাজ। একি! চারি দিকে সমস্তই যে বন্ধ! খুলে দাও, খুলে দাও, যত দ্বার-জানলা আছে সব খুলে দাও। —(অমলের গায়ে হাত দিয়া) বাবা, কেমন বোধ করছ?

অমল। খুব ভালো, খুব ভালো কবিরাজমশাই। আমার আর কোনো অসুখ নেই, কোনো বেদনা নেই। আঃ, সব খুলে দিয়েছ —সব তারাগুলি দেখতে পাচ্ছি —অন্ধকারের ওপারকার সব তারা।

রাজকবিরাজ। অর্ধরাত্রে যখন রাজা আসবেন তখন তুমি বিছানা ছেড়ে উঠে তাঁর সঙ্গে বেরোতে পারবে?

অমল। পারব, আমি পারব। বেরোতে পারলে আমি বাঁচি। আমি রাজাকে বলব, এই অন্ধকার আকাশে ধ্রুবতারাটিকে দেখিয়ে দাও। আমি সে তারা বোধ হয় কতবার দেখেছি কিন্তু সে যে কোন্‌টা সে তো আমি চিনি নে।

রাজকবিরাজ। তিনি সব চিনিয়ে দেবেন। (মাধবের প্রতি) এই ঘরটি রাজার আগমনের জন্যে পরিষ্কার করে ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখো। (মোড়লকে নির্দেশ করিয়া) ঐ লোকটিকে তো এ-ঘরে রাখা চলবে না।

অমল। না, না, কবিরাজমশায়, উনি আমার বন্ধু। তোমরা যখন আস নি উনিই আমাকে রাজার চিঠি এনে দিয়েছিলেন।

রাজকবিরাজ। আচ্ছা, বাবা, উনি যখন তোমার বন্ধু তখন উনিও এ-ঘরে রইলেন।
মাধব দত্ত। (অমলের কানে কানে) বাবা, রাজা তোমাকে ভালোবাসেন, তিনি স্বয়ং আজ আসছেন —তাঁর কাছে আজ কিছু প্রার্থনা কোরো। আমাদের অবস্থা তো ভালো নয়। জান তো সব।

অমল। সে আমি সব ঠিক করে রেখেছি, পিসেমশায় —সে তোমার কোনো ভাবনা নেই।

মাধব দত্ত। কী ঠিক করেছ বাবা?

অমল। আমি তাঁর কাছে চাইব, তিনি যেন আমাকে তাঁর ডাকঘরের হরকরা করে দেন —আমি দেশে দেশে ঘরে ঘরে তাঁর চিঠি বিলি করব।

মাধব দত্ত। (ললাটে করাঘাত করিয়া) হায় আমার কপাল!

অমল। পিসেমশায়, রাজা আসবেন, তাঁর জন্যে কী ভোগ তৈরি রাখবে।

দূত। তিনি বলে দিয়েছেন তোমাদের এখানে তাঁর মুড়ি-মুড়কিরভোগ হবে।

অমল। মুড়ি-মুড়কি! মোড়লমশায়, তুমি তো আগেই বলে দিয়েছিলে, রাজার সব খবরই তুমি জান! আমরা তো কিছুই জানতুম না।

মোড়ল। আমার বাড়িতে যদি লোক পাঠিয়ে দাও তা হলে রাজার জন্যে ভালো ভালো কিছু –

রাজকবিরাজ। কোনো দরকার নেই। এইবার তোমরা সকলে স্থির হও। এল, এল, ওর ঘুম এল। আমি বালকের শিয়রের কাছে বসব —ওর ঘুম আসছে। প্রদীপের আলো নিবিয়ে দাও —এখন আকাশের তারাটি থেকে আলো আসুক, ওর ঘুম এসেছে।

মাধব দত্ত। (ঠাকুরদার প্রতি) ঠাকুরদা, তুমি অমন মূর্তিটির মতো হাতজোড় করে নীরব হয়ে আছ কেন? আমার কেমন ভয় হচ্ছে। এ যা দেখছি এ-সব কি ভালো লক্ষণ! এরা আমার ঘর অন্ধকার করে দিচ্ছে কেন! তারার আলোতে আমার কী হবে!

ঠাকুরদা। চুপ করো অবিশ্বাসী! কথা কোয়ো না।

[সুধার প্রবেশ]
সুধা। অমল।

রাজকবিরাজ। ও ঘুমিয়ে পড়েছে।

সুধা। আমি যে ওর জন্যে ফুল এনেছি —ওর হাতে কি দিতে পারব না?

রাজকবিরাজ। আচ্ছা, দাও তোমার ফুল।

সুধা। ও কখন জাগবে?

রাজকবিরাজ। এখনই, যখন রাজা এসে ওকে ডাকবেন।

সুধা। তখন তোমরা ওকে একটি কথা কানে কানে বলে দেবে?

রাজকবিরাজ। কী বলব?

সুধা। বোলো যে, ‘সুধা তোমাকে ভোলে নি’।