আকাশের সাতটি তারা - জীবনানন্দ দাশ ( সংক্ষিপ্ত আলোচনা )



[ বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ ebanglaschools এর সমস্ত আলোচনা কোনো পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গের জন্য নয়। সাধারণ এবং অতি সাধারণ পিছিয়ে পড়া ছাত্র ছাত্রীদের জন্যই এই উদ্যোগ। তাদের কথা ভবেই এই আলোচনার প্রচেষ্টা। বিশিষ্টরা দূরে থাকুন । আমাদের একান্ত অনুরোধ যদি ছাত্র ছাত্রীরা এই আলোচনা থেকে উপকৃত হও তাহলে নীচের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে ভুলে যেও না। ]    


আকাশের সাতটি তারা

জীবনানন্দ দাশ


বাংলা কাব্য কবিতার জগতে রবীন্দ্র ঘরানার বাইরে এসে যিনি প্রথম কলম ধরলেন তিনি জীবনানন্দ দাশ। তিনি মূলত প্রকৃতির মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়কে কেন্দ্র করে তার মধ্যে  কোনো না কোনো মহৎ বিষয়কে রূপায়িত করেছেন। 'আকশের সাতটি তারা' কবিতাটি রূপসী বাংলা কাব্য গ্রন্থের ৭৩ টি কবিতার মধ্যে একটি অন্যতম কবিতা। কবির মৃত্যুর পর তার ভাই ৬২ টি কবিতা নিয়ে একটি কাব্য সংকলন প্রকাশ করেন। এবং নাম দেন রূপসী বাংলা।

কাব্য গ্রন্থের নাম থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় এই কবিতার সহজ বিষয় রূপে উঠে আসবে বাংলার পল্লী প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের কথা। এই কবিতাটিও তার ব্যতিক্রমী নয়। কোনো এক গোধূলি সন্ধ্যার আকাশে সাতটি তারার সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করে তার কবিতার নির্মাণ।

কবিতায় তিনি বলছেন এই বাংলার কোনো এক উন্মুক্ত প্রান্তরে বসে আকাশে সাতটি তারা প্রত্যক্ষ করছেন, সেই সাথে আকাশের বুকে লাল মেঘের উপস্থিতি দেখছেন। তারপরই কল্পনা করছেন গঙ্গাসাগরের ঢেউ, কেশবতী কন্যা, চুল, হিজল কাঠালবন, ধানের গন্ধ, কলমীর ঘ্রান, ঘাস, বট ফল ইত্যাদির মত ছোটছোট টুকরো টুকরো বিষয়। প্রাথমিক ভাবে পড়লে আমরা কোনো কিছুর সাথে কোনো কিছুরই মিল খুঁজে পাব না। আসলে কবি এই টুকরো টুকরো উপমা-চিত্রকল্পের মধ্য দিয়ে কোনো এক গভীর অনুভবে পৌঁছাতে চাইছেন।

আসলে এই কবিতায় অন্তর্নিহিত অর্থটি একমাত্র প্রধান বিষয়। তিনি কবিতার নামে যে সাতটি তারার কথা বললেন সেটি আসলে সাতজন পৌরানিক ঋষির নাম- পুলহ, ক্রতু, পুলস্ত্য, বশিষ্ট, অত্রি, অঙ্গিরা ও মরিচী। এই সাতজন ঋষি আসলে প্রজাপতি ব্রহ্মার অংশ। তাঁদের স্মরণে এই সপ্তর্ষি মন্ডল। মহাকাশে এর যেমন শোভা আছে তেমনই মৃত্যুর সাথে তারার সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। কবিতার ছত্রে ছত্রে তার বিন্যাস আমরা লক্ষ্য করব।

তিনি সাতটি তারার সাথে দেখছেন মেঘের রং কামরাঙার মত লাল এবং মৃত মনিয়া পাখি গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে।এখানে মনিয়া হল চঞ্চলতার প্রতীক যা কিনা আজ শান্ত। এবং আকাশের বুক চিড়ে কামরাঙার মত লাল আগুনে তার দহন হচ্ছে আর গঙ্গাসাগরের শান্ত স্নিগ্ধতায় তা মলিন হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ একটি কর্মজ্জ্বল একটি দিনের শেষ হচ্ছে। অন্ধকার মৃত্যু ক্রমশ নেমে আসছে চারদিকে। ঠিক তার পরেই কবি বলছেন নীল সন্ধ্যা কেশবতী কন্যা যেন আকাশে এসেছে,আমার চোখের 'পরে আমার মুখের 'পরে চুল তার ভাসে অর্থাৎ কবি অন্ধকার - প্রিয়জনের মৃত্যুকে অনুভব করছেন বারবার। তিনি বলছেন এই প্রকৃতিকে প্রিয়ার মতো এত কামনা দিয়ে এত মায়া ভরে আর কেউ কখনও দেখেনি। হিজল কাঠাল জামের মধ্যে দিয়ে তিনি প্রকৃতির প্রতিটি অভিব্যক্তি তিনি প্রাণ দিয়ে অনুভব করতে চাইছেন, যা কোনো ব্যক্তির প্রতিরূপ হিসাবে আমরা ভাবে নিতে পারি।

কবিতার দ্বিতীয় পঙতিতে এসে এই ভাবনা আরো জোরালো হয়। নরম ধানের মায়া গন্ধ, কলমীর তীক্ষ্ণ গন্ধ, হাঁসের পালকের কোমল ছোঁয়া, পুকুরের জলের স্নিগ্ধতা, মাছে দের আষ্টে গন্ধ, কিশোরীর চাল ধোয়া হাতের কোমল স্পর্শ সবই যেন কবিকে কামনার রসে জারিত করে যা তিনি প্রকৃতির ছোঁয়ায় খুঁজে পেতে চান বারবার। এর ঠিক পরেই অন্ধকার - মৃত্যুকে অনুভব করেছেন। লাল লাল বট ফলের মধ্যে ক্লান্ত নীরবতার শব্দকে তিনি শুনেছেন। নীরবে চলে যাওয়ার প্রতিটি মুহূর্তকে তিনি ভুলে থাকতে পারেন না বরং আরো আরো জড়িয়ে ধরতে চান বারবার। এই ঝরে যাওয়া পাতার মাঝেই নিজেকে খুঁজে পান। প্রকৃতির প্রতিটি অনুষঙ্গে তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়কে মিলিয়ে দিতে চান। কামনায় শিক্ত হয়ে প্রকৃতির মাঝেই এক সময় বিলীন হয়ে যেতে চান। আর তাই বলেন আকাশের সাতটি তারা যখন ওঠে আমি পাই টের। অর্থাৎ তিনি প্রতি মুহূর্তে ভূত ভবিষ্যতে বিলীন হয়ে যেতে চান, এই প্রকৃতির মাঝেই যেন তার স্থান হয় সেই বাসনাই উঠে এসেছে কবিতার মধ্যে দিয়ে।


COPYRIGHTS পুনর্মুদ্রণ যোগ্য নয়।

সংক্ষিপ্ত আলোচনা - খেয়াঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



[ বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ ebanglaschools এর সমস্ত আলোচনা কোনো পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গের জন্য নয়। সাধারণ এবং অতি সাধারণ পিছিয়ে পড়া ছাত্র ছাত্রীদের জন্যই এই উদ্যোগ। তাদের কথা ভবেই এই আলোচনার প্রচেষ্টা। বিশিষ্টরা দূরে থাকুন । আমাদের একান্ত অনুরোধ যদি ছাত্র ছাত্রীরা এই আলোচনা থেকে উপকৃত হও তাহলে নীচের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে ভুলে যেও না। ]    



খেয়া - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সংক্ষিপ্ত আলোচনা


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চৈতালি(১৮৯৬) কাব্যগ্রন্থের একটি অন্যতম কবিতা খেয়া। জমিদারী সূত্রে দীর্ঘদীন বাংলাদেশের সাজাদপুর - পাতিসরে থাকাকালীন তিনি নৌকা ভ্রমণ করতেন এবং সেখানেই দুপাশের গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা দুচোখ ভরে উপভোগ করেছিলেন। সেই রকমই এক সময়ে ১৩০৬ বঙ্গাব্দের চৈত্র থেকে শ্রাবণ মাসের মধ্যেই একটি কবিতা রচনা করলেন, যার নাম ‘খেয়া’, এটি এই কাব্যের ১৯ সংখ্যক একটি কবিতা। যেকোনো কবিতারই সাধারনত দুটি অর্থ থাকে – বাইরের অর্থ ও ভেতরের অর্থ। ‘খেয়া’ কবিতাটি পড়লে সাধারন পাঠকের কাছে উঠে আসে নিটোল এক গ্রামবাংলার মানুষের জীবনযাত্রার সাধারন ছবি। যেখান কবি আঁকেন দুই পাশে দুই জনপদ। একদিকে গ্রাম্যসভ্যতা ও অন্যদিক মফস্বল এবং মাঝখান থেকে বয়ে যাওয়া একটি নদী। এই নদী দুপাশের প্রান্তরকে আলাদা করলেও খেয়া বা নৌকা সেই দুই গ্রামের মানুষকে এক সূত্রে বেঁধে রেখেছে। এই খেয়াকে কেন্দ্র করেই বেঁচে আছে দুটি সভ্যতার মানুষজন। সাধারণ ভাবে আমরা জানি, গ্রামের মানুষের উপার্জিত আয় নির্ভর করে কৃষিজ ফসল বেচাকেনার মধ্য দিয়ে। সেকারনেই উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে নদী পেরিয়ে অন্য প্রান্তে তাদের নিত্য দিন পৌঁছাতে হয়। সেই সূত্র ধরেই তাদের পথ-ঘাট, মানুষ জন, তাদের কাঙ্ক্ষিত বিষয়গুলো পরস্পর পরস্পরকে চিনে নিয়েছে। আর সেখান থেকে অর্জিত অর্থ, সম্পদ তাদের জীবনকে সুন্দর ভাবে বাঁচতে সাহায্য করে। কারো কোনো দিন উপার্জন বেশি হলে যেমন স্মৃতি হয়ে থেকে যায়, তেমনি স্বল্প রোজগারে মনের মধ্যে তৈরি হয় দ্বন্দ্ব, আর উপার্জন না হলে খালি হাতে তাদের ফিরে আসতে হয়। এই সভ্যতা কোনো মানুষকে সহজে কিছু দেয়না, অর্জন করে নিতে হয়। গ্রামবাংলার এই ছবি কোনো নতুন কথা নয়। স্বল্প আয়ের মধ্য দিয়েই তারা ভালো থাকতে চায়, খুঁজে নিতে চায় তাদের আকাঙ্ক্ষা। প্রতিদিনের এই নিত্য যাপনে তাদের জীবন নিষ্পেষিত হয় প্রতিনিয়ত। তবু তারা হেরে যায় না। হয়ত তাদের ও জীবনে স্বচ্ছন্দ আসবে, রাজার মত তারাও সুখী হবে এই প্রত্যাশা নিয়ে বেঁচে থাকে প্রতিটা দিন, আর বেলার শেষে স্বপ্ন ভঙ্গ হলে বিমর্ষ হয়ে তারা ঘরে ফেরে। আশা আকাঙ্ক্ষার এই দোলাচলে এভাবেই কেটে যায় প্রতিটা দিন, প্রতিটা সময়। তাদের মনের দুঃখ কষ্ট কেউ জানতে চায় না। জানতে চায় না তাদের ভাললাগার খুঁটিনাটি। জমিদার আসে , সময় যায় তাদের জীবনের ইতিহাস বদলায় না। স্বাভাবিক ভাবে তাদের জীবনের কথাও কেও জানতে পারে না। শুধু মাত্র খেয়াকে সাথে করে ঈশ্বরের উপরে বিশ্বাস আর দুইজনপদের উপর আশা রেখে একটু সুখী জীবনের প্রত্যাশা করে প্রতি মুহূর্তে। কবি বলেন, এই জীর্ণ খেয়াই তাদের জীবনের একমাত্র ভরসা, যা তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ গ্রামের মানুষের সেই আর্ত কথাকেই তিনি তুলে ধরেছেন এই কবিতায়।  

COPYRIGHTS পুনর্মুদ্রণ যোগ্য নয়।