স্বাধীনতা - ল্যাংস্টন হিউজ


স্বাধীনতা
ল্যাংস্টন হিউজ

স্বাধীনতা কোনোদিনই আসবে না,
না,
আজ নয়
কোনোদিনই নয়
ভয় অথবা সমঝোতার মধ্যে,
তার কারন
আমাদেরও তো অন্য সকলের মতন
                        অধিকার রয়েছে,
দুপায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকার
দুকাঠা জমির মালিকানার,

শুনে শুনে কান পচে গেল,
‘সময়ে
সবই হবে, কাল একটা নতুন দিন’-


মৃত্যুর পরে তো আমার কোনো
স্বাধীনতার প্রয়োজন হবে না,
আগামীকালের রুটি
দিয়ে কি আজ বাঁচা যায়,
স্বাধীনতা একটা শক্তিশালী বীজপ্রবাহ,
বাঁচার জন্য,
একটা বড় প্রয়োজনের জন্য,
আমিও তো সেখানেই বাস করি,
তুমি যেখানে,

তাই
স্বাধীনতা আমার প্রয়োজন
তোমার যেমন।
















বৈষ্ণব পদাবলী



বৈষ্ণব পদাবলী
বৈষ্ণব পদাবলীর বিশেষত "পাঠ্য" ও উল্লেখযোগ্য কবি ও তাদের কিছু পদ এখানে দেওয়া হল।


বিদ্যাপতি
গোবিন্দদাস









কাজ চলছে...

বৈষ্ণব পদাবলী - চণ্ডীদাস



বৈষ্ণব পদাবলীর বিশেষত "পাঠ্য" ও উল্লেখযোগ্য কিছু পদ এখানে দেওয়া হল।




কেনা বাঁশী বা বড়ায়ি কালিনী নই কুলে
( "বড়ু" চণ্ডীদাস )

কেনা বাঁশী বা বড়ায়ি কালিনী নই কুলে।
কেনা বাঁশী বা বড়ায়ি এ গোঠ-গোকূলে ।
আকুল শরীর মোর বেআকুল মন।
বাঁশীর শবদে মো আউলাইল রান্ধন         ১
কেনা বাঁশী বাএ বড়ায়ি সেনা কোন জনা।
দাসী হআঁ তার পাএ নিশিবো আপনা       ধ্রু
কেনা বাঁশী বাএ বড়ায়ি চিত্তের হরিষে।
তার পাত্র বড়ায়ি মো কৈলোঁ কোন দোষে ।
আঝর ঝরএ মোর নয়নের পানী।
বাঁশীর শবদে বড়ায়ি হারায়িল পরানী।      ২
আকুল করিতে কিবা আহ্মার মন।
বাজাএ সুসর বাঁশী নান্দের নন্দন
পাখি নহোঁ তার ঠাই উড়ী পড়ি জাওঁ।
মেদিনী বিদার দেউ পসি লুকাওঁ            ৩
বন পোড়ে আগ বড়ায়ি জগজনে জানী।
মোর মন পোড়ে যে কুম্ভারের পানী
আস্তর সুখ মোর কাহ্ন-আভিলাসে।
বাসলী শিরে বন্দী গাইল চণ্ডীদাসে ।        ৪






কি মোহিনী জান বঁধু কি মোহিনী জান
( “দ্বিজ” চণ্ডীদাস )


কি মোহিনী জান বঁধু কি মোহিনী জান।
অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা হেন
রাতি কৈলু দিবস দিবস কৈলু রাতি।
বুঝিতে নারি বন্ধু তোমার পিরীতি
ঘর কৈলু বাহির বাহির কৈলু ঘর।
পর কৈলু আপন আপন কৈলু পর।
বন্ধু তুমি মোরে যদি নিদারুণ হও।
মরিব তোমার আগে দাঁড়াইয়া রও
বাশুলী-আদেশে দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়।

পরের লাগিয়া কি আপন পর হয় ।








সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম
( “দ্বিজ” চণ্ডীদাস )


সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম।
কানের ভিতর দিয়া          মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ
না জানি কতেক মধু         শ্যাম-নামে আছে গো
বদন ছাড়িতে নাহি পারে।
জপিতে জপিতে নাম         অবশ করিল গো
কেমনে পাইব সই তারে ।
নাম-পরতাপে যার           ঐছন করিল গো
অঙ্গের পরশে কিবা হয়।
যেখানে বসতি তার          নয়নে দেখিয়া গো
যুবতী-ধরম কৈছি রয় ।
পাসরিতে করি মনে         পাসরা না যায় গো
কি করিব কি হবে উপায়।
কহে দ্বিজ চণ্ডীদাসে          কুলবতী কুল নাশে
আপনার যৌবন যাচায় ।



বঁধূ কি আর বলিব আমি
( চণ্ডীদাস )


বঁধূ কি আর বলিব আমি।
জীবনে মরণে        জনমে জনমে
প্রাণনাথ হৈও তুমি ।
তোমার চরণে        আমার পরানে
লাগিল প্রেমের ফাঁসি।
সব সমর্পিয়া         একমন হৈয়া
নিশ্চয় হইলুঁ দাসী ।
ভাবিয়া দেখিলুঁ        এ তিন ভুবনে
আর কে আমার আছে।
রাধা বলি কেহ              শুধাইতে নাই
দাঁড়াইব কার কাছে।
এ-কুলে ও-কুলে      দু-কুলে গোকুলে
আপনা বলিব কায়।
শীতল বলিয়া         শরণ লইলুঁ
ও-দুটি কমল পায় ।
না ঠেলহ ছলে        অবলা অখলে
যে হয় উচিত তোর।
ভাবিয়া দেখিলুঁ       প্রাণনাথ বিনে
গতি যে নাহিক মোর ।
আঁখির নিমিখে       যদি নাহি হেরি
তবে সে পরাণে মরি।
চণ্ডীদাস কয়         পরশ-রতন
গলায় গাঁথিয়া পরি ।


বৈষ্ণব পদাবলী - জ্ঞানদাস


বৈষ্ণব পদাবলীর বিশেষত "পাঠ্য" ও উল্লেখযোগ্য কিছু পদ এখানে দেওয়া হল।



আলো মুঞি কেন গেলু কালিন্দীর কূলে
( জ্ঞানদাস )

আলো মুঞি কেন গেলু কালিন্দীর কূলে।
চিত হরি কালিয়া নাগর নিল চলে
রূপের পাথারে আঁখি ডুবি সে রহিল।
যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল
ঘরে যাইতে পথ মোর হৈল অফুরান।
অন্তরে বিদরে হিরা ফুকরে পরান !
চন্দন চাঁদের মাঝে মৃগমদ-ধাঁধা।
তার মাঝে হিয়ার পুতলী রৈল বাঁধা
কটি পীতবসন রশন তাহে জড়া।
বিধি নিরমিল কুলকলঙ্কের কোঁড়া
জাতি কুল শীল সব হেন বুঝি গেল।
ভুবন ভরিয়া মোর কলঙ্ক রহিল
কুলবর্তী সতী হৈয়া দুকুলে দিলু দুখ।
জ্ঞানদাস কহে দড় করি বাঁধ বুক।

অনুবাদ সাহিত্য



অনুবাদ সাহিত্য

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে যে বেশকিছু সাহিত্য রচিত হয়েছিল তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলা যেতে পারে অনুবাদ সাহিত্য। আমরা জানি, ১২০৬ খ্রীঃ যে তুর্কি আক্রমণ হয়েছিল তার ফলে বাংলাদেশের সমাজ এক বৃহৎ সংকটের মুখে পড়ে। অর্থাৎ, হিন্দু শাসনতন্ত্রের অবসান ও ইসলামীয় শাসনতন্ত্রের শুরু। এই সময় বিশেষত নীম্নবর্গীয় যে সকল হিন্দু জনজাতি ছিল তারা ক্রমশ ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে থাকে। কাজেই হিন্দুদের কাছে তাদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখা ছিল একমাত্র উপায়। আর সেই কারনেই একদল মানুষ অবক্ষয়িত হিন্দু সমাজকে পুনরুজ্জীবিত করতে ভারতীয় পুরানের অনুবাদ করতে থাকেন। তার-ই ফলে জন্ম নেয় অনুবাদ সাহিত্য।

         অনেকের মতে, বাংলায় ইসলামি শাসন শুরু হলে পাঠান সুলতানরা সভাকবিদের কাছ থেকে রামায়ন মহাভারতের গল্প শুনতে আগ্রহী হন, এবং অনুবাদ রচনায় উদ্বুদ্ধ করেন । যার ফলশ্রুতি মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্য। এর প্রমাণ স্বরূপ বলা যেতে পারে- রুকনুদ্দিন বরবক শাহ মালাধর বসুকে ভাগবতের অনুবাদ রচনার জন্য ‘গুণরাজখান’ উপাধি দেন। আবার পরাগল খা তার সভাকবিদের দিয়ে মহাভারত অনুবাদ করিয়ে নেন। ফলত, অনুবাদ সাহিত্য রচনার পিছনে যে ইসলামীয় রাজাদের প্রভাব ছিল না , সেটা অস্বীকার করা যায় না।

বাংলা সাহিত্যে অনুবাদ সাহিত্য মূলত তিনটি-
 রামায়ণ
মহাভারত
ভাগবত

        অনুবাদ সাহিত্য এ ক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য  রামায়ণ রচয়িতা  কৃত্তিবাস ওঝা বড়ু চন্ডীদাসের পরে তিনিই বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবি তাঁর রচিত রামায়ণ বাংলা ভাষায় প্রথম ও সর্বাধিক জনপ্রিয় কাব্য বর্ণনার হৃদয়গ্রাহিতা এবং ভাষার প্রাঞ্জলতাই এর জনপ্রিয়তার কারণকৃত্তিবাসী রামায়ণ হিসাবে পরিচিত গ্রন্থটি  ১৮০২ - ০৩ খ্রিস্টাব্দে  শ্রীরামপুর মিশন থেকে মুদ্রিত হয় মুদ্রণের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বঙ্গদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে

           রামায়ণেরকয়েকজন উল্লেখযোগ্য অনুবাদক ও কাব্যের নাম দেওয়া হলঃ


সময়কাল
কবি
কাব্যের নাম
পঞ্চদশ শতাব্দী
কৃত্তিবাস ওঝা
শ্রীরাম পাঁচালি
মাধব কন্দলি
শ্রীরাম পাঁচালি।
ষোড়শ শতাব্দী
শঙ্কর দেব
শ্রীরাম পাঁচালি (উত্তর কাণ্ড)
সপ্তদশ শতাব্দী
নিত্যানন্দ আচার্য
অদ্ভুত আচার্যের রামায়ণ
রামশঙ্কর দত্ত
রাম কথা
চন্দ্রাবতী
রামায়ণ
অষ্টাদশ শতাব্দী
রামচন্দ্র
বিভীষণের রায়বার
কাশীরাম
কালনেমির রায়বার
জগন্নাথ দাস
লঙ্কাকাণ্ড
উৎসবানন্দ
সীতার বনবাস
জগতরাম রায়
অদ্ভুত রামায়ণ



       মহাভারতের প্রথম বাংলা অনুবাদ হচ্ছে কবীন্দ্র মহাভারত  । আনুমানিক ১৫১৫ - ১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে  কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের বাংলা অনুবাদ করেন লস্কর পরাগল খাঁর নির্দেশে রচিত বলে এটি পরাগলী মহাভারত নামেও পরিচিত কবীন্দ্র মহাভারতে  অশ্বমেধপর্ব সংক্ষিপ্ত ছিল বলে ছুটি খাঁর নির্দেশে শ্রীকর নন্দী জৈমিনিসংহিতার অশ্বমেধপর্ব অবলম্বনে বিস্তৃত আকারে সেটি রচনা করেন, যাকে পৃথক গ্রন্থ না বলে বরং কবীন্দ্র মহাভারতের পরিশিষ্ট বলা চলে তবে বাংলা মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কাশীরাম দাস আনুমানিক ১৬০২ - ১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তাঁর কাব্য রচনা করেন । তিনি মহাভারতের কটি পর্ব অনুবাদ করেছিলেন তা জানা না গেলেও শ্রীরামপুর প্রেস থেকে ১৮০১-৩ খ্রিস্টাব্দে কাব্যটির চারটি পর্ব মুদ্রিত হয় পরবর্তী কালে জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের সম্পাদনায় ১৮৩৬ খ্রীঃ সম্পূর্ণ অংশ মুদ্রিত হয়। মধুর শব্দ , উপমা, অলংকার ছন্দের নৈপুন্যে তাঁর কাব্যশৈলী শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখে। কাশীরাম দাসের মহাভারত ‘ভারত পাঁচালি’ নামেও পরিচিত ছিল সকল বাংলা মহাভারতের অনুবাদের মধ্যে এটিই সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে


           মহাভারতের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য অনুবাদক ও কাব্যের নাম দেওয়া হলঃ

সময়কাল
কবি
কাব্যের নাম
ষোড়শ শতাব্দী
কবিন্দ্র পরমেশ্বর
পাণ্ডব বিজয়
শ্রীকর নন্দী
অশ্বমেধ কথা
রামচন্দ্র খান
অশ্বমেধ পর্ব
সপ্তদশ শতাব্দী
কাশীরাম দাস
মহাভারত
নিত্যানন্দ ঘোষ
মহাভারত
অষ্টাদশ শতাব্দী
দুর্লভ সিংহ
ভারত পাঁচালি
পুরুষোত্তম দাস
পাণ্ডব পাঁচালি


            সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ’সাধারণভাবে ভাগবত’নামে পরিচিতবেদব্যাস-প্রণীত অষ্টাদশ পুরাণের অন্যতম এবং তাঁর ব্রহ্মসুত্রের বারোটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত অকৃত্রিম ভাষ্য হল ‘ভাগবত’এর বিষয়বস্তু হল শ্রীকৃষ্ণেরর জীবনকথাবাংলায় 'ভাগবতচর্চার শুরু চৈতন্য-পূর্ব যুগে হলেও এর বিস্তার ঘটেছে চৈতন্য পরবর্তী যুগে ।  সংস্কৃত ভাগবত পুরাণ অবলম্বনে বাংলায় প্রথম কাব্য রচনা করেন বর্ধমান জেলার কুলীন গ্রাম নিবাসী মালাধর বসু বা গুণরাজ খান।  তিনি চৈতন্যপূর্ব যুগের কবি ছিলেনমালাধর বসুই ভাগবতের প্রথম অনুবাদকতার আগে অন্য কোনো ভাষায় ভাগবত অনূদিত হয়তাঁর কাব্যের নাম “শ্রীকৃষ্ণুবিজয়।  কাব্যটি ১৪৭৩-১৪৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত হয়েছিল।  শ্রীকৃষ্ণবিজয় রচনা করে তিনি গৌড়ের সুলতানের কাছ থেকে গুণরাজ খাঁ উপাধি পানশ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যের অপর নাম ছিল গোবিন্দমঙ্গল। এটিই সন-তারিখযুক্ত প্রথম বাংলা কাব্য। বিষ্ণুপুরাণ, হরিবংশ, বৈষুবীয় তন্ত্র গ্রন্থের অনুসরণে কবি তার কাব্য রচনা করেছেন।তাঁর কবিত্বের সঙ্গে ভক্তিপ্রাণতার মিশেল ও ঐশ্বর্যভাবের সঙ্গে মধুর কান্তাভাবের সমন্বয় শ্রী চৈতন্যও আস্বাদন করেন। রাধাভাবের উন্মেষ তার কাব্যেই প্রথম লক্ষ করা যায়, যা বৈষব পদাবলির পূর্বাভাসকে সূচিত করেছে। কাব্যে শ্রীকৃষ্ণুের ঐশ্বর্যভাবের চেয়ে মধুর ও কান্তা ভাবটিই বেশি প্রকাশ পেয়েছে। 

            ভাগবতের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য অনুবাদক ও কাব্যের নাম দেওয়া হলঃ
সময়কাল
কবি
কাব্যের নাম
পঞ্চদশ শতাব্দী
মালাধর বসু
শ্রীকৃষ্ণবিজয়
ষোড়শ শতাব্দী
গোবিন্দ আচার্য
কৃষ্ণমঙ্গল
দ্বিজ মাধব
শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল
সপ্তদশ শতাব্দী
যশশ্চন্দ্র
গোবিন্দবিলাস
অষ্টাদশ শতাব্দী
অভিরাম দাস
কৃষ্ণমঙ্গল
ঘনশ্যাম দাস
শ্রীকৃষ্ণবিলাস

-

কর্তার ভূত - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


কর্তার ভূত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৩২৬, শ্রাবণ
বুড়ো কর্তার মরণকালে দেশসুদ্ধ সবাই বলে উঠল, ‘তুমি গেলে আমাদের কী দশা হবে।’
শুনে তারও মনে দুঃখ হল। ভাবলে, ‘আমি গেলে এদের ঠাণ্ডা রাখবে কে।’
তা ব’লে মরণ তো এড়াবার জো নেই। তবু দেবতা দয়া করে বললেন, ‘ভাবনা কী। লোকটা ভূত হয়েই এদের ঘাড়ে চেপে থাক্‌‍-না। মানুষের মৃত্যু আছে, ভূতের তো মৃত্যু নেই।’

দেশের লোক ভারি নিশ্চিন্ত হল।
কেননা ভবিষ্যৎকে মানলেই তার জন্যে যত ভাবনা, ভূতকে মানলে কোনো ভাবনাই নেই; সকল ভাবনা ভূতের মাথায় চাপে। অথচ তার মাথা নেই, সুতরাং কারো জন্যে মাথাব্যথাও নেই।
তবু স্বভাবদোষে যারা নিজের ভাবনা নিজে ভাবতে যায় তারা খায় ভূতের কানমলা। সেই কানমলা না যায় ছাড়ানো, তার থেকে না যায় পালানো, তার বিরুদ্ধে না চলে নালিশ, তার সম্বন্ধে না আছে বিচার।
দেশসুদ্ধ লোক ভূতগ্রস্ত হয়ে চোখ বুজে চলে। দেশের তত্ত্বজ্ঞানীরা বলেন, ‘এই চোখ বুজে চলাই হচ্ছে জগতের সবচেয়ে আদিম চলা। একেই বলে অদৃষ্টের চালে চলা। সৃষ্টির প্রথম চক্ষুহীন কীটাণুরা এই চলা চলত; ঘাসের মধ্যে, গাছের মধ্যে, আজও এই চলার আভাস প্রচলিত।’
শুনে ভূতগ্রস্ত দেশ আপন আদিম আভিজাত্য অনুভব করে। তাতে অত্যন্ত আনন্দ পায়।
ভূতের নায়েব ভুতুড়ে জেলখানার দারোগা। সেই জেলখানার দেয়াল চোখে দেখা যায় না। এইজন্যে ভেবে পাওয়া যায় না, সেটাকে ফুটো করে কী উপায়ে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব।
এই জেলখানায় যে ঘানি নিরন্তর ঘোরাতে হয় তার থেকে এক ছটাক তেল বেরোয় না যা হাটে বিকোতে পারে, বেরোবার মধ্যে বেরিয়ে যায় মানুষের তেজ। সেই তেজ বেরিয়ে গেলে মানুষ ঠাণ্ডা হয়ে যায়। তাতে করে ভূতের রাজত্বে আর কিচ্ছুই না থাক্‌‍—অন্ন হোক, বস্ত্র হোক, স্বাস্থ্য হোক— শান্তি থাকে।
কত-যে শান্তি তার একটা দৃষ্টান্ত এই যে, অন্য সব দেশে ভূতের বাড়াবাড়ি হলেই মানুষ অস্থির হয়ে ওঝার খোঁজ করে। এখানে সে চিন্তাই নেই। কেননা ওঝাকেই আগেভাগে ভূতে পেয়ে বসেছে।


এই ভাবেই দিন চলত, ভূতশাসনতন্ত্র নিয়ে কারো মনে দ্বিধা জাগত না; চিরকালই গর্ব করতে পারত যে, এদের ভবিষ্যৎটা পোষা ভেড়ার মতো ভূতের খোঁটায় বাঁধা, সে ভবিষ্যৎ ভ্যা’ও করে না, ম্যা’ও করে না, চুপ করে পড়ে থাকে মাটিতে, যেন একেবারে চিরকালের মতো মাটি।
কেবল অতি সামান্য একটা কারণে একটু মুশকিল বাধল। সেটা হচ্ছে এই যে, পৃথিবীর অন্য দেশগুলোকে ভূতে পায় নি। তাই অন্য সব দেশে যত ঘানি ঘোরে তার থেকে তেল বেরোয় তাদের ভবিষ্যতের রথচক্রটাকে সচল করে রাখবার জন্যে,বুকের রক্ত পিষে ভূতের খর্পরে ঢেলে দেবার জন্যে নয়। কাজেই মানুষ সেখানে একেবারে জুড়িয়ে যায় নি। তারা ভয়ংকর সজাগ আছে।

এ দিকে দিব্যি ঠাণ্ডায় ভূতের রাজ্য জুড়ে ‘খোকা ঘুমোলো, পাড়া জুড়োলো’।
সেটা খোকার পক্ষে আরামের, খোকার অভিভাবকের পক্ষেও; আর পাড়ার কথা তো বলাই আছে।
কিন্তু, ‘বর্গি এল দেশে’।
নইলে ছন্দ মেলে না, ইতিহাসের পদটা খোঁড়া হয়েই থাকে।
দেশে যত শিরোমণি চূড়ামণি আছে সবাইকে জিজ্ঞাসা করা গেল, ‘এমন হল কেন।’
তারা এক বাক্যে শিখা নেড়ে বললে, ‘এটা ভূতের দোষ নয়, ভুতুড়ে দেশের দোষ নয়, একমাত্র বর্গিরই দোষ। বর্গি আসে কেন।’
শুনে সকলেই বললে, ‘তা তো বটেই।’ অত্যন্ত সান্ত্বনা বোধ করলে।
দোষ যারই থাক্, খিড়কির আনাচে-কানাচে ঘোরে ভূতের পেয়াদা, আর সদরের রাস্তায়-ঘাটে ঘোরে অভূতের পেয়াদা; ঘরে গেরস্তর টেঁকা দায়, ঘর থেকে বেরোবারও পথ নেই। এক দিক থেকে এ হাঁকে, ‘খাজনা দাও।’ আর-এক দিক থেকে ও হাঁকে, ‘খাজনা দাও।’
এখন কথাটা দাঁড়িয়েছে, ‘খাজনা দেব কিসে’।
এতকাল উত্তর দক্ষিণ পুব পশ্চিম থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নানা জাতের বুলবুলি এসে বেবাক ধান খেয়ে গেল, কারো হু ছিল না। জগতে যারা হুশয়ার এরা তাদের কাছে ঘেঁষতে চায় না, পাছে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। কিন্তু তারা অকস্মাৎ এদের অত্যন্ত কাছে ঘেঁষে, এবং প্রায়শ্চিতও করে না। শিরোমণি-চূড়ামণির দল পুঁথি খুলে বলেন, ‘বেহু যারা তারাই পবিত্র, হুশয়ার যারা তারাই অশুচি, অতএব হুশয়ারদের প্রতি উদাসীন থেকো, প্রবুদ্ধমিব সুপ্তঃ।’
শুনে সকলের অত্যন্ত আনন্দ হয়।

কিন্তু, তৎসত্ত্বেও এ প্রশ্নকে ঠেকানো যায় না, ‘খাজনা দেব কিসে’।
শ্মশান থেকে মশান থেকে ঝোড়ো হাওয়ায় হাহা ক’রে তার উত্তর আসে, ‘আব্রু দিয়ে, ইজ্জত দিয়ে, ইমান দিয়ে, বুকের রক্ত দিয়ে।’
প্রশ্নমাত্রেরই দোষ এই যে, যখন আসে একা আসে না। তাই আরও একটা প্রশ্ন উঠে পড়েছে, ‘ভূতের শাসনটাই কি অনন্তকাল চলবে।’
শুনে ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি আর মাসতুতো-পিসতুতোর দল কানে হাত দিয়ে বলে, ‘কী সর্বনাশ। এমন প্রশ্ন তো বাপের জন্মে শুনি নি। তা হলে সনাতন ঘুমের কী হবে— সেই আদিমতম, সকল জাগরণের চেয়ে প্রাচীনতম ঘুমের?’
প্রশ্নকারী বলে, ‘সে তো বুঝলুম, কিন্তু আধুনিকতম বুলবুলির ঝাঁক আর উপস্থিততম বর্গির দল, এদের কী করা যায়।’
মাসিপিসি বলে, ‘বুলবুলির ঝাঁককে কৃষ্ঞনাম শোনাব, আর বর্গির দলকেও।’
অর্বাচীনেরা উদ্ধত হয়ে বলে ওঠে, ‘যেমন করে পারি ভূত ছাড়াব।’
ভূতের নায়েব চোখ পাকিয়ে বলে, ‘চুপ। এখনো ঘানি অচল হয় নি।’
শুনে দেশের খোকা নিস্তব্ধ হয়, তার পরে পাশ ফিরে শোয়।

মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, বুড়ো কর্তা বেঁচেও নেই, মরেও নেই, ভূত হয়ে আছে। দেশটাকে সে নাড়েও না, অথচ ছাড়েও না।
দেশের মধ্যে দুটো-একটা মানুষ, যারা দিনের বেলা নায়েবের ভয়ে কথা কয় না, তারা গভীর রাত্রে হাত জোড় করে বলে, ‘কর্তা, এখনো কি ছাড়বার সময় হয় নি।’
কর্তা বলেন, ‘ওরে অবোধ, আমার ধরাও নেই, ছাড়াও নেই, তোরা ছাড়লেই আমার ছাড়া।’
তারা বলে, ‘ভয় করে যে, কর্তা।’
কর্তা বলেন, ‘সেইখানেই তো ভূত।’