Showing posts with label class 7. Show all posts
Showing posts with label class 7. Show all posts

ভারত-তীর্থ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভারত-তীর্থ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


হে মোর চিত্ত,পূণ্য তীর্থেজাগো রে ধীরে--
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।
হেথায় দাঁড়ায়ে দু-বাহু বাড়ায়ে নমি নর-দেবতারে,
উদার ছন্দে পরমানন্দে বন্দন করি তাঁরে।
ধ্যান-গম্ভীর এই যে ভূধর, নদীজপমালাধৃত প্রান্তর,
 হেথায় নিত্য হেরো পবিত্র  ধরিত্রীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।


কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা
দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে সমুদ্রে হল হারা।
হেথায় আর্য, হেথা অনার্য হেথায় দ্রাবিড়, চীন--
শক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।
পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার, সেথা হতে সবে আনে উপহার,
দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে  যাবে না ফিরে,
এই ভারতের মহামানবের  সাগরতীরে।


রণধারা বাহি জয়গান গাহি উন্মাদ কলরবে
ভেদি মরুপথ গিরিপর্বত যারা এসেছিল সবে,
তারা মোর মাঝে সবাই বিরাজে কেহ নহে নহে দূর,
আমার শোণিতে রয়েছে ধ্বনিতে তারি বিচিত্র সুর।
হে রুদ্রবীণা, বাজো, বাজো, বাজো, ঘৃণা করি দূরে আছে যারা আজও,
বন্ধ নাশিবে, তারাও আসিবে দাঁড়াবে ঘিরে
এই ভারতের মহামানবের  সাগরতীরে।


হেথা একদিন বিরামবিহীন  মহা ওংকারধ্বনি,
হৃদয়তন্ত্রে একের মন্ত্রে  উঠেছিল রনরনি।
তপস্যাবলে একের অনলে বহুরে আহুতি দিয়া
বিভেদ ভুলিল, জাগায়ে তুলিল একটি বিরাট হিয়া।
সেই সাধনার সে আরাধনার যজ্ঞশালায় খোলা আজি দ্বার,
হেথায় সবারে হবে মিলিবারে আনতশিরে--
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।


সেই হোমানলে হেরো আজি জ্বলে দুখের রক্ত শিখা,
হবে তা সহিতে মর্মে দহিতেআছে সে ভাগ্যে লিখা।
এ দুখ বহন করো মোর মন শোনো রে একের ডাক।
যত লাজ ভয় করো করো জয় অপমান দূরে থাক।
দুঃসহ ব্যথা হয়ে অবসান জন্ম লভিবে কী বিশাল প্রাণ।
পোহায় রজনী, জাগিছে জননী বিপুল নীড়ে,
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।



এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু মুসলমান।
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খৃস্টান।
এসো ব্রাহ্মণ শুচি করি মন ধরো হাত সবাকার,
এসো হে পতিত করো অপনীত সব অপমানভার।
মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা    মঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা,
সবারে-পরশে-পবিত্র-করা তীর্থনীরে।
আজি ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।


ব‌ই-ট‌ই - প্রেমেন্দ্র মিত্র



ব‌ই-ট‌ই
প্রেমেন্দ্র মিত্র


ব‌ই তো পড়ো, ট‌ই পড়ো কি?
তাই তো কাটি ছড়া।
ব‌ই পড়া সব মিছে-ই যদি
না হল ট‌ই পড়া।

ট‌ই পড়া যায় পড়তে কোথায়?
বলছি তবে শোনো।
ব‌ই-এর মাঝে লুকিয়ে থাকে
ট‌ই সে কোনও কোনও।

আর পাবে ট‌ই সকালবেলা
ব‌ই থেকে মুখ তুলে
হঠাৎ যদি বাইরে চেয়ে
মনটা ওঠে দুলে।

ট‌ই থাকে সব রোদ- মাখানো
গাছের ডালে পাতায়,
ট‌ই থাকে সেই আকাশ- ছোঁয়া
খোলা মাঠের খাতায়।

ট‌ই চমকায় বিজলি হয়ে
আঁধার- করা মেঘে,
খ‌ই হয়ে ট‌ই ফোটে দিঘির
জলে বৃষ্টি লেগে।

ট‌ই কাঁপে সব ছোট্ট পাখির
রংবেরঙের পাখায়
খোকা- খুকুর মুখে আবার
মিষ্টি হাসি মাখায়।

ব‌ই পড়ো খুব, যত পার,
সঙ্গে পড়ো ট‌ই।
ট‌ই ন‌ইলে থাকত কোথায়
এতরকম ব‌ই।।


জাতের বজ্জাতি - কাজী নজরুল ইসলাম




জাতের বজ্জাতি 
 কাজী নজরুল ইসলাম 

জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াত খেলছে জুয়া
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া॥
হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি, ভাবলি এতেই জাতির জান,
তাই তো বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে একশো-খান!
এখন দেখিস ভারত-জোড়া
পচে আছিস বাসি মড়া,
মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কাহুয়া॥


জানিস না কি ধর্ম সে যে বর্মসম সহনশীল,
তাকে কি ভাই ভাঙতে পারে ছোঁয়া-ছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল।
যে জাত-ধর্ম ঠুনকো এত,
আজ নয় কাল ভাঙবে সে তো,
যাক না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ, নাই পরোয়া॥

(সংক্ষেপিত)

আছেন কোথায় স্বর্গপুরে - লালন ফকির


আছেন কোথায় স্বর্গপুরে
লালন ফকির 

আছেন কোথায় স্বর্গপুরে কেউ নাহি তার ভেদ জানে।
কেন জিজ্ঞাসিলে খোদার কথা দেখায় আশমানে।।

পৃথিবী গোলাকার শুনি
      অহর্নিশি ঘোরে আপনি।
তাইতে হয় দিন-রজনী
      জ্ঞানী গুনী তাই মানে।।

একদিকেতে নিশি হলে
     অন্যদিকে দিবা বলে।
আকাশতো দেখে সকলে
     খোদা দেখে কয়জনে।।

আপন ঘরে কে কথা কয়
    না জেনে আসমানে তাকায়।
লালন বলে কেবা কোথায়
   বুঝিবে দিব্যজ্ঞানে।।

আঁকা লেখা - মৃদুল দাশগুপ্ত

আঁকা লেখা 
মৃদুল দাশগুপ্ত 

রঙ ছড়িয়ে খুশ খেয়ালে আমি যখন চিত্র আঁকি
তিনটি শালিক ঝগড়া থামায়, অবাক তাকায় চড়ুই পাখি
মৎস্য ভুলে মাছরাঙা তার নীল রঙটি ধার দিতে চায়
প্রজাপতির ঝাঁক চাইছে  তাদের রাখি আমার আঁকায়
গর্ত থেকে ইদুর, সেটাও পিটপিটে চোখ দেখছে চেয়ে
রঙ তুলিরা বেজায় খুশি আজ দুপুরে আমায় পেয়ে!

ওই যে মাঠে চাঁদের দুধের সর জমে যায় যখন পুরু
বাতাস ঈষৎ কাঁপন দিতেই আমার ছড়া লেখার শুরু
এবার যেন তারার মালা খুব গোপনে নামছে কাছে
'অ' লিখছে 'আ' লিখছে দশ জোনাকি বকুল গাছে
এই ছড়াতেই আজ আমাকে তোমার কাছে আনলো হাওয়া
সেই তো আমার পরম পুলক, সেই তো আমার পদক পাওয়া !

চিন্তাশীল - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


চিন্তাশীল


প্রথম দৃশ্য
 নরহরি চিন্তায় নিমগ্ন। ভাত শুকাইতেছে। মা মাছি তাড়াইতেছেন

মা। অত ভেবো না, মাথার ব্যামো হবে বাছা!

নরহরি। আচ্ছা মা, ‘ বাছা ' শব্দের ধাতু কী বলো দেখি।

মা। কী জানি বাপু!

নরহরি। ‘ বৎ স '। আজ তুমি বলছ ‘ বাছা ' — দু-হাজার বৎ সর আগে বলত ‘ বৎ স ' — এই কথাটা একবার ভালো করে ভেবে দেখো দেখি মা! কথাটা বড়ো সামান্য নয়। এ কথা যতই ভাববে ততই ভাবনার শেষ হবে না।

পুনরায় চিন্তায় মগ্ন

মা। যে ভাবনা শেষ হয় না এমন ভাবনার দরকার কী বাপ! ভাবনা তো তোর চিরকাল থাকবে, ভাত যে শুকোয়। লক্ষী আমার, একবার ওঠ্‌।

নরহরি। ( চমকিয়া) কী বললে মা? লক্ষ্মী? কী আশ্চর্য! এক কালে লক্ষ্মী বলতে দেবী-বিশেষকে বোঝাত। পরে লক্ষ্মীর গুণ অনুসারে সুশীলা স্ত্রীলোককে লক্ষ্মী বলত, কালক্রমে দেখো পুরুষের প্রতিও লক্ষ্মী শব্দের প্রয়োগ হচ্ছে! একবার ভেবে দেখো মা, আস্তে আস্তে ভাষার কেমন পরিবর্তন হয়! ভাবলে আশ্চর্য হতে হবে।

ভাবনায় দ্বিতীয় ডুব

মা। আমার আর কি কোনো ভাবনা নেই নরু? আচ্ছা, তুই তো এত ভাবিস, তুইই বল্‌ দেখি উপস্থিত কাজ উপস্থিত ভাবনা ছেড়ে কি এই-সব বাজে ভাবনা নিয়ে থাকা ভালো? সকল ভাবনারই তো সময় আছে।

নরহরি। এ কথাটা বড়ো গুরুতর মা! আমি হঠাৎ এর উত্তর দিতে পারব না। এটা কিছুদিন ভাবতে হবে, ভেবে পরে বলব।

মা। আমি যে কথাই বলি তোর ভাবনা তাতে কেবল বেড়েই ওঠে, কিছুতেই আর কমে না। কাজ নেই বাপু, আমি আর-কাউকে পাঠিয়ে দিই।

[ প্রস্থান ]

মাসিমা। ছি নরু, তুই কি পাগল হলি? ছেঁড়া চাদর, একমুখ দাড়ি — সমুখে ভাত নিয়ে ভাবনা! সুবলের মা তোকে দেখে হেসেই কুরুক্ষেত্র!

নরহরি। কুরুক্ষেত্র! আমাদের আর্যগৌরবের শ্মাশানক্ষেত্র! মনে পড়লে কি শরীর লোমাঞ্চিত হয় না! অন্তঃকরণ অধীর হয়ে ওঠে না! আহা, কত কথা মনে পড়ে! কত ভাবনাই জেগে ওঠে! বলো কী মাসি! হেসেই কুরুক্ষেত্র! তার চেয়ে বলো-না কেন কেঁদেই কুরুক্ষেত্র!

অশ্রুনিপাত

মাসিমা। ওমা, এ যে কাঁদতে বসল! আমাদের কথা শুনলেই এর শোক উপস্থিত হয়। কাজ নেই বাপু!

[ প্রস্থান]
দিদিমার প্রবেশ

দিদিমা। ও নরু, সূর্য যে অস্ত যায়!

নরহরি। ছি দিদিমা, সূর্য অস্ত যায় না। পৃথিবীই উলটে যায়। রোসো, আমি তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। ( চারি দিকে চাহিয়া) একটা গোল জিনিস কোথাও নেই?

দিদিমা। এই তোমার মাথা আছে — মুণ্ডু আছে।

নরহরি। কিন্তু মাথা যে বদ্ধ, মাথা যে ঘোরে না।

দিদিমা। তোমারই ঘোরে না, তোমার রকম দেখে পাড়াসুদ্ধ লোকের মাথা ঘুরছে! নাও, আর তোমায় বোঝাতে হবে না, এ দিকে ভাত জুড়িয়ে গেল, মাছি ভন্‌ ভন্‌ করছে।

নরহরি। ছি দিদিমা, এটা যে তুমি উলটো কথা বললে! মাছি তো ভন্‌ ভন্‌ করে না। মাছির ডানা থেকেই এইরকম শব্দ হয়। রোসো, আমি তোমাকে প্রমাণ করে দিচ্ছি —

দিদিমা। কাজ নেই তোমার প্রমাণ করে।

[ প্রস্থান


দ্বিতীয় দৃশ্য


নরহরি চিন্তামগ্ন। ভাবনা ভাঙাইবার উদ্দেশে নরহরির শিশু ভাগিনেয়কে কোলে করিয়া মাতার প্রবেশ

মা। ( শিশুর প্রতি) জাদু, তোমার মামাকে দণ্ডবৎ করো।

নরহরি। ছি মা, ওকে ভুল শিখিয়ো না। একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবে, ব্যাকরণ-অনুসারে দণ্ডবৎ করা হতেই পারে না — দণ্ডবৎ হওয়া বলে। কেন বুঝতে পেরেছ মা? কেননা দণ্ডবৎ মানে-

মা। না বাবা, আমাকে পরে বুঝিয়ে দিলেই হবে। তোমার ভাগ্‌নেকে এখন একটু আদর করো।

নরহরি। আদর করব? আচ্ছা, এসো আদর করি। ( শিশুকে কোলে লইয়া) কী করে আদর আরম্ভ করি? রোসো, একটু ভাবি।

চিন্তামগ্ন

মা। আদর করবি, তাতেও ভাবতে হবে নরু?

নরহরি। ভাবতে হবে না মা? বল কী! ছেলেবেলাকার আদরের উপরে ছেলের সমস্ত ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তা কি জান? ছেলেবেলাকার এক-একটা সামান্য ঘটনার ছায়া বৃহৎ আকার ধরে আমাদের সমস্ত যৌবনকালকে, আমাদের সমস্ত জীবনকে আচ্ছন্ন করে রাখে এটা যখন ভেবে দেখা যায় — তখন কি ছেলেকে আদর করা একটা সামান্য কাজ বলে মনে করা যায়? এইটে একবার ভেবে দেখো দেখি মা!

মা। থাক্‌ বাবা, সে কথা আর-একটু পরে ভাবব, এখন তোমার ভাগ্‌নেটির সঙ্গে দুটো কথা কও দেখি।

নরহরি। ওদের সঙ্গে এমন কথা কওয়া উচিত যাতে ওদের আমোদ এবং শিক্ষা দুই হয়। আচ্ছা, হরিদাস, তোমার নামের সমাস কী বলো দেখি।
হরিদাস। আমি চমা কাব।

মা। দেখো দেখি বাছা, ওকে এ-সব কথা জিগেস কর কেন? ও কী জানে!

নরহরি। না, ওকে এই বেলা থেকে এইরকম করে অল্পে অল্পে মুখস্থ করিয়ে দেব।

মা। ( ছেলে তুলিয়া লইয়া) না বাবা, কাজ নেই তোমার আদর করে।

নরহরি মাথায় হাত দিয়া পুনশ্চ চিন্তায় মগ্ন

(কাতর হইয়া ) বাবা, আমায় কাশী পাঠিয়ে দে, আমি কাশীবাসী হব।

নরহরি। তা যাও-না মা! তোমার ইচ্ছে হয়েছে, আমি বাধা দেব না।

মা। ( স্বগত) নরু আমার সকল কথাতেই ভেবে অস্থির হয়ে পড়ে, এটাতে বড়ো বেশি ভাবতে হল না। ( প্রকাশ্যে) তা হলে তো আমাকে মাসে মাসে কিছু টাকার বন্দোবস্ত করে দিতে হবে।

নরহরি। সত্যি নাকি? তা হলে আমাকে আর কিছুদিন ধরে ভাবতে হবে। একথা নিতান্ত সহজ নয়। আমি এক হপ্তা ভেবে পরে বলব।

মা। ( ব্যস্ত হইয়া) না বাবা, তোমার আর ভাবতে হবে না — আমার কাশী গিয়ে কাজ নেই।