হিমালয় দর্শন - বেগম রােকেয়া


হিমালয় দর্শন
বেগম রােকেয়া

যথা সময় যাত্রা করিয়া শিলিগুড়ি স্টেশনে আসিয়া পঁহুছিলাম। শিলিগুড়ি হইতে হিমালয় রেল রােড আরম্ভ হইয়াছে। ইস্ট ইন্ডিয়ান গাড়ির অপেক্ষা ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলগাড়ি ছােটো, হিমালয়ান রেলগাড়ি আবার তাহার অপেক্ষাও ছােটো, ক্ষুদ্র গাড়িগুলি খেলনা গাড়ির মতাে বেশ সুন্দর দেখায়। আর গাড়িগুলি খুব নীচু।-যাত্রীগণ ইচ্ছা করিলে চলিবার সময়ও অনায়াসে উঠিতে নামিতে পারেন।
আমাদের ট্রেন অনেক আঁকাবাঁকা পথ অতিক্রম করিয়া ধীরে ধীরে উপরে উঠিতে লাগিলগাড়িগুলি ‘কটাটটা’-শব্দ করিতে করিতে কখনও দক্ষিণে কখনও উত্তরে আঁকিয়া বাঁকিয়া চলিল। পথের দুই ধারে মনােরম দৃশ্য—কোথাও অতি উচ্চ (step) চূড়া, কোথাও নিবিড় অরণ্য।
ক্রমে আমরা সমুদ্র (sea level) হইতে তিন হাজার ফিট উচ্চে উঠিয়াছি, এখনও শীত বােধ হয় না, কিন্তু মেঘের ভেতর দিয়া চলিয়াছি। নিম্ন উপত্যকায় নির্মল শ্বেত কুজঝটিকা দেখিয়া সহসা নদী বলিয়া ভ্রম জন্মে। তরু, লতা, ঘাস, পাতা-সকলই মনােহর। এত বড়াে বড়াে ঘাস আমি পূর্বে দেখি নাই। হরিদ্বর্ণ চায়ের ক্ষেত্রগুলি প্রাকৃতিক শােভা আরও শতগুণ বৃদ্ধি করিয়াছে। দূর হইতে সারি সারি চারাগুলি বড়াে সুন্দর বােধ হয়। মাঝে মাঝে মানুষের চলিবার সংকীর্ণ পথগুলি ধরণীর সীমন্তের ন্যায় দেখায়! নিবিড় শ্যামল বন বসুমতীর ঘন কেশপাশ, আর পথগুলি আঁকা বাঁকা সিথি!
রেলপথে অনেকগুলি জলপ্রপাত বা নিঝর দৃষ্টিগােচর হইল—ইহার সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। কোথা হইতে আসিয়া ভীমবেগে হিমাদ্রির পাষাণ হৃদয় বিদীর্ণ করিতে করিতে ইহারা কোথায় চলিয়াছে। ইহাদেরই কোন একটি বিশালকায় জাহ্নবীর উৎস, একথা সহসা বিশ্বাস হয় কি? একটি বড়াে ঝরনার নিকট ট্রেন থামিল, আমরা ভাবিলাম, যাহাতে আমরা প্রাণ ভরিয়া জলপ্রবাহ দেখিতে পাই, সেই জন্য বােধহয় গাড়ি থামিয়াছে। (বাস্তবিক সেজন্য কিন্তু ট্রেন থামে নাই—অন্য কারণ ছিল। সেইখানে জল পরিবর্তন করা হইতেছিল।) যে কারণেই ট্রেন থামুক-আমাদের মনােরথ পূর্ণ হইল।
এখন আমরা চারি হাজার ফিট উর্ধ্বে উঠিয়াছি, বুশীত অনুভব করি না, কিন্তু গরমের জ্বালায় যে এতক্ষণ প্রাণ কষ্ঠাগত ছিল-সে জুলুম হইতে রক্ষা পাইলাম। অল্প অল্প বাতাস মৃদু গতিতে বহিতেছে।
অবশেষে কারসিয়ং স্টেশনে উপস্থিত হইলাম, এখানকার উচ্চতা ৪৮৬৪ ফিট। স্টেশন হইতে আমাদের বাসা অধিক দূর নহে, শীঘ্রই আসিয়া পঁহুছিলাম। আমাদের ট্রাঙ্ক কয়টা প্রমক্রমে দার্জিলিঙের ঠিকানায় book করা হইয়াছিল। জিনিসপত্রের অভাবে বাসায় আসিয়াও (সন্ধ্যার পূর্বে) গৃহসুখ (at home) অনুভব করিতে পারি নাই! সন্ধ্যার ট্রেনে আমাদের ট্রাঙ্কগুলি ফিরিয়া আসিল। আমাদের দার্জিলিং যাইবার পূর্বে আমাদের জিনিসপত্র থাকার বায়ু সেবন করিয়া চরিতার্থ হইল! পরদিন হইতে আমরা সম্পূর্ণ গৃহসুখে আছি। তাই বলি, কেবল আশ্রয় পাইলে সুখে গৃহে থাকা হয় না, আবশ্যকীয় আসবাব সরঞ্জামও চাই।
এখানে এখনও শীতের বৃদ্ধি হয় নাই, গ্রীষ্মও নাই। এ সময়কে পার্বত্য বসন্তকাল বলিলে কেমন হয় ? সুর্যকিরণ প্রখর বােধ হয়। আমাদের আসিবার পর একদিন মাত্র সামান্য বৃষ্টি হইয়াছিল। বায়ু ততখুবই স্বাস্থ্যকর, জল নাকি খুব ভালাে নহে। আমরা পানীয় জল ফিলটারে ছাঁকিয়া ব্যবহার করি। জল কিন্তু দেখিতে খুব পরিষ্কার স্বচ্ছ। কূপ নাই, নদী পুষ্করিণীও নাই—সবে ধন নিঝরের জল। ঝরনার সুবিমল, সুশীতল জলদর্শনে চক্ষু জুড়ায়, স্পর্শনে হস্ত জুড়ায় এবং ইহার চতুস্পার্ঘস্থিত শীতল বাতাসে, না, ঘন কুয়াশায় প্রাণ জুড়ায়!
এখানকার বায়ু পরিস্কার ও হালকা। বায়ু এবং মেদের লুকোচুরি খেলা দেখিতে চমৎকার ! এই মেঘ এদিকে আছে, ওদিক হইতে বাতাস আসিল,মেঘখণ্ডকে তাড়াইয়া লইয়া চলিল। প্রতিদিন অস্তমান রবি বায়ু এবং মেঘ লইয়া মনােহর সৌন্দর্যের রাজ্য রচনা করে। পশ্চিম গগনে পাহাড়ের গায়ে তরল স্বর্ণ ঢালিয়া দেওয়া হয়। অতঃপর খণ্ড খণ্ড সুকুমার মেঘগুলি সুকোমল অঙ্গে সুবর্ণ মাখিয়া বায়ুভরে ইতস্তত ছুটাছুটি করিতে থাকে। ইহাদের এই তামাশা দেখিতেই আমার সময় অতিবাহিত হয়, আত্মহারা হইয়া থাকি, আমি কোনাে কাজ করিতে পারি না।
মনে পড়ে একবার মহিলায় টেকির শাকের কথা পাঠ করিয়াছি। টেকি শাককে আমি ক্ষুদ্র গুল্ম বলিয়াই জানিতাম। কেবল ভূ-তত্ত্ব (Geology) গ্রন্থে পাঠ করিয়াছিলাম যে, কারনিফেরাস যুগে বড় বড় ঢেকিন্তু ছিল। এখন সেই টেকিতবু স্বচক্ষে দেখিলাম—ভারী আনন্দ হইল। তরুবর ২০/২৫ ফিট উচ্চ হইবে।
কোনাে কোনাে স্থানে খুব নিবিড় বন। সুখের বিষয় বাঘ নাই, তাই নির্ভয়ে বেড়াইতে পারি, আমরা নির্জন বন্য পথেই বেড়াইতে ভালােবাসি। সর্প এবং ছিনে জোঁক আছে। এ পর্যন্ত সর্পের সহিত আমাদের সাক্ষাৎ হয় নাই। কেবল দুই তিন বার জোঁকে রক্ত শােষণ করিয়াছে।
এদেশের স্ত্রীলােকেরা জোঁক দেখিলে ভয় পায় না। আমাদের ভুটিয়া চাকরানি ‘ভালু' বলে, ‘জেকে কি ক্ষতি করে ? রক্ত শােষণ শেষ হইলে আপনিই চলিয়া যায়। ভুটিয়ানিরা সাত গজ লম্বা কাপড় ঘাঘরার মতাে করিয়াপরে, কোমরে একখণ্ড কাপড় জড়ানাে থাকে, গায়ে জ্যাকেট এবং বিলাতি শাল দ্বারা মাথা ঢাকে, পৃষ্ঠে দুই এক মন বােঝা লইয়া অনায়াসে প্রস্তর-সল আবুড়াখাবুড়া পথ বহিয়া উচ্চে উঠে; ঐরুপ নীচেও যায়। যে পথ দেখিয়াই আমাদের সাহস গায়েব হয়—সেই পথে উহারা বােঝা লইয়া অবলীলাক্রমে উঠে।

মহিলার সম্পাদক মহাশয় আমাদের সম্বন্ধে একবার লিখিয়াছিলেন যে, রমণীজাতি দুর্বল বলিয়া তাঁহাদের নাম অবলা। জিজ্ঞাসা করি, এই ভূটিয়ানিরাও ঐ অবলা জাতির অন্তর্গত না কি? ইহারা উদরান্নের জন্য পুরুষদের প্রত্যাশী নহে; সমভাবে উপার্জন করে। বরং অধিকাংশ স্ত্রীলােকদিগকেই পাথর বহিতে দেখি-পুরুষেরা বেশি বােঝা বহন করে না। অবলারা প্রস্তর বহিয়া লইয়া যায়। সবলেরা পথে পাথর বিছাইয়া রাস্তা প্রস্তুত করে, সে কাজে বালক বালিকরাও যােগদান করে। এখানে সবলেরা বালক বালিকার দলভুক্ত বলিয়া বােধ হয়। | ভূটিয়ানিরা পাহাড়নি” বলিয়া আপন পরিচয় দেয়, এবং আমাদিগকে নীচেকা আমি’ বলে! যেন ইহাদের মতে নীচেকা আদমি'-ই অসভ্য! স্বভাবত ইহারা শ্রমশীলা, কার্যপ্রিয়, সাহসী ও সত্যবাদী। কিন্তু নীচেকা আদমি'র সংস্রবে থাকিয়া ইহারা ক্রমশ সশ্যাণরাজি হারাইতেছে। বাজারের পয়সা অল্পস্বল্প চুরি করা, দুধে জল মিশানাে ইত্যাদি দোষ শিখিতেছে। আবার ‘নীচেকা আদমি'র সঙ্গে বিবাহও হয়! ঐরূপে উহারা অন্যান্য জাতির সহিত মিশিতেছে। | আমাদের বাসা হইতে প্রায় এক মাইল দূরে বড়াে একটা ঝরনা বহিতেছে; এখান হইতে ঐ দুগ্ধফেননিভ জলের স্রোত দেখা যায়। দিবানিশি তাহার কল্লোল গীতি শুনিয়া ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির উচ্ছাস দ্বিগুণ ত্রিগুণ বেগে প্রবাহিত হয়। বলি, প্রাণটাও কেন ঐ নিঝরের ন্যায় বহিয়া গিয়া পরমেশ্বরের চরণপ্রান্তে লুটাইয়া পড়ে না?
অধিক কী বলিব, আমি পাহাড়ে আসিয়া অত্যন্ত সুখী এবং ঈশ্বরের নিকট কৃতজ্ঞ হইয়াছি। সমুদ্রের সামান্য নমুনা, অর্থাৎ বঙ্গোপসাগর দেখিয়াছি, বাকি ছিল পর্বতের একটি নমুনা দেখা। এখন সে সাধও পূর্ণ হইল। | না, সাধ তাে মিটে নাই! যত দেখি, ততই দর্শন পিপাসা শতগুণ বাড়ে! কিন্তু কেবল দুইটি চক্ষু দিয়াছেন, তাহা দ্বারা কত দেখিব? প্রভু অনেকগুলি চক্ষু দেন নাই কেন? যত দেখি, যত ভাবি, তাহা ভাষায় ব্যক্ত করিবার ক্ষমতা নাই। প্রত্যেকটি উচ্চশৃশ, প্রত্যেকটি ঝরনা প্রথমে যেন বলে, আমায় দেখ! আমায় দেখ! যখন তাহাকে বিস্ময়-বিস্ফারিত নয়নে দেখি, তখন তাহারা ঈষৎ হাস্যে ভূকুটি করিয়া বলে, আমাকে কী দেখ? আমার স্রষ্টাকে স্মরণ করাে! ঠিক কথা। চিত্র দেখিয়া চিত্রকরের নৈপুণ্য বুঝা যায়। নতুবা নাম শুনিয়া কে কাহাকে চিনে? আমাদের জন্য হিমালয়ের এই পাদদেশটুকু কত বৃহৎ, কত বিস্তৃত-কী মহান! আর সেই মহাশিল্পীর সৃষ্ট জগতে হিমালয় কত ক্ষুদ্র! বালুকাকণা বলিলেও বড়াে বলা হয়!
আমাদের এমন সুন্দর চক্ষু, কর্ণ, মন লইয়া যদি আমরা স্রষ্টার গুণকীর্তন না করি, তবে কি কৃতগ্নতা হয় না? মন, মস্তিষ্ক, প্রাণ সৰ লইয়া উপাসনা করিলে, তবে তৃপ্তি হয়। কেবল টিয়াপাখির মতাে কণ্ঠস্থ কতকগুলি শব্দ উচ্চারণ করিলে (অন্তত আমার মতে) উপাসনা হয় না। তদ্রুপ উপাসনায় প্রাণের আবেগ থাকে কই? প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দর্শনকালে মন প্রাণ স্বতঃই সমস্বরে বলিয়া উঠে, “ঈশ্বরই প্রশংসার যােগ্য। তিনিই ধন্য। তখন এসব কথা মুখে উচ্চারণের প্রয়ােজনও হয় না।
(সংক্ষেপিত ও সম্পাদিত)

0 comments:

Post a Comment