ডাকাতের মা - সতীনাথ ভাদুড়ী


ডাকাতের মা
সতীনাথ ভাদুড়ী
আগে সে ছিল ডাকাতের বউ। সৌখীর বাপ মরে যাবার পর থেকে তার পরিচয় ডাকাতের মা বলে। ...ডাকাতের মায়ের ঘুম কি পাতলা না হলে চলে। রাতবিরেতে কখন দরজায় টোকা পড়বে তার কি ঠিক আছে। টকটক করে দু-টোকার শব্দ থেমে থেমে তিনবার হলে বুঝতে হবে দলের লােক টাকা দিতে এসেছে। তিনবারের পর আরও একবার হলে বুঝতে হবে যে, সৌখী নিজে বাড়ি ফিরল। ছেলের আবার কড়া হুকুম- ‘তখনই দরজা খুলবি না হুট করে! খবরদার! দশবার নিশ্বাস ফেলতে যতক্ষণ সময় লাগে ততক্ষণ অপেক্ষা করবি। তারপর দরজা খুলবি। ...আরও কত রকমের টোকা মারবার রকমফের আছে। কতবার হয়েছে, কতবার বদলেছে। দুনিয়ায় বিশ্বাস করবে কাকে; পুলিশকে ঠেকানাে যায়; কিন্তু দলের কারও মনে যখন পাপ ঢােকে তখন তাকে ঠেকানাে হয় মুশকিল। দিনকালই পড়েছে অন্যরকম! সৌখীর বাপের মুখে শােনা যে, সেকালে দলের কে যেন জখম হয়ে ধরা পড়বার পর, নিজের হাতে নিজের জিব কেটে ফেলেছিল- পাছে পুলিশের কাছে দলের সম্বন্ধে কিছু বলে ফেলে সেই ভয়ে। আর আজকাল তিন বছর থেকে আর দেয় না। এ কী কখনও হতে পারত 'আগেকার কালে? ন্যায়-অন্যায় কর্তব্য-অকর্তব্যের পটিই কী একেবারে উঠে গেল দুনিয়া থেকে? সৌখীর বাপ কতবার জেলে গিয়েছে; সৌখীরও তাে এর আগে দু-বার কয়েদ হয়েছে; কখনও তাে দলের লােকে এর আগে এমন ব্যবহার করেনি। মাস না যেতেই হাতে টাকা এসে পৌছেছেকখনও বা আগাম—তিন-চার মাসের একসঙ্গে। কিন্তু এবার দেখাে তাে কাণ্ড! একটা সংসার পয়সার অভাবে ভেসে গেল কিনা তা একবার উঁকি মেরে দেখল না দলের লােক! আগের বউমার শরীরটা ছিল ভালাে। সৌখীর এবারকার বউটা রােগা-রােগা। তার উপর ছেলে হবার পর একেবারে ভেঙে গিয়েছে শরীর। সৌখী যখন একবার ধরা পড়ে, তখন বউমার ছেলে পেটে। হ্যা, নাতিটার বয়স চার-পাঁচ বছর হল বইকি। কী কপাল নিয়ে এসেছিল। যার বাপের নামে চৌকিদারসাহেব কাপে, দারােগাসাহেব পর্যন্ত যার বাপকে তুইতােকারি করতে সাহস করেননি কোনােদিন, তারই কিনা দু-বেলা ভাত জোটে না! হায় রে কপাল! এ বউ যে খাটতে পারে না ওই রােগা শরীর নিয়ে। আমি বুড়াে মানুষ, কোনােরকমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দুটো খই-মুড়ি বেচে আসি। তা দিয়ে নিজের পেট চালানােই শক্ত। সাধে কী আর বউমাকে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে হল! তাছাড়া গয়লাবাড়ির মেয়ে। ঝি-চাকরের কাজও তাে আমরা করতে পারি না। করলেই বা রাখত কে? সৌখীর মা-বউকে কি কেউ বিশ্বাস পায়! নইলে আমার কি ইচ্ছা করে না যে, বউ-নাতিকে নিয়ে ঘর করি! বেয়াইয়ের দুটো মোষআছে। তবু বউ-নাতিটার পেটে একটু একটু দুধ পড়ছে। ওদের শরীরে দরকার দুধের। আর বছরখানেক বাদেই তাে সৌখী ছাড় পাবে। তখন বউকে নিয়ে এসে রুপাের গয়না দিয়ে মুড়ে দেবে। দেখিয়ে দেব। পাড়ার লােকদের যে, সৌখীর মায়ের নাতি পথের ভিখিরি নয়। আসতে দাও না সৌখীকে! দলের ওই বদলােকগুলােকেও ঠান্ডা করতে হবে। আমি বলি, এসব একলসেঁড়ে লােকদের দলে না নিলেই হয়। ওরা কী ডাকাত নামের যুগ্যি; চোর, ছিচকে চোর! ওই যেটা টাকা দিতে আসত, সেটার চেহারা দেখেছ? তালপাতার সেপাই। থুতনির নীচে দু-গাছা দাড়ি! কালি-ঝুলিই মাখাে, আর মশালই হাতে নাও, ওই রােগা-পটকাকে দেখে কেউ ভয় পাবে কস্মিনকালে?...

ঘুম আর আসতে চায় না। রােজ রাতেই এই অবস্থা। মাথা পর্যন্ত কম্বলের মধ্যে ঢুকিয়ে না নিলে তার কোনাে কালেই ঘুম হয় না শীতের দিনে।...একবার সৌখী কোথা থেকে রাত-দুপুরে ফিরে এসে টোকার সাড়া না পেয়ে, কী মারই মেরেছিল মাকে! বলে দিয়েছিল যে ফের যদি কোনােদিন নাকমুখ ঢেকে শুতে দেখি, তাহলে খুন করে ফেলে দেব! বাপের বেটা, তাই মেজাজ অমন কড়া। আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দিয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমুলেও একটা বকুনি দেবার লােক পর্যন্ত নেই বাড়িতে, গেল পাঁচ বছরের মধ্যে! এ কী কম দুঃখের কথা...।

ঘুমের অসুবিধা হলেও, ছেলের কথা মনে করে সে এক দিনের জন্যও নাকমুখ ঢেকে শােয়নি পাঁচ বছরের মধ্যে।

...বাইরে নােনা আতা গাছতলায় শুকনাে পাতার উপর একটু খড়খড়ি করে শব্দ হল। গন্ধগোকুল কিংবা শিয়ালটিয়াল হবে বােধ হয়। কী খেতে যে এরা আসে বােঝা দায় ...বুড়াে হয়ে শীত বেড়েছে। আগে একখান কম্বলে কেমন দিব্যি চলে যেত। এ কম্বলখানা হয়েছে অনেক কালের পুরােনাে। এর আগের বার সৌখী জেল থেকে এনেছিল। সে কী আজকের কথা!
কম্বলখানার বয়স ক-বছর হবে তার হিসাব করতে গিয়ে বাধা পড়ে। টকটক করে টোকা পড়ার মতাে শব্দ যেন কানে এল। টিকটিকির ডাক বােধ হয়! হাতি পাঁকে পড়লে ব্যাঙেও লাথি মারে। টিকটিকিটা সুদ্ধ খুনশুড়ি আরম্ভ করেছে মজা দেখবার জন্য। করে নে।
টকটক করে আবার দরজায় দুটো টোকা পড়ল। ...না। তাহলে টিকটিকি না তাে। আওয়াজটা খনখনে—টিনের কপাটের উপর টোকা মারবার শব্দ।
বুড়ি উঠে বসে। ঘর গরম রাখার জন্য সে আগুন করেছিল মেঝেতে, সেটা কখন নিভে গিয়েছে; কিন্তু তার ধোঁয়া ঘরের অন্ধকারকে আরও জমাট করে তুলেছে।... এতদিনে কী তাহলে দলের হতভাগাগুলাের মনে পড়েছে সৌখীর মায়ের কথা ?
আবার দরজায় দুটো টোকা পড়ল। আর সন্দেহ নেই। অনেক দিনের অনভ্যাসের পর এই সামান্য। ব্যাপারটা বুড়ির মনের মধ্যে একটু উত্তেজনা এনেছে।
...তবু বলা যায় না। ...কে না কে...
সৌখীর মা আস্তে আস্তে উঠে দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বন্ধ কপাটের ফাক দিয়ে বাইরের লােকটাকে দেখবার চেষ্টা করল। ...লােকটাও বােধ হয় কপাটের ফাঁক দিয়ে ভিতরে দেখবার চেষ্টা করছে। বাইরেও ঘুটঘুটে অন্ধকার, কিছু দেখা যায় না। বিড়ির গন্ধ নাকে আসছে। ..আবার টোকা পড়ল দুটো। এবার একেবারে কানের কাছে। এ টোকা পড়বার কথা ছিল না। অবাক কাণ্ড! তাহলে তাে লােকটা টাকা দিতে আসেনি! পুলিশের লােকটোক নয় তাে? টোকা মারবার নিয়মকানুনগুলাে হয়তাে ভালাে জানে না! ...সৌখীর ছাড়া পাবার যে এখনও বহু দেরি! ...নিশ্চয়ই পুলিশের লােক। তবে তুমি যে-ই হও, টাকা দিলে নিশ্চয়ই নিয়ে নেব; তারপর অন্য কথা। ...কথা বলতে হবে সাবধানে; দলের কারও নামধাম আবার মুখ দিয়ে বেরিয়ে না পড়ে অজান্তে ।...
হঠাৎ মনে পড়ল, হুড়কো খুলবার আগে দশবার নিশ্বাস ফেলবার কথা। মানসিক উত্তেজনায় নিশ্বাস পড়ছেই না তা গুনবে কী।...বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করছে। বুড়ি তাড়াতাড়ি দশবার নিশ্বাস ফেলে নিয়মরক্ষা করে নিল।
দরজা খুলে সম্মুখে এক লম্বাচওড়া লােককে দেখে ডাকাতের মায়েরও গা ছমছম করে।। ‘ঘর যে একবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঢুকি কী করে? ‘কে, সৌখী। ওমা তুই। আমি ভাবি কে না কে।
বুড়ি ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছে।...এ ছেলে বুড়াে হয়েও সেই একই রকম থেকে গেল। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ফিরছে; বুক ফুলিয়ে পাড়া জাগিয়ে ঢুকতে পারত বাড়িতে অনায়াসে। কিন্তু দরজায় টোকা মেরে মা-র সঙ্গে খুনশুড়ি হচ্ছিল এতক্ষণ।...এ আনন্দ তার রাখবার জায়গা নেই।..
‘লাটসাহেব জেল দেখতে গিয়েছিল। আমার কাজ দেখে খুশি হয়ে ছেড়ে দেবার হুকুম দিয়ে দিল। খুশি আর কী। হেড জমাদার সাহেবকে টাকা খাইয়েছিলম। সেই সুপারিশ করে দিয়েছিল জেলারবাবুর কাছে। তাই বেশি রেমিশন পেয়ে গেলাম। আচ্ছা, তুই কুপিটা জ্বাল তাে আগে। তারপর সব কথা হবে।
দরকারের চাইতেও জোরে কথাগুলাে বলল সৌখী যাতে ঘরের অন্য সকলেও শুনতে পায়। তারপর মাকে কেরােসিন তেলের টেমিটাকে খুজতে সাহায্য করবার জন্য দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে তুলে ধরে।
বুড়ি এতক্ষণে আলােতে মুখ দেখতে পেল ছেলের। চুলে বেশ পাক ধরেছে এবার; তাই বাপের মুখের আদল ধরা পড়ছে ছেলের মুখে। রােগা-রােগা লাগছে যেন। সেখীটার তাে বাপের মতাে জেলে গেলে শরীর ভালাে হয়। তবে এবার এমন কেন? ছেলের চোখের চাউনি ঘরের দুর দেয়াল পর্যন্ত কী যেন খুঁজছে। কাদের খুঁজছে সে কথা আর বুড়িকে বুঝিয়ে বলে দিতে হবে না।...
‘হারে, জেলে তাের অসুখ-বিসুখ করেছিল নাকি? সৌখী এ প্রশ্ন কানে তুলতে চায় না; জিজ্ঞাসা করে, ‘এদের কাউকে দেখছি না?” প্রতি মুহুর্তে বুড়ি এই প্রশ্নের ভয়ই করছিল। জানা কথা যে, জিজ্ঞাসা করবেই; ...তবু. ‘বউ বাপের বাড়ি গিয়েছে। ‘হঠাৎ বাপের বাড়ি ?
...এতদিন পর বাড়ি ফিরেছে ছেলে। এখনই সব কথা খুলে বলে তার মেজাজ খারাপ করে দিতে চায় না। মরদের রাগ। শুনেই এখনই হয়তাে ছুটবে রাগের মাথায় দলের লােকের সঙ্গে বােঝাপড়া করতে।
...নাতি আর বউয়ের শরীর খারাপের কথাও এখনই বলে কাজ নেই। ছেলে ছেলে করে মরে সৌখী। আগের বউটার ছেলেপিলে হয়ইনি। এ বউয়ের ওই একটিই তাে টিমটিম করছে। তার শরীর খারাপের কথা শুনলে হয়তাে সৌখী এখানে আর একদিনও থাকবে না। এতদিন পর এল। একদিনও কাছে রাখতে পারব। না? খেয়ে-দেয়ে জিরিয়ে সুস্থির হয়ে থাকুক এক-আধদিন। তারপর সব কথা আস্তে আস্তে বলা যাবে।..
“কেন, মেয়েদের কী মা বাপকে দেখতে ইচ্ছে করে না একবারও?' | ‘না না, তাই কী বলছি নাকি?’ অপ্রতিভের চেয়ে হতাশ হয়েছে বেশি সৌখী। তার বাড়ি ফিরবার আনন্দ অর্ধেক হয়ে গিয়েছে মুহূর্তের মধ্যে। ছেলেটা কেমন দেখতে হয়েছে, তাই নিয়ে কত কল্পনার ছবি এঁকেছে জেলে বসে বসে। ছেলে কেমন করে গল্প করে মায়ের সঙ্গে তাই শুনবার জন্য টোকা মারবার আগে দরজায় কান ঠেকিয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। ভেবেছিল রাত নটার মধ্যে দুরন্ত ছেলেটা নিশ্চয়ই ঘুমােবে না। সে মনে মনে ঠিক করে ফেলে যে...কালই সে যাবে শ্বশুরবাড়ি বউছেলেকে নিয়ে আসতে। এ কথা এখনই মাকে বলে ফেলা ভালাে দেখায় না; নইলে মা আবার ভাববে যে নতুন বউ এসে ছেলেকে পর করে নিয়েছে। ...মা কত কী বলে চলেছে; এতক্ষণে শেষের কথাটা কানে গেল।
‘নে, হাতমুখ ধুয়ে নে। “না না। আমি খেয়ে এসেছি। এই রাত করে আর তােক রাঁধতে বসতে হবে না।' ‘না, রাঁধছে কে। খইমুড়ি আছে। খেয়েনে। তুই যে কত খেয়ে এসেছিস, সে আর আমি জানি না।
ব্যবসার পুজি খইমুড়িগুলাে শেষ করে শােয়ার সময় তার হঠাৎ নজর গেল মা-র গায়ের ছেড়া কম্বলখানার দিকে।
‘ওখান আমাকে দে।” আপত্তি ঠেলে সৌখী নিজের গায়ের নতুন কম্বলখানা মায়ের গায়ে জড়িয়ে দিল।
নতুন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েও বুড়ির ঘুম আসতে চায় না। পা কিছুতেই গরম হয় না, রাজ্যের দুশ্চিন্তায় মাথা গরম হয়ে উঠেছে। সৌখীর নাকডাকানির একঘেয়ে শব্দ কানে আসছে। এতদিন পর ছেলে বাড়ি এল; কোথায় নিশ্চিন্ত হবে, তা নয়, সৌখীকে কী খেতে দেবে কাল সকালে, সেই হয়েছে বুড়ির মস্ত ভাবনা। আজকের রাতটা না হয় বিক্রির খইমুড়ি দিয়ে কোনােরকমে চলে গেল।...যদি বলত দুটো ভাত খেতে ইচ্ছা। করছে, তাহলেই আর উপায় ছিল না, সব কথা না বলে। ...আলু-চচ্চড়ি খেতে কী ভালােই বাসে সৌখাটা! কতকাল হয়তাে জেলে খেতে পায়নি। আলু, চাল, সরষের তেল সবই কিনতে হবে। অত পয়সা পাব কোথায় ? ভােরে উঠেই কী ছেলেকে বলা যায় যে, আগে পয়সা জোগাড় করে আন, তবে বেঁধে দেব!...।
..কাছারির ঘড়িতে দুটো বাজল। ...ভেবে কূলকিনারা পাওয়া যায় না।..
মনে পড়ল যে, পেশকারসাহেবের বাড়ি রাজমিস্ত্রি লেগেছে। আজ যখন মুড়ি বেচতে গিয়েছিল তখন দেখেছে যে, পড়ে যাওয়া উত্তরের পাঁচিলটা গাঁথা হচ্ছে। বুড়ি বিছানা থেকে উঠে পা টিপে টিপে বেরােল ঘর থেকে।
...নাতি আর বউয়ের শরীর খারাপের কথাও এখনই বলে কাজ নেই। ছেলে ছেলে করে মরে সৌখী। আগের বউটার ছেলেপিলে হয়ইনি। এ বউয়ের ওই একটিই তাে টিমটিম করছে। তার শরীর খারাপের কথা শুনলে হয়তাে সৌখী এখানে আর একদিনও থাকবে না। এতদিন পর এল। একদিনও কাছে রাখতে পারব। না? খেয়ে-দেয়ে জিরিয়ে সুস্থির হয়ে থাকুক এক-আধদিন। তারপর সব কথা আস্তে আস্তে বলা যাবে।..
“কেন, মেয়েদের কী মা বাপকে দেখতে ইচ্ছে করে না একবারও?'  
‘না না, তাই কী বলছি নাকি?’ অপ্রতিভের চেয়ে হতাশ হয়েছে বেশি সৌখী। তার বাড়ি ফিরবার আনন্দ অর্ধেক হয়ে গিয়েছে মুহূর্তের মধ্যে। ছেলেটা কেমন দেখতে হয়েছে, তাই নিয়ে কত কল্পনার ছবি এঁকেছে জেলে বসে বসে। ছেলে কেমন করে গল্প করে মায়ের সঙ্গে তাই শুনবার জন্য টোকা মারবার আগে দরজায় কান ঠেকিয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। ভেবেছিল রাত নটার মধ্যে দুরন্ত ছেলেটা নিশ্চয়ই ঘুমােবে না। সে মনে মনে ঠিক করে ফেলে যে...কালই সে যাবে শ্বশুরবাড়ি বউছেলেকে নিয়ে আসতে। এ কথা এখনই মাকে বলে ফেলা ভালাে দেখায় না; নইলে মা আবার ভাববে যে নতুন বউ এসে ছেলেকে পর করে নিয়েছে। ...মা কত কী বলে চলেছে; এতক্ষণে শেষের কথাটা কানে গেল।
‘নে, হাতমুখ ধুয়ে নে। “না না। আমি খেয়ে এসেছি। এই রাত করে আর তােক রাঁধতে বসতে হবে না।' ‘না, রাঁধছে কে। খইমুড়ি আছে। খেয়েনে। তুই যে কত খেয়ে এসেছিস, সে আর আমি জানি না।
ব্যবসার পুজি খইমুড়িগুলাে শেষ করে শােয়ার সময় তার হঠাৎ নজর গেল মা-র গায়ের ছেড়া কম্বলখানার দিকে।
‘ওখান আমাকে দে।” আপত্তি ঠেলে সৌখী নিজের গায়ের নতুন কম্বলখানা মায়ের গায়ে জড়িয়ে দিল।
নতুন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েও বুড়ির ঘুম আসতে চায় না। পা কিছুতেই গরম হয় না, রাজ্যের দুশ্চিন্তায় মাথা গরম হয়ে উঠেছে। সৌখীর নাকডাকানির একঘেয়ে শব্দ কানে আসছে। এতদিন পর ছেলে বাড়ি এল; কোথায় নিশ্চিন্ত হবে, তা নয়, সৌখীকে কী খেতে দেবে কাল সকালে, সেই হয়েছে বুড়ির মস্ত ভাবনা। আজকের রাতটা না হয় বিক্রির খইমুড়ি দিয়ে কোনােরকমে চলে গেল।...যদি বলত দুটো ভাত খেতে ইচ্ছা। করছে, তাহলেই আর উপায় ছিল না, সব কথা না বলে। ...আলু-চচ্চড়ি খেতে কী ভালােই বাসে সৌখাটা! কতকাল হয়তাে জেলে খেতে পায়নি। আলু, চাল, সরষের তেল সবই কিনতে হবে। অত পয়সা পাব কোথায় ? ভােরে উঠেই কী ছেলেকে বলা যায় যে, আগে পয়সা জোগাড় করে আন, তবে বেঁধে দেব!...।
..কাছারির ঘড়িতে দুটো বাজল। ...ভেবে কূলকিনারা পাওয়া যায় না।..
মনে পড়ল যে, পেশকারসাহেবের বাড়ি রাজমিস্ত্রি লেগেছে। আজ যখন মুড়ি বেচতে গিয়েছিল তখন দেখেছে যে, পড়ে যাওয়া উত্তরের পাঁচিলটা গাঁথা হচ্ছে। বুড়ি বিছানা থেকে উঠে পা টিপে টিপে বেরােল ঘর থেকে।
মাতাদিন পেশকারের বাড়ি বেশি দূরে নয়। পাঁচিল সেদিন হাত দুই-আড়াই উঁচু পর্যন্ত গাঁথা হয়েছে। মাটি আর ভাঙা ইটের পাহাড় নীচে পড়ে থাকায়, সে পাঁচিল ভাঙতে বুড়ির বিশেষ অসুবিধা হল না।.. বাড়ি নিশুতি!
অন্ধকারে কী কোথায় আছে ঠাহর করা শক্ত। বারান্দায় দোরগােড়ায় গুছিয়ে রাখা রয়েছে পেশকার সাহেবের খড়মজোড়া, আর জলভরা ঘটি—ভােরে উঠেই দরকার লাগবে বলে।
ভয়ে বুড়ি উঠোনের আর কোথায় কী আছে, হাতড়ে হাতড়ে খুঁজবার চেষ্টা করল না। ঘটিটি তুলে নিয়ে পাঁচিল টপকে বাইরে বেরিয়ে এল নিঃশব্দে। জলটুকু পর্যন্ত ফেলেনি। এখন রাতদুপুরে লােটা হাতে যেতে দেখলেও কেউ সন্দেহ করবে না।
এদেশে লােটা বিনা সংসার অচল। দিনে বারকয়েক লােটা না মাজলে মাতাদিন পেশকারের হাত নিশপিশ করে। সেইজন্য হুলস্থুল পড়ে গেল তার বাড়িতে সকালবেলায়।
খােকার মা নাকে কেঁদে স্বামীকে মনে করিয়ে দিলেন যে, লােটা হল বাড়ির লক্ষ্মী; ...এখনই আর একটি কিনে আনা দরকার বাড়ির লক্ষ্মীশ্রী ফিরিয়ে আনতে হলে। কর্তার মেজাজ তখন তিরিক্ষি হয়ে আছে চোরের উপর রাগে।‘বাজে বক্ কোরাে না। তােমাদের তাে কেবল এই আইনের ধারায় স্পষ্ট লেখা আছে যে, চুরির খবর পুলিশকে না দিলে জেল পর্যন্ত হতে পারে; সে খবর রাখাে? 
 আইনচ মাতাদিন আরও অনেক ঝাঝালাে কথা খােকার মাকে শােনাতে শােনাতে বাড়ি থেকে বার হয়ে গেলেন থানায় খবর দেবার জন্য।
ফিরতিমুখে তিনি এলেন বাসনের দোকানে। নানা রকম ঘটি দেখাল দোকানদার; কিন্তু পছন্দসই কিছুতেই পাওয়া গেল না। পেশকারসাহেব বড়াে খুঁতখুতে লােটা সম্বন্ধে। তিনি চান খুরাে-দেওয়া লােটা—বুঝলেন কিনা—এই এত বড়াে সাইজের—মুখ হওয়া চাই বেশ ফাদালাে—যাতে বেশ হৃষ্টপুষ্ট মেয়েমানুষের এতখানি মােটা রুপাের কাকনসুস্থ হাত অনায়াসে ঢোকানাে যায়, ভিতরটা মাজবার জন্য। ...দোকানদার শেষকালে হাল ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করে—পুরােনাে হলে চলবে? নামেই পুরােনাে। সস্তায় পাবেন। আড়াই টাকায়।
পুরােনাে বাসনও বিক্রি হয় নাকি এখানে? দেখি।
ঘটি দেখেই তার খটকা লাগল। পকেট থেকে চশমা জোড়া বার করে নাকের ডগায় বসালেন। ...খুরাের নীচে ঠিক সেই তারা আঁকা! আর সন্দেহ নেই !..  
মাতাদিন পেশকার আইনের ধারা ভুলে গিয়ে দোকানদারের টুটি চেপে ধরেন।—'বল! এ লােটা কোখেকে পেলি? দিনে করিস দোকানদারি—আর রাতে বার হস সিঁধকাঠি নিয়ে!
একেবারে হই-হই-রইরই কাণ্ড। দোকানে লােক জড় হয়ে গেল। দোকানদার বলে যে, সে কিনেছে এই ঘটি নগদ চোদ্দো আনা পয়সা গুনে, সৌখীর মায়ের কাছ থেকে—এই কিছুক্ষণ মাত্র আগে।
‘চোদ্দো আনায় এই ঘটি পাওয়া যায় ? চোরাই মাল জেনেই কিনেছিস! চোরাই মাল রাখবার ফৌজদারি ধারা জানিস ?”
পেশকারসাহেব থানায় পাঠিয়ে দিলেন একজন ছােকরাকে, দারােগাকে ডেকে আনবার জন্য। চোর ধরা পড়বার পর দারােগাসাহেবের কাজে আর ঢিলেমি নেই। তখনই সাইকেলে এসে হাজির। সব ব্যাপার
শুনে তিনি সদলবলে সৌখীর বাড়িতে গিয়ে ঠেলে উঠলেন। সৌখীর মা আলুর তরকারি চড়িয়েছে উনােনে। ছেলে তখনও ওঠেনি বিছানা ছেড়ে।
অনেককাল জেলে ঘড়ি ধরে সকাল সকাল উঠতে হয়েছে; নতুন পাওয়া স্বাধীনতা উপভােগ করবার জন্য সৌখী মনে মনে ঠিক করেছে যে বেলা বারােটার আগে সে কিছুতেই আজ বিছানা ছেড়ে উঠবে না।
দারােগা-পুলিশ দেখে বুড়ির বুক কেঁপে ওঠে। পুলিশ দেখে ভয় পাবার লােক সে নয়; এর আগে কতবার সময়ে অসময়ে পুলিশকে তাদের বাড়িতে হানা দিতে দেখেছে। কিন্তু আজ যে ব্যাপার অন্য। মাতাদিন পেশকার আর বাসনওয়ালা যে পুলিশের সঙ্গে রয়েছে। তার যে ধারণা ছিল, বাসনওলা পুরােনাে বাসনগুলােকে রং-চং দিয়ে নতুনের মতাে না করে নিয়ে বিক্রি করে না.. পাঁচ-সাত বছর আগে পুলিশ একবার ভােররাত্রে তাদের বাড়ি ঘেরাও করছিল, বন্দুকের খোঁজে। তখন তাে মাথা হেঁট হয়নি তার। ডাকাতি করা তার স্বামী পুত্রের হকের নেশা। সে তাে মরদের কাজ; গর্বের জিনিস। জেলে যাওয়া সেক্ষেত্রে দূরদৃষ্টি মাত্র—তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। কিন্তু এ যে চুরি! ...ছিচকে চোরের কাজ, শেষকালে...
লজ্জায় সৌখীর মা অভিযােগ অস্বীকার করতে পর্যন্ত ভুলে গিয়েছে।
দারােগাসাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, তাকে, ‘তুই এই লােটা আজ বাজারে বাসনের দোকানে চোদ্দো আনায় বিক্রি করেছিস।
কোনাে জবাব বেরােল না বুড়ির মুখ দিয়ে। শুধু একবার ছেলের দিকে তাকিয়ে সে মাথা হেঁট করে নিল।
এতক্ষণে বােঝে সৌখী ব্যাপারটা। চোদ্দো আনা পয়সার জন্য মা শেষকালে একটা ঘটি চুরি করল! ...কেন মা তাকে বলল না! .এতদিন তার ডিউটি ছিল জেলখানার গুদামে। জেলের ঠিকেদারদের কাছ থেকে সে নব্বই টাকা রােজগার করে এনেছে। এখনও সে টাকা তার কোমরের বাটুয়ায় রয়েছে। মা তার কাছ থেকে চেয়ে নিল না কেন? মেয়েমানুষের আর কত আক্কেল হবে! হয়তাে ঘরদোরের দিকে তাকিয়ে এক নজরেই সংসারের দৈন্যদশার কথা আঁচ করে নেওয়া উচিত ছিল তার।... বুঝে, নিজে থেকেই মায়ের হাতে টাকা দেওয়া উচিত ছিল।..কিন্তু সে সময় পেল কই? রাতে এসে শুয়েছে; এতক্ষণ তাে। বিছানা ছেড়ে ওঠেইনি।...শেষ পর্যন্ত লােটা চুরি! জেলের মধ্যে ওই সব ছিচকে 'কদুচোর’দের সঙ্গে সে যে পারতপক্ষে কথা বলেনি কোনাে দিন!... ডাকাতরা জেলে আলাপ-সালাপ করে 'লাইফারদের সঙ্গে, এ কথা তাে মায়ের অজানা নয়। কদুচোরদের যে মাত্র দু-মাস তিন মাসের সাজা হয় ... মা কি জানে না যে...।
“এই বুড়ি! আমার কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন? বল। জবাব দে। বুড়ি নির্বাক। দারােগাবাবুর প্রশ্ন কানে গেল কী না, সে কথা বােঝাও যার না তার মুখ দেখে। আর থাকতে পারল না সৌখী। ‘দারােগাসাহেব, মেয়েমানুষকে নিয়ে টানাটানি করছেন কেন? আমি ঘটি চুরি করেছি কাল রাত্রে।
বিজ্ঞ দারােগাবাবু তার অনুচরদের দিকে বিজয়ীর দৃষ্টি হেনে ভাব দেখাতে চাইলেন যে, এত বেলা পর্যন্ত সৌখীদের ঘুমােতে দেখে, এ তিনি আগেই বুঝেছিলেন; শুধু বুড়ির মুখ দিয়ে কথাটা বার করে নিতে চাচ্ছিলেন এতক্ষণ।
এইবার সৌখীর মা ভেঙে পড়ল।...ছেলের নামে কলক এনেছে সে।...
‘না না কারােগাসাহেব! সৌখী করেনি, আমি করেছি। ওকে গ্রেপ্তার করবেন না। আমাকে করুন। ও কিছু জানে না। ও যে ঘুমুচ্ছিল। ওকে ছেড়ে দিন দারােগাসাহেব। এখনও যে বউ-ছেলের সঙ্গে দেখা হয়নি ওর।..
দারােগাবাবুর পায়ের উপর মাথা কুটছে বুড়ি। 
কিন্তু তিনি বাসনওলা কিংবা এই বুড়িটাকে নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না; তার দরকার আসল অপরাধীকে নিয়ে।
সৌখী যাবার সময় কোমর থেকে বাটুয়াটা বার করে রেখে দিয়ে গেল খাটিয়ার উপর।

মা তখনও মেঝেতে পড়ে ডুকরে ডুকরে কাদছে। উনােনে চড়ানাে আলুর তরকারির পোড়া গন্ধ সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়েছে।

2 comments: