নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
স্কুলে কী
বিভীষিকাই যে ছিলেন ভদ্রলোক!
আমাদের অঙ্ক
কষাতেন। আশ্চর্য পরিষ্কার ছিল মাথা। যেসব জটিল অঙ্ক নিয়ে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা
পণ্ডশ্রম করেছি, একবার মাত্র তাকিয়ে দেখতেন তার দিকে, তারপরেই এগিয়ে যেতেন ব্ল্যাক বোর্ডে, খসখস করে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলতে খড়ি। হঠাৎ খড়ি ভেঙে
গেলে বিরক্ত হয়ে টুকরো দুটো আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে তৎক্ষণাৎ আর একটা তুলে
নিতেন,
একটু পরেই আমরা রোমাঞ্চিত হয়ে দেখতুম ছবির মতো অঙ্কটা
সাজিয়ে দিয়েছেন।
পৃথিবীতে যত
অঙ্ক ছিল,
সব যেন ওঁর মুখস্থ। কিংবা মুখস্থ বললেও ঠিক হয় না, মনে হতো, আমাদের অদৃশ্য
অক্ষরে বোর্ডে আগে থেকেই কষা রয়েছে, অথচ উনি দেখতে পাচ্ছেন ঠিক, আর সঙ্গে সঙ্গে তার
উপরে খড়ি বুলিয়ে চলেছেন।
অকে যারা একশোর
মধ্যে একশো পায়, ওঁর ভয়ে তারাই
তটস্থ হয়ে থাকত। আর আমাদের মতো যেসব অঙ্ক-বিশারদের টেনেটুনে কুড়িও উঠতে চাইত না, তাদের অবস্থা সহজেই কল্পনা করা যেতে পারে। প্রকাণ্ড হাতের
প্রচণ্ড চড় খেয়ে মাথা ঘুরে যেত, কিন্তু কাঁদবার জো
ছিল না। চোখে এক ফোঁটা জল দেখলেই ক্লাস। ফাটিয়ে হুঙ্কার ছাড়তেন; পুরুষ মানুষ হয়ে অঙ্ক পারিসনে—তার উপরে কাদতে লজ্জা করে না? এখনি পা ধরে স্কুলের পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে দেবো।
তা উনি
পারতেন। ওঁর চড়ের জোর থেকেই আমরা তা আন্দাজ করে নিয়েছিলুম।
পুরুষমানুষ
হয়ে অঙ্ক পারে না—এমন অঘটন কল্পনাও
করতে পারতেন না মাস্টার মশাই। বলতেন, প্লেটোর দোরগোড়ায় কী লেখা ছিল, জানিস? যে অঙ্ক জানে না এখানে তার প্রবেশ
নিষেধ। স্বর্গের দরজাতেও ঠিক ওই কথাই লেখা রয়েছে—যদি সেখানে যেতে চাস, তা হলেস্বর্গের
খবরটা মাস্টারমশাই কোত্থেকে জোগাড় করলেন তিনিই জানেন। প্লেটো কে, তার দরজা দিয়ে ঢুকতে না পারলে কী ক্ষতি হবে, এ নিয়ে আমরা কোনোদিন মাথা ঘামাইনি। তাছাড়া যে স্বর্গে পা
দিয়েই জ্যামিতির এক্সট্রা ক্যতে হবে কিংবা স্কোয়ার মেজারের অঙ্ক নিয়ে বসতে হবে, সে স্বর্গের চাইতে লক্ষ যোজন দূরে থাকাই আমরা নিরাপদ বোধ
করতুম।
ম্যাট্রিকুলেশনের
গণ্ডী পার হয়ে অঙ্কের হাত থেকে রেহাই পেলুম, মাস্টারমশাইয়ের হাত থেকেও। কিন্তু অঙ্কের সেই বিভীষিকা মন থেকে গেল না। এমএ
পাশ করবার পরেও স্বপ্ন দেখেছি, পরীক্ষার লাস্ট বেল
পড়ো-পড়ো,
অথচ একটা অঙ্কও আমার মিলছে না। মাস্টারমশাই গার্ড হয়ে
একবার আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন, দু-চোখ দিয়ে তার আগুন ঝরছে। দাঁতে দাঁতে ঘষে বলছেন মাথার উপর ঘুরন্ত পাখা
সত্ত্বেও ঘামে নেয়ে আমি জেগে উঠেছি। মৃদু নীল আলোয় দেখেছি চেনা ঘরটাকে, চোখে পড়েছে সামনে আমার পড়ার টেবিল, আমার বইপত্রের স্তুপ। গভীর তৃপ্তির সঙ্গে ভেবেছি, এখন আর আমাকে স্কুলে অঙ্ক কষতে হয় না, আমি কলেজে বাংলা পড়াই।
একদিন একটি
পত্রিকার পক্ষ থেকে ফরমাশ এল, আমার ছেলেবেলার
গল্প শোনাতে হবে। আমি জানালুম, লেখক হিসেবে আমি
নিতান্ত সামান্য ব্যক্তি, আমার ছেলেবেলার
গল্পে কারো কোনো কৌতূহল নেই। তাছাড়া এমন কোনো স্মরণীয় ঘটনা ঘটেনি যে আসর করে তা লোককে
শোনাতে পারি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ ছাড়লেন না, তাঁরা জানালেন, সাহিত্যের ইন্দ্র
চন্দ্র মিত্র বরুণেরা কেউ তাদের বিশেষ পাত্তা দেননি, অতএব অতএব আমি ভাবলুম, তা হলে নির্ভয়ে লিখতে পারি। এঁরা নিজেরা ছাড়া ওঁদের
কাগজের বিশেষ পাঠক নেই, সুতরাং আমার
আত্মকথা কারো কাছে স্পর্ধার মতো মনে হবে না। কয়েকটি ঘরোয়া মানুষের কাছে ঘরোয়া
গল্প বলব—ওটা প্রীতির ব্যাপার, পদমর্যাদার নয়। কাগজ কলম নিয়ে বসে গেলরর
মনে এল
মাস্টারমশাইয়ের কথা। লিখলুম তাঁকে নিয়েই। ছবিটা যা ফুটল, তা খুব উজ্জ্বল নয়। লেখবার সময় কল্পনার খাদ কিছু মিশিয়ে
নিলুম সেটা বলাই বাহুল্য। সেই সঙ্গে সদুপদেশও একটু বর্ষণ করেছিলুম। মূল কথাটা এই
ছিল,
অহেতুক তাড়না করে কাউকে শিক্ষা দেওয়া যায় না, গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করতে গেলে গাধাটাই পঞ্চত্ব পায়। তার
প্রমাণ আমি নিজেই। মাস্টার। মশাই আমাকে এত প্রহার করেও অঙ্ক শেখাতে পারেননি, বরং যা শিখেছিলুম তা-ও ভুলেছি। এখন দুই আর দুইয়ে চার না
পাঁচ হয়,
তাই নিজের মধ্যে সন্দেহ জাগে।
পত্রিকার
কর্তৃপক্ষ খুশি হয়ে আমাকে দশ টাকা দক্ষিণা দিয়ে গেছেন। মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে
এইটুকুই আমার নগদ লাভ।
তারপরে আরো
অনেকদিন পার হয়ে গেল। সেই লেখার কথা ভুলে গেলুম, ভুলে গেলুম মাস্টারমশাইকেও। বয়স বেড়েছে, বিনিদ্র রাত্রিযাপনের মতো অনেক সমস্যা এসে দেখা দিয়েছে জীবনে। বর্তমানের
দাবিটা এত বেশি জোরালো যে স্মৃতির দিকে তাকাবার অবসর পর্যন্ত মেলে না।।
এমনি সময়
বাংলাদেশের এক প্রান্তের একটি কলেজ থেকে ডাক এল। ওঁদের বার্ষিক উৎসব, অতএব আতিথ্য নিতে যেতে হবে ওখানে। এবং বক্তৃতা দিতে হবে।
এই সব
উপলক্ষেই বিনাপয়সায় বেড়ানো যায়। তাছাড়া কলকাতা থেকে কেউ বাইরে গেলেই তার
রাজোচিত সম্বর্ধনা মেলে—এখানকার চড়ুই
পাখিও সেখানে রাজহংসের সম্মান পায়। কলকাতা থেকে দূরত্বটা যত বেশি হয়, আমাদের মতো নগণ্যের পক্ষে ততই সুখাবহ।
আমি সুযোগটা
ছাড়তে পারলুম না।
গিয়ে
পৌঁছতে চা-খাবার-আতিথেয়তার উচ্ছ্বাস। ছেলেরা তো এলই, দু’চারজন সম্ভ্রান্ত লোক
এসেও বিনীতভাবে আলাপ করে গেলেন। এমন কি খানকয়েক অটোগ্রাফের খাতা পর্যন্ত এগিয়ে
এল। রোমাঞ্চিত কলেবরে আমি স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে বাণী বিতরণ করতে লাগলুম, ব্যক্তি হিসেবে আমি যে এত মূল্যবান এর আগে কে ভেবেছিল
সে-কথা।
সভায়
জাঁকিয়ে বক্তৃতা করা গেল। রবীন্দ্রনাথ থেকে বারােটা উদ্ধৃতি দিলুম, কার একটা ইংরেজি কোটেশন চালিয়ে দিলুম বার্নার্ড শ'র নামে, শেষে দেশের তরুণদের
নিদারুণভাবে জাগ্রত হতে বলে যখন টেবিলে একটা প্রকাণ্ড কিল মেরে বক্তৃতা শেষ করলুম, তখন অল্পের জন্যে ফুলদানিটা রক্ষা পেলাে। আর হল-ফাটানো
হাততালিতে কান বন্ধ হওয়ার জো।।
বুড়ো
প্রিন্সিপ্যাল পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে আমাকে বললেন, ভারী চমৎকার বলেছেন আপনি, যেমন সারগর্ভ, তেমনি সুমধুর।
আমি বিনীত
হাসিতে বললুম, আজ শরীরটা তেমন ভালয় নেই, তাই মনের মতো করে বলতে পারলুম না। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা
ছেলেরা বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলল। শরীর ভালো নেই, তাতেই এরকম বললেন স্যার। শরীর ভালো থাকলে তো অর্থাৎ প্রলয় হয়ে যেত। আমি উদার
হাসি হাসলুম। যদিও মনে মনে জানি, এই একটি
সর্বার্থসাধক বক্তৃতাই আমার সম্বল, রবীন্দ্র জন্মােৎসব থেকে বনমহোৎসব পর্যন্ত এটাকেই এদিক ওদিক করে চালিয়ে দিই।
স্তুতিতে
স্ফীত মনে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়েছি, এমন সময় একটি ছেলে এসে খবর দিলে এক ড়ো ভদ্রলােক আমার সঙ্গে দেখা করতে চান।
প্রিন্সিপ্যাল
বললেন,
বেশ তো, ডেকে আনো এখানে।
ছেলেটি বললে, তিনি আসতে চাইছেন না—বাইরে মাঠে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
আমার
বক্তৃতায় নিশ্চয় কেউ অভিভূত হয়েছেন, আমাকে অভিনন্দন জানাবেন। এ অভিজ্ঞতা আগেও হয়েছে। সুতরাং দাক্ষিণ্য-পুলকিত
চিত্তে আমি বললুম, আচ্ছা চলো, আমি যাচ্ছি।
হলের বাইরে
ছােটো একটা মাঠ তরল অন্ধকারে ঢাকা। অত আলো থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমে ভালো করে কিছু
দেখতে পেলুম না। তারপর চোখে পড়ল মানুষটিকে। কুঁজো লম্বা চেহারা, মাথার সাদা চুলগুলি চিকমিক করছে।
ডাকলেন, সুকুমার!
আমি চমকে
উঠলুম। এখানে কেউ আমার নাম ধরে ডাকতে পারে সেটা যেমন আশ্চর্য, তারও চেয়ে। আশ্চর্য ওই গলার স্বর। আমার মনটাকে অদ্ভুতভাবে
দুলিয়ে দিল। স্মৃতির অন্ধকার থেকে একটা ভয়ের মৃদু শিহরণ আমার বুকের ভিতর দিয়ে
বয়ে গেল।
–আমাকে চিনতে
পারছ না সুকুমার? আমি—
-চিনেছি।
ভয় পাওয়ার অর্থটা বুঝতেও আর বাকি নেই। এই ডাক শুনে ছেলেবেলায় বহুদিন আমার
গায়ের রক্ত হিম হয়ে এসেছে—জানি এখনই একটা
ভয়ংকর চড় আমার পিঠের উপর নেমে আসবে। সেই ভয়টার কঙ্কাল লুকিয়ে ছিল মনের
চোরাকুঠুরিতে—ওই স্বর বিদ্যুতের আলোর মতো তাকে
উদ্ভাসিত করে তুলেছে।
আমার মাথা
তখনই ওঁর পায়ে নেমে এল। —মাস্টারমশাই, আপনি!
মাস্টারমশাই
বললেন,
বেঁচে থাকো বাবা, যশস্বী হও। রিটায়ার করার পর এখানে এসেই মাথা খুঁজেছি। বাড়ি থেকে বেরুই না, আজ তুমি বক্তৃতা করবে শুনে ছুটে এসেছি। খুব ভালাে বলেছ
সুকুমার,
খুব খুশি হয়েছি।
কিন্তু আমি
খুশি হতে পারলুম না। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন মাস্টারমশাই, বুদ্ধিতে ছুরির ফলার মতো ঝক্ করত চোখ। আজ আমার বক্তৃতার
ফাঁপা ফানুস দিয়ে যদি ওঁকে ভােলাতে পেরে থাকি, তাহলে সেটা। আমার কৃতিত্বে নয়, ওঁর মনেরও বয়স বেড়েছে বলে।
অপরাধীদের মতো
চাইলুম,
না স্যার, আপনার সামনে
মাস্টারমশাই আমাকে বলতে দিলেন না।
তোমরাই তো
আমাদের গর্ব, আমাদের পরিচয়। কিছুই দিতে পারিনি, খালি শাসন করেছি, পীড়ন করেছি।বলতে বলতে জামার পকেট থেকে বের করলেন শতচ্ছিন্ন এক জীর্ণ পত্রিকা:
একদিন আমার ছেলে এইটে এনে আমাকে দেখালে। পড়ে আনন্দে আমার চোখে জল এল। কতকাল হয়ে
গেল,
তবু সুকুমার 'আমাকে মনে
রেখেছে,
আমাকে নিয়ে গল্প লিখেছে। সকলকে এই লেখা আমি দেখাই, বলি দেখো, আমার ছাত্র আমাকে
অমর করে দিয়েছে।
মুহূর্তে
আমার জিভ শুকিয়ে গেল, লজ্জায়
আত্মগ্লানিতে আমার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করল। একটা কিছু বলতে চেষ্টা করলুম, কিন্তু মুখে কথা ফুটল না।
মাস্টারমশাইয়ের
গলা ধরে এসেছিল। একটু চুপ করে থেকে বললেন, কী যে আমার আনন্দ হয়েছে। সুকুমার, কী বলব! তোমার এই লেখাটা সব সময়ে আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। দু-একজন বলে, যেমন ধরে ধরে মারতেন, তেমনি বেশ শুনিয়ে দিয়েছে আপনাকে। আমি বলি, শোনাবে কেন—কত শ্রদ্ধা নিয়ে লিখেছে। আর সত্যিই তো
—অন্যায় যদি করেই থাকি, ওরা ছাত্র—ওরা সন্তান-বড়ো হলে সে অন্যায় আমার
শুধরে। দেবে বই কি। জানো সুকুমার, আনন্দে তোমাকে আমি
একটা চিঠিও লিখেছিলুম। কিন্তু পাঠাতে সাহস হয়নি। তোমরা এখন বড়ো হয়ে গেছ—এখনআর বলতে পারলেন না। আবছা আলোটায় এখন অভ্যস্ত হয়ে
উঠেছিলুম,
দেখলুম, মাস্টারমশাইয়ের
চোখ দিয়ে জল পড়ছে।
মনে হলো, স্নেহ-মমতা-ক্ষমার এক মহাসমুদ্রের ধারে এসে দাঁড়িয়েছি।
সেই স্নেহ–কোটি মণি-মাণিক্য দিয়ে যার পরিমাপ
হয় না;
সেই মমতা—যার দাম সংসারের সব
ঐশ্বর্যের চাইতে বেশি; সেই ক্ষমা—কুবেরের ভাণ্ডারকে ধরে দিয়েও যা পাওয়া যায় না।
আমি তাকে দশ
টাকায় বিক্রি করেছিলুম। এ অপরাধ আমি বইব কী করে, এ লজ্জা আমি কোথায় রাখব!
দারুন গল্পঃ
ReplyDeleteসেই ছোটবেলায় বাংলা sir পড়িয়েছিল, তখন এর সারমর্ম ঠিক বুঝতে পারিনি...আজ 21 বছর আমার, আজ পরে চোখে জল চলে এলো...😢😢😢
ReplyDeleteসত্যি জল চলে এল
Deleteগল্পটি সত্যি এবং অনবদ্য।
ReplyDeleteIt's story is very excited and nicely 😷😷😷😂😂😂
ReplyDeleteস্কুল কে বিভীষিকা ছিলেন
ReplyDeleteঅঙ্কের মাস্টারমশাই
Deleteদাম শব্দের অর্থ কি
ReplyDeleteprofit
ReplyDelete