ময়মনসিংহ গীতিকা


ময়মনসিংহ গীতিকা


ময়মনসিংহের অধিবাসী চন্দ্রকুমার দে (১৮৮৯-১৯৪৬)-র প্রচেষ্টায় সংগৃহীত ও ‘সৌরভ' পত্রিকায় প্রকাশিত “ময়মনসিংহ গীতিকা’ দেখে আকৃষ্ট হয়ে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৮৬-১৯৩৯) ময়মনসিংহ গীতিকা”ম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। এরপর আরাে কয়েকটি খণ্ড ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা' নামে প্রকাশিত হয়। সময় গীতিকা সংকলনই 'পূর্ববঙ্গ গীতিকা' নামে প্রচলিত। কালের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘকাল আগে ময়মনসিংহে উদ্ভূত এর কাহিনিগুলির ভাষারও বিবর্তন ঘটেছে, তাই সুনিশ্চিত করে এর উদ্ভবকাল নির্ণয় প্রায় অসম্ভব। কাহিনিগুলিতে বৈচিত্র্যময়, সরল, স্বত:স্ফুর্ত, আন্তরিকতাপূর্ণ, সম্প্রীতির আদর্শে উদ্বুদ্ধ গ্রামজীবনের অনবদ্য ছবি ধরা পরেছে। আধ্যাত্মিকতা ও অলৌকিকতার স্পর্শরহিত সমাজজীবনের এই ছবি মূলত ধর্মনির্ভর মধ্যযুগীয় কাব্যধারা থেকে স্বতন্ত্র। গীতিকবিতার এক বিশিষ্টভঙ্গি পূর্ববঙ্গ গীতিকায় লক্ষরা যায়। দ্বিজ কানাই, নয়নাদ ঘােষ, দ্বিজ ঈশান, রঘুসুত, চন্দ্রাবতী, ফকির ফৈজু, মনসুর বয়াতি প্রমুখে বচনায় গীতিকা-সাহিত্য উজ্জ্বল। কবিরা তাদের রচনায় তৎকালীন সমাজ ইতিহাসের যেমন প্রতিফলন ঘটিয়েছেন, পুরাণ-দর্শন-ধর্মতত্ত্বের অনুবর্তনও ঘটিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—“ময়মনসিংহ গীতিকাবাঙ্গালার পল্লীহৃদয়ের গভীরস্তর থেকে স্বত: উচ্ছ্বসিত উৎস, অকৃত্রিম বেদনার স্বচ্ছ ধারা। নানা ইতিকথা অবলম্বনে গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের কথা কবিত্বময় ও সুসংহত আকারে গীতিকাগুলিতে উৎসারিত হয়েছে। এর বিভিন্ন পালার মধ্যে উল্লেখযােগ্য কয়েকটি হলাে—আধা বধু, ‘মহুয়া", ‘মলুয়া', 'কমলা', 'কঙ্ক ও লীলা’ ‘দস্যু কেনারাম’ প্রভৃতি।

বাংলা সাহিত্যের উন্মেষ ধর্মসাধনা তথা ঈশ্বর-উপাসনাকে ভিত্তি করে। তাই সাধন-পদ্ধতির বৈচিত্র্যের প্রতিফলন সাহিত্যে অনিবার্যভাবেই এসেছে। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দী থেকে শুরু করে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি লক্ষ করলে তাতে বাংলাদেশে ধর্মসাধনার বহু বিচিত্র প্রকাশকে অনায়াসে সুচিহ্নিত করা যায়। যেমন— 'তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম, নাথধর্ম, সহজিয়া বৈষুব সম্প্রদায়, বাউল সম্প্রদায় প্রভৃতি। এছাড়াও অসংখ্য লৌকিক দেব-দেবীর উদ্ভবও সে সময়ে ঘটেছে। এইসব ধর্মসাধন-পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে 'আধুনিক যুগের কাছাকাছি সময় পর্যন্ত সাহিত্য রচিত হয়েছে। তান্ত্রিক বৌদ্ধদের চর্যাপদ, শৈব ও শাক্তদের অন্নদামঙ্গল, কালিকামাল, শিবায়বন, শাক্তগীতি, বৈষুবদের পদাবলি, কৃষ্ণমাল, চরিতকাব্য, নাথপন্থীদের গােরক্ষবিজয়, সহজিয়াদের সাধনাসংগীত প্রভৃতি মূলত ধর্মনির্ভর মধ্যযুগের সাহিত্যে একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী রচনা বলতে ছিল কিছু প্রণয় কাহিনি-নির্ভর আখ্যান, ময়মনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং অন্যান্য লােকসংগীত। খ্রিস্টীয় ষােড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে পাঠান রাজত্বের অবসানে বাঙালির রাষ্টনৈতিক অধিকার ক্ষু হয়। মােগল যুগে এদেশে এক নতুন জমিদার শ্রেণির সৃষ্টি হলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে। হােসেন-শাহী বংশের অবনতির সময় থেকে বহির্বাণিজ্য বাঙালির হাতছাড়া হতে থাকে এবং বিদেশি বণিকদের অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে। তাই, সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে সাধারণ বাঙালি ভূমি-উপজীবী হয়ে পড়ে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিদেশি বণিকদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কাজকর্ম করে অল্প কিছুসংখ্যক লােক বেশ লাভবান হল এবং তাদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে লাগল। সমাজের উচ্চস্তরের এই অন্ত:সারশূন্য অস্থির ও বিলাস ব্যসনের চিত্র 'ভারতচন্দ্রের কাব্যে প্রতিফলিত হয়েছে। খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে মােগল রাজশক্তির পতনের সময়কালে বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রদেশের নবাবদের মধ্যেও স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের ফলে তাদের বিলাসী উজ্জ্বলতায় এবং অক্ষম শাসনে বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র অরাজকতা ও দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। বর্গির হাঙ্গামা সমাজকে অস্থির ও সন্ত্রস্ত করে তুলল। পর্তুগিজ, ফরাসি, ইংরেজ প্রভৃতি পাশ্চাত্য শক্তি ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে নিজেদের ক্ষমতাবৃদ্ধিও আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। অবশেষে, ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধে সিরাজদৌল্লার পরাজয়ে ভারতবর্ষইংরেজ শাসনাধীন হয়ে পড়ে। যুদ্ধবিধ্বস্ত শিথিল সমাজজীবনে উন্নত সাহিত্যচর্চা ছিল কল্পনাতীত। অবক্ষয়ের সেই যুগে নবদ্বীপের মহারাজ কৃচন্দ্র রায়ের (১৭১০-১৮৮৩ খ্রি:) পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতচন্দ্র রায় রামপ্রসাদ সেনের মতেকবিরীকাব্যরচনা করেছেন। এই সময়পর্বে বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য কবিদের মধ্যে ধর্মমঙ্গলেরকবিঘনরাম চক্রবর্তী ও শিবায়নেরকবিরামেশ্বর ভট্টাচার্যের নাম উল্লেখযােগ্য।  



এছাড়া এই সময়ের কিছু বৈকবিতা, চরিতকাব্যগ্রন্থ, বৈষুব নিবন্ধ-পদসংকলন, রামায়ণ-মহাভারত ও ভাগবতের অনুবাদ, বিদ্যাসুন্দরকাব্য, সত্যনারায়ণ পাঁচালি, শৈযােগী সম্প্রদায়ের ছড়া ও গাথা, নীতিকথা, ঐতিহাসিক গাথা, গণিতের আর্যা, ইসলামি বাংলায় রচিত আরবি-ফারসি উপাখ্যান-আশ্রয়ী কিসসার সন্ধান পাওয়া যায়। এছাড়া, ভাষাশিক্ষার প্রয়ােজনে বিদেশি ধর্মপ্রচারক ও বণিকেরা বাংলা শব্দকোষ সংকলন করেন এবং বাংলা ভাষার ব্যাকরণ

0 comments:

Post a Comment