নাথ সাহিত্য



নাথ সাহিত্য

মঙ্গলকাব্য ছাড়া ‘নাথ সাহিত্য” নামে পরিচিত আরেক শ্রেণির কাব্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল। বাংলাদেশে সুপ্রাচীনকাল থেকে বর্তমান শিব-উপাসক এক যােগী সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠিত ধমহি হল নাথধর্ম। বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব কালক্রমে স্তিমিত হয়ে এলে তার সঙ্গে শৈবধর্মের মিশ্রণের ফলেই এই নাথধর্মের উৎপত্তি। নাথ ধর্মসম্প্রদায়ের যােগ-মাহাত্ম্যই নাথ সাহিত্যের বিষয়, কীভাবে যােগের শক্তিতে দুঃখ বিপদ অতিক্রম করা যায়, জয় করা যায় মৃত্যুকে পর্যন্ত—নাথসাহিত্যে সে কথাই বর্ণিত হয়েছে। এই নাথসাহিত্যের দুটি ভাগ। সেগুলি হল (১) শিষ্য গােরক্ষনাথ কীভাবে গুরু মীননাখাকে উদ্ধার করলেন সেই কাহিনি অর্থাৎ সংসারের মায়ায় আবদ্ধ মীননাথকে যােগী করে তােলার কাহিনি আর (২) রানি ময়নামতী আর তার পুত্র গোবিন্দচরে কাহিনি। যে আলাদা ছড়া-পাঁচালির আকারে মীননাথ-গোরক্ষনাথের কাহিনি রয়েছে, তার নাম ‘গােরক্ষবিজয় বা 'মীন-চেতন; আর, যে কাহিনিতে রানি ময়নামতী-গোবিন্দচন্দ্রের বৃত্তান্ত পাওয়া যায় তা 'ময়নামতীর গান' বা 'গােপীচন্দ্রের গান নামে পরিচিত। সুপ্রাচীন কাল থেকে নানা প্রক্ষেপের মধ্য দিয়ে এসব কাহিনির মূল রূপটি বর্তমানে বহুল-পরিবর্তিত, এমনকি, এর বহু পুথিতে চৈতন্য প্রভাবের স্পষ্ট প্রমাণ মেলে। এই নাথসাহিত্য-গােরক্ষবিজয়’ আর ‘গােপীচন্দ্রের গান’ গ্রাম্য কবিদের রচনা। যে কারণে এতে না আছে পাণ্ডিত্যের আড়ম্বর, না আছে সংস্কৃত 'অলংকারশাস্ত্রের প্রভাব। সহজ, সরল, অনাড়ম্বর ভাষা-রীতিই নাথসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য। তবুও এতে ধর্মতত্ত্ব, দার্শনিকতার সঙ্গে কবিত্বের সূরণও লক্ষ করা যায়। করুণ রসাত্মক গােপীচন্দ্রে গানে প্রাচীন বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনচিত্রের সহজ ৰূপায়ণ ঘটেছে, সামাজিক রীতিনীতি, অর্থনৈতিক অবস্থার পরিচয় রয়েছে, গ্রাম্য ছড়া-প্রবাদ-প্রকৃতির বিবরণও এতে লিপিবদ্ধ হয়েছে। গানগুলিতে বৌদ্ধ ও ব্রাক্ষ্মণ্যধর্মের প্রভাব নানাভাবে এসেছে। এসেছে অতিপ্রাকৃত তথা অলৌকিকতার স্পর্শ। বাংলার বাইরে গানগুলির প্রচারের উদ্দেশ্যে এগুলিকে মারাঠি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, ওড়িয়া—প্রভৃতি ভাষায় অনুবাদও করা হয়েছিল। বহুকবি “গােরক্ষবিজয়” এবং “গােপীচন্দ্রের গান রচনা করেছেন। অষ্টাদশ শতকের আগে লেখা মীননাথ-গােরক্ষনাথের কাহিনির কোনাে পুথি পাওয়া যায়নি। গােরক্ষবিজয়ের প্রাচীনতম কবিদের মধ্যে রয়েছেন ভীমসেন রায়, শ্যামদাস সেন, শেখ ফয়জুল্লা প্রমুখ।ময়নামতীর গানের প্রাপ্ত পুথির মধ্যে কোনােটিসপ্তদশ শতকেরআগে রচিত নয়। এ কাহিনির উল্লেখযােগ্য কবি হলেন-দুর্লভ মল্লিক, ভবানী দাস, সুকুর মামুদ প্রমুখ।

0 comments:

Post a Comment