মানবপুত্র- বিমল কর-


মানবপুত্র

শালবনীর মেলায় আবার দেখা।
ডাক শুনে মুখ ফেরাতেই কে যেন খপ করে হাত ধরে ফেলল কেষ্টর। কাবহিডের। মরা-জ্যোৎস্নায় সে-মুখের দিকে তাকিয়ে কেষ্ট অবাক। ঠিক ঠাওর হয় না। এ কে ?। কাঁচপােকার টিপ কপালে, চোখে কাজল, পরনে রঙিন শাড়ি। সাজনী নয় তাে ? সাজনার কথা মনে হতেই গায়ে-কাঁটা কেষ্ট দাঁড়িয়ে থাকে, চেষ্টা করে হাত ছাড়িয়ে। নেবার।
হাত ছাড়ে না টিপ-কপালী। কাজল-চোখ আরও ডাগর করে, কথার সুরে টান। দিয়ে বলে, “ভালছিস কি ? লারছিস ঠাওরাতে ? আমি রে, আমি—কিষ্টো, গঙ্গামণি।” নামের চেন্নায় নিমেষে মনে পড়ল গঙ্গামণিকে। কিন্তু ঠিক চেনা গেল না।
মেলার বাইরে এসে কাবইিডের আলাে-মােছা, কার্তিক-পূণিমার কুয়াশা-ভেজা। জ্যোৎস্নায় গঙ্গামণিকে নিষ্পলক নয়নে দেখতে থাকল কেষ্ট।
হঠাৎ বুঝি খেয়াল হল গঙ্গামণির, কেষ্ট তার সঙ্গে একটাও কথা বলেনি। খেয়াল হাতেই সােজাসুজি চোখ তুলে তাকাল গঙ্গামণি। বললে, রা কাড়ছিস না যে- ? চিনতে লারলি ?”
কেষ্ট তবু চুপ। একটু পরে বললে, “তুই হেথায় ক্যানে ?”
"বিটিছেলা আমি, জুয়া চালতে আসি নাই। মানসিক দিব যে, তাও লয়। পয়সা। কুথায় রে কিষ্টো, ফুটা-কড়িও সাথে নাই।” একটু থামে গঙ্গামণি। ঠাণ্ডা হাওয়ায়। কাপুনি লেগেছে। শাড়ির আঁচলটা আরও ঘন করে গায়ে-মাথায় জড়িয়ে নিয়ে বলে। “সাধ তাে কতাে লয় মনে, পুজাথানে আজ মানসিক দিয়ে পেরথনা করি রাত। পােয়ালে ভাতে-পাতে হয় ঠাকুর গাে, আর কিছু লয়।” গঙ্গামণি কথার শেষে হঠাৎ। থামল। দীর্ঘ করুণ একটা টান দিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। 
 কে তাকাল। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় গঙ্গামণির চোখের কাজল, কপালের টিপ বুঝি। ধুয়ে যাচ্ছে আস্তে-আস্তে। কৃশকরুণ কতকগুলাে রেখা কুঞ্চিত, শীর্ণ, অস্থিসর্বস্ব একটি। মুখকে ফুটিয়ে তুলছে—সেই আলােয়, সেই হাওয়ায়। | গঙ্গামণি গলার সুর আরও করুণ করে আবার বললে, “বুঝে দ্যাখ ক্যানে রে—চাপার ঠেঙে সাজ দিলাম, শাড়ি নিলাম হাতে-পায়ে ধরে।” গঙ্গামণি আঁচলে বাঁধা শালপাতার মােড়ক খুলে ধরল, “মাথা কুটে তার ঠেঙে পানও লিয়েছি দশ খিলি—দশ গণ্ডা পয়সা দিতে হবে কাল সুয্যি ওঠার মুখে-মুখেই,—কিন্তুক এক খিলি। পান লিলে না কোন হতভাগা। ” গঙ্গামণির সবঙ্গি থরথর করে কেঁপে উঠল ঠাণ্ডা হাওয়ায়, না উত্তেজনায়, কে জানে। কথাটাও ও শেষ করল ঠিক মিনমিনে সুরে নয়, বরং তিক্ত কর্কশভাবেই। 
শালপাতায় মােড়া পানের খিলির দিকে বােকার মতাে চেয়ে থাকল কেষ্ট। একেবারেই বােবা হয়ে।
অনেকক্ষণ পরে কেষ্ট জানতে চাইল, "থাকিস কুথায় আজকাল ?”।
“ভাগাড়ে।” তিক্ত সুরেই জবাব দিল গঙ্গামণি, “কপাল বটেক আমার, পাটরানীর কপাল রে কিষ্টো আজ হেথায় কাল হােথায়, কেউ দিলেক শুতে তাে ঢাকায় শুলাম, দিলে তাে নালায়। শেয়াল-কুকুরের পারা দিন কাটাই । গঙ্গামণি থামল। তিক্ত সুর ওর মুখকে আরও বিকৃত, বীভৎস করে তুলেছে।
কেঃ চুপ। মনে মনে তার অনেক কথাই জমছে আস্তে আস্তে। গঙ্গামণির চেনা। রূপটাও সেই সঙ্গে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে তার কাছে।
কেষ্টর শীত করছিল। পা পা করে সে মেলার দিকে আবার এগুতে লাগল। গঙ্গামণিও।
মেলার প্রায় কাছাকাছি এসে গঙ্গামণি প্রশ্ন করলে, "এদিক পানে যাস কুথায় ?”।
“ঠাণ্ডা লাগে বড়। উই যে কোণে চায়ের দোকান দিয়েছে শেতল—দ খুরি গরম। চা খেয়ে লি উর দোকানে। ”
“মন্দ লয়।” গঙ্গামণিও চা খাবার লােভে আনমনা হয়ে উঠল। বললে, “তুই। ক্যানে চায়ের দোকান দিলি না কিষ্টো। দু পয়সা তুর আসতাে।" সে কথার কোনাে জবাব দিল না কেষ্ট।
দোকানের বাইরে, একটু তফাতে চায়ের খুরিতে ঠোট ঠেকিয়ে গঙ্গামণির লােভ। বাড়লাে আরও। বললে, “বুঝলি নাকি রে, কিষ্টো—তুর ই চা-পানিতে পেটের
লনটা আগুন ধরাই দিলে।" একটু থেমে আবার, “বুঝ ক্যানে, চারবেলা পেটে। ভাত লাই। সে তুর কন সকালে দুটা ফুলারু খেলাম, সকবনেশে খিদায় পেট দুমড়ায়, তিতা আল কাটে মুখে।" কথার মাঝে থেমে গঙ্গামণি সটান হাত পাতলাে। কাকুতি। করে বললে, “দে না ক্যানে গুটেক পয়সা। মুড়ি-চিড়া কিনা খাই।” । 
কথা বলার মতাে কিছু খুঁজে পেল না কেষ্ট। পকেট থেকে একটা সিকি বের করে। গঙ্গামণির হাতে দিল। 
সিকি তাে নয়, যেন সাত রাজার ধন এক মানিক—খুরির গরম চা-টুকু এক চুমুকে নিঃশেষ করে গঙ্গামণি সিকিটা মুঠির মধ্যে জোরে চেপে ধরল। শীতের কাপুনির মধ্যেও বেশ একটু গরম পেয়েছে সে। চায়ে, না সিকিতে, কে জানে। 
মেলার এদিক-ওদিক তীক্ষ্ণ চোখে নজর করে গঙ্গামণি দ্রুতনিশ্বাসে বলে, “তু দাঁড়া। কিষ্টো হেথায় । হুই একটা ময়রার দোকান দেখি খুলা আছে। চট করে এলাম আমি । ”
প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না রেখেই গঙ্গামণি হাওয়ার বেগে ছুট দিল। চোখের পলকে অদৃশ্য।
সেদিকপানে তাকিয়ে গঙ্গামণিকে হঠাৎ চেন্না-দেওয়া জিনিসের মতােই চেনা গেল। স্পষ্ট, সহজভাবেই। কাবইিডের ফ্যাকাশে আলাে-ছড়ানাে এই মেলার ভিড়েই। মনে পড়ল কেষ্টর সেই পুরনাে গঙ্গামণিকে ; সেই চিল-চোখ, হাভাতে, হ্যাংলা, লােভী, দস্যি মেয়েটাকে। আর মনে পড়ল গত সনের কথাও। যে-সনে আকাল হল ; চাল গেল, চুলাে গেল গঙ্গামণিদের ; জাত গেল, ধর্ম গেল ; প্রাণও। জলের মতােই মনে পড়ছে সে-সমস্ত কথা।
চচুরিয়াতেই প্রথম দেখা, গঙ্গামণি আর কেষ্টর। তখন ওদিক পানে আকাল। লেগেছে। চালের আকাল। আকাল যদি চালের হয়, বাকি থাকে কি ? গােড়া। শুকোলাে তাে গাছের মরল, ফুল-পাতা মুড়ােল।
তেমনি। রাক্ষুসে একটা টান দিয়ে কেউ যেন ওদের পায়ের মাটি দিয়ে দিলে ।। ছুড়ে ফেলে দিলে মাথার চালা। দলে দলে গঙ্গামণিরা বেরিয়ে পড়ল গ্রাম ছেড়ে, ভিটেয়-ভিটেয় পিত্তবমির থুথু ছিটিয়ে। 
দেড়বিত্তের শহর চাঁচুরিয়া। সেই শহরই দেখতে দেখতে ভরে গেল হাভাতেদের। ভিড়। এ শহরেও তখন চাল বাড়ন্ত। ইট-টালির কারখানার স্টোর থেকে পিছল চড়া দরে চাল এনে আরও চড়া দরে বাজারে বিক্রি করছে মহাজনের তুটকো। দালালরা। রেল-রেশনের গুদাম থেকেও আসছে চোরা পথে ; সে চাল তাে চাল নয়, । যেন সাদা হাড়-বাঁধানাে পালিশ-দেওয়া খুরাে গুঁড়াে। 
জনমানুষের কমতি নেই চাঁচুরিয়ায়। যারা আছে, তাদেরই ভাতের পাতে টান ; তার ওপর এই নতুন উপসর্গ। ঘরের চৌকাঠে ওদের মাথা ঠুকতে দেখলেই গৃহস্থজন খেকিয়ে ওঠে, ওরে, ও হারামজাদার দল, বলি চাল কি এখানে আকাশ থেকে বৃষ্টি
প্রথম প্রথম ওরাও জবাব কাটতে। বলত, গায়ে শুনলাম, হেথা রাজায় গােলা বাঁধলেক ধানের। ঠাকুর গাে, দু মুঠা ভাতের লেগে এলাম হেথায়। ইটিশনের মালগুদামে কাঁড়ি কাঁড়ি চাল, কারখানার ফটক-ঘরে বস্তা বস্তা চাল—আপন চোখে। দেখলাম, ঠাকুর। হেথা 'আকাল হবেক ক্যানে কও ।।
ঠিক। চাঁচুরিয়াতে রাজায় গােলাই বেঁধেছে বটে। তবে সে গােলাতেই যা না, । হতভাগার দল। মরতে বাড়িতে, পথে-ঘাটে পেট চিতিয়ে পড়ে থাকিস কেন?
পড়েই থাকে ওরা। পথে, ঘাটে, পাথর-বাঁধানাে মালগুদামের রাস্তায়, সেশনের। ওভারব্রিজের তলায়। রােদুরে, ঝড়ে, বৃষ্টিতে, কলেরা-বসন্তর মধ্যেই।
দিন যায়। দু-দশ জন সরে পড়ে, রেলের চাকার তলায় গলা দেয় কজন, একদল যায় কলেরায়, একদল বসন্তে, না খেয়ে-খেয়ে ঘিয়ে-ভাজা কুকুরের মতাে কুৎসিত, নগ্ন ধড়টাকে রাস্তায় ফেলে রেখে কেউ কেউ আবার স্বর্গবাসী হয় ।
তবু যদি ওরা একসাথে সব কটা গিয়ে দামােদরের জলে ডুবে মরে, কি অন্যত্র চলে যায়, যেখানে ব্লাজায় ধানের গােলা বাঁধেনি। তা যাবে না।
এখানেই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে, হাড়গিলে রুগ্ন গরুর মতাে ধুকে ধুকে খাস টানবে, কথা বলবে, কাঁদবে। ঠিক মনে হবে, কাঁচা পথ দিয়ে বলদটানা গাড়ির চাকায় শব্দ উঠছেকাতরানাে, কশ, করুণ। ওরা কচ্ছপের মতাে মুখ লুকিয়েছে বুকের তলায়। গায়ে চামড়া-পােড়া গন্ধ। 
সারা শহরটা ওরা বিষিয়ে দিলে । আবর্জনায়, নােংরায়, মূলমূত্র আর প্রকাশ্য ব্যভিচারে। 
‘টাউন রেস্টুরেন্টের টেবিলে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে কেষ্ট সবই দেখতাে। আজ তিন বছর সে এখানে—এই চ'চুরিয়ায় চায়ের দেকানে কাজ করছে। মালিক বদল হল দোকানের, কলি ফিরল, সাইনবোের্ড উঠল মাথায়, টেবিল-চেয়ারও এলাে-কেই কিন্তু সেই কেষ্টই। তার আর কোথাও বদল নেই। সেই ময়লা নীল হাফপ্যান্ট আর আহাতা গেঞ্জি। এই চায়ের দােকানে আগে খদ্দের ছিল না, এখন খদ্দেরে ভিড় কত। সকাল থেকে চা দিয়ে দিয়ে, মামলেট ভেজে কেষ্টর হাতটাও অবশ হয়ে আসে আজকাল। নতুন একজন কারিগর এসেছে দোকানে। এতদিন একলাই ছিল কেষ্ট। এখন দু'জন। নতুন কারিগর চপ-কাটলেট ভাজে, মাংস রাধে, ডিমের ঝােল ।। 
 কোথায় ছিল এতদিন এইসব খদ্দেররা ? চপ কাটলেট আর ডিমের ঝােল যারা তারিয়ে তারিয়ে খায় সিগারেট ফোঁকে, চায়ের কাপে ঠোট ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে কথা বলে ? চোখের টোপ নিয়ে বসে আছে সর্বক্ষণ ? 
তাজব লাগে কেষ্টর । সতেরাে-আঠারাে বছর বয়সের ছেলে—চায়ের লিকার দেখে দেখে আর কাপ ধুয়ে ধুয়ে, যার মনটাই জলে-জলাে হয়ে থাকল, সেই কেষ্ট ভেবেই পায় না, চালের আকালে দেশটাই যখন জল-ভিক্ষু চাতক পাখির মতাে শূন্য। চোখে চেয়ে রয়েছে, তখন এই বাবুরা কেমন করে, কোথা থেকে আসে, চকমক করে, কাটলেট মুখে পুরে দিব্যি চিবােয়, মাংস খেয়ে হাড়গুলাে তুড়ে জুড়ে দেয় পথে। ঘূণি। বয়ে যায় হাভাতেদের সেই হাড় কুড়ােনাের পাল্লায়।
ভাবতে বসলে কেষ্টকে ‘সুসমাচার' খুলে বসতে হয়। মথি, যােহনের সুসমাচার আজও আছে কেষ্টর কাছে। আছে একটা ছেড়া-ফাটা বাইবেল। কাজের শেষে রাতে, দোকান বন্ধ হলে রেস্টুরেন্টেরই এক চিলতে পদা-ফেলে আড়াল-করা রান্নাঘর থেকে কেষ্ট তার বিছানাপাটি নামিয়ে নিয়ে বেঞ্চি জোড়া দিয়ে শুয়ে পড়ে। তখন কেরােসিনের কুপি। সেই কুপির আলােয় কেষ্ট ততন্ন করে খোঁজে মথি, লুক যােহনের সুসমাচারের কোথায় আছে এদের কথা। এরা—যারা চচুরিয়ায় এসেছে। ক্ষুধার তাড়নায়, আর ওরা—যারা ডিমের লালচে ঝোল চামচে ডুবিয়ে হুসংস করে থায়।
কুপির আলাে ধরে কেষ্ট যীশুর ছবিও দেখে। মিশনারি থেকে দিয়েছিল কবে, কোন্ যুগে, সেই ছেলেবেলায়—কেষ্ট যখন মিশনারির বাগানে ছিল, কাজ করত মালিদের সাথে। সে ছবি আজ কালিতে-ধুলােতে ময়লা, বিবর্ণ। কিন্তু তবু আছে—কেষ্টর কাছে, রেস্টুরেন্টের খুপরিতে দেওয়ালে আঠা দিয়ে আঁটা। 
মাথায় কাঁটার মুকুট, কপালে রিক্ত-বিন্দুকরুণ নেত্র, যীশু চেয়ে আছেন উপানে। খুপির শিস্ ওঠা লালচে আলােতে সে মুখ, সে চোখ, সে নগ্নগাত্র যীশু কেষ্টর কাছে আজকাল আরও রহস্যময় মনে হয়।
আঠারাে বছরের কেষ্ট-ভাল করে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যে অরফানেজে মানুষ মিশনারি কুঠিতে গতর দিয়েছে, রুটি খেয়েছে, লাল টালি ছাওয়া গীর্জয় অগানের সুরে সুরে প্লেয়ার করেছে ঠোঁট নেড়ে—সেই কেষ্টপদ দাস অবশেষে বুঝি একটা সান্ত্বনা খুজে পেল। ঊর্ধনেত্র যীশুর ছবির দিকে চেয়ে চেয়ে কেষ্ট যেন বুঝতে পারল, এ অন্যায়ের বিচার স্বর্গে।
আর এই যে তছনছ অবস্থা, কদর্য ভিড়, খেয়ােখেয়ি, ঘিনঘিনে নােংরামি, এ আর কিছু নয় অপতে-পাওয়া অবস্থা। বেলসেবুরের সাত অনুচরসাত শয়তান অট্টহাস্য হাসছে। তাদের দাপটে মেঘ হল না আকাশে, বৃষ্টি নেই, জল নেই। শয়তানদের নিশ্বাসে ধানের শীষ শুকিয়ে গেল, ফসল ফুরাল মাঠে-মাঠে। এমনই হবে না ? আকাশ থেকে আগুন আর গন্ধকের বৃষ্টি নেমে এসে প্লাবন বয়ে যাবে। নিশ্চিহ্ন হবে পাপ ; তবেই মনুষ্য-পুত্র আত্মপ্রকাশ করবেন। 
সেই আগুন আর গন্ধকের বৃষ্টিতেই না চাঁচুরিয়ার প্লাবন ডেকেছে। তীব্র জ্বলনে, কছু গন্ধে এর আকাশ-বাতাস ভরা। সাত শয়তানের ছিটিয়ে দেওয়া আবর্জনায় । মানুষের গায়ে নােংরা, মনে নােংরা ।
ঠিক এমন সময়ই গঙ্গামণির সঙ্গে দেখা। চাঁচুরিয়া যখন আর চাঁচুরিয়া নয় ; নরক। নরক। 
ভােলাবাবুদের গদিতে চায়ের অডার ছিল। বাবুদের চা খাইয়ে হাতের আঙুলে। এটো চায়ের কাপ আর কেটলি ঝুলিয়ে কেষ্ট বাজারের রাস্তা দিয়ে আসছে। এমন সময় চোখে পড়ল দৃশ্যটা। কালীময়রার দোকান থেকে তার কর্মচারী নিতাই এটোকাটার আর ছেড়-পাতার জঞ্জাল ফেলা টিনটা হাতে করে রাস্তায় নামতেই চারপাশ থেকে ভিখিরি ছেলে-ছােকরাগুলাে তাকে ঘিরে ধরল। রাস্তার ওপাশে। নর্মদা। ওপারে গিয়ে গালগুলাে ফেলে দেবে নিতাই। কিন্তু কার সাধ্য এক পা। এগােয়। ছিনে জোঁকের মতাে তাকে আটকে ধরেছে।
গালাগাল দিতে দিতে নিতাই দু-এক পা মাত্র এগিয়েছে, এমন সময় কে বুঝি। বেকায়দায় আটকাতে গিয়ে নিতাইয়ের পায়ে পা জড়িয়ে ফেলল। টাল সামলাতে গিয়ে নিতাইয়ের হাতের টিন ছিটকে পড়ল রাস্তায়, ঠিক মাঝ রাস্তাতেই। মারমুখাে
লতাহ ঘুরে দাড়াতেই ভিখিরির বাচ্চাগুলাে দু পা হটে এলাে। আবার এগুবে এগুবে করছে, এমন সময় কপা দুরেই মাল বােঝাই লরি। সরে গেল নিতাই, পথ। ছেড়ে পালাল ভিখিরির বাচ্চাগুলাে। রাস্তা ফাঁকা। উচ্ছিষ্ট ছিটোনাে, পাতা ছিটোনাে টিনটা পড়ে আছে মাঝ রাস্তাতেই। হঠাৎ কোন এক অদৃশ্য কোণ থেকে একটা চিল। ঝাপিয়ে পড়ল সেই উচ্ছিষ্ট ভতি টিনটার উপরেই। চেচিয়ে উঠল পথ চলতি লােকজন। মালগুদামের রাস্তা থেকে বেরিয়ে মােড় ঘুরে সবেমাত্র গিয়ার বদলেছিল। পরীটা। পুরােদমে ব্রেক কষলাে। চাকা ঘষড়ানাের তীক্ষ, কর্কশ, আওয়াজ উঠল, বুক কাঁপানাের আওয়াজ।
সবাই কিন্তু অবাক। উচ্ছিষ্ট-ভর্তি টিন সামনে ছড়ানোে ; যা পেয়েছে, সল্টে-সাল্টে অাঁচলে তুলে, হাতে পুরে চোখের নিমেষে লিকলিকে বেতের মতাে মেয়েটা উধাও ।। ঠিক যেন একটা ছিল চোখের পলকে ছোঁ মেরে আবার উড়ে গেল। আশপাশে কোথাও তার চিহ্ন নেই। 
কেষ্টর বুক ধক ধক করে উঠেছিল। সে কাঁপন থামল দোকানে ফিরে জল খেয়ে। পরের দিন আবার দেখা। ওভারব্রিজের তলায়, একাগাড়ির স্ট্যান্ডে। দেখার। সাথে সাথেই চিনতে পারল কেষ্ট। সেই কালাে ছিল। 
স্টেশন থেকে ফিরছে কেষ্ট টিকিট বাবুদের চা-টো খাইয়ে, খবরের কাগজ আর পাঁউরুটি-বিস্কুটের হাত-ঝােলানাে ঝুড়িটা নিয়ে। 
কেষ্টর হাতের ঝুড়ির দিকেই তাকাচ্ছিল মেয়েটা সােজাসুজি। রােজই হয়তাে তাকায়। কিন্তু আগে কোনদিন কেষ্ট এই সাধারণ ব্যাপারটা বিশেষভাবে লক্ষ করেনি। আজ করল। দাড়াল কেষ্ট। তাকাল একটু। তারপর কাছে ডাকল। কালাে চিল কাছে এল। একেবারে গায়ের কাছেই।
“তুর নাম কি ?" কেষ্ট প্রশ্ন করলে। 
“গঙ্গামণি। চটপট জবাব গঙ্গামণির। 
“নামটা তাে তেমন টগবগে লয়। এলি কোন্ গাঁ থেকে ?” 
“ধলগাঁ। নদী-পারে ছষ্টিপুর, তার পাশেই বটে'গ। ”
“বটেক, ধলগা ?” কেষ্ট এক মুহূর্তে নীরবে কি ভাবল যেন। 
গঙ্গামণিকে দেখল নজর করে। কালাে চিলকেই। কাঠি গা, তবু গড়নে, চোখে, চুলে ছিটেফোঁটা রূপ আছে।
“ধলগা চিনি। দু’কোশ তফাতে গাঁ আমার কাঁকুড়গাছি।" কেষ্ট আবার একটু থেমে প্রশ্ন করলে, “উদিক পানেও আকাল ?”
কুথায় লয় ?” গঙ্গামণি ধারালাে দৃষ্টিতে কেষ্টকে যেন ব্যঙ্গ করে বললে, “সগগ, মত্ত, পাতাল সরবত্রই। তুর গাঁ আমার গাঁ সতন্তর লয়, পিরথিবী ভরেই আকাল।” 
কেষ্ট চুপ। একটু সরে এদিক-ওদিক তাকিয়ে রেস্টুরেন্টের পাঁউরুটি-বিস্কুটের ঝুড়ি থেকে দুটো মিষ্টি বিস্কুট ফেলে দিয়ে বললে, “কাল তুই অমন করে গাড়ির সামনে কাপাই পড়লি যে-ভাগ্যি জোরে বেঁচে গেলি নয়ত কাটা যেতিস। তুর কি ভয় ডর নাই রে ?”
বিস্কুটে দীত বসিয়ে গঙ্গামণি ঠোঁট বেঁকালাে। জবাব দিলে, “কাটা পড়লে নিশ্চিন্ত হতুম গ। পেরান গেলে পেট থাকত লাই। পেটের জ্বালা সর্বনেশে জ্বালা ; কেউটে সাপের কামড়। সে এলনের কাছে মরণ ডরায়।” কথার শেষে গঙ্গামণি কুকুরের। মতাে অদ্ভুত এক শব্দ করে হাসল । 
গঙ্গামণির হাসি কেষ্টর মরমে এসে বিধল। ঠাই পেল বরাবরের জন্যই। অন্তরঙ্গ হল এই পরিচয় দিনে দিনে। 
কেষ্টর তরফে বলার কথা সামান্য। কেষ্টপদ দাস অল্পবয়স থেকেই অনাথ। মিশনারীদের কাছে থেকেছে, খেয়েছে, পরেছে। তারপর হেথা-হেথা ঘুরে এখানে এলাে, চ'চুরিয়ায় তিন বছর আগে। সেই থেকে সে চায়ের দোকানে কাজ করে। ও কিন্তু কৃস্টান।
কেষ্টর সঙ্গে ভাব হওয়ার পর গঙ্গামণির কষ্ট একটু তবু খুচলাে। আগে নিত্য অনশন, এখন তবু টুকটাক জুটে যায় কেষ্টর কল্যাণে। রেস্টুরেন্টেরই আশপাশে চিল-চোখে সর্বক্ষণ সে টহল দিচ্ছে। ও এলাকাটা যেন ওর। সেখানে আর কাউকে হাত বাড়াতে দেখলেই চুলােচুলি শুরু করে। এদিকে মালিক আর কারিগরের চোখ বাঁচিয়ে কেষ্ট গঙ্গামণির আঁচলে এটা-ওটা ফেলে দেয়। ফাঁক পেলেই এই দয়া-দাক্ষিণ্য। | রােজকার ব্যবস্থাটা কিন্তু ছিল রাত্রেই, মালিক যখন চলে যায়, কারিগর বিদেয় নেয়, তখন। গলির পথ দিয়ে গঙ্গামণি রেস্টুরেন্টের পেছন দরজায় হাজির। “কি-ই-ষ্টো, উ কিষ্টো। আস্তে আস্তে নীচু গলায় ডাক দেয় গঙ্গামণি।
কেষ্ট মুখে কোনাে শব্দ করে না। নীরবে রেস্টুরেন্টের পড়তি বা বাড়তি মালের খানিকটা জালির ফুটো দিয়ে গঙ্গামণির ভাঙা টিনের থালায় ঢেলে দেয়। . খুশি গলায় গঙ্গামণি বলে, “তুর মতাে মনুয্যি নাই রে ই জগতে।
ক'দিনেই গঙ্গামশির লােভ আরও বেড়ে ওঠে, “উ কিষ্টো, গুটেক মাস দে-না।
কাল তাে শুধুই কাদা পারা টোনাে'ঝােল দিলি । ভাত লাই একটুকুনও।” 
নিজের ভাত থেকেই কেষ্ট খানিকটা ভাত দিয়ে দেয়। না বললেও সে যে দেয়।
, তা নয়। তবে রােজ হয়ে ওঠে না। মালিক মাপ করে চাল দিয়ে দেয় কেষ্টকে হপ্তাভােরের। আগেভাগে ফুরােলে কিনে খাও।।
আশ্চর্য মেয়ে এই গঙ্গামণি। কেষ্ট দেখত আর ভাবত। আর ওর লােভ, পেটের। জ্বালা—তা এতাে উগ্র, তীব্র যার বুঝি তুলনা নেই। লােভের আভায় গঙ্গামণির চোখ। দগদগে ঘায়ের মতাে জ্বলত ।। . গঙ্গামণিকে দেখে কেষ্টর মাঝে মাঝে মনে হত, মেয়েটা যেন গন্ধকেরই ঝড়। কটু। তীব্র, বিষাক্ত। 
তবু গঙ্গামণিকে কেষ্ট ভালবাসত। কেন যে, কে জানে ? প্রতিবেশী গ্রামের মেয়ে বলে কি? না, আরও কিছু ? 
এ রকম ভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন। বাধ সাধল গঙ্গামণি নিজেই। তার নিত্য। নতুন ফন্দি-ফিকির করে রেস্টুরেন্টের দরজা ঘেঁষে এসে দাঁড়ানাে, আর প্রত্যহ এটা-ওটা চাওয়া সমস্ত ব্যাপারটাকেই ফাঁসিয়ে দিলে মালিকের কাছে। কারিগর ব্যাটা। সন্দেহ করতে শুরু করেছিল আগে থেকেই, ইতর রসিকতাও করত কেষ্টার সঙ্গে তা। নিয়ে। শেষাবধি মালিককে চুগলি। হাতে নাতে বামাল ধরা পড়েনি কেষ্ট এই যা। রক্ষে। শাসানি, ধমকানি খেয়ে কেষ্ট হাত টান করলে। 
গঙ্গামণির জিবে তার জন্মে গেছে ততদিনে। সে ছটফটিয়ে ঘুরে মরতে লাগল। রেস্টুরেন্টের এপাশ ওপাশ।
এমন সময় হঠাৎ কদিন গঙ্গামণি উধাও। পাত্তা নেই তার। দিন চারেক পরে। ওভারব্রিজের তলাতেই দেখা।
“হঠাৎ করে গেলি কুথায় তুই ?” কেষ্ট প্রশ্ন করলে। গঙ্গামণির গায়ে একটা নতুন কোরা শাড়ি। মাথার চুলগুলাে তেল-চকচকে। “চাকরি নিলাম রে, কিষ্টো। বাবুর বাসায়।” খুশিতে গঙ্গামণি ঢলে পড়ছে। “কোন্ বাবু ?” “লাম-টাম জানি নাই। উ-ই যে বাবু, তুর দোকানে ঝুড়িঝুড়ি খাবার খেতে আসে রে। দুবলা গােছের, চোখে কাচ, সাদা পারা দেখতে । ” ।
রােগা, চশমাপরা, ফসা বাবুটি যে কে, কেষ্ট বুঝতে পারল না প্রথমে। পরে বুঝল। বাবু নতুন। একেবারেই নতুন এ শহরে। “বাবুর বাড়ি কুথায় ?” “হুই যে, রেলপারে, যেথায় সাঁকো আছে।” কেষ্ট মনে মনে জায়গাটা ভেবে নিলে। বাবুটিকেও ভাল করে মনে করল। তারপর বললে, “বাবুর বাসায় কোন্ কোন্ জন থাকে ?”
“কেউ লয়। ফাঁকা।” জবাব দিলে গঙ্গামণি, “আর ও জাতটাতও মানে না রে, কিষ্টো। আমার হাতের ছোঁয়া খায়। তিনদিন পেটপুরে ভাত খেলাম।” গঙ্গামণি এমন একটা মুখভঙ্গী করলে যেন ওর মুখে এখনাে সেই ভাতের গন্ধ।
কেষ্ট একটা বিড়ি ধরিয়ে গঙ্গামণিকে ভাল করে নজর করল আবার । গঙ্গামণির গা-গতরে একটু যেন ঢল নেমেছে আজকাল।
* দেখ, গঙ্গামণি । " কেষ্ট বললে ভেবে চিন্তে, “এই আকালে শহরে অনেক টকো লােক এলাে। অনেক ভদ্দরলােক বাবু। কিন্তু মানুষগুলােকে মনে লয় না। মন্দ ঠেকে। বরং ই তাের পথঘাটই ভাল ছিল রে।”
কেষ্টর কথায় গঙ্গামণি বাধা দিলে।
“আবকের কথা কাড়িস না, কিষ্টো। শাড়ি দিলেক, ভাত দিলেক, মানুষটা মন্দ হবে কিসের লেগে ? উ দেবতার বংশ।”
কেষ্ট চুপ করে গেল।
গঙ্গামশির সঙ্গে আর দেখা হল না। সপ্তাহ কাটল, মাস কাটল। সেই ফসা মতন। চশমা চোখে বাবুটিও আর আসে না। একদিন কেষ্ট গেল গঙ্গামণির খোঁজ নিতে। সাঁকোর কাছে বাড়ি আছে বটে, তবে সেখানে গঙ্গামণি নেই, সেই বাবুটিও না। কেষ্ট ফিরে এল। মনে পড়ছিল গঙ্গামণির কথা : শাড়ি দিলেক, ভাত দিলেক, মানুষ মন্দ হবে কিসের লেগে ? উ দেবতার বংশ।
সেই শেষ। কেষ্টর মনে গঙ্গামণির রং দিনে দিনে ফিকে হয়ে আসছিল। হঠাৎ আবার এই নতুন করে দেখা—শালবনীর মেলায়, কার্তিক পূর্ণিমার রাত্রে, কাবহিডের আলােয়। সেই গঙ্গামণি । হাত ধরতে কেষ্ট চমকে উঠল।
“পালালি কুথায়, তুই ? খুঁজে খুঁজে হেদায় গেলাম।” গঙ্গামণি আবার এসে কেষ্টর হাত ধরেছে।
পুরােনাে কথা ভাবতে ভাবতে কেষ্ট কখন যেন মেলা ছেড়ে ফাঁকায় ফাঁকায় ঘুরে মন্দিরের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। “খেলি তুই?”
“হাঁ। ফুরাইছিলাে সব। চারগণ্ডা পয়সাকী যে ছাতা-মাথা দিলেক রে কেষ্ট, গলাতেই সোঁদাই গেল। দে বিড়ি দে একটা। শীত করে বড়।"
শীত করছিল কেষ্টরও। গঙ্গামণিকে বিড়ি দিয়ে কেঃ আশপাশে একটু ঢাকা জায়গা
খুঁজে নিল।
পাশাপাশি বসল দুজনে, কেষ্ট আর গঙ্গামণি। মন্দিরের ভেতরে তখন পক্ষকাল চীদের কলার হিসেব-মত-থালা দেউটিকে ঘিরে শত শত মানসিক করা প্রদীপ জ্বলে হলে নিস্তেজ হয়ে আসছে।
দুজনেই চুপ করে বসে থাকল। কুয়াশা আরও ঘন হয়েছে, ফুটফুটে চাঁদের আলাে এবার যেন শীতের দাপটে সাদা কাপড় জড়ালাে গায়। দামােদরের চর থেকে ভিজে গন্ধ ভেসে আসছে। সোঁদা, বুনাে গন্ধ। গঙ্গামণির কাঁচপােকার টিপ খুলে পড়ে গেছে কোথায়। “হঠাৎ করে তুই শহর ছেড়ে গেলি কুথায় রে, গঙ্গামণি ?” কেষ্ট প্রশ্ন করলে। চট করে এবার আর জবাব দিতে পারল না গঙ্গামণি। মুখ বুজে বসে থাকল অনেকক্ষণ। পরে, কথার জবাব দিতে বসে ওর দু-চোখ জলভরা হয়ে উঠল। সমস্ত কথা খুলে বললে গঙ্গামণি কেষ্টর পাশে বসে। একে একে। সেই হারামজাদা শয়তন মিনস্টো ভুলিয়ে ভালিয়ে ভাতের লােভ দেখিয়ে তাকে শহর থেকে। সরিয়ে নিয়ে গেল। হেথায় হেথায় করে কাটাল কিছুদিন। তারপর একদিন পালিয়ে গেল। গঙ্গামণি একা। বিদেশ বিভুয়ে, গ্রামে গ্রামে পথ ঘাট মাঠ করে ও ঘুরে। বেড়াতে লাগল ভিক্ষে চেয়ে চেয়ে, ভাতের জন্য হাত পেতে পেতে। গাঁয়ে গাঁয়ে। ধানের গােলা আজও শূন্য, আজও আকাল মেটেনি। পেটের তাড়ায় ঘুরতে ঘুরতে। শেষ পর্যন্ত গঙ্গামণি এসে উঠল হাতামােড়ায়। সেইখানেই ছিল গঙ্গামণি আজ দুদু। মাস। চাঁপাদের কাছেই। ওদের কথায়, ওদের সাথেই এই মেলায় এল, শালবনীর। মেলায়। কথার শেষে গঙ্গামণি কেষ্টর হাত জড়িয়ে ধরে কাকুতিতে কেঁদে উঠল।
“আর লারি, কিষ্টো। ব্যাধি হল শরীলে, বল নাই। এ ফলন সামলাতে লারি।। তুই সাথে লিয়ে চল আমায়।”
হাত সরিয়ে দিলে না কেষ্ট গঙ্গামণির। কান পেতে শুনল সব কথা। প্রথম। আলাপের সেই হাসি মরমে গাঁথা ছিল, এবার গাঁথা হল এই অনুনয়। নিরুত্তরে কেষ্ট। শুধু তাকিয়ে থাকল মন্দিরের দিকে। শেষ রাতের দুধ-আলাে চুড়াে-ভাঙা, শ্যাওলামাখ্যা মন্দিরের গায়ে গা মিশিয়ে দিয়ে যেন নিঃসাড়ে সােহাগ জানাচ্ছে।
ভাের হল। সূর্য ওঠার মুখেই গঙ্গামণি চাঁপার শাড়ি, জামা চুপিসারে ফেলে রেখে। একায় এসে উঠল। পাশে কেষ্ট। গঙ্গামণির দিকে তাকাল কেষ্ট। ভােরের আলােয় 
গঙ্গামণি ছেড়া-ফাটা, চিট-নােঙরা শাড়িতে গা গতর ঢেকে এসেছে কায়ক্লেশে। শীতের হাওয়ায় কাঁপছে ঠকঠকিয়ে।
সেদিক পানে তাকিয়ে তাকিয়ে কেষ্ট প্রথমটায় কেমন যেন অবাক তারপর অপ্রত। একটা বেদনায় মন ভার হয়ে বসে থাকল।
কেষ্টর চোখে গঙ্গামণির লুকোনাে লজ্জাটা ধরা পড়ে গেছে। ছেড়া-ফাটা শাড়ির আঁটুনিতেও ঢাকা পড়েনি সে কলঙ্ক চিহ্নটা।
একা ততক্ষণে এগিয়ে চলছে পলাশবনীর পথ ধরে। লাল গুলাে উড়ে পথের পাশে পলাশ আকন্দের পাতায় রং ধরাচ্ছে ধূসর। শূন্য প্রান্তরে একটানা ঘন্টি বাজছে। ঘােড়ার গলায় বাঁধা ঘণ্টিগুলাের। সামনে পিছনে আরও কত একা, কত মেলা ফিরতি। মানুষজন।
একার ঝাঁকুনি খেতে খেতে সহসা কেষ্ট বুঝতে পারল সাজনীর সাজে সেজে এসেও গঙ্গামণি কাল রাত্তিরে পানের মােড়ক বাঁধা আঁচলের গিট খুলতে পারেনি কেন ।
আবার সেই চাঁচুরিয়ায় ফিরে এল গঙ্গামণি। এসে দেখে, অবস্থার হেরফের তেমন কিছু হয়নি। মরে, পালিয়ে বেঁচেবর্তে শেষ পর্যন্ত যারা টিকে গেছে তারা প্রায় সকলেই ঠাঁই নিয়েছে ওভারব্রিজের নিচে, একা স্ট্যান্ডের ছাউনির তলায়। ঘােড়ায়, কুকুরে, মানুষে মিলে-মিশে রাতটুকু নিশ্চিন্তে ওরা কাটিয়ে দেয়। ভােরের মুখ দেখার সাথে। সাথেই যে যার মতাে বেরিয়ে পড়ে পথে। গঙ্গামণিও এসে মাথা খুঁজলাে সেই ছাউনিতে। আসার পথেই কেষ্ট সাবধান করে দিয়েছে গঙ্গামণিকে। খবরদার, দিনের বেলায়।
রেস্টুরেন্টের আশেপাশে গঙ্গামণি যেন ঘুরঘুর না করে । রাত্রে সেই আগের মতােই। গুগলিপথ দিয়ে লুকিয়ে গিয়ে পিছন দরজায় এসে ডাক দিলেই হবে। সজাগ থাকবে। কেষ্ট।
এবার আর কেষ্টর কথা অমান্য করতে সাহস করল না গঙ্গামণি। সারা দিন পরে। সিকিপেটা, আধপেটা যাই হােক, যেমন হােক খাবারটা জোটে কেষ্টর কাছেই। তা কি। বন্ধ হতে দেওয়া যায় ? 
খুব সাবধান হয়েছে এবার গঙ্গামণি। যতক্ষণ দিনের আলাে আছে, বাজার-পথে। ওর ছায়া দেখবে না কেউ। সারা দিন লাইনধারে, স্টেশনে, প্যাসেঞ্জার গাড়ির কামরায়। কামরায় ভিক্ষে চেয়ে বেড়ায়। 
রাত হলে ওর পা আর বাধা মনতাে না। বাজারে ঢুকতিপথে অন্ধকার মতাে একটা। জায়গায় চুপ করে দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকত রেস্টুরেন্টের দিকে। কতক্ষণে ভিড়। কমে, মালিক চলে যায়, দোকানের দরজা বন্ধ করে দেয় কেষ্ট। অগ্রহায়ণের হিমে। গঙ্গামণির সঙ্গি কনকনিয়ে আসে—তবু পা নড়ে না, চোখ ফেরে না অন্যদিকে । রেস্টুরেন্টের বাতিটা নিভে যাবার অপেক্ষায় তার দু চোথ ঠায় জেগে থাকে।।
রেস্টুরেন্টের বাতি নিভে গেলে পা-পা করে গঙ্গামণি গলির পথ ধরে। ছাই, জঞ্জাল, ফণিমনসা ঢাকা এক মানুষ-গা অন্ধকার গলি। সেই গলি দিয়ে নিঃশব্দে পা। টিপে টিপে গঙ্গামণি রেস্টুরেন্টের পিছন দরজায় এসে থামে। জলের ফুকরি দিয়ে উকি মারে। আস্তে আস্তে ডাকে—“কিষ্টো, উ কিষ্টো।” 
কেষ্ট সজাগ। ডাক শুনে গঙ্গামণির জন্যে লুকিয়ে রাখা খাবার আছে অনেক ফুকরির কাছে এসে দাঁড়ায় । 
কালিঝুলি মাখা হালের ফুকরির গায়ে গঙ্গামণির জ্বলজ্বলে চোখ দুটো বেড়ালের। চোখের মতাে জ্বলতে থাকে। হাপর-টানার মতাে শব্দ ওঠে ওর নিশ্বাসের। আবছা । একটা ছায়া জালের ওপাশে মুখ ঘষে। 
লুকিয়ে রাখা পাত্রটা ঝটপট টেনে নেয় কেষ্ট। ফাঁক দিয়ে গঙ্গামণির থালায় উজাড়। করে ঢেলে দেয় সঞ্চিত খাদ্যবস্তুগুলাে। 
কথা বলার অবসর নেই গঙ্গামণির। অন্ধকারেই একটা হাত তার থালা থেকে মুখে। এসে উঠেছে।
চুপ—সব চুপ। দূরে কুকুর ডাকছে। কেরােসিনের লালচে আলােয় রেস্টুরেন্টের মধ্যে দাঁড়িয়ে কেষ্ট। বাইরে অন্ধকার । আবর্জনার গন্ধ ভাসছে। খেতে খেতে গঙ্গামণির গলা বন্ধ হয়ে আসে, বিষম লাগে। কাশির দমকে বুক ছিড়ে যাবার যােগাড়।
ধমক দেয় কেষ্ট। ধরা পড়ার ভয়ে ওর গা ছমছম করে। তাড়াতাড়ি জল দিয়ে বিদেয় করে দেয় গঙ্গামণিকে।
নিত্যই এই। কোনাে রকমফের নেই। রাত্রে নিদেনপক্ষে একটি দুটি কথা হয়। নয়তাে সব কিছুই চুপি চুপি ; নিঃসাড়ে । কথার পাট দিনের বেলায়। কাজের ফাঁকে কেষ্ট স্টেশনে এলে।
দেখতে দেখতে অগ্রহায়ণ শেষ হল। পৌষ এল শীতের প্রচণ্ড দাপট নিয়ে। সে পেীষও শেষ। মাঘ মাসে গঙ্গামণি একা স্ট্যান্ডের ছাউনির তলায় শীতের রােদুরে চুপচাপ বসে থাকে আর হাঁপায়। গায়ে বল পায় না। প্যাসেঞ্জার ট্রেন এলে কোনরকমে শরীরটাকে টেনে-টুনে প্লাটফর্ম পর্যন্ত নিয়ে যায়। তাও যেন পারে না। রােজ। মাথা ঘােরে চরকিপাকে, দম বন্ধ হয়ে আসে, হাপ ওঠে। চড়চড়িয়ে টান। পড়ে পেটে, পেট মােচড় দিয়ে ওঠে। গা গুলােয়, মাথা গুলােয়।।
শরীরটা যতই নিস্তেজ হয়ে আসে, ততই যেন গঙ্গামণির পেটের খিদে জিভ ঠেলে। বেরিয়ে আসে। কুকুরের মতাে পাত চেটে বেড়ায় ও একা স্ট্যান্ডের এখানে ওখানে ।।
এদিকে রেস্টুরেন্টে ফোর রেষারেষি বেধে গেছে কারিগর আর কেষ্টতে। ক্যাশ। থেকে টাকা চুরি করেছিল কারিগর। ধরা পড়ে দোষ চাপাল কেষ্টর ঘাড়ে। তা ছাড়া। বেশ খানিকটা হাত টান ছিল কারিগর ছােকরার। ধরা পড়লেই কেষ্টকে কোনঠাসা । করে দিত। বাবুকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলত, “হবে না কেন মালে কমতি ? সেই শালী। তাে আবার এসেছে—পিরীতের বােষ্টমী কেষ্টার। উর পাতেই তাে যায়।” 
গােলমেলে ব্যাপার দেখে কেষ্ট গঙ্গামণির আসা বন্ধ করে দিলে। বললে, “ঝামেলা। বাঁধাইছে রে, গঙ্গামণি। উ শালা লটবরের শয়তানি সব। তুই আর আমার ঠেছে। রেতে যাস নে। থাক হেথায়। লুকাই চুরাই দিব ক্যানে কিছু।” ।
সেই থেকে গঙ্গামণির দুকুল যেতে বসল। দুর্বল শরীর নিয়ে বসে থেকে পাত চাটলে পেট ভরে না ; কেষ্টর প্রত্যাশায় পথ চেয়ে চেয়ে হদ্দ হয়ে গেলেও তেমন কিছু জোটে না আজকাল। রােজ তাে নয়ই। বাধ্য হয়েই গঙ্গামণিকে এবার স্টেশন বাজার সর্বত্রই ককিয়ে, কেপে, হাতে-পায়ে ধরে পেটের জ্বালা মেটাবার চেষ্টায় বেরােতে হল। _ আরও কিছুদিন কাটল এইভাবেই। গঙ্গামণি আর পারে না। শরীরে কুলােয় না । একেই, তায় আবার যা জোটে এটোকটিা তাতে ওর অরুচি।।
কেষ্টর সঙ্গে পথে-ঘাটে দেখা হলেই গঙ্গামণি ওর পথ আটকে ধরে ।। “আর তােলারি রে, কিষ্টো। ভাল তুই ভাল। দয়ামায়া কুথায় গেল রে তুর ?  ই শরীলে আমার থাকল কি ক ?
কেঃ চুপটি করে সব শােনে। কথা বলার মতাে কিছু খুজে পায় না। কিই বা। আছে বলার !
আর একদিন দেখা। প্লেট-ঢাকা খাবার নিয়ে কেষ্ট যাচ্ছিল স্টেশনে, বুকিং। অফিসে।
“যাস কুথায় রে, কিষ্টো ?” গঙ্গামণি পথ আড়াল করে দাঁড়াল, “কি আছে রে উতে ?”
“চ”। ” জবাব দিলে কেষ্ট, টিকিটবাবুর চেনা-জানা লােক এল। অড়রি দিলেক। _ চপের প্লেটের দিকে লােভাতুর দৃষ্টিতে গঙ্গামণি তাকিয়ে থাকল, “মাসের চপ, না কি। রে ?” জিভে জল এসে পড়েছে ওর।
“হী ; মাসের । ” কে পা বাড়াল। “শুন, শুন কিষ্টো ;—টিকিটবাবুরা সবটাই কি খাবেক আর টুকটা ফেলাছড়া থাকলে দিস ক্যানে আমায়। আমি হেথায় আছি।” গঙ্গামণি চপের গন্ধ শুকতে। শুকতে যেন অবশ হয়ে এল। 
চলে গেল কেষ্ট চপের প্লেট হাতে নিয়ে। 
কিন্তু ছাড়া পেলে না। সেই থেকে গঙ্গামণুির সাথে দেখা হলেই ও নাছােড়বান্দা।
“উ কিষ্টো। খাওয়া ক্যানে একটা চপ রে? কতোই তাে হয় তুদের রােজ। বড় সাধ লাগে। ই জিবে আর সােয়াদ নাই রে। পায়ে পড়ি কিষ্টো তুর, একটা মাসের চপ খাওয়া আমায় । ” 
কেষ্ট কত বােঝায়। বলে, “বড় কড়াকড়ি রে, গঙ্গামণি। মালিক নিজের হাতে সব গুণে রাখে, হিসেব নেয়। চপ্ তােকে খাওয়াই কি করে ? একটু সবুর কর, ফাঁক পেলেই খাওয়াবাে।” 
গঙ্গামণির কপাল ভাল । অল্প কদিনের মধ্যেই হঠাৎ একটা সুযােগ জুটে গেল। মাঘের শেষ তখন। বাজারে আলুর আড়ৎ যার সেই নন্দীবাবুদের মেয়ের বিয়ে। দু হাতে পয়সা ঢেলে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে নন্দীবাবু। বােষ্টম লােক। বাড়িতে মাছ মাংস একেবারেই অচল। অথচ বরযাত্রীদের জন্যে খাবার ব্যবস্থাটা মাংসের পর্যায়ে না তুললেই নয়। মদনবাবুর রেস্টুরেন্টে ঢালাও অডার হল মাংস আর চপের।
মাঘের প্রচণ্ড শীত। বিয়ের লগ্ন মাঝ-রাতে। সেই দুরন্ত শীতে নিমন্ত্রিতদের পাতে গরম চপ আর মাংস তুলে দেওয়ার পাট চুকোতে-চুকোতে বিয়ের লগ্ন পেরিয়ে গেল । ক্লান্ত মদনবাবু বিদায় নিলে। চলে গেল কারিগর গামছার একটা মােটা রকমের পুঁটুলি বেঁধে। রেস্টুরেন্টের ধােয়ামােছা শেষ করে কেষ্ট উনুনটায় কয়লা ঢেলে দিলে। রাত তাে প্রায় শেষ হতে চলল। ভাের না হতেই গরম জল দরকার চায়ের। 
হাতমুখ ধুয়ে অল্প একটু বিশ্রাম নিল কেষ্ট। সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনীতে সমস্ত শরীরটা অবসন্ন হয়ে এসেছে। পর পর দুটো বিড়ি খেয়ে হাই তুলল। ঘুম পাচ্ছে ওর ; ভীষণ ঘুম। রাতের গােড়ায় জোর খিদে পেয়েছিল ; এখন আর দীতে কুটো কাটতেও ইচ্ছে করে না।
বেঞ্চি জোড়া দিয়ে কেষ্ট তার বিছানাটা বিছিয়ে নিল রেস্টুরেন্ট ঘরে। একটা কালাে ময়লা পদ লুলত রেস্টুরেন্টের রান্না ঘর আর এই চেয়ার টেবিল সাজানাে ঘরের মধ্যে। পদটিা গুটিয়ে দিলে কেষ্ট। উনুনে আঁচ উঠে গেছে। এই প্রচণ্ড শীতে ওই অচের তাপটা বেশ লাগে।
চায়ের জল-গরমের টিনটা উনুনে চাপিয়ে জল ভর্তি করে দিল। ফুটুক এখন। ঠিক এমন সময় জালের ফুকরি দিয়ে ডাক শােনা গেল, “কিষ্টো—উ কিষ্টো। ” এই ডাকেরই অপেক্ষা করছিল কেষ্ট। গঙ্গামণিকে আজ সে আসতে বলেছে। হৈ-হট্টগােলের মধ্যে না হলে আর সুযােগ জুটত না। কতদিন মেয়েটা একটা চপের জন্যে বায়না ধরেছে, মাথা খুঁড়ছে কেষ্টর পায় । আজকের এই রাশি রাশি খাবারের মধ্যে ও যদি দুটো খায় কেউ জানতে পারবে না, ধরতে পারবে না। বেচারী গঙ্গামণি। কতকাল পেট ভরে খায়নি, কতদিন ওর মুখে এটোকাটা আর নােঙরা ছাড়া কিছু ওঠেনি। কেষ্টর ভরসা করেই গঙ্গামণি এখানে এসেছিল এবার, এই চাঁচুরিয়ায়—কিন্তু কেষ্টও পারল না। পারল না গঙ্গামণিকে নিত্য একবেলা এক মুঠিও হাতে তুলে। দিতে।
জালের ফুকরির পাশে পিছন-দরজা। সেই দরজাটার থিল খুলে কেষ্ট ডাকল, “আয়—ভেতরে আয়।”
গঙ্গামণিকে দ্বিতীয়বার বলতে হল না। অন্ধকারের গুহা থেকে লােভাত একটা ভীরু পণ্ড যেন ঘরে এসে ঢুকল। শীতের দাপটে কাঁহে হি হি করে। 
কেরােসিনের খুপির আলােয় সেই ফোলা ফোলা বীভৎস মূর্তির দিকে তাকিয়ে কেষ্ট। আবার দরজার খিল এটে দিল।
“রাতটা শেষ করেই এলাম রে।” গঙ্গামণি এক কোণে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তীক্ষ চোখে নজর করছে।
“ভালােই করলি।" কেষ্ট কি যেন ভাবল একটু। তার নিজের পাত্রটা টেনে নিলে। দেওয়াল-তা থেকে। গঙ্গামণির জন্যে লুকিয়ে রেখেছিল দুটো চপ, কহতা মাংস।
খাবারের পাত্রটা এগিয়ে দেবার আগে কেষ্ট বললে, “শীতে তুই বড় কাপছিস। গঙ্গামণি, একটু আগুন পুইয়ে নে। না হলে খাবি কি, কেঁপেই মরবি।”
“আগ সেকে কাজ নাই। তু দেখ ক্যানে—আমি হদ হন করে খেয়ে লিব। সারা। রাত ঠায় চোখ ফাবড়ে বসে আছি তাে বসেই আছি। ই বাবা, এত কি যজ্ঞি রে কিষ্টো, মানুষগুলা খায় তাে রাত ভাের করেই খায় সব।” গঙ্গামণি অধৈর্য হয়ে আঁচল পাতল। “লিতে হবে না। বােস তুই, উখানেই বােস। বােসে বােসে খা।” কেষ্টর কথায় গঙ্গামণি বােধহয় একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল প্রথমটায়। কিন্তু। অতশত ভাববার সময় নেই তার। পেট থেকে জল টানছে জিবে। মাটিতে বসে পড়ল গঙ্গামণি।
হাতের পাত্রটা কেষ্ট এগিয়ে দিল। সেদিক পানে তাকিয়ে গঙ্গামশির চোখের পাতা। আর পড়তে চায় না। ঠোট দুটো ফাঁক হয়ে থাকে, হা হয়ে থাকে মুখ। জিভ দিয়ে। জল গড়িয়ে পড়ে ঘি-ভাতের ওপর। _ বিয়ে বাড়িতে পরিবেশন শেষ করে আসার পথে কারিগর নটবর ওদের ভাগ নিয়ে। এসেছিল-লুচি, মাছ, ঘিভাত কত কিছু। কেষ্টকেও দিয়ে গেছে খানিক খানিক। সবই ভােলা ছিল। কেষ্ট থালাটাই এগিয়ে দিয়েছে গঙ্গামণিকে। এর ওপর মাংস আর চল। | Wীবনে কোনােদিন এত খাবার দেখেনি গঙ্গামণি। জিতে স্বাদ জানে না অনেক। কিছুরই। কোটা কি, মিষ্টি না ঝাল, টক না মােনতা, কিছুই তার জানা নেই। কোন্টা আগে ছোবে, কি যে আগে খাবে গঙ্গামণি তা ভেবেই পায় না। চোখ দুটো তার থালার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকে।
কেষ্টর তাগিদে গঙ্গামণির বিমূঢ় 'ভাবটা কাটল। 
হাত বাড়াল গঙ্গামণি, "ভাতে মিষ্টি কেন রে কিষ্টো? লং ক্যানে ইয়াতে ? মাগাে মা, ঘিয়ে চপচপায় ! ক্যাওটের বিটি আমি, বাপের কালেও মাছের সােয়াদ জ্ঞান হল না ইর। পারা রে কিষ্টো। কী সুয়াদ—জিভে জড়ায় যায় গ।” 
বিড়ি ধরিয়ে কেষ্ট একদৃষ্টে তাকিয়েছিল গঙ্গামশির দিকে। গঙ্গামণিকেই সে দেখছে। দেখার মতই না দৃশ্যটা। পা ছড়িয়ে, মুখ থুবড়ে থালার ওপর লুটিয়ে পড়েছে গঙ্গামণি। হাতের আঙুলগুলাে তার পাগল হয়ে ছুটোছুটি করছে পাতের ওপর। বিরাম নেই এস আর গলাধঃকরণের। চোখ তুলে চায় না—সােজা করে না দেহটাকে। অদ্ভুত। অদ্ভুত দেখাচ্ছে গঙ্গামণিকে। দু-পাঁচ ক্রোশ ছুটে আসার পর ঘাড়-মুখ গুঁজে ঘােড়াগুলাে ঠিক এমনিভাবেই দানা খায় না।
দশ্যটাকে কে জানে কেন, কের ভালাে লাগছে না। এমন হবে জানলে গঙ্গামণিকে ঘরের মধ্যে ডেকে নিত না ; খাওয়াত না চোখের সামনে বসিয়ে । কি যে খেয়াল হয়েছিল কেষ্টর, ইচ্ছে জেগেছিল ভীষণ–গঙ্গামণিকে সামনে বসিয়ে ভালােমন্দ দিয়ে পেটপুরে খাওয়াবে। এই প্রচণ্ড শীতে ঘরের মধ্যে উনুনের আঁচের আরাম কি কম! সেই আরামে নিশ্চিন্তে বসে গঙ্গামণি ধীরে ধীরে খাক না কেন সব—যত তার পাতে আছে।খাওয়ার খুশিতে গঙ্গামণির মুখে আনন্দ উপচে উঠুক, ক্ষুধা-তৃপ্তির। সেই আরাম আর সুখ, যে আরাম, সুখ ও ভুলে গেছে অনেক কাল, অনেক শীত আগেই। অনেক সাধ ছিলাে কেষ্টর, প্রবল বাসনাই, গঙ্গামণির সেই খুশি, পরিতৃপ্ত, চিরতার্থ মুখখানি আজ ও দেখবে। আর সেই সঙ্গে একথাও বুঝুক গঙ্গামণি, কেষ্ট নিরুপায় ; নয়তাে গঙ্গামণিকে খাওয়াতে তার কি কিছু কম সাধ ? | কিন্তু কই খাওয়ানাের সেই সুখ পাচ্ছে না তাে কেষ্ট। গঙ্গামণির মুখ-ঘাড় গুঁজে বসা ওই দেহের কোথাও কি খাওয়ার আনন্দ আছে, কি সুখ?
আশ্চর্য! কেষ্ট অবাক মানছে মনে মনে। অপদেবতায় সূর্যের আলাে মুছে দেয়, গাছের সবুজ পাতা এক নিশ্বাসে ঝরিয়ে ফেলে, সমুদ্রের জল শুকিয়ে আগুনের ঝড় তােলে, যশ ঝড়; তেমনি কি–তেমনি কি, আকালের ঝড় মানুষের মুখ থেকে খাওয়ার খুশিও মুছে নিয়ে গেল। 
সেদিক পানে তাকিয়ে তাকিয়ে বেলসেবুবের সাত অনুচরসাত অপদেবতাকে কেষ্ট যেন হঠাৎ রেস্টুরেন্টের এই ঘরে অস্পষ্টভাবে দেখতে পেল। অনুভব করতে পারল তাদের বিষনিশ্বাস। সেই তীব্র কটু গন্ধকের হাওয়া দিয়েছে আবার। পুরনাে চাঁচুরিয়া আর গঙ্গামণি, গঙ্গামণির দল মনের নাগরদোলায় ওঠানামা করছে। 
কে ? কেষ্ট চমকে উঠল। পাত থেকে হাত গুটিয়ে গঙ্গামণিও তাকাল চোখ
রেস্টুরেন্টেরর বাইরের দরজায় ভীষণ জোরে ধাক্কা মারছে কে ? কান পেতে শব্দটা শুনতেই কেষ্টর মুখ শুকিয়ে এল। টিপ টিপ করে উঠল বুক।
বাইরের দরজায় ধাক্কা মারার শব্দটা থেমেছে। গঙ্গামণি তখনাে পাত আগলে বসে। মাংসটা তবু একটু খেয়েছে, কিন্তু বড় সাধের চপ দুটো তখনাে তার পাতে।। তারিয়ে তারিয়ে খাবে শেষ-পাতে, সেই ইচ্ছেতেই একপাশে সরিয়ে রেখেছিল।
ইঙ্গিতে কেষ্ট গঙ্গামণিকে উঠতে বললে চটপট। ফিসফিসিয়ে জানাল, পিছু-দরজা দিয়ে পালিয়ে যেতে। 
মাংস আর চপ ছেড়ে পালিয়ে যেতে মন চাইছিল না গঙ্গামণির। চুপি গলায় সে বললে, “ডরাস ক্যানে ? উ কিছু লয়। বাতাস হবে, কি কুকুর-টুকুর। 
দরজায় ধাক্কা মারছে না আর কেউ। শব্দ নেই কোথাও। কেষ্ট অপেক্ষা করলে। তবে ? ও কি বেলসেবুব ? কেষ্টর ভয় কমল না এতটুকুও। “কাজ কি ঝামেলায় ? তুই যা গঙ্গামণি ?”
প্রচণ্ড অনিচ্ছা, তবু গঙ্গামণিকে যেতে হবে। রাগ হল তার খুব। চপ দুটো চট করে তুলে নিল । একটা কামড় বসিয়ে গরগর করতে লাগল রাগে আর বিরক্তিতে। আস্তে আস্তে খিল খুলল কেষ্ট পিছন-দরজার। কপাটের একটু ফাঁক দিয়ে এক চিলতে অন্ধকার চোখে ঠেকেনি তখনাে, হঠাৎ কে যেন বাইরে থেকে দড়াম করে।
একলাথি মেরে কপাট দুটো হাট করে দিল।
কপালে ঠোকর লাগল কেষ্টর, জোর ঠোক্কর কপাটের। ঝিম ঝিম করে উঠল। মাথাটা। 
কপালে হাত বুলাতে বুলােতে কেষ্ট এক চোখে চাইল। সেই চাওয়াতেই তার। সবঙ্গি অসাড়, পাথর হয়ে যায়। স্বপ্ন নয়, নটবরও নয়, বাবু স্বয়ং-মদনবাবু। একেবারে দরজার ওপরেই।
মদনবাবু এক নজরে সব দেখে নিলেন। আগেও দেখেছেন জালের যুকরি দিয়ে ।। পিছন দরজার কপাটটা বন্ধ করে খিল তুলে দিলেন মদনবাবু। ঝাপিয়ে পড়ে গলা। টিপে ধরলেন কেষ্টর।
“নেমকহারাম, জোচ্চোর, সােয়াইন—আমার ব্যাগ কোথায় বল? তারপর দেখছি। সব” 
দম বন্ধ হয়ে আসার যােগাড় হয়েছিল কেষ্টর। মদনবাবুর হাত থেকে গলা ছাড়াবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল কেষ্ট। গলা দিয়ে দমবন্ধ হবার মতাে ঘড়ঘড় শব্দ। উঠল। গলা ছেড়ে দিলেন মদনবাবু। দম নিতে লাগল কেষ্ট। গলা তার শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। মুখ পাংশু। “কোথায় আমার ব্যাগ ?” মদনবাবু এক থাপ্পড় লাগালেন কেষ্টর গালে।। দু-পা হঠে আসতে হল কেষ্টকে। “জানি না বাবু।” “শালা, শুয়ার, ব্যাগ জানাে না তুমি ? জানাচ্ছি, দাঁড়াও ?”
কেষ্টর চুলের মুঠি নেড়ে আর এক থাপ্পড় কষালেন তার গালে। কেষ্ট দেওয়ালের। গা খেয়ে ছিটকে এল। _ এক লাফে মদনবাবু এগিয়ে গেলেন ক্যাশের দিকে। ক্যাশের চাবি খােলা! টানাটা। উঠোতেই ব্যাগটা হাতে ঠেকল। নিত্যদিন যেভাবে ব্যাগটা পড়ে থাকে, ঠিক। সেইভাবেই পড়ে আছে। যথেষ্ট ভারী। হ্যাঁ, নন্দীবাবুর টাকায় ভারী হয়েছিল বলেই।
এই শীতের শেষরাতে ব্যাগের কথা মনে পড়ল বিছানায় শুয়ে। আর যেই-না মনে। পড়া ছুটতে ছুটতে তিনি এলেন দোকানে। হাজার কাজে, ভিড়ে, বিয়ে বাড়ির খাবার। পাঠানাের তদারকে কখন যেন ভুলেই ব্যাগটা দোকানে রেখে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। মনে পড়তেই ছুটে এলেন। বাইরে থেকে দরজায় ধাক্কা দিলেন। কোনাে শব্দ নেই। এলেন পিছন-দরজায়। জালের ফুকরি দিয়ে তাকালেন অন্দরে। ঘুমন্ত কেষ্টকে ডাক। দেবেন বলেই। কিন্তু তাকিয়ে যে দৃশ্যটা চোখে পড়ল তাতে আপাদমস্তক গলে উঠল। মদনবাবুর। নটবরের কথাই তা হলে ঠিক। এমনিভাবে কে? রোজ তার দােকানের। খাবার চুরি করে ডিটাকে খাওয়ায়। টাকা-পয়সাও যে আজকাল ক্যাশ থেকে মাঝে। মাঝে চুরি যায়—সেটাও তাহলে কেষ্টর কীতি । বিশ্বাস কি ? আর ব্যাগ। ব্যাগটাও কি। তিনি সত্যি তুলে দোকানে ফেলে গেছেন না হাতিয়ে নিয়েছে কে৪। পলকে তার। বিচারবুদ্ধি লােপ পেল।
ব্যাগটা হাতে করেই মদনবাবু আবার কেষ্টর কাছে এসে দাঁড়ালেন। নােটগুলাে। বের করে গুলে নিচ্ছেন এমন সময় খুট করে শব্দ হল। গঙ্গামণি পিছন দরজার খিলখুলে ফেলেছে। পালাবার জন্যে পা বাড়িয়েছে সবে।
মদনবাবু ছুটে এসে গঙ্গামণির হাত ধরে ফেললেন।
“শার্থী, হারামজাদী, লুঠতে এসেছিস এখানে? তাের চোদ্দ ভাতারের জমিদারি এটা। রা—রাখ শীঘ্রি চ—নামিয়ে রাখু, ফেলে দে।”
হ্যাঁচকা টান দিলেন মদনবাবু। গঙ্গামণি সেই টানে ছিটকে কেষ্টর কাছে গিয়ে দেওয়ালে ধাক্কা খেলে। . ব্যাগটা মদনবাবু ততক্ষণে পকেটে পুরে ফেলেছেন।
গঙ্গামণিও ছাড়ার মেয়ে নয়। তার সেই বহুদিন আগেকার বেপরােয়া ভাবটা হঠাৎ যেন ভর করল তাকে। চপ্ সে রাখবে না। হাতের মুঠিটা আরও জোর করে গঙ্গামণি। চপ চেপে ধরল। যেন হাতের মুঠিতে আগলে রেখেছে তার জীবন।
“গাল দিয়াে নাই । থুবাে নাই চপ্‌।” গঙ্গামণি দরজার দিকে আবার এগিয়ে চলল।
মদনবাবু সাপ্টে ধরলেন গঙ্গামণিকে। চল্, তিনি কেড়ে নেবেনই। রােখ চেপে গেছে। ধস্তাধস্তিতে, কাড়াকাড়িতে গঙ্গামণির চ গুঁড়াে গুঁড়াে হয়ে মাটিতে ছড়িয়ে ছিটকে পড়ল। বাঁ হাতের চপটা তখনও বাঁচিয়ে রেখেছে ও। 
‘হেলানী মাগি, চপ্ তােকে রাখতেই হবে। খেতে দেবাে না। দেখি কেমন করে খাস তুই। ” মদনবাবু গঙ্গামণির বাঁ হাত চেপে ধরে মােচড় দিলেন।
“চামার”-কাতরে উঠে গঙ্গামণি মদনবাবুর বুকের পাশেই কামড়ে ধরল।
আর্তনাদ করে মদনবাবু হাত ছেড়ে দিলেন। গঙ্গামণি ছুটে পালাতে যাবে, আবার হাত বাড়ালেন মদনবাবু। শাড়ির ছেড়া আঁচলটা হাতে এল। টান দিতেই বাধা পেল গঙ্গামণি ; ছেড়া শাড়ি ছিড়ে গেল ; এক টুকরাে তাে কাপড়, গা খুলে কোমর খুলল।
সমস্ত জোর দিয়েই বুঝি একটা লাথি মেরেছিলেন পেটে মদনবাবু, গঙ্গামণি তীব্র আর্তনাদ করে ঘুরে পড়ল উনুনের ওপর। হুমড়ি খেয়েই পড়েছিল গঙ্গামণি।।
গরম-জল-ভরা টিনটা লাগল কোমরে—উল্টে পড়ল উনুনের পাশেই। উনুনে জল পড়ে ভ্যাপসা কটু গন্ধ ভেসে উঠল, বিশ্রী একটা শব্দ হল আগুনে জল পড়ার। বাকি জলটা গড়িয়ে পড়ল উনুন বয়ে মাটিতে। গঙ্গামণিও টলতে টলতে লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে, অসহ্য কাতরানিতে কঁকিয়ে কেঁদে উঠল । 
কেষ্ট পাথরের মত এক কোণে দাঁড়িয়ে। তার কোনাে সম্বিত নেই। কাঠের মত দাড়িয়ে সে শুধু দেখেই যাচ্ছে। কি ঘটছে তা অনুভব করার বােধটুকুও লুপ্ত তার ।। রণশেষে মদনবাবু বিজয়ীর মতাে দাঁড়িয়ে ক্লান্তশ্বাস ফেলতে ফেলতে গঙ্গামণিকে। দেখছেন। নিষ্ঠুর, কদর্য একটা হাসি তার মুখে। চোখ দুটো তখনাে হিংস্র, অপ্রকৃতিস্থ।
“চপ্ খাবে-- ? হারামজাদী মাগী ! খা চপ।” মদনবাবু কেষ্টর দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন।
“আর ব্যাটাচ্ছেলে, রাস্কেল, জোচ্চোর,—তুই! তাের বাপের দোকান এটা ? পিরীত করে রাস্তার ভুড়ি ধরে এনে চ কাটলেট খাওয়াবি ? শুয়ােরের বাচ্চা, এক আধ দিন নয়—বচ্ছর ধরে তুমি এই রকম চালাচ্ছ ?
মদনবাবু কেষ্টকে আরও কয়েক ঘা কাবার জন্যে এগিয়ে যাচ্ছিলেন হঠাৎ গঙ্গামণির মমাস্তিক একটা আর্তনাদ শুনে ঘুরে দাঁড়ালেন। কেমন যেন মনে হল! এক। পা সুকে তা চোখে নজর করলেন। কেরােসিনের খুপির লালচে আলােতেও রং। ভুল হয় না। রক্তই। কাপড়ে, উরুতে, মেঝেতে। ফিনকি দিয়ে ছুটছে। _ কী বীভৎস। মদনবাবুর সবঙ্গি শিরশিরিয়ে উঠল। অদ্ভুত একটা ভয় বুকের হাড়ে। হাড়ে জমাট বাধল, হৃৎপিণ্ডটা যেন নিজের কানের কাছেই উঠে এসেছে। পাংশু মুখে। মদনবাবু চোখ ফিরিয়ে নিলেন। কেষ্টকেই আবার তাঁর নজরে পড়ল। দু মুহূর্ত। আকাশ-পাতাল কি যেন ভাবলেন মদনবাবু কেষ্টর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। তারপর। হঠাৎ মানিব্যাগ থেকে কতকগুলাে নােট পকেটে পুরে ব্যাগটা তাগ করে ছুড়ে দিলেন। কেষ্টর বিছানার ওপর। অন্ধকারে, কথার ভাঁজে ব্যাগটা হারিয়ে গেল।
"ও! এই-" মদনবাবু কেষ্টর দিকে তাকিয়ে শাসানাের ভঙ্গিতেই কথাটা বলবার। চেষ্টা করলেন, কিন্তু গলার স্বরে জোর এল না, “এখানে এই সমস্ত হচ্ছে ? পেট। খসানাে। আচ্ছা দাঁড়াও, ব্যবস্থা করছি তােমার। যাচ্ছি থানায়। মানুষ মারার । চেষ্টা ! শয়তান
পরমুহূর্তেই মদনবাবু গঙ্গামণির দিকে এক পলক তাকিয়ে পিছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। গলির অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁডিয়ে তিনি যে দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিলেন কেষ্ট তা বুঝতে পারল। 
কেরােসিনের খুপির লালচে ম্লান আলােতে রেস্টুরেন্ট ঘরের দেওয়াল, বালতি, হাঁড়ি, কুঁড়ি যেন তালগােল পাকিয়ে হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে। উনুনের অচের আভা যেন আভা নয় একটা চিতাই হবে। তেমনি হিংস্রভাবে তাপ ছড়াচ্ছে ঘরের বাতাসে। কাটা ছাগলের মতাে লুটোপুটি খাচ্ছে গঙ্গামণি। কী করুণ, অসহনীয়, মমন্তিক তার। গােঙানি। রেস্টুরেন্ট ঘরের বদ্ধ বাতাসও সে কান্নায় ককিয়ে উঠেছে।
কেষ্ট পাথর। ভয়ঙ্কর এক জগতে নিঃসঙ্গ দাড়িয়ে সে। বেলসেলুবের সাত অনুচর-সাত অপদেবতায় ঘেরা এই শ্মশান থেকে পালিয়ে যাওয়ার মতাে পায়ে জোর নেই তার। ক্ষমতা নেই, এতটুকু। পথ হাঁটতে হাঁটতে কেঃ চলে এসেছে সেই মরুভূমিতে, যেখানে ঝড় উঠিয়ে, সাপ ছেড়ে, আগুন বৃষ্টি করে বেলসেতুব ভােজের উল্লাসে মত্ত। গন্ধকের সেই কটু বিষাক্ত হাওয়া ফুলে ফুলে ভূতের নাচ নাচছে। গঙ্গামণির পায়ের কাছে, পেটের কাছে, গায়ে, হাতে, মাথায়। গন্ধকের সেই গরম হাওয়া। ভােজের আগে খানিকটা মাংসই সেঁকে নিচ্ছে নাকি শয়তানরা? |
“কিষ্টো—কিষ্টো রে, আর লারি। উ মাগাে, দায়ে গতর কাটে কোন চামারে ? পেট কোমর কাটে ; বাঁচারে আমায় । বাঁচা। টুকুন জল দে।” 
জল ? কেষ্ট তবু খানিকটা সম্বিত ফিরে পেল এই জল চাওয়ায়। গেলাসে করে। জল এগিয়ে দিলে গঙ্গামণিকে। জল খাওয়ার চেষ্টা করলে গঙ্গামণি, পারলে না।। আবার লুটিয়ে পড়ল। বাঁ হাতের মুঠিতে তখনও তার আধখানা চত্।
গঙ্গামণির কটিতটের দিকে এতক্ষণে ভাল করে চাইল কেষ্ট। দ হাতের ব্যবধান থেকে। চেয়েই চোখ বন্ধ করলে। সবঙ্গি শিহরিত হবার অস্ফুট একটা শব্দ শােনা গেল তার জিবে আর ঠোটে। মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। পিছু হটে ধপ করে বসে পড়ল কেষ্ট দু হাতে মুখ ঢেকে।
হঠাৎ একটা ডাক ছাড়া, ডুকরে ওঠা কান্নার শব্দে চমকে উঠে কেষ্ট তাকাল গঙ্গামনির দিকে। আধুলি পিথুলি থেমে গেছে গঙ্গামণির। কাটা ছাগল যেমন শেষ ডাক দিয়ে থেমে যায়, তেমনি।
কেষ্টর সবঙ্গ অসাড় হয়ে গেল সেই মুহূর্তেই। বিশ্বরিত, নিপলক-নয়ন, বিমাট চিত্ত সে। পরমাশ্চর্য একটি জীবনকে সে দেখতে পেয়েছে। কেরােসিনের লালচে বিবর্ণ আলােয় অস্পষ্ট একটা মাংসপিণ্ডকে। কোন যাদুবলে হঠাৎ গঙ্গামণির জানুদেশে এসে ঠাঁই নিল এ প্রাণ, এই পিণ্ড ? বুকের ওপর দিয়ে যেন রেল গাড়ির চাকা চলে যাচ্ছে কেষ্টর। অব্যক্ত যন্ত্রণা আর গুরু গুরু। দেহের সমস্ত রক্তবিন্দু পাগল হয়ে হৃৎপিণ্ডের কাছে ছুটে আসছে। 
আলােছায়ার সেই অতল রহস্যের পাতায় গঙ্গামণির শত নাড়ির রক্তের আল্পনা অাঁকা ছিল—অদ্ভুত আল্পনা, সেই আল্পনার রেহ-পিড়িতে নিশ্চিন্ত একটি প্রাণ নিঃশব্দে পড়ে থাকল।
গঙ্গামণি একটু থেমে একবার উঠে বসার চেষ্টা করে কাতরে, ককিয়ে আবার। নেতিয়ে পড়ল। 
ছটফট করছে কেষ্ট। পায়চারি করছে পাগলের মতাে। গঙ্গামণি নিশ্চল, নিম্পন্দ। তবে কি সে মরে গেল ? চলে গেল এই পিয়াজ-রসুনের গন্ধভরা বন্ধ রেস্টুরেন্ট ঘরের দেওয়াল ডিঙিয়ে, ওই ফুকরি কাটা জালের মধ্যে দিয়ে বাইরের হাওয়ায় আকাশে ?
বিমূঢ় কেষ্ট কি করবে বুঝতে না পেরে এক মগ জল নিয়ে গঙ্গামণির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ঠক ঠক করে তার পা কাঁপছে, হাত কাঁপছে। খানিকটা জল ছলকে পড়ল গঙ্গামণির পেটে, পায়েসদ্যজাতের গায়ে। বাকি জলটা কেষ্ট গঙ্গামণির মুখে মাথায় ঢেলে দিয়ে হাঁপাতে লাগল।
দেখছে কেষ্ট। দেখছে এক মনে ; দু চোখে অজস্র মমতা আর উদ্বেগ ভরে, গঙ্গামণি একটু কেঁপে ওঠে কি না ! আর একবার কাতরে ওঠে কি না।
গঙ্গামণি কেঁপেই উঠল । আর হঠাৎ-হঠাৎ সেই অস্পষ্ট মাংসপিণ্ডটা কোন অজেয় শক্তি বলে কেঁদে উঠল এতক্ষণে, এই প্রথম, দুর্বল, অসহায় গলায় ।।
কেষ্টর সর্বদেহ শিহরিত হল সেই কান্নার শব্দে। আরও বিহুল, বিমূঢ় হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল ও। যেন বনের পথে পথ-ভুলে হাতড়ে মরছে একটা আলাের নিশানা।
কেমন করে যেন অকস্মাৎ অতর্কিতে কেষ্টর চোখ পড়ল দেওয়ালে আঠা দিয়ে আঁটা সেই ধূলি-ধোঁয়া-মলিন, বিবর্ণ যীশুর ছবির ওপর। চোখ পড়ে তাে থমকেই থাকে, নড়ে না আর। কেষ্ট যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছে। আজ এই মুহূর্তে কেমন উজ্জ্বল দেখাচ্ছে ছবিটা ! উনুনের আঁচের লাল আভার খানিকটা তিক রেখায় বিচ্ছুরিত হচ্ছে ছবির গায়—সেই অভায় যীশু আজ আলােকিত।
কেঃ পলকহীন। চোখে তার অগাধ বিস্ময়। মন তার হাওয়ায় হাওয়ায় কোথায় বুঝি ভেসে গেছে। মনে পড়ছে অনেক কাল আগেকার একটি দৃশ্য : দোপাটি ফুলের বাগান ঘেরা ইটরঙের কাদামাটির চার্চ। কেষ্টরা গিয়ে বসেছে চার্চের ভেতর। সাদা লম্বা জামা গায়ে পাথী বুড়াে বাইবেল পড়ছে। চশমাটা নাকের তলায় নামানাে। কয়েকটা মােমবাতি জ্বলছে, কাঁপছে তার শিখা। সে আলােয় যীশুর প্রকাণ্ড ছবিটার।
অন্ধকার ঘােচে না। মুখটা থাকে অস্পষ্ট। পাদ্রী বুড়াে সেই দিকে বার বার চায় আর চাপা গলায় পড়ে—ঠিক এই রকমই হবে। যখন দেখবে ওই সমস্ত দুর্ঘটনা ঘটছে। তখন নিশ্চিত জানতে পারবে যে, ধর্মরাজ্য হাতের কাছে এসেছে। আমার কথা। বিশ্বাস কর। মাটি এবং আকাশ লােপ পেতে পারে কিন্তু আমার কথার অন্যথা হবে।
। সে সময় সেই দুর্ঘটনার পর সূর্য অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে, চাঁদ আর আলাে দেবে। , এবং সমস্ত নক্ষত্র আকাশ থেকে খসে খসে পড়বে। আকাশের জ্যোতিষ্কমণ্ডল। কাঁপতে থাকবে। তারপর আকাশে মনুষ্যপুত্রের নিদর্শন দেখতে পাওয়া যাবে । পৃথিবীর সকল জাতি তখন অনুশােচনা করতে থাকবে। তারা দেখতে পাবে। মনুষ্যপুত্র মহামণ্ডিত হয়ে আকাশের মেঘের ওপর দিয়ে আসছে। 
কী এক অদ্ভুত, তীব্র অনুভূতিতে বেদনায় আকুল হয়ে কেষ্ট তাকাল নীচে। রসুন-পিয়াজ, মাংস-মশলা এটো-কাঁটা ছড়ানাে ধোঁয়া-কয়লার কটু বাষ্পভরা। রেস্টুরেন্টের আধাে-অন্ধকার মাটির দিকে, গঙ্গামণির রক্ত আল্পনার পাত্রে সাজানাে। মাংস পিণ্ডটা যেখানে কঁকিয়ে উঠছে থেকে থেকে।
বিমুঢ়, বিচলিত, বিহুল কেষ্ট সেখানে কি যেন দেখছে, কি যেন খুজছে !

0 comments:

Post a Comment