নাটোরের কথা
অবনীন্দ্রনাথ
ঠাকুর
আজ সকালে
মনে পড়ল একটি গল্প—সেই প্রথম স্বদেশী
যুগের সময়কার, কী করে আমরা বাংলা ভাষার প্রচলন
করলুম। ভূমিকম্পের বছর সেটা। প্রোভিন্সিয়াল
কন্ফারেন্স হবে নাটােরে। নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ ছিলেন রিসেপশন কমিটির
প্রেসিডেন্ট। আমরা তাঁকে শুধু ‘নাটাের’ বলেই সম্ভাষণ করতুম। নাটোর নেমন্তন্ন করলেন আমাদের বাড়ির
সবাইকে। আমাদের বাড়ির সঙ্গে তাঁর ছিল বিশেষ ঘনিষ্ঠতা, আমাদের কাউকে ছাড়বেন না—দীপুদা, আমরা বাড়ির অন্য সব ছেলেরা, সবাই তৈরি হলুম, রবিকাকা তো ছিলেনই। আরো অনেক নেতারা, ন্যাশনাল কংগ্রেসের চাঁইরাও গিয়েছিলেন। ন-পিসেমশায় জানকীনাথ ঘোষাল, ডব্লিউ. সি. বোনার্জি, মেজোজ্যাঠামশায়, লালমোহন ঘোষ— প্রকাণ্ড বক্তা তিনি, বড়ো ভালো লোক ছিলেন, আর কী সুন্দর বলতে
পারতেন কিন্তু ঝোঁক ঐ ইংরেজিতে—সুরেন্দ্র
বাঁড়ুজ্জে, আরো অনেকে ছিলেন—সবার নাম কি মনে আসছে এখন।
তৈরি তো
হলুম সবাই যাবার জন্য। ভাবছি যাওয়া-আসা হাঙ্গাম বড়ো। নাটোর বললেন, কিছু ভাবতে হবে না দাদা।
ব্যবস্থা
হয়ে গেল,
এখান থেকে স্পেশাল ট্রেন ছাড়বে আমাদের জন্য। রওনা হলুম সবাই মিলে হৈ-হৈ করতে করতে।
চোগা-চাপকান পরেই তৈরি হলুম, তখনো বাইরে ধুতি
পরে চলাফেরা অভ্যেস হয় নি। ধুতি-পাঞ্জাবি সঙ্গে নিয়েছি, নাটােরে পৌঁছেই এ-সব খুলে ধুতি পরব।
আমরা যুবকর
ছিলুম একদল, মহাফুর্তিতে ট্রেনে চড়েছি। নাটোরের
ব্যবস্থা—রাস্তায় খাওয়া-দাওয়ার কী আয়োজন! কিছুটি ভাবতে হচ্ছে না, স্টেশনে স্টেশনে খোঁজখবর নেওয়া, তদারক করা, কিছুই বাদ যাচ্ছে
না—মহা আরামে যাচ্ছি। সারাঘাট তো পৌঁছানো গেল। সেখানেও নাটোরের
চমৎকার ব্যবস্থা। কিছু ভাববারও নেই, কিছু করবারও নেই, সোজা স্টীমারে উঠে
যাওয়া।
সঙ্গের
মোটঘাট বিছানা-কম্বল?
নাটোর বললেন, কিছু ভেবো না। সব ঠিক আছে।
আমি বললুম, আরে, ভাবব না তে কী। ওতে
যে ধুতিপাঞ্জাবি সবকিছুই আছে।
নাটোর বললেন, আমাদের লোকজন আছে, তারা সব ব্যবস্থা করবে।
দেখি
নাটোরের লোকজনেরা বিছানাবাক্স মোটঘাট সব তুলছে, আর আমার কথা শুনে মিটমিটি হাসছে। যাক, কিছুই যখন করবার নেই, সোজা ঝাড়া
হাত-পায় ষ্টীমারে নির্ভাবনায় উঠে গেলুম। পদ্মা দেখে মহা খুশি আমরা, ফুর্তি আর ধরে না। খাবার সময় হল, ডেকের উপর টেবিল-চেয়ার সাজিয়ে খাবার জায়গা করা হল। খেতে
বসেছি সবাই একটা লম্বা টেবিলে। টেবিলের এক দিকে হোমরাচোমরা চাঁইরা, আর-এক দিকে আমরা ছোকরারা, দীপুদা আমার পাশে। খাওয়া শুরু হল, ‘বয়’রা খাবার নিয়ে আগে যাচ্ছে ঐ পাশে, চাঁইদের দিকে, ওঁদের দিয়ে তবে তো আমাদের দিকে ঘুরে আসবে। মাঝখানে বসেছিলেন একটি চাঁই; তাঁর কাছে এলেই খাবারের ডিশ প্রায় শেষ হয়ে যায়। কাটলেট
এল তো সেই চাঁই ছ-সাতখানা একবারেই তুলে নিলেন। আমাদের দিকে যখন আসে তখন আর বিশেষ
কিছু বাকি থাকে না; কিছু বলতেও পারি নে। পুডিং এল; দীপুদা বললেন, অবন, পুডিং এসেছে, খাওয়া যাবে বেশ করে। দীপুদা ছিলেন খাইয়ে, আমিও ছিলুম খাইয়ে। পুডিং-হাতে বয় টেবিলের এক পাশ থেকে ঘুরে ঘুরে যেই সেই
চাঁইয়ের কাছে এসেছে, দেখি তিনি অর্ধেকের
বেশি নিজের প্লেটে তুলে নিলেন। ওমা, দীপুদা আর আমি মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলুম। দীপুদা বললেন, হল আমাদের আর পুডিং খাওয়া!
সত্যি বাপু, অমন ‘জাইগ্যান্টিক’ খাওয়া আমরা কেউ কখনো দেখি নি। ঐ রকম খেয়ে খেয়েই শরীরখানা
ঠিক রেখেছিলেন ভদ্রলোক। বেশ শরীরটা ছিল তার বলতেই হবে। দীপুদা শেষটায় বয়কে টিপে
দিলেন,
খাবারটা আগে যেন আমাদের দিকেই আনে। তার পর থেকে দেখতুম, দুটাে করে ডিশে খাবার আসত। একটা বয় ও দিকে খাবার দিতে থাকত
আর-একটা এ দিকে। চোখে দেখে না খেতে পাওয়ার জন্য আর আপসোস করতে হয় নি আমাদের।
নাটোরে তো
পৌঁছানো গেল। এলাহি ব্যাপার সব। কী সুন্দর সাজিয়েছে বাড়ি, বৈঠকখানা। ঝাড়লণ্ঠন, তাকিয়া, ভালো ভালো দামি ফুলদানি, কার্পেট, সে-সবের তুলনা নেই—যেন ইন্দ্রপুরী। কী আন্তরিক আদরযত্ন, কী সমারোহ, কী তার সব
ব্যবস্থা। একেই বলে রাজসমাদর। সব-কিছু তৈরি হাতের কাছে। চাকর-বাকরকে সব
শিখিয়ে-পড়িয়ে ঠিক করে রাখা হয়েছিল, না চাইতেই সব জিনিস কাছে এনে দেয়। ধুতি-চাদরও দেখি আমাদের জন্য পাট-করা সব
তৈরি,
বাক্স আর খুলতেই হল না। তখন বুঝলুম, মোটঘাটের জন্য আমাদের ব্যগ্রতা দেখে ওখানকার লোকগুলি কেন
হেসেছিল।
নাটোর বললেন, কোথায় স্নান করবে অবনদা, পুকুরে?
আমি বললুম, না দাদা, সাঁতার-টাতার জানি
নে,
শেষটায় ডুবে মরব। তার উপর যে ঠাণ্ডা জল, আমি ঘরেই চান করব। চান-টান সেরে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বেশ
ঘোরাঘুরি করতে লাগলুম। আমরা ছোকরার দল, আমাদের তেমন কোনো কাজকর্ম ছিল না। রবিকাকাদের কথা আলাদা। খাওয়া-দাওয়া, ধুমধাম, গল্পগুজব—রবিকাকা ছিলেন—গানবাজনাও
জমত খুব। নাটোরও ছিলেন গানবাজনায় বিশেষ উৎসাহী। তিনিই ছিলেন রিসেপশন কমিটির
প্রেসিডেন্ট। কাজেই তিনি সব ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে খবরাখবর করতেন; মজার কিছু ঘটনা থাকলে আমাদের ক্যাম্পে এসে খবরটাও দিয়ে
যেতেন। খুব জমেছিল আমাদের। রাজসুখে আছি। ভোরবেলা বিছানায় শুয়ে, তখনো চোখ খুলি নি, চাকর এসে হাতে গড়গড়ার নল গুঁজে দিলে। কে কখন তামাক খায়, কে দুপুরে এক বোতল সোডা, কে বিকেলে একটু ডাবের জল, সব-কিছু নিখুঁত
ভাবে জেনে নিয়েছিল—কোথাও বিন্দুমাত্র
ত্রুটি হবার জো নেই। খাওয়া-দাওয়ার তো কথাই নেই। ভিতর থেকে রানীমা নিজের হাতে
পিঠে-পায়েস করে পাঠাচ্ছেন। তার উপরে নাটোরের ব্যবস্থায় মাছ মাংস ডিম কিছুই বাদ
যায় নি,
হালুইকর বসে গেছে বাড়িতেই, নানা রকমের মিষ্টি করে দিচ্ছে এবেলা ওবেলা।
আমি ঘুরে
ঘুরে নাটোরের গ্রাম দেখতে লাগলুম—কোথায় কী পুরোনো
বাড়ি ঘর মন্দির। সঙ্গে সঙ্গে স্কেচ করে যাচ্ছি। অনেক স্কেচ করেছি সেবারে, এখনো সেগুলি আমার কাছে আছে। চাঁইদেরও অনেক স্কেচ করেছি; এখন সেগুলি দেখতে বেশ মজা লাগবে। নাটোরেরও খুব আগ্রহ, সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন একেবারে অন্দরমহলে রানী ভবানীর ঘরে।
সেখানে বেশ সুন্দর সুন্দর ইঁটের উপর নানা কাজ করা। ওঁর রাজত্বে যেখানে যা দেখবার
জিনিস ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগলেন। আর আমি স্কেচ করে নিচ্ছি, নাটোর তো খুব খুশি। প্রায়ই এটা ওটা স্কেচ করে দেবার জন্য
ফরমাশও করতে লাগলেন। তা ছাড়া আরো কত রকমের খেয়াল—শুধু আমি নয়, দলের যে যা খেয়াল
করছে,
নাটাের তৎক্ষণাৎ তা পূরণ করছেন। ফুর্তির চোটে আমার সব
অদ্ভুত খেয়াল মাথায় আসত। একদিন খেতে খেতে বললুম, কী সন্দেশ খাওয়াচ্ছেন নাটোর, টেবিলে আনতে আনতে
ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। গরম গরম সন্দেশ খাওয়ান দেখি। বেশ গরম গরম চায়ের সঙ্গে গরম গরম সন্দেশ খাওয়া যাবে। শুনে
টেবিলসুদ্ধ সবার হো-হো করে হাসি। তক্ষুনি হুকুম হল, খাবার ঘরের দরজার সামনেই হালুইকর বসে গেল। গরম গরম সন্দেশ তৈরি করে দেবে ঠিক
খাবার সময়ে।
রাউণ্ড
টেবিল কন্ফারেন্স বসল। গোল হয়ে সবাই বসেছি। মেজোজ্যাঠামশায় প্রিসাইড করবেন।
ন-পিসেমশায় জানকীনাথ ঘোষাল রিপোর্ট লিখছেন আর কলম ঝাড়ছেন; তার পাশে বসেছিলেন নাটোরের ছোটো তরফের রাজা, মাথায় জরির তাজ, ঢাকাই মসলিনের চাপকান পরে। ন-পিসেমশায় কালি ছিটিয়ে ছিটিয়ে তাঁর সেই সাজ
কালো বুটিদার করে দিলেন।
আগে থেকেই
ঠিক ছিল,
রবিকাকা প্রস্তাব করলেন প্রোভিন্সিয়াল কন্ফারেন্স বাংলা
ভাষায় হবে। আমরা ছোকরারা সবাই রবিকাকার দলে; আমরা বললুম, নিশ্চয়ই, প্রোভিন্সিয়াল কনফারেন্সে বাংলা ভাষার স্থান হওয়া চাই।
রবিকাকাকে বললুম, ছেড়ো না, আমরা শেষ পর্যন্ত লড়ব এজন্য। সেই নিয়ে আমাদের বাধল
চাঁইদের সঙ্গে। তাঁরা আর ঘাড় পাতেন না, ছোকরার দলের কথায় আমলই দেন না। তাঁরা বললেন, যেমন কংগ্রেসে হয় তেমনি এখানেও হবে সব-কিছু ইংরেজিতে। অনেক তক্কাতক্কির পর
দুটো দল হয়ে গেল। একদল বলবে বাংলাতে, একদল বলবে ইংরেজিতে। সবাই মিলে গেলুম প্যাণ্ডেলে। বসেছি সব, কন্ফারেন্স আরম্ভ হবে। রবিকাকার গান ছিল, গান তো আর ইংরেজিতে হতে পারে না, বাংলা গানই হল। ‘সোনার বাংলা’ গানটা বোধ হয় সেই সময়ে গাওয়া হয়েছিল—রবিকাকাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়ো।
এখন, প্রেসিডেণ্ট উঠেছেন স্পীচ দিতে; ইংরেজিতে যেই-না মুখ খোলা আমরা ছোকরারা যারা ছিলুম বাংলা
ভাষার দলে সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলুম—বাংলা, বাংলা। মুখ আর খুলতেই দিই না কাউকে। ইংরেজিতে কথা আরম্ভ
করলেই আমরা চেঁচাতে থাকি—বাংলা, বাংলা। মহা মুশকিল, কেউ আর কিছু বলতে পারেন না। তবুও ঐ চেঁচামেচির মধ্যেই দু-একজন দু-একটা কথা
বলতে চেষ্টা করেছিলেন। লালমোহন ঘোষ ছিলেন ঘোরতর ইংরেজিদুরস্ত, তাঁর মতো ইংরেজিতে কেউ বলতে পারত না, তিনি ছিলেন পার্লামেণ্টারি বক্তা—তিনি
শেষটায় উঠে বাংলায় করলেন বক্তৃতা। কী সুন্দর তিনি বলেছিলেন। যেমন পারতেন তিনি
ইংরেজিতে বলতে তেমনি চমৎকার তিনি বাংলাতেও বক্তৃত৷ করলেন। আমাদের উল্লাস দেখে কে, আমাদের তো জয়জয়কার। কন্ফারেন্সে বাংলা ভাষা চলিত হল। সেই
প্রথম আমরা পাবলিক্লি বাংলা ভাষার জন্য লড়লুম।
যাক, আমাদের তো জিত হল; এবারে প্যাণ্ডেলের বাইরে এসে একটু চা খাওয়া যাক। বাড়িতে গিয়েই চা খাবার কথা, তবে ওখানেও চায়ের ব্যবস্থা কিছু ছিল। নাটোর বললেন, কিন্তু গরম গরম সন্দেশ আজ চায়ের সঙ্গে খাবার কথা আছে যে
অবনদা। আমি বললুম, সে তো হবেই, এটা হল উপরি-পাওয়া, এখানে একটু চা খেয়ে নিই তো আগে। এখনকার মতো তখন আমাদের খাও খাও বলতে হত না।
হাতের কাছে খাবার এলেই তলিয়ে দিতেম।
0 comments:
Post a Comment