Showing posts with label CLASS 12 STORY. Show all posts
Showing posts with label CLASS 12 STORY. Show all posts

পোস্ট‌্মাস্টার -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


পোস্ট‌্মাস্টার 



প্রথম কাজ আরম্ভ করিয়াই উলাপুর গ্রামে পোস্ট‌্মাস্টারকে আসিতে হয়। গ্রামটি অতি সামান্য। নিকটে একটি নীলকুঠি আছে, তাই কুঠির সাহেব অনেক জোগাড় করিয়া এই নূতন পোস্ট্আপিস স্থাপন করাইয়াছে।
আমাদের পোস্ট‌্মাস্টার কলিকাতার ছেলে। জলের মাছকে ডাঙায় তুলিলে যেরকম হয়, এই গণ্ডগ্রামের মধ্যে আসিয়া পোস্ট‌্মাস্টারেরও সেই দশা উপস্থিত হইয়াছে। একখানি অন্ধকার আটচালার মধ্যে তাঁহার আপিস ; অদূরে একটি পানাপুকুর এবং তাহার চারি পাড়ে জঙ্গল। কুঠির গোমস্তা প্রভৃতি যে-সকল কর্মচারী আছে তাহাদের ফুরসত প্রায় নাই এবং তাহারা ভদ্রলোকের সহিত মিশিবার উপযুক্ত নহে।
বিশেষত কলিকাতার ছেলে ভালো করিয়া মিশিতে জানে না। অপরিচিত স্থানে গেলে, হয় উদ্ধত নয় অপ্রতিভ হইয়া থাকে। এই কারণে স্থানীয় লোকের সহিত তাঁহার মেলামেশা হইয়া উঠে না। অথচ হাতে কাজ অধিক নাই। কখনো কখনো দুটো-একটা কবিতা লিখিতে চেষ্টা করেন। তাহাতে এমন ভাব ব্যক্ত করিয়াছেন যে, সমস্ত দিন তরুপল্লবের কম্পন এবং আকাশের মেঘ দেখিয়া জীবন বড়ো সুখে কাটিয়া যায় – কিন্তু অন্তর্যামী জানেন, যদি আরব্য উপন্যাসের কোনো দৈত্য আসিয়া এক রাত্রের মধ্যে এই শাখাপল্লব-সমেত সমস্ত গাছগুলা কাটিয়া পাকা রাস্তা বানাইয়া দেয়, এবং সারি সারি অট্টালিকা আকাশের মেঘকে দৃষ্টিপথ হইতে রুদ্ধ করিয়া রাখে, তাহা হইলে এই আধমরা ভদ্রসন্তানটি পুনশ্চ নবজীবন লাভ করিতে পারে।
পোস্ট‌্মাস্টারের বেতন অতি সামান্য। নিজে রাঁধিয়া খাইতে হয় এবং গ্রামের একটি পিতৃমাতৃহীন অনাথা বালিকা তাঁহার কাজকর্ম করিয়া দেয়, চারিটি-চারিটি খাইতে পায়। মেয়েটির নাম রতন। বয়স বারো-তেরো। বিবাহের বিশেষ সম্ভাবনা দেখা যায় না।
সন্ধ্যার সময় যখন গ্রামের গোয়ালঘর হইতে ধূম কুণ্ডলায়িত হইয়া উঠিত, ঝোপে ঝোপে ঝিল্লি ডাকিত, দূরে গ্রামের নেশাখোর বাউলের দল খোল-করতাল বাজাইয়া উচ্চৈঃস্বরে গান জুড়িয়া দিত – যখন অন্ধকার দাওয়ায় একলা বসিয়া গাছের কম্পন দেখিলে কবিহৃদয়েও ঈষৎ হৃৎকম্প উপস্থিত হইত, তখন ঘরের কোণে একটি ক্ষীণশিখা প্রদীপ জ্বালিয়া পোস্ট‌্মাস্টার ডাকিতেন – “রতন।” রতন দ্বারে বসিয়া এই ডাকের জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকিত কিন্তু এক ডাকেই ঘরে আসিত না ; বলিত, “কি গা বাবু, কেন ডাকছ।”
পোস্ট‌্মাস্টার। তুই কী করছিস।
রতন। এখনই চুলো ধরাতে যেতে হবে-হেঁশেলের-
পোস্ট‌্মাস্টার। তোর হেঁশেলের কাজ পরে হবে এখন-একবার তামাকটা সেজে দে তো।
অনতিবিলম্বে দুটি গাল ফুলাইয়া কলিকায় ফুঁ দিতে দিতে রতনের প্রবেশ। হাত হইতে কলিকাটা লইয়া পোস্ট‌্মাস্টার ফস্ করিয়া জিজ্ঞাসা করেন, “আচ্ছা রতন, তোর মাকে মনে পড়ে ?” সে অনেক কথা ; কতক মনে পড়ে, কতক মনে পড়ে না। মায়ের চেয়ে বাপ তাহাকে বেশি ভালোবাসিত, বাপকে অল্প অল্প মনে আছে। পরিশ্রম করিয়া বাপ সন্ধ্যাবেলায় ঘরে ফিরিয়া আসিত, তাহারই মধ্যে দৈবাৎ দুটি-একটি সন্ধ্যা তাহার মনে পরিষ্কার ছবির মতো অঙ্কিত আছে। এই কথা হইতে হইতে ক্রমে রতন পোস্ট‌্মাস্টারের পায়ের কাছে মাটির উপর বসিয়া পড়িত। মনে পড়িত, তাহার একটি ছোটোভাই ছিল – বহু পূর্বেকার বর্ষার দিনে একদিন একটা ডোবার ধারে দুইজনে মিলিয়া গাছের ভাঙা ডালকে ছিপ করিয়া মিছামিছি মাছধরা খেলা করিয়াছিল – অনেক গুরুতর ঘটনার চেয়ে সেই কথাটাই তাহার মনে বেশি উদয় হইত। এইরূপ কথাপ্রসঙ্গে মাঝে মাঝে বেশি রাত হইয়া যাইত, তখন আলস্যক্রমে পোস্ট‌্মাস্টারের আর রাঁধিতে ইচ্ছা করিত না। সকালের বাসি ব্যঞ্জন থাকিত এবং রতন তাড়াতাড়ি উনুন ধরাইয়া খানকয়েক রুটি সেঁকিয়া আনিত – তাহাতেই উভয়ের রাত্রের আহার চলিয়া যাইত।
এক-একদিন সন্ধ্যাবেলায় সেই বৃহৎ আটচালার কোণে আপিসের কাঠের চৌকির উপর বসিয়া পোস্ট‌্মাস্টারও নিজের ঘরের কথা পাড়িতেন – ছোটোভাই মা এবং দিদির কথা, প্রবাসে একলা ঘরে বসিয়া যাহাদের জন্য হৃদয় ব্যথিত হইয়া উঠিত তাহাদের কথা। যে-সকল কথা সর্বদাই মনে উদয় হয় অথচ নীলকুঠির গোমস্তাদের কাছে যাহা কোনোমতেই উত্থাপন করা যায় না, সেই কথা একটি অশিক্ষাতা ক্ষুদ্র বালিকাকে বলিয়া যাইতেন, কিছুমাত্র অসংগত মনে হইত না। অবশেষে এমন হইল, বালিকা কথোপকথনকালে তাঁহার ঘরের লোকদিগকে মা দিদি দাদা বলিয়া চির-পরিচিতের ন্যায় উল্লেখ করিত। এমন-কি, তাহার ক্ষুদ্র হৃদয়পটে বালিকা তাঁহাদের কাল্পনিক মূর্তিও চিত্রিত করিয়া লইয়াছিল।
একদিন বর্ষাকালে মেঘমুক্ত দ্বিপ্রহরে ঈষৎ-তপ্ত সুকোমল বাতাস দিতেছিল ; রৌদ্রে ভিজা ঘাস এবং গাছপালা হইতে একপ্রকার গন্ধ উত্থিত হইতেছিল ; মনে হইতেছিল, যেন ক্লান্ত ধরণীর উষ্ণ নিশ্বাস গায়ের উপরে আসিয়া লাগিতেছে ; এবং কোথাকার এক নাছোড়বান্দা পাখি তাহার একটা একটানা সুরের নালিশ সমস্ত দুপুরবেলা প্রকৃতির দরবারে অত্যন্ত করুণস্বরে বার বার আবৃত্তি করিতেছিল। পোস্ট‌্মাস্টারের হাতে কাজ ছিল না – সেদিনকার বৃষ্টিধৌত মসৃণ চিক্কণ তরুপল্লবের হিল্লোল এবং পরাভূত বর্ষার ভগ্নাবশিষ্ট রৌদ্রশুভ্র স্তূপাকার মেঘস্তর বাস্তবিকই দেখিবার বিষয় ছিল ; পোস্ট‌্মাস্টার তাহা দেখিতেছিলেন এবং ভাবিতেছিলেন, এই সময় কাছে একটি-কেহ নিতান্ত আপনার লোক থাকিত – হৃদয়ের সহিত একান্ত সংলগ্ন একটি স্নেহপুত্তলি মানবমূর্তি। ক্রমে মনে হইতে লাগিল, সেই পাখি ঐ কথাই বার বার বলিতেছে এবং এই জনহীন তরুচ্ছায়ানিমগ্ন মধ্যাহ্নের পল্লবমর্মরের অর্থও কতকটা ঐরূপ। কেহ বিশ্বাস করে না, এবং জানিতেও পায় না, কিন্তু ছোটো পল্লীর সামান্য বেতনের সাব-পোস্ট‌্মাস্টারের মনে গভীর নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে দীর্ঘ ছুটির দিনে এইরূপ একটা ভাবের উদয় হইয়া থাকে।
পোস্ট‌্মাস্টার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ডাকিলেন, “রতন।” রতন তখন পেয়ারাতলায় পা ছড়াইয়া দিয়া কাঁচা পেয়ারা খাইতেছিল ; প্রভুর কণ্ঠস্বর শুনিয়া অবিলম্বে ছুটিয়া আসিল – হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, “দাদাবাবু, ডাকছ?” পোস্ট‌্মাস্টার বলিলেন, “তোকে আমি একটু একটু করে পড়তে শেখাব।” বলিয়া সমস্ত দুপুরবেলা তাহাকে লইয়া “স্বরে অ” “স্বরে আ” করিলেন। এবং এইরূপে অল্পদিনেই যুক্ত-অর উত্তীর্ণ হইলেন।
শ্রাবণ মাসে বর্ষণের আর অন্ত নাই। খাল বিল নালা জলে ভরিয়া উঠিল। অহর্নিশি ভেকের ডাক এবং বৃষ্টির শব্দ। গ্রামের রাস্তায় চলাচল প্রায় একপ্রকার বন্ধ-নৌকায় করিয়া হাটে যাইতে হয়।
একদিন প্রাতঃকাল হইতে খুব বাদলা করিয়াছে। পোস্ট‌্মাস্টারের ছাত্রীটি অনেকক্ষণ দ্বারের কাছে অপেক্ষা করিয়া বসিয়া ছিল, কিন্তু অন্যদিনের মতো যথাসাধ্য নিয়মিত ডাক শুনিতে না পাইয়া আপনি খুঙ্গিপুঁথি লইয়া ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। দেখিল, পোস্ট‌্মাস্টার তাঁহার খাটিয়ার উপর শুইয়া আছেন – বিশ্রাম করিতেছেন মনে করিয়া অতি নিঃশব্দে পুনশ্চ ঘর হইতে বাহিরে যাইবার উপক্রম করিল। সহসা শুনিল – “রতন”। তাড়াতাড়ি ফিরিয়া গিয়া বলিল, “দাদাবাবু, ঘুমোচ্ছিলে?” পোস্ট‌্মাস্টার কাতরস্বরে বলিলেন, “শরীরটা ভালো বোধ হচ্ছে না – দেখ্ তো আমার কপালে হাত দিয়ে।”
এই নিতান্ত নিঃসঙ্গ প্রবাসে ঘনবর্ষায় রোগকাতর শরীরে একটুখানি সেবা পাইতে ইচ্ছা করে। তপ্ত ললাটের উপর শাঁখাপরা কোমল হস্তের স্পর্শ মনে পড়ে। এই ঘোর প্রবাসে রোগযন্ত্রণায় স্নেহময়ী নারী-রূপে জননী ও দিদি পাশে বসিয়া আছেন এই কথা মনে করিতে ইচ্ছা করে, এবং এ স্থলে প্রবাসীর মনের অভিলাষ ব্যর্থ হইল না। বালিকা রতন আর বালিকা রহিল না। সেই মুহূর্তেই সে জননীর পদ অধিকার করিয়া বসিল, বৈদ্য ডাকিয়া আনিল, যথাসময়ে বটিকা খাওয়াইল, সারারাত্রি শিয়রে জাগিয়া রহিল, আপনি পথ্য রাঁধিয়া দিল, এবং শতবার করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “হাঁগো দাদাবাবু, একটুখানি ভালো বোধ হচ্ছে কি।”
বহুদিন পরে পোস্ট‌্মাস্টার ক্ষীণ শরীরে রোগশয্যা ত্যাগ করিয়া উঠিলেন ; মনে স্থির করিলেন, আর নয়, এখান হইতে কোনোমতে বদলি হইতে হইবে। স্থানীয় অস্বাস্থ্যের উল্লেখ করিয়া তৎক্ষণাৎ কলিকাতায় কর্তৃপদের নিকট বদলি হইবার জন্য দরখাস্ত করিলেন।
রোগসেবা হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া রতন দ্বারের বাহিরে আবার তাহার স্বস্থান অধিকার করিল। কিন্তু পূর্ববৎ আর তাহাকে ডাক পড়ে না। মাঝে মাঝে উঁকি মারিয়া দেখে, পোস্ট‌্মাস্টার অত্যন্ত অন্যমনস্কভাবে চৌকিতে বসিয়া অথবা খাটিয়ায় শুইয়া আছেন। রতন যখন আহ্বান প্রত্যাশা করিয়া বসিয়া আছে, তিনি তখন অধীরচিত্তে তাঁহার দরখাস্তের উত্তর প্রতীক্ষা করিতেছেন। বালিকা দ্বারের বাহিরে বসিয়া সহস্রবার করিয়া তাহার পুরানো পড়া পড়িল। পাছে যেদিন সহসা ডাক পড়িবে সেদিন তাহার যুক্ত-অর সমস্ত গোলমাল হইয়া যায়, এই তাহার একটা আশঙ্কা ছিল। অবশেষে সপ্তাহখানেক পরে একদিন সন্ধ্যাবেলায় ডাক পড়িল। উদ্বেলিতহৃদয়ে রতন গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিয়া বলিল, “দাদাবাবু, আমাকে ডাকছিলে ?”
পোস্ট‌্মাস্টার বলিলেন, “রতন, কালই আমি যাচ্ছি।”
রতন। কোথায় যাচ্ছ, দাদাবাবু।
পোস্ট‌্মাস্টার। বাড়ি যাচ্ছি।
রতন। আবার কবে আসবে।
পোস্ট‌্মাস্টার। আর আসব না।
রতন আর কোনো কথা জিজ্ঞাসা করিল না। পোস্ট‌্মাস্টার আপনিই তাহাকে বলিলেন, তিনি বদলির জন্য দরখাস্ত করিয়াছিলেন, দরখাস্ত নামঞ্জুর হইয়াছে ; তাই তিনি কাজে জবাব দিয়া বাড়ি যাইতেছেন। অনেকক্ষণ আর কেহ কোনো কথা কহিল না। মিট‌্মিট্ করিয়া প্রদীপ জ্বলিতে লাগিল এবং এক স্থানে ঘরের জীর্ণ চাল ভেদ করিয়া একটি মাটির সরার উপর টপ‌্টপ্ করিয়া বৃষ্টির জল পড়িতে লাগিল।
কিছুক্ষণ পরে রতন আস্তে আস্তে উঠিয়া রান্নাঘরে রুটি গড়িতে গেল। অন্যদিনের মতো তেমন চট‌্পট্ হইল না। বোধ করি মধ্যে মধ্যে মাথায় অনেক ভাবনা উদয় হইয়াছিল। পোস্ট‌্মাস্টারের আহার সমাপ্ত হইলে পর বালিকা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “দাদাবাবু, আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে?”
পোস্ট‌্মাস্টার হাসিয়া কহিলেন, “সে কী করে হবে।” ব্যাপারটা যে কী কী কারণে অসম্ভব তাহা বালিকাকে বুঝানো আবশ্যক বোধ করিলেন না।
সমস্ত রাত্রি স্বপ্নে এবং জাগরণে বালিকার কানে পোস্ট‌্মাস্টারের হাস্যধ্বনির কণ্ঠস্বর বাজিতে লাগিল – “সে কী করে হবে।”
ভোরে উঠিয়া পোস্ট‌্মাস্টার দেখিলেন, তাঁহার স্নানের জল ঠিক আছে ; কলিকাতার অভ্যাস-অনুসারে তিনি তোলা জলে স্নান করিতেন। কখন তিনি যাত্রা করিবেন সে কথা বালিকা কী কারণে জিজ্ঞাসা করিতে পারে নাই ; পাছে প্রাতঃকালে আবশ্যক হয় এইজন্য রতন তত রাত্রে নদী হইতে তাঁহার øস্নানের জল তুলিয়া আনিয়াছিল। স্নান সমাপন হইলে রতনের ডাক পড়িল। রতন নিঃশব্দে গৃহে প্রবেশ করিল এবং আদেশপ্রতীক্ষায় একবার নীরবে প্রভুর মুখের দিকে চাহিল। প্রভু কহিলেন, “রতন, আমার জায়গায় যে লোকটি আসবেন তাঁকে বলে দিয়ে যাব, তিনি তোকে আমারই মতন যত্নœকরবেন ; আমি যাচ্ছি বলে তোকে কিছু ভাবতে হবে না।” এই কথাগুলি যে অত্যন্ত স্নেহগর্ভ এবং দয়ার্দ্র হৃদয় হইতে উত্থিত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই, কিন্তু নারীহৃদয় কে বুঝিবে। রতন অনেকদিন প্রভুর অনেক তিরস্কার নীরবে সহ্য করিয়াছে কিন্তু এই নরম কথা সহিতে পারিল না। একেবারে উচ্ছ্বসিত হৃদয়ে কাঁদিয়া উঠিয়া কহিল, “না, না, তোমার কাউকে কিছু বলতে হবে না, আমি থাকতে চাই নে।”
পোস্ট‌্মাস্টার রতনের এরূপ ব্যবহার কখনো দেখেন নাই, তাই অবাক হইয়া রহিলেন।
নূতন পোস্ট‌্মাস্টার আসিল। তাহাকে সমস্ত চার্জ বুঝাইয়া দিয়া পুরাতন পোস্ট‌্মাস্টার গমনোন্মুখ হইলেন। যাইবার সময় রতনকে ডাকিয়া বলিলেন, “রতন, তোকে আমি কখনো কিছু দিতে পারি নি। আজ যাবার সময় তোকে কিছু দিয়ে গেলুম, এতে তোর দিন কয়েক চলবে।”
কিছু পথখরচা বাদে তাঁহার বেতনের যত টাকা পাইয়াছিলেন পকেট হইতে বাহির করিলেন। তখন রতন ধুলায় পড়িয়া তাঁহার পা জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “দাদাবাবু, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে কিছু দিতে হবে না ; তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমার জন্যে কাউকে কিছু ভাবতে হবে না”-বলিয়া এক-দৌড়ে সেখান হইতে পলাইয়া গেল।
ভূতপূর্ব পোস্ট‌্মাস্টার নিশ্বাস ফেলিয়া হাতে কার্পেটের ব্যাগ ঝুলাইয়া, কাঁধে ছাতা লইয়া মুটের মাথায় নীল ও শ্বেত রেখায় চিত্রিত টিনের পেঁটরা তুলিয়া ধীরে ধীরে নৌকাভিমুখে চলিলেন।

যখন নৌকায় উঠিলেন এবং নৌকা ছাড়িয়া দিল, বর্ষাবিস্ফারিত নদী ধরণীর উচ্ছলিত অশ্রুরাশির মতো চারি দিকে ছলছল করিতে লাগিল, তখন হৃদয়ের মধ্যে অত্যন্ত একটা বেদনা অনুভব করিতে লাগিলেন – একটি সামান্য গ্রাম্য বালিকার করুণ মুখচ্ছবি যেন এক বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ করিতে লাগিল। একবার নিতান্ত ইচ্ছা হইল, “ফিরিয়া যাই, জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি” – কিন্তু তখন পালে বাতাস পাইয়াছে, বর্ষার স্রোত খরতর বেগে বহিতেছে, গ্রাম অতিক্রম করিয়া নদীকূলের শ্মশান দেখা দিয়াছে – এবং নদীপ্রবাহে ভাসমান পথিকের উদাস হৃদয়ে এই তত্ত্বের উদয় হইল, জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার।

কিন্তু রতনের মনে কোনো তত্ত্বের উদয় হইল না। সে সেই পোস্ট্আপিস গৃহের চারি দিকে কেবল অশ্রুজলে ভাসিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। বোধ করি তাহার মনে ক্ষীণ আশা জাগিতেছিল, দাদাবাবু যদি ফিরিয়া আসে-সেই বন্ধনে পড়িয়া কিছুতেই দূরে যাইতে পারিতেছিল না। হায় বুদ্ধিহীন মানবহৃদয়! ভ্রান্তি কিছুতেই ঘোচে না, যুক্তিশাস্ত্রের বিধান বহু বিলম্বে মাথায় প্রবেশ করে, প্রবল প্রমাণকেও অবিশ্বাস করিয়া মিথ্যা আশাকে দুই বাহুপাশে বাঁধিয়া বুকের ভিতরে প্রাণপণে জড়াইয়া ধরা যায়, অবশেষে একদিন সমস্ত নাড়ী কাটিয়া হৃদয়ের রক্ত শুষিয়া সে পলায়ন করে, তখন চেতনা হয় এবং দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশে পড়িবার জন্য চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠে।
(১২৯৮ বঃ)


ভাত - মহাশ্বেতা দেবী

ভাত

মহাশ্বেতা দেবী
লোকটার চাহনি বড়বাড়ির বড়বউয়ের প্রথম থেকেই ভালো লাগেনি। কী রকম যেন উগ্র চাহনি। আর কোমর পর্যন্ত ময়লা লুঙ্গিটা অত্যন্তই ছোট। চেহারাটা বুনো বুনো। কিন্তু বামুন ঠাকুর বলল, ভাত খাবে কাজ করবে।
-কোথা থেকে আনলে?
এ সংসারে সব কিছুই চলে বড়পিসিমার নিয়মে। বড়পিসিমা বড়বউয়ের পিসি-শাশুড়ী হন। খুবই অদ্ভুত কথা। তাঁর বিয়ে হয়নি।সবাই বলে, সংসার ঠেলবার কারণে অমন বড়লোক হয়েও ওরা মেয়ের বিয়ে দেয়নি। তখন বউ মরে গেলে বুড়ো কর্তা সংসার নিয়ে নাটাঝামটা হচ্ছিল।
বড়বাড়ির লোকরা বলে, ওর বিয়ে ঠাকুরের সঙ্গে। উনি হলেন দেবতার সেবিকা।
বড়বাড়িতে শিবমন্দিরও আছে একটা। বুড়ো কর্তা এ রাস্তার সবগুলো বাড়িই শিব-মহেশ্বর-ত্রিলোচনা-উমাপতি, এমন বহু নামে শিবকে দিয়ে রেখেছিলেন। দূরদর্শী লোক ছিলেন। তাঁর জন্যেই এরা করে খাচ্ছে। বড়পিসিমা না কি বলেছিলেন, ঊনি আমার পতিদেবতা। মানুষের সঙ্গে বিয়ে দিও না।
এসব কথা সত্যি না মিথ্যে কে জানে। বড়পিসিমা চিরকাল এ সংসারে হেঁসেল দেখেছেন, ভাড়াটে বাড়িতে মিস্তিরি লাগিয়েছেন এবং তাঁর বাবার সেবা করেছেন।
বড়বউয়ের কথা শুনে বড়পিসিমা বলেন, কোথা থেকে আনলে মানে? ঝড় জলে দেশ ভেসে গেছে। আমাদের বাসিনীর কে হয়। সে-ই ডেকে আনলে।
বড়বউ বলে, কি রকম দেখতে!
-ময়ূরছাড়া কার্তিক আসবে নাকি? তোমরা তো দশটা পয়সা দিতে পারবে না প্রাণে ধরে। এই চৌদ্দ দফায় কাজ করবে, পেটে দুটো খাবে বই তো নয়। কেনা চাল নয়, বাদা থেকে চাল আসচে। তা দিতেও আঙুল বেঁকে যাচ্ছে?
বড়বউ চুপ করে যায়। বড়পিসির কথায় আজকাল কেমন যেন একটা ঠেস থাকে। 'তোমাদের মানে কী? বড়পিসিমা কি অন্য বাড়ির লোক নাকি?'
বড়পিসিমা শেষ খোঁচাটা মারেন। তোমার শ্বশুরই মরতে বসেছে বাছা। সে জন্যে হোমযজ্ঞি হচ্ছে। তার জন্যে একটা লোক খাবে...
বড়বউ কোনো কথা বলে না। সব কথাই সত্যি। তার শ্বশুরই মরতে বসেছেন। বিরাশি বছরটা অনেক বয়েস। কিন্তু শ্বশুর বেশ টনকো ছিলেন। তবে ক্যানসার বলে কথা। ক্যানসার যে লিভারে হয় তাই বড়বউ জানত না। বড়বউ প্রায় দৌড়ে চলে যায়।
আজ অনেক কাজ। মেজবউ উনোন পাড়ে বসেছে। শাশুড়ীর মাছ খাওয়া বুঝি ঘুচে যায়। তাই কয়েকদিন ধরে বড় ইলিশ, পাকা পোনার পেটি, চিতলের কোল, ডিমপোরা ট্যাংরা, বড় ভেটকি মাছের যজ্ঞি লেগেছে। রেঁধে-বেড়ে শাশুড়ীকে খাওয়ানো তার কাজ।
শ্বশুরের ঘরে নার্স। বড়বউ এখন গেল সে ঘরে। সে একটু বসলে পরে নার্স এসে চা খেয়ে যাবে। সেজছেলে বিলেতে। তার আসার কথা ওঠে না। ছোট, মেজ ও বড় ঘুমোচ্ছে। এ বাড়ির ছেলেরা বেলা এগারোটার আগে ঘুম থেকে ওঠে না। সেই জন্যেই তাদের চাকরি করা হয়ে ওঠেনি। আঠারোখানা দেবত্র বাড়ি আর বাদা অঞ্চলে অসাগর জমি থাকলে কাজ বা করে কে?
শ্বশুরের ঘরে বসে বড়বউ ভাবতে চেষ্টা করে শ্বশুর নেই, সে অবস্থাটা কেমন হবে। ক্যানসার, লিভারে ক্যানসার, তা আগে বোঝা যায়নি। বোঝা গেল যখন তখন আর কিছু করার নেই। বড়বউ ভাবতে চেষ্টা করে, তখনো চাঁদ সূর্য উঠবে কিনা। শ্বশুর তার কাছে ঠাকুরদেবতার সমান।
-তাঁর জন্যে দই পেতে ইসবগুল দিয়ে শরবত করে দিতে হত, শত ঠাকুর থাকুক, তিনি খেতে আসার পাঁচমিনিট আগে বড়বউকে করতে হত রুটি লুচি। তাঁর বিছানা পাততে হত, পা টিপতে হত। কত কাজ করতে হত সারা জীবন ধরে। এখন সে সব কি আর করতে হবে না, কে জানে।
ডাক্তারেরা এলে দিয়েছে বলেই তো আজ এই যজ্ঞিহোম হচ্ছে। ছোটবউয়ের বাবা এক তান্ত্রিক এনেছেন। বেল, শ্যাওড়া, অশ্বত্থ, বট, তেঁতুল গাছের কাঠ এনেছে আধ মণ করে। সেগুলো সব এক মাপে কাটতে হবে। কালো বিড়ালের লোম আনতে গেছে ভজন চাকর। শ্মশান থেকে বালি, বেশ্যাঘরের হাতআর্শি, এমন কত যে ফরমাশ।
তা ওই লোকটাকে ধরে আনা কাঠ কাটার জন্যে। ও নাকি কদিন খায়নি। বাসিনী ধরে এনেছে। বাদায় থাকে অথচ ভাতের আহিংকে এতখানি। এ আবার কী কথা? বাদায় চালের অভাব না কি? দেখো না একতলায় গিয়ে। ডোলে ডোলে কতরকম চাল থরে থরে সাজানো আছে।
নার্স এসে বসে। বড়বউ নেমে যায়। আজ খাওয়া-দাওয়া ঝপ করে সারতে হবে। তান্ত্রিক হোমে বসবার আগে। হোম করে তান্ত্রিক শ্বশুরের প্রাণটুকু ওই হাতআর্শিতে ধরে রাখবেন। তান্ত্রিক নীচের হলঘরে বসে আছেন।
বড়পিসিমা বলেন, নামতে পারলে বাছা? চালগুলো তো বের করে দেবে?
-এই যে দিই।
ঝিঙেশাল চালের ভাত নিরামিষ ডাল তরকারির সঙ্গে। রামশাল চালের ভাত মাছের সঙ্গে। বড়বাবু কনকপানি চাল ছাড়া খান না, মেজ আর ছোটর জন্য বারোমাস পদ্মজালি চাল রান্না হয়। বামুন-চাকর-ঝি-দের জন্যে মোটা সাপটা চাল।
বাদার লোকটি কাঠ কাটতে কাটতে চোখ তুলে দেখে। চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসে তার।
-হ্যাঁ বাসিনী, এত নানাবিধি চাল?
-বাবুরা খায়।
-ওই পাঁচ ভাগে ভাত হয়?
-হবে নে? বাদায় এদের এত জমি। চাল এনে পাহাড় করছে। বড়পিসিমা বেচেও দিচ্ছে নুক্কে নুক্কে। আমিই বেচতেছি সে চাল।
-বাদায় এদের চাল হয়! তা দে দেকি বাসিনী। এক মুষ্টি চালই দে। গালে দে জল খাই। বড্ড ঝ্যামন আঁচড় কাটতিছে পেটের মদ্যিখানে। সেই কদ্দিন ঘরে আঁদা ভাত খাই না। দে বাসিনী, বাগ্যতা করি তোর।
-আরে আরে! কী করো উচ্ছব দাদা। গাঁ সম্পর্কে দাদা তো হও। কেন-বা এমন করতেছ। পিসিমা দেকতে পেলে সব্বনাশ হবে। আমি ঠিক তাগেবাগে দে ঝাব। তুমি হাত চালিয়ে নাও দেকি। বাবা! এদেরকে বলিহারি ঝাই। এট্টা লোক কদিন খায়নি শুনচ। আগে চাট্টি খেতে দে।
বাসিনী চালগুলি নিয়ে চলে যাবার সময় মাথা নাড়তে নাড়তে চলে যায়। লোকটির নাম উৎসব। চিরকালই সে উচ্ছব নাইয়া নামে পরিচিত। গত কয়েকদিন সে সত্যিই খায়নি। কপালটা মন্দ তার। বড়ই মন্দ। যতদিন রান্না খিচুড়ি দেয়া হচ্ছিল ততদিন সে যেতে পারেনি। অ চন্নুনির মা। চন্নুনিরে। তোমরা রা কাড়ো না ক্যান?-কোতা অইলে গো!
বস্তুত এসব বলে সে যখন খুঁজছিল বউ-ছেলে-মেয়েকে তখন তার বুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল। একদিকে তুমুল ঝড়-বৃষ্টি, ছেলে-মেয়েকে জাপটে সাপটে ধরে বউ কাঁপছিল শীতে আর ভয়ে। সে ঘরে মাঝ খুঁটি ধরে মাটির দিকে দাবাচ্ছিল। মাঝ খুঁটিটি মাতাল আনন্দে টলছিল, ধনুষ্টংকার রোগীর মতো কেঁপে ঝেঁকে উঠছিল। উচ্ছববলে চলছিল ভগমান! ভগমান! ভগমান! কিন্তু এমন দুর্যোগে ভগবানও কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমোন বোধ করি। ভগমান! ভগমান! উচ্ছব বলছিল। এমন সময় মাতলার জল বাতাসের চাবুকে ছটফটিয়ে উঠে এসেছিল। জল উঠল। জল নামল, উচ্ছবের সংসার মাটিতে লুটোপুটি গেল।
সকাল হতেই বোঝা গিয়েছিল সর্বনাশের বহরখানা। তারপর কয়েকদিন ধরে ঘরের চালের নিচ থেকে কোনো সাড়া পাবার আশায় উচ্ছব পাগল হয়ে থাকে। কে, কোথায়, পাগল নাকি উচ্ছব? সাধন দাশের কথা উচ্ছব নেয় না। সাধন বলে, তোরেও তো টেনে নেচ্ছেল। গাচে বেঁধে রয়ে গেলি। উচ্ছব বলে, রা কাড় অ চন্নুনির মা! ঘরের পাশ ছেড়ে সে নড়তে চায় না। তাছাড়া টিনের বেশ একটা মুখবন্ধ কৌটো ছিল ঘরে। তার মধ্যে ছিল নিভুই উচ্ছবের জমি চেয়ে দরখাস্তের নকল। উচ্ছব নাইয়া/পিং হরিচরণ নাইয়া/সে কৌটোটা-বা কোথায়?
যা আর নেই, যা ঝড়-জল-মাতলার গর্ভে গেছে, তাই খুঁজে খুঁজে উচ্ছব পাগল হয়েছিল। তাই রান্না খিচুড়ি তার খাওয়া হয়নি। তারপর যখন তার সম্বিত ফিরল, তখন আর খিচুড়ি নেই। ড্রাইডোল। চালগুলি সে চিবিয়ে জল খেয়েছিল। এভাবে কিছুদিন যায়। তারপর গ্রামের লোকজন বলে, মরেচে যারা তারাদের ছেরাদ কত্তে হয়। এ কাজ করার জন্যে তারা মহানাম শতপথিকে খবর দেয়। কিন্তু মহানাম এখন আর দুটো গ্রামে অনুরূপ শ্রাদ্ধশান্তি সেরে তবে এখানে আসবে। গ্রামবাসী অন্যেরা মাছ-গুগলি-কাঁকড়া যা পাচ্ছে ধরতে লেগেছে। উচ্ছবকে সাধন বলে, তুমি একা কলকেতা যাব বলে নেচে বা উটলে কেন? সরকার ঘর কত্তে খরচা দেবে শুনচ না?
উচ্ছব হঠাৎ খুব বুদ্ধিমান সাজতে চাও ও বলে, সে এট্টা কতা বটে।
ঝড়-জলে কার কী হল, মা-ভাই-বোন আছে না গেছে দেখতে বাসিনী আসতে পারেনি। তার বোন আর ভাজ কলকাতা যাচ্ছিল। ওরা কিছুকাল ঠিকে কাজ করবে। উচ্ছব আগেও গিয়েছিল একবার। বাসিনী যেখানে কাজ করে, সে ঘরবাড়ি দেখেছিল বাইরে থেকে। বারবাড়িতে ঠাকুরদালান আছে, মন্দিরের মাথার পেতলের ত্রিশুলটা দেখেছিল। বাসিনীর মনিববাড়িতে হেলা ঢলা ভাত, এ গল্প গ্রামে সবাই শুনেছে। উচ্ছবের হঠাৎ মনে হয় কলকাতা গিয়ে খেয়ে মেখে আসি। কেন মনে হয়েছিল তা সে বলতে পারে না। উপোসে, এক রাতে বউ-ছেলে-মেয়ে ঘরদোর হারিয়ে সে যেন কেমন হয়ে যাচ্ছিল। মাথার ভেতরটা ঝিমঝিম করে, কোনো কথা গুছিয়ে ভাবতে পারে না। খুব ভাবে সে, না না। এইবার গুচিয়ে ভাবতে হচ্ছে। কী যে হল তা এখনো দিশে হচ্ছে না তেমন। ভাবতে গেলেই তার প্রথমে মনে হয় ধানে গোছ আসার আগেই ধান গাছ থেকে সবুজ রঙ চলে যেতে থাকে। কার্তিক মাসেই ধান খড় হয়ে গেল। তা দেখে উচ্ছব মাথায় হাত দিয়েছিল। সতীশ মিস্তিরির হরকুল, পাটনাই, মোটা, তিন ধানে মড়ক। উচ্ছব তো সতীশবাবুর জমিতে কাজ করেই ক-মাস বেঁচে থাকে। অ উচ্ছব, মনিবের ধান যায় তো তুই কাঁদিস কেন? কাঁদব না, সাধানবাবু, কাঁদব না? লক্ষ্মী না আসতে সেধে ভাসান যাচ্ছে তা কাঁদব না এতটুকু? আমরা খাব কী?
তা গুছিয়ে চিন্তা করতে বসলে আগে মনে হয় ধানক্ষেতে আগুন লাগার কথা। তারপরই মনে পড়ে যে রাতে ঝড় হয়। সেই সন্ধ্যেয় অনেকদিন বাদে সে পেট ভরে খেয়েছিল। এই এত হিঞ্চে সেদ্ধ আর এত গুগলি সেদ্ধ নুন আর লঙ্কা পোড়া দিয়ে। দিনটা এমন ছিল যে সেদিনে গ্রামের সকল উচ্ছবেরা ভরা পেট খেয়েছিল। খেতে খেতে চন্নুনির মা বলেছিল, দেবতার গতিক ভালো নয়কো। লৌকো নে ঝারা বেইরেচে বুঝি-বা বোট মারা পড়ে।
এ কথাটাও বেশ মনে পড়ে। তারপরেই মনে পড়ে মাঝখুঁটিটা সে মাটির দিকে ঠেলে ধরে আছে। মা বসুমতী ঝেমন সে খুঁটি রাকতে চায়নে, উগরে ফেলে দেবে। ভগমান! ভগমান! ভগমান! তারপর বিদ্যুচ্চমকে ক্ষণিক আলোয় দেখা মাতলার সফেন জল ছুটে আসছে। ব্যস, সব ঘোলামেলা একাকার তার পর থেকে। কি হল। কোথায় গেল সব। তুমি কোথায়, আমি কোথায়। উচ্ছব নাইয়া/পিং হরিচরণ নাইয়া/কাগজসহ কোটোটি কোথায়। বড় সুন্দর কৌটোখানি গো! চুন্নুনিদের যদি রেখে যেত ভগবান, তাহলে উচ্ছবের বুকে শত হাতির বল থাকত আজ। তাহলে সে কৌটো নিয়ে সবাই ভিক্ষেয় বেরোত। সতীশবাবুর নাতি ফুট খায়। উচ্ছব কৌটোটা চেয়ে এনেছিল। অমন কৌটো থাকলে দরকারে একমুঠো ফুটিয়ে নেয়া যায়। চমৎকার কৌটো।
-কী হল, হাত চালাও বাছা। উদিকে শুষচে কত্তা, হোম হবে, তা কাটগুনো দাঁড়িয়ে দেখচ? বড়পিসিমা খনখনিয়ে ওঠে।
-বড় খিদে নেগেছে মা গো!
-এই শোনো কতা। ভাত নামলেও খাওয়া নেই একন। তান্ত্রিকের নতুন বিধেন হল, সর্বস্ব রেঁধে রাখো, হোম হলে খেও। তুমি হাত চালাও।
উচ্ছব আবার কাঠ কাটতে থাকে। প্রত্যেকটি কাঠ দেড়হাত লম্বা হবে। ধারালো কাটারিটি সে তোলে ও নামায়। ফুটন্ত ভাতের গন্ধ তাকে বড় উতলা করে। এদিক-ওদিক চেয়ে বাসিনী ঝুড়ি বোঝাই শাক নিয়ে উঠোনে ধুতে আসে। ঝপ করে একটা ঠোঙা তার হাতে দিয়ে বলে, ছাতু খেয়ে জল খেয়ে এসো রাস্তার কল হতে। দেরি কোরো না মোটে। এ পিচাশের বাড়ি কেমন তা ঝাননি দাদা। গরিবের গতর এরা শস্তা দেকে।
-কে মরতেচে, হ্যাঁ বাসিনী?
-তেকেলে বুড়ো। বাড়ির কত্তা। মরবে নে? মদ রে, মেয়েছেলে রে, ওই ঝে হোমের জোগান দিচ্ছে, ওই মুটকি ওনার খাস ঝি। কত্তা মোলে পরে ওকে সাত নাতি না মেরিচি তো আমি বাসিনী নই। তেকেলে বুড়ো মরচে তার ঝন্যি হোম!
ছাতু কটি নিয়ে উচ্ছব বেরিয়ে যায়। বাপ রে! এতে তরকারি, এত চাল এত মাছ, এ একটা যজ্ঞি বটে! সব নাকি বাদার দৌলতে। সে কোন বাদা? উচ্ছবের বাদায় শুধু গুগলি-গেঁড়ি- কচুশাক-সুষনো শাক। উচ্ছব ছাতুটুকু একটু খায়, মিষ্টির দোকানে ভাঁড় চেয়ে নিয়ে জল খায়। ছাতু নাকি পেটে পড়লে ফুলেফেঁপে ওঠে। তাই হোক। পেটের গভর ভরুক। কিন্তু সাগরে শিশির পড়ে। উচ্ছব টের পায় না কিছুই। আবার সে ফিরে আসে।
-কোথা গেছলে?
-এট্টু বাইরে গেলাম মা!
কাঠ কাটলে হোম, হোম হলে ভাত, উচ্ছব তাড়াতাড়ি হাত চালায়।
মেজবউ চেঁচিয়ে বলে, খাবার ঘর মুছেচ বাসিনী? সব রান্না তুলতে হবে।
বাসিনী বলে, মুছিচি!
বড়বউ হেঁকে বলে, সব হয়ে গেল?
-মাচের ঘরে সব হল।
এলো সব কথা শুনে উচ্ছব বুকে বল পায়। ভাত খাবে সে, ভাত। আগে ভাত খাবে, জিভে ভাতের সোয়াদ নেবে। আসার সময়ে গাঁ-জ্ঞেয়াতি বলেছিল, কলকেতা ঝাচ্চ ঝকন, তকন কালীঘাটে ওদের ছরাদ সেরে দিও। অপঘাতে গেচে ওরা। হ্যাঁ, তাও করবে উচ্ছব। মহানাম শতপতি তো এল না। এলে পরে নদীর পাড়ে সারবন্দী ছরাদ হবে। উচ্ছব কালীঘাটে ছরাদ সারবে। শতীশবাবু বলেছে, উচ্ছবের মতিচ্ছন্ন হয়েছে বই তো নয়। বউ-ছেলে-মেয়ে অপঘাতে মরল, মানুষ পাগল হয়ে যায়। উচ্ছব ভাত ভাত করচে দেখো।
তুমি কী বুঝবে সতীশবাবু! নদীর পাড়েও থাক না, মেটে ঘরেও থাক না। পাকা ঘর কি ঝড় জলে পড়ে? তোমার ধান চালও পাকা ঘরে রেখেছে। চোর ডাকাতে নেবে না। দেশজোড়া দুর্যোগেও তোমার ঘরে রান্না হয়। ভাত খেতে দিলে না উচ্ছবকে। তোকে এগলা দিলে চলবে? তাহলেই পালে পালে পঙ্গপাল জুটবে নে? এ হল ভগমানের মার। এর চোট থেকে তোরে বাঁচাতে পারি?- তা তুমি ভাত দিলে না, দেশে ভাত নেই। সেই যে পোকায় ধান নষ্ট, সেই হতেই তো উচ্ছবের আধপেটা সিকি উপোসের শুরু। পেটে ভাত নেই বলে উচ্ছবও প্রেত হয়ে আছে। ভাত খেলে সে মানুষ হবে। তখন বউ-মেয়ে-ছেলের জন্যে কাঁদবে। দুঃখ তো ওর হয়নি। ও শুধু পাগল হয়ে বউ-মেয়েকে ডেকেছিল কয়েকদিন ধরে। তখনি উচ্ছব প্রেত হয়ে গেছে। মানুষ থাকলে ও ঠিকই বুঝত যে জলের টানে মানুষ ভেসে গেছে। কত গরু মোষ ভেসে গেল, চন্নুনির মা তো কোন ছার। উচ্ছব কাঠ কাটা শেষ করে। আড়াই মণ কাঠ কাটল সে ভাতের হুতাশে। নইলে দেহে ক্ষমতা ছিল না।
পাঁচ ভাগে কাঠ রেখে আসে দালানে। উঠোনে কাঠের কুচো, টুকরো সব ঝুড়িতে তুলে উঠোন ঝাঁট দেয়। তারপর বড়পিসিমাকে দেখতে পেয়ে শুধোয়, মা! বাইরে ঝেয়ে বসব?
বড়পিসিমা কোনো জবাবই দেন না। কেননা তান্ত্রিক হঠাৎ "ওঁ হ্রীং ঠং ঠং ভো ভো রোগ শৃণু শৃণু" বলে গর্জে উঠে রোগকে দাঁড় করান, কালো বেড়ালের লোমে রোগকে বেঁদে ফেলেন ও হোম শুরু করেন। একই সঙ্গে ওপর থেকে নার্স নেমে এসে বলে, ডাক্তারকে কল দিন।- বড়, মেজ ও ছোট ঘুমভাঙা চোখে বিরস মুখে হোমের ঘর থেকে বেরিয়ে যায় বাসিনী। উচ্ছবকে বলে, তুমি ঝেয়ে বাইরে বোসো দাদা। না, মন্তর বললে বটে। ঝেমন হাঁকুড় পাড়লে অমনি কত্তা টাল নিলে? কত্তার দেহ থেকে ব্যাদিটা হাঁচোড়পাঁচোড় করে বেইরে এল। চ্যান করবে তো করে নাও কেন?
-একন চ্যান করব নে। মাতায় জল পড়লে পেট মানতে চায় নে মোটে।
বাইরে এসে উচ্ছব শিবমন্দিরের চাতালে বসে। কেমন মন্দির, কেমন চাতাল! বাপ রে! এসব নাকি বাদার দৌলতে। সে বাদাটা কোথায় থাকে? ভাত তো খায়নি উচ্ছব অনেকদিন। ভাত খেয়ে দেহে শক্তি পেলে উচ্ছব সেই বাদাটা খুঁজে বের করবে। উচ্ছবের মতো আরো কত লোক আছে দেশে। তাদেরকেও বলবে।
মন্দিরের চাতালে তাস পেটে তিনটি ছেলে। তারা বলে, বুড়োকে বাঁচিয়ে তুলতে হোম হচ্চে। ফালতু!
-কী ফালতু?
-বেঁচে ও কতদিন জীবন পাবে? একশো? যত সব ফালতু।
উচ্ছব চোখ বোজে। এমন যজ্ঞির পরেও বুড়োকত্তা বেশিদিন বাঁচবে না? কী কাণ্ড! মাতলা নদী যদি সে রাতে পাগল হয়ে মাতাল মাতনে উঠে না আসে তো উচ্ছবের বউ, চন্নুনি, ছোট খোকা অনেকদিন বাঁচে। উচ্ছবের চোখের কোলে জল গড়ায়... ভাত খাবে আজ। সেই আশাতেই প্রেত উচ্ছব মানুষ হয়ে গেল নাকি? বড়-মেয়ে ছোট খোকার কথা মনে হতে চোখে জল এল এমন হঠাৎ? ভাতই সব। অন্ন লক্ষ্মী, অন্ন লক্ষ্মী, অন্নই লক্ষ্মী, ঠাগমা বলত। ঠাগমা বলত, রন্নো হল মা নক্কী।
-কি হে, কানছ কেন?
-আমারে শুদোচ্ছেন বাবু?
-হ্যাঁ হে।
-আবাদ থেকে আসতেচি বাবু গো! ঝড়ে জলে সব নাশ হয়ে, ঘরের মানুষ...
-ও!
তাস পিটানো ছেলেগুলি অস্বস্তিতে পড়ে। বয়স্ক ছেলেটি বলে, ঠিক আছে ভাই ঘুম এসো। উচ্ছব সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমিয়েই থাকে সে অনেকক্ষণ। অনেকক্ষণ। অবশেষে কার পায়ের ধাক্কা খেয়ে ঘুম ভাঙে তার!
ইস! এ যে সাঁঝবেলা গো। কিন্তু তাকে ঠেলা দিচ্ছে কেন লোকটা?
-ওঠো ওঠো, কে তুমি?
-বাবু... আমি...
-চুরির মতলবে পড়ে আছ?
-না বাবু, এই বাড়িতে কাজ করতেছিলাম।
-ওঠো ওঠো।
উচ্ছব উঠে পড়ে। তারপর সে অত্যন্ত ঘাবড়ে যায়। রাস্তায় বেশ কয়েকটি গাড়ি। লোকের ছোট ছোট জটলা। -কী হয়েচে বাবু?
-কেউই তার কথায় জবাব দেয় না। উচ্ছব বাড়িতে ঢোকে। ঢুকতেই বড়পিসিমার বিলাপ শোনে, তোমার ছোট বেয়াই কী ডাকাতে সন্নেসী আনল গো দাদা। যজ্ঞি হল আর তুমিও মল্লে। অ দাদা! তুমি যে বিরেশিতে যাবে তা কে জানত বলো গো! তোমার যে আটানব্বুই বচর থাকার কথা গো দাদা।
বাসিনীকে দেখতে পায় না উচ্ছব। তবে খুব কর্মব্যস্ততা দেখে। কেত্তন না এলে বেরুনো নেই। কে যেন বলে।
- কেওন কি বলছিস বড় খোকা। বোনরা, দিদিরা আসুক। বড়পিসিমা বলেন। চন্দন বাটছ কেউ?
-খাটের টাকা কে নিয়েছে?
-বাগবাজারে ফোন করেচো?
-ফর্দটা দেকে দাও দিকি কেউ। খই, ফুল, ধুতি। শববস্তর...
উচ্ছব পাঁচিলের গায়ে সিটিয়ে লেপটে দাঁড়িয়ে থাকে। কত যে সময় যায়, কত কী যে হতে থাকে।
মস্ত খাট আসে। রাতে রাতে বের কত্তে হবে। রাতে রাতে কাজ সারতে হবে। নইলে দোষ লাগবে।
অনেক তোড়জোড় হয়, মেয়েরা এসে কাঁদে! হোমযজ্ঞ করেও বুড়ো কত্তার প্রাণটা যে রইল না, তাতে তান্ত্রিককে এতটুকু কুণ্ঠিত দেখা যায় না। তিনি লাইন করে ফেলেন তাঁর। ফলে বড়পিসিমা চেঁচিয়ে বলতে থাকেন, তিন ছেলে হোম ছেড়ে উঠে গেল যে?
এসব কাজে বিঘ্নি পড়লে রক্ষে আচে?-এ কথার আলোচনায় খুব সরগরম হয় বাড়ি। শোকের কোনো ব্যাপার থাকে না। বাড়ির উনুনি জ্বলবে না। রাস্তার দোকান থেকে চা আসতে থাকে। অবশেষে রাত একটার পর বুড়োকত্তা বোম্বাই খাটে শুয়ে নাচতে নাচতে চলে যান। পেশাদারি ও দক্ষ শববাহকেরা আধা দৌড় দেয়। ফলে কীর্তন দলও দৌড়তে বাধ্য হয়। বড়পিসিমা বলেন, বাসিনী। সর্বস্ব রান্না পথে ঢেলে দিগে যা। ঘর দোর মুক্ত কর সব। বউরা যাও না। দাঁড়িয়ে বা রইলে কেন?
উচ্ছবের মাথার মধ্যে যে মেঘ চলছিল তা সরে যায়। সে বুঝতে পারে, সব ভাত ওরা পথে ফেলে দিতে যাচ্ছে।
বাসিনী বলে, ধর দেকি দাদা।
-এই যে ধরি!
উচ্ছবের মাথায় এখন বুদ্ধি স্থির, সে জানে সে কী করবে।
-আমাকে দে ভারীটা।
মোটা চালের ভাতের বড় ডেগটি নিয়ে সে বলে, দূরে ফেলে দে আসি।
হ্যাঁ হ্যাঁ, নয়তো কুকুরে ছেটাবে, সকালে কাকে ঠোক দেবে-বামুন বলে।
বেরিয়ে এসে উচ্ছব হনহনিয়ে হাঁটতে থাকে। খানিক হেঁটে সে আধা দৌড় মারে। ভাত, বাদার ভাত তার হাতে এখন। পথে ঢেলে দেবে? কাক কুকুরে খাবে?
-দাদা!-ত্রস্ত বাসিনী প্রায় ছুটে আসে, অশুচ বাড়ির ভাত খেতে নি দাদা!
-খেতে নি? তুমিও ঝেয়ে বামুন হয়েচ?
-অ দাদা, ব্যাগ্যতা করি-
উচ্ছব ফিরে দাঁড়ায়। তার চোখ এখন বাদার কামটের মতো হিংস্র। দাঁতগুলো বের করে সে কামটের মতোই হিংস্র ভঙ্গি করে। বাসিনী থমকে দাঁড়ায়।
উচ্ছব দৌড়তে থাকে। প্রায় এক নিশ্বাসে সে স্টেশনে চলে যায়।
বসে, ও খাবল খাবল ভাত খায়। ভাতে হাত ঢুকিয়ে দিতে সে স্বর্গসুখ পায় ভাতের স্পর্শে। চন্নুনির মা কখনো তাকে এমন সুখ দিতে পারেনি। খেতে খেতে তার যে কী হয়। মুখ ডুবিয়ে দিয়ে খায়। ভাত, শুধু ভাত। বাদার ভাত। বাদার ভাত খেলে তবে তো সে আসল বাদাটার খোঁজ পেয়ে যাবে একদিন। আছে, আরেকটা বাদা আছে। সে বাদাটার খোঁজ নির্ঘাৎ পাবে উচ্ছব। আরো ভাত খেয়ে নি। চন্নুনিরে! তুইও খা, চন্নুনির মা খাও, ছোট খোকা খা, আমার মধ্যে বসে তোরাও খা! আঃ! এবার জল খাই, জল! তারপর আরো ভাত। ভোরের টেনে চেইপে বসে সোজা ক্যানিং যাচ্চি। ভাত পেটে পড়েচে এখন ঝানচি ঝে ক্যানিং হয়ে দেশঘরে ঝেতে হবে।
উচ্ছব হাঁড়িটি জাপটে, কানায় মাথা ছুঁইয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
পেতলের ডেগটি চুরি করার অপরাধে সকালে লোকজন উচ্ছবকে সেখানেই ধরে ফেলে। পেটে ভাতের ভার নিয়ে উচ্ছব ঘুমিয়েছিল, ঘুম তার ভাঙেনি।

মারতে মারতে উচ্ছবকে ওরা থানায় নিয়ে যায়। আসল বাদাটার খোঁজ করা হয় না আর উচ্ছবের। সে বাদাটা বড়বাড়িতে থেকে যায় অচল হয়ে।