সহাবস্থান - সমরেশ মজুমদার

সহাবস্থান
সমরেশ মজুমদার
এখন বিকেল। ব্যালকনিতে চেয়ার পেতে বসেছিলেন দিব্যজ্যোতি। সামনে চোখ মেললেই চোখের শান্তি হয়। কোথাও কোনও বাধার প্রাচীর নেই। দক্ষিণ দিক, বোধহয় বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত একদম খোলা। নিবারণ ঢোল ঠিকই বলে। এত মিষ্টি হাওয়া তিনি কোনওদিন গায়ে মাখেননি।
শরীরটা জুত নেই। আজকাল নিয়মের ব্যতিক্রম হলেই এমন হয়। ঠিক সময়ে খাওয়া, শোওয়া, ঘুমাবার চেষ্টা চালিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা এবং বই পড়া, জীবন বলতে এখন এই। লতিকার তাগাদায় জীবনের শেষপ্রান্তে এসে একটা মোচড় এল। শোভাবাজারে ঘিঞ্জিতে তিনি হাঁটতে পারতেন না। এখানে এত সবুজ মাঠে হাঁটতে হাওয়া লাগবে। মল্লিকবাড়ির অন্দরে হাওয়া ঢুকত কিন্তু এখানে ঈশ্বরের দাক্ষিণ্য পর্যাপ্ত। নিবারণকে দেখে তার খারাপ লাগছে না। ওর সঙ্গে কথা বলেও আরাম পাওয়া যাবে। আশেপাশের ফ্ল্যাটের মানুষ যারা আসবে তারা কেমন হয় সেইটেই ভাবনার। দিব্যজ্যোতি খুশি মনে ঘরের ভেতরটা লক্ষ করলেন মুখ ফিরিয়ে। আর অমনি বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। কোনও আভিজাত্য নেই, দেশলাই বাক্সের মতো দেওয়াল, শুনতেই সব মিলিয়ে অনেক স্কোয়ার ফুট কিন্তু কেমন খোপ-খোপ। আজন্ম মল্লিকবাড়ির সেই বিশাল থামওয়ালা বড়-বড় ঘরে বারো ইঞ্চি দেওয়ালের মধ্যে থেকে এসে এটিকে খেলাঘর বলে মনে হচ্ছে। খেলাঘর বটে–জীবনের সব পাট চুকিয়ে, আত্মীয়-অনাত্মীয়দের সব মুখের চেহারা দেখে এই খেলাঘর পেতেছে লতিকা তাকে নিয়ে।
অত হাওয়া লাগিও না ঠান্ডা লেগে যাবে। পেছনে এসে দাঁড়ালেন লতিকা। তারপর স্বামীর বুক গলায় একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে দিলেন। ঠান্ডা লাগছিল না কিন্তু এতে বেশ আরাম হল। দিব্যজ্যোতির। হেসে বললেন, কলকাতা শহরে গরমকালে চাদর জড়িয়ে বসে আছি, কী কাণ্ড! শোভাবাজারে এমনটা ভাবতেও পারেনি লতিকা।লতিকা চারপাশে তাকালেন, শুধু শূন্য মাঠ আর দূরে-দূরে অর্ধসমাপ্ত কিছু বাড়ি। আকাশ এখন টকটকে হয়ে আছে; সূর্য ডুবুডুবু। লতিকা। বললেন, আঃ, এত আরাম ভগবান আমার কপালে লিখে রেখেছিলেন আমি স্বপ্নেও ভাবিনি গো।
দিব্যজ্যোতি তাকালেন স্ত্রী-র দিকে। বয়স সর্বাঙ্গে স্পষ্ট কিন্তু চুলে পাক ধরেনি, দাঁতও পড়েনি। একটু মোটা হয়ে গেছেন বটে লতিকা কিন্তু খাটতে দ্বিধা করেন না। এখন ওঁর দিকে পেছন ফিরে রেলিং-এ ভর করে পৃথিবী দেখছেন যে মহিলা তিনি তাঁর স্ত্রী। সাদা শাড়িতে রং খুঁজে পাওয়া ভার। দিব্যজ্যোতি ডাকলেন, তু!
লতিকা চমকে ফিরে তাকালেন। দিব্যজ্যোতি অবাক হলেন, কি হল, অমন করলে কেন?
লতিকা মৃদু মাথা নাড়ালেন, না, কিছু না। বলো?
কিছু তো বটেই। বলো বলতে চাও না। দিব্যজ্যোতি নিজের গলায় অভিমান শুনলেন।
লতিকা হাসলেন, কি বলছিলে বলো! বুঝেছি চা চাই।
তাহলে মন্দ হয় না। কিন্তু তোমার ঝামেলা বাড়িয়ে কী লাভ!
চা আর ভাতের ব্যবস্থা এসেই করেছি। এ বাড়িতে আজ নতুন তোমার জীবন।
হ্যাঁ, কত বয়স হল?
বছর গুনো না। বছরের হিসেব আর ভালো লাগেনা। কি বলছিলে তখন? লতিকা পাশে এসে দাঁড়ালেন।
খুব অন্তরঙ্গ কিছু কথা বুকে ছটফট করছিল দিব্যজ্যোতির। তিনি জানেন লতিকা সেই কথাগুলোর আন্দাজ পেয়েছে। দীর্ঘদিন ভালোবেসে একসঙ্গে থাকলে মাটিও আকাশকে বুঝতে পারে। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে কথাগুলো উচ্চারণ করলে নিজের কানেই অন্যরকম ঠেকবে বলে মনে হল তাঁর। তিনি বললেন, বলছিলাম, আমার গায়ের চাদর জড়িয়ে দিলে কিন্তু নিজে তো এই হাওয়া গায়ে মাখছ।
লতিকার চোখ ছোট হল। তারপরেই হাসি ফুটল ঠোঁটে, আমার কিছু হবে না। মেয়েদের ঠান্ডা কম লাগে। শশাভাবাজারে শীতকালে কীরকম জামা পরতাম? শরীরে এখন এত চর্বি, ঠান্ডাটা ঢুকবে কোত্থেকে? তুমি বসো, আমি চা আনছি।
লতিকা চলে গেলেন ভেতরে। দিব্যজ্যোতি মাথা নিচু করলেন। এই সময়টা মন্দ কি! দু-জনেই জানেন কথাটা বলা হল না কিন্তু অন্য কথার ভিড়ে তা ডুবিয়ে রাখাই মাঝে-মাঝে আরামদায়ক। সারাটা জীবন শুধু যেমন অন্যের জন্যে খরচ করে যাওয়া!
আর একটু বাদে উঠে দাঁড়ালেন দিব্যজ্যোতি। সত্যি শীত লাগছে এখন। হাওয়ার দাপট বাড়ছে, আকাশের গায়ে একটু কালো ছাপ। ঘরে ঢুকে আলো জ্বাললেন। নতুন বাল্বের আলোয় ঘরটা ঝকমকিয়ে উঠল। এইটে তাদের শোওয়ার ঘর। কোনওমতে একটি খাট পাতা হয়েছে। আর কিছুই সাজিয়ে রাখা হয়নি। পাশের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সুইচ টিপলেন–এটি দ্বিতীয় শোওয়ার ঘর। আপাতত এখানেই সমস্ত জিনিস স্তূপ করে রাখা হয়েছে। আলমারি থেকে চেয়ার, লতিকার রান্নার সব জিনিসপত্র। এগুলোও তিনি অনেক-অনেক কাল দেখে আসছেন। শোভাবাজারের বাড়িতে যাদের মানাত এখানে তাদের দেখতে অস্বস্তি হচ্ছে। এই আধুনিক ফ্ল্যাটে পুরোনো আসবাব বড় বেমানান। কিন্তু নতুন কিছু কেনার সামর্থ্য কোথায়?বাইরের ঘরের দরজায় এসে আলো জ্বাললেন। সোফাসেট। ওই টুলটা ঠাকুরমার আমলের। এখনও কীরকম চকচক করছে। হঠাৎ দিব্যজ্যোতির মনে হল, এই আধুনিক বাড়িতে তিনি বা তাঁরা কতটা মানানসই? এই গিলে করা পাঞ্জাবি, কোঁচাননা ধুতি আর সুতির চাদর? এই সময়ে সশব্দে কলিং বেল জানিয়ে দিল কেউ এসেছে। দরজা খুলতে গিয়ে সচেতন হলেন দিব্যজ্যোতি। আগন্তুক অবাঞ্ছিত কিনা তা জানবার জন্যে এখানকার দরজায় ছোট ফুটো থাকে। তাতে চোখ রেখে ভালো লাগল তাঁর, নিবারণ এসেছে। দরজা খুলে প্রসন্ন মুখে তাকালেন, এসো, নিবারণ।
সব ঠিক আছে? কোনও প্রবলেম নেই? নিবারণ হাত তুলে প্রশ্ন করল।
বাইরে দাঁড়িয়ে তো সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা যায় না। ভেতরে আসতে বলেছি।
দিব্যজ্যোতির কথায় ভেতরে ঢুকে নিবারণ বলল, একি। জানালাগুলো খোলেননি কেন? ঘরে গুমোট হবে। বলেই সে জানালার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, দিব্যজ্যোতি বাধা দিলেন, না-না, থাক এখন, মশা ঢুকবে।
মশা? নো মশা হিয়ার। থাকলে একদম রোগা পটকা।
থাক না। তুমি বসো। আসলে খুললেও তো বন্ধ করতে হবে।
ততক্ষণে একটি জানালা খুলে ফেলেছে নিবারণ, বন্ধ করার ভয়ে খুলবেন না? ঠিক আছে, যাওয়ার সময় আমি বন্ধ করে দেব। আর দেখেছেন কি হাওয়া! কি পবিত্র!
পবিত্র! দিব্যজ্যোতি চমকে উঠলেন, শব্দটা খুব ভালো বললে হে। তুমি কি কবিতা লেখো? পবিত্র হাওয়া। বাঃ!
নিবারণ লজ্জা পেল, না-না। অশিক্ষিত মানুষ, এসব ক্ষমতা আমার কোথায়?মুখে যা আসে বলে ফেলি। বলার পরও কেউ না বলে দিলে বুঝতে পারি না কথাটা ভালো।
দিব্যজ্যোতি ভালো করে ছেলেটিকে লক্ষ্য করলেন, যে বয়স শুনেছেন, চেহারায় সেটি মালুম হয় না। তিনি অন্য প্রসঙ্গে গেলেন, আর সব ফ্ল্যাটের মানুষ কবে আসছেন?
এসে গেলেন বলে। আমরা তো তৈরি হয়ে বসে আছি। এখন ঠিক আছে, সবাই এসে গেলে একা আমায় সব ঝক্কি সামলাতে হবে। প্রাণহরিবাবু, চেনেন তো ওঁকে, ওই যে মিটিং-এর দিন যিনি আপনাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, আমাদের ম্যানেজার। ছি, ছি, এই দেখুন বলি কথাটা ম্যানেজার কিন্তু সঙ্গদোষে জিভে যে উচ্চারণ ঢুকেছিল তাই বেরিয়ে আসে। যা বলছিলাম, প্রাণহরিবাবু মাঝে-মাঝে আসবেন এখানে। অতএব আমার একার ঘাড়ে সব। কিন্তু কাজ দেখে পালাবার পাত্র নই আমি। নিবারণ যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছিলেন, ব্যাপারটা লক্ষ করলেন দিব্যজ্যোতি।
তিনি বললেন, তোমরা এই বাড়িটার নাম জব্বর দিয়েছ হে!
তা যা বলেছেন। বাঙালি থেকে চিনে সবাই আসছেন তখন বাড়ির নাম কলকাতা ভালো মানাচ্ছে। আমি এবার উঠি। উশখুশ করল নিবারণ।
উঠবে মানে? এলেই বা কেন?
এই প্রথম সন্ধে, আপনারা আছেন কেমন দেখতে ইচ্ছে করল।
খুব ভালো ইচ্ছে। বসো তো! তোমার সঙ্গে গল্প করতে আমার ভালো লাগছে।
এই সময় দু-কাপ চা হাতে লতিকা দরজায় এসে দাঁড়াতেই নিবারণ উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করল, ছি-ছি, আপনি আমার জন্যেও চা করলেন?
একজনের চা তৈরিতে যে পরিশ্রম, দুজনের কিন্তু তা ডবল হয়ে যায় না, আপনি অনেকদিন বাঁচবেন! লতিকা টেবিলে চা নামিয়ে রাখলেন।
দিব্যজ্যোতি একটু চিমটি কাটলেন, তুমি আবার কখন মনে করলে ওকে!
করেছি। উলটোদিকের সোফায় গুছিয়ে বসলেন লতিকা।
নিবারণ একদৃষ্টিতে লতিকার দিকে তাকিয়েছিল। বিব্রত মুখে লতিকা প্রশ্ন করলেন, কি দেখছেন ওরকম করে?
নিবারণ মাথা নাড়ল, আপনি না কি বলব সাক্ষাৎ মা দুর্গার মতো দেখতে।
হঠাৎ ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন দিব্যজ্যোতি, লতিকার মুখে রক্ত জমল। নিবারণ তার কথায় জোর দিল, হ্যাঁ, আমি মিথ্যে বলছি না। আপনার দিকে তাকিয়েই কেমন ভক্তি-ভক্তি ভাব জাগে।
দিব্যজ্যোতির গলায় তখনও হাসির রেশ, ঠিকই বলেছ ভাই। আমার তো সারাজীবন ওই করে কেটে গেল।
লতিকা কৃত্রিম রোষ দেখালেন, থামো তো! নিবারণবাবু, আপনার সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে। আপনি না এলে আমাকেই ডাকতে যেতে হত। কিন্তু এত বড় বাড়ি একদম খালি হয়ে রয়েছে, ভয়-ভয় লাগে।
দিব্যজ্যোতি বললেন, এখন বাড়ি খালি বলে ভয় পাচ্ছ, বাড়ি ভরে গেলে আবার লোক দেখে হাঁপিয়ে উঠবে।
উঠি উঠব তবু শোভাবাজারের বাড়ির মতো ঘরকুনো হয়ে থাকতে তো হবে না। শুনুন, ওঁকে তো বলে কোনও লাভ নেই। একটা কথাও কানে ঢোকে না। আমার একজন পুরুত চাই। ভালো। পুরুত। লতিকা আবদারের গলায় জানালেন।
পুরুত মানে পুজো করবেন? এই তল্লাটে কোনও পুরোহিত আছে কিনা মনে করতে পারল না নিবারণ। প্রাণহরিবাবু ব্রাহ্মণ, উনি পুরুতগিরি করেন কিনা সেটা জানা নেই।
হ্যাঁ। গৃহপ্রবেশ করলাম অথচ একটা পুজো হল না, এটা খুব খারাপ ব্যাপার। আমি তাই বেশিরভাগ জিনিসপত্রে হাত দিইনি। পুজো করার পর গোছাব। আপনি কাল সকালেই একজন পুরুত এনে দিন। খুব বড় কিছু নয়, একটা পুজো করে নেব।
দিব্যজ্যোতি মন দিয়ে শুনছিলেন। এবার বললেন, ছাড়ো তো এসব! পুরুত নয়, আমাদের একটা ভালো কাজের লোক চাই। শোভাবাজারে যারা ছিল তারা পাড়া ছেড়ে এত দূরে আসতে চাইল না। তুমি ভাই একটি ঝি কিংবা চাকর দেখে দাও, নইলে তোমার ওই দুর্গাঠাকুরানির  ফাঁই ফরমাশ খাটতে-খাটতে আমার প্রাণ জেরবার হয়ে যাবে।
লতিকা ফুঁসে উঠলেন, বাজে বোকো না। শোভাবাজারে তো পায়ের ওপর পা তুলে থাকতে। লোক আজ না-হোক কাল পেয়ে যাব কিন্তু পুরুত আমার চাই কালকেই। ভয় পেয়ো না, তোমাকে এই পুজোর ব্যাপারে কিছু করতে হবে না। এখানে কোনও ঠাকুরবাড়ি নেই?
নিবারণ মাথা নাড়ল, আপনি তো কথাটা বলে ফেলেছেন, জোগাড় করার দায়িত্ব আমার। তবে একটা কথা, মন্ত্রটা নিয়ে খুঁতখুঁতুনি করবে না।
লতিকা শিউরে উঠলেন, ওমা, সেকি কথা!
দিব্যজ্যোতি হাসলেন, বিদ্যাস্থানে ভয়ে বচ। বঙ্গগৃহিণীরা এই করেই মরল।
মরি নিজের বাড়িতেই মরব। বিয়ের পর থেকেই মান্ধাতার আমলের বাড়িতে শরিকদের সঙ্গে ঝগড়া করে কাটাতে হয়েছে। তোমার আর কী! এখন একটু হাত-পা মেলার সুযোগ পেয়েছি, হাজার হোক নিজের বাড়ি বলে কথা।
এই সময় দুম করে আলো নিভে গেল। নিবারণ বলল, এই এক জ্বালা। ঘাবড়াবেন না, জেনারেটর আছে। দেখি গিয়ে।
নিবারণ অন্ধকারেই চা এক চুমুকে শেষ করে উঠে দাঁড়াল। দিব্যজ্যোতি হাঁ-হাঁ করে উঠলেন, অন্ধকারে যাবে কী করে? লতু টর্চ আনা।
নিবারণ বললেন, কিছু ব্যস্ত হবেন না। প্যাঁচাঁদের চেয়ে খারাপ দেখি না অন্ধকারে। কলকাতায় থাকতে-থাকতে সেটাও অভ্যাস হয়ে গেছে। কাল আপনি আপনার পুরুত পেয়ে যাবেন ঠিক। সকাল-সকাল আনব।
বাড়িটা এখন ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে ডুবে রয়েছে। নিবারণ বেরিয়ে যাওয়ার পর দরজা দিয়ে লতিকা বললেন, এখানে ভূতের মতো বসে না থেকে বারান্দায় বসবে চলো।
মোমবাতি আনোনি? দিব্যজ্যোতির উঠতে ইচ্ছে করছিল না। জানালা দিয়ে খারাপ হাওয়া আসছে না।
লতিকা বললেন, এনেছি তবে এখন খুঁজে পাব না। বলে অন্ধকারেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ বসে রইলেন দিব্যজ্যোতি। খালি বাড়িতে খুটখাট শব্দ হচ্ছে। দিব্যজ্যোতির মনে হল খালি বাড়ি বলেই এই শব্দ। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদেই তাঁর অস্বস্তি আরম্ভ হল। যেন ঘরের মধ্যেই তিনি শব্দের উৎস খুঁজে পাচ্ছেন। দিব্যজ্যোতি নিচু গলায় ডাকলেন, লতু! শব্দটা যেন কয়েকগুণ জোরে কানে বাজল। তিনি ধীরে-ধীরে উঠতে গিয়ে হোঁচট খেলেন। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের নখে ব্যথা লাগল টেবিলের পায়ে ধাক্কা লাগায়।
কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকতে সাহস হল না। শোভাবাজারে কোনওকালেও ভূতের ভয় পায়নি। ওর এক জেঠিমা তান্ত্রিকদের খুব মানতেন। বিডন স্ট্রিটে এক তান্ত্রিকের কাছে যাওয়া আসা ছিল তাঁর। তন্ত্রমতে প্রেত পাঠানো যায় কারও ক্ষতি করতে অথবা কেউ ক্ষতি করছে জানলে সেই প্রেতকে দিয়ে পাহারা দেওয়ানো যায় এসব কথা শুনে-শুনে নেশা চড়িয়ে দিয়েছেন। এখন তাঁর মনে। অন্যরকমের ভয় এল। এই বিশাল শূন্যবাড়িতে একা থাকাটাই অসম্ভব। শব্দগুলো নানারকম মানে হয়ে কানের ভেতরে ঢুকছে।
দিব্যজ্যোতি হাতড়ে-হাতড়ে বারান্দায় চলে এসে থমকে দাঁড়ালেন। লতিকা গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। দিব্যজ্যোতি ঠিক করলেন চশমার  কাঁচ এবার পালটাতে হবে। যতই অন্ধকার হোক, লতিকাকে তিনি বেশ  ঝাঁপসা দেখছেন যেন। বাইরে অনেক দূরে টিমটিমে আলো। আর আকাশটা এখন মেঘমুক্ত কারণ ঠাসঠাস তারারা ঝকঝক করছে। দিব্যজ্যোতি আরও একটু এগোলেন। তাঁর পায়ের শব্দ এতক্ষণে লতিকার কানে যাওয়া উচিত ছিল কিন্তু সে মুখ ফেরাচ্ছে না। মজা লাগল দিব্যজ্যোতির, মেয়েদের বয়স বাড়লেও মনের মধ্যে অভিমানের বাক্সটা ঢেকেঢুকে রাখে। সময় বুঝলেই খানিকটা খুলে দেখায়। দিব্যজ্যোতি বিকেলে যেটা বলতে গিয়ে পারেননি এই আধা অন্ধকারে যখন তারার আলোর মিশেল চারপাশে, তখন দু-হাত বাড়িয়ে লতিকাকে কাছে টানলেন। লতিকার শরীরটা এই বয়সেও নরম, অন্তত তাঁর চেয়ে নরম। কাঁধে চাপ দিয়ে ওঁকে ঘুরিয়ে মুখ লাগিয়ে লতিকার চিবুক তুলে অনেক-অনেকদিন পরে চুম্বন। করলেন তিনি। এক ঝটকায় মনে হল যৌবনের উচ্ছ্বাসের যে স্বাদ লতিকার ঠোঁটে পেতেন তার গন্ধ যেন নাকে লাগল। কিছু বলার জন্য তিনি মুখ খুলতে যেতেই লতিকা হু-হুঁ করে কেঁদে উঠলেন। তারপর দিব্যজ্যোতির বুকে মাথা রেখে সেই কান্নাটা গিলতে চেষ্টা করলেন।
কাঠ হয়ে গেলেন দিব্যজ্যোতি। কোনওমতে নিজেকে সামলে লতিকার পিঠে আলতো হাত বোলালেন। তারপর গাঢ়স্বরে বললেন, you must not, you must not!
তা এসব বছর পাঁচেক আগের কথা। সময়ের চড়া পড়ে-পড়ে এত সময় কোথাও এক ফোঁটা জল নেই বলে ধারণা জন্মেছিল দিব্যজ্যোতির কিন্তু এ স্রোত চোখের বাইরে দিয়ে বয়! চেয়ারে নড়েচড়ে বসলেন তিনি। সেই সময় লতিকা বলে উঠল, বড়খুকিদের আসতে লিখলাম।
জামাই ছুটি পায়নি। দিব্যজ্যোতি মনে করিয়ে দিলেন, বড়খুকির মেয়ের পরীক্ষা!
লতিকা জবাব দিলেন না। তাঁর কেবলই মনে হচ্ছিল ছুটি না পাওয়া, মেয়ের পরীক্ষা–এসব বাহানা। কেউ তাঁর ইচ্ছের দাম দিতে চায় না। কিন্তু আজ ওই বারান্দায় যাওয়ার পর, একা। দাঁড়িয়ে অন্ধকার দেখার পর থেকেই মনে হচ্ছিল ওর কথা। মনে হচ্ছিল কোথাও কি ভুল হয়ে গেছে? সে যেসব অন্যায় করেছে, চোরের মতো চলে গিয়ে তাঁরাও কি ওকে বুঝতে ভুল করেছেন?
ছোটবেলায় ছোটখুকি বলত, দেখো, আমি বড় হয়ে বিয়েই করব না। বিয়ে করলেই তো তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে।দুই বোনের পার্থক্য ছিল দশ বছরের। বড়খুকির বিয়ের পরে তাঁর কান্না দেখে মেয়ে বলেছিল।
এই বাড়ি নিজের। কোনও শরিক নেই, কারও কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে না। এই সুখ তাঁর। অনেকদিনের আকাঙ্ক্ষায় ছিল। কিন্তু আজ কেন নিজেকে সুখী ভাবতে পারছেন না তিনি? হঠাৎ মুখ তুললেন লতিকা, মানুষ আর জন্তুর মধ্যে কী পার্থক্য জানো? সবাইকে নিয়ে সুখী হতে না পারলে মানুষের সুখ পূর্ণ হয় না।
কী বলতে চাইছ তুমি? দিব্যজ্যোতির বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল।
আমি তোমার কাছে একটা ভিক্ষে চাইব?
ভিক্ষে বলছ কেন?
ছোটখুকি, ছোটখুকির কাছে একবার যেতে চাই।
কেন?
জানি না। কিন্তু না গেলে মন শান্ত হবে না।
সে যদি তোমায় অপমান করে?
আর কখনও যাব না।
না লতিকা। যাকে একবার মৃত ভেবেছ, তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখোনি, তাকে আর টেনে এনো না। স্মৃতি হাতড়ে পিছু ফেরা ভালো নয়। তোমার বড় মেয়েও খুশি হবে না। তা ছাড়া যে লোকটা ছোটখুকিকে পয়সার লোভে মডেলিং করায়, তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবার ইচ্ছা আমার নেই। দিব্যজ্যোতি কথাগুলো বলছেন যখন তখনই আলো ফিরে এল। শোভাবাজারে লোডশেডিং শেষ হলে অনেক গলা থেকে একসঙ্গে আনন্দধ্বনি ছিটকে উঠত, কিন্তু এখানে কেউ কোনও আওয়াজ করল না। এবং তখনই দিব্যজ্যোতির খেয়াল হল নিবারণ জেনারেটর চালু করতে গিয়েছিল।
অথচ তার কোনও ফল পাওয়া যায়নি। ব্যাপারটা নিয়ে পরে কথা বলব।
মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে গেল দিব্যজ্যোতির। লতিকা তাঁকে ডাকছেন।
কি বলছ? বিরক্তি মুখে, গলায়।
বাথরুমে যাব।
যাবে তো যাওগে, আমাকে ডাকার কী আছে?
কীসব শব্দ হচ্ছে চারপাশে! তুমি একটু দাঁড়াবে?
লতিকার কথা বলতে অসুবিধে হচ্ছিল। তবু সেই মুচড়ানো গলায় বললেন, কি করব, আজ ওকে ভীষণ মনে পড়ছে। আমাকে ছোটবেলায় এইরকম বারান্দাওয়ালা বাড়ির কথা বলত! দিব্যজ্যোতি বললেন, লতু! তুমিও বলেছ, সী ইজ ডেড টু আস।
লতিকা নিজেকে মুক্ত করে ধীরে-ধীরে চেয়ারে গিয়ে বসলেন। দিব্যজ্যোতি একটু অসহায় চোখে তাকালেন। তাঁর শরীরে কম্পন আসছিল। হাঁটুদুটো হঠাৎ খুব দুর্বল হয়ে পড়ল। তিনি চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলেন। এবং এতদিন বাদে স্ত্রীকে চুম্বনের যে আনন্দ কিছুক্ষণ আগে। বেলুনের মতো ফুলছিল তা এখন চুপসে গেছে। ওই কান্না একটি কারণেই আসতে পারে লতিকার, তাঁরও। দুটো মানুষের সূত্র যদি এক হয় তাহলে একের অনুকরণ অন্যে টের পাবেই। তিনি কিছুতেই মুখটা মনে করতে চাইছিলেন না, তখন বারংবার সে ফিরে আসছে। উনিশ বছর। বয়সের তাঁর সবচেয়ে আদরের মেয়ে, ছোট মেয়ে, একেবারে বিয়ে করে খবর পাঠাল সে কাজটা করেছে। সামনে এসে দাঁড়িয়ে জানানোর সাহস হল না। শোভাবাজারের রক্ষণশীল বাড়ির অন্য আত্মীয়দের কথা ছেড়ে দিলেন। এই চোরের মতো কাজটার জন্যে প্রচণ্ড অপমানিত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি আহত হয়েছিলেন লতিকা। বড় মেয়ে সম্বন্ধ এনেছিল। বড়জামাই-এর অফিসে কাজ করত ছেলেটি। দিল্লিতেই বাড়ি। মেয়েজামাই লিখেছিল ছোটমেয়েকে নিয়ে লতিকা যেন দিল্লিতে কয়েকদিন কাটিয়ে আসেন। সেখানেই মেয়ে দেখবে ছেলে। সেইমতো টিকিট কাটা হয়ে গিয়েছিল আর আজই এই কাণ্ড! ছেলে ছবি আঁকে। নিজের সিগারেটের খরচ যার ছবি বিক্রির টাকায় ওঠে না সে বিয়ে করেছে দিব্যজ্যোতি মল্লিকের। মেয়েকে। লতিকা তৎক্ষণাৎ ঘোষণা করেছিলেন তিনি ধরে নেবেন ছোট মেয়ে মৃত। মুখ দর্শন। করবেন না ঠিক করেও দিব্যজ্যোতিকে অনেকদিন নিজের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছিল। উনিশ বছর তিল তিল করে যে স্নেহ দিয়ে ওকে গড়ে তুলেছিলেন তা মুছে ফেলা মুশকিল। কথাটা জানার পর মেয়ে আর এ-মুখো হয়নি। দিব্যজ্যোতি জানেন না ফিরে এলে তিনি কি করতেন। তাঁর বিস্ময় লাগে, উনিশ বছরের অভ্যাস ভালোবাসা পরস্পরের হৃদয়ের স্পর্শ ম্লান হয়ে গেল মেয়ের কোন আকর্ষণের তাগিদে?কয়েক বছরের বা মাসের মধ্যে একটি পুরুষ কোন জাদুতে এত মূল্যবান হয়ে ওঠে? তারপর যখন কাগজের বিজ্ঞাপনে মেয়ের মোহিনী ছবি দেখতে লাগলেন, বুঝলেন মডেলিং করছে পেট ভরাতে, তখন তলানিটুকুও চলে গেল মন থেকে।
দাঁড়াব? আমি? বাথরুমের দরজায়? তুমি কি কচি খুকি? লতিকা আর কথা না বলে নেমে গেলেন বিছানা থেকে। নতুন জায়গা, দেওয়ালের গন্ধ এখনও মরেনি, ঘুম আসছিল না প্রথম রাতে। তাও যদি এল লতিকার ভূতের ভয় সেটা ভাঙিয়ে দিল। বালিশে মুখ ডুবিয়ে নিজের শরীর অনুভব করেছিলেন দিব্যজ্যোতি। হঠাৎ কানে একটা শব্দ বাজল। না, খালি বাড়ির শব্দ নয়, লতিকার হাত থেকে মগ পড়ে গেছে নিশ্চয়ই। তিনি আবার ঘুমাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু আর ঘুম আসছে না। দিব্যজ্যোতি চিত হয়ে শুতেই মনে হল লতিকা এখনও ফেরেননি। যতই হোক এতক্ষণ কারও বাথরুমে থাকা বাড়াবাড়ি। তিনি শুয়ে-শুয়েই ডাকলেন লতু! কেউ সাড়া দিল না। অথচ বাথরুমটা তো লাগোয়াই। দিব্যজ্যোতি উঠলেন। চশমাটা নিতে গিয়েও নিলেন না। ভেজানো দরজা, ভেতর থেকে ছিটকিনি দেওয়া নেই, দিব্যজ্যোতি আবার ডাকলেন, লতু? তোমার হয়ে গেছে?
কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করেও সাড়া না পেয়ে দরজায় চাপ দিতেই বুক নিংড়ে আর্তনাদ ছিটকে উঠল দিব্যজ্যোতির। লতিকা বাথরুমের মেঝেতে পড়ে আছেন।
দৌড়ে কাছে যেতে গিয়ে দেওয়াল ধরে নিজেকে সামলালেন দিব্যজ্যোতি। শরীরটা যে এত বিকল হয়েছে তা আন্দাজেও ছিল না। তাঁর নিজের বুক ধড়াস-ধড়াস করছে। চোখের দৃষ্টি  ঝাঁপসা হয়ে আসছে। কোনওরকমে তিনি লতিকার শরীরের সামনে উবু হয়ে বসলেন। তাঁর খুবই কষ্ট হচ্ছিল। হাত তুলে লতিকার কাঁধ ধরলেন তিনি, লতুলতু। কী হয়েছে লতু? কথা বলো লতু।
কোনও সাড়া নেই। দিব্যজ্যোতি কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। তাঁর শরীরে এখন এমন সামর্থ্য নেই যে নিচে গিয়ে হাঁকাহাঁকি করে নিবারণকে ডাকবেন। কিন্তু একজন ডাক্তার আনা। দরকার এই বোধ সক্রিয় ছিল তাঁর। নিজের সমস্ত মানসিক শক্তি জড়ো করে শক্ত হতে চাইলেন। তিনি। তারপর আঙুল নিয়ে গেলেন লতিকার নাকের সামনে। নিশ্বাস কি পড়ছে? বোঝা যাচ্ছে না। দিব্যজ্যোতির মনে হল তাঁর আঙুলের চামড়া এত মোটা হয়ে গেছে বয়স হওয়ায় যে সামান্য আলতো চাপে ঠাওর করতে পারছেন না। মুখ তুলতেই কল দেখতে পেলেন তিনি। কি মনে হতেই কলের মুখ ঈষৎ খুলতেই জল পড়তে লাগল লতিকার মাথায়। সেই জল তিনি হাতে নিয়ে বুলিয়ে দিতে লাগলেন ওঁর গলায় কপালে।
আচমকা অন্যতর ভাবনা এল। এখন লতিকা যদি এইভাবেই চোখ বন্ধ রেখে চলে যায়? ওর এই সাধের নতুন বাড়িতে লতিকা ছাড়া তিনি কেমন করে থাকবেন? শুধু বাড়ি নয়, তাঁর প্রতিদিন। অভ্যাসের সঙ্গে যখন লতিকা জড়িত তখন তিনি এর পরের দিনগুলো বাঁচবেন কী করে? বুকের ভেতরটা হু-হুঁ করে উঠল দিব্যজ্যোতির। তিনি প্রাণপণে লতিকাকে ডাকতে লাগলেন।
এই সময় চোখ মেললেন লতিকা। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা, জলের স্পর্শ এবং কানে নিজের নাম তাঁকে বিহ্বল করে তুলল এবং তখনই তিনি স্বামীর মুখ দেখতে পেলেন। ধীরে-ধীরে উঠে বসতে চেষ্টা করলেন লতিকা। দিব্যজ্যোতি জিজ্ঞাসা করলেন বিপর্যস্ত স্বরে, কি হয়েছিল লতু, তোমার কি হয়েছিল।
ভেজা চুল, সিক্ত জামায় শীত করল লতিকার। চোখ বন্ধ করে বললেন, পড়ে গিয়েছিলাম, হঠাৎ মাথাটা–। দুটি মানুষ পরস্পরকে অবলম্বন করে কোনওক্রমে প্রচুর সময় নিয়ে খাটে ফিরে এল। লতিকা পোশাক পরিবর্তন করার শক্তি পেলেন না। সিক্তবস্ত্র মুক্ত হয়ে চাদরে শরীর মুড়ে পড়ে রইলেন একপাশে। দিব্যজ্যোতি, শক্তিহীন, চোখের সামনে অন্ধকার নিয়ে, বুকভরতি যন্ত্রণায় প্রথম পদক্ষেপ বুঝেও চাদর টেনে তাঁর পাশে শুয়ে। বালিশের নিচ থেকে কৌটো বের করে একটা সরবিট্রেট বের করে নিজের মুখে দিয়ে তারপর দ্বিতীয়টি লতিকার মুখের দিকে বাড়িয়ে দিতেই শুনলেন, কী?
সরবিট্রেট!
থাক।
দুটো মানুষের শরীরে সাদা চাদর এমনভাবে পাশাপাশি টানটান যে আচমকা দেখলে দুটি মৃতদেহ মনে হওয়া অস্বাভাবিক হত না। লতিকার হাত বেরিয়ে এসে দিব্যজ্যোতির হাত আঁকড়ে ধরল। বাথরুমের খোলা কল তখন একটানা জল ঢেলে যাচ্ছে।

নিমগাছ-বনফুল


নিমগাছ
বনফুল

কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে।
পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ।
কেউ বা ভাজছে গরম তেলে।
খোস দাদ হাজা চুলকুনিতে লাগাবে।
চর্মরোগের অব্যর্থ মহৌষধ।
কচি পাতাগুলো খায়ও অনেকে।
এমনি কাঁচাই…..

কিংবা ভেজে বেগুন- সহযোগে।
যকৃতের পক্ষে ভারী উপকার।
কচি ডালগুলো ভেঙে চিবোয় কত লোক…। দাঁত ভালো থাকে।
কবিরাজরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
বাড়ির পাশে গজালে বিজ্ঞরা খুসী হন।
বলেন-“নিমের হওয়া ভাল, থাক, কেটো না।”
কাটে না, কিন্তু যত্নও করে না।
আবর্জনা জমে এসে চারিদিকে।
শান দিয়ে বাধিয়েও দেয় কেউ- সে আর এক আবর্জনা।
হঠাৎ একদিন একটা নূতন ধরণের লোক এল।
মুগ্ধ দৃষ্টিতে বেয়ে রইল নিমগাছের দিকে। ছাল তুললে না, পাতা ছিঁড়লে না, ডাল ভাঙ্গলে না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শুধু।
বলে উঠলো, “বাঃ কি সুন্দর পাতাগুলো…..কি রূপ। থোকা থোকা ফুলেরই বা কি বাহার….এক ঝাঁক নক্ষত্র নেমে এসেছে যেন নীল আকাশ থেকে সবুজ সায়রে। বাঃ–”
খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে চলে গেল।`
কবিরাজ নয়, কবি।
নিমগাছটার ইচ্ছে করতে লাগল লোকটার সঙ্গে চলে যায়। কিন্তু পারলে না।মাটির ভেতর শিকড় অনেক দূরে চলে গেছে। বাড়ির পিছনে আবর্জনার স্তূপের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইল সে।
ওদের বাড়ীর গৃহকর্ম-নিপুণা লক্ষ্ণী বউটার ঠিক এই দশা।

টোপ - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়


টোপ
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

সকালে একটা পার্সেল এসে পৌঁছেছে। খুলে দেখি এক জোড়া জুতো।
না, শত্রুপক্ষের কাজ নয়। এক জোড়া পুরোনো হেঁড়া জুতা পাঠিয়ে আমার সঙ্গে রসিকতার চেষ্টাও করেনি কেউ। চমৎকার ঝকঝকে বাঘের চামড়ার নতুন চটিা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়, পায়ে দিতে লজ্জা বোধ হয় দস্তুর মতো। ইচ্ছে করে বিছানায় শুইয়ে রাখি
কিন্তু জুতোজোড়া পাঠাল কে? কোথাও অর্ডার দিয়েছিলাম বলেও তো মনে পড়ছে না। আর বন্ধুদের সব কটাকেই তো চিনি, বিনামূল্যে এমন এক জোড়া জুতো পাঠানোর মতো দরাজ মেজাজ এবং ট্যাঁক কারো আছে বলেও জানি না তাহলে ব্যাপারটা কী?
খুব আশ্চর্য হব কি না ভাবছি, এমন সময় একখানা সবুজ রঙের কার্ড চোখে পড়লো। উইথ বেস্ট কমপ্লিমেন্টস অব রাজাবাহাদুর এন. আর. চৌধুরী, রামগঙ্গা এস্টেট!
আর তখুনি মনে পড়ে গেল। মনে পড়ল আট মাস আগেকার এক আরণ্যক ইতিহাস, একটি বিচিত্র শিকার-কাহিনী।
রাজাবাহাদুরের সঙ্গে আলাপের ইতিহাসটা ঘোলাটে, সূত্রগুলো এলোমেলো যতদূর মনে হয়, আমার এক সহপাঠী তার এস্টেটে চাকরি করত তারই যোগাযোগে রাজাবাহাদুরের এক জন্মবাসরে আমি একটা কাব্য-সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেছিলাম। ঈশ্বর গুপ্তের অনুপ্রাস চুরি করে যে প্রশস্তি রচনা করেছিলাম তার দুটো লাইন এই রকম —
ত্রিভুবন-প্রভাকর ওহে প্রভাকর,
গুণবান মহীয়ান হে রাজেন্দ্রবর।
ভূতলে অতুল কীর্তি রামচন্দ্র সম—
অরাতি-দমন ওহে তুমি নিরুপম।
কাব্যচর্চার ফললাভ হল একেবারে নগদ নগদ। পড়েছি—আকবরের সভাসদ আবদুর রহিম খানখানান হিন্দী কবি গঙ্গের চার লাইন কবিতা শুনে চার লক্ষ টাকা পুরষ্কার দিয়েছিলেন। দেখলাম সে নবাবী মেজাজের ঐতিহ্যটা গুণবান মহীয়ান অরাতিদমন মহারাজ এখনো বজায় রেখেছেন। আমার মতো দীনাতিদীনের ওপরেও রাজদৃষ্টি পড়ল, তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন, প্রায়ই চা খাওয়াতে লাগলেন, তারপর সামান্য একটা উপলক্ষ্য করে দামী একটা সোনার হাতঘড়ি উপহার দিয়ে বসলেন এক সময়ে সেই থেকে রাজাবাহাদুর সম্পর্কে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হয়ে আছি আমি। নিছক কবিতা মেলাবার জন্য বিশেষণগুলো ব্যবহার করেছিলাম, এখন সেগুলোকেই মন-প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতে সুরু করেছি।
রাজাবাহাদুরকে আমি শ্রদ্ধা করি। আর গুণগ্রাহী লোককে শ্রদ্ধা করাই তো স্বাভাবিক। বন্ধুরা বলে, মোসাহেব। কিন্তু আমি জানি ওটা নিছক গায়ের জ্বালা, আমার সৌভাগ্যে ওদের ঈর্ষা। তা আমি পরোয়া করি না। নৌকা বাঁধতে হলে বড় গাছ দেখে বাঁধাই ভালো, অন্তত ছোটখাটো ঝড়ঝাপটার আঘাতে সম্পূর্ণ নিরাপদ।
তাই মাস আষ্টেক আগে রাজাবাহাদুর যখন শিকারে তাঁর সহযাত্রী হওয়ার জন্যে আমাকে। নিমন্ত্রণ জানালেন তখন তা আমি ঠেলতে পারলাম না। কলকাতার সমস্ত কাজকর্ম ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে পড়া গেল। তা ছাড়া গোরা সৈন্যদের মাঝে মাঝে রাইফেল উঁচিয়ে শকুন। মারতে দেখা ছাড়া শিকার সম্বন্ধে কোনো স্পষ্ট ধারণাই নেই আমার। সেদিক থেকেও মনের ভেতরে গভীর এবং নিবিড় একটা প্রলোভন ছিল।
জঙ্গলের ভেতরে ছোট একটা রেললাইনে আরো ছোট একটা স্টেশনে গাড়ী থামল। নামবার সঙ্গে সঙ্গে সোনালী-তকমা-আঁটা ঝকঝকে-পপাশাক-পরা আর্দালি এসে সেলাম দিল আমাকে। বললে—হুজুর চলুন।
স্টেশনের বাইরে মেটে রাস্তায় দেখি মস্ত একখানা গাড়ি যার পুরো নাম রোলস রয়েস, সংক্ষেপে যাকে বলে ‘রোজ’। তা ‘রোজ’ই বটে। মাটিতে চলল না রাজহাঁসের মতো হাওয়ায় ভেসে গেল সেটা ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারলাম না। চামড়ার খটখটে গদী নয়, লাল মখমলের কুশনা হেলান দিতে সংকোচ হয়, পাছে মাথার সস্তা নারকেল তেলের দাগ ধরে যায়। আর বসবার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হয়—সমস্ত পৃথিবীটা নিচের মাটির ঢেলার মতো গুঁড়িয়ে যাক—আমি এখানে সুখে এবং নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়তে পারি।
হাঁসের মতো ভেসে চলল ‘রোজা মেটে রাস্তায় চলেছে অথচ এতটুকু ঝাঁকুনি নেই। ইচ্ছে হলো একবার ঘাড় বার করে দেখি গাড়িটা ঠিক মাটি দিয়েই চলেছে, না দুহাত ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে ওর চাকাগুলো।
পথের দুপাশে তখন নতুন একটা জগতের ছবি সবুজ শালবনের আড়ালে আড়ালে চা বাগানের বিস্তার চকচকে উজ্জ্বল পাতার শান্ত, শ্যামল সমুদ্র। দূরে আকাশের গায়ে কালো পাহাড়ের রেখা।
ক্রমশ চা-বাগান শেষ হয়ে এল, পথের দুপাশে ঘন হয়ে দেখা দিতে লাগল অবিচ্ছিন্ন শালবন। একজন আর্দালি জানাল, হুজুর, ফরেস্ট এসে পড়েছে।
ফরেস্টই বটে। পথের ওপর থেকে সূর্যের আলো সরে গেছে, এখন শুধু শান্ত আর বিষণ্ণ ছায়া। রাত্রির শিশির এখনও ভিজিয়ে রেখেছে পথটাকে। ‘রোজে’র নিঃশব্দ চাকার নীচে মড় মড় করে সাড়া তুলছে শুকনো শালের পাতা। বাতাসে গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টির মতো শালের ফুল ঝরে পড়ছে পথের পাশে, উড়ে আসছে গায়ে কোথা থেকে চকিতের জন্যে ময়ূরের তীক্ষ্ণ চীৎকার ভেসে এল। দু পাশে নিবিড় শালের বন, কোথাও কোথাও ভেতর দিয়ে খানিকটা দৃষ্টি চলে, কখনো কখনো বুনো ঝোপে আচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে এক টুকরো কাঠের গায়ে লেখা ১৯৩৫, ১৯৪০। মানুষ বনকে শুধু উচ্ছন্ন করতে চায় না, তাকে বাড়াতেও চায়। এই সব প্লটে বিভিন্ন সময়ে নতুন করে শালের চারা রোপণ করা হয়েছে, এ তারই নির্দেশ।
বনের রূপ দেখতে দেখতে চলেছি। মাঝে মাঝে ভয় যে না করছিল এমন নয়। এই ঘন। জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ যদি গাড়ির এঞ্জিন খারাপ হয়ে যায়, আর তাক বুঝে যদি লাফ মারে একটা বুনো জানোয়ার, তা হলে—
তা হলে পকেটের ফাউন্টেন পেনটা ছাড়া আত্মরক্ষার আর কোনো অস্ত্রট সঙ্গে নেই।
শেষটায় আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসা করে বসলম—হ্যাঁরে, এখানে বাঘ আছে?
ওরা অনুকম্পার হাসি হাসল।
–হাঁ, হুজুর।
—ভালুক?
রাজা-রাজড়ার সহবৎ, কাজেই যতটুকু জিজ্ঞাসা করব ঠিক ততটুকুই উত্তর। ওরা বলল—হাঁ হুজুর।
—অজগর সাপ?
—জী মালিক।
প্রশ্ন করার উৎসাহ ওই পর্যন্ত এসে থেমে গেল আমার। যে রকম দ্রুত উত্তর দিয়ে যাচ্ছে তাতে কোনো প্রশ্নই যে ‘না’ বলে আমাকে আশ্বস্ত করবে এমন তো মনে হচ্ছে না। যতদূর মনে হচ্ছিল গেরিলা, হিপোপোটেমাস, ভ্যাম্পায়ার কোনো কিছুই বাকি নেই। এখানে জুলু কিংবা ফিলিপিনেরাও বিষাক্ত বুমেরাং বাগিয়ে আছে কি না এবং মানুষ পেলে তারা বেগুন-পোড়া করে খেতে ভালবাসে কি না, এ জাতীয় একটা কুটিল জিজ্ঞাসাও আমার মনে জেগে উঠেছে ততক্ষণে কিন্তু নিজেকে সামলে নিলাম।
খানিকটা আসতেই গাড়িটা ঘস ঘস করে ব্রেক কষল একটা আমি প্রায় আর্তনাদ করে উঠলাম—কি রে, বাঘ নাকি?
আর্দালিরা মুচকে হাসল–না হুজুর, এসে পড়েছি।
ভালো করে তাকিয়ে দেখি, সত্যিই তো এসে পড়েছি সন্দেহ নেই। পথের বাঁ দিকে ঘন শালবনের ভেতরে একটুখানি ফাঁকা জমি। সেখানে কাঠের তৈরি বাংলো প্যাটার্নের একখানা দোতলা বাড়ি। এই নিবিড় জঙ্গলের ভেতর যেমন আকস্মিক, তেমনি অপ্রত্যাশিত
গাড়ির শব্দে বাড়িটার ভেতর থেকে দু-তিন জন চাপরাসী বেরিয়ে এল ব্যতিব্যস্ত হয়ে। এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি, এবার দেখলাম বাড়ির সামনে চওড়া একটা গড়খাই কাটা। লোকগুলো ধরাধরি করে মস্ত বড় একফালি কাঠ খাদটার ওপরে সাঁকোর মতো বিছিয়ে দিলো তারই ওপর দিয়ে গাড়ি দিয়ে দাঁড়াল রাজাবাহাদুর এন.আর.চৌধুরীর হান্টিং বাংলোর সামনে।
আরে আরে কী সৌভাগ্য! রাজাবাহাদুর স্বয়ং এসে বারান্দায় দাঁড়িয়েছেন আমার অপেক্ষায়। এক গাল হেসে বললেন, আসুন, আসুন, আপনার জন্য আমি এখনো চা পর্যন্ত খাইনি।
শ্রদ্ধায় আর বিনয়ে আমার মাথা নিচু হয়ে গেল। মুখে কথা যোগাল না, শুধু বেকুবের মতো কৃতার্থের হাসি হাসলাম একগালা
রাজাবাহাদুর বললেন—এত কষ্ট করে আপনি যে আসবেন সে ভাবতেই পারিনি। বড় আনন্দ হল। চলুন চলুন, ওপরে চলুন।
এত গুণ না থাকলে কি আর রাজা হয়! একেই বলে রাজোচিত বিনয়।
রাজাবাহাদুর বললেন—আগে স্নান করে রিফ্রেশড হয়ে আসুন, টি ইজ গেটিং রেডি বোয়, সাহেব কো গোসলখানামে লে যাও।
চল্লিশ বছরের দাড়িওয়ালা বয় নিঃসন্দেহে বাঙালী। তবু হিন্দী করে হুকুমটা দিলেন রাজাবাহাদুর, কারণ ওটাই রাজকীয় দস্তুর। বয় আমাকে গোসলখানায় নিয়ে গেল।
আশ্চর্য, এই জঙ্গলের ভেতরও এত নিখুঁত আয়োজন! এমন একটা বাথরুমে জীবনে আমি স্নান করিনি। ব্র্যাকেটে তিন-চারখানা সদ্য পাট-ভাঙা নতুন ভোয়ালে, তিনটে দামী সোপকেসে তিন রকমের নতুন সাবান, যাকে দামী দামী তেল, লাইমজুস অতিকায় বাথটাব, ওপরে ঝাঁঝরি। নিচে টিউবওয়েল থেকে পাম্প করে এখানে ধারাস্নানের ব্যবস্থা একেবারে রাজকীয় কারবার কে বলবে এটা কলকাতার গ্র্যান্ড হোটেল নয়!
স্নান হয়ে গেল। ব্রাকেটে ধোপদুরস্ত করা ফরাসডাঙার ধুতী, সিলকের লুঙ্গি, আদ্দির পাজামা দামের দিক থেকে পাজামাটাই সস্তা মনে হল, তাই পরে নিলাম।
বয় বাইরেই দাঁড়িয়েছিল, নিয়ে গেল ড্রেসিংরুমে। ঘরজোড়া আয়না, পৃথিবীর যা কিছু প্রসাধনের জিনিস কিছু আর বাকি নেই এখানে
ড্রেসিংরুম থেকে বেরুতে সোজা ডাক পড়ল রাজাবাহাদুরের লাউঞ্জে রাজাবাহাদুর একখানা চেয়ারে চিত হয়ে শুয়ে ম্যানিলা চুরুট খাচ্ছিলেন। বললেন, আসুন চা তৈরী।
চায়ের বর্ণনা না করাই ভালো। চা, কফি, কোকো, ওভালটিন, রুটি, মাখন, পনির, চর্বিতে জমাট ঠাণ্ডা মাংস। কলা থেকে আরম্ভ করে পিচ পর্যন্ত প্রায় দশ রকমের ফল।
সেই গন্ধমাদন থেকে যা পারি গোগ্রাসে গিলে চললাম আমি। রাজাবাহাদুর কখনো এক টুকরো রুটি খেলেন, কখনো একটু ফল। অর্থাৎ কিছুই খেলেন না, শুধু পর পর কাপ তিনেক চা ছাড়া। তারপর আর একটা চুরুট ধরিয়ে বললেন—একবার জানালা দিয়ে চেয়ে দেখুন।
দেখলাম প্রকৃতির এমন অপূর্ব রূপ জীবনে আর দেখিনি। ঠিক জানলার নিচেই মাটিটা খাড়া তিন চারশো ফুট নেমে গেছে বাড়িটা যেন ঝুলে আছে সেই রাক্ষুসে শূন্যতার ওপরে। তলায় দেখা যাচ্ছে ঘন জঙ্গল, তার মাঝ দিয়ে পাহাড়ী নদীর একটা সঙ্কীর্ণ নীলোজ্জল রেখা যতদূর দেখা যায়, বিস্তীর্ণ অরণ্য চলেছে প্রসারিত হয়ে তার সীমান্তে নীল পাহাড়ের প্রহরা।
আমার মুখ দিয়ে বেরুলো—চমৎকার!
রাজাবাহাদুর বললেন রাইট। আপনারা কবি মানুষ, আপনাদের তো ভালো লাগবেই আমারই মাঝে মাঝে কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে মশাই। কিন্তু নিচের ওই যে জঙ্গলটি দেখতে পাচ্ছেন ওটি বড় সুবিধের জায়গা নয়। টেরাইয়ের ওয়ান অব দি ফিয়ার্সেস্ট ফরেস্টস। একেবারে প্রাগৈতিহাসিক হিংস্রতার রাজত্ব।
আমি সভয়ে জঙ্গলটার দিকে তাকালাম। ওয়ান অব দি ফিয়ার্সেস্ট! কিন্তু ভয় পাওয়ার মতো কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না। চারশো ফুট নিচে ওই অতিকায় জঙ্গলটাকে একটা নিরবচ্ছিন্ন বেঁটে গাছের ঝোপ বলে মনে হচ্ছে, নদীর রেখাটাকে দেখাচ্ছে উজ্জ্বল একখানা পাতার মতো। আশ্চর্য সবুজ, আশ্চর্য সুন্দর। অফুরন্ত রোদে ঝলমল করছে অফুরন্ত প্রকৃতি-পাহাড়টা যেন গাঢ় নীল রঙ দিয়ে আঁকা। মনে হয়, উপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়লে ওই স্তব্ধ গম্ভীর অরণ্য যেন আদর করে বুকে টেনে নেবে রাশি রাশি পাতার একটা নরম বিছানার ওপরে। অথচ–
আমি বললাম—ওখানেই শিকার করবে নাকি? ক্ষেপেছেন, নামব কী করে! দেখছেন তো, পেছনে চারশো ফুট খাড়া পাহাড়। আজ পর্যন্ত ওখানে কোনো শিকারীর বন্দুক গিয়ে পৌঁছোয় নি। তবে হ্যাঁ, ঠিক শিকার করি না বটে, আমি মাঝে মাঝে মাছ ধরি ওখান থেকে।
—মাছ ধরেন!—আমি হাঁ করলাম মাছ ধরেন কিরকম? ওই নদী থেকে নাকি?
—সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য দরকার হলে পরে দেখতে পাবেন রাজাবাহাদুর রহস্যময় ভাবে। মুখ টিপে হাসলেনা আপাতত শিকারের আয়োজন করা যাক, কিছু না জুটলে মাছের চেষ্টাই করা। যাবো তবে ভালো টোপ ছাড়া আমার পছন্দ হয় না, আর তাতে অনেক হাঙ্গামা।
—কিছু বুঝতে পারছি না।
রাজাবাহাদুর জবাব দিলেন না, শুধু হাসলেন। তারপর ম্যানিলা চুরুটের খানিকটা সুগন্ধি ধোঁয়া ছড়িয়ে বললেন—আপনি রাইফেল ছুঁড়তে জানেন?
বুঝলাম কথাটি চাপা দিতে চাইছেন। সঙ্গে সঙ্গে জিহ্বাকে দমন করে ফেললাম, এর পরে আর কিছু জিজ্ঞাসা করাটা সঙ্গত হবে না, শোভনও নয়। সেটা কোর্ট-ম্যানারের বিরোধী।
রাজাবাহাদুর আবার বললেন, রাইফেল ছুঁড়তে পারেন?
বললাম—ছেলেবেলায় এয়ার গান ছুঁড়েছি।
রাজাবাহাদুর হেসে উঠলেন—তা বটে। আপনারা কবি মানুষ, ওসব অস্ত্রশস্ত্রের ব্যাপার আপনাদের মানায় না। আমি অবশ্য বারো বছর বয়সেই রাইফেল হাতে তুলে নিয়েছিলাম আপনি চেষ্টা করে দেখুন না, কিছু শক্ত ব্যাপার নয়।
উঠে দাঁড়ালেন রাজাবাহাদুরা ঘরের একদিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁকে অনুসরণ করে আমি দেখলাম—এ শুধু লাউঞ্জ নয়, রীতিমতো একটা ন্যাচারাল মিউজিয়াম এবং অস্ত্রাগার। খাওয়ার টেবিলেই নিমগ্ন ছিলাম বলে এতক্ষণ দেখতে পাইনি, নইলে এর আগেই চোখে পড়া উচিত ছিল।
চারিদিকে সারি সারি নানা আকারের আগ্নেয়াস্ত্র। গোটাচারেক রাইফেল, ছোট বড় নানা রকম চেহারা। একটা হুকের সঙ্গে খাপে আঁটা একজোড়া রিভলভার ঝুলছে তার পাশেই ঝুলছে খোলা একখানা লম্বা শেফিল্ডের তলোয়ার—সূর্যের আলোর মতো তার ফলার নিষ্কলঙ্ক রঙা মোটা। চামড়ার বেলটে ঝকঝকে পেতলের কার্তুজ রাইফেলের, রিভলভারের। জরিদার খাপে খান তিনেক নেপালী ভোজালি। আর দেয়ালের গায়ে হরিণের মাথা, ভালুকের মুখ, নানা রকমের চামড়া–বাঘের, সাপের, হরিণের, গো-সাপের একটা টেবিলে অতিকায় হাতীর মাথা—দুটো বড় বড় দাঁত এগিয়ে আছে সামনের দিকে। বুঝলাম—এরা রাজাবাহাদুরের বীরকীর্তির নিদর্শন।
ছোট একটা রাইফেল তুলে নিলেন রাজাবাহাদুর, বললেন—এটা লাইট জিনিস। তবে ভালো রিপিটার অনায়াসে বড় বড় জানোয়ার ঘায়েল করতে পারে।
আমার কাছে অবশ্য সবই সমান। লাইট রিপিটার যা, হাউইটজার কামানও তাই তবু সৌজন্য রক্ষার জন্যে বলতে হলো—বাঃ, তবে তো চমৎকার জিনিস!
রাজাবাহাদুর রাইফেলটা বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে তা হলে চেষ্টা করুন। লোড করাই আছে, ছুঁড়ুন ওই জানালা দিয়ে।
আমি সভয়ে তিন পা পিছিয়ে গেলাম। জীবনে বেকুবি অনেক করেছি, কিন্তু তার পরিমাণটা আর বাড়াতে প্রস্তুত নই। যুদ্ধ-ফেরত এক বন্ধুর মুখে তাঁর রাইফেল ছোঁড়ার প্রথম অভিজ্ঞতা শুনেছিলাম—পড়ে গিয়ে পা ভেঙে নাকি তাঁকে একমাস বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছিল। নিজেকে যতদূর জানি—আমার ফাঁড়া শুধু পা ভাঙার ওপর দিয়েই কাটবে বলে মনে হয় না।
বললাম—ওটা এখন থাক, পরে হবে না হয়।
রাজাবাহাদুর মৃদু কৌতুকের হাসি হাসলেন। বললেন—এখন ভয় পাচ্ছেন, কিন্তু একবার ধরতে শিখলে আর ছাড়তে চাইবেন না। হাতে থাকলে বুঝবেন কত বড় শক্তিমান আপনি ইউ ক্যান ইজিলি ফেস অল দ্য রাস্কেলস অব—অব—
হঠাৎ তাঁর চোখ ঝকঝক করে উঠল। মৃদু হাসিটা মিলিয়ে গিয়ে শক্ত হয়ে উঠল মুখের পেশীগুলো অ্যান্ড এ রাইভ্যাল–
মুহূর্তে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল আমার। রাজাবাহাদুরের দু’চোখে বন্য হিংসা, রাইফেলটা এমন শক্ত মুঠিতে বাগিয়ে ধরেছেন যেন সামনে কাউকে গুলি করবার জন্যে তৈরী হচ্ছেন তিনি। উত্তেজনার ঝোঁকে আমাকেই যদি লক্ষ্যভেদ করে বসেন তা হলে—
আতঙ্কে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। কিন্তু ততক্ষণে মেঘ কেটে গেছে–রাজা রাজড়ার মেজাজ! রাজাবাহাদুর হাসলেনা।
—ওয়েল, পরে আপনাকে তালিম দেওয়া যাবে। সবই তো রয়েছে, যেটা খুশি আপনি ট্রাই করতে পারেন। চলুন, এখন বারান্দায় গিয়ে বসা যাক, লেটস হ্যাভ সাম এনার্জি।
প্রাতরাশেই প্রায় বিন্ধ্যপর্বত উদরসাৎ করা হয়েছে, আর কি হলে এনার্জি সঞ্চিত হবে বোঝা শক্ত। কিন্তু কথাটা বলেই রাজাবাহাদুর বাইরের বারান্দার দিকে পা বাড়িয়েছেন। সুতরাং আমাকেও পিছু নিতে হল।
বাইরের বারান্দায় বেতের চেয়ার, বেতের টেবিল। এখানে ঢোকবার পরে এমন সব বিচিত্র রকমের আসনে বসছি যে আমি প্রায় নার্ভাস হয়ে উঠেছি। তবু যেন বেতের চেয়ারে বসতে পেয়ে খানিকটা সহজ অন্তরঙ্গতা অনুভব করা গেল। এটা অন্তত চেনা জিনিস।
আর বসবার সঙ্গে সঙ্গেই বোঝা গেল এনার্জি কথাটার আসল তাৎপর্য কি। বেয়ারা তৈরীই ছিল, ট্রেতে করে একটি ফেনিল গ্লাস সামনে এনে রাখল। অ্যালকোহলের উগ্র গন্ধ ছড়িয়ে গেল বাতাসে।
রাজাবাহাদুর স্মিত হাস্যে বললেন—চলবে?
সবিনয়ে জানালাম, না।
—তবে বিয়ার আনবে? একেবারে মেয়েদের ড্রিঙ্ক! নেশা হবে না।
–না থাক। অভ্যেস নেই কোনোদিন।
–হুঁ, গুড কন্ডাক্টের প্রাইজ পাওয়া ছেলে! রাজাবাহাদুরের সুরে অনুকম্পার আভাস আমি কিন্তু চোদ্দ বছরের বয়সেই প্রথম ড্রিঙ্ক ধরি।
রাজা-রাজড়ার ব্যাপার—সবই অলৌকিক জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গেই কেউটের বাচ্চা। সুতরাং মন্তব্য অনাবশ্যক। ট্রে বার বার যাতায়াত করতে লাগল। রাজাবাহাদুরের প্রখর উজ্জ্বল চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে এল ক্রমশ, ফর্সা মুখ গোলাপী রং ধরল। হঠাৎ অসুস্থ দৃষ্টিতে তিনি আমার দিকে তাকালেন।
—আচ্ছা বলতে পারেন, আপনি রাজা নন কেন?
এ রকম একটা প্রশ্ন করলে বোকার মতো দাঁত বের করে থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই। আমিও তাই করলাম
—বলতে পারলেন না?
–না।
—আপনি মানুষ মারতে পারেন?
এ আবার কী রকম কথা! আমার আতঙ্ক জাগল।
–না।
তা হলে বলতে পারবেন না। ইউ আর অ্যাবসোলিউটলি হোপলেস।
উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ালেন রাজাবাহাদুর। বলে গেলেন আই পিটি ইউ।
বুঝলাম নেশাটা চড়েছে। আমি আর কথা বাড়ালাম না, চুপ করে বসে রইলাম সেখানেই। খানিক পরেই ঘরের ভেতরে নাক ডাকার শব্দ। তাকিয়ে দেখি তাঁর লাউঞ্জের সেই চেয়ারটায় হাঁ করে ঘুমুচ্ছেন রাজাবাহাদুর, মুখের কাছে কতকগুলো মাছি উড়ছে ভনভন করে।
* * * *
সেইদিন রাত্রেই শিকারের প্রথম অভিজ্ঞতা।
জঙ্গলের ভেতর বসে আছি মোটরে। দুটো তীব্র হেডলাইটের আলো পড়েছে সামনের সঙ্কীর্ণ পথে আর দুধারের শালবনে। ওই আলোর রেখার বাইরে অবশিষ্ট জঙ্গলটায় যেন প্রেতপুরীর। জমাট অন্ধকার রাত্রির তমসায় আদিম হিংসা সজাগ হয়ে উঠেছে চারিদিকে অনুভব করছি সমস্ত স্নায়ু দিয়ে। এখানে হাতীর পাল ঘুরছে দূরের কোনো পাহাড়ের পাথর গুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, ঝোপের ভেতরে অজগর প্রতীক্ষা করে আছে অসতর্ক শিকারের আশায়, আসন্ন বিপদের সম্ভাবনায় উৎকর্ণ হয়ে আছে হরিণের পাল আর কোনো একটা খাদের ভেতরে জ্বলজ্বল করছে। ‘ক্ষুধার্ত বাঘের চোখা কালো রাত্রিতে জেগে আছে কালো অরণ্যের প্রাথমিক জীবনা।
রোমাঞ্চিত ভীত প্রতীক্ষায় চুপ করে বসে আছি মোটরের মধ্যেকিন্তু হিংসার রাজত্ব শালবন। ডুবে আছে একটা আশ্চর্য স্তব্ধতায়। শুধু কানের কাছে অবিশ্রান্ত মশার গুঞ্জন ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। মাঝে মাঝে অল্প বাতাস দিচ্ছে—শালের পাতায় উঠেছে এক একটা মৃদু মর্মর। আর কখনো ডাকছে বনমুরগী, ঘুমের মধ্যে পাখা ঝাপটাচ্ছে ময়ূর। মনে হচ্ছে এই গভীর ভয়ঙ্কর অরণ্যের প্রাণীগুলো যেন নিশ্বাস বন্ধ করে একটা নিশ্চিত কোনো মুহূর্তের প্রতীক্ষা করে আছে।
আমরাও প্রতীক্ষা করে আছি। মোটরের মধ্যে নিঃসাড় হয়ে বসে আছি আমরা—একটি কথাও বলবার উপায় নেই। রাইফেলের নল এঞ্জিনের ওপরে বাড়িয়ে দিয়ে শিকারী বাঘের মতোই তাকিয়ে আছেন রাজবাহাদুর। চোখ দুটো উগ্র প্রখর হয়ে আছে হেডলাইটের তীব্র আলোক রেখাটার দিকে, একটা জানোয়ার ওই রেখাটা পেরুবার দুঃসাহস করলেই রাইফেল গর্জন করে উঠবে।
কিন্তু জঙ্গলের সেই আশ্চর্য স্তব্ধতা অরণ্য যেন আজ রাত্রে বিশ্রাম করছে, একটি রাত্রের জন্য। ক্লান্ত হয়ে জানোয়ারগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে খাদের ভেতরে, ঝোপের আড়ালে কেটে চলেছে মন্থর সময়। রাজাবাহাদুরের হাতের রেডিয়াম ডায়াল ঘড়িটা একটা সবুজ চোখের মত জ্বলছে, রাত দেড়টা পেরিয়ে গেছে। ক্রমশ উসখুস করছেন উৎকীর্ণ রাজবাহাদুরনাঃ হোপলেস! আজ আর পাওয়া যাবে না।
বহুদূর থেকে একটা তীক্ষ্ণ গম্ভীর শব্দ, হাতীর ডাকা ময়ূরের পাখা-ঝাপটানি চলছে মাঝে মাঝে এক ফাঁকে একটা প্যাঁচা চেঁচিয়ে উঠল, রাত্রি ঘোষণা করে গেল শেয়ালের দল। কিন্তু কোথায় বাঘ, কোথায় বা ভালুক? অন্ধকার বনের মধ্যে দ্রুত কতকগুলো ছুটন্ত খুরের আওয়াজ পালিয়ে গেল হরিণের পালা
কিন্তু কোনো ছায়া পড়ছে না আলোকবৃত্তের ভেতরে। মশার কামড় যেন অসহ্য হয়ে উঠেছে।
–বৃথাই গেল রাতটা। রাজাবাহাদুরের কণ্ঠস্বরে পৃথিবীর সমস্ত বিরক্তি ভেঙে পড়ল ডেভিল লাক! সীটের পাশ থেকে একটা ফ্লাসক তুলে নিয়ে ঢক ঢক করে ঢাললেন গলাতে, ছড়িয়ে পড়ল হুইস্কির কটু গন্ধ।
–থ্যাঙ্ক হেনস!–রাজবাহাদুর হঠাৎ নড়ে বসলেন সচকিত হয়ো নক্ষত্রবেগে হাতটা চলে গেল রাইফেলের ট্রিগারো শিকার এসে পড়েছে। আমিও দেখলাম। বহুদূর থেকে আলোর রেখাটার ভেতর কী একটা জানোয়ার দাঁড়িয়ে আছে স্থির হয়ে। এমন একটা জোরালো আলো চোখে পড়াতে কেমন দিশেহারা হয়ে গেছে, তাকিয়ে আছে এই দিকেই। দুটো জোনাকির বিন্দুর মতো চিক চিক করছে তার চোখ।
–ড্যাম! রাইফেল থেকে হাত সরিয়ে নিলেন রাজবাহাদুর, কিন্তু পরমুহূর্তেই চাপা উত্তেজিত গলায় বললেন—থাক, আজ ছুঁচোই মারব।
দুম করে রাইফেল গর্জন করে উঠল। কানে তালা ধরে গেল আমার, বারুদের গন্ধে বিস্বাদ হয়ে উঠল নাসারন্ধ্র। অব্যর্থ লক্ষ্য রাজবাহাদুরের—পড়েছে জানোয়ারটা।
ড্রাইভার বললে—তুলে আনব হুজুর?
বিকৃতমুখে রাজবাহাদুর বললেন, কী হবে? গাড়ি ঘোরাও।
রেডিয়াম ডায়ালের সবুজ আলোয় রাত তিনটো গাড়ি ফিরে চলল হান্টিং বাংলোর দিকে। একটা ম্যানিলা চুরুট ধরিয়ে রাজবাহাদুর আবার বললেন—ড্যাম!
কিন্তু কী আশ্চর্যজঙ্গল যেন রসিকতা সুরু করেছে আমাদের সঙ্গে। দিনের বেলা অনেক চেষ্টা। করেও দুটো একটা বনমুরগী ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না—এমন কি একটা হরিণ পর্যন্ত নয়। নাইট-শুটিংয়ে সেই অবস্থা। পর পর তিন রাত্রি জঙ্গলের নানা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে চেষ্টা করা হল, কিন্তু নগদ লাভ যা ঘটল তা অমানুষিক মশার কামড়। জঙ্গলের হিংস্র জন্তুর সাক্ষাৎ মিলল না বটে, কিন্তু মশাগুলো চিনতে পারা গেল। এমন সাংঘাতিক মশা যে পৃথিবীর কোথাও থাকতে পারে এতদিন এ ধারণা ছিল না আমার।
তবে মশার কামড়ের ক্ষতিপূরণ চলতে লাগল গন্ধমাদন উজাড় করে। সত্যি বলতে কি, শিকার করতে না পারলেও মনের দিক থেকে বিন্দুমাত্র ক্ষোভ ছিল না আমার। জঙ্গলের ভেতরে এমন রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন কল্পনারও বাইরে। জীবনে এমন দামী খাবার কোনো দিন মুখে তুলিনি, এমন চমৎকার বাথরুমে স্নান করিনি কখনো, এত পুরু জাজিমের বিছানায় শুয়ে অস্বস্তিতে প্রথম দিন তো ঘুমুতেই পারিনি আমি নিবিড় জঙ্গলের নেপথ্যে গ্র্যান্ড হোটেলের স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাচ্ছি—শিকার না হলেও কণামাত্র ক্ষতি নেই আমার। প্রত্যেক দিনই লাউঞ্জে চা খেতে খেতে চারশো ফুট নিচেকার ঘন জঙ্গলটার দিকে চোখ পড়ো সকালের আলোয় উদ্ভাসিত শ্যামলতা দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তীর্ণ হয়ে আছে অপরূপ প্রসন্নতায়। ওয়ান অব দি ফিয়ার্সেস্ট ফরেস্ট, বিশ্বাস হয় না। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি বাতাসে আকার-অবয়বহীন পত্রাবরণ সবুজ সমুদ্রের মতো দুলছে, চক্র দিচ্ছে পাখির দল—এখান থেকে মৌমাছির মতো দেখায় পাখীগুলোকে জানালার ঠিক নিচেই ইস্পাতের ফলার মতো পাহাড়ী নদীটার নীলিমোজ্জ্বল রেখা—দুটো একটা নুড়ি ঝকমক করে মণিখণ্ডের মতো। বেশ লাগে।
তার পরেই চমক ভাঙে আমার। তাকিয়ে দেখি ঠোঁটের কোণে ম্যানিলা চুরুট পুড়ছে, অস্থির চঞ্চল পায়ে রাজবাহাদুর ঘরের ভেতরে পায়চারি করছেনা চোখেমুখে একটা চাপা আক্রোশ ঠোঁট দুটোয় নিষ্ঠুর কঠিনতা। কখনো একটা রাইফেল তুলে নিয়ে বিরক্তিভরে নামিয়ে রাখেন। কখনো ভোজালি তুলে নিয়ে নিজের হাতের ওপরে ফলাটা পরীক্ষা করেন সেটার ধার আবার কখনো বা জানালার সামনে খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন নিচের জঙ্গলটার দিকে। আজ তিন দিন থেকে উল্লেখযোগ্য একটা কিছু শিকার করতে পারেন নি ক্ষোভে তাঁর দাঁতগুলো কড়মড় করতে থাকে।
তার পরেই বেরিয়ে যান এনার্জি সংগ্রহের চেষ্টায় বাইরের বারান্দায় গিয়ে হাঁক দেন—পেগ।
কিন্তু পরের পয়সায় রাজভোগ খেয়ে এবং রাজোচিত বিলাস করে বেশি দিন কাটানো আর সম্ভব নয়—আমার পক্ষে। রাজবাহাদুরের অনুগ্রহ একটি দামী জিনিস বটে, কিন্তু কলকাতায় আমার ঘর-সংসার আছে, একটা দায়িত্ব আছে তার। সুতরাং চতুর্থ দিন সকালে কথাটা আমাকে পাড়তে হল।
বললাম, এবার আমাকে বিদায় দিন তা হলে
রাজবাহাদুর সবে চতুর্থ পেগে চুমুক দিয়েছেন তখন। তেমনি অসুস্থ আর রক্তাভ চোখে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, আপনি যেতে চান?
–হ্যাঁ, কাজকর্ম রয়েছে—
—কিন্তু আমার শিকার আপনাকে দেখাতে পারলাম না।
—সে না হয় আর একবার হবে।
—হুমা চাপা ঠোঁটের ভেতরেই একটা গম্ভীর আওয়াজ করলেন রাজাবাহাদুর আপনি ভাবছেন আমার ওই রাইফেলগুলো, দেওয়ালে ওই সব শিকারের নমুনা—ওগুলো সব ফার্স?
আমি সন্ত্রস্ত হয়ে বললাম, না, না, তা কেন ভাবতে যাব! শিকার তো খানিকটা অদৃষ্টের ব্যাপার–
—হুম! অদৃষ্টকেও বদলানো চলে রাজাবাহাদুর উঠে পড়লেন আমার সঙ্গে আসুন।
 দুজনে বেরিয়ে এলাম রাজাবাহাদুর আমাকে নিয়ে এলেন হান্টিং বাংলোর পেছন দিকটাতো ঠিক সেখানে—যার চারশো ফুট নিচে টেরাইয়ের অন্যতম হিংস্র অরণ্য বিস্তীর্ণ হয়ে আছে।
এখানে আসতে আর একটা নতুন জিনিস চোখে পড়ল দেখি কাঠের একটা রেলিং দেওয়া সাঁকোর মতন জিনিস সেই সীমাহীন শূন্যতার ওপরে প্রায় পনেরো মোল হাত প্রসারিত হয়ে আছে। তার পাশে দুটো বড় বড় কাঠের চাকা, তাদের সঙ্গে দুজোড়া মোটা কাছি জড়ানো। ব্যাপারটা কী ঠিক বুঝতে পারলাম না।
—আসুন। রাজবাহাদুর সেই ঝুলন্ত সাঁকোটার ওপরে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমিও গেলাম তাঁর পেছনে পেছনে একটা আশ্চর্য বন্দোবস্ত। ঠিক সাঁকোটার নিচেই পাহাড়ী নদীটার রেখা, নুড়ি মেশানো সঙ্কীর্ণ বালুতট তার দুপাশে, তাছাড়া জঙ্গল আর জঙ্গল। নিচে তাকাতে আমার মাথা ঘুরে উঠল। রাজবাহাদুর বললেন, জানেন এসব কী?
–না।
আমার মাছ ধরবার বন্দোবস্ত। এর কাজ খুব গোপনে নানা হাঙ্গামা আছে। কিন্তু অব্যর্থ।
—ঠিক বুঝতে পারছি না।
—আজ রাত্রেই বুঝতে পারবেন। শিকার দেখাতে আপনাকে ডেকে এনেছি, নতুন একটা শিকার দেখাব কিন্তু কোনোদিন এর কথা কারো কাছে প্রকাশ করতে পারবেন না।
কিছু না বুঝেই মাথা নাড়লাম–না।
–তা হলে আজ রাতটা অবধি থাকুন। কাল সকালেই আপনার গাড়ীর ব্যবস্থা করব। রাজবাহাদুর আবার হান্টিং বাংলোর সম্মুখের দিকে এগোলেন কাল সকালের পর এমনিতেই আপনার আর এখানে থাকা চলবে না।
একটা কাঠের সাঁকো, দুটো কপিকলের মতো জিনিস। মাছ ধরার ব্যবস্থা কাউকে বলা যাবে এবং কাল সকালেই চলে যেতে হবে সবটা মিলিয়ে যেন রহস্যের খাসমহল একেবারে আমার কেমন এলোমেলো লাগতে লাগল সমস্ত। কিন্তু ভালো করে জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। রাজাবাহাদুরকে বেশি প্রশ্ন করতে কেমন অস্বস্তি লাগে আমার অনধিকার-চর্চা মনে হয়।
বাংলোর সামনে তিন চারটে ছোট ছোট নোংরা ছেলেমেয়ে খেলা করে বেড়াচ্ছে, হিন্দুস্থানী কীপারটার বেওয়ারিশ সম্পত্তি। কীপারটাকে সকালে রাজাবাহাদুর শহরে পাঠিয়েছেন, কিছু দরকারী জিনিসপত্র কিনে কাল সে ফিরবো ভারী বিশ্বাসী আর অনুগত লোক। মাতৃহীন ছেলেমেয়েগুলো সারাদিন হুটোপাটি করে ডাকবাংলোর সামনে রাজবাহাদুর বেশ অনুগ্রহের চোখে দেখেন ওদের। দোতলার জানলা থেকে পয়সা, রুটি কিংবা বিস্কুট ছুঁড়ে দেন, নিচে ওরা সেগুলো নিয়ে কুকুরের মতো লোফালুফি করে। রাজাবাহাদুর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন সকৌতুকে।
আজও ছেলেমেয়েগুলো হুল্লোড় করে তাঁর চারিপাশে এসে ঘিরে দাঁড়ালো। বললে হুজুর, সেলাম। রাজবাহাদুর পকেটে হাত দিয়ে কতকগুলো পয়সা ছড়িয়ে দিলেন ওদের ভিতরে হরির লুঠের মতো কাড়াকাড়ি পড়ে গেল।
বেশ ছেলেমেয়েগুলি। দুই থেকে আট বছর পর্যন্ত বয়েস আমার ভারী ভালো লাগে ওদের। আরণ্যক জগতের শাল শিশুদের মতো সতেজ আর জীবন্ত প্রকৃতির ভেতর থেকে প্রাণ আহরণ করে যেন বড় হয়ে উঠেছে।
সন্ধ্যায় ডিনার টেবিলে বসে আমি বললাম, আজ রাত্রে মাছ ধরবার কথা আছে আপনার।
চোখের কোনা দিয়ে আমার দিকে তাকালেন রাজবাহাদুরা লক্ষ্য করেছি আজ সমস্ত দিন বড় বেশি মদ খাচ্ছেন আর ক্রমাগত চুরুট টেনে চলেছেনা ভালো করে আমার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলেন নি। ভেতরে ভেতরে কিছু একটা ঘটে চলেছে তাঁর।
রাজবাহাদুর সংক্ষেপে বললেন—হুম।
আমি সসংকোচে জিজ্ঞাসা করলাম, কখন হবে?
একমুখ ম্যানিলা চুরুটের ধোঁয়া ছড়িয়ে তিনি জবাব দিলেন—সময় হলে ডেকে পাঠাবা এখন আপনি গিয়ে শুয়ে পড়ুন। স্বচ্ছন্দে কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিতে পারেন।
শেষ কথাটা পরিষ্কার আদেশের মতো শোনালো। বুঝলাম আমি বেশিক্ষণ আর তাঁর সঙ্গে কথা বলি এ তিনি চান না। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে বলাটা অতিথিপরায়ণ গৃহস্থের অনুনয় নয়, রাজার নির্দেশ এবং সে নির্দেশ পালন করতে বিলম্ব না করাই ভালো।
কিন্তু অতি নরম জাজিমের বিছানায় শুয়েও ঘুম আসছে না। মাথার ভিতর আবর্তিত হচ্ছে অসংলগ্ন চিন্তা। মাছ ধরা, কাঠের সাঁকো, কপিকল, অত্যন্ত গোপনীয়! অতল রহস্য!
তারপর এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যে চৈতন্য আচ্ছন্ন হয়ে এল তা আমি নিজেই টের পাইনি।
মুখের ওপর ঝাঁঝালো একটা টর্চের আলো পড়তে আমি ধড়মড় করে উঠে পড়লাম। রাত তখন কটা ঠিক জানি না আরণ্যক পরিবেশে নির্জনতা আবির্ভূতা বাহিরে শুধু তীব্রকণ্ঠ ঝিঝির ডাক।
আমার গায়ে বরফের মতো ঠাণ্ডা একটা হাত পড়েছে কার। সে হাতের স্পর্শে পা থেকে মাথা পর্যন্ত শিউরে গেল আমার। রাজাবাহাদুর বললেন—সময় হয়েছে, চলুন।
আমি কী বলতে যাচ্ছিলাম—ঠোঁটে আঙুল দিলেন রাজবাহাদুরা কোনো কথা নয়, আসুন।
এই গভীর রাত্রে এমনি নিঃশব্দে আহ্বান—সবটা মিলিয়ে একটা রোমাঞ্চকর উপন্যাসের পটভূমি তৈরী হয়েছে যেন কেমন একটা অস্বস্তি, একটা অনিশ্চিত ভয়ে গা ছমছম করতে লাগল আমার। মন্ত্রমুগ্ধের মতো রাজবাহাদুরের পেছন পেছনে বেরিয়ে এলাম।
হান্টিং বাংলোটা অন্ধকার। একটা মৃত্যুর শীতলতা ঢেকে রেখেছে তাকে একটানা ঝিঝির ডাক—চারিদিকে অরণ্যে কান্নার শব্দের মতো পত্রমর্মরা গভীর রাত্রিতে জঙ্গলের মধ্যে মোটর থামিয়ে বসে থাকতে আমার ভয় করেছিল, আজও ভয় করছে। কিন্তু এ ভয়ের চেহারা আলাদা–এর মধ্যে আর একটা কী যেন মিশে আছে ঠিক বুঝতে পারছি না, অথচ পা-ও সরতে চাইছে না আমার মুখের ওপরে একটা টর্চের আলো, রাজাবাহাদুরের হাতের স্পর্শটা বরফের মতো ঠাণ্ডা, ঠোঁটে আঙুল দিয়ে নীরবতার সেই দুর্বোধ্য কুটিল সংকেত!
টর্চের আলোয় পথ দেখিয়ে রাজাবাহাদুর আমাকে সেই ঝুলন্ত সাঁকোটার কাছে নিয়ে এলেন। দেখি তার উপরে শিকারের আয়োজন। দুখানা চেয়ার পাতা, দুটো তৈরী রাইফেলা। দুজন বেয়ারা একটা কপিকলের চাকা ঘুরিয়ে কী একটা জিনিস নামিয়ে দিচ্ছে নিচের দিকে। এক মুহূর্তের জন্য রাজাবাহাদুর তাঁর নয় সেলের হান্টিং টর্চটা নিচের দিকে ফ্ল্যাশ করলেন। প্রায় আড়াই শো ফুট নিচে সাদা পুঁটলির মতো কী একটা জিনিস কপিকলের দড়ির সঙ্গে নেমে যাচ্ছে দ্রুতবেগে।
আমি বললাম, ওটা কি রাজাবাহাদুর?
—মাছের টোপ।
—কিন্তু এখনও কিছু বুঝতে পারছি না।
—একটু পরে বুঝবেন। এখন চুপ করুন
এবারে স্পষ্ট ধমক দিলেন আমাকে। মুখ দিয়ে ভক ভক করে হুইস্কির তীব্র গন্ধ বেরুচ্ছে। রাজাবাহাদুর প্রকৃতিস্থ নেই। আর কিছুই বুঝতে পারছি না আমি আমার মাথার ভেতর সব যেন গণ্ডগোল হয়ে গেছে। একটা দুর্বোধ্য নাটকের নির্বাক দ্রষ্টার মতো রাজাবাহাদুরের পাশের চেয়ারটাতে আসন নিলাম আমি।
ওদিকে ঘন কালো বনান্তের উপরে ভাঙা চাঁদ দেখা দিল। তার খানিকটা ম্লান আলো এসে পড়ল চারশো ফুট নিচের নদীর জলে, তার ছড়ানো মণিখণ্ডের মতো নুড়িগুলোর উপরে। আবছাভাবে যেন দেখতে পাচ্ছিকপিকলের দড়ির সঙ্গে বাঁধা সাদা পুঁটলিটা অল্প অল্প নড়ছে বালির ওপরে। এক হাতে রাজাবাহাদুর রাইফেলটা বাগিয়ে ধরে আছেন, আর এক হাতে মাঝে মাঝে আলো ফেলছেন নিচের পুঁটলিটায়। চকিত আলোয় যেটুকু মনে হচ্ছে—পুঁটলিটা যেন জীবন্ত, অথচ কী জিনিস কিছু বুঝতে পারছি না। এ নাকি মাছের টোপ! কিন্তু কী মাছ—এ কিসের টোপ?
আবার সেই স্তব্ধতার প্রতীক্ষা। মুহূর্ত কাটছে, মিনিট কাটছে, ঘণ্টা কাটছে। রাজাবাহাদুরের টর্চের আলো বারে বারে পিছলে পড়ছে নিচের দিকে। দিগন্তপ্রসার হিংস্র অরণ্য ভাঙা ভাঙা জ্যোৎস্নায় দেখাচ্ছে তরঙ্গিত একটা সমুদ্রের মতো নিচের নদীটা ঝকঝক করছে যেন একখানা খাপ-খোলা তলোয়ার। অবাক বিস্ময়ে আমি বসে আছি। মিনিট কাটছে, ঘণ্টা কাটছে। টোপ ফেলে মাছ ধরছেন রাজবাহাদুর।
অথচ সব ধোঁয়াটে লাগছে আমার কান পেতে শুনছি—ঝিঝির ডাক, দূরে হাতীর গর্জন, শালপাতার মর্মর। এ প্রতীক্ষার তত্ব আমার কাছে দুর্বোধ্যা শুধু হুইস্কি আর ম্যানিলা চুরুটের গন্ধ এসে লাগছে আমার। মিনিট কাটছে, ঘণ্টা কাটছে। রেডিয়াম ডায়াল ঘড়ির কাঁটা চলেছে ঘুরে। ক্রমশ যেন সম্মোহিত হয়ে গেলাম, ক্রমশ যেন ঘুম এল—আমার। তারপরেই হঠাৎ কানের কাছে। বিকট শব্দে রাইফেল সাড়া দিয়ে উঠল—চারশো ফুট নিচ থেকে উপরের দিকে উৎক্ষিপ্ত হয়ে উঠল প্রচণ্ড বাঘের গর্জন চেয়ারটা শুদ্ধ আমি কেঁপে উঠলাম।
টর্চের আলোটা সোজা পড়ছে নুড়ি-ছড়ানো বালির ডাঙাটার ওপরে পরিষ্কার দেখতে পেলাম ডোরাকাটা অতিকায় একটা বিশাল জানোয়ার সাদা পুঁটলিটার ওপরে একখানা থাবা চাপিয়ে দিয়ে পড়ে আছে, সাপের মতো ল্যাজ আছড়াচ্ছে অন্তিম আক্ষেপো ওপর থেকে ইন্দ্রের বজ্রের মতো অব্যর্থ গুলি গিয়ে লেগেছে তার মাথায়। এত ওপর থেকে এমন দুর্নিবার মৃত্যু নামবে আশঙ্কা করতে পারেনি। রাজাবাহাদুর সোৎসাহে বললেন—ফতে!
এতক্ষণে মাছ ধরবার ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি। সোৎসাহে সোল্লাসে বললাম—মাছ তো ধরলেন, ডাঙায় তুলবেন কেমন করে?
—ওই কপিকল দিয়ে। এই জন্যই তো ওগুলোর ব্যবস্থা।
ব্যাপারটা যেমন বিচিত্র তেমনি উপভোগ্যা আমি রাজাবাহাদুরকে অভিনন্দিত করতে যাব, এমন সময়—এমন সময়—পরিষ্কার শুনতে পেলাম শিশুর গোঙানি ক্ষীণ অথচ নির্ভুল। কিসের শব্দ!
চারশো ফুট নিচ থেকে ওই শব্দটা আসছে। হ্যাঁ—কোনো ভুল নেই! মুখের বাঁধন খুলে গেছে, কিন্তু বড় দেরীতে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল, আমার চুল খাড়া হয়ে উঠল আমি পাগলের মতো চীকার করে উঠলাম, রাজাবাহাদুর, কিসের টোপ আপনার? কি দিয়ে আপনি মাছ ধরলেন?
—চুপ! একটা কালো রাইফেলের নল আমার বুকে ঠেকালেন রাজাবাহাদুর। তারপরেই আমার চারিদিকে পৃথিবীটা পাক খেতে খেতে হাওয়ায় গড়া একটা বুদ্বুদের মতো শূন্যে মিলিয়ে গেল। রাজাবাহাদুর জাপটে না ধরলে চারশো ফুট নিচেই পড়ে যেতাম হয়তো।
* * * *
কীপারের একটা বেওয়ারিশ ছেলে যদি জঙ্গলে হারিয়ে গিয়ে থাকে তা অস্বাভাবিক নয়, তাতে কারো ক্ষতি নেই। কিন্তু প্রকাণ্ড রয়্যাল বেঙ্গল মেরেছিলেন রাজাবাহাদুর–লোককে ডেকে দেখানোর মতো।
তাই আট মাস পরে এই চমৎকার চটি-জোড়া উপহার এসেছে। আট মাস আগেকার সে রাত্রি এখন স্বপ্ন হয়ে যাওয়াই ভালো, কিন্তু এই চটিজোড়া অতি মনোরম বাস্তবা পায়ে দিয়ে একবার হেঁটে দেখলাম, যেমন নরম, তেমনি আরাম।