টোপ - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়


টোপ
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

সকালে একটা পার্সেল এসে পৌঁছেছে। খুলে দেখি এক জোড়া জুতো।
না, শত্রুপক্ষের কাজ নয়। এক জোড়া পুরোনো হেঁড়া জুতা পাঠিয়ে আমার সঙ্গে রসিকতার চেষ্টাও করেনি কেউ। চমৎকার ঝকঝকে বাঘের চামড়ার নতুন চটিা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়, পায়ে দিতে লজ্জা বোধ হয় দস্তুর মতো। ইচ্ছে করে বিছানায় শুইয়ে রাখি
কিন্তু জুতোজোড়া পাঠাল কে? কোথাও অর্ডার দিয়েছিলাম বলেও তো মনে পড়ছে না। আর বন্ধুদের সব কটাকেই তো চিনি, বিনামূল্যে এমন এক জোড়া জুতো পাঠানোর মতো দরাজ মেজাজ এবং ট্যাঁক কারো আছে বলেও জানি না তাহলে ব্যাপারটা কী?
খুব আশ্চর্য হব কি না ভাবছি, এমন সময় একখানা সবুজ রঙের কার্ড চোখে পড়লো। উইথ বেস্ট কমপ্লিমেন্টস অব রাজাবাহাদুর এন. আর. চৌধুরী, রামগঙ্গা এস্টেট!
আর তখুনি মনে পড়ে গেল। মনে পড়ল আট মাস আগেকার এক আরণ্যক ইতিহাস, একটি বিচিত্র শিকার-কাহিনী।
রাজাবাহাদুরের সঙ্গে আলাপের ইতিহাসটা ঘোলাটে, সূত্রগুলো এলোমেলো যতদূর মনে হয়, আমার এক সহপাঠী তার এস্টেটে চাকরি করত তারই যোগাযোগে রাজাবাহাদুরের এক জন্মবাসরে আমি একটা কাব্য-সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেছিলাম। ঈশ্বর গুপ্তের অনুপ্রাস চুরি করে যে প্রশস্তি রচনা করেছিলাম তার দুটো লাইন এই রকম —
ত্রিভুবন-প্রভাকর ওহে প্রভাকর,
গুণবান মহীয়ান হে রাজেন্দ্রবর।
ভূতলে অতুল কীর্তি রামচন্দ্র সম—
অরাতি-দমন ওহে তুমি নিরুপম।
কাব্যচর্চার ফললাভ হল একেবারে নগদ নগদ। পড়েছি—আকবরের সভাসদ আবদুর রহিম খানখানান হিন্দী কবি গঙ্গের চার লাইন কবিতা শুনে চার লক্ষ টাকা পুরষ্কার দিয়েছিলেন। দেখলাম সে নবাবী মেজাজের ঐতিহ্যটা গুণবান মহীয়ান অরাতিদমন মহারাজ এখনো বজায় রেখেছেন। আমার মতো দীনাতিদীনের ওপরেও রাজদৃষ্টি পড়ল, তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন, প্রায়ই চা খাওয়াতে লাগলেন, তারপর সামান্য একটা উপলক্ষ্য করে দামী একটা সোনার হাতঘড়ি উপহার দিয়ে বসলেন এক সময়ে সেই থেকে রাজাবাহাদুর সম্পর্কে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হয়ে আছি আমি। নিছক কবিতা মেলাবার জন্য বিশেষণগুলো ব্যবহার করেছিলাম, এখন সেগুলোকেই মন-প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতে সুরু করেছি।
রাজাবাহাদুরকে আমি শ্রদ্ধা করি। আর গুণগ্রাহী লোককে শ্রদ্ধা করাই তো স্বাভাবিক। বন্ধুরা বলে, মোসাহেব। কিন্তু আমি জানি ওটা নিছক গায়ের জ্বালা, আমার সৌভাগ্যে ওদের ঈর্ষা। তা আমি পরোয়া করি না। নৌকা বাঁধতে হলে বড় গাছ দেখে বাঁধাই ভালো, অন্তত ছোটখাটো ঝড়ঝাপটার আঘাতে সম্পূর্ণ নিরাপদ।
তাই মাস আষ্টেক আগে রাজাবাহাদুর যখন শিকারে তাঁর সহযাত্রী হওয়ার জন্যে আমাকে। নিমন্ত্রণ জানালেন তখন তা আমি ঠেলতে পারলাম না। কলকাতার সমস্ত কাজকর্ম ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে পড়া গেল। তা ছাড়া গোরা সৈন্যদের মাঝে মাঝে রাইফেল উঁচিয়ে শকুন। মারতে দেখা ছাড়া শিকার সম্বন্ধে কোনো স্পষ্ট ধারণাই নেই আমার। সেদিক থেকেও মনের ভেতরে গভীর এবং নিবিড় একটা প্রলোভন ছিল।
জঙ্গলের ভেতরে ছোট একটা রেললাইনে আরো ছোট একটা স্টেশনে গাড়ী থামল। নামবার সঙ্গে সঙ্গে সোনালী-তকমা-আঁটা ঝকঝকে-পপাশাক-পরা আর্দালি এসে সেলাম দিল আমাকে। বললে—হুজুর চলুন।
স্টেশনের বাইরে মেটে রাস্তায় দেখি মস্ত একখানা গাড়ি যার পুরো নাম রোলস রয়েস, সংক্ষেপে যাকে বলে ‘রোজ’। তা ‘রোজ’ই বটে। মাটিতে চলল না রাজহাঁসের মতো হাওয়ায় ভেসে গেল সেটা ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারলাম না। চামড়ার খটখটে গদী নয়, লাল মখমলের কুশনা হেলান দিতে সংকোচ হয়, পাছে মাথার সস্তা নারকেল তেলের দাগ ধরে যায়। আর বসবার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হয়—সমস্ত পৃথিবীটা নিচের মাটির ঢেলার মতো গুঁড়িয়ে যাক—আমি এখানে সুখে এবং নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়তে পারি।
হাঁসের মতো ভেসে চলল ‘রোজা মেটে রাস্তায় চলেছে অথচ এতটুকু ঝাঁকুনি নেই। ইচ্ছে হলো একবার ঘাড় বার করে দেখি গাড়িটা ঠিক মাটি দিয়েই চলেছে, না দুহাত ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে ওর চাকাগুলো।
পথের দুপাশে তখন নতুন একটা জগতের ছবি সবুজ শালবনের আড়ালে আড়ালে চা বাগানের বিস্তার চকচকে উজ্জ্বল পাতার শান্ত, শ্যামল সমুদ্র। দূরে আকাশের গায়ে কালো পাহাড়ের রেখা।
ক্রমশ চা-বাগান শেষ হয়ে এল, পথের দুপাশে ঘন হয়ে দেখা দিতে লাগল অবিচ্ছিন্ন শালবন। একজন আর্দালি জানাল, হুজুর, ফরেস্ট এসে পড়েছে।
ফরেস্টই বটে। পথের ওপর থেকে সূর্যের আলো সরে গেছে, এখন শুধু শান্ত আর বিষণ্ণ ছায়া। রাত্রির শিশির এখনও ভিজিয়ে রেখেছে পথটাকে। ‘রোজে’র নিঃশব্দ চাকার নীচে মড় মড় করে সাড়া তুলছে শুকনো শালের পাতা। বাতাসে গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টির মতো শালের ফুল ঝরে পড়ছে পথের পাশে, উড়ে আসছে গায়ে কোথা থেকে চকিতের জন্যে ময়ূরের তীক্ষ্ণ চীৎকার ভেসে এল। দু পাশে নিবিড় শালের বন, কোথাও কোথাও ভেতর দিয়ে খানিকটা দৃষ্টি চলে, কখনো কখনো বুনো ঝোপে আচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে এক টুকরো কাঠের গায়ে লেখা ১৯৩৫, ১৯৪০। মানুষ বনকে শুধু উচ্ছন্ন করতে চায় না, তাকে বাড়াতেও চায়। এই সব প্লটে বিভিন্ন সময়ে নতুন করে শালের চারা রোপণ করা হয়েছে, এ তারই নির্দেশ।
বনের রূপ দেখতে দেখতে চলেছি। মাঝে মাঝে ভয় যে না করছিল এমন নয়। এই ঘন। জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ যদি গাড়ির এঞ্জিন খারাপ হয়ে যায়, আর তাক বুঝে যদি লাফ মারে একটা বুনো জানোয়ার, তা হলে—
তা হলে পকেটের ফাউন্টেন পেনটা ছাড়া আত্মরক্ষার আর কোনো অস্ত্রট সঙ্গে নেই।
শেষটায় আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসা করে বসলম—হ্যাঁরে, এখানে বাঘ আছে?
ওরা অনুকম্পার হাসি হাসল।
–হাঁ, হুজুর।
—ভালুক?
রাজা-রাজড়ার সহবৎ, কাজেই যতটুকু জিজ্ঞাসা করব ঠিক ততটুকুই উত্তর। ওরা বলল—হাঁ হুজুর।
—অজগর সাপ?
—জী মালিক।
প্রশ্ন করার উৎসাহ ওই পর্যন্ত এসে থেমে গেল আমার। যে রকম দ্রুত উত্তর দিয়ে যাচ্ছে তাতে কোনো প্রশ্নই যে ‘না’ বলে আমাকে আশ্বস্ত করবে এমন তো মনে হচ্ছে না। যতদূর মনে হচ্ছিল গেরিলা, হিপোপোটেমাস, ভ্যাম্পায়ার কোনো কিছুই বাকি নেই। এখানে জুলু কিংবা ফিলিপিনেরাও বিষাক্ত বুমেরাং বাগিয়ে আছে কি না এবং মানুষ পেলে তারা বেগুন-পোড়া করে খেতে ভালবাসে কি না, এ জাতীয় একটা কুটিল জিজ্ঞাসাও আমার মনে জেগে উঠেছে ততক্ষণে কিন্তু নিজেকে সামলে নিলাম।
খানিকটা আসতেই গাড়িটা ঘস ঘস করে ব্রেক কষল একটা আমি প্রায় আর্তনাদ করে উঠলাম—কি রে, বাঘ নাকি?
আর্দালিরা মুচকে হাসল–না হুজুর, এসে পড়েছি।
ভালো করে তাকিয়ে দেখি, সত্যিই তো এসে পড়েছি সন্দেহ নেই। পথের বাঁ দিকে ঘন শালবনের ভেতরে একটুখানি ফাঁকা জমি। সেখানে কাঠের তৈরি বাংলো প্যাটার্নের একখানা দোতলা বাড়ি। এই নিবিড় জঙ্গলের ভেতর যেমন আকস্মিক, তেমনি অপ্রত্যাশিত
গাড়ির শব্দে বাড়িটার ভেতর থেকে দু-তিন জন চাপরাসী বেরিয়ে এল ব্যতিব্যস্ত হয়ে। এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি, এবার দেখলাম বাড়ির সামনে চওড়া একটা গড়খাই কাটা। লোকগুলো ধরাধরি করে মস্ত বড় একফালি কাঠ খাদটার ওপরে সাঁকোর মতো বিছিয়ে দিলো তারই ওপর দিয়ে গাড়ি দিয়ে দাঁড়াল রাজাবাহাদুর এন.আর.চৌধুরীর হান্টিং বাংলোর সামনে।
আরে আরে কী সৌভাগ্য! রাজাবাহাদুর স্বয়ং এসে বারান্দায় দাঁড়িয়েছেন আমার অপেক্ষায়। এক গাল হেসে বললেন, আসুন, আসুন, আপনার জন্য আমি এখনো চা পর্যন্ত খাইনি।
শ্রদ্ধায় আর বিনয়ে আমার মাথা নিচু হয়ে গেল। মুখে কথা যোগাল না, শুধু বেকুবের মতো কৃতার্থের হাসি হাসলাম একগালা
রাজাবাহাদুর বললেন—এত কষ্ট করে আপনি যে আসবেন সে ভাবতেই পারিনি। বড় আনন্দ হল। চলুন চলুন, ওপরে চলুন।
এত গুণ না থাকলে কি আর রাজা হয়! একেই বলে রাজোচিত বিনয়।
রাজাবাহাদুর বললেন—আগে স্নান করে রিফ্রেশড হয়ে আসুন, টি ইজ গেটিং রেডি বোয়, সাহেব কো গোসলখানামে লে যাও।
চল্লিশ বছরের দাড়িওয়ালা বয় নিঃসন্দেহে বাঙালী। তবু হিন্দী করে হুকুমটা দিলেন রাজাবাহাদুর, কারণ ওটাই রাজকীয় দস্তুর। বয় আমাকে গোসলখানায় নিয়ে গেল।
আশ্চর্য, এই জঙ্গলের ভেতরও এত নিখুঁত আয়োজন! এমন একটা বাথরুমে জীবনে আমি স্নান করিনি। ব্র্যাকেটে তিন-চারখানা সদ্য পাট-ভাঙা নতুন ভোয়ালে, তিনটে দামী সোপকেসে তিন রকমের নতুন সাবান, যাকে দামী দামী তেল, লাইমজুস অতিকায় বাথটাব, ওপরে ঝাঁঝরি। নিচে টিউবওয়েল থেকে পাম্প করে এখানে ধারাস্নানের ব্যবস্থা একেবারে রাজকীয় কারবার কে বলবে এটা কলকাতার গ্র্যান্ড হোটেল নয়!
স্নান হয়ে গেল। ব্রাকেটে ধোপদুরস্ত করা ফরাসডাঙার ধুতী, সিলকের লুঙ্গি, আদ্দির পাজামা দামের দিক থেকে পাজামাটাই সস্তা মনে হল, তাই পরে নিলাম।
বয় বাইরেই দাঁড়িয়েছিল, নিয়ে গেল ড্রেসিংরুমে। ঘরজোড়া আয়না, পৃথিবীর যা কিছু প্রসাধনের জিনিস কিছু আর বাকি নেই এখানে
ড্রেসিংরুম থেকে বেরুতে সোজা ডাক পড়ল রাজাবাহাদুরের লাউঞ্জে রাজাবাহাদুর একখানা চেয়ারে চিত হয়ে শুয়ে ম্যানিলা চুরুট খাচ্ছিলেন। বললেন, আসুন চা তৈরী।
চায়ের বর্ণনা না করাই ভালো। চা, কফি, কোকো, ওভালটিন, রুটি, মাখন, পনির, চর্বিতে জমাট ঠাণ্ডা মাংস। কলা থেকে আরম্ভ করে পিচ পর্যন্ত প্রায় দশ রকমের ফল।
সেই গন্ধমাদন থেকে যা পারি গোগ্রাসে গিলে চললাম আমি। রাজাবাহাদুর কখনো এক টুকরো রুটি খেলেন, কখনো একটু ফল। অর্থাৎ কিছুই খেলেন না, শুধু পর পর কাপ তিনেক চা ছাড়া। তারপর আর একটা চুরুট ধরিয়ে বললেন—একবার জানালা দিয়ে চেয়ে দেখুন।
দেখলাম প্রকৃতির এমন অপূর্ব রূপ জীবনে আর দেখিনি। ঠিক জানলার নিচেই মাটিটা খাড়া তিন চারশো ফুট নেমে গেছে বাড়িটা যেন ঝুলে আছে সেই রাক্ষুসে শূন্যতার ওপরে। তলায় দেখা যাচ্ছে ঘন জঙ্গল, তার মাঝ দিয়ে পাহাড়ী নদীর একটা সঙ্কীর্ণ নীলোজ্জল রেখা যতদূর দেখা যায়, বিস্তীর্ণ অরণ্য চলেছে প্রসারিত হয়ে তার সীমান্তে নীল পাহাড়ের প্রহরা।
আমার মুখ দিয়ে বেরুলো—চমৎকার!
রাজাবাহাদুর বললেন রাইট। আপনারা কবি মানুষ, আপনাদের তো ভালো লাগবেই আমারই মাঝে মাঝে কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে মশাই। কিন্তু নিচের ওই যে জঙ্গলটি দেখতে পাচ্ছেন ওটি বড় সুবিধের জায়গা নয়। টেরাইয়ের ওয়ান অব দি ফিয়ার্সেস্ট ফরেস্টস। একেবারে প্রাগৈতিহাসিক হিংস্রতার রাজত্ব।
আমি সভয়ে জঙ্গলটার দিকে তাকালাম। ওয়ান অব দি ফিয়ার্সেস্ট! কিন্তু ভয় পাওয়ার মতো কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না। চারশো ফুট নিচে ওই অতিকায় জঙ্গলটাকে একটা নিরবচ্ছিন্ন বেঁটে গাছের ঝোপ বলে মনে হচ্ছে, নদীর রেখাটাকে দেখাচ্ছে উজ্জ্বল একখানা পাতার মতো। আশ্চর্য সবুজ, আশ্চর্য সুন্দর। অফুরন্ত রোদে ঝলমল করছে অফুরন্ত প্রকৃতি-পাহাড়টা যেন গাঢ় নীল রঙ দিয়ে আঁকা। মনে হয়, উপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়লে ওই স্তব্ধ গম্ভীর অরণ্য যেন আদর করে বুকে টেনে নেবে রাশি রাশি পাতার একটা নরম বিছানার ওপরে। অথচ–
আমি বললাম—ওখানেই শিকার করবে নাকি? ক্ষেপেছেন, নামব কী করে! দেখছেন তো, পেছনে চারশো ফুট খাড়া পাহাড়। আজ পর্যন্ত ওখানে কোনো শিকারীর বন্দুক গিয়ে পৌঁছোয় নি। তবে হ্যাঁ, ঠিক শিকার করি না বটে, আমি মাঝে মাঝে মাছ ধরি ওখান থেকে।
—মাছ ধরেন!—আমি হাঁ করলাম মাছ ধরেন কিরকম? ওই নদী থেকে নাকি?
—সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য দরকার হলে পরে দেখতে পাবেন রাজাবাহাদুর রহস্যময় ভাবে। মুখ টিপে হাসলেনা আপাতত শিকারের আয়োজন করা যাক, কিছু না জুটলে মাছের চেষ্টাই করা। যাবো তবে ভালো টোপ ছাড়া আমার পছন্দ হয় না, আর তাতে অনেক হাঙ্গামা।
—কিছু বুঝতে পারছি না।
রাজাবাহাদুর জবাব দিলেন না, শুধু হাসলেন। তারপর ম্যানিলা চুরুটের খানিকটা সুগন্ধি ধোঁয়া ছড়িয়ে বললেন—আপনি রাইফেল ছুঁড়তে জানেন?
বুঝলাম কথাটি চাপা দিতে চাইছেন। সঙ্গে সঙ্গে জিহ্বাকে দমন করে ফেললাম, এর পরে আর কিছু জিজ্ঞাসা করাটা সঙ্গত হবে না, শোভনও নয়। সেটা কোর্ট-ম্যানারের বিরোধী।
রাজাবাহাদুর আবার বললেন, রাইফেল ছুঁড়তে পারেন?
বললাম—ছেলেবেলায় এয়ার গান ছুঁড়েছি।
রাজাবাহাদুর হেসে উঠলেন—তা বটে। আপনারা কবি মানুষ, ওসব অস্ত্রশস্ত্রের ব্যাপার আপনাদের মানায় না। আমি অবশ্য বারো বছর বয়সেই রাইফেল হাতে তুলে নিয়েছিলাম আপনি চেষ্টা করে দেখুন না, কিছু শক্ত ব্যাপার নয়।
উঠে দাঁড়ালেন রাজাবাহাদুরা ঘরের একদিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁকে অনুসরণ করে আমি দেখলাম—এ শুধু লাউঞ্জ নয়, রীতিমতো একটা ন্যাচারাল মিউজিয়াম এবং অস্ত্রাগার। খাওয়ার টেবিলেই নিমগ্ন ছিলাম বলে এতক্ষণ দেখতে পাইনি, নইলে এর আগেই চোখে পড়া উচিত ছিল।
চারিদিকে সারি সারি নানা আকারের আগ্নেয়াস্ত্র। গোটাচারেক রাইফেল, ছোট বড় নানা রকম চেহারা। একটা হুকের সঙ্গে খাপে আঁটা একজোড়া রিভলভার ঝুলছে তার পাশেই ঝুলছে খোলা একখানা লম্বা শেফিল্ডের তলোয়ার—সূর্যের আলোর মতো তার ফলার নিষ্কলঙ্ক রঙা মোটা। চামড়ার বেলটে ঝকঝকে পেতলের কার্তুজ রাইফেলের, রিভলভারের। জরিদার খাপে খান তিনেক নেপালী ভোজালি। আর দেয়ালের গায়ে হরিণের মাথা, ভালুকের মুখ, নানা রকমের চামড়া–বাঘের, সাপের, হরিণের, গো-সাপের একটা টেবিলে অতিকায় হাতীর মাথা—দুটো বড় বড় দাঁত এগিয়ে আছে সামনের দিকে। বুঝলাম—এরা রাজাবাহাদুরের বীরকীর্তির নিদর্শন।
ছোট একটা রাইফেল তুলে নিলেন রাজাবাহাদুর, বললেন—এটা লাইট জিনিস। তবে ভালো রিপিটার অনায়াসে বড় বড় জানোয়ার ঘায়েল করতে পারে।
আমার কাছে অবশ্য সবই সমান। লাইট রিপিটার যা, হাউইটজার কামানও তাই তবু সৌজন্য রক্ষার জন্যে বলতে হলো—বাঃ, তবে তো চমৎকার জিনিস!
রাজাবাহাদুর রাইফেলটা বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে তা হলে চেষ্টা করুন। লোড করাই আছে, ছুঁড়ুন ওই জানালা দিয়ে।
আমি সভয়ে তিন পা পিছিয়ে গেলাম। জীবনে বেকুবি অনেক করেছি, কিন্তু তার পরিমাণটা আর বাড়াতে প্রস্তুত নই। যুদ্ধ-ফেরত এক বন্ধুর মুখে তাঁর রাইফেল ছোঁড়ার প্রথম অভিজ্ঞতা শুনেছিলাম—পড়ে গিয়ে পা ভেঙে নাকি তাঁকে একমাস বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছিল। নিজেকে যতদূর জানি—আমার ফাঁড়া শুধু পা ভাঙার ওপর দিয়েই কাটবে বলে মনে হয় না।
বললাম—ওটা এখন থাক, পরে হবে না হয়।
রাজাবাহাদুর মৃদু কৌতুকের হাসি হাসলেন। বললেন—এখন ভয় পাচ্ছেন, কিন্তু একবার ধরতে শিখলে আর ছাড়তে চাইবেন না। হাতে থাকলে বুঝবেন কত বড় শক্তিমান আপনি ইউ ক্যান ইজিলি ফেস অল দ্য রাস্কেলস অব—অব—
হঠাৎ তাঁর চোখ ঝকঝক করে উঠল। মৃদু হাসিটা মিলিয়ে গিয়ে শক্ত হয়ে উঠল মুখের পেশীগুলো অ্যান্ড এ রাইভ্যাল–
মুহূর্তে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল আমার। রাজাবাহাদুরের দু’চোখে বন্য হিংসা, রাইফেলটা এমন শক্ত মুঠিতে বাগিয়ে ধরেছেন যেন সামনে কাউকে গুলি করবার জন্যে তৈরী হচ্ছেন তিনি। উত্তেজনার ঝোঁকে আমাকেই যদি লক্ষ্যভেদ করে বসেন তা হলে—
আতঙ্কে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। কিন্তু ততক্ষণে মেঘ কেটে গেছে–রাজা রাজড়ার মেজাজ! রাজাবাহাদুর হাসলেনা।
—ওয়েল, পরে আপনাকে তালিম দেওয়া যাবে। সবই তো রয়েছে, যেটা খুশি আপনি ট্রাই করতে পারেন। চলুন, এখন বারান্দায় গিয়ে বসা যাক, লেটস হ্যাভ সাম এনার্জি।
প্রাতরাশেই প্রায় বিন্ধ্যপর্বত উদরসাৎ করা হয়েছে, আর কি হলে এনার্জি সঞ্চিত হবে বোঝা শক্ত। কিন্তু কথাটা বলেই রাজাবাহাদুর বাইরের বারান্দার দিকে পা বাড়িয়েছেন। সুতরাং আমাকেও পিছু নিতে হল।
বাইরের বারান্দায় বেতের চেয়ার, বেতের টেবিল। এখানে ঢোকবার পরে এমন সব বিচিত্র রকমের আসনে বসছি যে আমি প্রায় নার্ভাস হয়ে উঠেছি। তবু যেন বেতের চেয়ারে বসতে পেয়ে খানিকটা সহজ অন্তরঙ্গতা অনুভব করা গেল। এটা অন্তত চেনা জিনিস।
আর বসবার সঙ্গে সঙ্গেই বোঝা গেল এনার্জি কথাটার আসল তাৎপর্য কি। বেয়ারা তৈরীই ছিল, ট্রেতে করে একটি ফেনিল গ্লাস সামনে এনে রাখল। অ্যালকোহলের উগ্র গন্ধ ছড়িয়ে গেল বাতাসে।
রাজাবাহাদুর স্মিত হাস্যে বললেন—চলবে?
সবিনয়ে জানালাম, না।
—তবে বিয়ার আনবে? একেবারে মেয়েদের ড্রিঙ্ক! নেশা হবে না।
–না থাক। অভ্যেস নেই কোনোদিন।
–হুঁ, গুড কন্ডাক্টের প্রাইজ পাওয়া ছেলে! রাজাবাহাদুরের সুরে অনুকম্পার আভাস আমি কিন্তু চোদ্দ বছরের বয়সেই প্রথম ড্রিঙ্ক ধরি।
রাজা-রাজড়ার ব্যাপার—সবই অলৌকিক জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গেই কেউটের বাচ্চা। সুতরাং মন্তব্য অনাবশ্যক। ট্রে বার বার যাতায়াত করতে লাগল। রাজাবাহাদুরের প্রখর উজ্জ্বল চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে এল ক্রমশ, ফর্সা মুখ গোলাপী রং ধরল। হঠাৎ অসুস্থ দৃষ্টিতে তিনি আমার দিকে তাকালেন।
—আচ্ছা বলতে পারেন, আপনি রাজা নন কেন?
এ রকম একটা প্রশ্ন করলে বোকার মতো দাঁত বের করে থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই। আমিও তাই করলাম
—বলতে পারলেন না?
–না।
—আপনি মানুষ মারতে পারেন?
এ আবার কী রকম কথা! আমার আতঙ্ক জাগল।
–না।
তা হলে বলতে পারবেন না। ইউ আর অ্যাবসোলিউটলি হোপলেস।
উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ালেন রাজাবাহাদুর। বলে গেলেন আই পিটি ইউ।
বুঝলাম নেশাটা চড়েছে। আমি আর কথা বাড়ালাম না, চুপ করে বসে রইলাম সেখানেই। খানিক পরেই ঘরের ভেতরে নাক ডাকার শব্দ। তাকিয়ে দেখি তাঁর লাউঞ্জের সেই চেয়ারটায় হাঁ করে ঘুমুচ্ছেন রাজাবাহাদুর, মুখের কাছে কতকগুলো মাছি উড়ছে ভনভন করে।
* * * *
সেইদিন রাত্রেই শিকারের প্রথম অভিজ্ঞতা।
জঙ্গলের ভেতর বসে আছি মোটরে। দুটো তীব্র হেডলাইটের আলো পড়েছে সামনের সঙ্কীর্ণ পথে আর দুধারের শালবনে। ওই আলোর রেখার বাইরে অবশিষ্ট জঙ্গলটায় যেন প্রেতপুরীর। জমাট অন্ধকার রাত্রির তমসায় আদিম হিংসা সজাগ হয়ে উঠেছে চারিদিকে অনুভব করছি সমস্ত স্নায়ু দিয়ে। এখানে হাতীর পাল ঘুরছে দূরের কোনো পাহাড়ের পাথর গুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, ঝোপের ভেতরে অজগর প্রতীক্ষা করে আছে অসতর্ক শিকারের আশায়, আসন্ন বিপদের সম্ভাবনায় উৎকর্ণ হয়ে আছে হরিণের পাল আর কোনো একটা খাদের ভেতরে জ্বলজ্বল করছে। ‘ক্ষুধার্ত বাঘের চোখা কালো রাত্রিতে জেগে আছে কালো অরণ্যের প্রাথমিক জীবনা।
রোমাঞ্চিত ভীত প্রতীক্ষায় চুপ করে বসে আছি মোটরের মধ্যেকিন্তু হিংসার রাজত্ব শালবন। ডুবে আছে একটা আশ্চর্য স্তব্ধতায়। শুধু কানের কাছে অবিশ্রান্ত মশার গুঞ্জন ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। মাঝে মাঝে অল্প বাতাস দিচ্ছে—শালের পাতায় উঠেছে এক একটা মৃদু মর্মর। আর কখনো ডাকছে বনমুরগী, ঘুমের মধ্যে পাখা ঝাপটাচ্ছে ময়ূর। মনে হচ্ছে এই গভীর ভয়ঙ্কর অরণ্যের প্রাণীগুলো যেন নিশ্বাস বন্ধ করে একটা নিশ্চিত কোনো মুহূর্তের প্রতীক্ষা করে আছে।
আমরাও প্রতীক্ষা করে আছি। মোটরের মধ্যে নিঃসাড় হয়ে বসে আছি আমরা—একটি কথাও বলবার উপায় নেই। রাইফেলের নল এঞ্জিনের ওপরে বাড়িয়ে দিয়ে শিকারী বাঘের মতোই তাকিয়ে আছেন রাজবাহাদুর। চোখ দুটো উগ্র প্রখর হয়ে আছে হেডলাইটের তীব্র আলোক রেখাটার দিকে, একটা জানোয়ার ওই রেখাটা পেরুবার দুঃসাহস করলেই রাইফেল গর্জন করে উঠবে।
কিন্তু জঙ্গলের সেই আশ্চর্য স্তব্ধতা অরণ্য যেন আজ রাত্রে বিশ্রাম করছে, একটি রাত্রের জন্য। ক্লান্ত হয়ে জানোয়ারগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে খাদের ভেতরে, ঝোপের আড়ালে কেটে চলেছে মন্থর সময়। রাজাবাহাদুরের হাতের রেডিয়াম ডায়াল ঘড়িটা একটা সবুজ চোখের মত জ্বলছে, রাত দেড়টা পেরিয়ে গেছে। ক্রমশ উসখুস করছেন উৎকীর্ণ রাজবাহাদুরনাঃ হোপলেস! আজ আর পাওয়া যাবে না।
বহুদূর থেকে একটা তীক্ষ্ণ গম্ভীর শব্দ, হাতীর ডাকা ময়ূরের পাখা-ঝাপটানি চলছে মাঝে মাঝে এক ফাঁকে একটা প্যাঁচা চেঁচিয়ে উঠল, রাত্রি ঘোষণা করে গেল শেয়ালের দল। কিন্তু কোথায় বাঘ, কোথায় বা ভালুক? অন্ধকার বনের মধ্যে দ্রুত কতকগুলো ছুটন্ত খুরের আওয়াজ পালিয়ে গেল হরিণের পালা
কিন্তু কোনো ছায়া পড়ছে না আলোকবৃত্তের ভেতরে। মশার কামড় যেন অসহ্য হয়ে উঠেছে।
–বৃথাই গেল রাতটা। রাজাবাহাদুরের কণ্ঠস্বরে পৃথিবীর সমস্ত বিরক্তি ভেঙে পড়ল ডেভিল লাক! সীটের পাশ থেকে একটা ফ্লাসক তুলে নিয়ে ঢক ঢক করে ঢাললেন গলাতে, ছড়িয়ে পড়ল হুইস্কির কটু গন্ধ।
–থ্যাঙ্ক হেনস!–রাজবাহাদুর হঠাৎ নড়ে বসলেন সচকিত হয়ো নক্ষত্রবেগে হাতটা চলে গেল রাইফেলের ট্রিগারো শিকার এসে পড়েছে। আমিও দেখলাম। বহুদূর থেকে আলোর রেখাটার ভেতর কী একটা জানোয়ার দাঁড়িয়ে আছে স্থির হয়ে। এমন একটা জোরালো আলো চোখে পড়াতে কেমন দিশেহারা হয়ে গেছে, তাকিয়ে আছে এই দিকেই। দুটো জোনাকির বিন্দুর মতো চিক চিক করছে তার চোখ।
–ড্যাম! রাইফেল থেকে হাত সরিয়ে নিলেন রাজবাহাদুর, কিন্তু পরমুহূর্তেই চাপা উত্তেজিত গলায় বললেন—থাক, আজ ছুঁচোই মারব।
দুম করে রাইফেল গর্জন করে উঠল। কানে তালা ধরে গেল আমার, বারুদের গন্ধে বিস্বাদ হয়ে উঠল নাসারন্ধ্র। অব্যর্থ লক্ষ্য রাজবাহাদুরের—পড়েছে জানোয়ারটা।
ড্রাইভার বললে—তুলে আনব হুজুর?
বিকৃতমুখে রাজবাহাদুর বললেন, কী হবে? গাড়ি ঘোরাও।
রেডিয়াম ডায়ালের সবুজ আলোয় রাত তিনটো গাড়ি ফিরে চলল হান্টিং বাংলোর দিকে। একটা ম্যানিলা চুরুট ধরিয়ে রাজবাহাদুর আবার বললেন—ড্যাম!
কিন্তু কী আশ্চর্যজঙ্গল যেন রসিকতা সুরু করেছে আমাদের সঙ্গে। দিনের বেলা অনেক চেষ্টা। করেও দুটো একটা বনমুরগী ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না—এমন কি একটা হরিণ পর্যন্ত নয়। নাইট-শুটিংয়ে সেই অবস্থা। পর পর তিন রাত্রি জঙ্গলের নানা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে চেষ্টা করা হল, কিন্তু নগদ লাভ যা ঘটল তা অমানুষিক মশার কামড়। জঙ্গলের হিংস্র জন্তুর সাক্ষাৎ মিলল না বটে, কিন্তু মশাগুলো চিনতে পারা গেল। এমন সাংঘাতিক মশা যে পৃথিবীর কোথাও থাকতে পারে এতদিন এ ধারণা ছিল না আমার।
তবে মশার কামড়ের ক্ষতিপূরণ চলতে লাগল গন্ধমাদন উজাড় করে। সত্যি বলতে কি, শিকার করতে না পারলেও মনের দিক থেকে বিন্দুমাত্র ক্ষোভ ছিল না আমার। জঙ্গলের ভেতরে এমন রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন কল্পনারও বাইরে। জীবনে এমন দামী খাবার কোনো দিন মুখে তুলিনি, এমন চমৎকার বাথরুমে স্নান করিনি কখনো, এত পুরু জাজিমের বিছানায় শুয়ে অস্বস্তিতে প্রথম দিন তো ঘুমুতেই পারিনি আমি নিবিড় জঙ্গলের নেপথ্যে গ্র্যান্ড হোটেলের স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাচ্ছি—শিকার না হলেও কণামাত্র ক্ষতি নেই আমার। প্রত্যেক দিনই লাউঞ্জে চা খেতে খেতে চারশো ফুট নিচেকার ঘন জঙ্গলটার দিকে চোখ পড়ো সকালের আলোয় উদ্ভাসিত শ্যামলতা দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তীর্ণ হয়ে আছে অপরূপ প্রসন্নতায়। ওয়ান অব দি ফিয়ার্সেস্ট ফরেস্ট, বিশ্বাস হয় না। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি বাতাসে আকার-অবয়বহীন পত্রাবরণ সবুজ সমুদ্রের মতো দুলছে, চক্র দিচ্ছে পাখির দল—এখান থেকে মৌমাছির মতো দেখায় পাখীগুলোকে জানালার ঠিক নিচেই ইস্পাতের ফলার মতো পাহাড়ী নদীটার নীলিমোজ্জ্বল রেখা—দুটো একটা নুড়ি ঝকমক করে মণিখণ্ডের মতো। বেশ লাগে।
তার পরেই চমক ভাঙে আমার। তাকিয়ে দেখি ঠোঁটের কোণে ম্যানিলা চুরুট পুড়ছে, অস্থির চঞ্চল পায়ে রাজবাহাদুর ঘরের ভেতরে পায়চারি করছেনা চোখেমুখে একটা চাপা আক্রোশ ঠোঁট দুটোয় নিষ্ঠুর কঠিনতা। কখনো একটা রাইফেল তুলে নিয়ে বিরক্তিভরে নামিয়ে রাখেন। কখনো ভোজালি তুলে নিয়ে নিজের হাতের ওপরে ফলাটা পরীক্ষা করেন সেটার ধার আবার কখনো বা জানালার সামনে খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন নিচের জঙ্গলটার দিকে। আজ তিন দিন থেকে উল্লেখযোগ্য একটা কিছু শিকার করতে পারেন নি ক্ষোভে তাঁর দাঁতগুলো কড়মড় করতে থাকে।
তার পরেই বেরিয়ে যান এনার্জি সংগ্রহের চেষ্টায় বাইরের বারান্দায় গিয়ে হাঁক দেন—পেগ।
কিন্তু পরের পয়সায় রাজভোগ খেয়ে এবং রাজোচিত বিলাস করে বেশি দিন কাটানো আর সম্ভব নয়—আমার পক্ষে। রাজবাহাদুরের অনুগ্রহ একটি দামী জিনিস বটে, কিন্তু কলকাতায় আমার ঘর-সংসার আছে, একটা দায়িত্ব আছে তার। সুতরাং চতুর্থ দিন সকালে কথাটা আমাকে পাড়তে হল।
বললাম, এবার আমাকে বিদায় দিন তা হলে
রাজবাহাদুর সবে চতুর্থ পেগে চুমুক দিয়েছেন তখন। তেমনি অসুস্থ আর রক্তাভ চোখে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, আপনি যেতে চান?
–হ্যাঁ, কাজকর্ম রয়েছে—
—কিন্তু আমার শিকার আপনাকে দেখাতে পারলাম না।
—সে না হয় আর একবার হবে।
—হুমা চাপা ঠোঁটের ভেতরেই একটা গম্ভীর আওয়াজ করলেন রাজাবাহাদুর আপনি ভাবছেন আমার ওই রাইফেলগুলো, দেওয়ালে ওই সব শিকারের নমুনা—ওগুলো সব ফার্স?
আমি সন্ত্রস্ত হয়ে বললাম, না, না, তা কেন ভাবতে যাব! শিকার তো খানিকটা অদৃষ্টের ব্যাপার–
—হুম! অদৃষ্টকেও বদলানো চলে রাজাবাহাদুর উঠে পড়লেন আমার সঙ্গে আসুন।
 দুজনে বেরিয়ে এলাম রাজাবাহাদুর আমাকে নিয়ে এলেন হান্টিং বাংলোর পেছন দিকটাতো ঠিক সেখানে—যার চারশো ফুট নিচে টেরাইয়ের অন্যতম হিংস্র অরণ্য বিস্তীর্ণ হয়ে আছে।
এখানে আসতে আর একটা নতুন জিনিস চোখে পড়ল দেখি কাঠের একটা রেলিং দেওয়া সাঁকোর মতন জিনিস সেই সীমাহীন শূন্যতার ওপরে প্রায় পনেরো মোল হাত প্রসারিত হয়ে আছে। তার পাশে দুটো বড় বড় কাঠের চাকা, তাদের সঙ্গে দুজোড়া মোটা কাছি জড়ানো। ব্যাপারটা কী ঠিক বুঝতে পারলাম না।
—আসুন। রাজবাহাদুর সেই ঝুলন্ত সাঁকোটার ওপরে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমিও গেলাম তাঁর পেছনে পেছনে একটা আশ্চর্য বন্দোবস্ত। ঠিক সাঁকোটার নিচেই পাহাড়ী নদীটার রেখা, নুড়ি মেশানো সঙ্কীর্ণ বালুতট তার দুপাশে, তাছাড়া জঙ্গল আর জঙ্গল। নিচে তাকাতে আমার মাথা ঘুরে উঠল। রাজবাহাদুর বললেন, জানেন এসব কী?
–না।
আমার মাছ ধরবার বন্দোবস্ত। এর কাজ খুব গোপনে নানা হাঙ্গামা আছে। কিন্তু অব্যর্থ।
—ঠিক বুঝতে পারছি না।
—আজ রাত্রেই বুঝতে পারবেন। শিকার দেখাতে আপনাকে ডেকে এনেছি, নতুন একটা শিকার দেখাব কিন্তু কোনোদিন এর কথা কারো কাছে প্রকাশ করতে পারবেন না।
কিছু না বুঝেই মাথা নাড়লাম–না।
–তা হলে আজ রাতটা অবধি থাকুন। কাল সকালেই আপনার গাড়ীর ব্যবস্থা করব। রাজবাহাদুর আবার হান্টিং বাংলোর সম্মুখের দিকে এগোলেন কাল সকালের পর এমনিতেই আপনার আর এখানে থাকা চলবে না।
একটা কাঠের সাঁকো, দুটো কপিকলের মতো জিনিস। মাছ ধরার ব্যবস্থা কাউকে বলা যাবে এবং কাল সকালেই চলে যেতে হবে সবটা মিলিয়ে যেন রহস্যের খাসমহল একেবারে আমার কেমন এলোমেলো লাগতে লাগল সমস্ত। কিন্তু ভালো করে জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। রাজাবাহাদুরকে বেশি প্রশ্ন করতে কেমন অস্বস্তি লাগে আমার অনধিকার-চর্চা মনে হয়।
বাংলোর সামনে তিন চারটে ছোট ছোট নোংরা ছেলেমেয়ে খেলা করে বেড়াচ্ছে, হিন্দুস্থানী কীপারটার বেওয়ারিশ সম্পত্তি। কীপারটাকে সকালে রাজাবাহাদুর শহরে পাঠিয়েছেন, কিছু দরকারী জিনিসপত্র কিনে কাল সে ফিরবো ভারী বিশ্বাসী আর অনুগত লোক। মাতৃহীন ছেলেমেয়েগুলো সারাদিন হুটোপাটি করে ডাকবাংলোর সামনে রাজবাহাদুর বেশ অনুগ্রহের চোখে দেখেন ওদের। দোতলার জানলা থেকে পয়সা, রুটি কিংবা বিস্কুট ছুঁড়ে দেন, নিচে ওরা সেগুলো নিয়ে কুকুরের মতো লোফালুফি করে। রাজাবাহাদুর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন সকৌতুকে।
আজও ছেলেমেয়েগুলো হুল্লোড় করে তাঁর চারিপাশে এসে ঘিরে দাঁড়ালো। বললে হুজুর, সেলাম। রাজবাহাদুর পকেটে হাত দিয়ে কতকগুলো পয়সা ছড়িয়ে দিলেন ওদের ভিতরে হরির লুঠের মতো কাড়াকাড়ি পড়ে গেল।
বেশ ছেলেমেয়েগুলি। দুই থেকে আট বছর পর্যন্ত বয়েস আমার ভারী ভালো লাগে ওদের। আরণ্যক জগতের শাল শিশুদের মতো সতেজ আর জীবন্ত প্রকৃতির ভেতর থেকে প্রাণ আহরণ করে যেন বড় হয়ে উঠেছে।
সন্ধ্যায় ডিনার টেবিলে বসে আমি বললাম, আজ রাত্রে মাছ ধরবার কথা আছে আপনার।
চোখের কোনা দিয়ে আমার দিকে তাকালেন রাজবাহাদুরা লক্ষ্য করেছি আজ সমস্ত দিন বড় বেশি মদ খাচ্ছেন আর ক্রমাগত চুরুট টেনে চলেছেনা ভালো করে আমার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলেন নি। ভেতরে ভেতরে কিছু একটা ঘটে চলেছে তাঁর।
রাজবাহাদুর সংক্ষেপে বললেন—হুম।
আমি সসংকোচে জিজ্ঞাসা করলাম, কখন হবে?
একমুখ ম্যানিলা চুরুটের ধোঁয়া ছড়িয়ে তিনি জবাব দিলেন—সময় হলে ডেকে পাঠাবা এখন আপনি গিয়ে শুয়ে পড়ুন। স্বচ্ছন্দে কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিতে পারেন।
শেষ কথাটা পরিষ্কার আদেশের মতো শোনালো। বুঝলাম আমি বেশিক্ষণ আর তাঁর সঙ্গে কথা বলি এ তিনি চান না। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে বলাটা অতিথিপরায়ণ গৃহস্থের অনুনয় নয়, রাজার নির্দেশ এবং সে নির্দেশ পালন করতে বিলম্ব না করাই ভালো।
কিন্তু অতি নরম জাজিমের বিছানায় শুয়েও ঘুম আসছে না। মাথার ভিতর আবর্তিত হচ্ছে অসংলগ্ন চিন্তা। মাছ ধরা, কাঠের সাঁকো, কপিকল, অত্যন্ত গোপনীয়! অতল রহস্য!
তারপর এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যে চৈতন্য আচ্ছন্ন হয়ে এল তা আমি নিজেই টের পাইনি।
মুখের ওপর ঝাঁঝালো একটা টর্চের আলো পড়তে আমি ধড়মড় করে উঠে পড়লাম। রাত তখন কটা ঠিক জানি না আরণ্যক পরিবেশে নির্জনতা আবির্ভূতা বাহিরে শুধু তীব্রকণ্ঠ ঝিঝির ডাক।
আমার গায়ে বরফের মতো ঠাণ্ডা একটা হাত পড়েছে কার। সে হাতের স্পর্শে পা থেকে মাথা পর্যন্ত শিউরে গেল আমার। রাজাবাহাদুর বললেন—সময় হয়েছে, চলুন।
আমি কী বলতে যাচ্ছিলাম—ঠোঁটে আঙুল দিলেন রাজবাহাদুরা কোনো কথা নয়, আসুন।
এই গভীর রাত্রে এমনি নিঃশব্দে আহ্বান—সবটা মিলিয়ে একটা রোমাঞ্চকর উপন্যাসের পটভূমি তৈরী হয়েছে যেন কেমন একটা অস্বস্তি, একটা অনিশ্চিত ভয়ে গা ছমছম করতে লাগল আমার। মন্ত্রমুগ্ধের মতো রাজবাহাদুরের পেছন পেছনে বেরিয়ে এলাম।
হান্টিং বাংলোটা অন্ধকার। একটা মৃত্যুর শীতলতা ঢেকে রেখেছে তাকে একটানা ঝিঝির ডাক—চারিদিকে অরণ্যে কান্নার শব্দের মতো পত্রমর্মরা গভীর রাত্রিতে জঙ্গলের মধ্যে মোটর থামিয়ে বসে থাকতে আমার ভয় করেছিল, আজও ভয় করছে। কিন্তু এ ভয়ের চেহারা আলাদা–এর মধ্যে আর একটা কী যেন মিশে আছে ঠিক বুঝতে পারছি না, অথচ পা-ও সরতে চাইছে না আমার মুখের ওপরে একটা টর্চের আলো, রাজাবাহাদুরের হাতের স্পর্শটা বরফের মতো ঠাণ্ডা, ঠোঁটে আঙুল দিয়ে নীরবতার সেই দুর্বোধ্য কুটিল সংকেত!
টর্চের আলোয় পথ দেখিয়ে রাজাবাহাদুর আমাকে সেই ঝুলন্ত সাঁকোটার কাছে নিয়ে এলেন। দেখি তার উপরে শিকারের আয়োজন। দুখানা চেয়ার পাতা, দুটো তৈরী রাইফেলা। দুজন বেয়ারা একটা কপিকলের চাকা ঘুরিয়ে কী একটা জিনিস নামিয়ে দিচ্ছে নিচের দিকে। এক মুহূর্তের জন্য রাজাবাহাদুর তাঁর নয় সেলের হান্টিং টর্চটা নিচের দিকে ফ্ল্যাশ করলেন। প্রায় আড়াই শো ফুট নিচে সাদা পুঁটলির মতো কী একটা জিনিস কপিকলের দড়ির সঙ্গে নেমে যাচ্ছে দ্রুতবেগে।
আমি বললাম, ওটা কি রাজাবাহাদুর?
—মাছের টোপ।
—কিন্তু এখনও কিছু বুঝতে পারছি না।
—একটু পরে বুঝবেন। এখন চুপ করুন
এবারে স্পষ্ট ধমক দিলেন আমাকে। মুখ দিয়ে ভক ভক করে হুইস্কির তীব্র গন্ধ বেরুচ্ছে। রাজাবাহাদুর প্রকৃতিস্থ নেই। আর কিছুই বুঝতে পারছি না আমি আমার মাথার ভেতর সব যেন গণ্ডগোল হয়ে গেছে। একটা দুর্বোধ্য নাটকের নির্বাক দ্রষ্টার মতো রাজাবাহাদুরের পাশের চেয়ারটাতে আসন নিলাম আমি।
ওদিকে ঘন কালো বনান্তের উপরে ভাঙা চাঁদ দেখা দিল। তার খানিকটা ম্লান আলো এসে পড়ল চারশো ফুট নিচের নদীর জলে, তার ছড়ানো মণিখণ্ডের মতো নুড়িগুলোর উপরে। আবছাভাবে যেন দেখতে পাচ্ছিকপিকলের দড়ির সঙ্গে বাঁধা সাদা পুঁটলিটা অল্প অল্প নড়ছে বালির ওপরে। এক হাতে রাজাবাহাদুর রাইফেলটা বাগিয়ে ধরে আছেন, আর এক হাতে মাঝে মাঝে আলো ফেলছেন নিচের পুঁটলিটায়। চকিত আলোয় যেটুকু মনে হচ্ছে—পুঁটলিটা যেন জীবন্ত, অথচ কী জিনিস কিছু বুঝতে পারছি না। এ নাকি মাছের টোপ! কিন্তু কী মাছ—এ কিসের টোপ?
আবার সেই স্তব্ধতার প্রতীক্ষা। মুহূর্ত কাটছে, মিনিট কাটছে, ঘণ্টা কাটছে। রাজাবাহাদুরের টর্চের আলো বারে বারে পিছলে পড়ছে নিচের দিকে। দিগন্তপ্রসার হিংস্র অরণ্য ভাঙা ভাঙা জ্যোৎস্নায় দেখাচ্ছে তরঙ্গিত একটা সমুদ্রের মতো নিচের নদীটা ঝকঝক করছে যেন একখানা খাপ-খোলা তলোয়ার। অবাক বিস্ময়ে আমি বসে আছি। মিনিট কাটছে, ঘণ্টা কাটছে। টোপ ফেলে মাছ ধরছেন রাজবাহাদুর।
অথচ সব ধোঁয়াটে লাগছে আমার কান পেতে শুনছি—ঝিঝির ডাক, দূরে হাতীর গর্জন, শালপাতার মর্মর। এ প্রতীক্ষার তত্ব আমার কাছে দুর্বোধ্যা শুধু হুইস্কি আর ম্যানিলা চুরুটের গন্ধ এসে লাগছে আমার। মিনিট কাটছে, ঘণ্টা কাটছে। রেডিয়াম ডায়াল ঘড়ির কাঁটা চলেছে ঘুরে। ক্রমশ যেন সম্মোহিত হয়ে গেলাম, ক্রমশ যেন ঘুম এল—আমার। তারপরেই হঠাৎ কানের কাছে। বিকট শব্দে রাইফেল সাড়া দিয়ে উঠল—চারশো ফুট নিচ থেকে উপরের দিকে উৎক্ষিপ্ত হয়ে উঠল প্রচণ্ড বাঘের গর্জন চেয়ারটা শুদ্ধ আমি কেঁপে উঠলাম।
টর্চের আলোটা সোজা পড়ছে নুড়ি-ছড়ানো বালির ডাঙাটার ওপরে পরিষ্কার দেখতে পেলাম ডোরাকাটা অতিকায় একটা বিশাল জানোয়ার সাদা পুঁটলিটার ওপরে একখানা থাবা চাপিয়ে দিয়ে পড়ে আছে, সাপের মতো ল্যাজ আছড়াচ্ছে অন্তিম আক্ষেপো ওপর থেকে ইন্দ্রের বজ্রের মতো অব্যর্থ গুলি গিয়ে লেগেছে তার মাথায়। এত ওপর থেকে এমন দুর্নিবার মৃত্যু নামবে আশঙ্কা করতে পারেনি। রাজাবাহাদুর সোৎসাহে বললেন—ফতে!
এতক্ষণে মাছ ধরবার ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি। সোৎসাহে সোল্লাসে বললাম—মাছ তো ধরলেন, ডাঙায় তুলবেন কেমন করে?
—ওই কপিকল দিয়ে। এই জন্যই তো ওগুলোর ব্যবস্থা।
ব্যাপারটা যেমন বিচিত্র তেমনি উপভোগ্যা আমি রাজাবাহাদুরকে অভিনন্দিত করতে যাব, এমন সময়—এমন সময়—পরিষ্কার শুনতে পেলাম শিশুর গোঙানি ক্ষীণ অথচ নির্ভুল। কিসের শব্দ!
চারশো ফুট নিচ থেকে ওই শব্দটা আসছে। হ্যাঁ—কোনো ভুল নেই! মুখের বাঁধন খুলে গেছে, কিন্তু বড় দেরীতে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল, আমার চুল খাড়া হয়ে উঠল আমি পাগলের মতো চীকার করে উঠলাম, রাজাবাহাদুর, কিসের টোপ আপনার? কি দিয়ে আপনি মাছ ধরলেন?
—চুপ! একটা কালো রাইফেলের নল আমার বুকে ঠেকালেন রাজাবাহাদুর। তারপরেই আমার চারিদিকে পৃথিবীটা পাক খেতে খেতে হাওয়ায় গড়া একটা বুদ্বুদের মতো শূন্যে মিলিয়ে গেল। রাজাবাহাদুর জাপটে না ধরলে চারশো ফুট নিচেই পড়ে যেতাম হয়তো।
* * * *
কীপারের একটা বেওয়ারিশ ছেলে যদি জঙ্গলে হারিয়ে গিয়ে থাকে তা অস্বাভাবিক নয়, তাতে কারো ক্ষতি নেই। কিন্তু প্রকাণ্ড রয়্যাল বেঙ্গল মেরেছিলেন রাজাবাহাদুর–লোককে ডেকে দেখানোর মতো।
তাই আট মাস পরে এই চমৎকার চটি-জোড়া উপহার এসেছে। আট মাস আগেকার সে রাত্রি এখন স্বপ্ন হয়ে যাওয়াই ভালো, কিন্তু এই চটিজোড়া অতি মনোরম বাস্তবা পায়ে দিয়ে একবার হেঁটে দেখলাম, যেমন নরম, তেমনি আরাম।

বিজ্ঞাপন বিভ্ৰাট - শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ে


বিজ্ঞাপন বিভ্ৰাট

সংবাদপত্র পাঠ করিতেছিল এবং সিগারের প্রভুত ধূমে ঘরটি প্রায়ই অন্ধকার করিয়া ফেলিয়াছিল। বেলা প্রায় সাড়ে সাতটা, এমন সময় বন্ধু প্রমথনাথ ঘরে ঢুকিয়াই অতি কষ্টে কাশি চাপিতে চাপিতে বলিল, পর্বতো বহ্নিমান ধূমাৎ। তুমি ঘরে আছ, ধোঁয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে। উঃ, ঘরটা এমন অগ্নিকুণ্ড করে বসে আছ কি করে?
নন্দ হাতের কাগজখানা ফেলিয়া প্রফুল্লস্বরে কহিল, আমি তোমার মতো বিলেত ফেরত সন্ন্যাসী নই যে, চুরুটাটা পর্যন্ত ত্যাগ করতে হবে।
প্রমথ একখানা চেয়ার অধিকার করিয়া বলিল, তুমিই সন্ন্যাসী নামের বেশী উপর্যুক্ত। গাঁজার মতো চুরুটগুলো খেয়ে খেয়ে ইহকাল পরকাল দুই নষ্ট করলে।
নন্দ হো হো করিয়া হাসিয়া বলিল, রাগ করলে ভাই? আমি কিন্তু তোমাকে গাঁজাখের সন্ন্যাসীর সঙ্গে তুলনা করিনি।
নন্দ এবং প্রমথর বন্ধুত্ব আশৈশব দীর্ঘ না হইলেও ঘটনাচক্রে পরস্পরের প্রতি গাঢ় স্নেহবন্ধন অটুট হইয়া পড়িয়াছিল। নন্দ দোহারা, খুব বলবান, চোখে চশমা। রং ময়লা। মুখে তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও দৃঢ়তার এমন একটি সুন্দর সমাবেশ ছিল যে, খুব সুশ্ৰী না হইলেও তাঁহাকে সুপুরুষ বলিয়া বোধ হইত। প্রমথনাথ ফসর্গ ছিপছিপে যুবক, মুখে লালিত্যের বেশ একটা দীপ্তি আছে। তার স্বভাবটি বড় নরমদুর্বল বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। কাহারও কোনও অনুরোধে না বলিবার ক্ষমতা তাহার একেবারেই নাই।
বহু ধনদৌলতের একমাত্র উত্তরাধিকারী প্রমথ বিলাত গিয়া ব্যারিস্টারি পাস করিয়া আসিয়াছিল। বিলাত পৌঁছিয়া সে প্রথম বাঙালীর মুখ দেখিল নন্দর। নন্দর বিলাত যাওয়ার ইতিহাসটা কিছু জটিল। সে গরিবের ছেলে, প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করিবার পর দেখিল, কলেজে পড়বার মতো সংস্থান নাই। আত্মীয়স্বজনের দ্বারস্থ হইবার প্রবৃত্তি ছিল না। অথচ বিলাতে গিয়া উচ্চশিক্ষা লাভের তীব্র অভিলাষ ছিল।
এক দিন সে এক বিলাতযাত্রী জাহাজে খালাসী হইয়া বিলাত পলায়ন করিল। সেখানে পৌঁছিয়া পেটের দায়ে কুলির কাজ আরম্ভ করিয়াছিল। ভাগ্যদেবী নবাগত প্রমথর মালগুলা নন্দর ঘাড়ে চাপাইতে গিয়া নন্দকেই প্রমথর ঘাড়ে চাপাইয়া দিলেন। প্রমথ ও নন্দ উভয়েই তখন নিতান্ত ছেলেমানুষ। নিবন্ধিব বিদেশে পরস্পরকে পাইয়া তাহারা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাইল। প্রমথর টাকায় নন্দও আইন পড়িতে আরম্ভ করিল।
তারপর দুই জনে ব্যারিস্টারি পাস করিয়া দেশে ফিরিয়াছে। নন্দ ব্যবসা আরম্ভ করিয়াছে, বেশ দুই পয়সা উপার্জনও করিতেছে। প্রমথ প্রায় নিষ্কমা; খবরের কাগজ পড়িয়া, দেশনীতি আলোচনা করিয়া এবং সময়ে অসময়ে বন্দুক ঘাড়ে বনে জঙ্গলে ঘুরিয়া বেড়াইয়া যৌবনকালটা অপব্যয় করিয়া ফেলিতেছিল।
প্রমথ আবার আরম্ভ করিল, তুমি ঐ সিগার খাওয়া কবে ছাড়বে বল দিকি?
নন্দ বলিল, যমরাজা বেশী জিদ করলে কি করব বলতে পারি না, তবে তার আগে তো নয়।
প্রমথ বলিল, তার আগে ছাড় কি না দেখা যাবে। এক ব্যক্তির শুভাগমন হলেই তখন ছাড়তে পথে পাবে না।
নন্দ বলিল, ইঙ্গিতটা বোধ হচ্ছে আমার ভবিষ্যৎ গৃহিণীর সম্বন্ধে। তা তিনি কি যমরাজের চেয়েও ভয়ঙ্কর হবেন না কি?
প্রমথ বলিল, অন্তত যমরাজের চেয়ে তাঁদের ক্ষমতা বেশী, তার শাস্ত্রীয় প্রমাণ আছে।
নন্দ কহিল, সেইজন্যই তো আমি এই ক্ষমতাশালিনীদের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতে চাই। তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলামেশা করবার বাসনা মোটেই নেই।
প্রমথ ভ্রূ তুলিয়া বলিল, অৰ্থাৎ বিয়ে কচ্ছ না?
নন্দ উৎফুল্ল তাচ্ছিল্যের সহিত বলিল, নাঃ।
প্রমথ কহিল, এটা তো নতুন শুনছি। কারণ জানতে পারি কি?
নন্দ বলিল, বিয়ে জিনিসটা একদম পুরোনো হয়ে গেছে। ওতে আর রোমান্সের গন্ধটি পর্যন্ত নেই।  বলিয়া প্রসঙ্গটা উড়াইয়া দিবার মানসে খবরের কাগজখানা আবার তুলিয়া লইল।
প্রমথ বলিল, নন্দ ভাই, ওইখানেই তোমার সঙ্গে আমার গরমিল। বিয়েটাই এ পৃথিবীতে নববর্ষের পাঁজির মতো একমাত্র নতুন জিনিসআর যা কিছু সব দাগী, পুরোনো, বস্তাপচা।
নন্দ প্ৰত্যুত্তরে কাগজখানা প্রমথর গায়ে ছুড়িয়া দিয়া বলিল, তার প্রমাণ এই দেখ না। বিয়ে জিনিসটা এতই খেলো হয়ে গেছে যে, কাগজে পর্যন্ত তার বিজ্ঞাপন।
প্রমথ নিক্ষিপ্ত কাগজখানা তুলিয়া লইয়া মনোনিবেশপূর্বক পড়িতে লাগিল।
নন্দ বলিল, তর্ক করে হাঁপিয়ে উঠেছ, এক পেয়ালা চা খাও। এখনও আটটা বাজেনি। বাড়ি গিয়ে নাইতে খেতে তোমার তো সেই একটা।
প্রমথ কোনও জবাব দিল না, নিবিষ্ট-মনে পড়িতে লাগিল। নন্দ বেয়ারাকে ডাকিয়া বলিল, দিদিকে দো পেয়ালা চা বানানে বোলে৷।
এইখানে বলিয়া রাখা ভাল যে, প্রমথ পূর্বে চা খাইত না, কিন্তু সম্প্রতি কয়েকটি অভিনব আকর্ষণে সে চা ধরিয়াছে।
খবরের কাগজখানা পড়িতে পড়িতে প্রমথ মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল, তারপর সেখানা জানুর উপর পাতিয়া বলিল, ওহে, শোনো একটা বিজ্ঞাপন, বলিয়া পড়িতে লাগিল, Wanted a young Barrister bridegroom for a rich beautiful and accomplished Baidya girl. Girls age sixteen. Apply with photograph to Box 1526. পাঠ শেষ করিয়া কাগজখানা দ্বারা নন্দর জানুর উপর আঘাত করিয়া বলিল, ব্যস, বুঝলে হে ব্যারিস্টার ব্রাইডগুম, একটা দরখাস্ত করে দাও, খুব রোমান্টিক হবে।
নন্দ বলিল, আমি এখানে একমাত্র ব্রাইডগুম নই। শ্ৰীমান প্রমথনাথ সেন মহাশয়ই এই ষোড়শীর উপর্যুক্ত পাত্র বলে মনে হচ্ছে।
প্রমথ হাসিয়া প্রতিবাদ করিল, কিছুতেই না। নন্দলাল সেনগুপ্ত থাকতে প্রমথনাথ সে দিকে কোনমতেই দৃষ্টিপাত করতে পারেন না।
নন্দ একটা কপট দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, তবে থাক, কারুর দৃষ্টিপাত করে কােজ নেই। আর কোনও ভাগ্যবান ব্যারিস্টার এই তরুণীকে লাভ করুক।
প্রমথ জিদ ধরিয়া বলিল, না না, এসো না, একটু মজাই করা যাক! তারপর তোমার দরখাস্ত যে মঞ্জুর হবে, তারই বা ঠিক কি?
নন্দ বলিল, বেশ, যদি দরখাস্ত করবারই ইচ্ছে হয়ে থাকে, নিজেই কর।
প্রমথ একটু চকিত হইয়া বলিল, না, তা কি হয়? তুমি কর।
নন্দ বলিল, বাঃ, এ তোমার বেশ বিচার! মজা করবে তুমি, আর ফ্যাসাদে পড়ব আমি?—আচ্ছা, এস, এক কাজ করা যাক-লটারি কর, যার নাম ওঠে।
মজা করিবার ইচ্ছ। আর প্রমথর বেশী ছিল না; কিন্তু সেই প্ৰথমে আগ্রহে দেখাইয়াছে, অতএব অনিচ্ছার সহিত সম্মত হইল। তখন দু টুকরো কাগজে দুজনের নাম লিখিয়া একটা হ্যাটের তলায় চাপা দেওয়া হইল। নন্দ হ্যাটের তলায় হাত ঢুকাইয়া একটা কাগজ বাহির করিয়া নাম পড়িয়াই উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া সপদদাপে বলিল, ভাগঃ ফলতি সর্বত্রং ন বিদ্যাং ন চ পৌরুষং-হে ভাগ্যবান, এই দেখ বলিয়া কাগজখানা তুলিয়া ধরিয়া নামটা দেখাইল।
প্রমথ বিকলভাবে একটু হাসিয়া বলিল, নিজের নাম না ওঠায় এতদূর বিমর্ষ হয়ে পড়েছ যে, সংস্কৃত ভাষাটার উপরও তোমার কিছুমাত্র মমতা নেই দেখছি।
এবার নন্দ উৎসাহের তাড়নায় কাগজ-কলম লইয়া বলিল, আর দেরি নয়, দরখাস্ত লিখে ফেলা যাক। বাঙলায় না ইংরিজিতে?
প্রমথর উদ্যম একেবারে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছিল, সে ত্ৰিয়মাণাভাবে বলিল, না, ইংরিজিতে কাজ নেই, আবার humble petition…Most respectfully shewenth লিখে ফেলবে। বাঙলাই ভাল।
নন্দ তাহার যৎকিঞ্চিৎ বাঙলার সাহায্যেই দরখাস্ত লিখিয়া ফেলিল,—
মহাশয়,
আমি ব্যারিস্টার, বিজ্ঞাপনে বর্ণিত কন্যাকে বিবাহ করিতে চাহি।
ইতি।
শ্ৰীপ্ৰমথনাথ সেন।
দরখাস্ত শুনিয়া প্রমথ বলিল, এক কাজ করলে হয় না? নামটা উপস্থিত বদলে দেয়া যাক, তাহলে রোমান্স জামবে ভাল। কোনও উপায়ে এই বিজ্ঞাপনের হাত হইতে আত্মরক্ষা করিতে পারিলে এখন সে বাঁচে।
নন্দ রাজি হইয়া বলিল, বেশ, কি নাম বল।
প্রমথ বলিল, ঐ অর্থেরই অন্য কোনও নাম।
জিজ্ঞাসা করিল, প্রমথ কথাটার মানে কি হে?
এমন সময় দুই হাতে দু পেয়ালা চা সাবধানে ধরিয়া একটি পনেরো ষোলো বছরের মেয়ে ঘরে ঢুকিল। পাতলা ছিপছিপে, সুশ্ৰী সুগঠন দেহ; একবার দেখিলেই বেশ বোঝা যায়,–নন্দর বোন। নিতান্ত সাধারণ আটপৌরে শাড়ি-শেমিজ পরাপায়ে জুতা নাই। অমিয়া এখনও অবিবাহিতা। নন্দ বিলাত হইতে ফিরিবার অনতিকাল পরে তাহার বাপ-মা দুজনেই মারা গিয়াছিলেনএখন অমিয়াই তাহার একমাত্র রক্তের বন্ধন।
উপস্থিত প্রসঙ্গটার মাঝখানে অমিয়া আসিয়া পড়ায় প্রমথ মনে মনে বিব্রত ও লজ্জিত হইয়া উঠিল। নন্দ পূর্ববৎ স্বচ্ছন্দে জিজ্ঞাসা করিল, প্রমথ কি প্রেমসংক্রান্ত কোনও কথা না কি?
অমিয়া চায়ের পেয়ালাদুটি সবেমাত্র টেবিলের উপর রাখিয়াছিল। ভাষা সম্বন্ধে দাদার প্রগাঢ় অজ্ঞতা দেখিয়া সে হাসি সামলাইতে পারিল না। কিন্তু হাসিয়া ফেলিয়াই অপ্ৰস্তুতভাবে বলিয়া উঠিল, বাঃ দাদা
নন্দ অর্বাচীনের মতো ভগিনীকে প্রশ্ন করিল, অমিয়া, তুই জানিস, প্রমথ কথার মানে?
অমিয়া আড়চোখে একবার প্রমথর মুখখানা দেখিয়া লইয়া মুখ টিপিয়া টিপিয়া হাসিতে লাগিল।
প্রমথ লজ্জার সঙ্কটে তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, প্রমথনাথের বদলে ভূতনাথ হতে পাবে।
শব্দটির প্রকৃত অৰ্থ বুঝিতে পারিয়া নন্দ কিছুক্ষণ উচ্চারবে হাসিয়া লইল। তারপর দরখাস্ত হইতে প্রমথনাথ কাটিয়া ভূতনাথ বসাইয়া দিল।
ব্যাপার কি বুঝিতে না পারিয়া অমিয়া কৌতূহলের সহিত দরখাস্তখানা নিরীক্ষণ করিতেছিল। প্রমথ বেচারা এতই বিহ্বল হইয়া পড়িয়াছিল যে, এক চুমুক গরম চা খাইয়া মুখ পুড়াইয়া উঃ করিয়া উঠিল। চকিতে ফিরিয়া অমিয়া বলিল, বড্ড গরম বুঝি—?
অধিকতর লজ্জায় ঘাড় নাড়িয়া প্রতিবাদস্বরূপ প্রমথ আর এক চুমুক চা খাইয়া ফেলিল এবং এবার মুখের দহটাকে কোনও মতেই উর্ধর্বস্বরে প্রকাশ করিল না।
নন্দ বলিল, ফটোর কি করা যায়? তোমার ফটো একখানা আছে বটে আমার কাছে-? বলিয়া ঘরের কোণের একটি ছোট টিপাই-এর উপর হইতে অ্যালবামখানা তুলিয়া লইল। অমিয়া আস্তে আস্তে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল এবং দরজা পার হইয়াই তাহার দ্রুত পলায়নের পদশব্দ ফটো-অনুসন্ধাননিরত নন্দর কানে গেল না।
নন্দ অ্যালবাম ভাল করিয়া খুজিয়া বলিল, কৈ, তোমার ছবিখানা দেখতে পাচ্ছি না! গেল কোথায়?
পলাতকার পদধ্বনি যে শুনিয়েছিল, সে আরক্ত কৰ্ণমূলে বলিল, আছে কোথাওওইখানেইনন্দ বলিল, না হে, এই দেখ না, জায়গাটা খালিতারপর গলা চড়াইয়া ডাকিল, অমিয়া-অমিয়া
প্রমথ তাড়াতাড়ি ব্যাকুলভাবে বলিল, দরকার কি নন্দ, তোমার একখানা ছবিই দিয়ে দাও না!
নন্দ কিছুক্ষণ প্রমথর মুখের পানে তাকাইয়া থাকিয়া সহস্যে বলিল, তোমার মতলব কি বলতো? এ যে আগাগোড়াই জুঙ্গুরি! শেষে আমার ঠ্যাং-এ দড়ি পড়বে না তো?
প্রমথ বলিল, না না, কোনও ভয় নেই। এখন ফটোখানা দিয়ে দাও, তারপর বিয়ে না হয় না। কোরো।
নন্দ নিজের একখানা ফটো খামের মধ্যে পুরিয়া বলিল, তুমি নিশ্চিন্ত হতে পার, বরকর্তার পদটা আমিই গ্ৰহণ করলুম। যা কিছু কথাবার্তা আমিই করব। বলিয়া চিঠিতে নিজের ঠিকানা দিয়া খাম বন্ধ করিয়া চা-পানে মনোনিবেশ করিল।

০২.
দিন পনেরো পরে প্রমথ নন্দর বাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইল।
কি হে, কি খবর?
নন্দ একরাশি ধূম উদিগরণ করিয়া বলিল, খবর সব ভাল। অ্যাদ্দিন কোথায় ছিলে?
প্রমথ বলিল, ময়ূরভঞ্জে গিয়েছিলুম ভালুক শিকার করতে।
নন্দ বলিল, আমাকে একটা খবর দিয়ে গেলেই ভাল করতে। তা সে যাক, এদিকে সব ঠিক।
প্রমথ জিজ্ঞাসা করিল, সব ঠিক? কিসের?
নন্দ প্রমথর নির্দোষ স্কন্ধের উপর এক প্ৰচণ্ড চপেটাঘাত করিয়া বলিল, কিসের আবার? তোমার বিয়ের।
প্রমথ আকাশ হইতে পড়িল, আমার বিয়ের? সে আবার কি?
বস্তুত সেদিনকার বিজ্ঞাপনের ব্যাপারটা প্রমথর বিন্দুবিসর্গও মনে ছিল না। বিস্মৃতির আনন্দে সে এই কটা দিন ময়ূরভঞ্জের জঙ্গলে দিব্য নিশ্চিন্তমনে কাটাইয়া দিয়াছে। তাই নন্দ যখন নিতান্ত ভাবলেশহীন বৈজ্ঞানিকের মতো তাহার মধ্যাকাশে মস্ত একটা ধূমকেতু দেখাইয়া দিল, তখন প্রমথ ভয়ব্যাকুলের মতো বসিয়া পড়িল। নন্দ স্বচ্ছন্দে বলিতে লাগিল, সবই ঠিক করে ফেলা গেছে। মেয়ে দেখা, এমন কি, আশীর্বাদ পর্যন্ত। মেয়েটি সত্যিই সুন্দরী হে; এবং শিক্ষিতা, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। মেয়ের বাপ বেশ আলোকপ্ৰাপ্ত লোক। কোনও রকম কুসংস্কারের বালাই নেই। মেয়েটির নাম সুকুমারী।
প্রমথ অস্থির হইয়া বলিল, আমি এই কদিন ছিলুম না, আর তুমি সব গোল পাকিয়ে বসে আছ?
নন্দ বলিল, তুমি না থাকায় বড় অসুবিধায় পড়া গিয়েছিল। অগত্যা তোমার হয়ে আশীর্বাদটাও আমি গ্ৰহণ করেছি। কন্যাপক্ষের এখনও ধারণা যে, আমিই বর। সে ভুল ভাঙবে একেবারে বিয়ের রাত্রে।
প্রমথ ব্যাকুলস্বরে বলিল, ভাই, সবই যখন তুমি করলে, তখন বিয়েটাও কর। আমায় রেহাই দাও।
নন্দ ফিরিয়া বলিল, কি রকম? তখন নিজে কথা দিয়ে এখন পেছুচ্ছ? কিন্তু তা তো হতে পারে না। সমস্ত ঠিক হয়ে গেছে-এই ৭ই বিয়ের দিন।
প্রমথ রাগ করিয়া বলিল, কেন তুমি আমায় না জানিয়ে সব ঠিক করে বসলে?
নন্দ বলিল, এ তোমার অন্যায় কথা। তখনই আমি তোমায় বলে দিয়েছিলুম।
প্রমথ বলিল, বেশ, যা হয়ে গেছে যাক, এখন তুমিই বিয়ে কর।
দৃঢ়স্বরে নন্দ বলিল, কখনই না। তোমার জন্যে পাত্রী স্থির করে তাকে নিজে বিয়ে করা আমার পক্ষে অসম্ভব।
প্রমথ বলিল, তাহলে আমিও নিরুপায়।
নন্দ ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিল, অৰ্থাৎ?
অর্থাৎ আমি এখন বিয়ে করতে পারব না।
তুমি চাও চুক্তিভঙ্গের অপরাধে আমি জেলে যাই?
প্রমথ রাগিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, জেলে যাওয়াই তোমার উচিত। তাহলে যদি একটু কাণ্ডজ্ঞান হয়।  বলিয়া হন-হন করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
নন্দ চেঁচাইয়া বলিল, মনে থাকে যেন, ৭ই বিয়েগোধূলি লগ্নে। নিমন্ত্রণপত্র আজই আমি ইসু করে দিচ্ছি।
প্রমথ যতই রাগ করিয়া চলিয়া আসুক না, দোষ যে নন্দর অপেক্ষা তাহারই বেশী, তাহা সে মর্মে মর্মে অনুভব করিতে লাগিল এবং এই গুরুতর দুর্ঘটনার জন্য নিজেকে অশেষভাবে লাঞ্ছিত করিতেও ত্রুটি করিল না। এক ধরনের লোক আছেযদিও খুব বিরলযাহারা নিজের দোষ সবচেয়ে বড় করিয়া দেখে এবং নিজের লঘু পাপের উপর গুরুদণ্ড চাপাইয়া দেয়, যাহার হয়তো কোনই প্রয়োজন ছিল না। আত্মলাঞ্ছনা শেষ করিয়া প্রমথ নিজের উপর এই কঠিন দণ্ডবিধান করিল যে, মন তাহার এ বিবাহের যতই বিপক্ষে হউক না কেন, বিবাহ তাহাকে করিতেই হইবে। ইহাই তাহার মুঢ়তার উপর্যুক্ত দণ্ড। তাছাড়া নন্দ যখন একটা কাজ করিয়া ফেলিয়াছে, তখন তাহাকে পাঁচজনের সম্মুখে অপদস্থ করা যাইতে পারে না। নাকোনও কারণেই নহে।
 
বিবাহের দিন যথাসময়ে আসিতে বিলম্ব করিল না, এবং সে দিন সন্ধ্যাবেল প্রমথকে বন্ধুবান্ধব দ্বারা পরিবৃত করিয়া বরকতা নন্দলাল মোটর আরোহণে বিবাহস্থলে উপস্থিত হইতেও বিলম্ব করিল। না। প্রমথ ইচ্ছা করিয়াই কোনও রকম সাজসজ্জা করে নাইমুখ ভারি করিয়া বসিয়াছিল। তাহাকে দেখিয়া বর বলিয়া মনেই হয় না। বরং নন্দ বরকতা বলিয়া বেশের বিশেষ পরিপাট্যসাধন করিয়া আসিয়াছিল। এ ক্ষেত্রে অজ্ঞ ব্যক্তির কাছে সেই বর বলিয়া প্ৰতীয়মান হইল।
কন্যার পিতা ল্যানসডাউন রোডে বাড়ি ভাড়া করিয়াছিলেন। সেইখানেই বিবাহ। বরপক্ষ সেখানে উপস্থিত হইবামাত্র মহা হুলস্থূল পড়িয়া গেল। চিৎকার, হাঁকাহাঁকি, উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনির মধ্যে কন্যাকর্তা তাড়াতাড়ি বরকে নামাইয়া লইতে ছুটিয়া আসিলেন। নন্দ তখন নামিয়া পড়িয়াছেপ্রমথ গোঁজ হইয়া গাড়ির মধ্যে বসিয়া আছে। সে মনে মনে ভাবিতেছে, যাঁহার কন্যাকে সে বিবাহ করিতেছে, তাঁহার নামটা পর্যন্ত সে জানে না-জানিবার দরকারও নাই। কোনও রকমে এই পাপ-রাত্ৰি কাটিলে বাঁচা যায়। তারপর, পরের কথা পরে ভাবিলেই চলিবে।
হঠাৎ অত্যন্ত পরিচিত কণ্ঠস্বরে সচকিত হইয়া প্রমথ তাকাইয়া দেখিল, তাহারই মাতুল প্রমদাবাবু সাদরে নন্দর বাহু ধরিয়া বলিতেছেন, এস বাবা, এস।
প্রমথর মনের মধ্যে সন্দেহের বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল, সে চিৎকার করিয়া উঠিল, এ কি মামা, তুমি?
প্রমদাবাবু ফিরিয়া প্রমথকে দেখিয়া বলিলেন, এ কি প্রমথ, তুইও বরযাত্রী না কি? কোথায় ছিলি এত দিন? খুঁজে খাঁজে হয়রান, কোথাও সন্ধান না পেয়ে শেষে চিঠি লিখে রেখে এলুম। চিঠি পেয়েছিলি তো?
প্রমথ উত্তেজিত স্বরে বলিল, কোন চিঠি?
সুকুর বিয়ের নেমন্তান্ন চিঠি।
হায় হায়! ময়ুরভঞ্জ হইতে ফিরিবার পর প্রমথ একখানা চিঠিও খুলিয়া দেখে নাই।
এই সময়টার জন্যই নন্দ অপেক্ষা করিতেছিল। সে সহাস্যমুখে সকলের দিকে ফিরিয়া বলিতে আরম্ভ করিল, দেখুন, একটা ভুল গোড়া থেকেই হয়ে এসেছে, এখন তার সংশোধন হওয়া দরকার। আজ বিবাহের বর-
প্রমথ মোটর হইতে লাফাইয়া নন্দর হাত সজোরে চাপিয়া ধরিল; বলিল, নন্দ, চুপ কর। একটা কথা আছে, শুনে যাও। বলিয়া তাহাকে টানিতে টানিতে অন্তরালে লইয়া গেল। কন্যাপক্ষীয় এবং বরপক্ষীয় সকলেই অবাক হইয়া রহিল।
প্রমথ বলিল, তুমি একটা আস্ত গাধা। করেছ কি! সুকু যে আমার বোন হয়! প্রমদাবাবু আমার সাক্ষাৎ মামা।
নন্দ হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল! প্রমথ হাসিয়া বলিল, হাঁ করলে কি হবে? এখন চল, ভগিনীকে উদ্ধার কর। কেলেঙ্কারী যা করবার, তা তো করেছ। এখন মামার জাতটাও মারবে?
নন্দ এমনই স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিল যে, বিবাহ শেষ না হইয়া যাওয়া পর্যন্ত একটি কথাও বলিতে পারে নাই। সম্প্রদানের সময় বরের নাম লইয়া একটু গোলমাল হইয়াছিল, কিন্তু তাহা সহজেই কাটিয়া গেল। প্রমথ বুঝাইয়া দিল যে, নন্দর ডাকনাম ভুতো।
বিবাহ চুকিয়া গেলে প্রমথ নন্দকে জিজ্ঞাসা করিল, কি হে, বিয়েটা রোমান্টিক বোধ হচ্ছে তো? নন্দ বলিল, হুঁ। কিন্তু তোমাকে বঞ্চিত করে ভাল করিনি, এখন বোধ হচ্ছে।
বটেকেন?
কি জানি যদি আবার পরে দাবি করে বস!
প্রমথ কৃত্রিম কোপে ঘুষি তুলিয়া বলিল, চোপরও।
নন্দ বলিল, সে যেন হল। কিন্তু তোমার মুখের গ্রাস কেড়ে নিলুম। তোমার একটা হিল্লে করে দিতে হবে তো!
প্রমথ নিরীহ ভালমানুষের মতো বলিল, হিল্লে তো তোমার হাতেই আছে।
প্রমথ অসহিষ্ণু হইয়া বলিল, থাক গে। নন্দ, আমাকে আজ ছুটি দাও ভাই-আমার একটু কাজ আছে।
নন্দ বলিল, কি কাজ না বললে ছুটি পাচ্ছি না।
আমাকে একবার-একবার অমিয়াকে খবর দিতে হবে।
অমিয়াকে খবর কাল দিলেই হবে। এই রাত্রে তার ঘুম ভাঙিয়ে আমার বিয়ের খবর দেবার দরকার নেই।
কিন্তু আমার পরিত্রাণের খবরটা তো দেওয়া দরকার।
তার মানে?
তার মানে, তুমি একটি গাধা, তার চেয়েও বড়একটি উট। এখনও বুঝতে পারনি?
সহসা প্রমথর আগা-গোড়া সমস্ত ব্যবহারটা স্মরণ করিয়া নন্দর মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। সে প্রমথর হাতখানা ধরিয়া তিন চারবার জোরে ঝাঁকানি দিয়া বলিল, অ্যাঁ, অমিয়া তোমার মাথাটি খেয়েছে? তাই বুঝি। এ বিয়েতে এত আপত্তি? ওঃ, What a fool I have been! ফটোখানা তাহলে অমিয়া হস্তগত করেছিলআর আমি বেয়ারাটিকে মিছিমিছি বাপান্ত করলুম! কিন্তু এত কাণ্ড করবার কি দরকার ছিল? আমাকে একবার বললেই তো সব গোল চুকে যেত।
প্রমথ লজ্জিত হইয়া বলিল, না না, বলবার মতো কিছু হয়নিশুধু মনে মনে-। তাহলে তোমার অমত নেই তো?
নন্দ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, প্রমথ ভাই, কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমাদের বন্ধুত্বের অপমান করতে চাইনে। কিন্তু অমিয়ার যে এ ভাগ্য হবে, তা আমার আশার অতীত।
প্রমথ তাড়াতাড়ি নন্দকে বাহুবেষ্টনে বদ্ধ করিয়া বলিল, থাক, হয়েছে হয়েছে। আমি তাহলে তাকে গিয়ে খবর দিয়ে আসি যে, আমার বোনের সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়ে গেছে।