সারদামঙ্গল – ৫ম সর্গ
September 10, 2019
No comments
সারদামঙ্গল – ৫ম সর্গ
গীতি
[রাগিণী বেহাগ,– তাল কাওয়ালী]
মধুর রজনী,
মধুর ধরণী,
মধুর, চন্দ্রমা, মধুর সমীর!
ভাগীরথী-বুকে
ভাসি ভাসি সুখে
চলে ফুলময়ী তরী ধীর ধীর!
আলুথালু কেশ,
আলুথালু বেশ,
ঘুমায় কামিনী রূপসী রুচির!
অপরূপ হাস
আননে বিকাশ,
অধরপল্লব অলপ অধীর!
না জানি কেমন
দেখিছে স্বপন
মধুর–মধুর–মুরতি মদির!
১
বেলা ঠিক দ্বিপ্রহর!
দিনকর খরতর,
নিঝুম নীরব সব–গিরি, তরু, লতা।
কপোতী সুদূর বনে
ঘুঘু–ঘু করুণ স্বনে
কাঁদিয়ে বলিছে যেন শোকের বারতা।
২
তৃষায় ফাটিছে ছাতি,
জল খুঁজে পাতি পাতি
বেড়ায় মহিষযূথ চারি দিকে ফিরে।
এলায়ে পড়িছে গা,
লটপট করে পা,
ধুঁকিয়ে হরিণগুলি চলে ধীরে ধীরে।
৩
কিবে স্নিগ্ধ দরশন,
তরুরাজি ঘন ঘন,
অতল পাতালপুরী নিবিড় গহন!
যত দূর যায় দেখা
ঢেকে আছে উপত্যকা,
গভীর গম্ভীর স্থির মেঘের মতন।
৪
কায়াহীন মহাছায়া
বিশ্ব-বিমোহিনী মায়া
মেঘে শশীঢাকা রাকা-রজনীরূপিণী,
অসীম কানন-তল
ব্যেপে আছে অবিরল;
উপরে উজলে ভানু, ভূতলে যামিনী।
৫
ঘোর্ ঘোর্ সমুদয়,
কি এক রহস্যময়,
শান্তি, তৃপ্তিময়, ভুলায় নয়ন;
অনন্ত বরষাকালে
অনন্ত জলদজালে
লুকায়ে রেখেছে যেন জ্বলন্ত তপন।
৬
পত্র-রন্ধ্র ধরি ধরি
কিরণের ঝারা ঝরি
মাণিক ছড়িয়ে যেন পড়েছে কাননে,
চিকন শাদ্বল দলে
দীপ্ দীপ্ কোরে জ্বলে
তারকা ছড়ান যেন বিমল গগনে॥
৭
নভ-চুম্বী শৃঙ্গবরে
ও কি দপ্ দপ্ করে!
কুঞ্জে কুঞ্জে দাবানল হইল আকুল;
তরু থেকে তরুপরে,
বন হতে বনান্তরে
ছুটে, যেন ফুটে ওঠে শিমুলের ফুল–
রাশি রাশি শিমুলের ফুল।
৮
অর্চ্চিপুঞ্জ লক লক,
ভ্বক ভ্বক, ধ্বক ধ্বক,
দাউ দাউ ধুধু ধুধু, ধায় দশ দিকে;
ঝল্কা ঝল্কা হল্কা ছোটে,
বোঁবোঁ বোঁবোঁ চর্ক্কি লোটে,
মাতাল ছুটেছে যেন মনের বেটিকে।
৯
দেখিতে দেখিতে দেখ
কেবল অনল এক,
এক মাত্র মহাশিখা ওঠে নিরবধি;
আগ্নেয় শিখর ’পরে
যেন ওঠে বেগভরে
ভীষণ গগন-মুখী আগুনের নদী।
১০
দিগঙ্গনাগণ যেন
আতঙ্কে আড়ষ্ট হেন,
অটল প্রশান্ত গিরি বিভ্রান্ত উদাস;
চতুর্দ্দিকে লম্ফে ঝম্পে,
মত্ত যেন রণদম্ফে
তোল্পাড় কোরে ধায় দারুণ বাতাস–
উঃ! কি আগুন-মাখা দারুণ বাতাস!
১১
ত্রিলোকতারিণী গঙ্গে,
তরল তরঙ্গ রঙ্গে
এ বিচিত্র উপত্যকা আলো করি করি,
চলেছে মা মহোল্লাসে!
তোমারি পুলিনে হাসে,
সুদূর সে কলিকাতা আনন্দ-নগরী।
১২
আহা, স্নেহ-মাখা নাম,
আনন্দ–আনন্দধাম,
প্রিয় জন্মভূমি তুমি কোথায় এখন!
এ বিজন গিরি-দেশে
প্রকৃত প্রশান্ত বেশে
যতই সান্ত্বনা করে, কেঁদে ওঠে মন;–
কেন মা! আমার তত কেঁদে ওঠে মন!
১৩
হে সারদে দাও দেখা!
বাঁচিতে পারি নে একা,
কাতর হয়েছে প্রাণ, কাতর হৃদয়;
কি বলেছি অভিমানে
শুনো না শুনো না কানে,
বেদনা দিও না প্রাণে ব্যথার সময়!
১৪
অহ, অহ, ওহো, ওহো,
কি মহান্ সমারোহ!
ঘোর-ঘটা মহাছটা কেমন উদার!
নিসর্গ মহান্ মূর্ত্তি
চতুর্দ্দিকে পায় স্ফুর্ত্তি,
চতুর্দ্দিকে যেন মহাসমুদ্র অপার।
১৫
অনন্ত তরঙ্গ-মালা
করিতে করিতে খেলা
কোথায় চলিয়া গেছে, চলে না নজর;
দৃষ্টিপথ-প্রান্তভাগে
ময়ায় মিশিয়া জাগে
উদার পরার্থরাজি সাজি থরে থর।
১৬
উদার-উদারতর
দাঁড়ায়ে শিখর-পর
এই যে হৃদয়-রাণী ত্রিদিব-সুষমা!
এ নিসর্গ-রঙ্গভূমি,
মনোরমা নটী তুমি,
শোভার সাগরে এক শোভা নিরুপমা।
১৭
আননে বচন নাই,
নয়নে পলক নাই,
কান নাই মন নাই আমার কথায়;
মুখখানি হাসহাস,
আলুথালু বেশ বাস
আলুথালু কেশপাশ বাতাসে লুটায়।
১৮
না জানি কি অভিনব
খুলিয়ে গিয়েছে ভব
আজি ও বিহ্বল মত্ত প্রফুল্ল নয়নে!
আদরিণী, পাগলিনী,
এ নহে শশি-যামিনী;
ঘুমাইয়ে একাকিনী কি দেখ স্বপনে!
১৯
আহা কি ফুটিল হাসি!
বড় আমি ভালবাসি
ওই হাসিমুখখানি প্রেয়সী তোমার,
বিষাদের আবরণে
বিমুক্ত ও চন্দ্রাননে
দেখিবার আশা আর ছিল না আমার!
দরিদ্র ইন্দ্রত্ব লাভে
কতটুকু সুখ পাবে,
আমার সুখের সিন্ধু অনন্ত উদার;–
কবির সুখের সিন্ধু অনন্ত উদার!
২০
ও বিধু-বদন-হাসি
গোলাপ-কুসুম-রাশি,
ফুটে আছে যে জনার নেশার নয়নে;
সে যেন কি হয়ে যায়,
সে যেন কি নিধি পায়,
বিহ্বল পাগল প্রায়, বেড়ায় কি বোকে বোকে আপনার মনে,
এস বোন, এস ভাই
হেসে খেলে চ’লে যাই
আনন্দে আনন্দ করি আনন্দ-কাননে!
এমন আনন্দ আর নাই ত্রিভুবনে!
২১
এমন আনন্দ আর নাই ত্রিভুবনে!
হে প্রশান্ত গিরি-ভূমি,
জীবন জুড়ালে তুমি
জীবন্ত করিয়ে মম জীবনের ধনে!
এমন আনন্দ আর নাই ত্রিভুবনে!
২২
প্রিয়ে সঞ্জীবনী লতা,
কত যে পেয়েছি ব্যথা
হেরে সে বিষাদময়ী মূরতি তোমার!
হেরে কত দুঃস্বপন
পাগল হয়েছে মন,
কতই কেঁদেছি আমি কোরে হাহাকার!
২৩
আজি সে সকলি মম
মায়ার লহরী সম
আনন্দ-সাগর-মাঝে খেলিয়া বেড়ায়।
দাঁড়াও হৃদয়েশ্বরী,
ত্রিভুবন আলো করি,
দু নয়ন ভরি ভরি দেখিব তোমায়!
২৪
দেখিয়ে মেটে না সাধ
কি জানি কি আছে স্বাদ,
কি জানি কি মাথা আছে ও শুভ আননে!
কি এক বিমল ভাতি,
প্রভাত করেছে রাতি;
হাসিছে অমরাবতী নয়ন-কিরণে!
২৫
এমন সাধের ধনে
প্রতিবাদী জনে জনে,
দয়া মায়া নাই মনে, কেমন কঠোর!
আদরে গেঁথেছে বালা
হৃদয়-কুসুম-মালা,
কৃপাণে কাটিবে কে রে সেই ফুলডোর!
২৬
পুন কেন অশ্রুজল!
বহ তুমি অবিরল!
চরণ-কমল আহা ধুয়াও দেবীর!
মানস-সরসী-কোলে
সোণার নলিনী দোলে,
আনিয়ে পরাও গলে সমীর সুধীর!
বিহঙ্গম! খুলে প্রাণ
ধর রে পঞ্চম তান!
সারদা-মঙ্গল গান গাও কুতূহলে!
ইতি
শান্তি
গীতি
[রাগিণী সিন্ধু-ভৈরবী,-তাল ঠুংরি]
প্রিয়ে, কি মধুর মনোহর মূরতি তোমার!
সদা যেন হাসিতেছে আলয় আমার!
সদা যেন ঘরে ঘরে
কমলা বিরাজ করে,
ঘরে ঘরে দেববীণা বাজে সারদার!
ধাইয়ে হরষ-ভরে
কল কোলাহল করে,
হাসে খেলে চারি দিকে কুমারী কুমার!
হয়ে কত জ্বালাতন
করি অন্ন আহরণ,
ঘরে এলে উলে যায় হৃদয়ের ভার!
মরুময় ধরাতল,
তুমি শুভ্র শতদল,
করিতেছ ঢলঢল সমূখে আমার!
ক্ষুধা তৃষা দূরে রাখি,
ভোর হ’য়ে ব’সে থাকি,
নয়ন পরাণ ভোরে দেখি অনিবার!–
তোমায়, দেখি অনিবার।
তুমি লক্ষ্মী-সরস্বতী,
আমি ব্রহ্মাণ্ডের পতি,
হোগ্গে এ বসুমতী যায় খুসি তার!
সারদামঙ্গল – ৪র্থ সর্গ
September 10, 2019
No comments
সারদামঙ্গল – ৪র্থ সর্গ
গীতি
[রাগিণী ভৈরবী,-তাল ঠা-ঠুংরি]
কোথা গো প্রকৃতি সতী সে রূপ তোমার
যে রূপে নয়ন মন ভুলাতে আমার।
সেই সুরধুনী-কূলে
ফুলময় ফুলে ফুলে,
বেড়াইতে বনবালা পরি ফুলহার।
নবীন-নীরদ-কোলে
সোণার যে দোলা দোলে,
ক্ষণেক দুলিতে, ক্ষণে পালাতে আবার।
সুধাংশুমণ্ডলে বসি
খেলিতে লইয়ে শশী,
হাসিয়ে ছড়িয়ে দিতে তারকারতন;–
হাসি দিগঙ্গনাগণে
ধরি ধরি সে রতনে
খেলিত কন্দুক-খেলা, হসিত সংসার।
এ তমান্ধ তলাতলে
কি বিষম জ্বালা জ্বলে,
কেবল জ্বলিয়ে মরি ঘোচে না আঁধার।
চল দেবী লয়ে চল,
যথা জাগে হিমাচল,
উদার সে রূপরাশি দেখি একবার!
১
অসীম নীরদ নয়।
ও-ই গিরি হিমালয়!
উথলে উঠেছে যেন অনন্ত জলধি;
ব্যেপে দিগ্ দিগন্তর,
তরঙ্গিয়া ঘোরতর,
প্লাবিয়া গগনাঙ্গন জাগে নিরবধি।
২
বিশ্ব যেন ফেলে পাছে
কি এক দাঁড়ায়ে আছে!
কি এক প্রকাণ্ড কাণ্ড মহান্ ব্যাপার!
কি এক মহান্ মূর্তি,
কি এক মহান্ স্ফূর্তি
মহান্ উদার সৃষ্টি প্রকৃতি তোমার!
৩
পদে পৃথ্বী, শিরে ব্যোম,
তুচ্ছ তারা সূর্য্য সোম
নক্ষত্র নখাগ্রে যেন গণিবারে পারে;
সমুখে সাগরাম্বরা
ছড়িয়ে রয়েছে ধরা,
কটাক্ষে কখন যেন দেখিছে তাহারে।
৪
কত শত অভ্যুদয়,
কতই বিলয় লয়,
চক্ষের উপর যেন ঘটে ক্ষণে ক্ষণে;
হর হর হর হর
সুর নর থরথর
প্রলয়-পিনাক-রাব বাজে না শ্রবণে।
৫
ঝটিকা দুরন্ত মেয়ে,
বুকে খেলা করে ধেয়ে
ধরিত্রী গ্রাসিয়া সিন্ধু লোটে পদতলে।
জ্বলন্ত-অনল-ছবি
ধ্বক্ ধ্বক্ জ্বলে রবি,
কিরণ-জ্বলন-জ্বালা মালা শোভে গলে।
৬
কালের করাল হাসি
দলকে দামিনী রাশি,
কক্কড়ু দন্তে দন্তে ভীষণ ঘর্ষণ;
ত্রিজগৎ ত্রাহি ত্রাহি;
কিছুই ভ্রুক্ষেপ নাহি;
কে যোগেন্দ্র ব্যোমকেশ যোগে নিমগন।
৭
ওই মেরু উপহাসি
অনন্ত বরফ রাশি
যুবন্ তপন করে ঝক্ ঝক্ করে!
উপরে বিচিত্র রেখা,
চারু ইন্দ্রধনু লেখা,
অলকা অমরাবতী রয়েছে ভিতরে–
লুকান লুকান যেন রয়েছে ভিতরে॥
৮
ওই কিবে ধবধব
তুঙ্গ তুঙ্গ শৃঙ্গ সব
ঊর্দ্ধমুখে ধেয়ে গেছে ফুঁড়িয়া অম্বর।
দাঁড়াইয়ে পাদদেশে
ললিত হরিত বেশে
নধর নিকুঞ্জ-রাজি সাজে থরে থর।
৯
সানু আলিঙ্গিয়ে করে
শূন্যে যেন বাজি করে
বপ্র-কেলি-কুতূহলে মত্ত করিগণ;
নবীন নীরদমালা
সঙ্গে সঙ্গে করে খেলা,
দশন বিজলী-ঝলা বিলসে কেমন!
১০
ওই গণ্ডশৈল-শিরে
গুল্মরাজি চিরে চিরে
বিকাশে গৈরিক-ঘটা ছটা রক্তময়।
তৃণ তরু লতাজাল,
অপরূপ লালে লাল;
মেঘের আড়ালে যেন অরুণ উদয়।
১১
কাছে কাছে স্থানে স্থালে
নীচ-মুখে উচ-কানে
চরিয়া বেড়ায় সব চমর চমরী,
সুচিকণ শুভ্র কায়
মাছি পিছলিয়া যায়,
অনিলে চামর চলে চন্দ্রিমা-লহরী॥
১২
কিবে ওই মনোহারী
দেবদারু সারি সারি
দেদার চলিয়া গেছে কাতারে কাতার!
দূর দূর আলবালে,
কোলাকুলি ডালে ডালে,
পাতার মন্দির গাঁথা মাথায় সবার।
১৩
তলে তৃণ লতা পাতা;
সবুজ বিছানা পাতা;
ছোট ছোট কুঞ্জবন হেথায় হোথায়।
কেমন পাকম ধরি,
কেকারব করি করি,
ময়ূর ময়ূরী সব নাচিয়া বেড়ায়।
১৪
মধ্যমে ফোয়ারা ছোটে,
যেন ধূমকেতু উঠে,
ফরফর তুপ্ড়ি ফোটে, কেটে পড়ে ফুল;
কত রকমের পাখী
কলরবে ডাকি ডাকি
সঙ্গে সঙ্গে ওঠে পড়ে, আহ্লাদে আকুল।
১৫
জলধারা ঝরঝর,
সমীরণ সরসর,
চমকি চরন্ত মৃগ চায় চারি চারি দিকে;–
চমকি আকাশ-ময়
ফুটে ওঠে কুবলয়,
চমকি বিদ্যুল্লতা মিলায় নিমিখে।
১৬
এ কি স্থান অভিনব!
বিচিত্র শিখর সব
চৌদিকে দাঁড়ায়ে আছে ঘেরিয়ে আমায়;
গায়ে তরু লতা পাতা
থোলো থোলো ফুল গাঁথা,
বরফের–হীরকের টোপর মাথায়।
১৭
তলভূমি সমূদয়
ফুলে ফুলে ফুলময়,
শিরোপরে লম্বমান মেঘের বিতান;
আকাশ পড়েছে ঢাকা
আর নাহি যায় দেখা
তপনের সুবর্ণের তরল নিশান।
১৮
কেবল বিজলী-মালা
বেড়ায় করিয়ে খেলা;
কে গো, বিমানে আজি অমরী অমর!
তোমরা কি সারদারে
দেখেছ, এনেছ তারে
ভূষিতে এ প্রকৃতির প্রাসাদ সুন্দর!
১৯
হায় দেবী, কোথায় তুমি!
শূন্য গিরি-ফুলভূমি!
কোথায়–কোথায়–হায়–সারদা–সারদা!–
আর কেন হাস্য-মুখে!
হান উগ্র বজ্র বুকে!–
কি ঘোর তামসী নিশি!–****
২০
আহা স্নিগ্ধ সমীরণ!
বুঝিলে তুমি বেদন!
বুঝিল না সুলোচনা সারদা আমার!–
হা মানিনী! মানভরে
গেছ কোন্ লোকান্তরে!–
বল দেব, বল বল কুশল তাহার!
২১
অয়ি, ফুলময়ী সতী
গিরি-ভূমি ভাগ্যবতী!
অভাগার তরে তব হয় নি সৃজন;
দেখা যদি পাই তার,
দেখা হবে পুনর্ব্বার;
হলেম তোমার কাছে বিদায় এখন॥
২২
ওই ওই ভৃগুভূমে,
আচ্ছন্ন তুহিন ধূমে
রয়েছে আকাশে মিশে অপরূপ স্থান!
আব্ছা আব্ছা দেখা যায়
গুহা গোমুখের প্রায়,
পাতাল ভেদিয়া তায় ধায় যেন বান।
২৩
ফেনিল সলিলরাশি
বেগভরে পড়ে আসি,
চন্দ্রলোক ভেঙে যেন পড়ে পৃথিবীতে;
সুধাংশু-প্রবাহ পারা
শত শত ধায় ধারা,
ঠিকরে অসংখ্য তারা ছোটে চারি ভিতে!–
অসংখ্য শীকর শিলা ছোটে চারি ভিতে।–
২৪
শৃঙ্গে শৃঙ্গে ঠেকে ঠেকে,
লম্ফে লম্ফে ঝেঁকে ঝেঁকে,
জেলের জালের মত হয়ে ছাত্রাকার,
ঘুরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে;
ফেনার আরশি ওড়ে,
উড়েছে মরাল যেন হাজার হাজার।
২৫
আবরিয়ে কলেবর
ঝরিছে সহস্র ঝর,
ভৃগুভূমি মনোহর সেজেছে কেমন!
যেন ভৈরবের গায়
আহ্লাদে উথুলে ধায়
ফণা তুলে চুলবুলে ফণী অগণন।
২৬
নেমে নেমে ধারাগুলি,
করি করি কোলাকুলি,
একবেণী হয়ে হয়ে নদী বয়ে যায়;
ঝরঝর কলকল
ঘোর রাবে ভাঙে জল,
পশু পক্ষী কোলাহল করিয়ে বেড়ায়।
২৭
সিংহ দুটি শুয়ে তটে
আনন আবরি জটে,
মগন রয়েছে যেন আপনার ধ্যানে;
আলসে তুলিছে হাই,
কা'কেও দৃক্পাত নাই,
গ্রীবাভঙ্গে কদাচিৎ চায় নদী পানে।
২৮
কিবে ভৃগু-পাদমূলে
উথুলে উথুলে দুলে
ট'লে ঢ'লে চলেছেন দেবী সুরধুনী!
কবির, যোগীর ধ্যান,
ভোলা মহেশের প্রাণ,
ভারত-সুরভি-গাভী, পতিত-পাবনী।
পুণ্যতোয়া গিরিবালা!
জুড়াও প্রাণের জ্বালা!
জুড়ায় ত্রিতাপ-জ্বালা মা তোমার জলে!
সারদামঙ্গল – ২য় সর্গ
September 10, 2019
No comments
সারদামঙ্গল – ২য় সর্গ
গীতি
[রাগিণী কালাংড়া,–তাল যৎ]
হারায়েছি-হারায়েছি রে, সাধের স্বপনের ললনা
মানস-মরালী আমার কোথা গেল বল না!
কমল-কাননে বালা,
করে কত ফুলখেলা,
আহা, তার মালা গাঁথা হ’ল না!
প্রিয় ফুলতরুগণ,
সুধাকর, সমীরণ,
বল বল ফিরে কি আর পাব না!
কেন এল চেতনা!
১
আহা সে পুরুষবর
না জানি কেমনতর
দাঁড়ায়ে রজতগিরি অটল সুধীর!
উদার ললাট ঘটা,
লোচনে বিজলীছটা,
নিটোল বুকের পাটা, নধর শরীর।
২
সৌম্য মূর্ত্তি স্ফুর্ত্তি-ভরা,
পিঙ্গল বল্কল পরা,
নীরদ-তরঙ্গ-লীলা জটা মনোহর;
শুভ্র অভ্র উপবীত
উরস্থলে বিলম্বিত,
যোগপাটা ইন্দ্রধনু রাজিছে সুন্দর।
৩
কুসুমিতা লতা ভালে,
শ্মশ্রুরেখা শোভে গালে,
করেতে অপূর্ব্ব এক কুসুম রতন;
চাহিয়ে ভুবন পানে
কি যেন উদয় প্রাণে,
অধরে ধরে না হাসি–শশীর কিরণ।
৪
কি এক বিভ্রম ঘটা,
কি এক বদন ছটা,
কি এক উছলে অঙ্গে লাবণ্য-লহরী;
মন্দাকিনী আসি কাছে
থমকে দাঁড়ায়ে আছে,
থমকে দাঁড়ায়ে দেখে অমর অমরী।
৫
নধর মন্দাররাজি
নবীন পল্লবে সাজি
দূরে দূরে ধীরে ধীরে ঘেরিয়ে দাঁড়ায়।
গরজি গম্ভীর স্বরে
জলধর শির’পরে
করি করি জয়ধ্বনি চলে দুলে দুলে।
তড়িত ললিত বালা,
করে লুকাচুরি খেলা,
সহসা সমুখে দেখে চমকে পালায়।
অপ্সরী বাঁশরী করে
দাঁড়ায়ে শিখরী পরে
আনন্দে বিজয়গান গায় প্রাণ খুলে।
৬
দিগঙ্গনা কুতূহলে
সমীর-হিল্লোল ছলে
বরষে মন্দার ধারা আবরি গগন।
আমোদে আমোদময়,
অমৃত উথুলে বয়,
ত্রিদশ-আলয় আজি আনন্দে মগন।
জ্যোতির্ম্ময় সপ্ত ঋষি
প্রভাত উজলি দিশি,
সম্ভ্রমে কুসুমাঞ্জলি অর্পিছেন পদতলে॥
৭
সে মহাপুরুষ-মেলা,
সে নন্দনবন-খেলা,
সে চিরবসন্ত-বিকশিত ফুলহার,
কিছুই হেথায় নাই;
মনে মনে ভাবি তাই,
কি দেখে আসিতে মন সরিবে তোমার!
৮
কেমনে বা তোমা বিনে
দীর্ঘ দীর্ঘ রাত্র দিনে
সুদীর্ঘ জীবন-জ্বালা সব অকাতরে,
কার আর মুখ চেয়ে
অবিশ্রাম যাব বেয়ে
ভাসায়ে তনুর তরী অকূল সাগরে!
৯
কেন গো ধরণী রাণী
বিরস বদনখানি,
কেন গো বিষণ্ণ তুমি উদার আকাশ,
কেন প্রিয় তরু লতা
ডেকে নাহি কহ কথা,
কেন রে হৃদয় কেন শ্মশান উদাস
১০
কোন সুখ নাই মনে,
সব গেছে তার সনে;
খোলো হে অমরগণ স্বরগের দ্বার।
বল কোন্ পদ্মবনে,
লুকায়েছ সংগোপনে
দেখিব কোথায় আছে সারদা আমার!
১১
অয়ি, এ কি, কেন কেন,
বিষণ্ণ হইলে হেন।
আনত আনন-শশী আয়ত নয়ন,
অধরে মন্থরে আসি
কপোলে মিলায় হাসি
থর থর ওষ্ঠাধর, স্ফোরে না বচন।
১২
তেমন অরুণ-রেখা
কেন কুহোলিকা-ঢাকা,
প্রভাত-প্রতিমা আজি কেন গো মলিন।
বল বল চন্দ্রাননে,
কে ব্যথা দিয়েছে মনে,
কে এমন–কে এমন হৃদয়-বিহীন!
১৩
বুঝিলাম অনুমানে,
করুণা-কটাক্ষ দানে
চাবে না আমার পানে, কবে না ও কথা;
কেন যে কবে না হায়
হৃদয় জানিতে চায়,
সরমে কি বাধে বাণী, মরমে বা বাজে ব্যথা!
১৪
যদি মর্ম্মব্যথা নয়,
কেন অশ্রুধারা বয়!
দেববালা ছলাকলা জানে না কখন;
সরল মধুর প্রাণ,
সতত মুখেতে গান,
আপন বীণার তানে আপনি মগন!
১৫
অয়ি,হা সরলা সতী
সত্যরূপা সরস্বতী!
চির-অনুরক্ত ভক্ত হয়ে কৃতাঞ্জলি
পদ্ম-পদ্মাসন কাছে
নীরবে দাঁড়ায়ে আছে,
কি করিবে, কোথা যাবে, দাও অনুমতি!
স্বরগ-কুসুম-মালা
নরক-জ্বলন-জ্বালা,
ধরিবে প্রফুল্ল মুখে মস্তকে সকলি।
তব আজ্ঞা সুমঙ্গল,
যাই যাব রসাতল,
চাইনে এ বরমালা, এ অমরাবতী!
১৬
নরকে নারকি-দলে
মিশি গে মনের বলে,
পরাণ কাতর হ’লে ডাকিব তোমায়;
যেন দেবী সেই ক্ষণে
অভাগারে পড়ে মনে,
ঠেল না চরণে, দেখো, ভুল না আমায়!
১৭
অহহ! কিসের তরে
অভাগা নরকে জরে
মরু-মরু-মরুময়-জীবন-লহরী;
এ বিরস মরুভূমে
সকলি আচ্ছন্ন ধূমে,
কোথাও একটিও আর নাহি ফোটে ফুল;
কভু মরীচিকা মাজে
বিচিত্র কুসুম রাজে,
উঃ! কি বিষম বাজে সেই ভাঙে ভুল!
এত যে যন্ত্রণা জ্বালা,
অবমান অবহেলা,
তবু কেন প্রাণ টানে! কি করি, কি করি!
১৮
তেমন আকৃতি, আহা,
ভাবিয়ে ভাবিয়ে যাহা
আনন্দে উন্মত্ত মন, পাগল পরাণ,
সে কি গো এমন হবে,
মোর দুখে সুখে রবে
কাঁদিয়ে ধরিলে কর ফিরাবে বয়ান!
১৯
ভাবিতে পারিনে আর!
অন্ধকার–অন্ধকার–
ঝটিকার ঘূর্ণী ঘোরে মাথার ভিতর;
তরঙ্গিয়া রক্তরাশি
নাকে মুখে চোকে আসি
বেগে যেন ভেঙে ফেলে; ধর ধর ধর;–
২০
ধর, আত্মা, ধৈর্য্য ধর,
ছি ছি এ কি কর কর,
মর যদি, মরা চাই মানুষের মত;
থাকি বা প্রিয়ার বুকে
যাই বা মরণ-মুখে,
এ আমি, আমিই রব; দেখুক্ জগত।
২১
মহান্ মনেরি তরে
জ্বালা জ্বলে চরাচরে,
পুড়ে মরে ক্ষুদ্রেরাই পতঙ্গের প্রায়;
জলুক্ যতই জ্বলে,
পর জ্বালা-মালা গলে,
নীলকণ্ঠ-কণ্ঠে জ্বলে হলাহল-দ্যুতি;
হিমাদ্রিই বক্ষ’পরে
সহে বজ্র অকাতরে,
জঙ্গল জ্বলিয়া যায় লতায় পাতায়;
অস্তাচলে চলে রবি,
কেমন প্রশান্ত ছবি!
তখনো কেমন আহা উদার বিভূতি!
২২
হা ধিক্ অধীর হেন!
দেখেও দেখ না কেন
দুখে দুখী অশ্রুমুখী প্রাণপ্রতিমায়!
প্রণয় পবিত্র ধনে
সন্দেহ করো না মনে,
নাগরদোলায় দোলা শিশুরি মানায়!
সারদা সরলা বালা,
সবে না সন্দেহ জ্বালা,
ব্যথা পাবে সুকোমল হৃদয়কমলে॥
সারদামঙ্গল – ৩য় সর্গ
September 10, 2019
No comments
সারদামঙ্গল – ৩য় সর্গ
গীতি
[রাগিণী বিভাস,–তাল আড়াঠেকা]
বিরাজ সারদে কেন এ ম্লান কমলবনে!
আজো কি রে অভাগিনী ভালবাস মনে মনে!
মলিন নলিন বেশ,
মলিন চিকণ কেশ,
মলিন মধুর মূর্ত্তি, হাসি নাই চন্দ্রাননে!
মলিন কমল-মালা,
মলিন মৃণাল-বালা,
আর সে অমৃত-জ্যোতি জ্বলে না ক বিলোচনে!
চির আদরিণী বীণা,
কেন, যেন দীনহীনা
ঘুমায়ে পায়ের কাছে পড়ে আছে অচেতনে!
জীবন-কিরণ-রেখা,
অস্তাচলে দিল দেখা,
এ হৃদি-কমল দেবী ফুটিবে না-আর!
যাও বীণা লয়ে করে,
ব্রহ্মার মানস সরে,
রাজহংস কেলি করে সুবর্ণ নলিনী সনে।
১
আজি এ বিষণ্ণ বেশে
কেন দেখা দিলে এসে,
কাঁদিলে কাঁদালে দেবী জন্মের মতন!
পূর্ণিমা-প্রমোদ-আলো,
নয়নে লেগেছে ভাল;
মাঝেতে উথলে নদী, দু পারে দু জন–
চক্রবাক চক্রবাকী দু পারে দু জন!
২
নয়নে নয়নে মেলা,
মানসে মানসে খেলা,
অপরে প্রেমের হাসি বিষাদে মলিন;
হৃদয়-বীণার মাঝে
ললিত রাগিণী বাজে,
মনের মধুর গান মনেই বিলীন।
৩
সেই আমি, সেই তুমি,
সেই এ স্বরগ-ভূমি,
সেই সব কল্পতরু, সেই কুঞ্জবন;
সেই প্রেমে সেই স্নেহ,
সেই প্রাণ, সেই দেহ;
কেন মন্দাকিনী-তীরে দু পারে দু জন!
৪
আকুল ব্যাকুল প্রাণ,
মিলিবারে ধাবমান;
কেন এসে অভিমান সমুখে উদয়!–
কান্তি-শান্তি ময় তনু,
অপরূপ ইন্দ্রধনু,
তেজে যেন জ্বলে মন, অটল-হৃদয়।
৫
কাতর পরাণ পরে
চেয়ে আছে স্নেহভরে,
নয়ন-কিরণ যেন পীযূষ-লহরী;
এমন পদার্থে হেলি
যাব না যাব না ঠেলি,
উভয়-সঙ্কটে আজ মরি যদি, মরি।
৬
কেন গো পরের করে
সুখের নির্ভর করে,
আপনা আপনি সুখী নহে কেন নর!
সদাশিব সদানন্দ,
সতী বিনে নিরানন্দ,
শ্মশানে ভ্রমেণ ভোলা খেপা দিগম্বর।
৭
হৃদয়-প্রতিমা লয়ে,
থাকি থাকি সুখী হয়ে,
অধিক সুখের আশা নিরাশা শ্মশান;
ভক্তিভাবে সদা স্মরি,
মনে মনে পূজা করি,
জীবন-কুসুমাঞ্জলি পদে করি দান।
৮
বাসনা বিচিত্র ব্যোমে
খেলা করে রবি সোমে
পরিয়ে নক্ষত্র তারা হীরকের হার,
প্রগাঢ় তিমিররাশি
ভুবন ভরেছে আসি
অন্তরে জ্বলিছে আলো, নয়নে আঁধার।
৯
বিচিত্র এ মত্তদশা,
ভাবভরে যোগে বসা,
হৃদয়ে উদার জ্যোতি কি বিচিত্র জ্বলে!
কি বিচিত্র সুর তান
ভরপুর করে প্রাণ,
কে তুমি গাহিছ গান আকাশমণ্ডলে!
১০
জ্যোতির প্রবাহ-মাঝে
বিশ্ববিমোহিনী রাজে!
কে তুমি লাবণ্য-লতা মূর্তি মধুরিমা,
মৃদু মৃদু হাসি হাসি
বিলাও অমৃতরাশি,
আলোয় করেছ আলো প্রেমের প্রতিমা!
১১
ফুটে ফুটে অবিরল
হাসে সব শতদল,
অবিরল গুঞ্জরিয়ে ভ্রমর বেড়ায়;
সমীর সুরভিময়
সুখে ধীরে ধীরে বয়,
লুটায়ে চরণতলে স্তুতিগান গায়।
১২
আচম্বিতে এ কি খেলা!
নিবিড় নিরদমালা!
হা হা রে, লাবণ্য-বালা লুকা’ল লুকা’ল!
এমন ঘুমের ঘোরে
জাগালে কে জোর কোরে,
সাধের স্বপন আহা ফুরা’ল ফুরা’ল!
১৩
বসন্তের বনমালা
ঘুমের রূপের ডালা
মায়ার মোহিনী মেয়ে স্বপন-সুন্দরী!
মনের মুকুরতলে
পশিয়ে ছায়ার ছলে
কর কত লীলাখেলা; কতই লহরী!
১৪
কোথা থেকে এস তারা,
মাখিয়ে সুধার ধারা,
জুড়াতে কাতর প্রাণ নিশান্ত সময়ে!
(লয়ে পশু পক্ষী প্রাণী
ঘুমায় ধরণী রাণী,)
কোথায় চলিয়ে যাও অরুণ উদয়ে।
১৫
ফের্ এ কি আলো এল!
কই কই, কোথা গেল,
কেন এল, দেখা দিল, লুকাল আবার!
কে আমারে অবিরত
খেপায় খেপার মত,
জীবন-কুসুম-লতা কোথা রে আমার!
১৬
কোথা সে প্রাণের পাখী,
বাতাসে ভাসিয়ে থাকি
আর কেন গান কোরে ডাকে না আমায়!
বল দেবী মন্দাকিনী!
ভেসে ভেসে একাকিনী
সোণামূখী তরীখানি গিয়েছে কোথায়!
১৭
এই না, তোমারি তীরে
দেখা আমি পেনু ফিরে,
তুলে কেন না রাখিনু বুকের ভিররে!
হা ধিক্ রে অভিমান,
গেল গেল গেল প্রাণ
করাল কালিমা ওই গ্রাসে চরাচরে!
১৮
হারায়ে নয়ন-তারা
হয়েছি জগত-হারা,
ক্ষণে ক্ষণে আপনারে হারাই হারাই;
ওই ভাই দাও বোলে
কোন্ দিকে যাব চোলে,
ও কি ওঠে জ্বোলে জ্বোলে, কোথায় পালাই।
১৯
ও কি ও, দারুণ শব্দ,
আকাশ পাতাল স্তব্ধ;
দারুণ আগুন সুদু ধুধু ধুধু ধায়,
তুমুল তরঙ্গ ঘোর,
কি ঘোর ঝড়ের জোর,
পাঁজর ঝাঁঝর মোর দাঁড়াই কোথায়!
২০
তবে কি সকলি ভুল!
নাই কি প্রেমের মূল!
বিচিত্র গগন-ফুল কল্পনা লতার?
মন কেন রসে ভাসে
প্রাণ কেন ভালবাসে
আদরে পরিতে গলে সেই ফুলহার?
২১
শত শত নর নারী
দাঁড়ায়েছে সারি সারি,
নয়ন খুঁজিছে কেন সেই মুখখানি?
হেরে হারা-নিধি পায়,
না হেরিলে প্রাণ যায়,
এমন সরল সত্য কি আছে না জানি!
২২
ফুটিলে প্রেমের ফুল
ঘুমে মন ঢুলু ঢুলু,
আপনি সৌরভে প্রাণ আপনি পাগল;
সেই স্বর্গ-সুধা পানে
কত যে আনন্দ প্রাণে,
অমায়িক প্রেমিকে তা জানেন কেবল।
২৩
নন্দন-নিকুঞ্জবনে
বসি শ্বেত শিলাসনে
খোলা প্রাণে রতিকাম বিহারে কেমন!
আননে উদার হাসি,
নয়নে অমৃতরাশি;
অপরূপ আলো এক উজলে ভুবন।
২৪
পারিজাত-মালা করে,
চাহি চাহি স্নেহভরে
আদরে পরস্পরে গলায় পরায়;
মেজাজ্ গিয়েছে খুলে,
বসেছে দুনিয়া ভুলে,
সুধার সাগর যেন সমুখে গড়ায়।
২৫
কি এক ভাবেতে ভোর
কি যেন নেশার ঘোর,
টলিয়ে ঢলিয়ে পড়ে নয়নে নয়ন;
গলে গলে বাহুলতা,
জড়িমা-জড়িত কথা,
সোহাগে সোহাগে রাগে গলগল মন।
২৬
করে কর থরথর,
টলমল কলেবর,
গুরুগুরু দুরুদুরু বুকের ভিতর;
তরুণ অরুণ ঘটা
আননে আরক্ত ছটা,
অধর কমল-দল কাঁপে থরথর।
২৭
প্রণয়-পবিত্র কাম,
সুখ-স্বর্গ-মোক্ষ ধাম!
আজি কেন হেরি হেন মাতোয়ারা বেশ!
ফুলধনু ফুলছড়ি
দূরে যায় গড়াগড়ি;
রতির খুলিয়ে খোঁপা আলুথালু কেশ!
২৮
বিহ্বল পাগল প্রাণে
চেয়ে সতী পতি পানে,
গড়িয়ে গড়িয়ে কোথা চলে গেছে মন;
মুগ্ধ মত্ত নেত্র দুটি,
আধ ইন্দীবর ফুটি,
দুলুদুলু ঢুলুঢুলু করিছে কেমন!
২৯
আসলে উঠিছে হাই,
ঘুম আছে, ঘুম নাই,
কি যেন স্বপন মত চলিয়াছে মনে;
সুখের সাগরে ভাসি
কিবে প্রাণখোলা হাসি!
কি এক লহরী খেলে নয়নে নয়নে!
৩০
উথুলে উথুলে প্রাণ
উঠিছে ললিত তান,
ঘুমায়ে ঘুমায়ে গান গায় দুই জন;
সুরে সুরে সম্ রাখি
ডেকে ডেকে ওঠে পাখী,
তালে তালে ঢ’লে ঢ’লে চলে সমীরণ!
৩১
কুঞ্জের আড়াল থেকে
চন্দ্রমা লুকায়ে দেখে,
প্রণয়ীর সুখে সদা সুখা সুধাকর;
সাজিয়ে মুকুল ফুলে
আহ্লাদেতে হেলে দুলে
চৌদিকে নিকুঞ্জ-লতা নাচে মনোহর।
সে আনন্দে আনন্দিনী,
উথলিয়ে মন্দাকিনী;
করি করি কলধ্বনি বহে কুহূহলে॥
৩২
এ ভুল প্রাণের ভুল,
মর্ম্মে বিজড়িত মূল,
জীবনের সঞ্জীবনী অমৃত-বল্লরী;
এ এক নেশার ভুল,
অন্তরাত্মা নিদ্রাকুল,
স্বপনে বিচিত্র-রূপা দেবী যোগেশ্বরী।
৩৩
কভু বরাভয় করে,
চাঁদে যেন সুধা ক্ষরে
করে মধুর স্বরে অভয় প্রদান;
কখন গেরুয়া পরা,
ভীষণ ত্রিশূল ধরা,
পদভরে কাঁপে ধরা ভূধর অধীর;
দীপ্ত সূর্য্য হুতাশন
ধ্বক্ ধ্বক্ দু নয়ন,
হুঙ্কারে বিদরে ব্যোম, লুকায় মিহির;
ঘোরঘট্ট অট্ট হাসি
ঝলকে পাবকরাশি;
প্রলয় সাগরে যেন উঠেছে তুফান।
৩৪
কভু আলুথালু কেশে
শ্মশানের প্রান্ত দেশে
জ্যো’স্নায় আছেন বসি বিষণ্ণ বদনে;
গঙ্গার তরঙ্গমালা
সমুখে করিছে খেলা,
চাহিয়ে তাদের পানে উদাস নয়নে।
৩৫
পবন আকুল হয়ে
চিতা-ভস্মরজ লয়ে
শোকভরে ধীরে ধীরে শ্রীঅঙ্গে মাথায়,
শ্বেত করবীর বেলা,
চামেলি মালতী মেলা,
ছড়াইয়ে চারি দিকে কাঁদিয়ে বেড়ায়।
৩৬
হায় ফের বিষাদিনী!
কে সাজালে উদাসীনী!
সম্বর এ মূর্তি দেবী সম্বর সম্বর!
বটে এ শ্মশান-মাঝে
এলোকেশী কালী সাজে
দানব-রুধির-রঙ্গে নাচে ভয়ঙ্কর।
৩৭
অবার নয়নে জল!
ওই সেই হলাহল,
ওরি তরে জীর্ণজরা জীবন আমার;
গরজি গগন ভোরে
দাঁড়াও ত্রিশূল ধোরে!
সংহার-মূরতি অতি মধুর তোমার!
৩৮
আমার এ ব্রজবুক,
ত্রিশূলেরো তীক্ষ্ণ মুখ,
দাও দাও বসাইয়ে এড়াই যন্ত্রণা!
সমুখে আরক্তমুখী,
মরণে পরম সুখী,
এ নহে প্রলয়-ধ্বনি, বাঁশরী-বাজনা।
৩৯
অনন্ত নিদ্রার কোলে
অনন্ত মোহের ভোলে
অনন্ত শয্যায় গিয়ে করিব শয়ন,
আর আমি কাঁদিব না,
আর আমি কাঁদাব না,
নীরবে মিলিয়ে যাবে সাধের স্বপন!
৪০
তপন-তর্পণ-আল
অসীম যন্ত্রণা-জাল,
প্রশান্ত অনন্ত ছায়া অনন্ত যামিনী;
সে ছায়ে ঘুমাব সুখে,
বজ্র বাজিবে না বুকে,
নিস্তব্ধ ঝটিকা ঝঞ্জা, নীরব মেদিনী।
৪১
বাঁধ বুক, ত্যজ ভয়,
পুণ্য এ, পাতক নয়;
খুনে আর পরিত্রাণে অনেক অন্তর।
ভালবাসা তারি ভাল,
সহে যারে চির কাল;
বাঁচুক্ বাঁচুক্ তারা হউক্ অমর!
৪২
হবে না হবে না আর,
হয়ে গেছে যা হবার,
ধোরো না ধোরো না, বৃথা রুধ না আমাকে!
এ পোড়া পিঞ্জর রাখি
উড়ুক পরাণ পাখী,
দেখুক দেখুক যদি আর কিছু থাকে!
ছাড়! আন! যাও যাও!
বেগে বুকে বিঁধে দাও!
ওই সে ত্রিশূল দোলে গগনমণ্ডলে
Subscribe to:
Posts (Atom)
Category1
Popular Posts
-
মহুয়ার দেশ সমর সেন ১ মাঝে মাঝে সন্ধ্যার জলস্রোতে অলস সূর্য দেয় এঁকে গলিত সোনার মতো উজ্জ্বল আলোর স্তম্ভ , আর আগুন লাগে জল...
-
টোপ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সকালে একটা পার্সেল এসে পৌঁছেছে। খুলে দেখি এক জোড়া জুতো। না, শত্রুপক্ষের কাজ নয়। এক জোড়া পুরোনো হেঁড়া...
-
আমি দেখি শক্তি চট্টোপাধ্যায় গাছগুলো তুলে আনো, বাগানে বসাও আমাদের দরকার শুধু গাছ দেখা গাছ দেখে যাওয়া গাছের সবুজ টুকু শরীর...
-
[ বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ ebanglaschools এর সমস্ত আলোচনা কোনো পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গের জন্য নয়। সাধারণ এবং অতি সাধারণ পিছিয়ে পড়া ছাত্র ছাত্রীদের ...
-
দাম নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় স্কুলে কী বিভীষিকাই যে ছিলেন ভদ্রলোক! আমাদের অঙ্ক কষাতেন। আশ্চর্য পরিষ্কার ছিল মাথা। যেসব জটিল অঙ্ক নি...
-
অভিষেক মাইকেল মধুসূদন দত্ত কনক-আসন ত্যজি, বীরেন্দ্রকেশরী ইন্দ্রজিৎ, প্রণমিয়া ধাত্রীর চরণে, কহিলা,— “কি হেতু, মাতঃ, গতি তব আজ...
-
তিন পাহাড়ের কোলে শক্তি চট্টোপাধ্যায় অন্ধকারে তিনপাহাড়ে ট্রেনের থেকে নেমে , হাওয়া বিলাসী তিন ...
Labels
ABOUT
BOLAKA
BOOKS
BORNOPORICOY
CLASS 11
CLASS 11 POEM
CLASS 11 STORY
CLASS 12
CLASS 12 POEM
CLASS 12 STORY
class 7
CLASS 8
CLASS10 POEM
CLASS10 STORY
GOLPOGUCCHA 1
GRAMMAR
hs suggestion 2023
HS বাংলা প্রশ্নপত্র
MP বাংলা প্রশ্নপত্র
SAHITYER ITIHAS
TIFFIN BREAK
অব্যয়
চর্যাপদ
দল
বাক্য
বাচ্য
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন
সন্ধি
সমাস
সাময়িক পত্রিকা