বিজ্ঞাপন বিভ্ৰাট - শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ে


বিজ্ঞাপন বিভ্ৰাট

সংবাদপত্র পাঠ করিতেছিল এবং সিগারের প্রভুত ধূমে ঘরটি প্রায়ই অন্ধকার করিয়া ফেলিয়াছিল। বেলা প্রায় সাড়ে সাতটা, এমন সময় বন্ধু প্রমথনাথ ঘরে ঢুকিয়াই অতি কষ্টে কাশি চাপিতে চাপিতে বলিল, পর্বতো বহ্নিমান ধূমাৎ। তুমি ঘরে আছ, ধোঁয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে। উঃ, ঘরটা এমন অগ্নিকুণ্ড করে বসে আছ কি করে?
নন্দ হাতের কাগজখানা ফেলিয়া প্রফুল্লস্বরে কহিল, আমি তোমার মতো বিলেত ফেরত সন্ন্যাসী নই যে, চুরুটাটা পর্যন্ত ত্যাগ করতে হবে।
প্রমথ একখানা চেয়ার অধিকার করিয়া বলিল, তুমিই সন্ন্যাসী নামের বেশী উপর্যুক্ত। গাঁজার মতো চুরুটগুলো খেয়ে খেয়ে ইহকাল পরকাল দুই নষ্ট করলে।
নন্দ হো হো করিয়া হাসিয়া বলিল, রাগ করলে ভাই? আমি কিন্তু তোমাকে গাঁজাখের সন্ন্যাসীর সঙ্গে তুলনা করিনি।
নন্দ এবং প্রমথর বন্ধুত্ব আশৈশব দীর্ঘ না হইলেও ঘটনাচক্রে পরস্পরের প্রতি গাঢ় স্নেহবন্ধন অটুট হইয়া পড়িয়াছিল। নন্দ দোহারা, খুব বলবান, চোখে চশমা। রং ময়লা। মুখে তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও দৃঢ়তার এমন একটি সুন্দর সমাবেশ ছিল যে, খুব সুশ্ৰী না হইলেও তাঁহাকে সুপুরুষ বলিয়া বোধ হইত। প্রমথনাথ ফসর্গ ছিপছিপে যুবক, মুখে লালিত্যের বেশ একটা দীপ্তি আছে। তার স্বভাবটি বড় নরমদুর্বল বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। কাহারও কোনও অনুরোধে না বলিবার ক্ষমতা তাহার একেবারেই নাই।
বহু ধনদৌলতের একমাত্র উত্তরাধিকারী প্রমথ বিলাত গিয়া ব্যারিস্টারি পাস করিয়া আসিয়াছিল। বিলাত পৌঁছিয়া সে প্রথম বাঙালীর মুখ দেখিল নন্দর। নন্দর বিলাত যাওয়ার ইতিহাসটা কিছু জটিল। সে গরিবের ছেলে, প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করিবার পর দেখিল, কলেজে পড়বার মতো সংস্থান নাই। আত্মীয়স্বজনের দ্বারস্থ হইবার প্রবৃত্তি ছিল না। অথচ বিলাতে গিয়া উচ্চশিক্ষা লাভের তীব্র অভিলাষ ছিল।
এক দিন সে এক বিলাতযাত্রী জাহাজে খালাসী হইয়া বিলাত পলায়ন করিল। সেখানে পৌঁছিয়া পেটের দায়ে কুলির কাজ আরম্ভ করিয়াছিল। ভাগ্যদেবী নবাগত প্রমথর মালগুলা নন্দর ঘাড়ে চাপাইতে গিয়া নন্দকেই প্রমথর ঘাড়ে চাপাইয়া দিলেন। প্রমথ ও নন্দ উভয়েই তখন নিতান্ত ছেলেমানুষ। নিবন্ধিব বিদেশে পরস্পরকে পাইয়া তাহারা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাইল। প্রমথর টাকায় নন্দও আইন পড়িতে আরম্ভ করিল।
তারপর দুই জনে ব্যারিস্টারি পাস করিয়া দেশে ফিরিয়াছে। নন্দ ব্যবসা আরম্ভ করিয়াছে, বেশ দুই পয়সা উপার্জনও করিতেছে। প্রমথ প্রায় নিষ্কমা; খবরের কাগজ পড়িয়া, দেশনীতি আলোচনা করিয়া এবং সময়ে অসময়ে বন্দুক ঘাড়ে বনে জঙ্গলে ঘুরিয়া বেড়াইয়া যৌবনকালটা অপব্যয় করিয়া ফেলিতেছিল।
প্রমথ আবার আরম্ভ করিল, তুমি ঐ সিগার খাওয়া কবে ছাড়বে বল দিকি?
নন্দ বলিল, যমরাজা বেশী জিদ করলে কি করব বলতে পারি না, তবে তার আগে তো নয়।
প্রমথ বলিল, তার আগে ছাড় কি না দেখা যাবে। এক ব্যক্তির শুভাগমন হলেই তখন ছাড়তে পথে পাবে না।
নন্দ বলিল, ইঙ্গিতটা বোধ হচ্ছে আমার ভবিষ্যৎ গৃহিণীর সম্বন্ধে। তা তিনি কি যমরাজের চেয়েও ভয়ঙ্কর হবেন না কি?
প্রমথ বলিল, অন্তত যমরাজের চেয়ে তাঁদের ক্ষমতা বেশী, তার শাস্ত্রীয় প্রমাণ আছে।
নন্দ কহিল, সেইজন্যই তো আমি এই ক্ষমতাশালিনীদের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতে চাই। তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলামেশা করবার বাসনা মোটেই নেই।
প্রমথ ভ্রূ তুলিয়া বলিল, অৰ্থাৎ বিয়ে কচ্ছ না?
নন্দ উৎফুল্ল তাচ্ছিল্যের সহিত বলিল, নাঃ।
প্রমথ কহিল, এটা তো নতুন শুনছি। কারণ জানতে পারি কি?
নন্দ বলিল, বিয়ে জিনিসটা একদম পুরোনো হয়ে গেছে। ওতে আর রোমান্সের গন্ধটি পর্যন্ত নেই।  বলিয়া প্রসঙ্গটা উড়াইয়া দিবার মানসে খবরের কাগজখানা আবার তুলিয়া লইল।
প্রমথ বলিল, নন্দ ভাই, ওইখানেই তোমার সঙ্গে আমার গরমিল। বিয়েটাই এ পৃথিবীতে নববর্ষের পাঁজির মতো একমাত্র নতুন জিনিসআর যা কিছু সব দাগী, পুরোনো, বস্তাপচা।
নন্দ প্ৰত্যুত্তরে কাগজখানা প্রমথর গায়ে ছুড়িয়া দিয়া বলিল, তার প্রমাণ এই দেখ না। বিয়ে জিনিসটা এতই খেলো হয়ে গেছে যে, কাগজে পর্যন্ত তার বিজ্ঞাপন।
প্রমথ নিক্ষিপ্ত কাগজখানা তুলিয়া লইয়া মনোনিবেশপূর্বক পড়িতে লাগিল।
নন্দ বলিল, তর্ক করে হাঁপিয়ে উঠেছ, এক পেয়ালা চা খাও। এখনও আটটা বাজেনি। বাড়ি গিয়ে নাইতে খেতে তোমার তো সেই একটা।
প্রমথ কোনও জবাব দিল না, নিবিষ্ট-মনে পড়িতে লাগিল। নন্দ বেয়ারাকে ডাকিয়া বলিল, দিদিকে দো পেয়ালা চা বানানে বোলে৷।
এইখানে বলিয়া রাখা ভাল যে, প্রমথ পূর্বে চা খাইত না, কিন্তু সম্প্রতি কয়েকটি অভিনব আকর্ষণে সে চা ধরিয়াছে।
খবরের কাগজখানা পড়িতে পড়িতে প্রমথ মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল, তারপর সেখানা জানুর উপর পাতিয়া বলিল, ওহে, শোনো একটা বিজ্ঞাপন, বলিয়া পড়িতে লাগিল, Wanted a young Barrister bridegroom for a rich beautiful and accomplished Baidya girl. Girls age sixteen. Apply with photograph to Box 1526. পাঠ শেষ করিয়া কাগজখানা দ্বারা নন্দর জানুর উপর আঘাত করিয়া বলিল, ব্যস, বুঝলে হে ব্যারিস্টার ব্রাইডগুম, একটা দরখাস্ত করে দাও, খুব রোমান্টিক হবে।
নন্দ বলিল, আমি এখানে একমাত্র ব্রাইডগুম নই। শ্ৰীমান প্রমথনাথ সেন মহাশয়ই এই ষোড়শীর উপর্যুক্ত পাত্র বলে মনে হচ্ছে।
প্রমথ হাসিয়া প্রতিবাদ করিল, কিছুতেই না। নন্দলাল সেনগুপ্ত থাকতে প্রমথনাথ সে দিকে কোনমতেই দৃষ্টিপাত করতে পারেন না।
নন্দ একটা কপট দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, তবে থাক, কারুর দৃষ্টিপাত করে কােজ নেই। আর কোনও ভাগ্যবান ব্যারিস্টার এই তরুণীকে লাভ করুক।
প্রমথ জিদ ধরিয়া বলিল, না না, এসো না, একটু মজাই করা যাক! তারপর তোমার দরখাস্ত যে মঞ্জুর হবে, তারই বা ঠিক কি?
নন্দ বলিল, বেশ, যদি দরখাস্ত করবারই ইচ্ছে হয়ে থাকে, নিজেই কর।
প্রমথ একটু চকিত হইয়া বলিল, না, তা কি হয়? তুমি কর।
নন্দ বলিল, বাঃ, এ তোমার বেশ বিচার! মজা করবে তুমি, আর ফ্যাসাদে পড়ব আমি?—আচ্ছা, এস, এক কাজ করা যাক-লটারি কর, যার নাম ওঠে।
মজা করিবার ইচ্ছ। আর প্রমথর বেশী ছিল না; কিন্তু সেই প্ৰথমে আগ্রহে দেখাইয়াছে, অতএব অনিচ্ছার সহিত সম্মত হইল। তখন দু টুকরো কাগজে দুজনের নাম লিখিয়া একটা হ্যাটের তলায় চাপা দেওয়া হইল। নন্দ হ্যাটের তলায় হাত ঢুকাইয়া একটা কাগজ বাহির করিয়া নাম পড়িয়াই উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া সপদদাপে বলিল, ভাগঃ ফলতি সর্বত্রং ন বিদ্যাং ন চ পৌরুষং-হে ভাগ্যবান, এই দেখ বলিয়া কাগজখানা তুলিয়া ধরিয়া নামটা দেখাইল।
প্রমথ বিকলভাবে একটু হাসিয়া বলিল, নিজের নাম না ওঠায় এতদূর বিমর্ষ হয়ে পড়েছ যে, সংস্কৃত ভাষাটার উপরও তোমার কিছুমাত্র মমতা নেই দেখছি।
এবার নন্দ উৎসাহের তাড়নায় কাগজ-কলম লইয়া বলিল, আর দেরি নয়, দরখাস্ত লিখে ফেলা যাক। বাঙলায় না ইংরিজিতে?
প্রমথর উদ্যম একেবারে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছিল, সে ত্ৰিয়মাণাভাবে বলিল, না, ইংরিজিতে কাজ নেই, আবার humble petition…Most respectfully shewenth লিখে ফেলবে। বাঙলাই ভাল।
নন্দ তাহার যৎকিঞ্চিৎ বাঙলার সাহায্যেই দরখাস্ত লিখিয়া ফেলিল,—
মহাশয়,
আমি ব্যারিস্টার, বিজ্ঞাপনে বর্ণিত কন্যাকে বিবাহ করিতে চাহি।
ইতি।
শ্ৰীপ্ৰমথনাথ সেন।
দরখাস্ত শুনিয়া প্রমথ বলিল, এক কাজ করলে হয় না? নামটা উপস্থিত বদলে দেয়া যাক, তাহলে রোমান্স জামবে ভাল। কোনও উপায়ে এই বিজ্ঞাপনের হাত হইতে আত্মরক্ষা করিতে পারিলে এখন সে বাঁচে।
নন্দ রাজি হইয়া বলিল, বেশ, কি নাম বল।
প্রমথ বলিল, ঐ অর্থেরই অন্য কোনও নাম।
জিজ্ঞাসা করিল, প্রমথ কথাটার মানে কি হে?
এমন সময় দুই হাতে দু পেয়ালা চা সাবধানে ধরিয়া একটি পনেরো ষোলো বছরের মেয়ে ঘরে ঢুকিল। পাতলা ছিপছিপে, সুশ্ৰী সুগঠন দেহ; একবার দেখিলেই বেশ বোঝা যায়,–নন্দর বোন। নিতান্ত সাধারণ আটপৌরে শাড়ি-শেমিজ পরাপায়ে জুতা নাই। অমিয়া এখনও অবিবাহিতা। নন্দ বিলাত হইতে ফিরিবার অনতিকাল পরে তাহার বাপ-মা দুজনেই মারা গিয়াছিলেনএখন অমিয়াই তাহার একমাত্র রক্তের বন্ধন।
উপস্থিত প্রসঙ্গটার মাঝখানে অমিয়া আসিয়া পড়ায় প্রমথ মনে মনে বিব্রত ও লজ্জিত হইয়া উঠিল। নন্দ পূর্ববৎ স্বচ্ছন্দে জিজ্ঞাসা করিল, প্রমথ কি প্রেমসংক্রান্ত কোনও কথা না কি?
অমিয়া চায়ের পেয়ালাদুটি সবেমাত্র টেবিলের উপর রাখিয়াছিল। ভাষা সম্বন্ধে দাদার প্রগাঢ় অজ্ঞতা দেখিয়া সে হাসি সামলাইতে পারিল না। কিন্তু হাসিয়া ফেলিয়াই অপ্ৰস্তুতভাবে বলিয়া উঠিল, বাঃ দাদা
নন্দ অর্বাচীনের মতো ভগিনীকে প্রশ্ন করিল, অমিয়া, তুই জানিস, প্রমথ কথার মানে?
অমিয়া আড়চোখে একবার প্রমথর মুখখানা দেখিয়া লইয়া মুখ টিপিয়া টিপিয়া হাসিতে লাগিল।
প্রমথ লজ্জার সঙ্কটে তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, প্রমথনাথের বদলে ভূতনাথ হতে পাবে।
শব্দটির প্রকৃত অৰ্থ বুঝিতে পারিয়া নন্দ কিছুক্ষণ উচ্চারবে হাসিয়া লইল। তারপর দরখাস্ত হইতে প্রমথনাথ কাটিয়া ভূতনাথ বসাইয়া দিল।
ব্যাপার কি বুঝিতে না পারিয়া অমিয়া কৌতূহলের সহিত দরখাস্তখানা নিরীক্ষণ করিতেছিল। প্রমথ বেচারা এতই বিহ্বল হইয়া পড়িয়াছিল যে, এক চুমুক গরম চা খাইয়া মুখ পুড়াইয়া উঃ করিয়া উঠিল। চকিতে ফিরিয়া অমিয়া বলিল, বড্ড গরম বুঝি—?
অধিকতর লজ্জায় ঘাড় নাড়িয়া প্রতিবাদস্বরূপ প্রমথ আর এক চুমুক চা খাইয়া ফেলিল এবং এবার মুখের দহটাকে কোনও মতেই উর্ধর্বস্বরে প্রকাশ করিল না।
নন্দ বলিল, ফটোর কি করা যায়? তোমার ফটো একখানা আছে বটে আমার কাছে-? বলিয়া ঘরের কোণের একটি ছোট টিপাই-এর উপর হইতে অ্যালবামখানা তুলিয়া লইল। অমিয়া আস্তে আস্তে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল এবং দরজা পার হইয়াই তাহার দ্রুত পলায়নের পদশব্দ ফটো-অনুসন্ধাননিরত নন্দর কানে গেল না।
নন্দ অ্যালবাম ভাল করিয়া খুজিয়া বলিল, কৈ, তোমার ছবিখানা দেখতে পাচ্ছি না! গেল কোথায়?
পলাতকার পদধ্বনি যে শুনিয়েছিল, সে আরক্ত কৰ্ণমূলে বলিল, আছে কোথাওওইখানেইনন্দ বলিল, না হে, এই দেখ না, জায়গাটা খালিতারপর গলা চড়াইয়া ডাকিল, অমিয়া-অমিয়া
প্রমথ তাড়াতাড়ি ব্যাকুলভাবে বলিল, দরকার কি নন্দ, তোমার একখানা ছবিই দিয়ে দাও না!
নন্দ কিছুক্ষণ প্রমথর মুখের পানে তাকাইয়া থাকিয়া সহস্যে বলিল, তোমার মতলব কি বলতো? এ যে আগাগোড়াই জুঙ্গুরি! শেষে আমার ঠ্যাং-এ দড়ি পড়বে না তো?
প্রমথ বলিল, না না, কোনও ভয় নেই। এখন ফটোখানা দিয়ে দাও, তারপর বিয়ে না হয় না। কোরো।
নন্দ নিজের একখানা ফটো খামের মধ্যে পুরিয়া বলিল, তুমি নিশ্চিন্ত হতে পার, বরকর্তার পদটা আমিই গ্ৰহণ করলুম। যা কিছু কথাবার্তা আমিই করব। বলিয়া চিঠিতে নিজের ঠিকানা দিয়া খাম বন্ধ করিয়া চা-পানে মনোনিবেশ করিল।

০২.
দিন পনেরো পরে প্রমথ নন্দর বাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইল।
কি হে, কি খবর?
নন্দ একরাশি ধূম উদিগরণ করিয়া বলিল, খবর সব ভাল। অ্যাদ্দিন কোথায় ছিলে?
প্রমথ বলিল, ময়ূরভঞ্জে গিয়েছিলুম ভালুক শিকার করতে।
নন্দ বলিল, আমাকে একটা খবর দিয়ে গেলেই ভাল করতে। তা সে যাক, এদিকে সব ঠিক।
প্রমথ জিজ্ঞাসা করিল, সব ঠিক? কিসের?
নন্দ প্রমথর নির্দোষ স্কন্ধের উপর এক প্ৰচণ্ড চপেটাঘাত করিয়া বলিল, কিসের আবার? তোমার বিয়ের।
প্রমথ আকাশ হইতে পড়িল, আমার বিয়ের? সে আবার কি?
বস্তুত সেদিনকার বিজ্ঞাপনের ব্যাপারটা প্রমথর বিন্দুবিসর্গও মনে ছিল না। বিস্মৃতির আনন্দে সে এই কটা দিন ময়ূরভঞ্জের জঙ্গলে দিব্য নিশ্চিন্তমনে কাটাইয়া দিয়াছে। তাই নন্দ যখন নিতান্ত ভাবলেশহীন বৈজ্ঞানিকের মতো তাহার মধ্যাকাশে মস্ত একটা ধূমকেতু দেখাইয়া দিল, তখন প্রমথ ভয়ব্যাকুলের মতো বসিয়া পড়িল। নন্দ স্বচ্ছন্দে বলিতে লাগিল, সবই ঠিক করে ফেলা গেছে। মেয়ে দেখা, এমন কি, আশীর্বাদ পর্যন্ত। মেয়েটি সত্যিই সুন্দরী হে; এবং শিক্ষিতা, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। মেয়ের বাপ বেশ আলোকপ্ৰাপ্ত লোক। কোনও রকম কুসংস্কারের বালাই নেই। মেয়েটির নাম সুকুমারী।
প্রমথ অস্থির হইয়া বলিল, আমি এই কদিন ছিলুম না, আর তুমি সব গোল পাকিয়ে বসে আছ?
নন্দ বলিল, তুমি না থাকায় বড় অসুবিধায় পড়া গিয়েছিল। অগত্যা তোমার হয়ে আশীর্বাদটাও আমি গ্ৰহণ করেছি। কন্যাপক্ষের এখনও ধারণা যে, আমিই বর। সে ভুল ভাঙবে একেবারে বিয়ের রাত্রে।
প্রমথ ব্যাকুলস্বরে বলিল, ভাই, সবই যখন তুমি করলে, তখন বিয়েটাও কর। আমায় রেহাই দাও।
নন্দ ফিরিয়া বলিল, কি রকম? তখন নিজে কথা দিয়ে এখন পেছুচ্ছ? কিন্তু তা তো হতে পারে না। সমস্ত ঠিক হয়ে গেছে-এই ৭ই বিয়ের দিন।
প্রমথ রাগ করিয়া বলিল, কেন তুমি আমায় না জানিয়ে সব ঠিক করে বসলে?
নন্দ বলিল, এ তোমার অন্যায় কথা। তখনই আমি তোমায় বলে দিয়েছিলুম।
প্রমথ বলিল, বেশ, যা হয়ে গেছে যাক, এখন তুমিই বিয়ে কর।
দৃঢ়স্বরে নন্দ বলিল, কখনই না। তোমার জন্যে পাত্রী স্থির করে তাকে নিজে বিয়ে করা আমার পক্ষে অসম্ভব।
প্রমথ বলিল, তাহলে আমিও নিরুপায়।
নন্দ ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিল, অৰ্থাৎ?
অর্থাৎ আমি এখন বিয়ে করতে পারব না।
তুমি চাও চুক্তিভঙ্গের অপরাধে আমি জেলে যাই?
প্রমথ রাগিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, জেলে যাওয়াই তোমার উচিত। তাহলে যদি একটু কাণ্ডজ্ঞান হয়।  বলিয়া হন-হন করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
নন্দ চেঁচাইয়া বলিল, মনে থাকে যেন, ৭ই বিয়েগোধূলি লগ্নে। নিমন্ত্রণপত্র আজই আমি ইসু করে দিচ্ছি।
প্রমথ যতই রাগ করিয়া চলিয়া আসুক না, দোষ যে নন্দর অপেক্ষা তাহারই বেশী, তাহা সে মর্মে মর্মে অনুভব করিতে লাগিল এবং এই গুরুতর দুর্ঘটনার জন্য নিজেকে অশেষভাবে লাঞ্ছিত করিতেও ত্রুটি করিল না। এক ধরনের লোক আছেযদিও খুব বিরলযাহারা নিজের দোষ সবচেয়ে বড় করিয়া দেখে এবং নিজের লঘু পাপের উপর গুরুদণ্ড চাপাইয়া দেয়, যাহার হয়তো কোনই প্রয়োজন ছিল না। আত্মলাঞ্ছনা শেষ করিয়া প্রমথ নিজের উপর এই কঠিন দণ্ডবিধান করিল যে, মন তাহার এ বিবাহের যতই বিপক্ষে হউক না কেন, বিবাহ তাহাকে করিতেই হইবে। ইহাই তাহার মুঢ়তার উপর্যুক্ত দণ্ড। তাছাড়া নন্দ যখন একটা কাজ করিয়া ফেলিয়াছে, তখন তাহাকে পাঁচজনের সম্মুখে অপদস্থ করা যাইতে পারে না। নাকোনও কারণেই নহে।
 
বিবাহের দিন যথাসময়ে আসিতে বিলম্ব করিল না, এবং সে দিন সন্ধ্যাবেল প্রমথকে বন্ধুবান্ধব দ্বারা পরিবৃত করিয়া বরকতা নন্দলাল মোটর আরোহণে বিবাহস্থলে উপস্থিত হইতেও বিলম্ব করিল। না। প্রমথ ইচ্ছা করিয়াই কোনও রকম সাজসজ্জা করে নাইমুখ ভারি করিয়া বসিয়াছিল। তাহাকে দেখিয়া বর বলিয়া মনেই হয় না। বরং নন্দ বরকতা বলিয়া বেশের বিশেষ পরিপাট্যসাধন করিয়া আসিয়াছিল। এ ক্ষেত্রে অজ্ঞ ব্যক্তির কাছে সেই বর বলিয়া প্ৰতীয়মান হইল।
কন্যার পিতা ল্যানসডাউন রোডে বাড়ি ভাড়া করিয়াছিলেন। সেইখানেই বিবাহ। বরপক্ষ সেখানে উপস্থিত হইবামাত্র মহা হুলস্থূল পড়িয়া গেল। চিৎকার, হাঁকাহাঁকি, উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনির মধ্যে কন্যাকর্তা তাড়াতাড়ি বরকে নামাইয়া লইতে ছুটিয়া আসিলেন। নন্দ তখন নামিয়া পড়িয়াছেপ্রমথ গোঁজ হইয়া গাড়ির মধ্যে বসিয়া আছে। সে মনে মনে ভাবিতেছে, যাঁহার কন্যাকে সে বিবাহ করিতেছে, তাঁহার নামটা পর্যন্ত সে জানে না-জানিবার দরকারও নাই। কোনও রকমে এই পাপ-রাত্ৰি কাটিলে বাঁচা যায়। তারপর, পরের কথা পরে ভাবিলেই চলিবে।
হঠাৎ অত্যন্ত পরিচিত কণ্ঠস্বরে সচকিত হইয়া প্রমথ তাকাইয়া দেখিল, তাহারই মাতুল প্রমদাবাবু সাদরে নন্দর বাহু ধরিয়া বলিতেছেন, এস বাবা, এস।
প্রমথর মনের মধ্যে সন্দেহের বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল, সে চিৎকার করিয়া উঠিল, এ কি মামা, তুমি?
প্রমদাবাবু ফিরিয়া প্রমথকে দেখিয়া বলিলেন, এ কি প্রমথ, তুইও বরযাত্রী না কি? কোথায় ছিলি এত দিন? খুঁজে খাঁজে হয়রান, কোথাও সন্ধান না পেয়ে শেষে চিঠি লিখে রেখে এলুম। চিঠি পেয়েছিলি তো?
প্রমথ উত্তেজিত স্বরে বলিল, কোন চিঠি?
সুকুর বিয়ের নেমন্তান্ন চিঠি।
হায় হায়! ময়ুরভঞ্জ হইতে ফিরিবার পর প্রমথ একখানা চিঠিও খুলিয়া দেখে নাই।
এই সময়টার জন্যই নন্দ অপেক্ষা করিতেছিল। সে সহাস্যমুখে সকলের দিকে ফিরিয়া বলিতে আরম্ভ করিল, দেখুন, একটা ভুল গোড়া থেকেই হয়ে এসেছে, এখন তার সংশোধন হওয়া দরকার। আজ বিবাহের বর-
প্রমথ মোটর হইতে লাফাইয়া নন্দর হাত সজোরে চাপিয়া ধরিল; বলিল, নন্দ, চুপ কর। একটা কথা আছে, শুনে যাও। বলিয়া তাহাকে টানিতে টানিতে অন্তরালে লইয়া গেল। কন্যাপক্ষীয় এবং বরপক্ষীয় সকলেই অবাক হইয়া রহিল।
প্রমথ বলিল, তুমি একটা আস্ত গাধা। করেছ কি! সুকু যে আমার বোন হয়! প্রমদাবাবু আমার সাক্ষাৎ মামা।
নন্দ হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল! প্রমথ হাসিয়া বলিল, হাঁ করলে কি হবে? এখন চল, ভগিনীকে উদ্ধার কর। কেলেঙ্কারী যা করবার, তা তো করেছ। এখন মামার জাতটাও মারবে?
নন্দ এমনই স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিল যে, বিবাহ শেষ না হইয়া যাওয়া পর্যন্ত একটি কথাও বলিতে পারে নাই। সম্প্রদানের সময় বরের নাম লইয়া একটু গোলমাল হইয়াছিল, কিন্তু তাহা সহজেই কাটিয়া গেল। প্রমথ বুঝাইয়া দিল যে, নন্দর ডাকনাম ভুতো।
বিবাহ চুকিয়া গেলে প্রমথ নন্দকে জিজ্ঞাসা করিল, কি হে, বিয়েটা রোমান্টিক বোধ হচ্ছে তো? নন্দ বলিল, হুঁ। কিন্তু তোমাকে বঞ্চিত করে ভাল করিনি, এখন বোধ হচ্ছে।
বটেকেন?
কি জানি যদি আবার পরে দাবি করে বস!
প্রমথ কৃত্রিম কোপে ঘুষি তুলিয়া বলিল, চোপরও।
নন্দ বলিল, সে যেন হল। কিন্তু তোমার মুখের গ্রাস কেড়ে নিলুম। তোমার একটা হিল্লে করে দিতে হবে তো!
প্রমথ নিরীহ ভালমানুষের মতো বলিল, হিল্লে তো তোমার হাতেই আছে।
প্রমথ অসহিষ্ণু হইয়া বলিল, থাক গে। নন্দ, আমাকে আজ ছুটি দাও ভাই-আমার একটু কাজ আছে।
নন্দ বলিল, কি কাজ না বললে ছুটি পাচ্ছি না।
আমাকে একবার-একবার অমিয়াকে খবর দিতে হবে।
অমিয়াকে খবর কাল দিলেই হবে। এই রাত্রে তার ঘুম ভাঙিয়ে আমার বিয়ের খবর দেবার দরকার নেই।
কিন্তু আমার পরিত্রাণের খবরটা তো দেওয়া দরকার।
তার মানে?
তার মানে, তুমি একটি গাধা, তার চেয়েও বড়একটি উট। এখনও বুঝতে পারনি?
সহসা প্রমথর আগা-গোড়া সমস্ত ব্যবহারটা স্মরণ করিয়া নন্দর মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। সে প্রমথর হাতখানা ধরিয়া তিন চারবার জোরে ঝাঁকানি দিয়া বলিল, অ্যাঁ, অমিয়া তোমার মাথাটি খেয়েছে? তাই বুঝি। এ বিয়েতে এত আপত্তি? ওঃ, What a fool I have been! ফটোখানা তাহলে অমিয়া হস্তগত করেছিলআর আমি বেয়ারাটিকে মিছিমিছি বাপান্ত করলুম! কিন্তু এত কাণ্ড করবার কি দরকার ছিল? আমাকে একবার বললেই তো সব গোল চুকে যেত।
প্রমথ লজ্জিত হইয়া বলিল, না না, বলবার মতো কিছু হয়নিশুধু মনে মনে-। তাহলে তোমার অমত নেই তো?
নন্দ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, প্রমথ ভাই, কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমাদের বন্ধুত্বের অপমান করতে চাইনে। কিন্তু অমিয়ার যে এ ভাগ্য হবে, তা আমার আশার অতীত।
প্রমথ তাড়াতাড়ি নন্দকে বাহুবেষ্টনে বদ্ধ করিয়া বলিল, থাক, হয়েছে হয়েছে। আমি তাহলে তাকে গিয়ে খবর দিয়ে আসি যে, আমার বোনের সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। 


ময়মনসিংহ গীতিকা


ময়মনসিংহ গীতিকা


ময়মনসিংহের অধিবাসী চন্দ্রকুমার দে (১৮৮৯-১৯৪৬)-র প্রচেষ্টায় সংগৃহীত ও ‘সৌরভ' পত্রিকায় প্রকাশিত “ময়মনসিংহ গীতিকা’ দেখে আকৃষ্ট হয়ে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৮৬-১৯৩৯) ময়মনসিংহ গীতিকা”ম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। এরপর আরাে কয়েকটি খণ্ড ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা' নামে প্রকাশিত হয়। সময় গীতিকা সংকলনই 'পূর্ববঙ্গ গীতিকা' নামে প্রচলিত। কালের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘকাল আগে ময়মনসিংহে উদ্ভূত এর কাহিনিগুলির ভাষারও বিবর্তন ঘটেছে, তাই সুনিশ্চিত করে এর উদ্ভবকাল নির্ণয় প্রায় অসম্ভব। কাহিনিগুলিতে বৈচিত্র্যময়, সরল, স্বত:স্ফুর্ত, আন্তরিকতাপূর্ণ, সম্প্রীতির আদর্শে উদ্বুদ্ধ গ্রামজীবনের অনবদ্য ছবি ধরা পরেছে। আধ্যাত্মিকতা ও অলৌকিকতার স্পর্শরহিত সমাজজীবনের এই ছবি মূলত ধর্মনির্ভর মধ্যযুগীয় কাব্যধারা থেকে স্বতন্ত্র। গীতিকবিতার এক বিশিষ্টভঙ্গি পূর্ববঙ্গ গীতিকায় লক্ষরা যায়। দ্বিজ কানাই, নয়নাদ ঘােষ, দ্বিজ ঈশান, রঘুসুত, চন্দ্রাবতী, ফকির ফৈজু, মনসুর বয়াতি প্রমুখে বচনায় গীতিকা-সাহিত্য উজ্জ্বল। কবিরা তাদের রচনায় তৎকালীন সমাজ ইতিহাসের যেমন প্রতিফলন ঘটিয়েছেন, পুরাণ-দর্শন-ধর্মতত্ত্বের অনুবর্তনও ঘটিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—“ময়মনসিংহ গীতিকাবাঙ্গালার পল্লীহৃদয়ের গভীরস্তর থেকে স্বত: উচ্ছ্বসিত উৎস, অকৃত্রিম বেদনার স্বচ্ছ ধারা। নানা ইতিকথা অবলম্বনে গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের কথা কবিত্বময় ও সুসংহত আকারে গীতিকাগুলিতে উৎসারিত হয়েছে। এর বিভিন্ন পালার মধ্যে উল্লেখযােগ্য কয়েকটি হলাে—আধা বধু, ‘মহুয়া", ‘মলুয়া', 'কমলা', 'কঙ্ক ও লীলা’ ‘দস্যু কেনারাম’ প্রভৃতি।

বাংলা সাহিত্যের উন্মেষ ধর্মসাধনা তথা ঈশ্বর-উপাসনাকে ভিত্তি করে। তাই সাধন-পদ্ধতির বৈচিত্র্যের প্রতিফলন সাহিত্যে অনিবার্যভাবেই এসেছে। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দী থেকে শুরু করে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি লক্ষ করলে তাতে বাংলাদেশে ধর্মসাধনার বহু বিচিত্র প্রকাশকে অনায়াসে সুচিহ্নিত করা যায়। যেমন— 'তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম, নাথধর্ম, সহজিয়া বৈষুব সম্প্রদায়, বাউল সম্প্রদায় প্রভৃতি। এছাড়াও অসংখ্য লৌকিক দেব-দেবীর উদ্ভবও সে সময়ে ঘটেছে। এইসব ধর্মসাধন-পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে 'আধুনিক যুগের কাছাকাছি সময় পর্যন্ত সাহিত্য রচিত হয়েছে। তান্ত্রিক বৌদ্ধদের চর্যাপদ, শৈব ও শাক্তদের অন্নদামঙ্গল, কালিকামাল, শিবায়বন, শাক্তগীতি, বৈষুবদের পদাবলি, কৃষ্ণমাল, চরিতকাব্য, নাথপন্থীদের গােরক্ষবিজয়, সহজিয়াদের সাধনাসংগীত প্রভৃতি মূলত ধর্মনির্ভর মধ্যযুগের সাহিত্যে একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী রচনা বলতে ছিল কিছু প্রণয় কাহিনি-নির্ভর আখ্যান, ময়মনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং অন্যান্য লােকসংগীত। খ্রিস্টীয় ষােড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে পাঠান রাজত্বের অবসানে বাঙালির রাষ্টনৈতিক অধিকার ক্ষু হয়। মােগল যুগে এদেশে এক নতুন জমিদার শ্রেণির সৃষ্টি হলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে। হােসেন-শাহী বংশের অবনতির সময় থেকে বহির্বাণিজ্য বাঙালির হাতছাড়া হতে থাকে এবং বিদেশি বণিকদের অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে। তাই, সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে সাধারণ বাঙালি ভূমি-উপজীবী হয়ে পড়ে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিদেশি বণিকদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কাজকর্ম করে অল্প কিছুসংখ্যক লােক বেশ লাভবান হল এবং তাদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে লাগল। সমাজের উচ্চস্তরের এই অন্ত:সারশূন্য অস্থির ও বিলাস ব্যসনের চিত্র 'ভারতচন্দ্রের কাব্যে প্রতিফলিত হয়েছে। খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে মােগল রাজশক্তির পতনের সময়কালে বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রদেশের নবাবদের মধ্যেও স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের ফলে তাদের বিলাসী উজ্জ্বলতায় এবং অক্ষম শাসনে বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র অরাজকতা ও দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। বর্গির হাঙ্গামা সমাজকে অস্থির ও সন্ত্রস্ত করে তুলল। পর্তুগিজ, ফরাসি, ইংরেজ প্রভৃতি পাশ্চাত্য শক্তি ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে নিজেদের ক্ষমতাবৃদ্ধিও আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। অবশেষে, ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধে সিরাজদৌল্লার পরাজয়ে ভারতবর্ষইংরেজ শাসনাধীন হয়ে পড়ে। যুদ্ধবিধ্বস্ত শিথিল সমাজজীবনে উন্নত সাহিত্যচর্চা ছিল কল্পনাতীত। অবক্ষয়ের সেই যুগে নবদ্বীপের মহারাজ কৃচন্দ্র রায়ের (১৭১০-১৮৮৩ খ্রি:) পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতচন্দ্র রায় রামপ্রসাদ সেনের মতেকবিরীকাব্যরচনা করেছেন। এই সময়পর্বে বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য কবিদের মধ্যে ধর্মমঙ্গলেরকবিঘনরাম চক্রবর্তী ও শিবায়নেরকবিরামেশ্বর ভট্টাচার্যের নাম উল্লেখযােগ্য।  



এছাড়া এই সময়ের কিছু বৈকবিতা, চরিতকাব্যগ্রন্থ, বৈষুব নিবন্ধ-পদসংকলন, রামায়ণ-মহাভারত ও ভাগবতের অনুবাদ, বিদ্যাসুন্দরকাব্য, সত্যনারায়ণ পাঁচালি, শৈযােগী সম্প্রদায়ের ছড়া ও গাথা, নীতিকথা, ঐতিহাসিক গাথা, গণিতের আর্যা, ইসলামি বাংলায় রচিত আরবি-ফারসি উপাখ্যান-আশ্রয়ী কিসসার সন্ধান পাওয়া যায়। এছাড়া, ভাষাশিক্ষার প্রয়ােজনে বিদেশি ধর্মপ্রচারক ও বণিকেরা বাংলা শব্দকোষ সংকলন করেন এবং বাংলা ভাষার ব্যাকরণ

নাথ সাহিত্য



নাথ সাহিত্য

মঙ্গলকাব্য ছাড়া ‘নাথ সাহিত্য” নামে পরিচিত আরেক শ্রেণির কাব্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল। বাংলাদেশে সুপ্রাচীনকাল থেকে বর্তমান শিব-উপাসক এক যােগী সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠিত ধমহি হল নাথধর্ম। বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব কালক্রমে স্তিমিত হয়ে এলে তার সঙ্গে শৈবধর্মের মিশ্রণের ফলেই এই নাথধর্মের উৎপত্তি। নাথ ধর্মসম্প্রদায়ের যােগ-মাহাত্ম্যই নাথ সাহিত্যের বিষয়, কীভাবে যােগের শক্তিতে দুঃখ বিপদ অতিক্রম করা যায়, জয় করা যায় মৃত্যুকে পর্যন্ত—নাথসাহিত্যে সে কথাই বর্ণিত হয়েছে। এই নাথসাহিত্যের দুটি ভাগ। সেগুলি হল (১) শিষ্য গােরক্ষনাথ কীভাবে গুরু মীননাখাকে উদ্ধার করলেন সেই কাহিনি অর্থাৎ সংসারের মায়ায় আবদ্ধ মীননাথকে যােগী করে তােলার কাহিনি আর (২) রানি ময়নামতী আর তার পুত্র গোবিন্দচরে কাহিনি। যে আলাদা ছড়া-পাঁচালির আকারে মীননাথ-গোরক্ষনাথের কাহিনি রয়েছে, তার নাম ‘গােরক্ষবিজয় বা 'মীন-চেতন; আর, যে কাহিনিতে রানি ময়নামতী-গোবিন্দচন্দ্রের বৃত্তান্ত পাওয়া যায় তা 'ময়নামতীর গান' বা 'গােপীচন্দ্রের গান নামে পরিচিত। সুপ্রাচীন কাল থেকে নানা প্রক্ষেপের মধ্য দিয়ে এসব কাহিনির মূল রূপটি বর্তমানে বহুল-পরিবর্তিত, এমনকি, এর বহু পুথিতে চৈতন্য প্রভাবের স্পষ্ট প্রমাণ মেলে। এই নাথসাহিত্য-গােরক্ষবিজয়’ আর ‘গােপীচন্দ্রের গান’ গ্রাম্য কবিদের রচনা। যে কারণে এতে না আছে পাণ্ডিত্যের আড়ম্বর, না আছে সংস্কৃত 'অলংকারশাস্ত্রের প্রভাব। সহজ, সরল, অনাড়ম্বর ভাষা-রীতিই নাথসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য। তবুও এতে ধর্মতত্ত্ব, দার্শনিকতার সঙ্গে কবিত্বের সূরণও লক্ষ করা যায়। করুণ রসাত্মক গােপীচন্দ্রে গানে প্রাচীন বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনচিত্রের সহজ ৰূপায়ণ ঘটেছে, সামাজিক রীতিনীতি, অর্থনৈতিক অবস্থার পরিচয় রয়েছে, গ্রাম্য ছড়া-প্রবাদ-প্রকৃতির বিবরণও এতে লিপিবদ্ধ হয়েছে। গানগুলিতে বৌদ্ধ ও ব্রাক্ষ্মণ্যধর্মের প্রভাব নানাভাবে এসেছে। এসেছে অতিপ্রাকৃত তথা অলৌকিকতার স্পর্শ। বাংলার বাইরে গানগুলির প্রচারের উদ্দেশ্যে এগুলিকে মারাঠি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, ওড়িয়া—প্রভৃতি ভাষায় অনুবাদও করা হয়েছিল। বহুকবি “গােরক্ষবিজয়” এবং “গােপীচন্দ্রের গান রচনা করেছেন। অষ্টাদশ শতকের আগে লেখা মীননাথ-গােরক্ষনাথের কাহিনির কোনাে পুথি পাওয়া যায়নি। গােরক্ষবিজয়ের প্রাচীনতম কবিদের মধ্যে রয়েছেন ভীমসেন রায়, শ্যামদাস সেন, শেখ ফয়জুল্লা প্রমুখ।ময়নামতীর গানের প্রাপ্ত পুথির মধ্যে কোনােটিসপ্তদশ শতকেরআগে রচিত নয়। এ কাহিনির উল্লেখযােগ্য কবি হলেন-দুর্লভ মল্লিক, ভবানী দাস, সুকুর মামুদ প্রমুখ।

নীলধ্বজের প্রতি জনা - মাইকেল মধুসূদন দত্ত



নীলধ্বজের প্রতি জনা
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
বাজিছে রাজ-তোরনে রণবাদ্য আজি;
হ্রেষে অশ্ব; গর্জ্জে গজ; উড়িছে আকাশে
রাজকেতু; মুহুর্মুহুঃ হুঙ্কারিছে মাতি
রণমদে রাজসৈন্য ;—কিন্তু কোন্‌ হেতু?
সাজিছ কি, নররাজ, যুঝিতে সদলে—
প্রবীর পুত্রের মৃত্যু প্রতিবিধিৎসিতে
নিবাইতে এ শোকাগ্নি ফাল্পুনির লোহে ?
এই তো সাজে তোমারে, ক্ষত্রমনি তুমি,
মহাবাহু! যাও বেগে গজরাজ যথা
যমদণ্ডসম শুণ্ড আস্ফালি নিনাদে!
টুট কিরীটীর গর্ব্ব আজি রণস্থলে!
খণ্ডমুণ্ড তার আন শূল-দণ্ড-শিরে!
অন্যায় সমরে মূঢ় নাশিল বালকে;
নাশ, মহাষ্বাস, তারে! ভুলিব এ জ্বালা,
এ বিষম জ্বালা, দেব, ভুলিব সত্বরে!
জন্মে মৃত্যু ;—বিধাতার এ বিধি জগতে।
ক্ষত্রকুল-রত্ম পুত্র প্রবীর সুমতি,
সম্মুখসমরে পড়ি, গেছে স্বর্গধামে,—
কি কাজ বিলাপে, প্রভু? পাল, মহীপাল,
ক্ষত্রধর্ম্ম, ক্ষত্রকর্ম্ম সাধ ভুজবলে।
হায়, পাগলিনী জনা! তব সভামাঝে
নাচিছে নর্ত্তকী আজি, গায়ক গাইছে,
উথলিছে বীণাধ্বনি! তব সিংহাসনে
বসিছে পুত্রহা রিপু—মিত্রোত্তম এবে’
সেবিছ যতনে তুমি অতিথি-রতনে।—
কি লজ্জা! দুঃখের কথা, হায়, কব কারে?
হতজ্ঞান আজি কি হে পুত্রের বিহনে,
মাহেশ্বরী-পুরীশ্বর নীলধ্বজ রথী?
যে দারুণ বিধি, রাজা, আঁধারিলা আজি
রাজ্য, হরি পুত্রধনে, হরিলা কি তিনি
জ্ঞান তব? তা না হলে, কহ মোরে, কেন
এ পাষণ্ড পাণ্ডুরথী পার্থ তব পুরে
অতিথি? কেমনে তুমি, হায়, মিত্রভাবে
পরশ সে কর, যাহা প্রবীরের লোহে
লোহিত? ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম এই কি, নৃমণি?
কোথা ধনু, কোথা তুণ, কোথা চর্ম্ম, অসি?
না ভেদি রিপুর বক্ষ তীক্ষ্ণতম শরে
রণক্ষেত্রে, মিষ্টালাপে তুষিছ কি তুমি
কর্ণ তার সভাতলে? কি কহিবে, কহ,
যবে দেশ-দেশান্তরে জনরব লবে
এ কাহিনী,— কি কহিবে ক্ষত্রপতি যত?
নররারায়ণ-জ্ঞানে, শুনিনু পূজিছ
পার্থে রাজা, ভক্তিভাবে ;—এ কি ভ্রান্তি তব?
হায়, ভোজবালা কুন্তী—কে না জানে, তারে,
স্বৈরিণী? তনয় তার জারজ অর্জ্জুনে
(কি লজ্জা), কি গুণে তুমি পূজ, রাজরথি,
নরনারায়ণ-জ্ঞানে? রে দারুণ বিধি,
এ কি লীলাখেলা তোর, বুঝিব কেমনে?
একমাত্র পুত্র দিয়া নিলি পুনঃ তারে
অকালে! আছিল মান,— তাও কি নাশিলি?
নরনারায়ণ পার্থ? কুলটা যে নারী—
বেশ্যা—গর্ভে তার কি হে জনমিলা আসি
হৃষীকেশ? কোন্‌ শাস্ত্রে, কোন্‌ বেদে লেখে—
কি পুরাণে—এ কাহিনী? দ্বৈপায়ন ঋষি
পাণ্ডব-কীর্ত্তন গান গায়েন সতত।
সত্যবতীসুত ব্যাস বিখ্যাত জগতে!
ধীবরী জননী, পিতা ব্রাহ্মণ! করিলা
কামকেলি লয়ে কোলে ভ্রাতৃবধূদ্বয়ে
ধর্ম্মমতি! কি দেখিয়া, বুঝাও দাসীরে,
গ্রাহ্য কর তাঁর কথা, কুলাচার্য্য তিনি
কু-কুলের? তবে যদি অবতীর্ণ ভবে
পার্থরূপে পীতাম্বর, কোথা পদ্মালয়া
ইন্দিরা? দ্রৌপদী বুঝি? আঃ মরি, কি সতী!
শাশুড়ীর যোগ্য বধূ! পৌরব-সরসে
নলিনী! অলির সখী, রবির অধীনী,
সমীরণ-প্রিয়া! ধিক্‌। হাসি আসে মুখে
(হেন দুঃখে) ভাবি যদি পাঞ্চালীর কথা!
লোক-মাতা রমা কি হে এ ভ্রষ্টা রমণী?
জানি আমি কহে লোক রথীকুল-পতি
পার্থ! মিথ্যা কথা, নাথ! বিবেচনা কর,
সূক্ষ্ম বিবেচক তুমি বিখ্যাত জগতে।—
ছদ্মবেশে লক্ষ রাজে ছলিল দুর্ম্মতি
স্বয়ম্বরে। যথাসাধ্য যে যুঝিল, কহ,
ব্রাহ্মণ ভাবিয়া তারে, কোন্‌ ক্ষত্ররথী,
সে সংগ্রামে? রাজদলে তেঁই সে জিতিল!
দহিল খাণ্ডব দুষ্ট কৃষ্ণের সহায়ে।
শিখণ্ডীর সহকারে কুরুক্ষেত্র রণে
পৌরব-গৌরব ভীষ্ম বৃদ্ধ পিতামহে
সংহারিল মহাপাপী! দ্রোণাচার্য্য গুরু,—
কি কুছলে নরাধম বধিল তাঁহারে,
দেখ স্মরি? বসুন্ধরা গ্রাসিলা সরোষে
রথচক্র যবে, হায়; যবে ব্রহ্মশাপে
বিকল সমরে, মরি, কর্ণ মহাযশাঃ
নাশিল বর্ব্বর তাঁরে। কহ মোরে, শুনি,
মহারথী-প্রথা কি হে এই মহারথি?
আনায়-মাঝারে আনি মৃগেন্দ্রে কৌশলে
বধে ভীরুচিত ব্যাধ; সে মৃগেন্দ্র যবে
নাশে রিপু, আক্রমে সে নিজ পরাক্রমে!
কি না তুমি জান রাজা? কি কব তোমারে
জানিয়া শুনিয়া তবে কি ছলনে ভুল
আত্মশ্লাঘা১০, মহারথি? হায় রে কি পাপে,
রাজ-শিরোমণি রাজা নীলধ্বজ আজি
নতশির,—হে বিধাতঃ!—পার্থের সমীপে?
কোথা বীরদর্প তব? মানদর্প কোথা?
চণ্ডালের পদধূলি ব্রাহ্মণের ভালে?
কুরঙ্গীর অশ্রুবারি নিবায় কি কভু
দাবানলে? কোকিলের কাকলী-লহরী
উচ্চনাদী প্রভঞ্জনে নীরবয়ে১১ কবে?
ভীরুতার সাধনা কি মানে বলবাহু?
কিন্তু বৃথা এ গঞ্জনা১২। গুরুজন তুমি;
পড়িব বিষম পাপে গঞ্জিলে তোমারে।
কুলনারী আমি, নাথ, বিধির বিধানে
পরাধীনা! নাহি শক্তি মিটাই স্ববলে
এ পোড়া মনের বাঞ্ছা! দুরন্ত ফাল্পুনি
(এ কৌন্তেয় যোধে ধাতা সৃজিলা নাশিতে
বিশ্বসুখ!) নিঃসন্তানা করিল আমারে!
তুমি পতি, ভাগ্যদোষে বাম মম প্রতি
তুমি! কোন্‌ সাধে প্রাণ ধরি ধরাধামে?
হায় রে, এ জনাকীর্ণ ভবস্থল আজি
বিজন জনার পক্ষে! এ পোড়া ললাটে
লিখিলা বিধাতা যাহা, ফলিল তা কালে!—
হা প্রবীর! এই হেতু ধরিনু কি তোরে,
দশ মাস দশ দিন নানা যত্ম সয়ে,
এ উদরে? কোন্‌ জন্মে, কোন্‌ পাপে পাপী
তোর কাছে অভাগিনী, তাই দিলি বাছা,
এ তাপ? আশার লতা তাই রে ছিঁড়িলি?
হা পুত্র। শোধিলি কি রে তুই এইরূপে,
মাতৃধার? এই কি রে ছিল তেরা মনে?—
কেন বৃথা, পোড়া আঁখি, বরষিস্‌ ১৩ আজি
বারিধারা? রে অবোধ, কে মুছিবে তোরে?
কেন বা জ্বলিস্‌, মনঃ? কে জুড়ারে আজি
বাক্য-সুধারসে তোরে? পাণ্ডবের শরে
খণ্ড শিরোমণি তোর; বিবরে ১৪ লুকায়ে,
কাঁদি খেদে, মর্‌, অরে মণিহারা ফণি!—
যাও চলি, মহাবল, যাও কুরুপুরে
নব মিত্র পার্থ সহ! মহাযাত্রা করি
চলিল অভাগা জনা পুত্রের উদ্দেশে!
ক্ষত্র-কুলবালা আমি; ক্ষত্র-কুল বধু;
কেমনে এ অপমান সব ধৈর্য্য ধরি?
ছাড়িব এ পোড়া প্রাণ জাহ্নবীর জলে;
দেখিব বিস্মৃতি যদি কৃতান্তনগরে
লভি অন্তে! যাচি চির বিদায় ও পদে!
ফিরি যবে রাজপুরে প্রবেশিবে আসি,
নরেশ্বর, “কোথা জনা?” বলি ডাক যদি
উত্তরিবে প্রতিধ্বনি “কোথা জনা?” বলি!
ইতি শ্রীবীরাঙ্গনাকাব্যে জনাপত্রিকা নাম
একাদশঃ সর্গঃ।