মশা, ভূত ও সুরবালা- শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়


মশা, ভূত ও সুরবালা

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়


আমার বাথরুমে একটি লোনলি মশা আছে। বুঝলেন মশাই, এরকম বুদ্ধিমান মশক আমি জীবনে আর দেখিনি। ধূর্ত, ফিজিক্যালি ফিট এবং ক্যারাটে বা কুংফুর ওস্তাদের মতো কূটকৌশলী। গত পনেরো দিনের চেষ্টায় আমি তাকে মারতে পারিনি। অথচ মশা মারায় আমার বেশ হাতযশ আছে।
ওই একটা ব্যাপারে অবশ্য আমি খুবই কাঁচা। কত চড়-চাপড় দিয়েও এ-যাবৎ যে-কয়টি মশা মারতে পেরেছি তা হাতে গোনা যায়। দু-হাতে তালি বাজিয়েই হয়তো মারলুম, মশাটা পড়লও তার মধ্যে, কিন্তু মরল না।
কেন মরল না মশাই? মরার-ই তো কথা।
কপাল, আমার হাতের তেলো তো ফাঁপা। ওই ফাঁপার মধ্যে পড়ে দিব্যি গা বাঁচিয়ে উড়ে চলে যায়। তবে আমার গিন্নি এ-ব্যাপারে খুবই নমস্যা মহিলা। মশার একেবারে যম। যেটাকে টার্গেট করবেন সেটারই কপাল পুড়ল।
আপনার স্ত্রীকে আমার নমস্কার জানাবেন। কৃতী মহিলাদের শ্রদ্ধা জানাতে আমি খুবই ভালোবাসি।
তা না-হয় জানালুম। কিন্তু মশাই আপনার বাথরুমে কি ওই একটিই মাত্র মশা?
আর মশা নেই? আজ্ঞে না। আমার সারাবাড়িতে একটিও মশা খুঁজে পাবেন না।
সে কী? এ কি ভূতুড়ে কান্ড নাকি মশাই? যতদূর শুনেছিলাম, আপনি একটা পুরোনো বাড়ি কিনেছেন। পুরোনো বাড়ির আনাচে-কানাচে তো প্রচুর মশা থাকার কথা!
বাড়ি নয় মশাই, বাড়ি নয়। আমি একাবোকো মানুষ, বাড়ি দিয়ে কী করব? একটা পুরোনো বাড়ির তিনতলায় একটা ফ্ল্যাট কিনেছি। দুখানা শোয়ার ঘর, একখানা বেশ বড়োসড়ো খাওয়া আর বসার জায়গা। আমার তো বেশি জায়গা লাগে না। আসবাবপত্রও যৎসামান্য। বুড়ো বয়েসে কেউ হুড়ো না দেয়, সেইজন্যই কেনা। নইলে সম্পত্তি দিয়ে আমি কী করব বলুন?
আহা, বুড়ো বয়েসের চিন্তা এই কাঁচা বয়েসেই কেন? এখনও তো ওসব ভাববার বয়েস সামনে পড়ে আছে।
একটা আগাম প্ল্যানিং থাকা ভালো, বুঝলেন। ফ্ল্যাটটা কিনতে যে-লোনটা নিতে হয়েছে, সেটা শোধ করতে এখন বেশি গায়ে লাগছে না। কিন্তু বেশি বয়েসে লোন নিলে চাপে পড়ে যেতে হয়।
তা মশার কথাটা কিন্তু এখনও শেষ হয়নি। তিনতলায় কি মশার উৎপাত কিছু কম?
তা হতে পারে। কিন্তু আমার ফ্ল্যাটে ওই একটিই মশা। তার কোনো সঙ্গী-সাথিও নেই। সারাদিন সে আমার জন্যই অপেক্ষা করে। আমি যেই বাথরুমে ঢুকি অমনি শুরু হয় তার খেল। ওপরে উঠে, নীচুতে নেমে, শূন্যে পাকদন্ডী তৈরি করে কত কায়দায় সে যে আমাকে অ্যাটাক করতে থাকে তা না দেখলে বিশ্বাস হবে না আপনার। তাকে মারবার সবরকম চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। মশা মারবার ওষুধ স্প্রে করলে নিশ্চয়ই মরবে। তবে তার ধূর্তামি দেখে আমারও জেদ চেপেছে তাকে আমি হাত দিয়েই মারব।
আচ্ছা, আপনার মশাটা কি ব্যাচেলার বলে আপনার মনে হয়?
আসলে মশাদের তো বিয়ে হয় না, অনেক গার্লফ্রেন্ড থাকতে পারে। সেই অর্থে সব মশাই ব্যাচেলার। যদিও ছেলেপুলে হতে বাধা নেই।
হ্যাঁ, সেটা অবশ্য ঠিক কথা। পশুপাখিরা তো লিভ টুগেদারই করে।
মশা কিন্তু পশুপাখির মধ্যে পড়ে না।
তাহলে?
মশা কীটপতঙ্গের গ্রুপে।
তাই তো! ঠিক কথাই তো! তাহলে মশাটা বেশ প্রবলেম ক্রিয়েট করছে বলুন।
তা বলতে পারেন। তবে আজকাল মাঝে-মধ্যে মনে হচ্ছে মশার সঙ্গে আমার যে-লড়াইটা চলছে সেটা অনেকটা খেলাধুলোর মতোই ব্যাপার। সময়টাও কাটছে ভালোই। আজকাল বাথরুমে মশাটার সঙ্গে ধ্বস্তাধস্তি করতে গিয়ে বেশ অনেকটা সময় কেটে যায়। বাথরুমটা বলতে নেই, বেশ বড়োই। পালিয়ে যাওয়ার অনেক জায়গা।
আহা, শুনেও ভালো লাগে। আমাদের মোটে একখানা, তা সেটাও এমন ছোটো যে মাজা ঘোরানোর জায়গা নেই। বাথরুম জিনিসটা পুরুষদের কাছে, বিশেষ করে চিন্তাশীল পুরুষদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। আর্কিমিডিস তো ওই বাথরুমেই কী যেন একটা আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। তা ছাড়া অনেক দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ তাঁরা সব ওই বাথরুমেই চিন্তাটিন্তা করেন বলে শুনেছি। তাই ভাবি, একখানা ভালো বাথরুম থাকলে হয়তো আমার মাথাটাও ভালো খেলত। কিন্তু সে আর হওয়ার জো নেই। পাঁচটা মিনিট বাথরুম বন্ধ থাকলেই বাড়িতে হইচই পড়ে যায়। আপনার বাথরুম ক-টা?
দুটো।
আহা, কান জুড়িয়ে গেল। আপনি একা মানুষ, দু-দুটো বাথরুম। আর আমরা পাঁচজন, বাথরুম মোটে একখানা। বড়ো একটেরে একখানা বাথরুম পেলে আমি তো মশাই গলাও সেধে ফেলতুম। আমার বন্ধু বঙ্কা তো বাথরুমে গলা সেধেই নামকরা গায়ক হয়ে গেল। বাথরুম জিনিসটার গুরুত্ব যে কী সাংঘাতিক তা বলে বোঝানো যায় না।
তা বটে। বাথরুম সম্পর্কে আমিও কিছু ভালো ভালো কথা শুনেছি বটে। ভালো বাথরুম পেলে নাকি সুপ্ত প্রতিভা জেগে ওঠে।
অতি সত্য কথা। ছেলেবেলায় মশাই, আমার অঙ্কে বেশ মাথা ছিল। গানের গলা ছিল। দু-চার লাইন কবিতাও লিখে ফেলতুম। ওই বাথরুমের জন্যই বেগ চেপে চেপে কোষ্ঠকাঠিন্য হয়ে গেল। আর তাইতেই প্রতিভাটাও গেল ঘোলাটে হয়ে।
খুবই দুঃখের কথা।
তার ওপর আবার মশাহীন বাথরুম! ভাবাই যায় না।
মশাহীন! না মশাহীন হতে যাবে কেন ওই যে বললুম একটা লোনলি মশা আছে।
আহা, মশাদের আর কতদিন আয়ু বলুন। ঠিক জানা নেই বটে, তবে মাসছয়েকের বেশি কী আর হবে? না হয় বছরখানেকই ধরে নিচ্ছি। ততদিনে তার ন্যাচারাল ডেথ হয়ে গেলেই তা আপনি নিষ্কণ্টক।
মুশকিল কী জানেন? কয়েকদিন আগে অবধি মশাটাকে আমি শত্রু বলে ভাবতাম বটে, কিন্তু হঠাৎ দিনকয়েক হল আমার মনে হচ্ছে, বজ্জাত হোক যাই হোক, মশাটা তো আমাকে সঙ্গও দিচ্ছে। এই যে আমি বাথরুমে গেলেই সে তার খেল শুরু করে, এতে আমার একাকিত্ব ভাবটা কেটেও তো যায় এবং বেশ একটা ফুর্তির ভাব আসে।
কথাটা কিন্তু মন্দ বলেননি। কুকুর, বেড়াল, পাখি পুষলেও কিন্তু ওরকমধারা হয়। মশা অবশ্য পোষ মানার পাত্র নয়।
পোষ মানলে মজাটাও থাকবে না।
আপনি বেশ বিজ্ঞ মানুষ। হবে-না? যার দু-দুটো বাথরুম তার বিজ্ঞ না হয়ে উপায় নেই কিনা। আচ্ছা মশাই, আপনার দ্বিতীয় বাথরুমটার কথা তো কিছুই বললেন না!
ওঃ! ওটা সম্পর্কে যত কম বলা যায়, ততই ভালো।
কেন মশাই, কেন? সেটা কি ব্যবহারযোগ্য নয়?
না, এমনিতে সেটা খুবই ভালো বাথরুম। বিশাল বড়ো। সেটাতে আবার শ্বেতপাথরের একটা পেল্লায় বাথটাব। আছে, বিরাট আয়না, রাজকীয় কমোড এবং বেশ দামি দামি সব ফিটিংস।
তা হলে সেটা ব্যবহার করেন না কেন?
একটু অসুবিধে আছে।
কী অসুবিধে মশাই?
আজ্ঞে, বললে হয়তো আপনি বিশ্বাস করবেন না।
কেন মশাই, বিশ্বাস করব না কেন?
ওই বাথরুমটা আর একজন ব্যবহার করেন।
ও, তা বিশ্বাস না করার কী আছেন বলুন? আর একজন তো ব্যবহার করতেই পারে।
তা, তো বটেই! কিন্তু আমার ফ্ল্যাটে আমি ছাড়া দৃশ্যত আর কেউ থাকে না।
অ্যাঁ। তা হলে এই আর একজনটা এল কোত্থেকে?
সেটাই তো আমারও প্রশ্ন। ফ্ল্যাটে আর কেউ থাকে না, অথচ ওই বাথরুমটা আর কেউ ব্যবহার করছে এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?
বাইরে থেকে কেউ আসে না তো?
আজ্ঞে না।
তবে কি ভূতটুত কিছু?
আমি ভূতে বিশ্বাস করতাম না, এখনও করতে চাইছি না, তবে ব্যাপারটা ওরকমই।
একটু খুলে বলুন-না মশাই, শুনে শরীর রোমাঞ্চিত হচ্ছে যে!
বলার তেমন কিছু নেই। আমি ওই বাথরুমে গেলেই বাথরুমটা যেন খুশি হয় না।
আহা, বাথরুমের আবার খুশি-অখুশি কী?
আছে মশাই, আছে। বাথরুমটা আমাকে তার যোগ্য ব্যবহারকারী বলে মনেই করে না। প্রথম দিন গিয়ে কমোডে বসতে না বসতেহ, ফ্লাশটা আপনা থেকেই অন হয়ে হুড়মুড় করে জল নেমে এল সিস্টার্ন থেকে। শাওয়ার থেকে জল পড়তে লাগল অকারণে। বাথটাবের কলটা কে খুলে দিল। দরজাটা দুম করে খুলে গেল। আমি তো পালিয়ে বাঁচি না।
এ তো পরিষ্কার ভূতুড়ে কান্ড মশাই।
তা বলতে পারেন। অন্যের কাছে ব্যাপারটা ভূতুড়ে বলেই মনে হবে হয়তো। আমার ব্যাখ্যাটা অন্যরকম।
কীরকম মশাই?
কোনো নাক-উঁচু লোক ওটা ব্যবহার করত। খুব শৌখিন লোক। আর বাথরুমটাও সেইজন্য একটু উন্নাসিক। এলেবেলে লোক তাকে ব্যবহার করুক এটা সে চায় না। তাই আমি ঢুকলেই বাথরুমটা নানা কায়দায় তার প্রতিবাদ জানায়।
কিন্তু আপনি যে বললেন, ওটা আর কেউ ব্যবহার করে।
হ্যাঁ, তাও করে। নিশুত রাতে বাথরুম থেকে খুব সুরেলা শিস শুনতে পাই, কখনো গুনগুন করে গান। দামি ওডিকোলোনের গন্ধ আসে, শাওয়ার খুলে কেউ স্নান করে টের পাই।
আপনার ভয় করে না?
না। ভূতে বিশ্বাস করি না বলেই ভয়ও পাই না।
কিন্তু অকাট্য প্রমাণ পেয়েও ভূতে বিশ্বাস করেন না কেন?
বিশ্বাস জিনিসটাই যে ওরকম। বিরুদ্ধ প্রমাণ পেলেও বিশ্বাস শেকড় গেড়ে বসে থাকে, টলতে চায় না।
আশ্চর্য। ভূত সামনে এসে যদি দাঁড়ায় তখনও বিশ্বাস করবেন না?
আজ্ঞে না। পরিষ্কার বলে দেব, ফোটো হে বাপু, তোমাকে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
মশাই, এটা কিন্তু আপনার অন্যায়। ভূতকে পাত্তা না দেওয়াটা ঠিক নয়।
পাত্তা না দিলেও, ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগে না। শিসটা বেশ সুরেলা। গানের গলাও খারাপ নয়। আর সুগন্ধিগুলো খুবই চমৎকার।
আপনি বেশ সাহসী লোক।
না মশাই, আমার ধারণা ঠিক উলটো। বরং আমি বেশ ভীতু লোক। ও-বাড়িতে আর যারা আছে তারাও বলে, আমি নাকি খুব সাহসী লোক। কিন্তু আমি তো আমার মধ্যে সাহসের ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাই না।
ভূতুড়ে ফ্ল্যাটে থাকা কি সাহসের কাজ নয়?
আজ্ঞে, ভূতুড়ে ফ্ল্যাট বলছেন কেন? আপনাদের কথামতো যদি ভূত থেকেই থাকে, সে তো ফ্ল্যাটের আর কোথাও কোনো উৎপাত করে না। তার একমাত্র লক্ষ্য হল ফ্ল্যাটের ভালো বাথরুমটা। আমার কী মনে হয় জানেন?
কী মশাই?
মনে হয়, ভূত-টুত নয়, বাথরুমটাই একটু অ্যানিমেটেড হয়ে গেছে। বাথরুমটা উন্নাসিক হওয়াতেই এসব হচ্ছে। আমাকে পছন্দ করছে না। তাই আমি ওই বাথরুমটাকে অ্যাভয়েড করে চলি। ফলে কোনো ঝামেলা হয় না।
তা হলে আপনার একটা বাথরুমে একটা লোনলি মশা এবং অন্যটায় একটা শৌখিন ভূত। বেশ আছেন মশাই।
হ্যাঁ। আছি বেশ ভালোই। দিব্যি খোলামেলা ফ্ল্যাট, আলো-হাওয়া আছে।
তা কত বড়ো হবে ফ্ল্যাটখানা?
মন্দ নয়। ফ্ল্যাটের মালিক তো বিক্রির সময় বলেছিল ষোলোশো বর্গফুট। দলিলেও তাই লেখা আছে।
ষোলোশো? ও বাবা, সে তো পেল্লায় ব্যাপার! আমার কপালটা দেখুন, ধারেকর্জে তল হয়ে, গিন্নির তাড়নায় অতিকষ্টে মাত্র পাঁচশো পঁয়ত্রিশ বর্গফুটের একখানা ফ্ল্যাট কিনতে পেরেছি। তাইতেই গাদাগাদি করে থাকা। বেশি ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকার ড্ৰব্যাকটা কী জানেন? পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট হয়ে যায়। প্রাইভেসি বলে বস্তুটাই থাকে না কিনা। এ-ঘর, ও-ঘর করতে গিয়ে গায়ে গা ঠেকে যায়। গুতোগুতি করে থাকা আর কী। আর সেইজন্যই তো যতক্ষণ পারি বাড়ির বাইরে কাটিয়ে যাই। আর আপনি রাজা-বাদশার মতো থাকেন। শুনতেও কত ভালো লাগে। কিন্তু একা মানুষ, অতবড়ো ফ্ল্যাটটা কেনার দরকারটা কী ছিল?
আজ্ঞে না, আপনাকে তো বলেইছি, অত জায়গা আমার লাগে না। তবে লোকটা ভারি সস্তায় দিল বলে নেওয়া। ফ্ল্যাটটায় বেশ হাত-পা খেলিয়ে থাকা যায় বটে।
তা কত পড়ল?
লাখ বিশেকের মধ্যেই হয়ে গেল।
বিশ লাখ। তা টাকাটা লোন করলেন বুঝি?
না, লোন নিতে হয়নি। কুড়িয়ে বাড়িয়ে হয়ে গেল।
তাহলে তো আপনি শাঁসালো লোক মশাই। গত দু-মাস ধরে আলাপ, কিন্তু আপনি যে, একজন পয়সাওয়ালা লোক তা টেরটিও পেতে দেননি তো।
টাকার কীই বা মূল্য আছে বলুন!
তা অবিশ্যি ঠিক। টাকা এখন পয়সার স্তরে নেমে গেছে। দশ পয়সা বিশ পয়সার কয়েনগুলো পর্যন্ত আজকাল কেউ নিতে চায় না। আমার কাছে গাদাগুচ্ছের পড়ে আছে। শুনছি এক টাকা দু-টাকার নোটও আর ছাপা হচ্ছে না। শুধু কয়েনগুলো চলছে। না মশাই, টাকার আর ইজ্জত রইল না। আচ্ছা মশাই, তাহলে এই উঠতি বয়সে সংসারী হচ্ছেন না কেন বলুন তো? একটা বিয়ে করে ফেলুন। মশা আর ভূত নিয়ে তো জীবন কাটানো যাবে না।
নিজের বিয়ের চেয়ে আমি পরের বিয়ে দিতেই বেশি ভালোবাসি।
সেটা কীরকম ব্যাপার মশাই?
খুব সোজা, বাংলার ঘরে ঘরে তো বিবাহযোগ্যা অরক্ষণীয়ার অভাব নেই। টাকা-পয়সার অভাবে সেইসব মেয়ের বাপ বিয়ে দিতেও পারছেন না। আমি সাধ্যমতো দু-চারটে বিয়েতে কিছু সাহায্য করতে পেরেছি। সেটাতেই আমার বেশি আনন্দ।
বাঃ মশাই, শুনে বড় খুশি হলাম। আপনার চরিত্রের এই মহৎ দিকটার কথা আমার জানা ছিল না। উঃ, কতদিন কোনো মহৎ মানুষের দেখা পাইনি। মানুষ যে এই কলিযুগেও মহৎ হতে পারে–এই ধারণাটাই করা কঠিন হয়ে পড়ছিল ক্রমশ। না মশাই, আজ আপনি আমার চোখ খুলে দিলেন।
আহা, অতটা বাড়িয়ে বলার কিছু নেই। আসলে যখনই কোনো মেয়ে বা মেয়ের বাপ আমাকে এসে বিয়ে করার জন্য ধরে তখনই আমি টাকা-পয়সা দিয়ে বিয়ের বন্দোবস্ত করে নিজের গর্দান বাঁচাই। মহত্ত্ব নয়, ওটা আমার আত্মরক্ষার কৌশল বলতে পারেন।
ও-কথায় ভুলছি না মশাই, আপনি নিজের মহত্ত্বকে আড়াল করতে চাইছেন। মহৎ লোকের লক্ষণই তো তাই। নিজের মহত্ত্ব স্বীকার করলে, আর তার মূল্য কী থাকে বলুন? আপনার কাছে অনেক কিছু শেখার আছে। বয়সে ছোটো না-হলে আমি আপনার পায়ের ধুলো নিতুম।
ছিঃ ছিঃ, কী যে বলেন! শুনলেও পাপ হয়।
না, মশাই, না, গুণীর গুণ-এর মর্যাদা দেওয়া তো বাঙালির ধাতে নেই। কিন্তু আমি সেরকম লোক নই। গুণী মানুষ দেখলে মাথা নোয়াতে জানি।
আপনি অতি উদারহৃদয় মানুষ।
না মশাই না। উদার আর হতে পারলাম কই? মাসকাবারে হাতে মোটে দশটি হাজার টাকা পাই। তাই দিয়ে সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হয়। ধারকর্জও হয়ে যায়। পাঁচটি হুমদো হুমদো প্রাণী, এসোজন, বোসোজন, অভদ্রতা, ভদ্রতা, ব্যাঙ্কের লোন শোধ দেওয়া, এল আই সি-র প্রিমিয়াম, ঠিকে ঝি-র মাইনে সব মিটিয়ে উদার হওয়ার সুযোগ কোথায় বলুন? নইলে আমারও কি ইচ্ছে করে না অরক্ষণীয়াদের বিয়ে দিই, বন্যাত্রাণে সাহায্য
করি, গরিবের চিকিৎসার খরচ জোগাই? করে, খুবই ইচ্ছে করে, কিন্তু উপায় কী বলুন!
অতি ঠিক কথা। মানুষের মধ্যে মহত্ত্ব আছেই, তবে সেটা
হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটা ফোড়ার মতো টনটন করে, বদ্ধজীবের মতো ডানা ঝাঁপটায়, পাথরচাপা ঘাসের মতো। চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে থাকে। তাই-না?
আপনার উপমা-জ্ঞান অতি চমৎকার। হ্যাঁ, ওরকমই হয় বটে। তবে টাকা থাকলেই যে সবাই দানধ্যান করে তা কিন্তু নয়। এই আমার কথাই ধরুন। ভাবি বটে, অনেক টাকা থাকলে মেলা দানধ্যান করতুম, কিন্তু যদি কোনোদিন সত্যিই ছপ্পড় ফুড়ে টাকা আসে, তখন হয়তো মানসিক পরিবর্তন হয়ে যাবে। টাকা হলে নাকি টাকার নেশা বাড়ে। আরও টাকা, আরও টাকা করে মানুষ হেদিয়ে মরে।
আপনি বিজ্ঞ মানুষ। ঠিকই ধরেছেন। দানধ্যান করার জন্য টাকা ছারখারের চেয়েও মানসিকতার প্রয়োজন বেশি। তবে দানধ্যান বা লোকের সেবা সাহায্য করে বেড়ানোর নেশার বাড়াবাড়িও ভালো নয়। ওর মধ্যে আবার অহং প্রবল হয়ে দাঁড়ায়। দানধ্যানের অহংকার অর্জিত পুণ্যের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে। কখনো-কখনো সাধ্যমতো লোককে একটু আধটু সাহায্য করলেও হয়। টাকাপয়সার চেয়ে সহানুভূতি, সাহচর্য, পাশে দাঁড়ানো এসবেরও মূল্য আছে।
আপনার কাছে বসলেই কতকিছু শেখা যায়। আচ্ছা, আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, আপনি একটু অস্বস্তি এবং উদবেগের মধ্যে আছেন। কেমন যেন একটু আনমনাও। তাই না? ঠিক যেন প্রফুল্ল দেখছি-না আপনাকে?
ঠিকই ধরেছেন। সম্প্রতি আমি একটু অশান্তিতে আছি।
সে কী কথা! আপনার মতো মহৎ মানুষ যদি অশান্তিতে থাকেন তাহলে তো আমাদের-ই উদবেগের কথা। কী হয়েছে বলুন তো?
ঠিক বলবার মতো নয়।
খুব প্রাইভেট প্রবলেম কি?
হ্যাঁ, তাও বলতে পারেন। তবে আপনি সহানুভূতিশীল মানুষ। আপনাকে বলাই যায়। বিশেষ করে আমার যখন পরামর্শ দেওয়ার মতো বিচক্ষণ মানুষ কেউ তেমন নেই।
আহা, শুনে বড়ো প্রীত হলুম। আমার বউ তো আমাকে দিনরাত বোকা, হাঁদা, ভ্যাবাগঙ্গারাম, আহাম্মক বলে গঞ্জনা দেয়। শুনতে শুনতে আমিও কেন যে ক্যাবলা হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু একসময়ে আমারও কিছু বুদ্ধিশুদ্ধি ছিল মশাই।
আছে। এখনও আছে। নিজেকে বোকা ভাবতে নেই। আমি তো আপনার কথাবার্তায় বিচক্ষণতার লক্ষণই দেখতে পাই।
ধন্যবাদ মশাই, অজস্র ধন্যবাদ। আপনি আমার হারানো আত্মবিশ্বাসটা ফিরিয়ে দিলেন। তা ব্যাপারটা কী?
আমি ব্যাচেলর বলে এবং রোজগারপাতি ভালো করি বলে, আমার কাছে কিছু মানুষ সাহায্যের আশায়। আসে।
তা তো বটেই, পাকা কাঁঠাল ভাঙলে মাছি তো আসবেই। তা রোজগারপাতি আপনার কেমন হয়?
ভালোই, আমি ইঞ্জিনিয়ার, এম বি এ। কনসালটেন্সি আছে। ফলে বুঝতেই পারছেন।
খুব পারছি, খুব পারছি, তারপর বলুন।
এই সম্প্রতি আমার গ্রাম-সম্পর্কে এক খুড়োমশাই এসে হাজির হয়েছেন।
গ্রামটা কোথায়?
নৈহাটির কাছে, গ্রাম নামেই। আসলে এখন পুরোদস্তুর শহর হয়ে গেছে। তা এই খুড়োমশাই এসে অবধি আমি কিছু অশান্তিতে আছি।
খুব টেঁটিয়া লোক নাকি?
না, না। অতি সজ্জন মানুষ, নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ, জীবনে একটাও মিথ্যে কথা বলেছেন কি না সন্দেহ। ত্রিসন্ধ্যা। আহ্নিক, জপতপ করেন। তা ছাড়া ভারি অমায়িক ব্যবহার।
বলেন কী? এমন মানুষকে নিয়ে তাহলে আপনার অশান্তি হচ্ছে কেন?
মানুষটা এরকম বলেই অশান্তি। তিনি কলকাতায় এসে আমার বাড়িতেই উঠেছেন। তারপরই আমার আচরণ দেখে অন্নজল ত্যাগ করার উপক্রম।
বলেন কী? কী করেছেন আপনি?
বামুন হয়েও পইতে রাখি না, আহ্নিক করি না, বাসি কাপড়ে চা খাই, সদাচারের অভাব। তিনি তেজস্বী মানুষ। এসব অনাচার দেখে ভারি রেগে গিয়ে চলেই যাচ্ছিলেন। আমি ক্ষমাটমা চাওয়ায় তিনি আমাকে গোবর জলটল দিয়ে শুদ্ধ করে গঙ্গাস্নান করিয়ে একদিন হবিষ্যি ভক্ষণ করিয়ে গলায় পইতে ঝুলিয়ে দিয়েছেন, নিয়মিত আহ্নিক করাচ্ছেন, বাসি কাপড় না ছেড়ে কোথাও কাজ করার উপায় নেই।
আহা, এসব করা তো ভালোই। প্রাচীনকাল থেকে ওসব চলে আসছে, ওর মধ্যে ভালো ব্যাপারও থাকতে পারে তো!
কিন্তু এসব করতে গিয়ে আমার মানসিক শান্তি খুবই বিঘ্নিত। ওঁর ব্রাহ্মণী অবশ্য রান্নাবান্না খুবই ভালো করেন। এতদিন আমিই যা হোক কিছু রান্না করে খাচ্ছিলাম। ওঁরা আসার পর আমার হেঁসেলে ঢোকা বারণ। আরও আশ্চর্যের কথা, খুড়ো আসার পর বাথরুমের বেয়াদবিও বন্ধ হয়েছে।
ওই দেখুন, ওকেই বলে ব্রহ্মতেজ। ভূতপ্রেত পালানোর পথ পায় না। বাঃ, এ তো বেশ ভালোই হয়েছে মশাই। পুজো-আচ্চা চালিয়ে যান, ভূত আর কাছে ঘেঁষবে না।
আহা, ভূতপ্রেত যাই হোক, ব্যাপারটা তো আমি উপভোগই করতাম। কিন্তু আরও একটা মুশকিল হয়েছে।
কী বলুন তো?
খুড়োর সঙ্গে খুড়িমা যেমন এসেছেন তেমনি তাঁদের একমাত্র মেয়ে সুরবালাও এসেছে কিনা।
বাঃ, বেশ নামটি তো। সুরবালা, এ-ধরনের পুরোনো নাম তো আজকাল রাখাই হয় না। তা তাতে মুশকিলটা কীসের?
সুরবালাই মূর্তিমতী মুশকিল।
কেন মশাই, কেন?
সুরবালার বয়স সতেরো-আঠেরো। খুবই চালাক, চতুর, একটু ফাজিল, আর….আর…..
আর? থাকগে সেসব কথা, আসল ব্যাপারটা হল, খুড়োমশাই এবং তাঁর পরিবার পেঁয়াজ-রসুন, বলির পাঁঠা ছাড়া অন্য মাংস, ডিম ইত্যাদি খান না। আমাকেও সেইসব নিয়ম মেনে চলতে হচ্ছে। আর একটু-আধটু যে অনিয়ম করব তারও উপায় নেই। সুরবালা আমার ওপর রীতিমতো গোয়েন্দাগিরি করে যাচ্ছে। সেদিন ভাত খাওয়ার সময় বাঁ-হাতে জল খেয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে নালিশ। বাইরে থেকে হয়তো ওমলেট খেয়ে এসেছি। ঘরে ঢুকতেই সুরবালা ঘোষণা করল, উনি পেঁয়াজ খেয়ে এসেছেন। বুঝুন কান্ড।
হ্যাঁ, তা বটে, একটু-আধটু অসুবিধে তো হতেই পারে। পুরোনো অভ্যেস তো। তা ওঁরা থাকবেন ক-দিন?
আসলে ওঁরা এসেছেন সুরবালার জন্য একটি সচ্চরিত্র পাত্রের খোঁজ পেয়ে। পাত্রটি নাকি সংস্কৃতে এম এ, কোন কলেজের অধ্যাপক, ধুতি-পাঞ্জাবি পরে, ত্রিসন্ধ্যা আহ্নিক করে, শাস্ত্রজ্ঞ এবং সদবংশজাত। বিয়ে প্রায় ঠিক হয়ে গেছে। দু-পক্ষের কথাবার্তাও মোটামুটি পাকা।
বাঃ, তাহলে তো ল্যাঠা চুকেই যাচ্ছে।
না, যাচ্ছে না।
কেন মশাই? সুরবালার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলেই তো ওঁরা ফিরে যাবেন?
হ্যাঁ।
তাহলে?
সুরবালাকে আপনি দেখেননি।
তা তো বটেই।
দেখলেই বুঝতেন সমস্যাটা কোথায়?
দেখতে কদাকার নাকি?
না, বরং উলটো, সুরবালা ভীষণ সুন্দরী, আর…
আর?
তাকে দেখলেই আমার বুকটা ধক করে ওঠে।
এ তো ভালো লক্ষণ নয় মশাই!
না। আর বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সুরবালার দুটো চোখ সবসময়ে লাল আর ভেজা ভেজা। সেদিন আড়াল থেকে শুনলাম, খুড়িমা ওকে বকছেন, কাঁদছিস কেন মুখপুড়ি? এত ভালো পাত্র আর জুটবে? জবাবে সুরবালা বলছিল, তোমরা কী বুঝবে কেন কাঁদছি? ও বিয়ে ভেঙে দাও। মায়ে-মেয়েতে বেশ লেগে গেল।
তারপর?
ওইখানেই ঝুলে আছে। শুধু গতকাল যখন অফিসে বেরোচ্ছি, তখন সুরবালা দরজা দিতে এসে চাপা গলায় বলল, অনেক পাষাণ দেখেছি, আপনার মতো দেখিনি।
বলেন কী মশাই? এ তো সাংঘাতিক কথা!
হ্যাঁ। সেই থেকে বড়ো উচাটন হয়ে আছি। মনে শান্তি নেই।
আহা, এতে উচাটন হওয়ার কী আছে? আরে আপনি ভূতকে ভয় পান না, দানশীল লোক, মহৎ প্রাণ, আপনার ভয়টা কীসের?
ভয়ের ব্যাপার তো নয়। এ হল ব্যাখ্যার অতীত একটা সিচুয়েশন। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না ব্যাপারটা।
কেন, আমি তো বেশ বুঝতে পারছি।
পারছেন?
বিলক্ষণ।
কী বুঝলেন?
সেটা হাঁটতে হাঁটতেই বলবখন। এখন উঠুন তো, উঠে পড়ন। খুড়োমশাই বাড়িতে আছেন তো?
আছেন, কিন্তু…
আর কিন্তু নয়, দেরি করলে কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে যাবে। খুড়োমশাইয়ের সঙ্গে আমার এক্ষুনি কথা বলা দরকার।
ইয়ে, তা নয় যাচ্ছি। কিন্তু….

সংক্ষিপ্ত আলোচনা - দাম


[ বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ ebanglaschools এর সমস্ত আলোচনা কোনো পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গের জন্য নয়। সাধারণ এবং অতি সাধারণ পিছিয়ে পড়া ছাত্র ছাত্রীদের জন্যই এই উদ্যোগ। তাদের কথা ভবেই এই আলোচনার প্রচেষ্টা। বিশিষ্টরা দূরে থাকুন । আমাদের একান্ত অনুরোধ যদি ছাত্র ছাত্রীরা এই আলোচনা থেকে উপকৃত হও তাহলে নীচের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে ভূলে যেও না। ]    




সংক্ষিপ্ত আলোচনা - দাম



নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘দাম’ গল্পটি ১৩৬৫ বঙ্গাব্দে শারদীয়া “তরুণের স্বপ্ন” পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। তাঁর অন্যান্য গল্পের মত এই গল্পটিও বেশ উল্লেখযোগ্যও। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সুকুমার, অংক নামক বিষয়টি তার কাছে বিভীষিকার মত। কিন্তু ছেলেবেলায় তার স্কুলের মাস্টারমশাই যেন তেন প্রকারেন সকলকে অংক শেখাতে চান। তিনি মনে করেন জীবনটা অংকের মত, অংক না শিখলে জীবন ভালোভাবে গড়া যায় না।  সেকারনেই সকলকে মারধর করে জোর করে অংক শেখাতে বসতেন।
       কিন্তু জোর করে তো কাউকে কিছু সেখানো যায় না। তাই সুকুমারকেও শেখানো যায়নি। উচ্চশিক্ষায় সে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়ে এবং পরবর্তী কালে সে বাংলার অধ্যাপক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন। এরপরই গল্পের মূল আকর্ষণ। সুকুমার বাংলার অধ্যাপক হলে নানান পত্র পত্রিকা থেকে তার কাছে আবদার আসে নিজস্ব গল্প রচনার জন্য। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে লক্ষণীয় সে গল্পের বিষয় স্থির করে উঠতে পারে না, শেষ পর্যন্ত ছেলেবেলার স্কুলের সেই মাস্টারমশাইয়ের কথা গল্পের বিষয়বস্তু রূপে নির্বাচন করেন, সেখানে সে জানায় মাস্টারমশাই সেদিন ভূল ছিল। তার পদ্ধতিও ভূল ছিল। আরো ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলে ছাত্রদের ভয় দেখিয়ে পিটিয়ে কখনো মানুষ করা যায় না। তার ক্ষোভ জানিয়ে তার দশটাকা প্রাপ্তিও হয়।
       গল্পের শেষ অংশে আমরা লক্ষ্য করি সুকুমার একসময় বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত কলেজে বক্তৃতা রাখতে যায়। সেখানে তার বক্তৃতা শুনে সবাই অভিভূত হয়ে পড়ে। এখানেও একটি বিশেষ কথা লক্ষণীয় যে, সে নিজেই জানায় সে একটি মাত্র বক্তৃতাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অদল বদল করে চালিয়ে দেয়। আর সেই বক্তৃতা শুনে সকলে মুগ্ধও হয়। কাজেই সকলের কাছে সে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুললেও নিজের কাছে পরিতৃপ্ত হতে পারে না। সেকারনেই এক সময় ছেলেবেলার মাস্টারমশাইয়ের সাথে দেখা হলে তার সামনে দাঁড়াতেও সংকোচ বোধ করে। কারণ সে নিজেকে আর বড় করে ভাবতে পারে না।
সুকুমার আরো লজ্জিত হয় মাস্টারমশাইয়ের হাতে সেই পত্রিকা দেখে। সে তো সেই পত্রিকাতেই মাস্টারমশাইকে অসম্মান করেছিল , তার স্নেহ মায়া ভালোবাসাকে মাত্র দশটাকার বিনিময়ে বিক্রি পর্যন্ত করেছিল। আজ সে নিজের কাছেই নিজে লজ্জিত অপমানিত। তার কাছে যেন তার কথাই বারবার ফিরে আসে সত্যিই মাস্টারমশাই তাকে পিটিয়ে মানুষ করতে পারেনি, আসলে পিটিয়েতো কাউকে মানুষ করা যায় না। তার সেদিনের সেই নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিয়ে মাস্টারমশাই সুকুমারকে বুকে টেনে ধরে। সমস্ত মান অভিমান যেন এক নিমেষে কোথায় হারিয়ে যায়। আসলে মাস্টারমশাইরা তো এমনই হয়। এই মাস্টারমশাইকেই সে দশ টাকায় বিক্রি করেছে। তবুও সুকুমারের মধ্যে আত্মগ্লানি মোছে না। সে উপলব্ধি করে সে অধ্যাপক হলেও যারা তাকে এই শিখরে পৌঁছে দিয়েছে তাদের শিক্ষা – মায়া – ভালোবাসার ‘দাম’ সে দিতে পারেনি।




















copywrite ebanglaschools
পুনর্মুদ্রণযোগ্য নয়।


সংক্ষিপ্ত আলোচনা - তিন পাহাড়ের কোলে


[ বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ ebanglaschools এর সমস্ত আলোচনা কোনো পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গের জন্য নয়। সাধারণ এবং অতি সাধারণ পিছিয়ে পড়া ছাত্র ছাত্রীদের জন্যই এই উদ্যোগ। তাদের কথা ভবেই এই আলোচনার প্রচেষ্টা। বিশিষ্টরা দূরে থাকুন । আমাদের একান্ত অনুরোধ যদি ছাত্র ছাত্রীরা এই আলোচনা থেকে উপকৃত হও তাহলে নীচের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে ভূলে যেও না। ]    

সংক্ষিপ্ত আলোচনা – তিন পাহাড়ের কোলে

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রচলিত ছন্দের একেবারেই ব্যতিক্রমী ধারার কবিতা 'তিন পাহাড়ের কোলে'।কবিতা সবসময়ই দুটো অর্থ বহন করে একটি বাইরের অর্থ অন্যটি ভেতরের অর্থ। বাইরের অর্থে, কোনো এক রাত্রির পরিবেশে তিন বন্ধুর ভ্রমণের গল্প বলে এই কবিতাটি। কবি জানান তিন বন্ধু মিলে কোনো একদিন রাত্রে পৌঁছায় পাহাড়ি কোনো এক অঞ্চলে। সেখানকার পাহাড়ি পরিবেশের সৌন্দর্য কবির চোখে যেন স্মৃতি হয়ে থেকে গেছে বহুকাল। একদিকে পাহাড়ি অঞ্চলের অপার সৌন্দর্য, অন্যদিকে চারিদিকের নিস্তব্ধতায় কবি মন ভাসতে ভাসতে পৌঁছে যায় কোনো এক অপার সৌন্দর্যের জগতে। তাই কবি বলতে চেয়েছেন এমন সৌন্দর্য শুধু কবিকেই নয় সকল ভ্রমণ পিপাসু মানুষকেই মুগ্ধ করে।
       কবি দ্বিতীয় পংতিতে বলেন পাহাড়ি অঞ্চল এমন এক ধাঁধার মত তার ভৌগলিক সীমানা এমনই যে চাইলেই এক পথ ছেড়ে অন্য পথ ধরে হারিয়ে যাওয়া যায়। আর চারিদিকে ছড়িয়ে ছটিয়ে থাকা প্রবল জলোচ্ছ্বাস, স্তূপাকৃতি পাথর , বড় বড় গাছকে যেন ছুঁয়ে নিজেকে অনুভব করা যায় সহজেই। আর নিজেকে অনুভব করতে পারলেই কবি মন হারিয়ে যায় কোনো এক নীল নীলিমায়। আর সেখানেই একান্তে জমে থাকা কথা গুলো নিজের অজান্তেই ধরা দেয় মনে। সেই ভালোলাগা কেবল বলে বোঝাবার মত নয়।
       কবিতার দ্বিতীয় পংতিতে তিনি বলেন, পাহাড়ের সৌন্দর্য তখনই প্রকাশিত হয় যখন রাত্রির অন্ধকার কাটিয়ে ভোরের আলো দেখা দেয় , চারিদিক ঝলমল করে ওঠে। কবি এই সৌন্দর্যে নব বধূর ঘোমটার সাথে তুলনা করেছেন। আর সেই নতুন ভোরের আলোয় যদি উপর থেকে গোটা পাহাড়কে দেখা যায় দেখা যাবে পাহাড়ের বুকের মধ্যে যেন শত শত গ্রাম মেঘের মধ্যে ভেসে আছে। কবি এই সৌন্দর্যের সামনে দাঁড়িয়ে  বলতে চেয়েছেন, প্রতিদিনের কোলাহল মুখর একঘেয়ে জীবন যাপনের মধ্যে এই সৌন্দর্যকে কখনই উপভোগ করা যাবে না। খাঁচা থেকে বেড়িয়ে এসে পাহাড়ি গ্রামের জনজীবন অর্থাৎ তাদের সংস্কৃতি তাদের যাপন ও পাহাড়ের বিচিত্র সৌন্দর্যকে প্রত্যক্ষ করতে পারলেই নিজের শৈশব অর্থাৎ ভেতরের আমিকে খুঁজে পাওয়া যাবে।
       কবিতার বাইরের অর্থের পাশাপাশি থেকে যায় ভেতরের অর্থও। এই কবিতায় কবি সমকালীন সময়ের সামাজিক অবস্থায় জর্জরিত সাধারণ মানুষের মুক্তির কথাই যেন বলতে চেয়েছেন।
















copywrite ebanglaschools
পুনর্মুদ্রণযোগ্য নয়।

সংক্ষিপ্ত আলোচনা – রূপনারানের কূলে



[ বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ ebanglaschools এর সমস্ত আলোচনা কোনো পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গের জন্য নয়। সাধারণ এবং অতি সাধারণ পিছিয়ে পড়া ছাত্র ছাত্রীদের জন্যই এই উদ্যোগ। তাদের কথা ভবেই এই আলোচনার প্রচেষ্টা। বিশিষ্টরা দূরে থাকুন । আমাদের একান্ত অনুরোধ যদি ছাত্র ছাত্রীরা এই আলোচনা থেকে উপকৃত হও তাহলে নীচের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে ভূলে যেও না। ]    




সংক্ষিপ্ত আলোচনা – রূপনারানের কূলে


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্তিম লেখা কবিতা গুলির মধ্যে একটি কবিতা “রূপনারানের কূলে”। “শেষ লেখা” (১৯৪১) কাব্যগ্রন্থে এই কবিতাটি সংকলিত। রবীন্দ্রনাথ ভাবুক কবি বরাবর, তাঁর জীবনের ছোটবড় নানান সমস্যা জটলতা উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়। জীবনের অন্তিম লগ্নে এসে বারবার ফিরে দেখতে চেয়েছেন তাঁর জীবনকে। আর সেখানে বারবারই মিলেছে দুঃখ- বেদনা- হতাশার ছবি। তাঁরই প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে এই কবিতায়। 

             কবি মনে করেছেন তিনি যেন বাস্তবিক রূপময় পৃথিবীর এক কোনে জেগে উঠেছেন। নদীর চলার মত তাঁর জীবন যতই এগিয়েছে কেবলই মনে হয়েছে এই জগত স্বপ্ন নয়, অর্থাৎ বাস্তবের প্রতিমূর্তি। স্বপ্নের সেই নির্মোহ এখানে নেই , আছে কেবল যন্ত্রণা আর শুধুই যন্ত্রণা। আসলে আমাদের প্রত্যেককে জীবনে যন্ত্রণার মধ্যে দিয়েই সুখের বা আনন্দের পরিসরে পৌঁছাতে হয়। তিনি জানিয়েছেন রক্তের অক্ষরে- ‘আঘাতে আঘাতে’ ‘বেদনায় বেদনায়’ জর্জরিত হলেই নিজেকে অনুভব করা যায়। আর তখনই মানুষ খুঁজে পায় নিজেকে , আনন্দের পরিতৃপ্তি লাভ করে। কিন্তু এই যন্ত্রণাময় জীবন প্রতিটি মানুষের কাছে কঠিন সত্যের মত , অথচ এখান থেকে পালিয়ে আসার পথ কারোর নেই। এই কঠিন সত্যকে আঘাত বেদনার মধ্যে দিয়েই উপলব্ধি করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ এই কঠিন সত্যকেই জীবন দিয়ে ভালোবেসেছেন। তাঁর বিশ্বাস এই সত্য কখনো কাউকে বঞ্চনা করে না। আত্মপরিচয়ে তিনি বলছেন “ সত্যের লক্ষণই এই যে , সমস্তই তার মধ্যে এসে মেলে”। আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা করতে পারলেই জীবনে সঠিক আনন্দ আসে। সেকারনেই সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করবার জন্য তিনি জীবনের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তিনি মনে করেন মৃত্যুতেই জীবনের সব দেনা শোধ করে দেওয়া যাবে। সুতরাং জীবনের কাছে তিনি কৃতজ্ঞ।



















































































copywrite ebanglaschools পুনর্মুদ্রণযোগ্য নয়।

উপেক্ষিতা - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়


উপেক্ষিতা
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়


পথে যেতে যেতেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়।
সে বোধ হয় বাংলা দুই কী তিন সালের কথা। নতুন কলেজ থেকে বার হয়েছি, এমন সময় বাবা মারা গেলেন। সংসারের অবস্থা ভালো ছিল না, স্কুলমাস্টারি নিয়ে গেলুম হুগলি জেলার একটা পাড়াগাঁয়ে। …গ্রামটির অবস্থা একসময়ে খুব ভালো থাকলেও আমি যখন গেলুম তখন তার অবস্থা খুব শোচনীয়। খুব বড়ো গ্রাম, অনেকগুলি পাড়া, গ্রামের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত বোধ হয় এক ক্রোশেরও ওপর। প্রাচীন আম-কাঁটালের বনে সমস্ত গ্রামটি অন্ধকার।
আমি ওগ্রামে থাকতুম না। গ্রাম থেকে প্রায় এক মাইল দূরে সে-গ্রামের রেলস্টেশন। স্টেশনমাস্টারের একটি ছেলে পড়ানোর ভার নিয়ে সেই রেলের P.W.D.-এর একটা পরিত্যক্ত বাংলোয় থাকতুম। চারিদিকে নির্জন মাঠ, মাঝে মাঝে তালবাগান। স্কুলটি ছিল গ্রামের ও-প্রান্তে। মাঠের মধ্যে নেমে হেঁটে যেতুম প্রায় এক ক্রোশ।
একদিন বর্ষাকাল, বেলা দশটা প্রায় বাজে, স্কুলে যাচ্ছি। সোজা রাস্তা দিয়ে না গিয়ে একটু শীঘ্র যাবার জন্য পাড়ার ভেতর দিয়ে একটা রাস্তা নেমে গিয়েছে সেইটে দিয়ে যাচ্ছি। সমস্ত পথটা বড়ো বড়ো আম-কাঁটালের ছায়ায় ভরা। একটু আগে খুব একপশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল, আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন ছিল। গাছের ডাল থেকে টুপটুপ করে বৃষ্টির জল ঝরে পড়ছিল। একটা জীর্ণ ভাঙা ঘাটওয়ালা প্রাচীন পুকুরের ধার দিয়ে রাস্তা। সেই রাস্তা বেয়ে যাচ্ছি, সেই সময় কে একটি স্ত্রীলোক, খুব টকটকে রংটা, হাতে বালা অনন্ত, পরনে চওড়া লালপাড় শাড়ি, বয়স চব্বিশ পঁচিশ হবে, পাশের একটা সরু রাস্তা দিয়ে ঘড়া নিয়ে উঠলেন আমার সামনের রাস্তায়। বোধ হয় পুকুরে যাচ্ছিলেন জল আনবার জন্যে। আমায় দেখে ঘোমটা টেনে পথের পাশে দাঁড়ালেন। আমি পাশকাটিয়ে জোরে চলে গেলুম। আমার এখন স্বীকার করতে লজ্জা হয়, কিন্তু তখন আমি ইউনিভার্সিটির সদ্যপ্রসূত গ্র্যাজুয়েট, বয়স সবে কুড়ি, অবিবাহিত। সংস্কৃত কাব্যসাহিত্যের পাতায় পাতায় যেসব তরলিকা, মঞ্জুলিকা, বাসন্তী—উজ্জয়িনীবাসিনী অগুরু-বাস-মোদিত-কেশা তরুণী অভিসারিকার দল, তারা—আর তাদের সঙ্গে ইংরেজি কাব্যের কত Althea, কত Genevieve, Theosebia তাদের নীল নয়ন আর তুষারধবল কোমল বাহুবল্লি নিয়ে আমার তরুণ মনের মধ্যে রাতদিন একটা সুমিষ্ট কল্পলোকের সৃষ্টি করে রেখেছিল। তাই সেদিন সেই সুশ্রী তরুণী রূপ, তাঁর বালা অনন্ত-পরা অনাবৃত হাতদুটির সুঠাম সৌন্দর্য আর সকলের ওপর তাঁর পরনের শাড়ি দ্বারা নির্দিষ্ট তাঁর সমস্ত দেহের একটা মহিমান্বিত সীমারেখা আমাকে মুগ্ধ এবং অভিভূত করে ফেললে। আমার মনের ভিতর এক প্রকারের নূতন অনুভূতি, আমার বুকের রক্তের তালে তালে সেদিন একটা নূতন স্পন্দন আমার কাছে বড়ড়া স্পষ্ট হয়ে উঠল।
বিকালবেলা রেললাইনের ধারে মাঠে গিয়ে চুপ করে বসে রইলুম। তালবাগানের মাথার ওপর সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। বেগুনি রং-এর মেঘগুলো দেখতে দেখতে ক্রমে ধূসর, পরেই আবার কালো হয়ে উঠতে লাগল। আকাশের অনেকটা জুড়ে মেঘগুলো দেখতে হয়েছিল যেন একটা আদিম যুগের জগতের উপরিভাগের বিস্তীর্ণ মহাসাগর। …বেশ কল্পনা করে নেওয়া যাচ্ছিল, সেই সমুদ্রের চারিপাশে একটা গাঢ় রহস্যভরা অজ্ঞাত মহাদেশ, যার অন্ধকারময় বিশাল অরণ্যানীর মধ্যে প্রাচীন যুগের লুপ্ত অতিকায় প্রাণীরা সব ঘুরে বেড়াচ্ছে।
দিন কেটে গিয়ে রাত হল। বাসায় এসে Keats পড়তে শুরু করলুম। পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, মাটির প্রদীপের বুক পুড়ে উঠে প্রদীপ কখন নিভে গিয়েছে। অনেক রাত্রে উঠে দেখলুম বাইরে টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে… আকাশ মেঘে অন্ধকার।…
তার পরদিনও পাড়ার ভেতর দিয়ে গেলুম। সেদিন কিন্তু তাঁকে দেখলুম না। আসবার সময়ও সেখান দিয়েই এলুম, কাউকে দেখলুম না। পরদিন ছিল রবিবার। সোমবার দিন আবার সেই পথ দিয়েই গেলুম। পুকুরটার কাছাকাছি গিয়েই দেখি যে তিনি জল নিয়ে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন, আমায় দেখে ঘোমটা টেনে দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।… আমার বুকের রক্তটা যেন দুলে উঠল, খুব জোরে হেঁটে বেরিয়ে গেলুম।…রাস্তার বাঁকের কাছে গিয়ে ইচ্ছা আর দমন করতে না-পেরে একবার পিছন ফিরে তাকালুম, দেখি তিনি ঘাটের ওপর উঠে ঘোমটা খুলে কৌতূহলী নেত্রে আমার দিকেই চেয়ে রয়েছেন, আমি চাইতেই ঘোমটা আবার টেনে দিলেন।
ওপরের পথটা ছেড়েই দিলুম একেবারে। পুকুরের পথ দিয়েই রোজ যাই। দু একদিন পরে আবার একদিন তাঁকে দেখতে পেলুম। আমার মনে হল সেদিনও তিনি আমায় একটু আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ করলেন। এইভাবে পনেরো-কুড়ি দিন কেটে গেল। কোনোদিন তাঁকে দেখতে পাই, কোনোদিন পাই না। আমার কিন্তু বেশ মনে হতে লাগল, তিনি আমার প্রতি দিন দিন আগ্রহান্বিতা হয়ে উঠছেন। আজকাল ততটা স্তভাবে ঘোমটা দেন না। আমারও কি হল—তাঁর গতি-ভঙ্গির একটা মধুর শ্রী, তাঁর দেহের একটা শান্ত কমনীয়তা, আমায় দিন দিন যেন অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ফেলতে লাগল।
একদিন তখন আশ্বিন মাসের প্রথম, শরৎ পড়ে গিয়েছে… নীল আকাশের সাদা সাদা লঘু মেঘখণ্ড উড়ে যাচ্ছে… চারিদিকে খুব রৌদ্র ফুটে উঠেছে… রাস্তার পাশের বনকচু, ভাঁট শ্যাওড়া, কুঁচলতার ঝোপ থেকে একটা কটুতিক্ত গন্ধ উঠছে।… শনিবার সকাল সকাল স্কুল থেকে ফিরছি। রাস্তা নির্জন, কেউ কোনো দিকে নেই। পুকুরটার পথ ধরেছি, একদল ছাতারে পাখি পুকুরের ওপারের ঝোপের মাথায় কিচ কিচ করছিল, পুকুরের জলের নীল ফুলের দলগুলো রৌদ্রতাপে মুড়ে ছিল। আমি আশা করিনি এমনসময় তিনি পুকুরের ঘাটে আসবেন। কিন্তু দেখলুম তিনি জল ভরে উঠে আসছেন। এর আগে চার-পাঁচ দিন তাঁকে দেখিনি, হঠাৎ মনে কী হল, একটা বড়ো দুঃসাহসের কাজ করে বসলুম। তাঁর কাছে গিয়ে বললুম— দেখুন, কিছু মনে করবেন না আপনি। আমি এখানকার স্কুলে কাজ করি, রোজ এই পথে যেতে যেতে আপনাকে দেখতে পাই, আমার বড় ইচ্ছে করে আপনি আমার বোন হন। আমি আপনাকে বউদিদি বলব, আমি আপনার ছোটো ভাই। কেমন তো? তিনি আমার কথার প্রথম অংশটায় হঠাৎ চমকে উঠে কেমন জড়োসড়ো হয়ে উঠেছিলেন, দ্বিতীয় অংশটায় তাঁর সে চমকানো ভাবটা একটু দূর হল। ঘড়া-কাঁখে নীচু চোখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি যুক্তকরে প্রণাম করে বললুম-বউদিদি, আমার এ ইচ্ছা আপনাকে পূর্ণ করতে হবে। আমাকে ছোটো ভাইয়ের অধিকার দিতেই হবে আপনাকে।
তিনি ঘোমটা অর্ধেকটা খুলে একটা স্থির শান্তদৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলেন। সুশ্রী মুখ যে আমি কখনো দেখিনি তা নয়, তবুও মনে হল তাঁর ডাগর কালো চোখদুটির শান্তভাব আর তাঁর ঠোঁটের নীচের একটা বিশেষ ভাঁজ, এই দুটিতে মিলে তাঁর সুন্দর মুখের গড়নে এমন এক বৈচিত্র্য এনেছে, যা সচরাচর চোখে পড়ে না।
খানিকক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইলুম। তারপর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন তোমার বাড়ি কোথায়?
আনন্দে সারা গা কেমন শিউরে উঠল। বললুম-কলকাতার কাছে, চব্বিশ পরগনা জেলায়। এখানে স্টেশনে থাকি।
তিনি জিজ্ঞাসা করলেন—তোমার নাম কী?
নাম বললুম।
তিনি বললেন—তোমার বাড়িতে কে কে আছেন?
বললুম—এখন বাড়িতে শুধু মা আর দুটি ছোটো ছোটো ভাই আছে। বাবা এই দু-বৎসর মারা গিয়েছেন।
তিনি একটু যেন আগ্রহের সুরে বললেন—তোমার কোনো বোন নেই?
আমি বললুম—না। আমার দুজন বড়ো বোন ছিলেন, তাঁরা অনেকদিন মারা গিয়েছেন। বড়দি যখন মারা যান তখন আমি খুব ছোটো, মেজদি পাঁচ-ছ বৎসর মারা গিয়েছেন। আমি এই মেজদিকেই জানতুম, তিনি আমায় বড়ো ভালোবাসতেন। তিনি আমার চেয়েও ছয় বৎসরের বড়ো ছিলেন।
তাঁর দৃষ্টি একটু ব্যথা-কাতর হয়ে এল, জিজ্ঞাসা করলেন—তোমার মেজদি থাকলে এখন তাঁর বয়স হত কত?
বললুম—এই ছাব্বিশ বছর।
তিনি একটু মৃদু হাসির সঙ্গে বললেন—তাই বুঝি ভাইটির আমার একজন বোন খুঁজে বেড়ানো হচ্ছে, না?
কী মিষ্টি হাসি! কী মধুর শান্ত ভাব! মাথা নীচু করে প্রণাম করে তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে বললুম—তা হলে ভাইয়ের অধিকার দিলেন তো আপনি?
তিনি শান্ত হাসিমাখা মুখে চুপ করে রইলেন।
আমি বললুম-বউদি, আমি জানতুম আমি পাব। আগ্রহের সঙ্গে খুঁজলে ভগবানও নাকি ধরা দেন, আমি একজন বোন অনায়াসেই পাব। আচ্ছা এখন আসি। আপনি কিন্তু ভুলে যাবেন না বউদি, আপনার যেন দেখা পাই। রবিবার বাদে আমি দু-বেলাই এ রাস্তা দিয়ে যাব।
আমার মাঠের ধারের তালবাগানটার পাখিগুলো রোজই সকাল-বিকাল ডাকে। একটা কী পাখি তার সুর খাদ থেকে ধাপে ধাপে তুলে একেবারে পঞ্চমে চড়িয়ে আনে। মন যেদিন ভারী থাকে সেদিন সে সুরের উদাস মাধুর্য প্রাণের মধ্যে কোনো সাড়া দেয় না।… আজ দেখলুম পাখিটার গানের সুরের স্তরে স্তরে হৃদয়টা কেমন লঘু থেকে লঘুতর হয়ে উঠছে।… মনে হতে লাগল জীবনটা কেবল কতকগুলো স্নিগ্ধ ছায়াশীতল পাখির গানে ভরা অপরাহের সমষ্টি, আর পৃথিবীটা শুধু নীল আকাশের তলায় ইতস্তত বর্ধিত অযত্ন-সম্ভুত তাল-নারিকেল গাছের বন দিয়ে তৈরি—যাদের ঈষৎ কম্পমান দীর্ঘ শ্যামল পত্ৰশীর্ষ অপরাহ্রে অবসন্ন রৌদ্রে চিকচিক করছে।
তার পরদিন বউদিদির সঙ্গে দেখা হল ছুটির পর বিকালবেলা। বউদিদি যেন চাপা হাসির সুরে জিজ্ঞাসা করলেন—এই যে, বিমলের বুঝি আজ খুব সকাল সকাল স্কুলে যাওয়া হয়েছিল!
আমি উত্তর দিলুম—বেশ বউদি, আমি ওবেলা তো ঠিক সময়েই গেলুম— আপনিই ছিলেন না, এখন দোষটা বুঝি আমার ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে, না? আর বউদি, ঘাটে ওবেলা আরও সব মেয়েরা ছিলেন।
বউদিদি হেসে ফেললেন, বললেন—তাই তো! ভাইটির আমার ওবেলা তো বড়ো বিপদ গিয়েছে তা হলে!
আমার একটু লজ্জা হল, ভালো করে জবাব দিতে না-পেরে বললুম—তা নয় বউদি, আমি এখানে অপরিচিত, পাড়ার মধ্যে দিয়ে পথ—পাছে কেউ কিছু মনে করে!
বউদিদির চোখের কৌতুক-দৃষ্টি তখনও যায়নি, তিনি বললেন—আমি ওবেলা ঘাটের জলেই ছিলাম বিমল। তুমি ওই চটকা গাছটার তলায় গিয়ে একবার ঘাটের দিকে চেয়ে দেখলে, আমায় তুমি দেখতে পাওনি।
আমি জিজ্ঞাসা করলুম—বউদি, আপনার বাপেরবাড়ি কোথায়?
বউদিদি উত্তর দিলেন, খোলাপোতা চেনো? সেই খোলাপোতায়।
আমি ইতস্তত করছি দেখে আমায় আর একটু বিশদ সংবাদ দিয়ে বললেন, ওই যে খোলাপোতার রাস! বউদিদির হাসিভরা দৃষ্টি যেন একটু গর্বমিশ্রিত হয়ে উঠল। কিন্তু বলা আবশ্যক যে, খোলাপোতা বলে কোনো গ্রামের নাম এই আমি প্রথম শুনলুম। অথচ বউদির বাপেরবাড়ি, যেখানে এমন রাস হয়, সেই বিশ্ববিশ্রুত খোলাপাতার ভৌগোলিক অবস্থান সম্বন্ধে আমার অজ্ঞতা পাছে তাঁর মনে ব্যথা দেয়, এই ভয়ে বলে ফেললুম—ও! সেই খোলাপোতায়? ওটা কোন জেলায় ভালো…
বউদিদির কাছ থেকে সাহায্য পাবার প্রত্যাশা করেছিলুম কিন্তু দেখলুম তিনি সে বিষয়ে নির্বিকার। তাঁর হাসিভরা সরল মুখখানির দিকে চেয়ে আমার করুণা হল, এ-সমস্ত জটিল ভৌগোলিক তত্বের মীমাংসা নিয়ে তাঁকে পীড়িত করতে আর আমার মন সরল না।
বললুম—আচ্ছা বউদি, আসি তাহলে।
বউদিদি তাড়াতাড়ি ঘড়ার মুখ থেকে কলার পাতে মোড়া কী বার করলেন। সেইটে আমার হাতে দিয়ে বললেন—কাল চাপড়া ষষ্ঠীর জন্যে ক্ষীরের পুতুল তৈরি করেছিলাম, আর গোটাকতক কলার বড়া আছে, বাসায় গিয়ে খেও।
চার-পাঁচ দিন জ্বর ভোগের পর একদিন পথ্য পেয়ে স্কুলে যাচ্ছি, বউদিদির সঙ্গে দেখা। আমায় আসতে দেখে বউদিদি উৎসুক দৃষ্টিতে অনেকদ্দূর থেকে আমার দিকে চেয়েছিলেন। নিকটে যেতে জিজ্ঞাসা করলেন—এ কি বিমল, এমন মুখ শুকনো কেন?
বললুম-জ্বর হয়েছিল বউদিদি।
বউদিদি উদবেগের সুরে বললেন—ও, তাই তুমি চার-পাঁচদিন আসনি বটে। আমি ভাবলাম, বোধ হয় কীসের ছুটি আছে। আহা তাই তো, বড্ড রোগা হয়ে গিয়েছ যে বিমল।
তাঁর চোখের দৃষ্টিতে একটা সত্যিকারের ব্যথামিশ্রিত স্নেহের আত্মপ্রকাশ বেশ বুঝতে পেরে মনের মধ্যে একটা নিবিড় আনন্দ পেলুম। হেসে বললুম—যে দেশ আপনাদের বউদি, একবার অতিথি হলে আপ্যায়নের চোটে একেবারে অস্থির করে তুলবে।
বউদিদি জিজ্ঞাসা করলেন—আচ্ছা বিমল, ওখানে তোমায় বেঁধে দেয় কে?
আমি বললুম—কে আর রাঁধবে, আমি নিজেই।
বউদিদি একটু চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন—আচ্ছা বিমল, এক কাজ করো না কেন?
আমি জিজ্ঞাসা করলুম—কী বউদি?
তিনি বললেন—মাকে এই পুজোর ছুটির পর নিয়ে এসো। এরকমভাবে কী করে বিদেশে কাটাবে বিমল? লক্ষ্মীটি, ছুটির পর মাকে অবিশ্যি করে নিয়ে এসো। এই গাঁয়ের ভেতর অনেক বাড়ি পাওয়া যাবে। আমাদের পাড়াতেই আছে। না হলে অসুখ হলে কে একটু জল দেয়? আচ্ছা হ্যাঁ বিমল, আজ যে পথ্য করলে, কে বেঁধে দিলে?
আমার হাসি পেল, বললুম—কে আবার দেবে বউদি? নিজেই করলুম।
তিনি আমার দিকে যেন কেমনভাবে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলেন। তাঁর সেদিনকার সেই সহানুভূতি-বিগলিত স্নেহমাখানো মাতৃমুখের জলভরা কালো চোখদুটি পরবর্তী জীবনে আমার অনেকদিন পর্যন্ত মনে ছিল।…
সেদিন স্কুল থেকে আসবার সময় দেখি, বউদিদি যেন আমার জন্যেই অপেক্ষা করছেন। আমায় দেখে কলার পাতায় মোড়া কী একটা আমার হাতে দিয়ে বললেন—শরীরটা একটু না–সারলে, রাত্রে গিয়ে রান্না, সে পেরে উঠবে না বিমল। এই খাবার দিলাম, রাত্রে খেও…।
বোধ হয় একটু আগেই তৈরি করে এনেছিলেন, আমি হাতে বেশ গরম পেলুম। বাসায় এসে কলার পাতা খুলে দেখি, খানকতক রুটি, মোহনভোগ, আর মাছের একটা ডালনা মতো।
তার পরদিন ছুটির পর আসবার সময়ও দেখি বউদিদি খাবার হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, আমার হাতে দিয়ে বললেন—বিমল, তুমি তোমার ওখানে দুধ নাও?
আমি বললুম—কেন, তাহলে দুধও খানিকটা করে দেন বুঝি? সত্যি বলছি বউদি, আপনি আমার জন্য অনর্থক এ কষ্ট করবেন না, তা হলে এ রাস্তায় আমি আর আসছি না।
বউদিদির গলা ভারী হয়ে এল, আমার ডান হাতটা আস্তে আস্তে এসে ধরে ফেললেন, বললেন—লক্ষ্মী ভাই, ছিঃ ও-কথা বোলো না। আচ্ছা, আমি যদি তোমার মেজদিই হতাম, তা হলে এ কথা কী আজ আমায় বলতে পারতে? আমার মাথার দিব্যি রইল, এ পথে রোজ যেতেই হবে।
সেই দিন থেকেই বউদিদি রোজ রাত্রের খাবার দেওয়া শুরু করলেন। সাত আট দিন পরে রুটির বদলে কোনোদিন লুচি, কোনোদিন পরোটা দেখা দিতে লাগল। তাঁর সে আগ্রহভরা মুখের দিকে চেয়ে আমি তাঁর সেসব স্নেহের দান ঠিক অস্বীকারও করতে পারতুম না, অথচ এই ভেবে অস্বস্তি বোধ করতুম যে আমার এই নিত্য খাবার জোগাতে না-জানি বউদিদিকে কত অসুবিধাই পোহাতে হচ্ছে। তার পরই আশ্বিন মাসের শেষে পুজোর ছুটি এসে পড়াতে আমি নিষ্কৃতি পেলুম।
সমস্ত পুজোর ছুটিটা কী নিবিড় আনন্দেই কাটল সেবার। আমার আকাশ-বাতাস যেন রাতদিন আফিমের রঙিন ধূমে আচ্ছন্ন থাকত। ভোরবেলা উঠোনের শিউলিগাছের সাদাফুল বিছানো তলাটা দেখলে—হেমন্ত রাত্রির শিশিরে ভেজা ঘাসগুলোর গা যেমন শিউরে আছে, ওইরকম আমার গা শিউরে উঠত…কার ওপর আমার জীবনের সমস্ত ভার অসীম নির্ভরতার সঙ্গে চাপিয়ে দিয়ে আমার মন যেন শরতের জলভরা নামানো হালকা মেঘের মতো একটা সীমাহারা হাওয়ার রাজ্যে ভেসে বেড়াতে লাগল।
ছুটি ফুরিয়ে গেল। প্রথম স্কুল খোলবার দিন পথে তাঁকে দেখলুম না। বিকালে যখন ফিরি, তখন শীতল হাওয়া একটু একটু দিচ্ছে।…পথের ধারের এক জায়গায় খানিকটা মাটি কারা বর্ষাকালে তুলে নিয়েছিল, সেখানটায় এখন বনকচু, কাল কাসুন্দা, ধুতুরা, কুচকাঁটা, ঝুমকো লতার দল পরস্পর জড়াজড়ি করে একটুখানি ছোটো ছোটো ঝোপ মতো তৈরি করেছে…শীতল হেমন্ত অপরাহের ছায়া-সবুজ ঝোপটির ওপর নেমে এসেছে…এমন একটা মিষ্টি নির্মল গন্ধ গাছগুলো থেকে উঠছে, এমন সুন্দর শ্রী হয়েছে ঝোপটির, সমস্ত ঝোপটি যেন বনলক্ষ্মীর শ্যামলা শাড়ির একটা অঞ্চল-প্রান্তের মতো।
তার পরদিন তাঁকে দেখলুম। তিনি আমায় লক্ষ করেননি, আপন-মনে ঘাটের চাতালে উঠতে যাচ্ছিলেন। আমি ডাকলুম-বউদি!…বউদিদি কেমন হঠাৎ চমকে উঠে আমার দিকে ফিরলেন।
—এ কি বিমল! কবে এলে? আজ কী স্কুল খুলল? কীরকম আছ?…সেই পরিচিত প্রিয় কণ্ঠস্বরটি। সেই স্নেহ-ঝরা শান্ত চোখ দুটি! বউদিদি আমার মনে
ছুটির আগে যে স্থান অধিকার করেছিলেন, ছুটির পরের স্থানটা তার চেয়ে আরও ওপরে।… আমি সমস্ত ছুটিটা তাঁকে ভেবেছি, নানামূর্তিতে নানা অবস্থায় তাঁকে কল্পনা করেছি, নানা গুণ তাঁতে আরোপ করেছি, তাঁকে নিয়ে আমার মুগ্ধ মনের মধ্যে অনেক ভাঙা-গড়া করেছি। আমার মনের মন্দিরে আমারই শ্রদ্ধা ভালোবাসায় গড়া তাঁর কল্পনামূর্তিকে অনেক অর্ঘ্যচন্দনে চৰ্চিত করেছি। তাই সেদিন যে বউদিদিকে দেখলুম, তিনি পূজার ছুটির আগেকার সে বউদিদি নন, তিনি আমার সেই নির্মলা, পূহৃদয়া পূণ্যময়ী মানসী প্রতিমা, আমার পার্থিব বউদিদিকে তিনি তাঁর মহিমাখচিত দিব্য বসনের আচ্ছাদনে আবৃত করে রেখেছিলেন, তাঁর স্নেহ করুণার জ্যোতির্বাষ্পে বউদিদির রক্তমাংসের দেহটার একটা আড়াল সৃষ্টি করেছিলেন।
আমার মাথা শ্রদ্ধায় সম্ভমে নত হয়ে পড়ল, আমি তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করলুম। বউদিদি বললেন—এসো এসো ভাই, আর প্রণাম করতে হবে না, আশীর্বাদ করছি এমনিই—রাজা হও। আচ্ছা বিমল, বাড়ি গিয়ে আমার কথা মনে ছিল?
মনে এলেও বাইরে আর বলতে পারলুম না—কে তবে আমার মগ্ন চৈতন্যকে আশ্রয় করে আমার নিত্যসুষুপ্তির মধ্যেও আমার সঙ্গিনী ছিল বউদি?…শুধু একটু হেসে চুপ করে রইলুম। বউদিদি জিজ্ঞাসা করলেন—মা ভালো আছেন?
আমি উত্তর দিলুম—হ্যাঁ বউদি, তিনি ভালো আছেন। তাঁকে আপনার কথা বললুম।
বউদিদি আগ্রহের সুরে বললেন—তিনি কী বললেন?
আমি বললুম—শুনে মার দুই চোখ জলে ভরে এল, বললেন—একবার দেখাবি তাকে বিমল? আমার নলিনীর শোক বোধ হয় তাকে দেখলে অনেকটা নিবারণ হয়।
বউদিদিরও দেখলুম দুই চোখ ছলছল করে এল, আমায় বললেন, হ্যাঁ বিমল, তা মাকে এই মাসে নিয়ে এলে না কেন?
আমি বললুম—সে এখন হয় না বউদি।
বউদিদি একটু ক্ষুব্ধ হলেন, বললেন—বিমল, জানো তো সেবার কীরকম কষ্টটা পেয়েছ! এই বিদেশ বিভুই, মাকে আনলে এই মিথ্যে কষ্টটা তো আর ভোগ করতে হয় না!
আমি উত্তর দিলুম—বউদি, আমি তো আর ভাবিনি যে আমি বিদেশে আছি, যেখানে আমার বউদি রয়েছেন, সে দেশ আমার বিদেশ নয়। মা না-থাকলেও আমার এখানে ভাবনা কীসের বউদি?
বউদিদির চোখে লজ্জা ঘনিয়ে এল, আমার দিকে ভালো করে চাইতে পারলেন, বললেন—হ্যাঁ, আমি তো সবই করছি। আমার কী কিছু করবার জো আছে? কত পরাধীন আমরা তা জানো তো ভাই! ওসব নয়, তুমি এই মাসেই মাকে আনো।
আমি কথাটাকে কোনোরকমে চাপা দিয়ে সেদিন চলে এলুম।
তার পরদিন ছুটির পর বউদিদির সঙ্গে দেখা। অন্যান্য কথাবার্তার পর আসবার সময় তিনি কলারপাতে মোড়া আবার কী একটা বার করলেন। তাঁর হাতে কলারপাত দেখলেই আমার ভয় হয়; আমি শঙ্কিতচিত্তে বলে উঠলুম—ও আবার কী বউদি? আবার সেই…
বউদিদি বাধা দিয়ে বললেন—আমার কি কোনো সাধ নেই বিমল? ভাইফোঁটাটা অমনি অমনি গেল, কিছু কী করতে পারলুম? কলার পাতা মোড়া রহস্যটি আমার হাতে দিয়ে বললেন—এতে একটু মিষ্টিমুখ করো, আর এইটে নাও—একখানা কাপড় কিনে নিও।
কথাটা ভালো করে শেষ না-করেই বউদি আমার হাতে একখানা দশ টাকার নোট দিতে এলেন। আমি চমকে উঠলুম, বললুম—এ কী বউদি, না না, এ কিছুতেই হবে না; খাবার আমি নিচ্ছি, কিন্তু টাকা নিতে পারব না।
আমার কথাটার স্বর বোধ হয় একটু তীব্র হয়ে পড়েছিল, বউদিদি হঠাৎ থতোমতো খেয়ে গেলেন, তাঁর প্রসারিত হাতখানা ভালো করে যেন গুটিয়ে নিতেও সময় পেলেন না, যেন কেমন হয়ে গেলেন। তারপর একটুখানি অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকবার পরই তাঁর টানা কালো চোখদুটি ছাপিয়ে বাঁধ ভাঙা বন্যার স্রোতের মতো জল গড়িয়ে পড়ল; আমার বুকে যেন কীসের খোঁচা বিঁধল।
এই নিতান্ত সরলা মেয়েটির আগ্রহভরা স্নেহ-উপহার রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে তাঁর বুকে যে লজ্জা আর ব্যথার শূল বিদ্ধ করলুম, সে ব্যথার প্রতিঘাত
অদৃশ্যভাবে আমার নিজের বুকে গিয়েও বাজল!
আমি তাড়াতাড়ি দুই হাতে তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে তাঁর হাত থেকে নোটখানা ও খাবার দুই-নিয়ে বললুম—বউদি, ভাই বলে এ অপরাধ এবারটা মাপ করুন আমার। আর কখনো আপনার কথার অবাধ্য হব না।
বউদিদির চোখের জল তখনও থামেনি।
দুই চোখ জলে ভরা সে তরুণী দেবীমূর্তির দিকে ভালো করে চাইতে না-পেরে আমি মাথা নীচু করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রইলুম।
বাড়ি এসে দেখলুম, কলারপাতের মধ্যে কতকগুলো দুগ্ধশুভ্র চন্দ্রপুলি, সুন্দর করে তৈরি। সমস্ত রাত ঘুমের ঘোরে বউদিদির বিষণ্ণ-কাতর দৃষ্টি বারবার চোখের সামনে ভাসতে লাগল।
মাসখানেক কেটে গেল।
প্রায়ই বউদিদির সঙ্গে দেখা হত। এখন আমরা ভাই-বোনের মতো হয়ে উঠেছিলুম, সেই রকমই পরস্পরকে ভাবতুম। একদিন আসছি, ফ্লানেল শার্টের একটা বোতাম আমার ছিল না। বউদি জিজ্ঞাসা করলেন—এ কী, বোতাম কোথায় গেল?
আমি বললুম—সে কোথায় গিয়েছে বউদি, বোতাম পরাতে জানিনে কাজেই ওই অবস্থা।
তার পরদিন দেখলুম, তিনি ছুঁচ-সুতো-বোতাম সমেতই এসেছেন। আমি বললুম—বউদি, এটা ঘাটের পথ, আপনি বোতাম পরাতে পরাতে কেউ যদি দেখে তো কী মনে করবে! আপনি বরং চুঁচটা আমায় দিন, আমি বাড়ি গিয়ে চেষ্টা করব এখন।
বউদিদি হেসে বললেন—তুমি চেষ্টা করে যা করবে তা আমি জানি, নাও সরে এসো এদিকে।
বাধ্য হয়ে সরেই গেলুম। তিনি বেশ নিশ্চিন্তভাবেই বোতাম পরাতে লাগলেন। ভয়টা দেখলুম তাঁর চেয়ে আমারই হল বেশি। ভাবলুম, বউদির তো সে কাণ্ডজ্ঞান নেই, কিন্তু যদি কেউ দেখে তো এর সমস্ত কষ্টটা ওঁকেই ভুগতে হবে।
একদিন বউদিদি জিজ্ঞাসা করলেন—বিমল, গোকুলপিঠে খেয়েছ?
আমার মা খুব ভালো গোকুলপিঠে তৈরি করতেন, কাজেই ও জিনিসটা আমি খুব খেয়েছি। কিন্তু বউদিদিকে একটু আনন্দ দেওয়ার জন্য বললুম—সে কীরকম বউদি?
আর রক্ষা নেই। তার পরদিনই বিকাল বেলা বউদিদি কলার পাতে মোড়া পিঠে নিয়ে হাজির।
আমায় বললেন—তুমি এখানে আমার সামনেই খাও। ঘড়ার জলে হাত ধুয়ে ফেলো এখন।
আমি বললুম—সর্বনাশ বউদি, এই এতগুলো পিঠে খেতে খেতে এ পথে লোক এসে পড়বে, সে হয় না, আমি বাড়ি গিয়েই খাব।
বউদি ছাড়বার পাত্রীই নন, বললেন—না, কেউ আসবে না বিমল। তুমি এখানেই খাও।
খেলুম, পিঠে খুব ভালো হয়নি। আমার মায়ের নিপুণ হাতের তৈরি পিঠের মতো নয়। বোধ হয় নতুন করতে শিখেছেন, ধারগুলো পুড়ে গিয়েছে, আস্বাদও ভালো নয়। বললুম—বাঃ বউদি, বড়ো সুন্দর তো! এ কোথায় তৈরি করতে শিখলেন? আপনার বাপেরবাড়ির দেশে বুঝি?
বউদির মুখে আর হাসি ধরে না। হাসিমুখে বললেন—এ আমি, আমাদের গুরুমা এসেছিলেন, তিনি শহরের মেয়ে, অনেক ভালো খাবার করতে জানেন, তাঁর কাছে শিখে নিয়েছিলাম।
তারপর সারা শীতকাল অন্যান্য পিঠের সঙ্গে গোকুলপিঠের পুনরাবৃত্তি চলল। ওই যে বলেছি, আমার ভালো লেগেছে, আর রক্ষা নেই।
একটা কথা আছে।
কিছুদিন ধরে আমার মনের মধ্যে একটা আগ্রহ একটু একটু করে জমছিল, জীবনটাকে খুব বড়ো করে অনুভব করবার জন্যে। আমার এ কুড়ি-একুশ বছর বয়সে এই ক্ষুদ্র পাড়াগাঁয়ে খাঁচার পাখির মতো আবদ্ধ থাকা ক্রমেই অসহ্য হয়ে উঠছিল। চলেও যেতাম এতদিন। এখানকার একমাত্র বন্ধন হয়েছিলেন বউদিদি। তাঁরই আগ্রহে স্নেহ-যত্নে সে অশান্ত ইচ্ছাটা কিছুদিন চাপা ছিল। এমন সময় মাঘ মাসের শেষের দিকে আমার এক আত্মীয় আমায় লিখলেন যে, তাঁদের কারখানা থেকে কাচের কাজ শেখবার জন্যে ইউরোপ আমেরিকায় ছেলে পাঠানো হবে, অতএব আমি যদি জীবনে কিছু করতে চাই, তবে শীঘ্ৰ যেন মোরাদাবাদ গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। তিনি সেখানকার কাচের কারখানার ম্যানেজার।
পত্র পেয়ে সমস্ত রাত আমার ঘুম হল না। ইউরোপ-আমেরিকা! সে কত ঊর্মি-সংগীত-মুখরিত শ্যামল সমুদ্রতট…কত অকূল সাগরের নীল জলরাশি, দূরে সবুজ বিন্দুর মতো ছোটো ছোটো দ্বীপ, ওই সিসিল! নতুন আকাশ, নতুন অনুভুতি…ডোভারের সাদা খড়ির পাহাড়—প্রশস্ত রাজপথে জনতার দ্রুত পাদচরণ, লাডগেট সার্কাস, টটেনহাম কোর্ট রোডবার্চ-উইলো পপলার মেপলগাছের সে কত শ্যামল পত্রসম্ভার, আমার কল্পলোকের সঙ্গিনী কনককেশিনী কত ক্লারা, কত মেরি, কত ইউজিনী।…
পরদিন সকালে পত্র লিখলুম—আমি খুব শীঘ্রই রওনা হব। স্কুলে সেদিনই নোটিশ দিলুম, পনেরো দিন পরে কাজ ছেড়ে দেব।
মন বড়ো ভালো ছিল না, উপরের পথটা দিয়ে কয়েকদিন গেলুম। দশ-বারো দিন পরে নীচের পথটা দিয়ে যেতে যেতে একদিন বউদিদির সঙ্গে দেখা। বউদিদি একটু অভিমান প্রকাশ করলেন—বিমল, বড়ো গুণের ভাই তো! আজ চার-পাঁচ দিনের মধ্যে বোনটা বাঁচল কী ম’ল তা খোঁজ করলে না?
আমি বললাম—বউদিদি, করলে সেটাই অস্বাভাবিক হত! বোনেরাই ভাইদের জন্যে কেঁদে মরে, ভাইয়েদের দায় পড়েছে বোনেদের ভাবনা ভাবতে। দুনিয়াসুদ্ধ ভাই-বোনেরই এই অবস্থা।
বউদিদি খিলখিল করে হেসে উঠলেন। এই তরুণীর হাসিটি বালিকার মত এমন মিষ্ট নির্মল যে এ শুধু লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতের জ্যোৎস্নার মতো উপভোগ করবার জিনিস, বর্ণনা করবার নয়। বললেন—তা জানি, জানি, নাও, আর গুমোর করতে হবে না, সে গুণ যে তোমাদের আছে তা কী আমরা ভেতরে ভেতরে বুঝি না? কিন্তু বুঝে কী করব, উপায় নেই। হ্যাঁ, তা সত্যি সত্যি মাকে কবে আনছ?
আমার কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা আমি বউদিদিকে কিছু বলিনি। সেকথা বললে যে তিনি মনে অত্যন্ত আঘাত পাবেন, এ আমি বুঝতে পেরেছিলুম। একবার ভাবলুম, সেই তো জানাতেই হবে, একদিন বলে ফেলি। কিন্তু অমন সরল হাসিভরা মুখ, অমন নিশ্চিন্ত শান্তির ভাব—বলতে বড়ো বাধল। মনে মনে বললুম, তোমরা কেবল বুঝি স্নেহ ঢেলে দিতেই জানো? তোমাদের স্নেহ-পাত্রদের বিদায়ের বাজনা যে বেজে উঠেছে এ সম্বন্ধে এ রকম অজ্ঞান কেন?
জিজ্ঞাসা করলুম—বউদি, একটা কথা বলি, আপনি আমায় এই অল্পদিনে এত ভালোবাসলেন কী করে? আচ্ছা আপনারা কী ভালোবাসার পাত্র-পাত্রীও দেখেন না? আমি কে বউদি যে আমার জন্যে এত করেন?
বউদিদির মুখ গম্ভীর হয়ে এল। তাঁর ওই এক বড়ো আশ্চর্য ছিল, মুখ গম্ভীর হলে প্রায়ই চোখে জল আসবে, জল কেটে গেল তো আবার হাসি ফুটবে। শরতের আকাশে রোদ-বৃষ্টি খেলার মতো। বললেন—এতদিন তোমায় বলিনি বিমল, আজ পাঁচ বছর হল আমারও ছোটো ভাই আমার মায়া কাটিয়ে চলে গিয়েছে, তারও নাম ছিল বিমল। থাকলে সে তোমারই মতো হত এতদিন। আর তোমারই মতো দেখতে। তুমি যেদিন প্রথম এ রাস্তা দিয়ে যাও, তোমায় দেখেই আমার মনের মধ্যে সমুদ্র উথলে উঠল, সেদিন বাড়ি গিয়ে আপন মনে কত কেঁদেছিলাম। তুমি এখান দিয়ে যেতে, রোজ তোমাকে দেখতাম। যেদিন তুমি আপনা হতেই দিদি বলে ডাকলে, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত যে কী সুখে আছি তা বলতে পারিনে। তোমায় যত্ন করে, তুমি যে বড়ো বোনের মতো ভালোবাসো, তাতে আমি বিমলের শোক অনেকটা ভুলেছি। ওই এক ভাই ছিল আমার। তুলসীতলায় রোজ সন্ধ্যাবেলা কত প্রণাম করি, বলি, ঠাকুর এক বিমলকে তো পায়ে টেনে নিয়েছ, আর এক বিমলকে যদি দিলে তো এর মঙ্গল করো, একে আমার কাছে রাখো।
চোখের জলে বউদিদির গলা আড়ষ্ট হয়ে গেল। আমি কিছু বললাম না। বলব কী!
একটু পরে বউদিদি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে জলভরা চোখ দুটি তুলে আমার মুখের দিকে চাইলেন। কী সুন্দর তাঁকে দেখাচ্ছিল। কালো চোখ দুটি ছল ছল করছে, টানা ভুরু যেন আরও নেমে এসেছে, চিবুকের ভাঁজটি আরও পরিস্ফুট, যেন কোন নিপুণ প্রতিমাকারক সরু বাঁশের চেঁচাড়ি দিয়ে কেটে তৈরি করেছে।…পথের পাশেই প্রথম ফাল্গুনের মুগ্ধ আকাশের তলায় আঁকোড় ফুলের একটা ঝোপে কাঁটাওয়ালা ডালগুলিতে থোলো থোলো সাদা ফুল ফুটে ছিল…মনের ফাঁকে ফাঁকে নেশা জমিয়ে আনে, এমনি তার মিষ্টি গন্ধ!
দুজনে অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলুম না। খানিক পরে বউদিদি বললেন
সেইজন্যেই বলছি ভাই, মাকে আনো। আমাদের পাড়ায় চৌধুরীদের বাড়িটা পড়ে আছে। ওরা এখানে থাকে না। খুব ভালো বাড়ি, কোনো অসুবিধা হবে না, তুমি মাকে নিয়ে এসো, ওখানেই থাকো, সে তাঁদের পত্র লিখলেই তাঁরা রাজি হবেন, বাড়ি তো এমনি পড়ে আছে। তোমার বোন পরাধীন, কিছু করবার তো ক্ষমতা নেই। তোমার সঙ্গে এসব দেখাশোনা, এসব লুকিয়ে, বাড়ির কেউ জানে না। তুমি দু-বেলা ঘাটের পথ দিয়ে যেও, দেখেই আমি শান্তি পাব ভাই। মাকে এ মাসেই আনো।
কেমন করে তা হবে?
একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলুম—বউদি, আমি এখানে থাকলে কী আপনি খুব সুখী হন?
বউদিদি বললেন—কী বলব বিমল? মাকে আনলে তোমার কষ্টটাও কম হয়, তা বুঝেও আমার সুখ! আর বেশ দুটি ভাই-বোন এক জায়গায় থাকব, বারো মাস দু-বেলা দেখা হবে, কী বলো?
আমি বললুম—ভাই যদি কোনো গুরুতর অপরাধ করে আপনার কাছে, তাকে ক্ষমা করতে পারবেন?
বউদিদি বললেন—শোনো কথার ভঙ্গি ভাইটির আমার, আমার কাছে তোমার আবার অপরাধটা কীসের শুনি?
আমি জোর করে বললুম—না বউদি, ধরুন যদি করি তাহলে?
বউদিদি আবার হেসে বললেন—না না, তা হলেও না। ছোটো ভাইটির কোনো কিছুতেই অপরাধ নেই আমার কাছে, আমি যে বড়ো বোন।
চোখে জল এসে পড়ল। আড়ষ্ট গলায় বললুম-ঠিক বউদি, ঠিক!
বউদি অবাক হয়ে গেলেন, বললেন—বিমল, কী হয়েছে ভাই! অমন করছ কেন?
মুখ ফিরিয়ে আনতে উদ্যত হলুম, বললুম—কিছু না বউদি, অমনি বলছি।
বউদিদি বললেন—তবুও ভালো। ভাইটির আমার এখনও ছেলেমানুষি যায়নি। হ্যাঁ ভালো কথা বিমল, তুমি ভালোবাস বলে বাগানের কলার কাঁদি আজ কাটিয়ে রেখেছি, পাকলে একদিন ভালো করে দেব এখন।
তার পরদিনই আমার নোটিশ অনুসারে স্কুলের কাজের শেষদিন। গিয়ে শুনলাম আমার জায়গায় নতুন লোক নেওয়া ঠিক হয়ে গিয়েছে। স্কুলে সকলের কাছে বিদায় নিয়ে চলে এলুম।
শুধু একবার শেষ দেখা করবার জন্যেই তার পরদিন পুকুরের ঘাটে ঠিক সময়ে গেলুম। তাঁর দেখা পেলে যে কী বলব তা ঠিক করে সেখানে যাইনি, সত্য কথা সব খুলে বলতে বোধ হয় পারতুম সেদিন—কিন্তু দেখা হল না! সব দিন তো দেখা হত না, প্রায়ই দু-তিন দিন অন্তর দেখা হত, আবার কিছুদিন ধরে হয়তো রোজই দেখা হত। সেদিন বিকালে গেলুম, তার পরদিন সকালেও গেলুম, কিন্তু দেখা পেলুম না।
সেদিন চলে আসবার সময় সেখানকার মাটি একটু কাগজে মুড়ে পকেটে নিলুম, যেখানে তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয় হবার দিন তিনি দাঁড়িয়েছিলেন।…
সেইদিনই বিকালে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে চিরদিনের মতো সে গ্রাম পরিত্যাগ করলুম।
মাঠের কোলে ছাতিম গাছের বনের মধ্যে কোথায় ঘুঘু ডাকছিল।–
সেসব আজ পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর আগেকার কথা।
তারপর জীবনে কত ঘটনা ঘটে গেল। ভগবানের কী অসীম করুণার দানই আমাদের এই জীবনটুকু! উপভোগ করে দেখলুম, এ কী মধু! কত নতুন দেশ, নতুন মুখ, কত জ্যোৎস্না-রাত্রি, নতুন নব-ঝোপের নতুন ফুল, কত সুঁইফুলের মতো শুভ্র নির্মল হৃদয়, কান্নাজড়ানো কত সে মধুর স্মৃতি!…
কাকার কাছে মোরাদাবাদে কাচের কারখানায় গেলুম। বছরখানেক পরে তারা আমায় পাঠিয়ে দিলে জার্মানিতে কাচের কাজ শিখতে। তারপর কোলেয়োঁ গেলুম, কাটা বেলোয়ারি কাচের কারখানার কাজ শেখবার জন্যে। কোলেয়োঁ অনেক দিন রইলুম। সেখানে থাকতে একজন আমেরিকান যুবকের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হল, তিনি ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট। শিকাগো ইটার-ওশ্যন কাগজের তিনি ফ্রান্স দেশস্থ সংবাদদাতা। কোলোয়ে সবসময়না-থাকলেও তিনি প্রায়ই ওখানে আসতেন। তাঁরই পরামর্শে তাঁর সঙ্গে আমেরিকায় গেলুম। তাঁর সাহায্যে দু-তিনটে বড়ো বড়ো কাচের কারখানার কাজ দেখবার সুযোগ পেলাম…পিটসবার্গে কর্নেগীর ওখানে প্রায় ছ-মাস রইলুম, নতুন ধরনের ব্লাস্টফার্নেসের কাজ ভালো করে বোঝবার জন্য।…মিডল ওয়েস্টের একটা কাচের কারখানায় প্রভাত দে কী বসু বলে একজন বাঙালি যুবকের সঙ্গে দেখা হল, তাঁরও বাড়ি চব্বিশ পরগনা জেলায়। সে ভদ্রলোক নিঃসম্বলে জাপান থেকে আমেরিকায় গিয়ে মহা হাবুডুবু খাচ্ছিলেন, তাঁরই মুখে শুনলুম, সেয়াটল-এ একটা নতুন কাচের কারখানা খোলা হচ্ছে। আমি জাপান দিয়ে আসব স্থির করেছিলুম, কাজেই আসবার সময় সেয়াটল গেলুম। তারপর জাপান ঘুরে দেশে এলুম।…মা ইতিমধ্যে মারা গিয়েছিলেন। ভাইদুটিকে নিয়ে গেলুম মোরাদাবাদে। বেশিদিন ওখানে থাকতে হল না। বম্বেতে বিয়ে করেছি, আমার শ্বশুর এখানে ডাক্তারি করতেন। সেই থেকে বম্বে অঞ্চলেরই অধিবাসী হয়ে পড়েছি।
বহুদিন বাংলা দেশে যাইনি, প্রায় ষোলো-সতেরো বছর হল। বাংলা দেশের জলমাটি গাছপালার জন্যে মনটা তৃষিত আছে। তাই আজ সন্ধ্যার সময় সমুদ্রের ধারে বসে আমার সবুজ শাড়ি-পরা বাংলা মায়ের কথাই ভাবছিলুম।…রাজাবাই টাওয়ারের মাথার ওপর এখনও একটু একটু রোদ আছে। বন্দরের নীল জলে মেসাজেরি মারিতিমদের একখানা জাহাজ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে, এ-খানা এখুনি ছেড়ে যাবে। বাঁ-ধারে খুব দূরে এলিফ্যান্টার নীল সীমারেখা। ভাবতে ভাবতে প্রথম যৌবনের একটা বিস্মৃতপ্রায় ঝাপসা ছবি বড়ো স্পষ্ট হয়ে মনে এল। পঁচিশ বছর পূর্বের এমনি এক সন্ধ্যায় দূর বাংলা দেশের এক নিভৃত পল্লিগ্রামের জীর্ণ শানবাঁধানো পুকুরের ঘাট বেয়ে উঠেছে আর্দ্রবসনা তরুণী এক পল্লিবধূ!…মাটির পথের বুকে বুকে লক্ষ্মীর চরণচিহ্নের মতো তার জলসিক্ত পা দু খানির রেখা আঁকা…আঁধার সন্ধ্যায় তার পথের ধারের বেণুকুঞ্জে লক্ষ্মীপেঁচা ডাকছে। তার স্নেহভরা পবিত্র বুকখানি বাইরের জগৎ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত অনিশ্চয়তায় ভরা। আম-কাঁটালের বনের মাথার ওপরকার নীলাকাশে দু-একটা নক্ষত্র উঠে সরলা স্নেহ-দুর্বলা বধূটির ওপর সস্নেহ কৃপাদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তারপর এক শান্ত আঙিনায় তুলসী মঞ্চমূলে স্নেহাস্পদের মঙ্গলপ্রার্থিনী সে কোন প্রণাম-নিরতা মাতৃমূর্তি, করুণামাখা অশ্রু ছল ছল।…
ওগো লক্ষ্মী, ওগো স্নেহময়ী পল্লিবধু, তুমি আজও কী আছ? এই সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর পরে আজও তুমি কি সেই পুকুরের ভাঙা ঘাটে সেইরকম জল আনতে যাও? আজ সে কতকালের কথা হল, তারপর জীবনে আবার কত কী দেখলুম, আবার কত কী পেলুম… আজ কতদিন পরে আবার তোমার কথা মনে পড়ল…তোমায় আবার দেখতে বড়ো ইচ্ছে করছে দিদিমণি, তুমি আজও কি আছে? মনে আসছে, অনেক দূরের যেন কোন খড়ের ঘর…মিটমিটে মাটির প্রদীপের আলো…মৌন সন্ধ্যা…নীরব ব্যথার অশ্রু…শান্ত সৌন্দর্য—স্নেহমাখা রাঙা শাড়ির আঁচল।…
আরব সমুদ্রের জলে এমন করুণ সূর্যাস্ত কখনো হয়নি!