চোখের-বালি (21-30)




২১
ইতিমধ্যে আরো এক চিঠি আসিয়া উপস্থিত হইল।-
“তুমি আমার চিঠির উত্তর দিলে না? ভালোই করিয়াছ। ঠিক কথা তো লেখা যায় না; তোমার যা জবাব,
সে আমি মনে মনে বুঝিয়া লইলাম। ভক্ত যখন তাহার দেবতাকে ডাকে, তিনি কি মুখের কথায় তাহার উত্তর
দেন। দুখিনীর বিলবপত্রখানি চরণতলে বোধ করি স্থান পাইয়াছে!
“কিন্তু ভক্তের পূজা লইতে গিয়া শিবের যদি তপোভঙ্গ হয়, তবে তাহাতে রাগ করিয়ো না, হৃদয়দেব! তুমি বর দাও, চোখ মেলিয়া চাও বা না চাও, জানিতে পার বা না পার, পূজা না দিয়া ভক্তের আর গতি নাই। তাই আজিও এই দু-ছত্র চিঠি লিখিলাম–হে আমার পাষাণ-ঠাকুর, তুমি অবিচলিত হইয়া থাকো।”-
মহেন্দ্র আবার চিঠির উত্তর লিখিতে প্রবৃত্ত হইল। কিন্তু আশাকে লিখিতে গিয়া বিনোদিনীর উত্তর কলমের মুখে আপনি আসিয়া পড়ে। ঢাকিয়া লুকাইয়া কৌশল করিয়া লিখিতে পারে না। অনেকগুলি ছিঁড়িয়া রাত্রের অনেক প্রহর কাটাইয়া একটা যদি বা লিখিল, সেটা লেফাফায় পুরিয়া উপরে আশার নাম লিখিবার সময় হঠাৎ তাহার পিঠে যেন কাহার চাবুক পড়িল–কে যেন বলিল,”পাষণ্ড, বিশ্বস্ত বালিকার প্রতি এমনি করিয়া প্রতারণা?” চিঠি মহেন্দ্র সহস্র টুকরা করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিল, এবং বাকি রাতটা টেবিলের উপর দুই হাতের মধ্যে মুখ ঢাকিয়া নিজেকে যেন নিজের দৃষ্টি হইতে লুকাইবার চেষ্টা করিল।


তৃতীয় পত্র–”যে একেবারেই অভিমান করিতে জানে না, সে কি ভালোবাসে। নিজের ভালোবাসাকে যদি অনাদর-অপমান হইতে বাঁচাইয়া রাখিতে না পারি, তবে সে ভালোবাসা তোমাকে দিব কেমন করিয়া।
“তোমার মন হয়তো ঠিক বুঝি নাই, তাই এত সাহস করিয়াছি। তাই যখন ত্যাগ করিয়া গেলে, তখনো নিজে অগ্রসর হইয়া চিঠি লিখিয়াছি; যখন চুপ করিয়া ছিলে, তখনো মনের কথা বলিয়া ফেলিয়াছি। কিন্তু তোমাকে যদি ভুল করিয়া থাকি, সে কি আমারই দোষ। একবার শুরু হইতে শেষ পর্যন্ত সব কথা মনে করিয়া দেখো দেখি, যাহা বুঝিয়াছিলাম, সে কি তুমিই বোঝাও নাই।
“সে যাই হোক, ভুল হোক সত্য হোক, যাহা লিখিয়াছি সে আর মুছিবে না, যাহা দিয়াছি সে আর ফিরাইতে পারিব না, এই আক্ষেপ। ছি ছি, এমন লজ্জাও নারীর ভাগ্যে ঘটে। কিন্তু তাই বলিয়া মনে করিয়ো না, ভালো যে বাসে সে নিজের ভালোবাসাকে বরাবর অপদস্থ করিতে পারে। যদি আমার চিঠি না চাও তো থাক্‌, যদি উত্তর না লিখিবে তবে এই পর্যন্ত–”



ইহার পর মহেন্দ্র আর থাকিতে পারিল না। মনে করিল, “অত্যন্ত রাগ করিয়াই ঘরে ফিরিয়া যাইতেছি।
বিনোদিনী মনে করে, তাহাকে ভুলিবার জন্যই ঘর ছাড়িয়া পালাইয়াছি!” বিনোদিনীর সেই স্পর্ধাকে হাতে হাতে অপ্রমাণ করিবার জন্যই তখনি মহেন্দ্র ঘরে ফিরিবার সংকল্প করিল।
এমন সময় বিহারী ঘরে প্রবেশ করিল। বিহারীকে দেখিবামাত্র মহেন্দ্রের ভিতরের পুলক যেন দ্বিগুণ বাড়িয়া উঠিল। ইতিপূর্বে নানা সন্দেহে ভিতরে ভিতরে বিহারীর প্রতি তাহার ঈর্ষা জন্মিতেছিল, উভয়ের বন্ধুত্ব ক্লিষ্ট হইয়া উঠিতেছিল। পত্রপাঠের পর আজ সমস্ত ঈর্ষাভার বিসর্জন দিয়া বিহারীকে সে অতিরিক্ত আবেগের সহিত আহ্বান করিয়া লইল। চৌকি হইতে উঠিয়া, বিহারীর পিঠে চাপড় মারিয়া, তাহার হাত ধরিয়া, তাহাকে একটা কেদারার উপরে টানিয়া বসাইয়া দিল।



কিন্তু বিহারীর মুখ আজ বিমর্ষ। মহেন্দ্র ভাবিল, বেচারা নিশ্চয় ইতিমধ্যে বিনোদিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়াছে এবং সেখান হইতে ধাক্কা খাইয়া আসিয়াছে। মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “বিহারী, এর মধ্যে আমাদের ওখানে গিয়াছিলে?”
বিহারী গম্ভীরমুখে কহিল, “এখনি সেখান হইতে আসিতেছি।”
মহেন্দ্র বিহারীর বেদনা কল্পনা করিয়া মনে মনে একটু কৌতুকবোধ করিল। মনে মনে কহিল, “হতভাগ্য
বিহারী। স্ত্রীলোকের ভালোবাসা হইতে বেচারা একেবারে বঞ্চিত।” বলিয়া নিজের বুকের পকেটের কাছটায়
এক বার হাত দিয়া চাপ দিল–ভিতর হইতে তিনটে চিঠি খড়খড় করিয়া উঠিল।
মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “সবাইকে কেমন দেখিলে?” বিহারী তাহার উত্তর না করিয়া কহিল, “বাড়ি ছাড়িয়া তুমি যে এখানে?”
মহেন্দ্র কহিল, “আজকাল প্রায় নাইট-ডিউটি পড়ে–বাড়িতে অসুবিধা হয়।”
বিহারী কহিল, “এর আগেও তো নাইট-ডিউটি পড়িয়াছে, কিন্তু তোমাকে তো বাড়ি ছাড়িতে দেখি নাই।”
মহেন্দ্র হাসিয়া কহিল, “মনে কোনো সন্দেহ জন্মিয়াছে না কি।”
বিহারী কহিল, “না, ঠাট্টা নয়, এখনি বাড়ি চলো।”
মহেন্দ্র বাড়ি ফিরিবার জন্য উদ্যত হইয়াই ছিল; বিহারীর অনুরোধ শুনিয়া সে হঠাৎ নিজেকে ভুলাইল, যেন বাড়ি যাইবার জন্য তাহার কিছুমাত্র আগ্রহ নাই। কহিল, “সে কি হয়, বিহারী। তা হলে আমার বৎসরটাই নষ্ট হইবে।”
বিহারী কহিল, “দেখো মহিনদা, তোমাকে আমি এতটুকু বয়স হইতে দেখিতেছি, আমাকে ভুলাইবার চেষ্টা করিয়ো না। তুমি অন্যায় করিতেছ।”
মহেন্দ্র। কার প’রে অন্যায় করিতেছি জজসাহেব!
বিহারী রাগ করিয়া বলিল, “তুমি যে চিরকাল হৃদয়ের বড়াই করিয়া আসিয়াছ, তোমার হৃদয় গেল কোথায় মহিনদা।”
মহেন্দ্র। সম্প্রতি কালেজের হাসপাতালে।
বিহারী। থামো মহিনদা, থামো। তুমি এখানে আমার সঙ্গে হাসিয়া ঠাট্টা করিয়া কথা কহিতেছ, সেখানে আশা তোমার বাহিরের ঘরে, অন্দরের ঘরে কাঁদিয়া কাঁদিয়া বেড়াইতেছে।
আশার কান্নার কথা শুনিয়া হঠাৎ মহেন্দ্রের মন একটা প্রতিঘাত পাইল। জগতে আর যে কাহারো সুখদুঃখ আছে, সে কথা তাহার নূতন নেশার কাছে স্থান পায় নাই। হঠাৎ চমক লাগিল, জিজ্ঞাসা করিল, “আশা কাঁদিতেছে কী জন্য।”



বিহারী বিরক্ত হইয়া কহিল, “সে কথা তুমি জান না, আমি জানি?”
মহেন্দ্র। তোমার মহিনদা সর্বজ্ঞ নয় বলিয়া যদি রাগ করিতেই হয় তো মহিনদার সৃষ্টিকর্তার উপর রাগ করো। তখন বিহারী যাহা দেখিয়াছিল, তাহা আগাগোড়া বলিল। বলিতে বলিতে বিনোদিনীর বক্ষোলগ্ন আশার সেই অশ্রুসিক্ত মুখখানি মনে পড়িয়া বিহারীর প্রায় কণ্ঠরোধ হইয়া আসিল।
বিহারীর এই প্রবল আবেগ দেখিয়া মহেন্দ্র আশ্চর্য হইয়া গেল। মহেন্দ্র জানিত বিহারীর হৃদয়ের বালাই নাই –এ উপসর্গ কবে জুটিল। যেদিন কুমারী আশাকে দেখিতে গিয়াছিল, সেই দিন হইতে নাকি। বেচারা বিহারী। মহেন্দ্র মনে মনে তাহাকে বেচারা বলিল বটে, কিন্তু দুঃখবোধ না করিয়া বরঞ্চ একটু আমোদ পাইল। আশার মনটি একান্তভাবে যে কোন্‌ দিকে, তাহা মহেন্দ্র নিশ্চয় জানিত। “অন্য লোকের কাছে যাহারা বাজ্ঞার ধন, কিন্তু আয়ত্তের অতীত, আমার কাছে তাহারা চিরদিনের জন্য আপনি ধরা দিয়াছে,” ইহাতে মহেন্দ্র বক্ষের মধ্যে একটা গর্বের স্ফীতি অনুভব করিল।



মহেন্দ্র বিহারীকে কহিল, “আচ্ছা চলো, যাওয়া যাক। তবে একটা গাড়ি ডাকো।”





২২
মহেন্দ্র ঘরে ফিরিয়া আসিবামাত্র তাহার মুখ দেখিয়াই আশার মনের সমস্ত সংশয় ক্ষণকালের কুয়াশার মতো এক মুহূর্তেই কাটিয়া গেল। নিজের চিঠির কথা স্মরণ করিয়া লজ্জায় মহেন্দ্রের সামনে সে যেন মুখ তুলিতেই পারিল না। মহেন্দ্র তাহার উপরে ভর্ৎসনা করিয়া কহিল, “এমন অপবাদ দিয়া চিঠিগুলা লিখিলে কী করিয়া।”
বলিয়া পকেট হইতে বহুবার পঠিত সেই চিঠি তিনখানি বাহির করিল। আশা ব্যাকুল হইয়া কহিল, “তোমার পায়ে পড়ি, ও চিঠিগুলো ছিঁড়িয়া ফেলো।” বলিয়া মহেন্দ্রের হাত হইতে চিঠিগুলা লইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িল। মহেন্দ্র তাহাকে নিরস্ত করিয়া সেগুলি পকেটে পুরিল। কহিল, “আমি কর্তব্যের অনুরোধে গেলাম, আর তুমি আমার অভিপ্রায় বুঝিলে না? আমাকে সন্দেহ করিলে?”
আশা ছল-ছল চোখে কহিল, “এবারকার মতো আমাকে মাপ করো। এমন আর কখনোই হইবে না।”
মহেন্দ্র কহিল, “কখনো না?”
আশা কহিল, “কখনো না।”
তখন মহেন্দ্র তাহাকে টানিয়া লইয়া চুম্বন করিল। আশা কহিল, “চিঠিগুলা দাও, ছিঁড়িয়া ফেলি।”
মহেন্দ্র কহিল, “না, ও থাক্‌!”
আশা সবিনয়ে মনে করিল, “আমার শাস্তিস্বরূপ এ চিঠিগুলি উনি রাখিলেন।”
এই চিঠির ব্যাপারে বিনোদিনীর উপর আশার মনটা একটু যেন বাঁকিয়া দাঁড়াইল। স্বামীর আগমনবার্তা লইয়া সে সখীর কাছে আনন্দ করিতে গেল না–বরঞ্চ বিনোদিনীকে একটু যেন এড়াইয়া গেল। বিনোদিনী সেটুকু লক্ষ্য করিল এবং কাজের ছল করিয়া একেবারে দূরে রহিল।



মহেন্দ্র ভাবিল, “এ তো বড়ো অদ্ভুত। আমি ভাবিয়াছিলাম, এবার বিনোদিনীকে বিশেষ করিয়াই দেখা যাইবে–উল্‌টা হইল? তবে সে চিঠিগুলার অর্থ কী।”
নারীহৃদয়ের রহস্য বুঝিবার কোনো চেষ্টা করিবে না বলিয়াই মহেন্দ্র মনকে দৃঢ় করিয়াছিল–ভাবিয়াছিল, বিনোদিনী যদি কাছে আসিবার চেষ্টা করে, তবু আমি দূরে থাকিব।” আজ সে মনে মনে কহিল, “না, এ তো ঠিক হইতেছে না। যেন আমাদের মধ্যে সত্যই কী একটা বিকার ঘটিয়াছে। বিনোদিনীর সঙ্গে সহজ স্বাভাবিক ভাবে কথাবার্তা আমোদপ্রমোদ করিয়া এই সংশয়াচ্ছন্ন গুমোটের ভাবটা দূর করিয়া দেওয়া উচিত।”
আশাকে মহেন্দ্র কহিল, “দেখিতেছি, আমিই তোমার সখীর চোখের বালি হইলাম। আজকাল তাঁহার আর দেখাই পাওয়া যায় না।”



আশা উদাসীন ভাবে উত্তর করিল, “কে জানে, তাহার কী হইয়াছে।”
এ দিকে রাজলক্ষ্মী আসিয়া কাঁদো-কাঁদো হইয়া কহিলেন, “বিপিনের বউকে আর তো ধরিয়া রাখা যায়
না।”
মহেন্দ্র চকিত ভাব সামলাইয়া কহিল, “কেন, মা।”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “কি জানি বাছা, সে তো এবার বাড়ি যাইবার জন্য নিতান্তই ধরিয়া পড়িয়াছে। তুই তো কাহাকেও খাতির করিতে জানিস না। ভদ্রলোকের মেয়ে পরের বাড়িতে আছে, উহাকে আপনার লোকের মতো আদর-যত্ন না করিলে থাকিবে কেন।”
বিনোদিনী শোবার ঘরে বসিয়া বিছানার চাদর সেলাই করিতেছিল। মহেন্দ্র প্রবেশ করিয়া ডাকিল, “বালি।”
বিনোদিনী সংযত হইয়া বসিল। কহিল, “কী, মহেন্দ্রবাবু।”
মহেন্দ্র কহিল, “কী সর্বনাশ। মহেন্দ্র আবার বাবু হইলেন কবে।”
বিনোদিনী আবার চাদর সেলাইয়ের দিকে নতচক্ষু নিবদ্ধ রাখিয়া কহিল, “তবে কী বলিয়া ডাকিব।”
মহেন্দ্র কহিল, “তোমার সখীকে যা বল–চোখের বালি।”
বিনোদিনী অন্যদিনের মতো ঠাট্টা করিয়া তাহার কোনো উত্তর দিল না–সেলাই করিয়া যাইতে লাগিল।
মহেন্দ্র কহিল, “ওটা বুঝি সত্যকার সম্বন্ধ হইল, তাই ওটা আর পাতানো চলিতেছে না!”



বিনোদিনী একটু থামিয়া দাঁত দিয়া সেলাইয়ের প্রান্ত হইতে খানিকটা বাড়তি সুতা কাটিয়া ফেলিয়া কহিল, “কী জানি, সে আপনি জানেন।”
বলিয়াই তাহার সর্বপ্রকার উত্তর চাপা দিয়া গম্ভীরমুখে কহিল, “কালেজ হইতে হঠাৎ ফেরা হইল যে?”
মহেন্দ্র কহিল, “কেবল মড়া কাটিয়া আর কত দিন চলিবে।”
আবার বিনোদিনী দন্ত দিয়া সুতা ছেদন করিল এবং মুখ না তুলিয়াই কহিল, “এখন বুঝি জিয়ন্তের আবশ্যক।”
মহেন্দ্র স্থির করিয়াছিল, আজ বিনোদিনীর সঙ্গে অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিক ভাবে হাস্যপরিহাস উত্তরপ্রত্যুত্তর করিয়া আসর জমাইয়া তুলিবে। কিন্তু এমনি গাম্ভীর্যের ভার তাহার উপর চাপিয়া আসিল যে, লঘু জবাব প্রাণপণ চেষ্টাতেও মুখের কাছে জোগাইল না। বিনোদিনী আজ কেমন একরকম কঠিন দূরত্ব রক্ষা করিয়া চলিতেছে দেখিয়া, মহেন্দ্রের মনটা সবেগে তাহার দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল–ব্যবধানটাকে কোনো একটা নাড়া দিয়া ভূমিসাৎ করিতে ইচ্ছা হইল। বিনোদিনীর শেষ বাক্যঘাতের প্রতিঘাত না দিয়া হঠাৎ তাহার কাছে আসিয়া বসিয়া কহিল, “তুমি আমাদের ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেছে কেন। কোনো অপরাধ করিয়াছি?”
বিনোদিনী তখন একটু সরিয়া সেলাই হইতে মুখ তুলিয়া দুই বিশাল উজ্জ্বল চক্ষু মহেন্দ্রের মুখের উপর স্থির রাখিয়া কহিল, “কর্তব্যকর্ম তো সকলেরই আছে। আপনি যে সকল ছাড়িয়া কালেজের বাসায় যান, সে কি কাহারো অপরাধে। আমারও যাইতে হইবে না? আমারও কর্তব্য নাই?”
মহেন্দ্র ভালো উত্তর অনেক ভাবিয়া খুঁজিয়া পাইল না। কিছুক্ষণ থামিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার এমন কী কর্তব্য যে না গেলেই নয়।”



বিনোদিনী অত্যন্ত সাবধানে সূচিতে সুতা পরাইতে পরাইতে কহিল, “কর্তব্য আছে কি না, সে নিজের মনই জানে। আপনার কাছে তাহার আর কী তালিকা দিব।”
মহেন্দ্র গম্ভীর চিন্তিত মুখে জানালার বাহিরে একটা সুদূর নারিকেলগাছের মাথার দিকে চাহিয়া অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। বিনোদিনী নিঃশব্দে সেলাই করিয়া যাইতে লাগিল। ঘরে ছুঁচটি পড়িলে শব্দ শোনা যায়, এমনি হইল। অনেকক্ষণ পরে মহেন্দ্র হঠাৎ কথা কহিল। অকসমাৎ নিঃশব্দতাভঙ্গে বিনোদিনী চমকিয়া উঠিল–তাহার হাতে ছুঁচ ফুটিয়া গেল।
মহেন্দ্র কহিল, “তোমাকে কোনো অনুনয়-বিনয়েই রাখা যাইবে না?”
বিনোদিনী তাহার আহত অঙ্গুলি হইতে রক্তবিন্দু শুষিয়া লইয়া কহিল, “কিসের জন্য এত অনুনয়-বিনয়। আমি থাকিলেই কী, আর না থাকিলেই কী। আপনার তাহাতে কী আসে যায়।”
বলিতে বলিতে গলাটা যেন ভারি হইয়া আসিল; বিনোদিনী অত্যন্ত মাথা নিচুকরিয়া সেলাইয়ের প্রতি একান্ত মনোনিবেশ করিল–মনে হইল, হয়তো বা তাহার নতনেত্রের পল্লবপ্রান্তে একটুখানি জলের রেখা দেখা দিয়াছে। মাঘের অপরাহ্ন তখন সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলাইবার উপক্রম করিতেছিল।



মহেন্দ্র মুহূর্তের মধ্যে বিনোদিনীর হাত চাপিয়া ধরিয়া রুদ্ধ সজলস্বরে কহিল, “যদি তাহাতে আমার আসে যায়, তবে তুমি থাকিবে?”
বিনোদিনী তাড়াতাড়ি হাত ছাড়াইয়া লইয়া সরিয়া বসিল। মহেন্দ্রের চমক ভাঙিয়া গেল। নিজের শেষ কথাটা ভীষণ ব্যঙ্গের মতো তাহার নিজের কানে বারংবার প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। অপরাধী জিহ্বাকে মহেন্দ্র দন্ত দ্বারা দংশন করিল–তাহার পর হইতে রসনা নির্বাক হইয়া রহিল।
এমন সময় এই নৈঃশব্দ্যপরিপূর্ণ ঘরের মধ্যে আশা প্রবেশ করিল। বিনোদিনী তৎক্ষণাৎ যেন পূর্বকেথোপকথনের অনুবৃত্তিস্বরূপে হাসিয়া মহেন্দ্রকে বলিয়া উঠিল, “আমার গুমর তোমরা যখন এত বাড়াইলে, তখন আমারও কর্তব্য, তোমাদের একটা কথা রাখা। যতক্ষণ না বিদায় দিবে ততক্ষণ রহিলাম।”
আশা স্বামীর কৃতকার্যতায় উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়া সখীকে আলিঙ্গন করিয়া ধরিল। কহিল, “তবে এই কথা রহিল। তাহা হইলে তিন-সত্য করো, যতক্ষণ না বিদায় দিব ততক্ষণ থাকিবে, থাকিবে, থাকিবে।”
বিনোদিনী তিন বার স্বীকার করিল। আশা কহিল, “ভাই চোখের বালি, সেই যদি রহিলেই তবে এত করিয়া সাধাইলে কেন। শেষকালে আমার স্বামীর কাছে তো হার মানিতে হইল।”
বিনোদিনী হাসিয়া কহিল, “ঠাকুরপো, আমি হার মানিয়াছি, না তোমাকে হার মানাইয়াছি?”
মহেন্দ্র এতক্ষণ স্তম্ভিত হইয়া ছিল; মনে হইতেছিল, তাহার অপরাধে যেন সমস্ত ঘর ভরিয়া রহিয়াছে, লাঞ্ছনা যেন তাহার সর্বাঙ্গ পরিবেষ্টন করিয়া। আশার সঙ্গে কেমন করিয়া সে প্রসন্নমুখে স্বাভাবিকভাবে কথা কহিবে। এক মুহূর্তের মধ্যে কেমন করিয়া সে আপনার বীভৎস অসংযমকে সহাস্য চটুলতায় পরিণত করিবে। এই পৈশাচিক ইন্দ্রজাল তাহার আয়ত্তের বহির্ভূত ছিল। সে গম্ভীরমুখে কহিল, “আমারই তো হার হইয়াছে।” বলিয়াই ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।



অনতিকাল পরেই আবার মহেন্দ্র ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া বিনোদিনীকে কহিল, “আমাকে মাপ করো।”
বিনোদিনী কহিল, “অপরাধ কী করিয়াছ, ঠাকুরপো।”
মহেন্দ্র কহিল, “তোমাকে জোর করিয়া এখানে ধরিয়া রাখিবার অধিকার আমাদের নাই।”
বিনোদিনী হাসিয়া কহিল, “জোর কই করিলে, তাহা তো দেখিলাম না। ভালোবাসিয়া ভালো মুখেই তো থাকিতে বলিলে। তাহাকে কি জোর বলে। বলো তো ভাই, চোখের বালি, গায়ের জোর আর ভালোবাসা কি একই হইল।”
আশা তাহার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হইয়া কহিল, “কখনোই না।”
বিনোদিনী কহিল, “ঠাকুরপো, তোমার ইচ্ছা আমি থাকি, আমি গেলে তোমার কষ্ট হইবে, সে তো আমার সৌভাগ্য। কী বল ভাই চোখের বালি, সংসারে এমন সুহৃদ কয় জন পাওয়া যায়। তেমন ব্যথার ব্যথী, সুখের সুখী, অদৃষ্টগুণে যদিই পাওয়া যায়, তবে আমিই বা তাহাকে ছাড়িয়া যাইবার জন্য ব্যস্ত হইব কেন।”
আশা তাহার স্বামীকে অপদস্থভাবে নিরুত্তর থাকিতে দেখিয়া ঈষৎ ব্যথিতচিত্তে কহিল, “তোমার সঙ্গে কথায় কে পারিবে ভাই। আমার স্বামী তো হার মানিয়াছেন, এখন তুমি একটু থামো।”
মহেন্দ্র আবার দ্রুত ঘর হইতে বাহির হইল। তখন রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করিয়া বিহারী মহেন্দ্রের সন্ধানে আসিতেছিল। মহেন্দ্র তাহাকে দ্বারের সম্মুখে দেখিতে পাইয়াই বলিয়া উঠিল, “ভাই বিহারী, আমার মতো পাষণ্ড আর জগতে নাই।” এমন বেগে কহিল, সে কথা ঘরের মধ্যে গিয়া পৌঁছিল।



ঘরের মধ্য হইতে তৎক্ষণাৎ আহ্বান আসিল, “বিহারী-ঠাকুরপো।”
বিহারী কহিল, “একটু বাদে আসছি, বিনোদ-বোঠান।” বিনোদিনী কহিল, “একবার শুনেই যাও না।” বিহারী ঘরে ঢুকিয়াই মুহূর্তের মধ্যে একবার আশার দিকে চাহিল–ঘোমটার মধ্য হইতে আশার মুখ যতটুকু দেখিতে পাইল, সেখানে বিষাদ বা বেদনার কোনো চিহ্নই তো দেখা গেল না। আশা উঠিয়া যাইবার চেষ্টা করিল, বিনোদিনী তাহাকে জোর করিয়া ধরিয়া রাখিল–কহিল, “আচ্ছা, বিহারী-ঠাকুরপো, আমার চোখের বালির সঙ্গে কি তোমার সতিন-সম্পর্ক। তোমাকে দেখলেই ও পালাতে চায় কেন।”
আশা অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া বিনোদিনীকে তাড়না করিল।
বিহারী হাসিয়া উত্তর করিল, “বিধাতা আমাকে তেমন সুদৃশ্য করিয়া গড়েন নাই বলিয়া।” বিনোদিনী। দেখছিস ভাই বালি, বিহারী-ঠাকুরপো বাঁচাইয়া কথা বলিতে জানেন–তোর রুচিকে দোষ না দিয়া বিধাতাকেই দোষ দিলেন। লক্ষ্মণটির মতোএমন সুলক্ষণ দেবর পাইয়াও তাহাকে আদর করিতে শিখিলি না–তোরই কপাল মন্দ।
বিহারী। তোমার যদি তাহাতে দয়া হয় বিনোদ-বোঠান, তবে আর আমার আক্ষেপ কিসের।
বিনোদিনী। সমুদ্র তো পড়িয়া আছে, তবু মেঘের ধারা নইলে চাতকের তৃষ্ণা মেটে না কেন। আশাকে ধরিয়া রাখা গেল না। সে জোর করিয়া বিনোদিনীর হাত ছাড়াইয়া বাহির হইয়া গেল। বিহারীও চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছিল। বিনোদিনী কহিল, “ঠাকুরপো, মহেন্দ্রবাবুর কী হইয়াছে, বলিতে পার?”
শুনিয়াই বিহারী থমকিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইল। কহিল, “তাহা তো জানি না। কিছু হইয়াছে নাকি।”
বিনোদিনী। কী জানি ঠাকুরপো, আমার তো ভালো বোধ হয় না।
বিহারী উদ্‌বিগ্ন মুখে চৌকির উপর বসিয়া পড়িল। কথাটা খোলসা শুনিবে বলিয়া বিনোদিনীর মুখের দিকে ব্যগ্রভাবে চাহিয়া অপেক্ষা করিয়া রহিল। বিনোদিনী কোনো কথা না বলিয়া মনোযোগ দিয়া চাদর সেলাই করিতে লাগিল।
কিছুক্ষণ প্রতীক্ষা করিয়া বিহারী কহিল, “মহিনদার সম্বন্ধে তুমি কি বিশেষ কিছু লক্ষ্য করিয়াছ।”
বিনোদিনী অত্যন্ত সাধারণভাবে কহিল, “কী জানি ঠাকুরপো, আমার তো ভালো বোধ হয় না। আমার
চোখের বালির জন্যে আমার কেবলই ভাবনা হয়।” বলিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সেলাই রাখিয়া উঠিয়া যাইতে উদ্যত হইল।
বিহারী ব্যস্ত হইয়া কহিল, “বোঠান, একটু বোসো।” বলিয়া একটা চৌকিতে বসিল।
বিনোদিনী ঘরের সমস্ত জানালা-দরজা সম্পূর্ণ খুলিয়া দিয়া কেরোসিনের বাতি উস্‌কাইয়া সেলাই টানিয়া
লইয়া বিছানার দূরপ্রান্তে গিয়া বসিল। কহিল, “ঠাকুরপো, আমি তো চিরদিন এখানে থাকিব না–কিন্তু আমি চলিয়া গেলে আমার চোখের বালির উপর একটু দৃষ্টি রাখিয়ো–সে যেন অসুখী না হয়।” বলিয়া যেন হৃদয়োচ্ছ্বাস সংবরণ করিয়া লইবার জন্য বিনোদিনী অন্য দিকে মুখ ফিরাইল।
বিহারী বলিয়া উঠিল, “বোঠান, তোমাকে থাকিতেই হইবে। তোমার নিজের বলিতে কেহ নাই–এই সরলা মেয়েটিকে সুখে দুঃখে রক্ষা করিবার ভার তুমি লও–তুমি তাহাকে ফেলিয়া গেলে আমি তো আর উপায় দেখি না।”
বিনোদিনী। ঠাকুরপো, তুমি তো সংসারের গতিক জান। এখানে বরাবর থাকিব কেমন করিয়া। লোকে কী বলিবে।
বিহারী। লোকে যা বলে বলুক, তুমি কান দিয়ো না। তুমি দেবী–অসহায়া বালিকাকে সংসারের নিষ্ঠুর আঘাত হইতে রক্ষা করা তোমারই উপযুক্ত কাজ। বোঠান, আমি তোমাকে প্রথমে চিনি নাই, সেজন্য আমাকে ক্ষমা করো। আমিও সংকীর্ণ-হৃদয় সাধারণ ইতরলোকদের মতো মনে মনে তোমার সম্বন্ধে অন্যায় ধারণা স্থান দিয়াছিলাম; একবার এমনও মনে হইয়াছিল, যেন আশার সুখে তুমি ঈর্ষা করিতেছ–যেন–কিন্তু সে-সব কথা মুখে উচ্চারণ করিতেও পাপ আছে। তার পরে, তোমার দেবীহৃদয়ের পরিচয় আমি পাইয়াছি–তোমার উপর আমার গভীর ভক্তি জন্মিয়াছে বলিয়াই, আজ তোমার কাছে আমার সমস্ত অপরাধ স্বীকার না করিয়া থাকিতে পারিলাম না।
বিনোদিনীর সর্বশরীর পুলকিত হইয়া উঠিল। যদিও সে ছলনা করিতেছিল, তবু বিহারীর এই ভক্তিউপহার সে মনে মনেও মিথ্যা বলিয়া প্রত্যাখ্যান করিতে পারিল না। এমন জিনিস সে কখনো কাহারো কাছ হইতে পায় নাই। ক্ষণকালের জন্য মনে হইল, সে যেন যথার্থই পবিত্র উন্নত–আশার প্রতি একটা অনির্দেশ্য দয়ায় তাহার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। সেই অশ্রুপাত সে বিহারীর কাছে গোপন করিল না, এবং সেই অশ্রুধারা বিনোদিনীর নিজের কাছে নিজেকে পূজনীয়া বলিয়া মোহ উৎপাদন করিল।
বিহারী বিনোদিনীকে অশ্রু ফেলিতে দেখিয়া নিজের অশ্রুবেগ সংবরণ করিয়া উঠিয়া বাহিরে মহেন্দ্রের ঘরে গেল। মহেন্দ্র যে হঠাৎ নিজেকে পাষণ্ড বলিয়া কেন ঘোষণা করিল, বিহারী তাহার কোনো তাৎপর্য খুঁজিয়া পাইল না। ঘরে গিয়া দেখিল, মহেন্দ্র নাই। খবর পাইল, মহেন্দ্র বেড়াইতে বাহির হইয়াছে। পূর্বে মহেন্দ্র অকারণে কখনোই ঘর ছাড়িয়া বাহির হইত না। সুপরিচিত লোকের এবং সুপরিচিত ঘরের বাহিরে মহেন্দ্রের অত্যন্ত ক্লান্তি ও পীড়া বোধ হইত। বিহারী ভাবিতে ভাবিতে ধীরে ধীরে বাড়ি চলিয়া গেল।
বিনোদিনী আশাকে নিজের শয়নঘরে আনিয়া বুকের কাছে টানিয়া দুই চক্ষু জলে ভরিয়া কহিল, “ভাই চোখের বালি, আমি বড়ো হতভাগিনী, আমি বড়ো অলক্ষণা।”
আশা ব্যথিত হইয়া তাহাকে বাহুপাশে বেষ্টন করিয়া স্নেহার্দ্রকণ্ঠে বলিল, “কেন ভাই, অমন কথা কেন বলিতেছ।”
বিনোদিনী রোদনোচ্ছ্বসিত শিশুর মতো আশার বক্ষে মুখ রাখিয়া কহিল, “আমি যেখানে থাকিব, সেখানে কেবল মন্দই হইবে। দে ভাই, আমাকে ছাড়িয়া দে, আমি আমার জঙ্গলের মধ্যে চলিয়া যাই।”
আশা চিবুকে হাত দিয়া বিনোদিনীর মুখ তুলিয়া ধরিয়া কহিল, “লক্ষ্মীটি ভাই, অমন কথা বলিস নে-তোকে ছাড়িয়া আমি থাকিতে পারিব না–আমাকে ছাড়িয়া যাইবার কথা কেন আজ তোর মনে আসিল।”
মহেন্দ্রের দেখা না পাইয়া বিহারী কোনো একটা ছুতায় পুনর্বার বিনোদিনীর ঘরে আসিয়া মহেন্দ্র ও আশার মধ্যবর্তী আশঙ্কার কথাটা আর-একটু স্পষ্ট করিয়া শুনিবার জন্য উপস্থিত হইল।
মহেন্দ্রকে পরদিন সকালে তাহাদের বাড়ি খাইতে যাইতে বলিবার জন্য বিনোদিনীকে অনুরোধ করিবার উপলক্ষ লইয়া সে উপস্থিত হইল। “বিনোদ-বোঠান” বলিয়া ডাকিয়াই হঠাৎ কেরোসিনের উজ্জ্বল আলোকে বাহির হইতেই আলিঙ্গনবদ্ধ সাশ্রুনেত্র দুই সখীকে দেখিয়াই থমকিয়া দাঁড়াইল। আশার হঠাৎ মনে হইল, নিশ্চয়ই বিহারী তাহার চোখের বালিকে কোনো অন্যায় নিন্দা করিয়া কিছু বলিয়াছে, তাই সে আজ এমন করিয়া চলিয়া যাইবার কথা তুলিয়াছে। বিহারীবাবুর ভারি অন্যায়। উহার মন ভালো নয়। আশা বিরক্ত হইয়া বাহির হইয়া আসিল। বিহারীও বিনোদিনীর প্রতি ভক্তির মাত্রা চড়াইয়া বিগলিতহৃদয়ে দ্রুত প্রস্থান করিল।
সেদিন রাত্রে মহেন্দ্র আশাকে কহিল, “চুনি, আমি কাল সকালের প্যাসেজ্ঞারেই কাশী চলিয়া যাইব।”
আশার বক্ষঃস্থল ধক্‌ করিয়া উঠিল-কহিল, “কেন।”
মহেন্দ্র কহিল, “কাকীমাকে অনেক দিন দেখি নাই।”
শুনিয়া আশা বড়োই লজ্জাবোধ করিল; এ কথা পূর্বেই তাহার মনে উদয় হওয়া উচিত ছিল; নিজের
সুখদুঃখের আকর্ষণে স্নেহময়ী মাসিমাকে সে যে ভুলিয়াছিল, অথচ মহেন্দ্র সেই প্রবাসী-তপস্বিনীকে মনে করিয়াছে, ইহাতে নিজেকে কঠিনহৃদয়া বলিয়া বড়োই ধিক্‌কার জন্মিল।
মহেন্দ্র কহিল, “তিনি আমারই হাতে তাঁহার সংসারের একমাত্র স্নেহের ধনকে সমর্পণ করিয়া দিয়া চলিয়া গেছেন–তাঁহাকে একবার না দেখিয়া আমি কিছুতেই সুস্থির হইতে পারিতেছি না।”
বলিতে বলিতে মহেন্দ্রের কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হইয়া আসিল; স্নেহপূর্ণ নীরব আশীর্বাদও অব্যক্ত মঙ্গলকামনার সহিত বারংবার সে আশার ললাট ও মস্তকের উপর দক্ষিণ করতল চালনা করিতে লাগিল। আশা এই অকসমাৎ স্নেহাবেগের সম্পূর্ণ মর্ম বুঝিতে পারিল না, কেবল তাহার হৃদয় বিগলিত হইয়া অশ্রু পড়িতে লাগিল। আজই সন্ধ্যাবেলায় বিনোদিনী তাহাকে অকারণ স্নেহাতিশয্যে যে-সব কথা বলিয়াছিল, তাহা মনে পড়িল। উভয়ের মধ্যে কোথাও কোনো যোগ আছে কি না, তাহা সে কিছুই বুঝিল না। কিন্তু মনে হইল, যেন ইহা তাহার জীবনে কিসের একটা সূচনা। ভালো কি মন্দ কে জানে।
ভয়ব্যাকুলচিত্তে সে মহেন্দ্রকে বাহুপাশ বদ্ধ করিল। মহেন্দ্র তাহার সেই অকারণ আশঙ্কার আবেশ অনুভব করিতে পারিল। কহিল, “চুনি, তোমার উপর তোমার পুণ্যবতী মাসিমার আশীর্বাদ আছে, তোমার কোনো ভয় নাই, কোনো ভয় নাই। তিনি তোমারই মঙ্গলের জন্য তাঁহার সমস্ত ত্যাগ করিয়া গেছেন, তোমার কখনো কোনো অকল্যাণ হইতে পারে না।”
আশা তখন দৃঢ়চিত্তে সমস্ত ভয় দূর করিয়া ফেলিল। স্বামীর এই আশীর্বাদ অক্ষয়কবচের মতো গ্রহণ করিল। সে মনে মনে বারংবার তাহার মাসিমার পবিত্র পদধূলি মাথায় তুলিয়া লইতে লাগিল, এবং একাগ্রমনে কহিল, “মা, তোমার আশীর্বাদ আমার স্বামীকে সর্বদা রক্ষা করুক!”
পরদিনে মহেন্দ্র চলিয়া গেল, বিনোদিনীকে কিছুই বলিয়া গেল না। বিনোদিনী মনে মনে কহিল, “নিজে অন্যায় করা হইল, আবার আমার উপরে রাগ! এমন সাধু তো দেখি নাই। কিন্তু এমন সাধুত্ব বেশিদিন টেঁকে না।”





২৩
সংসারত্যাগিনী অন্নপূর্ণা বহুদিন পরে হঠাৎ মহেন্দ্রকে আসিতে দেখিয়া যেমন স্নেহে আনন্দে আপ্লুত হইয়া গেলেন, তেমনি তাঁহার হঠাৎ ভয় হইল, বুঝি আশাকে লইয়া মার সঙ্গে মহেন্দ্রের আবার কোনো বিরোধ ঘটিয়াছে এবং মহেন্দ্র তাঁহার কাছে নালিশ জানাইয়া সান্ত্বনালাভ করিতে আসিয়াছে। মহেন্দ্র শিশুকাল হইতেই সকলপ্রকার সংকট ও সন্তাপের সময় তাহার কাকীর কাছে ছুটিয়া আসে। কাহারো উপর রাগ করিলে অন্নপূর্ণা তাহার রাগ থামাইয়া দিয়াছেন, দুঃখবোধ করিলে তাহা সহজে সহ্য করিতে উপদেশ দিয়াছেন। কিন্তু বিবাহের পর হইতে মহেন্দ্রের জীবনে সর্বাপেক্ষা যে সংকটের কারণ ঘটিয়াছে, তাহার প্রতিকারচেষ্টা দূরে থাক্‌, কোনোপ্রকার সান্ত্বনা পর্যন্ত তিনি দিতে অক্ষম। সে সম্বন্ধে যেভাবে যেমন করিয়াই তিনি হস্তক্ষেপ করিবেন,তাহাতেই মহেন্দ্রের সাংসারিক বিপ্লব আরো দ্বিগুণ বাড়িয়া উঠিবে ইহাই যখন নিশ্চয় বুঝিলেন, তখনই তিনি সংসার ত্যাগ করিলেন। রুগ্‌ণ শিশু যখন জল চাহিয়া কাঁদে, এবং জল দেওয়া যখন কবিরাজের নিতান্ত নিষেধ, তখন পীড়িতচিত্তে মা যেমন অন্য ঘরে চলিয়া যান, অন্নপূর্ণা তেমনি করিয়া নিজেকে প্রবাসে লইয়া গেছেন। দূর তীর্থবাসে থাকিয়া ধর্মকর্মের নিয়মিত অনুষ্ঠানে এ কয়দিন সংসার অনেকটা ভুলিয়াছিলেন, মহেন্দ্র আবার কি সেই-সকল বিরোধের কথা তুলিয়া তাঁহার প্রচ্ছন্ন ক্ষতে আঘাত করিতে আসিয়াছে।
কিন্তু মহেন্দ্র আশাকে লইয়া তাহার মার সম্বন্ধে কোনো নালিশের কথা তুলিল না। তখন অন্নপূর্ণার আশঙ্কা অন্য পথে গেল। যে মহেন্দ্র আশাকে ছাড়িয়া কালেজে যাইতে পারিত না, সে আজ কাকীর খোঁজ লইতে কাশী আসে কেন। তবে কি আশার প্রতি মহেন্দ্রর টান ক্রমে ঢিলা হইয়া আসিতেছে। মহেন্দ্রকে তিনি কিছু আশঙ্কার সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, “হাঁ রে মহিন, আমার মাথা খা, ঠিক করিয়া বল্‌ দেখি, চুনি কেমন আছে।”
মহেন্দ্র কহিল, “সে তো বেশ ভালো আছে কাকীমা।”
“আজকাল সে কী করে, মহিন। তোরা কি এখনো তেমনি ছেলেমানুষ আছিস, না কাজকর্মে ঘরকন্নায় মন দিয়াছিস?”
মহেন্দ্র কহিল, “ছেলেমানুষি একেবারেই বন্ধ। সকল ঝঞ্ঝাটের মূল সেই চারুপাঠখানা যে কোথায় অদৃশ্য হইয়াছে, তাহার আর সন্ধান পাইবার জো নাই। তুমি থাকিলে দেখিয়া খুশি হইতে–লেখাপড়া শেখায় অবহেলা করা স্ত্রীলোকের পক্ষে যতদূর কর্তব্য, চুনি তাহা একান্ত মনে পালন করিতেছে।”
“মহিন, বিহারী কী করিতেছে।”
মহেন্দ্র কহিল, “নিজের কাজ ছাড়া আর-সমস্তই করিতেছে। নায়েব-গোমস্তায় তাহার বিষয়সম্পত্তি দেখে; কী চক্ষে দেখে, তাহা ঠিক বলিতে পারি না। বিহারীর চিরকাল ঐ দশা। তাহার নিজের কাজ পরে দেখে, পরের কাজ সে নিজে দেখে।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “সে কি বিবাহ করিবে না, মহিন।”
মহেন্দ্র একটুখানি হাসিয়া কহিল, “কই, কিছুমাত্র উদ্‌যোগ তো দেখি না।”
শুনিয়া অন্নপূর্ণা হৃদয়ের গোপন স্থানে একটা আঘাত পাইলেন। তিনি নিশ্চয় বুঝিতে পারিয়াছিলেন, তাঁহার বোনঝিকে দেখিয়া, একবার বিহারী আগ্রহের সহিত বিবাহ করিতে উদ্যত হইয়াছিল, তাহার সেই উন্মুখ আগ্রহ অন্যায় করিয়া অকসমাৎ দলিত হইয়াছে। বিহারী বলিয়াছিল, “কাকীমা, আমাকে আর বিবাহ করিতে কখনো অনুরোধ করিয়ো না।” সেই বড়ো অভিমানের কথা অন্নপূর্ণার কানে বাজিতেছিল। তাঁহার একান্ত অনুগত সেই স্নেহের বিহারীকে তিনি এমন মনভাঙা অবস্থায় ফেলিয়া আসিয়াছিলেন, তাহাকে কোনো সান্ত্বনা দিতে পারেন নাই। অন্নপূর্ণা অত্যন্ত বিমর্ষ ও ভীত হইয়া ভাবিতে লাগিলেন, “এখনো কি আশায় প্রতি বিহারীর মন পড়িয়া আছে।”



মহেন্দ্র কখনো ঠাট্টার ছলে, কখনো গম্ভীরভাবে, তাহাদের ঘরকন্নার আধুনিক সমস্ত খবর-বার্তা জানাইল, বিনোদিনীর কথার উল্লেখমাত্র করিল না।
এখন কালেজ খোলা, কাশীতে মহেন্দ্রের বেশি দিন থাকিবার কথা নয়। কিন্তু কঠিন রোগের পর স্বাসথ্যকর আবহাওয়ার মধ্যে গিয়া আরোগ্যলাভের যে সুখ, মহেন্দ্র কাশীতে অন্নপূর্ণার নিকটে থাকিয়া প্রতিদিন সেই সুখ অনুভব করিতেছিল–তাই একে একে দিন কাটিয়া যাইতে লাগিল। নিজের সঙ্গে নিজের যে একটা বিরোধ জন্মিবার উপক্রম হইয়াছিল, সেটা দেখিতে দেখিতে দূর হইয়া গেল। কয়দিন সর্বদা ধর্মপরায়ণা অন্নপূর্ণার স্নেহমুখচ্ছবির সম্মুখে থাকিয়া, সংসারের কর্তব্যপালন এমনি সহজ ও সুখকর মনে হইতে লাগিল যে, তাহার পূর্বেকার আতঙ্ক হাস্যকর বোধ হইল। মনে হইল, বিনোদিনী কিছুই না। এমন কি, তাহার মুখের চেহারাই মহেন্দ্র স্পষ্ট করিয়া মনে আনিতে পারে না। অবশেষে মহেন্দ্র খুব জোর করিয়াই মনে মনে কহিল, “আশাকে আমার হৃদয় হইতে এক চুল সরাইয়া বসিতে পারে, এমন তো আমি কোথাও কাহাকেও দেখিতে পাই না।”



মহেন্দ্র অন্নপূর্ণাকে কহিল, “কাকীমা, আমার কালেজ কামাই যাইতেছে–এবারকার মতো তবে আসি। যদিও তুমি সংসারের মায়া কাটাইয়া একান্তে আসিয়া আছ–তবু অনুমতি করো মাঝে মাঝে আসিয়া তোমার পায়ের ধূলা লইয়া যাইব।”
মহেন্দ্র গৃহে ফিরিয়া আসিয়া যখন আশাকে তাহার মাসির স্নেহোপহার সিঁদুরের কৌটা ও একটি সাদা পাথরের চুমকি ঘটি দিল, তখন তাহার চোখ দিয়া ঝরঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল। মাসিমার সেই পরমস্নেহময় ধৈর্য ও মাসিমার প্রতি তাহাদের ও তাহার শাশুড়ির নানাপ্রকার উপদ্রব স্মরণ করিয়া তাহার হৃদয় ব্যাকুল হইয়া উঠিল। স্বামীকে জানাইল, “আমার বড়ো ইচ্ছা করে, আমি একবার মাসিমার কাছে গিয়া তাঁহার ক্ষমা ও পায়ের ধূলা লইয়া আসি। সে কি কোনোমতেই ঘটিতে পারে না।”
মহেন্দ্র আশার বেদনা বুঝিল, এবং কিছুদিনের জন্য কাশীতে সে তাহার মাসিমার কাছে যায়, ইহাতে তাহার সম্মতিও হইল। কিন্তু পুনর্বার কালেজ কামাই করিয়া আশাকে কাশী পৌঁছাইয়া দিতে তাহার দ্বিধা বোধ হইতে লাগিল।



আশা কহিল, “জেঠাইমা তো অল্পদিনের মধ্যেই কাশী যাইবেন, সেই সঙ্গে গেলে কি ক্ষতি আছে।”
মহেন্দ্র রাজলক্ষ্মীকে গিয়া কহিল, “মা, বউ একবার কাশীতে কাকীমাকে দেখিতে যাইতে চায়।”
রাজলক্ষ্মী শ্লেষবাক্যে কহিলেন, “বউ যাইতে চান তো অবশ্যই যাইবেন, যাও, তাঁহাকে লইয়া যাও।”
মহেন্দ্র যে আবার অন্নপূর্ণার কাছে যাতায়াত আরম্ভ করিল, ইহা রাজলক্ষ্মীর ভালো লাগে নাই। বধূর যাইবার প্রস্তাবে তিনি মনে মনে আরো বিরক্ত হইয়া উঠিলেন।
মহেন্দ্র কহিল, “আমার কালেজ আছে, আমি রাখিতে যাইতে পারিব না। তাহার জেঠামশায়ের সঙ্গে যাইবে।”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “সে তো ভালো কথা। জেঠামশায়রা বড়োলোক, কখনো আমাদের মতো গরিবের ছায়া মাড়ান না, তাঁহাদের সঙ্গে যাইতে পারিলে কত গৌরব!”
মাতার উত্তরোত্তর শ্লেষবাক্যে মহেন্দ্রের মন একেবারে কঠিন হইয়া বাঁকিল। সে কোনো উত্তর না দিয়া আশাকে কাশী পাঠাইতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়া চলিয়া গেল।
বিহারী যখন রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে দেখা করিতে আসিল, রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “ও বিহারী, শুনিয়াছিস, আমাদের বউমা যে কাশী যাইতে ইচ্ছা করিয়াছেন।”



বিহারী কহিল, “বল কী মা, মহিনদা আবার কালেজ কামাই করিয়া কাশী যাইবে?”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “না না, মহিন কেন যাইবেন। তা হইলে আর বিবিয়ানা হইল কই। মহিন এখানে থাকিবেন, বউ তাঁহার জেঠামহারাজের সঙ্গে কাশী যাইবেন। সবাই সাহেব-বিবি হইয়া উঠিল।”
বিহারী মনে মনে উদ্‌বিগ্ন হইল, বর্তমান কালের সাহেবিয়ানা স্মরণ করিয়া নহে। বিহারী ভাবিতে লাগিল, “ব্যাপারখানা কী। মহেন্দ্র যখন কাশী গেল আশা এখানে রহিল; আবার মহেন্দ্র যখন ফিরিল তখন আশা কাশী যাইতে চাহিতেছে। দুজনের মাঝখানে একটা কী গুরুতর ব্যাপার ঘটিয়াছে। এমন করিয়া কতদিন চলিবে? বন্ধু হইয়াও আমরা ইহার কোনো প্রতিকার করিতে পারিবে না–দূরে দাঁড়াইয়া থাকিব?”
মাতার ব্যবহারে অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হইয়া মহেন্দ্র তাহার শয়নঘরে আসিয়া বসিয়া ছিল। বিনোদিনী ইতিমধ্যে মহেন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নাই–তাই আশা তাহাকে পাশের ঘর হইতে মহেন্দ্রের কাছে লইয়া আসিবার জন্য অনুরোধ করিতেছিল।



এমন সময় বিহারী আসিয়া মহেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিল, “আশা-বোঠানের কি কাশী যাওয়া স্থির হইয়াছে।”
মহেন্দ্র কহিল, “না হইবে কেন। বাধাটা কী আছে।”
বিহারী কহিল, “বাধার কথা কে বলিতেছে। কিন্তু হঠাৎ এ খেয়াল তোমাদের মাথায় আসিল যে?”
মহেন্দ্র কহিল, “মাসিকে দেখিবার ইচ্ছা–প্রবাসী আত্মীয়ের জন্য ব্যাকুলতা, মানবচরিত্রে এমন মাঝে মাঝে ঘটিয়া থাকে।”
বিহারী জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি সঙ্গে যাইতেছ?”
প্রশ্ন শুনিয়াই মহেন্দ্র ভাবিল, “জেঠার সঙ্গে আশাকে পাঠানো সংগত নহে, এই কথা লইয়া আলোচনা
করিতে বিহারী আসিয়াছে।” পাছে অধিক কথা বলিতে গেলে ক্রোধ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে, তাই সংক্ষেপে বলিল, “না।”
বিহারী মহেন্দ্রকে চিনিত। সে যে রাগিয়াছে, তাহা বিহারীর আগোচর ছিল না। একবার জিদ ধরিলে তাহাকে টলানো যায় না, তাহাও সে জানিত। তাই মহেন্দ্রের যাওয়ার কথা আর তুলিল না। মনে মনে ভাবিল, “বেচারা আশা যদি কোনো বেদনা বহন করিয়াই চলিয়া যাইতেছে হয়, তবে সঙ্গে বিনোদিনী গেলে তাহার সান্ত্বনা হইবে।” তাই ধীরে ধীরে কহিল, “বিনোদ-বোঠান তাঁর সঙ্গে গেলে হয় না?”
মহেন্দ্র গর্জন করিয়া উঠিল, “বিহারী, তোমার মনের ভিতর যে-কথাটা আছে, তাহা স্পষ্ট করিয়া বলো। আমার সঙ্গে অসরলতা করিবার কোনো দরকার দেখি না। আমি জানি, তুমি মনে মনে সন্দেহ করিয়াছ, আমি বিনোদিনীকে ভালোবাসি। মিথ্যা কথা। আমি বাসি না। আমাকে রক্ষা করিবার জন্য তোমাকে পাহারা দিয়া বেড়াইতে হইবে না। তুমি এখন নিজেকে রক্ষা করো। যদি সরল বন্ধুত্ব তোমার মনে থাকিত, তবে বহুদিন আগে তুমি আমার কাছে তোমার মনের কথা বলিতে এবং নিজেকে বন্ধুর অন্তঃপুর হইতে বহু দূরে লইয়া যাইতে। আমি তোমার মুখের সামনে স্পষ্ট করিয়া বলিতেছি, তুমি আশাকে ভালোবাসিয়াছ।”



অত্যন্ত বেদনার স্থানে দুই পা দিয়া মাড়াইয়া দিলে, আহত ব্যক্তি মুহূর্তকাল বিচার না করিয়া আঘাতকারীকে যেমন সবলে ধাক্কা দিয়া ফেলিতে চেষ্টা করে–রুদ্ধকণ্ঠ বিহারী তেমনি পাংশুমুখে তাহার চৌকি হইতে উঠিয়া মহেন্দ্রের দিকে ধাবিত হইল–হঠাৎ থামিয়া বহুকষ্টে স্বর বাহির করিয়া কহিল, “ঈশ্বর তোমাকে ক্ষমা করুন, আমি বিদায় হই।” বলিয়া টলিতে টলিতে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল!
পাশের ঘর হইতে বিনোদিনী ছুটিয়া আসিয়া ডাকিল, “বিহারী-ঠাকুরপো!”
বিহারী দেয়ালে ভর করিয়া একটুখানি হাসিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, “কী, বিনোদ-বোঠান!”
বিনোদিনী কহিল, “ঠাকুরপো, চোখের বালির সঙ্গে আমিও কাশীতে যাইব।” বিহারী কহিল, “না না, বোঠান, সে হইবে না, সে কিছুতেই হইবে না। তোমাকে মিনতি করিতেছি- আমার কথায় কিছুই করিয়ো না। আমি এখানকার কেহ নই, আমি এখানকার কিছুতেই হস্তক্ষেপ করিতে চাহি না, তাহাতে ভালো হইবে না। তুমি দেবী, তুমি যাহা ভালো বোধ কর, তাহাই করিয়ো। আমি চলিলাম।”
বলিয়া বিহারী বিনোদিনীকে বিনম্র নমস্কার করিয়া চলিল। বিনোদিনী কহিল, “আমি দেবী নই ঠাকুরপো, শুনিয়া যাও। তুমি চলিয়া গেলে কাহারো ভালো হইবে না। ইহার পরে আমাকে দোষ দিয়ো না।”
বিহারী চলিয়া গেল। মহেন্দ্র স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া ছিল। বিনোদিনী তাহার প্রতি জ্বলন্ত বজ্রের মতো একটা কঠোর কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া পাশের ঘরে চলিয়া গেল, সে-ঘরে আশা একান্ত লজ্জায় সংকোচে মরিয়া যাইতেছিল। বিহারী তাহাকে ভালোবাসে, এ কথা মহেন্দ্রের মুখে শুনিয়া সে আর মুখ তুলিতে পারিতেছিল না। কিন্তু তাহার উপর বিনোদিনীর আর দয়া হইল না। আশা যদি তখন চোখ তুলিয়া চাহিত, তাহা হইলে সে ভয় পাইত। সমস্ত সংসারের উপর বিনোদিনীর যেন খুন চাপিয়া গেছে। মিথ্যা কথা বটে! বিনোদিনীকে কেহই ভালোবাসে না বটে! সকলেই ভালোবাসে এই লজ্জাবতী ননির পুতুলটিকে।



মহেন্দ্র সেই যে আবেগের মুখে বিহারীকে বলিয়াছিল, “আমি পাষণ্ড”–তাহার পর আবেগ শান্তির পর হইতে সেই হঠাৎ আত্মপ্রকাশের জন্য সে বিহারীর কাছে কুণ্ঠিত হইয়া ছিল। সে মনে করিতেছিল, তাহার সব কথাই যেন ব্যক্ত হইয়া গেছে। সে বিনোদিনীকে ভালোবাসে না, অথচ বিহারী জানিয়াছে যে সে ভালোবাসে-ইহাতে বিহারীর উপরে তাহার বড়ো একটা বিরক্তি জন্মিতেছিল। বিশেষত, তাহার পর হইতে যতবার বিহারী তাহার সম্মুখে আসিতেছিল তাহার মনে হইতেছিল, যেন বিহারী সকৌতূহলে তাহার একটা ভিতরকার কথা খুঁজিয়া বেড়াইতেছে। সেই-সমস্ত বিরক্তি উত্তরোত্তর জমিতেছিল–আজ একটু আঘাতেই বাহির হইয়া পড়িল।
কিন্তু বিনোদিনী পাশের ঘর হইতে যেরূপ ব্যাকুলভাবে ছুটিয়া আসিল, যেরূপ আর্তকণ্ঠে বিহারীকে রাখিতে চেষ্টা করিল এবং বিহারীর আদেশ পালন স্বরূপে আশার সহিত কাশী যাইতে প্রস্তুত হইল, ইহা মহেন্দ্রের পক্ষে অভাবিতপূর্ব। এই দৃশ্যটি মহেন্দ্রকে প্রবল আঘাতে অভিভূত করিয়া দিল। সে বলিয়াছিল, সে বিনোদিনীকে ভালোবাসে না; কিন্তু যাহা শুনিল, যাহা দেখিল, তাহা তাহাকে সুস্থির হইতে দিল না, তাহাকে চারি দিক হইতে বিচিত্র আকারে পীড়ন করিতে লাগিল। আর কেবলই নিষ্ফল পরিতাপের সহিত মনে হইতে লাগিল, “বিনোদিনী শুনিয়াছে–আমি বলিয়াছি “আমি তাহাকে ভালোবাসি না”




২৪
মহেন্দ্র ভাবিতে লাগিল, “আমি বলিয়াছি মিথ্যা কথা, আমি বিনোদিনীকে ভালোবাসি না”। অত্যন্ত কঠিন করিয়া বলিয়াছি। আমি যে তাহাকে ভালোবাসি তাহা না-ই হইল, কিন্তু ভালোবাসি না, এ কথাটা বড়ো কঠোর। এ কথায় আঘাত না পায় এমন স্ত্রীলোক কে আছে। ইহার প্রতিবাদ করিবার অবসর কবে কোথায় পাইব। ভালোবাসি এ কথা ঠিক বলা যায় না; কিন্তু ভালোবাসি না, এই কথাটাকে একটু ফিকা করিয়া, নরম করিয়া জানানো দরকার। বিনোদিনীর মনে এমন-একটা নিষ্ঠুর অথচ ভুল সংস্কার থাকিতে দেওয়া অন্যায়।”
এই বলিয়া মহেন্দ্র তাহার বাক্সর মধ্য হইতে আর-একবার তাহার চিঠি তিনখানি পড়িল। মনে মনে কহিল, “বিনোদিনী আমাকে যে ভালোবাসে, ইহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু কাল সে বিহারীর কাছে অমন করিয়া আসিয়া পড়িল কেন। সে কেবল আমাকে দেখাইয়া। আমি যখন তাহাকে ভালোবাসি না স্পষ্ট করিয়া বলিলাম, তখন সে কোনো সুযোগে আমার কাছে তাহার ভালোবাসা প্রত্যাখ্যান না করিয়া কী করিবে। এমনি করিয়া আমার কাছে অবমানিত হইয়া হয়তো সে বিহারীকে ভালোবাসিতেও পারে।”
মহেন্দ্রের ক্ষোভ এতই বাড়িয়া উঠিতে লাগিল যে, নিজের চাঞ্চল্যে সে নিজে আশ্চর্য এবং ভীত হইয়া উঠিল। নাহয় বিনোদিনী শুনিয়াছে, মহেন্দ্র তাহাকে ভালোবাসে না–তাহাতে দোষ কী। নাহয় এই কথায় অভিমানিনী বিনোদিনী তাহার উপর হইতে মন সরাইয়া লইতে চেষ্টা করিবে–তাহাতেই বা ক্ষতি কী।ঝড়ের সময় নৌকার শিকল যেমন নোঙরকে টানিয়া ধরে, মহেন্দ্র তেমনি ব্যাকুলতার সঙ্গে আশাকে যেন অতিরিক্ত জোর করিয়া ধরিল।
রাত্রে মহেন্দ্র আশার মুখ বক্ষের কাছে ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “চুনি, তুমি আমাকে কতখানি ভালোবাস ঠিক করিয়া বলো।”
আশা ভাবিল, “এ কেমন প্রশ্ন। বিহারীকে লইয়া অত্যন্ত লজ্জাজনক যে-কথাটা উঠিয়াছে, তাহাতেই কি তাহার উপরে সংশয়ের ছায়া পড়িয়াছে।” সে লজ্জায় মরিয়া গিয়া কহিলল, “ছি ছি, আজ তুমি এমন প্রশ্ন কেন করিলে। তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে খুলিয়া বলো–আমার ভালোবাসায় তুমি কবে কোথায় কী অভাব দেখিয়াছ।”


মহেন্দ্র আশাকে পীড়ন করিয়া তাহার মাধুর্য বাহির করিবার জন্য কহিল, “তবে তুমি কাশী যাইতে চাহিতেছ কেন।”
আশা কহিল, “আমি কাশী যাইতে চাই না, আমি কোথাও যাইব না।”
মহেন্দ্র। তখন তো চাহিয়াছিলে।
আশা অত্যন্ত পীড়িত হইয়া কহিল, “তুমি তো জান, কেন চাহিয়াছিলাম।”
মহেন্দ্র। আমাকে ছাড়িয়া তোমার মাসির কাছে বোধ হয় বেশ সুখে থাকিতে।
আশা কহিল, “কখনো না। আমি সুখের জন্য যাইতে চাহি নাই।”



মহেন্দ্র কহিল, “আমি সত্য বলিতেছি চুনি, তুমি আর-কাহাকেও বিবাহ করিলে ঢের বেশি সুখী হইতে পারিতে।”
শুনিয়া আশা চকিতের মধ্যে মহেন্দ্রের বক্ষ হইতে সরিয়া গিয়া, বালিশে মুখ ঢাকিয়া, কাঠের মতো আড়ষ্ট হইয়া রহিল–মুহূর্তপরেই তাহার কান্না আর চাপা রহিল না। মহেন্দ্র তাহাকে সান্ত্বনা দিবার জন্য বক্ষে তুলিয়া লইবার চেষ্টা করিল, আশা বালিশ ছাড়িল না। পতিব্রতার এই অভিমানে মহেন্দ্র সুখে গর্বে ধিক্‌কারে ক্ষুদ্ধ হইতে লাগিল।
যে-সব কথা ভিতরে-ভিতরে আভাসে ছিল, সেইগুলা হঠাৎ স্পষ্ট কথায় পরিস্ফুট হইয়া সকলেরই মনে একটা গোলমাল বাধাইয়া দিল। বিনোদিনী মনে মনে ভাবিতে লাগিল–অমন স্পষ্ট অভিযোগের বিরুদ্ধে বিহারী



কেন কোনো প্রতিবাদ করিল না। যদি সে মিথ্যা প্রতিবাদও করিত, তাহা হইলেও যেন বিনোদিনী একটু খুশি হইত। বেশ হইয়াছে, মহেন্দ্র বিহারীকে যে-আঘাত করিয়াছে, তাহা তাহার প্রাপ্যই ছিল। বিহারীর মতো অমন মহৎ লোক কেন আশাকে ভালোবাসিবে। এই আঘাতে বিহারীকে যে দূরে লইয়া গেছে, সে যেন ভালোই হইয়াছে–বিনোদিনী যেন নিশ্চিন্ত হইল।
কিন্তু বিহারীর সেই মৃত্যুবাণাহত রক্তহীন পাংশু মুখ বিনোদিনীকে সকল কর্মের মধ্যে যেন অনুসরণ করিয়া ফিরিল। বিনোদিনীর অন্তরে যে সেবাপরায়ণা নারীপ্রকৃতি ছিল, সে সেই আর্ত মুখ দেখিয়া কাঁদিতে লাগিল। রুগ্‌ণ শিশুকে যেমন মাতা বুকের কাছে দোলাইয়া বেড়ায়, তেমনি সেই আতুর মূর্তিকে বিনোদিনী আপন হৃদয়ের মধ্যে রাখিয়া দোলাইতে লাগিল; তাহাকে সুস্থ করিয়া সেই মুখে আবার রক্তের রেখা, প্রাণের প্রবাহ, হাস্যের বিকাশ দেখিবার জন্য বিনোদিনীর একটা অধীর ঔৎসুক্য জন্মিল।
দুই-তিন দিন সকল কর্মের মধ্যে এইরূপ উন্মনা হইয়া ফিরিয়া বিনোদিনী আর থাকিতে পারিল না। বিনোদিনী একখানি সান্ত্বনার পত্র লিখিল, কহিল-
“ঠাকুরপো, আমি তোমার সেদিনকার সেই শুষ্ক মুখ দেখিয়া অবধি প্রাণমনে কামনা করিতেছি, তুমি



সুস্থ হও, তুমি যেমন ছিলে তেমনিটি হও–সেই সহজ হাসি আবার কবে দেখিব, সেই উদার কথা আবার কবে শুনিব। তুমি কেমন আছ, আমাকে একটি ছত্র লিখিয়া জানাও। তোমার বিনোদ-বোঠান।”
বিনোদিনী দরোয়ানের হাত দিয়া বিহারীর ঠিকানায় চিঠি পাঠাইয়া দিল।
আশাকে বিহারী ভালোবাসে, এ কথা যে এমন রূঢ় করিয়া, এমন গর্হিতভাবে মহেন্দ্র মুখে উচ্চারণ করিতে পারিবে, তাহা বিহারী স্বপ্নেও কল্পনা করে নাই। কারণ, সে নিজেও এমন কথা স্পষ্ট করিয়া কখনো মনে স্থান দেয় নাই। প্রথমটা বজ্রাহত হইল–তার পরে ক্রোধে ঘৃণায় ছটফট করিয়া বলিতে লাগিল, “অন্যায়, অসংগত, অমূলক।”
কিন্তু কথাটা যখন একবার উচ্চারিত হইয়াছে, তখন তাহাকে আর সম্পূর্ণ মারিয়া ফেলা যায় না। তাহার মধ্যে যেটুকু সত্যের বীজ ছিল, তাহা দেখিতে দেখিতে অঙ্কুরিত হইয়া উঠিতে লাগিল। কন্যা দেখিবার উপলক্ষে সেই যে একদিন সূর্যাস্তকালে বাগানের উচ্ছ্বসিত পুষ্পগন্ধপ্রবাহে লজ্জিতা বালিকার সুকুমার মুখখানিকে সে নিতান্তই আপনার মনে করিয়া বিগলিত অনুরাগের সহিত একবার চাহিয়া দেখিয়াছিল, তাহাই বার বার মনে পড়িতে লাগিল, এবং বুকের কাছে কী যেন চাপিয়া ধরিতে লাগিল, এবং একটা অত্যন্ত কঠিন বেদনা কণ্ঠের কাছ পর্যন্ত আলোড়িত হইয়া উঠিল। দীর্ঘরাত্রি ছাদের উপর শুইয়া শুইয়া বাড়ির সম্মুখের পথে দ্রুতপদে পায়চারি করিতে করিতে, যাহা এতদিন অব্যক্ত ছিল তাহা বিহারীর মনে ব্যক্ত হইয়া উঠিল। যাহা সংযত ছিল তাহা উদ্দাম হইল; নিজের কাছেও যাহার কোনো প্রমাণ ছিল না, মহেন্দ্রের বাক্যে তাহা বিরাট প্রাণ পাইয়া বিহারীর অন্তর বাহির ব্যাপ্ত করিয়া দিল।



তখন সে নিজেকে অপরাধী বলিয়া বুঝিল। মনে মনে কহিল, “আমার তো আর রাগ করা শোভা পায় না, মহেন্দ্রের কাছে তো ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া বিদায় লইতে হইবে। সেদিন এমনভাবে চলিয়া আসিয়াছিলাম, যেন মহেন্দ্র দোষী, আমি বিচারক–সে অন্যায় স্বীকার করিয়া আসিব।”
বিহারী জানিত, আশা কাশী চলিয়া গেছে। একদিন সে সন্ধ্যার সময় ধীরে ধীরে মহেন্দ্রের দ্বারের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। রাজলক্ষ্মীর দূরসম্পর্কের মামা সাধুচরণকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “সাধ্‌দা, কদিন আসিতে পারি নাই–এখানকার সব খবর ভালো?” সাধুচরণ সকলের কুশল জানাইল। বিহারী জিজ্ঞাসা করিল, “বোঠান কাশীতে কবে গেলেন।” সাধুচরণ কহিল, “তিনি যান নাই। তাঁহার কাশী যাওয়া হইবে না।” শুনিয়া, কিছু না মানিয়া অন্তঃপুরে যাইবার জন্য বিহারীর মন ছুটিল। পূর্বে যেমন সহজে যেমন আনন্দে আত্মীয়ের মতো সে পরিচিত সিঁড়ি বাহিয়া ভিতরে যাইত, সকলের সঙ্গে স্নিগ্ধ কৌতুকের সহিত হাস্যালাপ করিয়া আসিত, কিছুই মনে হইত না, আজ তাহা অবিহিত, তাহা দুর্লভ, জানিয়াই তাহার চিত্ত যেন উন্মত্ত হইল। আর-একটিবার, কেবল শেষবার, তেমনি করিয়া ভিতরে গিয়া ঘরের ছেলের মতো রাজলক্ষ্মীর সহিত কথা সারিয়া, একবার ঘোমটাবৃত আশাকে বোঠান বলিয়া দুটো তুচ্ছ কথা কহিয়া আসা তাহার কাছে পরম আকাঙ্ক্ষার বিষয় হইয়া উঠিল। সাধুচরণ কহিল, “ভাই, অন্ধকারে দাঁড়াইয়া রহিলে যে, ভিতরে চলো।”
শুনিয়া বিহারী দ্রুতবেগে ভিতরের দিকে কয়েক পদ অগ্রসর হইয়াই ফিরিয়া সাধুকে কহিল, “যাই একটা কাজ আছে।” বলিয়া তাড়াতাড়ি প্রস্থান করিল। সেই রাত্রেই বিহারী পশ্চিমে চলিয়া গেল।
দরোয়ান বিনোদিনীর চিঠি লইয়া বিহারীকে না পাইয়া চিঠি ফিরাইয়া লইয়া আসিল। মহেন্দ্র তখন দেউড়ির সম্মুখে ছোটো বাগানটিতে বেড়াইতেছিল। জিজ্ঞাসা করিল, “এ কাহার চিঠি।” দরোয়ান সমস্ত বলিল। মহেন্দ্র চিঠিখানি নিজে লইল।



একবার সে ভাবিল, চিঠিখানা লইয়া বিনোদিনীর হাতে দিবে–অপরাধিনী বিনোদিনীর লজ্জিত মুখ একবার সে দেখিয়া আসিবে–কোনো কথা বলিবে না। এই চিঠির মধ্যে বিনোদিনীর লজ্জার কারণ যে আছেই, মহেন্দ্রের মনে তাহাতে কোনো সন্দেহ ছিল না। মনে পড়িল, পূর্বেও আর-একদিন বিহারীর নামে এমনি একখানা চিঠি গিয়াছিল। চিঠিতে কী লেখা আছে, এ কথা না জানিয়া মহেন্দ্র কিছুতেই স্থির থাকিতে পারিল না। সে মনকে বুঝাইল–বিনোদিনী তাহার অভিভাবকতায় আছে, বিনোদিনীর ভালোমন্দের জন্য সে দায়ী। অতএব এরূপ সন্দেহজনক পত্র খুলিয়া দেখাই তাহার কর্তব্য। বিনোদিনীকে বিপথে যাইতে দেওয়া কোনোমতেই হইতে পারে না।
মহেন্দ্র ছোটো চিঠিখানা খুলিয়া পড়িল। তাহা সরল ভাষায় লেখা, সেইজন্য অকৃত্রিম উদ্‌বেগ তাহার মধ্য হইতে পরিষ্কার প্রকাশ পাইয়াছে। চিঠিখানা পুনঃপুন পাঠ করিয়া এবং অনেক চিন্তা করিয়া মহেন্দ্র ভাবিয়া উঠিতে পারিল না, বিনোদিনীর মনের গতি কোন্‌ দিকে। তাহার কেবলই আশঙ্কা হইতে লাগিল, “আমি যে তাহাকে ভালোবাসি না বলিয়া অপমান করিয়াছি, সেই অভিমানে বিনোদিনী অন্য দিকে মন দিবার চেষ্টা করিতেছে। রাগ করিয়া আমার আশা সে একেবারেই ছাড়িয়া দিয়াছে।”
এই কথা মনে করিয়া মহেন্দ্রের ধৈর্যরক্ষা করা একেবারে অসম্ভব হইয়া উঠিল। যে বিনোদিনী তাহার নিকট আসিয়াছিল, সে যে মুহূর্তকালের মূঢ়তায় সম্পূর্ণ তাহার অধিকারচ্যুত হইয়া যাইবে, সেই সম্ভাবনায় মহেন্দ্রকে স্থির থাকিতে দিল না। মহেন্দ্র ভাবিল, “বিনোদিনী আমাকে যদি মনে মনে ভালোবাসে, তাহা বিনোদিনীর পক্ষে মঙ্গলকর–এক জায়গায় সে বদ্ধ হইয়া থাকিবে। আমি নিজের মন জানি, আমি তো তাহার প্রতি কখনোই অন্যায় করিব না। সে আমাকে নিরাপদে ভালোবাসিতে পারে। আমি আশাকে ভালোবাসি, আমার দ্বারা তাহার কোনো ভয় নাই। কিন্তু সে যদি অন্য কোনো দিকে মন দেয় তবে তাহার কী সর্বনাশ হইতে পারে কে জানে। মহেন্দ্র স্থির করিল, নিজেকে ধরা না দিয়া বিনোদিনীর মন কোনো অবকাশে আর-একবার ফিরাইতেই হইবে।



মহেন্দ্র অন্তঃপুরে প্রবেশ করিতেই দেখিল, বিনোদিনী পথের মধ্যেই যেন কাহার জন্য উৎকণ্ঠিত হইয়া
প্রতীক্ষা করিতেছে। অমনি মহেন্দ্রের মনে চকিতের মধ্যে বিদ্বেষ জ্বলিয়া উঠিল। কহিল,”ওগো, মিথ্যা দাঁড়াইয়া
আছ, দেখা পাইবে না। এই তোমার চিঠি ফিরিয়া আসিয়াছে।” বলিয়া চিঠিখানা ফেলিয়া দিল।
বিনোদিনী কহিল,”খোলা যে?”
মহেন্দ্র তাহার জবাব না দিয়াই চলিয়া গেল। বিহারী চিঠি খুলিয়া পড়িয়া কোনো উত্তর না দিয়া চিঠি ফেরত পাঠাইয়াছে মনে করিয়া বিনোদিনীর সর্বাঙ্গের সমস্ত শিরা দব্‌ দব্‌ করিতে লাগিল। যে দরোয়ান চিঠি লইয়া গিয়াছিল, তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইল; সে অন্য কাজে অনুপস্থিত ছিল, তাহাকে পাওয়া গেল না। প্রদীপের মুখ হইতে যেমন জ্বলন্ত তৈলবিন্দু ক্ষরিয়া পড়ে, রুদ্ধ শয়নকক্ষের মধ্যে বিনোদিনীর দীপ্ত নেত্র হইতে তেমনি হৃদয়ের জ্বালা অশ্রুজলে গলিয়া পড়িতে লাগিল। নিজের চিঠিখানা ছিঁড়িয়া ছিঁড়িয়া কুটিকুটি করিয়া কিছুতেই তাহার সান্ত্বনা হইল না–সেই দুই-চারি লাইন কালির দাগকে অতীত হইতে বর্তমান হইতে একেবারেই মুছিয়া ফেলিবার, একেবারেই “না” করিয়া দিবার কোনো উপায় নাই কেন। ক্রুদ্ধা মধুকরী যাহাকে সন্মুখে পায় তাহাকেই দংশন করে,ক্ষুব্ধা বিনোদিনী তেমনি তাহার চারি দিকের সমস্ত সংসারটাকে জ্বালাইবার জন্য প্রস্তুত হইল। সে যাহা চায় তাহাতেই বাধা? কোনো কিছুতেই কি সে কৃতকার্য হইতে পারিবে না। সুখ যদি না পাইল, তবে যাহারা তাহার সকল সুখের অন্তরায়, যাহারা তাহাকে কৃতার্থতা হইতে ষ্টি, সমস্ত সম্ভবপর সম্পদ হইতে বঞ্চিত করিয়াছে, তাহাদিগকে পরাস্ত ধূলিলুন্ঠিত করিলেই তাহার ব্যর্থ জীবনের কর্ম সমাধা হইবে।






২৫
সেদিন নূতন ফাল্গুনে প্রথম বসন্তের হাওয়া দিতেই আশা অনেক দিন পরে সন্ধ্যার আরম্ভে ছাদে মাদুর পাতিয়া বসিয়াছে। একখানি মাসিক কাগজ লইয়া খণ্ডশ প্রকাশিত একটা গল্প খুব মনোযোগ দিয়া সেই অল্প আলোকে পড়িতেছিল। গল্পের নায়ক তখন সংবৎসর পরে পূজার ছুটিতে বাড়ি আসিবার সময় ডাকাতের হাতে পড়িয়াছে,আশার হৃদয় উদ্‌বেগে কাঁপিতেছিল; এ দিকে হতভাগিনী নায়িকা ঠিক সেই সময়েই বিপদের স্বপ্ন দেখিয়া কাঁদিয়া জাগিয়া উঠিয়াছে। আশা চোখের জল আর রাখিতে পারে না। আশা বাংলা গল্পের অত্যন্ত উদার সমালোচক ছিল। যাহা পড়িত,তাহাই মনে হইত চমৎকার। বিনোদিনীকে ডাকিয়া বলিত,”ভাই চোখের বালি, মাথা খাও, এ গল্পটা পড়িয়া দেখো। এমন সুন্দর! পড়িয়া আর কাঁদিয়া বাঁচি না।” বিনোদিনী ভালোমন্দ বিচার করিয়া আশার উচ্ছ্বসিত উৎসাহে বড়ো আঘাত করিত।
আজিকার এই গল্পটা আশা মহেন্দ্রকে পড়াইবে বলিয়া স্থির করিয়া যখন সজল-চক্ষে কাগজখানা বন্ধ করিল, এমন সময় মহেন্দ্র আসিয়া উপস্থিত হইল। মহেন্দ্রের মুখ দেখিয়াই আশা উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিল। মহেন্দ্র জোর করিয়া প্রফুল্লতা আনিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, “একলা ছাদের উপর কোন্‌ ভাগ্যবানের ভাবনায় আছ?”
আশা নায়ক-নায়িকার কথা একেবারে ভুলিয়া গিয়া কহিল, “তোমার কী শরীর আজ ভালো নাই।”
মহেন্দ্র। শরীর বেশ আছে।
আশা। তবে তুমি মনে মনে কী একটা ভাবিতেছ, আমাকে খুলিয়া বলো।
মহেন্দ্র আশার বাটা হইতে একটা পান তুলিয়া লইয়া মুখে দিয়া কহিল, “আমি ভাবিতেছিলাম, তোমার
মাসিমা বেচারা কত দিন তোমাকে দেখেন নাই। একবার হঠাৎ যদি তুমি তাঁহার কাছে গিয়া পড়িতে পার, তবে তিনি কত খুশিই হন।”
আশা কোনো উত্তর না করিয়া মহেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। হঠাৎ এ কথা আবার নূতন করিয়া কেন মহেন্দ্রের মনে উদয় হইল, তাহা সে বুঝিতে পারিল না।
আশাকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া মহেন্দ্র কহিল, “তোমার যাইতে ইচ্ছা করে না?”
এ কথার উত্তর দেওয়া কঠিন। মাসিকে দেখিবার জন্য যাইতে ইচ্ছা করে, আবার মহেন্দ্রকে ছাড়িয়া যাইতে ইচ্ছাও করে না। আশা কহিল, “কালেজের ছুটি পাইলে তুমি যখন যাইতে পারিবে, আমিও সঙ্গে যাইব।”
মহেন্দ্র। ছুটি পাইলেও যাইবার জো নাই; পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে।
আশা। তবে থাক্‌, এখন না-ই গেলাম।
মহেন্দ্র। থাক্‌ কেন। যাইতে চাহিয়াছিলে, যাও-না।
আশা। না, আমার যাইবার ইচ্ছা নাই।
মহেন্দ্র। এই সেদিন এত ইচ্ছা ছিল, হঠাৎ ইচ্ছা চলিয়া গেল? আশা এই কথায় চুপ করিয়া চোখ নিচু করিয়া বসিয়া রহিল। বিনোদিনীর সঙ্গে সন্ধি করিবার জন্য বাধাহীন অবসর চাহিয়া মহেন্দ্রের মন ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত অধীর হইয়া উঠিয়াছিল। আশাকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া তাহার একটা অকারণ রাগের সঞ্চার হইল। কহিল, “আমার উপর মনে মনে তোমার কোনো সন্দেহ জন্মিয়াছে নাকি। তাই আমাকে চোখে চোখে পাহারা দিয়া রাখিতে চাও?”
আশার স্বাভাবিক মৃদুতা নম্রতা ধৈর্য মহেন্দ্রের কাছে হঠাৎ অত্যন্ত অসহ্য হইয়া উঠিল। মনে মনে কহিল, “মাসির কাছে যাইতে ইচ্ছা আছে, বলো যে, আমি যাইবই, আমাকে যেমন করিয়া হোক পাঠাইয়া দাও–তা নয়, কখনো হাঁ, কখনো না, কখনো চুপচাপ–এ কী রকম।”
হঠাৎ মহেন্দ্রের এই উগ্রতা দেখিয়া আশা বিস্মিত ভীত হইয়া উঠিল। সে অনেক চেষ্টা করিয়া কোনো উত্তরই ভাবিয়া পাইল না। মহেন্দ্র কেন যে কখনো হঠাৎ এত আদর করে, কখনো হঠাৎ এমন নিষ্ঠুর হইয়া উঠে, তাহা সে কিছুই বুঝিতে পারে না। এইরূপে মহেন্দ্র যতই তাহার কাছে দুর্বোধ্য হইয়া উঠিতেছে, ততই আশার কম্পান্বিত চিত্ত ভয়ে ও ভালোবাসায় তাহাকে যেন অত্যন্ত অধিক করিয়া বেষ্টন করিয়া ধরিতেছে।
মহেন্দ্রকে আশা মনে মনে সন্দেহ করিয়া চোখে চোখে পাহারা দিতে চায়! ইহা কি কঠিন উপহাস, না নির্দয় সন্দেহ? শপথ করিয়া কি ইহার প্রতিবাদ আবশ্যক, না হাস্য করিয়া ইহা উড়াইয়া দিবার কথা?
হতবুদ্ধি আশাকে পুনশ্চ চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া অধীর মহেন্দ্র দ্রুতবেগে সেখান হইতে উঠিয়া চলিয়া গেল। তখন কোথায় রহিল মাসিক পত্রের সেই গল্পের নায়ক, কোথায় রহিল গল্পের নায়িকা। সূর্যাস্তের আভা অন্ধকারে মিশাইয়া গেল, সন্ধ্যারম্ভের ক্ষণিক বসন্তের বাতাস গিয়া শীতের হাওয়া দিতে লাগিল–তখনো আশা সেই মাদুরের উপর লুণ্ঠিত হইয়া পড়িয়া রহিল।
অনেক রাত্রে আশা শয়নঘরে গিয়া দেখিল, মহেন্দ্র তাহাকে না ডাকিয়াই শুইয়া পড়িয়াছে। তখনই আশার মনে হইল, স্নেহময়ী মাসির প্রতি তাহার উদাসীনতা কল্পনা করিয়া মহেন্দ্র তাহাকে মনে মনে ঘৃণা করিতেছে। বিছানার মধ্যে ঢুকিয়াই আশা মহেন্দ্রের দুই পা জড়াইয়া তাহার পায়ের উপর মুখ রাখিয়া পড়িয়া রহিল। তখন মহেন্দ্র করুণায় বিচলিত হইয়া তাহাকে টানিয়া লইবার চেষ্টা করিল। আশা কিছুতেই উঠিল না। সে কহিল, “আমি যদি কোনো দোষ করিয়া থাকি, আমাকে মাপ করো।”
মহেন্দ্র আর্দ্রচিত্তে কহিল, “তোমার কোনো দোষ নাই, চুনি। আমি নিতান্ত পাষণ্ড, তাই তোমাকে অকারণে আঘাত করিয়াছি।”
তখন মহেন্দ্রের দুই পা অভিষিক্ত করিয়া আশার অশ্রু ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। মহেন্দ্র উঠিয়া বসিয়া তাহাকে দুই বাহুতে তুলিয়া আপনার পাশে শোয়াইল। আশার রোদনবেগ থামিলে সে কহিল, “মাসিকে কি আমার দেখিতে যাইবার ইচ্ছা করে না। কিন্তু তোমাকে ফেলিয়া আমার যাইতে মন সরে না। তাই আমি যাইতে চাই নাই, তুমি রাগ করিয়ো না।”
মহেন্দ্র ধীরে ধীরে আশার আর্দ্র কপোল মুছাইতে মুছাইতে কহিল, “এ কি রাগ করিবার কথা, চুনি। আমাকে ছাড়িয়া যাইতে পার না, সে লইয়া আমি রাগ করিব? তোমাকে কোথাও যাইতে হইবে না।”
আশা কহিল, “না, আমি কাশী যাইব।”
মহেন্দ্র। কেন।
আশা। তোমাকে মনে মনে সন্দেহ করিয়া যাইতেছি না–এ কথা যখন একবার তোমার মুখ দিয়া বাহির হইয়াছে, তখন আমাকে কিছুদিনের জন্যও যাইতেই হইবে।
মহেন্দ্র। আমি পাপ করিলাম, তাহার প্রায়শ্চিত্ত তোমাকে করিতে হইবে?

আশা। তাহা আমি জানি না–কিন্তু পাপ আমার কোনোখানে হইয়াছেই, নহিলে এমন-সকল অসম্ভব কথা উঠিতেই পারিত না। যে-সব কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিতে পারিতাম না, সে-সব কথা কেন শুনিতে হইতেছে।
মহেন্দ্র। তাহার কারণ, আমি যে কী মন্দ লোক তাহা তোমার স্বপ্নেরও অগোচর।

আশা ব্যস্ত হইয়া কহিল, “আবার! ও কথা বলিয়ো না। কিন্তু এবার আমি কাশী যাইবই।”
মহেন্দ্র হাসিয়া কহিল, “আচ্ছা যাও, কিন্তু তোমার চোখের আড়ালে আমি যদি নষ্ট হইয়া যাই, তাহা হইলে কী হইবে।”
আশা কহিল, “তোমার আর অত ভয় দেখাইতে হইবে না, আমি কিনা ভাবিয়া অস্থির হইতেছি।”
মহেন্দ্র। কিন্তু ভাবা উচিত। তোমার এমন স্বামীটিকে যদি অসাবধানে বিগড়াইতে দাও, তবে এর পরে কাহাকে দোষ দিবে?
আশা। তোমাকে দোষ দিব না, সেজন্য তুমি ভাবিয়ো না।
মহেন্দ্র। তখন নিজের দোষ স্বীকার করিবে?
আশা। একশোবার।
মহেন্দ্র। আচ্ছা, তাহা হইলে কাল একবার তোমার জেঠামশায়ের সঙ্গে গিয়া কথাবার্তা ঠিক করিয়া আসিব।
এই বলিয়া মহেন্দ্র “অনেক রাত হইয়াছে” বলিয়া পাশ ফিরিয়া শুইল।



কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ পুনর্বার এ পাশে ফিরিয়া কহিল, “চুনি, কাজ নাই, তুমি নাই বা গেলে।”
আশা কাতর হইয়া কহিল, “আবার বারণ করিতেছ কেন। এবার একবার না গেলে তোমার সেই ভর্ৎসনাটা আমার গায়ে লাগিয়া থাকিবে। আমাকে দু-চার দিনের জন্যও পাঠাইয়া দাও।” মহেন্দ্র কহিল, “আচ্ছা।” বলিয়া আবার পাশ ফিরিয়া শুইল।
কাশী যাইবার আগের দিন আশা বিনোদিনীর গলা জড়াইয়া কহিল, “ভাই বালি, আমার গা ছুঁইয়া একটা
কথা বল্‌।”
বিনোদিনী আশার গাল টিপিয়া ধরিয়া কহিল, “কী কথা, ভাই। তোমার অনুরোধ আমি রাখিব না?”
আশা। কে জানে ভাই, আজকাল তুমি কী রকম হইয়া গেছ। কোনোমতেই যেন আমার স্বামীর কাছে বাহির হইতে চাও না।



বিনোদিনী। কেন চাই না সে কি তুই জানিস নে, ভাই। সেদিন বিহারীবাবুকে মহেন্দ্রবাবু যে কথা বলিলেন, সে কি তুই নিজের কানে শুনিস নাই। এ-সকল কথা যখন উঠিল তখন কি আর বাহির হওয়া উচিত–তুমিই বলো-না, ভাই বালি।
ঠিক উচিত যে নহে, তাহা আশা বুঝিত। এ-সকল কথার লজ্জাকরতা যে কতদূর, তাহাও সে নিজের মন হইতেই সম্প্রতি বুঝিয়াছে। তবু বলিল, “কথা অমন কত উঠিয়া থাকে, সে-সব যদি না সহিতে পারিস তবে আর ভালোবাসা কিসের, ভাই। ও কথা ভুলিতে হইবে।”
বিনোদিনী। আচ্ছা ভাই, ভুলিব।
আশা। আমি তো ভাই, কাল কাশী যাইব, আমার স্বামীর যাহাতে কোনো অসুবিধা না হয় তোমাকে সেইটে বিশেষ করিয়া দেখিতে হইবে। এখনকার মতো পালাইয়া বেড়াইলে চলিবে না।
বিনোদিনী চুপ করিয়া রহিল। আশা বিনোদিনীর হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল, “মাথা খা ভাই বালি, এই কথাটা আমাকে দিতেই হইবে।”
বিনোদিনী কহিল, “আচ্ছা।”





২৬
এক দিকে চন্দ্র অস্ত যায়, আর-এক দিকে সূর্য উঠে। আশা চলিয়া গেল, কিন্তু মহেন্দ্রের ভাগ্যে এখনো বিনোদিনীর দেখা নাই। মহেন্দ্র ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়, মাঝে মাঝে ছুতা করিয়া সময়ে-অসময়ে তাহার মার ঘরে আসিয়া উপস্থিত হয়, বিনোদিনী কেবলই ফাঁকি দিয়া পালায়, ধরা দেয় না।
রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রের এইরূপ অত্যন্ত শূন্যভাব দেখিয়া ভাবিলেন, “বউ গিয়াছে, তাই এ বাড়িতে মহিনের কিছুই আর ভালো লাগিতেছে না।” আজকাল মহেন্দ্রের সুখদুঃখের পক্ষে মা যে বউয়ের তুলনায় একান্ত অনাবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে, তাহা মনে করিয়া তাঁহাকে বিঁধিল–তবু মহেন্দ্রের এই লক্ষ্মীছাড়া বিমর্ষ ভাব দেখিয়া তিনি বেদনা পাইলেন। বিনোদিনীকে ডাকিয়া বলিলেন, “সেই ইন্‌ফ্লুয়েজ্ঞার পর হইতে আমার হাঁপানির মতো হইয়াছে; আমি তো আজকাল সিঁড়ি ভাঙিয়া ঘন ঘন উপরে যাইতে পারি না। তোমাকে বাছা, নিজে থাকিয়া মহিনের খাওয়াদাওয়া সমস্তই দেখিতে হইবে। বরাবরকার অভ্যাস, একজন কেহ যত্ন না করিলে মহিন থাকিতে পারে না। দেখো-না, বউ যাওয়ার পর হইতে ও কেমন একরকম হইয়া গেছে। বউকেও ধন্য বলি, কেমন করিয়া গেল?”
বিনোদিনী একটুখানি মুখ বাঁকাইয়া বিছানার চাদর খুঁটিতে লাগিল। রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “কী বউ, কী ভাবিতেছ। ইহাতে ভাবিবার কথা কিছু নাই। যে যাহা বলে বলুক, তুমি আমাদের পর নও।”
বিনোদিনী কহিল, “কাজ নাই, মা।”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “আচ্ছা, তবে কাজ নাই। দেখি আমি নিজে যা পারি তাই করিব।”
বলিয়া তখনই তিনি মহেন্দ্রের তেতলার ঘর ঠিক করিবার জন্য উদ্যত হইলেন। বিনোদিনী ব্যস্ত হইয়া কহিল, “তোমার অসুখ-শরীর, তুমি যাইয়ো না, আমি যাইতেছি। আমাকে মাপ করো পিসিমা, তুমি যেমন আদেশ করিবে আমি তাহাই করিব।”
রাজলক্ষ্মী লোকের কথা একেবারেই তুচ্ছ করিতেন। স্বামীর মৃত্যুর পর হইতে সংসারে এবং সমাজে তিনি মহেন্দ্র ছাড়া আর কিছুই জানিতেন না। মহেন্দ্র সম্বন্ধে বিনোদিনী সমাজনিন্দার আভাস দেওয়াতে তিনি বিরক্ত হইয়াছিলেন। আজন্মকাল তিনি মহিনকে দেখিয়া আসিতেছেন, তাহার মতো এমন ভালো ছেলে আছে কোথায়। সেই মহিনের সম্বন্ধেও নিন্দা! যদি কেহ করে, তবে তাহার জিহ্বা খসিয়া যাক। তাঁহার নিজের কাছে যেটা ভালো লাগে ও ভালো বোধ হয় সে-সম্বন্ধে বিশ্বের লোককে উপেক্ষা করিবার জন্য রাজলক্ষ্মীর একটা স্বাভাবিক জেদ ছিল।



আজ মহেন্দ্র কালেজ হইতে ফিরিয়া আসিয়া আপনার শয়নঘর দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেল। দ্বার খুলিয়াই দেখিল, চন্দনগুঁড়া ও ধুনার গন্ধে ঘর আমোদিত হইয়াআছে। মশারিতে গোলাপি রেশমের ঝালর লাগানো। নীচের বিছানায় শু িজাজিম তকতক করিতেছে এবং তাহার উপরে পূর্বেকার পুরাতন তাকিয়ার পরিবর্তে রেশম ও পশমের ফুলকাটা বিলাতি চৌকা বালিশ সুসজ্জিত। তাহার কারুকার্য বিনোদিনীর বহুদিনের পরিশ্রমজাত। আশা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিত, “এগুলি তুই কার জন্যে তৈরি করিতেছিস, ভাই।”
বিনোদিনী হাসিয়া বলিত, “আমার চিতাশয্যার জন্য। মরণ ছাড়া তো সোহাগের লোক আমার আর কেহই নাই।”
দেয়ালে মহেন্দ্রের যে বাঁধানো ফোটোগ্রাফখানি ছিল, তাহার ফ্রেমের চার কোণে রঙিন ফিতার দ্বারা সুনিপুণভাবে চারিটি গ্রনিথ বাঁধা, এবং সেই ছবির নীচে ভিত্তিগাত্রে একটি টিপাইয়ের দুই ধারে দুই ফুলদানিতে ফুলের তোড়া, যেন মহেন্দ্রের প্রতিমূর্তি কোনো অজ্ঞাত ভক্তের পূজা প্রাপ্ত হইয়াছে। সবসুদ্ধ সমস্ত ঘরের চেহারা অন্যরকম। খাট যেখানে ছিল সেখান হইতে একটুখানি সরানো। ঘরটিকে দুই ভাগ করা হইয়াছে; খাটের সম্মুখে দুটি বড়ো আলনায় কাপড় ঝুলাইয়া দিয়া আড়ালের মতো প্রস্তুত হওয়ায় নীচে বসিবার বিছানা ও রাত্রে শুইবার খাট স্বতন্ত্র হইয়া গেছে। যে আলমারিতে আশার সমস্ত শখের জিনিস চীনের খেলনা প্রভৃতি সাজানো ছিল, সেই আলমারির কাঁচের দরজায় ভিতরের গায়ে লাল সালু কুঞ্চিত করিয়া মারিয়া দেওয়া হইয়াছে; এখন আর তাহার ভিতরের কোনো জিনিস দেখা যায় না। ঘরের মধ্যে তাহার পূর্ব-ইতিহাসের যে-কিছু চিহ্ন ছিল, তাহা নূতন হস্তের নব সজ্জায় সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন হইয়া গেছে।



পরিশ্রান্ত মহেন্দ্র মেঝের উপরকার শু িবিছানায় শুইয়া নূতন বালিশগুলির উপর মাথা রাখিবামাত্র একটি মৃদু সুগন্ধ অনুভব করিল–বালিশের ভিতরকার তুলার সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে নাগকেশর ফুলের রেণু ও কিছু আতর মিশ্রিত ছিল।
মহেন্দ্রের চোখ বুজিয়া আসিল, মনে হইতে লাগিল, এই বালিশের উপর যাহার নিপুণ হস্তের শিল্প, তাহারই কোমল চম্পক-অঙ্গুলির যেন গন্ধ পাওয়া যাইতেছে।
এমন সময় দাসী রূপার রেকাবিতে ফল ও মিষ্ট এবং কাঁচের গ্লাসে বরফ-দেওয়া আনারসের শরবত আনিয়া দিল। এ সমস্তই পূর্বপ্রথা হইতে কিছু বিভিন্ন এবং বহু যত্ন ও পারিপাট্যের সহিত রচিত। সমস্ত স্বাদে গন্ধে দৃশ্যে নূতনত্ব আসিয়া মহেন্দ্রের ইন্দ্রিয়-সকল আবিষ্ট করিয়া তুলিল।



তৃপ্তিপূর্বক ভোজন সমাধা হইলে, রূপার বাটায় পান ও মসলা লইয়া বিনোদিনী ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করিল। হাসিতে হাসিতে কহিল, “এ কয়দিন তোমার খাবার সময় হাজির হইতে পারি নাই, মাপ করিয়ো, ঠাকুরপো। আর যাই কর, আমার মাথার দিব্য রহিল, তোমার অযত্ন হইতেছে, এ খবরটা আমার চোখের বালিকে দিয়ো না। আমার যথাসাধ্য আমি করিতেছি–কিন্তু কী করিব ভাই, সংসারের সমস্ত কাজই আমার ঘাড়ে।”
এই বলিয়া বিনোদিনী পানের বাটা মহেন্দ্রের সম্মুখে অগ্রসর করিয়া দিল। আজিকার পানের মধ্যেও কেয়া খয়েরের একটু বিশেষ নূতন গন্ধ পাওয়া গেল।
মহেন্দ্র কহিল, “যত্নের মাঝে মাঝে এমন এক-একটা ত্রুটি থাকাই ভালো।”
বিনোদিনী কহিল, “ভালো কেন, শুনি।”
মহেন্দ্র উত্তর করিল, “তার পরে খোঁটা দিয়া সুদসুদ্ধ আদায় করা যায়।”
“মহাজন-মহাশয়, সুদ কত জমিল?”
মহেন্দ্র কহিল, “খাবার সময় হাজির ছিলে না, এখন খাবার পরে হাজরি পোষাইয়া আরো পাওনা বাকি থাকিবে।”
বিনোদিনী হাসিয়া কহিল, “তোমার হিসাব যেরকম কড়াক্কড়, তোমার হাতে একবার পড়িলে আর উদ্ধার নাই দেখিতেছি।”
মহেন্দ্র কহিল, “হিসাবে যাই থাক্‌, আদায় কী করিতে পারিলাম।”



বিনোদিনী কহিল, “আদায় করিবার মতো আছে কী। তবু তো বন্দী করিয়া রাখিয়াছ।” বলিয়া ঠাট্টাকে হঠাৎ গাম্ভীর্যে পরিণত করিয়া ঈষৎ একটু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।
মহেন্দ্রও একটু গম্ভীর হইয়া কহিল, “ভাই বালি, এটা কি তবে জেলখানা।”
এমন সময় বেহারা নিয়মমত আলো আনিয়া টিপাইয়ের উপর রাখিয়া চলিয়া গেল।
হঠাৎ চোখে আলো লাগাতে মুখের সামনে একটু হাতের আড়াল করিয়া নতনেত্রে বিনোদিনী বলিল, “কী জানি ভাই। তোমার সঙ্গে কথায় কে পারিবে। এখন যাই, কাজ আছে।”
মহেন্দ্র হঠাৎ তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল, “বন্ধন যখন স্বীকার করিয়াছ তখন যাইবে কোথায়?”
বিনোদিনী কহিল, “ছি ছি, ছাড়ো–যাহার পালাইবার রাস্তা নাই, তাহাকে আবার বাঁধিবার চেষ্টা কেন।”
বিনোদিনী জোর করিয়া হাত ছাড়াইয়া লইয়া প্রস্থান করিল।
মহেন্দ্র সেই বিছানার সুগন্ধ বালিশের উপর পড়িয়া রহিল, তাহার বুকের মধ্যে রক্ত তোলপাড় করিতে লাগিল। নিস্তব্ধ সন্ধ্যা, নির্জন ঘর, নববসন্তের বাতাস দিতেছে, বিনোদিনীর মন যে ধরা দিল-দিল–উন্মাদ মহেন্দ্র আপনাকে আর ধরিয়া রাখিতে পারিবে না, এমনি বোধ হইল। তাড়াতাড়ি আলো নিবাইয়া ঘরের প্রবেশদ্বার বন্ধ করিল, তাহার উপরে শার্সি আঁটিয়া দিল, এবং সময় না হইতেই বিছানার মধ্যে গিয়া শুইয়া পড়িল।
এও তো সে পুরাতন বিছানা নহে। চার-পাঁচখানা তোশকে শয্যাতল পূর্বের চেয়ে অনেক নরম। আবার একটি গন্ধ–সে অগুরুর কি খসখসের, কি কিসের ঠিক বুঝা গেল না। মহেন্দ্র অনেক বার এপাশ-ওপাশ করিতে লাগিল–কোথাও যেন পুরাতনের কোনো একটা নিদর্শন খুঁজিয়া পাইয়া তাহা আঁকড়াইয়া ধরিবার চেষ্টা। কিন্তু কিছুই হাতে ঠেকিল না।



রাত্রি নটার সময় রুদ্ধ দ্বারে ঘা পড়িল। বিনোদিনী বাহির হইতে কহিল, “ঠাকুরপো, তোমার খাবার আসিয়াছে, দুয়ার খোলো।”
তখনই দ্বার খুলিবার জন্য মহেন্দ্র ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া শার্শির অর্গলে হাত লাগাইল। কিন্তু খুলিল না-মেঝের উপর উপুড় হইয়া লুটাইয়া কহিল, “না না, আমার ক্ষুধা নাই, আমি খাইব না।”
বাহির হইতে উদ্‌বিগ্ন কণ্ঠের প্রশ্ন শোনা গেল, “অসুখ করে নি তো? জল আনিয়া দিব? কিছু চাই কি।”
মহেন্দ্র কহিল, “আমার কিছুই চাই না–কোনো প্রয়োজন নাই।”
বিনোদিনী কহিল, “মাথা খাও, আমার কাছে ভাঁড়াইয়ো না। আচ্ছা, অসুখ না থাকে তো একবার দরজা খোলো।”
মহেন্দ্র সবেগে বলিয়া উঠিল, “না খুলিব না, কিছুতেই না। তুমি যাও।”
বলিয়া মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি উঠিয়া পুনর্বার বিছানার মধ্যে গিয়া শুইয়া পড়িল এবং অন্তর্হিতা আশার সমৃতিকে শূন্য শয্যা ও চঞ্চল হৃদয়ের মধ্যে অন্ধকারে খুঁজিয়া বেড়াইতে লাগিল।
ঘুম যখন কিছুতেই আসিতে চায় না; তখন মহেন্দ্র বাতি জ্বালাইয়া দোয়াত কলম লইয়া আশাকে চিঠি লিখিতে বসিল। লিখিল, “আশা, আর অধিক দিন আমাকে একা ফেলিয়া রাখিয়ো না। আমার জীবনের লক্ষ্মী তুমি। তুমি না থাকিলেই আমার সমস্ত প্রবৃত্তি শিকল ছিঁড়িয়া আমাকে কোন্‌ দিকে টানিয়া লইতে চায়, বুঝিতে পারি না। পথ দেখিয়া চলিব, তাহার আলো কোথায়–সে আলো তোমার বিশ্বাসপূর্ণ দুটি চোখের প্রেমস্নিগ্ধ দৃষ্টিপাতে। তুমি শীঘ্র এসো, আমার শুভ, আমার ধ্রুব, আমার এক। আমাকে স্থির করো, রক্ষা করো, আমার হৃদয় পরিপূর্ণ করো। তোমার প্রতি লেশমাত্র অন্যায়ের মহাপাপ হইতে, তোমাকে মুহূর্তকাল বিস্মরণের বিভীষিকা হইতে আমাকে উদ্ধার করো।”



এমনি করিয়া মহেন্দ্র নিজেকে আশার অভিমুখে সবেগে তাড়না করিবার জন্য অনেক রাত ধরিয়া অনেক কথা লিখিল। দূর হইতে সুদূরে অনেকগুলি গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং করিয়া তিনটা বাজিল। কলিকাতার পথে গাড়ির শব্দ আর প্রায় নাই, পাড়ার পরপ্রান্তে কোনো দোতলা হইতে নটীকণ্ঠে বেহাগ-রাগিণীর যে গান উঠিতেছিল সেও বিশ্বব্যাপিনী শান্তি ও নিদ্রার মধ্যে একেবারে ডুবিয়া গেছে। মহেন্দ্র একান্তমনে আশাকে স্মরণ করিয়া এবং মনের উদ্‌বেগ দীর্ঘ পত্রে নানারূপে ব্যক্ত করিয়া অনেকটা সান্ত্বনা পাইল, এবং বিছানায় শুইবামাত্র ঘুম আসিতে তাহার কিছুমাত্র বিলম্ব হইল না।
সকালে মহেন্দ্র যখন জাগিয়া উঠিল, তখন বেলা হইয়াছে, ঘরের মধ্যে রৌদ্র আসিয়াছে। মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিল; নিদ্রার পর গতরাত্রির সমস্ত ব্যাপার মনের মধ্যে হালকা হইয়া আসিয়াছে। বিছানার বাহিরে আসিয়া মহেন্দ্র দেখিল–গতরাত্রে আশাকে সে যে চিঠি লিখিয়াছিল, তাহা টিপাইয়ের উপর দোয়াত দিয়া চাপা রহিয়াছে। সেখানি পুনর্বার পড়িয়া মহেন্দ্র ভাবিল, “করেছি কী। এ যে নভেলি ব্যাপার! ভাগ্যে পাঠাই নাই। আশা পড়িলে কী মনে করিত। সে তো এর অর্ধেক কথা বুঝিতেই পারিত না।” রাত্রে ক্ষণিক কারণে হৃদয়াবেগ যে অসংগত বাড়িয়া উঠিয়াছিল, ইহাতে মহেন্দ্র লজ্জা পাইল; চিঠিখানা টুকরা টুকরা করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিল; সহজ ভাষায় আশাকে একখানি সংক্ষিপ্ত চিঠি লিখিল-



“তুমি আর কত দেরি করিবে। তোমার জেঠামহাশয়ের যদি শীঘ্র ফিরিবার কথা না থাকে, তবে আমাকে লিখিয়ো, আমি নিজে গিয়া তোমাকে লইয়া আসিব। এখানে একলা আমার ভালো লাগিতেছে না।”





২৭
মহেন্দ্র চলিয়া যাওয়ার কিছুদিন পরেই আশা যখন কাশীতে আসিল, তখন অন্নপূর্ণার মনে বড়োই আশঙ্কা জন্মিল। আশাকে তিনি নানাপ্রকারে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, “হাঁ রে চুনি, তুই যে তোর সেই চোখের বালির কথা বলিতেছিলি, তোর মতে, তার মতন এমন গুণবতী মেয়ে আর জগতে নাই?”
“সত্যই মাসি, আমি বাড়াইয়া বলিতেছি না। তার যেমন বুদ্ধি তেমনি রূপ, কাজকর্মে তার তেমনি হাত।”
“তোর সখী, তুই তো তাহাকে সর্বগুণবতী দেখিবি, বাড়ির আর-সকলে তাহাকে কে কী বলে শুনি।”
“মার মুখে তো প্রশংসা ধরে না। চোখের বালি দেশে যাইবার কথা বলিতেই তিনি অস্থির হইয়া ওঠেন। এমন সেবা করিতে কেহ জানে না। বাড়ির চাকর দাসীরও যদি কারো ব্যামো হয় তাকে বোনের মতো, মার মতো যত্ন করে।”
“মহেন্দ্রের মত কী।”
“তাঁকে তো জানই মাসি, নিতান্ত ঘরের লোক ছাড়া আর-কাউকে তাঁর পছন্দই হয় না। আমার বালিকে সকলেই ভালোবাসে, কিন্তু তাঁর সঙ্গে তার আজ পর্যন্ত ভালো বনে নাই।”
“কী রকম।”
“আমি যদি-বা অনেক করিয়া দেখাসাক্ষাৎ করাইয়া দিলাম, তাঁর সঙ্গে তার কথাবার্তাই প্রায় বন্ধ। তুমি তো জান, তিনি কী রকম কুনো–লোকে মনে করে, তিনি অহংকারী, কিন্তু তা নয় মাসি, তিনি দুটি-একটি লোক ছাড়া কাহাকেও সহ্য করিতে পারেন না।”
শেষ কথাটা বলিয়া ফেলিয়া হঠাৎ আশার লজ্জাবোধ হইল, গাল-দুটি লাল হইয়া উঠিল। অন্নপূর্ণা খুশি হইয়া মনে মনে হাসিলেন–কহিলেন, “তাই বটে, সেদিন মহিন যখন আসিয়াছিল, তোর বালির কথা একবার মুখেও আনে নাই।”
আশা দুঃখিত হইয়া কহিল, “ঐ তাঁর দোষ। যাকে ভালোবাসেন না, সে যেন একেবারেই নাই। তাকে যেন একদিনও দেখেন নাই, জানেন নাই, এমনি তাঁর ভাব।”


অন্নপূর্ণা শান্ত স্নিগ্ধ হাস্যে কহিলেন, “আবার যাকে ভালোবাসেন মহিন যেন জন্মজন্মান্তর কেবল তাকেই দেখেন এবং জানেন, এ ভাবও তাঁর আছে। কী বলিস, চুনি।”
আশা তাহার কোনো উত্তর না করিয়া চোখ নিচু করিয়া হাসিল। অন্নপূর্ণা জিজ্ঞাসা করিলেন, “চুনি, বিহারীর কী খবর বল্‌ দেখি। সে কি বিবাহ করিবে না।”
মুহূর্তের মধ্যেই আশার মুখ গম্ভীর হইয়া গেল–সে কী উত্তর দিবে ভাবিয়া পাইল না।
আশার নিরুত্তর ভাবে অত্যন্ত ভয় পাইয়া অন্নপূর্ণা বলিয়া উঠিলেন, “সত্য বল্‌ চুনি, বিহারীর অসুখেিবসুখ কিছু হয় নি তো?”



বিহারী এই চিরপুত্রহীনা রমণীর স্নেহ-সিংহাসনে পুত্রের মানস-আদর্শরূপে বিরাজ করিত। বিহারীকে তিনি সংসারে প্রতিষ্ঠিত দেখিয়া আসিতে পারেন নাই, এ দুঃখ প্রবাসে আসিয়া প্রতিদিন তাঁহার মনে জাগিত। তাঁহার ক্ষুদ্র সংসারের আর-সমস্তই একপ্রকার সম্পূর্ণ হইয়াছে, কেবল বিহারীর সেই গৃহহীন অবস্থা স্মরণ করিয়াই তাঁহার পরিপূর্ণ বৈরাগ্যচর্চার ব্যাঘাত ঘটে।
আশা কহিল, “মাসি, বিহারী-ঠাকুরপোর কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়ো না।”



অন্নপূর্ণা আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন বল্‌ দেখি।”
আশা কহিল, “সে আমি বলিতে পারিব না।” বলিয়া ঘর হইতে উঠিয়া গেল।
অন্নপূর্ণা চুপ করিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন, “অমন সোনার ছেলে বিহারী, এরই মধ্যে তাহার কি এতই বদল হইয়াছে যে, চুনি আজ তাহার নাম শুনিয়া উঠিয়া যায়। অদৃষ্টেরই খেলা। কেন তাহার সহিত চুনির বিবাহের কথা হইল, কেনই-বা মহেন্দ্র তাহার হাতের কাছ হইতে চুনিকে কাড়িয়া লইল।”
অনেক দিন পরে আজ আবার অন্নপূর্ণার চোখ দিয়া জল পড়িল–মনে মনে তিনি কহিলেন, “আহা, আমার বিহারী যদি এমন-কিছু করিয়া থাকে যাহা আমার বিহারীর যোগ্য নহে, তবে সে তাহা অনেক দুঃখ পাইয়াই করিয়াছে, সহজে করে নাই।” বিহারীর সেই দুঃখের পরিমাণ কল্পনা করিয়া অন্নপূর্ণার বক্ষ ব্যথিত হইতে লাগিল।
সন্ধ্যার সময় যখন অন্নপূর্ণা আহ্নিকে বসিয়াছেন, তখন একটা গাড়ি আসিয়া দরজায় থামিল, এবং সহিস বাড়ির লোককে ডাকিয়া রুদ্ধ দ্বারে ঘা মারিতে লাগিল। অন্নপূর্ণা পূজাগৃহ হইতে বলিয়া উঠিলেন, “ঐ যা, আমি একেবারেই ভুলিয়া গিয়াছিলাম, আজ কুঞ্জর শাশুড়ির এবং তার দুই বোনঝির এলাহাবাদ হইতে আসিবার কথা ছিল। ঐ বুঝি তাহারা আসিল। চুনি, তুই একবার আলোটা লইয়া দরজা খুলিয়া দে।”



আশা লণ্ঠন-হাতে দরজা খুলিয়া দিতেই দেখিল, বিহারী দাঁড়াইয়া। বিহারী বলিয়া উঠিল, “এ কী বোঠান, তবে যে শুনিলাম, তুমি কাশী আসিবে না।”
আশার হাত হইতে লণ্ঠন পড়িয়া গেল। সে যেন প্রেতমূর্তি দেখিয়া এক নিশ্বাসে দোতলায় ছুটিয়া গিয়া আর্তস্বরে বলিয়া উঠিল, “মাসিমা, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, উঁহাকে এখনই যাইতে বলো।”
অন্নপূর্ণা পূজার আসন হইতে চমকিয়া উঠিয়া কহিলেন, “কাহাকে চুনি, কাহাকে।”
আশা কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো এখানেও আসিয়াছেন।” বলিয়া সে পাশের ঘরে গিয়া দ্বার রোধ করিল।
বিহারী নীচে হইতে সকল কথাই শুনিতে পাইল। সে তখনই ছুটিয়া যাইতে উদ্যত–কিন্তু অন্নপূর্ণা পূজাহ্নিক ফেলিয়া যখন নামিয়া আসিলেন, তখন দেখিলেন, বিহারী দ্বারের কাছে মাটিতে বসিয়া পড়িয়াছে, তাহার শরীর হইতে সমস্ত শক্তি চলিয়া গেছে।



অন্নপূর্ণা আলো আনেন নাই। অন্ধকারে তিনি বিহারীর মুখের ভাব দেখিতে পাইলেন না, বিহারীও তাঁহাকে দেখিতে পাইল না।
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “বেহারী!”
হায়, সেই চিরদিনের স্নেহসুধাসিক্ত কণ্ঠস্বর কোথায়। এ কণ্ঠের মধ্যে যে কঠিন বিচারের বজ্রধ্বনি প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে। জননী অন্নপূর্ণা, সংহার-খড়গ তুলিলে কার ‘পরে। ভাগ্যহীন বিহারী যে আজ অন্ধকারে তোমার মঙ্গলচরণাশ্রয়ে মাথা রাখিতে আসিয়াছিল।
বিহারীর অবশ শরীর আপাদমস্তক বিদ্যুতের আঘাতে চকিত হইয়া উঠিল, কহিল, “কাকীমা, আর নয়, আর একটি কথাও বলিয়ো না। আমি চলিলাম।”
বলিয়া বিহারী ভূমিতে মাথা রাখিয়া প্রণাম করিল, অন্নপূর্ণার পাও স্পর্শ করিল না। জননী যেমন গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন করে, অন্নপূর্ণা তেমনি করিয়া বিহারীকে সেই রাত্রের অন্ধকারে নীরবে বিসর্জন করিলেন, একবার ফিরিয়া ডাকিলেন না। গাড়ি বিহারীকে লইয়া দেখিতে দেখিতে অদৃশ্য হইয়া গেল।
সেই রাত্রেই আশা মহেন্দ্রকে চিঠি লিখিল-
“বিহারী-ঠাকুরপো হঠাৎ আজ সন্ধ্যাবেলা এখানে আসিয়াছিলেন। জেঠামশায়রা কবে কলিকাতায় ফিরিবেন, ঠিক নাই–তুমি শীঘ্র আসিয়া আমাকে এখান হইতে লইয়া যাও।”






২৮
সেদিন রাত্রিজাগরণ ও প্রবল আবেগের পরে সকালবেলায় মহেন্দ্রের শরীর-মনে একটা অবসাদ উপস্থিত হইয়াছিল। তখন ফাল্গুনের মাঝামাঝি, গরম পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে। মহেন্দ্র অন্যদিন সকালে তাহার শয়নগৃহের কোণে টেবিলে বই লইয়া বসিত। আজ নীচের বিছানায় তাকিয়ায় হেলান দিয়া পড়িল। বেলা হইয়া যায়, স্নানে গেল না। রাস্তা দিয়া ফেরিওয়ালা হাঁকিয়া যাইতেছে। পথে আপিসের গাড়ির শব্দের বিরাম নাই। প্রতিবেশীর নূতন বাড়ি তৈরি হইতেছে, মিসিত্র-কন্যারা তাহারই ছাদ পিটিবার তালে তালে সমস্বরে একঘেয়ে গান ধরিল। ঈষৎ তপ্ত দক্ষিণের হাওয়ায় মহেন্দ্রের পীড়িত স্নায়ুজাল শিথিল হইয়া আসিয়াছে; কোনো কঠিন পণ, দুরূহ চেষ্টা, মানস-সংগ্রাম আজিকার এই হালছাড়া গা-ঢালা বসন্তের দিনের উপযুক্ত নহে।
“ঠাকুরপো, তোমার আজ হল কী। স্নান করিবে না? এ দিকে খাবার যে প্রস্তুত। ও কী ভাই, শুইয়া যে! অসুখ করিয়াছে? মাথা ধরিয়াছে?” বলিয়া বিনোদিনী কাছে আসিয়া মহেন্দ্রের কপালে হাত দিল।
মহেন্দ্র অর্ধেক চোখ বুজিয়া জড়িতকণ্ঠে বলিল, “আজ শরীরটা তেমন ভালো নাই–আজ আর স্নান করিব না।”
বিনোদিনী কহিল, “স্নান না কর তো দুটিখানি খাইয়া লও।” বলিয়া পীড়াপীড়ি করিয়া সে মহেন্দ্রকে ভোজনস্থানে লইয়া গেল এবং উৎকণ্ঠিত যত্নের সহিত অনুরোধ করিয়া আহার করাইল।
আহারের পর মহেন্দ্র পুনরায় নীচের বিছানায় আসিয়া শুইলে, বিনোদিনী শিয়রে বসিয়া ধীরে ধীরে তাহার মাথা টিপিয়া দিতে লাগিল। মহেন্দ্র নিমীলিতচক্ষে বলিল, “ভাই বালি, এখনো তো তোমার খাওয়া হয় নাই, তুমি খাইতে যাও।”



বিনোদিনী কিছুতেই গেল না। অলস মধ্যাহ্নের উত্তপ্ত হাওয়ায় ঘরের পর্দা উড়িতে লাগিল এবং প্রাচীরের কাছে কম্পমান নারিকেলগাছের অর্থহীন মর্মরশব্দ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। মহেন্দ্রের হৃৎপিণ্ড ক্রমশই দ্রুততর তালে নাচিতে লাগিল এবং বিনোদিনীর ঘন নিশ্বাস সেই তালে মহেন্দ্রের কপালের চুলগুলি কাঁপাইতে থাকিল। কাহারো কণ্ঠ দিয়া একটি কথা বাহির হইল না। মহেন্দ্র মনে মনে ভাবিতে লাগিল, “অসীম বিশ্বসংসারের অনন্ত প্রবাহের মধ্যে ভাসিয়া চলিয়াছি, তরণী ক্ষণকালের জন্য কখন কোথায় ঠেকে, তাহাতে কাহার কী আসে যায় এবং কতদিনের জন্যই বা যায় আসে।”
শিয়রের কাছে বসিয়া কপালে হাত বুলাইতে বুলাইতে বিহ্বল যৌবনের গুরুভারে ধীরে ধীরে বিনোদিনীর মাথা নত হইয়া আসিতেছিল; অবশেষে তাহার কেশাগ্রভাগ মহেন্দ্রের কপোল স্পর্শ করিল। বাতাসে আন্দোলিত সেই কেশগুচ্ছের কম্পিত মৃদু স্পর্শে তাহার সমস্ত শরীর বারংবার কাঁপিয়া উঠিল, হঠাৎ যেন নিশ্বাস তাহার বুকের কাছে অবরুদ্ধ হইয়া বাহির হইবার পথ পাইল না। ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া মহেন্দ্র কহিল, “নাঃ আমার কালেজ আছে, আমি যাই।” বলিয়া বিনোদিনীর মুখের দিকে না চাহিয়া দাঁড়াইয়া উঠিল।



বিনোদিনী কহিল, “ব্যস্ত হইয়ো না, আমি তোমার কাপড় আনিয়া দিই।” বলিয়া মহেন্দ্রের কালেজের কাপড় বাহির করিয়া আনিল।
মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি কালেজে চলিয়া গেল, কিন্তু সেখানে কিছুতেই স্থির থাকিতে পারিল না। পড়াশুনায় মন দিতে অনেকক্ষণ বৃথা চেষ্টা করিয়া সকাল সকাল বাড়ি ফিরিয়া আসিল।
ঘরে ঢুকিয়া দেখে, বিনোদিনী বুকের তলায় বালিশ টানিয়া লইয়া নীচের বিছানায় উপুড় হইয়া কী একটা বই পড়িতেছে–রাশীকৃত কালো চুল পিঠের উপর ছড়ানো। বোধ করি বা সে মহেন্দ্রের জুতার শব্দ শুনিতে পায় নাই। মহেন্দ্র আস্তে আস্তে পা টিপিয়া কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। শুনিতে পাইল, পড়িতে পড়িতে বিনোদিনী একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।



মহেন্দ্র কহিল, “ওগো করুণাময়ী, কাল্পনিক লোকের জন্য হৃদয়ের বাজে খরচ করিয়ো না। কী পড়া হইতেছে।”
বিনোদিনী ত্রস্ত হইয়া উঠিয়া বসিয়া তাড়াতাড়ি বইখানা অঞ্চলের মধ্যে লুকাইয়া ফেলিল। মহেন্দ্র কাড়িয়া দেখিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। অনেকক্ষণ হাতাহাতি-কাড়াকাড়ির পর পরাভূত বিনোদিনীর অঞ্চল হইতে মহেন্দ্র বইখানি ছিনাইয়া লইয়া দেখিল–বিষবৃক্ষ। বিনোদিনী ঘন নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে রাগ করিয়া মুখ ফিরাইয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।
মহেন্দ্রের বক্ষঃস্থল তোলপাড় করিতেছিল। অনেক চেষ্টায় সে হাসিয়া কহিল, “ছি ছি, বড়ো ফাঁকি দিলে। আমি ভাবিয়াছিলাম, খুব একটা গোপনীয় কিছু হইবে বা। এত কাড়াকাড়ি করিয়া শেষকালে কিনা বিষবৃক্ষ বাহির হইয়া পড়িল।”
বিনোদিনী কহিল, “আমার আবার গোপনীয় কী থাকিতে পারে, শুনি।”
মহেন্দ্র ফস্‌ করিয়া বলিয়া ফেলিল, “এই মনে করো, যদি বিহারীর কাছ হইতে কোনো চিঠি আসিত?”
নিমেষের মধ্যে বিনোদিনীর চোখে বিদ্যুৎ স্ফুরিত হইল। এতক্ষণ ফুলশর ঘরের কোণে খেলা করিতেছিল, সে যেন দ্বিতীয় বার ভস্মসাৎ হইয়া গেল। মুহূর্তে-প্রজ্বলিত অগ্নিশিখার মতো বিনোদিনী উঠিয়া দাঁড়াইল। মহেন্দ্র তাহার হাত ধরিয়া কহিল, “মাপ করো, আমার পরিহাস মাপ করো।”



বিনোদিনী সবেগে হাত ছিনাইয়া লইয়া কহিল, “পরিহাস করিতেছ কাহাকে। যদি তাঁহার সঙ্গে বন্ধুত্ব করিবার যোগ্য হইতে, তবে তাঁহাকে পরিহাস করিলে সহ্য করিতাম। তোমার ছোটো মন, বন্ধুত্ব করিবার শক্তি নাই, অথচ ঠাট্টা।”
বিনোদিনী চলিয়া যাইতে উদ্যত হইবামাত্র মহেন্দ্র দুই হাতে তাহার পা বেষ্টন করিয়া বাধা দিল। এমন সময়ে সম্মুখে এক ছায়া পড়িল, মহেন্দ্র বিনোদিনীর পা ছাড়িয়া চমকিয়া মুখ তুলিয়া দেখিল, বিহারী।
বিহারী স্থির দৃষ্টিপাতে উভয়কে দগ্ধ করিয়া শান্ত ধীর স্বরে কহিল, “অত্যন্ত অসময়ে উপস্থিত হইয়াছি, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকিব না। একটা কথা বলিতে আসিয়াছিলাম। আমি কাশী গিয়াছিলাম, জানিতাম না, সেখানে বউঠাকরুণ আছেন। না জানিয়া তাঁহার কাছে অপরাধী হইয়াছি; তাঁহার কাছে ক্ষমা চাহিবার অবসর নাই, তাই তোমার কাছে ক্ষমা চাহিতে আসিয়াছি। আমার মনে জ্ঞানে অজ্ঞানে যদি কখনো কোনো পাপ স্পর্শ করিয়া থাকে, সেজন্য তাঁহাকে যেন কখনো কোনো দুঃখ সহ্য করিতে না হয়, তোমার কাছে আমার এই প্রার্থনা।”



বিহারীর কাছে দুর্বলতা হঠাৎ প্রকাশ পাইল বলিয়া মহেন্দ্রের মনটা যেন জ্বলিয়া উঠিল। এখন তাহার ঔদার্যের সময় নহে। সে একটু হাসিয়া কহিল, “ঠাকুরঘরে কলা খাইবার যে গল্প আছে, তোমার ঠিক তাই দেখিতেছি। তোমাকে দোষ স্বীকার করিতেও বলি নাই; অস্বীকার করিতেও বলি নাই; তবে ক্ষমা চাহিয়া সাধু হইতে আসিয়াছ কেন।”
বিহারী কাঠের পুতুলের মতো কিছুক্ষণ আড়ষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল–তার পরে যখন কথা বলিবার প্রবল চেষ্টায় তাহার ঠোঁট কাঁপিতে লাগিল, তখন বিনোদিনী বলিয়া উঠিল, “বিহারী-ঠাকুরপো, তুমি কোনো উত্তর দিয়ো না। কিছুই বলিয়ো না। ঐ লোকটি যাহা মুখে আনিল, তাহাতে উহারই মুখে কলঙ্ক লাগিয়া রহিল, সে কলঙ্ক তোমাকে স্পর্শ করে নাই।”
বিনোদিনীর কথা বিহারীর কানে প্রবেশ করিল কি না সন্দেহ–সে যেন স্বপ্নচালিতের মতো মহেন্দ্রের ঘরের সম্মুখ হইতে ফিরিয়া সিঁড়ি দিয়া নামিয়া যাইতে লাগিল। বিনোদিনী তাহার পশ্চাতে গিয়া কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো, আমাকে কি তোমার কোনো কথা বলিবার নাই। যদি তিরস্কারের কিছু থাকে, তবে তিরস্কার করো।”
বিহারী যখন কোনো উত্তর না করিয়া চলিতে লাগিল, বিনোদিনী সম্মুখে আসিয়া দুই হাতে তাহার দক্ষিণ হাত চাপিয়া ধরিল। বিহারী অপরিসীম ঘৃণার সহিত তাহাকে ঠেলিয়া দিয়া চলিয়া গেল। সেই আঘাতে বিনোদিনী যে পড়িয়া গেল তাহা সে জানিতেও পারিল না।
পতনশব্দ শুনিয়া মহেন্দ্র ছুটিয়া আসিল। দেখিল, বিনোদিনীর বাম হাতের কনুয়ের কাছে কাটিয়া রক্ত পড়িতেছে। মহেন্দ্র কহিল, “ইস্‌, এ যে অনেকটা কাটিয়াছে” বলিয়া তৎক্ষণাৎ নিজের পাতলা জামা খানিকটা টানিয়া



ছিঁড়িয়া ক্ষতস্থানে ব্যাণ্ডেজ বাঁধিতে প্রস্তুত হইল। বিনোদিনী তাড়াতাড়ি হাত সরাইয়া লইয়া কহিল, “না না, কিছুই করিয়ো না, রক্ত পড়িতে দাও।” মহেন্দ্র কহিল, “বাঁধিয়া একটা ঔষধ দিতেছি, তা হইলে আর ব্যথা হইবে না, শীঘ্র সারিয়া যাইবে।” বিনোদিনী সরিয়া গিয়া কহিল, “আমি ব্যথা সারাইতে চাই না, এ কাটা আমার থাক্‌।” মহেন্দ্র কহিল, “আজ অধীর হইয়া তোমাকে আমি লোকের সামনে অপদস্থ করিয়াছি, আমাকে মাপ
করিতে পারিবে কি।”
বিনোদিনী কহিল, “মাপ কিসের জন্য। বেশ করিয়াছ। আমি কি লোককে ভয় করি। আমি কাহাকেও মানি না। যাহারা আঘাত করিয়া ফেলিয়া চলিয়া যায়, তাহারাই কি আমার সব, আর যাহারা আমাকে পায়ে ধরিয়া টানিয়া রাখিতে চায়, তাহারা আমার কেহই নহে?”
মহেন্দ্র উন্মত্ত হইয়া গদগদকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “বিনোদিনী, তবে আমার ভালোবাসা তুমি পায়ে ঠেলিবে না?” বিনোদিনী কহিল, “মাথায় করিয়া রাখিব। ভালোবাসা আমি জন্মাবধি এত বেশি পাই নাই যে, “চাই না” বলিয়া ফিরাইয়া দিতে পারি।”
মহেন্দ্র তখন দুই হাতে বিনোদিনীর দুই হাত ধরিয়া কহিল,”তবে এসো আমার ঘরে। তোমাকে আজ আমি ব্যথা দিয়াছি, তুমিও আমাকে ব্যথা দিয়া চলিয়া আসিয়াছ–যতক্ষণ তাহা একেবারে মুছিয়া না যাইবে, ততক্ষণ আমার খাইয়া শুইয়া কিছুতেই সুখ নাই।”
বিনোদিনী কহিল,”আজ নয়, আজ আমাকে ছাড়িয়া দাও। যদি তোমাকে দুঃখ দিয়া থাকি, মাপ করো।”



মহেন্দ্র কহিল, “তুমিও আমাকে মাপ করো, নহিলে আমি রাত্রে ঘুমাইতে পারিব না।”
বিনোদিনী কহিল,”মাপ করিলাম।”
মহেন্দ্র তখনই অধীর হইয়া বিনোদিনীর কাছে হাতে-হাতে ক্ষমা ও ভালোবাসারএকটা নিদর্শন পাইবার জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিল। কিন্তু বিনোদিনীর মুখের দিকে চাহিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল। বিনোদিনী সিঁড়ি দিয়া নামিয়া চলিয়া গেল–মহেন্দ্রও ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া ছাদে বেড়াইতে লাগিল। বিহারীর কাছে হঠাৎ আজ মহেন্দ্র ধরা পড়িয়াছে, ইহাতে তাহার মনে একটা মুক্তির আনন্দ উপস্থিত হইল। লুকোচুরির যে-একটা ঘৃণ্যতা আছে, একজনের কাছে প্রকাশ হইয়াই যেন তাহা অনেটা দূর হইল। মহেন্দ্র মনে মনে কহিল, “আমি নিজেকে ভালো বলিয়া মিথ্যা করিয়া আর চালাইতে চাহি না–কিন্তু আমি ভালোবািস–আমি ভালোবাসি, সে কথা মিথ্যে নহে।” –নিজের ভালোবাসার গৌরবে তাহার স্পর্ধা এতই বাড়িয়া উঠিল যে, নিজেকে মন্দ বলিয়া সে আপন মনে উদ্ধতভাবে গর্ব করিতে লাগিল। নিস্তব্ধ সন্ধ্যাকলে নীরব-জ্যোতিষ্কমণ্ডলী-অধিরাজিত অনন্ত জগতের প্রতি একটা অবজ্ঞা নিক্ষেপ করিয়া মনে মনে কহিল, “যে আমাকে যত মন্দই মনে করুক, কিন্তু আমি ভালোবাসি।” বলিয়া বিনোদিনীর মানসী মূর্তিকে দিয়া মহেন্দ্র সমস্ত আকাশ, সমস্ত সংসার, সমস্ত কর্তব্য আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। বিহারী হঠাৎ আসিয়া আজ যেন মহেন্দ্রের জীবনের ছিপি-আঁটা মসীপাত্র উলটাইয়া ভাঙিয়া ফেলিল–বিনোদিনীর কালো চোখ এবং কালো চুলের কািল দেখিতে দেখিতে বিস্তৃত হইয়া পূর্বেকার সমস্ত সাদা এবং সমস্ত লেখা লেপিয়া একাকার করিয়া দিল।






২৯
পরদিন ঘুম ভাঙিয়া বিছানা হইতে উঠিবামাত্রই একটি মধুর আবেগে মহেন্দ্রের হৃদয় পূর্ণ হইয়া গেল। প্রভাতের সূর্যালোক যেন তাহার সমস্ত ভাবনায় বাসনায় সোনা মাখাইয়া দিল। কী সুন্দর পৃথিবী, কী মধুময় আকাশ, বাতাস যেন পুষ্পরেণুর মতো সমস্ত মনকে উড়াইয়া লইয়া যাইতেছে।
সকালবেলায় বৈষ্ণব ভিক্ষুক খোল-করতাল বাজাইয়া গান জুড়িয়া দিয়াছিল। দরোয়ান তাড়াইয়া দিতে উদ্যত হইলে মহেন্দ্র দরোয়ানকে ভর্ৎসনা করিয়া তখনই তাহাদিগকে একটা টাকা দিয়া ফেলিল। বেহারা কেরোসিনের ল্যাম্প লইয়া যাইবার সময় অসাবধানে ফেলিয়া দিয়া চুরমার করিল–মহেন্দ্রের মুখের দিকে তাকাইয়া ভয়ে তাহার প্রাণ শুকাইয়া গেল। মহেন্দ্র তিরস্কারমাত্র না করিয়া প্রসন্নমুখে কহিল,”ওরে ওখানটা ভালো করিয়া ঝাঁট দিয়া ফেলিস–যেন কাহারো পায়ে কাঁচ না ফোটে।”
আজ কোনো ক্ষতিকেই ক্ষতি বলিয়া মনে হইল না।
প্রেম এতদিন নেপথ্যের আড়ালে লুকাইয়া বসিয়া ছিল–আজ যে সন্মুখে আসিয়া পর্দা উঠাইয়া দিয়াছে। জগৎসংসারের উপর হইতে আবরণ উঠিয়া গেছে। প্রতিদিনের পৃথিবীর সমস্ত তুচ্ছতা আজ অন্তর্হিত হইল। গাছপালা, পশুপক্ষী, পথের জনতা, নগরের কোলাহল, সকলই আজ অপরূপ। এই বিশ্বব্যাপী নূতনতা এতকাল ছিল কোথায়।
মহেন্দ্রের মনে হইতে লাগিল, আজ যেন বিনোদিনীর সঙ্গে অন্যদিনের মতো সামান্যভাবে মিলন হইবে না। আজ যেন কবিতায় কথা বলিলে এবং সংগীতে ভাব প্রকাশ করিলে, তবে ঠিক উপযুক্ত হয়। আজিকার দিনকে ঐশ্বর্যে সৌন্দর্যে পূর্ণ করিয়া মহেন্দ্র সৃষ্টিছাড়া সমাজছাড়া একটা আরব্য-উপন্যাসের অদ্ভুত দিনের মতো করিয়া তুলিতে চায়। তাহা সত্য হইবে, অথচ স্বপ্ন হইবে–তাহাতে সংসারের কোনো বিধিবিধান, কোনো দায়িত্ব, কোনো বাস্তবিকতা থাকিবে না।


আজ সকাল হইতে মহেন্দ্র চঞ্চল হইয়া বেড়াইতে লাগিল, কালেজে যাইতে পারিল না; কারণ, মিলনের লগ্নটি কখন অকসমাৎ আবির্ভূত হইবে, তাহা তো কোনো পজ্ঞিকায় লেখে না।
গৃহকার্যে রত বিনোদিনীর কণ্ঠস্বর মাঝে মাঝে ভাঁড়ার হইতে, রান্নাঘর হইতে মহেন্দ্রের কানে আসিয়া পৌঁছিতে লাগিল। আজ তাহা মহেন্দ্রের ভালো লাগিল না–আজ সে বিনোদিনীকে মনে মনে সংসার হইতে বহুদূরে স্থাপন করিয়াছে।
সময় কাটিতে চায় না। মহেন্দ্রের স্নানাহার হইয়া গেল–সমস্ত গৃহকর্মের বিরামে মধ্যাহ্ন নিস্তব্ধ হইয়া আসিল। তবু বিনোদিনীর দেখা নাই। দুঃখে এবং সুখে, অধৈর্যে এবং আশায় মহেন্দ্রের মনোযন্ত্রের সমস্ত তারগুলা ঝংকৃত হইতে লাগিল।
কালিকার কাড়াকাড়ি-করা সেই বিষবৃক্ষখানি নীচের বিছানায় পড়িয়া আছে। দেখিবামাত্র সেই কাড়াকাড়ির সমৃতিতে মহেন্দ্রের মনে পুলকাবেশ জাগিয়া উঠিল। বিনোদিনী যে-বালিশ চাপিয়া শুইয়াছিল, সেই বালিশটা টানিয়া লইয়া মহেন্দ্র তাহাতে মাথা রাখিল; এবং বিষবৃক্ষখানি তুলিয়া লইয়া তাহার পাতা উলটাইতে লাগিল। ক্রমে কখন এক সময় পড়ায় মন লাগিয়া গেল, কখনা পাঁচটা বাজিয়া গেল–হুঁশ হইল না।



এমন সময় একটি মোরাদাবাদি খুঞ্চের উপর থালায় ফল ও সন্দেশ এবং রেকাবে বরফচিনিসংযুক্ত সুগন্ধি দলিত খরমুজা লইয়া বিনোদিনী ঘরে প্রবেশ করিল এবং মহেন্দ্রের সম্মুখে রাখিয়া কহিল, “কী করিতেছ, ঠাকুরপো। তোমার হইল কী। পাঁচটা বাজিয়া গেছে, এখনো হাতমুখ-ধোয়া কাপড়-ছাড়া হইল না?”
মহেন্দ্রের মনে একটা ধাক্কা লাগিল। মহেন্দ্রের কী হইয়াছে, সে কি জিজ্ঞাসা করিবার বিষয়। বিনোদিনীর সে কি অগোচর থাকা উচিত। আজিকার দিন কি অন্য দিনেরই মতো। পাছে যাহা আশা করিয়াছিল, হঠাৎ তাহার উলটা কিছু দেখিতে পায়, এই ভয়ে মহেন্দ্র গতকল্যকার কথা স্মরণ করাইয়া কোনো দাবি উত্থাপন করিতে পারিল না।
মহেন্দ্র খাইতে বসিল। বিনোদিনী ছাদে-বিছানো রৌদ্রে-দেওয়া মহেন্দ্রের কাপড়গুলি দ্রুতপদে ঘরে বহিয়া আনিয়া নিপুণ হস্তে ভাঁজ করিয়া কাপড়ের আলমারির মধ্যে তুলিতে লাগিল।



মহেন্দ্র কহিল, “একটু রোসো, আমি খাইয়া উঠিয়া তোমার সাহায্য করিতেছি।”
বিনোদিনী জোড়হাত করিয়া কহিল, “দোহাই তোমার, আর যা কর সাহায্য করিয়ো না।”
মহেন্দ্র খাইয়া উঠিয়া কহিল, “বটে! আমাকে অকর্মণ্য ঠাওরাইয়াছ! আচ্ছা, আজ আমার পরীক্ষা হউক!” বলিয়া কাপড় ভাঁজ করিবার বৃথা চেষ্টা করিতে লাগিল।
বিনোদিনী মহেন্দ্রের হাত হইতে কাপড় কাড়িয়া লইয়া কহিল, “ওগো মশায়, তুমি রাখো, আমার কাজ বাড়াইয়ো না।”
মহেন্দ্র কহিল, “তবে তুমি কাজ করিয়া যাও, আমি দেখিয়া শিক্ষালাভ করি।” বলিয়া আলমারির সম্মুখে বিনোদিনীর কাছে আসিয়া মাটিতে আসন করিয়া বসিল। বিনোদিনী কাপড় ঝাড়িবার ছলে একবার করিয়া মহেন্দ্রের পিঠের উপর আছড়াইয়া কাপড়গুলি পরিপাটিপূর্বক ভাঁজ করিয়া আলমারিতে তুলিতে লাগিল।
আজিকার মিলন এমনি করিয়া আরম্ভ হইল। মহেন্দ্র প্রত্যুষ হইতে যেরূপ কল্পনা করিতেছিল, সেই অপূর্বতার কোনো লক্ষণই নাই। এরূপভাবে মিলন কাব্যে লিখিবার, সংগীতে গাহিবার, উপন্যাসে রচিবার যোগ্য নহে। কিন্তু তবু মহেন্দ্র দুঃখিত হইল না, বরঞ্চ একটু আরাম পাইল। তাহার কাল্পনিক আদর্শকে কেমন করিয়া খাড়া করিয়া রাখিত, কিরূপ তাহার আয়োজন, কী কথা বলিত, কী ভাব প্রকাশ করিতে হইত, সকলপ্রকার সামান্যতাকে কী উপায়ে দূরে রাখিত, তাহা মহেন্দ্র ঠাওরাইতে পারিতেছিল না–এই কাপড় ঝাড়া ও ভাঁজ করার মধ্যে হাসিতামাশা করিয়া সে যেন স্বরচিত একটা অসম্ভব দুরূহ আদর্শের হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া বাঁচিল।



এমন সময় রাজলক্ষ্মী ঘরে প্রবেশ করিলেন। মহেন্দ্রকে কহিলেন, “মহিন, বউ কাপড় তুলিতেছে, তুই ওখানে বসিয়া কী করিতেছিস।”
বিনোদিনী কহিল, “দেখো তো পিসিমা মিছামিছি কেবল আমার কাজে দেরি করাইয়া দিতেছেন।”
মহেন্দ্র কহিল, “বিলক্ষণ। আমি আরো ওঁর কাজে সাহায্য করিতেছিলাম।”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “আমার কপাল! তুই আবার সাহায্য করিবি! জান বউ, মহিনের বরাবর ঐরকম। চিরকাল মা-খুড়ির আদর পাইয়া ও যদি কোনো কাজ নিজের হাতে করিতে পারে।”
এই বলিয়া মাতা পরমস্নেহে কর্মে অপটু মহেন্দ্রের প্রতি নেত্রপাত করিলেন। কেমন করিয়া এই অকর্মণ্য একান্ত মাতৃস্নেহাপেক্ষী বয়স্ক সন্তানটিকে সর্বপ্রকার আরামে রাখিতে পারিবেন, বিনোদিনীর সহিত রাজলক্ষ্মীর সেই একমাত্র পরামর্শ। এই পুত্রসেবাব্যাপারে বিনোদিনীর প্রতি নির্ভর করিয়া তিনি নিতান্ত নিশ্চিন্ত, পরম সুখী। সম্প্রতি বিনোদিনীর মর্যাদা যে মহেন্দ্র বুঝিয়াছে এবং বিনোদিনীকে রাখিবার জন্য তাহার যত্ন হইয়াছে, ইহাতেও রাজলক্ষ্মী আনন্দিত। মহেন্দ্রকে শুনাইয়া শুনাইয়া তিনি কহিলেন, “বউ, আজ তো তুমি মহিনের গরম কাপড় রোদে দিয়া তুলিলে, কাল মহিনের নূতন রুমালগুলিতে উহার নামের অক্ষর সেলাই করিয়া দিতে হইবে। তোমাকে এখানে আনিয়া অবধি যত্ন-আদর করিতে পারিলাম না বাছা, কেবল খাটাইয়া মারিলাম।”



বিনোদিনী কহিল, “পিসিমা, অমন করিয়া যদি বল তবে বুঝিব তুমি আমাকে পর ভাবিতেছ।”
রাজলক্ষ্মী আদর করিয়া কহিলেন, “আহা মা, তোমার মতো আপন আমি পাব কোথায়।”
বিনোদিনীর কাপড়-তোলা শেষ হইলে রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “এখন কি তবে সেই চিনির রসটা চড়াইয়া দিব, না, এখন তোমার অন্য কাজ আছে?”
বিনোদিনী কহিল, “না, পিসিমা, অন্য কাজ আর কই। চলো মিঠাইগুলি তৈরি করিয়া আসি গে।”
মহেন্দ্র কহিল, “মা, এইমাত্র অনুতাপ করিতেছিলে উহাকে খাটাইয়া মারিতেছ, আবার এখনই কাজে টানিয়া লইয়া চলিলে?”
রাজলক্ষ্মী বিনোদিনীর চিবুক স্পর্শ করিয়া কহিলেন, “আমাদের লক্ষ্মী মেয়ে যে কাজ করিতেই ভালোবাসে।”
মহেন্দ্র কহিল, “আজ সন্ধ্যাবেলায় আমার হাতে কোনো কাজ নাই, ভাবিয়াছিলাম বালিকে লইয়া একটা বই পড়িব।”
বিনোদিনী কহিল, “পিসিমা, বেশ তো, আজ সন্ধ্যাবেলা আমরা দুজনেই ঠাকুরপোর বই-পড়া শুনিতে আসিব–কী বল।”



রাজলক্ষ্মী ভাবিলেন, “মহিন আমার নিতান্ত একলা পড়িয়াছে, এখন সকলে মিলিয়া তাহাকে ভুলাইয়া রাখা আবশ্যক।” কহিলেন, “তা বেশ তো, মহিনের খাবার তৈরি শেষ করিয়া আমরা আজ সন্ধ্যাবেলা পড়া শুনিতে আসিব। কী বলিস, মহিন।”
বিনোদিনী মহেন্দ্রের মুখের দিকে কটাক্ষপাত করিয়া একবার দেখিয়া লইল। মহেন্দ্র কহিল, “আচ্ছা।” কিন্তু তাহার আর উৎসাহ রহিল না। বিনোদিনী রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে-সঙ্গেই বাহির হইয়া গেল।
মহেন্দ্র রাগ করিয়া ভাবিল, “আমিও আজ বাহির হইয়া যাইব–দেরি করিয়া বাড়ি ফিরিব।” বলিয়া তখনই বাহিরে যাইবার কাপড় পরিল। কিন্তু সংকল্প কাজে পরিণত হইল না। মহেন্দ্র অনেকক্ষণ ধরিয়া ছাদে পায়চারি করিয়া বেড়াইল, সিঁড়ির দিকে অনেক বার চাহিল, শেষে ঘরের মধ্যে আসিয়া বসিয়া পড়িল। বিরক্ত হইয়া মনে মনে কহিল, “আমি আজ মিঠাই স্পর্শ না করিয়া মাকে জানাইয়া দিব, এত দীর্ঘকাল ধরিয়া চিনির রস জ্বাল দিলে তাহাতে মিষ্টত্ব থাকে না।”



আজ আহারের সময় বিনোদিনী রাজলক্ষ্মীকে সঙ্গে করিয়া আনিল। রাজলক্ষ্মী তাঁহার হাঁপানির ভয়ে প্রায় উপরে উঠিতে চান না, বিনোদিনী তাঁহাকে অনুরোধ করিয়াই সঙ্গে আনিয়াছে। মহেন্দ্র অত্যন্ত গম্ভীর মুখে খাইতে বসিল।
বিনোদিনী কহিল, “ও কী ঠাকুরপো, আজ তুমি কিছুই খাইতেছ না যে!” রাজলক্ষ্মী ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিছু অসুখ করে নাই তো?” বিনোদিনী কহিল, “এত করিয়া মিঠাই করিলাম, কিছু মুখে দিতেই হইবে। ভালো হয় নি বুঝি? তবে
থাক্‌। না না, অনুরোধে পড়িয়া জোর করিয়া খাওয়া কিছু নয়। না না, কাজ নাই।” মহেন্দ্র কহিল, “ভালো মুশকিলেই ফেলিলে। মিঠাইটাই সব চেয়ে খাইবার ইচ্ছা, লাগিতেছেও ভালো,
তুমি বাধা দিলে শুনিব কেন।” দুইটি মিঠাই মহেন্দ্র নিঃশেূর্বক খাইল–তাহার একটি দানা, একটু গুঁড়া পর্যন্ত ফেলিল না। আহারান্তে তিন জনে মহেন্দ্রের শোবার ঘরে আসিয়া বসিলেন। পড়িবার প্রস্তাবটা মহেন্দ্র আর তুলিল না।
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “তুই কী বই পড়িবি বলিয়াছিলি, আরম্ভ কর-না।”
মহেন্দ্র কহিল, “কিন্তু তাহাতে ঠাকুর-দেবতার কথা কিছুই নাই, তোমার শুনিতে ভালো লাগিবে না।”
ভালো লাগিবে না! যেমন করিয়া হোক, ভালো লাগিবার জন্য রাজলক্ষ্মী কৃতসংকল্প। মহেন্দ্র যদি তুর্কি ভাষাও পড়ে, তাঁহার ভালো লাগিতেই হইবে। আহা বেচারা মহিন, বউ কাশী গেছে, একলা পড়িয়া আছে-তোহার যা ভালো লাগিবে মাতার তাহার ভালো না লাগিলে চলিবে কেন।
বিনোদিনী কহিল, “এক কাজ করো-না ঠাকুরপো, পিসিমার ঘরে বাংলা শান্তিশতক আছে, অন্য বই রাখিয়া আজ সেইটে পড়িয়া শোনাও-না। পিসিমারও ভালো লাগিবে, সন্ধ্যাটাও কাটিবে ভালো।” মহেন্দ্র নিতান্ত করুণভাবে একবার বিনোদিনীর মুখের দিকে চাহিল। এমন সময় ঝি আসিয়া খবর দিল, “মা, কায়েত-ঠাকরুন আসিয়া তোমার ঘরে বসিয়া আছেন।”
কায়েত-ঠাকরুন রাজলক্ষ্মীর অন্তরঙ্গ বন্ধু। সন্ধ্যার পর তাঁহার সঙ্গে গল্প করিবার প্রলোভন সংবরণ করা রাজলক্ষ্মীর পক্ষে দুঃসাধ্য। তবু ঝিকে বলিলেন, “কায়েত-ঠাকরুনকে বল্‌, আজ মহিনের ঘরে আমার একটু কাজ আছে, কাল তিনি যেন অবশ্য-অবশ্য করিয়া আসেন।”
মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি কহিল, “কেন মা, তুমি তাঁর সঙ্গে দেখা করিয়াই এসো-না।” বিনোদিনী কহিল, “কাজ কী পিসিমা, তুমি এখানে থাকো, আমি বরঞ্চ কায়েত-ঠাকরুনের কাছে গিয়া বসি গে।”
রাজলক্ষ্মী প্রলোভন সংবরণ করিতে না পারিয়া কহিলেন, “বউ, তুমি ততক্ষণ এখানে বোসো–দেখি, যদি কায়েত-ঠাকরুনকে বিদায় করিয়া আসিতে পারি। তোমারা পড়া আরম্ভ করিয়া দাও–আমার জন্য অপেক্ষা করিয়ো না।”
রাজলক্ষ্মী ঘরের বাহির হইবামাত্র মহেন্দ্র আর থাকিতে পারিল না–বলিয়া উটিল, “কেন তুমি আমাকে ইচ্ছা করিয়া এমন করিয়া মিছামিছি পীড়ন কর।” বিনোদিনী যেন আশ্চর্য হইয়া কহিল, “সে কী, ভাই! আমি তোমাকে পীড়ন কী করিলাম।
তবে কি তোমার ঘরে আসা আমার দোষ হইয়াছে। কাজ নাই, আমি যাই।” বলিয়া বিমর্ষমুখে উঠিবার উপক্রম করিল। মহেন্দ্র তাহার হাত ধরিয়া ফেলিয়া কহিল, “অমনি করিয়াই তো তুমি আমাকে দগ্ধ কর।” বিনোদিনী কহিল, “ইস, আমার যে এত তেজ, তাহা তো আমি জানিতাম না তোমারও তো প্রাণ কঠিন
কম নয়, অনেক সহ্য করিতে পার। খুব যে ঝলসিয়া-পুড়িয়া গেছ, চেহারা দেখিয়া তাহা কিছু বুঝিবার জো নাই।” মহেন্দ্র কহিল, “চেহারায় কী বুঝিবে।” বলিয়া বিনোদিনীর হাত বলপূর্বক লইয়া নিজের বুকের উপর চাপিয়া ধরিল। বিনোদিনী “উঃ” বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিতেই মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি হাত ছাড়িয়া দিয়া কহিল, “লাগিল কি।”
দেখিল, কাল বিনোদিনীর হাতের যেখানটা কাটিয়া গিয়াছিল, সেইখান দিয়া আবার রক্ত পড়িতে লাগিল। মহেন্দ্র অনুতপ্ত হইয়া কহিল, “আমি ভুলিয়া গিয়াছিলাম–ভারি অন্যায় করিয়াছি। আজ কিন্তু এখনই তোমার ও -জায়গাটা বাঁধিয়া ওষুধ লাগাইয়া দিব–কিছুতেই ছাড়িব না।”
বিনোদিনী কহিল, “না, ও কিছুই না। আমি ওষুধ দিব না।” মহেন্দ্র কহিল, “কেন দিবে না।” বিনোদিনী কহিল, “কেন আবার কী। তোমার আর ডাক্তারি করিতে হইবে না, ও যেমন আছে থাক্‌।” মহেন্দ্র মুহূর্তের মধ্যে গম্ভীর হইয়া গেল–মনে মনে কহিল, “কিছুই বুঝিবার জো নাই। স্ত্রীলোকের মন!” বিনোদিনী উঠিল। অভিমানী মহেন্দ্র বাধা না দিয়া কহিল, “কোথায় যাইতেছ।” বিনোদিনী কহিল, “কাজ আছে।” বলিয়া ধীরপদে চলিয়া গেল। মিনিটখানেক বসিয়াই মহেন্দ্র বিনোদিনীকে ফিরাইয়া আনিবার জন্য দ্রুত উঠিয়া পড়িল; সিঁড়ির কাছ পর্যন্ত
গিয়াই ফিরিয়া আসিয়া একলা ছাদে বেড়াইতে লাগিল। বিনোদিনী অহরহ আকর্ষণও করে, অথচ বিনোদিনী এক মুহূর্ত কাছে আসিতেও দেয় না। অন্যে তাহাকে জিনিতে পারে না, এ গর্ব মহেন্দ্রের ছিল, তাহা সে সম্প্রতি বিসর্জন দিয়াছে–কিন্তু চেষ্টা করিলেই অন্যকে সে জিনিতে পারে, এ গর্বটুকুও কি রাখিতে পারিবে না। আজ সে হার মানিল, অথচ হার মানাইতে পারিল না। হৃদয়ক্ষেত্রে মহেন্দ্রের মাথা বড়ো উচ্চেই ছিল–সে কাহাকেও আপনার সমকক্ষ বলিয়া জানিত না–আজ সেইখানেই তাহাকে ধুলায় মাথা লুটাইতে হইল। যে শ্রেষ্ঠতা হারাইল তাহার বদলে কিছু পাইলও না। ভিক্ষুকের মতো রুদ্ধ দ্বারের সম্মুখে সন্ধ্যার সময় রিক্তহস্তে পথে দাঁড়াইয়া থাকিতে হইল।
ফাল্গুন-চৈত্রমাসে বিহারীদের জমিদারি হইতে সরষে-ফুলের মধু আসিত, প্রতিবৎসরই সে তাহা রাজলক্ষ্মীকে পাঠাইয়া দিত–এবারও পাঠাইয়া দিল।
বিনোদিনী মধুভাণ্ড লইয়া স্বয়ং রাজলক্ষ্মীর কাছে গিয়া কহিল, “পিসিমা, বিহারী-ঠাকুরপো মধু পাঠাইয়াছেন।”
রাজলক্ষ্মী তাহা ভাঁড়ারে তুলিয়া রাখিতে উপদেশ দিলেন। বিনোদিনী মধু তুলিয়া আসিয়া রাজলক্ষ্মীর কাছে বসিল। কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো কখনো তোমাদের তত্ত্ব লইতে ভোলেন না। বেচারার নিজের মা নাই নাকি, তাই তোমাকেই মার মতো দেখেন।”
বিহারীকে রাজলক্ষ্মী এমনি মহেন্দ্রের ছায়া বলিয়া জানিতেন যে, তাহার কথা তিনি বিশেষ-কিছু ভাবিতেন না–সে তাঁহাদের বিনা-মূল্যের বিনা-যত্নের বিনা-চিন্তার অনুগত লোক ছিল। বিনোদিনী যখন রাজলক্ষ্মীকে মাতৃহীন বিহারীর মাতৃস্থানীয়া বলিয়া উল্লেখ করিল, তখন রাজলক্ষ্মীর মাতৃহৃদয় অকসমাৎ স্পর্শ করিল। হঠাৎ মনে হইল, “তা বটে, বিহারীর মা নাই এবং আমাকেই সে মার মতো দেখে।”
মনে পড়িল, রোগে তাপে সংকটে বিহারী বরাবর বিনা আহ্বানে, বিনা আড়ম্বরে তাঁহাকে নিঃশব্দ নিষ্ঠার সহিত সেবা করিয়াছে; রাজলক্ষ্মী তাহা নিশ্বাসপ্রশ্বাসের মতো সহজে গ্রহণ করিয়াছেন এবং সেজন্য কাহারো কাছে কৃতজ্ঞ হওয়ার কথা তাঁহার মনেও উদয় হয় নাই। কিন্তু বিহারীর খোঁজখবর কে রাখিয়াছে। যখন অন্নপূর্ণা ছিলেন তিনি রাখিতেন বটে-রোজলক্ষ্মী ভাবিতেন, “বিহারীকে বশে রাখিবার জন্য অন্নপূর্ণা স্নেহের আড়ম্বর করিতেছেন।”
রাজলক্ষ্মী আজ নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “বিহারী আমার আপন ছেলের মতোই বটে।”
বলিয়াই মনে উদয় হইল, বিহারী তাঁহার আপন ছেলের চেয়ে ঢের বেশি করে–এবং কখনো বিশেষ কিছু প্রতিদান না পাইয়াও তাঁহাদের প্রতি সে ভক্তি স্থির রাখিয়াছে। ইহা ভাবিয়া তাঁহার অন্তরের মধ্য হইতে দীর্ঘনিশ্বাস পড়িল।
বিনোদিনী কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো তোমার হাতের রান্না খাইতে বড়ো ভালোবাসেন।”
রাজলক্ষ্মী সস্নেহগর্বে কহিলেন, “আর-কারো মাছের ঝোল তাহার মুখে রোচে না।” বলিতে বলিতে মনে পড়িল, অনেক দিন বিহারী আসে নাই। কহিলেন, “আচ্ছা বউ, বিহারীকে আজকাল দেখিতে পাই না কেন।”
বিনোদিনী কহিল, “আমিও তো তাই ভাবিতেছিলাম, পিসিমা। তা, তোমারছেলেটি বিবাহের পর হইতে নিজের বউকে লইয়াই এমনি মাতিয়া রহিয়াছে–বন্ধুবান্ধবরা আসিয়া আর কী করিবে বলো।”
কথাটা রাজলক্ষ্মীর অত্যন্ত সংগত বোধ হইল। স্ত্রীকে লইয়া মহেন্দ্র তাহার সমস্ত হিতৈষীদের দূর করিয়াছে। বিহারীর তো অভিমান হইতেই পারে–কেন সে আসিবে। বিহারীকে নিজের দলে পাইয়া তাহার প্রতি রাজলক্ষ্মীর সমবেদনা বাড়িয়া উঠিল। বিহারী যে ছেলেবেলা হইতে একান্ত নিঃস্বার্থভাবে মহেন্দ্রের কত উপকার করিয়াছে, তাহার জন্য কতবার কত কষ্ট সহ্য করিয়াছে, সে সমস্ত তিনি বিনোদিনীর কাছে বিবৃত করিয়া বলিতে লাগিলেন–ছেলের উপর তাঁহার নিজের যা নালিশ তা বিহারীর বিবরণ দ্বারা সমর্থন করিতে লাগিলেন। দুদিন বউকে পাইয়া মহেন্দ্র যদি তাহার চিরকালের বন্ধুকে এমন অনাদর করে, তবে সংসারে ন্যায়ধর্ম আর রহিল কোথায়।
বিনোদিনী কহিল, “কাল রবিবার আছে, তুমি বিহারী-ঠাকুরপোকে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াও, তিনি খুশি হইবেন।”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “ঠিক বলিয়াছ বউ, তা হইলে মহিনকে ডাকাই, সে বিহারীকে নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইবে।”
বিনোদিনী। না পিসিমা, তুমি নিজে নিমন্ত্রণ করো। রাজনক্ষ্মী। আমি কি তোমাদের মতো লিখিতে পড়িতে জানি। বিনোদিনী। তা হোক, তোমার হইয়া না-হয় আমিই লিখিয়া দিতেছি। বিনোদিনী রাজলক্ষ্মীর নাম দিয়া নিজেই নিমন্ত্রণ-চিঠি লিখিয়া পাঠাইল।
রবিবার দিন মহেন্দ্রের অত্যন্ত আগ্রহের দিন। পূর্বরাত্রি হইতেই তাহার কল্পনা উদ্দাম হইয়া থাকে, যদিও এ পর্যন্ত তাহার কল্পনার অনুরূপ কিছুই হয় নাই–তবু রবিবারের ভোরের আলো তাহার চক্ষে মধুবর্ষণ করিতে লাগিল। জাগ্রত নগরীর সমস্ত কোলাহল তাহার কানে অপরূপ সংগীতের মতো আসিয়া প্রবেশ করিল।
কিন্তু ব্যাপারখানা কী। মার আজ কোনো ব্রত আছে নাকি! অন্যদিনের মতো বিনোদিনীর প্রতি গৃহকর্মের ভার দিয়া তিনি তো বিশ্রাম করিতেছেন না। আজ তিনি নিজেই ব্যস্ত হইয়া বেড়াইতেছেন।
এই হাঙ্গামে দশটা বাজিয়া গেল–ইতিমধ্যে মহেন্দ্র কোনো ছুতায় বিনোদিনির সঙ্গে এক মুহূর্ত বিরলে দেখা করিতে পারিল না। বই পড়িতে চেষ্টা করিল, পড়ায় কিছুতেই মন বসিল না–খবরের কাগজের একটা অনাবশ্যক বিজ্ঞাপনে পনেরো মিনিট দৃষ্টি আবদ্ধ হইয়া রহিল। আর থাকিতে পারিল না। নীচে গিয়া দেখিল, মা তাঁহার ঘরের বারান্দায় একটা তোলা উনানে রাঁধিতেছেন এবং বিনোদিনী কটিদেশে দৃঢ় করিয়া আঁচল জড়াইয়া জোগান দিতে ব্যস্ত।
মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল,”আজ তোমাদের ব্যাপারটা কী। এত ধুমধাম যে!”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “বউ তোমাকে বলে নাই? আজ যে বিহারীকে নিমন্ত্রণ করিয়াছি।”
বিহারীকে নিমন্ত্রণ! মহেন্দ্রের সর্বশরীর জ্বলিয়া উঠিল। তৎক্ষণাৎ কহিল, “কিন্তু মা, আমি তো থাকিতে পারিব না।” রাজলক্ষ্মী। কেন।
মহেন্দ্র। আমার যে বাহিরে যাইতে হইবে।
রাজলক্ষ্মী। খাওয়াদাওয়া করিয়া যাস, বেশি দেরি হইবে না।
মহেন্দ্র। আমার যে বাহিরে নিমন্ত্রণ আছে।
বিনোদিনী মুহূর্তের জন্য মহেন্দ্রের মুখে কটাক্ষপাত করিয়া কহিল, “যদি নিমন্ত্রণ থাকে, তা হইলে উনি যান-না, পিসিমা। নাহয় আজ বিহারী ঠাকুরপো একলাই খাইবেন।” কিন্তু নিজের হাতের যত্নের রান্না মহিনকে খাওয়াইতে পারিবেন না, ইহা রাজলক্ষ্মীর সহিবে কেন। তিনি যতই পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন, মহিন ততই বাঁকিয়া দাঁড়াইল। “অত্যন্ত জরুরি নিমন্ত্রণ, কিছুতেই কাটাইবার জো নাই–বিহারীকে নিমন্ত্রণ করিবার পূর্বে আমার সহিত পরামর্শ করা উচিত ছিল” ইত্যাদি।
রাগ করিয়া মহেন্দ্র এইরূপে মাকে শান্তি দিবার ব্যবস্থা করিল। রাজলক্ষ্মীর সমস্ত উৎসাহ চলিয়া গেল। তাঁহার ইচ্ছা হইল, রান্না ফেলিয়া তিনি চলিয়া যান। বিনোদিনী কহিল,”পিসিমা, তুমি কিছু ভাবিয়ো না-ঠোকুরপো মুখে আস্ফালন করিতেছেন, কিন্তু আজ উহার বাহিরে নিমন্ত্রণে যাওয়া হইতেছে না।”
রাজলক্ষ্মী মাথা নাড়িয়া কহিলেন, “না বাছা, তুমি মহিনকে জান না, ও যা একবার ধরে তা কিছুতেই ছাড়ে না।”
কিন্তু বিনোদিনী মহেন্দ্রকে রাজলক্ষ্মীর চেয়ে কম জানে না, তাহাই প্রমাণ হইল। মহেন্দ্র বুঝিয়াছিল, বিহারীকে বিনোদিনীই নিমন্ত্রণ করাইয়াছে। ইহাতে তাহার হৃদয় ঈর্ষায় যতই পীড়িত হইতে লাগিল,ততই তাহার পক্ষে দূরে যাওয়া কঠিন হইল। বিহারী কী করে, বিনোদিনী কী করে, তাহা না দেখিয়া সে বাঁচিবে কী করিয়া। দেখিয়া জ্বলিতে হইবে, কিন্তু দেখাও চাই।
বিহারী আজ অনেক দিন পরে নিমন্ত্রিত-আত্মীয়ভাবে মহেন্দ্রের অন্তঃপুরে প্রবেশ করিল। বাল্যকাল হইতে যে ঘর তাহার পরিচিত এবং যেখানে সে ঘরের ছেলের মতো অবারিতভাবে প্রবেশ করিয়া দৌরাত্ন্য করিয়াছে, তাহার দ্বারের কাছে আসিয়া মূহূর্তের জন্য সে থমকিয়া দাঁড়াইল–একটা অশ্রুতরঙ্গ পলকের মধ্যে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিবার জন্য তাহার বক্ষকবাটে আঘাত করিল। সেই আঘাত সংবরণ করিয়া লইয়া সে স্মিতহাস্যে ঘরে প্রবেশ করিয়া সদ্যঃস্নাতা রাজলক্ষ্মীকে প্রণাম করিয়া তাঁহার পায়ের ধুলা লইল। বিহারী যখন সর্বদা যাতায়াত করিত তখন এরূপ অভিবাদন তাহাদের প্রথা ছিল না।
আজ যেন সে বহুদূর প্রবাস হইতে পুনর্বার ঘরে ফিরিয়া আসিল। বিহারী প্রণাম করিয়া উঠিবার সময় রাজলক্ষ্মী সস্নেহে তাহার মাথায় হস্তস্পর্শ করিলেন।
রাজলক্ষ্মী আজ নিগূঢ় সহানুভূতিবশত বিহারীর প্রতি পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি আদর ও স্নেহ প্রকাশ করিলেন। কহিলেন,”ও বেহারি, তুই এতদিন আসিস নাই কেন। আমি রোজ মনে করিতাম, আজ, নিশ্চয় বেহারি আসিবে, কিন্তু তোর আর দেখা নাই।”
বিহারী হাসিয়া কহিল,”রোজ আসিলে তো তোমার বিহারীকে রোজ মনে করিতে না, মা। মহিনদা কোথায়।”
রাজলক্ষ্মী বিমর্ষ হইয়া কহিলেন,”মহিনের আজ কোথায় নিমন্ত্রণ আছে, সে আজ কিছুতেই থাকিতে পারিল না।”
শুনিবামাত্র বিহারীর মনটা বিকল হইয়া গেল। আশৈশব প্রণয়ের শেষ এই পরিণাম? একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মন হইতে সমস্ত বিষাদবাষ্প উপস্থিতমত তাড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিয়া বিহারী জিজ্ঞাসা করিল, “আজ কী রান্না হইয়াছে শুনি।” বলিয়া তাহার নিজের প্রিয় ব্যঞ্জনগুলির কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। রাজলক্ষ্মীর রন্ধনের দিন বিহারী কিছু অতিরিক্ত আড়ম্বর করিয়া নিজেকে লুব্ধ বলিয়া পরিচয় দিত-আহারলোলুপতা দেখাইয়া বিহারী মাতৃহৃদয়শালিনী রাজলক্ষ্মীর স্নেহ কাড়িয়া লইত। আজও তাঁহার স্বরচিত ব্যঞ্জন সম্বন্ধে বিহারীর অতিমাত্রায় কৌতূহল দেখিয়া, রাজলক্ষ্মী হাসিতে হাসিতে তাঁহার লোভাতুর অতিথিকে আশ্বাস দিলেন।
এমন সময় মহেন্দ্র আসিয়া বিহারীকে শুষ্কস্বরে দস্তুরমত জিজ্ঞাসা করিল, “কী বিহারী, কেমন আছ।”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “কই মহিন, তুই তোর নিমন্ত্রণে গেলি না?”
মহেন্দ্র লজ্জা ঢাকিতে চেষ্টা করিয়া কহিল, “না, সেটা কাটাইয়া দেওয়া গেছে।”
স্নান করিয়া আসিয়া বিনোদিনী যখন দেখা দিল, তখন বিহারী প্রথমটা কিছুই বলিতে পারিল না। বিনোদিনী ও মহেন্দ্রের যে-দৃশ্য সে দেখিয়াছিল, তাহা তাহার মনে মুদ্রিত ছিল।
বিনোদিনী বিহারীর অনতিদূরে আসিয়া মৃদুস্বরে কহিল, “কী ঠাকুরপো, একেবারে চিনিতেই পার না নাকি।”
বিহারী কহিল, “সকলকেই কি চেনা যায়।”
বিনোদিনী কহিল, “একটু বিবেচনা থাকিলেই যায়।” বলিয়া খবর দিল, “পিসিমা, খাবার প্রস্তুত হইয়াছে।”
মহেন্দ্র-বিহারী খাইতে বসিল; রাজলক্ষ্মী অদূরে বসিয়া দেখিতে লাগিলেন এবং বিনোদিনী পরিবেশন করিতে লাগিল।
মহেন্দ্রের খাওয়ার মনোযোগ ছিল না, সে কেবল পরিবেশনে পক্ষপাত লক্ষ্য করিতে লাগিল। মহেন্দ্রের মনে হইল, বিহারীকে পরিবেশন করিয়া বিনোদিনী যেন একটা বিশেষ সুখ পাইতেছে। বিহারীর পাতেই যে বিশেষ করিয়া মাছের মুড়া ও দধির সর পড়িল, তাহার উত্তম কৈফিয়ত ছিল–মহেন্দ্র ঘরের ছেলে, বিহারী নিমন্ত্রিত। কিন্তু মুখ ফুটিয়া নালিশ করিবার ভালো হেতুবাদ ছিল না বলিয়াই মহেন্দ্র আরো বেশি করিয়া জ্বলিতে লাগিল।
অসময়ে বিশেষ সন্ধানে তপসিমাছ পাওয়া গিয়াছিল, তাহার মধ্যে একটি ডিমওয়ালা ছিল; সেই মাছটি বিনোদিনী বিহারীর পাতে দিতে গেলে বিহারী কহিল, “না না, মহিনদাকে দাও, মহিনদা ভালোবাসে।” মহেন্দ্র তীব্র অভিমানে বলিয়া উঠিল, “না না, আমি চাই না।” শুনিয়া বিনোদিনী দ্বিতীয় বার অনুরোধ মাত্র না করিয়া সে-মাছ বিহারীর পাতে ফেলিয়া দিল।
আহারান্তে দুই বন্ধু উঠিয়া ঘরের বাহিরে আসিলে বিনোদিনী তাড়াতাড়ি আসিয়া কহিল, “বিহারী ঠাকুরপো, এখনই যাইয়ো না, উপরের ঘরে একটু বসিবে চলো।”
বিহারী কহিল, “তুমি খাইতে যাইবে না?”
বিনোদিনী কহিল, “না, আজ একাদশী।”
নিষ্ঠুর বিদ্রূপের একটি সূক্ষ্ম হাস্যরেখা বিহারীর ওষ্ঠপ্রান্তে দেখা দিল–তাহার অর্থ এই যে, একাদশীকেরাও আছে। অনুষ্ঠানের ত্রুটি নাই।
সেই হাস্যের আভাসটুকু বিনোদিনীর দৃষ্টি এড়ায় নাই–তবু সে যেমন তাহার হাতের কাটা ঘা সহ্য করিয়াছিল; তেমনি করিয়া ইহাও সহ্য করিল। নিতান্ত মিনতির স্বরে কহিল, “আমার মাথা খাও, একবার বসিবে চলো।”
মহেন্দ্র হঠাৎ অসংগতভাবে উত্তেজিত হইয়া বলিয়া উঠিল, “তোমাদের কিছুই তো বিবেচনা নাই–কাজ থাক্‌ কর্ম থাক্‌, ইচ্ছা থাক্‌ বা না থাক্‌, তবু বসিতেই হইবে। এত অধিক আদরের আমি তো কোনো মানে বুঝিতে পারি না।”
বিনোদিনী উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল। কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো, শোনো একবার, তোমার মহিনদার কথা শোনো। আদরের মানে আদর, অভিধানে তাহার আর কোনো দ্বিতীয় মানে লেখে না।” (মহেন্দ্রের প্রতি) “যাই বল ঠাকুরপো, অধিক আদরের মানে শিশুকাল হইতে তুমি যত পরিষ্কার বোঝ, এমন আর কেহ বোঝে না।”
বিহারী কহিল, “মহিনদা, একটা কথা আছে, একবার শুনিয়া যাও।” বলিয়া বিহারী বিনোদিনীকে কোনো বিদায়সম্ভাষণ না করিয়া মহেন্দ্রকে লইয়া বাহিরে গেল। বিনোদিনী বারান্দার রেলিং ধরিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া শূন্য উঠানের শূন্যতার দিকে তাকাইয়া রহিল।
বিহারী বাহিরে আসিয়া কহিল, “মহিনদা, আমি জানিতে চাই, এইখানে কি আমাদের বন্ধুত্ব শেষ হইল।”
মহেন্দ্রের বুকের ভিতর তখন জ্বলিতেছিল, বিনোদিনীর পরিহাস-হাস্য বিদ্যুৎশিখার মতো তাহার মস্তিকের এক প্রান্ত হইতে আর-এক প্রান্ত বারংবার ফিরিয়া ফিরিয়া বিঁধিতেছিল–সে কহিল, “মিটমাট হইলে তোমার তাহাতে বিশেষ সুবিধা হইতে পারে, কিন্তু আমার কাছে তাহা প্রার্থনীয় বোধ হয় না। আমার সংসারের মধ্যে আমি বাহিরের লোক ঢুকাইতে চাই না–অন্তঃপুরকে আমি অন্তঃপুর রাখিতে চাই।”
বিহারী কিছু না বলিয়া চলিয়া গেল।
ঈর্ষাজর্জর মহেন্দ্র একবার প্রতিজ্ঞা করিল, “বিনোদিনীর সঙ্গে দেখা করিব না”–তাহার পরে বিনোদিনীর সহিত সাক্ষাতের প্রত্যাশায় ঘরে-বাহিরে, উপরে-নীচে ছটফট করিয়া বেড়াইতে লাগিল।




৩০
আশা একদিন অন্নপূর্ণাকে জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা মাসিমা, মেসোমশায়কে তোমার মনে পড়ে?”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “আমি এগারো বৎসর বয়সে বিধবা হইয়াছি, স্বামীর মূর্তি ছায়ার মতো মনে হয়।”
আশা জিজ্ঞাসা করিল, “মাসি, তবে তুমি কাহার কথা ভাব।”
অন্নপূর্ণা ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “আমার স্বামী এখন যাঁহার মধ্যে আছেন, সেই ভগবানের কথা ভাবি।”
আশা কহিল, “তাহাতে তুমি সুখ পাও?”
অন্নপূর্ণা সস্নেহে আশার মাথায় হাত বুলাইয়া কহিলেন, “আমার সে মনের কথা তুই কি বুঝবি বাছা। সে আমার মন জানে, আর যাঁর কথা ভাবি তিনিই জানেন।”
আশা মনে মনে ভাবিতে লাগিল, “আমি যাঁর কথা রাত্রিদিন ভাবি, তিনি কি আমার মনের কথা জানেন না। আমি ভালো করিয়া চিঠি লিখিতে পারি না বলিয়া তিনি কেন আমাকে চিঠি লেখা ছাড়িয়া দিয়াছেন।”
আশা কয়দিন মহেন্দ্রের চিঠি পায় নাই। নিশ্বাস ফেলিয়া মনে মনে সে ভাবিল, “চোখের বালি যদি হাতের কাছে থাকিত, সে আমার মনের কথা ঠিকমতো করিয়া লিখিয়া দিতে পারিত।”
কুলিখিত তুচ্ছপত্র স্বামীর কাছে আদর পাইবে না মনে করিয়া চিঠি লিখিতে কিছুতে আশার হাত সরিত না। যতই যত্ন করিয়া লিখিতে চাহিত, ততই তাহার অক্ষর খারাপ হইয়া যাইত। মনের কথা যতই ভালো করিয়া গুছাইয়া লইবার চেষ্টা করিত ততই তাহার পদ কোনোমতেই সম্পূর্ণ হইত না। যদি একটিমাত্র “শ্রীচরণেষু” লিখিয়া নাম সহি করিলেই মহেন্দ্র অন্তর্যামী দেবতার মতো সকল কথা বুঝিতে পারিত, তাহা হইলেই আশার চিঠিলেখা সার্থক হইত। বিধাতা এতখানি ভালোবাসা দিয়াছিলেন, একটুখানি ভাষা দেন নাই কেন।
মন্দিরে সন্ধ্যারতির পরে গৃহে ফিরিয়া আসিয়া আশা অন্নপূর্ণার পায়ের কাছে বসিয়া আস্তে আস্তে তাঁহার পায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। অনেকক্ষণ নিঃশব্দের পর বলিল, “মাসি, তুমি যে বল, স্বামীকে দেবতার মতো করিয়া সেবা করা স্ত্রীর ধর্ম, কিন্তু যে স্ত্রী মূর্খ, যাহার বুদ্ধি নাই, কেমন করিয়া স্বামীর সেবা করিতে হয় যে জানে না, সে কী করিবে।”


অন্নপূর্ণা কিছুক্ষণ আশার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন–একটি চাপা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “বাছা, আমিও তো মূর্খ, তবুও তো ভগবানের সেবা করিয়া থাকি।”
আশা কহিল, “তিনি যে তোমার মন জানেন, তাই খুশি হন। কিন্তু মনে করো, স্বামী যদি মূর্খের সেবায় খুশি না হন?”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “সকলকে খুশি করিবার শক্তি সকলের থাকে না, বাছা। স্ত্রী যদি আন্তরিক শ্রদ্ধাভক্তিযত্নের সঙ্গে স্বামীর সেবা ও সংসারের কাজ করে, তবে স্বামী তাহা তুচ্ছ করিয়া ফেলিয়া দিলেও স্বয়ং জগদীশ্বর তাহা কুড়াইয়া লন।”



আশা নিরুত্তরে চুপ করিয়া রহিল। মাসির এই কথা হইতে সান্ত্বনা গ্রহণের অনেক চেষ্টা করিল, কিন্তু স্বামী যাহাকে তুচ্ছ করিয়া ফেলিয়া দিবেন, জগদীশ্বরও যে তাহাকে সার্থকতা দিতে পারিবেন, এ কথা কিছুতেই তাহার মনে হইল না। সে নতমুখে বসিয়া তাহার মাসির পায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল।
অন্নপূর্ণা তখন আশার হাত ধরিয়া তাহাকে আরো কাছে টানিয়া লইবেন। তাহার মস্তক চুম্বন করিলেন; রুদ্ধকণ্ঠকে দৃঢ়চেষ্টায় বাধামুক্ত করিয়া কহিলেন, “চুনি, দুঃখে কষ্টে যে শিক্ষালাভ হয় শুধু কানে শুনিয়া তাহা পাইবি না। তোর এই মাসিও একদিন তোর বয়সে তোরই মতো সংসারের সঙ্গে মস্ত করিয়া দেনাপাওনার সম্পর্ক পাতিয়া বসিয়াছিল। তখন আমিও তোরই মতো মনে করিতাম, যাহার সেবা করিব তাহার সন্তোষ না জন্মিবে কেন। যাহার পূজা করিব তাহার প্রসাদ না পাইব কেন। যাহার ভালোর চেষ্টা করিব, সে আমার চেষ্টাকে ভালো বলিয়া না বুঝিবে কেন। পদে পদে দেখিলাম, সেরূপ হয় না। অবশেষে একদিন অসহ্য হইয়া মনে হইল, পৃথিবীতে আমার সমস্তই ব্যর্থ হইয়াছে–সেইদিনই সংসার ত্যাগ করিয়া আসিলাম। আজ দেখিতেছি, আমার কিছুই নিষ্ফল হয় নাই। ওরে বাছা, যাঁর সঙ্গে আসল দেনাপাওনার সম্পর্ক, যিনি এই সংসার-হাটের মূল মহাজন, তিনিই আমার সমস্তই লইতেছিলেন, হৃদয়ে বসিয়া আজ সে কথা স্বীকার করিয়াছেন। তখন যদি জানিতাম! যদি তাঁর কর্ম বলিয়া সংসারের কর্ম করিতাম, তাঁকে দিলাম বলিয়াই সংসারকে হৃদয় দিতাম,তা হইলে কে আমাকে দুঃখ দিতে পারিত।”



আশা বিছানায় শুইয়া শুইয়া অনেক রাত্রি পর্যন্ত অনেক কথা ভাবিল, তবু ভালো করিয়া কিছুই বুঝিতে পারিল না। কিন্তু পুণ্যবতী মাসির প্রতি তাহার অসীম ভক্তি ছিল, সেই মাসির কথা সম্পূর্ণ না বুঝিলেও একপ্রকার শিরোধার্য করিয়া লইল। মাসি সকল সংসারের উপরে যাঁহাকে হৃদয়ে স্থান দিয়াছেন, তাঁহার উদ্দেশে অন্ধকারে বিছানায় উঠিয়া বসিয়া গড় করিয়া প্রণাম করিল। বলিল, “আমি বালিকা, তোমাকে জানি না, আমি কেবল আমার স্বামীকে জানি, সেজন্য অপরাধ লইয়ো না। আমার স্বামীকে আমি যে পূজা দিই, ভগবান, তুমি তাঁহাকে তাহা গ্রহণ করিতে বলিয়ো তিনি যদি তাহা পায়ে ঠেলিয়া দেন, তবে আর বাঁচিব না। আমি আমার মাসিমার মতো পুণ্যবতী নই, তোমাকে আশ্রয় করিয়া আমি রক্ষা পাইব না।” এই বলিয়া আশা বার বার বিছানার উপর গড় করিয়া প্রণাম করিল।
আশার জেঠামশায়ের ফিরিবার সময় হইল। বিদায়ের পূর্বসন্ধ্যায় অন্নপূর্ণা আশাকে আপনার কোলে বসাইয়া কহিলেন, “চুনি, মা আমার, সংসারের শোক-দুঃখ-অমঙ্গল হইতে তোকে সর্বদা রক্ষা করিবার শক্তি আমার নাই। আমার এই উপবেশ, যেখান থেকে যত কষ্টই পাস, তোর বিশ্বাস তোর ভক্তি স্থির রাখিস, তোর ধর্ম যেন অটল থাকে।”
আশা তাঁহার পায়ের ধূলা লইয়া কহিল, “আশীর্বাদ করো মাসিমা, তাই হইবে।”

0 comments:

Post a Comment