চোখের-বালি (51-55)


৫১

হিমালয়শিখর যে যমুনাকে তুষারস্রুত অক্ষয় জলধারা দিতেছে, কতকালের কবিরা মিলিয়া সেই যমুনার মধ্যে যে কবিত্বস্রোত ঢালিয়ছেন, তাহাও অক্ষয়। ইহার কল-ধ্বনির মধ্যে কত বিচিত্র ছন্দ ধ্বনিত এবং ইহার তরঙ্গলীলায় কতকালের পুলকোচ্ছ্বসিত ভাবাবেগ উদ্‌বেলিত হইয়া উঠিতেছে।
প্রদোষে সেই যমুনাতীরে মহেন্দ্র আসিয়া যখন বসিল, তখন ঘনীভূত প্রেমের আবেশ তাহার দৃষ্টিতে, তাহার নিশ্বাসে, তাহার শিরায়, তাহার অস্থিগুলির মধ্যে প্রগাঢ মোহরসপ্রবাহ সঞ্চার করিয়া দিল। আকাশে সূর্যাস্তকিরণের স্বর্ণবীণা বেদনার মূর্ছনায় অলোকশ্রুত সংগীতে ঝংকৃত হইয়া উঠিল।
বিস্তীর্ণ নির্জন বালুতটে বিচিত্র বর্ণচ্ছটায় দিন ধীরে ধীরে অবসান হইয়া গেল। মহেন্দ্র চক্ষু অর্ধেক মুদ্রিত করিয়া কাব্যলোক হইতে গোখুর-ধূলিজালের মধ্যে বৃন্দাবনের ধেনুদের গোষ্ঠে প্রত্যাবর্তনের হাম্বারব শুনিতে পাইল।
বর্ষার মেঘে আকাশ আচ্ছন্ন হইয়া আসিল। অপরিচিত স্থানের অন্ধকার কেবল কৃষ্ণবর্ণের আবরণ মাত্র নহে, তাহা বিচিত্র রহস্যে পরিপূর্ণ। তাহার মধ্য দিয়া যেটুকু আভা যেটুকু আকৃতি দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা অজ্ঞাত অনুচ্চারিত ভাষায় কথা কহে। পরপারবর্তী বালুকার অস্ফুট পাণ্ডুরতা, নিস্তরঙ্গ জলের মসীকৃষ্ণ কালিমা, বাগানে ঘনপল্লব বিপুল নিম্ববৃক্ষের পুজ্ঞীভূত স্তব্ধতা, তরুহীন মলান ধূসর তটের বঙ্কিম রেখা, সমস্ত সেই আষাঢ়-সন্ধ্যার অন্ধকারে বিবিধ অনির্দিষ্ট অপরিস্ফুট আকারে মিলিত হইয়া মহেন্দ্রকে চারি দিকে বেষ্টন করিয়া ধরিল।




পদাবলীর বর্ষাভিসার মহেন্দ্রের মনে পড়িল। অভিসারিকা বাহির হইয়াছে। যমুনার ঐ তটপ্রান্তে সে একাকিনী আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। পার হইবে কেমন করিয়া। “ওগো পার করো গো,পার করো”–মহেন্দ্রের বুকের মধ্যে এই ডাক আসিয়া পৌঁছিতেছে–”ওগো, পার করো।”
নদীর পরপারে অন্ধকারে সেই অভিসারিণী বহুদূরে–তবু মহেন্দ্র তাহাকে স্পষ্ট দেখিতে পাইল। তাহার কাল নাই তাহার বয়স নাই, সে চিরন্তন গোপবালা–কিন্তু তবু মহেন্দ্র তাহাকে চিনিল–সে এই বিনোদিনী! সমস্ত বিরহ, সমস্ত বেদনা, সমস্ত যৌবনভার লইয়া তখনকার কাল হইতে সে অভিসারে যাত্রা করিয়া, কত গান কত ছন্দের মধ্য দিয়া এখনকার কালের তীরে আসিয়া উত্তীর্ণ হইয়াছে–আজিকার এই জনহীন যমুনাতটের উপরকার আকাশে তাহারই কণ্ঠস্বর শুনা যাইতেছে–”ওগো,পার করো গো”–খেয়া-নৌকার জন্য সে এই অন্ধকারে আর কতকাল এমন একলা দাঁড়াইয়া থাকিবে–”ওগো, পার করো।”




মেঘের এক প্রান্ত অপসারিত হইয়া কৃষ্ণপক্ষের তৃতীয়ার চাঁদ দেখা দিল। জ্যোৎস্নার মায়ামন্ত্রে সেই নদী ও নদীতীর, সেই আকাশ ও আকাশের সীমান্ত, পৃথিবীর অনেকবাহিরে চলিয়া গেল। মর্তের কোনো বন্ধন রহিল না। কালের সমস্ত ধরাবাহিকতা ছিঁড়িয়া গেল–অতীতকালের সমস্ত ইতিহাস লুপ্ত, ভবিষ্যৎ কালের সমস্ত ফলাফল অন্তর্হিত–শুধু এই রজতধারা-প্লাবিত বর্তমানটুকু যমুনা ও যমুনাতটের মধ্যে মহেন্দ্র ও বিনোদিনীকে লইয়া বিশ্ববিধানের বাহিরে চিরস্থায়ী।
মহেন্দ্র মাতাল হইয়া উঠিল। বিনোদিনী যে তাহাকে প্রত্যাখ্যান করিবে, জ্যোৎস্নারাত্রির এই নির্জন স্বর্গখণ্ডকে লক্ষ্মীরূপে সম্পূর্ণ করিয়া তুলিবে না, ইহা সে কল্পনা করিতে পারিল না। তৎক্ষণাৎ উঠিয়া সে বিনোদিনীকে খুঁজিতে বাড়ির দিকে চলিয়া গেল।




শয়নগৃহে আসিয়া দেখিল, ঘর ফুলের গন্ধে পূর্ণ। উন্মুক্ত জানালা-দরজা দিয়া জ্যোৎস্নার আলো শুভ্র বিছানার উপর আসিয়া পড়িয়াছে। বিনোদিনী বাগান হইতে ফুল তুলিয়া মালা গাঁথিয়া খোঁপায় পরিয়াছে, গলায় পরিয়াছে, কটিতে বাঁধিয়াছে–ফুলে ভূষিত হইয়া সে বসন্তকালের পুষ্পভারলুণ্ঠিত লতাটির ন্যায় জ্যোৎস্নায় বিছানার উপরে পড়িয়া আছে।
মহেন্দ্রের মোহ দ্বিগুণ হইয়া উঠিল। সে অবরুদ্ধকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “বিনোদ, আমি যমুনার ধারে অপেক্ষা করিয়া বসিয়া ছিলাম, তুমি যে এখানে অপেক্ষা করিয়া আছ, আকাশের চাঁদ আমাকে সেই সংবাদ দিল, তাই আমি চলিয়া আসিলাম।”
এই কথা বলিয়া মহেন্দ্র বিছানায় বসিবার জন্য অগ্রসর হইল।
বিনোদিনী তাড়াতাড়ি চকিত হইয়া উঠিয়া দক্ষিণবাহু প্রসারিত করিয়া কহিল, “যাও যাও, তুমি এ বিছানায় বসিয়ো না।”
ভরাপালের নৌকা চড়ার ঠেকিয়া গেল–মহেন্দ্র স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইল। অনেকক্ষণ তাহার মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। পাছে মহেন্দ্র নিষেধ না মানে, এইজন্য বিনোদিনী শয্যা ছাড়িয়া আসিয়া দাঁড়াইল।
মহেন্দ্র কহিল, “তবে তুমি কাহার জন্য সাজিয়াছ। কাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছ।”




বিনোদিনী আপনার বুক চাপিয়া ধরিয়া কহিল, “যাহার জন্য সাজিয়াছি, সে আমার অন্তরের ভিতরে আছে।”
মহেন্দ্র কহিল, “সে কে। সে বিহারী?”
বিনোদিনী কহিল, “তাহার নাম তুমি মুখে উচ্চারণ করিয়ো না।”
মহেন্দ্র। তাহারই জন্য তুমি পশ্চিমে ঘুরিয়া বেড়াইতেছ?
বিনোদিনী। তাহারই জন্য।
মহেন্দ্র। তাহারই জন্য তুমি এখানে অপেক্ষা করিয়া আছ? বিনোদিনী। তাহারই জন্য। মহেন্দ্র। তাহার ঠিকানা জানিয়াছ? বিনোদিনী। জানি না, কিন্তু যেমন করিয়া হউক, জানিবই। মহেন্দ্র। কোনোমতেই জানিতে দিব না। বিনোদিনী। না যদি জানিতে দাও, আমার হৃদয় হইতে তাহাকে কোনোমতেই বাহির করিতে পারিবে না। এই বলিয়া বিনোদিনী চোখ বুজিয়া আপনার হৃদয়ের মধ্যে বিহারীকে একবার অনুভব করিয়া লইল। মহেন্দ্র সেই পুষ্পাভরণা বিরহবিধুরমূর্তি বিনোদিনীর দ্বারা একই কালে প্রবলবেগে আকৃষ্ট ও প্রত্যাখ্যাত
হইয়া হঠাৎ ভীষণ হইয়া উঠিল–মুষ্টি বদ্ধ করিয়া কহিল, “ছুরি দিয়া কাটিয়া তোমার বুকের ভিতর হইতে তাহাকে বাহির করিব।” বিনোদিনী অবিচলিতমুখে কহিল, “তোমার ভালোবাসার চেয়ে তোমার ছুরি আমার হৃদয়ে সহজে প্রবেশ




করিবে।” মহেন্দ্র। তুমি আমাকে ভয় কর না কেন, এখানে তোমার রক্ষক কে আছে। বিনোদিনী। তুমি আমার রক্ষক আছ। তোমার নিজের কাছ হইতে তুমি আমাকে রক্ষা করিবে। মহেন্দ্র। এইটুকু শ্রদ্ধা, এইটুকু বিশ্বাস, এখনো বাকি আছে! বিনোদিনী। তা না হইলে আমি আত্মহত্যা করিয়া মরিতাম, তোমার সঙ্গে বাহির হইতাম না। মহেন্দ্র। কেন মরিলে না–ঐটুকু বিশ্বাসের ফাঁসি আমার গলায় জড়াইয়া আমাকে দেশদেশান্তরে টানিয়া
মারিতেছ কেন। তুমি মরিলে কত মঙ্গল হইত ভাবিয়া দেখো। বিনোদিনী। তাহা জানি, কিন্তু যতদিন বিহারীর আশা আছে, ততদিন আমি মরিতে পারিব না। মহেন্দ্র। যতদিন তুমি না মরিবে, ততদিন আমার প্রত্যাশাও মরিবে না–আমিও নিষ্কৃতি পাইব না। আমি
আজ হইতে ভগবানের কাছে সর্বান্তঃকরণে তোমার মৃত্যু কামনা করি। তুমি আমারও হইয়ো না, তুমি বিহারীরও হইয়ো না। তুমি যাও। আমাকে ছুটি দাও।
আমার মা কাঁদিতেছেন, আমার স্ত্রী কাঁদিতেছে–তাঁহাদের অশ্রু আমাকে দূর হইতে দগ্ধ করিতেছে। তুমি না মরিলে, তুমি আমারএবং পৃথিবীর সকলের আশার অতীত না হইলে, আমি তাঁহাদের চোখের জল মুছাইবার অবসর পাইব না।
এই বলিয়া মহেন্দ্র ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল। বিনোদিনী একলা পড়িয়া আপনার চারি দিকে যে মোহজাল রচনা করিতেছিল, তাহা সমস্ত ছিঁড়িয়া দিয়া গেল। চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া বিনোদিনী বাহিরের দিকে চাহিয়া রহিল–আকাশভরা জ্যোৎস্না শূন্য করিয়া দিয়া তাহার সমস্ত সুধারস কোথায় উবিয়া গেছে। সেই কেয়ারি-করা বাগান, তাহার পরে বালুকাতীর, তাহার পরে নদীর কালো জল, তাহার পরে ওপারের অস্ফুটতা–সমস্তই যেন একখানা বড়ো সাদা কাগজের উপরে পেনসিলে-আঁকা একটি চিত্র মাত্র–সমস্তই নীরস এবং নিরর্থক।
মহেন্দ্রকে বিনোদিনী কিরূপ প্রবলবেগে আকর্ষণ করিয়াছে, প্রচণ্ড ঝড়ের মতো কিরূপ সমস্ত শিকড়-সুদ্ধ তাহাকে উৎপাটিত করিয়াছে, আজ তাহা অনুভব করিয়া তাহার হৃদয় আরো যেন অশান্ত হইয়া উঠিল। তাহার তো এই সমস্ত শক্তিই রহিয়াছে, তবে কেন বিহারী পূর্ণিমার রাত্রির উদ্‌বেলিত সমুদ্রের ন্যায় তাহার সন্মুখে আসিয়া ভাঙিয়া পড়ে না। কেন একটা অনাবশ্যক ভালোবাসার প্রবল অভিঘাত প্রত্যহ তাহার ধ্যানের মধ্যে আসিয়া কাঁদিয়া পড়িতেছে, আর-একটা আগন্তুক রোদন বারংবার আসিয়া তাহার অন্তরের রোদনকে কেন পরিপূর্ণ অবকাশ দিতেছে না। এই যে একটা প্রকাণ্ড আন্দোলনকে সে জাগাইয়া তুলিয়াছে, ইহাকে লইয়া সমস্ত জীবন সে কী করিবে, এখন ইহাকে শান্ত করিবে কী উপায়ে।




আজ যে-সমস্ত ফুলের মালায় সে নিজেকে ভূষিত করিয়াছিল, তাহার উপরে মহেন্দ্রের মুগ্ধ দৃষ্টি পড়িয়াছিল জানিয়া সমস্ত টানিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিল। তাহার সমস্ত শক্তি বৃথা, চেষ্টা বৃথা, জীবন বৃথা–এই কানন, এই জ্যোৎস্না, এই যমুনাতট,এই অপূর্বসুন্দর পৃথিবী, সমস্তই বৃথা।
এত ব্যর্থতা, তবু যে যেখানে সে সেখানেই দাঁড়াইয়া আছে–জগতে কিছুরই লেশমাত্র ব্যত্যয় হয় নাই। তবু কাল সূর্য উঠিবে এবং সংসার তাহার ক্ষুদ্রতম কাজটুকু পর্যন্ত ভুলিবে না–এবং অবিচলিত বিহারী যেমন
দূরে ছিল, তেমনি দূরে থাকিয়া ব্রাক্ষণ বালককে তাহার বোধোদয়ের নূতন পাঠ অভ্যাস করাইবে। বিনোদিনীর চক্ষু ফাটিয়া অশ্রু বাহির হইয়া পড়িল। সে তাহার সমস্ত বল ও আকাঙ্ক্ষা লইয়া কোন্‌ পাথরকে ঠেলিতেছে। তাহার হৃদয় রক্তে ভাসিয়া গেল, কিন্তু তাহার অদৃষ্ট সুচ্যগ্রপরিমাণ সরিয়া বসিল না।




৫২

সমস্ত রাত্রি মহেন্দ্র ঘুমায় নাই–ক্লান্তশরীরে ভোরের দিকে তাহার ঘুম আসিল। বেলা আটটা-নয়টার সময় জাগিয়া তাড়াতড়ি উঠিয়া বসিল। গতরাত্রির একটা কোনো অসমাপ্ত বেদনা ঘুমের ভিতরে ভিতরে যেন প্রবাহিত হইতেছিল। সচেতন হইবামাত্র মহেন্দ্র তাহার ব্যথা অনুভব করিতে আরম্ভ করিল। কিছুক্ষণ পরেই রাত্রির সমস্ত ঘটানাটা মনে স্পষ্ট জাগিয়া উঠিল। সকালবেলাকার সেই রৌদ্রে, অতৃপ্ত নিদ্রার ক্লান্তিতে সমস্ত জগৎটা এবং জীবনটা অত্যন্ত বিরস বোধ হইল। সংসারত্যাগের গ্লানি, ধর্মত্যাগের গভীর পরিতাপ এবং এই উদ্‌ান্িত জীবনের সমস্ত অশান্তিভার মহেন্দ্র কিসের জন্য বহন করিতেছে। এই মহাবেশশূন্য প্রভাতরৌদ্রে মহেন্দ্রের মনে হইল, সে বিনোদিনীকে ভালোবাসে না। রাস্তার দিকে সে চাহিয়া দেখিল, সমস্ত জাগ্রত পৃথিবী ব্যস্ত হইয়া কাজে ছুটিয়াছে। সমস্ত আত্মগৌরব পঙ্কের মধ্যে বিসর্জন দিয়া একটি বিমুখ স্ত্রীলোকের পদপ্রান্তে অকর্মণ্য জীবনকে প্রতিদিন আবদ্ধ করিয়া রাখিবার যে মূঢ়তা, তাহা মহেন্দ্রর কাছে সুস্পষ্ট হইল। একটা প্রবল আবেগের উচ্ছ্বাসের পর হৃদয়ে অবসাদ উপস্থিত হয়–ক্লান্ত হৃদয় তখন আপন অনুভূতির বিষয়কে কিছুকালের জন্য দূরে ঠেলিয়া রাখিতে চায়। সেই ভাবের ভাঁটার সময় তলের সমস্ত প্রচ্ছন্ন পঙ্ক বাহির হইয়া পড়ে–যাহা মোহ আনিয়াছিল তাহাতে বিতৃষ্ণা জন্মে। মহেন্দ্র যে কিসের জন্য নিজেকে এমন করিয়া অপমানিত করিতেছে, তাহা সে আজ বুঝিতে পারিল না। সে বলিল, “আমি সর্বাংশেই বিনোদিনীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তবু আজ আমি সর্বপ্রকার হীনতা ও লাঞ্ছনা স্বীকার করিয়া ঘৃণিত ভিক্ষুকের মতো তাহার পশ্চাতে অহোরাত্র ছুটিয়া বেড়াইতেছি, এমনতরো অদ্ভুত পাগলামি কোন্‌ শয়তান আমার মাথার মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দিয়াছে।” বিনোদিনী মহেন্দ্রের কাছে আজ একটি স্ত্রীলোকমাত্র, আর কিছুই নহে–তাহার চারি দিকে সমস্ত পৃথিবীর সৌন্দর্য হইতে, সমস্ত কাব্য হইতে, কাহিনী হইতে, যে একটি লাবণ্যজ্যোতি আকৃষ্ট হইয়াছিল তাহা আজ মায়ামরীচিকার মতো অন্তর্ধান করিতেই একটি সামান্য নারীমাত্র অবশিষ্ট রহিল–তাহার কোনো অপূর্বত্ব রহিল না।
তখন এই ধিক্‌কৃত মোহচক্র হইতে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করিয়া বাড়ি ফিরিয়া যাইবার জন্য মহেন্দ্র ব্যগ্র হইল। যে শান্তি প্রেম এবং স্নেহ তাহার ছিল, তাহাই তাহার কাছে দুর্লভতম অমৃত বলিয়া বোধ হইল। বিহারীর আশৈশব অটলনির্ভর বন্ধুত্ব তাহার কাছে মহামূল্য বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। মহেন্দ্র মনে মনে কহিল, “যাহা যথার্থ গভীর এবং স্থায়ী, তাহার মধ্যে বিনা চেষ্টায়, বিনা বাধায় আপনাকে সম্পূর্ণ নিমগ্ন করিয়া রাখা যায় বলিয়া তাহার গৌরব আমরা বুঝিতে পারি না–যাহা চঞ্চল ছলনামাত্র, যাহার পরিতৃপ্তিতেও লেশমাত্র সুখ নাই, তাহা আমাদিগকে পশ্চাতে ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়দৌড় করাইয়া বেড়ায় বলিয়াই তাহাকে চরম কামনার ধন মনে করি।”
মহেন্দ্র কহিল, “আজই বাড়ি ফিরিয়া যাইব–বিনোদিনী যেখানেই থাকিতে চাহে, সেইখানেই তাহাকে রাখিবার ব্যবস্থা করিয়া দিয়া আমি মুক্ত হইব।” “আমি মুক্ত হইব” এই কথা দৃঢ়স্বরে উচ্চারণ করিতেই তাহার মনে একটি আনন্দের আবির্ভাব হইল–এতদিন যে অবিশ্রাম দ্বিধার ভার সে বহন করিয়া আসিতেছিল, তাহা হালকা হইয়া আসিল। এতদিন, এই মুহূর্তে যাহা তাহার পরম অপ্রীতিকর ঠেকিতেছিল, পরমুহূর্তেই তাহা পালন করিতে বাধ্য হইতেছিল–জোর করিয়া “না” কি “হাঁ” সে বলিতে পারিতেছিল না; তাহার অন্তঃকরণের মধ্যে যে আদেশ উত্থিত হইতেছিল বরাবর জোর করিয়া তাহার মুখ চাপা দিয়া সে অন্যপথে চলিতেছিল–এখন সে যেমনি সবেগে বলিল, “আমি মুক্তিলাভ করিব”, অমনি তাহার দোলা-পীড়িত হৃদয় আশ্রয় পাইয়া তাহাকে অভিনন্দন করিল।
মহেন্দ্র তখনই শয্যাত্যাগ করিয়া উঠিয়া মুখ ধুইয়া বিনোদিনীর সহিত দেখা করিতে গেল। গিয়া দেখিল, তাহার দ্বার বন্ধ। দ্বারে আঘাত দিয়া কহিল, “ঘুমাইতেছ কি।”
বিনোদিনী কহিল, “না। তুমি এখন যাও।”
মহেন্দ্র কহিল, “তোমার সঙ্গে বিশেষ কথা আছে–আমি বেশিক্ষণ থাকিব না।”
বিনোদিনী কহিল, “কথা আর আমি শুনিতে পারি না–তুমি এখন যাও, আমাকে আর বিরক্ত করিয়ো না, আমাকে একলা থাকিতে দাও।”
অন্য কোনো সময় হইলে এই প্রত্যাখানে মহেন্দ্রের আবেগ আরো বাড়িয়া উঠিত। কিন্তু আজ তাহার অত্যন্ত ঘৃণাবোধ হইল। সে ভাবিল, “এই সামান্য এক স্ত্রীলোকের কাছে আমি নিজেকে এতই হীন করিয়াছি যে, আমাকে যখন-তখন এমনতরো অবজ্ঞাভরে দূর করিয়া দিবার অধিকার ইহার জন্মিয়াছে। সে অধিকার ইহার স্বাভাবিক অধিকার নহে। আমিই তাহা ইহাকে দিয়া ইহার গর্ব এমন অন্যায়রূপে বাড়াইয়া দিয়াছি।” এই লাঞ্ছনার পরে মহেন্দ্র নিজের মধ্যে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করিবার চেষ্টা করিল। সে কহিল, “আমি জয়ী হইব–ইহার বন্ধন আমি ছেদন করিয়া দিয়া চলিয়া যাইব।


আহারান্তে মহেন্দ্র টাকা উঠাইয়া আনিবার জন্য ব্যাঙ্কে চলিয়া গেল। টাকা উঠাইয়া আশার জন্য ও মার জন্য কিছু ভালো নতুন জিনিস কিনিবে বলিয়া সে এলাবাহাদের দোকানে ঘুরিতে লাগিল।

আবার একবার বিনোদিনীর দ্বারে আঘাত পড়িল। প্রথমে সে বিরক্ত হইয়া কোনো উত্তর করিল না–তাহার পরে আবার বার বার আঘাত করিতেই বিনোদিনী জ্বলন্ত রোষে সবলে দ্বার খুলিয়া কহিল, “কেন তুমি আমাকে বার বার বিরক্ত করিতে আসিতেছ।” কথা শেষ না হইতেই বিনোদিনী দেখিল, বিহারী দাঁড়াইয়া আছে।
ঘরের মধ্যে মহেন্দ্র আছে কি না, দেখিবার জন্য বিহারী একবার ভিতরে চাহিয়া দেখিল। দেখিল, শয়নঘরে শুষ্ক ফুল এবং ছিন্ন মালা ছড়ানো। তাহার মন নিমেষের মধ্যেই প্রবলবেগে বিমুখ হইয়া গেল। বিহারী যখন দূরে ছিল, তখন বিনোদিনীর জীবনযাত্রা সম্বন্ধে কোনো সন্দেহজনক চিত্র যে তাহার মনে উদয় হয় নাই তাহা নহে, কিন্তু কল্পনার লীলা সে চিত্রকে ঢাকিয়াও একটি উজ্জ্বল মোহিনীচ্ছবি দাঁড় করাইয়াছিল। বিহারী যখন বাগানে প্রবেশ করিতেছিল তখন তাহার হৃৎকম্প হইতেছিল–পাছে কল্পনাপ্রতিমায় অকসমাৎ আঘাত লাগে, এইজন্য তাহার চিত্ত সংকুচিত হইতেছিল। বিহারী বিনোদিনীর শয়নগৃহের দ্বারে সম্মুখে দাঁড়াইবামাত্র সেই আঘাতটাই লাগিল।


দূরে থাকিয়া বিহারী একসময় মনে করিয়াছিল, সে আপনার প্রেমাভিষেকে বিনোদিনীর জীবনের সমস্ত পঙ্কিলতা অনায়াসে ধৌত করিয়া লইতে পারিবে। কাছে আসিয়া দেখিল, তাহা সহজ নহে–মনের মধ্যে করুণার বেদনা আসিল কই। হঠাৎ ঘৃণার তরঙ্গ উঠিয়া তাহাকে অভিভূত করিয়া দিল। বিনোদিনীকে বিহারী অত্যন্ত মলিন দেখিল।

এক মুহূর্তেই বিহারী ফিরিয়া দাঁড়াইয়া “মহেন্দ্র” “মহেন্দ্র” করিয়া ডাকিল। এই অপমান পাইয়া বিনোদিনী নম্রমৃদুস্বরে কহিল, “মহেন্দ্র নাই, মহেন্দ্র শহরে গেছে।” বিহারী চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলে বিনোদিনী কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো, তোমার পায়ে ধরি, একটুখানি তোমাকে বসিতে হইবে।”

বিহারী কোনো মিনতি শুনিবে না মনে করিয়াছিল, একেবারে এই ঘৃণার দৃশ্য হইতে এখনই নিজেকে দূরে লইয়া যাইবে স্থির করিয়াছিল, কিন্তু বিনোদিনীর করুণ অনুনয়স্বর শুনিবামাত্র ক্ষণকালের জন্য তাহার পা যেন আর উঠিল না।

বিনোদিনী কহিল, “আজ যদি তুমি বিমুখ হইয়া এমন করিয়া চলিয়া যাও, তবেআমি তোমারই শপথ করিয়া বলিতেছি, আমি মরিব।”
বিহারী তখন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “বিনোদিনী, তোমার জীবনের সঙ্গে আমাকে তুমি জড়াইবার চেষ্টা করিতেছ কেন। আমি তোমার কী করিয়াছি। আমি তো কখনো তোমার পথে দাঁড়াই নাই, তোমার সুখদুঃখে হস্তক্ষেপ করি নাই।”
বিনোদিনী কহিল, “তুমি আমার কতখানি অধিকার করিয়াছ, তাহা একবার তোমাকে জানাইয়াছি–তুমি বিশ্বাস কর নাই। তবু আজ আবার তোমার বিরাগের মুখে সেই কথাই জানাইতেছি। তুমি তো আমাকে না বলিয়া জানাইবার, লজ্জা করিয়া জানাইবার, সময় দাও নাই। তুমি আমাকে ঠেলিয়া ফেলিয়াছ, তবু আমি তোমার পা ধরিয়া বলিতেছি, আমি তোমাকে–”
বিহারী বাধা দিয়া কহিল, “সে কথা আর বলিয়ো না, মুখে আনিয়ো না। সে কথা বিশ্বাস করিবার জো
নাই।”
বিনোদিনী। সে কথা ইতর লোকে বিশ্বাস করিতে পারে না, কিন্তু তুমি করিবে। সেইজন্য একবার আমি তোমাকে বসিতে বলিতেছি।
বিহারী। আমি বিশ্বাস করি বা না করি, তাহাতে কী আসে যায়। তোমার জীবন যেমন চলিতেছে, তেমনি চলিবে তো।


বিনোদিনী। আমি জানি তোমার ইহাতে কিছুই আসিবে-যাইবে না। আমার ভাগ্য এমন যে, তোমার সম্মানরক্ষা করিয়া তোমার পাশে দাঁড়াইবার আমার কোনো উপায় নাই। চিরকাল তোমা হইতে আমাকে দূরেই থাকিতে হইবে। আমার মন তোমার কাছে এই দাবিটুকু কেবল ছাড়িতে পারে না যে, আমি যেখানে থাকি আমাকে তুমি একটুকু মাধুর্যের সঙ্গে ভাবিবে। আমি জানি, আমার উপরে তোমার অল্প একটু শ্রদ্ধা জন্মিয়াছিল, সেইটুকু আমার একমাত্র সম্বল করিয়া রাখিব। সেইজন্য আমার সব কথা তোমাকে শুনিতে হইবে। আমি হাতজোড় করিয়া বলিতেছি ঠাকুরপো, একটুখানি বসো।

“আচ্ছা চলো” বলিয়া বিহারী এখান হইতে অন্যত্র কোথাও যাইতে উদ্যত হইল।
বিনোদিনী কহিল, “ঠাকুরপো, যাহা মনে করিতেছ, তাহা নহে। এ ঘরে কোনো কলঙ্ক স্পর্শ করে নাই।
তুমি এই ঘরে এক দিন শয়ন করিয়াছিলে–এ ঘর তোমার জন্য উৎসর্গ করিয়া রাখিয়াছি–ঐ ফুলগুলোতোমারই পূজা করিয়া আজ শুকাইয়া পড়িয়া আছে। এই ঘরেই তোমাকে বসিতে হইবে।”


শুনিয়া বিহারীর চিত্তে পুলকের সঞ্চার হইল। ঘরের মধ্যে সে প্রবেশ করিল। বিনোদিনী দুই হাত দিয়া তাহাকে খাট দেখাইয়া দিল। বিহারী খাটে গিয়া বসিল-বিনোদিনী ভূমিতলে তাহার পায়ের কাছে উপবেশন করিল। বিহারী ব্যস্ত হইয়া উঠিতেই বিনোদিনী কহিল, “ঠাকুরপো, তুমি বসো। আমার মাথা খাও, উঠিয়ো না। আমি তোমার পায়ের কাছে বসিবারও যোগ্য নই, তুমি দয়া করিয়াই সেখানে স্থান দিয়াছ। দূরে থাকিলেও এই অধিকারটুকু আমি রাখিব।”

এই বলিয়া বিনোদিনী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তাহার পরে হঠাৎ চমকিয়া উঠিয়া কহিল, “তোমার
খাওয়া হইয়াছে, ঠাকুরপো?”
বিহারী কহিল, “স্টেশন হইতে খাইয়া আসিয়াছি।”
বিনোদিনী। আমি গ্রাম হইতে তোমাকে যে চিঠিখানি লিখিয়াছিলাম, তাহা খুলিয়া কোনো জবাব না দিয়া
মহেন্দ্রের হাত দিয়া আমাকে ফিরাইয়া পাঠাইলে কেন।
বিহারী। সে চিঠি তো আমি পাই নাই।
বিনোদিনী। এবারে মহেন্দ্রের সঙ্গে কলিকাতায় কি তোমার দেখা হইয়াছিল।
বিহারী। তোমাকে গ্রামে পৌঁছাইয়া দিবার পরদিন মহেন্দ্রের সঙ্গে দেখা হইয়াছিল, তাহার পরেই আমি পশ্চিমে বেড়াইতে বাহির হইয়াছিলাম, তাহার সঙ্গে আর দেখা হয় নাই।
বিনোদিনী। তাহার পূর্বে আর-এক দিন আমার চিঠি পড়িয়া উত্তর না দিয়া ফিরাইয়া পাঠাইয়াছিলে?
বিহারী। না, এমন কখনোই হয় নাই।
বিনোদিনী স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া রহিল। তাহার পরে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, “সমস্ত বুঝিলাম। এখন আমার সব কথা তোমাকে বলি। যদি বিশ্বাস কর তো ভাগ্য মানিব, যদি না কর তো তোমাকে দোষ দিব না, আমাকে বিশ্বাস করা কঠিন।”
বিহারীর হৃদয় তখন আর্দ্র হইয়া গেছে। এই ভক্তিভারনম্রা বিনোদিনীর পূজাকে সে কোনোমতেই অপমান করিতে পারিল না। সে কহিল, “বোঠান, তোমাকে কোনো কথাই বলিতে হইবে না, কিছু না শুনিয়া আমি তোমাকে বিশ্বাস করিতেছি। আমি তোমায় ঘৃণা করিতে পারি না। তুমি আর একটি কথাও বলিয়ো না।”


শুনিয়া বিনোদিনীর ছোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল, সে বিহারীর পায়ের ধুলা মাথায় তুলিয়া লইল। কহিল, “সব কথা না বলিলে আমি বাঁচিব না। একটু ধৈর্য ধরিয়া শুনিতে হইবে–তুমি আমাকে যে-আদেশ করিয়াছিলে, তাহাই আমি শিরোধার্য করিয়া লইলাম। যদিও তুমি আমাকে পত্রটুকুও লেখ নাই, তবু আমি আমার সেই গ্রামে লোকের উপহাস ও নিন্দা সহ্য করিয়া জীবন কাটাইয়া দিতাম, তোমার স্নেহের পরিবর্তে তোমার শাসনই আমি গ্রহণ করিতাম–কিন্তু বিধাতা তাহাতেও বিমুখ হইলেন। আমি যে-পাপ জাগাইয়া তুলিয়াছি, তাহা আমাকে নির্বাসনেও টিকিতে দিল না। মহেন্দ্র গ্রামে আসিয়া, আমার ঘরের দ্বারে আসিয়া, আমাকে সকলের সম্মুখে লাজ্ঞিত করিল। সে-গ্রামে আর আমার স্থান হইল না। দ্বিতীয় বার তোমার আদেশের জন্য তোমাকে অনেক খুঁজিলাম, কোনোমতেই তোমাকে পাইলাম না, মহেন্দ্র আমার খোলা চিঠি তোমার ঘর হইতে ফিরাইয়া লইয়া আমাকে প্রতারণা করিল। বুঝিলাম, তুমি আমাকে একেবারে পরিত্যাগ করিয়াছ। ইহার পরে আমি একেবারেই নষ্ট হইতে পারিতাম–কিন্তু তোমার কী গুণ আছে, তুমি দূরে থাকিয়াও রক্ষা করিতে পার–তোমাকে মনে স্থান দিয়াছি বলিয়াই আমি পবিত্র হইয়াছি–একদিন তুমি আমাকে দূর করিয়া দিয়া নিজের যে পরিচয় দিয়াছ, তোমার সেই কঠিন পরিচয়, কঠিন সোনার মতো, কঠিন মানিকের মতো আমার মনের মধ্যে রহিয়াছে, আমাকে মহামূল্য করিয়াছে; দেব, এই তোমার চরণ ছুঁইয়া বলিতেছি, সে মূল্য নষ্ট হয় নাই।”

বিহারী চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। বিনোদিনীও আর কোনো কথা কহিল না। অপরাহ্নের আলোক প্রতিক্ষণে মলান হইয়া আসিতে লাগিল। এমন সময় মহেন্দ্র ঘরের দ্বারের কাছে আসিয়া বিহারীকে দেখিয়া চমকিয়া উঠিল। বিনোদিনীর প্রতি তাহার যে একটা ঔদাসীন্য জন্মিতেছিল, ঈর্ষার তাড়নায় তাহা দূর হইবার উপক্রম হইল। বিনোদিনী বিহারীর পায়ের কাছে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছে দেখিয়া, প্রত্যাখ্যাত মহেন্দ্রের গর্বে আঘাত লাগিল। বিনোদিনীর সহিত বিহারীর চিঠিপত্র দ্বারা এই মিলন ঘটিয়াছে, ইহাতে তাহার আর সন্দেহ রহিল না। এতদিন বিহারী বিমুখ হইয়াছিল, এখন সে যদি নিজে আসিয়া ধরা দেয়, তবে বিনোদিনীকে ঠেকাইবে কে। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে ত্যাগ করিতে পারে, কিন্তু আর-কাহারো হাতে ত্যাগ করিতে পারে না, তাহা আজ বিহারীকে দেখিয়া বুঝিতে পারিল।

ব্যর্থরোষে তীব্র বিদ্রূপের স্বরে মহেন্দ্র বিনোদিনীকে কহিল, “এখন তবে রঙ্গভূমিতে মহেন্দ্রের প্রস্থান, বিহারীর প্রবেশ! দৃশ্যটি সুন্দর–হাততালি দিতে ইচ্ছা হইতেছে। কিন্তু আশা করি, এই শেষ অঙ্ক, ইহার পরে আর কিছুই ভালো লাগিবে না।”

বিনোদিনীর মুখ রক্তিম হইয়া উঠিল। মহেন্দ্রের আশ্রয় লইতে যখন তাহাকে বাধ্য হইতে হইয়াছে, তখন এ অপমানের উত্তর তাহার আর কিছুই নাই–ব্যাকুলদৃষ্টিতে সে কেবল একবার বিহারীর মুখের দিকে চাহিল।
বিহারী খাট হইতে উঠিল–অগ্রসর হইয়া কহিল, “মহেন্দ্র তুমি বিনোদিনীকে কাপুরুষের মতো অপমান করিয়ো না–তোমার ভদ্রতা যদি তোমাকে নিষেধ নাকরে, তোমাকে নিষেধ করিবার অধিকার আমার আছে।”
মহেন্দ্র হাসিয়া কহিল, “ইহারই মধ্যে অধিকার সাব্যস্ত হইয়া গেছে? আজ তোমার নূতন নামকরণ করা যাক-বিনোদ-বিহারী।”
বিহারী অপমানের মাত্রা চড়িতে দেখিয়া মহেন্দ্রের হাত চাপিয়া ধরিল। কহিল, “মহেন্দ্র, বিনোদিনীকে আমি বিবাহ করিব, তোমাকে জানাইলাম, অতএব এখন হইতে সংযতভাবে কথা কও।”
শুনিয়া মহেন্দ্র বিস্ময়ে নিস্তব্ধ হইয়া গেল, এবং বিনোদিনী চমকিয়া উঠিল–বুকের মধ্যে তাহার সমস্ত রক্ত তোলপাড় করিতে লাগিল।
বিহারী কহিল, “তোমাকে আর-একটি খবর দিবার আছে–তোমার মাতা মৃত্যুশয্যায় শয়ান, তাঁহার বাঁচিবার কোনো আশা নাই। আমি আজ রাত্রের গাড়িতেই যাইব। বিনোদিনীও আমার সঙ্গে ফিরিবে।”
বিনোদিনী চমকিয়া উঠিল, কহিল, “পিসিমার অসুখ?” বিহারী কহিল, “সারিবার অসুখ নহে। কখন কী হয়, বলা যায় না।”
মহেন্দ্র তখন আর-কোনো কথা না বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
বিনোদিনী তখন বিহারীকে বলিল, “যে কথা তুমি বলিলে, তাহা তোমার মুখ দিয়া কেমন করিয়া বাহির হইল! এ কি ঠাট্টা।”
বিহারী কহিল, “না, আমি সত্যই বলিয়াছি, তোমাকে আমি বিবাহ করিব।”
বিনোদিনী। এই পাপিষ্ঠাকে উদ্ধার করিবার জন্য?
বিহারী। না। আমি তোমাকে ভালোবাসি বলিয়া, শ্রদ্ধা করি বলিয়া।
বিনোদিনী। এই আমার শেষ পুরস্কার হইয়াছে। এই যেটুকু স্বীকার করিলে ইহার বেশি আর আমি কিছুই চাই না। পাইলেও তাহা থাকিবে না, ধর্ম কখনো তাহা সহ্য করিবেন না।
বিহারী। কেন করিবেন না।
বিনোদিনী। ছি ছি, এ কথা মনে করিতে লজ্জা হয়। আমি বিধবা, আমি নিন্দিতা, সমস্ত সমাজের কাছে
আমি তোমাকে লাজ্ঞিত করিব, এ কখনো হইতেই পারে না। ছি ছি, এ কথা তুমি মুখে আনিয়ো না।
বিহারী। তুমি আমাকে ত্যাগ করিবে?
বিনোদিনী। ত্যাগ করিবার অধিকার আমার নাই। তুমি গোপনে অনেকের অনেক ভালো কর–তোমার একটা কোনো ব্রতের একটা-কিছু ভার আমার উপর সমর্পণ করিয়ো, তাহাই বহন করিয়া আমি নিজেকে তোমার সেবিকা বলিয়া গণ্য করিব। কিন্তু ছি ছি, বিধবাকে তুমি বিবাহ করিবে! তোমার ঔদার্যে সব সম্ভব হইতে পারে, কিন্তু আমি যদি এ কাজ করি, তোমাকে সমাজে নষ্ট করি, তবে ইহজীবনে আমি আর মাথা তুলিতে পারিব না।
বিহারী। কিন্তু বিনোদিনী, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
বিনোদিনী। সেই ভালোবাসার অধিকারে আমি আজ একটিমাত্র স্পর্ধা প্রকাশ করিব। বলিয়া বিনোদিনী ভূমিষ্ঠ হইয়া বিহারীর পদাঙ্গুলি চুম্বন করিল। পায়ের কাছে বসিয়া কহিল, “পরজন্মে তোমাকে পাইবার জন্য আমি তপস্যা করিব–এ জন্মে আমার আর কিছু আশা নাই, প্রাপ্য নাই। আমি অনেক দুঃখ দিয়াছি, অনেক দুঃখ পাইয়াছি, আমার অনেক শিক্ষা হইয়াছে। সে শিক্ষা যদি ভুলিতাম, তবে আমি তোমাকে হীন করিয়া আরো হীন হইতাম। কিন্তু তুমি উচ্চ আছ বলিয়াই আজ আমি আবার মাথা তুলিতে পারিয়াছি–এ আশ্রয় আমি ভূমিসাৎ করিব না।”
বিহারী গম্ভীরমুখে চুপ করিয়া রহিল।
বিনোদিনী হাত জোড় করিয়া কহিল, “ভুল করিয়ো না–আমাকে বিবাহ করিলে তুমি সুখী হইবে না, তোমার গৌরব যাইবে-আমিও সমস্ত গৌরব হারাইব। তুমি চিরদিন নির্লিপ্ত, প্রসন্ন। আজও তুমি তাই থাকো–আমি দূরে থাকিয়া তোমার কর্ম করি। তুমি প্রসন্ন হও, তুমি সুখী হও।”




৫৩

মহেন্দ্র তাহার মাতার ঘরে প্রবেশ করিতে যাইতেছে, তখন আশা তাড়াতড়ি বাহির হইয়া আসিয়া কহিল, “ এখন ও-ঘরে যাইয়ো না।”
মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “কেন।”
আশা কহিল, “ডাক্তার বলিয়াছেন হঠাৎ মার মনে, সুখের হউক, দুঃখের হউক একটা কোনো আঘাত লাগিলে বিপদ হইতে পারে।”
মহেন্দ্র কহিল, “আমি একবার আস্তে আস্তে তাঁহার মাথার শিয়রের কাছে গিয়া দেখিয়া আসি গে–তিনি
টের পাইবেন না।”
আশা কহিল, “তিনি অতি অল্প শব্দেই চমকিয়া উঠিতেছেন, তুমি ঘরে ঢুকিলেই তিনি টের পাইবেন।”
মহেন্দ্র। তবে, এখন তুমি কী করিতে চাও।
আশা। আগে বিহারী-ঠাকুরপো আসিয়া একবার দেখিয়া যান–তিনি যেরূপ পরামর্শ দিবেন, তাহাই করিব।
বলিতে বলিতে বিহারী আসিয়া পড়িল। আশা তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইয়াছিল।
বিহারী। বোঠান, ডাকিয়াছ? মা ভালো আছেন তো?
আশা বিহারীকে দেখিয়া যেন নির্ভর পাইল। কহিল, “তুমি যাওয়ার পর হইতে মা যেন আরো চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছেন। প্রথম দিন তোমাকে না দেখিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিহারী কোথায় গেল।” আমি বলিলাম, “তিনি বিশেষ কাজে গেছেন, বৃহস্পতিবারের মধ্যে ফিরিবার কথা আছে।” তাহার পর হইতে তিনি থাকিয়া থাকিয়া চমকিয়া উঠিতেছেন। মুখে কিছুই বলেন না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে যেন কাহার অপেক্ষা করিতেছেন। কাল তোমার টেলিগ্রাম পাইয়া জানাইলাম, আজ তুমি আসিবে। শুনিয়া তিনি আজ তোমার জন্য বিশেষ করিয়া খাবার আয়োজন করিতে বলিয়াছেন। তুমি যাহা যাহা ভালোবাস, সমস্ত আনিতে দিয়াছেন, সম্মুখের বারান্দায় রাঁধিবার আয়োজন করাইয়াছেন, তিনি ঘর হইতে দেখাইয়া দিবেন। ডাক্তারের নিষেধ কিছুতেই শুনিলেন না। আমাকে এই খানিকক্ষণ হইল ডাকিয়া বলিয়া দিলেন, “বউমা, তুমি নিজের হাতে সমস্ত রাঁধিবে, আমি আজ সামনে বসাইয়া বিহারীকে খাওয়াইব। ”
শুনিয়া বিহারীর চোখ ছলছল করিয়া আসিল। জিজ্ঞাসা করিল, “মা আছেন কেমন।”


আশা কহিল, “তুমি একবার নিজে দেখিবে এসো–আমার তো বোধ হয়, ব্যামো আরো বাড়িয়াছে।”

তখন বিহারী ঘরে প্রবেশ করিল। মহেন্দ্র বাহিরে দাঁড়াইয়া আশ্চর্য হইয়া গেল। আশা বাড়ির কর্তৃত্ব অনায়াসে গ্রহণ করিয়াছে–সে মহেন্দ্রকে কেমন সহজে ঘরে ঢুকিতে নিষেধ করিল। না করিল সংকোচ, না করিল অভিমান। মহেন্দ্রের বল আজ কতখানি কমিয়া গেছে। সে অপরাধী, সে বাহিরে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল–মার ঘরেও ঢুকিতে পারিল না।
তাহার পরে ইহাও আশ্চর্য–বিহারীর সঙ্গে আশা কেমন অকুন্ঠিতভাবে কথাবার্তা কহিল। সমস্ত পরামর্শ তাহারই সঙ্গে। সেই আজ সংসারের একমাত্র রক্ষক, সকলের সুহৃৎ। তাহার গতিবিধি সর্বত্র, তাহার উপদেশেই সমস্ত চলিতেছে। মহেন্দ্র কিছুদিনের জন্য যে-জায়গাটি ছাড়িয়া চলিয়া গেছে, ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, সে-জায়গা ঠিক আর তেমনটি নাই।




বিহারী ঘরে ঢুকিতেই রাজলক্ষ্মী তাঁহার করুণ চক্ষু তাহার মুখের দিকে রাখিয়া কহিলেন, “বিহারী, ফিরিয়াছিস?”
বিহারী কহিল, “হাঁ, মা, ফিরিয়া আসিলাম।”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “তোর কাজ শেষ হইয়া গেছে?” বলিয়া তাহার মুখের দিকে একাগ্রদৃষ্টিতে চাহিলেন।
বিহারী প্রফুল্লমুখে “হাঁ মা, কাজ সুসম্পন্ন হইয়াছে, এখন আমার আর-কোনো ভাবনা নাই” বলিয়া একবার বাহিরের দিকে চাহিল।
রাজলক্ষ্মী। আজ বউমা তোমার জন্য নিজের হাতে রাঁধিবেন, আমি এখান হইতে দেখাইয়া দিব। ডাক্তার বারণ করে–কিন্তু আর বারণ কিসের জন্য, বাছা। আমি কি একবার তোদের খাওয়া দেখিয়া যাইব না।
বিহারী কহিল, “ডাক্তারের বারণ করিবার তো কোনো হেতু দেখি না, মা–তুমি না দেখাইয়া দিলে চলিবে কেন। ছেলেবেলা হইতে তোমার হাতের রান্নাই আমরা ভালোবাসিতে শিখিয়াছি–মহিনদার তো পশ্চিমের ডালরুটি খাইয়া অরুচি ধরিয়া গেছে–আজ সে তোমার মাছের ঝোল পাইলে বাঁচিয়া যাইবে। আজ আমরা দুই ভাই ছেলেবেলাকার মতো রেষারেষি করিয়া খাইব, তোমার বউমা অন্নে কুলাইতে পারিলে হয়।”




যদিচ রাজলক্ষ্মী বুঝিয়াছিলেন, বিহারী মহেন্দ্রকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছে, তবু তাহার নাম শুনিতেই তাঁহার হৃদয় স্পন্দিত হইয়া নিশ্বাস ক্ষণকালের জন্য কঠিন হইয়া উঠিল।
সে-ভাবটা কাটিয়া গেলে বিহারী কহিল, “পশ্চিমে গিয়া মহিনদার শরীর অনেকটা ভালো হইয়াছে। আজ পথের অনিয়মে সে একটু মলান আছে, স্নানাহার করিলেই শুধরাইয়া উঠিবে।”
রাজলক্ষ্মী তবু মহেন্দ্রের কথা কিছু বলিলেন না। তখন বিহারী কহিল, “মা, মহিনদা বাহিরেই দাঁড়াইয়া আছে, তুমি না ডাকিলে সে তো আসিতে পারিতেছে না।”
রাজলক্ষ্মী কিছু না বলিয়াই দরজার দিকে চাহিলেন। চাহিতেই বিহারী ডাকিল, “মহিনদা, এসো।”
মহেন্দ্র ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করিল। পাছে হৃৎপিণ্ড হঠাৎ স্তব্ধ হইয়া যায়, এই ভয়ে রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রের মুখের দিকে তখনই চাহিতে পারিলেন না। চক্ষু অর্ধনিমীলিত করিলেন। মহেন্দ্র বিছানার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া চমকিয়া উঠিল, তাহাকে কে যেন মারিল। মহেন্দ্র মাতার পায়ের কাছে মাথা রাখিয়া পা ধরিয়া পড়িয়া রহিল। বক্ষের স্পন্দনে রাজলক্ষ্মীর সমস্ত শরীর কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিল।
কিছুক্ষণ পরে অন্নপূর্ণা ধীরে ধীরে কহিলেন, “দিদি, মহিনকে তুমি উঠিতে বলো, নহিলে ও উঠিবে না।”
রাজলক্ষ্মী কষ্টে বাক্যস্ফুরণ করিয়া কহিলেন, “মহিন ওঠ্‌।”


মহিনের নাম উচ্চারণমাত্র অনেক দিন পরে তাঁহার চোখ দিয়া ঝর ঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল। সেই অশ্রু পড়িয়া তাঁহার হৃদয়ের বেদনা লঘু হইয়া আসিল। তখন মহেন্দ্র উঠিয়া মাটিতে হাঁটু গাড়িয়া খাটের উপর বুক দিয়া তাহার মার পাশে আসিয়া বসিল। রাজলক্ষ্মী কষ্টে পাশ ফিরিয়া দুই হাতে মহেন্দ্রের মাথা লইয়া তাহার মস্তক আঘ্রাণ করিলেন, তাহার ললাট চুম্বন করিলেন।

মহেন্দ্র রুদ্ধকন্ঠে কহিল, “মা, তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়াছি, আমাকে মাপ করো।” বক্ষ শান্ত হইলে রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “ও কথা বলিস নে মহিন, আমি তোকে মাপ না করিয়া কি বাঁচি।
বউমা, বউমা কোথায় গেল।” আশা পাশের ঘরে পথ্য তৈরি করিতেছিল–অন্নপূর্ণা তাহাকে ডাকিয়া আনিলেন। তখন রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রকে ভূতল হইতে উঠিয়া তাঁহার খাটে বসিতে ইঙ্গিত করিলেন। মহেন্দ্র খাটে বসিলে
রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রের পার্শ্বে স্থান-নির্দেশ করিয়া আশাকে কহিলেন, “বউমা, এইখানে তুমি বসো–আজ আমি একবার তোমাদের দুজনকে একত্রে বসাইয়া দেখিব, তাহা হইলে আমার সকল দুঃখ ঘুচিবে। বউমা, আমার কাছে আর লজ্জা করিয়ো না–আর মহিনের ‘পরেও মনের মধ্যে কোনো অভিমান না রাখিয়া একবার এইখানে বসো–আমার চোখ জুড়াও মা।”




তখন ঘোমটা-মাথায় আশা লজ্জায় ধীরে ধীরে আসিয়া কম্পিতবক্ষে মহেন্দ্রের পাশে গিয়া বসিল। রাজলক্ষ্মী স্বহস্তে আশার ডান হাত তুলিয়া লইয়া মহেন্দ্রের ডান হাতে রাখিয়া চাপিয়া ধরিলেন–কহিলেন, “আমার এই মাকে তোর হাতে দিয়া গেলাম, মহিন–আমার এই কথাটি মনে রাখিস, তুই এমন লক্ষ্মী আর কোথাও পাবি নে। মেজোবউ, এসো, ইহাদের একবার আশীর্বাদ করো-তোমার পুণ্যে ইহাদের মঙ্গল হউক।”
অন্নপূর্ণা সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইতেই উভয়ে চোখের জলে তাঁহার পদধূলি গ্রহণ করিল। অন্নপূর্ণা উভয়ের
মস্তকচুম্বন করিয়া কহিলেন, “ভগবান তোমাদের কল্যাণ করুন।”
রাজলক্ষ্মী। বিহারী, এসো বাবা, মহিনকে তুমি একবার ক্ষমা করো। বিহারী তখনই মহেন্দ্রের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াতেই মহেন্দ্র উঠিয়া দৃঢবাহু দ্বারা বিহারীকে বক্ষে টানিয়া কোলাকুলি করিল।
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “মহিন, আমি তোকে এই আর্শীর্বাদ করি–শিশুকাল হইতে বিহারী তোর যেমন বন্ধু ছিল, চিরকাল তেমনি বন্ধু থাক্‌-ইহার চেয়ে তোর সৌভাগ্য আর-কিছু হইতে পারে না।”
এই বলিয়া রাজলক্ষ্মী অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়া নিস্তব্ধ হইলেন। বিহারী একটা উত্তেজক ঔষধ তাঁহার মুখের কাছে আনিয়া ধরিতেই রাজলক্ষ্মী হাত সরাইয়া দিয়া কহিলেন, “আর ওষুধ না, বাবা। এখন আমি ভগবানকে স্মরণ করি–তিনি আমাকে আমার সমস্ত সংসারদাহের শেষ ওষুধ দিবেন। মহিন, তোরা একটুখানি বিশ্রাম কর্‌গে। বউমা, এইবার রান্না চড়াইয়া দাও।”
সন্ধ্যাবেলায় বিহারী এবং মহেন্দ্র রাজলক্ষ্মীর বিছানার সম্মুখে নীচে পাত পাড়িয়া খাইতে বসিল। আশার উপর রাজলক্ষ্মী পরিবেশনের ভার দিয়াছিলেন, সে পরিবেশন করিতে লাগিল। মহেন্দ্রের বক্ষের মধ্যে অশ্রু উদ্‌বেলিত হইয়া উঠিতেছিল, তাহার মুখে অন্ন উঠিতেছিল না। রাজলক্ষ্মী তাহাকে বার বার বলিতে লাগিলেন, “মহিন, তুই কিছুই খাইতেছিস না কেন। ভালো করিয়া খা, আমি দেখি।”




বিহারী কহিল, “জানই তো মা, মহিনদা চিরকাল ঐরকম, কিছুই খাইতে পারে না। বৌঠান, ঐ ঘন্টটা আমাকে আর-একটু দিতে হইবে, বড়ো চমৎকার হইয়াছে।”
রাজলক্ষ্মী খুশি হইয়া ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “আমি জানি, বিহারী ঐ ঘন্টটা ভালোবাসে। বউমা, ওটুকুতে কী হইবে, আর-একটু বেশি করিয়া দাও।”
বিহারী কহিল, “তোমার এই বউটি বড়ো কৃপণ, হাত দিয়া কিছু গলে না।”
রাজলক্ষ্মী হাসিয়া কহিলেন, “দেখো তো বউমা, বিহারী তোমারই নুন খাইয়া তোমারই নিন্দা করিতেছে।”
আশা বিহারীর পাতে একরাশ ঘন্ট দিয়া গেল। বিহারী কহিল, “হায় হায়! ঘন্ট দিয়াই আমার পেট ভরাইবে দেখিতেছি, আর ভালো ভালো জিনিস সমস্তই মহিনদার পাতে পড়িবে।”
আশা ফিসফিস করিয়া বলিয়া গেল, “নিন্দুকের মুখ কিছুতেই বন্ধ হয় না।”




বিহারী মৃদুস্বরে কহিল, “মিষ্টান্ন দিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখো, বন্ধ হয় কি না।”
দুই বন্ধুর আহার হইয়া গেলে, রাজলক্ষ্মী অত্যন্ত তৃপ্তিবোধ করিলেন। কহিলেন, “বউমা, তুমি শীঘ্র খাইয়া এসো।”
রাজলক্ষ্মীর আদেশে আশা খাইতে গেলে তিনি মহেন্দ্রকে কহিলেন, “মহিন, তুই শুইতে যা।”
মহেন্দ্র কহিল, “এখনই শুইতে যাইব কেন।”
মহেন্দ্র রাত্রে মাতার সেবা করিবে স্থির করিয়াছিল। রাজলক্ষ্মী কোনোমতেই তাহা ঘটিতে দিলেন না। কহিলেন, “তুই শ্রান্ত আছিস মহিন, তুই শুইতে যা।”
আশা আহার করিয়া পাখা লইয়া রাজলক্ষ্মীর শিয়রের কাছে আসিয়া বসিবার উপক্রম করিলে, তিনি চুপি চুপি তাহাকে কহিলেন, “বউমা, মহেন্দ্রের বিছানা ঠিক হইয়াছে কি না দেখো গে, সে একলা আছে।”
আশা লজ্জায় মরিয়া গিয়া কোনোমতে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। ঘরে গেবল বিহারী এবং অন্নপূর্ণা রহিলেন।
তখন রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “বিহারী, তোকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। বিনোদিনীর কী হইল বলিতে
পারিস? সে এখন কোথায়।”
বিহারী কহিল, “বিনোদিনী কলিকাতায় আছে।”
রাজলক্ষ্মী নীরব দৃষ্টিতে বিহারীকে প্রশ্ন করিলেন। বিহারী তাহা বুঝিল। কহিল, “বিনোদিনীর জন্য তুমি
আর কিছুমাত্র ভয় করিয়ো না, মা।”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “সে আমাকে অনেক দুঃখ দিয়াছে, বিহারী, তবু তাহাকে আমি মনে মনে ভালোবাসি।”
বিহারী কহিল, “সে-ও তোমাকে মনে মনে ভালোবাসে, মা।”
রাজলক্ষ্মী, আমারও তাই বোধ হয় বিহারী। দোষগুণ সকলেরই আছে, কিন্তু সে আমাকে ভালোবাসিত। তেমন সেবা কেহ ছল করিয়া করিতে পারিত না।
বিহারী কহিল, “তোমার সেবা করিবার জন্য সে ব্যাকুল হইয়া আছে।”
রাজলক্ষ্মী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “মহিনরা তো এখন শুইতে গেছে, রাত্রে তাহাকে একবার আনিলে কি ক্ষতি আছে।”
বিহারী কহিল, “মা, সে তো এই বাড়িরই বাহির-ঘরে লুকাইয়া বসিয়া আছে। তাহাকে আজ সমস্ত দিন জলবিন্দু পর্যন্ত মুখে দেওয়াইতে পারি নাই। সে পণ করিয়াছে, যতক্ষণ তুমি তাহাকে ডাকিয়া না মাপ করিবে ততক্ষণ সে জলস্পর্শ করিবে না।”
রাজলক্ষ্মী ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “সমস্ত দিন উপবাস করিয়া আছে! আহা, তাহাকে ডাক্‌, ডাক্‌!”
বিনোদিনী ধীরে ধীরে রাজলক্ষ্মীর ঘরে প্রবেশ করিতেই তিনি বলিয়া উঠিলেন, “ছি ছি বউ, তুমি করিয়াছ
কি। আজ সমস্ত দিন উপোস করিয়া আছ? যাও যাও, আগে খাইয়া লও, তাহার পরে কথা হইবে।”
বিনোদিনী রাজলক্ষ্মীর পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিয়া কহিল, “আগে তুমি পাপিষ্ঠাকে মাপ করো,
পিসিমা, তবে আমি খাইব।”
রাজলক্ষ্মী। মাপ করিয়াছি বাছা, মাপ করিয়াছি, আমার এখন কাহারো উপর আর রাগ নাই।–বিনোদিনীর ডান হাত ধরিয়া তিনি কহিলেন, “বউ, তোমা হইতে কাহারো মন্দ না হউক, তুমিও ভালো থাকো।”
বিনোদিনী। তোমার আশীর্বাদ মিথ্যা হইবে না, পিসিমা। আমি তোমার পা ছুঁইয়া বলিতেছি আমা হইতে এ সংসারের মন্দ হইবে না।
অন্নপূর্ণাকে বিনোদিনী ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া খাইতে গেল। খাইয়া আসিলে পর রাজলক্ষ্মী তাহার দিকে চাহিয়া কহিলেন, “বউ, এখন তবে তুমি চলিলে?”
বিনোদিনী। পিসিমা, আমি তোমার সেবা করিব। ঈশ্বর সাক্ষী, আমা হইতে তুমি কোনো অনিষ্ট আশঙ্কা করিয়ো না।
রাজলক্ষ্মী বিহারীর মুখের দিকে চাহিলেন। বিহারী একটু চিন্তা করিয়া কহিল, “বোঠান থাকুন মা, তাহাতে ক্ষতি হইবে না।”
রাত্রে বিহারী, বিনোদিনী এবং অন্নপূর্ণা তিনজনে মিলিয়া রাজলক্ষ্মীর শুশ্রূষা করিলেন।
এ দিকে আশা সমস্ত রাত্রি রাজলক্ষ্মীর ঘরে আসে নাই বলিয়া লজ্জায় অত্যন্ত প্রত্যুষে উঠিয়াছে। মহেন্দ্রকে বিছানায় সুপ্ত অবস্থায় রাখিয়া তাড়াতাড়ি মুখ ধুইয়া কাপড় ছাড়িয়া প্রস্তুত হইয়া আসিল। তখনো অন্ধকার একেবারে যায় নাই। রাজলক্ষ্মীর দ্বারের কাছে আসিয়া যাহা দেখিল, তাহাতে আশা অবাক হইয়া গেল। ভাবিল , “এ কি স্বপ্ন।”
বিনোদিনী একটি স্পিরিট ল্যাম্প জ্বালিয়া জল গরম করিতেছে। বিহারী রাত্রে ঘুমাইতে পায় নাই, তাহার জন্য চা তৈরি হইবে।
আশাকে দেখিয়া বিনোদিনী উঠিয়া দাঁড়াইল। কহিল, “আজ আমি আমার সমস্ত অপরাধ লইয়া তোমার আশ্রয় গ্রহণ করিলাম–আর কেহ আমাকে দূর করিতে পারিবে না–কিন্তু তুমি যদি বল “যাও তো আমাকে এখনই যাইতে হইবে।”
আশা কোনো উত্তর করিতে পারিল না–তাহার মন কী বলিতেছে, তাও সে যেন ভালো করিয়া বুঝিতে পারিল না, অভিভূত হইয়া রহিল।
বিনোদিনী কহিল, “আমাকে কোনোদিন তুমি মাপ করিতে পারিবে না–সে চেষ্টাও করিয়ো না। কিন্তু আমাকে আর ভয় করিয়ো না। যে কয়দিন পিসিমার দরকার হইবে, সেই কটা দিন আমাকে একটুখানি কাজ করিতে দাও, তার পরে আমি চলিয়া যাইব।”
কাল রাজলক্ষ্মী যখন আশার হাত লইয়া মহেন্দ্রের হাতে দিলেন, তখন আশা তাহার মন হইতে সমস্ত অভিমান মুছিয়া ফেলিয়া সম্পূর্ণভাবে মহেন্দ্রের কাছে আত্মসমর্পন করিয়াছিল। আজ বিনোদিনীকে সম্মুখে দেখিয়া তাহার খণ্ডিত প্রেমের দাহ শান্তি মানিল না। ইহাকে মহেন্দ্র একদিন ভালোবাসিয়াছিল, ইহাকে এখনো হয়তো মনে মনে ভালোবাসে–এ কথা তাহার বুকের ভিতরে ঢেউয়ের মতো ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরেই মহেন্দ্র জাগিয়া উঠিবে, বিনোদিনীকে দেখিবে–কী জানি কী চক্ষে দেখিবে। কাল রাত্রে আশা তাহার সমস্ত সংসারকে নিষ্কন্টক দেখিয়াছিল–আজ প্রত্যুষে উঠিয়াই দেখিল, কাঁটাগাছ তাহার ঘরের প্রাঙ্গণেই। সংসারে সুখের স্থানই সবচেয়ে সংকীর্ণ–কোথাও তাহাকে সম্পূর্ণ নির্বিঘ্নে রাখিবার অবকাশ নাই।
হৃদয়ের ভার লইয়া আশা রাজলক্ষ্মীর ঘরে প্রবেশ করিল, এবং অত্যন্ত লজ্জার সঙ্গে কহিল, “মাসিমা, তুমি সমস্ত রাত বসিয়া আছ–যাও, শুতে যাও।” অন্নপূর্ণা আশার মুখের দিকে একবার ভালো করিয়া চাহিয়া দেখিলেন। তাহার পরে শুইতে না গিয়া আশাকে নিজের ঘরে লইয়া গেলেন। কহিলেন, “চুনি, যদি সুখী হইতে চাস, তবে সব কথা মনে রাখিস নে। অন্যকে দোষী করিয়া যেটুকু সুখ, দোষ মনে রাখিবার দুঃখ তাহার চেয়ে ঢের বেশি।”
আশা কহিল, “মাসিমা, আমি মনে কিছু পুষিয়া রাখিতে চাই না, আমি ভুলিতেই চাই, কিন্তু ভুলিতে দেয় না যে।”
অন্নপূর্ণা। বাছা, তুই ঠিক বলিয়াছিস–উপদেশ দেওয়া সহজ, উপায় বলিয়া দেওয়াই শক্ত। তবু আমি তোকে একটা উপায় বলিয়া দিতেছি। যেন ভুলিয়াছিস এই ভাবটি অন্তত বাহিরে প্রাণপণে রক্ষা করিতে হইবে-আগে বাহিরে ভুলিতে আরম্ভ করিস, তাহা হইলে ভিতরেও ভুলিবি। এ কথা মনে রাখিস চুনি, তুই যদি না ভুলিস, তবে অন্যকেও স্মরণ করাইয়া রাখিবি! তুই নিজের ইচ্ছায় না পারিস, আমি তোকে আজ্ঞা করিতেছি, তুই বিনোদিনীর সঙ্গে এমন ব্যবহার কর্‌, যেন সে কখনো তোর কোনো অনিষ্ট করে নাই এবং তাহার দ্বারা তোর অনিষ্টের কোনো আশঙ্কা নাই।
আশা নম্রমুখে কহিল, “কী করিতে হইবে বলো।” অন্নপূর্ণা কহিলেন, “বিনোদিনী এখন বিহারীর জন্য চা তৈরি করিতেছে। তুই দুধ-চিনি-পেয়ালা সমস্ত লইয়া যা–দুইজনে মিলিয়া কাজ কর্‌।”
আশা আদেশ পালনের জন্য উঠিল।
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “এটা সহজ–কিন্তু আমার আর-একটি কথা আছে, সেটা আরো শক্ত–সেইটে তোকে পালন করিতেই হইবে। মাঝে মাঝে মহেন্দ্রের সঙ্গে বিনোদিনীর দেখা হইবেই, তখন তোর মনে কী হইবে, তাহা আমি জানি–সে-সময় তুই গোপন কটাক্ষেও মহেন্দ্রের ভাব কিংবা বিনোদিনীর ভাব দেখিবার চেষ্টামাত্রও করিস নে। বুক ফাটিয়া গেলেও তোকে অবিচলিত থাকিতে হইবে। মহেন্দ্র ইহা জানিবে যে, তুই সন্দেহ করিস না, শোক করিস না, তোর মনে ভয় নাই, চিন্তা নাই–জোড় ভাঙিবার পূর্বে যেমন ছিল, জোড় লাগিয়া আবার ঠিক তেমনই হইয়াছে–ভাঙনের দাগটুকুও মিলাইয়া গেছে। মহেন্দ্র কি আর-কেহ তোর মুখ দেখিয়া নিজেকে অপরাধী বলিয়া মনে করিবে না। চুনি, ইহা আমার অনুরোধ বা উপদেশ নহে, ইহা তোর মাসিমার আদেশ। আমি যখন কাশী চলিয়া যাইব, আমার এই কথাটি একদিনের জন্যও ভুলিস নে।”
আশা চায়ের পেয়ালা প্রভৃতি লইয়া বিনোদিনীর কাছে উপস্থিত হইল। কহিল, “জল কি গরম হইয়াছে। আমি চায়ের দুধ আনিয়াছি।”
বিনোদিনী আশ্চর্য হইয়া আশার মুখের দিকে চাহিল। কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো বারান্দায় বসিয়া আছেন, চা তুমি তাঁহার কাছে পাঠাইয়া দাও, আমি ততক্ষণ পিসিমার জন্য মুখ ধুইবার বন্দোবস্ত করিয়া রাখি। তিনি বোধ হয় এখনই উঠিবেন।”
বিনোদিনী, চা লইয়া বিহারীর কাছে গেল না। বিহারী ভালোবাসা স্বীকার করিয়া তাহাকে যে অধিকার দিয়াছে, সেই অধিকার স্বেচ্ছামতে খাটাইতে তাহার সংকোচ বোধ হইতে লাগিল। অধিকারলাভের যে মর্যাদা আছে, সেই মর্যাদা রক্ষা করিতে হইলে অধিকারপ্রয়োগকে সংযত করিতে হয়। যতটা পাওয়া যায় ততটা লইয়া টানাটানি করা কাঙালকেই শোভা পায়–ভোগকে খর্ব করিলেই সম্পদের যথার্থ গৌরব। এখন, বিহারী তাহাকে নিজে না ডাকিলে, কোনো-একটা উপলক্ষ করিয়া বিনোদিনী তাহার কাছে আর যাইতে পারে না।
বলিতে-বলিতেই মহেন্দ্র আসিয়া উপস্থিত হইল। আশার বুকের ভিতরটা যদিও ধড়াস করিয়া উঠিল, তবু সে আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়া স্বাভাবিক স্বরে মহেন্দ্রকে কহিল, “তুমি এত ভোরে উঠিলে যে? পাছে আলো লাগিয়া তোমার ঘুম ভাঙে তাই আমি জানালা-দরজা সব বন্ধ করিয়া আসিয়াছি।”
বিনোদিনীর সম্মুখেই আশাকে এইরূপ সহজভাবে কথা কহিতে শুনিয়া মহেন্দ্রের বুকের একটা পাথর যেন নামিয়া গেল। সে আনন্দচিত্তে কহিল, “মা, কেমন আছেন, তাই দেখিতে আসিয়াছি–মা কি এখনো ঘুমাইতেছেন।”
আশা কহিল, “হাঁ, তিনি ঘুমাইতেছেন, এখন তুমি যাইয়ো না। বিহারী-ঠাকুরপো বলিয়াছেন, তিনি আজ
অনেকটা ভালো আছেন। অনেক দিন পরে কাল তিনি সমস্ত রাত ভালো করিয়া ঘুমাইয়াছেন।”
মহেন্দ্র নিশ্চিন্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কাকীমা কোথায়।” আশা তাঁহার ঘর দেখাইয়া দিল। আশার এই দৃঢ়তা ও সংযম দেখিয়া বিনোদিনীও আশ্চর্য হইয়া গেল।
মহেন্দ্র ডাকিল, “কাকীমা!” অন্নপূর্ণা যদিও ভোরে স্নান করিয়া লইয়া এখন পূজায় বসিবেন স্থির করিয়াছিলেন তবুও তিনি কহিলেন, “আয়, মহিন, আয়।”
মহেন্দ্র তাঁহাকে প্রণাম করিয়া কহিল, “কাকীমা, আমি পাপিষ্ঠ, তোমাদের কাছে আসিতে আমার লজ্জা করে।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “ছি ছি, ও কথা বলিস নে মহিন–ছেলে ধুলা লইয়াও মার কোলে আসিয়া বসে।”
মহেন্দ্র। কিন্তু আমার এ ধুলা কিছুতেই মুছিবে না কাকীমা। অন্নপূর্ণা। দুই-একবার ঝাড়িলেই ঝরিয়া যাইবে। মহিন, ভালোই হইয়াছে। নিজেকে ভালো বলিয়া তোর অহংকার ছিল, নিজের ‘পরে বিশ্বাস তোর বড়ো বেশি ছিল, পাপের ঝড়ে তোর সেই গর্বটুকুই ভাঙ্গিয়া দিয়াছে, আর কোনো অনিষ্ট করে নাই।
মহেন্দ্র। কাকীমা, এবার তোমাকে আর ছাড়িয়া দিব না, তুমি গিয়াই আমার এই দুর্গতি হইয়াছে। অন্নপূর্ণা। আমি থাকিয়া যে-দুর্গতি ঠেকাইয়া রাখিতাম, সে-দুর্গতি একবার ঘটিয়া যাওয়াই ভালো। এখন
আর তোর আমাকে কোনো দরকার হইবে না। দরজার কাছে আবার ডাক পড়িল, “কাকীমা, আহ্নিকে বসিয়াছ নাকি।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “না, তুই আয়।” বিহারী ঘরে প্রবেশ করিল। এত সকালে মহেন্দ্রকে জাগ্রত দেখিয়া কহিল, “মহিনদা, আজ তোমার জীবনে এই বোধ হয় প্রথম সূর্যোদয় দেখিলে!”
মহেন্দ্র কহিল, “হাঁ বিহারী, আজ আমার জীবনে প্রথম সূর্যোদয়, বিহারীর বোধ হয় কাকীমার সঙ্গে কোনো পরামর্শ আছে–আমি যাই।” বিহারী হাসিয়া কহিল, “তোমাকেও নাহয় ক্যাবিনেটের মিনিস্টার করিয়া লওয়া গেল। তোমার কাছে আমি তো কখনো কিছু গোপন করি নাই–যদি আপত্তি না কর, আজও গোপন করিব না।” মহেন্দ্র। আমি আপত্তি করিব! তবে আর দাবি করিতে পারি না বটে। তুমি যদি আমার কাছে কিছু গোপন না কর, তবে আমিও আমার প্রতি আবার শ্রদ্ধা করিতে পারিব।
আজকাল মহেন্দ্রের সম্মুখে সকল কথা অসংকোচে বলা কঠিন। বিহারীর মুখ বাধিয়া আসিল, তবু সে জোর করিয়া বলিল, “বিনোদিনীকে বিবাহ করিব, এমন-একটা কথা উঠিয়াছিল, কাকীমার সঙ্গে সেই সম্বন্ধে আমি কথাবার্তা শেষ করিতে আসিয়াছি।”
মহেন্দ্র একান্ত সংকুচিত হইয়া উঠিল। অন্নপূর্ণা চকিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “এ আবার কী কথা বিহারী।” মহেন্দ্র প্রবল শক্তি প্রয়োগ করিয়া সংকোচ দূর করিল। কহিল, “বিহারী, এ বিবাহের কোনো প্রয়োজন নাই।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “এ বিবাহের প্রস্তাবে কি বিনোদিনীর কোনো যোগ আছে।”
বিহারী কহিল, “কিছুমাত্র না।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “সে কি ইহাতে রাজী হইবে।”
মহেন্দ্র বলিয়া উঠিল, “বিনোদিনী কেন রাজী হইবে না, কাকীমা। আমি জানি, সে একমনে বিহারীকে ভক্তি করে–এমন আশ্রয় সে কি ইচ্ছা করিয়া ছাড়িয়া দিতে পারে।”
বিহারী কহিল, “মহিনদা, আমি বিনোদিনীকে বিবাহের প্রস্তাব করিয়াছি–সে লজ্জার সঙ্গে তাহা প্রত্যাখ্যান করিয়াছে।”
শুনিয়া মহেন্দ্র চুপ করিয়া রহিল।




৫৪

ভালোয়-মন্দয় দুই-তিন দিন রাজলক্ষ্মীর কাটিয়া গেল। একদিন প্রাতে তাঁহার মুখ বেশ প্রসন্ন ও বেদনা সমস্ত হ্রাস হইল। সেই দিন তিনি মহেন্দ্রকে ডাকিয়া কহিলেন, “আর আমার বেশিক্ষণ সময় নাই–কিন্তু আমি বড়ো সুখে মরিলাম মহিন, আমার কোনো দুঃখ নাই। তুই যখন ছোটো ছিলি, তখন তোকে লইয়া আমার যে আনন্দ ছিল, আজ সেই আনন্দে আমার বুক ভরিয়া উঠিয়াছে–তুই আমার কোলের ছেলে, আমার বুকের ধন–তোর সমস্ত বালাই লইয়া আমি চলিয়া যাইতেছি, এই আমার বড়ো সুখ।“ বলিয়া রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রের মুখে গায়ে হাত বুলাইতে লাগিলেন। মহেন্দ্রের রোদন বাধা না মানিয়া উচ্ছ্বসিত হইতে লাগিল।
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “কাঁদিস নে, মহিন। লক্ষ্মী ঘরে রহিল। বউমাকে আমার চাবিটা দিস। সমস্তই আমি গুছাইয়া রাখিয়াছি, তোদের ঘরকন্নার জিনিসের কোনো অভাব হইবে না। আর-একটি কথা আমি বলি মহিন, আমার মৃত্যুর পূর্বে কাহাকেও জানাস নে–আমার বাক্সে দুহাজার টাকার নোট আছে, তাহা আমি বিনোদিনীকে দিলাম। সে বিধবা,একাকিনী, ইহার সুদ হইতে তাহার বেশ চলিয়া যাইবে–কিন্তু মহিন, তাহাকে তোদের সংসারের ভিতরে রাখিস নে, তোর প্রতি আমার এই অনুরোধ রহিল।”
বিহারীকে ডাকিয়া রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “বাবা বিহারী, কাল মহিন বলিতেছিল, তুই গরিব ভদ্রলোকদের চিকিৎসার জন্য একটি বাগান করিয়াছিস–ভগবান তোকে দীর্ঘজীবী করিয়া গরিবের হিত করুন। আমার বিবাহের সময় আমার শ্বশুর আমাকে একখানি গ্রাম যৌতুক করিয়াছিলেন, সেই গ্রামখানি আমি তোকে দিলাম, তোর গরিবদের কাজে লাগাস, তাহাতে আমার শ্বশুরের পূণ্য হইবে।”




৫৫

রাজলক্ষ্মীর মৃত্যু হইলে পর শ্রাদ্ধশেষে মহেন্দ্র কহিল,”ভাই বিহারী, আমি ডাক্তারি জানি–তুমি যে-কাজ আরম্ভ করিয়াছে, আমাকেও তাহার মধ্যে নাও। চুনি যেরূপ গৃহিণী হইয়াছে সেও তোমার অনেক সহায়তা করিতে পারিবে। আমরা সকলে সেইখানেই থাকিব।”
বিহারী কহিল,”মহিনদা, ভালো করিয়া ভাবিয়া দেখো–এ কাজ কি বরাবর তোমার ভালো লাগিবে? বৈরাগ্যের ক্ষণিক উচ্ছ্বাসের মুখে একটা স্থায়ী ভার গ্রহণ করিয়া বসিয়ো না।”
মহেন্দ্র কহিল, “বিহারী, তুমিও ভাবিয়া দেখো, যে জীবন আমি গঠন করিয়াছি, তাহাকে লইয়া আলস্যভরে আর উপভোগ করিবার জো নাই–কর্মের দ্বারা তাহাকে যদি টানিয়া লইয়া না চলি, তবে কোন্‌ দিন সে আমাকে টানিয়া অবসাদের মধ্যে ফেলিবে। তোমার কর্মের মধ্যে আমাকে স্থান দিতেই হইবে।”
সেই কথাই স্থির হইয়া গেল।
অন্নপূর্ণা ও বিহারী বসিয়া শান্ত বিষাদের সহিত সেকালের কথা আলোচনা করিতেছিলেন। তাঁহাদের পরস্পরের বিদায়ের সময় কাছে আসিয়াছে। বিনোদিনী দ্বারের কাছে আসিয়া কহিল, “কাকীমা, আমি কি এখানে একটু বসিতে পারি।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “এসো এসো বাছা, বসো।”
বিনোদিনী আসিয়া বসিলে তাহার সহিত দুই-চারিটা কথা কহিয়া বিছানা তুলিবার উপলক্ষ করিয়া অন্নপূর্ণা বারান্দায় গেলেন।
বিনোদিনী বিহারীকে কহিল,”এখন আমার প্রতি তোমার যাহা আদেশ, তাহা বলো।”


বিহারী কহিল,”বোঠান, তুমিই বলো, তুমি কী করিতে চাও।” বিনোদিনী কহিল,”শুনিলাম, গরিবদের চিকিৎসার জন্য গঙ্গার ধারে তুমি একখানি বাগান লইয়াছ–আমি সেখানে তোমার কোনো একটা কাজ করিব। কিছু না হয় তো আমি রাঁধিয়া দিতে পারি।”

বিহারী কহিল, “বোঠান, আমি অনেক ভাবিয়াছি। নানান হাঙ্গামে আমাদের জীবনের জালে অনেক জট পড়িয়া গেছে। এখন নিভৃতে বসিয়া বসিয়া তাহারই একটি একটি গ্রন্থি মোচন করিবার দিন আসিয়াছে। পূর্বে সমস্ত পরিস্কার করিয়া লইতে হইবে। এখন হৃদয় যাহা চায়, তাহাকে আর প্রশ্রয় দিতে সাহস হয় না। এ পর্যন্ত যাহা-কিছু ঘটিয়াছে, যাহা-কিছু সহ্য করিয়াছি, তাহার সমস্ত আবর্তন, সমস্ত আন্দোলন শান্ত করিতে না পারিলে, জীবনের সমাপ্তির জন্য প্রস্তুত হইতে পারিব না। যদি সমস্ত অতীতকাল অনুকূল হইত, তবে সংসারে একমাত্র তোমার দ্বারাই আমার জীবন সম্পূর্ণ হইতে পারিত–এখন তোমা হইতে আমাকে বঞ্চিত হইতেই হইবে। এখন আর সুখের জন্য চেষ্টা বৃথা, এখন কেবল আস্তে আস্তে সমস্ত ভাঙচুর সারিয়া লইতে হইবে।”

এই সময় অন্নপূর্ণা ঘরে ঢুকিতেই বিনোদিনী কহিল, “মা, আমাকে তোমার পায়ে স্থান দিতে হইবে।

পাপিষ্ঠা বলিয়া আমাকে তুমি ঠেলিয়ো না।” অন্নপূর্ণা কহিলেন, “মা, চলো, আমার সঙ্গেই চলো।” অন্নপূর্ণা ও বিনোদিনীর কাশীতে যাইবার দিন কোনো সুযোগে বিহারী বিরলে বিনোদিনীর সহিত দেখা করিল। কহিল,”বোঠান, তোমার একটা কিছু চিহ্ন আমি কাছে রাখিতে চাই।” বিনোদিনী কহিল,”আমার এমন কী আছে, যাহা চিহ্নের মতো কাছে রাখিতে পার?”
বিহারী লজ্জা ও সংকোচের সহিত কহিল,”ইংরেজের একটা প্রথা আছে, প্রিয়জনের একগুচ্ছ চুল
সমরণের জন্য রাখিয়া দেয়–যদি তুমি–।”
বিনোদিনী। ছি ছি, কী ঘৃণা। আমার চুল লইয়া কী করিবে। সেই অশুচি মৃতবস্তু আমার এমন কিছুই নহে, যাহা আমি তোমকে দিতে পারি। আমি হত-ভাগিনী তোমার কাজে থাকিতে পারিব না–আমি এমন একটাকিছু দিতে চাই, যাহা আমার হইয়া তোমার কাজ করিবে–বলো,তুমি লইবে?
বিহারী কহিল, “লইব।” তখন বিনোদিনী তাহার অঞ্চলের প্রান্ত খুলিয়া হাজার টাকার দুইখানি নোট বিহারীর হাতে দিল। বিহারী সুগভীর আবেগের সহিত স্থিরদৃষ্টিতে বিনোদিনীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। খানিক বাদে বিহারী
কহিল, “আমি কি তোমাকে কিছু দিতে পারিব না।”
বিনোদিনী কহিল, “তোমার চিহ্ন আমার কাছে আছে, তাহা আমার অঙ্গের ভূষণ–তাহা কেহ কাড়িতে পারিবে না। আমার আর কিছু দরকার নাই।” বলিয়া সে নিজের হাতের সেই কাটা দাগ দেখাইল। বিহারী আশ্চর্য হইয়া রহিল। বিনোদিনী কহিল, “তুমি জান না–এ তোমারই আঘাত–এবং এ আঘাত তোমারই উপযুক্ত। ইহা এখন তুমিও ফিরাইতে পার না।”
মাসিমার উপদেশসত্ত্বেও আশা বিনোদিনী সম্বন্ধে মনকে নিষ্কন্টক করিতে পারে নাই। রাজলক্ষ্মীর সেবায় দুইজনে একত্রে কাজ করিয়াছে, কিন্তু আশা যখনই বিনোদিনীকে দেখিয়াছে তখনই তাহার বুকের মধ্যে ব্যথা লাগিয়াছে–মুখ দিয়া সহজে কথা বাহির হয় নাই, এবং হাসিবার চেষ্টা তাহাকে পীড়ন করিয়াছে। বিনোদিনীর নিকট হইতে সামান্য কোনো সেবা গ্রহণ করিতেও তাহার সমস্ত চিত্ত বিমুখ হইয়াছে। বিনোদিনীর সাজা পান অনেক সময়ে শিষ্টতার খাতিরে তাহাকে গ্রহণ করিতে হইয়াছে, কিন্তু আড়ালে তাহা ফেলিয়া দিয়াছে। কিন্তু আজ যখন বিদায়কাল উপস্থিত হইল–মাসিমা সংসার হইতে দ্বিতীয়বার চলিয়া যাইতেছেন বলিয়া আশার হৃদয় যখন অশ্রুজলে আর্দ্র হইয়া গেল, তখন সেইসঙ্গে বিনোদিনীর প্রতি তাহার করুণার উদয় হইল। যে একেবারে চলিয়া যাইতেছে তাহাকে মাপ করিতে পারে না, এমন কঠিন মন অল্পই আছে। আশা জানিত, বিনোদিনী মহেন্দ্রকে ভালোবাসে; মহেন্দ্রকে ভালো না বাসিবেই বা কেন। মহেন্দ্রকে ভালোবাসা যে কিরূপ অনিবার্য, আশা তাহা নিজের হৃদয়ের ভিতর হইতেই জানে। নিজের ভালোবাসার সেই বেদনায় বিনোদিনীর প্রতি আজ তাহার বড়ো দয়া হইল। বিনোদিনী মহেন্দ্রকে চিরদিনের জন্য ছাড়িয়া যাইতেছে, তাহার যে দুর্বিষহ দুঃখ, তাহা আশা অতিবড়ো শত্রুর জন্যও কামনা করিতে পারে না–মনে করিয়া তাহার চক্ষে জল আসিল; এককালে সে বিনোদিনীকে ভালোবাসিয়াছিল–সেই ভালোবাসা তাহাকে স্পর্শ করিল। সে ধীরে ধীরে বিনোদিনীর কাছে আসিয়া অত্যন্ত করুণার সঙ্গে, স্নেহের সঙ্গে, বিষাদের সঙ্গে মৃদুস্বরে কহিল, “দিদি, তুমি চলিলে?”


বিনোদিনী আশার চিবুক ধরিয়া কহিল, “হাঁ বোন, আমার যাইবার সময় আসিয়াছে। একসময় তুমি আমাকে ভালোবাসিয়াছিলে–এখন সুখের দিনে সেই ভালোবাসার একটুখানি আমার জন্যে রাখিয়ো, ভাই–আর সব ভুলিয়া যেয়ো!”

মহেন্দ্র আসিয়া প্রণাম করিয়া কহিল, “বৌঠান, মাপ করিয়ো।” তাহার চোখের প্রান্তে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়াইয়া পড়িল।
বিনোদিনী কহিল, “তুমিও মাপ করিয়ো ঠাকুরপো, ভগবান তোমাদের চিরসুখী করুন।”


0 comments:

Post a Comment