গৃহদাহ-২

ষোড়শ পরিচ্ছেদ
একি, সুরেশ যে! এস এস, বাড়ির ভেতরে এস। ভাল ত?
মহিমের স্বাগত-সম্ভাষণ সমাপ্ত হইবার পূর্বে সুরেশ সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। হাতের গ্লাডস্টোন ব্যাগটা নামাইয়া রাখিয়া কহিল, হ্যাঁ, ভাল। কিন্তু কি রকম, একা দাঁড়িয়ে যে? অচলা বধূঠাকুরানী একমুহূর্তে সচলা হয়ে অন্তর্ধান হলেন কিরূপে? তাঁর প্রবল বিশ্রম্ভালাপ মোড়ের ওপর থেকে যে আমাকে এ বাড়ির পাত্তা দিলে।
বস্তুতঃ অচলার শেষ কথাটা রাগের মাথায় একটু জোরে বাহির হইয়া পড়িয়াছিল, ঠিক দ্বারের বাহিরেই তাহা সুরেশের কানে গিয়াছিল।
সুরেশ কহিল, দেখলে মহিম, বিদুষী স্ত্রী-লাভের সুবিধে কত? ক’দিনই বা এসেছেন, কিন্তু এর মধ্যেই পাড়াগাঁয়ের প্রেমালাপের ধরনটা পর্যন্ত এমনি আয়ত্ত করে নিয়েছেন যে, খুঁত বের করে দেয়, পাড়াগেঁয়ে মেয়েরও তা সাধ্য নেই।
মহিম লজ্জায় আকর্ণ রাঙ্গা হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। সুরেশ ঘরের দিকে চাহিয়া অচলাকে উদ্দেশ করিয়া পুনরায় কহিল, অত্যন্ত অসময়ে এসে রসভঙ্গ করে দিলুম বৌঠান, মাপ কর। মহিম, দাঁড়িয়ে রইলে যে! বসবার কিছু থাকে ত নিয়ে চল, একটু বসি। হাঁটতে হাঁটতে ত পায়ের বাঁধন ছিঁড়ে গেছে—ভাল জায়গায় বাড়ি করেছিলে ভাই—চল, চল, কলকাতায় চল।
চল, বলিয়া মহিম তাহাকে বাহিরের বসিবার ঘরে আনিয়া বসাইল।
সুরেশ কহিল, বৌঠান কি আমার সামনে বের হবেন না নাকি? পর্দানশীন?
মহিম জবাব দিবার পূর্বেই পাশের দরজা ঠেলিয়া অচলা প্রবেশ করিল। তাহার মুখে কলহের চিহ্নমাত্র নাই, নমস্কার করিয়া প্রসন্নমুখে কহিল, এ যে আশাতীত সৌভাগ্য! কিন্তু এমন অকস্মাৎ যে?
তাহার প্রফুল্ল হাসিমুখ সুখ-সৌভাগ্যের প্রসন্ন বিকাশ কল্পনা করিয়া সুরেশের বুকের ভিতরটা ঈর্ষায় যেন জ্বলিয়া উঠিল। হাত তুলিয়া প্রতি-নমস্কার করিয়া বলিল, এখন দেখচি বটে, এমন অকস্মাৎ এসে পড়া উচিত হয়নি। কিন্তু কাণ্ডটা কি হচ্চিল? Their first difference না,—আসা পর্যন্ত এইভাবে মতভেদ চলচে? কোন্‌টা?
অচলা তেমনি হাসিমুখে কহিল, কোন্‌টা শুনলে আপনি বেশ খুশি হন বলুন? শেষেরটা ত? তা হলে আমার তাই বলা উচিত—অতিথিকে মনঃক্ষুণ্ণ করতে নেই।
সুরেশের মুখ গম্ভীর হইল; কহিল, কে বললে নেই? বাড়ির গৃহিণীর সেই ত হল আসল কাজ—সেই ত তার পাকা পরিচয়।
অচলা হাসিতে হাসিতে কহিল, গৃহই নেই, তার আবার গৃহিণী! এই দুঃখীদের কুঁড়ের মধ্যে কি করে যে আজ আপনার রাত্রি কাটবে, সেই হয়েছে আমার ভাবনা। কিন্তু ধন্য আপনাকে, জেনে শুনে এ দুঃখ সইতে এসেছেন।
স্বামীর মুখের প্রতি চাহিয়া কহিল, আচ্ছা, নয়নবাবুকে ধরে চন্দ্রবাবুর বাড়িতে আজ রাতটার মত ওঁর শোবার ব্যবস্থা করা যায় না? তাঁদের পাকা বাড়ি—বসবার ঘরটাও আছে, ওঁর কষ্ট হতো না!
সৌজন্যের আবরণে উভয়ের শ্লেষের এই-সকল প্রচ্ছন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে মহিম মনে মনে অধীর হইয়া উঠিতেছিল; কিন্তু কি করিয়া থামাইবে, ভাবিয়া পাইতেছিল না, এমনি অবস্থায় সুরেশ নিজেই তাহার প্রতিকার করিল; সহসা হাতজোড় করিয়া বলিল, আমার ঘাট হয়েচে বৌঠান, বরং একটু চা-টা দাও, খেয়ে গায়ে জোর করে নিয়ে তার পরে নয়নবাবুকে বল, শ্রবণবাবুকে বল—চন্দ্রবাবুর পাকা ঘরে শোবার জন্যে সুপারিশ ধরতে রাজি আছি। কিন্তু যাই বল মহিম, এর ওপর এত টান সত্যি হলে, খুশি হবার কথা বটে।

মহিমের হইয়া অচলাই তাহার উত্তর দিল; সহাস্যে কহিল, খুশি হওয়া না হওয়া মানুষের নিজের হাতে; কিন্তু এ আমার শ্বশুরের ভিটে, এর ওপর টান না জন্মে বড়লাটের রাজপ্রাসাদের ওপর টান পড়লে সেইটে ত হত মিথ্যে। যাক, আগে গায়ে জোর হোক, তার পর কথা হবে। আমি চায়ের জল চড়াতে বলে এসেচি, পাঁচ মিনিটের মধ্যে এনে হাজির করে দিচ্চি—ততক্ষণ মুখ বুজে একটু বিশ্রাম করুন; বলিয়া অচলা হাসিয়া প্রস্থান করিল।
সে চলিয়া যাইতেই সুরেশের বুকের জ্বালাটা যেন বাড়িয়া উঠিল। নিজেকে সে চিরদিনই দুর্বল এবং অস্থিরমতি বলিয়াই জানিত, এবং এজন্য তাহার লজ্জা বা ক্ষোভও ছিল না। ছেলেবেলায় বন্ধুবান্ধবেরা যখন মহিমের সঙ্গে তুলনা করিয়া তাহাকে খেয়ালী প্রভৃতি বলিয়া অনুযোগ করিত, তখন সে মনে মনে খুশি হইয়া বলিত, সে ঠিক যে, তাহার সঙ্কল্পের জোর নাই, সে প্রবৃত্তির বাধ্য; কিন্তু হৃদয় তাহার প্রশস্ত—সে কখনও হীন বা ছোট কাজ করে না। সে নিজের আয় বুঝিয়া ব্যয় করিতে জানে না, পাত্রাপাত্র হিসাব করিয়া দান করিতে পারে না—মন কাঁদিয়া উঠিলে গায়ের বস্ত্রখানা পর্যন্ত বিসর্জন দিয়া চলিয়া আসিতে তাহার বাধে না—তা সে যাহাকে এবং যে কারণেই হোক; কিন্তু এ কথা কাহারও বলিবার জো নেই যে, সুরেশ কাহাকেও দ্বেষ করিয়াছে, কিংবা স্বার্থের জন্য এমন কোন কাজ করিয়াছে, যাহা তাহার করা উচিত ছিল না। সুতরাং আজন্মকাল হৃদয়ের ব্যাপারে যাহার একান্ত দুর্বল বলিয়াই অখ্যাতি ছিল এবং নিজেও যাহা সে সত্য বলিয়াই বিশ্বাস করিত, সেই সুরেশ যখন অকস্মাৎ অচলার সম্পর্কে শেষ-মুহূর্তে আপনার এত বড় কঠোর সংযমের পরিচয় পাইল, তখন নিজের মধ্যে এই অজ্ঞাত শক্তির দেখা পাইয়া কেবল আত্মপ্রসাদই লাভ করিল না, তাহার সমস্ত হৃদয় গর্বে বিস্ফারিত হইয়া উঠিল।অচলার বিবাহের পরে দুটো দিন সে আপনাকে নিরন্তর এই কথাই বলিতে লাগিল—সে শক্তিহীন অক্ষম নয়—সে প্রবৃত্তির দাস নয়; বরঞ্চ আবশ্যক হইলে সমস্ত প্রবৃত্তিটাকেই সে বুকের ভিতর হইতে সমূলে উৎপাটন করিয়া ফেলিয়া দিতে পারে। বন্ধুত্ব যে কি, তাহার সুখের জন্য একজন যে কতখানি ত্যাগ করিতে পারে, এইবার বন্ধু ও বন্ধু-পত্নী বুঝুন গিয়া।
কিন্তু কোন মিথ্যা দিয়াই দীর্ঘকাল একটা ফাঁক ভরাইয়া রাখা যায় না। আত্মসংযম তাহার সত্য বস্তু নয়, ইহা আত্মপ্রতারণা। সুতরাং একটা সম্পূর্ণ সপ্তাহ না কাটিতেই এই মিথ্যা সংযমের মোহ তাহার বিস্ফারিত হৃদয় হইতে ধীরে ধীরে নিষ্কাশিত হইয়া তাহাকে সঙ্কুচিত করিয়া আনিতে লাগিল, মন তাহার বারংবার বলিতে লাগিল, এই স্বার্থত্যাগের দ্বারা সে পাইল কি? ইহা তাহাকে কি দিল? কোন্‌ অবলম্বন লইয়া সে আপনাকে এখন খাড়া রাখিবে? পিসিমা বলিলেন, বাবা, এইবার তুই এমনি একটি বৌ ঘরে আন্‌, আমি নিয়ে সংসার করি।
একদিন সমাজের দোরগোড়ায় কেদারবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হইলে তিনি স্পষ্টই বলিলেন, কাজটা তাঁহার ভাল হয় নাই। মহিমের সহিত বিবাহ দিতে ত গোড়াগুড়িই তাঁহার ইচ্ছা ছিল না—শুধু সে নিশ্চেষ্ট হইয়া রহিল বলিয়াই তিনি অবশেষে মত দিলেন। ঘরে আসিয়া তাহার মনের মধ্যে অভিশাপের মত জাগিতে লাগিল, এই বিবাহ দ্বারা তাহাদের কেহই যেন সুখী না হয়। নিজের অবস্থাকে অতিক্রম করার অপরাধ বন্ধুও অনুভব করুন, অচলাও যেন নিজের ভুল বুঝিতে পারিয়া আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হইয়া মরে। কিন্তু তাই বলিয়া মন তাহার ছোট নয়। এই অকল্যাণ কামনার জন্য নিজেকে সে অনেকরকম করিয়া শাসিত করিতে লাগিল। কিন্তু তাহার পীড়িত প্রতারিত হৃদয় কিছুতেই বশ মানিল না—নিতান্ত একগুঁয়ে ছেলের মত নিরন্তর ঐ কথাই আবৃত্তি করিতে লাগিল। এমনি করিয়া মাস-খানেক সে কোনমতে কাটাইয়া দিয়া একদিন কৌতূহল আর দমন করিতে না পারিয়া অবশেষে ব্যাগ হাতে মহিমের বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইল।

সুরেশ বন্ধুর মুখের পানে চাহিয়া কহিল, এখন দেখতে পাচ্চো মহিম, আমার কথাটা কতখানি সত্যি?
মহিম জিজ্ঞাসা করিল, কোন্‌ কথাটা?
সুরেশ বিজ্ঞের মত বলিল, আমার পল্লীগ্রামে বাস নয় বটে, কিন্তু এর সমস্তই আমি জানি। আমি তথাপি কি সাবধান করে দিইনি যে, গ্রামের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে একটা ঘোরতর বিরোধ বাধবে?
মহিম সহজভাবে কহিল, কৈ, তেমন বিরোধ ত কিছু হয়নি।
বিরোধ আর বল কাকে? তোমার বাড়িতে কেউ খেলে কি? সেইটেই কি যথেষ্ট অশান্তি অপমান নয়?
আমি খেতে কাউকে বলিনি।
বলনি? আচ্ছা, কৈ, বৌভাতে আমাকে ত নেমন্তন্ন করনি মহিম?
ওটা হয়নি বলেই করিনি।
সুরেশ বিস্মিত হইয়া বলিল, বৌভাত হয়নি? ওঃ—তোমাদের যে আবার—কিন্তু এমন করে ক’টা উপদ্রব এড়ানো যাবে মহিম? আপদ-বিপদ আছে, ছেলেমেয়ের কাজ-কর্ম আছে—সংসার করতে গেলে নেই কি? আমি বলি—
যদুর হাতে চায়ের সরঞ্জাম এবং নিজে থালায় করিয়া মিষ্টান্ন লইয়া অচলা প্রবেশ করিল। সুরেশের শেষ কথাটা তাহার কানে গিয়াছিল; কিন্তু তাহার মুখের ভাবে সুরেশ তাহা ধরিতে পারিল না। দুই বন্ধুর জলযোগ এবং চা-পান শেষ হইলে মহিম কাঁধের উপর চাদরটা ফেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। গ্রামের জমিদার মুসলমান, তাঁহার ছেলেটিকে মহিম ইংরাজি পড়াইত। জমিদারসাহেব নিজে লেখাপড়া না জানিলেও তাঁহার ঔদার্য ছিল, মহিমের সহিত সদ্ভাবও যথেষ্ট ছিল। এইজন্য গ্রামের লোক সমাজের দোহাই দিয়া আজও তাহার উপর উপদ্রব করিতে সাহস করে নাই।
অচলা কহিল, আজ পড়াতে না গেলেই কি হতো না?
মহিম কহিল, কেন?
অচলার মনের জোর ও অন্তরের নির্মলতা যত বড়ই হোক, সুরেশের সহিত তাহার সম্বন্ধটা যেরূপ দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাতে তাহার আকস্মিক অভ্যাগমে কোন রমণীই সঙ্কোচ অনুভব না করিয়া থাকিতে পারে না। সুরেশকে সে ভাল করিয়াই চিনিত, তাহার হৃদয় যত মহৎই হোক, সে হৃদয়ের ঝোঁকের উপর তাহার কোন আস্থা ছিল না—এমন কি, ভয়ই করিত। এই সন্ধ্যায় তাহারই সহিত তাহাকে একাকী ফেলিয়া যাইবার প্রস্তাবে সে মনে মনে উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিল; কিন্তু বাহিরে তাহার লেশমাত্র প্রকাশ না করিয়া হাসিয়া কহিল, বাঃ, সে কি হয়? অতিথিকে একলা ফেলে—
মহিম কহিল, তাতে অতিথি সৎকারের কোন ত্রুটি হবে না। তা ছাড়া তুমি ত রইলে—

অচলা ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, কিন্তু আমিও থাকতে পারব না। সুরেশের প্রতি চাহিয়া কহিল, আমাদের উড়ে বামুনটি এমনি পাকা রাঁধুনী যে, তার সঙ্গে না থাকলে কিছুই মুখে দেবার জো থাকবে না। আমি বলি, তুমি বরঞ্চ—
মহিম ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না, তা হয় না। ঘণ্টা-দুই বৈ ত নয়। বলিয়া ঘরের কোণ হইতে সে লাঠিটা তুলিয়া লইল। একে ত মহিমের কাজের ধারা সহজে বিপর্যস্ত হয় না, তাহাতে এই একটা সামান্য কারণ লইয়া বারংবার নির্বন্ধ প্রকাশ করিতেও অচলার লজ্জা করিতে লাগিল, পাছে ভয়টা তাহার সুরেশের চোখে ধরা পড়িয়া লজ্জাটা শতগুণ হইয়া উঠে।
মহিম ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল। তাহাকে শুনাইয়া সুরেশ অচলাকে হাসিয়া কহিল, কেন নিজের মুখ হেঁট করা! চিরকাল জানি, ও সে পাত্রই নয় যে, কারও কথা রাখবে।
তুমি বরং যা হোক একখানা বই আমাকে দিয়ে নিজের কাজে যাও—আমার দিব্যি সময় কেটে যাবে।
কথাটা হঠাৎ অচলাকে বাজিল যে, বাস্তবিকই মহিম কোনদিন কোন অনুরোধই তাহার রক্ষা করে না। হউক না ইহা তাহার সুমহৎ গুণ, কিন্তু তবুও সুরেশের মুখ হইতে স্বামীর এই আজন্ম কর্তব্যনিষ্ঠার পরিচয় তাহারই সম্মুখে আজ তাহাকে অপমানকর উপেক্ষার আকারে বিঁধিল। কোন কথা না কহিয়া, সে নিজের ঘরে গিয়া, যদুকে দিয়া একখানা বাংলা বই পাঠাইয়া দিয়া রান্নাঘরে চলিয়া গেল।
অনেক রাত্রে শয়ন করিতে গিয়া মহিম জিজ্ঞাসা করিল, সুরেশ কতদিন এখানে থাকবে তোমাকে বললে?
এমনি ত নানা কারণে আজ সারাদিনই স্বামীর উপর তাহার মন প্রসন্ন ছিল না; তাহাতে এই প্রশ্নের মধ্যে একটা কুৎসিত বিদ্রূপ নিহিত আছে কল্পনা করিয়া সে চক্ষের নিমেষে জ্বলিয়া উঠিল; কঠোর কণ্ঠে প্রশ্ন করিল, তার মানে?
মহিম অবাক হইয়া গেল। সে সোজাভাবেই কথাটা জানিতে চাহিয়াছিল, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ কিছুই করে নাই। তাহাদের এতক্ষণের আলাপের মধ্যে এ প্রশ্নটা সে বন্ধুকে সঙ্কোচে জিজ্ঞাসা করিতে পারে নাই এবং সুরেশ নিজে হইতে তাহা বলে নাই। কিন্তু তাহার আশা ছিল, সুরেশ নিশ্চয়ই অচলাকে তাহা বলিয়াছে।
মহিমকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া অচলা নিজেই বলিল, এ কথার মানে এত সোজা যে, তোমাকে জিজ্ঞাসা করবারও দরকার নেই। তোমার বিশ্বাস যে, সুরেশবাবু কোন সঙ্কল্প নিয়েই এখনে এসেছেন, এবং তা সফল হতে কত দেরি হবে সে আমি জানি। এই ত?
মহিম আরও ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া স্নিগ্ধস্বরে বলিল, আমার ও-রকম কোন বিশ্বাস নেই। কিন্তু মৃণালের ব্যবহারে আজ তোমার মন ভাল নেই, তুমি কিছুই ধীরভাবে বুঝতে পারবে না। আজ শোও, কাল সে কথা হবে। বলিয়া নিজেই বিছানায় শুইয়া পাশ ফিরিয়া নিদ্রার উদ্যোগ করিল।
অচলাও শুইয়া পড়িল বটে, কিন্তু কিছুতেই ঘুমাইতে পারিল না। তাহার মনের মধ্যে সারাদিন যে বিরক্তি উত্তরোত্তর জমা হইয়া উঠিতেছিল, সামান্য একটা কলহের আকারে তাহা বাহির হইয়া যাইতে পারিলে হয়ত সে সুস্থ হইতে পারিত; কিন্তু এমন করিয়া তাহার মুখ বন্ধ করিয়া দেওয়ায় সে নিজের মধ্যেই শুধু পুড়িতে লাগিল। অথচ যে প্রসঙ্গ বন্ধ হইয়া গেল, তাহাকে অশিক্ষিত সাধারণ স্ত্রীলোকের মত গায়ে পড়িয়া আন্দোলন করায় যে লজ্জা এবং ইতরতা আছে, তাহাও তাহার দ্বারা সম্পূর্ণ অসম্ভব। সে শুধু কল্পনায় স্বামীকে প্রতিপক্ষ দাঁড় করাইয়া, জ্বালাময়ী প্রশ্নোত্তরমালায় নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করিয়া গভীর রাত্রি পর্যন্ত বিনিদ্র থাকিয়া শয্যায় ছটফট করিতে লাগিল।
একটু বেলায় ঘুম ভাঙ্গিয়া অচলা ধড়মড় করিয়া বাহিরে আসিয়া দেখিল, যদু কেৎলি হাতে করিয়া রান্নাঘরে চলিয়াছে। ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বাবু কিছু বলে গেছেন যদু?

যদু কহিল, এক প্রহর বেলার মধ্যেই ফিরে আসবেন বলে গেছেন।
মহিম প্রত্যহ প্রত্যুষে উঠিয়া নিজের ক্ষেতখামার দেখিতে যাইত; ফিরিয়া আসিতে কোনদিন বা দ্বিপ্রহর অতীত হইয়া যাইত।
অচলা প্রশ্ন করিল, নতুনবাবু উঠেছেন?
যদু কহিল, উঠেছেন বৈ কি! তিনিই ত চা তৈরি করতে বলে দিলেন।
অচলা তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুইয়া, কাপড় ছাড়িয়া বাহিরে আসিয়া দেখিল, সুরেশ বহুক্ষণ পূর্বেই প্রস্তুত হইয়া ঘরের সমস্ত জানালা খুলিয়া দিয়া, খোলা দরজার সুমুখে একখানা চেয়ার টানিয়া লইয়া কালকের সেই বইখানা পড়িতেছে। অচলার পদশব্দে সুরেশ বই হইতে মুখ তুলিয়া চাহিল। অচলার মুখের উপর রাত্রিজাগরণের সমস্ত চিহ্ন দেদীপ্যমান। চোখের নীচে কালি পড়িয়াছে, গণ্ড পাংশু, ওষ্ঠ মলিন—সে যত দেখিতে লাগিল, ততই তাহার দুই চক্ষু ঈর্ষার আগুনে দগ্ধ হইতে লাগিল; কিন্তু কিছুতেই দৃষ্টি আর ফিরাইতে পারিল না।
তাহার চাহনির ভঙ্গীতে অচলা বিস্মিত হইল, কিন্তু অর্থ বুঝিতে পারিল না; কহিল, কখন উঠলেন? আমার উঠতে আজ দেরি হয়ে গেল।
তাই ত দেখছি, বলিয়া সুরেশ ধীরে ধীরে মাথা নাড়িল। সুমুখের দেওয়ালের গায়ে বহুদিনের পুরাতন একটা বড় আরশি টাঙ্গান ছিল; ঠিক সেই সময়েই অচলার দৃষ্টি তাহার উপরে পড়ায়, সুরেশের চাহনির অর্থ একমুহূর্তেই তাহার কাছে পরিস্ফুট হইয়া উঠিল এবং নিজের শ্রীহীনতার লজ্জায় যেন সে একেবারে মরিয়া গেল। এই মুখখানা কেমন করিয়া লুকাইবে, কোথায় লুকাইবে, সুরেশের মিথ্যা ধারণার কি করিয়া প্রতিবাদ করিবে—কিছুই ভাবিয়া না পাইয়া সে দ্রুতবেগে বাহির হইয়া গেল—বলিতে বলিতে গেল, যাই, আপনার চা নিয়ে আসি গে।
সুরেশ কোন কথা বলিল না, শুধু একটা প্রচণ্ড দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া শূন্যদৃষ্টিতে শূন্যের পানে চাহিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল।
মিনিট-দশেক পরে চায়ের সরঞ্জাম সঙ্গে লইয়া অচলা পুনরায় যখন প্রবেশ করিল, তখন সুরেশ আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়াছিল। চা খাইতে খাইতে সুরেশ কহিল, কৈ, তুমি চা খেলে না?
অচলা হাসিয়া কহিল, আমি আর খাইনে।
কেন খাও না?
আর ভাল লাগে না। তা ছাড়া, এ জায়গাটা গরম না কি, খেলে ঘুম হয় না। কাল ত প্রায় সারারাত ঘুমোতে পারিনি। হাসিয়া বলিল, একটা রাত ঘুম না হলে চোখমুখের কি যে শ্রী হয়—পোড়া-মুখ যে আর লোকের সামনে বার করা যায় না। বলিয়া লজ্জিত মুখে হাসিতে লাগিল।
সুরেশ ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, কিন্তু এ তোমার ছেলেবেলার অভ্যাস, চা খেতে মহিম অনুরোধ করে না?
অচলা হাসিয়া বলিল, অনুরোধ করলেই বা শুনবে কে? তা ছাড়া এ আর এমন কি জিনিস যে না খেলেই নয়?
এ হাসি যে শুষ্ক হাসি সুরেশ তাহা স্পষ্ট দেখিতে পাইল। আবার ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিল, তুমি ত জানই, ভুমিকা করে কথা বলা আমার অভ্যাসও নয়, পারিও নে। কিন্তু স্পষ্ট করে দু-একটা কথা জিজ্ঞাসা করলে কি তুমি রাগ করবে?
অচলা হাসিমুখে কহিল, শোন কথা! রাগ করব কেন?

সুরেশ কহিল, বেশ। তা হলে জিজ্ঞাসা করি, তুমি এখানে সুখে আছ কি?
অচলার হাসিমুখ আরক্ত হইয়া উঠিল; বলিল, এ প্রশ্ন আপনার করাই উচিত নয়।
কেন নয়?
অচলা মাথা নাড়িয়া বলিল, না। আমি সুখে নেই—এ কথা আপনার মনে হওয়াই অন্যায়।
সুরেশ একটুখানি ম্লানহাসি হাসিয়া বলিল, মনটা কি ন্যায়-অন্যায় ভেবে নিয়ে তবে মনে করে অচলা? কেবল মাস-দুই পূর্বে এ ভাবনা শুধু যে আমার উচিত ছিল তাই নয়, এ ভাবনায় অধিকার ছিল। আজ দু’মাস পরে সব অধিকার যদি ঘুচে থাকে ত থাক, সে নালিশ করিনে, এখন শুধু সত্যি কথাটা জেনে যেতে চাই। এসে পর্যন্ত একবার মনে হচ্ছে জিতেছ, একবার মনে হচ্ছে হেরেছ। আমার মনটা ত তোমার অজানা নেই—একবার সত্যি করে বল ত অচলা, কি?
দুর্নিবার অশ্রুর ঢেউ অচলার কণ্ঠ পর্যন্ত ফেনাইয়া উঠিল; কিন্তু প্রাণপণে তাহাদের শক্তি প্রতিহত করিয়া অচলা বেগে মাথা নাড়িয়া বলিল, আমি বেশ আছি।
সুরেশ ধীরে ধীরে কহিল, ভালই।
ইহার পরে কিছুক্ষণ পর্যন্ত কেহই যেন কোন কথা খুঁজিয়া পাইল না। সুরেশ অকস্মাৎ যেন চকিত হইয়া বলিয়া উঠিল, আর একটা কথা। তোমার জন্যে যে আমি কত সয়েচি, সে কি তোমার কখনো—
অচলা দুই কানে অঙ্গুলি দিয়া বলিয়া উঠিল, এ-সমস্ত আলোচনা আপনি মাপ করবেন।
সুরেশ খোলা দরজায় দুই হাত প্রসারিত করিয়া অচলার পলায়নের পথ রুদ্ধ করিয়া বলিল, না, মাপ আমি করতেই পারিনে, তোমাকে শুনতেই হবে।
তাহার চোখে সেই দৃষ্টি—যাহা মনে পড়িলে আজও অচলা শিহরিয়া ওঠে। একটুখানি পিছাইয়া গিয়া সভয়ে কহিল, আচ্ছা বলুন—
সুরেশ কহিল, ভয় নেই, তোমার গায়ে আমি হাত দেব না—আমার এখনো সে জ্ঞান আছে। বলিয়া পুনরায় চৌকির উপরে বসিয়া পড়িয়া কহিল, এই কথাটা তোমাকে মনে রাখতেই হবে যে, আমি তোমার ওপর সমস্ত অধিকার হারালেও, আমার ওপর তোমার সমস্ত অধিকার বর্তমান আছে।
অচলা বাধা দিয়া কহিল, এ মনে রাখায় আমার কোন লাভ নেই, কিন্তু—, বলিতে বলিতে দেখিতে পাইল, কথাটা যেন সজোরে আঘাত করিয়া সুরেশকে পলকের জন্য বিবর্ণ করিয়া ফেলিল এবং সেই মুহূর্তে নিজেও স্পষ্ট অনুভব করিল অনুতাপের কথা তাহার নিজের পিঠের উপর সজোরে আসিয়া পড়িল।
ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া এবার সে কোমলকণ্ঠে বলিল, সুরেশবাবু, এ-সব কথা আমারও শোনা পাপ, আপনারও বলা উচিত নয়। কেন আপনি এ-সব কথা তুলে আমাকে দুঃখ দিচ্চেন?

সুরেশ তাহার মুখের উপর দৃষ্টি রাখিয়া বলিল, দুঃখ কি পাও অচলা?
অচলার মুখ দিয়া অকস্মাৎ বাহির হইয়া গেল, আমি কি পাষাণ সুরেশবাবু?
সুরেশ তাহার সেই দৃষ্টি অচলার মুখের উপর হইতে নামাইল না বটে, কিন্তু অচলার দুই চক্ষু নত হইয়া পড়িল। সুরেশ ধীরে ধীরে বলিল, ব্যস্‌, এই আমার চিরজীবনের সম্বল রইল অচলা, এর বেশি আর চাইনে। বলিয়া এক মুহূর্ত স্থির থাকিয়া কহিল, তুমি যখন পাষাণ নও, তখন এই শেষ ভিক্ষে থেকে আর আমাকে কিছুতে বঞ্চিত করতে পারবে না। তোমার সুখের ভার যার ওপর ইচ্ছে থাকুক, কিন্তু তোমার হাত থেকে দুঃখই যখন শুধু পেয়ে এসেছি, তখন তোমারও দুঃখের বোঝা আজ থেকে আমার থাক—এই বর আজ মাগি—আমাকে তুমি ভিক্ষা দাও। বলিতে বলিতেই অশ্রুভারে তাহার কণ্ঠরোধ হইয়া গেল। অচলার চোখ দিয়াও তাহার বিগত দিবারাত্রির সমস্ত পুঞ্জীভূত বেদনা তাহার ইচ্ছার বিরুদ্ধেও এইবার গলিয়া ঝরঝর করিয়া পড়িতে লাগিল।
এমনি সময়ে ঠিক দ্বারের বাহিরেই জুতার শব্দ শোনা গেল এবং পরক্ষণেই মহিম ঘরে ঢুকিতে ঢুকিতে কহিল, কি হে সুরেশ, চা-টা খেলে?
সুরেশ সহসা জবাব দিতে পারিল না। সে কোনমতে মুখ নিচু করিয়া কোঁচার খুঁটে চোখ মুছিয়া ফেলিল, এবং অচলা আঁচলে মুখ ঢাকিয়া দ্রুতবেগে মহিমের পাশ দিয়া বাহির হইয়া গেল। মহিম চৌকাঠের ভিতর এক পা এবং বাহিরে এক পা দিয়া হতবুদ্ধির মত দাঁড়াইয়া রহিল।




সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
আপনাকে সংবরণ করিয়া মহিম ঘরে ঢুকিয়া একখানা চৌকি টানিয়া লইয়া উপবেশন করিল।
মানব-চিত্ত যে অবস্থায় সর্বাপেক্ষা অসঙ্কোচে ও অবলীলাক্রমে মিথ্যা উদ্ভাবন করিতে পারে, সুরেশের তখন সেই অবস্থা। সে চট করিয়া হাত দিয়া চোখ মুছিয়া ফেলিল; সলজ্জ হাস্যে, উদারভাবে স্বীকার করিল যে, সে বাস্তবিকই ভারী দুর্বল হইয়া পড়িতেছে। কিন্তু মহিম সেজন্য কিছুমাত্র উদ্বেগ প্রকাশ করিল না, এমন কি তাহার হেতু পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করিল না।
সুরেশ তখন নিজেই নিজের কৈফিয়ত দিতে লাগিল। কহিল, যিনি যাই বলুন মহিম, এ আমি জোর করে বলতে পারি যে, এদের চোখে জল দেখলে কোথা থেকে যেন নিজেদের চোখেও জল এসে পড়ে—কিছুতে সামলানো যায় না। আমি না গিয়ে পড়লে কেদারবাবু ত এ যাত্রা কিছুতেই বাঁচতেন না, কিন্তু বুড়ো আচ্ছা বদমেজাজী লোক হে মহিম, একটিমাত্র মেয়ে, তবুও তাকে খবর দিতে দিলে না। বিয়ের দিন থেকে সেই যে ভদ্রলোক চটে আছে, সে চটা আর জোড়া লাগল না। বললুম, যা হবার, সে ত হয়েই গেছে—
মহিম জিজ্ঞাসা করিল, চা পেয়েছ ত হে?
সুরেশ ঘাড় নাড়িয়া কহিল, হাঁ পেয়েছি। কিন্তু বাপের কাছে এ-রকম ব্যবহার পেলে কার চক্ষে না জল আসে বল? পুরুষমানুষই সব সময় সইতে পারে না, এ ত স্ত্রীলোক।
মহিম বলিল, তা বটে। রাত্রে তোমার শোবার কোন ব্যাঘাত হয়নি সুরেশ, বেশ ঘুমোতে পেরেছিলে? নতুন জায়গা—
সুরেশ তাড়াতাড়ি কহিল, না, নতুন জায়গায় আমার ঘুমের কোন ত্রুটি হয়নি—একপাশেই রাত কেটে গেছে। আচ্ছা মহিম, কেদারবাবু তাঁর অসুখের খবর তোমাদের একেবারেই দিলেন না, এ কি আশ্চর্য ব্যাপার ভেবে দেখ দেখি!
মহিম একান্ত সহজভাবে কহিল, আশ্চর্য বৈ কি! বলিয়াই একটুখানি হাসিয়া কহিল, হাতমুখ ধুয়ে একটু বেড়াতে বার হবে নাকি? যাও ত একটু চটপট সেরে নাও ভাই, আমাকে ঘণ্টা-খানেকের মধ্যেই বেরুতে হবে। এখনও আমার সকালের কাজকর্মই সারা হয়নি।
সুরেশ তাহার পুস্তকের প্রতি মনোনিবেশ করিয়া কহিল, গল্পটা বেশ লাগছে—এটা শেষ করে ফেলি।
তাই কর। আমি ঘণ্টা-দুইয়ের মধ্যেই ফিরে আসছি, বলিয়া মহিম উঠিয়া চলিয়া গেল।
সে পিছন ফিরিবামাত্রই সুরেশ চোখ তুলিয়া চাহিল। মনে হইল, কোন্‌ অদৃশ্য হস্ত এক মুহূর্তের মধ্যে আগাগোড়া মুখখানার উপরে যেন এক পোঁচ লজ্জার কালি মাখাইয়া দিয়াছে।
যে দ্বার দিয়া মহিম বাহির হইয়া গেল, সেই খোলা দরজার প্রতি নির্নিমেষ চাহিয়া সুরেশ কাঠের মত শক্ত হইয়া বসিয়া রহিল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তাহার অযাচিত জবাবদিহির সমস্ত নিষ্ফলতা ক্রুদ্ধ অভিমানে তাহার সর্বাঙ্গে হূল ফুটাইয়া দংশন করিতে লাগিল।
দুই বন্ধুর কথোপকথন দ্বারের অন্তরালে দাঁড়াইয়া অচলা কান পাতিয়া শুনিতেছিল। মহিম কাপড় ছাড়িবার জন্য নিজের ঘরে ঢুকিবার অব্যবহিত পরেই সে কবাট ঠেলিয়া প্রবেশ করিল।
মহিম মুখ তুলিয়া চাহিতেই অচলা স্বাভাবিক মুক্তকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, আমার বাবা কি তোমার কাছে এমন কিছু গুরুতর অপরাধ করেছেন?

অকস্মাৎ এরূপ প্রশ্নের তাৎপর্য বুঝিতে না পারিয়া মহিম জিজ্ঞাসুমুখে নীরব রহিল।
অচলা পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, আমার কথাটা বুঝি বুঝতে পারলে না?
মহিম কহিল, না, কথাগুলো প্রিয় না হলেও স্পষ্ট বটে; কিন্তু তার অর্থ বোঝা কঠিন। অন্ততঃ আমার পক্ষে বটে।
অচলা অন্তরের ক্রোধ যথাশক্তি দমন করিয়া জবাব দিল, এ-দুটোর কোনটাই তোমার কাছে কঠিন নয়, কিন্তু কঠিন হচ্ছে স্বীকার করা। সুরেশবাবুকে যে কথা তুমি স্বচ্ছন্দে জানিয়ে এলে, সেই কথাটাই আমাকে জানাবার বোধ করি তোমার সাহস হচ্ছে না। কিন্তু আজ আমি তোমাকে স্পষ্ট করেই জিজ্ঞাসা করতে চাই, আমার বাবা কি তোমার কাছে এত তুচ্ছ হয়ে গেছেন যে, তাঁর সাংঘাতিক অসুখের খবরটাতে তুমি কান দেওয়া আবশ্যক মনে কর না?
মহিম ঘাড় নাড়িয়া বলিল, খুবই করি। কিন্তু যেখানে সে আবশ্যক নেই, সেখানে আমাকে কি করতে বল?
অচলা কহিল, কোন্‌খানে আবশ্যক নেই শুনি?
মহিম ক্ষণকাল স্ত্রীর মুখের প্রতি নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া কঠোরকণ্ঠে বলিয়া ফেলিল, যেমন এইমাত্র সুরেশের ছিল না। আর যেমন এ নিয়ে তোমারও এতখানি রাগারাগি করে আমার মুখ থেকে কড়া টেনে বার করবার প্রয়োজন ছিল না। যাক, আর না। যার তলায় পাঁক আছে, তার জল ঘুলিয়ে তোলা আমি বুদ্ধির কাজ মনে করিনে। বলিয়া মহিম বাহির হইয়া যাইতেছিল, অচলা দ্রুতপদে সম্মুখে আসিয়া পথ আটকাইয়া দাঁড়াইল। ক্ষণকাল পরে সে দাঁত দিয়া সজোরে অধর চাপিয়া রহিল, ঠিক যেন একটা আকস্মিক দুঃসহ আঘাতের মর্মান্তিক চিৎকার সে প্রাণপণে রুদ্ধ করিতেছে মনে হইল। তারপরে কহিল, তোমার বাইরে কি বিশেষ জরুরি কোন কাজ আছে? দু’ মিনিট অপেক্ষা করতে পারবে না?
মহিম কহিল, তা পারব।
অচলা কহিল, তা হলে কথাটা স্পষ্ট হয়েই যাক। জল যখন সরে আসে, তখনই পাঁকের খবর পাওয়া যায়, এই না?
মহিম ঘাড় নাড়িয়া কহিল, হাঁ।
অচলা বলিল, নিরর্থক জল ঘুলিয়ে তোলার আমিও পক্ষপাতী নই, কিন্তু সেই ভয়ে পঙ্কোদ্বারটাও বন্ধ রাখা কি ভাল? একদিন যদি ঘোলায় ত ঘোলাক না, যদি বরাবরের জন্যে পাঁকের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যায়! কি বল?
মহিম কঠিনভাবে কহিল, আমার আপত্তি নেই, কিন্তু তার চেয়ে ঢের বেশি দরকারী কাজ আমার পড়ে রয়েছে—এখন সময় হবে না।
অচলা ঠিক তেমনি কঠিনকণ্ঠে জবাব দিল, তোমার এই ঢের বেশি দরকারী কাজ সারা হয়ে গেলে ফুরসত হবে ত? ভাল, ততক্ষণ আমি না হয় অপেক্ষা করেই রইলুম। বলিয়া পথ ছাড়িয়া সরিয়া দাঁড়াইল।
মহিম ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। যতক্ষণ তাহাকে দেখা গেল, ততক্ষণ পর্যন্ত সে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার পরে কবাট বন্ধ করিয়া দিল।
ঘণ্টা-খানেক পরে যখন সে স্নান করিবার প্রসঙ্গ লইয়া বাহিরে সুরেশের ঘরে আসিয়া দাঁড়াইল, তাহার তখন মুখের শ্রান্ত শোকাচ্ছন্ন চেহারা সুরেশ চোখ তুলিবামাত্র অনুভব করিল। মহিমের সঙ্গে ইতিমধ্যে নিশ্চয় কিছু একটা ঘটিয়া গিয়াছে, ইহা অনুমান করিয়া সুরেশ মনে মনে অত্যন্ত সঙ্কুচিত হইয়া উঠিল, কিন্তু সাহস করিয়া প্রশ্ন করিতে পারিল না।
অচলা চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ও কি হচ্ছে?

সুরেশ ব্যাগের মধ্যে তাহার কল্যকার ব্যবহৃত জামা-কাপড়গুলি গুছাইয়া তুলিতেছিল, কহিল, একটার মধ্যেই ত ট্রেন, একটু আগেই ঠিক করে নিচ্চি।
অচলা একটুখানি আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিল, আপনি কি আজই যাবেন নাকি?
সুরেশ মুখ না তুলিয়াই কহিল, হাঁ।
অচলা কহিল, কেন বলুন ত?
সুরেশ তেমনি অধোমুখে থাকিয়াই বলিল, আর থেকে কি হবে? তোমাদের একবার দেখতে এসেছিলুম, দেখে গেলুম।
অচলা ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া বলিল, তবে উঠে আসুন। এ-সব কাজ আপনাদের নয়, মেয়েমানুষের; আমি গুছিয়ে সমস্ত ঠিক করে দিচ্ছি। বলিয়া অগ্রসর হইয়া আসিতেই সুরেশ ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, না না, তোমাকে কিছু করতে হবে না—এ কিছুই নয়—এ অতি—
কিন্তু তাহার মুখের কথা শেষ না হইতেই অচলা ব্যাগটা তাহার সুমুখ হইতে টানিয়া লইয়া সমস্ত জিনিসপত্র উপুড় করিয়া ফেলিয়া ভাঁজ করা কাপড় আর একবার ভাঁজ করিয়া ধীরে ধীরে ব্যাগের মধ্যে তুলিতে লাগিল। সুরেশ অদূরে দাঁড়াইয়া অত্যন্ত কুণ্ঠিত হইয়া বারংবার বলিতে লাগিল, এর কিছুই আবশ্যক ছিল না—সে যদি—আমি নিজেই—ইত্যাদি ইত্যাদি।
অচলা অনেকক্ষণ পর্যন্ত কোন কথারই প্রত্যুত্তর করিল না, ধীরে ধীরে কাজ করিতে করিতে কহিল, আপনার ভগিনী কিংবা স্ত্রী থাকলে তাঁরাই করতেন, আপনাকে করতে দিতেন না; কিন্তু আপনার ভয় যদি বন্ধুটি ফিরে এসে দেখতে পান—এই না? কিন্তু তাতেই বা কি, এ ত মেয়েমানুষেরই কাজ।
সুরেশ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। এইমাত্র মহিমের সহিত তাহার যাহা হইয়া গিয়াছে, অচলা তাহা নিশ্চয়ই জানে না। তাই কথাটা পাড়িয়া তাহাকে ক্ষুণ্ণ করিতেও তাহার সাহস হইল না, অথচ ভয় করিতেও লাগিল, পাছে সে আসিয়া পড়িয়া আবার স্বচক্ষে ইহা দেখিয়া ফেলে।
ব্যাগটি পরিপাটি করিয়া সাজাইয়া দিয়া অচলা আস্তে আস্তে বলিল, বাবার অসুখের কথা না তুললেই ছিল ভাল। এতে তাঁর অপমানই শুধু সার হল—উনি ত গ্রাহ্যই করলেন না।
সুরেশ চকিত হইয়া কহিল, কি বললে তোমাকে মহিম?
অচলা তাহার ঠিক জবাব না দিয়া পাশের দরজাটা চোখ দিয়া দেখাইয়া কহিল, ঐখানে দাঁড়িয়ে আমি নিজেই সমস্ত শুনেচি।
সুরেশ অপ্রতিভ হইয়া কহিল, সেজন্যে আমি তোমার কাছে মাপ চাচ্চি অচলা।
অচলা মুখ তুলিয়া হাসিয়া কহিল, কেন?
সুরেশ অনুতপ্ত-কণ্ঠে কহিল, কারণ ত তুমি নিজেই বললে। আমার নিজের দোষে তাঁকে তোমাকে দুজনকে আজ আমি অপমান করেছি; সেইজন্যেই তোমার কাছে বিশেষ করে ক্ষমা প্রার্থনা করচি অচলা!
অচলা মুখ তুলিয়া চাহিল। সহসা তাহার সমস্ত চোখমুখ যেন ভিতরের আবেগে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল; কহিল, যাই কেননা আপনি করে থাকেন সুরেশবাবু, সে ত আমার জন্যেই করেছেন? আমাকে লজ্জার হাত থেকে অব্যাহতি দেবার জন্যই ত আজ আপনার এই লজ্জা। তবুও আমার কাছে আপনাকে মাপ চাইতে হবে, এত বড় অমানুষ আমি নই। কিসের জন্যে আপনি লজ্জিত হচ্ছেন? যা করেছেন, বেশ করেছেন।

সুরেশের বিস্মিত হতবুদ্ধিপ্রায় মুখের পানে চাহিয়া অচলা বুঝিল, সে তাহার কথাটা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারে নাই। তাই একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া কহিল, আজই আপনি যাবেন না, সুরেশবাবু! এখানে লজ্জা যদি কিছু পেয়ে থাকেন সে ত আমারই লজ্জা ঢাকবার জন্যে; নইলে নিজের জন্যে আপনার ত কোন দরকারই ছিল না! আর বাড়ি আপনার বন্ধুর একার নয়, এর ওপর আমারও ত কিছু অধিকার আছে। সেই জোরে আজ আমি নিমন্ত্রণ করচি, আমার অতিথি হয়ে অন্ততঃ আর কিছুদিন থাকুন।
তাহার সাহস দেখিয়া সুরেশ অভিভূত হইয়া গেল। কিন্তু দ্বিধাগ্রস্ত-হৃদয়ে কি একটা বলিবার উপক্রম করিতেই দেখিতে পাইল, মহিম তাহার বাহিরের কাজ সারিয়া বাড়ি ঢুকিতেছে। অচলা তখন পর্যন্ত ব্যাগটা সম্মুখে লইয়া মেঝের উপর বসিয়া এই দিকে পিছন ফিরিয়া ছিল; পাছে মহিমের আগমন জানিতে না পারিয়া আরও কিছু বলিয়া ফেলে, এই ভয়ে যে একেবারে সঙ্কুচিত হইয়া বলিয়া উঠিল, এই যে মহিম, কাজ সারা হল তোমার?
হাঁ হল, বলিয়া মহিম ঘরে পা দিয়াই অচলাকে তদবস্থায় নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, ও কি হচ্ছে?
অচলা ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল, কিন্তু সে প্রশ্নের জবাব না দিয়া সুরেশকেই লক্ষ্য করিয়া পূর্ব-প্রসঙ্গের সূত্র ধরিয়া কহিল, আপনি আমারও ত বন্ধু—শুধু বন্ধুই বা কেন, আমাদের যা করছেন, তাতে আপনি আমার পরমাত্মীয়। এমন করে চলে গেলে আমার লজ্জার, ক্ষোভের সীমা থাকবে না। আজ আপনাকে ত আমি কোনমতেই ছেড়ে দিতে পারব না।
সুরেশ শুষ্ক হাসিয়া কহিল, শোন কথা মহিম! তোমাদের দেখতে এসেছিলুম, দেখে গেলুম বাস্‌! কিন্তু এ জঙ্গলের মধ্যে আমাকে অনর্থক বেশিদিন ধরে রেখে তোমাদেরই বা লাভ কি, আর আমারই বা সহ্য করে ফল কি বল?
মহিম ধীরভাবে জবাব দিল, বোধ করি রাগ করে চলে যাচ্ছিলে; কিন্তু সেটা উনি পছন্দ করেন না। অচলা তীক্ষ্ণকণ্ঠে কহিল, তুমি পছন্দ কর নাকি?
মহিম জবাব দিল, আমার কথা ত হচ্ছে না।
সুরেশ মনে মনে অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিল। তার এই অপ্রিয় আলোচনা কোনমতে থামাইয়া দিবার জন্য প্রফুল্লতার ভান করিয়া সহাস্যে কহিল, এ কি মিথ্যে অপবাদ দেওয়া! রাগ করব কেন হে, আচ্ছা লোক ত তোমরা! বেশ, খুশিই যদি হও, আরও দু-একদিন না হয় থেকেই যাবো। বৌঠান, কাপড়গুলো আর তুলে কাজ নেই, বের করেই ফেলো। মহিম, চল হে, তোমাদের পুকুর থেকে আজ স্নান করেই আসা যাক; তার পরে বাড়ি গিয়ে না হয় একশিশি কুইনিনই গেলা যাবে।
চল, বলিয়া মহিম জামা-কাপড় ছাড়িবার জন্য ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

                                                                     



                                                           অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

যাহারা নূতন জুতার সুতীক্ষ্ণ কামড় গোপনে সহ্য করিয়া বাহিরে স্বচ্ছন্দতার ভান করে, ঠিক তাহাদের মতই সুরেশ সমস্ত দিনটা হাসিখুশিতে কাটাইয়া দিল; কিন্তু আর একজন, যাহাকে আরও গোপনে এই দংশনের অংশ গ্রহণ করিতে হইল, সে পারিল না।
স্বামীর অবিচলিত গাম্ভীর্যের কাছে এই কদাকার ভাঁড়ামিতে, এত বেহায়াপনায় তাহার ক্ষোভে অপমানে মাথা খুঁড়িয়া মরিতে ইচ্ছা করিতে লাগিল। তাঁহাকে সে আজও হৃদয়ের দিক হইতে চিনিতে না পারিলেও বুদ্ধির দিক হইতে চিনিয়াছিল। সে স্পষ্ট দেখিতে লাগিল, এই তীক্ষ্ণ-ধীমান অল্পভাষী লোকটির কাছে এ অভিনয় একেবারেই ব্যর্থ হইয়া যাইতেছে, অথচ লজ্জার কালিমা প্রতি মুহূর্তেই যেন তাহারি মুখের উপর গাঢ়তর হইয়া উঠিতেছে। আজ সকালবেলার পরে মহিম আর বাটীর বাহির হয় নাই; সুতরাং দিনের বেলায় ভাত খাওয়া হইতে শুরু করিয়া রাত্রির লুচি খাওয়া পর্যন্ত প্রায় সমস্ত সময়টাই এইভাবে কাটিয়া গেল।
অনেক রাত্রি পর্যন্ত বিছানার উপর ছটফট করিয়া অচলা ধীরে ধীরে কহিল, সারারাত্রি আলো জ্বেলে পড়লে আর একজন ঘুমোতে পারে না। তোমার কাছে এটুকু দয়াও কি আর আমি প্রত্যাশা করতে পারিনে?
তাহার কণ্ঠস্বরে মহিম চমকিয়া উঠিয়া এবং তাড়াতাড়ি বাতিটা নামাইয়া দিয়া কহিল, অন্যায় হয়ে গেছে, আমাকে মাপ করো। বলিয়া বই বন্ধ করিয়া আলো নিবাইয়া দিয়া শয্যায় আসিয়া শুইয়া পড়িল। এই প্রার্থিত অনুগ্রহলাভের জন্য অচলা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিল না, কিন্তু ইহা তাহার নিদ্রার পক্ষেও লেশমাত্র সাহায্য করিল না। বরঞ্চ যত সময় কাটিতে লাগিল, এই নিঃশব্দ অন্ধকার যেন ব্যথায় ভারী হইয়া প্রতি মুহূর্তেই তাহার কাছে দুঃসহ হইয়া উঠিতে লাগিল। আর সহিতে না পারিয়া এক সময়ে সে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা, জ্ঞানে হোক, অজ্ঞানে হোক, সংসারে ভুল করলেই তার শাস্তি পেতে হয়, এ কথা কি সত্যি?
মহিম অত্যন্ত সহজভাবে জবাব দিল, অভিজ্ঞ লোকেরা তাই ত বলেন।
অচলা পুনরায় কিছুক্ষণ নীরবে থাকিয়া কহিল, তবে যে ভুল আমরা দু’জনেই করেছি, যার কুফল গোড়া থেকেই শুরু হয়েচে, তার শেষ ফলটা কি-রকম দাঁড়াবে, তুমি আন্দাজ করতে পারো?
মহিম কহিল, না।
অচলা কহিল, আমিও পারিনে। কিন্তু ভেবে ভেবে আমি এটুকু বুঝেছি যে, আর সমস্ত ছেড়ে দিলেও শুধু পুরুষমানুষ বলেই এই শাস্তির বেশি ভার পুরুষের বহা উচিত।
মহিম বলিল, আরও একটু ভাবলে দেখিতে পাবে, মেয়েমানুষের বোঝা তাতে এক তিল কম পড়ে না। কিন্তু পুরুষটি কে? আমি, না সুরেশ?
অচলা যে শিহরিয়া উঠিল, অন্ধকারের মধ্যেও মহিম তাহা অনুভব করিল।
ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া অচলা ধীরে ধীরে কহিল, তুমি যে একদিন আমাকে মুখের ওপরেই অপমান করতে শুরু করবে, এ আমি ভেবেছিলুম। আর এও জানি, এ জিনিস একবার আরম্ভ হলে কোথায় যে শেষ হয়, তা কেউ বলতে পারে না; কিন্তু আমি ঝগড়া করতেও পারব না, কিংবা বিয়ে হয়েচে বলেই ঝগড়া করে তোমার ঘর করতেও পারব না। কাল হোক, পরশু হোক, আমি বাবার ওখানে ফিরে যাবো।
মহিম কহিল, তোমার বাবা কিন্তু আশ্চর্য হবেন।

অচলা বলিল, না। তিনি জানতেন বলেই আমাকে বারংবার সাবধান করবার চেষ্টা করেছিলেন যে, এর ফল কোনদিন ভাল হবে না। কলকাতায় চলে, কিন্তু পল্লীগ্রামে সমাজ, আত্মীয়, বন্ধু সকলকে ত্যাগ করে শুধু স্ত্রী নিয়ে কারও বেশি দিন চলে না। সুতরাং তিনি আর যাই হোন, আশ্চর্য হবেন না।
মহিম কহিল, তবে তাঁর নিষেধ শোনোনি কেন?
অচলা প্রাণপণ-বলে একটা উচ্ছ্বসিত শ্বাস দমন করিয়া লইয়া কহিল, আমি ভাবতুম, তুমি কিছুই না বুঝে কর না।
সে ধারণা ভেঙ্গে গেছে?
হাঁ।
তাই ভাগের কারবারে সুবিধে হলো না টের পেয়ে দোকান তুলে দিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে চাচ্ছো?
হাঁ।
মহিম কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, তা হলে যেয়ো। কিন্তু একে ব্যবসা বলেই যদি বুঝতে শিখে থাকো, আমার সঙ্গে তোমার মতের মিল হবে না, কিন্তু এ কথাটাও ভুলো না যে, ব্যবসা জিনিসটাকেও বুঝতে সময় লাগে। সে ভুল যদি কখনো ধরা পড়ে আমাকে জানিয়ো, আমি তখনি গিয়ে নিয়ে আসব।
অচলার চোখ দিয়া এক ফোঁটা জল গড়াইয়া পড়িল; হাত দিয়া তাহা সে মুছিয়া ফেলিয়া কয়েক মুহূর্ত স্থির থাকিয়া কণ্ঠস্বরকে সংযত করিয়া বলিল, ভুল মানুষের বাব বার হয় না। তোমার সে কষ্ট স্বীকার করবার দরকার হবে, মনে করিনে।
মহিম কহিল, মনে করা যায় না বলেই তাকে ভবিষ্যৎ বলা হয়। সেই ভবিষ্যতের ভাবনা ভবিষ্যতের জন্যে রেখে আজ আমাকে মাপ কর, আমি আর বকতে পারচি নে।
অচলা আঘাত পাইয়া বলিল, আমাকে কি তুমি তামাশা করচ? তা যদি হয়, তোমার ভুল হচ্ছে। আমি সত্যই কাল-পরশু চলে যেতে চাই।
মহিম কহিল, আমি সত্যিই তোমাকে যেতে দিতে চাইনে।
অচলা হঠাৎ অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কি আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে রাখবে? সে তুমি কিছুতেই পারো না, জানো?
মহিম শান্ত সহজভাবে জবাব দিল, বেশ ত, সেও ত আজই রাত্রে নয়। কাল-পরশু যখন যাবে, তখন বিবেচনা করে দেখলেই হবে। ঢের সময় আছে, আজ এই পর্যন্ত থাক। বলিয়া সে মাথার বালিশটা উলটাইয়া লইয়া সমস্ত প্রসঙ্গ জোর করিয়া বন্ধ করিয়া দিয়া, নিশ্চিন্তভাবে শয়ন করিল এবং বোধ করি বা পরক্ষণেই ঘুমাইয়া পড়িল।
পরদিন সকালে চা খাইতে বসিয়া সুরেশ জিজ্ঞাসা করিল, মহিম ত মাঠের চাষবাস দেখতে আজও ভোরে বেরিয়ে গেছে বোধ হয়?
অচলা ঘাড় নাড়িয়া কহিল, পৃথিবী ওলট-পালট হয়ে গেলেও তার অন্যথা হবার জো নেই।
সুরেশ চায়ের বাটিটা মুখ হইতে নামাইয়া রাখিয়া বলিল, এক হিসেবে সে আমাদের চেয়ে ঢের ভাল। তার কাজের একটা গতি আছে, যা কলের চাকার মত যতক্ষণ দম আছে, ততক্ষণ চলবেই।
অচলা কহিল, কলের মত হওয়াটাই কি আপনি ভাল বলেন?
সুরেশ মাথা নাড়িয়া বলিল, তা বলি, কেননা, এ ক্ষমতা আমার নিজের সাধ্যাতীত। দুর্বল হওয়ার যে কত দোষ, সে ত আমি জানি; তাই যে স্থিরচিত্ত, তাকে আমি প্রশংসা না করে পারিনে। কিন্তু আজ আমাকে ছুটি দাও, আমি বাড়ি যাই।
অচলা তৎক্ষণাৎ সম্মত হইয়া বলিল, যান। আমি কাল যাচ্চি।

সুরেশ আশ্চর্য হইয়া কহিল, তুমি কোথায় যাবে কাল?
কলকাতায়।
হঠাৎ কলকাতায় কেন? কৈ, কাল এ মতলব ত শুনিনি?
বাবার অসুখ, তাই তাঁকে একবার দেখতে যাবো।
সুরেশের মুখের উপর উদ্বেগের ছায়া পড়িল, কহিল, অসুস্থ বাপকে হঠাৎ দেখবার ইচ্ছে হওয়া কিছু সংসারে আশ্চর্য ঘটনা নয়; কিন্তু ভয় হয়, পাছে বা আমার জন্যেই একটা রাগারাগি করে—
অচলা তাহার কোন জবাব দিল না। যদু সুমুখ দিয়া যাইতেছিল, সুরেশ ডাকিয়া কহিল, তোর বাবু মাঠ থেকে ফিরেছেন রে?
যদু কহিল, তিনি ত আজ সকালে বার হননি! তাঁর পড়বার ঘরে ঘুমোচ্চেন।
অচলা তাড়াতাড়ি গিয়া দ্বারের বাহির হইতে উঁকি মারিয়া দেখিল, মহিম একটা চেয়ারের উপর হেলান দিয়া বসিয়া দুই পা টেবিলের উপরে তুলিয়া দিয়া ঘুমাইতেছে। একটা লোক রাত্রের অতৃপ্ত নিদ্রা এইভাবে পোষাইয়া লইতেছে, সংসারে ইহা একান্ত অদ্ভুত নহে, কিন্তু অচলার বাস্তুবিকই বিস্ময়ের অবধি রহিল না, যখন সে স্বচক্ষে দেখিল, তাহার স্বামী দিনের কর্ম বন্ধ রাখিয়া এই অসময়ে ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন। সে পা টিপিয়া ঘরে ঢুকিয়া চুপ করিয়া তাহার মুখের পানে চাহিয়া রহিল। সম্মুখের খোলা জানালা দিয়া প্রভাতের অপর্যাপ্ত আলোক সেই নিদ্রামগ্ন মুখের উপর পড়িয়াছিল। আজ অকস্মাৎ এতদিন পরে তাহার চোখের উপর এমন একটা নতুন জিনিস পড়িল যাহা ইতিপূর্বে কোনদিন সে দেখে নাই। আজ দেখিল, শান্ত মুখের উপর যেন একখানা অশান্তির সূক্ষ্ম জাল পড়িয়া আছে; কপালের উপর যে কয়েকটা রেখা পড়িয়াছে, এক বৎসর পূর্বেও সেখানে সে-সকল দাগ ছিল না। সমস্ত মুখের চেহারাটাই আজ যেন তাহার মনে হইল, কিসের গোপন ব্যথায় শ্রান্ত, পীড়িত। সে নিঃশব্দে আসিয়াছিল, নিঃশব্দেই চলিয়া যাইতে চাহিয়াছিল; কিন্তু পিকদানিটা পায়ে ঠেকিয়া যেটুকু শব্দ হইল, তাহাতেই মহিম চোখ মেলিয়া চাহিল, অচলা অপ্রস্তুত হইয়া কহিল, এখন ঘুমাচ্চো যে? অসুখ করেনি ত?
মহিম চোখ রগড়াইয়া উঠিয়া বসিয়া বলিল, কি জানি, অসুখ না হওয়াই ত আশ্চর্য!
অচলা আর দ্বিতীয় প্রশ্ন না করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
খাওয়া-দাওয়ার পরেই সুরেশ যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হইতেছিল, মহিম অদূরে একখানা চৌকির উপর বসিয়া তাহার সহিত কথাবার্তা কহিতেছিল; অচলা দ্বারের নিকট আসিয়া বিনা ভূমিকায় বলিয়া উঠিল, কাল আমিও যাচ্ছি। সুবিধে হলে বাবার সঙ্গে একবার দেখা করবেন।
সুরেশ বিস্ময় প্রকাশ করিয়া কহিল, তাই নাকি? বলিয়াই মহিমের মুখের প্রতি চোখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বৌঠানকে তুমি কাল কলকাতা পাঠাচ্চ নাকি মহিম?
স্ত্রীর এই গায়ে-পড়া বিরুদ্ধতায় মহিমের ভিতরটা যেন জ্বলিয়া উঠিল; কিন্তু সে মুখের ভাব প্রসন্ন রাখিয়াই মৃদু হাসিয়া বলিল, আর কোন বাধা ছিল না, কিন্তু আমাদের এই পল্লীগ্রামের গৃহস্থঘরে নাটক তৈরি করার রীতি নেই। কালই বা কেন, আজই ত তোমার সঙ্গে পাঠিয়ে দিতে পারতুম।
সুরেশের মুখ লজ্জায় আরক্ত হইয়া উঠিল; অচলা চক্ষের পলকে তাহা লক্ষ্য করিয়া জোর করিয়া হাসিয়া বলিল, সুরেশবাবু, আমাদের শহরে বাড়ি বলে লজ্জিত হবার কারণ নেই। অসুস্থ বাপ-মাকে দেখতে যাওয়া যদি পাড়াগাঁয়ের রীতি না হয়, আমি ত বলি আমাদের শহরের নাটকই ঢের ভাল। আপনি না হয় আজকের দিনটেও থেকে যান না, কাল একসঙ্গেই যাবো।

তাহার অপরিসীম ঔদ্ধত্যে সুরেশের মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। সে মাথা হেঁট করিয়া বলিতে লাগিল, না না, আমার আর থাকবার জো নেই বৌঠান! তোমার ইচ্ছে হলে কাল যেয়ো, কিন্তু আমি আজই চললুম। বলিতে বলিতেই সে তীব্র উত্তেজনায় হঠাৎ ব্যাগটা হাতে করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।
তাহার উত্তেজনার আবেগ অচলাকেও একবার যেন মূল হইতে নাড়িয়া দিল। সে অকস্মাৎ ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিল, এখনও ট্রেনের অনেক দেরি সুরেশবাবু, এরি মধ্যে যাবেন না—একটু দাঁড়ান। আমার দুটো কথা দয়া করে শুনে যান। তাহার আর্ত কণ্ঠস্বরের আকুল অনুরোধে উভয় শ্রোতাই যুগপৎ চমকিয়া উঠিল।
অচলা কোনদিকে লক্ষ্য না করিয়া বলিতে লাগিল, তোমার আমি কোন কাজেই লাগলুম না সুরেশবাবু, কিন্তু তুমি ছাড়া আর আমাদের অসময়ের বন্ধু কেউ নেই। তুমি বাবাকে গিয়ে বলো, এরা আমাকে বন্ধ করে রেখেছে, কোথাও যেতে দেবে না—আমি এখানে মরে যাবো। সুরেশবাবু, আমাকে তোমরা নিয়ে যাও—যাকে ভালবাসি নে, তার ঘর করবার জন্যে আমাকে তোমরা ফেলে রেখে দিয়ো না।
মহিম বিহ্বলের ন্যায় নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল।
সুরেশ ফিরিয়া দাঁড়াইয়া দুই চক্ষু দৃপ্ত করিয়া উচ্চকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, তুমি জানো মহিম, উনি ব্রাহ্মমহিলা। নামে স্ত্রী হলেও ওঁর ওপর পাশবিক বলপ্রয়োগের তোমার অধিকার নেই।
মহিম মুহূর্তকালের জন্যই অভিভূত হইয়া গিয়াছিল। সে আত্মসংবরণ করিয়া শান্তস্বরে স্ত্রীকে কহিল, তুমি কিসের জন্যে কি করচ, একবার ভেবে দেখ দিকি অচলা। সুরেশকে কহিল, পশু-বল, মানুষ-বল, কোন জোরই আমি কারও উপর কোন দিন খাটাই নে। বেশ ত সুরেশ, তুমি যদি থাকতে পার, আজকের দিনটা থেকে ওঁকে সঙ্গে করেই নিয়ে যাও না। আমি নিজে গিয়ে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসব—তাতে গ্রামের মধ্যে বিশেষ দৃষ্টিকটুও হবে না। একটুখানি থামিয়া বলিল, একটু কাজ আছে, এখন চললুম। সুরেশ, যাওয়া যখন হলই না, তখন কাপড়-চোপড় ছেড়ে ফেল। আমি ঘণ্টা-খানেকের মধ্যে ফিরে আসচি। বলিয়া ধীরে ধীরে ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল।
অচলা মূর্তির মত চৌকাঠ ধরিয়া যেমন দাঁড়াইয়াছিল, তেমনই দাঁড়াইয়া রহিল। সুরেশ মিনিট-খানেক হেঁটমুখে থাকিয়া হঠাৎ অট্টহাসি হাসিয়া বলিল, বাঃ রে, বাঃ। বেশ একটি অঙ্ক অভিনয় করা গেল! তুমিও মন্দ করনি, আমি ত চমৎকার! ওর বাড়িতে ওর স্ত্রী নিয়ে ওকেই চোখ রাঙ্গিয়ে দিলুম। আর চাই কি? আর বন্ধু আমার মিষ্টিমুখে একটু হেসে ঠিক যেন বাহবা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি বাজি রেখে বলতে পারি অচলা, ও আড়ালে শুধু গলা ছেড়ে হোহো করে হাসবার জন্যেই কাজের ছুতো করে বেরিয়ে গেল। যাক, আরশিখানা একবার আন ত বৌঠান, দেখি নিজের মুখের চেহারা কি-রকম দেখাচ্চে! বলিয়া চাহিয়া দেখিল, অচলার মুখখানা একেবারে সাদা হইয়া গিয়াছে। সে কোন জবাব দিল না, শুধু দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।













ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
যে শয্যা স্পর্শ করিতেও আজ অচলার ঘৃণা বোধ হওয়া উচিত ছিল, তাহাই যখন সে যথানিয়মে প্রস্তুত করিতে অপরাহ্নবেলায় ঘরে প্রবেশ করিল, তখন সমস্ত মনটা যে তাহার কোথায় এবং কি অবস্থায় ছিল—মানব-চিত্ত সম্বন্ধে যাঁহার কিছুমাত্র অভিজ্ঞতা আছে তাঁহারই অগোচর রহিবে না।
যন্ত্র-চালিতের মত অভ্যস্ত কর্ম সমাপন করিয়া ফিরিবার মুখে পাশের ছোট টেবিলটির প্রতি অকস্মাৎ তার চোখ পড়িয়া গেল; এবং ব্লটিং প্যাডখানির উপর প্রসারিত একখানি ছোট্ট চিঠি সে চক্ষের নিমিষে পড়িয়া ফেলিল। মাত্র একটি ছত্র। বার, তারিখ নাই, মৃণাল লিখিয়াছে—সেজদামশাই গো, করছ কি? পরশু থেকে তোমার পথ চেয়ে চেয়ে তোমার মৃণালের চোখ-দুটি ক্ষয়ে গেল যে!
বহুক্ষণ অবধি অচলার চোখের পাতা নড়িল না। ঠিক পাথরে-গড়া মূর্তির পলকবিহীন দৃষ্টি সেই একটি ছত্রের উপর পাতিয়া সে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। এ চিঠি কবেকার, কখন, কে আনিয়া দিয়া গেছে—সে কিছুই জানে না। মৃণালের বাটী কোন্‌ দিকে, কোন্‌ মুখে তাহার বাড়ি ঢুকিতে হয়, কোন্‌ পথটার উপর, কিজন্য সে এমন করিয়া তাহার ব্যগ্র উৎসুক দৃষ্টি পাতিয়া রাখিয়াছে, তাহার কিছুই জানিবার জো নাই। সম্মুখের এই ক’টি কালির দাগ শুধু এই খবরটুকু দিতেছে যে, কোন্‌ এক পরশু হইতে একজন আর একজনের প্রতীক্ষায় পথ চাহিয়া চোখ নষ্ট করিবার উপক্রম করিয়াছে, কিন্তু দেখা মিলে নাই।
এদিকে সেই প্রায়ান্ধকার ঘরের মধ্যে একদৃষ্টে চাহিয়া চাহিয়া, তাহার নিজের চোখ-দুটি বেদনায় পীড়িত এবং কালো কালো অক্ষরগুলা প্রথমে ঝাপসা এবং পরে যেন ছোট পোকার মত সমস্ত কাগজময় নড়িয়া বেড়াইতে লাগিল। তবুও এমনি একভাবে দাঁড়াইয়া হয়ত সে আর কতক্ষণ চাহিয়া থাকিত; কিন্তু নিজের অজ্ঞাতসারে এতক্ষণ ধরিয়া তাহার ভিতরে ভিতরে যে নিশ্বাসটা উত্তরোত্তর জমা হইয়া উঠিতেছিল, তাহাই যখন অবরুদ্ধ স্রোতের বাঁধ ভাঙ্গার ন্যায় অকস্মাৎ সশব্দে গর্জিয়া বাহির হইয়া আসিল, তখন সেই শব্দে সে চমকিয়া সম্বিৎ ফিরিয়া পাইল। দ্বারের বাহিরে মুখ তুলিয়া দেখিল, সন্ধ্যায় আঁধার প্রাঙ্গণতলে নামিয়া আসিয়াছে এবং যদু চাকর হ্যারিকেন লণ্ঠন জ্বালাইয়া বাহিরের ঘরে দিতে চলিয়াছে। ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বাবু ফিরে এসেছেন, যদু?
যদু কহিল, না মা, কৈ এখনও ত তিনি ফেরেন নি।
এতক্ষণে অচলার মনে পড়িল, দুপুরবেলার সেই লজ্জাকর অভিনয়ের একটা অঙ্ক শেষ হইলে, সেই যে তিনি বাহির হইয়া গিয়াছেন, এখনও ফিরেন নাই। স্বামীর প্রাত্যহিক গতিবিধি সম্বন্ধে আজ তাহার তিলমাত্র সংশয় রহিল না। সুরেশের আসা পর্যন্ত এমনই একটা উৎকট ও অবিচ্ছিন্ন কলহের ধারা এ বাটীতে প্রবাহিত হইয়াছিল যে তাহারই সহিত মাতামাতি করিয়া অচলা আর সব ভুলিয়াছিল। সে স্বামীকে ভালবাসে না, অথচ ভুল করিয়া বিবাহ করিয়াছে, সারাজীবন সেই ভুলেরই দাসত্ব করার বিরুদ্ধে তাহার অশান্ত চিত্ত বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়া অহর্নিশি লড়াই করিতেছিল। মৃণালের কথাটা সে একপ্রকার বিস্মৃত হইয়াই গিয়াছিল, কিন্তু আজ সন্ধ্যার অন্ধকারে সে মৃণালের একটিমাত্র ছত্র তাহার সমস্ত পুরাতন দাহ লইয়া যখন উল্টা-স্রোতে ফিরিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন একমুহূর্তে প্রমাণ হইয়া গেল, তাহার সেই ভুল-করা স্বামীরই অন্য নারীতে আসক্তির সংশয় হৃদয় দগ্ধ করিতে সংসারে কোন চিন্তার চেয়েই খাটো নয়।
লেখাটুকু সে আর একবার পড়িবার জন্য চোখের কাছে তুলিয়া ধরিতে হাত বাড়াইল, কিন্তু নিবিড় ঘৃণায় হাতখানা তাহার আপনি ফিরিয়া আসিল। সে চিঠি সেইখানেই তেমনি খোলা পড়িয়া রহিল, অচলা ঘরের বাহিরে আসিয়া, বারান্দার খুঁটিতে ঠেস দিয়া, স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

হঠাৎ তাহার মনে হইল—সব মিথ্যা। এই ঘরদ্বার, স্বামী-সংসার, খাওয়া-পরা, শোওয়া-বসা কিছুই সত্য নয়—কোন কিছুর জন্যেই মানুষের তিলার্ধ হাত-পা বাড়াইবার পর্যন্ত আবশ্যকতা নাই। শুধু মনের ভুলেই মানুষে ছটফট করিয়া মরে, না হইলে পল্লীগ্রাম শহরই বা কি, খড়ের ঘর রাজপ্রাসাদই বা কি, আর স্বামী-স্ত্রী, বাপ-মা, ভাই-বোন সম্বন্ধই বা কোথায়! আর কিসের জন্যেই বা রাগারাগি, কান্নাকাটি, ঝগড়াঝাঁটি করিয়া মরে! দুপুরবেলা অত বড় কাণ্ডের পরেও যে স্বামী স্ত্রীকে একলা ফেলিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিশ্চিন্ত হইয়া বাহিরে কাটাইতে পারে, তাহার মনের কথা যাচাই করিবার জন্যেই বা এত মাথাব্যথা কেন? সমস্ত মিথ্যা! সমস্ত ফাঁকি! মরীচিকার মতই সমস্ত অসত্য! কিন্তু সংসার তাহার কাছে এতদূর খালি হইয়া যাইতে পারিত না, একবার যদি সে মৃণালের ঐ ভাষাটুকুর উপরে তাহার সমস্ত চিত্ত ঢালিয়া না দিয়া, সেই মৃণালকে একবার ভাবিবার চেষ্টা করিত। অন্য নারীর সহিত সেই পল্লীবাসিনী সদানন্দময়ীর আচরণ একবার মনে করিয়া দেখিলে তার নিজের মনটাকে ঐ ক’টা কথার কালিমাই এমন করিয়া কালো করিয়া দিতে বোধ করি পারিত না।
যদু ফিরিয়া আসিয়া কহিল, বাবু জিজ্ঞাসা করলেন, চায়ের জল গরম হয়েছে কি?
অচলা ঠিক যেন ঘুম ভাঙ্গিয়া উঠিল, কহিল, কোন্‌ বাবু?
যদু জোর দিয়া বলিল, আমাদের বাবু। এইমাত্র তিনি ফিরে এলেন যে। চায়ের জল ত অনেকক্ষণ গরম হয়ে গেছে মা।
চল যাচ্ছি, বলিয়া অচলা রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হইয়া গেল। খানিক পরে চা এবং জলখাবার চাকরের হাতে দিয়া বাহিরে আসিয়া দেখিল, মহিম অন্ধকার বারান্দায় পায়চারি করিতেছে এবং সুরেশ ঘরের মধ্যে লণ্ঠনের কাছে মুখ লইয়া একমনে খবরের কাগজ পড়িতেছে। যেন কেহই কাহারো উপস্থিতি আজ জানিতেও পারে নাই। এই যে অত্যন্ত লজ্জাকর সঙ্কোচ দুটি চিরদিনের বন্ধুর মাঝখানে আজ সহজ শিষ্টাচারের পথটা পর্যন্ত রুদ্ধ করিয়া দিয়াছে, তাহার উপলক্ষটা মনে পড়িতেই অচলার পা-দুটি থামিয়া গেল।
অচলাকে দেখিয়া মহিম থমকিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, সুরেশকে চা দিতে এত দেরি হ’ল যে?
অচলার মুখ দিয়া কিছুতেই কথা বাহির হইল না। সে মুহূর্তকাল মাথা হেঁট করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া, নীরবে ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে আসিয়া উপস্থিত হইল।
যদু চায়ের সরঞ্জাম টেবিলের উপর রাখিয়া দিয়া বাহির হইয়া গেলে, সুরেশ কাগজখানা রাখিয়া দিয়া মুখ ফিরাইল; কহিল, মহিম কৈ, সে এখনো ফেরেনি নাকি?
সঙ্গে সঙ্গেই মহিম প্রবেশ করিয়া একখানা চৌকি টানিয়া লইয়া উপবেশন করিল, কিন্তু সে যে মিনিট-দশেক ধরিয়া তাহারই কানের কাছে বারান্দার উপরে হাঁটিয়া বেড়াইতেছিল, এই বাহুল্য কথাটা মুখ দিয়া উচ্চারণ করার প্রয়োজন বোধ করিল না।
তার পরেই সমস্ত চুপচাপ। অচলা নিঃশব্দে অধোমুখে দু বাটি চা প্রস্তুত করিয়া এক বাটি সুরেশকে দিয়া, অন্যটা স্বামীর দিকে অগ্রসর করিয়া দিয়া নীরবেই উঠিয়া যাইতেছিল, মহিমের আহ্বানে সে চমকিয়া দাঁড়াইল।
মহিম কহিল, একটু অপেক্ষা কর, বলিয়া নিজেই চট করিয়া উঠিয়া কবাটে খিল লাগাইয়া দিল। চক্ষের নিমেষে তাহার ছয়-নলা পিস্তলটার কথাই সুরেশের স্মরণ হইল; এবং হাতের পেয়ালা কাঁপিয়া উঠিয়া খানিকটা চা চলকাইয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। সে মুখখানা মড়ার মত বিবর্ণ করিয়া বলিল, দোর বন্ধ করলে যে?

তাহার কণ্ঠস্বর, মুখের চেহারা ও প্রশ্নের ভঙ্গীতে অচলারও ঠিক সেই কথাই মনে পড়িয়া মাথার চুল পর্যন্ত কাঁটা দিয়া উঠিল। বোধ করি বা একবার যেন সে চিৎকার করিবারও প্রয়াস করিল, কিন্তু তাহার যে চেষ্টা সফল হইল না। মহিম ক্ষণকালমাত্র অচলার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া সমস্ত বুঝিল। তার পরে সুরেশের মুখের পানে চাহিয়া বলিল, চাকরটা এসে পড়ে, এই জন্যেই—নইলে পিস্তলটা আমার চিরকাল যেমন বাক্সে বন্ধ থাকে, এখনো তেমনি আছে। তোমরা এত ভয় পাবে জানলে আমি দোর বন্ধ করতাম না।
সুরেশ চায়ের পেয়ালাটা নামাইয়া রাখিয়া হাসিবার মত মুখের ভাব করিয়া বলিল, বাঃ, ভয় পেতে যাবো কেন হে? তুমি আমার উপর গুলি চালাবে—বাঃ—প্রাণের ভয়! আমি? কবে আবার তুমি দেখলে? আচ্ছা যা হোক—
তাহার অসংলগ্ন কৈফিয়ত শেষ হইবার পূর্বেই মহিম কহিল, সত্যই কখনো ভয় পেতে তোমাকে দেখিনি। প্রাণের মায়া তোমার নেই বলেই আমি জানতাম। সুরেশ, আমার নিজের দুঃখের চেয়ে তোমার এই অধঃপতন আমার বুকে আজ বেশি করে বাজল। যাতে তোমার মত মানুষকেও এত ছোট করে আনতে পারে—না, সুরেশ কাল তুমি নিশ্চয় বাড়ি যাবে। কোন ছলে আর দেরি করা চলবে না।
সুরেশ তবুও কি একটা জবাব দিতে চাহিল; কিন্তু এবার তাহার গলা দিয়া স্বরও ফুটিল না, ঘাড়টাও সোজা করিতে পারিল না; সেটা যেন তাহার অজ্ঞাতসারেই ঝুঁকিয়া পড়িল।
তুমি ভেতরে যাও অচলা, বলিয়া মহিম খিল খুলিয়া পরক্ষণেই অন্ধকারের মধ্যে বাহির হইয়া গেল।
এইবার সুরেশ মাথা তুলিয়া জোর করিয়া হাসিয়া কহিল, শোন কথা। অমন কত গণ্ডা বন্দুক-পিস্তল রাতদিন নাড়াচাড়া করে বুড়ো হয়ে এলুম, এখন ওর একটা ভাঙ্গা ফুটো রিভলভারের ভয়ে মরে গেছি আর কি! হাসালে যা হোক, বলিয়া সুরেশ নিজেই টানিয়া টানিয়া হাসিতে লাগিল। সে হাসিতে যোগ দিবার মত লোক ঘরের মধ্যে অচলা ছাড়া আর কেহ ছিল না। সে কিন্তু যেমন ঘাড় হেঁট করিয়া এতক্ষণ দাঁড়াইয়া ছিল, তেমনি ভাবেই আরও কিছুকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া ধীরে ধীরে পাশের দরজা দিয়া ভিতরে চলিয়া গেল।
ঘণ্টা-খানেক পরে মহিম নিজের ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, কেহ নাই। পাশের ঘরে গিয়া দেখিল, মাটিতে মাদুর পাতিয়া, হাতের উপর মাথা রাখিয়া অচলা শুইয়া আছে। স্বামীকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়া সে উঠিয়া বসিল। পাশে একটা খালি তক্তপোশ ছিল, মহিম তাহার উপর উপবেশন করিয়া বলিল, কেমন, কাল তোমার বাপের বাড়ি যাওয়া ত ঠিক?
অচলা নীচের দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল, কোন জবাব দিল না।
মহিম অল্পক্ষণ অপেক্ষা করিয়া পুনশ্চ কহিল, যাকে ভালবাস না, তারই ঘর করতে হবে, এত বড় অন্যায় উপদ্রব আমি স্বামী হলেও তোমার ওপর করতে পারব না।
কিন্তু অচলা তেমনি পাষাণ-মূর্তির মত নিঃশব্দ স্থির হইয়া রহিল দেখিয়া মহিম বলিতে লাগিল, কিন্তু তোমার ওপর আমার অন্য নালিশ আছে। আমার স্বভাব ত জানো। শুধু বিয়ের পর থেকেই ত নয়, অনেক আগেই ত আমাকে জানতে যে, আমি সুখ-দুঃখ যাই হোক, নিজের প্রাপ্য ছাড়া একবিন্দু উপরি পাওনা কখনো প্রত্যাশা করিনে—পেলেও নিইনে। ভালবাসার ওপর ত জোর খাটে না অচলা। না পারলে হয়ত তা দুঃখের কথা, কিন্তু লজ্জার কথা ত নয়। কেন তবে এতদিন কষ্ট পাচ্ছিলে? কেন আমাকে না জানিয়ে ভেবে নিয়েছিলে, আমি জোর করে তোমাকে আটক রাখবো? কোনদিন কোন বিষয়েই ত আমি জোর খাটাই নি। তাঁরা তোমাকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলে, তবে তোমার প্রাণ বাঁচবে—আর আমাকে জানালে কি কোন উপায় হতো না? তোমার প্রাণের দামটা কি শুধু তাঁরাই বোঝেন?

অচলা অশ্রু-বিকৃত অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর যতদূর সাধ্য সহজ ও স্বাভাবিক করিয়া চুপি চুপি বলিল, তুমিও ত ভালোবাসো না।
মহিম আশ্চর্য হইয়া কহিল, এ কথা কে বললে? আমি ত কখনো বলিনি।
অচলার উত্তপ্ত হইয়া উঠিতে বিলম্ব হইল না; কহিল, শুধু কথাই কি সব? শুধু মুখের বলাই সত্যি, আর সব মিথ্যে? রাগের মাথায় মনের কষ্টে যা কিছু মানুষের মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, তাকেই কেবল সত্যি ধরে নিয়েই তুমি জোর খাটাতে চাও? তোমার মতন নিক্তির ওজনে কথা বলতে না পারলেই কি তার মাথায় পা দিয়ে ডুবিয়ে দিতে হবে? বলিতে বলিতেই তাহার গলা ধরিয়া প্রায় রুদ্ধ হইয়া আসিল।
মহিম কিছুই বুঝিতে না পারিয়া কহিল, তার মানে?
অচলা উচ্ছ্বসিত রোদন চাপিয়া বলিল, মনে করো না—তোমার মত সাবধানী লোকেও মিথ্যেকে চিরকাল চাপা দিয়ে রাখতে পারে! তোমারও কত ভুল হতে পারে—দেখ গে চেয়ে, তোমারই টেবিলের ওপর। শুধু আমাদেরই—
মহিম প্রায় হতবুদ্ধি হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি আমার টেবিলের ওপর?
অচলা মুখে আঁচল গুঁজিয়া মাদুরের উপর উপুড় হইয়া পড়িল। তাহার কাছে আর কোন জবাব না পাইয়া মহিম আস্তে আস্তে তাহার টেবিল দেখিতে গেল। তাহার পড়ার ঘরের টেবিলের উপর খান-কতক বই পড়িয়াছিল; প্রায় দশ মিনিট ধরিয়া সেইগুলা উলটিয়া-পালটিয়া দেখিয়া, তাহার নীচে, আশেপাশে সমস্ত তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া স্ত্রীর অভিযোগের কিছুমাত্র তাৎপর্য বুঝিতে না পারিয়া, বিমূঢ়ের ন্যায় ফিরিয়া আসিবার পথে শোবার ঘরটার প্রতি দৃষ্টি পড়ায়, ভিতরে একটা পা দিয়াই মৃণালের সেই চিঠিখানার উপর তাহার চোখ পড়িল। সেখানা হাতে তুলিয়া লইয়া পড়িবামাত্রই, অকস্মাৎ অন্ধকারে বিদ্যুৎহানার মতই আজ একমুহূর্তে মহিম পথ দেখিতে পাইল। অচলা যে কি ইঙ্গিত করিয়াছে, আর বুঝিতে বিলম্ব হইল না। সেটুকু হাতের মধ্যে লইয়া মহিম বিছানার উপর বসিয়া শূন্যদৃষ্টিতে বাহিরের অন্ধকারে চাহিয়া চুপ করিয়া রহিল। যেমন করিয়া সে প্রথম দিনটিতে আসিয়াছিল, যেভাবে সে চলিয়া গিয়াছিল, সতীন বলিয়া সে অচলাকে যত পরিহাস করিয়াছে—একটি একটি করিয়া তাহার সমস্ত মনে পড়িতে লাগিল।
পল্লীগ্রামের এইসকল রহস্যালাপের সহিত যে মেয়ে পরিচিত নয়, প্রতিদিন তাহার যে কিরূপ বিঁধিয়াছে, এবং যে নিজেও যখন কোনদিন এই পরিহাসে খোলা মনে যোগ দিতে পারে নাই, বরঞ্চ স্ত্রীর সম্মুখে লজ্জা পাইয়া বারংবার বাধা দিবার চেষ্টা করিয়াছে—তাহার সেই লজ্জা যদি এই উচ্চশিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী রমণীর ধারণায় অপরাধীর সত্যকার লজ্জা বলিয়া ধীরে ধীরে বদ্ধমূল হইয়া উঠিয়া থাকে ত আজ তাহার মূলোচ্ছেদ করিবে সে কি দিয়া? বাহিরের অন্ধকারের ভিতর হইতেই আজ অনেক সত্য তাহাকে দেখা দিতে লাগিল। কেমন করিয়া অচলার হৃদয় ধীরে ধীরে সরিয়া গিয়াছে, কেমন করিয়া স্বামীর সঙ্গ দিনের পর দিন বিষাক্ত হইয়াছে, কেমন করিয়া স্বামীর আশ্রয় প্রতিমুহূর্তে কারাগার হইয়া উঠিয়াছে—সমস্তই সে যেন স্পষ্ট দেখিতে লাগিল। এই প্রাণান্তকর অবরোধের মধ্যে হইতে পরিত্রাণ পাইবার সেই যে আকুল প্রার্থনা সুরেশের কাছে তখন উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিয়াছিল—সে যে তাহার অন্তরের কোন্‌ অন্তরতম দেশ হইতে উত্থিত হইয়াছিল, তাহাও আজ মহিমের মনশ্চক্ষের সম্মুখে প্রচ্ছন্ন রহিল না। অচলাকে সে যথার্থই সমস্ত হৃদয় দিয়া ভালবাসিয়াছিল। সেই অচলার এতদিন এত কাছে থাকিয়াও, তাহার এত বড় মনোবেদনার প্রতি চোখ বুজিয়া থাকাটাকে সে গভীর অপরাধ বলিয়া গণ্য করিল। কিন্তু এমন করিয়া আর ত একটা মুহূর্তও চলিবে না! স্ত্রীর হৃদয় ফিরিয়া পাইবার উপায় আছে কি না, তাহা কোথায় কত দূরে সরিয়া গিয়াছে, অনুমান করাও আজ দুঃসাধ্য। কিন্তু অনেক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়াও স্বামী বলিয়া যাহাকে সে একদিন আশ্রয় করিয়াছিল, তাহারই কাছে অপমান এবং লাঞ্ছনা পাইয়া যে আজ তাহাকে ফিরিতে হইতেছে, এত বড় ভুল ত তাহাকে জানানো চাই।

মহিম ধীরে ধীরে উঠিয়া গিয়া অচলার দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইয়া দেখিল, কবাট রুদ্ধ এবং ঠেলিয়া দেখিল, তাহা ভিতর হইতে বন্ধ। আস্তে আস্তে বার-দুই ডাকিয়া যখন কোন সাড়া পাইল না, তখন শুধু যে জোর করিয়া শান্তিভঙ্গ করিবারই তাহার প্রবৃত্তি হইল না, তাহা নহে, একটা অতি কঠিন পরীক্ষার দায় হইতে আপাততঃ নিষ্কৃতি পাইয়া নিজেও যেন বাঁচিয়া গেল।
মহিম ফিরিয়া আসিয়া শয্যায় শুইয়া পড়িল; কিন্তু যাহার অভাবে পার্শ্বের স্থানটা আজ শূন্য পড়িয়া রহিল, ও-ঘরে সে অনশনে মাটিতে পড়িয়া আছে মনে করিয়া কিছুতেই তাহার চক্ষে নিদ্রা আসিল না। উঠিয়া গিয়া ঘুম ভাঙ্গাইয়া তাহাকে তুলিয়া আনা উচিত কি না, ভাবিতে ভাবিতে দ্বিধা করিতে করিতে অনেক রাত্রে বোধ করি সে কিছুক্ষণের জন্য তন্দ্রামগ্ন হইয়া পড়িয়াছিল, সহসা মুদ্রিত-চক্ষে তীব্র আলোক অনুভব করিয়া চোখ মেলিয়া চাহিল। শিয়রের খোলা জানালা দিয়া এবং চালের ফাঁক দিয়া অজস্র আলোক ও উৎকট ধূমে ঘর ভরিয়া গিয়াছে এবং অত্যন্ত সন্নিকটে এমন একটা শব্দ উঠিয়াছে যাহা কানে প্রবেশমাত্রই সর্বাঙ্গ অসাড় করিয়া দেয়। কোথায় যে আগুন লাগিয়াছে, তাহা নিশ্চয় বুঝিয়াও ক্ষণকালের জন্য সে হাত-পা নাড়িতে পারিল না। কিন্তু সেই কয়েকটা মুহূর্তের মধ্যেই তাহার মাথার ভিতর দিয়া যেন ব্রহ্মাণ্ড খেলিয়া গেল। লাফাইয়া উঠিয়া, দ্বার খুলিয়া বাহিরে আসিয়া দেখিল, রান্নাঘর এবং যে ঘরে আজ অচলা ঘুমাইয়া পড়িয়াছে, তাহারই বারান্দার একটা কোণ বিদীর্ণ করিয়া প্রধূমিত অগ্নিশিখা উপরের সমস্ত জামগাছটাকে রাঙ্গা করিয়া ফেলিয়াছে।
পল্লীগ্রামে খড়ের ঘরে আগুন ধরিলে তাহা নিবাইবার কল্পনা করাও পাগলামি, সে চেষ্টাও কেহ করে না; পাড়ার লোক, যে যাহার জিনিসপত্র ও গরু-বাছুর সরাইতে ছুটাছুটি করে, এবং ভিন্ন পাড়ার লোক একদিকে মেয়েরা এবং একদিকে পুরুষেরা সমবেত হইয়া অত্যন্ত নিরুদ্বেগে হায় হায় করিয়া এবং কি পরিমাণের দ্রব্য-সম্ভার দগ্ধ হইতেছে এবং কি করিয়া এ সর্বনাশ ঘটিল, তাহারই আলোচনা করিয়া সমস্ত বাড়িটা ভস্মসাৎ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে। তার পরে ঘরে ফিরিয়া হাত-পা ধুইয়া বাকি রাত্রিটুকু বিছানায় গড়াইয়া লইয়া পুনরায় সকালবেলা একে একে গাড়ু-হাতে দেখা দেয়; এবং আলোচনার জেরটুকু সকালের মত শেষ করিয়া বাড়ি গিয়া স্নানাহার করে। কিন্তু একজনের গৃহপ্রাঙ্গণের বিরাট ভস্মস্তূপ আর একজনের জীবনযাত্রার লেশমাত্র ব্যাঘাত ঘটাইতে পারে না।

মহিম পল্লীগ্রামের লোক, সকল কথাই সে জানিত। তাই নিরর্থক চেঁচামেচি করিয়া অসময়ে পাড়ার লোকের ঘুম ভাঙ্গাইয়া দিল না। বিন্দুমাত্র প্রয়োজনও ছিল না, কারণ তাহার আম-কাঁঠালের এত বড় বাগানটা অতিক্রম করিয়া এই অগ্ন্যুৎপাত যে আর কাহারও গৃহ স্পর্শ করিবে, সে সম্ভাবনা ছিল না। বাহিরের সারের যে কয়টা ঘরে সুরেশ এবং চাকর-বাকরেরা নিদ্রিত ছিল, অগ্নিস্পৃষ্ট হইবার তখনও তাহাদের বিলম্ব ছিল। বিলম্ব ছিল না শুধু অচলার ঘরটার। সে তাহারই দ্বারে সজোরে করাঘাত করিয়া ডাকিল, অচলা!
অচলা ঠিক যেন জাগিয়াছিল, এমনিভাবে উত্তর দিল, কেন?
মহিম কহিল, দোর খুলে বেরিয়ে এস!
অচলা শ্রান্তকণ্ঠে জবাব দিল, কি হবে? আমি ত বেশ আছি!
মহিম কহিল, দেরি করো না, বেরিয়ে এসো—বাড়িতে আগুন লেগেছে।
প্রত্যুত্তরে অচলা একবার ভয়জড়িতকণ্ঠে চিৎকার করিয়া উঠিল, তার পরে সমস্ত চুপচাপ! মহিমের পুনশ্চ ব্যগ্র আহ্বানে সে আর সাড়াও দিল না। ঠিক এই ভয়ই মহিমের ছিল; কারণ বাটীতে আগুন লাগা যে কি ব্যাপার, তাহার কোনপ্রকার ধারণাই অচলার ছিল না। মহিম ঠিক বুঝিল, ইতিপূর্বে সে চোখ বুজিয়াই কথা কহিতেছিল, কিন্তু চোখ মেলিয়া যে দৃশ্য তাহাকেও কিছুক্ষণের জন্য অবশ করিয়া ফেলিয়াছিল, সেই অপর্যাপ্ত আলোকে উদ্ভাসিত সমস্ত ঘরটা চোখে পড়িবামাত্র অচলারও সংজ্ঞা বিলুপ্ত হইয়াছে। কিন্তু এই দুর্ঘটনার জন্য মহিম প্রস্তুত হইয়াই ছিল। সে একটা কবাট নাড়িয়া উঁচু করিয়া হাঁসকলটা খুলিয়া ফেলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল এবং মূর্ছিতা স্ত্রীকে বুকে তুলিয়া লইয়া অবিলম্বে প্রাঙ্গণে আসিয়া দাঁড়াইল।
এইবার সে বাটীর অন্য সকলকে সজাগ করিবার জন্য নাম ধরিয়া চিৎকার করিতে লাগিল। সুরেশ পাংশুমুখে বাহির হইয়া আসিল, যদু প্রভৃতি অপর সকলেও দ্বার খুলিয়া ছুটিয়া বাহির হইয়া পড়িল, তাহার পরেই একটা প্রচণ্ড শব্দে অচলা সচেতন হইয়া দুই বাহু দিয়া স্বামীর কণ্ঠ প্রাণপণ-বলে জড়াইয়া ধরিয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল।

মহিম সকলকে লইয়া যখন বাহিরের খোলা জায়গায় আসিয়া পড়িল, তখন বড় ঘরের চালে আগুন ধরিয়াছে। এইবার তাহার মনে পড়িল, অচলার অলঙ্কার প্রভৃতি দামী জিনিস যাহা কিছু আছে, সমস্তই এই ঘরে এবং আর মুহূর্ত বিলম্ব করিলে কিছুই বাঁচানো যাইবে না।
অচলা প্রকৃতিস্থ হইয়াছিল; সে সজোরে স্বামীর হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল, না, সে হবে না। প্রতিশোধ নেবার এই কি সময় পেলে? কিছুতেই ওর মধ্যে তোমাকে আমি যেতে দেব না। যাক, সব পুড়ে যাক।
না গেলে চলবে না, অচলা, বলিয়া জোর করিয়া হাত ছাড়াইয়া লইয়া মহিম সেই জমাট ধূমরাশির মধ্যে দ্রুতবেগে গিয়া প্রবেশ করিল। যদু চেঁচাইতে চেঁচাইতে সঙ্গে সঙ্গে ছুটিল।
সুরেশ এতক্ষণ পর্যন্ত অভিভূতের মত চাহিয়া অদূরে দাঁড়াইয়া ছিল; অকস্মাৎ সংবিৎ পাইয়া, সে পিছু লইবার উপক্রম করিতেই অচলা তাহার কোঁচার খুঁট ধরিয়া ফেলিয়া কঠোরকণ্ঠে কহিল, আপনি যান কোথায়?
সুরেশ টানাটানি করিয়া বলিল, মহিম গেল যে—
অচলা তিক্তস্বরে বলিল, তিনি গেলেন তাঁর জিনিস বাঁচাতে। আপনি কে? আপনাকে যেতে আমি কোনমতেই দেব না।
তাহার কণ্ঠস্বরে স্নেহের লেশমাত্র সম্পর্ক ছিল না—এ যেন সে অনধিকারীর উৎপাতকে তিরস্কার করিয়া দমন করিল।
মিনিট দুই-তিন পরেই মহিম দুই হাতে দু’টা বাক্স লইয়া এবং যদু প্রকাণ্ড একটা তোরঙ্গ মাথায় করিয়া উপস্থিত হইল। মহিম অচলার পায়ের কাছে রাখিয়া কহিল, তোমার গহনার বাক্সটা যেন কিছুতে হাতছাড়া করো না, আমরা বাইরের ঘরে যদি কিছু বাঁচাতে পারি, চেষ্টা করি গে।
অচলার মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইল না। তাহার মুঠোর মধ্যে তখনো সুরেশের কোঁচার খুঁট ধরা ছিল, তেমনি ধরা রহিল। মহিম পলকমাত্র সেদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া যদুকে সঙ্গে লইয়া পুনরায় অদৃশ্য হইয়া গেল।










বিংশ পরিচ্ছেদ
প্রভাতের প্রথম আলোকে স্বামীর মুখের প্রতি চোখ পড়িবামাত্রই অচলার বুকের ভিতরটা হাহা-রবে কাঁদিয়া উঠিল। চোখের জল আর সে কোনমতে সংবরণ করিতে পারিল না। এ কি হইয়াছে! মাথার চুল ধুলাতে, বালুতে, ভস্মে রুক্ষ, বিবর্ণ; শীর্ণ বিরসমুখ অগ্ন্যুত্তাপে ঝলসিয়া একটা রাত্রির মধ্যেই তাহার অমন সুন্দর স্বামীকে যেন বুড়া করিয়া দিয়া গিয়াছে। গ্রামের লোক চারিদিকে ঘুরিয়া ফিরিয়া কলরব করিতেছে। পিতল-কাঁসার বাসন-কোসন সে ত সমস্তই গিয়াছে দেখা যাইতেছে। তা যাক—কিন্তু শাল-দোশালা গহনাপত্র তাই-বা আর কত ঐ একটিমাত্র তোরঙ্গে রক্ষা পাইয়াছে—এই লইয়া অত্যন্ত তীক্ষ্ণ সমালোচনা চলিতেছে। ইহাদেরই একটু দূরে নির্বাণোন্মুখ অগ্নিস্তূপের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে চাহিয়া মহিম চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। সমস্তই শুনিতে পাইতেছিল, কিন্তু কৌতূহল নিবারণ করিবার মত মনের অবস্থা তাহার ছিল না। ও-পাড়ার ভিখু বাঁড়ুয্যে—অত্যন্ত গণ্যমান্য ব্যক্তি—বাতের জন্য এ পর্যন্ত আসিয়া পৌঁছিতে পারেন নাই; এখন লাঠিতে ভর দিয়া সদলবলে আগমন করিতেছেন দেখিয়া মহিম অগ্রসর হইয়া গেল। বাঁডুয্যেমশাই বহুপ্রকার বিলাপ করিয়া শেষে বলিলেন, মহিম, তোমার বাবা অনেকদিন স্বর্গীয় হয়েছেন বটে, কিন্তু তিনি আর আমি ভিন্ন ছিলাম না। আমরা দু’জনে হরিহর-আত্মা ছিলাম।
মহিম ঘাড় নাড়িয়া সবিনয়ে জানাইল যে, ইহাতে তাহার কোন সংশয় নাই। শুনিয়া তিনি কহিলেন যে, এই কাণ্ডটি যে ঘটিবে, তাহা তিনি পূর্বাহ্ণেই জানিতেন।
মহিম চকিত হইয়া জিজ্ঞাসুমুখে চাহিয়া রহিল। পার্শ্বে-ই বেড়ার আড়ালে অচলা জিনিসপত্র লইয়া স্তব্ধ হইয়া বসিয়া ছিল, সেও শুনিবার জন্য উৎকর্ণ হইয়া উঠিল। ভূমিকা এই পর্যন্ত করিয়া বাঁডুয্যেমশাই বলিতে লাগিলেন, ব্রহ্মার ক্রোধ ত শুধু শুধু হয় না বাবা!
আমাদের একবার জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করলে না, এতবড় বামুনের ছেলে হয়ে কি অকর্মটাই না করলে বল দেখি।
মহিম কথাটা বুঝিতে পারিল না। তিনি নিজের কথাটার তখন বিস্তৃত ব্যাখ্যা করিতে অনুচরগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া বলিতে লাগিলেন, আমরা সবাই বলাবলি করি যে, কিছু একটা ঘটবেই। কৈ, আর কারুর প্রতি ব্রহ্মার অকৃপা হল না কেন! বাবা, বেম্মও যা, খ্রিস্টানও তাই। সাহেব হলেই বলে খ্রিস্টান, আর বাঙালী হলেই বলে বেম্ম। এ আমাদের কাছে—যাদের শাস্ত্রজ্ঞান জন্মেছে—তাদের কাছে চাপা থাকে না।
উপস্থিত সকলেই ইহাতে অনুমোদন করিল। তিনি উৎসাহ পাইয়া বলিয়া উঠিলেন, যাই কর না বাবা, আগে একটা প্রায়শ্চিত্ত করে ওটাকে ত্যাগ করে—
মহিম হাত তুলিয়া বলিল, থামুন। আপনাদের আমি অসম্মান করতে চাইনে, কিন্তু যা নয়, তা মুখে আনবেন না। আমি যাঁকে ঘরে এনেচি, তাঁর পুণ্যে ঘর থাকে ভালই; না হয় বার বার পুড়ে যায়, সেও আমার সহ্য হবে। বলিয়া অন্যত্র চলিয়া গেল।
বাঁডুয্যেমশাই সমস্ত সাঙ্গোপাঙ্গ লইয়া কিছুক্ষণ হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া লাঠি ঠকঠক করিয়া ঘরে ফিরিয়া গেলেন। মনে মনে যাহা বলিতে বলিতে গেলেন তাহা মুখে না আনাই ভাল।
অচলা সমস্ত শুনিতে পাইয়াছিল; তাহার দুই চক্ষু বাহিয়া বড় বড় অশ্রুর ফোঁটা ঝরিয়া পড়িতে লাগিল।

যদু আসিয়া কহিল, মা, তোমাকে জিজ্ঞাসা করে বাবু পালকিবেহারা ডেকে আনতে বললেন। আনব?
অচলা আঁচলে চোখ মুছিয়া ফেলিয়া কহিল, বাবুকে একবার ডেকে দাও ত যদু।
পালকি?
এখন থাক।
মহিম কাছে আসিয়া দাঁড়াইতে তাহার চোখে আবার জল আসিয়া পড়িল। সে হঠাৎ ঝুঁকিয়া পড়িয়া তাহার পায়ের ধূলা মাথায় লইতেই মহিম বিস্মিত ও ব্যস্ত হইয়া উঠিল। হয়ত সে স্বামীর হাত-দুটা ধরিয়া কাছে টানিয়া বসাইত, হয়ত বা আরও কিছু ছেলেমানুষি করিয়া ফেলিত; কি করিত, তা সে তাহার অন্তর্যামীই জানিতেন; কিন্তু সকাল হইয়া গিয়াছে—চারিদিকে কৌতূহলী লোক; অচলা আপনাকে সংযত করিয়া লইয়া কহিল, পালকি কেন?
মহিম কহিল, ন’টার ট্রেন ধরতে পারলেই ত সবদিকে সুবিধে। একটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে স্নানাহার করতে পারবে। কাল রাত্রেও ত কিছু খাওনি।
আর তুমি?
আমি! মহিম আর একটুখানি চিন্তা করিয়া লইয়া বলিল, আমারও যা হোক একটা উপায় হবে বৈ কি।
তা হলে আমারও হবে। আমি যাবো না।
কি উপায় হবে বল?
অচলা এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিল না। একবার তাহার মুখে আসিল—বনে, গাছতলায়! কিন্তু সে ত সত্যই সম্ভব নয়। আর পাড়ায় কাহারও বাটীতে একটা ঘণ্টার জন্যও আশ্রয় লওয়া যে কত অপমানজনক, সে ইঙ্গিত ত সে এইমাত্র ভাল করিয়াই পাইয়াছে। মৃণালের কথা যে তাহার মনে পড়ে নাই, তাহা নহে, বারংবার স্মরণ হইয়াছে; কিন্তু লজ্জায় তাহা মুখ দিয়া উচ্চারণ করিতে পারিল না। কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া কহিল, তুমিও সঙ্গে চল।
মহিম আশ্চর্য হইয়া বলিল, আমি সঙ্গে যাবো? তাতে লাভ কি?
অচলা বলিল, লাভ-লোকসান দেখবার ভার আজ থাকে আমি নেব। তোমার শুভানুধ্যায়ী এখানে বেশি নেই, সে আমি জানতে পেরেচি। তা ছাড়া, তোমার মুখের চেহারা এক রাত্রির মধ্যেই যা হয়ে গেছে, সে তুমি দেখতে পাচ্ছো না, আমি পাচ্ছি। আমার গলায় ছুরি দিলেও, এখানে তোমাকে একলা ফেলে রেখে আমি যেতে পারবো না।
মহিমের মনের ভিতর তোলপাড় করিতে লাগিল; কিন্তু সে স্থির হইয়া রহিল।
অচলা বলিতে লাগিল, কেন তুমি অত ভাবচ? আমার গয়নাগুলো ত আছে। তা দিয়ে পশ্চিমে যেখানে হোক কোথাও একটা ছোট বাড়ি অনায়াসে কিনতে পারবো। যেখানেই থাকি, আমাকে না খেতে দিয়ে মেরে ফেলতে তুমি পারবে না। সে চেষ্টা তোমাকে করতেই হবে। আর বলেইচি ত তোমার ভার এখন থেকে আমার ওপর।
যদু অদূরে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, পালকি আনতে যাবো মা?
উত্তরের জন্য অচলা উৎসুক-চক্ষে স্বামীর মুখের পানে চাহিয়া রহিল। মহিম ইহার জবাব দিল। যদুকে আনিতে হুকুম করিয়া স্ত্রীকে বলিল, কিন্তু আমি ত এখুনি যেতে পারিনে।
শুনিয়া অনির্বচনীয় শান্তি ও তৃপ্তিতে অচলার বুক ভরিয়া গেল। সে অন্তরের আবেগ সংবরণ করিয়া সহজভাবে কহিল, সে সত্যি, এক্ষুণি তোমার যাওয়া হয় না; কিন্তু সন্ধ্যের গাড়িতে নিশ্চয় যাবে বল? নইলে আমি খাবার নিয়ে বসে বসে ভাবব, আর—
কিন্তু মন্তব্যটা তাহার মহিমের দীর্ঘশ্বাসে যেন নিবিয়া গেল। সে মলিন হইয়া সভয়ে কহিল, ও বেলা যেতে পারবে না? তবে এই অন্ধকার রাত্রে কার বাড়িতে—কিন্তু বলিতে বলিতেই সে থামিয়া গেল। যাহার বাটীতে তাহার স্বামীর রাত্রি যাপনের সম্ভাবনা, সে কথা মনে হইতেই তাহার মুখশ্রী গম্ভীর ও বিবর্ণ হইয়া উঠিল। বোধ করি, তাহার মনের কথা মহিম বুঝিল না। জিজ্ঞাসা করিল, কলকাতায় আমাকে কোথায় যেতে বল?

অচলা তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, কেন, বাবার ওখানে।
মহিম ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না।
না, কেন? সেও কি তোমার নিজের বাড়ি না?
মহিম তেমনি মাথা নাড়িয়া জানাইল, না।
অচলা কহিল, না হয় সেখানে কেবল দুটো দিন থেকেই আমরা পশ্চিমে চলে যাবো।
না।
অচলা জানিত, তাহাকে টলানো সম্ভব নয়। একটুখানি চিন্তা করিয়া বলিল, তবে চল, এখান থেকেই আমরা পশ্চিমের কোন শহরে গিয়ে উঠি গে। আমি সঙ্গে থাকলে কোথাও আমাদের কষ্ট হবে না আমি বেশ জানি। কিন্তু গহনাগুলো ত বেচতে হবে; সে কলকাতা ছাড়া হবে কি করে?
মহিম আর একদিকে চাহিয়া নীরব হইয়া রহিল। অচলা ব্যগ্রকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, পশ্চিমেও ত বড় শহর আছে, সেখানেও ত বিক্রি করা যায়? আমার বাক্সে প্রায় দু’ শ টাকা আছে, এখন তাতেই ত আমাদের যাওয়া হতে পারে? চুপ করে রইলে যে? বল না শিগগির!
মহিম স্ত্রীর চোখের দিকে চাহিতে পারিল না, কিন্তু জবাব দিল; বলিল, তোমার গহনা নিতে পারব না অচলা।
অকস্মাৎ একটা গুরুতর ধাক্কা খাইয়া যেন অচলা পিছাইয়া গেল। খানিক পরে কহিল, কেন পারবে না, শুনতে পাই?
মহিম তাহার উত্তর দিল না এবং কিছুক্ষণ পর্যন্ত উভয়ে নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। হঠাৎ অচলা একসঙ্গে একরাশ প্রশ্ন করিয়া বসিল। কহিল, পৃথিবীতে স্বামী কি কেবল তুমি একটি? দুঃসময়ে তাঁরা নেন কি করে? স্ত্রীর গহনা থাকে কি জন্যে? এত কষ্টে এগুলো বাঁচাতে গেলেই বা কেন? বলিয়া সে ছোট টিনের বাক্সটা হাত দিয়া ঠেলিয়া দিয়া কহিল, আর বিপদের দিনে যদি কোন কাজেই না লাগে ত মিথ্যে বোঝা বয়ে বেড়িয়ে কি হবে? আগুন এখনও জ্বলচে, আমি টান মেরে ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে চলে যাই—তোমার মনে যা আছে করো। বলিয়া যে আঁচল দিয়া চোখ চাপিয়া ধরিল।
মিনিট-দুই চুপ করিয়া থাকিয়া মহিম ধীরে ধীরে কহিল, আমি সমস্ত ভেবে দেখলাম অচলা। কিন্তু, তুমি ত জানো, আমি কোন কাজ ঝোঁকের ওপর করিনে; কিংবা আর কেউ করে, সেও চাইনে, তুমি যা দিতে চাচ্ছো, তা নিজের বলে নিতে পারলে আজ আমার সুখের সীমা থাকত না; কিন্তু কিছুতেই নিতে পারিনে। দুঃখ দেখে তোমার মত আরও একজন আরও ঢের বেশি আমাকে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সেও যেমন দয়া, এও তেমনি দয়া; কিন্তু এতে না তোমাদের, না আমার, কারও শেষ পর্যন্ত ভাল হবে না বলেই আমার বিশ্বাস।
অচলা আর সহ্য করিতে পারিল না। কান্না ভুলিয়া বোধ করি প্রতিবাদ করিবার জন্যই দৃপ্ত চক্ষু-দুটি উপরে তুলিবামাত্র স্বামীর দৃষ্টি অনুসরণ করিতে দেখিতে পাইল, কতকটা দূরে তাহাদের যে পুষ্করিণী আছে, তাহারই ঘাটের পাশে বাঁধানো নিমগাছতলায় সুরেশ হাতে মাথা রাখিয়া আকাশের দিকে মুখ তুলিয়া চুপ করিয়া পড়িয়া আছে। অচলার মুখের কথা মুখেই রহিয়া গেল এবং উচ্ছ্রিত মাথা তাহার আপনি হেঁট হইয়া গেল।
কিন্তু মহিম যেন কতকটা অন্যমনস্কের মত আপন মনেই বলিতে লাগিল, শুধু যে কখনো শান্তি পাবো না তা নয়, তোমাকে বারংবার বঞ্চিত করতে পারি, এ সম্বন্ধই কোনদিন আমাদের মধ্যে হয়নি। একটুখানি থামিয়া কহিল, অচলা, নিজেকে রিক্ত করে দান করবার অনেক দুঃখ। কিন্তু ঝোঁকের ওপর হয়ত তাই একমুহূর্তে পারা যায়, কিন্তু তার ফলভোগ হয় সারা জীবন ধরে। আমি জানি, একটা ভুলের জন্যে তোমাদের মনস্তাপের অবধি নেই। আবার একটা ভুল হয়ে গেলে, তুমি না পারবে কোনদিন নিজেকে ক্ষমা করতে, না পারবে আমাকে মাপ করতে। এ ক্ষতি সইবার মত সম্বল তোমার নেই; এ কথা আজ না টের পেতে পারো, দু’দিন পরে পারবে। তাই তোমার কাছ থেকে কিছুই আমি নিতে পারব না।

কথাগুলা অচলার বুকের ভিতর বিঁধিল। স্বামীর চক্ষে সে যে কত পর তাহা আজ যেমন অনুভব করিল, এমন আর কোনদিন নয়; এবং সঙ্গে সঙ্গেই মৃণালের স্মৃতিতে সে ক্রোধে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। সেও কঠিন হইয়া বলিয়া উঠিল, তুমি এতক্ষণ ধরে যা বোঝাচ্ছো সে আমি বুঝেছি। হয়ত তোমার কথাই সত্যি, হয়ত তোমার মুখ দেখে দয়া হওয়াতেই আমার যথাসর্বস্ব দিতে চেয়েছিলুম। হয়ত দু’দিন পরে আমাকে সত্যি এর জন্যে অনুতাপ করতে হতো; সব ঠিক, কিন্তু দ্যাখো অপরের মনের ইচ্ছে বুঝে নেবার মত যত বুদ্ধিই তোমার থাক, তোমাকে বুঝিয়ে দেবারও জিনিস আছে। স্ত্রীর জিনিস জোর করে নেওয়া ত দূরের কথা, হাত পেতে নেবার সম্বল তোমারই বা কি আছে? আর তোমার সঙ্গে আমি তর্ক করব না। এটুকু বিবেক-বুদ্ধি যে এখনো তোমাতে বাকি আছে, আজ থেকে তাই আমার সান্ত্বনা। কিন্তু যেখানেই থাকি, একদিন না একদিন তোমাকে সব কথা বুঝতেই হবে। হবেই হবে। বলিয়া সে হাত দিয়া নিজের মুখ চাপিয়া ধরিয়া কান্না রোধ করিল।
ন’টার ট্রেনে সুরেশও বাটী ফিরিতেছিল। গত রাত্রের অগ্নিকাণ্ড তাহাকে কেমন যেন একরকম করিয়া দিয়াছিল। কাহারও সহিত কথা কহিবার যেন শক্তিই তাহাতে ছিল না। গাড়ি আসিতে এখনও কিছু বিলম্ব ছিল; সুরেশ মহিমকে স্টেশনের এক প্রান্তে ডাকিয়া লইয়া গিয়া ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিয়া উঠিল, মহিম, আগুন লাগার জন্যে আমাকে ত তুমি সন্দেহ করোনি?
মহিম তাহার হাতদুটো সজোরে ধরিয়া ফেলিয়া শুধু বলিল, ছি!
সুরেশের দুই চোখ ছলছল করিতে লাগিল। বাষ্পরুদ্ধ-স্বরে বলিল, কাল থেকে এই ভয়ে আমার শান্তি নেই মহিম।
মহিম নীরবে শুধু একটু তাহার হাতের মধ্যে চাপ দিল। তাহার পরে কহিল, সুরেশ, একটা সত্যকার অপরাধ অনেক মিথ্যা অপরাধের বোঝা বয়ে আনে। কিন্তু অনেক দুঃখ পেয়ে তুমি যাই কর না কেন, যাকে ‘ক্রাইম’ বলে, সে তুমি কোনদিন করতে পার না বলে আজও আমি বিশ্বাস করি। একটুখানি থামিয়া কহিল, সুরেশ, তুমি ভগবান মানো না বটে, কিন্তু যে যথার্থ মানে সে অহর্নিশি প্রার্থনা করে, এ বিশ্বাস তিনি যেন তার না ভেঙ্গে দেন।

ট্রেন আসিয়া পড়িল। মেয়েদের গাড়িতে অচলা এবং তাহার দাসীকে তুলিয়া দিয়া মহিম সুরেশের কাছে আসিতেই সে জানালা দিয়া হাত বাড়াইয়া তাহার ডান হাতটা ধরিয়া ফেলিয়া কহিল, তোমার কালকের ক্ষতিটা পূর্ণ করে দেবার প্রার্থনাটা আমার কিছুতেই মঞ্জুর করলে না, কিন্তু তোমার ভগবান তোমার প্রার্থনা যেন মঞ্জুর করেন ভাই। আমাকে যেন আর তিনি ছোট না করেন, বলিয়াই সে হাত ছাড়িয়া দিয়া মুখ ফিরাইয়া বসিল।
ওদিকে জানালায় মুখ রাখিয়া অচলা যদুর সঙ্গে এতক্ষণ চুপি চুপি কি কথা কহিতেছিল, মহিম নিকটে আসিতেই জিজ্ঞাসা করিল, মৃণালদিদির স্বামী নাকি আজ মারা গেছেন?
মহিম ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ঘণ্টা-খানেক পূর্বে মারা গেছেন শুনলাম।
অচলা জিজ্ঞাসা করিল, প্রায় দশ-বারোদিন ধরে নিউমোনিয়ায় ভুগছিলেন। এ খবরটাও আমাকে দেওয়া কোনদিন তুমি আবশ্যক মনে করোনি?
মহিম জবাব দিতে চাহিল, কিন্তু কি করিয়া কথাটা গুছাইয়া বলিবে, ভাবিতে ভাবিতেই বাঁশী বাজাইয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিল।







একবিংশ পরিচ্ছেদ
তখনও কেদারবাবু আগেকার স্বাস্থ্য ফিরিয়া পান নাই। খাওয়া-দাওয়ার পরে আসিয়া বারান্দায় একখানা ইজি-চেয়ারে পড়িয়া খবরের কাগজ পড়িতে পড়িতে হয়ত একটু তন্দ্রাভিভূত হইয়াছিলেন, দরজায় ঠিকা গাড়ির কঠোর শব্দে চোখ মেলিয়া দেখিলেন, সুরেশ এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাঁহার কন্যা ও ঝি অবতরণ করিল। ঘুমের ঝোঁক তাঁহার নিমিষে উড়িয়া গেল; কি একটা অজ্ঞাত শঙ্কায় শশব্যস্তে উঠিয়া পড়িয়া গলা বাড়াইয়া চিৎকার করিলেন, অচলা যে? সুরেশ, তুমি কোথা থেকে? কি, ব্যাপার কি? এ-সব কি কাণ্ড-কারখানা, আমি ত কিছু বুঝতে পারিনে!
অচলা উঠিয়া আসিয়া পিতার পদধূলি গ্রহণ করিল। সুরেশ প্রণাম করিয়া কহিল, মহিমের টেলিগ্রাফ পাননি?
কেদারবাবু উদ্বিগ্নমুখে কহিলেন, কৈ, না!
সুরেশ একখানা চৌকি টানিয়া লইয়া উপবেশন করিয়া বলিল, তা হলে হয় সে টেলিগ্রাফ করতে ভুলেছে, না হয় এখনো এসে পৌঁছায় নি।
কেদারবাবু কহিলেন, টেলিগ্রাফ যাক, ব্যাপার কি, তাই আগে বল না! তুমি এদের কোথা থেকে নিয়ে এলে?
সুরেশ বলিল, কাল রাত্রিতে আগুন লেগে মহিমের বাড়ি পুড়ে গেছে।
বাড়ি পুড়ে গেছে? সর্বনাশ! বল কি—বাড়ি পুড়ে গেল? কেমন করে পুড়ল? মহিম কৈ? তুমি এদের পেলে কোথায়? এক নিশ্বাসে এতগুলা প্রশ্ন করিয়া কেদারবাবু ধপ্‌ করিয়া তাঁহার ইজি-চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন।
সুরেশ বলিল, এদের সেখান থেকেই নিয়ে আসচি। আমি সেখানেই ছিলাম কিনা।
কেদারবাবুর মুখ অত্যন্ত অপ্রসন্ন এবং গম্ভীর হইয়া উঠিল, কহিলেন, তুমি ছিলে সেখানে? কবে গেলে, আমি ত কিছু জানিনে। কিন্তু সে কৈ?
সুরেশ বলিল, মহিম ত আসতে পারছে না, তাই—
তাঁহার গম্ভীর মুখ অন্ধকার হইয়া উঠিল। মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না না, এ-সব ভাল কথা নয়। অতিশয় মন্দ কথা। যৎপরোনাস্তি অন্যায়। এ-সব ত আমি কোনমতেই—, বলিতে বলিতে তিনি চোখ তুলিয়া কন্যার মুখের প্রতি চাহিলেন।
অচলা এতক্ষণ একটা চেয়ারের পিঠে হাত রাখিয়া নীরবে দাঁড়াইয়া ছিল। পিতার এই সংশয় তাহার মর্মে গিয়া বিঁধিল। তাহার এই অকস্মাৎ আগমনের হেতু যে তিনি লেশমাত্র বিশ্বাস করেন নাই, তাহা সুস্পষ্ট উপলব্ধি করিয়া লজ্জায় ঘৃণায় তাহার মুখে আর রক্তের চিহ্ন রহিল না।
কেদারবাবু এখানে ভুল করিলেন। মেয়ের মুখের চেহারায় তাঁহার সন্দেহ দৃঢ়ীভূত হইল। আরাম-চেয়ারটায় হেলিয়া পড়িয়া হাতের কাগজখানা মুখের উপরে টানিয়া নিয়া ফোঁস করিয়া একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, যা ভাল বোঝ তোমরা কর। আমি কালই বাড়ি ছেড়ে আর কোথাও চলে যাবো।
সুরেশ ক্রুদ্ধ-বিস্ময়ের সহিত কহিল, এ-সব আপনি কি বলচেন কেদারবাবু? আপনি বা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবেন কেন, আর হয়েছেই বা কি? বলিয়া সে একবার অচলার প্রতি একবার তাহার পিতার প্রতি চাহিতে লাগিল; কিন্তু কাহারও মুখ তাহার দৃষ্টিগোচর হইল না।
কেদারবাবুর কাছে কোন জবাব না পাইয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, যাক, আমার ওপর মহিম যা ভার দিয়েছিল তা হয়ে গিয়েছে। এখন আপনারা যা ভাল বোঝেন করুন। আমার নাওয়া-খাওয়া এখনো হয়নি, আমি বাড়ি চললুম। বলিয়া সে কয়েক পদ দ্বারের অভিমুখে অগ্রসর হইতেই কেদারবাবু উঠিয়া বসিয়া ক্লান্তকণ্ঠে কহিলেন, আহা, যাও কেন ছাই।ব্যাপারটা কি, তবু শুনিই না। আগুন লাগল কি করে?

সুরেশ অভিমান-ভরে বলিল, তা জানিনে।
তুমি গেলে কবে সেখানে?
দিন পাঁচ-ছয় পূর্বে। আমি খাইনি এখনো, আর দেরি করতে পারিনে, বলিয়া পুনরায় চলিবার উপক্রম করিতেই কেদারবাবু বলিয়া উঠিলেন, আহা-হা, নাওয়া-খাওয়া ত তোমাদের কারও হয়নি দেখচি, কিন্তু জলে পড়নি এটাও ত বাড়ি, এখানেও ত চাকরবাকর আছে। অচলা, ডাকো না একবার বেয়ারাটাকে—দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বোস, বোস, সুরেশ, ব্যাপারটা কি হলো, খুলেই সব বল শুনি।
সুরেশ ফিরিয়া আসিয়া বসিল। একটু চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, রাত্রে ঘুমুচ্চি, মহিমের চিৎকারে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে দেখি, সমস্ত ধুধু করে জ্বলছে; খড়ের ঘর, নিবোবার উপায়ও ছিল না, সে বৃথা চেষ্টাও কেউ করলে না—সর্বস্ব পুড়ে গেল আর কি!
কেদারবাবু লাফাইয়া উঠিয়া বলিলেন, বল কি হে, সর্বস্ব পুড়ে গেল? কিছুই বাঁচাতে পারা গেল না? অচলার গয়নাপত্রগুলো?
সেগুলো বেঁচেচে।
তবু রক্ষে হোক! বলিয়া বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া আবার চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন। খানিকক্ষণ স্তব্ধভাবে বসিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তবু, কি করে আগুনটা লাগল?
সুরেশ কহিল, বললুম ত আপনাকে, সে খবর এখনো জানা যায়নি। তবে গ্রামের মধ্যে বড় কেউ আর তার শুভাকাঙ্ক্ষী নেই, তা জেনে এসেছি।
নেই বুঝি?
না।
কেদারবাবু আর কোন কথা কহিলেন না। অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া বসিয়া থাকিয়া পরিশেষে আর একটা গভীর নিঃশ্বাস মোচন করিয়া, উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, যাও, স্নান করে এসো গে সুরেশ, আর বেলা করো না। দেখি, রান্না-বান্নার কি যোগাড় হচ্ছে। বলিয়া তাহাকে সঙ্গে করিয়া বাহির হইয়া গেলেন।
আহারাদির পরেও তিনি সুরেশকে মুক্তি দেন নাই। সে একটা আরাম-চৌকির উপরে অর্ধনিদ্রিতাবস্থায় পড়িয়া ছিল। অচলাও সেই যে স্নানান্তে তাহার ঘরে গিয়া খিল দিয়াছিল, আর তাহার কোন সাড়াশব্দ ছিল না। বিশ্রাম ছিল না শুধু কেদারবাবুর। এখন যে টেলিগ্রাম আসা না আসার বিশেষ কোন সার্থকতা ছিল না, তাহারই জন্য সমস্ত বেলাটা ছটফট করিয়া, সন্ধ্যার সময় অসময়ে ঘুমানো উচিত নয়, এই অজুহাতে মেয়েকে ডাকাইয়া পাঠাইয়া, প্রথমেই বলিয়া উঠিলেন, তোমরা যে বললে, সে টেলিগ্রাম করেচে—কৈ তার ত কিছুই দেখিনে। তোমরা ট্রেনেতে এসে পড়লে, আর তারের খবর এতক্ষণেও পৌঁছল না। আচ্ছা, দাঁড়াও ত দেখি, বলিয়া মেয়ের মুখের জবাব না শুনিয়াই চটিজুতা ফটফট করিতে করিতে দ্রুতবেগে বাহির হইয়া গেলেন এবং ক্ষণকাল পরেই নীচে হইতে তাঁহার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর স্পষ্ট শুনা যাইতে লাগিল। অচলার দাসীকে ধরিয়া তিনি নানাপ্রকারে জেরা করিতেছেন, এবং প্রত্যুত্তরে সে আশ্চর্য হইয়া বারংবার প্রতিবাদ করিয়া বলিতেছে, সে কি বাবু, আগুন লেগে ঘরদোর সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল, চক্ষে দেখে এলুম, আর আপনি বলছেন, পোড়েনি! আর আগুন যদি না-ই লাগবে, তবে ঘরদোর পুড়ে ভস্ম হয়ে গেল কি করে, একবার বিবেচনা করে দেখুন দেখি!
সুরেশ সমস্তই শুনিতেছিল; সে মাথা তুলিয়া দেখিল, অচলা চৌকাঠ ধরিয়া দাঁড়াইয়া পাংশু-মুখে কান পাতিয়া প্রত্যেক কথাটি গিলিতেছে। শুষ্ক উপহাসের ভঙ্গিতে কহিল, তোমার বাবার হল কি, বলতে পারো?

অচলা চমকিয়া মুখ ফিরাইয়া বলিল, না।
সুরেশ কহিল, আমি নিশ্চয়ই বলতে পারি উনি বিশ্বাস করেন নি। ওঁর ধারণা, আগুন লাগার গল্পটা আমাদের আগাগোড়া বানানো। একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, সত্যি-মিথ্যে একদিন টের পাবেনই, কিন্তু ওঁর সন্দেহটা এমন যে, এখানে আসা আমার পক্ষে একেবারে অসম্ভব হয়ে উঠেচে।
অচলা শুষ্কমুখে জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি আর আসবেন না?
সুরেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, বোধ করি সম্ভব নয়। আমারও ত কিছু আত্মসম্মান বোধ আছে। কোন লোককে দিয়ে আমার ব্যাগটা বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ো।
অচলা ঘাড় নাড়িয়া বলিল, আচ্ছা। কিন্তু তাহার এখানে আসা না-আসার সম্বন্ধে কোন কথা কহিল না।
তা হলে কাল সকালেই দিয়ো। অনেক দরকারী জিনিস আমার ওর মধ্যে আছে, বলিয়া সে কেদারবাবুর জন্যে অপেক্ষা না করিয়াই বাহির হইয়া গেল।
কেদারবাবু ফিরিয়া আসিয়া কিছু আশ্চর্য হইলেন বটে, কিন্তু মনে মনে যে অপ্রসন্ন হইয়াছেন, তাহা বোধ হইল না।
রাত্রে বহুক্ষণ পর্যন্ত শয্যার উপর ছটফট করিয়া অচলা উঠিয়া পড়িল। তাহার ইচ্ছা, বাহিরে বারান্দায় দাঁড়াইয়া সম্মুখের রাজপথের উপর লোকচলাচলের প্রতি চাহিয়া কিছুক্ষণের জন্যেও অন্যমনস্ক হয়।
তাহার ঘরের ও-দিকের কবাট খুলিয়া সে বারান্দায় আসিয়া দেখিল, তখনও বসিবার ঘরে আলো জ্বলিতেছে। প্রথমে মনে করিল, চাকরেরা গ্যাস বন্ধ করিতে ভুলিয়া গিয়াছে। কিন্তু কয়েক পদ অগ্রসর হইতেই ভিতর হইতে তাহার পিতার কণ্ঠস্বর কানে আসিতে তাহার বিস্ময়ের পরিসীমা রহিল না। চিরদিন তিনি দশটা বাজিতে না বাজিতেই শয্যা গ্রহণ করেন; কিন্তু আজ সাড়ে দশটা বাজিয়া গিয়াছে। পরক্ষণেই দাসীর গলা শুনা গেল। সে বলিতেছে, এখন সোয়ামী মারা গেছে—আর যে মৃণাল-দিদিমণি শ্বশুরঘর করে, এমন ত আমার মনে হয় না বাবু। জামাইবাবুর সঙ্গে কি যে দাদা-নাতনী সুবাদ, তা তেনারাই জানে।
প্রত্যুত্তরে কেদারবাবু শুধু হুঁ বলিয়াই চুপ করিয়া রহিলেন।
অচলা বুঝিল, ইতিপূর্বে অনেক কথাই হইয়া গিয়াছে। মৃণালের সম্বন্ধে, মহিমের সম্বন্ধে, তাহার সম্বন্ধে—কিছুই বাদ যায় নাই। কিন্তু পাছে নিজের সম্বন্ধে নিরতিশয় অপ্রিয় কথা নিজের কানেই শুনিতে হয়, এই ভয়ে সে যেমন নিঃশব্দে আসিয়াছিল, তেমনই নীরবে ফিরিয়া যাইতে চাহিল; কিন্তু কিসে যেন তাহার পা লোহার শিকলে বাঁধিয়া দিয়া গেল।
কেদারবাবু অল্পক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া প্রশ্ন করিলেন, দু’জনের তা হলে বনিবনাও হয়নি বল?

ঝি কহিল, মোটে না বাবু, মোটে না। একটি দিনের তরে না।
এই দাসীটিকে অচলা নির্বোধ বলিয়াই এতদিন জানিত; আজ দেখিল, বুদ্ধি তাহার কাহারো অপেক্ষা কম নয়।
কেদারবাবু আবার মিনিট-খানেক মৌন থাকিয়া বলিলেন, কাল রাতে তা হলে কারও খাওয়া হয়নি বল? সুরেশ যাওয়া পর্যন্তই একরকম ঝগড়াঝাঁটিতেই দিন কাটছিল?
দাসীর উত্তর শুনা গেল না বটে, কিন্তু পিতার মুখের মন্তব্য শুনিয়াই বুঝা গেল, সে গ্রীবা আন্দোলনের দ্বারা কিরূপ অভিমত ব্যক্ত করিল। কারণ, পরক্ষণেই কেদারবাবু একটা গভীর নিশ্বাস মোচন করিয়া বলিলেন, এমনটি যে একদিন ঘটবে, আমি আগেই জানতুম। আজকালকার ছেলেমেয়েরা ত বাপ-মায়ের কথা গ্রাহ্য করে না; নইলে আমি ত সমস্তই একরকম ঠিক করে এনেছিলুম। আজ তা হলে ওর ভাবনা কি! বলিয়া আর একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিলেন, তাহাও স্পষ্ট শুনিতে পাওয়া গেল।
ঝি পূর্ণ সহানুভূতির সহিত প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কহিল, তাই বলুন ত বাবু, নইলে আজ ভাবনা কি! কোন্‌ অজ পাড়াগাঁয়ে কিনা একটা খোড়ো মেটে বাড়ি! তাও রইল কৈ? আজ জামাইবাবুও ত—, বলিয়া সেও কথাটাকে শেষ না করিয়াও একটা দীর্ঘশ্বাসের দ্বারা অনেকদূর পর্যন্ত ঠেলিয়া দিল।
কপাল! বলিয়া কেদারবাবু মিনিট-দুই নিঃশব্দে থাকিয়া, উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, আচ্ছা, তুই যা; বলিয়া তাহাকে বিদায় দিয়া আলো নিবাইবার জন্য বেয়ারাকে ডাকাডাকি করিতে লাগিলেন।
অচলা পা টিপিয়া আস্তে আস্তে তাহার ঘরে আসিয়া বিছানায় শুইয়া পড়িল। পিতার উদারতা, তাঁহার ভদ্রতাবোধের ধারণা কোনদিনই তাহার মনের মধ্যে খুব উচ্চ অঙ্গের ছিল না, কিন্তু সে যে বাটীর দাসীর সহিত নিভৃতে আলোচনা করিবার মত এত ক্ষুদ্র, ইহাও সে কখনও ভাবিতে পারিত না। আজ তাহার নিজের মন ছোট হইয়া মাটিতে লুটাইতেছে—কিন্তু তাহার স্বামী, তাহার পিতা, তাহার দাসী, তাহার বন্ধু—সবাই যখন তাহারই মত ভূমিতলে পড়িয়া, তখন কাহাকেও অবলম্বন করিয়া কোনদিন যে সে এই ধূলিশয্যা হইতে উঠিয়া দাঁড়াইতে পারিবে, এ ভরসা সে কল্পনা করিতেও পারিল না।






দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
কেদারবাবু সংসারে সাধারণ দশজনের মত দোষে-গুণে মানুষ। মেয়ের বিবাহে জামাই যাহাতে পাস-করা হয়, অবস্থাপন্ন হয়, এই কামনাই করিয়াছিলেন। মহিম ভাল ছেলে, সে এম. এ. পাস করিয়াছে, দেশে তাহার অন্নবস্ত্রের সংস্থান আছে, অতএব তাহার হাতে কন্যা সম্প্রদান করিতে তিনি সৌভাগ্য বলিয়াই গণ্য করিয়াছিলেন। কিন্তু অকস্মাৎ তাহার ধনাঢ্য বন্ধু সুরেশ যখন একদিন তাহার গাড়ি করিয়া আসিয়া একটা উলটা রকমের খবর দিয়া নিজেই জামাইগিরির উমেদার খাড়া হইল, তখন উভয় বন্ধুর মধ্যে আর্থিক সঙ্গতির হিসাব করিয়া মহিমকে বরখাস্ত করিতে কেদারবাবুর মনের মধ্যে কোন আপত্তিই উঠিল না। তিনি ভালবাসার সূক্ষ্মতত্ত্বের বড় একটা ধার ধারিতেন না। তাঁহার বিশ্বাস ছিল, মেয়েমানুষে যাহার কাছে গাড়িপালকি চড়িয়া বস্ত্রালঙ্কার পরিয়া সুখে-স্বচ্ছন্দে থাকিতে পায়, স্বামী হিসাবে তাহাকেই সকলের শ্রেষ্ঠ বলিয়া গণ্য করে। সুতরাং মেয়েকে সুখী করাই যদি পিতার কর্তব্য হয় ত এত বড় অযাচিত সুযোগ কোনমতেই যে হাতছাড়া করা উচিত নয়, ইহা স্থির করিতে তাঁহাকে অত্যন্ত বেশি চিন্তা করিতে হয় নাই।
এমন কি, বড়লোক জামাতার কাছে কর্জ করিয়া বিবাহের পূর্বেই হাজার-পাঁচেক টাকা লওয়াও তিনি দোষের মনে করেন নাই; এবং বাড়িটা যখন তাহার থাকিবে, তখন পরিশোধের দুশ্চিন্তাও তাঁহাকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলে নাই।
অথচ হতভাগা মেয়েটা সমস্ত পণ্ড করিয়া দিল—কিছুতেই বাগ মানিল না। অতএব শেষ পর্যন্ত সেই মহিমের হাতেই তাঁহাকে মেয়ে দিতে হইল বটে, কিন্তু এই দুর্ঘটনায় তাঁহার ক্ষোভের অবধি রহিল না। তা ছাড়া, যে কথাটা এখন তাঁহাকে নিজের কাছে নিজে স্বীকার করিতে হইল তাহা এই যে, টাকাটা এইবার ফিরাইয়া দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু জিনিসটা লেখাপড়ার মধ্যে না থাকায় এবং পরিশোধের রাস্তাটাও খুব সুস্পষ্ট ও প্রাঞ্জল হইয়া চোখে না পড়ায়, ইহার চিন্তাটাকেও তিনি হৃদয়ের মধ্যে তেমনি উজ্জ্বল করিয়া তুলিতে পারিলেন না। সুতরাং, প্রশ্নটা যদিচ মনের মধ্যে উঠিল বটে, কিন্তু উত্তরটা তেমনি ঝাপসা হইয়া রহিল।
অচলা শ্বশুরবাড়ি চলিয়া গেল। ইহার পরে সুরেশের আসা-যাওয়া, ঘনিষ্ঠতা কেদারবাবু পছন্দ করিতেন না। বাটী নাই অজুহাতে অধিকাংশ সময় দেখাও দিতেন না। কিন্তু তাহাকে ভালবাসিতেন বলিয়া মেয়ের দুর্ব্যবহারে বৃদ্ধ অন্তরের মধ্যে লজ্জিত এবং দুঃখিত হইয়াই রহিলেন।
এইভাবে দিন কাটিতেছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন তিনি অত্যন্ত অসুখে পড়িয়া গেলেন। সুরেশ আসিয়া চিকিৎসা করিয়া এবং নিজে পুত্রাধিক সেবা-যত্ন করিয়া তাঁহাকে আরোগ্য করিয়া তুলিল। তিনি স্বয়ং ঋণের উল্লেখ করিলে, সে তাহা বন্ধুকে যৌতুক দিয়াছে বলিয়া হাসিয়া উড়াইয়া দিল। সেই অবধি এই যুবকটির প্রতি তাঁহার স্নেহ প্রতিদিন গভীর ও অকৃত্রিম হইয়া উঠিতে লাগিল। এমন কি, সময়ে সময়ে কন্যার বিরুদ্ধে তাঁহার মনের মধ্যে অভিশাপের ন্যায় উদয় হইত যে, দুর্ভাগা মেয়েটা এমন রত্ন চিনিল না, উপেক্ষা করিয়া ত্যাগ করিয়া গেল, সে যেন একদিন ইহার শাস্তি ভোগ করে।
এই ব্যাপারে মহিম তাঁহার দু চক্ষের বিষ হইয়া গিয়াছিল সত্য, কিন্তু তাই বলিয়া তাঁহার কন্যা যে নারীধর্ম জলাঞ্জলি দিয়া স্বামীত্যাগের গভীর দুষ্কৃতি সর্বাঙ্গে বহিয়া তাঁহারই গৃহে আসিয়া উঠিবে, ইহা তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নাই; এবং এই মহাপাপে যে ব্যক্তি সাহায্য করিয়াছে, সে যত বড় হউক, পিতার মনের ভাব যে তাহার বিরুদ্ধে কিরূপ বাঁকিয়া দাঁড়াইবে, ইহাও অনুমান করা কঠিন নহে।

অন্যপক্ষে, পিতার প্রতি কন্যার মনোভাব পূর্বে যেমনি থাক, যেদিন তিনি শুধুমাত্র টাকার লোভেই মহিমকে বর্জন করিয়া সুরেশের হাতে তাহাকে সমর্পণ করিতে বদ্ধপরিকর হইয়াছিলেন, এবং পরিশোধের কোন উপায় না থাকা সত্ত্বেও তাহার কাছে ঋণ গ্রহণ করিয়াছিলেন, সেদিন হইতে মানুষ হিসাবে কেদারবাবু অচলার চক্ষে অত্যন্ত নামিয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু সেই অশ্রদ্ধা শতগুণে বাড়িয়া গিয়াছিল কাল রাত্রে, যখন সে স্বকর্ণে শুনিতে পাইল, তিনি নিজের কন্যার চরিত্রের সম্বন্ধে গোপনে দাসীর মতামত গ্রহণ করিতেও সঙ্কোচ বোধ করিলেন না।
কিন্তু সেই সঙ্গে অচলা আজি আপনাকেও দেখিতে পাইল। তাহার সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হইয়া চোখে পড়িল, যে মুহূর্তে সে স্বামীকে নিজের মুখে বলিয়াছে, তাহাকে সে ভালবাসে না, সে মুহূর্তেই নারীর সর্বোত্তম মর্যাদাও জগৎসংসার হইতে তাহার জন্য মুছিয়া গিয়াছে। তাই আজ সে স্বামীর কাছে ছোট, পিতার কাছে ছোট, নিজের পরিচারিকার কাছে ছোট, এমন কি সেই সুরেশের মত লোকের চক্ষেও আজ সে এত ছোট যে তাহাকে লালসার সঙ্গিনী কল্পনা করাও তাহার পক্ষে আর দুরাশা নয়। কিন্তু সত্যই কি সে তাই? এমনি ছোট? এই ত সেদিন সে যাহার ভালবাসাকেই সর্বজয়ী করিতে সমস্ত বিরোধ, সমস্ত প্রলোভন পায়ে দলিয়া উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছিল, আজ ইহারই মধ্যে সে কথা কি সবাই ভুলিয়াছে? তাহাকে সুরেশের সঙ্গে পাঠাইয়া দিয়াও স্বামী তাহার কোন সংবাদ লইলেন না। এই ঔদাসীন্যের নিগূঢ় অপমান ও লাঞ্ছনা তাহাকে সমস্ত রাত্রি যেন আগুন দিয়া পোড়াইতে লাগিল।
সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গিল, তখন বেলা হইয়াছে। তরুণ সূর্যালোক খোলা জানালার ভিতর দিয়া ঘরের মেঝের উপর ছড়াইয়া পড়িয়াছে। সে ধীরে ধীরে শয্যায় উঠিয়া বসিয়া শিয়রের জানালাটা খুলিয়া দিয়া বাহিরের পথের দিকে চাহিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।
কলিকাতার রাজপথে জনপ্রবাহের বিরাম নাই। কেহ কাজে চলিয়াছে, কেহ ঘরে ফিরিতেছে, কেহ-বা প্রভাতের আলোক ও হাওয়ার মধ্যে শুধু শুধু ঘুরিয়া বেড়াইতেছে—চাহিয়া চাহিয়া হঠাৎ এক সময়ে তাহার মনে হইল, এ সময়ে কেহই ত ঘরে বসিয়া নাই, আর আমিই বা যথার্থ কি এমন গুরুতর অপরাধ করিয়াছি, যাহাতে মুখ দেখাইতে পারি না—আপনাকে আপনি আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছি! অপরাধ যদি কিছু করিয়াই থাকি ত সে তাঁর কাছে। সে দণ্ড তিনিই দিবেন; কিন্তু নির্বিচারে যে-কেহ শাস্তি দিতে আসিবে, তাহাই মাথা পাতিয়া লইব কিসের জন্য?
অচলা তৎক্ষণাৎ উঠিয়া দাঁড়াইল এবং সমস্ত গ্লানি যেন জোর করিয়া ঝাড়িয়া ফেলিয়া হাত-মুখ ধুইয়া কাপড় ছাড়িয়া বসিবার ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল।
কেদারবাবু তাঁহার আরাম-কেদারায় বসিয়া খবরের কাগজ পাঠ করিতেছিলেন, একটিবার মাত্র মুখ তুলিয়াই আবার সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় মনঃসংযোগ করিলেন।
খানিক পরেই বেয়ারা কেৎলিতে গরম চায়ের জল এবং অন্যান্য সরঞ্জাম আনিয়া টেবিলের উপর রাখিয়া গেল, কেদারবাবু নিজে উঠিয়া আসিয়া নিজের জন্য এক পেয়ালা চা প্রস্তুত করিয়া লইলেন এবং বাটিটা হাতে করিয়া নিঃশব্দে তাঁহার আরাম-চৌকিতে ফিরিয়া গিয়া খবরের কাগজ লইয়া বসিলেন।

অচলা নতমুখে বসিয়া পিতার আচরণ সমস্ত লক্ষ্য করিল, কিন্তু নিজে যাচিয়া তাঁহার চা তৈরি করিয়া দিতে কিংবা একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে তাহার সাহসও হইল না, ইচ্ছাও করিল না।
কিন্তু ঘরের মধ্যে এমন করিয়া কাঠের মূর্তির মত মুখ বুজিয়া বসিয়া থাকাও অসম্ভব। এমন কি, এইভাবে দীর্ঘকাল এক গৃহের মধ্যেও তাঁহার সহিত বাস করা সম্ভবপর এবং উচিত কিনা এবং না হইলেই বা সে কি উপায় করিবে, এই জটিল সমস্যার কোথাও একটু নিরালায় বসিয়া মীমাংসা করিয়া লইতে যখন সে উঠি-উঠি করিতেছিল, এমন সময়ে দুঃসহ বিস্ময়ে চাহিয়া দেখিল, সুরেশ ঘরে প্রবেশ করিতেছে।
সে হাত তুলিয়া কেদারবাবুকে নমস্কার করিতে তিনি মুখ তুলিয়া মাথাটা একটু নাড়িয়া পুনশ্চ পড়ায় মন দিলেন।
সুরেশ চেয়ার টানিয়া লইয়া বসিল। চায়ের জিনিসগুলা সরাইবার জন্য বেয়ারা ঘরে ঢুকিতেই তাহাকে কহিল, আমার ব্যাগটা কোথায় আছে, আমার গাড়িতে তুলে দাও ত। শেভ করবার জিনিসগুলো পর্যন্ত তার মধ্যে আছে। দেরি করো না, আমি এখ্‌খুনি যাবো।
যে আজ্ঞে বলিয়া সে চলিয়া গেলে আবার সমস্ত কক্ষটা স্তব্ধ হইয়া রহিল। খানিক পরে সুরেশ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল, মহিমের কোন খবর পাওয়া গেল?
কেদারবাবু মুখ তুলিয়াই শুধু বলিলেন, না।
সুরেশ কহিল, আশ্চর্য!
তার পরে আবার সমস্ত চুপচাপ। বেহারা ফিরিয়া আসিয়া জানাইল, ব্যাগ তাঁহার গাড়িতে তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে।
আমি তা হলে চললুম। মহিমের চিঠি এলে আমাকে একটু খবর পাঠাবেন, বলিয়া সুরেশ উঠিবার উপক্রম করিতেই সহসা কেদারবাবু হাতের কাগজখানা মাটিতে ফেলিয়া দিয়া বলিয়া উঠিলেন, তুমি একটু অপেক্ষা কর সুরেশ, আমি আসচি। বলিয়া তাহার মুখের প্রতি দৃষ্টিপাতমাত্র না করিয়াই চটিজুতার পটাপট শব্দ করিয়া একটু দ্রুতবেগেই ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন।
এতক্ষণ অবধি অচলা অধোমুখেই ছিল। তিনি বাহির হইয়া যাইতেই বিস্মিত সুরেশ অকস্মাৎ মুখ ফিরাইতেই তাহার দৃষ্টি অচলার ত্রস্তপীড়িত ও একান্ত মলিন দুই চক্ষুর উপর গিয়া পড়িল। জিজ্ঞাসা করিল, ব্যাপার কি?
অচলা মুখ আনত করিয়া শুধু মাথা নাড়িল।
সুরেশ বলিল, আমি যে কত দুঃখিত, কত লজ্জিত হয়েচি তা বলে জানাতে পারিনে।
অচলা অধোমুখে নীরবে বসিয়া রহিল।
সে পুনশ্চ কহিল, তোমার বাবা যে আমাকে এমন হীন, এত বড় পাষণ্ড ভাবতে পারেন, এ আমি স্বপ্নেও মনে করিনি।
এ অভিযোগেও অচলা কোন উত্তর দিল না, তেমনি স্থির হইয়া বসিয়া রহিল।
সুরেশ বলিল, আমার এমনি ইচ্ছে হচ্ছে যে এখ্‌খুনি মহিমের কাছে গিয়ে তাকে—কথাটা শেষ হইতে পাইল না, কেদারবাবু ফিরিয়া আসিলেন।
তাঁহার হাতে একখানা ছোট কাগজ। সেইখানা সুরেশের সম্মুখে টেবিলের উপর রাখিয়া দিয়া কহিলেন, গড়িমসি করে তোমার সেই টাকাটার একখানা রসিদ দেওয়া আর ঘটে উঠেনি। পাঁচ হাজার টাকার হ্যান্ডনোট লিখেই দিলুম—সুদ বোধ হয় আর দিতে পারব না; তবে এই বাড়িটা ত রইল, এর থেকে আসলটা শোধ হতে পারবেই।
সুরেশ স্তম্ভিতের ন্যায় ক্ষণকাল দাঁড়াইয়া থাকিয়া বলিল, আমি ত আপনার কাছে হ্যান্ডনোট চাইনি কেদারবাবু!

কেদারবাবু বলিলেন, তুমি চাওনি সত্য, কিন্তু আমার ত দেওয়া উচিত। এতদিন যে দিইনি, সেই আমার যথেষ্ট অন্যায় হয়ে গেছে সুরেশ, কাগজখানা তুমি পকেটে তুলে রাখো। বুড়ো হয়েচি, হঠাৎ যদি মরে যাই, টাকাটার গোল হতে পারে।
সুরেশ আবেগের সহিত জবাব দিল, কেদারবাবু, সুরেশ আর যাই করুক, সে টাকা নিয়ে কখনো কারোর সঙ্গে গোল করে না। তা ছাড়া আপনি নিজেও বেশ জানেন, এ টাকা আমি চাইনে—এ আমি আমার বন্ধুকে যৌতুক দিয়েচি।
কেদারবাবু বলিলেন, তা হলে সে তোমার বন্ধুকেই দিয়ো, আমাকে নয়। আমি যা নিয়েছি, সে আমারই ঋণ।
সুরেশ কহিল, বেশ, আমার বন্ধুকেই দেবো, বলিয়া কাগজখানা টেবিল হইতে তুলিয়া লইয়া দুই পা পিছাইয়া গিয়া অচলার সম্মুখে দাঁড়াইবামাত্রই, কেদারবাবু অগ্ন্যুৎপাতের ন্যায় প্রজ্বলিত হইয়া উঠিলেন। চিৎকার করিয়া বলিলেন, খবরদার সুরেশ! কাল থেকে অনেক অপমান আমি নিঃশব্দে সহ্য করেচি, কিন্তু আমার মেয়েকে আমার চোখের সামনে তুমি টাকা দিয়ে যাবে, সে আমার কিছুতেই সইবে না বলে দিচ্ছি। বলিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে তাঁহার আরাম-কেদারায় ধপ করিয়া বসিয়া পড়িলেন।
প্রথমটা সুরেশ চমকিয়া কেদারবাবুর প্রতি নির্নিমেষ-দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। তিনি ওইরূপে বসিয়া পড়িলে সে তাহার বিবর্ণ মুখ অচলার প্রতি ফিরাইয়া দেখিল, সে একমুহূর্তে যেন পাষাণ হইয়া গিয়াছে। প্রবল চেষ্টায় একবার সুরেশ কি একটা বলিতেও গেল; কিন্তু তাহার শুষ্ককণ্ঠ একটা অব্যক্ত ধ্বনি ভিন্ন স্পষ্ট কিছুই বাহির হইল না। আবার ফিরিয়া দেখিল, কেদারবাবু দুই করতল মুখের উপর চাপিয়া ধরিয়া তেমনি পড়িয়া আছেন। আর সে কথা বলিবার চেষ্টাও করিল না, শুধু আড়ষ্টের মত আরও মিনিট-খানেক স্তব্ধভাবে থাকিয়া অবশেষে নিঃশব্দে ধীরে ধীরে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
সে চলিয়া গেল, কিন্তু কন্যা ও পিতা ঠিক তেমনি একভাবে বসিয়া রহিলেন; এবং দেয়ালের গায়ে বড় ঘড়িটার টিক্‌টিক্‌ শব্দ ছাড়া সমস্ত কক্ষ ব্যাপিয়া কেবল একটা নিষ্ঠুর নীরবতা বিরাজ করিতে লাগিল।
নীচে সুরেশের রবার-টায়ারের গাড়িখানা যে ফটক পার হইয়া গেল, তাহা ঘোড়ার ঘুরের শব্দে বুঝিতে পারা গেল এবং পরক্ষণেই বেহারা ঘরে ঢুকিয়া ডাকিল, বাবু!
কেদারবাবু চোখ তুলিয়া দেখিলেন, তাহার হাতে একখণ্ড ছিন্ন কাগজ। আর কিছু বলিতে হইল না, তিনি লাফাইয়া উঠিয়া তাহার দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করিয়া চিৎকার করিয়া উঠিলেন, নিয়ে যা বলচি ব্যাটা, নিয়ে যা সুমুখ থেকে। বেরো বলচি—
হতবুদ্ধি বেহারাটা মনিবের কাণ্ড দেখিয়া দ্রুতপদে পলায়ন করিতেই, তিনি কন্যার প্রতি অগ্নি-দৃষ্টিক্ষেপ করিয়া কণ্ঠস্বর আরও একপর্দা চড়াইয়া দিয়া বলিলেন, হারামজাদা, নচ্ছার যদি আর কোনদিন কোন ছলে আমার বাড়ি ঢোকবার চেষ্টা করে ত তাকে পুলিশে দেব—এই আমি তোমাকে জানিয়ে রাখলুম অচলা!
নিজের নাম শুনিয়া অচলা তাহার একান্ত পাণ্ডুর মুখখানি ধীরে ধীরে উন্নত করিয়া ব্যথিত ম্লান চক্ষুদুটি পিতার মুখের প্রতি নিঃশব্দে মেলিয়া চাহিয়া রহিল.
পিতা কহিলেন, টাকা ছড়িয়ে বাপের চোখকে বন্ধ করা যায় না, পাষণ্ড যেন এ কথা মনে রাখে।

কন্যা তথাপি নিরুত্তর হইয়া রহিল, কিন্তু তাহার মলিন দৃষ্টি যে উত্তরোত্তর প্রখর হইয়া উঠিতে লাগিল, পিতার দৃষ্টিতে তাহা পড়িল না। তিনি তর্জনী কম্পিত করিয়া কহিতে লাগিলেন, হ্যান্ডনোট ছিঁড়ে ফেলে বাপকে ঘুষ দেওয়া যায় না, এ কথা আমি তাকে বুঝিয়ে তবে ছাড়ব। এ বাড়ি আমি নিজে বিক্রি করে নিজের ঋণ পরিশোধ করে যেখানে ইচ্ছে চলে যাবো—আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না, তা বলে রাখচি।
এতক্ষণ পরে অচলা কথা কহিল। প্রথমটা বাধা পাইল বটে, কিন্তু তার পরে স্থির অবিচলিত-কণ্ঠে কহিল, ঋণ-পরিশোধ না করে বাড়িটা আমার জন্যে রেখে যাবে, এই কি আমি প্রত্যাশা করি বাবা? তুমি না করলে ত এ কাজ আমাকেই করতে হতো।
কেদারবাবু অধিকতর উত্তেজিতভাবে জবাব দিলেন, তোমরা যা করে এসেছ, শুধু তাইতেই ত আমি ভদ্রসমাজে মুখ দেখাতে পারচি নে, তা তুমি জানো?
অচলা তেমনি শান্ত দৃঢ়স্বরে প্রত্যুত্তর দিল, না, আমি জানিনে। আমি এমন কিছু যদি করতুম বাবা, তার জন্যে তুমি মুখ দেখাতে পারো না, তা হলে সকলের আগে আমার মুখই তোমরা কেউ দেখতে পেতে না। সে দেশে আর যারই অভাব থাক, ডুবে মরবার মত জলের অভাব ছিল না। বলিতে বলিতেই কান্নায় তাহার গলা ধরিয়া আসিল, কহিল, কাল থেকে যে অপমান আমাকে তুমি করচ, শুধু মিথ্যে বলেই সইতে পেরেচি, নইলে—
এইখানে তাহার একেবারে কণ্ঠরোধ হইয়া গেল। সে মুখের উপর আঁচল চাপিয়া ধরিয়া উচ্ছ্বসিত ক্রন্দন কোনমতে সংবরণ করিয়া দ্রুতবেগে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
কেদারবাবু একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন। ক্রোধ করিবার, আঘাত করিবার, শোক করিবার অর্থাৎ কন্যার নিন্দিত আচরণে সর্বপ্রকার গভীর বিষাদের কারণ একমাত্র তাঁহারাই ঘটিয়াছে, ইহাই ছিল তাঁহার বিশ্বাস; কিন্তু অপর পক্ষও যে অকস্মাৎ তাঁহারই আচরণকে অধিকতর গর্হিত বলিয়া মুখের উপর তিরস্কার করিয়া তীব্র অভিমানে কাঁদিয়া চলিয়া যাইতে পারে, এ সম্ভাবনা তাঁহার স্বপ্নেও উদয় হয় নাই। তাই অভিভূতের ন্যায় কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া তিনি আস্তে আস্তে বসিয়া পড়িলেন এবং মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে বারংবার বলিতে লাগিলেন, এই নাও—এ আবার এক কাণ্ড!
ইহার পরে আট-দশদিন পিতা-পুত্রীর যে কি করিয়া কাটিল, সে শুধু অন্তর্যামীই দেখিলেন। অচলা কোনমতেই নিজের ঘর ছাড়িয়া বাহির হইল না, বাটীর চাকর-দাসীর কাছেও মুখ-দেখানো তাহার পক্ষে যেন অসম্ভব হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। বিগত কয়দিনের মত আজও সে পথের দিকে চাহিয়াই দিন কাটাইবার জন্য খোলা জানালায় আসিয়া বসিয়াছিল।
শীতের দিন, মধ্যাহ্নের সঙ্গে সঙ্গেই একটা ম্লান ছায়া যেন আকাশ হইতে মাটির উপরে ধীরে ধীরে ঝরিয়া পড়িতেছিল এবং সেই মালিন্যের সহিত তাহার সমস্ত জীবনের কি একটা অজ্ঞাত সম্বন্ধ অন্তরের গভীর তলদেশে অনুভব করিয়া তাহার সমস্ত মন যেন এই স্বল্পায়ু বেলার মতই নিঃশব্দে অবসন্ন হইয়া আসিতেছিল। তাহার চক্ষু যে ঠিক কিছু দেখিতেছিল তাহাও নহে, অথচ অভ্যাসমত উপরে-নীচে, আশেপাশে কিছুই তাহার দৃষ্টি এড়াইতেছিল না। এমনি একভাবে বসিয়া বেলা যখন আর বাকি নাই, সহসা দেখিতে পাইল, সুরেশের গাড়ি তাহাদের বাটীতে প্রবেশ করিতেছে। চক্ষের পলকে তাহার সমস্ত মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল এবং পুলিশ দেখিয়া চোর যেভাবে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করে, ঠিক তেমনি করিয়া সে জানালা হইতে ছুটিয়া আসিয়া একেবারে খাটের উপর শুইয়া পড়িল।

মিনিট-কুড়ি পরে তাহার রুদ্ধ দরজায় ঘা পড়িল ; এবং বাহির হইতে তাহার পিতা স্নিগ্ধস্বরে ডাক দিলেন, মা অচলা, জেগে আছো কি?
কিন্তু সাড়া না পাইয়া অধিকতর কোমল-কণ্ঠে কহিলেন, বেলা গেছে মা, ওঠো। সুরেশের পিসীমা তোমাকে নিতে এসেছেন, মহিম নাকি ভারী পীড়িত।
অচলা শয্যাত্যাগ করিয়া উঠিয়া নীরবে দ্বার খুলিয়া দিতেই সুরেশের পিসিমা আসিয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন।
অচলা হেঁট হইয়া তাঁহার পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিল।
কেদারবাবু সকলের পশ্চাতে ঘরে ঢুকিয়া শয্যার একান্তে বসিয়া কন্যাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, তোমাদের চলে আসার পর থেকেই মহিমের ভারী জ্বর। খুব সম্ভব রাত্রে হিম লেগে দুশ্চিন্তায় পরিশ্রমে নানা কারণে এই অসুখটি হয়েছে। বলিয়া সুরেশের পিসিকে উদ্দেশ করিয়া পুনশ্চ কহিলেন, আমি ভেবে সারা হয়ে যাচ্ছি, এদের পাঠিয়ে পর্যন্ত সে একটা সংবাদ দিলে না কেন? সুরেশ আমার দীর্ঘজীবী হোক, সে গিয়ে বুদ্ধি করে তাকে এখানে না এনে ফেললে কি যে হতো তা ভগবানই জানেন। বলিয়া সস্নেহ অনুতাপে বৃদ্ধের গলা ধরিয়া আসিল।
অচলা নিঃশব্দে নতমুখে দাঁড়াইয়া সমস্ত শুনিল, কোন প্রশ্ন করিল না, কিছুমাত্র চাঞ্চল্য প্রকাশ করিল না।
সুরেশের পিসীমা অচলার বাহুর উপর তাঁহার ডান হাতখানি রাখিয়া শান্ত মৃদুকণ্ঠে বলিলেন ভয় নেই মা, সে দু’দিনেই ভাল হয়ে যাবে।
অচলা কোন কথা না কহিয়া তাঁহাকে আর একবার নত হইয়া প্রণাম করিয়া আলনা হইতে শুধু গায়ের কাপড়খানি টানিয়া লইয়া যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া দাঁড়াইল।
এই শীতের অপরাহ্নে ঠাণ্ডার মধ্যে তাহাকে কিছুমাত্র গরম জামা-কাপড় না লইয়া, খালি গায়ে, অনভ্যস্ত সাজে বাহিরে যাইতে উদ্যত দেখিয়া বৃদ্ধ পিতার বুকে বাজিল; কিন্তু পুরোবর্তী ঐ বিধবার সজ্জার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া আর তাঁহার বাধা দিতে প্রবৃত্তি হইল না। তিনি শুধু কেবল বলিলেন, চল মা, আমিও সঙ্গে যাচ্চি, বলিয়া চটি-জুতা পায়ে দিয়াই সকলের অগ্রে সিঁড়ি বাহিয়া নীচে নামিয়া চলিলেন।






ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
মহিমের প্রতি অচলার সকলের চেয়ে বড় অভিমান এই ছিল যে, স্ত্রী হইয়াও সে একটি দিনের জন্যও স্বামীর দুঃখ-দুশ্চিন্তার অংশ গ্রহণ করিতে পায় নাই। এই লইয়া সুরেশও বন্ধুর সহিত ছেলেবেলা হইতে অনেক বিবাদ করিয়াছে, কিন্তু কোন ফল হয় নাই। কৃপণের ধনের মত মহিম সেই বস্তুটিকে সমস্ত সংসার হইতে চিরদিন এমনি একান্ত করিয়া আগলাইয়া ফিরিয়াছে যে, তাহাকে দুঃখ দুঃসময়ে কাহারও সাহায্য করা দূরে থাক, কি যে তাহার অভাব, কোথায় যে তাহার ব্যথা, ইহাই কোনদিন কেহ ঠাহর করিতে পারে নাই।
সুতরাং বাড়ি যখন পুড়িয়া গেল, তখন সেই পিতৃপিতামহের ভস্মীভূত গৃহস্তূপের প্রতি চাহিয়া মহিমের বুকে যে কি শেল বিঁধিল, তাহার মুখ দেখিয়া অচলা অনুমান করিতে পারিল না। মৃণালের বৈধব্যেও স্বামীর দুঃখের পরিমাণ করা তাহার তেমনি অসাধ্য। যেদিন নিজের মুখে শুনাইয়া দিয়াছিল, তাহাকে সে ভালবাসে না, সেদিন সে আঘাতের গুরুত্ব সম্বন্ধেও সে এমনি অন্ধকারেই ছিল। অথচ এত বড় নির্বোধও সে নহে যে, সর্বপ্রকার দুর্ভাগ্যেই স্বামীর নির্বিকার ঔদাসীন্যকে যথার্থই সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতে তাহার মনের মধ্যে কোন সংশয়ই উঁকি মারিত না। তাই সেদিন স্টেশনের উপরে সে স্বামীর অবিচলিত শান্ত মুখের প্রতি বারংবার চাহিয়া সমস্ত পথটা শুধু এই কথাই ভাবিতে ভাবিতে আসিয়াছিল, সহিষ্ণুতার ওই মিথ্যা মুখোশের অন্তরালে তাহার মুখের সত্যকার চেহারাটা না জানি কিরূপ।
আজ তাহার পীড়ার সংবাদটাকে লঘু এবং স্বাভাবিক ঘটনার আকার দিবার জন্য কেদারবাবু যখন সহজ গলায় বলিয়াছিলেন, তিনি কিছুই আশ্চর্য হন নাই, বরঞ্চ এত বড় দুর্ঘটনার পরে এমনিই কিছু একটা মনে মনে আশঙ্কা করিতেছিলেন, তখন অচলার নিজের অন্তরে যে ভাব একমুহূর্তের জন্যও আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল, তাহাকে অবিমিশ্র উৎকণ্ঠা বলাও সাজে না।
সুরেশের রবার-টায়ারের গাড়ি দ্রুতবেগে চলিয়াছিল। পিসীমা এক দিকের দরজা টানিয়া দিয়া চুপ করিয়া বসিয়াছিলেন, এবং তাহার পার্শ্বে অচলা পাথরের মূর্তির মত স্থির হইয়া বসিয়াছিল। শুধু কেদারবাবু কাহারো কাছে কোন উৎসাহ না পাইয়াও পথের দিকে শূন্যদৃষ্টি পাতিয়া অনর্গল বকিতেছিলেন। সুরেশের মত দয়ালু বুদ্ধিমান বিচক্ষণ ছেলে ভূ-ভারতে নাই; মহিমের একগুঁয়েমির জ্বালায় তিনি বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছেন; যে দেশে মানুষ নাই, ডাক্তার-বৈদ্য নাই, শুধু চোর-ডাকাত, শিয়াল-কুকুরের বাস, সেই পাড়াগাঁয়ে গিয়া বাস করার শাস্তি একদিন তাহাকে ভাল করিয়াই ভোগ করিতে হইবে,—এমনি সমস্ত সংলগ্ন-অসংলগ্ন মন্তব্য তিনি নিরন্তর এই নির্বাক রমণী-দুইটির কর্ণে নির্বিচারে ঢালিয়া চলিতেছিলেন।
ইহার কারণও ছিল। কেদারবাবু স্বভাবতঃই যে এতটা হালকা প্রকৃতির লোক ছিলেন, তাহা নহে। কিন্তু আজ তাঁহার হৃদয়ের গূঢ়-আনন্দ কোন সংযমের শাসনই মানিতেছিল না। তাঁহাদের পরম মিত্র সুরেশের সহিত প্রকাশ্য বিবাদ, একমাত্র কন্যার নিঃশব্দ বিদ্রোহ এবং সর্বোপরি একান্ত কুৎসিত ও কদর্য সংশয়ের গোপন গুরুভার বিগত কয়েকদিন হইতে তাঁহার বুকের উপর জাঁতার মত চাপিয়া বসিয়াছিল; আজ পিসীমার অপ্রত্যাশিত আগমনে সেই ভারটা অকস্মাৎ অন্তর্হিত হইয়া গিয়াছিল। মহিমের অসুখের খবরটাকে তিনি মনের মধ্যে আমলই দেন নাই। যদি সে রাত্রির দৈব-দুর্বিপাকে ঠাণ্ডা লাগাইয়া একটু জ্বরভাবই হইয়া থাকে ত সে কিছুই নহে। পিসীমা দুই-তিনদিনের মধ্যে আরোগ্য হইবার আশা দিয়াছিলেন; হয়ত সে সময়ও লাগিবে না, হয়ত কাল সকালেই সারিয়া যাইবে। পীড়ার সম্বন্ধে ইহাই তিনি ভাবিয়া রাখিয়াছিলেন। কিন্তু আসল কথা হইতেছে এই যে, সুরেশ স্বয়ং গিয়া তাহাকে আপনার বাড়িতে ধরিয়া আনিয়াছে এবং যে-কোন ছলে তাহার স্রীকে তাহার পার্শ্বে আনিয়া দিবার জন্য নিজের পিসীমাকে পর্যন্ত পাঠাইয়া দিয়াছে। কন্যা জামাতার মধ্যে যে কিছুকাল হইতে একটা মনোমালিন্য চলিয়া আসিতেছিল, দাসীর মুখের এ তথ্যটি তিনি একবারও বিস্মৃত হন নাই। অতএব সমস্তই যে সেই দাম্পত্য-কলহের ফল, আজ এই সত্য পরিস্ফুট হওয়ায়, এই অবিশ্রাম বকুনির মধ্যেও তাঁহার নিরতিশয় আত্মগ্লানির সহিত মনে হইতে লাগিল, ওখানে পৌঁছিয়া সেই সম্পূর্ণ নিরপরাধ ও ভদ্র যুবকের মুখের পানে তিনি চাহিয়া দেখিবেন কি করিয়া? কিন্তু তাঁহার কন্যার সর্বদেহের উপর একটা কঠিন নীরবতা স্থির হইয়া বিরাজ করিতে লাগিল। অসুখটা যে বিশেষ কিছুই নহে, তাহা সেও মনে মনে বুঝিয়াছিল, শুধু বুঝিতে পারিতেছিল না, সুরেশ তাহাকে ধরিয়া আনিল কিরূপে! স্বামীকে সে এটুকু চিনিয়াছিল।

সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। রাস্তার গ্যাস জ্বলিয়া উঠিয়াছে। গাড়ি সুরেশের বাটীর ফটকের মধ্যে প্রবেশ করিল এবং গাড়িবারান্দার অনতিদূরে আসিয়া থামিল। কেদারবাবু গলা বাড়াইয়া দেখিয়া সহসা উদ্বিগ্ন-স্বরে বলিয়া উঠিলেন, দুখানা গাড়ি দাঁড়িয়ে কেন?
সঙ্গে সঙ্গেই অচলার চকিত দৃষ্টি গিয়া তাহার উপরে পড়িল এবং লণ্ঠনের আলোকে স্পষ্ট দেখিতে পাইল, সুরেশ একজন প্রবীণ ইংরাজকে সসম্ভ্রমে গাড়িতে তুলিয়া দিতেছে এবং আর একজন সাহেবী-পোশাকপরা বাঙালী পার্শ্বে দাঁড়াইয়া আছে। ইঁহারা যে ডাক্তার, তাহা উভয়েই চক্ষের পলকে বুঝিতে পারিল।
তাঁহারা চলিয়া গেলে ইঁহাদের গাড়ি আসিয়া গাড়িবারান্দায় লাগিল। সুরেশ দাঁড়াইয়া ছিল, কেদারবাবু চিৎকার করিয়া প্রশ্ন করিলেন, মহিম কেমন আছে সুরেশ? অসুখটা কি?
সুরেশ কহিল, ভাল আছে। আসুন।
কেদারবাবু অধিকতর ব্যগ্রকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, অসুখটা কি তাই বল না শুনি?
সুরেশ কহিল, অসুখের নাম করলে ত আপনি বুঝতে পারবেন না কেদারবাবু! জ্বর, বুকে একটু সর্দি বসেছে। কিন্তু আপনি নেমে আসুন, ওঁদের নামতে দিন।
কেদারবাবু নামিবার চেষ্টামাত্র না করিয়া বলিলেন, একটু সর্দি বসেছে। তার চিকিৎসা ত তুমি নিজেই করতে পার! আমি ছেলেমানুষ নই সুরেশ, দু’জন ডাক্তার কেন? সাহেব-ডাক্তারই বা কিসের জন্যে? বলিতে বলিতে তাঁহার গলা কাঁপিতে লাগিল।

সুরেশ নিকটে আসিয়া হাত ধরিয়া তাঁহাকে নামাইয়া লইয়া বলিল, পিসীমা, অচলাকে ভেতরে নিয়ে যাও, আমি যাচ্চি।
অচলা কাহাকেও কোন প্রশ্ন করিল না, তাহার মুখের চেহারাও অন্ধকারে দেখা গেল না; নামিতে গিয়া পাদানের উপর তাহার পা যে টলিতে লাগিল, ইহাও কাহারও চোখে পড়িল না, সে যেমন নিঃশব্দে আসিয়াছিল, তেমনি নিঃশব্দে নামিয়া পিসীমার পিছনে পিছনে বাটীর ভিতর চলিয়া গেল।
মিনিট-কয়েক পরে দ্বারের ভারী পর্দা সরাইয়া যখন সে রোগীর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল, তখন মহিম বোধ করি তাহার বাটীর সম্বন্ধে কি-সব বলিতেছিল। সেই জড়িতকণ্ঠের দুটা কথা কানে প্রবেশ করিবামাত্রই আর তাহার বুঝিতে বাকি রহিল না, ইহা অর্থহীন প্রলাপ এবং রোগ কতদূর গিয়া দাঁড়াইয়াছে; মুহূর্তকালের জন্য সে দেয়ালের গায়ে ভর দিয়া আপনাকে দৃঢ় করিয়া রাখিল।
যে মেয়েটি রোগীর শিয়রে বসিয়া বরফ দিতেছিল, সে ফিরিয়া চাহিল এবং ধীরপদে উঠিয়া আসিয়া অচলাকে হেঁট হইয়া প্রণাম করিয়া সোজা হইয়া দাঁড়াইল। ইহার বিধবার বেশ। চুলগুলি ঘাড় পর্যন্ত ছোট করিয়া ছাঁটা; ইহার মুখের উপর সর্বকালের সকল বিধবার বৈরাগ্য যেন নিবিড়ভাবে বিরাজ করিতেছিল। ম্লান দীপালোকে প্রথমে ইহাকে মৃণাল বলিয়া অচলা চিনিতে পারে নাই; এখন মুখোমুখি স্থির হইয়া দাঁড়াইতেই ক্ষণকালের জন্য উভয়েই যেন স্তম্ভিত হইয়া রহিল; একবার অচলার সমস্ত দেহ দুলিয়া নড়িয়া উঠিল; কি একটা বলিবার জন্য ওষ্ঠাধরও কাঁপিতে লাগিল; কিন্তু কোন কথাই তাহার মুখ ফুটিয়া বাহির হইল না, এবং পরক্ষণেই তাহার সংজ্ঞাহীন দেহ ছিন্নলতার মত মৃণালের পদমূলে পড়িয়া গেল।
চেতনা পাইয়া অচলা চাহিয়া দেখিল, সে পিতার ক্রোড়ের উপর মাথা রাখিয়া একটা কোচের উপর শুইয়া আছে। একজন দাসী গোলাপজলের পাত্র হইতে তাহার চোখেমুখে ছিটা দিতেছে এবং পার্শ্বে দাঁড়াইয়া সুরেশ একখানা হাতপাখা লইয়া ধীরে ধীরে বাতাস করিতেছে।
ব্যাপারটা কি হইয়াছে, স্মরণ করিতে তাহার কিছুক্ষণ লাগিল। কিন্তু মনে পড়িতে লজ্জায় মরিয়া শশব্যস্তে উঠিয়া বসিবার উপক্রম করিতেই কেদারবাবু বাধা দিয়া কহিলেন, একটু বিশ্রাম কর মা, এখন উঠে কাজ নাই।
অচলা মৃদুকণ্ঠে বলিল, না বাবা, আমি বেশ ভাল হয়ে গেছি, বলিয়া পুনরায় বসিবার চেষ্টা করিতে পিতা জোর করিয়া ধরিয়া রাখিয়া উদ্বেগের সহিত বলিলেন, এখন উঠবার কোন আবশ্যক নেই অচলা, বরঞ্চ একটুখানি ঘুমোবার চেষ্টা কর।
সুরেশও অস্ফুটে বোধ করি এই কথারই অনুমোদন করিল। অচলা নীরবে একবার তাহার মুখের পানে চাহিয়া প্রত্যুত্তরে কেবল পিতার হাতখানা ঠেলিয়া দিয়া সোজা উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ঘুমোবার জন্যে ত এখানে আসিনি বাবা—আমার কিছুই হয়নি—আমি ও-ঘরে যাচ্চি। বলিয়া প্রতিবাদের অপেক্ষা না করিয়া বাহির হইয়া গেল।
এ বাটীর ঘর-দ্বার সে বিস্মৃত হয় নাই। রোগীর কক্ষ চিনিয়া লইতে তাহার বিলম্ব হইল না। প্রবেশ করিতেই মৃণাল চাহিয়া দেখিল; কহিল, তুমি এসে একটুখানি বসো সেজদি, আমি আহ্নিকটা সেরে নিই গে। বরফের টুপিটা গড়িয়ে না পড়ে যায়, একটু নজর রেখো। বলিয়া সে অচলাকে নিজের জায়গায় বসাইয়া দিয়া ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল।






চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ
কঠিন নিমোনিয়া রোগ সারিতে সময় লাগিবে। কিন্তু মহিম ধীরে ধীরে যে আরোগ্যের পথেই চলিয়াছিল, এ যাত্রায় আর তাহার ভয় নাই, এ কথা সকলের কাছেই সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল। তাহার মুখের অর্থহীন বাক্য, চোখের উদ্‌ভ্রান্ত দৃষ্টি সমস্তই শান্ত এবং স্বাভাবিক হইয়া আসিতেছিল।
দিন-দশেক পরে একদিন অপরাহ্নবেলায় মহিম শান্তভাবে ঘুমাইতেছিল। এ বৎসর সর্বত্রই শীতটা বেশী পড়িয়াছিল। তাহাতে এইমাত্র বাহিরে এক পশলা বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। রোগীর খাটের সহিত একটা বড় তক্তপোশ জোড়া দিয়া বিছানা করা হইয়াছিল; ইহার উপরেই সকলে বেশ করিয়া কাপড় গায়ে দিয়া বসিয়াছিল। সকলের চোখ-মুখেই একটা নিরুদ্বিগ্ন তৃপ্তির প্রকাশ; শুধু পিসীমা গৃহকর্মে অন্যত্র নিযুক্ত এবং কেদারবাবু তখনও বাড়ি হইতে আসিয়া জুটিতে পারেন নাই।
সুরেশের প্রতি চাহিয়া মৃণাল হঠাৎ হাতজোড় করিয়া কহিল, এইবার আমার ছাড়পত্র মঞ্জুর করতে হুকুম হোক সুরেশবাবু, আমি দেশে যাই। এই দারুণ শীতে আমার বুড়ী শাশুড়ি হয়ত বা মরেই গেল।
সুরেশ কহিল, এখনও কি তাঁর বেঁচে থাকা দরকার নাকি? না, তাঁর জন্য আপনার যাওয়া হবে না।
মৃণাল পলকের তরে ঘাড় ফিরাইয়া বোধ করি বা একটা দীর্ঘনিশ্বাসই চাপিয়া লইল; তাহার পরে সুরেশের মুখের পানে চাহিয়া একটু হাসিয়া বলিল, শুধু আপনিই নয় সুরেশবাবু, এ প্রশ্ন পূর্বে আমিও অনেকবার করেছি। মনেও হয়, এখন তাঁর যাওয়া মঙ্গল। কিন্তু মরণ-বাঁচনের মালিক যিনি, তাঁর ত সে খেয়াল নেই, থাকলে হয়ত সংসারে অনেক দুঃখ-কষ্টের হাত থেকে মানুষ নিস্তার পেত।
অচলা এতক্ষণ চুপ করিয়াই ছিল। মৃণালের কথায় বোধ করি তাহার স্বামীর মৃত্যুর কথাটাই মনে করিয়া কহিল, তার মানে যিনি অন্তর্যামী তিনি জানেন, মানুষ শত দুঃখেও নিজের মৃত্যু চায় না।
মৃণালের মুখের উপর একটা গোপন বেদনার চিহ্ন প্রকাশ পাইল। মাথা নাড়িয়া কহিল, না সেজদি, তা নয়। এমন সময় সত্যিই আসে যখন মানুষে যথার্থই মরণ-কামনা করে। সেদিন অনেক রাত্রে হঠাৎ তন্দ্রা ভেঙ্গে যেতে শাশুড়ি-ঠাকরুনকে বিছানায় পেলুম না। তাড়াতাড়ি বাইরে এসে দেখি, ঠাকুরঘরের দরজাটা একটু খোলা। চুপি চুপি পাশে এসে দাঁড়ালুম। দেখি, তিনি গলায় কাপড় দিয়ে ঠাকুরের কাছে করজোড়ে মৃত্যু ভিক্ষে চাইচেন। বলছেন, ঠাকুর! যদি একটা দিনও কায়মনে তোমার সেবা করে থাকি ত আজ আমার লজ্জা নিবারণ কর। আমি মুক্তি চাইনে, স্বর্গ চাইনে, শুধু এই চাই ঠাকুর, তুমি আর আমাকে লজ্জা দিও না—আমি এ মুখ আমার বৌমার কাছে বার করতে পারচি নে। বলিতে বলিতেই মৃণাল ঝরঝর করিয়া কাঁদিতে লাগিল।এই প্রার্থনার মধ্যে মাতৃ-হৃদয়ের কত বড় সুগভীর বেদনা যে নিহিত ছিল, তাহা কাহারও অনুভব করিতে বিলম্ব হইল না। সুরেশের দুই চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল। কাহারও সামান্য দুঃখেই সে কাতর হইয়া পড়িত; আজ এই সন্তানহারা বৃদ্ধা জননীর মর্মান্তিক দুঃখের কাহিনীতে তাহার বুকের মধ্যে ঝড় বহিতে লাগিল। সে খানিকক্ষণ স্তব্ধভাবে মাটির দিকে চাহিয়া থাকিয়া মুখ তুলিয়া অকস্মাৎ উচ্ছ্বসিতকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, আচ্ছা, যাও দিদি, তোমার বুড়ো শাশুড়ির সেবা করে কর্তব্য কর গে, আমি আর তোমাকে আটকে রাখব না। এই হতভাগ্য দেশের আজও যদি কিছু গৌরব করবার থাকে ত সে তোমার মত মেয়েমানুষ । এমন জিনিসটি বোধ করি, আর কোন দেশ দেখাতে পারে না। বলিয়া সে জিজ্ঞাসু-মুখে একবার অচলার প্রতি চাহিল। কিন্তু সে জানালার বাহিরে একখণ্ড ধূসর মেঘের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া নিঃশব্দে বসিয়াছিল বলিয়া তাহার কাছ হইতে কোন সাড়া আসিল না।
কিন্তু মৃণাল লজ্জা পাইয়া নিজের দিক হইতে আলোচনাটাকে অন্য পথে সরাইবার জন্য তাড়াতাড়ি জোর করিয়া একটু হাসিয়া বলিল, না, নেই বৈ কি! আপনি সব দেশের খবর জানেন কিনা! আচ্ছা, সেজদার চেয়ে আপনি বড় না ছোট?
এই অদ্ভুত প্রশ্নে সুরেশ সহাস্যে কহিল, কেন বলুন ত?
মৃণাল বাধা দিয়া বলিল, না, আমাকে আর আপনি নয়। আমি দিদি হলেও যখন বয়সে ছোট, তখন—মেজদা? নদা?—বলুন, বলুন, শিগ্‌গির বলুন, কি?
অচলা আকাশ হইতে দৃষ্টি অপসারিত করিয়া এবার তাহার দিকে চাহিল। অনেকদিন পূর্বে যেদিন এই মেয়েটি এমনি দ্রুত, এমনি অবলীলাক্রমে তাহার সহিত সেজদি সম্বন্ধ পাতাইয়া লইয়াছিল, সে কথা তাহার মনে পড়িল। কিন্তু মৃণালের চরিত্রের এই দিকটা সুরেশের জানা ছিল না বলিয়া সে এই আশ্চর্য রমণীর মুখের পানে তাকাইয়া সকৌতুক হাস্যে বলিল, নদা! নদা! তোমার সেজদার চেয়ে আমি প্রায় দেড় বছরের ছোট।
মৃনাল কহিল, তা হলে নদা, দয়া করে একটি লোক ঠিক করে দিন, যে আমাকে কাল সকালের গাড়িতে রেখে আসবে।
যাইবার অনুমতি এইমাত্র সুরেশ নিজে দিলেও সে যে কাল সকালেই যাইতে উদ্যত হইবে তাহা সে ভাবে নাই। তাই ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া ঈষৎ গম্ভীর হইয়া বলিল, আর দুটো দিনও কি থাকতে পারবে না দিদি? তোমার ওপর ভার দিয়ে আমরা মহিমের জন্যে একেবারে নিশ্চিন্ত ছিলুম। এমন অহর্নিশি সতর্ক, এমন গুছিয়ে সেবা করতে আমি হাসপাতালেও কখনো কাউকে দেখেচি বলে মনে হয় না। কি বল অচলা?
প্রত্যুত্তরে অচলা শুধু মাথা নাড়িল।
মৃণাল সুরেশের চিন্তিতভাব লক্ষ্য করিয়া হাসিমুখে বলিল, আপনি সেজন্যে একটুকুও ভাববেন না। যার জিনিস, তারই হাতে দিয়ে যাচ্ছি, নইলে আমিও হয়ত যেতে পারতুম না। আপনার ত মনে আছে, আমাদের কি রকম তাড়াতাড়ি চলে আসতে হয়েছিল। তাই কোনো বন্দোবস্ত করেই আসা হয়নি। কাল আমাকে ছুটি দিন নদা, আবার যখনই হুকুম করবেন, তখনই চলে আসব।
সুরেশ আবার কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া সহসা বলিয়া বসিল, আচ্ছা মৃণাল, সেই অজ পাড়াগাঁয়ে শুধু কেবল একটা বুড়ো শাশুড়ির সেবা করে, আর পূজো-আহ্নিক করে তোমার সমস্ত সময়টা কাটবে কি করে, আমি তাই শুধু ভাবি।
মৃণালের মুখের উপর পুনরায় ব্যথার চিহ্ন প্রকাশ পাইল। কিন্তু সে হাসিয়া কহিল, সময় কাটাবার ভার ত আমার ওপর নেই নদা। যিনি সময় সৃষ্টি করেছেন তিনিই তার ব্যবস্থা করবেন।

সুরেশ কহিল, আচ্ছা সে যেন হলো। কিন্তু তোমার শাশুড়ি ত বেশীদিন বাঁচবেন না, আর মহিমকেও ডাক্তারের হুকুমমত ভাল হয়ে পশ্চিমের কোন একটা স্বাস্থ্যকর শহরে গিয়ে কিছুকাল বাস করতে হবে। তখন একলাটি সেখানে তুমি থাকবে কি করে?
মৃণাল উপরের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া পুনরায় একটু হাসিল। কহিল, সে উনিই জানেন।
অজ্ঞাতসারে সুরেশের মুখ দিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস পড়িল। মৃণাল কহিল, নদা বুঝি এ-সব মানেন না?
কি সব?
এই যেমন ভগবান—
না।
তবে বুঝি আমাদের জন্যে ওটা আপনার অবজ্ঞার দীর্ঘনিশ্বাস বয়ে গেল নদা?
সুরেশ এ প্রশ্নে সহসা কোন উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ বিমনার মত তাহার মুখের পানে চাহিয়া থাকিয়া হঠাৎ ঘাড় নাড়িয়া বলিয়া উঠিল, না মৃণাল, তা নয়। একটা অজানা ভবিষ্যতের ভার তেমনি অজানা একটা ঈশ্বরের ওপরে দিয়ে তারা যে বরঞ্চ আমাদের চেয়ে জিতের পথেই চলে, তা আমি অনেক দেখেচি। কিন্তু এ-সব আলোচনা থাক দিদি, হয়ত আমার প্রতি তোমার একটা ঘৃণা জন্মে যাবে।
মৃণাল তাড়াতাড়ি হেঁট হইয়া সুরেশের পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া কহিল, আচ্ছা থাক।
সুরেশ বিস্ময়ে অবাক হইয়া কহিল, এটা আবার কি হলো মৃণাল?
কোন্‌টা নদা?
কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ পায়ের ধূলো নেওয়াটা?
মৃণাল কহিল, বড়ভাইয়ের ধূলো নিতে কি আবার দিনক্ষণ দেখাতে হয় নাকি? বলিয়া হাসিয়া উঠিয়া গেল।
আচ্ছা মেয়ে ত! বলিয়া সস্নেহে-হাস্যে সুরেশ অচলার প্রতি চাহিতে গিয়া বিস্ময়ে একেবারে অভিভূত হইয়া গেল। তাহার সমস্ত মুখ শ্রাবণ-আকাশের মত ঘন মেঘে যেন আচ্ছন্ন হইয়া গিয়াছে, এমনি বোধ হইল। কিন্তু বিস্ময়ের ধাক্কা সামলাইয়া এ-সম্বন্ধে কোনোপ্রকার প্রশ্নের আভাসমাত্র দিবার পূর্বেই অচলা হতবুদ্ধি সুরেশকে আকাশ-পাতাল ভাবিবার অজস্র অবকাশ দিয়া ত্বরিতপদে মৃণালের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া গেল।
সেইখানে স্তব্ধভাবে বসিয়া সুরেশ কেবলি আপনাকে আপনি জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, এ কিসে কি হইল? মৃণালের প্রণাম করার সঙ্গে ইহার কেমন করিয়া যেন একটা নিগূঢ় যোগ আছে, তাহা সে নিজের ভিতর হইতেই নিশ্চয় অনুমান করিতে লাগিল; কিন্তু এ যোগ কোথায়? কেন মৃণাল অকস্মাৎ তাহার পদধূলি মাথায় লইয়া চলিয়া গেল, এবং পলক না ফেলিতে কেনই-বা অচলা ওরূপ বিবর্ণমুখে ঘর ছাড়িয়া প্রস্থান করিল। নিজের ব্যবহার ও কথাবার্তাগুলা সে আগাগোড়া বারংবার তন্ন তন্ন করিয়া স্মরণ করিয়াও কিন্তু কোন কূলকিনারা খুঁজিয়া পাইল না। অথচ পাশাপাশি এত বড় দুটা ঘটনাও কিছু শুধু শুধু ঘটে নাই, তাহাও সে বুঝিল। সুতরাং তাহারই কোন অজ্ঞাত নিন্দিত আচরণই যে এই অনর্থের মূল, এ সংশয় তাহার মনের মধ্যে কাঁটার মত বিঁধিতে লাগিল।
কিন্তু মৃণালকেও এ-সম্বন্ধে কোনপ্রকার প্রশ্ন করা অসম্ভব। রাত্রিটা সে এক-রকম পাশ কাটাইয়া রহিল, এবং প্রভাতে একসময়ে অচলাকে নিভৃতে পাইয়া কহিল, তোমাকে একটা কথার জবাব দিতে হবে।

অচলার মুখ লজ্জায় রাঙ্গা হইয়া উঠিল। প্রশ্নটা যে কি, সে তাহার অগোচর ছিল না। গত রাত্রির সেই তাহার অদ্ভুত আচরণের এই কৈফিয়ত দিতে হইবে বুঝিয়া সে আরক্ত-মুখে মৃদুকণ্ঠে কহিল, কি কথা?
সুরেশ আস্তে আস্তে বলিল, কাল মৃণাল হঠাৎ আমার পায়ের ধুলো নিয়ে উঠে গেল, তুমিও মুখ ভার করে রাগ করে চলে গেলে, সে কি তার শাশুড়ির মরণের কথা বলেছিলুম বলে?
এই অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে অচলা একটা পথ দেখিতে পাইয়া মনে মনে খুশি হইয়া বলিল, এ-রকম প্রসঙ্গ কি তোমার তোলা উচিত ছিল? সে বেচারার স্বামী নেই, শাশুড়ির মৃত্যুতে তার নিঃসহায় অবস্থাটা একবার ভেবে দেখ দিকি!
সুরেশ অতিশয় ক্ষুব্ধ হইয়া কহিল, আমার ভারী অন্যায় হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি যে আর বেশীদিন বাঁচতে পারেন না, এ ত মৃণাল নিজেও বোঝে। তা ছাড়া সে নিঃসহায় হবেই বা কেন?
অচলা জবাব দিল, এ কথা আমরা ত তাকে একবারও বলিনি। বরঞ্চ তুমিই তাকে নানারকমে ভয় দেখালে, দেশে সে একলাটি থাকবে কেমন করে?
সুরেশ অত্যন্ত অনুতপ্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তা হলে সে যাবার পূর্বে আমার কি তাকে সাহস দেওয়া উচিত নয়? তার যে কোন ভয় নেই, এ কথা কি তাকে—বলিতে বলিতেই অকৃত্রিম করুণায় তাহার কণ্ঠ সজল হইয়া আসিল।
অচলা তাহার মুখের পানে চাহিয়া হাসিল। এই পরদুঃখকাতর সহৃদয় যুবকের সহস্র দয়ার কাহিনী তাহার চক্ষের নিমিষে মনে পড়িয়া গেল। ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না, তোমার সাহস দিতেও হবে না, ভয় দেখিয়েও কাজ নেই। যখন সে সময় আসবে, তখন আমি চুপ করে থাকব না।
সুরেশ আত্মবিস্মৃত আবেগভরে অকস্মাৎ তাহার হাতখানা সজোরে চাপিয়া ধরিয়া প্রচণ্ড একটা নাড়া দিয়া বলিয়া উঠিল, এই ত তোমার যোগ্য কথা! এই ত তোমার কাছে আমি চাই অচলা! বলিয়া ফেলিয়াই কিন্তু অপরিসীম লজ্জায় হাত ছাড়িয়া দিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিল।
তাহার যে উচ্ছ্বাস মুহূর্তপূর্বে পরার্থপরতার নির্মল আনন্দের মধ্যে জন্মলাভ করিয়াছিল, এই লজ্জিত পলায়নে তাহা এক নিমিষেই কদর্য কলুষিত হইয়া দেখা দিল। অচলার বুকের রক্ত বিদ্যুৎবেগে প্রবাহিত হইয়া বিন্দু বিন্দু ঘামে ললাট ভরিয়া উঠিল এবং সর্বাঙ্গ বারংবার শিহরিয়া উঠিয়া নিকটবর্তী একখানা চেয়ারের উপর সে নির্জীবের মত বসিয়া পড়িল। কিছুক্ষণে তাহার সে ভাবটা কাটিয়া গেল বটে, কিন্তু পীড়িত স্বামীর শয্যায় গিয়া নিজের আসনটি গ্রহণ করিতে আজ সমস্ত সকালটা তাহার কেমন যেন ভয় ভয় করিতে লাগিল।
যাই যাই করিয়াও যাইতে মৃণালের দিন-দুই দেরি হইয়া গেল। মহিমের কাছে বিদায় লইতে গিয়া দেখিল, আজ সে পাশ ফিরিয়া অত্যন্ত অসময়ে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। যে বিদায় লইতে আসিয়াছিল, সে এই মিথ্যা নিদ্রার হেতু নিশ্চিত অনুমান করিয়াও চুপি চুপি কহিল, ওঁকে আর জাগিয়ে কাজ নেই সেজদি। কি বল?
প্রত্যুত্তরে অচলার ঠোঁটের কোণে শুধু একটুখানি বাঁকা হাসি দেখা দিল। মৃণাল মনে মনে বুঝিল, এ ছলনা সে ছাড়াও আরো একটি নারীর কাছে প্রকাশ পাইয়াছে। তাহার বিরুদ্ধে অচলা অন্তরের মধ্যে যে গোপন ঈর্ষার ভাব পোষণ করে, তাহা সে মহিমের কাছে কোনদিন আভাসমাত্র না পাইয়াও জানিত। এই একান্ত অমূলক দ্বেষ তাহাকে কাঁটার মত বিঁধিত। কিন্তু তথাপি অচলা যে নিজের হীনতা দিয়া আজিকার দিনেও ওই পীড়িত লোকটির পবিত্র দুর্বলতাটুকুকে বিকৃত করিয়া দেখিবে, তাহা সে ভাবে নাই। মুহূর্তকালের নিমিত্ত তাহার মনটা জ্বালা করিয়া উঠিল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়া কানে কানে কহিল, তুমি ত সব জান সেজদি, আমার হয়ে ওঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ো। বলো, ভাল হয়ে আবার যখন দেশে ফিরবেন, বেঁচে থাকি ত দেখা হবে।

নীচে কেদারবাবু বসিয়াছিলেন। মৃণাল প্রণাম করিয়া দাঁড়াইতেই তাঁহার চোখের কোণে জল আসিয়া পড়িল। এই অল্পকালের মধ্যেই সকলের মত তিনিও এই বিধবা মেয়েটিকে অতিশয় ভালবাসিয়াছিলেন। জামার হাতায় অশ্রু মুছিয়া কহিলেন, মা, তোমার কল্যাণেই মহিমকে আমরা যমের মুখ থেকে ফিরে পেয়েছি। যখনি ইচ্ছে হবে, যখনই একটু বেড়াবার সাধ হবে, তোমার এই বুড়ো ছেলেটিকে ভুলো না মা। আমার বাড়ি তোমার জন্যে রাত্রি-দিন খোলা থাকবে মৃণাল।
অচলা অদূরে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়াছিল। মৃণাল তাহাকে দেখাইয়া হাসিমুখে কহিল, যমের বাপের সাধ্যি কি বাবা, ওঁর কাছ থেকে সেজদাকে নিয়ে যায়! যেদিন সেজদির হাতে পৌঁছে দিয়েছি, সেইদিনই আমার কাজ চুকে গেছে।
কেদারবাবুর মুখের ভাব একটু গম্ভীর হইল, কিন্তু আর তিনি কিছু বলিলেন না।
দুইজন বৃদ্ধগোছের কর্মচারী ও একজন দাসী মৃণালকে দেশে পৌঁছাইয়া দিতে প্রস্তুত হইয়াছিল; তাহাদের সকলকে লইয়া স্টেশনের অভিমুখে ঘোড়ার গাড়ি ফটকের বাহির হইয়া গেলে কেদারবাবুর অন্তরের ভিতর হইতে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়িল। ধীরে ধীরে শুধু বলিলেন, অদ্ভুত, অপূর্ব মেয়ে!
সুরেশের মনটাও বোধ করি এইভাবে পরিপূর্ণ হইয়াছিল। সে কোনদিকে লক্ষ্য না করিয়া সায় দিয়া আবেগের সহিত বলিয়া উঠিল, আমি কখনো এমনটি আর দেখিনি কেদারবাবু! এমন মিষ্টি কথাও কখনো শুনিনি, এমন নিপুণ কাজকর্মও কখনো দেখিনি। যে কাজ দাও, এমন অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে করে দেবে যে মনে হবে যেন এই নিয়েই সে চিরকালটা আছে। অথচ আশ্চর্য এই যে, কোনদিন গ্রামের বাইরে পর্যন্ত যায়নি।
কেদারবাবু ইহা সত্য বলিয়া জানিলেও বিস্ময় প্রকাশ করিয়া কহিলেন, বল কি সুরেশ!
সুরেশ কহিল, যথার্থই তাই। ওর পানে চেয়ে চেয়ে আমার মাঝে মাঝে মনে হতো, এই যে জন্মান্তরের সংস্কার বলে একটা প্রবাদ আছে, কি জানি সত্যি নাকি! বলিয়া হাসিতে লাগিল।
পরকাল-সম্বন্ধীয় প্রসঙ্গে কেদারবাবু চিন্তাযুক্ত মুখে কিছুক্ষণ স্থিরভাবে থাকিয়া সহসা বলিয়া উঠিলেন, তা সে যাই হোক, এ কয়দিন দেখে দেখে আমার নিশ্চয় বিশ্বাস হয়েছে, এ মেয়ে স্ত্রীলোকের মধ্যে অমূল্য রত্ন। একে সারাজীবন এমন জীবন্মৃত করে রাখা শুধু পাপ নয়, মহাপাপ। ও আমার মেয়ে হলে আমি কোনমতেই নিশ্চেষ্ট থাকতে পারতুম না।
সুরেশ আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি করতেন?

বৃদ্ধ উদ্দীপ্তস্বরে বলিলেন, আমি আবার বিবাহ দিতুম। একটা বুড়োর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ওর ওই উনিশ-কুড়ি বছর বয়সে যারা ওকে সন্ন্যাসিনী সাজিয়েছে, তারা ওর মিত্র নয়, ওর শত্রু। শত্রুর কার্যকে আমি কোনমতেই ন্যায়সঙ্গত বলে স্বীকার করে নিতুম না।
একটু মৌন থাকিয়া পুনরায় কহিতে লাগিলেন, তাছাড়া ওর স্বামীর ব্যবহারটাই একবার মনে করে দেখ দিকি সুরেশ। সে লোকটার দু-দুটো স্ত্রী গত হতে পঞ্চাশ বছর বয়সে যখন এমন মেয়েকে বিবাহ করতে রাজি হলো তখন নিজের সুখ-সুবিধে ভিন্ন স্ত্রীর ভবিষ্যতের দিকে পাষণ্ড কতটুকু দৃষ্টিপাত করেছিল, কল্পনা কর দেখি।
সুরেশকে নিরুত্তর দেখিয়া বৃদ্ধ অধিকতর উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন। কহিলেন, না সুরেশ, আমি বিধবা-বিবাহের ভালমন্দ তর্ক তুলচি নে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তোমার সমস্ত হিন্দুসমাজ চিৎকার করে ম’লেও আমি মানবো না, এই ব্যবস্থাই ওই দুধের মেয়েটার পক্ষে চরম শ্রেয়ঃ। ওর এমন এতটুকু কিছু নেই, যার মুখ চেয়ে ও একটা দিন কাটাতে পারে। সমস্ত জীবনটা কি তোমরা খেলার জিনিস পেয়েছ সুরেশ, যে ব্রহ্মচর্য ব্রহ্মচর্য করে চেঁচালেই সারা দুনিয়াটা ওর জন্যেই রাতারাতি বদলে ঋষির তপোবন হয়ে উঠবে! মেয়েটার শুধু কাপড়-চোপড়ের পানে চাইলে আমার বুক যেন ফেটে যেতে থাকে।
সুরেশ জবাব দিল না, মুখ তুলিয়াও চাহিল না; কিন্তু চোখের কোণে দেখিতে পাইল যে, চৌকাঠে ভর দিয়া অচলা এতক্ষণ পর্যন্ত মূর্তির মত দাঁড়াইয়াছিল—সেখানে আর সে নাই, কখন নিঃশব্দে ঘরের ভিতরে চলিয়া গেছে।
মৃণাল চলিয়া গেলে, অচলা যখনই সুরেশের মুখের দিকেই দিকে চাহিয়া দেখে, তখনই তাহার মনে হয়, সে বিমনা হইয়া আছে এবং কিসের শোক যেন তাহাকে নিরন্তর শুষ্ক করিয়া ফেলিতেছে।
দুই দিন পরে একদিন অপরাহ্ণে সুরেশ নীচের বারান্দার একধারে রৌদ্রের মধ্যে আরাম-কেদারাটা টানিয়া লইয়া কি একখানা বই পড়িতেছিল, পদশব্দে চাহিয়া দেখিল, তাহারই জন্য চা লইয়া অচলা নিজে আসিতেছে। এরূপ ঘটনা পূর্বে কোনদিন ঘটে নাই; তাই সে আশ্চর্য হইয়া সোজা উঠিয়া বসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বেয়ারা কৈ? আজ তুমি যে!
অচলা এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়াই একটা ছোট টিপয় চেয়ারের পাশে টানিয়া চায়ের বাটি নামাইয়া রাখিল এবং আর একখানা চেয়ার টানিয়া লইয়া নিজেও বসিয়া পড়িল।
এই অভিনব আচরণে তাহাকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করিতে আর সুরেশের সাহস হইল না। শুধু চায়ের পেয়ালাটা নীরবে হাতে তুলিয়া লইল।
কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে বসিয়া থাকিয়া অচলা মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা, সুরেশবাবু, আপনি কি বিধবা-বিবাহ কোন ক্ষেত্রেই ভাল বলে মনে করেন না?
সুরেশ চায়ের বাটি হইতে মুখ না তুলিয়াই জবাব দিল, করি। তার কারণ, কুসংস্কার আজও আমার অতদূর পর্যন্ত পৌঁছয় নি।
অচলা চিন্তা করিবার নিজেকে আর মুহূর্ত অবসর না দিয়া বলিল, তাহলে মৃণালের মত মেয়েকে বিবাহ করতে আপনার ত লেশমাত্র আপত্তি থাকা উচিত নয়।

সুরেশ চায়ের বাটিটা হাতে করিয়া শক্ত হইয়া বসিয়া বলিল, এ কথার মানে?
অচলার মুখে বা কণ্ঠস্বরে কোনরূপ উত্তেজনা প্রকাশ পাইল না। বেশ সহজভাবে বলিল, আপনার কাছে আমি অসংখ্য ঋণে ঋণী। তা ছাড়া আমি আপনার হিতাকাঙিক্ষণী। আপনাকে আমি সুষ্ঠু, সহজ, সংসারী এবং স্বাভাবিক দেখতে চাই। একদিন আপনি বিবাহ করতে প্রস্তুত ছিলেন, আজ আমার একান্ত অনুরোধ, আপনি স্বীকার করুন।
এক নিশ্বাসে মুখস্থর মত এতগুলা কথা বলিয়া অচলা যেন হাঁপাইতে লাগিল।
সুরেশ পাথরে-গড়া মূর্তির মত অনেকক্ষণ স্থির হইয়া বসিয়া থাকিয়া শেষে কহিল, এতে তুমি কি সত্যই সুখী হবে?
অচলা কহিল, হাঁ।
সে রাজি হবে?
তাই ত আমার বিশ্বাস।
সুরেশ একটুখানি ম্লান হাসিয়া বলিল, আমার বিশ্বাস তা নয়। বইয়ে পড়েছ ত সহমরণের দিনে কোন কোন সতী হাসতে হাসতে পুড়ে মরত। মৃণাল তাদেরই জাত। এদের মুখের কথায় সম্মত করানো ত ঢের দূরের কথা, একটা একটা করে হাত-পা কাটতে থাকেলেও একে আর একবার বিয়ে করতে রাজী করানো যাবে না। এ অসাধ্য-সাধনের চেষ্টা করে মাঝ থেকে আমাকে তার কাছে মাটি করে দিও না অচলা। আমাকে সে দাদা বলে ডেকেছে, তার কাছে আমি সম্মানটুকু বজায় রাখতে চাই।
দেখিতে দেখিতে অচলার সমস্ত মুখ ক্রোধে কালো হইয়া উঠিল। সুরেশের কথা শেষ হইতেই কঠিন মৃদুকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, সংসারে শুধু মৃণালই একমাত্র সতী নয় সুরেশবাবু এমন সতীও আছে, যারা মনে মনেও একবার কাউকে স্বামিত্বে বরণ করলে, সহস্র কোটি প্রলোভনেও আর তাদের নড়ানো যায় না। এদের কথা আপনি ছাপার বইয়ে পড়তে না পেলেও সত্যি বলে জেনে রাখবেন সুরেশবাবু! বলিয়া স্তম্ভিত অভিভূত সুরেশের প্রতি দৃক্‌পাতমাত্র না করিয়াই এ গর্বিতা রমণী দৃঢ়-পদক্ষেপে ঘর ছাড়িয়া বাহিরে গেল।
পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ
একজনের উচ্ছ্বসিত অকপট প্রশংসার মধ্যে যে আর একজনের কত বড় সুকঠোর আঘাত ও অপমান লুকাইয়া থাকিতে পারে, বক্তা ও শ্রোতা উভয়ের কেহই বোধ করি তাহা মুহূর্তকাল পূর্বেও জানিত না। সুরেশ হাতের বাটি হাতে লইয়া আড়ষ্ট হইয়া বসিয়া রহিল, এবং অচলা তাহার ঘরে ঢুকিয়া নিঃশব্দে দ্বার রুদ্ধ করিয়া বালিশে মুখ গুঁজিয়া মর্মান্তিক ক্রন্দনের দুর্নিবার বেগ রোধ করিতে লাগিল,—পাশেই মহিমের ঘর, পাছে বিন্দুমাত্র শব্দও তাহার কানে গিয়া পৌঁছে। বস্তুতঃ অন্তর্যামী ভিন্ন সে কান্নার ইতিহাস আর দ্বিতীয় ব্যক্তি জানিল না।
কিন্তু সে নিজে এই গভীর দুঃখের মধ্যে এক নূতন তত্ত্ব লাভ করিল। এই নারী-জীবনের সতীত্ব যে কতবড় সম্পদ, এতদিন পরে তাহার পরিপূর্ণ মহিমা আজই প্রথম যেন তাহার চোখের সম্মুখে সম্পূর্ণ উদ্ঘাটিত হইয়া দেখা দিল। সেদিন সুরেশের সংস্পর্শে পিতার সন্দিগ্ধ দৃষ্টিকে সে অন্যায় উপদ্রব মনে করিয়া যৎপরোনাস্তি ক্রুদ্ধ ও ব্যথিত হইয়াছিল, কিন্তু আজ অকস্মাৎ সেই ধর্মহীন পরস্ত্রীলুব্ধ সুরেশকেই যখন সতীত্বের পাদপদ্মে অমন করিয়া মাথা পাতিয়া প্রণাম করিতে দেখিল, তখন নিজের সত্যকার স্থানটাও আর তাহার দৃষ্টির অগোচর রহিল না।
আরও একটা জিনিস। সুস্পষ্ট বাক্যের শক্তি যে কত বৃহৎ, আজ এ সত্যও সে প্রথম উপলব্ধি করিল। সে শিক্ষিতা রমণী। স্বামীর প্রতি কায়মন-নিষ্ঠাই যে সতীত্ব, এ কথা তাহার অবিদিত ছিল না। শুধু দেহ বা শুধু মন কোনটাই যে একাকী সম্পূর্ণ নয়, ইহা সে ভাল করিয়াই জানিত। তথাপি মন যখন তাহার বিচলিত হইয়াছে, স্বামীকে ভালবাসে না, জিহ্বা যখন এ কথা উচ্চরবে ঘোষণা করিতেও সঙ্কোচ মানে নাই, তখনও কিন্তু কোনদিন তাহার আপনাকে ছোট বলিয়া মনে হয় নাই। কিন্তু আজ যখন সুরেশের মুখের সুস্পষ্ট বাণী না জানিয়া তাহার নামের সঙ্গে অসতী শব্দটা যোগ করিয়া দিতে চাহিল, তখনই তাহার সমস্ত অন্তরাত্মা যেন এক বুক-ফাটা বেদনার আর্তস্বরে চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল।
তাই বলিয়া মৃণালের প্রতি যে তাহার শ্রদ্ধা বাড়িল, তাহা নহে; কিন্তু এই মেয়েটির প্রসঙ্গে যে চৈতন্য আজ লাভ করিল, ইহা সে জীবনে কখনও বিস্মৃত হইবে না, ইহা আপনার কাছে আপনি বার বার প্রতিজ্ঞা করিতে লাগিল।
বাহিরে পিতার লাঠির আওয়াজ এবং পিছনে সুরেশের পদশব্দ শুনিতে পাইল। বুঝিল, তাঁহারা মহিমকে দেখিতে চলিয়াছেন, এবং অল্পকাল পরেই পিতার কণ্ঠস্বরে তাহার আহ্বান শুনিয়া সে বেশ করিয়া আঁচলে চোখ-মুখ মুছিয়া দ্বার খুলিয়া ও-ঘরে গিয়া উপস্থিত হইল।
কেদারবাবু তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া ব্যস্তভাবে বলিয়া উঠিলেন, আজ ব্যাপার কি? দুটোর সময় সুরুয়া দেবার কথা, চারটে বাজে যে! ও কি, চোখ-মুখ অমন ভারী কেন? ঘুমুচ্ছিলে না কি?
অচলা উত্তর না দিয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিল। রোগীকে সুরুয়া দিবার ব্যবস্থা হইবার পরে এই কাজটা মৃণালই করিত। চাকর চড়াইয়া দিত, সে আন্দাজ করিয়া যথাসময়ে নামাইয়া লইত। সে চলিয়া গেলে এ ভারটা অচলার উপরেই পড়িয়াছিল। আজ সে কথা তাহার মনেই ছিল না। ছুটিয়া গিয়া দেখিল, আগুন বহুক্ষণ নিবিয়া গিয়াছে এবং সমস্তটা শুকাইয়া পুড়িয়া রহিয়াছে।

বহুক্ষণ সেইখানে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া যখন সে ফিরিয়া আসিল, তখন কেদারবাবু এ কথা শুনিয়া অচলাকে কিছুই না বলিয়া শুধু সুরেশকে লক্ষ্য করিয়া কঠিনভাবে বলিলেন, তখনি ত তোমাকে বলেছিলুম সুরেশ, এখন একজন ভাল নার্স না রাখলে মহিমকে বাঁচাতে পারবে না। নিজের মেয়েকে কি আমার চেয়ে তোমরা বেশি বোঝো?
সুরেশ নিরুত্তরে বসিয়া রহিল। কিন্তু মহিম যে এতক্ষণ নিঃশব্দে স্ত্রীর লজ্জিত ম্লান মুখখানির প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া ছিল, তাহা কেহই দেখে নাই। সে এখন ধীরে ধীরে কহিল, নার্সের হাতে আমার ওষুধ পর্যন্ত খেতে প্রবৃত্তি হবে না সুরেশ। তবে ওঁকে সাহায্য করবার একজন লোক দাও। কাল-পরশু দুটো রাত্রিই ওঁকে সারারাত্রি জাগতে হয়েছে। দিনের বেলায় একটু বিশ্রামের অবকাশ না পেলে কলের মানুষকে দিয়েও কাজ পাবে না ভাই।
কথাটা বর্ণে বর্ণে সত্য না হইলেও মিথ্যা নয়। সুরেশ খুশী হইয়া মুখ তুলিল, কিন্তু কেদারবাবু নিজের রূঢ়বাক্যে লজ্জা পাইয়া কোন-কিছু একটা বলিবার উদ্যোগ করিতেই অচলা ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
রাত্রে তাহার অনেকবার ইচ্ছা করিতে লাগিল, রুগ্ন স্বামীর কাছে বহু অপরাধের জন্য কাঁদিয়া ক্ষমা ভিক্ষা চাহিয়া একবার জিজ্ঞাসা করে, তাহার মত পাপিষ্ঠাকে তিরস্কার হইতে বাঁচাইবার জন্য তাঁহার কি মাথাব্যথা পড়িয়াছিল! কিন্তু নিদারুণ লজ্জায় কোনমতেই এ প্রশ্ন তাহার মুখ দিয়া বাহির হইতে চাহিল না।
সুরেশের একটা কাজ ছিল, প্রতিদিন অনেক রাত্রে সে একবার করিয়া মহিমের ঘরে ঢুকিয়া প্রয়োজনীয় সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া দিয়া তবে শুইতে যাইত। মৃণাল থাকিতে সে প্রায় সারারাত্রিই আনাগোনা করিত, এবং তাহার আবশ্যকও ছিল; কিন্তু কয়দিন হইতে দেখা গেল, সে সহজে আর ঘরে প্রবেশ করে না। প্রয়োজন হইলে দাসী পাঠাইয়া খবর লয়, শুধু সন্ধ্যার প্রাক্কালে ক্ষণকালের জন্য একটিবার মাত্র নিজে আসিয়া সংবাদ গ্রহণ করে। তাহার এই নূতন আচরণ সকলের অগ্রে অচলারই দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল; কিন্তু এ বিষয়ে সামান্য একটু মন্তব্য প্রকাশ করাও তাহার পক্ষে সম্ভবপর নহে, তাই সে মৌন হইয়াই ছিল; কিন্তু যেদিন মহিম নিজে ইহার উল্লেখ করিল, তখন তাহাকে বলিতেই হইল, আজকাল তিনি অধিকাংশ সময় বাটীতেও থাকেন না এবং ইহার হেতু কি, তাহাও সে জানে না। মহিম চুপ করিয়া শুনিল, কোনপ্রকার মতামত প্রকাশ করিল না।
পরদিন সকালে অচলা নীচে নামিতেছিল, এবং সুরেশও কি একটা কাজে এই সিঁড়ি দিয়াই উপরে উঠিতেছিল; মুখ তুলিয়া অচলাকে দেখিবামাত্রই অন্যদিকে সরিয়া গেল। সে যে সর্বপ্রকারে তাহাকেই পরিহার করিয়া চলিতেছে, এ বিষয়ে আর তাহার সংশয়মাত্র রহিল না; এবং একদিন যাহা সে সমস্ত মন দিয়া কামনা করিয়াছিল, আজ তাহার সেই মনই সুরেশের আচরণে বেদনায় পীড়িত হইয়া উঠিল।



একবিংশ পরিচ্ছেদ
তখনও কেদারবাবু আগেকার স্বাস্থ্য ফিরিয়া পান নাই। খাওয়া-দাওয়ার পরে আসিয়া বারান্দায় একখানা ইজি-চেয়ারে পড়িয়া খবরের কাগজ পড়িতে পড়িতে হয়ত একটু তন্দ্রাভিভূত হইয়াছিলেন, দরজায় ঠিকা গাড়ির কঠোর শব্দে চোখ মেলিয়া দেখিলেন, সুরেশ এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাঁহার কন্যা ও ঝি অবতরণ করিল। ঘুমের ঝোঁক তাঁহার নিমিষে উড়িয়া গেল; কি একটা অজ্ঞাত শঙ্কায় শশব্যস্তে উঠিয়া পড়িয়া গলা বাড়াইয়া চিৎকার করিলেন, অচলা যে? সুরেশ, তুমি কোথা থেকে? কি, ব্যাপার কি? এ-সব কি কাণ্ড-কারখানা, আমি ত কিছু বুঝতে পারিনে!
অচলা উঠিয়া আসিয়া পিতার পদধূলি গ্রহণ করিল। সুরেশ প্রণাম করিয়া কহিল, মহিমের টেলিগ্রাফ পাননি?
কেদারবাবু উদ্বিগ্নমুখে কহিলেন, কৈ, না!
সুরেশ একখানা চৌকি টানিয়া লইয়া উপবেশন করিয়া বলিল, তা হলে হয় সে টেলিগ্রাফ করতে ভুলেছে, না হয় এখনো এসে পৌঁছায় নি।
কেদারবাবু কহিলেন, টেলিগ্রাফ যাক, ব্যাপার কি, তাই আগে বল না! তুমি এদের কোথা থেকে নিয়ে এলে?
সুরেশ বলিল, কাল রাত্রিতে আগুন লেগে মহিমের বাড়ি পুড়ে গেছে।
বাড়ি পুড়ে গেছে? সর্বনাশ! বল কি—বাড়ি পুড়ে গেল? কেমন করে পুড়ল? মহিম কৈ? তুমি এদের পেলে কোথায়? এক নিশ্বাসে এতগুলা প্রশ্ন করিয়া কেদারবাবু ধপ্‌ করিয়া তাঁহার ইজি-চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন।
সুরেশ বলিল, এদের সেখান থেকেই নিয়ে আসচি। আমি সেখানেই ছিলাম কিনা।
কেদারবাবুর মুখ অত্যন্ত অপ্রসন্ন এবং গম্ভীর হইয়া উঠিল, কহিলেন, তুমি ছিলে সেখানে? কবে গেলে, আমি ত কিছু জানিনে। কিন্তু সে কৈ?
সুরেশ বলিল, মহিম ত আসতে পারছে না, তাই—
তাঁহার গম্ভীর মুখ অন্ধকার হইয়া উঠিল। মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না না, এ-সব ভাল কথা নয়। অতিশয় মন্দ কথা। যৎপরোনাস্তি অন্যায়। এ-সব ত আমি কোনমতেই—, বলিতে বলিতে তিনি চোখ তুলিয়া কন্যার মুখের প্রতি চাহিলেন।
অচলা এতক্ষণ একটা চেয়ারের পিঠে হাত রাখিয়া নীরবে দাঁড়াইয়া ছিল। পিতার এই সংশয় তাহার মর্মে গিয়া বিঁধিল। তাহার এই অকস্মাৎ আগমনের হেতু যে তিনি লেশমাত্র বিশ্বাস করেন নাই, তাহা সুস্পষ্ট উপলব্ধি করিয়া লজ্জায় ঘৃণায় তাহার মুখে আর রক্তের চিহ্ন রহিল না।
কেদারবাবু এখানে ভুল করিলেন। মেয়ের মুখের চেহারায় তাঁহার সন্দেহ দৃঢ়ীভূত হইল। আরাম-চেয়ারটায় হেলিয়া পড়িয়া হাতের কাগজখানা মুখের উপরে টানিয়া নিয়া ফোঁস করিয়া একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, যা ভাল বোঝ তোমরা কর। আমি কালই বাড়ি ছেড়ে আর কোথাও চলে যাবো।
সুরেশ ক্রুদ্ধ-বিস্ময়ের সহিত কহিল, এ-সব আপনি কি বলচেন কেদারবাবু? আপনি বা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবেন কেন, আর হয়েছেই বা কি? বলিয়া সে একবার অচলার প্রতি একবার তাহার পিতার প্রতি চাহিতে লাগিল; কিন্তু কাহারও মুখ তাহার দৃষ্টিগোচর হইল না।
কেদারবাবুর কাছে কোন জবাব না পাইয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, যাক, আমার ওপর মহিম যা ভার দিয়েছিল তা হয়ে গিয়েছে। এখন আপনারা যা ভাল বোঝেন করুন। আমার নাওয়া-খাওয়া এখনো হয়নি, আমি বাড়ি চললুম। বলিয়া সে কয়েক পদ দ্বারের অভিমুখে অগ্রসর হইতেই কেদারবাবু উঠিয়া বসিয়া ক্লান্তকণ্ঠে কহিলেন, আহা, যাও কেন ছাই।ব্যাপারটা কি, তবু শুনিই না। আগুন লাগল কি করে?

সুরেশ অভিমান-ভরে বলিল, তা জানিনে।
তুমি গেলে কবে সেখানে?
দিন পাঁচ-ছয় পূর্বে। আমি খাইনি এখনো, আর দেরি করতে পারিনে, বলিয়া পুনরায় চলিবার উপক্রম করিতেই কেদারবাবু বলিয়া উঠিলেন, আহা-হা, নাওয়া-খাওয়া ত তোমাদের কারও হয়নি দেখচি, কিন্তু জলে পড়নি এটাও ত বাড়ি, এখানেও ত চাকরবাকর আছে। অচলা, ডাকো না একবার বেয়ারাটাকে—দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বোস, বোস, সুরেশ, ব্যাপারটা কি হলো, খুলেই সব বল শুনি।
সুরেশ ফিরিয়া আসিয়া বসিল। একটু চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, রাত্রে ঘুমুচ্চি, মহিমের চিৎকারে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে দেখি, সমস্ত ধুধু করে জ্বলছে; খড়ের ঘর, নিবোবার উপায়ও ছিল না, সে বৃথা চেষ্টাও কেউ করলে না—সর্বস্ব পুড়ে গেল আর কি!
কেদারবাবু লাফাইয়া উঠিয়া বলিলেন, বল কি হে, সর্বস্ব পুড়ে গেল? কিছুই বাঁচাতে পারা গেল না? অচলার গয়নাপত্রগুলো?
সেগুলো বেঁচেচে।
তবু রক্ষে হোক! বলিয়া বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া আবার চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন। খানিকক্ষণ স্তব্ধভাবে বসিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তবু, কি করে আগুনটা লাগল?
সুরেশ কহিল, বললুম ত আপনাকে, সে খবর এখনো জানা যায়নি। তবে গ্রামের মধ্যে বড় কেউ আর তার শুভাকাঙ্ক্ষী নেই, তা জেনে এসেছি।
নেই বুঝি?
না।
কেদারবাবু আর কোন কথা কহিলেন না। অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া বসিয়া থাকিয়া পরিশেষে আর একটা গভীর নিঃশ্বাস মোচন করিয়া, উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, যাও, স্নান করে এসো গে সুরেশ, আর বেলা করো না। দেখি, রান্না-বান্নার কি যোগাড় হচ্ছে। বলিয়া তাহাকে সঙ্গে করিয়া বাহির হইয়া গেলেন।
আহারাদির পরেও তিনি সুরেশকে মুক্তি দেন নাই। সে একটা আরাম-চৌকির উপরে অর্ধনিদ্রিতাবস্থায় পড়িয়া ছিল। অচলাও সেই যে স্নানান্তে তাহার ঘরে গিয়া খিল দিয়াছিল, আর তাহার কোন সাড়াশব্দ ছিল না। বিশ্রাম ছিল না শুধু কেদারবাবুর। এখন যে টেলিগ্রাম আসা না আসার বিশেষ কোন সার্থকতা ছিল না, তাহারই জন্য সমস্ত বেলাটা ছটফট করিয়া, সন্ধ্যার সময় অসময়ে ঘুমানো উচিত নয়, এই অজুহাতে মেয়েকে ডাকাইয়া পাঠাইয়া, প্রথমেই বলিয়া উঠিলেন, তোমরা যে বললে, সে টেলিগ্রাম করেচে—কৈ তার ত কিছুই দেখিনে। তোমরা ট্রেনেতে এসে পড়লে, আর তারের খবর এতক্ষণেও পৌঁছল না। আচ্ছা, দাঁড়াও ত দেখি, বলিয়া মেয়ের মুখের জবাব না শুনিয়াই চটিজুতা ফটফট করিতে করিতে দ্রুতবেগে বাহির হইয়া গেলেন এবং ক্ষণকাল পরেই নীচে হইতে তাঁহার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর স্পষ্ট শুনা যাইতে লাগিল। অচলার দাসীকে ধরিয়া তিনি নানাপ্রকারে জেরা করিতেছেন, এবং প্রত্যুত্তরে সে আশ্চর্য হইয়া বারংবার প্রতিবাদ করিয়া বলিতেছে, সে কি বাবু, আগুন লেগে ঘরদোর সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল, চক্ষে দেখে এলুম, আর আপনি বলছেন, পোড়েনি! আর আগুন যদি না-ই লাগবে, তবে ঘরদোর পুড়ে ভস্ম হয়ে গেল কি করে, একবার বিবেচনা করে দেখুন দেখি!
সুরেশ সমস্তই শুনিতেছিল; সে মাথা তুলিয়া দেখিল, অচলা চৌকাঠ ধরিয়া দাঁড়াইয়া পাংশু-মুখে কান পাতিয়া প্রত্যেক কথাটি গিলিতেছে। শুষ্ক উপহাসের ভঙ্গিতে কহিল, তোমার বাবার হল কি, বলতে পারো?

অচলা চমকিয়া মুখ ফিরাইয়া বলিল, না।
সুরেশ কহিল, আমি নিশ্চয়ই বলতে পারি উনি বিশ্বাস করেন নি। ওঁর ধারণা, আগুন লাগার গল্পটা আমাদের আগাগোড়া বানানো। একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, সত্যি-মিথ্যে একদিন টের পাবেনই, কিন্তু ওঁর সন্দেহটা এমন যে, এখানে আসা আমার পক্ষে একেবারে অসম্ভব হয়ে উঠেচে।
অচলা শুষ্কমুখে জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি আর আসবেন না?
সুরেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, বোধ করি সম্ভব নয়। আমারও ত কিছু আত্মসম্মান বোধ আছে। কোন লোককে দিয়ে আমার ব্যাগটা বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ো।
অচলা ঘাড় নাড়িয়া বলিল, আচ্ছা। কিন্তু তাহার এখানে আসা না-আসার সম্বন্ধে কোন কথা কহিল না।
তা হলে কাল সকালেই দিয়ো। অনেক দরকারী জিনিস আমার ওর মধ্যে আছে, বলিয়া সে কেদারবাবুর জন্যে অপেক্ষা না করিয়াই বাহির হইয়া গেল।
কেদারবাবু ফিরিয়া আসিয়া কিছু আশ্চর্য হইলেন বটে, কিন্তু মনে মনে যে অপ্রসন্ন হইয়াছেন, তাহা বোধ হইল না।
রাত্রে বহুক্ষণ পর্যন্ত শয্যার উপর ছটফট করিয়া অচলা উঠিয়া পড়িল। তাহার ইচ্ছা, বাহিরে বারান্দায় দাঁড়াইয়া সম্মুখের রাজপথের উপর লোকচলাচলের প্রতি চাহিয়া কিছুক্ষণের জন্যেও অন্যমনস্ক হয়।
তাহার ঘরের ও-দিকের কবাট খুলিয়া সে বারান্দায় আসিয়া দেখিল, তখনও বসিবার ঘরে আলো জ্বলিতেছে। প্রথমে মনে করিল, চাকরেরা গ্যাস বন্ধ করিতে ভুলিয়া গিয়াছে। কিন্তু কয়েক পদ অগ্রসর হইতেই ভিতর হইতে তাহার পিতার কণ্ঠস্বর কানে আসিতে তাহার বিস্ময়ের পরিসীমা রহিল না। চিরদিন তিনি দশটা বাজিতে না বাজিতেই শয্যা গ্রহণ করেন; কিন্তু আজ সাড়ে দশটা বাজিয়া গিয়াছে। পরক্ষণেই দাসীর গলা শুনা গেল। সে বলিতেছে, এখন সোয়ামী মারা গেছে—আর যে মৃণাল-দিদিমণি শ্বশুরঘর করে, এমন ত আমার মনে হয় না বাবু। জামাইবাবুর সঙ্গে কি যে দাদা-নাতনী সুবাদ, তা তেনারাই জানে।
প্রত্যুত্তরে কেদারবাবু শুধু হুঁ বলিয়াই চুপ করিয়া রহিলেন।
অচলা বুঝিল, ইতিপূর্বে অনেক কথাই হইয়া গিয়াছে। মৃণালের সম্বন্ধে, মহিমের সম্বন্ধে, তাহার সম্বন্ধে—কিছুই বাদ যায় নাই। কিন্তু পাছে নিজের সম্বন্ধে নিরতিশয় অপ্রিয় কথা নিজের কানেই শুনিতে হয়, এই ভয়ে সে যেমন নিঃশব্দে আসিয়াছিল, তেমনই নীরবে ফিরিয়া যাইতে চাহিল; কিন্তু কিসে যেন তাহার পা লোহার শিকলে বাঁধিয়া দিয়া গেল।
কেদারবাবু অল্পক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া প্রশ্ন করিলেন, দু’জনের তা হলে বনিবনাও হয়নি বল?

ঝি কহিল, মোটে না বাবু, মোটে না। একটি দিনের তরে না।
এই দাসীটিকে অচলা নির্বোধ বলিয়াই এতদিন জানিত; আজ দেখিল, বুদ্ধি তাহার কাহারো অপেক্ষা কম নয়।
কেদারবাবু আবার মিনিট-খানেক মৌন থাকিয়া বলিলেন, কাল রাতে তা হলে কারও খাওয়া হয়নি বল? সুরেশ যাওয়া পর্যন্তই একরকম ঝগড়াঝাঁটিতেই দিন কাটছিল?
দাসীর উত্তর শুনা গেল না বটে, কিন্তু পিতার মুখের মন্তব্য শুনিয়াই বুঝা গেল, সে গ্রীবা আন্দোলনের দ্বারা কিরূপ অভিমত ব্যক্ত করিল। কারণ, পরক্ষণেই কেদারবাবু একটা গভীর নিশ্বাস মোচন করিয়া বলিলেন, এমনটি যে একদিন ঘটবে, আমি আগেই জানতুম। আজকালকার ছেলেমেয়েরা ত বাপ-মায়ের কথা গ্রাহ্য করে না; নইলে আমি ত সমস্তই একরকম ঠিক করে এনেছিলুম। আজ তা হলে ওর ভাবনা কি! বলিয়া আর একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিলেন, তাহাও স্পষ্ট শুনিতে পাওয়া গেল।
ঝি পূর্ণ সহানুভূতির সহিত প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কহিল, তাই বলুন ত বাবু, নইলে আজ ভাবনা কি! কোন্‌ অজ পাড়াগাঁয়ে কিনা একটা খোড়ো মেটে বাড়ি! তাও রইল কৈ? আজ জামাইবাবুও ত—, বলিয়া সেও কথাটাকে শেষ না করিয়াও একটা দীর্ঘশ্বাসের দ্বারা অনেকদূর পর্যন্ত ঠেলিয়া দিল।
কপাল! বলিয়া কেদারবাবু মিনিট-দুই নিঃশব্দে থাকিয়া, উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, আচ্ছা, তুই যা; বলিয়া তাহাকে বিদায় দিয়া আলো নিবাইবার জন্য বেয়ারাকে ডাকাডাকি করিতে লাগিলেন।
অচলা পা টিপিয়া আস্তে আস্তে তাহার ঘরে আসিয়া বিছানায় শুইয়া পড়িল। পিতার উদারতা, তাঁহার ভদ্রতাবোধের ধারণা কোনদিনই তাহার মনের মধ্যে খুব উচ্চ অঙ্গের ছিল না, কিন্তু সে যে বাটীর দাসীর সহিত নিভৃতে আলোচনা করিবার মত এত ক্ষুদ্র, ইহাও সে কখনও ভাবিতে পারিত না। আজ তাহার নিজের মন ছোট হইয়া মাটিতে লুটাইতেছে—কিন্তু তাহার স্বামী, তাহার পিতা, তাহার দাসী, তাহার বন্ধু—সবাই যখন তাহারই মত ভূমিতলে পড়িয়া, তখন কাহাকেও অবলম্বন করিয়া কোনদিন যে সে এই ধূলিশয্যা হইতে উঠিয়া দাঁড়াইতে পারিবে, এ ভরসা সে কল্পনা করিতেও পারিল না।





দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
কেদারবাবু সংসারে সাধারণ দশজনের মত দোষে-গুণে মানুষ। মেয়ের বিবাহে জামাই যাহাতে পাস-করা হয়, অবস্থাপন্ন হয়, এই কামনাই করিয়াছিলেন। মহিম ভাল ছেলে, সে এম. এ. পাস করিয়াছে, দেশে তাহার অন্নবস্ত্রের সংস্থান আছে, অতএব তাহার হাতে কন্যা সম্প্রদান করিতে তিনি সৌভাগ্য বলিয়াই গণ্য করিয়াছিলেন। কিন্তু অকস্মাৎ তাহার ধনাঢ্য বন্ধু সুরেশ যখন একদিন তাহার গাড়ি করিয়া আসিয়া একটা উলটা রকমের খবর দিয়া নিজেই জামাইগিরির উমেদার খাড়া হইল, তখন উভয় বন্ধুর মধ্যে আর্থিক সঙ্গতির হিসাব করিয়া মহিমকে বরখাস্ত করিতে কেদারবাবুর মনের মধ্যে কোন আপত্তিই উঠিল না। তিনি ভালবাসার সূক্ষ্মতত্ত্বের বড় একটা ধার ধারিতেন না। তাঁহার বিশ্বাস ছিল, মেয়েমানুষে যাহার কাছে গাড়িপালকি চড়িয়া বস্ত্রালঙ্কার পরিয়া সুখে-স্বচ্ছন্দে থাকিতে পায়, স্বামী হিসাবে তাহাকেই সকলের শ্রেষ্ঠ বলিয়া গণ্য করে। সুতরাং মেয়েকে সুখী করাই যদি পিতার কর্তব্য হয় ত এত বড় অযাচিত সুযোগ কোনমতেই যে হাতছাড়া করা উচিত নয়, ইহা স্থির করিতে তাঁহাকে অত্যন্ত বেশি চিন্তা করিতে হয় নাই।
এমন কি, বড়লোক জামাতার কাছে কর্জ করিয়া বিবাহের পূর্বেই হাজার-পাঁচেক টাকা লওয়াও তিনি দোষের মনে করেন নাই; এবং বাড়িটা যখন তাহার থাকিবে, তখন পরিশোধের দুশ্চিন্তাও তাঁহাকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলে নাই।
অথচ হতভাগা মেয়েটা সমস্ত পণ্ড করিয়া দিল—কিছুতেই বাগ মানিল না। অতএব শেষ পর্যন্ত সেই মহিমের হাতেই তাঁহাকে মেয়ে দিতে হইল বটে, কিন্তু এই দুর্ঘটনায় তাঁহার ক্ষোভের অবধি রহিল না। তা ছাড়া, যে কথাটা এখন তাঁহাকে নিজের কাছে নিজে স্বীকার করিতে হইল তাহা এই যে, টাকাটা এইবার ফিরাইয়া দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু জিনিসটা লেখাপড়ার মধ্যে না থাকায় এবং পরিশোধের রাস্তাটাও খুব সুস্পষ্ট ও প্রাঞ্জল হইয়া চোখে না পড়ায়, ইহার চিন্তাটাকেও তিনি হৃদয়ের মধ্যে তেমনি উজ্জ্বল করিয়া তুলিতে পারিলেন না। সুতরাং, প্রশ্নটা যদিচ মনের মধ্যে উঠিল বটে, কিন্তু উত্তরটা তেমনি ঝাপসা হইয়া রহিল।
অচলা শ্বশুরবাড়ি চলিয়া গেল। ইহার পরে সুরেশের আসা-যাওয়া, ঘনিষ্ঠতা কেদারবাবু পছন্দ করিতেন না। বাটী নাই অজুহাতে অধিকাংশ সময় দেখাও দিতেন না। কিন্তু তাহাকে ভালবাসিতেন বলিয়া মেয়ের দুর্ব্যবহারে বৃদ্ধ অন্তরের মধ্যে লজ্জিত এবং দুঃখিত হইয়াই রহিলেন।
এইভাবে দিন কাটিতেছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন তিনি অত্যন্ত অসুখে পড়িয়া গেলেন। সুরেশ আসিয়া চিকিৎসা করিয়া এবং নিজে পুত্রাধিক সেবা-যত্ন করিয়া তাঁহাকে আরোগ্য করিয়া তুলিল। তিনি স্বয়ং ঋণের উল্লেখ করিলে, সে তাহা বন্ধুকে যৌতুক দিয়াছে বলিয়া হাসিয়া উড়াইয়া দিল। সেই অবধি এই যুবকটির প্রতি তাঁহার স্নেহ প্রতিদিন গভীর ও অকৃত্রিম হইয়া উঠিতে লাগিল। এমন কি, সময়ে সময়ে কন্যার বিরুদ্ধে তাঁহার মনের মধ্যে অভিশাপের ন্যায় উদয় হইত যে, দুর্ভাগা মেয়েটা এমন রত্ন চিনিল না, উপেক্ষা করিয়া ত্যাগ করিয়া গেল, সে যেন একদিন ইহার শাস্তি ভোগ করে।
এই ব্যাপারে মহিম তাঁহার দু চক্ষের বিষ হইয়া গিয়াছিল সত্য, কিন্তু তাই বলিয়া তাঁহার কন্যা যে নারীধর্ম জলাঞ্জলি দিয়া স্বামীত্যাগের গভীর দুষ্কৃতি সর্বাঙ্গে বহিয়া তাঁহারই গৃহে আসিয়া উঠিবে, ইহা তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নাই; এবং এই মহাপাপে যে ব্যক্তি সাহায্য করিয়াছে, সে যত বড় হউক, পিতার মনের ভাব যে তাহার বিরুদ্ধে কিরূপ বাঁকিয়া দাঁড়াইবে, ইহাও অনুমান করা কঠিন নহে।

অন্যপক্ষে, পিতার প্রতি কন্যার মনোভাব পূর্বে যেমনি থাক, যেদিন তিনি শুধুমাত্র টাকার লোভেই মহিমকে বর্জন করিয়া সুরেশের হাতে তাহাকে সমর্পণ করিতে বদ্ধপরিকর হইয়াছিলেন, এবং পরিশোধের কোন উপায় না থাকা সত্ত্বেও তাহার কাছে ঋণ গ্রহণ করিয়াছিলেন, সেদিন হইতে মানুষ হিসাবে কেদারবাবু অচলার চক্ষে অত্যন্ত নামিয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু সেই অশ্রদ্ধা শতগুণে বাড়িয়া গিয়াছিল কাল রাত্রে, যখন সে স্বকর্ণে শুনিতে পাইল, তিনি নিজের কন্যার চরিত্রের সম্বন্ধে গোপনে দাসীর মতামত গ্রহণ করিতেও সঙ্কোচ বোধ করিলেন না।
কিন্তু সেই সঙ্গে অচলা আজি আপনাকেও দেখিতে পাইল। তাহার সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হইয়া চোখে পড়িল, যে মুহূর্তে সে স্বামীকে নিজের মুখে বলিয়াছে, তাহাকে সে ভালবাসে না, সে মুহূর্তেই নারীর সর্বোত্তম মর্যাদাও জগৎসংসার হইতে তাহার জন্য মুছিয়া গিয়াছে। তাই আজ সে স্বামীর কাছে ছোট, পিতার কাছে ছোট, নিজের পরিচারিকার কাছে ছোট, এমন কি সেই সুরেশের মত লোকের চক্ষেও আজ সে এত ছোট যে তাহাকে লালসার সঙ্গিনী কল্পনা করাও তাহার পক্ষে আর দুরাশা নয়। কিন্তু সত্যই কি সে তাই? এমনি ছোট? এই ত সেদিন সে যাহার ভালবাসাকেই সর্বজয়ী করিতে সমস্ত বিরোধ, সমস্ত প্রলোভন পায়ে দলিয়া উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছিল, আজ ইহারই মধ্যে সে কথা কি সবাই ভুলিয়াছে? তাহাকে সুরেশের সঙ্গে পাঠাইয়া দিয়াও স্বামী তাহার কোন সংবাদ লইলেন না। এই ঔদাসীন্যের নিগূঢ় অপমান ও লাঞ্ছনা তাহাকে সমস্ত রাত্রি যেন আগুন দিয়া পোড়াইতে লাগিল।
সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গিল, তখন বেলা হইয়াছে। তরুণ সূর্যালোক খোলা জানালার ভিতর দিয়া ঘরের মেঝের উপর ছড়াইয়া পড়িয়াছে। সে ধীরে ধীরে শয্যায় উঠিয়া বসিয়া শিয়রের জানালাটা খুলিয়া দিয়া বাহিরের পথের দিকে চাহিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।
কলিকাতার রাজপথে জনপ্রবাহের বিরাম নাই। কেহ কাজে চলিয়াছে, কেহ ঘরে ফিরিতেছে, কেহ-বা প্রভাতের আলোক ও হাওয়ার মধ্যে শুধু শুধু ঘুরিয়া বেড়াইতেছে—চাহিয়া চাহিয়া হঠাৎ এক সময়ে তাহার মনে হইল, এ সময়ে কেহই ত ঘরে বসিয়া নাই, আর আমিই বা যথার্থ কি এমন গুরুতর অপরাধ করিয়াছি, যাহাতে মুখ দেখাইতে পারি না—আপনাকে আপনি আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছি! অপরাধ যদি কিছু করিয়াই থাকি ত সে তাঁর কাছে। সে দণ্ড তিনিই দিবেন; কিন্তু নির্বিচারে যে-কেহ শাস্তি দিতে আসিবে, তাহাই মাথা পাতিয়া লইব কিসের জন্য?
অচলা তৎক্ষণাৎ উঠিয়া দাঁড়াইল এবং সমস্ত গ্লানি যেন জোর করিয়া ঝাড়িয়া ফেলিয়া হাত-মুখ ধুইয়া কাপড় ছাড়িয়া বসিবার ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল।
কেদারবাবু তাঁহার আরাম-কেদারায় বসিয়া খবরের কাগজ পাঠ করিতেছিলেন, একটিবার মাত্র মুখ তুলিয়াই আবার সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় মনঃসংযোগ করিলেন।
খানিক পরেই বেয়ারা কেৎলিতে গরম চায়ের জল এবং অন্যান্য সরঞ্জাম আনিয়া টেবিলের উপর রাখিয়া গেল, কেদারবাবু নিজে উঠিয়া আসিয়া নিজের জন্য এক পেয়ালা চা প্রস্তুত করিয়া লইলেন এবং বাটিটা হাতে করিয়া নিঃশব্দে তাঁহার আরাম-চৌকিতে ফিরিয়া গিয়া খবরের কাগজ লইয়া বসিলেন।

অচলা নতমুখে বসিয়া পিতার আচরণ সমস্ত লক্ষ্য করিল, কিন্তু নিজে যাচিয়া তাঁহার চা তৈরি করিয়া দিতে কিংবা একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে তাহার সাহসও হইল না, ইচ্ছাও করিল না।
কিন্তু ঘরের মধ্যে এমন করিয়া কাঠের মূর্তির মত মুখ বুজিয়া বসিয়া থাকাও অসম্ভব। এমন কি, এইভাবে দীর্ঘকাল এক গৃহের মধ্যেও তাঁহার সহিত বাস করা সম্ভবপর এবং উচিত কিনা এবং না হইলেই বা সে কি উপায় করিবে, এই জটিল সমস্যার কোথাও একটু নিরালায় বসিয়া মীমাংসা করিয়া লইতে যখন সে উঠি-উঠি করিতেছিল, এমন সময়ে দুঃসহ বিস্ময়ে চাহিয়া দেখিল, সুরেশ ঘরে প্রবেশ করিতেছে।
সে হাত তুলিয়া কেদারবাবুকে নমস্কার করিতে তিনি মুখ তুলিয়া মাথাটা একটু নাড়িয়া পুনশ্চ পড়ায় মন দিলেন।
সুরেশ চেয়ার টানিয়া লইয়া বসিল। চায়ের জিনিসগুলা সরাইবার জন্য বেয়ারা ঘরে ঢুকিতেই তাহাকে কহিল, আমার ব্যাগটা কোথায় আছে, আমার গাড়িতে তুলে দাও ত। শেভ করবার জিনিসগুলো পর্যন্ত তার মধ্যে আছে। দেরি করো না, আমি এখ্‌খুনি যাবো।
যে আজ্ঞে বলিয়া সে চলিয়া গেলে আবার সমস্ত কক্ষটা স্তব্ধ হইয়া রহিল। খানিক পরে সুরেশ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল, মহিমের কোন খবর পাওয়া গেল?
কেদারবাবু মুখ তুলিয়াই শুধু বলিলেন, না।
সুরেশ কহিল, আশ্চর্য!
তার পরে আবার সমস্ত চুপচাপ। বেহারা ফিরিয়া আসিয়া জানাইল, ব্যাগ তাঁহার গাড়িতে তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে।
আমি তা হলে চললুম। মহিমের চিঠি এলে আমাকে একটু খবর পাঠাবেন, বলিয়া সুরেশ উঠিবার উপক্রম করিতেই সহসা কেদারবাবু হাতের কাগজখানা মাটিতে ফেলিয়া দিয়া বলিয়া উঠিলেন, তুমি একটু অপেক্ষা কর সুরেশ, আমি আসচি। বলিয়া তাহার মুখের প্রতি দৃষ্টিপাতমাত্র না করিয়াই চটিজুতার পটাপট শব্দ করিয়া একটু দ্রুতবেগেই ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন।
এতক্ষণ অবধি অচলা অধোমুখেই ছিল। তিনি বাহির হইয়া যাইতেই বিস্মিত সুরেশ অকস্মাৎ মুখ ফিরাইতেই তাহার দৃষ্টি অচলার ত্রস্তপীড়িত ও একান্ত মলিন দুই চক্ষুর উপর গিয়া পড়িল। জিজ্ঞাসা করিল, ব্যাপার কি?
অচলা মুখ আনত করিয়া শুধু মাথা নাড়িল।
সুরেশ বলিল, আমি যে কত দুঃখিত, কত লজ্জিত হয়েচি তা বলে জানাতে পারিনে।
অচলা অধোমুখে নীরবে বসিয়া রহিল।
সে পুনশ্চ কহিল, তোমার বাবা যে আমাকে এমন হীন, এত বড় পাষণ্ড ভাবতে পারেন, এ আমি স্বপ্নেও মনে করিনি।
এ অভিযোগেও অচলা কোন উত্তর দিল না, তেমনি স্থির হইয়া বসিয়া রহিল।
সুরেশ বলিল, আমার এমনি ইচ্ছে হচ্ছে যে এখ্‌খুনি মহিমের কাছে গিয়ে তাকে—কথাটা শেষ হইতে পাইল না, কেদারবাবু ফিরিয়া আসিলেন।
তাঁহার হাতে একখানা ছোট কাগজ। সেইখানা সুরেশের সম্মুখে টেবিলের উপর রাখিয়া দিয়া কহিলেন, গড়িমসি করে তোমার সেই টাকাটার একখানা রসিদ দেওয়া আর ঘটে উঠেনি। পাঁচ হাজার টাকার হ্যান্ডনোট লিখেই দিলুম—সুদ বোধ হয় আর দিতে পারব না; তবে এই বাড়িটা ত রইল, এর থেকে আসলটা শোধ হতে পারবেই।
সুরেশ স্তম্ভিতের ন্যায় ক্ষণকাল দাঁড়াইয়া থাকিয়া বলিল, আমি ত আপনার কাছে হ্যান্ডনোট চাইনি কেদারবাবু!

কেদারবাবু বলিলেন, তুমি চাওনি সত্য, কিন্তু আমার ত দেওয়া উচিত। এতদিন যে দিইনি, সেই আমার যথেষ্ট অন্যায় হয়ে গেছে সুরেশ, কাগজখানা তুমি পকেটে তুলে রাখো। বুড়ো হয়েচি, হঠাৎ যদি মরে যাই, টাকাটার গোল হতে পারে।
সুরেশ আবেগের সহিত জবাব দিল, কেদারবাবু, সুরেশ আর যাই করুক, সে টাকা নিয়ে কখনো কারোর সঙ্গে গোল করে না। তা ছাড়া আপনি নিজেও বেশ জানেন, এ টাকা আমি চাইনে—এ আমি আমার বন্ধুকে যৌতুক দিয়েচি।
কেদারবাবু বলিলেন, তা হলে সে তোমার বন্ধুকেই দিয়ো, আমাকে নয়। আমি যা নিয়েছি, সে আমারই ঋণ।
সুরেশ কহিল, বেশ, আমার বন্ধুকেই দেবো, বলিয়া কাগজখানা টেবিল হইতে তুলিয়া লইয়া দুই পা পিছাইয়া গিয়া অচলার সম্মুখে দাঁড়াইবামাত্রই, কেদারবাবু অগ্ন্যুৎপাতের ন্যায় প্রজ্বলিত হইয়া উঠিলেন। চিৎকার করিয়া বলিলেন, খবরদার সুরেশ! কাল থেকে অনেক অপমান আমি নিঃশব্দে সহ্য করেচি, কিন্তু আমার মেয়েকে আমার চোখের সামনে তুমি টাকা দিয়ে যাবে, সে আমার কিছুতেই সইবে না বলে দিচ্ছি। বলিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে তাঁহার আরাম-কেদারায় ধপ করিয়া বসিয়া পড়িলেন।
প্রথমটা সুরেশ চমকিয়া কেদারবাবুর প্রতি নির্নিমেষ-দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। তিনি ওইরূপে বসিয়া পড়িলে সে তাহার বিবর্ণ মুখ অচলার প্রতি ফিরাইয়া দেখিল, সে একমুহূর্তে যেন পাষাণ হইয়া গিয়াছে। প্রবল চেষ্টায় একবার সুরেশ কি একটা বলিতেও গেল; কিন্তু তাহার শুষ্ককণ্ঠ একটা অব্যক্ত ধ্বনি ভিন্ন স্পষ্ট কিছুই বাহির হইল না। আবার ফিরিয়া দেখিল, কেদারবাবু দুই করতল মুখের উপর চাপিয়া ধরিয়া তেমনি পড়িয়া আছেন। আর সে কথা বলিবার চেষ্টাও করিল না, শুধু আড়ষ্টের মত আরও মিনিট-খানেক স্তব্ধভাবে থাকিয়া অবশেষে নিঃশব্দে ধীরে ধীরে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
সে চলিয়া গেল, কিন্তু কন্যা ও পিতা ঠিক তেমনি একভাবে বসিয়া রহিলেন; এবং দেয়ালের গায়ে বড় ঘড়িটার টিক্‌টিক্‌ শব্দ ছাড়া সমস্ত কক্ষ ব্যাপিয়া কেবল একটা নিষ্ঠুর নীরবতা বিরাজ করিতে লাগিল।
নীচে সুরেশের রবার-টায়ারের গাড়িখানা যে ফটক পার হইয়া গেল, তাহা ঘোড়ার ঘুরের শব্দে বুঝিতে পারা গেল এবং পরক্ষণেই বেহারা ঘরে ঢুকিয়া ডাকিল, বাবু!
কেদারবাবু চোখ তুলিয়া দেখিলেন, তাহার হাতে একখণ্ড ছিন্ন কাগজ। আর কিছু বলিতে হইল না, তিনি লাফাইয়া উঠিয়া তাহার দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করিয়া চিৎকার করিয়া উঠিলেন, নিয়ে যা বলচি ব্যাটা, নিয়ে যা সুমুখ থেকে। বেরো বলচি—
হতবুদ্ধি বেহারাটা মনিবের কাণ্ড দেখিয়া দ্রুতপদে পলায়ন করিতেই, তিনি কন্যার প্রতি অগ্নি-দৃষ্টিক্ষেপ করিয়া কণ্ঠস্বর আরও একপর্দা চড়াইয়া দিয়া বলিলেন, হারামজাদা, নচ্ছার যদি আর কোনদিন কোন ছলে আমার বাড়ি ঢোকবার চেষ্টা করে ত তাকে পুলিশে দেব—এই আমি তোমাকে জানিয়ে রাখলুম অচলা!
নিজের নাম শুনিয়া অচলা তাহার একান্ত পাণ্ডুর মুখখানি ধীরে ধীরে উন্নত করিয়া ব্যথিত ম্লান চক্ষুদুটি পিতার মুখের প্রতি নিঃশব্দে মেলিয়া চাহিয়া রহিল.
পিতা কহিলেন, টাকা ছড়িয়ে বাপের চোখকে বন্ধ করা যায় না, পাষণ্ড যেন এ কথা মনে রাখে।

কন্যা তথাপি নিরুত্তর হইয়া রহিল, কিন্তু তাহার মলিন দৃষ্টি যে উত্তরোত্তর প্রখর হইয়া উঠিতে লাগিল, পিতার দৃষ্টিতে তাহা পড়িল না। তিনি তর্জনী কম্পিত করিয়া কহিতে লাগিলেন, হ্যান্ডনোট ছিঁড়ে ফেলে বাপকে ঘুষ দেওয়া যায় না, এ কথা আমি তাকে বুঝিয়ে তবে ছাড়ব। এ বাড়ি আমি নিজে বিক্রি করে নিজের ঋণ পরিশোধ করে যেখানে ইচ্ছে চলে যাবো—আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না, তা বলে রাখচি।
এতক্ষণ পরে অচলা কথা কহিল। প্রথমটা বাধা পাইল বটে, কিন্তু তার পরে স্থির অবিচলিত-কণ্ঠে কহিল, ঋণ-পরিশোধ না করে বাড়িটা আমার জন্যে রেখে যাবে, এই কি আমি প্রত্যাশা করি বাবা? তুমি না করলে ত এ কাজ আমাকেই করতে হতো।
কেদারবাবু অধিকতর উত্তেজিতভাবে জবাব দিলেন, তোমরা যা করে এসেছ, শুধু তাইতেই ত আমি ভদ্রসমাজে মুখ দেখাতে পারচি নে, তা তুমি জানো?
অচলা তেমনি শান্ত দৃঢ়স্বরে প্রত্যুত্তর দিল, না, আমি জানিনে। আমি এমন কিছু যদি করতুম বাবা, তার জন্যে তুমি মুখ দেখাতে পারো না, তা হলে সকলের আগে আমার মুখই তোমরা কেউ দেখতে পেতে না। সে দেশে আর যারই অভাব থাক, ডুবে মরবার মত জলের অভাব ছিল না। বলিতে বলিতেই কান্নায় তাহার গলা ধরিয়া আসিল, কহিল, কাল থেকে যে অপমান আমাকে তুমি করচ, শুধু মিথ্যে বলেই সইতে পেরেচি, নইলে—
এইখানে তাহার একেবারে কণ্ঠরোধ হইয়া গেল। সে মুখের উপর আঁচল চাপিয়া ধরিয়া উচ্ছ্বসিত ক্রন্দন কোনমতে সংবরণ করিয়া দ্রুতবেগে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
কেদারবাবু একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন। ক্রোধ করিবার, আঘাত করিবার, শোক করিবার অর্থাৎ কন্যার নিন্দিত আচরণে সর্বপ্রকার গভীর বিষাদের কারণ একমাত্র তাঁহারাই ঘটিয়াছে, ইহাই ছিল তাঁহার বিশ্বাস; কিন্তু অপর পক্ষও যে অকস্মাৎ তাঁহারই আচরণকে অধিকতর গর্হিত বলিয়া মুখের উপর তিরস্কার করিয়া তীব্র অভিমানে কাঁদিয়া চলিয়া যাইতে পারে, এ সম্ভাবনা তাঁহার স্বপ্নেও উদয় হয় নাই। তাই অভিভূতের ন্যায় কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া তিনি আস্তে আস্তে বসিয়া পড়িলেন এবং মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে বারংবার বলিতে লাগিলেন, এই নাও—এ আবার এক কাণ্ড!
ইহার পরে আট-দশদিন পিতা-পুত্রীর যে কি করিয়া কাটিল, সে শুধু অন্তর্যামীই দেখিলেন। অচলা কোনমতেই নিজের ঘর ছাড়িয়া বাহির হইল না, বাটীর চাকর-দাসীর কাছেও মুখ-দেখানো তাহার পক্ষে যেন অসম্ভব হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। বিগত কয়দিনের মত আজও সে পথের দিকে চাহিয়াই দিন কাটাইবার জন্য খোলা জানালায় আসিয়া বসিয়াছিল।
শীতের দিন, মধ্যাহ্নের সঙ্গে সঙ্গেই একটা ম্লান ছায়া যেন আকাশ হইতে মাটির উপরে ধীরে ধীরে ঝরিয়া পড়িতেছিল এবং সেই মালিন্যের সহিত তাহার সমস্ত জীবনের কি একটা অজ্ঞাত সম্বন্ধ অন্তরের গভীর তলদেশে অনুভব করিয়া তাহার সমস্ত মন যেন এই স্বল্পায়ু বেলার মতই নিঃশব্দে অবসন্ন হইয়া আসিতেছিল। তাহার চক্ষু যে ঠিক কিছু দেখিতেছিল তাহাও নহে, অথচ অভ্যাসমত উপরে-নীচে, আশেপাশে কিছুই তাহার দৃষ্টি এড়াইতেছিল না। এমনি একভাবে বসিয়া বেলা যখন আর বাকি নাই, সহসা দেখিতে পাইল, সুরেশের গাড়ি তাহাদের বাটীতে প্রবেশ করিতেছে। চক্ষের পলকে তাহার সমস্ত মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল এবং পুলিশ দেখিয়া চোর যেভাবে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করে, ঠিক তেমনি করিয়া সে জানালা হইতে ছুটিয়া আসিয়া একেবারে খাটের উপর শুইয়া পড়িল।

মিনিট-কুড়ি পরে তাহার রুদ্ধ দরজায় ঘা পড়িল ; এবং বাহির হইতে তাহার পিতা স্নিগ্ধস্বরে ডাক দিলেন, মা অচলা, জেগে আছো কি?
কিন্তু সাড়া না পাইয়া অধিকতর কোমল-কণ্ঠে কহিলেন, বেলা গেছে মা, ওঠো। সুরেশের পিসীমা তোমাকে নিতে এসেছেন, মহিম নাকি ভারী পীড়িত।
অচলা শয্যাত্যাগ করিয়া উঠিয়া নীরবে দ্বার খুলিয়া দিতেই সুরেশের পিসিমা আসিয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন।
অচলা হেঁট হইয়া তাঁহার পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিল।
কেদারবাবু সকলের পশ্চাতে ঘরে ঢুকিয়া শয্যার একান্তে বসিয়া কন্যাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, তোমাদের চলে আসার পর থেকেই মহিমের ভারী জ্বর। খুব সম্ভব রাত্রে হিম লেগে দুশ্চিন্তায় পরিশ্রমে নানা কারণে এই অসুখটি হয়েছে। বলিয়া সুরেশের পিসিকে উদ্দেশ করিয়া পুনশ্চ কহিলেন, আমি ভেবে সারা হয়ে যাচ্ছি, এদের পাঠিয়ে পর্যন্ত সে একটা সংবাদ দিলে না কেন? সুরেশ আমার দীর্ঘজীবী হোক, সে গিয়ে বুদ্ধি করে তাকে এখানে না এনে ফেললে কি যে হতো তা ভগবানই জানেন। বলিয়া সস্নেহ অনুতাপে বৃদ্ধের গলা ধরিয়া আসিল।
অচলা নিঃশব্দে নতমুখে দাঁড়াইয়া সমস্ত শুনিল, কোন প্রশ্ন করিল না, কিছুমাত্র চাঞ্চল্য প্রকাশ করিল না।
সুরেশের পিসীমা অচলার বাহুর উপর তাঁহার ডান হাতখানি রাখিয়া শান্ত মৃদুকণ্ঠে বলিলেন ভয় নেই মা, সে দু’দিনেই ভাল হয়ে যাবে।
অচলা কোন কথা না কহিয়া তাঁহাকে আর একবার নত হইয়া প্রণাম করিয়া আলনা হইতে শুধু গায়ের কাপড়খানি টানিয়া লইয়া যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া দাঁড়াইল।
এই শীতের অপরাহ্নে ঠাণ্ডার মধ্যে তাহাকে কিছুমাত্র গরম জামা-কাপড় না লইয়া, খালি গায়ে, অনভ্যস্ত সাজে বাহিরে যাইতে উদ্যত দেখিয়া বৃদ্ধ পিতার বুকে বাজিল; কিন্তু পুরোবর্তী ঐ বিধবার সজ্জার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া আর তাঁহার বাধা দিতে প্রবৃত্তি হইল না। তিনি শুধু কেবল বলিলেন, চল মা, আমিও সঙ্গে যাচ্চি, বলিয়া চটি-জুতা পায়ে দিয়াই সকলের অগ্রে সিঁড়ি বাহিয়া নীচে নামিয়া চলিলেন।






ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
মহিমের প্রতি অচলার সকলের চেয়ে বড় অভিমান এই ছিল যে, স্ত্রী হইয়াও সে একটি দিনের জন্যও স্বামীর দুঃখ-দুশ্চিন্তার অংশ গ্রহণ করিতে পায় নাই। এই লইয়া সুরেশও বন্ধুর সহিত ছেলেবেলা হইতে অনেক বিবাদ করিয়াছে, কিন্তু কোন ফল হয় নাই। কৃপণের ধনের মত মহিম সেই বস্তুটিকে সমস্ত সংসার হইতে চিরদিন এমনি একান্ত করিয়া আগলাইয়া ফিরিয়াছে যে, তাহাকে দুঃখ দুঃসময়ে কাহারও সাহায্য করা দূরে থাক, কি যে তাহার অভাব, কোথায় যে তাহার ব্যথা, ইহাই কোনদিন কেহ ঠাহর করিতে পারে নাই।
সুতরাং বাড়ি যখন পুড়িয়া গেল, তখন সেই পিতৃপিতামহের ভস্মীভূত গৃহস্তূপের প্রতি চাহিয়া মহিমের বুকে যে কি শেল বিঁধিল, তাহার মুখ দেখিয়া অচলা অনুমান করিতে পারিল না। মৃণালের বৈধব্যেও স্বামীর দুঃখের পরিমাণ করা তাহার তেমনি অসাধ্য। যেদিন নিজের মুখে শুনাইয়া দিয়াছিল, তাহাকে সে ভালবাসে না, সেদিন সে আঘাতের গুরুত্ব সম্বন্ধেও সে এমনি অন্ধকারেই ছিল। অথচ এত বড় নির্বোধও সে নহে যে, সর্বপ্রকার দুর্ভাগ্যেই স্বামীর নির্বিকার ঔদাসীন্যকে যথার্থই সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতে তাহার মনের মধ্যে কোন সংশয়ই উঁকি মারিত না। তাই সেদিন স্টেশনের উপরে সে স্বামীর অবিচলিত শান্ত মুখের প্রতি বারংবার চাহিয়া সমস্ত পথটা শুধু এই কথাই ভাবিতে ভাবিতে আসিয়াছিল, সহিষ্ণুতার ওই মিথ্যা মুখোশের অন্তরালে তাহার মুখের সত্যকার চেহারাটা না জানি কিরূপ।
আজ তাহার পীড়ার সংবাদটাকে লঘু এবং স্বাভাবিক ঘটনার আকার দিবার জন্য কেদারবাবু যখন সহজ গলায় বলিয়াছিলেন, তিনি কিছুই আশ্চর্য হন নাই, বরঞ্চ এত বড় দুর্ঘটনার পরে এমনিই কিছু একটা মনে মনে আশঙ্কা করিতেছিলেন, তখন অচলার নিজের অন্তরে যে ভাব একমুহূর্তের জন্যও আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল, তাহাকে অবিমিশ্র উৎকণ্ঠা বলাও সাজে না।
সুরেশের রবার-টায়ারের গাড়ি দ্রুতবেগে চলিয়াছিল। পিসীমা এক দিকের দরজা টানিয়া দিয়া চুপ করিয়া বসিয়াছিলেন, এবং তাহার পার্শ্বে অচলা পাথরের মূর্তির মত স্থির হইয়া বসিয়াছিল। শুধু কেদারবাবু কাহারো কাছে কোন উৎসাহ না পাইয়াও পথের দিকে শূন্যদৃষ্টি পাতিয়া অনর্গল বকিতেছিলেন। সুরেশের মত দয়ালু বুদ্ধিমান বিচক্ষণ ছেলে ভূ-ভারতে নাই; মহিমের একগুঁয়েমির জ্বালায় তিনি বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছেন; যে দেশে মানুষ নাই, ডাক্তার-বৈদ্য নাই, শুধু চোর-ডাকাত, শিয়াল-কুকুরের বাস, সেই পাড়াগাঁয়ে গিয়া বাস করার শাস্তি একদিন তাহাকে ভাল করিয়াই ভোগ করিতে হইবে,—এমনি সমস্ত সংলগ্ন-অসংলগ্ন মন্তব্য তিনি নিরন্তর এই নির্বাক রমণী-দুইটির কর্ণে নির্বিচারে ঢালিয়া চলিতেছিলেন।
ইহার কারণও ছিল। কেদারবাবু স্বভাবতঃই যে এতটা হালকা প্রকৃতির লোক ছিলেন, তাহা নহে। কিন্তু আজ তাঁহার হৃদয়ের গূঢ়-আনন্দ কোন সংযমের শাসনই মানিতেছিল না। তাঁহাদের পরম মিত্র সুরেশের সহিত প্রকাশ্য বিবাদ, একমাত্র কন্যার নিঃশব্দ বিদ্রোহ এবং সর্বোপরি একান্ত কুৎসিত ও কদর্য সংশয়ের গোপন গুরুভার বিগত কয়েকদিন হইতে তাঁহার বুকের উপর জাঁতার মত চাপিয়া বসিয়াছিল; আজ পিসীমার অপ্রত্যাশিত আগমনে সেই ভারটা অকস্মাৎ অন্তর্হিত হইয়া গিয়াছিল। মহিমের অসুখের খবরটাকে তিনি মনের মধ্যে আমলই দেন নাই। যদি সে রাত্রির দৈব-দুর্বিপাকে ঠাণ্ডা লাগাইয়া একটু জ্বরভাবই হইয়া থাকে ত সে কিছুই নহে। পিসীমা দুই-তিনদিনের মধ্যে আরোগ্য হইবার আশা দিয়াছিলেন; হয়ত সে সময়ও লাগিবে না, হয়ত কাল সকালেই সারিয়া যাইবে। পীড়ার সম্বন্ধে ইহাই তিনি ভাবিয়া রাখিয়াছিলেন। কিন্তু আসল কথা হইতেছে এই যে, সুরেশ স্বয়ং গিয়া তাহাকে আপনার বাড়িতে ধরিয়া আনিয়াছে এবং যে-কোন ছলে তাহার স্রীকে তাহার পার্শ্বে আনিয়া দিবার জন্য নিজের পিসীমাকে পর্যন্ত পাঠাইয়া দিয়াছে। কন্যা জামাতার মধ্যে যে কিছুকাল হইতে একটা মনোমালিন্য চলিয়া আসিতেছিল, দাসীর মুখের এ তথ্যটি তিনি একবারও বিস্মৃত হন নাই। অতএব সমস্তই যে সেই দাম্পত্য-কলহের ফল, আজ এই সত্য পরিস্ফুট হওয়ায়, এই অবিশ্রাম বকুনির মধ্যেও তাঁহার নিরতিশয় আত্মগ্লানির সহিত মনে হইতে লাগিল, ওখানে পৌঁছিয়া সেই সম্পূর্ণ নিরপরাধ ও ভদ্র যুবকের মুখের পানে তিনি চাহিয়া দেখিবেন কি করিয়া? কিন্তু তাঁহার কন্যার সর্বদেহের উপর একটা কঠিন নীরবতা স্থির হইয়া বিরাজ করিতে লাগিল। অসুখটা যে বিশেষ কিছুই নহে, তাহা সেও মনে মনে বুঝিয়াছিল, শুধু বুঝিতে পারিতেছিল না, সুরেশ তাহাকে ধরিয়া আনিল কিরূপে! স্বামীকে সে এটুকু চিনিয়াছিল।

সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। রাস্তার গ্যাস জ্বলিয়া উঠিয়াছে। গাড়ি সুরেশের বাটীর ফটকের মধ্যে প্রবেশ করিল এবং গাড়িবারান্দার অনতিদূরে আসিয়া থামিল। কেদারবাবু গলা বাড়াইয়া দেখিয়া সহসা উদ্বিগ্ন-স্বরে বলিয়া উঠিলেন, দুখানা গাড়ি দাঁড়িয়ে কেন?
সঙ্গে সঙ্গেই অচলার চকিত দৃষ্টি গিয়া তাহার উপরে পড়িল এবং লণ্ঠনের আলোকে স্পষ্ট দেখিতে পাইল, সুরেশ একজন প্রবীণ ইংরাজকে সসম্ভ্রমে গাড়িতে তুলিয়া দিতেছে এবং আর একজন সাহেবী-পোশাকপরা বাঙালী পার্শ্বে দাঁড়াইয়া আছে। ইঁহারা যে ডাক্তার, তাহা উভয়েই চক্ষের পলকে বুঝিতে পারিল।
তাঁহারা চলিয়া গেলে ইঁহাদের গাড়ি আসিয়া গাড়িবারান্দায় লাগিল। সুরেশ দাঁড়াইয়া ছিল, কেদারবাবু চিৎকার করিয়া প্রশ্ন করিলেন, মহিম কেমন আছে সুরেশ? অসুখটা কি?
সুরেশ কহিল, ভাল আছে। আসুন।
কেদারবাবু অধিকতর ব্যগ্রকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, অসুখটা কি তাই বল না শুনি?
সুরেশ কহিল, অসুখের নাম করলে ত আপনি বুঝতে পারবেন না কেদারবাবু! জ্বর, বুকে একটু সর্দি বসেছে। কিন্তু আপনি নেমে আসুন, ওঁদের নামতে দিন।
কেদারবাবু নামিবার চেষ্টামাত্র না করিয়া বলিলেন, একটু সর্দি বসেছে। তার চিকিৎসা ত তুমি নিজেই করতে পার! আমি ছেলেমানুষ নই সুরেশ, দু’জন ডাক্তার কেন? সাহেব-ডাক্তারই বা কিসের জন্যে? বলিতে বলিতে তাঁহার গলা কাঁপিতে লাগিল।

সুরেশ নিকটে আসিয়া হাত ধরিয়া তাঁহাকে নামাইয়া লইয়া বলিল, পিসীমা, অচলাকে ভেতরে নিয়ে যাও, আমি যাচ্চি।
অচলা কাহাকেও কোন প্রশ্ন করিল না, তাহার মুখের চেহারাও অন্ধকারে দেখা গেল না; নামিতে গিয়া পাদানের উপর তাহার পা যে টলিতে লাগিল, ইহাও কাহারও চোখে পড়িল না, সে যেমন নিঃশব্দে আসিয়াছিল, তেমনি নিঃশব্দে নামিয়া পিসীমার পিছনে পিছনে বাটীর ভিতর চলিয়া গেল।
মিনিট-কয়েক পরে দ্বারের ভারী পর্দা সরাইয়া যখন সে রোগীর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল, তখন মহিম বোধ করি তাহার বাটীর সম্বন্ধে কি-সব বলিতেছিল। সেই জড়িতকণ্ঠের দুটা কথা কানে প্রবেশ করিবামাত্রই আর তাহার বুঝিতে বাকি রহিল না, ইহা অর্থহীন প্রলাপ এবং রোগ কতদূর গিয়া দাঁড়াইয়াছে; মুহূর্তকালের জন্য সে দেয়ালের গায়ে ভর দিয়া আপনাকে দৃঢ় করিয়া রাখিল।
যে মেয়েটি রোগীর শিয়রে বসিয়া বরফ দিতেছিল, সে ফিরিয়া চাহিল এবং ধীরপদে উঠিয়া আসিয়া অচলাকে হেঁট হইয়া প্রণাম করিয়া সোজা হইয়া দাঁড়াইল। ইহার বিধবার বেশ। চুলগুলি ঘাড় পর্যন্ত ছোট করিয়া ছাঁটা; ইহার মুখের উপর সর্বকালের সকল বিধবার বৈরাগ্য যেন নিবিড়ভাবে বিরাজ করিতেছিল। ম্লান দীপালোকে প্রথমে ইহাকে মৃণাল বলিয়া অচলা চিনিতে পারে নাই; এখন মুখোমুখি স্থির হইয়া দাঁড়াইতেই ক্ষণকালের জন্য উভয়েই যেন স্তম্ভিত হইয়া রহিল; একবার অচলার সমস্ত দেহ দুলিয়া নড়িয়া উঠিল; কি একটা বলিবার জন্য ওষ্ঠাধরও কাঁপিতে লাগিল; কিন্তু কোন কথাই তাহার মুখ ফুটিয়া বাহির হইল না, এবং পরক্ষণেই তাহার সংজ্ঞাহীন দেহ ছিন্নলতার মত মৃণালের পদমূলে পড়িয়া গেল।
চেতনা পাইয়া অচলা চাহিয়া দেখিল, সে পিতার ক্রোড়ের উপর মাথা রাখিয়া একটা কোচের উপর শুইয়া আছে। একজন দাসী গোলাপজলের পাত্র হইতে তাহার চোখেমুখে ছিটা দিতেছে এবং পার্শ্বে দাঁড়াইয়া সুরেশ একখানা হাতপাখা লইয়া ধীরে ধীরে বাতাস করিতেছে।
ব্যাপারটা কি হইয়াছে, স্মরণ করিতে তাহার কিছুক্ষণ লাগিল। কিন্তু মনে পড়িতে লজ্জায় মরিয়া শশব্যস্তে উঠিয়া বসিবার উপক্রম করিতেই কেদারবাবু বাধা দিয়া কহিলেন, একটু বিশ্রাম কর মা, এখন উঠে কাজ নাই।
অচলা মৃদুকণ্ঠে বলিল, না বাবা, আমি বেশ ভাল হয়ে গেছি, বলিয়া পুনরায় বসিবার চেষ্টা করিতে পিতা জোর করিয়া ধরিয়া রাখিয়া উদ্বেগের সহিত বলিলেন, এখন উঠবার কোন আবশ্যক নেই অচলা, বরঞ্চ একটুখানি ঘুমোবার চেষ্টা কর।
সুরেশও অস্ফুটে বোধ করি এই কথারই অনুমোদন করিল। অচলা নীরবে একবার তাহার মুখের পানে চাহিয়া প্রত্যুত্তরে কেবল পিতার হাতখানা ঠেলিয়া দিয়া সোজা উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ঘুমোবার জন্যে ত এখানে আসিনি বাবা—আমার কিছুই হয়নি—আমি ও-ঘরে যাচ্চি। বলিয়া প্রতিবাদের অপেক্ষা না করিয়া বাহির হইয়া গেল।
এ বাটীর ঘর-দ্বার সে বিস্মৃত হয় নাই। রোগীর কক্ষ চিনিয়া লইতে তাহার বিলম্ব হইল না। প্রবেশ করিতেই মৃণাল চাহিয়া দেখিল; কহিল, তুমি এসে একটুখানি বসো সেজদি, আমি আহ্নিকটা সেরে নিই গে। বরফের টুপিটা গড়িয়ে না পড়ে যায়, একটু নজর রেখো। বলিয়া সে অচলাকে নিজের জায়গায় বসাইয়া দিয়া ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল।






চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ
কঠিন নিমোনিয়া রোগ সারিতে সময় লাগিবে। কিন্তু মহিম ধীরে ধীরে যে আরোগ্যের পথেই চলিয়াছিল, এ যাত্রায় আর তাহার ভয় নাই, এ কথা সকলের কাছেই সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল। তাহার মুখের অর্থহীন বাক্য, চোখের উদ্‌ভ্রান্ত দৃষ্টি সমস্তই শান্ত এবং স্বাভাবিক হইয়া আসিতেছিল।
দিন-দশেক পরে একদিন অপরাহ্নবেলায় মহিম শান্তভাবে ঘুমাইতেছিল। এ বৎসর সর্বত্রই শীতটা বেশী পড়িয়াছিল। তাহাতে এইমাত্র বাহিরে এক পশলা বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। রোগীর খাটের সহিত একটা বড় তক্তপোশ জোড়া দিয়া বিছানা করা হইয়াছিল; ইহার উপরেই সকলে বেশ করিয়া কাপড় গায়ে দিয়া বসিয়াছিল। সকলের চোখ-মুখেই একটা নিরুদ্বিগ্ন তৃপ্তির প্রকাশ; শুধু পিসীমা গৃহকর্মে অন্যত্র নিযুক্ত এবং কেদারবাবু তখনও বাড়ি হইতে আসিয়া জুটিতে পারেন নাই।
সুরেশের প্রতি চাহিয়া মৃণাল হঠাৎ হাতজোড় করিয়া কহিল, এইবার আমার ছাড়পত্র মঞ্জুর করতে হুকুম হোক সুরেশবাবু, আমি দেশে যাই। এই দারুণ শীতে আমার বুড়ী শাশুড়ি হয়ত বা মরেই গেল।
সুরেশ কহিল, এখনও কি তাঁর বেঁচে থাকা দরকার নাকি? না, তাঁর জন্য আপনার যাওয়া হবে না।
মৃণাল পলকের তরে ঘাড় ফিরাইয়া বোধ করি বা একটা দীর্ঘনিশ্বাসই চাপিয়া লইল; তাহার পরে সুরেশের মুখের পানে চাহিয়া একটু হাসিয়া বলিল, শুধু আপনিই নয় সুরেশবাবু, এ প্রশ্ন পূর্বে আমিও অনেকবার করেছি। মনেও হয়, এখন তাঁর যাওয়া মঙ্গল। কিন্তু মরণ-বাঁচনের মালিক যিনি, তাঁর ত সে খেয়াল নেই, থাকলে হয়ত সংসারে অনেক দুঃখ-কষ্টের হাত থেকে মানুষ নিস্তার পেত।
অচলা এতক্ষণ চুপ করিয়াই ছিল। মৃণালের কথায় বোধ করি তাহার স্বামীর মৃত্যুর কথাটাই মনে করিয়া কহিল, তার মানে যিনি অন্তর্যামী তিনি জানেন, মানুষ শত দুঃখেও নিজের মৃত্যু চায় না।
মৃণালের মুখের উপর একটা গোপন বেদনার চিহ্ন প্রকাশ পাইল। মাথা নাড়িয়া কহিল, না সেজদি, তা নয়। এমন সময় সত্যিই আসে যখন মানুষে যথার্থই মরণ-কামনা করে। সেদিন অনেক রাত্রে হঠাৎ তন্দ্রা ভেঙ্গে যেতে শাশুড়ি-ঠাকরুনকে বিছানায় পেলুম না। তাড়াতাড়ি বাইরে এসে দেখি, ঠাকুরঘরের দরজাটা একটু খোলা। চুপি চুপি পাশে এসে দাঁড়ালুম। দেখি, তিনি গলায় কাপড় দিয়ে ঠাকুরের কাছে করজোড়ে মৃত্যু ভিক্ষে চাইচেন। বলছেন, ঠাকুর! যদি একটা দিনও কায়মনে তোমার সেবা করে থাকি ত আজ আমার লজ্জা নিবারণ কর। আমি মুক্তি চাইনে, স্বর্গ চাইনে, শুধু এই চাই ঠাকুর, তুমি আর আমাকে লজ্জা দিও না—আমি এ মুখ আমার বৌমার কাছে বার করতে পারচি নে। বলিতে বলিতেই মৃণাল ঝরঝর করিয়া কাঁদিতে লাগিল।এই প্রার্থনার মধ্যে মাতৃ-হৃদয়ের কত বড় সুগভীর বেদনা যে নিহিত ছিল, তাহা কাহারও অনুভব করিতে বিলম্ব হইল না। সুরেশের দুই চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল। কাহারও সামান্য দুঃখেই সে কাতর হইয়া পড়িত; আজ এই সন্তানহারা বৃদ্ধা জননীর মর্মান্তিক দুঃখের কাহিনীতে তাহার বুকের মধ্যে ঝড় বহিতে লাগিল। সে খানিকক্ষণ স্তব্ধভাবে মাটির দিকে চাহিয়া থাকিয়া মুখ তুলিয়া অকস্মাৎ উচ্ছ্বসিতকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, আচ্ছা, যাও দিদি, তোমার বুড়ো শাশুড়ির সেবা করে কর্তব্য কর গে, আমি আর তোমাকে আটকে রাখব না। এই হতভাগ্য দেশের আজও যদি কিছু গৌরব করবার থাকে ত সে তোমার মত মেয়েমানুষ । এমন জিনিসটি বোধ করি, আর কোন দেশ দেখাতে পারে না। বলিয়া সে জিজ্ঞাসু-মুখে একবার অচলার প্রতি চাহিল। কিন্তু সে জানালার বাহিরে একখণ্ড ধূসর মেঘের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া নিঃশব্দে বসিয়াছিল বলিয়া তাহার কাছ হইতে কোন সাড়া আসিল না।
কিন্তু মৃণাল লজ্জা পাইয়া নিজের দিক হইতে আলোচনাটাকে অন্য পথে সরাইবার জন্য তাড়াতাড়ি জোর করিয়া একটু হাসিয়া বলিল, না, নেই বৈ কি! আপনি সব দেশের খবর জানেন কিনা! আচ্ছা, সেজদার চেয়ে আপনি বড় না ছোট?
এই অদ্ভুত প্রশ্নে সুরেশ সহাস্যে কহিল, কেন বলুন ত?
মৃণাল বাধা দিয়া বলিল, না, আমাকে আর আপনি নয়। আমি দিদি হলেও যখন বয়সে ছোট, তখন—মেজদা? নদা?—বলুন, বলুন, শিগ্‌গির বলুন, কি?
অচলা আকাশ হইতে দৃষ্টি অপসারিত করিয়া এবার তাহার দিকে চাহিল। অনেকদিন পূর্বে যেদিন এই মেয়েটি এমনি দ্রুত, এমনি অবলীলাক্রমে তাহার সহিত সেজদি সম্বন্ধ পাতাইয়া লইয়াছিল, সে কথা তাহার মনে পড়িল। কিন্তু মৃণালের চরিত্রের এই দিকটা সুরেশের জানা ছিল না বলিয়া সে এই আশ্চর্য রমণীর মুখের পানে তাকাইয়া সকৌতুক হাস্যে বলিল, নদা! নদা! তোমার সেজদার চেয়ে আমি প্রায় দেড় বছরের ছোট।
মৃনাল কহিল, তা হলে নদা, দয়া করে একটি লোক ঠিক করে দিন, যে আমাকে কাল সকালের গাড়িতে রেখে আসবে।
যাইবার অনুমতি এইমাত্র সুরেশ নিজে দিলেও সে যে কাল সকালেই যাইতে উদ্যত হইবে তাহা সে ভাবে নাই। তাই ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া ঈষৎ গম্ভীর হইয়া বলিল, আর দুটো দিনও কি থাকতে পারবে না দিদি? তোমার ওপর ভার দিয়ে আমরা মহিমের জন্যে একেবারে নিশ্চিন্ত ছিলুম। এমন অহর্নিশি সতর্ক, এমন গুছিয়ে সেবা করতে আমি হাসপাতালেও কখনো কাউকে দেখেচি বলে মনে হয় না। কি বল অচলা?
প্রত্যুত্তরে অচলা শুধু মাথা নাড়িল।
মৃণাল সুরেশের চিন্তিতভাব লক্ষ্য করিয়া হাসিমুখে বলিল, আপনি সেজন্যে একটুকুও ভাববেন না। যার জিনিস, তারই হাতে দিয়ে যাচ্ছি, নইলে আমিও হয়ত যেতে পারতুম না। আপনার ত মনে আছে, আমাদের কি রকম তাড়াতাড়ি চলে আসতে হয়েছিল। তাই কোনো বন্দোবস্ত করেই আসা হয়নি। কাল আমাকে ছুটি দিন নদা, আবার যখনই হুকুম করবেন, তখনই চলে আসব।
সুরেশ আবার কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া সহসা বলিয়া বসিল, আচ্ছা মৃণাল, সেই অজ পাড়াগাঁয়ে শুধু কেবল একটা বুড়ো শাশুড়ির সেবা করে, আর পূজো-আহ্নিক করে তোমার সমস্ত সময়টা কাটবে কি করে, আমি তাই শুধু ভাবি।
মৃণালের মুখের উপর পুনরায় ব্যথার চিহ্ন প্রকাশ পাইল। কিন্তু সে হাসিয়া কহিল, সময় কাটাবার ভার ত আমার ওপর নেই নদা। যিনি সময় সৃষ্টি করেছেন তিনিই তার ব্যবস্থা করবেন।

সুরেশ কহিল, আচ্ছা সে যেন হলো। কিন্তু তোমার শাশুড়ি ত বেশীদিন বাঁচবেন না, আর মহিমকেও ডাক্তারের হুকুমমত ভাল হয়ে পশ্চিমের কোন একটা স্বাস্থ্যকর শহরে গিয়ে কিছুকাল বাস করতে হবে। তখন একলাটি সেখানে তুমি থাকবে কি করে?
মৃণাল উপরের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া পুনরায় একটু হাসিল। কহিল, সে উনিই জানেন।
অজ্ঞাতসারে সুরেশের মুখ দিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস পড়িল। মৃণাল কহিল, নদা বুঝি এ-সব মানেন না?
কি সব?
এই যেমন ভগবান—
না।
তবে বুঝি আমাদের জন্যে ওটা আপনার অবজ্ঞার দীর্ঘনিশ্বাস বয়ে গেল নদা?
সুরেশ এ প্রশ্নে সহসা কোন উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ বিমনার মত তাহার মুখের পানে চাহিয়া থাকিয়া হঠাৎ ঘাড় নাড়িয়া বলিয়া উঠিল, না মৃণাল, তা নয়। একটা অজানা ভবিষ্যতের ভার তেমনি অজানা একটা ঈশ্বরের ওপরে দিয়ে তারা যে বরঞ্চ আমাদের চেয়ে জিতের পথেই চলে, তা আমি অনেক দেখেচি। কিন্তু এ-সব আলোচনা থাক দিদি, হয়ত আমার প্রতি তোমার একটা ঘৃণা জন্মে যাবে।
মৃণাল তাড়াতাড়ি হেঁট হইয়া সুরেশের পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া কহিল, আচ্ছা থাক।
সুরেশ বিস্ময়ে অবাক হইয়া কহিল, এটা আবার কি হলো মৃণাল?
কোন্‌টা নদা?
কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ পায়ের ধূলো নেওয়াটা?
মৃণাল কহিল, বড়ভাইয়ের ধূলো নিতে কি আবার দিনক্ষণ দেখাতে হয় নাকি? বলিয়া হাসিয়া উঠিয়া গেল।
আচ্ছা মেয়ে ত! বলিয়া সস্নেহে-হাস্যে সুরেশ অচলার প্রতি চাহিতে গিয়া বিস্ময়ে একেবারে অভিভূত হইয়া গেল। তাহার সমস্ত মুখ শ্রাবণ-আকাশের মত ঘন মেঘে যেন আচ্ছন্ন হইয়া গিয়াছে, এমনি বোধ হইল। কিন্তু বিস্ময়ের ধাক্কা সামলাইয়া এ-সম্বন্ধে কোনোপ্রকার প্রশ্নের আভাসমাত্র দিবার পূর্বেই অচলা হতবুদ্ধি সুরেশকে আকাশ-পাতাল ভাবিবার অজস্র অবকাশ দিয়া ত্বরিতপদে মৃণালের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া গেল।
সেইখানে স্তব্ধভাবে বসিয়া সুরেশ কেবলি আপনাকে আপনি জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, এ কিসে কি হইল? মৃণালের প্রণাম করার সঙ্গে ইহার কেমন করিয়া যেন একটা নিগূঢ় যোগ আছে, তাহা সে নিজের ভিতর হইতেই নিশ্চয় অনুমান করিতে লাগিল; কিন্তু এ যোগ কোথায়? কেন মৃণাল অকস্মাৎ তাহার পদধূলি মাথায় লইয়া চলিয়া গেল, এবং পলক না ফেলিতে কেনই-বা অচলা ওরূপ বিবর্ণমুখে ঘর ছাড়িয়া প্রস্থান করিল। নিজের ব্যবহার ও কথাবার্তাগুলা সে আগাগোড়া বারংবার তন্ন তন্ন করিয়া স্মরণ করিয়াও কিন্তু কোন কূলকিনারা খুঁজিয়া পাইল না। অথচ পাশাপাশি এত বড় দুটা ঘটনাও কিছু শুধু শুধু ঘটে নাই, তাহাও সে বুঝিল। সুতরাং তাহারই কোন অজ্ঞাত নিন্দিত আচরণই যে এই অনর্থের মূল, এ সংশয় তাহার মনের মধ্যে কাঁটার মত বিঁধিতে লাগিল।
কিন্তু মৃণালকেও এ-সম্বন্ধে কোনপ্রকার প্রশ্ন করা অসম্ভব। রাত্রিটা সে এক-রকম পাশ কাটাইয়া রহিল, এবং প্রভাতে একসময়ে অচলাকে নিভৃতে পাইয়া কহিল, তোমাকে একটা কথার জবাব দিতে হবে।

অচলার মুখ লজ্জায় রাঙ্গা হইয়া উঠিল। প্রশ্নটা যে কি, সে তাহার অগোচর ছিল না। গত রাত্রির সেই তাহার অদ্ভুত আচরণের এই কৈফিয়ত দিতে হইবে বুঝিয়া সে আরক্ত-মুখে মৃদুকণ্ঠে কহিল, কি কথা?
সুরেশ আস্তে আস্তে বলিল, কাল মৃণাল হঠাৎ আমার পায়ের ধুলো নিয়ে উঠে গেল, তুমিও মুখ ভার করে রাগ করে চলে গেলে, সে কি তার শাশুড়ির মরণের কথা বলেছিলুম বলে?
এই অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে অচলা একটা পথ দেখিতে পাইয়া মনে মনে খুশি হইয়া বলিল, এ-রকম প্রসঙ্গ কি তোমার তোলা উচিত ছিল? সে বেচারার স্বামী নেই, শাশুড়ির মৃত্যুতে তার নিঃসহায় অবস্থাটা একবার ভেবে দেখ দিকি!
সুরেশ অতিশয় ক্ষুব্ধ হইয়া কহিল, আমার ভারী অন্যায় হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি যে আর বেশীদিন বাঁচতে পারেন না, এ ত মৃণাল নিজেও বোঝে। তা ছাড়া সে নিঃসহায় হবেই বা কেন?
অচলা জবাব দিল, এ কথা আমরা ত তাকে একবারও বলিনি। বরঞ্চ তুমিই তাকে নানারকমে ভয় দেখালে, দেশে সে একলাটি থাকবে কেমন করে?
সুরেশ অত্যন্ত অনুতপ্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তা হলে সে যাবার পূর্বে আমার কি তাকে সাহস দেওয়া উচিত নয়? তার যে কোন ভয় নেই, এ কথা কি তাকে—বলিতে বলিতেই অকৃত্রিম করুণায় তাহার কণ্ঠ সজল হইয়া আসিল।
অচলা তাহার মুখের পানে চাহিয়া হাসিল। এই পরদুঃখকাতর সহৃদয় যুবকের সহস্র দয়ার কাহিনী তাহার চক্ষের নিমিষে মনে পড়িয়া গেল। ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না, তোমার সাহস দিতেও হবে না, ভয় দেখিয়েও কাজ নেই। যখন সে সময় আসবে, তখন আমি চুপ করে থাকব না।
সুরেশ আত্মবিস্মৃত আবেগভরে অকস্মাৎ তাহার হাতখানা সজোরে চাপিয়া ধরিয়া প্রচণ্ড একটা নাড়া দিয়া বলিয়া উঠিল, এই ত তোমার যোগ্য কথা! এই ত তোমার কাছে আমি চাই অচলা! বলিয়া ফেলিয়াই কিন্তু অপরিসীম লজ্জায় হাত ছাড়িয়া দিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিল।
তাহার যে উচ্ছ্বাস মুহূর্তপূর্বে পরার্থপরতার নির্মল আনন্দের মধ্যে জন্মলাভ করিয়াছিল, এই লজ্জিত পলায়নে তাহা এক নিমিষেই কদর্য কলুষিত হইয়া দেখা দিল। অচলার বুকের রক্ত বিদ্যুৎবেগে প্রবাহিত হইয়া বিন্দু বিন্দু ঘামে ললাট ভরিয়া উঠিল এবং সর্বাঙ্গ বারংবার শিহরিয়া উঠিয়া নিকটবর্তী একখানা চেয়ারের উপর সে নির্জীবের মত বসিয়া পড়িল। কিছুক্ষণে তাহার সে ভাবটা কাটিয়া গেল বটে, কিন্তু পীড়িত স্বামীর শয্যায় গিয়া নিজের আসনটি গ্রহণ করিতে আজ সমস্ত সকালটা তাহার কেমন যেন ভয় ভয় করিতে লাগিল।
যাই যাই করিয়াও যাইতে মৃণালের দিন-দুই দেরি হইয়া গেল। মহিমের কাছে বিদায় লইতে গিয়া দেখিল, আজ সে পাশ ফিরিয়া অত্যন্ত অসময়ে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। যে বিদায় লইতে আসিয়াছিল, সে এই মিথ্যা নিদ্রার হেতু নিশ্চিত অনুমান করিয়াও চুপি চুপি কহিল, ওঁকে আর জাগিয়ে কাজ নেই সেজদি। কি বল?
প্রত্যুত্তরে অচলার ঠোঁটের কোণে শুধু একটুখানি বাঁকা হাসি দেখা দিল। মৃণাল মনে মনে বুঝিল, এ ছলনা সে ছাড়াও আরো একটি নারীর কাছে প্রকাশ পাইয়াছে। তাহার বিরুদ্ধে অচলা অন্তরের মধ্যে যে গোপন ঈর্ষার ভাব পোষণ করে, তাহা সে মহিমের কাছে কোনদিন আভাসমাত্র না পাইয়াও জানিত। এই একান্ত অমূলক দ্বেষ তাহাকে কাঁটার মত বিঁধিত। কিন্তু তথাপি অচলা যে নিজের হীনতা দিয়া আজিকার দিনেও ওই পীড়িত লোকটির পবিত্র দুর্বলতাটুকুকে বিকৃত করিয়া দেখিবে, তাহা সে ভাবে নাই। মুহূর্তকালের নিমিত্ত তাহার মনটা জ্বালা করিয়া উঠিল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়া কানে কানে কহিল, তুমি ত সব জান সেজদি, আমার হয়ে ওঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ো। বলো, ভাল হয়ে আবার যখন দেশে ফিরবেন, বেঁচে থাকি ত দেখা হবে।

নীচে কেদারবাবু বসিয়াছিলেন। মৃণাল প্রণাম করিয়া দাঁড়াইতেই তাঁহার চোখের কোণে জল আসিয়া পড়িল। এই অল্পকালের মধ্যেই সকলের মত তিনিও এই বিধবা মেয়েটিকে অতিশয় ভালবাসিয়াছিলেন। জামার হাতায় অশ্রু মুছিয়া কহিলেন, মা, তোমার কল্যাণেই মহিমকে আমরা যমের মুখ থেকে ফিরে পেয়েছি। যখনি ইচ্ছে হবে, যখনই একটু বেড়াবার সাধ হবে, তোমার এই বুড়ো ছেলেটিকে ভুলো না মা। আমার বাড়ি তোমার জন্যে রাত্রি-দিন খোলা থাকবে মৃণাল।
অচলা অদূরে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়াছিল। মৃণাল তাহাকে দেখাইয়া হাসিমুখে কহিল, যমের বাপের সাধ্যি কি বাবা, ওঁর কাছ থেকে সেজদাকে নিয়ে যায়! যেদিন সেজদির হাতে পৌঁছে দিয়েছি, সেইদিনই আমার কাজ চুকে গেছে।
কেদারবাবুর মুখের ভাব একটু গম্ভীর হইল, কিন্তু আর তিনি কিছু বলিলেন না।
দুইজন বৃদ্ধগোছের কর্মচারী ও একজন দাসী মৃণালকে দেশে পৌঁছাইয়া দিতে প্রস্তুত হইয়াছিল; তাহাদের সকলকে লইয়া স্টেশনের অভিমুখে ঘোড়ার গাড়ি ফটকের বাহির হইয়া গেলে কেদারবাবুর অন্তরের ভিতর হইতে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়িল। ধীরে ধীরে শুধু বলিলেন, অদ্ভুত, অপূর্ব মেয়ে!
সুরেশের মনটাও বোধ করি এইভাবে পরিপূর্ণ হইয়াছিল। সে কোনদিকে লক্ষ্য না করিয়া সায় দিয়া আবেগের সহিত বলিয়া উঠিল, আমি কখনো এমনটি আর দেখিনি কেদারবাবু! এমন মিষ্টি কথাও কখনো শুনিনি, এমন নিপুণ কাজকর্মও কখনো দেখিনি। যে কাজ দাও, এমন অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে করে দেবে যে মনে হবে যেন এই নিয়েই সে চিরকালটা আছে। অথচ আশ্চর্য এই যে, কোনদিন গ্রামের বাইরে পর্যন্ত যায়নি।
কেদারবাবু ইহা সত্য বলিয়া জানিলেও বিস্ময় প্রকাশ করিয়া কহিলেন, বল কি সুরেশ!
সুরেশ কহিল, যথার্থই তাই। ওর পানে চেয়ে চেয়ে আমার মাঝে মাঝে মনে হতো, এই যে জন্মান্তরের সংস্কার বলে একটা প্রবাদ আছে, কি জানি সত্যি নাকি! বলিয়া হাসিতে লাগিল।
পরকাল-সম্বন্ধীয় প্রসঙ্গে কেদারবাবু চিন্তাযুক্ত মুখে কিছুক্ষণ স্থিরভাবে থাকিয়া সহসা বলিয়া উঠিলেন, তা সে যাই হোক, এ কয়দিন দেখে দেখে আমার নিশ্চয় বিশ্বাস হয়েছে, এ মেয়ে স্ত্রীলোকের মধ্যে অমূল্য রত্ন। একে সারাজীবন এমন জীবন্মৃত করে রাখা শুধু পাপ নয়, মহাপাপ। ও আমার মেয়ে হলে আমি কোনমতেই নিশ্চেষ্ট থাকতে পারতুম না।
সুরেশ আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি করতেন?

বৃদ্ধ উদ্দীপ্তস্বরে বলিলেন, আমি আবার বিবাহ দিতুম। একটা বুড়োর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ওর ওই উনিশ-কুড়ি বছর বয়সে যারা ওকে সন্ন্যাসিনী সাজিয়েছে, তারা ওর মিত্র নয়, ওর শত্রু। শত্রুর কার্যকে আমি কোনমতেই ন্যায়সঙ্গত বলে স্বীকার করে নিতুম না।
একটু মৌন থাকিয়া পুনরায় কহিতে লাগিলেন, তাছাড়া ওর স্বামীর ব্যবহারটাই একবার মনে করে দেখ দিকি সুরেশ। সে লোকটার দু-দুটো স্ত্রী গত হতে পঞ্চাশ বছর বয়সে যখন এমন মেয়েকে বিবাহ করতে রাজি হলো তখন নিজের সুখ-সুবিধে ভিন্ন স্ত্রীর ভবিষ্যতের দিকে পাষণ্ড কতটুকু দৃষ্টিপাত করেছিল, কল্পনা কর দেখি।
সুরেশকে নিরুত্তর দেখিয়া বৃদ্ধ অধিকতর উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন। কহিলেন, না সুরেশ, আমি বিধবা-বিবাহের ভালমন্দ তর্ক তুলচি নে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তোমার সমস্ত হিন্দুসমাজ চিৎকার করে ম’লেও আমি মানবো না, এই ব্যবস্থাই ওই দুধের মেয়েটার পক্ষে চরম শ্রেয়ঃ। ওর এমন এতটুকু কিছু নেই, যার মুখ চেয়ে ও একটা দিন কাটাতে পারে। সমস্ত জীবনটা কি তোমরা খেলার জিনিস পেয়েছ সুরেশ, যে ব্রহ্মচর্য ব্রহ্মচর্য করে চেঁচালেই সারা দুনিয়াটা ওর জন্যেই রাতারাতি বদলে ঋষির তপোবন হয়ে উঠবে! মেয়েটার শুধু কাপড়-চোপড়ের পানে চাইলে আমার বুক যেন ফেটে যেতে থাকে।
সুরেশ জবাব দিল না, মুখ তুলিয়াও চাহিল না; কিন্তু চোখের কোণে দেখিতে পাইল যে, চৌকাঠে ভর দিয়া অচলা এতক্ষণ পর্যন্ত মূর্তির মত দাঁড়াইয়াছিল—সেখানে আর সে নাই, কখন নিঃশব্দে ঘরের ভিতরে চলিয়া গেছে।
মৃণাল চলিয়া গেলে, অচলা যখনই সুরেশের মুখের দিকেই দিকে চাহিয়া দেখে, তখনই তাহার মনে হয়, সে বিমনা হইয়া আছে এবং কিসের শোক যেন তাহাকে নিরন্তর শুষ্ক করিয়া ফেলিতেছে।
দুই দিন পরে একদিন অপরাহ্ণে সুরেশ নীচের বারান্দার একধারে রৌদ্রের মধ্যে আরাম-কেদারাটা টানিয়া লইয়া কি একখানা বই পড়িতেছিল, পদশব্দে চাহিয়া দেখিল, তাহারই জন্য চা লইয়া অচলা নিজে আসিতেছে। এরূপ ঘটনা পূর্বে কোনদিন ঘটে নাই; তাই সে আশ্চর্য হইয়া সোজা উঠিয়া বসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বেয়ারা কৈ? আজ তুমি যে!
অচলা এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়াই একটা ছোট টিপয় চেয়ারের পাশে টানিয়া চায়ের বাটি নামাইয়া রাখিল এবং আর একখানা চেয়ার টানিয়া লইয়া নিজেও বসিয়া পড়িল।
এই অভিনব আচরণে তাহাকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করিতে আর সুরেশের সাহস হইল না। শুধু চায়ের পেয়ালাটা নীরবে হাতে তুলিয়া লইল।
কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে বসিয়া থাকিয়া অচলা মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা, সুরেশবাবু, আপনি কি বিধবা-বিবাহ কোন ক্ষেত্রেই ভাল বলে মনে করেন না?
সুরেশ চায়ের বাটি হইতে মুখ না তুলিয়াই জবাব দিল, করি। তার কারণ, কুসংস্কার আজও আমার অতদূর পর্যন্ত পৌঁছয় নি।
অচলা চিন্তা করিবার নিজেকে আর মুহূর্ত অবসর না দিয়া বলিল, তাহলে মৃণালের মত মেয়েকে বিবাহ করতে আপনার ত লেশমাত্র আপত্তি থাকা উচিত নয়।

সুরেশ চায়ের বাটিটা হাতে করিয়া শক্ত হইয়া বসিয়া বলিল, এ কথার মানে?
অচলার মুখে বা কণ্ঠস্বরে কোনরূপ উত্তেজনা প্রকাশ পাইল না। বেশ সহজভাবে বলিল, আপনার কাছে আমি অসংখ্য ঋণে ঋণী। তা ছাড়া আমি আপনার হিতাকাঙিক্ষণী। আপনাকে আমি সুষ্ঠু, সহজ, সংসারী এবং স্বাভাবিক দেখতে চাই। একদিন আপনি বিবাহ করতে প্রস্তুত ছিলেন, আজ আমার একান্ত অনুরোধ, আপনি স্বীকার করুন।
এক নিশ্বাসে মুখস্থর মত এতগুলা কথা বলিয়া অচলা যেন হাঁপাইতে লাগিল।
সুরেশ পাথরে-গড়া মূর্তির মত অনেকক্ষণ স্থির হইয়া বসিয়া থাকিয়া শেষে কহিল, এতে তুমি কি সত্যই সুখী হবে?
অচলা কহিল, হাঁ।
সে রাজি হবে?
তাই ত আমার বিশ্বাস।
সুরেশ একটুখানি ম্লান হাসিয়া বলিল, আমার বিশ্বাস তা নয়। বইয়ে পড়েছ ত সহমরণের দিনে কোন কোন সতী হাসতে হাসতে পুড়ে মরত। মৃণাল তাদেরই জাত। এদের মুখের কথায় সম্মত করানো ত ঢের দূরের কথা, একটা একটা করে হাত-পা কাটতে থাকেলেও একে আর একবার বিয়ে করতে রাজী করানো যাবে না। এ অসাধ্য-সাধনের চেষ্টা করে মাঝ থেকে আমাকে তার কাছে মাটি করে দিও না অচলা। আমাকে সে দাদা বলে ডেকেছে, তার কাছে আমি সম্মানটুকু বজায় রাখতে চাই।
দেখিতে দেখিতে অচলার সমস্ত মুখ ক্রোধে কালো হইয়া উঠিল। সুরেশের কথা শেষ হইতেই কঠিন মৃদুকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, সংসারে শুধু মৃণালই একমাত্র সতী নয় সুরেশবাবু এমন সতীও আছে, যারা মনে মনেও একবার কাউকে স্বামিত্বে বরণ করলে, সহস্র কোটি প্রলোভনেও আর তাদের নড়ানো যায় না। এদের কথা আপনি ছাপার বইয়ে পড়তে না পেলেও সত্যি বলে জেনে রাখবেন সুরেশবাবু! বলিয়া স্তম্ভিত অভিভূত সুরেশের প্রতি দৃক্‌পাতমাত্র না করিয়াই এ গর্বিতা রমণী দৃঢ়-পদক্ষেপে ঘর ছাড়িয়া বাহিরে গেল।






পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ
একজনের উচ্ছ্বসিত অকপট প্রশংসার মধ্যে যে আর একজনের কত বড় সুকঠোর আঘাত ও অপমান লুকাইয়া থাকিতে পারে, বক্তা ও শ্রোতা উভয়ের কেহই বোধ করি তাহা মুহূর্তকাল পূর্বেও জানিত না। সুরেশ হাতের বাটি হাতে লইয়া আড়ষ্ট হইয়া বসিয়া রহিল, এবং অচলা তাহার ঘরে ঢুকিয়া নিঃশব্দে দ্বার রুদ্ধ করিয়া বালিশে মুখ গুঁজিয়া মর্মান্তিক ক্রন্দনের দুর্নিবার বেগ রোধ করিতে লাগিল,—পাশেই মহিমের ঘর, পাছে বিন্দুমাত্র শব্দও তাহার কানে গিয়া পৌঁছে। বস্তুতঃ অন্তর্যামী ভিন্ন সে কান্নার ইতিহাস আর দ্বিতীয় ব্যক্তি জানিল না।
কিন্তু সে নিজে এই গভীর দুঃখের মধ্যে এক নূতন তত্ত্ব লাভ করিল। এই নারী-জীবনের সতীত্ব যে কতবড় সম্পদ, এতদিন পরে তাহার পরিপূর্ণ মহিমা আজই প্রথম যেন তাহার চোখের সম্মুখে সম্পূর্ণ উদ্ঘাটিত হইয়া দেখা দিল। সেদিন সুরেশের সংস্পর্শে পিতার সন্দিগ্ধ দৃষ্টিকে সে অন্যায় উপদ্রব মনে করিয়া যৎপরোনাস্তি ক্রুদ্ধ ও ব্যথিত হইয়াছিল, কিন্তু আজ অকস্মাৎ সেই ধর্মহীন পরস্ত্রীলুব্ধ সুরেশকেই যখন সতীত্বের পাদপদ্মে অমন করিয়া মাথা পাতিয়া প্রণাম করিতে দেখিল, তখন নিজের সত্যকার স্থানটাও আর তাহার দৃষ্টির অগোচর রহিল না।
আরও একটা জিনিস। সুস্পষ্ট বাক্যের শক্তি যে কত বৃহৎ, আজ এ সত্যও সে প্রথম উপলব্ধি করিল। সে শিক্ষিতা রমণী। স্বামীর প্রতি কায়মন-নিষ্ঠাই যে সতীত্ব, এ কথা তাহার অবিদিত ছিল না। শুধু দেহ বা শুধু মন কোনটাই যে একাকী সম্পূর্ণ নয়, ইহা সে ভাল করিয়াই জানিত। তথাপি মন যখন তাহার বিচলিত হইয়াছে, স্বামীকে ভালবাসে না, জিহ্বা যখন এ কথা উচ্চরবে ঘোষণা করিতেও সঙ্কোচ মানে নাই, তখনও কিন্তু কোনদিন তাহার আপনাকে ছোট বলিয়া মনে হয় নাই। কিন্তু আজ যখন সুরেশের মুখের সুস্পষ্ট বাণী না জানিয়া তাহার নামের সঙ্গে অসতী শব্দটা যোগ করিয়া দিতে চাহিল, তখনই তাহার সমস্ত অন্তরাত্মা যেন এক বুক-ফাটা বেদনার আর্তস্বরে চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল।
তাই বলিয়া মৃণালের প্রতি যে তাহার শ্রদ্ধা বাড়িল, তাহা নহে; কিন্তু এই মেয়েটির প্রসঙ্গে যে চৈতন্য আজ লাভ করিল, ইহা সে জীবনে কখনও বিস্মৃত হইবে না, ইহা আপনার কাছে আপনি বার বার প্রতিজ্ঞা করিতে লাগিল।
বাহিরে পিতার লাঠির আওয়াজ এবং পিছনে সুরেশের পদশব্দ শুনিতে পাইল। বুঝিল, তাঁহারা মহিমকে দেখিতে চলিয়াছেন, এবং অল্পকাল পরেই পিতার কণ্ঠস্বরে তাহার আহ্বান শুনিয়া সে বেশ করিয়া আঁচলে চোখ-মুখ মুছিয়া দ্বার খুলিয়া ও-ঘরে গিয়া উপস্থিত হইল।
কেদারবাবু তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া ব্যস্তভাবে বলিয়া উঠিলেন, আজ ব্যাপার কি? দুটোর সময় সুরুয়া দেবার কথা, চারটে বাজে যে! ও কি, চোখ-মুখ অমন ভারী কেন? ঘুমুচ্ছিলে না কি?
অচলা উত্তর না দিয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিল। রোগীকে সুরুয়া দিবার ব্যবস্থা হইবার পরে এই কাজটা মৃণালই করিত। চাকর চড়াইয়া দিত, সে আন্দাজ করিয়া যথাসময়ে নামাইয়া লইত। সে চলিয়া গেলে এ ভারটা অচলার উপরেই পড়িয়াছিল। আজ সে কথা তাহার মনেই ছিল না। ছুটিয়া গিয়া দেখিল, আগুন বহুক্ষণ নিবিয়া গিয়াছে এবং সমস্তটা শুকাইয়া পুড়িয়া রহিয়াছে।

বহুক্ষণ সেইখানে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া যখন সে ফিরিয়া আসিল, তখন কেদারবাবু এ কথা শুনিয়া অচলাকে কিছুই না বলিয়া শুধু সুরেশকে লক্ষ্য করিয়া কঠিনভাবে বলিলেন, তখনি ত তোমাকে বলেছিলুম সুরেশ, এখন একজন ভাল নার্স না রাখলে মহিমকে বাঁচাতে পারবে না। নিজের মেয়েকে কি আমার চেয়ে তোমরা বেশি বোঝো?
সুরেশ নিরুত্তরে বসিয়া রহিল। কিন্তু মহিম যে এতক্ষণ নিঃশব্দে স্ত্রীর লজ্জিত ম্লান মুখখানির প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া ছিল, তাহা কেহই দেখে নাই। সে এখন ধীরে ধীরে কহিল, নার্সের হাতে আমার ওষুধ পর্যন্ত খেতে প্রবৃত্তি হবে না সুরেশ। তবে ওঁকে সাহায্য করবার একজন লোক দাও। কাল-পরশু দুটো রাত্রিই ওঁকে সারারাত্রি জাগতে হয়েছে। দিনের বেলায় একটু বিশ্রামের অবকাশ না পেলে কলের মানুষকে দিয়েও কাজ পাবে না ভাই।
কথাটা বর্ণে বর্ণে সত্য না হইলেও মিথ্যা নয়। সুরেশ খুশী হইয়া মুখ তুলিল, কিন্তু কেদারবাবু নিজের রূঢ়বাক্যে লজ্জা পাইয়া কোন-কিছু একটা বলিবার উদ্যোগ করিতেই অচলা ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
রাত্রে তাহার অনেকবার ইচ্ছা করিতে লাগিল, রুগ্ন স্বামীর কাছে বহু অপরাধের জন্য কাঁদিয়া ক্ষমা ভিক্ষা চাহিয়া একবার জিজ্ঞাসা করে, তাহার মত পাপিষ্ঠাকে তিরস্কার হইতে বাঁচাইবার জন্য তাঁহার কি মাথাব্যথা পড়িয়াছিল! কিন্তু নিদারুণ লজ্জায় কোনমতেই এ প্রশ্ন তাহার মুখ দিয়া বাহির হইতে চাহিল না।
সুরেশের একটা কাজ ছিল, প্রতিদিন অনেক রাত্রে সে একবার করিয়া মহিমের ঘরে ঢুকিয়া প্রয়োজনীয় সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া দিয়া তবে শুইতে যাইত। মৃণাল থাকিতে সে প্রায় সারারাত্রিই আনাগোনা করিত, এবং তাহার আবশ্যকও ছিল; কিন্তু কয়দিন হইতে দেখা গেল, সে সহজে আর ঘরে প্রবেশ করে না। প্রয়োজন হইলে দাসী পাঠাইয়া খবর লয়, শুধু সন্ধ্যার প্রাক্কালে ক্ষণকালের জন্য একটিবার মাত্র নিজে আসিয়া সংবাদ গ্রহণ করে। তাহার এই নূতন আচরণ সকলের অগ্রে অচলারই দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল; কিন্তু এ বিষয়ে সামান্য একটু মন্তব্য প্রকাশ করাও তাহার পক্ষে সম্ভবপর নহে, তাই সে মৌন হইয়াই ছিল; কিন্তু যেদিন মহিম নিজে ইহার উল্লেখ করিল, তখন তাহাকে বলিতেই হইল, আজকাল তিনি অধিকাংশ সময় বাটীতেও থাকেন না এবং ইহার হেতু কি, তাহাও সে জানে না। মহিম চুপ করিয়া শুনিল, কোনপ্রকার মতামত প্রকাশ করিল না।
পরদিন সকালে অচলা নীচে নামিতেছিল, এবং সুরেশও কি একটা কাজে এই সিঁড়ি দিয়াই উপরে উঠিতেছিল; মুখ তুলিয়া অচলাকে দেখিবামাত্রই অন্যদিকে সরিয়া গেল। সে যে সর্বপ্রকারে তাহাকেই পরিহার করিয়া চলিতেছে, এ বিষয়ে আর তাহার সংশয়মাত্র রহিল না; এবং একদিন যাহা সে সমস্ত মন দিয়া কামনা করিয়াছিল, আজ তাহার সেই মনই সুরেশের আচরণে বেদনায় পীড়িত হইয়া উঠিল।










ষড়্‌‌বিংশ পরিচ্ছেদ
অচলার সমস্ত কাজকর্ম, সমস্ত ওঠা-বসার মধ্যেও নিভৃত হৃদয়তলে যে কথাটা অনুক্ষণ জ্বালা করিতেই লাগিল, তাহা এই যে সুরেশের মনের মধ্যে একটা প্রকাণ্ড পরিবর্তন কাজ করিতেছে, যাহার সহিত তাহার নিজের কোন সম্বন্ধ নেই। যে উদ্দাম ভালবাসা একদিন তাহারই মধ্যে জন্মলাভ করিয়া বর্ধিত হইয়া উঠিয়াছে, সে আজ জীর্ণ আশ্রয়ের ন্যায় তাহাকে ত্যাগ করিয়া অন্যত্র যাত্রা করিয়াছে। আপনাকে আপনি সে সহস্র তিরস্কার, সহস্র কটূক্তি করিয়া লাঞ্ছনা করিতে লাগিল, কিন্তু তথাপি এই বিদায়ের বেদনাকে আজ সে কোনক্রমেই মন হইতে দূরে সরাইতে পারিল না। এমন কি মাঝে বিকট ভয়ে সর্বাঙ্গ কণ্টকিত করিয়া এ সংশয় উঁকি মারিতে লাগিল, নিজের অজ্ঞাতসারে সেও সুরেশকে গোপনে ভালবাসিয়াছে কি না। প্রতিবারই এ আশঙ্কাকে সে অসঙ্গত, অমূলক বলিয়া উপহাস করিয়া উড়াইয়া দিতে লাগিল; আপনাকে আপনি বিদ্রূপ করিয়া বলিতে লাগিল, এ অসম্ভব সম্ভব হইবার পূর্বে সে গলায় দড়ি দিয়া মরিবে; তথাপি ছায়ার মত এ কথা যেন তাহার মনের পিছনে লাগিয়াই রহিল, ঘুরিতে ফিরিতেই যেন সে ইহাকে চোখে দেখিতে লাগিল এবং বোধ করি বা, এই বিভীষিকা হইতে আত্মরক্ষা করিতে সে স্নানাহারের সময়টুকু ব্যতীত দিবারাত্রির একটুকু কাল স্বামীর কাছ-ছাড়া হইতে সাহস করিল না। পাশের যে ঘরটা তাহার নিজের ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট ছিল, কয়দিনের মধ্যে সে ঘরে প্রবেশ করিতেও তাহার প্রবৃত্তি হইল না; এমন করিয়াও কিছুদিন অতিবাহিত হইয়া গেল।
মহিম প্রায় আরোগ্য হইয়া উঠিয়াছে। শীঘ্রই জব্বলপুরে চেঞ্জে যাইবার কথাবার্তা চলিতেছে। সেদিন সকালবেলা অচলা মেঝের উপর বসিয়া একটি স্টোভে স্বামীর জন্য দুধ গরম করিতেছিল; দুধ মুহুর্মুহুঃ উথলিয়া উঠিতেছিল, কোন দিকে চাহিবার তাহার এতটুকু অবসর নাই, মহিম এতক্ষণ যে একদৃষ্টে তাহারই প্রতি চাহিয়া ছিল, সে জানিত না—হঠাৎ স্বামীর দীর্ঘশ্বাস কানে যাইতেই সে মুখ তুলিয়া একটিবারমাত্রই চাহিয়াই পুনরায় নিজের কাজে মন দিল।
মহিম কোনদিন বেশি কথা কহে না; কিন্তু আজ সহসা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিয়া উঠিল, বাস্তবিক অচলা, বড় দুঃখ ছাড়া কোনদিন কোন বড় জিনিস লাভ করা যায় না। আমার বাড়িও আবার হবে, রোগও একদিন সারবে; কিন্তু এর থেকেও যে অমূল্য বস্তুটি লাভ করলুম, সে তুমি। আজকাল আমার মনে হয়, তুমি ছাড়া আর বোধ হয়, আমার একটা দিনও কাটবে না।
অচলা নিঃশব্দে গরম দুধ বাটিতে ঢালিয়া ঠাণ্ডা করিতে লাগিল, কোন উত্তর করিল না। মহিম একটু থামিয়া পুনশ্চ কহিল, মৃণাল, সুরেশ এরা আমার সেবা কিছু কম করেনি, কিন্তু কি জানি, যখনই জ্ঞান হতো তখনই কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করতুম; কেবলি মনে হতো হয়ত এদের কত কষ্ট, কত অসুবিধে হচ্ছে—এদের দয়ার ঋণ আমি কেমন করে এ জীবনে শোধ দেব। কিন্তু ভগবানের হাতে বাঁধা এমনি সম্বন্ধ যে, তোমার বিষয়ে কখনো মনে হয় না, এই সেবার দেনা একদিন আমাকে শুধতেই হবে। আমাকে বাঁচিয়ে তোলা যেন তোমার নিজেরই গরজ। বলিয়া মহিম একটুখানি হাসিল।
অচলা ঘাড় হেঁট করিয়া দুধ নাড়িতেই লাগিল, কোন কথা কহিল না।

মহিম বলিল, আর কত ঠাণ্ডা করবে, দাও।
তবুও অচলা জবাব দিল না, তেমনি অধোমুখেই বসিয়া রহিল। প্রথমটা মহিম একটুখানি বিস্মিত হইল কিন্তু পরক্ষণেই বুঝিতে পারিল, স্বামীর কাছে অচলা চোখের জল গোপন করিবার জন্যই অমন করিয়া একভাবে অধোমুখে বসিয়া আছে।
কেন যে সুরেশ বড়-একটা আসে না, তাহার হেতু নিশ্চয় করিয়া মহিম না বুঝিলেও কতকটা অনুমান করে নাই, তাহা নহে। ইহাতে ক্ষোভ-মিশ্রিত একটা আনন্দের ভাবই তাহার মনের মধ্যে ছিল। কারণ, অচলা যে সতর্ক হইয়াছে, নির্জনে অকস্মাৎ দেখা হইতে পারে, এই ভয়েই সে যে ঘর ছাড়িয়া সহজে অন্যত্র যাইতে চাহে না, ইহা সে মনে মনে অনুভব করিল। আজ তাই সারাদিন ধরিয়া মন যেন তাহার বসন্ত-বাতাসে উড়িয়া বেড়াইয়া কাটাইল। তাহার শয্যার কিছু দূরে একটা চৌকি ছিল। সেদিন অনেক রাত্রি পর্যন্ত তাহার উপরে বসিয়া অচলা কি একখানা বই পড়িতেছিল, এবং ক্লান্তিবশতঃ সেখানেই অবশিষ্ট রাতটুকু ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। পরদিন সকালে মহিমের ডাকে শশব্যস্তে উঠিয়া বসিল, এবং জানালা দিয়া দেখিল, বেলা হইয়া গিয়াছে।
মহিম কি-একটা কাজ বলিতে গিয়া চুপ করিয়া গেল, এবং স্ত্রীর আপাদমস্তক বার বার নিরীক্ষণ করিয়া বিস্ময়ের স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, তোমার নিজের গায়ের কাপড় কি হলো?
অচলা ততোধিক বিস্ময়ে নিজের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিল, এইমাত্র ঘুম ভাঙ্গিয়া যেখানা সে তাড়াতাড়ি নিজের গায়ে জড়াইয়া লইয়া উঠিয়া আসিয়াছে, সেখানা সুরেশের। স্বামীর প্রশ্নটা তাহাকে যেন চাবুক মারিল। লজ্জায় ব্যথায় তাহার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল; কিন্তু এ যে কি করিয়া ঘটিল, তাহা কোনমতেই ভাবিয়া পাইল না। তাহার স্মরণ হইল, গত রাত্রে তিনি ঘুমাইয়া পড়িলে সে নিজের শালখানা পাট করিয়া তাঁহার পায়ের উপর চাপা দিয়া অঞ্চলমাত্র গায়ে দিয়া পড়িতে বসিয়াছিল। ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে তাহার অত্যন্ত শীত করিতেছিল মনে পড়ে, তাহার পরে জাগিয়া উঠিয়া ইহাই দেখিতেছে।
কিন্তু স্ত্রীর একান্ত লজ্জিত ম্লান মুখের পানে চাহিয়া মহিম সস্নেহে সকৌতুকে হাসিল।
কহিল, এতে লজ্জা কি অচলা? চাকরটাই হয়ত উলটা-পালটা করে তোমারটা তার ঘরে দিয়ে তারটা এখানে রেখে গিয়েছে। না হয় সুরেশ নিজেই হয়ত কাল বিকেলবেলা ফেলে গিয়েছে, রাত্রে চিনতে না পেরে তুমি গায়ে দিয়েছ। বেয়ারাকে ডেকে বদলে আনতে বলে দাও।
দিই, বলিয়া সেখানা হাতে করিয়া অচলা বাহির হইয়া আসিল এবং পাশের ঘরে ঢুকিয়া যখন অবসন্নের মত বসিয়া পড়িল, তখন বুঝিতে কিছুই আর তাহার অবশিষ্ট ছিল না। অনেক রাত্রে সকলে ঘুমাইয়া পড়িলে সুরেশ যে নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করিয়াছিল, এবং শীতের মধ্যে তাহাকে ওভাবে নিদ্রিত দেখিয়া আপনার গাত্রবাসখানি দিয়া ঘুমন্ত তাহাকে সস্নেহে সযত্নে আচ্ছাদিত করিয়া নীরবে চলিয়া গিয়াছিল, ইহাতে তাহার আর লেশমাত্র সংশয় রহিল না। সে চোখ বুজিয়া সে আনত সতৃষ্ণ দৃষ্টি যেন স্পষ্ট দেখিতে পাইয়া রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। তাহার মনে হইতে লাগিল, শুধু তাহাকেই দেখিবার জন্য এবং ভাল করিয়াই দেখিবার জন্য সে অমন করিয়া আসিয়াছে, এবং হয়ত প্রতি রাত্রেই আসিয়া থাকে, কেহ জানিতেও পারে না।
এই কদাচারে তাহার লজ্জার পরিসীমা রহিল না; এবং ইহাকে সে কুৎসিত বলিয়া, গর্হিত বলিয়া, অভদ্র বলিয়া সহস্রপ্রকারে অপমানিত করিতে লাগিল এবং অতিথির প্রতি গৃহস্বামীর এ চৌর্যবৃত্তিকে সে কোনদিন ক্ষমা করিবে না বলিয়া নিজের কাছে বারংবার প্রতিজ্ঞা করিল; কিন্তু তথাপি তাহার সমস্ত মনটা যে এই অভিযোগে কোনমতেই সায় দিতেছে না, ইহাও তাহার অগোচর রহিল না এবং কোথায় কিসে যে তাহাকে এতদিন উঠিতে বসিতে বিঁধিতেছিল, তাহাও যেন একেবারে সুস্পষ্ট হইয়া দেখা দিল।

কেদারবাবুর এক বাল্যবন্ধু জব্বলপুর শহরে বাস করেন; তাঁহার নিকট হইতে উত্তর আসিল, জলবায়ু ও প্রাকৃতিক দৃশ্যে এ স্থান অতি উৎকৃষ্ট। তাঁহার নিজের বাসাও খুব বড়; অতএব মহিমের যদি আসাই হয়, ত সে স্বচ্ছন্দে তাঁহার কাছেই থাকিতে পারে।
একদিন সকালে কেদারবাবু আসিয়া এই সংবাদ জ্ঞাপন করিলেন ; এবং মাঘ মাস যখন শেষ হইয়াই আসিতেছে এবং পথের অল্পস্বল্প ক্লেশও যখন সহ্য করিতে সমর্থ, তখন আর কালবিলম্ব না করিয়া তাহার যাত্রা করাই কর্তব্য। যুবা-বয়সে তিনি নিজে একবার জব্বলপুরে গিয়াছিলেন, সেই স্মৃতি তাঁহার মনে ছিল, মহা উল্লাসে সেই সকল বর্ণনা করিয়া কহিলেন, জগদীশের স্ত্রী এখনো জীবিত আছেন, তিনি মায়ের মত মহিমকে যত্ন করিবেন, এবং চাই কি, এই উপলক্ষে তাঁহারও আর একবার দেশটা দেখা হইয়া যাইবে। মহিম চুপ করিয়া এই-সকল শুনিল, কিন্তু কিছুমাত্র উৎসাহ প্রকাশ করিল না। এই আগ্রহহীনতা শুধু অচলাই লক্ষ্য করিল। পিতা প্রস্থান করিলে সে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, কেন, জব্বলপুর ত বেশ জায়গা, তোমার যেতে কি ইচ্ছে নেই?
মহিম কহিল, তোমরা সকলে আমাকে যতটা সুস্থ সবল ভাবছ, ততটা এখনো আমি হইনি। কোনদিন হব কিনা, তার আমি আশা করিনে।
অচলা বলিল, সেই জন্যই ত ডাক্তার তোমার চেঞ্জের ব্যবস্থা করেছেন। একবার ঘুরে এলেই সমস্ত সেরে যাবে।
মহিম ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়িয়া ক্ষণকাল চুপ করিয়া রহিল। পরে কহিল, কি জানি। কিন্তু এ অবস্থায় আমার নিজের বা পরের উপর নির্ভর করে স্বর্গে যেতেও ভরসা হয় না। অচলা, ভেতরে ভেতরে আমি বড় দুর্বল, বড় অসুস্থ। তুমি কাছে না থাকলে হয়ত আমি বেশী দিন বাঁচবো না। বলিতে বলিতে তাহার কণ্ঠস্বর যেন সজল হইয়া উঠিল।
যে মুখ ফুটিয়া কখনো কিছু চাহে না, কখনো নিজের দুঃখ অভাব ব্যক্ত করে না, তাহারই মুখের এই আকুল ভিক্ষা ঠিক যেন শূলের মত আঘাত করিয়া অচলার হৃদয়ে যত স্নেহ, যত করুণা, যত মাধুর্য এতদিন রুদ্ধ হইয়া ছিল, সমস্ত একসঙ্গে একমুহূর্তে মুখ খুলিয়া দিল। সে নিজেকে আর ধরিয়া রাখিতে না পারিয়া পাছে অসম্ভব কিছু-একটা করিয়া বসে এই ভয়ে চক্ষের জল চাপিতে চাপিতে একেবারে ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল। মহিম হতবুদ্ধির মত অনেকক্ষণ পর্যন্ত বিস্ময়ে ব্যথায় সে উন্মুক্ত দ্বারের দিকে নির্নিমেষে চাহিয়া আবার ধীরে ধীরে শুইয়া পড়িল।
আবার যখন উভয়ে সাক্ষাৎ হইল তখন স্বামী-স্ত্রীর কেহই এ সম্বন্ধে কোন কথা কহিল না। পরদিন অচলা একখানা টেলিগ্রাম হাতে করিয়া আসিয়া হাসিমুখে কহিল, জগদীশবাবু টেলিগ্রামের জবাব দিয়েছেন, তাঁর বাসার কাছে আমাদের জন্যে তিনি একটা ছোট বাড়ি ঠিক করেছেন।
মহিম কথাটা ঠিক বুঝিতে না পারিয়া বলিল, তার মানে?

অচলা কহিল, বাবার বন্ধু বলে তোমাকেই না হয় তিনি বাড়িতে জায়গা দিতে পারেন। কিন্তু দু’জনে গিয়ে ত তাঁর কাঁধে ভর করা যায় না। তাই কালই একটা বাসা ঠিক করবার জন্যে টেলিগ্রাম করতে বাবাকে চিঠি লিখে দিই। এই তার জবাব। বলিয়া সে হলদে খামখানা স্বামীর বিছানার উপর ছুড়িয়া দিল।
মহিম হাতে লইয়া সেখানা আগাগোড়া পড়িয়া শুধু বলিল, আচ্ছা। অচলা যে স্বেচ্ছায় সঙ্গে যাইতে চাহে, ইহা সে বুঝিল। কিন্তু কল্যকার আচরণ, যাহা আজিও তাহার কাছে তেমনি দুর্বোধ্য, তেমনিই দুর্জ্ঞেয়, তাহাই স্মরণ করিয়া কোনরূপ অযথা চাঞ্চল্য প্রকাশ করিতে আর তাহার প্রবৃত্তি হইল না।
কিন্তু অচলার তরফ হইতে যাত্রার উদ্যোগ পুরা মাত্রায় চলিতে লাগিল। সেদিন দুপুরবেলা সে বাটীতে আসিয়া তাহার জিনিসপত্র গুছাইতেছিল, কেদারবাবু দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া কিছুক্ষণ নিঃশব্দে নিরীক্ষণ করিয়া কহিলেন, তোমার না গেলেই কি নয় মা?
অচলা চমকিয়া মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন বাবা?
স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার দিক দিয়া তাহার সঙ্গে থাকাটা যে ঠিক সঙ্গত নয়, পিতা হইয়া কন্যাকে এ কথা জানাইতে কেদারবাবু লজ্জা বোধ করিলেন। তাই তিনি মহিমের বর্তমান আর্থিক অবস্থার ইঙ্গিত করিয়া কহিলেন, বেশীদিন ত নয়। তা ছাড়া, জগদীশের ওখানে তার কোন অসুবিধেই হতো না। এই অল্পকালের জন্যে বেশী কতকগুলো খরচপত্র করে—
আসল কথাটা অচলা বুঝিল না। সে পিতার মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া প্রশ্ন করিল, তিনি বলছিলেন বুঝি?
না না, মহিম কিছু বলেন নি, শুধু আমি ভাবছি—
তুমি কিছু ভেবো না বাবা, সে আমি সমস্ত ঠিক করে নেবো, বলিয়া অচলা পুনরায় তাহার কাজের মধ্যে মনোনিবেশ করিল এবং পরদিনই লুকাইয়া তাহার দুখানা গহনা বিক্রি করিয়া নগদ টাকা সংগ্রহ করিয়া রাখিল।
ফাল্গুনের মাঝামাঝি যাত্রার সঙ্কল্প ছিল, কিন্তু সুরেশের পিসিমা পুরোহিত ডাকাইয়া পাঁজি দেখাইয়া মাসের প্রথম সপ্তাহেই দিন স্থির করিয়া দিলেন। সেই মতই সকলকে মানিয়া লইতে হইল।
যাইবার দিন-দুই পূর্ব হইতেই অচলার সারা প্রাণটা যেন হাওয়ায় ভাসিয়া বেড়াইতে লাগিল। এই কলিকাতা ত্যাগ করিয়া কিছুদিনের নিমিত্ত স্বামিগৃহবাস ব্যতীত তাহাকে জীবনে কখনো অন্যত্র যাইতে হয় নাই, আজিও সে পশ্চিমের মুখ দেখে নাই। সেখানে কত প্রাচীন কীর্তি, কত বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, কত নদ-নদী, জলপ্রপাত, এমন কত কি আছে, যাহার গল্প লোকের মুখে শুনা ভিন্ন নিজে দেখিবার কল্পনা কোনদিন তাহার মনে স্থান পায় নাই। এইবার সেই-সকল আশ্চর্য সে স্বচক্ষে দেখিতে চলিয়াছে। তাহা ছাড়া সেখানে তাহার স্বামী ভগ্নদেহ ফিরিয়া পাইবে, একাকী সে-ই সেখানে ঘরণী, গৃহিণী, সর্বকার্যে স্বামীর সাহায্যকারিণী। সেখানে জলবায়ু স্বাস্থ্যকর, সেখানে জীবন-যাত্রার পথ সহজ ও সুগম, তিনি ভাল হইলে হয়ত একদিন তাহারা সেইখানেই তাহাদের ঘর-সংসার পাতিয়া বসিবে এবং অচিরভবিষ্যতে যে-সকল অপরিচিত অতিথিরা একে একে আসিয়া তাহাদের গৃহস্থালী পরিপূর্ণ করিয়া তুলিবে, তাহাদের কচি মুখগুলি নিতান্ত পরিচিতের মতই সে যেন চোখের উপর স্পষ্ট দেখিতে লাগিল।
এমনি কত কি যে সুখের স্বপ্ন দিবানিশি তাহার মাথার মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল, তার ইয়ত্তা নাই। আর সকল কথার মধ্যে স্বামী যে তাহাকে ছাড়িয়া আর স্বর্গে যাইতেও ভরসা করেন না, এই কথাটা মিশিয়া যেন তাহার সমস্ত চিন্তাকেই একেবারে মধুময় করিয়া তুলিল। আর তাহার কাহারও বিরুদ্ধে কোন ক্ষোভ, কোন নালিশ রহিল না—অন্তরের সমস্ত গ্লানি ধুইয়া মুছিয়া গিয়া হৃদয় গঙ্গাজলের মত নির্মল ও পবিত্র হইয়া উঠিল। আজ তাহার বড় সাধ হইতে লাগিল, যাইবার আগে একবার মৃণালকে দেখে এবং সমস্ত বুক দিয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়া জানা-অজানা সকল অপরাধের ক্ষমা-ভিক্ষা মাগিয়া লয়। আর সুরেশের জন্যও তাহার প্রাণ কাঁদিতে লাগিল। সে যে পরম বন্ধু হইয়াও লজ্জায় সঙ্কোচে তাহাদের দেখা দিতে পারে না, তাহার এই দুর্ভাগ্যের গোপন বেদনাটি সে আজ যেমন অনুভব করিল, এমন বোধ করি কোনদিন করে নাই। তাঁহারও কাছে সর্বান্তঃকরণে ক্ষমা চাহিয়া বিদায় লইবার আছে। কিন্তু অনুসন্ধান করিয়া জানিল, তিনি কাল হইতেই গৃহে নাই।

যাইবার দিন সকাল হইতেই আকাশে মেঘ করিয়া টিপি টিপি বৃষ্টি পড়িত আরম্ভ করিয়াছিল। জিনিসপত্র বাঁধা-ছাদা হইয়াছে, কিছু কিছু স্টেশনেও পাঠানো হইয়াছে, টিকিট পর্যন্ত কেনা হইয়া গিয়াছে। অচলার জন্যও সেকেন্ড ক্লাস টিকিট কেনার প্রস্তাব হইয়াছিল, কিন্তু সে ঘোরতর আপত্তি তুলিয়া মহিমকে বলিয়াছিল, টাকা মিথ্যে নষ্ট করবার সাধ থাকে ত কিনতে দাও গে। আমি সুস্থ সবল, তা ছাড়া কত বড়লোকের মেয়েরা ইন্‌টার ক্লাসের মেয়েগাড়িতে যাচ্ছে, আর আমি পারিনে? আমি দেড়া ভাড়ার বেশি কোনমতেই যাবো না।
সুতরাং সেইরূপ ব্যবস্থাই হইয়াছিল।
সম্পূর্ণ দুটা দিন সুরেশের দেখা নাই। কিন্তু আজ সকালে দুর্যোগের জন্যই হোক বা অপর কোন কারণেই হোক, সে তাহার পড়িবার ঘরে ছিল। এই আনন্দহীন কক্ষের মধ্যে অচলা ঠিক যেন একটা বসন্তের দমকা বাতাসের মত গিয়া প্রবেশ করিল। তাহার কণ্ঠস্বরে আনন্দের আতিশয্য উপচাইয়া পড়িতেছিল, বলিল, সুরেশবাবু, এ জন্মে আমাদের আর মুখ দেখবেন না নাকি? এত বড় অপরাধটা কি করেছি, বলুন ত?
সুরেশ চিঠি লিখিতেছিল, মুখ তুলিয়া চাহিল। তাহাদের বাড়ি পুড়িয়া গেলে আশেপাশের গাছগুলার যে চেহারা অচলা আসিবার দিন চক্ষে দেখিয়া আসিয়াছিল, সুরেশের এই মুখখানা এমনি করিয়াই তাহাদের স্মরণ করাইয়া দিল যে, সে মনে মনে শিহরিয়া উঠিল। বসন্তের হাওয়া ফিরিয়া গেল—সে কি বলিতে আসিয়াছিল, সব ভুলিয়া কাছে আসিয়া উদ্বিগ্নকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, তোমার কি অসুখ করেচে, সুরেশবাবু? কৈ, আমাকে ত এ কথা বলনি।
শুধু পলকের নিমিত্তই সুরেশ মুখ তুলিয়াছিল। তৎক্ষণাৎ নত করিয়া কহিল, না, আমার কোন অসুখ করেনি, আমি ভালই আছি; বলিয়া সেই বইখানার পাতা উলটাইতে উলটাইতে পুনরায় কহিল, আজই ত তোমরা যাবে, সমস্ত ঠিক হয়েছে? কতকাল হয়ত আর দেখা হবে না।
কিন্তু মিনিট-খানেক পর্যন্ত অপর পক্ষ হইতে উত্তর না পাইয়া সুরেশ বিস্ময়ে মুখ তুলিয়া চাহিল। অচলার দুই চক্ষু জলে ভাসিতেছিল, চোখাচোখি হইবামাত্রই বড় বড় অশ্রুর ফোঁটা টপটপ করিয়া ঝরিয়া পড়িল।
সুরেশের ধমনীতে উষ্ণ রক্তস্রোত উন্মত্ত হইয়া উঠিল, কিন্তু আজ সে তাহার সমস্ত শক্তি একত্র করিয়া, আপনাকে সংযত করিয়া দৃষ্টি অবনত করিল।

অচলা অঞ্চলে অশ্রু মুছিয়া গাঢ়স্বরে বলিয়া উঠিল, তোমার কখ্‌খনো শরীর ভাল নেই সুরেশবাবু, তুমিও আমাদের সঙ্গে চলো।
সুরেশ মাথা নাড়িয়া শুধু বলিল, না।
না, কেন? তোমার জন্যে—কথাটা শেষ হইতে পাইল না। দ্বারের বাহির হইতে বেহারা ডাকিয়া কহিল, বাবু, আপনার চা—বলিতে বলিতে সে পর্দা সরাইয়া ঘরে প্রবেশ করিল এবং পরক্ষণেই অচলা অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া বাহির হইয়া গেল।
ঘণ্টা-খানেক পরে সে তাহার স্বামীর কক্ষে প্রবেশ করিলে মহিম জিজ্ঞাসা করিল, সুরেশ ক’দিন থেকে কোথায় গেছে জানো? পিসীমাকেও কিছু বলে যায়নি; সে কি আজ আমার সঙ্গে দেখা করবে না নাকি?
অচলা আস্তে আস্তে কহিল, আজ ত তিনি বাড়িতেই আছেন।
মহিম কহিল, না। এইমাত্র আমাকে ঝি বলে গেল, সে সকালেই কোথায় বেরিয়ে গেছে।
অচলা চুপ করিয়া রহিল। ক্ষণকাল পূর্বেই যে তাহার সহিত সাক্ষাৎ ঘটিয়াছিল, সে যে অতিশয় অসুস্থ, সে যে ছেলেবেলার মত এবারও তোমার জীবন রক্ষা করিয়াছে—শুধু কেবল এইটুকু কৃতজ্ঞতার জন্যও একবার তাহাকে আমাদের ওখানে আহ্বান করা উচিত—
আর তাহাকে ভয় নাই—লজ্জিতাকে সংশয়ের চক্ষে দেখিয়া আর লজ্জা দিয়ো না—তাহার অন্তরের এই-সকলের একটা কথাও জিহ্বা আজ উচ্চারণ করিতে পারিল না। সে স্বামীর মুখের প্রতি ভাল করিয়া চাহিয়া দেখিতে পর্যন্ত পারিল না; নিঃশব্দে নিরুত্তরে হাতের কাছে যে-কোন একটা কাজের মধ্যে আপনাকে নিযুক্ত করিয়া দিল।
ক্রমশঃ স্টেশনে যাইবার সময় নিকটবর্তী হইয়া উঠিল। নীচে কেদারবাবুর হাঁক-ডাক শোনা গেল এবং পিসীমা পূর্ণঘট প্রভৃতি লইয়া ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। চাকরেরা জিনিসপত্র গাড়ির মাথায় তুলিয়া দিল, শুধু যিনি গৃহস্বামী, তাঁহারই কোন উদ্দেশ পাওয়া গেল না। অথচ, এই বলিয়া প্রকাশ্যে কেহ আলোচনা করিতেও সাহস করিল না—ব্যাপারটা ভিতরে ভিতরে এমনিই যেন সকলকে কুণ্ঠিত করিয়া তুলিয়াছিল।
কেদারবাবু কন্যাকে একটু নিরালায় পাইয়া মাথায় হাত দিয়া স্নেহার্দ্রকণ্ঠে কহিলেন, সতীলক্ষ্মী হও মা, মায়ের মত হও। বুড়োবয়সে না বুঝে অনেক মন্দ কথা বলেচি মা, রাগ করিস নে; বলিয়া তাড়াতাড়ি সরিয়া গেলেন।
মহিম গাড়িতে উঠিতে গিয়া অচলাকে একান্তে ক্ষুণ্ণস্বরে চুপি চুপি কহিল, সে সত্যিই আমাদের সঙ্গে দেখা করলে না। একটা কথা তাকে বলবার জন্যে আমি দু’দিন পথ চেয়ে ছিলাম।
পিতার বাক্যে তাহার চোখ দিয়া জল পড়িতেছিল, সে কেবল ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, না।
দ্বারের অন্তরালে পিসীমা দাঁড়াইয়া ছিলেন। অচলা প্রগাঢ় ভক্তিভরে তাঁহাকে প্রণাম করিয়া পদধূলি গ্রহণ করিতেই তিনি গদগদ-কণ্ঠে অসংখ্য আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, হাতের নোয়া অক্ষয় হোক মা, স্বামীকে নীরোগ করে শিগ্‌গির ফিরিয়ে এনো, এই প্রার্থনা করি।
এই আমার সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ পিসীমা !—বলিয়া চোখের জল মুছিতে মুছিতে সে গাড়িতে গিয়া বসিল। কথাটা কেদারবাবুরও কানে গেল। তিনি নিজে অমার্জনীয় লজ্জায় যেন মরিয়া গেলেন।






সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ
হাওড়া স্টেশন হইতে পশ্চিমের গাড়ি ছাড়িতে মিনিট-দশেক মাত্র বিলম্ব আছে। বাহিরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, টিপি-টিপি বৃষ্টির আর বিরাম নাই। লোকের পায়ে পায়ে জলে-কাদায় সমস্ত প্লাটফর্ম ভরিয়া উঠিয়াছে,—যাত্রীরা পিছল বাঁচাইয়া ভিড় ঠেলিয়া কোনমতে মোটঘাট লইয়া জায়গা খুঁজিয়া ফিরিতেছিল; এমনি সময় অচলা চাহিয়া দেখিল, প্রকাণ্ড একটা ব্যাগ হাতে করিয়া সুরেশ আসিতেছে।
বিস্ময়ে, দুশ্চিন্তায় কেদারবাবুর মুখ অন্ধকার হইয়া উঠিল, সে কাছে আসিতে না আসিতে তিনি চিৎকার করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ব্যাপার কি সুরেশ? তুমি কোথায় চলেছ?
জবাবটা সুরেশ অচলাকে দিল। তাহারই মুখের প্রতি চাহিয়া শুষ্ক হাসিয়া বলিল, নাঃ—তোমার উপদেশ, নিমন্ত্রণ কোনটাই অবহেলা করা চলে না দেখলুম। আজ সকালবেলা তুমি অমন করে চোখে আঙুল দিয়ে না দেখালে হয়ত ধরতেই পারতুম না, শরীর আমার কত খারাপ হয়ে গেছে! চল, তোমাদের অতিথি হয়েই দিন-কতক দেখি, সারতে পারি কি না! বাস্তবিক বলচি ম—
বেশ ত, বেশ ত সুরেশ। তা ছাড়া, নূতন জায়গায় আমাদেরও ঢের সাহায্য হবে; বলিয়া মহিম পলকের জন্য একবার অচলার প্রতি দৃষ্টিপাত করিল। সেই মুহূর্তের নিঃশব্দ ব্যথিত দৃষ্টি যেন সকলকেই উচ্চকণ্ঠে শুনাইয়া অচলাকে কহিয়া উঠিল, আমাকে বলিলে না কেন? যাহার স্বাস্থ্য লইয়া মনে মনে এত উৎকণ্ঠা ভোগ করিয়াছ, আজ সকালবেলা পর্যন্ত উভয়ে যে কথা আলোচনা করিয়াছ, আমাকে তাহা ঘূণাগ্রে জানিতে দাও নাই কেন? এই লুকোচুরির কি প্রয়োজন ছিল, অচলা!
কিন্তু অচলা অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া রহিল এবং সুরেশ ক্ষণকাল বিমূঢ়ের মত থাকিয়া অকস্মাৎ ভিতরের উত্তেজনা বাহিরে ঠেলিয়া আনিয়া অকারণ ব্যস্ততার সহিত বলিয়া উঠিল, কিন্তু আর ত দেরি নেই। চল চল, গাড়িতে উঠে তার পরে কথাবার্তা। চলুন কেদারবাবু, বলিয়া সে কেবলমাত্র সম্মুখের দিকেই চোখ রাখিয়া সকলকে একপ্রকার যেন ঠেলিয়া লইয়া চলিল।
কেদারবাবু বহুক্ষণ পর্যন্ত কোন কথা কহিলেন না। মহিমকে তাহার জায়গায় বসাইয়া দিয়া অচলাকে মেয়েদের গাড়িতে তুলিয়া দিলেন। শুধু গাড়ি ছাড়িবার সময় সুরেশ হেঁট হইয়া যখন তাঁহাকে নমস্কার করিয়া মহিমের পার্শ্বে গিয়া বসিল, তখনই তাহাকে বলিলেন, তুমি সঙ্গে আছ, আশা করি, পথে বিশেষ কোন কষ্ট হবে না। মেয়েদের গাড়িটা একটু দূরে রইল, মাঝে মাঝে খবর নিয়ো সুরেশ এবং মহিমকে আর-একবার সতর্ক করিয়া দিয়া কহিলেন, পৌঁছেই খবর দিতে যেন ভুল হয় না—দেখো। আমি অতিশয় উদ্বিগ্ন হয়ে থাকব, বলিয়া চোখের জল চাপিয়া প্রস্থান করিলেন। তাঁহার বিষণ্ণ মলিন মুখ ও স্নেহার্দ্র কণ্ঠস্বর বহুক্ষণ পর্যন্ত দুই বন্ধুরই কানের মধ্যে বাজিতে লাগিল।
গাড়ি ছাড়িলে ঠাণ্ডার ভয়ে মহিম কম্বল মুড়ি দিয়া অবিলম্বে শুইয়া পড়িল, কিন্তু সুরেশ সেইখানে একভাবে বসিয়া রহিল। তাহার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিবার সেখানে লোক কেহ ছিল না, থাকিলে যে-কেহ বলিতে পারিত, ওই দুটো চোখের দৃষ্টি আজ কোনমতেই স্বাভাবিক নয়—ভিতরে অতি বড় অগ্নিকাণ্ড না ঘটিতে থাকিলে মানুষের চোখ দিয়া কিছুতেই অমন কঠিন আলো ফুটিয়া বাহির হয় না।
শ্লো প্যাসেঞ্জার ছোট-বড় প্রত্যেক স্টেশনেই ধরিতে ধরিতে মন্থরগতিতে অগ্রসর হইতে লাগিল এবং বাহিরে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি সমভাবেই বর্ষিতে লাগিল। একটা বড় স্টেশনে গাড়ি থামিবার উপক্রম করিলে, মহিম তাহার আবরণের ভিতর হইতে মুখ বাহির করিয়া কহিল, ভিড় ছিল না, একটু শুয়ে নিলে না কেন সুরেশ? এমন সুবিধে ত বরাবর আশা করা যায় না।

সুরেশ চমকিয়া বলিল, হাঁ, এই যে শুই।
এই চমকটা এমনই অসঙ্গত ও অকারণে কুণ্ঠিত দেখাইল যে, মহিম সবিস্ময়ে অবাক হইয়া রহিল। সে যেন তাহার অগোচরে কি একটা অপরাধ করিতেছিল, ধরা পড়ার ভয়েই এমন ত্রস্ত হইয়া পড়িয়াছে, এই ভাবটা মহিম অনেকক্ষণ পর্যন্ত মন হইতে দূর করিতে পারিল না।
গাড়ি আসিয়া থামিল।
সুরেশ আপনার অবস্থাটা অনুভব করিয়া একটুখানি হাসির আভাসে মুখখানা সরস করিয়া কহিল, আমি ভেবেছিলুম তুমি ঘুমোচ্ছ, তাই এমনি চমকে উঠেছিলুম—
মহিম শুধু কহিল, হুঁ; কিন্তু এই অনাবশ্যক কৈফিয়তটাও তাহার ভাল লাগিল না।
সুরেশ বলিল, তাঁর কিছু চাই কিনা একবার খবর নিতে পারলে—
কিন্তু জল পড়চে না?
ও কিছুই নয়, আমি চট করে দেখে আসচি, বলিয়া সুরেশ দরজা খুলিয়া বাহির হইয়া গেল। সে মেয়েগাড়ির সুমুখে আসিয়া দেখিল, অচলা ইতিমধ্যে একটি সমবয়সী সঙ্গী পাইয়াছে এবং তাহারই সহিত গল্প করিতেছে। সে-ই অগ্রে সুরেশকে দেখিতে পাইয়া অচলার গা টিপিয়া দিয়া মুখ ফিরিয়া বসিল, অচলা চাহিয়া দেখিতেই সুরেশ কিছু চাই কি না জিজ্ঞাসা করিল। অচলা ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না। তোমার জলে ভিজতে হবে না, যাও। বলিয়াই কিন্তু নিজের জানালার কাছে উঠিয়া আসিয়া মৃদুকণ্ঠে কহিল, আমার জন্যে তোমাকে ভাবতে হবে না, কিন্তু যাঁর জন্যে ভাবনা তাঁর প্রতি যেন দৃষ্টি থাকে।
সুরেশ কহিল, তা আছে, কিন্তু তোমার কিছু খাবার, কিংবা শুধু একটু জল—
অচলা সহাস্যে বলিল, না গো না, আমার কিছু চাইনে। কিন্তু তুমি নিজে কি জলে ভিজে অসুখ করতে চাও নাকি?
সুরেশ পলকমাত্র অচলার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়াই চক্ষু আনত করিল, কহিল, অনেকদিন থেকেই ত চাইচি, কিন্তু হতভাগ্যের কাছে অসুখ পর্যন্ত ঘেঁষতে চায় না যে!
কথা শুনিয়া অচলার কর্ণমূল পর্যন্ত লজ্জায় আরক্ত হইয়া উঠিল; কিন্তু পাছে সুরেশ মুখ তুলিয়াই তাহা দেখিতে পায়, এই আশঙ্কায় সে কোনমতে ইহাকে একটা পরিহাসের আকার দিতে জোর করিয়া হাসিয়া বলিল, আচ্ছা, একবার চল না। তখন এমন খাটুনি খাটাব যে—
কিন্তু কথাটাকে সে শেষ করিতে পারিল না, তাহার অদৃশ্য লজ্জা এই ছদ্ম রহস্যের বাহ্য প্রকাশকে যেন অর্ধপথেই ধিক্কার দিয়া থামাইয়া দিল।
গাড়ি ছাড়িবার ঘণ্টা বাজিল, সুরেশ কি বলিবার জন্য মুখ তুলিয়াও অবশেষে কিছু না বলিয়াই চলিয়া যাইতেছিল, সহসা বাধা পাইয়া ফিরিয়া দেখিল, তাহার র‍্যাপারের একটা খুঁট অচলার হাতের মুঠার মধ্যে। সে ফিসফিস করিয়া অকস্মাৎ তর্জন করিয়া উঠিল, তোমাকে আমি সঙ্গে যেতে ডেকেছি, এ কথা সকলের কাছে প্রকাশ করে দিলে কেন? কেন আমাকে অমন অপ্রতিভ করলে?
ঠিক এই কথাটাই সুরেশ তখন হইতে সহস্রবার তোলাপাড়া করিয়া অনুশোচনায় দগ্ধ হইতেছিল, তাই প্রত্যুত্তরে কেবল করুণকণ্ঠে কহিল, আমি না বুঝে অপরাধ করে ফেলেছি অচলা।

অচলা লেশমাত্র শান্ত না হইয়া তেমনি উত্তপ্তস্বরে জবাব দিল, না বুঝে বৈ কি! সকলের কাছে আমার শুধু মাথা হেঁট করবার জন্যেই তুমি ইচ্ছে করে বলেচ।
ট্রেন চলিতে শুরু করিয়াছিল; সুরেশ আর কথা কহিবার অবকাশ পাইল না; অচলা তাহার গায়ের কাপড় ছাড়িয়া দিতেই সে দুরুদুরু বক্ষে দ্রুতবেগে প্রস্থান করিল; সে কোনদিকে না চাহিয়া ছুটিয়া চলিল বটে, কিন্তু তাহাকে দৃষ্টি দ্বারা অনুসরণ করিতে গিয়া আর একজনের হৃৎস্পন্দন একেবারে থামিয়া যাইবার উপক্রম করিল। অচলার চোখ পড়িয়া গেল, আর একটা জানালা হইতে মুখ বাড়াইয়া মহিম ঠিক তাহাদের দিকেই চাহিয়া আছে। সে স্বস্থানে ফিরিয়া আসিয়া যখন উপবেশন করিল, সেই মেয়েটি জিজ্ঞাসা করিল, উনিই বুঝি আপনার বাবু?
অন্যমনস্ক অচলা শুধু একটা হুঁ দিয়াই আর একটা জানালার বাহিরে গাছপালা, মাঠ-ময়দানের প্রতি শূন্যদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল; যে গল্প অসমাপ্ত রাখিয়া সে সুরেশের কাছে গিয়াছিল, ফিরিয়া আসিয়া তাহাকে সম্পূর্ণ করিবার আর তাহার প্রবৃত্তিমাত্র রহিল না।
আবার গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর পার হইয়া যাইতে লাগিল, আবার মনের ক্ষোভ কাটিয়া গিয়া মুখ নির্মল ও প্রশান্ত হইয়া উঠিল, আবার সে তাহার সঙ্গিনীর সহিত স্বচ্ছন্দচিত্তে কথাবার্তায় যোগ দিতে পারিল; যে লজ্জা ঘণ্টা-কয়েকমাত্র পূর্বে তাহাকে পীড়িত করিয়া তুলিয়াছিল, সে আর তাহার মনেও রহিল না।
একটা বড় স্টেশনে সুরেশ খানসামার হাতে চা ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী উপস্থিত করিল। অচলা সেগুলি গ্রহণ করিয়া সস্নেহ অনুযোগের স্বরে কহিল, তোমাকে এত হাঙ্গামা করতে কে বলে দিচ্ছে বল ত? তোমার বন্ধুরত্নটি বুঝি?
এ বিষয়ে সুরেশ কাহারো যে বলার অপেক্ষা রাখে না, অচলা তাহা ভাল করিয়াই জানিত, তথাপি এই অযাচিত যত্নটুকুর পরিবর্তে সে এই স্নিগ্ধ খোঁচাটুকু না দিয়া যেন থাকিতে পারিল না।
সুরেশ মুখ টিপিয়া হাসিয়া চলিয়া যাইতেছিল, অচলা ফিরিয়া ডাকিল। সে চাপা হাসির আভাসটুকু তখনও তাহার ওষ্ঠাধরে লাগিয়া ছিল। তাহার প্রতি দৃষ্টিপাতমাত্রই অচলা সহসা মুচকিয়া হাসিয়া ফেলিয়াই লজ্জায় কুণ্ঠায় রাঙ্গা হইয়া উঠিল। এই আরক্ত আভাসটুকু সুরেশ দুই চক্ষু দিয়া যেন আকণ্ঠ পান করিয়া লইল।
অচলা স্বামীর সংবাদের জন্যই সুরেশকে ফিরিয়া ডাকিয়াছিল। তাঁহার কোনপ্রকার ক্লেশ বা অসুবিধা হইতেছে কি না, বা কিছু আবশ্যক আছে কি না—একবার আসিতে পারেন কি না, এই-সকল একটি একটি করিয়া জানিয়া লইতে সে চাহিয়াছিল; কিন্তু ইহার পরে এ-সম্বন্ধে আর একটি প্রশ্ন করিবারও তাহার শক্তি রহিল না। সে অসঙ্গত গাম্ভীর্যের সহিত শুধু জিজ্ঞাসা করিল, আমাদের ত এলাহাবাদে গাড়ি বদল করতে হবে? কত রাত্রে সেখানে পৌঁছবে জানেন? একবার জেনে এসে আমাকে বলে যেতে পারবেন?
আচ্ছা, বলিয়া সুরেশ একটু আশ্চর্য হইয়াই চলিয়া গেল।
অচলা ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, সেই মেয়েটি তাহার জায়গা ছাড়িয়া দূরে গিয়া বসিয়াছে। অচলা অন্তরের বিরক্তি গোপন করিতে না পারিয়া কহিল, আপনাদের বাড়িতে বুঝি কেউ চা-রুটি খায় না?
মেয়েটি সবিনয়ে হাসিয়া বলিল, হায় হায়, ও দৌরাত্ম্য থেকে বুঝি কোন বাড়ি নিস্তার পেয়েচে ভাবেন? ও ত সবাই খায়।

অচলা কহিল, তবে যে বড় ঘৃণায় সরে বসলেন?
মেয়েটি লজ্জিতস্বরে বলিল, না ভাই, ঘৃণায় নয়—পুরুষেরা ত সমস্ত খায়, তবে আমার শ্বশুর এ-সব পছন্দ করেন না, আর—আমাদের মেয়েমানুষের ত—
একদিন এমনি একটা খাওয়া-ছোঁয়ার ব্যাপার লইয়া মৃণালের সহিত তাহার বিচ্ছেদ ঘটিয়াছিল। সেদিনও সে যে-কারণে নিজেকে শাসন করিতে পারে নাই, আজও সে তেমনি একটা অন্তর্জ্বালায় আত্মবিস্মৃত হইয়া গেল, এবং মেয়েটির কথা শেষ না হইতেই রুক্ষস্বরে বলিয়া উঠিল, আপনাকে বিব্রত করতে আমি চাইনে, আপনি স্বচ্ছন্দে ফিরে এসে আপনার জায়গায় বসুন; বলিয়া চক্ষের নিমিষে চা এবং সমস্ত খাদ্যদ্রব্য জানালা দিয়া ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল। মেয়েটি অনেকক্ষণ পর্যন্ত নিঃশব্দে চাহিয়া কাঠের মত বসিয়া রহিল, তাহার পরে একেবারে সম্পূর্ণ মুখ ফিরাইয়া বসিয়া আঁচল দিয়া চোখ মুছিতে লাগিল। বোধ করি, সে ইহাই ভাবিল, এতক্ষণের এত আলাপ, এত কথাবার্তার যে বিন্দুমাত্র মর্যাদা রাখিল না, না জানি সে এ অশ্রু দেখিয়া আবার কি একটা করিয়া বসিবে।
কিছুক্ষণের জন্য বৃষ্টি থামিলেও আকাশে ঘন মেঘ উত্তরোত্তর জমা হইয়া উঠিতেছিল। অপরাহ্ণের কাছাকাছি পুনরায় চাপিয়া জল আসিল। এই জলের মধ্যে মেয়েটি নামিয়া যাইবে, সে তাহার উদ্যোগ-আয়োজন করিতে লাগিল।
অচলা আর স্থির থাকিতে না পারিয়া, একেবারে তাহার কাছে আসিয়া বসিয়া পড়িল। তাহার হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিল, নিজের ব্যবহারের জন্য আমি অত্যন্ত লজ্জিত। আমাকে আপনি মাপ করুন।
মেয়েটি হাসিল, কিন্তু সহসা উত্তর দিতে পারিল না।
অচলা পুনরায় কহিল, আমার মন খারাপ থাকলে কি যে করে ফেলি, তার কোন ঠিকানা থাকে না। স্বামী পীড়িত, তাঁকে নিয়ে হাওয়া বদলাতে যাচ্ছি, ভাল হন ভালই, না হলে ঐ বিদেশে কি যে হবে, তা শুধু ভগবানই জানেন। বলিতে বলিতে তাহার কণ্ঠ আর্দ্র হইয়া উঠিল।
মেয়েটি বিস্মিত হইয়া কহিল, কিন্তু আপনার স্বামীকে দেখলে ত পীড়িত বলে মনে হয় না।
অচলা কহিল, আমার স্বামী এই গাড়িতেই আছেন, কিন্তু আপনি তাঁকে দেখেন নি। উনি আমার স্বামীর বন্ধু।
মেয়েটি অধিকতর আশ্চর্য হইয়া চুপ করিয়া রহিল।
এই বন্ধুটি তাঁহার স্বামী কি না, জিজ্ঞাসা করায় সে যে হুঁ বলিয়া সায় দিয়াছিল, এ কথা অচলার মনেই ছিল না, কিন্তু মেয়েটি তাহা বিস্মৃত হয় নাই। কিন্তু তাহার বিস্ময়কে অচলা সম্পূর্ণ অন্যভাবে গ্রহণ করিল। সুরেশের সহিত তাহার আচরণ ও বাক্যালাপে সে নিজের অন্তরে জ্বালা দিয়া বিকৃত করিয়া হিন্দুনারীর চক্ষে ইহা কিরূপ বিসদৃশ দেখাইয়াছে, তাহাই কল্পনা করিয়া লজ্জায় মরিয়া গেল এবং একান্ত নিরর্থক ও বিশ্রী জবাবদিহির স্বরূপে বলিয়া ফেলিল, আমরা হিন্দু নই—ব্রাহ্ম।
মেয়েটি তবুও মৌন রহিল দেখিয়া অচলা সসঙ্কোচে তাহার হাতখানি ছাড়িয়া দিয়া কহিল, আমাদের আচার-ব্যবহার আপনারা সমস্ত বুঝতে না পারলেই আমাদের অদ্ভুত বলে ভাববেন না।
এইবার মেয়েটি হাসিল, কহিল, আমরা ত ভাবিনে, বরঞ্চ আপনারাই যে-কোন কারণে হোক আমাদের থেকে দূরে থাকতে চান। কেমন করে জানলুম? আমাদেরই দুই-একটি আত্মীয় আছেন, যাঁরা আপনাদের সমাজের। তাঁদের কাছ থেকেই আমি জানতে পেরেচি, বলিয়া সে হাসিতে লাগিল।

অচলা জিজ্ঞাসা করিল, সে কারণটি কি?
মেয়েটি কহিল, সে আপনি নিশ্চয়ই জানেন। না জানেন ত সমাজের কাউকে জিজ্ঞাসা করে নেবেন, বলিয়া হাসিয়া প্রসঙ্গটা অকস্মাৎ চাপা দিয়া কহিল, আচ্ছা, অত দূরে না গিয়ে আপনার স্বামীকে নিয়ে কেন আমাদের ওখানে আসুন না।
কোথায়, আরায়?
মা গো! সেখানে কি মানুষ থাকে! আমার উনি ঠিকেদারী কাজ করেন বলেই আমাকে মাঝে মাঝে আরায় গিয়ে থাকতে হয়। আমি ডিহরীর কথা বলচি। শোন নদীর ওপর আমাদের ছোট বাড়ি আছে, সেখানে দু’দিন থাকলে আপনার স্বামী ভাল হয়ে যাবেন। যাবেন সেখানে? বলিয়া মেয়েটি অচলার হাত-দুটি নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া উত্তরের আশায় তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল।
এই অপরিচিতার ঔৎসুক্য ও আন্তরিক আগ্রহ দেখিয়া অচলা মুগ্ধ হইয়া গেল। কহিল, কিন্তু আপনার স্বামীর ত অনুমতি চাই! তিনি না বললে ত যেতে পারিনে।
মেয়েটি মাথা নাড়িয়া বলিল, ইস, তাই বৈ কি! আমরা সেবা করতে দাসী বলে বুঝি সব তাতেই দাসী? মনেও করবেন না। হুকুম দেবার বেলায় আমরাই ত কর্তা। সে দেশ পছন্দ না হলে সোজা ডিহরীতে চলে আসবেন—এতটুকু চিন্তা করবেন না, এই আপনাকে বলে দিলুম। অনুমতি নিতে হয় আমি নেব, আপনার কি গরজ? বলিয়া এই স্বামী-সৌভাগ্যবতী মেয়েটি তাহার আনন্দের আতিশয্যে অচলাকে যেন আচ্ছন্ন করিয়া ধরিল।
আরা স্টেশন নিকটবর্তী হইয়া আসিতেছে, তাহা ট্রেনের মন্দগতিতে বুঝা গেল। সে অচলার হাত-দুটি পুনরায় নিজের ক্রোড়ের মধ্যে টানিয়া লইয়া আবেশভরে বলিল, আমার সময় হল, আমি চললুম, কিন্তু আপনি ভেবে ভেবে মিথ্যে মন খারাপ করতে পাবেন না বলে যাচ্ছি। আপনার কোন ভয় নেই, স্বামী আপনার খুব শিগ্‌গির ভাল হয়ে উঠবেন। কিন্তু কথা দিন, ফেরবার পথে একটিবার আমার ওখানে পায়ের ধুলো দিয়ে যাবেন?
অচলা চোখের জল চাপিয়া বলিল, সেদিন যদি পাই, নিশ্চয় আপনাকে একবার দেখে যাবো।
মেয়েটি বলিল, পাবেন বৈ কি, নিশ্চয় পাবেন। আপনাকে আমি চিনতে পেরেচি। এই আমি বলে যাচ্চি, আপনার এত বড় ভক্তি-ভালবাসাকে ভগবান কখনো বিমুখ করবেন না; এমন হতেই পারে না।
অচলা জবাব দিতে পারিল না, মুখ ফিরাইয়া একটা উচ্ছ্বসিত বাষ্পোচ্ছ্বাস সংবরণ করিয়া লইল।
বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি আসিয়া প্লাটফর্মে থামিল। মেয়েটির ছোট দেবর অন্যত্র ছিল, সে আসিয়া গাড়ির দরজা খুলিয়া দাঁড়াইল। অচলা তাহার কানের কাছে মুখ আনিয়া চুপি চুপি কহিল, আপনার স্বামীর নাম ত মুখে আনবেন না জানি, কিন্তু আপনার নিজের নামটি কি বলুন ত? যদি কখনো ফিরে আসি, কি করে আপনার খোঁজ পাব?
মেয়েটি মৃদু হাসিয়া কহিল, আমার নাম রাক্ষুসী। ডিহরীতে এসে কোন বাঙালীর মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলেই সে আমার সন্ধান বলে দেবে। কিন্তু দু’জনে একবার এসো ভাই। আমার মাথার দিব্যি রইল, আমি পথ চেয়ে থাকবো। শোন নদীর উপরেই আমাদের বাড়ি। এই বলিয়া মেয়েটি দুই হাত জোড় করিয়া হঠাৎ একটা নমস্কার করিয়া ভিজিতে ভিজিতে বাহির হইয়া গেল।

বাষ্পীয় শকট আবার ধীরে ধীরে যাত্রা করিল। এইমাত্র সন্ধ্যা হইয়াছে; কিন্তু অবিশ্রাম বারিপাতের সঙ্গে বাতাস যোগ দিয়া এই দুর্যোগের রাত্রিকে যেন শতগুণ ভীষণ করিয়া তুলিয়াছে। জানালার কাচের ভিতর দিয়া চাহিয়া তাহার দৃষ্টি পীড়িত হইয়া উঠিল—তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল, এই সূচীভেদ্য অন্ধকার তাহার আদি-অন্ত যেন গ্রাস করিয়া ফেলিয়াছে। আলোর মুখ, আনন্দের মুখ আর সে কখনও দেখিবে না—ইহা হইতে এ জীবনে আর তাহার মুক্তি নাই। সঙ্গিবিহীন নির্জন কক্ষের মধ্যে সে একটা কোণের মধ্যে আসিয়া গায়ের কাপড়টা আগাগোড়া টানিয়া দিয়া চোখ বুজিয়া শুইয়া পড়িল এবং এইবার তাহার দুই চক্ষু বাহিয়া ঝরঝর করিয়া অশ্রু ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। কেন যে এই চোখের জল, ঠিক কি যে তাহার এত বড় দুঃখ, তাহাও সে ভাবিয়া পাইল না, কিন্তু কান্নাকেও সে কোনমতে আয়ত্ত করিতে পারিল না। অদম্য তরঙ্গের মত সে তাহার বুকের ভিতরটা যেন চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া গর্জিয়া ফিরিতে লাগিল। তাহার পিতাকে মনে পড়িল, তাহার ছেলেবেলার সঙ্গী-সাথীদের মনে পড়িল, পিসীমাকে মনে পড়িল, মৃণালকে মনে পড়িল, এইমাত্র যে মেয়েটি রাক্ষুসী বলিয়া নিজেকে পরিচয় দিয়া গেল, তাহাকে মনে পড়িল,—যদু চাকরটা পর্যন্ত যেন তাহার চোখের উপর দিয়া বার বার আনাগোনা করিয়া বেড়াইতে লাগিল। সকলের নিকট সে যেন জন্মের শোধ বিদায় লইয়া কোথায় কোন্‌ নিরুদ্দেশে যাত্রা করিয়াছে, বক্ষের মধ্যে তাহার এমনি ব্যথা বাজিতে লাগিল।
এইভাবে নিরন্তর অশ্রুবিসর্জন করিয়া, গাড়ি যখন পরের স্টেশনে আসিয়া থামিল, তখন বেদনাতুর হৃদয় তাহার অনেকটা শান্ত হইয়া গিয়াছে। সে উঠিয়া বসিয়া ব্যাকুলদৃষ্টিতে দেখিতে লাগিল, যদি কোন স্ত্রীলোক যাত্রী এই দুর্যোগের রাত্রেও তাহার কক্ষে দৈবাৎ পদার্পণ করে। ভিজিতে ভিজিতে কেহ কেহ নামিয়া গেল, কেহ কেহ উঠিলও বটে, কিন্তু তাহার কামরার সন্নিকটেও কেহ আসিল না।
গাড়ি ছাড়িলে শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া সে তাহার জায়গায় ফিরিয়া আসিল এবং আপাদমস্তক আচ্ছাদিত করিয়া পূর্ববৎ শুইয়া পড়িতেই এবার কোন অচিন্তনীয় কারণে তাহার দুঃখার্ত চিত্ত অকস্মাৎ সুখের কল্পনায় ভরিয়া উঠিল। কিন্তু ইহা নতুন নহে; যেদিন বায়ুপরিবর্তনের প্রস্তাব প্রথম উত্থাপিত হয়, সেদিনও সে এমনি স্বপ্নই দেখিয়াছিল। আজও সে তেমনি তাহার রুগ্ন স্বামীকে স্মরণ করিয়া তাঁহারই স্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করিয়া এক অপরিচিত স্থানের মধ্যে আনন্দ ও সুখ-শান্তির জাল বুনিতে বুনিতে বিভোর হইয়া গেল।
কখন এবং কতক্ষণ যে সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, তাহার স্মরণ নাই। সহসা নিজের নাম কানে যাইবামাত্রই সে ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া দেখিল, দ্বারের কাছে সুরেশ দাঁড়াইয়া এবং সেই খোলা দরজার ভিতর দিয়া অজস্র জল-বাতাস ভিতরে ঢুকিয়া প্লাবনের সৃষ্টি করিয়াছে।
সুরেশ চিৎকার করিয়া কহিল, শিগ্‌গির নেমে পড়, প্লাটফর্মে গাড়ি দাঁড়িয়ে। তোমার নিজের ব্যাগটা কোথায়?

অচলার দুই চক্ষে ঘুম তখনও জড়াইয়াছিল, কিন্তু তাহার মনে পড়িল, এলাহাবাদ স্টেশনে জব্বলপুরের গাড়ি বদল করিতে হইবে। সে ব্যাগটা দেখাইয়া দিয়া শশব্যস্তে নামিয়া পড়িয়া ব্যাকুল হইয়া কহিল, কিন্তু এত জলের মধ্যে তাঁকে নামাবে কি করে? এখানে পালকি-টালকি কিছু কি পাওয়া যায় না? নইলে অসুখ যে বেড়ে যাবে সুরেশবাবু।
সুরেশ কি যে জবাব দিল, জলের শব্দে তাহা বুঝা গেল না। সে এক হাতে ব্যাগ ও অপর হস্তে অচলার একটা হাত দৃঢ়মুষ্টিতে চাপিয়া ধরিয়া ও-দিকের প্লাটফর্মের উদ্দেশ্যে দ্রুতবেগে টানিয়া লইয়া চলিল। এই ট্রেনটা ছাড়িবার জন্য প্রস্তুত হইয়া অপেক্ষা করিতেছিল, তাহারই একটা যাত্রিশূন্য ফার্স্টক্লাস কামরার মধ্যে অচলাকে ঠেলিয়া দিয়া সুরেশ তাড়াতাড়ি কহিল, তুমি স্থির হয়ে বসো, তাকে নামিয়ে আনি গে।
তা হলে আমার এই মোটা গায়ের কাপড়টা নিয়ে যাও, তাঁকে বেশ করে ঢেকে এনো। বলিয়া অচলা হাত বাড়াইয়া তাহার গাত্রবস্ত্রটা সুরেশের গায়ের উপর ফেলিয়া দিতেই সে দ্রুতবেগে প্রস্থান করিল।
অন্ধকারে যতদূর দৃষ্টি যায়, অচলা সম্মুখে চাহিয়া দেখিতে লাগিল, পোস্টের উপর দূরে দূরে স্টেশনের লণ্ঠন জ্বলিতেছে; কিন্তু এই প্রচণ্ড জলের মধ্যে যে আলোক এমনি অস্পষ্ট ও অকিঞ্চিৎকর যে, তাহার সাহায্যে কিছুই প্রায় দৃষ্টিগোচর হয় না। জলে ভিজিয়া যাত্রীরা ছুটাছুটি করিতেছে, কুলীরা মোট বহিয়া আনাগোনা করিতেছে, কর্মচারীরা বিব্রত হইয়া উঠিয়াছে—ঝাপসা ছায়ার মত তাহা দেখা যায় মাত্র। ক্রমশঃ তাহাও বিরল হইয়া আসিল, স্টেশনের ঘণ্টা তীক্ষ্ণরবে বাজিয়া উঠিল এবং যে ট্রেন হইতে অচলা এইমাত্র নামিয়া আসিয়াছে, ভীষণ অজগরের ন্যায় ফোঁসফোঁস শব্দে তাহা আকাশ-বাতাস কম্পিত করিয়া প্লাটফর্ম ত্যাগ করিয়া বাহির হইয়া গেল এবং অখণ্ড অন্ধকার ব্যতীত সম্মুখে আর কোন ব্যবধানই রহিল না।
আবার ঘণ্টায় ঘা পড়িল। ইহা যে এ গাড়ির জন্য অচলা তাহা বুঝিল, কিন্তু তাঁহারা উঠিলেন কি না, কোথায় উঠিলেন, জিনিস-পত্র সমস্ত তোলা হইল কি না, না কিছু রহিয়া গেল, কিছুই জানিতে না পারিয়া সে অত্যন্ত চিন্তিত হইয়া উঠিল।
একজন পিয়াদা সর্বাঙ্গে কম্বল ঢাকিয়া নীল লণ্ঠন হাতে বেগে চলিয়াছে। সুমুখে পাইয়া অচলা ডাকিয়া প্রশ্ন করিল, সমস্ত প্যাসেঞ্জার উঠিয়াছে কি না। প্রথম শ্রেণীর কামরা দেখিয়া লোকটা থমকিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, হাঁ মেমসাহেব।
অচলা কতকটা সুস্থির হইয়া সময় জিজ্ঞাসা করায় লোকটা কহিল, নয় বাজকে—
নয় বাজকে? অচলা চমকিয়া উঠিল। কিন্তু এলাহাবাদে পৌঁছিতে ত রাত্রি প্রায় শেষ হইবার কথা। ব্যাকুল হইয়া প্রশ্ন করিল, এলাহাবাদ—
কিন্তু লোকটা আর দাঁড়াইতে পারিতেছিল না। উপরে ছাদ ছিল না, তাই আকাশের বৃষ্টি ছাড়া গাড়ির ছাদ হইতে জল ছিটাইয়া তাহার চোখে-মুখে সূচের মত বিঁধিতেছিল। সে হাতের আলোকটা সবেগে নাড়িয়া দিয়া, মোগলসরাই! মোগলসরাই!—বলিয়া দ্রুতবেগে প্রস্থান করিল।
বাঁশী বাজাইয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিল। এমনি সময়ে সুরেশ তাহার সম্মুখ দিয়া ছুটিতে ছুটিতে বলিয়া গেল—ভয় নেই—আমি পাশের গাড়িতেই আছি।







অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ
সুরেশ পাশের গাড়িতে গিয়া উঠিল সত্য, কিন্তু তিনি? এই ত সে চোখ মেলিয়া নিরন্তর বাহিরের দিকে চাহিয়া আছে—তাঁহার চেহারা, তা সে যত অস্পষ্টই হোক, সে কি একবারও তাহার চোখে পড়িত না? আর এলাহাবাদের পরিবর্তে এই কি-একটা নূতন স্টেশনেই বা গাড়ি বদল করা হইল কিসের জন্য? জলের ছাটে তাহার মাথার চুল, তাহার গায়ের জামা সমস্ত ভিজিয়া উঠিতে লাগিল, তবুও সে খোলা জানালা দিয়া বার বার মুখ বাহির করিয়া একবার সম্মুখে একবার পশ্চাতে অন্ধকারের মধ্যে কি যে দেখিবার চেষ্টা করিতেছিল তাহা সে-ই জানে, কিন্তু এ কথা তাহার মন কিছুতেই স্বীকার করিতে চাহিল না যে, এ গাড়িতে তাহার স্বামী নাই—সে একেবারে অনন্যনির্ভর, একান্ত ও একাকী সুরেশের সহিত কোন এক দিগ্বিহীন নিরুদ্দেশ-যাত্রার পথে বাহির হইয়াছে। এমন হইতে পারে না! এই গাড়িতেই তিনি কোথাও না কোথাও আছেনই আছেন।
সুরেশ যাই হোক, এবং সে যাই করুক, একজন নিরপরাধা রমণীকে তাহার সমাজ হইতে, ধর্ম হইতে, নারীর সমস্ত গৌরব হইতে ভুলাইয়া এই অনিবার্য মৃত্যুর মধ্যে ঠেলিয়া দিবে, এতবড় উন্মাদ সে নয়। বিশেষতঃ ইহাতে তাহার লাভ কি? অচলার যে দেহটার প্রতি তাহার এত লোভ সেই দেহটাকে একটা গণিকার দেহে পরিণত দেখিতে অচলা যে বাঁচিয়া থাকিবে না, এ সোজা কথাটুকু যদি সে না বুঝিয়া থাকে ত ভালবাসার কথা মুখে আনিয়াছিল কোন্‌ মুখে? না না, ইহা হইতেই পারে না! ইঞ্জিনের দিকে কোথাও তিনি তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িয়াছেন, সে দেখিতে পায় নাই।
সহসা একটা প্রবল ঝাপটা তাহার চোখে-মুখে আসিয়া পড়িতেই সে সঙ্কুচিত হইয়া কোণের দিকে সরিয়া আসিল এবং ততক্ষণে নিজের প্রতি চাহিয়া দেখিল, সর্বাঙ্গে শুষ্ক বস্ত্র কোথাও আর এতটুকু অবশিষ্ট নাই। বৃষ্টির জলে এমন করিয়াই ভিজিয়াছে যে, অঞ্চল হইতে, জামার হাতা হইতে টপটপ করিয়া জল ঝরিয়া পড়িতেছে। এই শীতের রাতে সে না জানিয়া যাহা সহিয়াছিল, জানিয়া আর পারিল না এবং কিছু কিছু পরিবর্তন করিবার মানসে কম্পিতহস্তে ব্যাগটা টানিয়া লইয়া যখন চাবি খুলিবার আয়োজন করিতেছে, এমন সময় গাড়ির গতি অতি মন্দ হইয়া আসিল এবং অনতিবিলম্বে তাহা স্টেশনে আসিয়া থামিল। জল সমানে পড়িতেছে, কোন্‌ স্টেশন জানিবার উপায় নাই। তবুও ব্যাগ খোলাই পড়িয়া রহিল, সে ভিতরের অদম্য উদ্বেগের তাড়নায় একেবারে দ্বার খুলিয়া বাহিরে নামিয়া অন্ধকারে আন্দাজ করিয়া ভিজিতে ভিজিতে দ্রুতপদে সুরেশের জানালার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।
চিৎকার করিয়া ডাকিল, সুরেশবাবু!
এই কামরায় জন-দুই বাঙালী ও একজন ইংরাজ ভদ্রলোক ছিলেন। সুরেশ একটা কোণে জড়সড়ভাবে দেওয়ালে ঠেস দিয়া চোখ বুজিয়া বসিয়াছিল। অচলার বোধ করি ভয় ছিল, হয়ত তাহার গলা দিয়া সহজে শব্দ ফুটিবে না। তাই তাহার প্রবল উদ্যমের কণ্ঠস্বর ঠিক যেন আহত জন্তুর তীব্র আর্তনাদের মত শুধু সুরেশকেই নয়, উপস্থিত সকলকেই একেবারে চমকিত করিয়া দিল। অভিভূত সুরেশ চোখ মেলিয়া দেখিল, দ্বারে দাঁড়াইয়া অচলা; তাহার অনাবৃত মুখের উপর একই কালে অজস্র জলধারা এবং গাড়ির উজ্জ্বল আলোক পড়িয়া এমনিই একটা রূপের ইন্দ্রজাল রচনা করিয়াছে যে, সমস্ত লোকের মুগ্ধদৃষ্টি বিস্ময়ে একেবারে নির্বাক হইয়া গিয়াছে। সে ছুটিয়া আসিয়া কাছে দাঁড়াইতেই অচলা প্রশ্ন করিল, তাঁকে দেখচি নে—কৈ তিনি? কোন্‌ গাড়িতে তাঁকে তুলেচ?
চল দেখিয়ে দিচ্চি, বলিয়া সুরেশ বৃষ্টির মধ্যেই নামিয়া পড়িল এবং যেদিক হইতে অচলা আসিয়াছিল, সেইদিক পানেই তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া চলিয়া গেল।

বাঙালী দু’জন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিয়া একটু হাসিল। ইংরাজ কিছুই বুঝে নাই, কিন্তু নারী-কণ্ঠের আকুল প্রশ্ন তাহার মর্ম স্পর্শ করিয়াছিল; সে ভূলুণ্ঠিত কম্বলটা পায়ের উপর টানিয়া লইয়া শুধু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল এবং স্তব্ধমুখে বাহিরের অন্ধকারের প্রতি চাহিয়া রহিল।
অচলার কামরার সম্মুখে আসিয়া সুরেশ থমকিয়া দাঁড়াইল, ভিতরের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া সভয়ে প্রশ্ন করিল, তোমার ব্যাগ খোলা কেন? এবং প্রত্যুত্তরের জন্য এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করিয়া দরজাটা সজোরে ঠেলিয়া দিয়া অচলাকে বলপূর্বক আকর্ষণ করিয়া ভিতরে তুলিয়াই দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল।
সুরেশ অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া কহিল, এটা খুললে কে?
অচলা কহিল, আমি। কিন্তু ও থাক—তিনি কোথায় আমাকে দেখিয়ে দাও—না হয়, শুধু বলে দাও কোন্‌ দিকে, আমি নিজে খুঁজে নিচ্ছি; বলিতে বলিতে সে দ্বারের দিকে পা বাড়াতেই সুরেশ তাহার হাত ধরিয়া ফেলিয়া কহিল, অত ব্যস্ত কেন? গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে দেখতে পাচ্চো?
অচলা বাহিরের অন্ধকারে চাহিয়াই বুঝিল, কথাটা সত্য। গাড়ি চলিতে শুরু করিয়াছে। তাহার দুই চক্ষে নিরাশা যেন মূর্তি ধরিয়া দেখা দিল। সে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া সেই দৃষ্টি দিয়া শুধু পলকের জন্য সুরেশের একান্ত পাণ্ডুর শ্রীহীন মুখের প্রতি চাহিল এবং পরক্ষণেই ছিন্নমূল তরুর ন্যায় সশব্দে মেঝেয় লুটাইয়া পড়িয়া দুই বাহু দিয়া সুরেশের পা জড়াইয়া কাঁদিয়া উঠিল, কোথায় তিনি? তাঁকে কি তুমি ঘুমন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দিয়েচ? রোগা মানুষকে খুন করে তোমার—
এতবড় ভীষণ অভিযোগের শেষটা কিন্তু তখনও শেষ হইতে পাইল না। অকস্মাৎ তাহার বুক-ফাটা কান্না যেন শতধারে ফাটিয়া সুরেশকে একেবারে পাষাণ করিয়া দিয়া চতুর্দিকে ইহারই মত ভয়াবহ এক উন্মত্ত যামিনীর অভ্যন্তরে গিয়া বিলীন হইয়া গেল এবং সেইখানে, সেই গদি-আঁটা বেঞ্চের গায়ে হেলান দিয়া সুরেশ অসহ্য বিস্ময়ে শুধু স্তব্ধ হইয়া চাহিয়া রহিল। তার পরে তাহার পদতলে কি যে ঘটিতেছিল, কিছুক্ষণ পর্যন্ত তাহা যেন উপলব্ধি করিতেই পারিল না। অনেকক্ষণ পরে সে পা-দুটা টানিয়া লইবার চেষ্টা করিয়া ধীরে ধীরে কহিল, এ কাজ আমি পারি বলে তোমার বিশ্বাস হয়?
অচলা তেমনি কাঁদিতে কাঁদিতে জবাব দিল, তুমি সব পারো। আমাদের ঘরে আগুন দিয়ে তুমি তাঁকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলে। তুমি কোথায় কি করেচ, তোমার পায়ে পড়ি, আমাকে বল; বলিয়া সে আর একবার তাহার পা-দুটা ধরিয়া তাহারই পরে সজোরে মাথা কুটিতে লাগিল। কিন্তু পা-দুটা যাহার, সে কিন্তু একেবারে অবশ অচেতনের ন্যায় কেবল নিঃশব্দে চোখ মেলিয়া চাহিল।
বাহিরে মত্ত রাত্রি তেমনি দাপাদাপি করিতে লাগিল, আকাশের বিদ্যুৎ তেমনি বারংবার অন্ধকার চিরিয়া খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিতে লাগিল, উচ্ছৃঙ্খল ঝড়-জল তেমনিভাবেই সমস্ত পৃথিবী লণ্ডভণ্ড করিয়া দিতে লাগিল, কিন্তু এই দুটি অভিশপ্ত নর-নারীর অন্ধ-হৃদয়তলে যে প্রলয় গর্জিয়া ফিরিতে লাগিল, তাহার কাছে এ-সমস্ত একেবারে তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর হইয়া বাহিরেই পড়িয়া রহিল।
সহসা অচলা তাহার ভূ-শয্যা ছাড়িয়া তীরবেগে উঠিয়া দাঁড়াতেই সুরেশের যেন স্বপ্ন ছুটিয়া গেল। সে চাহিয়া দেখিল, পরের স্টেশন সন্নিকটবর্তী হওয়ায় গাড়ির বেগ হ্রাস হইয়া আসিয়াছে। অচলা কেন যে এমন করিয়া দাঁড়াইল, তাহা বুঝিতে বিলম্ব হইল না। প্রবল চেষ্টায় আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়া সুরেশ ডান হাত বাড়াইয়া তাহাকে বাধা দিয়া বলিল, বস। মহিম এ গাড়িতে নেই।

নেই! তবে কোথায় তিনি? বলিতে বিলিতে অচলা সম্মুখের বেঞ্চের উপর ধপ করিয়া বসিয়া পড়িল।
সুরেশ লক্ষ্য করিয়া দেখিল তাহার মুখের উপর হইতে রক্তের শেষ চিহ্নটুকু পর্যন্ত বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। বোধ করি, এতক্ষণের এত কান্নাকাটি, এত মাথা-কোটাকুটির মধ্যেও হৃদয়ে, তাহার সমস্ত প্রতিকূল যুক্তির বিরুদ্ধেও একপ্রকার অব্যক্ত অন্তর্নিহিত আশা ছিল, হয়ত এ-সকল আশঙ্কা সত্য নহে, হয়ত প্রচণ্ড দুঃস্বপ্নের দুঃসহ বেদনা ঘুমভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে ই শুধু কেবল একটা দীর্ঘনিশ্বাসেই অবসান হইয়া গিয়া পুলকে সমস্ত চরাচর রাঙা হইয়া উঠিবে। এমনি কিছু একটা অচিন্তনীয় পদার্থ হয়ত তখনও তাহার আগাগোড়া বুক খালি করিয়া দিয়া বিদায় গ্রহণ করে নাই। কেননা, এই ত তখন পর্যন্তও তাহার সংসারে যাহা-কিছু কামনার সমস্ত বজায় ছিল; অথচ একটা রাত্রিও পোহাইল না, আর তাহার কিছু নাই—একেবারে কিছু নাই। চক্ষের পলক ফেলিতে না ফেলিতে জীবনটা একেবারে দুর্ভাগ্যের শেষ-সীমা ডিঙাইয়া বাহির হইয়া গেল! এতবড় পরিমাণবিহীন বিপত্তিতে তাহার বাঁচিয়া থাকাটাই বোধ করি কোনমতে বিশ্বাস করিতে পারিতেছিল না। উভয়ে স্থির হইয়া বসিয়া রহিল। গাড়ি আসিয়া একটা অজানা স্টেশনে লাগিল এবং অল্পকাল পরে ছাড়িয়া চলিয়া গেল।
সুরেশ একবার কি একটা বলিবার চেষ্টা করিয়া আবার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া এবার উঠিয়া দাঁড়াইল, এবং জানালার কাচ তুলিয়া দিয়া কয়েকবার পায়চারি করিয়া সহসা অচলার সম্মুখে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া কহিল, মহিম ভাল আছে। এতক্ষণে বোধ হয় সে এলাহাবাদে পৌঁছেছে। একটুখানি থামিয়া বলিল, ওখান থেকে জব্বলপুরেও যেতে পারে, কলকাতায়ও ফিরে আসতে পারে।
অচলা ধীরে ধীরে মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
সেই অশ্রু-কলঙ্কিত মুখের উপর দুঃখ-নিরাশার চরম প্রতিমূর্তি আর-একবার সুরেশের চোখে পড়িল। তাহার ভুল যে কত বড় হইয়া গিয়াছে, এ কথা আর তাহার অগোচর ছিল না এবং ইহার জন্য আজ সে নিজেকে হত্যা করিয়া ফেলিতেও পারিত। কিন্তু যাহার সহস্র ছলনা তাহার সত্য দৃষ্টিকে এমন করিয়া আবৃত করিয়া এই ভুলের মধ্যেই বারংবার অঙ্গুলি-নির্দেশ করিয়াছে, সেই ছলনাময়ীর বিরুদ্ধেও তাহার সমস্ত অন্তর একেবারে বিষাক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। তাই আজ সে অচলার জিজ্ঞাসার উত্তরে তিক্তস্বরে বলিয়া উঠিল, বোধ হয় আমরা সশরীরে নরকেই যাচ্চি। যে অধঃপথে পথ দেখিয়ে এতদূর পর্যন্ত টেনে এনেচ, তার মাঝখানে ত ইচ্ছে করলেই দাঁড়াবার জায়গা পাওয়া যাবে না! এখন শেষ পর্যন্ত যেতেই হবে।
কথা শুনিয়া অচলার আপাদমস্তক একবার কাঁপিয়া উঠিল, তার পরে সে নিরুত্তরে মাথা হেঁট করিয়া রহিল। যে মিথ্যাচারী কাপুরুষ পরস্ত্রীকে এমন করিয়া বিপথে ভুলাইয়া আনিয়াও অসঙ্কোচে এত বড় নির্লজ্জ অপবাদ মুখ দিয়া উচ্চারণ করিতে পারে, তাহাকে বলিবার আর কাহার কি থাকে!
সুরেশ আবার পায়চারি করিতে লাগিল। বোধ হয় এই পাষাণ-প্রতিমার সুমুখে দাঁড়াইয়া কথা কহিবার তাহার শক্তি ছিল না। বলিতে লাগিল, তুমি এমন ভাব দেখাচ্ছ, যেন একা তোমারই সর্বনাশ! কিন্তু সর্বনাশ বলতে যা বোঝায়, তা আমার পক্ষে কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে জানো? আমি তোমাদের মত ব্রহ্মজ্ঞানী নই, আমি নাস্তিক। আমি পাপপুণ্যের ফাঁকা আওয়াজ করিনে, আমি নিরেট সত্যিকার সর্বনাশের কথাই ভাবি। তোমার রূপ আছে, চোখের জল আছে, মেয়েমানুষের যা-কিছু অস্ত্র-শস্ত্র তোমার তূণে সে-সব প্রয়োজনেরও অতিরিক্ত আছে, তোমার কোন পথেই বাধা পড়বে না। কিন্তু আমার পরিণাম কল্পনা করতে পারো? আমি পুরুষমানুষ—তাই আমাকে জেলের পথ বন্ধ করতে নিজের হাতে এইখানে গুলি করতে হবে। বলিয়া সুরেশ থমকিয়া দাঁড়াইয়া বুকের মাঝখানে হাত দিয়া দেখাইল।

অচলা কি একটা বলিতে উদ্যত হইয়া মুখ তুলিয়াও নিঃশব্দে মুখ ফিরাইয়া লইল। কিন্তু তাহার চোখের দৃষ্টিতে ঘৃণা যে উপচাইয়া পড়িতেছিল, তাহা দেখিতে পাইয়া সুরেশ ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিয়া কহিল, ময়ূরপুচ্ছ পাখায় গুঁজে দাঁড়কাক কখনো ময়ূর হয় না অচলা। ও চাহনি আমি চিনি, কিন্তু সে তোমাকে সাজে না। যাকে সাজতো, সে মৃণাল, তুমি নয়! তুমি অসূর্যস্পশ্যা হিন্দুর ঘরের কুলবধূ নও, এতটুকুতে তোমাদের জাত যাবে না। তুমি যেখানে খুশি নেমে চলে যাও। আমি চিঠি লিখি দিচ্ছি, মহিমকে দেখিও, সে ঘরে নেবে। টাকা দিচ্চি, তোমার বাপকে দিয়ো—তাঁর মুখ বন্ধ হয়ে যাবে। তোমার চিন্তা কি অচলা, এ এমনি কি বেশি অপরাধ?
সে আবার পায়চারি করিতে লাগিল, একবার চাহিয়াও দেখিল না, তাহার জ্বলন্ত শূল কোথায় কি কাজ করিল। খাবারের লোভে বন্যপশু ফাঁদে পড়িয়া অন্ধ ক্রোধে যাহা পায় তাহাই যেমন নিষ্ঠুর দংশনে ছিঁড়িতে থাকে, ঠিক সেইভাবে সুরেশ অচলাকে একেবারে যেন টুকরা টুকরা করিয়া ফেলিতে চাহিল। হঠাৎ মাঝখানে দাঁড়াইয়া পড়িয়া কহিল, এ এমনি কি ভয়ানক অপরাধ? স্বামীর ঘরে দাঁড়িয়ে তাঁর মুখের উপরে বলেছিলে, একজন পরপুরুষকে ভালবাস—সে কি ভুলে গেছ? যে লোক ঘরে আগুন দিয়ে তোমার স্বামীকে পোড়াতে চেয়েছিল বলে তোমার বিশ্বাস, তার সঙ্গেই চলে আসতে চেয়েছিলে এবং এলেও তাই; স্মরণ হয়? তার ঘরে, তার আশ্রয়ে বাস করে গোপনে কেঁদে তাকেই সঙ্গে আসতে সেধেছিলে মনে পড়ে? তার চেয়েও কি এটা বেশি অপরাধ? আরও কত-কি প্রতিদিনের অসংখ্য খুঁটিনাটি! তাই আজ আমার এত সাহস! আসলে তুমি একটা গণিকা, তাই তোমাকে ভুলিয়ে এনেচি। ভেবেছিলুম, প্রথমে একটুখানি চমকে উঠবে মাত্র। তার বেশি তোমার কাছে আশা করিনি। তোমাকে বার বার বলে দিচ্চি অচলা, তুমি সতী-সাবিত্রী নও। সে তেজ, সে দর্প তোমার সাজে না, মানায় না—সে তোমার একান্ত অনধিকারচর্চা! বলিয়া সুরেশ রুদ্ধশ্বাসে নির্জীব হইয়া থামিতেই অচলা মুখ তুলিয়া ভগ্নকণ্ঠে চিৎকার করিয়া উঠিল, আপনি থামবেন না সুরেশবাবু, আরও বলুন। আমাকে দুই পায়ে মাড়িয়ে মাড়িয়ে সংসারে যত কটু কথা, যত কুৎসিত বিদ্রূপ, যত অপমান আছে, সব করুন; বলিয়া মেঝের উপর অকস্মাৎ উপুড় হইয়া পড়িয়া অবরুদ্ধ রোদনের বিদীর্ণ-স্বরে বলিতে লাগিল, এই আমি চাই, এই আমার দরকার! এই আমাদের সত্যিকার সম্বন্ধ! পৃথিবীর কাছে, ভগবানের কাছে, আপনার কাছে এই আমার একমাত্র প্রাপ্য।
সুরেশ দেয়ালে ঠেস দিয়া কাঠ হইয়া চাহিয়া রহিল। অচলার সুদীর্ঘ কেশভার স্রস্তবিপর্যস্ত হইয়া মাটিতে লুটাইতে লাগিল, তাহার জলসিক্ত গাত্রবাস ধূলায় কাদায় মলিন কদর্য হইয়া উঠিল, কিন্তু সেদিকে সুরেশ পা বাড়াইতে পারিল না। নূতন শিকারী তাহার প্রথম ভূপতিত পক্ষিণীর মৃত্যুযন্ত্রণা যেমন অবাক হইয়া চাহিয়া দেখে, তেমনি দুই মুগ্ধ চক্ষের অপলক দৃষ্টি দিয়া সে কোন এক মরণাহত নারীর শেষ মুহূর্তের সাক্ষ্য লইতে দাঁড়াইয়া রহিল।

আবার গাড়ির গতি মন্দ হইতে মন্দতর হইয়া ধীরে ধীরে স্টেশনে আসিয়া থামিল। সুরেশ সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া শান্ত সহজ গলায় বলিল, লোকে তোমাকে এ অবস্থায় দেখলে আশ্চর্য হয়ে যাবে। তুমি উঠে বসো, আমি আমার ঘরে চললুম। সকাল হলে তুমি যেখানে নামতে চাইবে আমি নামিয়ে দেব, যেখানে যেতে চাইবে, আমি পাঠিয়ে দেব। ইতিমধ্যে ভয়ঙ্কর কিছু একটা করবার চেষ্টা করো না, তাতে কোনো ফল হবে না। বলিয়া সুরেশ কপাট খুলিয়া নীচে নামিয়া গেল এবং সাবধানে তাহা বন্ধ করিয়া কি ভাবিয়া ক্ষণকাল চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার পরে মুখ বাড়াইয়া কহিল, তুমি আমার কথা বুঝবে না, কিন্তু এইটুকু শুনে রাখো যে, এ সমস্যার মীমাংসার ভার আমি নিলুম। আর তোমার কোন অমঙ্গল ঘটতে দেব না—এর সমস্ত ঋণ আমি কড়ায় গণ্ডায় পরিশোধ করে যাবো, বলিয়া সে ধীরে ধীরে তাহার নিজের কামরার দিকে প্রস্থান করিল।
ট্রেনের টানা ও একঘেয়ে শব্দের বিরামের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবারেই সুরেশের তন্দ্রা ভাঙ্গিতেছিল বটে, কিন্তু চোখের পাতার ভার ঠেলিয়া চাহিয়া দেখিবার শক্তি আর যেন তাহাতে ছিল না। ভিজা কাপড়ে তাহার অত্যন্ত শীত করিতেছিল, বস্তুতঃ সে যে অসুখে পড়িতে পারে এবং বর্তমান অবস্থায় সে যে কি ভীষণ ব্যাপার, ইহা ভিতরে ভিতরে অনুভব করিতেও ছিল, কিন্তু ব্যাগ খুলিয়া বস্ত্রপরিবর্তনের উদ্যম একটা অসাধ্য অভিলাষের মতই তাহার মনের মধ্যে অসাড় হইয়া পড়িয়াছিল। ঠিক এমনি সময়ে তাহার কানে গিয়া একটা সুপরিচিত কণ্ঠের ডাক পৌঁছিল—কুলী! কুলী! সে অর্ধসজাগভাবে চোখ মেলিয়া দেখিল, গাড়ি কোন্‌ একটা স্টেশনে থামিয়া আছে, এবং কখন অন্ধকার কাটিয়া গিয়া ক্ষান্তবর্ষণ ধূসর মেঘের মধ্য দিয়া একপ্রকারের ঘোলাটে আলোকে সমস্ত স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। দেখিতে পাইল, অনেকে নামিতেছে, অনেকে চড়িতেছে, এবং তাহারই মাঝখানে দাঁড়াইয়া একটি শোকাচ্ছন্ন রমণীমূর্তি কিসের তরে আগ্রহে প্রতীক্ষা করিয়া আছে। এ অচলা। একজন কুলী ঘাড়ে একটা মস্ত চামড়ার ব্যাগ লইয়া গাড়ি হইতে নামিয়া আসিয়া কাছে দাঁড়াইতে সে তাহাকে কি-একটা জিজ্ঞাসা করিয়া গেটের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হইল।
এতক্ষণ পর্যন্ত সুরেশ নিশ্চেষ্টভাবে শুধু চাহিয়াই ছিল। বোধ হয় তাহার চোখের দেখা ভিতরে ঢুকিবার পথ পাইতেছিল না। কিন্তু গাড়ি ছাড়িবার বেলের শব্দ প্লাটফর্মের কোন এক প্রান্ত হইতে সহসা ধ্বনিয়া উঠিয়া তড়িৎস্পর্শের মত তাহার অন্তর-বাহিরকে একমুহূর্তে এক করিয়া তাহার সমস্ত জড়িমা ঘুচাইয়া দিল, এবং পলকের মধ্যে নিজের ব্যাগটা টানিয়া লইয়া দ্বার খুলিয়া বাহিরে আসিয়া পড়িল।
টিকিটের কথা অচলার মনেই ছিল না। সে দ্বারের মুখে টিকিটবাবুকে দেখিয়া থমকিয়া দাঁড়াইতেই সুরেশ পিছন হইতে স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিল, দাঁড়িয়ো না, চল আমি টিকিট দিচ্ছি।
তাহার আগমন অচলা টের পায় নাই। মুহূর্তের জন্য কুণ্ঠায় ভয়ে তাহার পা উঠিল না, কিন্তু এই সঙ্কোচ অপরের লক্ষ্য-বিষয়ীভূত হওয়ার পূর্বেই সে আস্তে আস্তে বাহির হইয়া আসিল।

বাহিরে আসিয়া উভয়ের নিম্নলিখিত মত কথার্বাতা হইল।
সুরেশ কহিল, আমি ভেবেছিলাম, তুমি সোজা কলকাতাতেই ফিরে যেতে চাইবে, হঠাৎ এই ডিহরীতে নেমে পড়লে কেন? এখানে কি পরিচিত কেউ আছেন?
অচলা অন্যদিকে চাহিয়াছিল, সেইদিকে চাহিয়াই জবাব দিল, কলকাতায় আমি কার কাছে যাবো?
কিন্তু এখানে?
অচলা চুপ করিয়া রহিল।
সুরেশ নিজেও কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া বলিল, আমার কোন কথা হয়ত আর তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না, আর সেজন্য আমার নালিশও কিছু নেই, আমি কেবল তোমার কাছে শেষ সময়ে কিছু ভিক্ষা চাই।
অচলা তেমনি নীরবে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
সুরেশ কহিল, আমার কথা কাউকে বোঝাবারও নয়, আমি বোঝাতেও চাইনে। আমার জিনিস আমার সঙ্গেই যাক। যেখানে গেলে এখানের আগুন আর পোড়াতে পারবে না, আমি সেই দেশের জন্যই আজ পথ ধরলুম, কিন্তু আমার শেষ সম্বলটুকু আমাকে দাও, আমি হাতজোড় করে তোমার কাছে এই প্রার্থনা জানাচ্ছি।
তথাপি অচলার মুখ দিয়া একটা কথাও বাহির হইল না।
সুরেশ কহিতে লাগিল, আমি নিজে তোমাকে অনেক কটু কথা বলেচি, অনেক দুঃখ দিয়েচি; কিন্তু পরে যে ভাল থাকার দম্ভে ওপরে বসে তোমার মাথায় কলঙ্কের কালি ছিটিয়ে কালো করে তুলবে, সে আমি মরেও সইতে পারবো না। আমার জন্যে তোমাকে আর দুঃখ না পেতে হয়, বিদায় হবার আগে আমাকে এইটুকু সুযোগ ভিক্ষে দিয়ে যাও অচলা।
তাহার কণ্ঠস্বরে কি যে ছিল, তাহা অন্তর্যামীই জানেন, অকস্মাৎ তপ্ত-অশ্রুতে অচলার দুই চক্ষু ভাসিয়া গেল। কিন্তু তবুও সে নিজের কণ্ঠ প্রাণপণে অবিকৃত রাখিয়া মৃদুস্বরে শুধু জিজ্ঞাসা করিল, আমাকে কি করতে হবে বলুন?
সুরেশ পকেট হইতে টাইম-টেবিলখানা বাহির করিয়া গাড়ির সময়টা দেখিয়া লইয়া কহিল, তোমাকে কিছুই করতে হবে না। কিন্তু সন্ধ্যার আগে যখন কোনদিকে যাবারই উপায় নেই, তখন এইটুকু কাল আর আমাকে বিশ্বাস করো না, এই শুধু আমি চাই। আমা হতে তোমার আর কোন অকল্যাণ হবে না, এ কথা তোমার নাম করেই আজ আমি শপথ করচি।
প্রত্যুত্তরে সে কোন কথাই কহিল না, কিন্তু সে যে সম্মত হইয়াছে তাহা বুঝা গেল।
লোকে দৃষ্টি এবং কৌতূহল আকর্ষণ করিবার আশঙ্কায় স্টেশনে ফিরিয়া তাহার ক্ষুদ্র বসিবার ঘরে গিয়া অপেক্ষা করিতে দু’জনের কাহারও প্রবৃত্তি হইল না। সন্ধান লইয়া জানা গেল, বড় রাস্তার উপরে সম্রাট শের শাহের নামে প্রচলিত সরাইয়ের অস্তিত্ব আজিও একেবারে বিলুপ্ত হয় নাই। শহরের একপ্রান্তে তাহারই একটার উদ্দেশে দু’জনে ক্ষণকালের জন্য নিজেদের মর্মান্তিক দুঃখ বিস্মৃত হইয়া একখানা গরুর গাড়ি করিয়া যাত্রা করিল।

পথে কেহ কাহারও সহিত বাক্যালাপ করিল না, কেহ কাহারও মুখের প্রতিও চাহিয়া দেখিল না। শুধু গো-শকট আসিয়া যখন সরাইয়ের প্রাঙ্গণে থামিল, তখন নামিতে গিয়া পলকের জন্য সুরেশের মুখের প্রতি অচলার দৃষ্টি পড়িয়া মনে মনে শুধু কেবল আশ্চর্য নয়, উদ্বিগ্ন হইল। তাহার দুই চোখ ভয়ানক রাঙ্গা অথচ মুখের উপর কিসে যেন কালি মাখাইয়া দিয়াছে। সংসারের অনেক ঝড়ঝাপটের মধ্যেই সে তাহাকে দেখিয়াছে, কিন্তু তাহার এ মূর্তি সে আর কখনও দেখিয়াছে বলিয়া স্মরণ করিতে পারিল না।
গাড়োয়ানকে ভাড়া দিয়া বিদায় করিয়া সুরেশ মনি-ব্যাগটা সেখানে রাখিয়া দিয়া বলিল, এটা আপাততঃ তোমার কাছে রইল, যদি কিছু দরকার মনে হয়, নিতে লজ্জা করো না।
অচলার ইচ্ছা হইল, জিজ্ঞাসা করে, এ কথার অর্থ কি? কিন্তু পারিল না।
সুরেশ কহিল, এই সুমুখের ঘরটাই সম্ভবতঃ কিছু ভালো, তুমি একটুখানি বিশ্রাম কর, আমি পাশের কোন একটা ঘর থেকে এই জামাকাপড়গুলো ছেড়ে আসি। কি জানি, এইগুলোর জন্যেই বোধ করি এ-রকম বিশ্রী ঠেকচে; বলিয়া সে অচলার সুবিধা-অসুবিধার প্রতি আর লেশমাত্র দৃষ্টিপাত না করিয়া নিজের ব্যাগটা হাতে লইয়া ঠিক মাতালের মত টলিয়া টলিয়া বারান্দা পার হইয়া কোণের ঘরে গিয়া প্রবেশ করিল।
সে চলিয়া গেলে অচলা একাকী পথের ধারে দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিল না। তাই সে অনেক কষ্টে নিজের ভারী ব্যাগটা টানিয়া টানিয়া সম্মুখের ঘরের মধ্যে আনিয়া ফেলিল, এবং তাহারই উপরে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রাস্তার উপরে লোক-চলাচল দেখিতে লাগিল।






ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ
সেই ঘরের সম্মুখে ব্যাগের উপরে বসিয়া আশা ও আশ্বাসের স্বপ্ন দেখিয়া অচলার কোথায় দিয়া যে দুই ঘণ্টা অতিবাহিত হইয়া গেল, তাহা সে জানিতে পারিল না। কিছুক্ষণ সূর্য উঠিয়াছে। শীতের দিনের ধূলি-ধূসরিত তরুশ্রেণী কল্যকার ঝড়-জলে স্নাত ও নির্মল হইয়া প্রভাতসূর্যকিরণে ঝলমল করিতেছে। সিক্ত-স্নিগ্ধ রাজপথের উপর দিয়া বিগত-ক্লেশ পান্থ প্রফুল্লমুখে চলিতে শুরু করিয়াছে; কদাচিৎ দুই-একটা এক্কাগাড়ি ছোট ছোট ঘণ্টার শব্দে চারিদিক মুখরিত করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে; মাঝে মাঝে রাখাল-বালকেরা গো-মহিষের দল লইয়া অদ্ভুত ও অসম্ভব আত্মীয়সম্বন্ধের অস্তিত্ব উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করিয়া কোন গ্রামপ্রান্তে যাত্রা করিয়াছে; অদূরবর্তী কোন এক কুটির হইতে গমভাঙ্গা যাঁতার শব্দে মিশিয়া হিন্দুস্থানী গৃহস্থ-বধূর অশ্রান্ত অপরিচিত সুর ভাসিয়া আসিতেছে। সবসুদ্ধ লইয়া এই যে একটি নূতন দিনের কর্মস্রোত তাহার চেতনায় ধীরে ধীরে গতিশীল হইয়া উঠিতেছিল, ইহারই বিচিত্র প্রবাহে তাহার দুঃখ, তাহার দুর্ভাগ্য, তাহার দুশ্চিন্তা কিছুক্ষণের নিমিত্ত কোথায় যেন ভাসিয়া গিয়াছিল। ঠিক কিসের জন্য, কেন সে এখানে এভাবে বসিয়া, তাহার স্মরণ ছিল না। অকস্মাৎ মনে পড়িল জন-দুই পল্লী বালকের বিস্মিত দৃষ্টিপাতে! তাহারা আঙ্গিনার একপ্রান্ত হইতে শুধু বিস্ফারিতচক্ষে নিঃশব্দে চাহিয়াছিল। এই জীর্ণ মলিন পান্থশালার প্রাচীন দিনের গৌরব-ইতিহাস ছেলে-দুটার জানা ছিল না; কিন্তু তাহাদের জ্ঞান হওয়া অবধি এরূপ বিশিষ্ট অতিথির সমাগম যে এ গৃহে কখনো ঘটে নাই, তাহাদের নীরব চোখের চাহনি সে কথা স্পষ্ট করিয়া অচলাকে জানাইয়া দিল। ঘুম ভাঙ্গিয়া নিত্য-নিয়মিত খেলা করিতে আসিয়া আজ সহসা এই আশ্চর্য ব্যাপার তাহাদের চোখে পড়িয়া গিয়াছে।
অচলা চমকিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বোধ হয় কিছু প্রশ্ন করিতে চাহিয়াছিল, কিন্তু ছেলে-দুটা নিমিষে অন্তর্ধান হইয়া গেল। কিন্তু সেই মুহূর্তে তাহার মনে পড়িল, প্রায় ঘণ্টা-দুই পূর্বে সেই যে সুরেশ কাপড় ছাড়িবার নাম করিয়া পাশের ঘরে গিয়া প্রবেশ করিয়াছে, আর দেখা দেয় নাই। এতক্ষণ ধরিয়া সে একাকী কি করিতেছে জানিবার জন্য সে তখন ধীরে ধীরে অগ্রসর হইয়া সেই কক্ষের সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইল এবং অবরুদ্ধ কবাটের ভিতর হইতে কোনপ্রকার সাড়া-শব্দ না পাইয়া সে মিনিট-দুই চুপ করিয়া থাকিয়া তাহার পর আস্তে আস্তে দ্বার ঠেলিয়া সামনেই যাহা দেখিতে পাইল তাহাতে একই কালে মুক্তির তীব্র আবেগে ও বিকট ভয়ে ক্ষণকালের নিমিত্ত তাহার সমস্ত দেহমন যেন পাষাণ হইয়া গেল। ঘরটা অন্ধকার, শুধু ওদিকের একটা ভাঙ্গা জানালা দিয়া খানিকটা আলো ঢুকিয়া মেঝের উপর পড়িয়াছে। সেইখানে আলো-আঁধারের মধ্যে একান্ত অপরিচ্ছন্ন ধূলা-বালির উপরে সুরেশ চিত হইয়া শুইয়া আছে। তাহার গায়ে তখনো সেই-সব জামা-কাপড়, শুধু কেবল খোলা ব্যাগটার ভিতর হইতে কতকগুলা জিনিসপত্র ইতস্ততঃ ছড়ানো।
চক্ষের পলকে তাহার শেষ-কথাগুলা অচলার মনে পড়িল; সে ডাক্তার, সে শুধু মানুষের জীবনটা ধরিয়া রাখিবার বিদ্যাই শিখিয়াছিল, তাহা নয়, তাহাকে নিঃশব্দে বাহির করিয়া দিবার কৌশলও তাহার অবিদিত ছিল না। মনে পড়িল, নিদারুণ ভুলের জন্য তাহার সেই উৎকট আত্মগ্লানি; মনে পড়িল, তাহার সেই বিদায় চাওয়া, সেই আশ্বাস দেওয়া—সর্বোপরি তাহার সেই বারংবার প্রায়শ্চিত্ত করার নিষ্ঠুর ইঙ্গিত; সমস্তই একসঙ্গে এক নিশ্বাসে যেন ওই অবলুণ্ঠিত দেহটার কেবল একটিমাত্র পরিণামের কথাই তাহার কানে কানে কহিয়া দিল। সেইখানে সেই দ্বার ধরিয়া সে ধীরে ধীরে বসিয়া পড়িল—তাহার এমন সাহস হইল না যে, আর ঘরে প্রবেশ করে।

কিন্তু এইবার ওই অচেতন দেহটার প্রতি চাহিয়া তাহার দুই চক্ষু ফাটিয়া জল বাহির হইয়া পড়িল। যে তাহারই জন্য এত বড় দুর্নামের বোঝা মাথায় লইয়া হতাশ্বাসে এমন করিয়া এই পৃথিবী হইতে চিরদিনের তরে বিদায় লইয়া গেল, অপরাধ তাহার যত গুরুতরই হোক, তাহাকে মার্জনা করিতে পারে না, এত বড় কঠিন হৃদয় সংসারে অল্পই আছে, এবং আজই প্রথম তাহার কাছে তাহার নিজের অপরাধও সুস্পষ্ট হইয়া দেখা দিল।
সুরেশের সহিত সেই প্রথম দিনের পরিচয় হইতে সেদিন পর্যন্ত যতকিছু কামনা-বাসনা, যত ভুলভ্রান্তি, যত মোহ, যত ছলনা, যত আগ্রহ-আবেগ উভয়ের মধ্য দিয়া বহিয়া গিয়াছে, সমস্তই একে একে ফিরিয়া ফিরিয়া দেখা দিতে লাগিল। তাহার নিজের আচরণ, তাহার পিতার আচরণ—অকস্মাৎ সর্বাঙ্গ শিহরিয়া মনে হইল, শুধু কেবল নিজের নয়, অনেকের অনেক পাতকের গুরুভার বহন করিয়াই আজ সুরেশ যে বিচারকের পদপ্রান্তে গিয়া উপনীত হইয়াছে, সেখানে সে নিঃশব্দে মুখ বুজিয়া সমস্ত শাস্তি স্বীকার করিয়া লইবে, কিংবা একটি একটি করিয়া সকল দুঃখ অভিযোগ ব্যক্ত করিয়া তাঁহার ক্ষমা ভিক্ষা চাহিবে!
ওই লোকটির সংসারে উপভোগ করিবার অনেক সাজ-সরঞ্জাম, অনেক উপকরণই সঞ্চিত ছিল, তথাপি এই যে নীরবে, লেশমাত্র আড়ম্বর না করিয়া সমস্ত পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল, ইহার গভীর বেদনা অচলাকে আজ ফিরিয়া ফিরিয়া বিদ্ধ করিতে লাগিল। সে যে যথার্থই প্রাণ দিয়া ভালবাসিয়াছিল, সে কথা আজ ওই মৃত্যুর সম্মুখে দাঁড়াইয়া প্রশ্ন করিবার, অবিশ্বাস করিবার আর এতটুকু অবকাশ রহিল না।

আবার তাহার দুই গণ্ড বাহিয়া দরদর ধারে অশ্রু বহিতে লাগিল। গতরাত্রে গাড়ির মধ্যে তাহাদের বিস্তর কঠিন কটু কথা, বিস্তর ধর্মাধর্ম, ন্যায়-অন্যায়ের বিতর্ক হইয়া গিয়াছে। কিন্তু সে-সকল যে কত বড় অর্থহীন প্রলাপ, অচলা তখন তাহার কি জানিত। ভালবাসার যে জাতি নাই, ধর্ম নাই, বিচার-বিবেক ভালমন্দ-বোধ কিছুই নাই, যে এমন করিয়া মরিতে পারে, সে যে এই-সব সমাজের হাতেগড়া আইন-কানুনের অনেক উপরে, এ-সকল বিধিনিষেধ যে তাহাকে স্পর্শ করিতে পারে না, এই মরণের সম্মুখে দাঁড়াইয়া আজ এ কথা সে অস্বীকার করিবে কেমন করিয়া?
অচলা আঁচল দিয়া চোখ মুছিতেছিল, সহসা তাহার বুকের ভিতরটা ছ্যাঁত করিয়া মনে হইল, মৃতদেহটা যেন একটুখানি নড়িয়া উঠিল, এবং পরক্ষণেই একটা অস্ফুট আর্তস্বরের সঙ্গে সুরেশ পাশ ফিরিয়া শুইল। সে মরে নাই—জীবিত আছে; একটা প্রচণ্ড আগ্রহবেগে অচলা ছুটিয়া গিয়া তাহার কাছে পড়িল এবং ভগ্নকণ্ঠে কহিল, সুরেশবাবু!
আহ্বান শুনিয়া সুরেশ দুই আরক্ত চক্ষু মেলিয়া চাহিল, কিন্তু কথা কহিল না।

অচলা আর কোন কথা বলিতে পারিল না, শুধু অদম্য বাষ্পোচ্ছ্বাস তাহার কণ্ঠরোধ করিয়া অশ্রুর আকারে দুই চক্ষু দিয়া নিরন্তর ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। কিন্তু মুহূর্ত পূর্বের অশ্রুর সহিত এ অশ্রুর কতই না প্রভেদ!
অথচ তাহার সকল চিন্তার মধ্যে যে চিন্তাটা ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত সংগোপনে পীড়া দিতেছিল, তাহা ইহার বাস্তব দিকটা। এই অজানা অপরিচিত স্থানে সুরেশের মৃতদেহ লইয়া সে কি উপায় করিবে, কাহাকে ডাকিবে, কাহাকে বলিবে—হয়ত অনেক অপ্রীতিকর আলোচনা, অনেক কুৎসিত প্রশ্ন উঠিবে—সে তাহার কাহাকে কি জবাব দিবে, হয়ত পুলিশে টানাটানি করিয়া সকল কথা বাহির করিয়া আনিবে—সেই-সকল অনাবৃত প্রকাশ্যতার লজ্জায় তাহার সমস্ত দেহ-মন যে অন্তরে অন্তরে পীড়িত, কিরূপ ক্লিষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল, তাহার সমস্তটা বোধ করি সে নিজেও সম্পূর্ণ উপলব্ধি করে নাই। এখন সেই বিপদের অপরিমেয় লাঞ্ছনা হইতে অকস্মাৎ অব্যাহতি পাইয়া তাহার কান্না যেন আর থামিতে চাহিল না, এবং সে মরে নাই, শুধু ইহাতে তাহার প্রতি অচলার সমস্ত হৃদয় কানায় কানায় কৃতজ্ঞতায় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।
কিছুক্ষণ এইভাবে কাটিলে সুরেশ ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিল, কাঁদছ কেন অচলা?
অচলা ভগ্নকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, কেন তুমি এমন করে শুয়ে রইলে? কেন গেলে না? কেন আমাকে এত ভয় দেখালে?
তাহার কণ্ঠস্বরে যে স্নেহ উদ্বেলিত হইয়া উঠিল, তাহা এমনই করুণ, এমনই মধুর যে, শুধু সুরেশের নয়, অচলার নিজের মধ্যেও কেমন একপ্রকার মোহের সঞ্চার করিল। সে পুনরায় কহিল, তোমার যদি এতই ঘুম পেয়েছিল, আমাকে বললে না কেন? আমি ত ওদিকের বড় ঘরটা পরিষ্কার করে যা হোক কিছু পেতে তোমার একটা বিছানা তৈরি করে দিতে পারতুম। ট্রেনের সময় হতে ত ঢের দেরি ছিল।
সুরেশ কোন জবাব দিল না, শুধু বিগলিত স্নেহে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া ধীরে ধীরে হাত বাড়াইয়া অচলার ডান হাতখানি তুলিয়া নিজের উত্তপ্ত ললাটের উপর রাখিয়া কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করিল।
অচলা চকিত হইয়া কহিল, এ যে ভয়ানক গরম! তোমার কি জ্বর হয়েছে নাকি!
সুরেশ কহিল, হুঁ। তা ছাড়া এ জ্বর সহজে সারবে বলেও আমার মনে হয় না। বোধ হয়—
অচলা হাতখানি আস্তে আস্তে টানিয়া লইল, এবং প্রত্যুত্তরে তাহার মুখ দিয়াও এবার কেবল একটা দীর্ঘনিশ্বাসই পড়িল। তাহার উদ্বেলিত সমস্ত স্নেহ-মমতা একমুহূর্তে জমিয়া যেন পাথর হইয়া গেল। সহ্য করিবার, ধৈর্য ধরিবার তাহার যে কিছু শক্তি ছিল, সমস্ত একত্র করিয়া সে স্থির হইয়া আজিকার বেলাটুকু গাড়ির জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকিবে, ইহাই সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, কিন্তু এই অচিন্তনীয় ও অভাবিতপূর্ব বিপদের মেঘে তাহার আশার ক্ষীণ রশ্মিরেখাটুকু যখন নিমিষে অন্তর্হিত হইয়া গেল, তখন মৃত্যু ভিন্ন জগতে আর প্রার্থনীয় বস্তু তাহার দ্বিতীয় রহিল না।
ইহাকে এইভাবে এখানে একাকী ফেলিয়া যাওয়ার কথা সে কল্পনা করিতেও পারিল না। কিন্তু যাহার পীড়ার সর্বপ্রকার দায়িত্ব, সমস্ত গুরুভার তাহার মাথায় পড়িল, তাহাকে লইয়া এই অপরিচিত স্থানে সে কি করিবে, কোথায় কাহার কাছে কি সাহায্য ভিক্ষা চাহিবে, কি পরিচয়ে মানুষের সহানুভূতি আকর্ষণ করিবে, অহর্নিশি কি অভিনয় করিবে, এই-সকল চিন্তা বিদ্যুৎবেগে তাহার মাথায় প্রবাহিত হওয়ায় সে ছুটিয়া পলাইবে, না ডাক ছাড়িয়া কাঁদিবে, না সজোরে মাথা কুটিয়া এই অভিশপ্ত জীবনের পালাটা হাতে হাতে চুকাইয়া দিয়া নিশ্চিন্ত হইবে, ইহার কোনটারই যেন কূল-কিনারা পাইল না।






ত্রিংশ পরিচ্ছেদ
সেদিন স্টেশন হইতে পথে কিছু কিছু জলে ভিজিয়া কেদারবাবু সাত-আটদিন গাঁটের বাত ও সর্দিজ্বরে শয্যাগত হইয়া পড়িয়াছিলেন। কন্যা-জামাতার কুশল-সংবাদের অভাবে অতিশয় চিন্তিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি জব্বলপুরের বন্ধুকে একখানা পোস্টকার্ড লেখা ভিন্ন বিশেষ কিছু করিয়া উঠিতে পারেন নাই। আজ তাহার জবাব আসিয়াছে। কেহই আসে নাই এবং তিনি কাহারও কোন খবর জানেন না, এইটুকু মাত্র খবর দিয়াছেন। ছত্র-কয়টি কেদারবাবু বার বার পাঠ করিয়া বিবর্ণমুখে শূন্যদৃষ্টিতে বাহিরের দিকে চাহিয়া শুধু চশমার কাচ-দুটা ঘন ঘন মুছিতে লাগিলেন। তাহাদের কি হইল, কোথায় গেল, সংবাদের জন্য তিনি কাহাকে ডাকিবেন, কোথায় চিঠি লিখিবেন, কাহার কাছে জিজ্ঞাসা করিবেন, কিছুই ভাবিয়া পাইলেন না। তাঁহার সকল আপদে-বিপদে যে ব্যক্তি কায়মন দিয়া সাহায্য করিত সেই সুরেশও নাই, সে-ও সঙ্গে গিয়াছে।
ঠিক এমনি সময়ে বেহারা আসিয়া আর-একখানি পত্র তাঁহার সুমুখেই রাখিয়া দিল। কেদারবাবু কোনমতে নাকের উপর চশমাখানা তুলিয়া দিয়া ব্যগ্রহস্তে চিঠিখানি তুলিয়া দেখিলেন, চিঠি তাঁহার কন্যা অচলার নামে। মেয়েলি হাতের চমৎকার স্পষ্ট লেখা। এ পত্র কে লিখিল, কোথা হইতে আসিল, জানিবার আগ্রহে অপরের চিঠি খোলা-না-খোলার প্রশ্ন তাঁহার মনে আসিল না, তাড়াতাড়ি খামখানা ছিঁড়িয়া প্রথমেই লেখিকার নাম পড়িয়া দেখিলেন, লেখা আছে, ‘তোমার মৃণাল’। তাহার পর এখানিও তিনি আদ্যোপান্ত বার বার পাঠ করিয়া বাহিরের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে চাহিয়া চশমা মোছার কাজে লাগিলেন। তাঁহার মনের মধ্যে যে কি করিতে লাগিল তাহা জগদীশ্বর জানেন। বহুক্ষণে চশমা পরিষ্কারের কাজটা স্থগিত রাখিয়া পুনরায় তাহা যথাস্থানে স্থাপিত করিয়া আর-একবার চিঠিখানি আগাগোড়া পড়িতে প্রবৃত্ত হইলেন। মৃণাল স্ত্রীর সহিষ্ণুতা, ক্ষমা, ধৈর্য প্রভৃতি সম্বন্ধে তীব্র-মধুর বহুপ্রকার উপদেশ দিয়া শেষের দিকে লিখিয়াছে—সেজদা তোমার সম্বন্ধে কিছুই বলেন না সত্য, জিজ্ঞাসা করিলেও ভয়ানক গম্ভীর হইয়া উঠেন বটে, কিন্তু আমি ত মেয়েমানুষ, আমি ত সব বুঝিতে পারি! আচ্ছা সেজদি, ঝগড়া-বিবাদ কাহার না হয় ভাই? কিন্তু তাই বলিয়া এত অভিমান! তোমার স্বামী তাঁহার শরীর-মনের বর্তমান অবস্থা না বুঝিয়া রাগ করিতেও পারেন, অধীর হইয়া অন্যায় করিয়া চলিয়া আসিতেও পারেন, কিন্তু তুমি ত এখনো পাগল হও নাই যে, তিনি যাই বলিতেই তুমি স্বচ্ছন্দে সায় দিয়া বলিলে, আচ্ছা, তাই হোক, যাও তোমার সেই বনবাসে। তাই আমি কেবল ভাবি সেজদি, কি করিয়া প্রাণ ধরিয়া তোমার মৃতকল্প স্বামীটিকে এত সহজে এই বনের মধ্যে বিসর্জন দিলে এবং দিয়া স্থির হইয়া এই সাত-আটদিন বলি কেন, সাত-আট বৎসর নিশ্চিন্ত মনে বাপের বাড়ি বসিয়া রহিলে! সত্য বলিতেছি, সেদিন যখন তিনি জিনিসপত্র লইয়া বাড়ি ঢুকিলেন, আমি হঠাৎ চিনিতে পারি নাই। তোমাদের কেন ঝগড়া হইল, কবে হইল, কিসের জন্য পশ্চিমে যাওয়ার বদলে তিনি দেশে চলিয়া আসিলেন, এ-সকল আমি কিছুই জানি না এবং জানিতে চাই না। কিন্তু আমার মাথার দিব্য রহিল, তুমি পত্রপাঠমাত্র চলিয়া আসিবে। জানই ত ভাই, আমার শাশুড়িকে ছাড়িয়া কোথাও যাইবার জো নাই। তবুও হয়ত আমি নিজে গিয়া তোমার পা ধরিয়া টানিয়া আনিতাম, যদি না সেজদা এতটা অসুস্থ হইয়া পড়িতেন। একবার এস, একবার নিজের চোখে তাঁকে দেখ, তখন বুঝিবে, এই অসঙ্গত মান করিয়া কতদূর অন্যায় করিয়াছ। এ বাড়িও তোমার, আমিও তোমার, সেইজন্য এ বাড়িতে আসিতে কোন দ্বিধা করিবে না। তোমার পথ চাহিয়া রহিলাম, শ্রীচরণে শত কোটি প্রণাম। আর একটা কথা। আমার এই পত্র লেখার কথা সেজদা যেন শুনিতে না পান, আমি লুকাইয়া লিখিলাম। ইতি—তোমার মৃণাল।
পত্র শেষ করিয়া মৃণাল একটা পুনশ্চ দিয়া কৈফিয়ত দিয়াছে যে, যেহেতু স্বামীর অনুপস্থিতিতে তুমি একটা বেলাও সুরেশবাবুর বাটীতে থাকিবে না জানি, তাই তোমার বাপের বাড়ির ঠিকানাতে লিখিলাম। ভরসা করি, এ পত্র তোমার হাতে পড়িতে বিলম্ব হইবে না।

কেদারবাবু হাত হইতে চিঠিখানা স্খলিত হইয়া পড়িয়া গেল, তিনি আর একবার শূন্যের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া তাঁহার চশমা-মোছার কার্যে ব্যাপৃত হইলেন। এটুকু বুঝা গিয়াছে, মহিম জব্বলপুরের পরিবর্তে এখন তাহার গ্রামে রহিয়াছে, এবং অচলা তথায় নাই। সে কোথায়, তাহার কি হইল, এ-সকল কথা হয় মহিম জানে না, না হয় জানিয়াও প্রকাশ করিতে ইচ্ছা করে না।
ঠাৎ মনে হইল, সুরেশই বা কোথায়? সে যে তাহাদের অতিথি হইবে বলিয়া সঙ্গ লইয়াছিল। সে নিশ্চয়ই বাটীতে ফিরে নাই, তাহা হইলে একবার দেখা করিতই। তাহার পরে পিতার বুকের মধ্যে যে আশঙ্কা অকস্মাৎ শূলের মত আসিয়া পড়িল, সে আঘাতে তিনি আর সোজা থাকিতে পারিলেন না, সেই আরাম-কেদারাটায় হেলান দিয়া পড়িয়া দুই চক্ষু মুদ্রিত করিলেন।
দুপুরবেলা দাসী সুরেশের বাটী হইতে সংবাদ লইয়া ফিরিয়া আসিয়া জানাইল, তাঁহার পিসীমা কিছুই জানেন না। কোন চিঠিপত্র না পাইয়া তিনিও অত্যন্ত চিন্তিত হইয়া আছেন।
রাত্রে নিভৃত শয়ন-কক্ষে কেদারবাবু প্রদীপের আলোকে আর একবার মৃণালের পত্রখানি লইয়া বসিলেন। ইহার প্রতি অক্ষর তন্ন তন্ন করিয়া আলোচনা করিতে লাগিলেন, যদি দাঁড়াইবার মত কোথাও এতটুকু জায়গা পাওয়া যায়। না হইলেও যে তিনি কোথায় গিয়া কি করিয়া মুখ লুকাইবেন, ইহা জানিতেন না। চিরদিন পুরুষানুক্রমে কলিকাতাবাসী ; কলিকাতার বাহিরে কোথাও যে কোন ভদ্রলোক বাঁচিতে পারে, এ কথা তিনি ভাবিতে পারিতেন না। সেই আজন্ম-পরিচিত স্থান, সমাজ, চিরদিনের বন্ধু-বান্ধব সমস্ত হইতে বিচ্যুত হইয়া কোথাও অজ্ঞাতবাসে যদি শেষ-জীবনটা অতিবাহিত করিতেই হয়, তবে সেই দুঃসহ দুর্ভর দিন-কয়টা যে কি করিয়া কাটিবে যে তাঁহার চিন্তার অতীত এবং কন্যা হইয়া যে দুর্ভাগিনী এই শাস্তির বোঝা তাহার রুগ্ন বৃদ্ধ পিতার অশক্ত শিরে তুলিয়া দিল, তাহাকে যে তিনি কি বলিয়া অভিশাপ দিবেন, তাহাও তাঁহার চিন্তার অতীত।
সারারাত্রির মধ্যে তিনি একবার চোখে-পাতায় করিতে পারিলেন না এবং ভোর নাগাদ তাঁহার অম্বলের ব্যথাটা আবার দেখা দিল; কিন্তু আজ যখন নিজের বলিয়া মুখ চাহিতে দুনিয়ায় আর কাহাকেও খুঁজিয়া পাইলেন না, তখন নির্জীবের মত শয্যাশ্রয় করিয়া পড়িয়া থাকিতেও তাঁহার ঘৃণা বোধ হইল। এতবড় বেদনাকেও আজ তিনি শান্তমুখে লুকাইয়া অন্যদিনের মত বাহিরে আসিলেন এবং রেলওয়ে স্টেশনের জন্য গাড়ি ডাকিতে পাঠাইয়া তাড়াতাড়ি জামা-কাপড় গুছাইয়া লইতে বেহারাকে আদেশ করিলেন।

0 comments:

Post a Comment