বঙ্গানুবাদ

বঙ্গানুবাদ


Once on a summer day a poor cap-seller was going to a fair for selling caps. Being tired he sat under the shade of a tree leaving behind him his basket containing caps. The gentle breeze made him drowsy and soon he fell asleep. After a while he suddenly woke up and was surprised to find that there was not a single cap left in the basket. Then he began to cry.


উত্তর : কোনাে এক গ্রামের দিনে এক দরিদ্র টুপি-বিক্রেতা টুপি বিক্রি করবার জন্য মেলায় যাচ্ছিল। ক্লান্ত হয়ে, টুপি ভর্তি ঝড়িটি পেছনে রেখে সে একটা গাছের ছায়ায় বসল। মৃদুমন্দ বাতাস তাকে তন্দ্রালু (বা তন্দ্রাচ্ছন্ন) করল। এবং শিগগিরই সে ঘমিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে সে হঠাৎ জেগে উঠল এবং অবাক হয়ে দেখল যে তার ঝুড়িতে। একটিও টুপি নেই। তখন সে কাঁদতে লাগল।



Once morning a monk went out to beg for food. He met a farmer and asked for some alms. But the farmer refused to help him saying, "I plough my field sow the seeds and gather the grain. Thus it is only by working hard that I get my livelihood. But how can you obtain yours, since you neither plough nro sow?

উত্তর : একদিন সকালে এক সন্ন্যাসী খাদ্য ভিক্ষা করতে বেরিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হ’ল এক কৃষকের। তিনি তার কাছ থেকে কিছ ভিক্ষা চাইলেন। কিন্তু কৃষক তাকে এই বলে সাহায্য করতে অস্বীকার করল “আমি আমার জমি চাষ করি বীজ বপন করি এবং শস্য সংগ্রহ করি। এইভাবে একমাত্র কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আমি আমার জীবিকা নির্বাহ করি। কিন্তু, যেহেতু আপনি চাষও করেন না বা বীজও বপন করেন না, আপনি কীভাবে। আপনার জীবিকানির্বাহ করতে পারেন?”


Man is social animal. He cannot live alone. No person can be happy without having sincere friends. But selfish persons fail to make real friendship. Because to get love, you must give love in return. 

উত্তর : মানুষ সামাজিক জীব। সে একা বাঁচতে পারে না। অন্তরঙ্গ বন্ধু ছাড়া কোনাে মানুষ সুখী হতে পারে নাকিন্তু স্বার্থপর মানুষরা প্রকৃত বন্ধুত্ব করতে পারে না। কারণ ভালােবাসা পেতে হলে প্রত্যুত্তরে ভালােবাসা দিতে হয়।


Once two friends started on a travel. Their way lay through a forest. As they came half way through the forest, a bear was seen slowly approaching them. One of them climbed up a tree. The other did not know how to climb a tree and lay flat on his face without breathing.

উত্তর : একদা দুই বন্ধু ভুমণে বের হয়েছিল। তাদের চলবার পথ বনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। যখন তারা বনের মধ্য দিয়ে অর্ধেক পথ এসেছে, তখন একটা ভালুককে তাদের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে দেখল। তাদের মধ্যে একজন একটা গাছে উঠে পড়ল। অপরজন গাছে উঠতে জানত না, তাই সে নিশ্বাস বন্ধ করে মাটিতে মুখ রেখে শুয়ে পড়ল।

সাত ভাই চম্পা - বিষ্ণু দে

সাত ভাই চম্পা
বিষ্ণু দে

চম্পা! তােমার মায়ার অন্ত নেই, 
কত-না পারুল-রাঙানাে রাজকুমার 
কত সমুদ্র কত নদী হয় পার! 
বিরাট বাংলা দেশের কত-না ছেলে
অবহেলে সয় সকল যন্ত্রণাই
চম্পা কখন জাগিবে নয়ন মেলে।

চম্পা, তােমার প্রেমেই বাংলা দেশ 
কত-না শাঙন রজনী পােহাল বলাে। 
গৌরীশৃঙ্গ মাথা হেঁট টলােমলাে, 
নিষিদ্ধ দেশে দীপঙ্করের শিখা 
চিনে জ্বলে, হয় মঙ্গোলিয়ায় লেখা, 
চম্পা, তােমায় চিনেছিল সিংহলও।

তােমাকে খুঁজেছে জানাে কি কৃষকে নৃপে 
অশ্বের খুরে, লাঙলের ফলা টেনে, 
হাতুড়ির ঘায়ে, কান্তের বাঁকা শানে, 
ভাটিয়ালি গানে, কপিলমুনির দ্বীপে; 
কলিঙ্গে আর কঙ্কণে গুর্জরে 
চম্পা, তােমার সাত ভাই গান করে।

শ্যাম-কাম্বােজে তারা বুঝি টানে দাঁড়,
নীল-কমলের দেশে রেখে আসে হাড় 
বহু চাঁদ বহু শ্ৰীমন্ত সদাগর, 
চম্পা, তােমারই পারুল মায়ার লােভে 
বাহিরকে ঘর আপনকে করে পর,

 বলী হাসে, আসে যবদ্বীপের সাড়।

তােমার বাহুর নির্দেশ দেখে ক্ষোভে 
কত প্রাণ গেল, কতজনা নিশি ডেকে 
অন্ধ আবেগে বৈতরণীতে ডােবে। 
চম্পা, তােমার অবিনশ্বর প্রাণ। 
এ কোন হিরণমায়ায় রেখেছ ঢেকে, 
খুলে দাও মুখ, রৌদ্রে জ্বলুক গান।।

কড়ির পাহাড়ে চম্পা, তুমি তাে নেই; 
কাঞ্চনমালা জানে না তােমার খেই; 
তবুও তােমায় খুঁজে মরে সারা দেশ
ঘােচাও চম্পা, দুস্থ হন্নবেশ, 

এ মাহ ভাদরে ভরা বাদরের শেষে 
চকিতে দেখাও জনগণমনে মুখ
মুক্তি! মুক্তি! চিনি সে তীব্র সুখ, 
সাত ভাই জাগে, নন্দিত দেশ-দেশ।।


দাম - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

দাম
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

স্কুলে কী বিভীষিকাই যে ছিলেন ভদ্রলোক!
আমাদের অঙ্ক কষাতেন। আশ্চর্য পরিষ্কার ছিল মাথা। যেসব জটিল অঙ্ক নিয়ে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা পণ্ডশ্রম করেছি, একবার মাত্র তাকিয়ে দেখতেন তার দিকে, তারপরেই এগিয়ে যেতেন ব্ল্যাক বোর্ডে, খসখস করে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলতে খড়ি। হঠাৎ খড়ি ভেঙে গেলে বিরক্ত হয়ে টুকরো দুটো আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে তৎক্ষণাৎ আর একটা তুলে নিতেন, একটু পরেই আমরা রোমাঞ্চিত হয়ে দেখতুম ছবির মতো অঙ্কটা সাজিয়ে দিয়েছেন।
পৃথিবীতে যত অঙ্ক ছিল, সব যেন ওঁর মুখস্থ। কিংবা মুখস্থ বললেও ঠিক হয় না, মনে হতো, আমাদের অদৃশ্য অক্ষরে বোর্ডে আগে থেকেই কষা রয়েছে, অথচ উনি দেখতে পাচ্ছেন ঠিক, আর সঙ্গে সঙ্গে তার উপরে খড়ি বুলিয়ে চলেছেন।
অকে যারা একশোর মধ্যে একশো পায়, ওঁর ভয়ে তারাই তটস্থ হয়ে থাকত। আর আমাদের মতো যেসব অঙ্ক-বিশারদের টেনেটুনে কুড়িও উঠতে চাইত না, তাদের অবস্থা সহজেই কল্পনা করা যেতে পারে। প্রকাণ্ড হাতের প্রচণ্ড চড় খেয়ে মাথা ঘুরে যেত, কিন্তু কাঁদবার জো ছিল না। চোখে এক ফোঁটা জল দেখলেই ক্লাস। ফাটিয়ে হুঙ্কার ছাড়তেন; পুরুষ মানুষ হয়ে অঙ্ক পারিসনেতার উপরে কাদতে লজ্জা করে না? এখনি পা ধরে স্কুলের পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে দেবো।
তা উনি পারতেন। ওঁর চড়ের জোর থেকেই আমরা তা আন্দাজ করে নিয়েছিলুম।
পুরুষমানুষ হয়ে অঙ্ক পারে নাএমন অঘটন কল্পনাও করতে পারতেন না মাস্টার মশাই। বলতেন, প্লেটোর দোরগোড়ায় কী লেখা ছিল, জানিস? যে অঙ্ক জানে না এখানে তার প্রবেশ নিষেধ। স্বর্গের দরজাতেও ঠিক ওই কথাই লেখা রয়েছেযদি সেখানে যেতে চাস, তা হলেস্বর্গের খবরটা মাস্টারমশাই কোত্থেকে জোগাড় করলেন তিনিই জানেন। প্লেটো কে, তার দরজা দিয়ে ঢুকতে না পারলে কী ক্ষতি হবে, এ নিয়ে আমরা কোনোদিন মাথা ঘামাইনি। তাছাড়া যে স্বর্গে পা দিয়েই জ্যামিতির এক্সট্রা ক্যতে হবে কিংবা স্কোয়ার মেজারের অঙ্ক নিয়ে বসতে হবে, সে স্বর্গের চাইতে লক্ষ যোজন দূরে থাকাই আমরা নিরাপদ বোধ করতুম।
ম্যাট্রিকুলেশনের গণ্ডী পার হয়ে অঙ্কের হাত থেকে রেহাই পেলুম, মাস্টারমশাইয়ের হাত থেকেও। কিন্তু অঙ্কের সেই বিভীষিকা মন থেকে গেল না। এমএ পাশ করবার পরেও স্বপ্ন দেখেছি, পরীক্ষার লাস্ট বেল পড়ো-পড়ো, অথচ একটা অঙ্কও আমার মিলছে না। মাস্টারমশাই গার্ড হয়ে একবার আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন, দু-চোখ দিয়ে তার আগুন ঝরছে। দাঁতে দাঁতে ঘষে বলছেন মাথার উপর ঘুরন্ত পাখা সত্ত্বেও ঘামে নেয়ে আমি জেগে উঠেছি। মৃদু নীল আলোয় দেখেছি চেনা ঘরটাকে, চোখে পড়েছে সামনে আমার পড়ার টেবিল, আমার বইপত্রের স্তুপ। গভীর তৃপ্তির সঙ্গে ভেবেছি, এখন আর আমাকে স্কুলে অঙ্ক কষতে হয় না, আমি কলেজে বাংলা পড়াই।
একদিন একটি পত্রিকার পক্ষ থেকে ফরমাশ এল, আমার ছেলেবেলার গল্প শোনাতে হবে। আমি জানালুম, লেখক হিসেবে আমি নিতান্ত সামান্য ব্যক্তি, আমার ছেলেবেলার গল্পে কারো কোনো কৌতূহল নেই। তাছাড়া এমন কোনো স্মরণীয় ঘটনা ঘটেনি যে আসর করে তা লোককে শোনাতে পারি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ ছাড়লেন না, তাঁরা জানালেন, সাহিত্যের ইন্দ্র চন্দ্র মিত্র বরুণেরা কেউ তাদের বিশেষ পাত্তা দেননি, অতএব  অতএব আমি ভাবলুম, তা হলে নির্ভয়ে লিখতে পারি। এঁরা নিজেরা ছাড়া ওঁদের কাগজের বিশেষ পাঠক নেই, সুতরাং আমার আত্মকথা কারো কাছে স্পর্ধার মতো মনে হবে না। কয়েকটি ঘরোয়া মানুষের কাছে ঘরোয়া গল্প বলবওটা প্রীতির ব্যাপার, পদমর্যাদার নয়। কাগজ কলম নিয়ে বসে গেলরর
মনে এল মাস্টারমশাইয়ের কথা। লিখলুম তাঁকে নিয়েই। ছবিটা যা ফুটল, তা খুব উজ্জ্বল নয়। লেখবার সময় কল্পনার খাদ কিছু মিশিয়ে নিলুম সেটা বলাই বাহুল্য। সেই সঙ্গে সদুপদেশও একটু বর্ষণ করেছিলুম। মূল কথাটা এই ছিল, অহেতুক তাড়না করে কাউকে শিক্ষা দেওয়া যায় না, গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করতে গেলে গাধাটাই পঞ্চত্ব পায়। তার প্রমাণ আমি নিজেই। মাস্টার। মশাই আমাকে এত প্রহার করেও অঙ্ক শেখাতে পারেননি, বরং যা শিখেছিলুম তা-ও ভুলেছি। এখন দুই আর দুইয়ে চার না পাঁচ হয়, তাই নিজের মধ্যে সন্দেহ জাগে।
পত্রিকার কর্তৃপক্ষ খুশি হয়ে আমাকে দশ টাকা দক্ষিণা দিয়ে গেছেন। মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে এইটুকুই আমার নগদ লাভ।
তারপরে আরো অনেকদিন পার হয়ে গেল। সেই লেখার কথা ভুলে গেলুম, ভুলে গেলুম মাস্টারমশাইকেও। বয়স বেড়েছে, বিনিদ্র রাত্রিযাপনের মতো অনেক সমস্যা এসে দেখা দিয়েছে জীবনে। বর্তমানের দাবিটা এত বেশি জোরালো যে স্মৃতির দিকে তাকাবার অবসর পর্যন্ত মেলে না।।
এমনি সময় বাংলাদেশের এক প্রান্তের একটি কলেজ থেকে ডাক এল। ওঁদের বার্ষিক উৎসব, অতএব আতিথ্য নিতে যেতে হবে ওখানে। এবং বক্তৃতা দিতে হবে।
এই সব উপলক্ষেই বিনাপয়সায় বেড়ানো যায়। তাছাড়া কলকাতা থেকে কেউ বাইরে গেলেই তার রাজোচিত সম্বর্ধনা মেলেএখানকার চড়ুই পাখিও সেখানে রাজহংসের সম্মান পায়। কলকাতা থেকে দূরত্বটা যত বেশি হয়, আমাদের মতো নগণ্যের পক্ষে ততই সুখাবহ।
আমি সুযোগটা ছাড়তে পারলুম না।
গিয়ে পৌঁছতে চা-খাবার-আতিথেয়তার উচ্ছ্বাস। ছেলেরা তো এলই, দুচারজন সম্ভ্রান্ত লোক এসেও বিনীতভাবে আলাপ করে গেলেন। এমন কি খানকয়েক অটোগ্রাফের খাতা পর্যন্ত এগিয়ে এল। রোমাঞ্চিত কলেবরে আমি স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে বাণী বিতরণ করতে লাগলুম, ব্যক্তি হিসেবে আমি যে এত মূল্যবান এর আগে কে ভেবেছিল সে-কথা।
সভায় জাঁকিয়ে বক্তৃতা করা গেল। রবীন্দ্রনাথ থেকে বারােটা উদ্ধৃতি দিলুম, কার একটা ইংরেজি কোটেশন চালিয়ে দিলুম বার্নার্ড শ'র নামে, শেষে দেশের তরুণদের নিদারুণভাবে জাগ্রত হতে বলে যখন টেবিলে একটা প্রকাণ্ড কিল মেরে বক্তৃতা শেষ করলুম, তখন অল্পের জন্যে ফুলদানিটা রক্ষা পেলাে। আর হল-ফাটানো হাততালিতে কান বন্ধ হওয়ার জো।।
বুড়ো প্রিন্সিপ্যাল পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে আমাকে বললেন, ভারী চমৎকার বলেছেন আপনি, যেমন সারগর্ভ, তেমনি সুমধুর।

আমি বিনীত হাসিতে বললুম, আজ শরীরটা তেমন ভালয় নেই, তাই মনের মতো করে বলতে পারলুম না। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেরা বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলল। শরীর ভালো নেই, তাতেই এরকম বললেন স্যার। শরীর ভালো থাকলে তো অর্থাৎ প্রলয় হয়ে যেত। আমি উদার হাসি হাসলুম। যদিও মনে মনে জানি, এই একটি সর্বার্থসাধক বক্তৃতাই আমার সম্বল, রবীন্দ্র জন্মােৎসব থেকে বনমহোৎসব পর্যন্ত এটাকেই এদিক ওদিক করে চালিয়ে দিই।
স্তুতিতে স্ফীত মনে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়েছি, এমন সময় একটি ছেলে এসে খবর দিলে এক ড়ো ভদ্রলােক আমার সঙ্গে দেখা করতে চান।
প্রিন্সিপ্যাল বললেন, বেশ তো, ডেকে আনো এখানে। ছেলেটি বললে, তিনি আসতে চাইছেন নাবাইরে মাঠে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
আমার বক্তৃতায় নিশ্চয় কেউ অভিভূত হয়েছেন, আমাকে অভিনন্দন জানাবেন। এ অভিজ্ঞতা আগেও হয়েছে। সুতরাং দাক্ষিণ্য-পুলকিত চিত্তে আমি বললুম, আচ্ছা চলো, আমি যাচ্ছি।
হলের বাইরে ছােটো একটা মাঠ তরল অন্ধকারে ঢাকা। অত আলো থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমে ভালো করে কিছু দেখতে পেলুম না। তারপর চোখে পড়ল মানুষটিকে। কুঁজো লম্বা চেহারা, মাথার সাদা চুলগুলি চিকমিক করছে।
ডাকলেন, সুকুমার!
আমি চমকে উঠলুম। এখানে কেউ আমার নাম ধরে ডাকতে পারে সেটা যেমন আশ্চর্য, তারও চেয়ে। আশ্চর্য ওই গলার স্বর। আমার মনটাকে অদ্ভুতভাবে দুলিয়ে দিল। স্মৃতির অন্ধকার থেকে একটা ভয়ের মৃদু শিহরণ আমার বুকের ভিতর দিয়ে বয়ে গেল।
আমাকে চিনতে পারছ না সুকুমার? আমি
-চিনেছি। ভয় পাওয়ার অর্থটা বুঝতেও আর বাকি নেই। এই ডাক শুনে ছেলেবেলায় বহুদিন আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে এসেছেজানি এখনই একটা ভয়ংকর চড় আমার পিঠের উপর নেমে আসবে। সেই ভয়টার কঙ্কাল লুকিয়ে ছিল মনের চোরাকুঠুরিতেওই স্বর বিদ্যুতের আলোর মতো তাকে উদ্ভাসিত করে তুলেছে।
আমার মাথা তখনই ওঁর পায়ে নেমে এল। মাস্টারমশাই, আপনি!
মাস্টারমশাই বললেন, বেঁচে থাকো বাবা, যশস্বী হও। রিটায়ার করার পর এখানে এসেই মাথা খুঁজেছি। বাড়ি থেকে বেরুই না, আজ তুমি বক্তৃতা করবে শুনে ছুটে এসেছি। খুব ভালাে বলেছ সুকুমার, খুব খুশি হয়েছি।
কিন্তু আমি খুশি হতে পারলুম না। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন মাস্টারমশাই, বুদ্ধিতে ছুরির ফলার মতো ঝক্ করত চোখ। আজ আমার বক্তৃতার ফাঁপা ফানুস দিয়ে যদি ওঁকে ভােলাতে পেরে থাকি, তাহলে সেটা। আমার কৃতিত্বে নয়, ওঁর মনেরও বয়স বেড়েছে বলে।
অপরাধীদের মতো চাইলুম, না স্যার, আপনার সামনে মাস্টারমশাই আমাকে বলতে দিলেন না।
তোমরাই তো আমাদের গর্ব, আমাদের পরিচয়। কিছুই দিতে পারিনি, খালি শাসন করেছি, পীড়ন করেছি।বলতে বলতে জামার পকেট থেকে বের করলেন শতচ্ছিন্ন এক জীর্ণ পত্রিকা: একদিন আমার ছেলে এইটে এনে আমাকে দেখালে। পড়ে আনন্দে আমার চোখে জল এল। কতকাল হয়ে গেল, তবু সুকুমার 'আমাকে মনে রেখেছে, আমাকে নিয়ে গল্প লিখেছে। সকলকে এই লেখা আমি দেখাই, বলি দেখো, আমার ছাত্র আমাকে অমর করে দিয়েছে।
মুহূর্তে আমার জিভ শুকিয়ে গেল, লজ্জায় আত্মগ্লানিতে আমার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করল। একটা কিছু বলতে চেষ্টা করলুম, কিন্তু মুখে কথা ফুটল না।
মাস্টারমশাইয়ের গলা ধরে এসেছিল। একটু চুপ করে থেকে বললেন, কী যে আমার আনন্দ হয়েছে। সুকুমার, কী বলব! তোমার এই লেখাটা সব সময়ে আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। দু-একজন বলে, যেমন ধরে ধরে মারতেন, তেমনি বেশ শুনিয়ে দিয়েছে আপনাকে। আমি বলি, শোনাবে কেনকত শ্রদ্ধা নিয়ে লিখেছে। আর সত্যিই তো অন্যায় যদি করেই থাকি, ওরা ছাত্রওরা সন্তান-বড়ো হলে সে অন্যায় আমার শুধরে। দেবে বই কি। জানো সুকুমার, আনন্দে তোমাকে আমি একটা চিঠিও লিখেছিলুম। কিন্তু পাঠাতে সাহস হয়নি। তোমরা এখন বড়ো হয়ে গেছএখনআর বলতে পারলেন না। আবছা আলোটায় এখন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলুম, দেখলুম, মাস্টারমশাইয়ের চোখ দিয়ে জল পড়ছে।
মনে হলো, স্নেহ-মমতা-ক্ষমার এক মহাসমুদ্রের ধারে এসে দাঁড়িয়েছি। সেই স্নেহকোটি মণি-মাণিক্য দিয়ে যার পরিমাপ হয় না; সেই মমতাযার দাম সংসারের সব ঐশ্বর্যের চাইতে বেশি; সেই ক্ষমাকুবেরের ভাণ্ডারকে ধরে দিয়েও যা পাওয়া যায় না।
আমি তাকে দশ টাকায় বিক্রি করেছিলুম। এ অপরাধ আমি বইব কী করে, এ লজ্জা আমি কোথায় রাখব!


দাঁড়াও - শক্তি চট্টোপাধ্যায়



দাঁড়াও
শক্তি চট্টোপাধ্যায়

মানুষ বড়াে কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও
 মানুষই ফাঁদ পাতছে, তুমি পাখির মতাে পাশে দাঁড়াও 
মানুষ বড়াে একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।

তােমাকে সেই সকাল থেকে তােমার মতাে মনে পড়ছে
 সন্ধে হলে মনে পড়ছে, রাতের বেলা মনে পড়ছে। 
মানুষ বড়াে একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।

এসে দাঁড়াও ভেসে দাঁড়াও এবং ভালােবেসে দাঁড়াও
 মানুষ বড়াে কাদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও 
মানুষ বড়াে একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।

মাসিপিসি - জয় গােস্বামী



মাসিপিসি
জয় গােস্বামী

ফুল ছুঁয়ে যায় চোখের পাতায়, জল ছুঁয়ে যায় ঠোঁটে
ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি রাত থাকতে ওঠে

শুকতারাটি ছাদের ধারে, চাঁদ থামে তালগাছে 
ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি ছাড়া কাপড় কাচে

দু এক ফোঁটা শিশির তাকায় ঘাসের থেকে ঘাসে 
ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি ট্রেন ধরতে আসে

ঘুমপাড়ানি মাসিপিসির মস্ত পরিবার
 অনেকগুলাে পেট বাড়িতে, একমুঠো রােজগার

ঘুমপাড়ানি মাসিপিসির পোঁটলা পুঁটলি কোথায় ? 
রেল বাজারের হােমগার্ডরা সাত ঝামেলা জোটায়

সাল মাহিনার হিসেব তাে নেই, জষ্টি কি বৈশাখ
 মাসিপিসির কোলে-কঁখে চালের বস্তা থাক

শতবর্য এগিয়ে আসে – শতবর্য যায়

চাল তােলাে গাে মাসিপিসি লালগােলা বনগাঁয়

অদ্ভুত আতিথিয়তা - ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর



অদ্ভুত আতিথিয়তা
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর


একদা আরব জাতির সহিত মুরদিগের সংগ্রাম হইয়াছিল। আরবসেনা বহুদূর পর্যন্ত এক মুরসেনাপতির অনুসরণ করে। তিনি অশ্বারােহণে ছিলেন, প্রাণভয়ে দ্রুতবেগে পলায়ন করিতে লাগিলেন। আরবেরা তাহার অনুসরণে বিরত হইলে, তিনি স্বপক্ষীয় শিবিরের উদ্দেশে গমন করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাঁহার দিকভ্রম জন্মিয়াছিল, এজন্য, দিকনির্ণয় করিতে না পারিয়া, তিনি বিপক্ষের শিবিরসন্নিবেশস্থানে উপস্থিত হইলেন। সে সময়ে তিনি এরূপ ক্লান্ত হইয়াছিলেন যে, আর কোনাে ক্রমেই অশ্বপৃষ্ঠে গমন করিতে পারেন না।

কিয়ৎক্ষণ পরে, তিনি, এক আরবসেনাপতির পটমণ্ডপদ্বারে উপস্থিত হইয়া, আশ্রয়-প্রার্থনা করিলেন। আতিথেয়তা বিষয়ে পৃথিবীতে কোনাে জাতিই আরবদিগের তুল্য নহে। কেহ অতিথিভাবে আরবদিগের আলয়ে উপস্থিত হইলে, তাঁহারা সাধ্যানুসারে তাহার পরিচর্যা করেন; সে ব্যক্তি শত্রু হইলেও, অণুমাত্র অনাদর, বিদ্বেষপ্রদর্শন বা বিপক্ষতাচরণ করেন না।
আরবসেনাপতি তৎক্ষণাৎ প্রার্থিত আশ্রয় প্রদান করিলেন এবং তাহাকে নিতান্ত ক্লান্ত ও ক্ষুৎপিপাসায় একান্ত অভিভূত দেখিয়া, আহারাদির উদ্যোগ করিয়া দিলেন।.

মুরসেনাপতি ক্ষুন্নিবৃত্তি পিপাসাশান্তি ও ক্লান্তি পরিহার করিয়া উপবিষ্ট হইলে, বন্ধুভাবে উভয় সেনাপতির কথােপকথন হইতে লাগিল। তাহারা, পরস্পর স্বীয় ও স্বীয় পূর্বপুরুষদিগের সাহস, পরাক্রম, সংগ্রামকৌশল প্রভৃতির পরিচয় প্রদান করিতে লাগিলেন। এই সময়ে, সহসা আরবসেনাপতির মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। তিনি তৎক্ষণাৎ গাত্রোত্থান ও তথা হইতে প্রস্থান করিলেন, এবং কিঞ্চিৎ পরেই মুরসেনাপতিকে বলিয়া পাঠাইলেন আমার অতিশয় অসুখবােধ হইয়াছে, এজন্য আমি উপস্থিত থাকিয়া, আপনকার পরিচর্যা করিতে পারিলাম না; আহারসামগ্রী ও শয্যা প্রস্তুত হইয়াছে, আপনি আহার করিয়া শয়ন করুন। আর, আমি দেখিলাম, আপনকার অশ্ব যেরূপ ক্লান্ত ও হতবীর্য হইয়াছে, তাহাতে আপনি কোনােক্রমেই নিবৃদবেগে ও নিরুপদ্রবে স্বীয় শিবিরে পঁহুছিতে পারিবেন না। অতি প্রত্যুষে, এক দ্রুতগামী তেজস্বী অশ্ব, সজ্জিত হইয়া, পটমণ্ডপের দ্বারদেশে দণ্ডায়মান থাকিবেক; আমিও সেই সময়ে আপনকার সহিত সাক্ষাৎ করিব এবং যাহাতে আপনি সত্বর প্রস্থান করিতে পারেন, তদবিষয়ে যথােপযুক্ত আনুকুল্য করিব।

কী কারণে আরবসেনাপতি এরূপ বলিয়া পাঠাইলেন, তাহার মর্মগ্ৰহ করিতে না পারিয়া, মুরসেনাপতি, আহার করিয়া, সন্দিহানচিত্তে শয়ন করিলেন। রজনীশেষে, আরব সেনাপতির লােক তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ করাইল, এবং কহিল, আপনার প্রস্থানের সময় উপস্থিত, গাত্রোত্থান ও মুখপ্রক্ষালনাদি করুন, আহার প্রস্তুত। সেনাপতি শয্যা পরিত্যাগ পূর্বক, মুখপ্রক্ষালনাদি সমাপন করিয়া, আহারস্থানে উপস্থিত হইলেন, কিন্তু সেখানে আরবসেনাপতিকে দেখিতে পাইলেন না; পরে, দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, তিনি সজ্জিত অশ্বের মুখরশ্মি ধারণ করিয়া দণ্ডায়মান আছেন।

আরবসেনাপতি দর্শনমাত্র, সাদর সম্ভাষণ করিয়া, মুরসেনাপতিকে অশ্বপৃষ্ঠে আরােহণ করাইলেন, এবং কহিলেন, আপনি সত্বর প্রস্থান করুন; এই বিপক্ষশিবির-মধ্যে, আমা অপেক্ষা আপনকার ঘােরতর বিপক্ষ আর নাই। গত রজনীতে, যৎকালে, আমরা উভয়ে, একাসনে আসীন হইয়া, অশেষবিধ কথােপকথন করিতেছিলাম, আপনি, স্বীয় ও স্বীয় পূর্বপুরুষদিগের বৃত্তান্তবর্ণন করিতে করিতে, আমার পিতার প্রাণহত্যার নির্দেশ করিয়াছিলেন। আমি শ্রবণমাত্র, বৈরসাধন বাসনার বশবর্তী হইয়া, বারংবার এই শপথ ও প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, সূর্যোদয় হইলেই প্রাণপণে পিতৃহন্তার প্রাণবধসাধনে প্রবৃত্ত হইব। এখন পর্যন্ত সূর্যের উদয় হয় নাই, কিন্তু উদয়েরও অধিক বিলম্ব নাই; আপনি সত্বর প্রস্থান করুন। আমাদের জাতীয় ধর্ম এই, প্রাণান্ত ও সর্বস্বান্ত হইলেও, অতিথির অনিষ্টচিন্তা করি না। কিন্তু আমার পটমণ্ডপ হইতে বহির্গত হইলেই, আপনকার অতিথিভাব অপগত হইবে এবং সেই মুহূর্ত অবধি, আপনি স্থির জানিবেন, আমি আপনকার প্রাণসংহারের নিমিত্ত প্রাণপণে যত্ন ও অশেষ প্রকারে চেষ্টা পাইব। এই যে অপর অশ্ব সজ্জিত হইয়া দণ্ডায়মান আছে দেখিতেছেন, সূর্যোদয় হইবামাত্র, আমি উহাতে আরােহণ করিয়া, বিপক্ষভাবে আপনকার অনুসরণে প্রবৃত্ত হইব। কিন্তু আমি আপনাকে যে অশ্ব দিয়াছি, উহা আমার অশ্ব অপেক্ষা কোনাে অংশেই হীন নহে; যদি উহা দ্রুতবেগে গমন করিতে পারে, তাহা হইলে আমাদের উভয়ের প্রাণরক্ষার সম্ভাবনা।

এই বলিয়া, আরবসেনাপতি, সাদর সম্ভাষণ ও করমর্দন পূর্বক, তাহাকে বিদায় দিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করিলেন। আরবসেনাপতিও, সূর্যোদয়দর্শনমাত্র, অশ্বে আরােহণ করিয়া, তদীয় অনুসরণে প্রবৃত্ত হইলেন। মুরসেনাপতি কতিপয় মুহূর্ত পূর্বে প্রস্থান করিয়াছিলেন, এবং তদীয় অশ্বও বিলক্ষণ সবল ও দ্রুতগামী। এজন্য, তিনি নির্বিঘ্নে স্বপক্ষীয় শিবিরসন্নিবেশস্থানে উপস্থিত হইলেন। আরবসেনাপতি, সবিশেষ যত্ন ও নিরতিশয় আগ্রহ সহকারে, তাহার অনুসরণ করিতেছিলেন; কিন্তু তাহাকে স্বপক্ষশিবিরে প্রবিষ্ট হইতে দেখিয়া, এবং অতঃপর আর বৈরসাধন সংকল্প সফল হইবার সম্ভাবনা নাই বুঝিতে পারিয়া, স্বীয় শিবিরে প্রতিগমন করিলেন।


আদাব - সমরেশ বসু

আদাব
সমরেশ বসু



রাত্রির নিস্তবতাকে কাপিয়ে দিয়ে মিলিটারি টহলদার গাড়িটা একবার ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে একটা পাক খেয়ে গেল।
শহরে ১৪৪ ধারা আর কারফিউ অর্ডার জারি হয়েছে। দাঙ্গা বেধেছে হিন্দু আর মুসলমানে। মুখােমুখি লড়াই দা, সড়কি, ছুরি, লাঠি নিয়ে। তা ছাড়া চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে গুপ্তঘাতকের দল - চোরাগােপ্তা হানছে অন্ধকারকে আশ্রয় করে।
লুঠেরা-রা বেরিয়েছে তাদের অভিযানে। মৃত্যু-বিভীষিকাময় এই অন্ধকার রাত্রি তাদের উল্লাসকে তীব্রতর করে তুলছে। বস্তিতে বস্তিতে জ্বলছে আগুন। মৃত্যুকাতর নারী-শিশুর চীৎকার স্থানে স্থানে আবহাওয়াকে বীভৎস করে তুলছে। তার উপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সৈন্যবাহী-গাড়ি। তারা গুলি ছুড়ছে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আইন ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে।
দুদিক থেকে দুটো গলি এসে মিশেছে এ জায়গায়। ডাস্টবিটা উল্টে এসে পড়েছে গলি দু'টোর মাঝখানে খানিকটা ভাঙাচোরা অবস্থায়। সেটাকে আড়াল করে গলির ভিতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল একটি লােক। মাথা তুলতে সাহস হলাে না, নির্জীবের মতাে পড়ে রইল খানিকক্ষণ। কান পেতে রইল দূরের অপরিস্ফুট কলরবের দিকে। কিছুই বােঝা যায় না। —“আল্লাহু-আকবর’ কি ‘বন্দেমাতরম্।
হঠাৎ ডাস্টবিটা একটু নড়ে উঠল। আচম্বিতে শিরশিরিয়ে উঠল দেহের সমস্ত শিরা-উপশিরা। দাঁতে দাঁত চেপে হাত পা-গুলােকে কঠিন করে লােকটা প্রতীক্ষা করে রইল একটা ভীষণ কিছুর জন্য। কয়েকটা মুর্হত কাটে। ...নিশ্চল নিস্তদ্ধ চারিদিক।
বােধহয় কুকুর। তাড়া দেওয়ার জন্যে লােকটা ডাস্টবিষ্টাকে ঠেলে দিল একটু। খানিকক্ষণ চুপচাপ।। আবার নড়ে উঠল ডাস্টবিষ্টা, ভয়ের সঙ্গে এবার একটু কৌতুহল হলাে। আস্তে আস্তে মাথা তুলল লােকটা ... ওপাশ থেকেও উঠে এল ঠিক তেমনি একটি মাথা। মানুষ! ডাস্টবিনের দুই পাশে দুটি প্রাণী, নিস্পন্দ নিশ্চল। হৃদয়ের স্পন্দন তালহারাধীর...। স্থির চারটে চোখের দৃষ্টি ভয়ে সন্দেহে উত্তেজনায় তীব্র হয়ে উঠেছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। উভয়ে উভয়কে ভাবছে খুনি। চোখে চোখ রেখে উভয়েই একটা আক্রমণের প্রতীক্ষা করতে থাকে, কিন্তু খানিকক্ষণ অপেক্ষা করেও কোনাে পক্ষ থেকেই আক্রমণ এল না। এবার দুজনের মনেই একটা প্রশ্ন জাগল হিন্দু, না মুসলমান? এ প্রশ্নের উত্তর পেলেই হয় তাে মারাত্মক পরিণতিটা দেখা দেবে। তাই সাহস করছে না কেউ কাউকে সে কথা জিজ্ঞেস করতে। প্রাণভীত দুটি প্রাণী পালাতেও পারছে —ছুরি হাতে আততায়ীর ঝাপিয়ে পড়ার ভয়ে।
অনেকক্ষণ এই সন্দিহান ও অস্বস্তিকর অবস্থায় দুজনেই অধৈর্য হয়ে পড়ে। একজন শেষ অবধি প্রশ্ন করে ফেলে—হিন্দু, না মুসলমান? আগে তুমি কও। অপর লােকটি জবাব দেয়।
পরিচয়কে স্বীকার করতে উভয়েই নারাজ। সন্দেহের দোলায় তাদের মন দুলছে। প্রথম প্রশ্নটা চাপা পড়ে, অন্য কথা আসে। একজন জিজ্ঞেস করে,—বাড়ি কোনে?

বুড়িগঙ্গার হেইপারে—সুবইড়ায়। তােমার?
---চাষাড়া-নারাইণগঞ্জের কাছে।..কী কাম করাে?
—নাও আছে আমার, না'য়ের মাঝি।তুমি?
—নারাইণগঞ্জের সুতাকলে কাম করি।
আবার চুপচাপ। অলক্ষ্যে অন্যায়ের মধ্যে দু'জনে দু'জনের চেহারাটা দেখবার চেষ্টা করে। চেষ্টা করে উভয়ের পােশাক-পরিচ্ছদটা খুটিয়ে দেখতে। অন্ধকার আর ডাস্টবিনটার আড়াল সেদিক থেকে অসুবিধা ঘটিয়েছে।...হঠাৎ কাছাকাছি কোথায় একটা শােরগোেল ওঠে। শােনা যায় দুপক্ষেরই উন্মত্ত কণ্ঠের ধ্বনি। সুতাকলের মজুর আর নাওয়ের মাঝি দুজনেই সন্ত্রস্ত হয়ে একটু নড়েচড়ে
—ধারে-কাছেই য্যান লাগছে। সুতা-মজুরের কণ্ঠে আতঙ্ক ফুটে উঠল।
—হ, চল এইখান থেইক্যা উইঠা যাই। মাঝিও বলে উঠল অনুরূপ কণ্ঠে।
সু-মজুর বাধা দিল: আরে, না না—উইঠো না। জানটারে দিবা নাকি?
মাঝির মন আবার সন্দেহে দুলে উঠল। লােকটার কোনাে বস্ অভিপ্রায় নেই তাে! সুতা মজুরের চোখের দিকে তাকাল সে। সুতা-মজুরও তাকিয়েছিল, চোখে চোখ পড়তেই বলল---বইয়াে। যেমুন বইয়া রইছ—সেই রকমই থাকো ।
মাঝির মনটা ছাঁৎ করে উঠল সুতা-মজুরের কথায়। লােকটা কি তাহলে তাকে যেতে দেবে না নাকি। তার সারা চোখে সন্দেহ আবার ঘনিয়ে এল। জিজ্ঞেস করল—ক্যান?
-ক্যান্? সুতা-মজুরের চাপা গলায় বেজে উঠল—ক্যান্ কি, মরতে যাইবা নাকি তুমি?
কথা বলার ভঙ্গিটা মাঝির ভালাে ঠেকল না। সম্ভব-অসম্ভব নানারকম ভেবে সে মনে মনে দৃঢ় হয়ে উঠল। যামু না কি এই আন্দাইরা গলির ভিতরে পইড়া থাকুম নাকি?
লােকটার জেদ দেখে সুতা মজুরের গলায় ফুটে উঠল সন্দেহ। বলল তােমার মতলবড়া তাে ভালাে মনে হইতেছে না। কোন জাতির লােক তুমি কইলা না, শেষে তােমাগাে দলবল যদি ডাইকা লইয়া আহ আমারে মারণের লেইগা?
—এইটা কেমুন কথা কও তুমি? স্থান-কাল ভুলে রাগে-দুঃখে মাঝি প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে। —ভালাে কথাই কইছি ভাই; বইয়াে, মানুষের মন বােঝাে না? সু-মজুরের গলায় যেন কী ছিল, মাঝি একটু আশ্বস্ত হলাে শুনে। —তুমি চইলা গেলে আমি একলা থাকুম নাকি?
শােরগােলটা মিলিয়ে গেল দূরে। আবার মৃত্যুর মতাে নিস্তব্ধ হয়ে আসে সব—মুহুর্তগুলিও কাটে যেন। মৃত্যুর প্রতীক্ষার মতাে। অন্ধকারে গলির মধ্যে ভাস্টবিনের দুই পাশে দুটি প্রাণী ভাবে নিজেদের বিপদের কথা, ঘরের কথা, মা-বউ ছেলেমেয়েদের কথা... তাদের কাছে কি আর তারা প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে পারবে না। তারাই থাকবে বেঁচে, কথা নেই, বার্তা নেই, হঠাৎ কোখেকে বজ্রপাতের মতাে নেমে এল দাঙ্গ।এই হাটে-বাজারে দোকানে এত হাসাহাসি, কথাকওয়াকওয়ি—আবার মুহূর্ত পরেই মারামারি, কাটাকাটি—একেবারে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিল সব। এমনভাবে মানুষ নির্মম নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে কী করে? কি অভিশপ্ত জাত। সূতা-মজুর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। দেখাদেখি মাঝিরও একটা নিশ্বাস পড়ে।
–বিড়ি খাইবা? সুতা-মজুর পকেট থেকে একটি বিড়ি বের করে বাড়িয়ে দিলাে মাঝির দিকে। মাঝি। বিড়িটা নিয়ে অভ্যাসমতাে দু'একবার টিপে, কানের কাছে বার কয়েক ঘুরিয়ে চেপে ধরল ঠোটের ফঁাকে। সুতা-মজুর তখন দেশলাই জ্বালাবার চেষ্টা করছে। আগে লক্ষ করেনি জামাটা কখন ভিজে গেছে। দেশলাইটাও গেছে সেঁতিয়ে। বার কয়েক খস্ শব্দের মধ্যে শুধু এক-আধটা নীলচে ঝিলিক দিয়ে উঠল। বাবুদ ঝরা কাঠিটা ফেলে দিল বিরক্ত হয়ে।
—হালার ম্যাচবাতিও গেছে সেঁইয়া। আর একটা কাঠি বের করল সে। মাঝি যেন খানিকটা অসবুর হয়েই উঠে এল সুতা-মজুরের পাশে।
—আরে জ্বল জ্বলব, দেও দেহিনি—আমার কাছে দেও। সুতা-মজুরের হাত থেকে দেশলাইটা সে প্রায় ছিনিয়েই নিল। দু'একবার খসখস্ করে সত্যিই সে জ্বালিয়ে ফেলল একটা কাঠি।
—সােহান্ আল্লা! –নেও নেও—ধরাও তাড়াতাড়ি।...ভূত দেখার মতাে চমকে উঠল সুতা-মজুর। টেপা
ঠোটের ফাঁক থেকে পড়ে গেল বিড়িটা।
—তুমি...?
একটা হালকা বাতাস এসে যেন ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল কাঠিটা। অন্ধকারের মধ্যে দু'জোড়া চোখ অবিশ্বাসে উত্তেজনায় আবার বড়াে বড়াে হয়ে উঠল। কয়েকটা নিস্তব্ধ পল টে।
মাঝি চট্‌ করে উঠে দাঁড়াল। বলল—হ আমি মােছলমান। -কী হইছে?
সুতা-মজুর 'ভয়ে ভয়ে জবাব দিল—কিছু হয় নাই, কিন্ত... মাঝির বগলের পুটলিটা দেখিয়ে বলল, ওইটার মধ্যে কী আছে?
—পােলা-মাইয়ার লেইগা দুইটা জামা আর একখান শাড়ি। কাইল আমাগাে ঈদের পরব জানাে? —আর কিছু নাই তাে! –সুতা-মজুরের অবিশ্বাস দূর হতে চায় না। —মিথ্যা কথা কইতেছি নাকি? বিশ্বাস না হয় দেখাে। পুঁটলিটা বাড়িয়ে দিল সে সুতা-মজুরের দিকে। —আরে না না ভাই, দেখুম আর কী। তবে দিনকালটা দেখছ তাে? বিশ্বাস করন যায়— তুমিই কও? হেই ত' হক কথাই। ভাই তুমি কিছু রাখ-টাখ নাই তাে?
—ভগবানের কিরা কইরা কইতে পারি একটা সুইও নাই। পরানটা লইয়া অখন ঘরের পােলা ঘরে ফিরা। যাইতে পারলে হয়। সুতা-মজুর তার জামা কাপড় নেড়েচেড়ে দেখায়।
—আইচ্ছা...মাঝি এমনভাবে কথা বলে যেন সে তার কোনাে আত্মীয়বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে। —আইচ্ছা—আমারে কইতে পারনি—এই মাই’র দইর কাটাকুটি কিয়ের লেইগা?
সুতা-মজুর খবরের কাগজের সঙ্গে সম্বন্ধ রাখে, খবরাখবর সে জানে কিছু। বেশ একটু উয়কণ্ঠেই জবাব দিল সে-দোষ তাে তােমাগাে ওই লিগওয়ালােগােই। তারাই তাে লাগাইছে হেই কিয়ের সংগ্রামের নাম কইরা।
মাঝি একটু কটুক্তি করে উঠল—হেই সব আমি বুঝি না। আমি জিগাই মারামারি কইরা হইব কী। তােমাগাে দু’গা লােক মরব, আমাগাে দু’গা মরব। তাতে দ্যাশের কী উপকারটা হইব?
—আরে আমিও তাে হেই কথাই কই। হইব আর কী, হইব আমার এই কলাটা—হাতের বুড়াে আঙুল দেখায় সে। তুমি মরবা, আমি মরুম, আর আমাগাে পােলামাইয়াগুলি ভিক্ষা কইরা বেড়াইব। এই গেল সনের “রায়টে' আমার ভগ্নিপতিরে কাইটা চাইরটুকরা কইরা মারল। ফলে বইন হইল বিধবা আর তার পােলামাইয়ারা আইয়া পড়ল আমার ঘাড়ের উপুর। বই কি আর সাধে। ন্যাতারা হেই সাততলার উপুর পায়ের উপুর পা দিয়ে হুকুম জারি কইরা বইয়া রইল আর হালার মরতে মরলাম আমরাই।
—মানুষ না, আমরা য্যান কুত্তার বাচ্চা হইয়া গেছি; নাইলে এমুন কামড়া-কামড়িটা লাগে কোয়? —নিল ক্রোধে মাঝি দু'হাত দিয়ে হাঁটু দুটোকে জড়িয়ে ধরে।
—হ।
—আমাগাে কথা ভাবে কেডা? এই যে দাঙ্গা বাধল—অখন দানা জুটাইব কোন্ সুমুন্দি ; নাওটারে কি আর ফিরা পামু? বাদামতলির ঘাটে কোন্ অতলে ডুবাইয়া দিছে তারে—তার ঠিক কি? জমিদার রূপবাবুর বাড়ির নায়েমশয় পিত্যেক মাসে একবার কইরা আমার নায়ে যাইত নইরার চরে কাছারি করতে। বাবুর হাত য্যা হজরতের হাত, বখশিশ দিত পাঁচ, নায়ের কোয়া দিত পাঁচ, একুনে’ দশটা টাকা। তাই আমার মাসের খােরাকি জুটাইত হেই বাবু। আর কি হিন্দুবাবু আইব আমার নায়ে।
সুতা-মজুর কী বলতে গিয়ে থেমে গেল। একসঙ্গে অনেকগুলি ভারী বুটের শব্দ শােনা যায়। শব্দ যেন বডাে রাস্তা থেকে গলির অন্দরের দিকেই এগিয়ে আসছে সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই। শঙ্কিত জিজ্ঞাসা নিয়ে উভয়ে চোখাচোখি করে।
—কী করব? মাঝি তাড়াতাড়ি পুঁটলিটাকে বগলদাবা করে। —চলাে পলাই। কিন্তক যামু কোনদিকে? শহরের রাস্তাঘাট তাে ভালাে চিনি না। মাঝি বলল, চলাে যেদিকে হউক। মিছামিছি পুলিশের মাইর খামু না, ওই ঢ্যামনাগাে বিশ্বাস নাই। —হ। ঠিক কথাই কইছ। কোনদিকে যাইবা কও—আইয়া তাে পড়ল। —এইদিকে।
গলিটার যে মুখটা দক্ষিণ দিকে চলে গেছে সেদিকে পথনির্দেশ করল মাঝি। বলল, চলাে, কোনাে গতিকে একবার যদি বাদামতলি ঘাটে গিয়া উঠতে পারি—তাইলে আর ডর নাই।
মাথা নিচু করে মােড়টা পেরিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে তারা ছুটল, সােজা এসে উঠল একেবার পাটুয়াটুলি রােডে। নিস্তব্ধ রাস্তা ইলেকট্রিকের আলােয় ফুটফু করছে। দুইজনেই একবার থমকে দাঁড়াল—ঘাপটি মেরে নেই তাে কেউ? কিন্তু দেরি করারও উপায় নেই। রাস্তার এমােড়-ওমােড় একবার দেখে নিয়ে ছুটল সােজা পশ্চিমদিকে। খানিকটা এগিয়ে এমন সময় তাদের পিছনে শব্দ উঠল ঘােড়ার খুরের। তাকিয়ে দেখল—অনেকটা দূরে একজন অশ্বারােহী এদিকেই আসছে। ভাববার সময় নেই। বাঁ-পাশে মেথর যাতায়াতের সরু গলির মধ্যে আত্মগােপন করল তারা। একটু পরেই ইংরেজ অশ্বারােহী রিভালবার হাতে তীব্র বেগে বেরিয়ে গেল তাদের বুকের মধ্যে অশ্বখুরধ্বনি তুলে দিয়ে। শব্দ যখন চলে গেল অনেক দুরে, উকিঝুঁকি মারতে মারতে আবার তারা বেরুল।
—কিনারে কিনারে চলাে। সুতা-মজুর বলে। রাস্তার ধার ঘেঁষে সন্ত্রস্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে তারা।
খাড়াও
-মাঝি চাপা-গলায় বলে। সুতা-মজুর চমকে থমকে দাঁড়ায়। -কী হইল?
—এদিকে আইয়াে-সুতা-মজুরের হাত ধরে মাঝি তাকে একটা পানবিড়ির দোকানের আড়ালে নিয়ে গেল।
হেদিকে দেখাে।
মাঝির সঙ্কেত মতাে সামনের দিকে তাকিয়ে সুতা-মজুর দেখল প্রায় একশাে গজ দূরে একটা ঘরে আলাে জ্বলছে। ঘরের সংলগ্ন উঁচু বারান্দায় দশ বারােজন বন্দুকধারী পুলিশ স্থাণুর মতাে দাঁড়িয়ে আছে, আর তাদের সামনে ইংরেজ অফিসার কী যেন বলছে অনর্গল পাইপের ধোঁয়ার মধ্যে হাত মুখ নেড়ে। বারান্দার নীচে ঘােড়ার জিন্ ধরে দাঁড়িয়ে আছে আর একটি পুলিশ। অশান্ত চঞ্চল ঘােড়া কেবলি পা ঠুকছে মাটিতে।
মাঝি বলে—ওইটা ইসলামপুর ফঁড়ি। একটু আগাইয়া গেলে ফাড়ির কাছেই বাঁয়ের দিকে যে গলি গেছে হেই পথে যাইতে হইব আমাগাে বাদামতলির ঘাট। | সুতা-মজুরের সমস্ত মুখ আতঙ্কে ভরে উঠল।-তবে?
—তাই কইতাছি তুমি থাকো, ঘাটে গিয়া তােমার বিশেষ কাম হইব না। মাঝি বলে, এইটা হিন্দুগাে আস্তানা আর ইসলামপুর হইল মুসলমানগাে। কাইল সকালে উইঠা বাড়িত যাইবা গা।
—আর তুমি ?
—আমি যাইগা। মাঝির গলা উদ্বেগে আর আশঙ্কায় ভেঙে পড়ে। আমি পারুম না ভাই থাকতে। আইজ আটদিন ঘরের খবর জানি না। কী হইল না হইল আল্লাই জানে। কোনােরকম কইরা গলিতে ঢুকতে পারলেই হইল। নৌকা না পাই সাঁতরাইয়া পার হমু বুড়িগঙ্গা।
—আরে না না মিয়া করাে কী? উৎকণ্ঠায় সুতা-মজুর মাঝির কামিজ চেপে ধরে। —কেমনে যাইবা তুমি, আঁ? আবেগ উত্তেজনায় মাঝির গলা কাঁপে।
—ধইরাে না, ভাই ছাইড়া দেও। বােঝ না তুমি কাইল ঈদ, পােলামাইয়ারা সব আইজ চান্দ দেখছে। কত আশা কইরা রইছে তারা নতুন জামা পিনব, বাপজানের কোলে চড়ব। বিবি চোখের জলে বুক ভাসাইতেছে। পারুম না ভাই-পারুম না—মনটা কেমন করতাছে। মাঝির গলা ধরে আসে। সুতা-মজুরের বুকের মধ্যে টনটন করে ওঠে। কামিজ ধরা হাতটা শিথিল হয়ে আসে।
—যদি তােমায় ধইরা ফেলায়?—ভয়ে আর অনুকম্পায় তার গলা ভরে ওঠে।
—পারব না ধরতে, ডৱাইও না। এইখান থাইকা য্যান উইঠো না। যাই ভূলুম না ভাই এই রাত্রের কথা। নসিবে থাকলে আবার তােমার লগে মােলাকাত হইব।—আদাব।
—আমিও ভুলুম না ভাই—আদাব। মাঝি চলে গেল পা টিপে টিপে।
সু-মজুর বুকভরা উদ্বেগ নিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বুকের ধুকধুকুনি তার কিছুতে বন্ধ হতে চায় । উৎকর্ণ হয়ে রইল সে, ভগমান্— মাজি য্যান বিপদে না পড়ে।
মুহূর্তগুলি কাটে রূদ্ধ-নিশ্বাসে। অনেকক্ষণ তা' হলাে, মাঝি বােধহয় এতক্ষণে চলে গেছে। আহা ‘পােলামাইয়ার’ কত আশা নতুন জামা পরবে, আনন্দ করবে পরবে। বেচারা ‘বাপজানের পরান তাে।। সু-মজুর একটা নিশ্বাস ফেলে। সােহাগে আর কান্নায় বিবি ভেঙে পড়বে মিয়াসাহেবের বুকে।
‘মরণের মুখ থেইকা তুমি বাঁইচা আইছ?” –সুতা-মজুরের ঠোটের কোণে একটু হাসি ফুটে উঠল, 'আর । মাঝি তখন কী করবে? মাঝি তখন
—হল..
ধ্বক্ করে উঠল সুতা-মজুরের বুক। বুট পায়ে কারা যেন ছুটোছুটি করছে। কী যেন বলাবলি করছে। টীকার করে।
—ডাকু ভাতা হ্যায়।
সু-মজুর গলা বাড়িয়ে দেখল পুলিশ অফিসার রিভলবার হাতে রাস্তার উপর লাফিয়ে পড়ল। সমস্ত অলটার নৈশ নিস্তব্ধতাকে কাপিয়ে দুবার গর্জে উঠল অফিসারের আগ্নেয়াস্ত্র।
গুড়ুম, গুড়ুম। দুটো নীলচে আগুনের ঝিলিক। উত্তেজনায় সুতা-মজুর হাতের একটা আঙুল কামড়ে ধরে। লাফ দিয়ে ঘােড়ায় উঠে অফিসার ছুটে গেল গলির ভিতর। ডাকুটার মরণ আর্তনাদ সে শুনতে পেয়েছে।
সুতা-মজুরের বিহ্বল চোখে ভেসে উঠল মাঝির বুকের রক্তে তার গােলামইয়ার, তার বিবির জামা শাড়ি রাঙা হয়ে উঠেছে। মাঝি বলছে—পারলাম না ভাই। আমার ছাওয়ালরা আর বিবি চোখের পানিতে ভাসব পরবের দিনে। দুশমনরা আমারে যাইতে দিল না তাগাে কাছে।


বাংলা বর্ণমালা

বাংলা বর্ণমালা

স্বরবর্ণ
অ = অজগর
আ = আম
ই = ইঁদুর
ঈ = ঈগল
উ = উট
ঊ = ঊষা
এ = একতারা
ঐ = ঐরাবত
ও = ওল
ঔ = ঔষধ