বনভােজনের ব্যাপার - নারায়ণ গঙ্গােপাধ্যায়।



বনভােজনের ব্যাপার
নারায়ণ গঙ্গােপাধ্যায়

হবুল সেন বলে যাচ্ছিল—পপালাও, ডিমের ডালনা, রুই মাছের কালিয়া, মাংসের কোর্মা—
উস-উস শব্দে নােলার জল টানল টেনিদা :বলে যা—থামলি কেন? মুগ মুসল্লম, বিরিয়ানি পােলাও, মশলদা দোসে, চাউ-চাউ, সামি কাবাব
এবার আমাকে কিছু বলতে হয়। আমি জুড়ে দিলাম : আলু ভাজা, শুক্তো, বাটিচচ্চড়ি, কুমড়াের ছােকা—
টেনিদা আর বলতে দিলে না ! গাঁক গাঁক করে চেঁচিয়ে উঠল ; থাম প্যালা, থাম বলছি। শুক্তো, বাটিচচ্চড়ি। দাঁত খিচিয়ে বললে, তার চেয়ে বল-না হিঞ্চে সেদ্ধ, গাঁদাল আর শিঙিমাছের ঝােল! পালা-জ্বরে ভুগিস আর বাসক পাতার রস খাস, এর চাইতে বেশি বুদ্ধি আর কী হবে তাের! দিব্যি অ্যায়সা অ্যায়সা মােগলাই খানার কথা হচ্ছিল, তার মধ্যে ধাঁ করে নিয়ে এল বাটি চচ্চড়ি আর বিউলির ডাল! ধ্যাত্তোর।
ক্যাবলা বললে, পশ্চিমে কুঁরুর তরকারি দিয়ে ঠেকুয়া খায়। বেশ লাগে!
—বেশ লাগে ?—টেনিদা তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল : কঁচা লঙ্কা আর ছােলার ছাতু আরও ভালাে। লাগে না? তবে তাই আগে যা। তাদের মতাে উল্লুকের সঙ্গে পিকনিকের আলােচনাও ঝকমারি !

হাবুল সেন বললেন, আহা-হা চৈইত্যা যাইত্যাছ কেন? পােলাপানে কয়—
– পােলাপান! এই গাড়লগুলােকে জলপান করলে তবে রাগ যায়! তাও কি খাওয়া যাবে এগুলােকে? নিম-নিসিলের চেয়েও অখাদ্য। এই রইল তােদের পিকনিক—আমি চললাম! তােরা ছােলার ছাতু আর কাচা লঙ্কার পিণ্ডি গেল গেয়ে—আমি ওসবের মধ্যে নেই!
সত্যিই চলে যায় দেখছি! আর দলপতি চলে যাওয়া মানেই আমরা একেবারে অনাথ! আমি টেনিদার হাত চেপে ধরলাম : আহা, বােসাে-না। একটা প্ল্যান-ট্যান হােক। ঠাট্টাও বােঝে না।
টেনিদা গজগজ করতে লাগল : ঠাট্টা! কুমড়াের ছেকা আর কুঁদর তরকারি নিয়ে ওসব বিচ্ছিরি ঠাট্টা আমার ভালাে লাগে না।
-না,-না, ওসব কথার কথা—হাবুল সেন ঢাকাই ভাষায় বােঝাতে লাগল । মােগলাই খানা না হইলে আর পিকনিক হইল কী?
—তবে লিস্টি কর—টেনিদা নড়ে চড়ে বসল। প্রথমে যে লিস্টটা হলাে তা এইরকম :
বিরিয়ানি 
পােলাও
কোর্মা
কোপ্তা 
কাবাব (দু-রকম)।
মাছের চপ 
মাঝখানে বেরসিকের মতাে বাধা দিলে ক্যাবলা ; তাহলে বাবুর্চি ঢাই, একটা ঢাকর, একটা মােটর লরি, দুশাে টাকা
—দ্যাখ ক্যাবলা—টেনিদা ঘুসি বাগাতে চাইল। আমি বললাম, চটলে কী হবে? চারজনে মিলে চাদা উঠেছে দশ টাকা দু-আনা।
টেনিদা নাক চুলকে বললে, 'তাহলে একটু কমসম করেই করা যাক। ট্র্যাক-খালির জমিদার সব—তােদের নিয়ে ভদ্দরলােকে পিকনিক করে!
আমি বলতে যাচ্ছিলাম, তুমি দিয়েছ দু-আনা, বাকি দশ টাকা গেছে আমাদের তিনজনের পকেট থেকে। কিন্তু বললেই গাঁট্টা। আর সে গাঁট্টা ঠাট্রার জিনিস নয়—জুতসই লাগলে স্রেফ গালপাট্টা উড়ে যাবে।
রফা করতে করতে শেষপর্যন্ত লিস্টটা যা দাঁড়াল তা এই : খিচুড়ি (প্যালা রাজহাঁসের ডিম আনিবে বলিয়াছে) আলু ভাজা (ক্যাবলা ভাজিবে)। পােনা মাছের কালিয়া (প্যালা রীধিবে) আমের আচার (হাবুল দিদিমার ঘর হইতে হাতসাফাই করিবে) রসগােল্লা, লেডিকেনি (ধারে 'ম্যানেজ' করিতে হইবে)।
লিস্টি শুনে আমি হাঁড়িমুখ করে বললাম, ওর সঙ্গে আর-একটা আইটেম জুড়ে দে হাবুল। টেনিলা খাবে।
-হে-হেঁ—প্যালার মগজে শুধু গােবর নেই, ছটাকখানেক ঘিলুও আছে দেখছি। বলেই টেনিদা আদর করে আমার পিঠ চাপড়ে দিলে। “গেছি গেছি’ বলে লাফিয়ে উঠলাম আমি।
আমরা পটলডাঙার ছেলে—কিছুতেই ঘাবড়াই না। চাটুজ্জেদের রােয়াকে বসে রােজ দু-বেলা আমরা গন্ডায়গন্ডায় হাতি-গন্ডার সাবাড় করে থাকি। তাই বেশ ভাঁটের মাথায় বলেছিলাম, দূর-দূর। হাঁসের ডিম খায় ভদ্দরলােক! খেতে হলে রাজহাঁসের ডিম। রীতিমতাে রাজকীয় খাওয়া!
—কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে শুনি? খুব যে চালিয়াতি করছিস, তুই ডিম পাড়বি নাকি?—টেনিদা জানতে চেয়েছিল।
-আমি পাড়তে যাব কোন দুঃখে?কী দায় আমার ?—আমি মুখ ব্যাজার করে বলেছিলাম : হাঁসে পাড়বে।
তাহলে সেই হাঁসের কাছ থেকে ডিম তােকেই আনতে হবে। যদি না আনিস, তাহলে তাহলে কী হবে বলবার দরকার ছিল না। কিন্তু কী গেরাে বলাে দেখি। কাল রবিবার ভােরের গাড়িতেই আমরা বেরুব পিকনিকে। আজকের মধ্যেই রাজহাঁসের ডিম জোগাড় করতে না পারলে তাে গেছি। পাড়ায় ভন্টাদের বাড়ি রাজহাঁস আছে গােটাকয়েক। ডিম-টিমও তারা নিশ্চয় পাড়ে। আমি ভন্টাকেই পাকড়ালাম। কিন্তু কী খলিফা ছেলে ভন্টা! দু-আনার পাঁঠার ঘুগনি আর ডজনখানেক ফুলুরি সাবড়ে তবে মুখ খুলল!
ড্রিম দিতে পারি, তবে, নিজের হাতে বার করে নিতে হবে বাক্স থেকে।
—তুই দে না ভাই এনে। একটা আইসক্রিম খাওয়াব। ভন্টা ঠোট বেঁকিয়ে বললে, নিজেরা পােলাও-মাংস সাঁটাবেন স্নার আমার বেলায় আইসক্রিম! ওতে চলবে না। ইচেছ হয় নিজে বের করে নাও—ক্সামি বাবা ময়লা ঘাঁটতে পারব না। কী করি, রাজি হতে হলাে।
ভন্টা বললে, দুপুরবেলায় আসিস। বাবা-মেজদা অফিসে যাওয়ার পরে। মা তখন ভোস-ভোস করে ঘুমােয়। সেইসময় ডিম বের করে দেবাে!
গেলাম দুপুরে। উঠোনের একপাশে কাঠের বাক্স—তার ভিতরে সার-সার খুপরি। গােটা দুই হাঁস ভিতরে বসে ডিমে তা দিচ্ছে। ভন্টা বললে, যা নিয়ে আয়। | কিন্তু কাছে যেতেই বিতিকিচ্ছিরিভাবে লিফ্যাল করে উঠল হল দুটো। ফোস ফোস করছে যে!
ভণ্টা উৎসাহ দিলে : ডিম নিতে এসেছিস—একটু আপত্তি করবে না ? তাের কোনাে ভয় নেই প্যালা—দে হাত ঢুকিয়ে।
হাত ঢুকিয়ে দেবাে? কিন্তু কী বিচ্ছিরি ময়লা!—ময়লা আর কী বদখত গন্ধ! একেবারে নাড়ি উলটে আসে। তার ওপরে যে-রকম ঠোঁট ফাঁক করে ভয় দেখাচ্ছে
ভন্টা বললে, চিয়ার আপ প্যালা। লেগে যায়।
যা থাকে কপালে বলে যেই হাত ঢুকিয়েছিসঙ্গে সঙ্গো—ওরে বাপরে! খটাং করে হাঁসটা হাত কামড়ে ধরল। সে কী কামড়! হাই-মাই করে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।
-কী হয়েছে রে ভণ্টা, নীচে এত গােলমাল কীসের?—ভন্টার মার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল।
আমি আর নেই। হ্যাচকা টানে হাঁসের ঠোট থেকে হাত ছাড়িয়ে চোচা দৌড় লাগালাম। দরদর করে রক্ত পড়ছে তখন।
রাজহাঁস এমন রাজকীয় কামড় বসাতে পারে কে জানত। কিন্তু কী ফেরেববাজ ভন্টটি। জেনে-শুনে ব্রাত্মণের রক্তপাত ঘটাল। আচ্ছা—পিকনিকটা চুকে যাক—দেখে নেব তারপর। ওই পাঁঠার ঘুগনি আর ফুলুরির শােধ তুলে হাড়ব।
কী করা যায়—গাঁটের পয়সা দিয়ে মাদ্রাজি ডিমই কিনতে হলাে গােটাকয়েক।
পরদিন সকালে শ্যামবাজার ইস্টিশানে পৌছে দেখি, টেনিদা, ক্যাবলা আর হাবুল এর মধ্যেই মার্টিনের রেলগাড়িতে চেপে বসে আছে। সঙ্গে একরাশ হাঁড়ি-কলশি, চালের পটুলি, তেলের ভাড়। গাড়িতে গিয়ে উঠতে টেনিদা হাঁক ছাড়ল : এনেছিস রাজহাঁসের ডিম?
দুর্গা নাম করতে করতে পুটলি খুলে দেখালাম। –এর নাম রাজহাঁসের ডিম। ইয়ার্কি পেয়েছিস?—টেনিদা গাঁট্টা বাগাল। আমি গাড়ির খােলা দরজার দিকে সরে গেলাম : মানে ইয়ে, ছােটো রাজহাঁস কিনা। —ছােটো রাজহাঁস! কী পেয়েছিস আমাকে শুনি? পাগল না পেটখারাপ? হাবুল সেন বললে, ছাড়ান দাও—হাড়ান দাও। ডিম তাে আনছে!
টেনিদা গর্জন করে বললে, ডিম এনেছে না কচু। এই তােকে বলে রাখছি প্যালা—ডিমের ডালনা থেকে তাের নাম কেটে দিলাম। এক টুকরাে আলু পর্যন্ত নয়, একটু ঝােলও নয়!
মন খারাপ করে আমি বসে রইলাম। ডিমের ভুলনা আমি ভীষণ ভালােবাসি, তাই থেকেই আমাকে বাদ দেওয়া। আচ্ছা বেশ, খেয়াে তােমরা। এমন নজর দেবাে পেট ফুলে ঢােল হয়ে যাবে তােমাদের।
ৰ্পি করে বাঁশি বাজল-নড়ে উঠল মার্টিনের রেল। তারপর ধ্বস-ধ্বস ভেস-ভোস করে এর রানাঘর, ওর ভাড়ারঘরের পাশ দিয়ে গাড়ি চলল।
টেনিদা বললে, বাগুইআটি ছাড়িয়ে আরও চারটে ইস্টিশান। তার মানে প্রায় এক ঘণ্টার মামলা। লেডিকেনির হাঁড়িটা বের কর, ক্যাবলা।
ক্যাবলা বললে, এখুনি! তাহলে পেঁৗছােবার আগেই যে সাফ হয়ে যাবে?
টেনিদা বললে, সাফ হবে কেন, দুটো-একটা চেখে দেখব শুধু। আমার বাবা ট্রেনে চাপলেই খিদে পায়। এই একঘণ্টা ধরে শুধু শুধু বাল থাকতে পারব না। বের কর হাঁড়িচটপট—
হাঁড়ি চটপটই বেরুল—মানে, বেরুতেই হলাে তাকে। তারপর মার্টিনের রেলের চলার তালে তালে ঝটপট করে সাবাড় হয়ে চলল। আমি, ক্যাবলা আর হাবুল সেন জুলজুল করে শুধু তাকিয়েই রইলাম। একটা লেডিকেনি। চেখে দেখতে আমরাও যে ভালােবাসি, সেকথা আর মুখ ফুটে বলাই গেল না।
ইস্টিশান থেকে নেমে প্রায় মাইলখানেক হাঁটবার পরে ক্যাবলার মামার বাড়ি। কাঁচা রাস্তা, এঁটেল মাটি, তার ওপর কাল রাতে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে আবার। আগে থেকেই রসগােল্লার হাঁড়িটা বাগিয়ে নিলে টেনিদা।।
—এটা আমি নিচ্ছি। বাকি মােটঘাটগুলাে তােরা নে।
রসগােল্লা বরং আমি নিচ্ছি, তুমি চালের পোঁটলাটা নাও টেনিদা। লেডিকেনির পরিণামটা ভেবে আমি বলতে চেষ্টা করলাম।
টেনিদা চোখ পাকাল : খবরদার প্যালা, ওসব মতলব ছেড়ে দে। টুপটাপ করে দু-চারটে গালে ফেলবার বুদ্ধি, তাই নয় ? বাবা–চালাকি ন চলিষ্যতি।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাঁটরি-বোঁচকা কাধে ফেলে আমরা তিনজনেই এগােলাম। কিন্তু তিন পাও যেতে হলাে না। তার আগেই ধহধপাস। টেনে একখানা রাম-আছাড় খেলাে হাবুল। -এই খেয়েছে কচুপােড়া।—টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল।
সারা গায়ে কাদা মেখে হাবুল উঠে দাঁড়াল। হাতের ডিমের পুটলিটা তখন কুঁকড়ে এতটুকু—হলদে রস গড়াচ্ছে তা থেকে।
ক্যাবলা বললে, ডিমের ডালনার বারােটা বেজে গেল।
তা গেল। করুণ চোখে 'আমরা তাকিয়ে রইলাম সেইদিকে। ইন্স—এত কষ্টের ডিম। ওরই জন্যে রাজহাঁসের কামড় পর্যন্ত খেতে হয়েছে।
টেনিদা হুংকার দিয়ে উঠল : দিলে সব পণ্ড করে। এই ঢাকাই বাঙালটাকে সঙ্গে এনেই ভুল হয়েছে। পিটিয়ে ঢাকাই পরােটা করলে তবে রাগ যায়।।
আমি বলতে যাচ্ছিলাম, হাবুল চার টাকা চাঁদা দিয়েছে—তার আগেই কী যেন একটা হয়ে গেল! হঠাৎ মনে হলাে আমার পা দুটো মাটি ছেড়ে শোঁ করে শূন্যে উড়ে গেল, আর তারপরেই
কাল থেকে যখন উঠে দাঁড়ালাম, তখন আমার মাথা-মুখ বেয়ে আচারের তেল গড়াচ্ছে। ওই অবস্থাতেই চেটে দেখলাম একটুখানি। বেশ ঝাল-ঝাল টক-টক—বেড়ে আচারটা করেছিল হাবুলের দিদিমা!
ক্যাবলা আবার ঘােষণা করলে, আমের আচারের একটা বেজে গেল।
টেনিদা খেপে বললে, চুপ কর বলছি ক্যাবলা—এক চড়ে গালের বােম্বা উড়িয়ে দেবাে।
কিন্তু তার আগেই টেনিদার বােদা উড়ল—মানে স্রেফ লম্বা হলাে কাদায়। সাত হাত দূরে ছিটকে গেল রসগােল্লার হাঁড়ি—ধবধবে সাদা রসগােল্লাগুলাে পাশের কাদাভরা খানায় গিয়ে পড়ে একেবারে নেবুর আচার।
ক্যাবলা বললে, রসগােল্লার দুটো বেজে গেল!
এবার আর টেনিদা একটা কথাও বললে না। বলবার ছিলই বা কী! রসগােল্লার শােকে বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে চারজনে পথ চলতে লাগলাম আমরা। টেনিদা তবু লেডিকেনিগুলাে সাবাড় করেছে, কিন্তু আমাদেব সান্ত্বনা কোথায়। অমন স্পঞ্জ রসগোল্লাগুলাে।
পাঁচ মিনিট পরে টেনিদাই কথা কইল।
—তবু পােনা মাছগুলাে আছে কী বলিস! খিচুড়ির সঙ্গে মাছের কালিয়া আর আলুভাজা-নেহাত মন্দ হবে না—আঁা?
হাবুল বললে, হ-হ, সেই ভালাে। বেশি খাইলে প্যাট গরম হইব। গুরুপাক না খাওয়াই ভালাে।
ক্যাবলা মিটমিট করে হাসল: শেয়াল বলেছিল, দ্রাক্ষাফল অতিশয় খাট্টা।—ক্যাবলা ছেলেবেলায় পশ্চিমে ছিল, তাই দুই-একটা হিন্দি শব্দ বেরিয়ে পড়ে মুখ দিয়ে।
টেনিদা বলে খাট্টা! বেশি পাঁঠামি করবি তাে চাঁট্টা বসিয়ে দেবাে।
ক্যাবলা ভয়ে স্পিকটি নট। আমি তখনও নাকের পাশ দিয়ে ঝাল-ঝাল টক-টক তেল চাটছি। হঠাৎ বুক পকেটটা কেমন ভিজে ভিজে মনে হলাে। হাত দিয়ে দেখি, বেশ বড়ােসড়াে এক-টুকরাে আমের আচার তার ভেতরে কায়েমি হয়ে আছে।।
-জয়গুরু। এদিক-ওদিক তাকিয়ে টপ করে সেটা তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিলাম। সত্যি—হাবুলের দিদিমা বেড়ে আচার করেছিল! আরাে গােটাকয়েক যদি ঢুক! | বাগানবাড়িতে পৌঁছােলাম আরাে পনেরাে মিনিট পর।
চারিদিকে সুপুরি আর নারকেলের বাগান—একটা পানা-ভরতি পুকুর, মাঝখানে, একতলা বাড়িটা। কিন্তু ঘরে চাবিবন্ধ। মালিটা কোথায় কেটে পড়েছে, কে জানে!
টেনিদা বললে, কুছ পরােয়া নেই। চুলােয় যাক মালি। বলং বলং বাহুবলং—নিজেরা উনুন খুঁড়ব-খড়ি কুড়ুৰ, রান্না কৰ—মালি ব্যাটা থাকলেই তাে ভাগ দিতে হতাে। যা হাবুল ইট কুড়িয়ে আনউনুন করতে হবে। প্যালা, কাঠ কুড়িয়ে নিয়ে আয়,-ক্যাবলাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যা।
—আর তুমি?—আমি ফস করে জিজ্ঞেস করে ফেললাম।
—আমি একটা নারকেল গাছে হেলান দিয়ে টেনিদা হাই তুলল : আমি এগুলাে সব পাহারা দিচ্ছি। সবচাইতে কঠিন কাজটাই নিলাম আমি। শেয়াল কুকুর এলে তাড়াতে হবে তাে।যা তােরাহাতে হাতে বাকি কাজগুলাে চটপট সেরে আয়।
কঠিন কাজই বটে! ইস্কুলের পরীক্ষার গার্ডদেরও অমনি কঠিন কাজ করতে হয়। ত্রৈরাশিল্পে অঙ্ক কষতে গিয়ে যখন ‘ঘােড়া-ঘােড়া ঘাস-ঘাস’ নিয়ে আমাদের দম আটকাবার জো, তখন গার্ড মােহিনীবাবুকে টেবিলে পা তুলে দিয়ে ফোরর-ফো’ শব্দে নাক ডাকাতে দেখছি।


টেনিদা বললে, যা—যা সব—দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কী করে রান্নাটা করে ফ্যাল-বড় খিদে পেয়েছে।
তা পেয়েছে বইকি। পুরাে এক হাঁড়ি লেডিকেনি এখনও গজগজ করছে পেটের ভিতর। আমাদের বরাতেই শুধু অষ্টরম্ভা। প্যাচার মতাে মুখ করে আমরা কাঠ খড়ি সব কুড়িয়ে আনলাম।
টেনিদা লিস্টি বার করে বললে, মাছের কালিয়া–প্যালা রাঁধিবে। আমাকে দিয়েই শুরু। আমি মাথা চুলকে বললাম, খিচুড়ি-টিচুড়ি আগে হয়ে যাক—তবে তাে? —খিচুড়ি লাস্ট আইটেম—গরম গরম খেতে হবে। কালিয়া সকলের আগে। নে প্যালালেগে যা—
ক্যাবলার মা মাছ কেটে নুন-টুন মাখিয়ে দিয়েছিলেন, তাই রক্ষা। কড়াইতে তেল চাপিয়ে আমি মাছ ঢেলে দিলাম তাতে।
| আরে—এ কী কাণ্ড! মাছ দেবার সঙ্গে সঙ্গে কড়াই-ভরতি ফেনা। তারপরেই আর কথা নেই—অতগুলাে মাছ তালগােল পাকিয়ে গেল একসঙ্গে। মাছের কালিয়া নয়—মাছের হালুয়া।। ক্যাবলা আদালতের পেয়ালার মতাে ঘােষণা করল : মাছের কালিয়ার তিনটে বেজে গেল।
—তবে রে ইস্টুপিড। টেনিদা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল : কঁচা তেলে মাছ দিয়ে তুই কালিয়া রাঁধছিস ? এবার তাের পালাজ্বরের পিলেরই একদিন কি আমারই একদিন।
এ তাে মার্টিনের রেল নয়—সােজা মাঠের রাস্তা। আমার কান পাকড়াবার জন্যে টেনিদার হাতটা এগিয়ে আসবার আগেই আমি হাওয়া। একেবারে পাব মেলের স্পিডে।
টেনিদা চেঁচিয়ে বললে, খিচুড়ির লিস্ট থেকে পালার নাম কাটা গেল। তা যাক। কপালে আজ হরিমটর আছে সে তাে গােড়াতেই বুঝতে পেরেছি। গােমড়া মুখে একটা।
আমড়া-গাছতলায় এসে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম।
বসেবসে কাঠপিপড়ে দেখছি, হঠাৎ গুটি গুটি হাবুল আর ক্যাবল এসে হাজির।
—কী রে, তােরাও ? ক্যাবলা ব্যাজার মুখে বললে, খিচুড়ি টেনিদা নিজেই রাঁধবে। আমাদের আরও খড়ি আনতে পাঠাল।
সেই মুহূর্তেই হাবুল সেনের আবিষ্কার! একেবারে কলম্বাসের আবিষ্কার যাকে বলে।
—এই প্যালা—দ্যাখছস? ওই গাছটায় কীরকম জলপাই পাকছে!
আর বলতে হলাে না। আমাদের তিনজনের | পেটেই তখন খিদেয় ইদুর লাফাচ্ছে।
জলপাই—জলপাই-ই সই। সঙ্গে সঙ্গে আমরা গাছে উঠে। পলাম—আহা টকটক মিঠেমিঠে জলপাই—যেন অমৃত।
হাবুলের খেয়াল হলাে প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে।
-এই, টেনিদার খিচুড়ি কী হইল? ঠিক কথা—খিচুড়ি তাে এতক্ষণে হয়ে যাওয়া উচিত। তড়াক করে গাছ থেকে নেমে পড়ল ওরা। হাতের কাছে পাতা-টাতা যা পেলে, তাই নিয়ে ছুটল উদ্ধশ্বাসে। আমিও গেলাম পেছনে পেছনে, আশায় আশায়। মুখে যাই বলুক—এক হাতা খিচুড়িও কি আমায় দেবে না? প্রাণ কি এত পাষাণ হবে টেনিদার?
কিন্তু খানিক দূরে এগিয়ে আমরা তিনজনেই থমকে দাঁড়ালাম। একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ! | টেনিদা সেই নারকেল গাছটায় হেলান দিয়ে ঘুমুচ্ছে। আর মাঝে মাঝে বলছে, দে—দে ক্যাবলা, পিঠটা আর একটু ভালাে করে চুলকে দে।
পিঠ চুলকে দিচ্ছে—সন্দেহ কী। কিন্তু সে ক্যাবলা নয়—একটা গােদা বানর। আর চার-পাঁচটা গােল হয়ে বসেছে টেনিদার চারিদিকে। কয়েকটা তাে মুঠো মুঠো চাল ভাল মুখে পুরছে, একটা আলুগুলাে সাবাড় করছে আর আস্তে আস্তে টেনিদার পিঠ চুলকে দিচ্ছে। আরামে হাঁ করে ঘুমুচ্ছে টেনিদা, থেকে থেকে বলছে, দে ক্যাবলা, আর একটু ভালাে করে চুলকে দে!
এবার আমরা তিনজনেই গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম। টেনিদা-বাঁদর-বাঁদর।। —কী! আমি বাঁদর!—বলেই টেনিদা হাঁ করে সােজা হয়ে বসল—সঙ্গে সঙ্গেই বাপ বাপ বলে চিৎকার। -ই-ই-ক্লি-ক্লিচ। কিচকিচ!
চোখের পলকে বানরগুলাে কাঁঠাল গাছের মাথায়। চাল-ডাল-আলুর পুটলিও সেইসঙ্গে। আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে তরিবত করে খেতে লাগল—সেইসঙ্গে কী বিচ্ছিরি ভেংচি। ওই ভেংচি দেখেই না লঙ্কার রাক্ষসগুলাে ভয় পেয়ে যুদ্ধে হেরে গিয়েছিল।
পুকুরের ঘাটলায় চারজনে আমরা পাশাপাশি চুপ করে বসে রইলাম। যেন শােকসভা। খানিক পরে ক্যাবলাই স্তব্দতা ভাঙল।
- বনভােজনের চারটে বাজল।।
– তা বাজল।—টেনিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলল । কিন্তু কী করা যায় বলতে প্যালা? সেই লেডিকেনিগুলাে কখন হজম হয়ে গেছে—পেট চুই-ছুঁই করছে খিদেয়।
অগত্যা আমি বললাম বাগানে একটি গাছে জলপাই পেকেছে, টেনিদা—
জলপাই! ইউরেকা! বনে ফলভােজন— সেইটেই তাে আসল বনভােজন। চল চল, শিগগির চল। লাফিয়ে উঠে টেনিদা বাগানের দিকে ছুটল।

আকাশে সাতটি তারা - জীবনানন্দ দাশ





আকাশে সাতটি তারা
জীবনানন্দ দাশ

আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে।
বসে থাকি; কামরাঙা-লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতাে 
গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে—আসিয়াছে শান্ত অনুগত 
বাংলার নীল সন্ধ্যা—কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে; 
আমার চোখের পরে আমার মুখের 'পরে চুল তার ভাসে; 
পৃথিবীর কোনাে পথ এ কন্যারে দেখে নি কো—দেখি নাই অত 
অজস্র চুলের চুমা হিজলে কাঁঠালে জামে ঝরে অবিরত, 
জানি নাই এত স্নিগ্ধ গন্ধ ঝরে রূপসীর চুলের বিন্যাসে


পৃথিবীর কোনাে পথে : নরম ধানের গন্ধ—কলমীর ঘ্রাণ, 
হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদ-সরপুঁটিদের
মৃদু ঘ্রাণ, কিশােরীর চালধােয়া ভিজে হাত—শীত হাতখান,
কিশােরের পায়ে- দলা মুথাঘাস—লাল লাল বটের ফলের 
ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতা—এরই মাঝে বাংলার প্রাণ; 
আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি পাই টের।

হিমালয় দর্শন - বেগম রােকেয়া


হিমালয় দর্শন
বেগম রােকেয়া

যথা সময় যাত্রা করিয়া শিলিগুড়ি স্টেশনে আসিয়া পঁহুছিলাম। শিলিগুড়ি হইতে হিমালয় রেল রােড আরম্ভ হইয়াছে। ইস্ট ইন্ডিয়ান গাড়ির অপেক্ষা ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলগাড়ি ছােটো, হিমালয়ান রেলগাড়ি আবার তাহার অপেক্ষাও ছােটো, ক্ষুদ্র গাড়িগুলি খেলনা গাড়ির মতাে বেশ সুন্দর দেখায়। আর গাড়িগুলি খুব নীচু।-যাত্রীগণ ইচ্ছা করিলে চলিবার সময়ও অনায়াসে উঠিতে নামিতে পারেন।
আমাদের ট্রেন অনেক আঁকাবাঁকা পথ অতিক্রম করিয়া ধীরে ধীরে উপরে উঠিতে লাগিলগাড়িগুলি ‘কটাটটা’-শব্দ করিতে করিতে কখনও দক্ষিণে কখনও উত্তরে আঁকিয়া বাঁকিয়া চলিল। পথের দুই ধারে মনােরম দৃশ্য—কোথাও অতি উচ্চ (step) চূড়া, কোথাও নিবিড় অরণ্য।
ক্রমে আমরা সমুদ্র (sea level) হইতে তিন হাজার ফিট উচ্চে উঠিয়াছি, এখনও শীত বােধ হয় না, কিন্তু মেঘের ভেতর দিয়া চলিয়াছি। নিম্ন উপত্যকায় নির্মল শ্বেত কুজঝটিকা দেখিয়া সহসা নদী বলিয়া ভ্রম জন্মে। তরু, লতা, ঘাস, পাতা-সকলই মনােহর। এত বড়াে বড়াে ঘাস আমি পূর্বে দেখি নাই। হরিদ্বর্ণ চায়ের ক্ষেত্রগুলি প্রাকৃতিক শােভা আরও শতগুণ বৃদ্ধি করিয়াছে। দূর হইতে সারি সারি চারাগুলি বড়াে সুন্দর বােধ হয়। মাঝে মাঝে মানুষের চলিবার সংকীর্ণ পথগুলি ধরণীর সীমন্তের ন্যায় দেখায়! নিবিড় শ্যামল বন বসুমতীর ঘন কেশপাশ, আর পথগুলি আঁকা বাঁকা সিথি!
রেলপথে অনেকগুলি জলপ্রপাত বা নিঝর দৃষ্টিগােচর হইল—ইহার সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। কোথা হইতে আসিয়া ভীমবেগে হিমাদ্রির পাষাণ হৃদয় বিদীর্ণ করিতে করিতে ইহারা কোথায় চলিয়াছে। ইহাদেরই কোন একটি বিশালকায় জাহ্নবীর উৎস, একথা সহসা বিশ্বাস হয় কি? একটি বড়াে ঝরনার নিকট ট্রেন থামিল, আমরা ভাবিলাম, যাহাতে আমরা প্রাণ ভরিয়া জলপ্রবাহ দেখিতে পাই, সেই জন্য বােধহয় গাড়ি থামিয়াছে। (বাস্তবিক সেজন্য কিন্তু ট্রেন থামে নাই—অন্য কারণ ছিল। সেইখানে জল পরিবর্তন করা হইতেছিল।) যে কারণেই ট্রেন থামুক-আমাদের মনােরথ পূর্ণ হইল।
এখন আমরা চারি হাজার ফিট উর্ধ্বে উঠিয়াছি, বুশীত অনুভব করি না, কিন্তু গরমের জ্বালায় যে এতক্ষণ প্রাণ কষ্ঠাগত ছিল-সে জুলুম হইতে রক্ষা পাইলাম। অল্প অল্প বাতাস মৃদু গতিতে বহিতেছে।
অবশেষে কারসিয়ং স্টেশনে উপস্থিত হইলাম, এখানকার উচ্চতা ৪৮৬৪ ফিট। স্টেশন হইতে আমাদের বাসা অধিক দূর নহে, শীঘ্রই আসিয়া পঁহুছিলাম। আমাদের ট্রাঙ্ক কয়টা প্রমক্রমে দার্জিলিঙের ঠিকানায় book করা হইয়াছিল। জিনিসপত্রের অভাবে বাসায় আসিয়াও (সন্ধ্যার পূর্বে) গৃহসুখ (at home) অনুভব করিতে পারি নাই! সন্ধ্যার ট্রেনে আমাদের ট্রাঙ্কগুলি ফিরিয়া আসিল। আমাদের দার্জিলিং যাইবার পূর্বে আমাদের জিনিসপত্র থাকার বায়ু সেবন করিয়া চরিতার্থ হইল! পরদিন হইতে আমরা সম্পূর্ণ গৃহসুখে আছি। তাই বলি, কেবল আশ্রয় পাইলে সুখে গৃহে থাকা হয় না, আবশ্যকীয় আসবাব সরঞ্জামও চাই।
এখানে এখনও শীতের বৃদ্ধি হয় নাই, গ্রীষ্মও নাই। এ সময়কে পার্বত্য বসন্তকাল বলিলে কেমন হয় ? সুর্যকিরণ প্রখর বােধ হয়। আমাদের আসিবার পর একদিন মাত্র সামান্য বৃষ্টি হইয়াছিল। বায়ু ততখুবই স্বাস্থ্যকর, জল নাকি খুব ভালাে নহে। আমরা পানীয় জল ফিলটারে ছাঁকিয়া ব্যবহার করি। জল কিন্তু দেখিতে খুব পরিষ্কার স্বচ্ছ। কূপ নাই, নদী পুষ্করিণীও নাই—সবে ধন নিঝরের জল। ঝরনার সুবিমল, সুশীতল জলদর্শনে চক্ষু জুড়ায়, স্পর্শনে হস্ত জুড়ায় এবং ইহার চতুস্পার্ঘস্থিত শীতল বাতাসে, না, ঘন কুয়াশায় প্রাণ জুড়ায়!
এখানকার বায়ু পরিস্কার ও হালকা। বায়ু এবং মেদের লুকোচুরি খেলা দেখিতে চমৎকার ! এই মেঘ এদিকে আছে, ওদিক হইতে বাতাস আসিল,মেঘখণ্ডকে তাড়াইয়া লইয়া চলিল। প্রতিদিন অস্তমান রবি বায়ু এবং মেঘ লইয়া মনােহর সৌন্দর্যের রাজ্য রচনা করে। পশ্চিম গগনে পাহাড়ের গায়ে তরল স্বর্ণ ঢালিয়া দেওয়া হয়। অতঃপর খণ্ড খণ্ড সুকুমার মেঘগুলি সুকোমল অঙ্গে সুবর্ণ মাখিয়া বায়ুভরে ইতস্তত ছুটাছুটি করিতে থাকে। ইহাদের এই তামাশা দেখিতেই আমার সময় অতিবাহিত হয়, আত্মহারা হইয়া থাকি, আমি কোনাে কাজ করিতে পারি না।
মনে পড়ে একবার মহিলায় টেকির শাকের কথা পাঠ করিয়াছি। টেকি শাককে আমি ক্ষুদ্র গুল্ম বলিয়াই জানিতাম। কেবল ভূ-তত্ত্ব (Geology) গ্রন্থে পাঠ করিয়াছিলাম যে, কারনিফেরাস যুগে বড় বড় ঢেকিন্তু ছিল। এখন সেই টেকিতবু স্বচক্ষে দেখিলাম—ভারী আনন্দ হইল। তরুবর ২০/২৫ ফিট উচ্চ হইবে।
কোনাে কোনাে স্থানে খুব নিবিড় বন। সুখের বিষয় বাঘ নাই, তাই নির্ভয়ে বেড়াইতে পারি, আমরা নির্জন বন্য পথেই বেড়াইতে ভালােবাসি। সর্প এবং ছিনে জোঁক আছে। এ পর্যন্ত সর্পের সহিত আমাদের সাক্ষাৎ হয় নাই। কেবল দুই তিন বার জোঁকে রক্ত শােষণ করিয়াছে।
এদেশের স্ত্রীলােকেরা জোঁক দেখিলে ভয় পায় না। আমাদের ভুটিয়া চাকরানি ‘ভালু' বলে, ‘জেকে কি ক্ষতি করে ? রক্ত শােষণ শেষ হইলে আপনিই চলিয়া যায়। ভুটিয়ানিরা সাত গজ লম্বা কাপড় ঘাঘরার মতাে করিয়াপরে, কোমরে একখণ্ড কাপড় জড়ানাে থাকে, গায়ে জ্যাকেট এবং বিলাতি শাল দ্বারা মাথা ঢাকে, পৃষ্ঠে দুই এক মন বােঝা লইয়া অনায়াসে প্রস্তর-সল আবুড়াখাবুড়া পথ বহিয়া উচ্চে উঠে; ঐরুপ নীচেও যায়। যে পথ দেখিয়াই আমাদের সাহস গায়েব হয়—সেই পথে উহারা বােঝা লইয়া অবলীলাক্রমে উঠে।

মহিলার সম্পাদক মহাশয় আমাদের সম্বন্ধে একবার লিখিয়াছিলেন যে, রমণীজাতি দুর্বল বলিয়া তাঁহাদের নাম অবলা। জিজ্ঞাসা করি, এই ভূটিয়ানিরাও ঐ অবলা জাতির অন্তর্গত না কি? ইহারা উদরান্নের জন্য পুরুষদের প্রত্যাশী নহে; সমভাবে উপার্জন করে। বরং অধিকাংশ স্ত্রীলােকদিগকেই পাথর বহিতে দেখি-পুরুষেরা বেশি বােঝা বহন করে না। অবলারা প্রস্তর বহিয়া লইয়া যায়। সবলেরা পথে পাথর বিছাইয়া রাস্তা প্রস্তুত করে, সে কাজে বালক বালিকরাও যােগদান করে। এখানে সবলেরা বালক বালিকার দলভুক্ত বলিয়া বােধ হয়। | ভূটিয়ানিরা পাহাড়নি” বলিয়া আপন পরিচয় দেয়, এবং আমাদিগকে নীচেকা আমি’ বলে! যেন ইহাদের মতে নীচেকা আদমি'-ই অসভ্য! স্বভাবত ইহারা শ্রমশীলা, কার্যপ্রিয়, সাহসী ও সত্যবাদী। কিন্তু নীচেকা আদমি'র সংস্রবে থাকিয়া ইহারা ক্রমশ সশ্যাণরাজি হারাইতেছে। বাজারের পয়সা অল্পস্বল্প চুরি করা, দুধে জল মিশানাে ইত্যাদি দোষ শিখিতেছে। আবার ‘নীচেকা আদমি'র সঙ্গে বিবাহও হয়! ঐরূপে উহারা অন্যান্য জাতির সহিত মিশিতেছে। | আমাদের বাসা হইতে প্রায় এক মাইল দূরে বড়াে একটা ঝরনা বহিতেছে; এখান হইতে ঐ দুগ্ধফেননিভ জলের স্রোত দেখা যায়। দিবানিশি তাহার কল্লোল গীতি শুনিয়া ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির উচ্ছাস দ্বিগুণ ত্রিগুণ বেগে প্রবাহিত হয়। বলি, প্রাণটাও কেন ঐ নিঝরের ন্যায় বহিয়া গিয়া পরমেশ্বরের চরণপ্রান্তে লুটাইয়া পড়ে না?
অধিক কী বলিব, আমি পাহাড়ে আসিয়া অত্যন্ত সুখী এবং ঈশ্বরের নিকট কৃতজ্ঞ হইয়াছি। সমুদ্রের সামান্য নমুনা, অর্থাৎ বঙ্গোপসাগর দেখিয়াছি, বাকি ছিল পর্বতের একটি নমুনা দেখা। এখন সে সাধও পূর্ণ হইল। | না, সাধ তাে মিটে নাই! যত দেখি, ততই দর্শন পিপাসা শতগুণ বাড়ে! কিন্তু কেবল দুইটি চক্ষু দিয়াছেন, তাহা দ্বারা কত দেখিব? প্রভু অনেকগুলি চক্ষু দেন নাই কেন? যত দেখি, যত ভাবি, তাহা ভাষায় ব্যক্ত করিবার ক্ষমতা নাই। প্রত্যেকটি উচ্চশৃশ, প্রত্যেকটি ঝরনা প্রথমে যেন বলে, আমায় দেখ! আমায় দেখ! যখন তাহাকে বিস্ময়-বিস্ফারিত নয়নে দেখি, তখন তাহারা ঈষৎ হাস্যে ভূকুটি করিয়া বলে, আমাকে কী দেখ? আমার স্রষ্টাকে স্মরণ করাে! ঠিক কথা। চিত্র দেখিয়া চিত্রকরের নৈপুণ্য বুঝা যায়। নতুবা নাম শুনিয়া কে কাহাকে চিনে? আমাদের জন্য হিমালয়ের এই পাদদেশটুকু কত বৃহৎ, কত বিস্তৃত-কী মহান! আর সেই মহাশিল্পীর সৃষ্ট জগতে হিমালয় কত ক্ষুদ্র! বালুকাকণা বলিলেও বড়াে বলা হয়!
আমাদের এমন সুন্দর চক্ষু, কর্ণ, মন লইয়া যদি আমরা স্রষ্টার গুণকীর্তন না করি, তবে কি কৃতগ্নতা হয় না? মন, মস্তিষ্ক, প্রাণ সৰ লইয়া উপাসনা করিলে, তবে তৃপ্তি হয়। কেবল টিয়াপাখির মতাে কণ্ঠস্থ কতকগুলি শব্দ উচ্চারণ করিলে (অন্তত আমার মতে) উপাসনা হয় না। তদ্রুপ উপাসনায় প্রাণের আবেগ থাকে কই? প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দর্শনকালে মন প্রাণ স্বতঃই সমস্বরে বলিয়া উঠে, “ঈশ্বরই প্রশংসার যােগ্য। তিনিই ধন্য। তখন এসব কথা মুখে উচ্চারণের প্রয়ােজনও হয় না।
(সংক্ষেপিত ও সম্পাদিত)

নােঙর - অজিত দত্ত

নােঙর
অজিত দত্ত

পাড়ি দিতে দূর সিন্ধুপারে 
নােঙর গিয়েছে পড়ে তটের কিনারে।। 
সারারাত মিছে দাঁড় টানি, 
মিছে দাঁড় টানি। 
জোয়ারের ঢেউগুলি ফুলে ফুলে ওঠে, 
এ-তরীতে মাথা ঠুকে সমুদ্রের দিকে তারা ছােটে। 
তারপর ভাঁটার শােষণ 
স্রোতের প্রবল প্রাণ করে আহরণ। 
জোয়ার-ভাটায় বাঁধা এ-তটের কাছে 
আমার বাণিজ্য-তরী বাঁধা পড়ে আছে। 

যতই না দাঁড় টানি, যতই মাস্তুলে বাধি পাল,
নােঙরের কাছি বাঁধা তবু এ নৌকা চিরকাল।
নিস্তব্দ মুহূর্তগুলি সাগরগর্জনে ওঠে কেঁপে, 
স্রোতের বিদ্রুপ শুনি প্রতিবার দাঁড়ের নিক্ষেপে। 
যতই তারার দিকে চেয়ে করি দিকের নিশানা
ততই বিরামহীন এই দাঁড় টানা।

তরী ভরা পণ্য নিয়ে পাড়ি দিতে সপ্তসিন্ধুপারে, 
নােঙর কখন জানি পড়ে গেছে তটের কিনারে। 
সারারাত তবু দাঁড় টানি, 
তবু দাঁড় টানি।।

নব নব সৃষ্টি - সৈয়দ মুজতবা আলী

.

নব নব সৃষ্টি
সৈয়দ মুজতবা আলী

সংস্কৃত ভাষা আত্মনির্ভরশীল। কোনাে নূতন চিন্তা, অনুভূতি কিংবা বস্তুর জন্য নবীন শব্দের প্রয়ােজন হলে সংস্কৃত ধার করার কথা না ভেবে আপন ভাণ্ডারে অনুসন্ধান করে, এমন কোনাে ধাতু বা শব্দ সেখানে আছে কি না যার সামান্য অদল বদল করে কিংবা পুরােনাে ধাতু দিয়ে নবীন শব্দটি নির্মাণ করা যায় কি না। তার অর্থ অবশ্য এ নয় যে, সংস্কৃত কস্মিনকালেও বিদেশি কোনাে শব্দ গ্রহণ করেনি। নিয়েছে, কিন্তু তার পরিমাণ এতই মুষ্টিমেয় যে, সংস্কৃতকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষা বলাতে কারও কোনাে আপত্তি থাকার কথা নয়। প্রাচীন যুগের সব ভাষাই তাই। হিব্রু, গ্রিক, আবেস্তা এবং ঈষং পরবর্তী যুগের আরবিও আত্মনির্ভরশীল এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বয়ংসম্পূর্ণ।

বর্তমান যুগের ইংরেজি ও বাংলা আত্মনির্ভরশীল নয়। আমরা প্রয়ােজন মতাে এবং অপ্রয়ােজনেও ভিন্ন ভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ নিয়েছি এবং নিচ্ছি। পাঠান-মােগল যুগে আইন-আদালত খাজনা-খারিজ নুতন রূপে দেখা দিল বলে আমরা আরবি ও ফার্সি থেকে প্রচুর শব্দ গ্রহণ করেছি। পরবর্তী যুগে ইংরেজি থেকে ইংরেজির মারফতে অন্যান্য ভাষা থেকে নিয়েছি এবং নিচ্ছি।
বিদেশি শব্দ নেওয়া ভালাে না মন্দ সে প্রশ্ন অবান্তর। নিয়েছি এবং এখনও সজ্ঞানে আপন খুশিতে নিচ্ছি এবং শিক্ষার মাধ্যমৰূপে ইংরেজিকে বর্জন করে বাংলা নেওয়ার পর যে আরও প্রচুর ইউরােপীয় শব্দ আমাদের ভাষায় ঢুকবে, সে সম্বন্ধেও কারও কোনাে সন্দেহ নেই। আলু-কপি আজ রান্নাঘর থেকে তাড়ানাে মুশকিল, বিলিতি ওষুধ প্রায় সকলেই খান, ভবিষ্যতে আরও নূতন নূতন ওষুধ খাবেন বলেই মনে হয়। এই দুই বিদেশি বস্তুর ন্যায় আমাদের ভাষাতেও বিদেশি শব্দ থেকে যাবে, নূতন আমদানিও বন্ধ করা যাবে না।
পৃথিবীতে কোনাে জিনিসই সম্পূর্ণ অসম্ভব নয়। অন্তত চেষ্টা করাটা অসম্ভবনাও হতে পারে। হিন্দি উপস্থিত সেই চেষ্টাটা করছেন—বহু সাহিত্যিক উঠে পড়ে লেগেছেন, হিন্দি থেকে আরবি, ফার্সি এবং ইংরেজি শব্দ তাড়িয়ে দেবার জন্য। চেষ্টাটার ফল আমি হয়তাে দেখে যেতে পারব না। আমার তরুণ পাঠকেরা নিশ্চয়ই দেখে যাবেন। ফল যদি ভালাে হয় তখন তারা না হয় চেষ্টা করে দেখবেন। (বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ স্বচ্ছন্দে লিখেছেন, ‘আব্রু দিয়ে, ইজজৎ দিয়ে, ইমান দিয়ে, বুকের রক্ত দিয়ে। নজরুল ইসলাম ইনকিলাব'—ইনক্লাব’ নয়—এবং ‘শহিদ’ শব্দ বাংলায় ঢুকিয়ে গিয়েছেন। বিদ্যাসাগর ‘সাধু’ রচনায় বিদেশি শব্দ ব্যবহার করতেন না, বেনামিতে লেখা ‘অসাধু' রচনায় চুটিয়ে আরবি-ফার্সি ব্যবহার করতেন। আর অতিশয় নিষ্ঠাবান ব্রাত্মণ পণ্ডিত হরপ্রসাদ আরবি-ফার্সি শব্দের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘােষণা করা ‘আহাম্মুখী’ বলে মনে করতেন। 'আলাল’ ও ‘হুতােম'-এর ভাষা বিশেষ উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল; সাধারণ বাংলা এ-স্রোতে গা ঢেলে দেবে না বলে তার উল্লেখ এথলে নিষ্প্রয়ােজন এবং হিন্দির বঙ্কিম স্বয়ং প্রেমচন্দ্র হিন্দিতে বিস্তর আরবি-ফার্সি ব্যবহার করেছেন।)
এস্থলে আর একটি কথা বলে রাখা ভালাে। রচনার ভাষা তার বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে। শংকরদর্শনের আলােচনায় ভাষা সংস্কৃতশব্দবহুল হবেই, পক্ষান্তরে মােগলাই রেস্তোরাঁর বর্ণনাতে ভাষা অনেকখানি ‘হতােম'-ঘঁষা হয়ে যেতে বাধ্য।‘বসুমতীর সম্পাদকীয় রচনার ভাষা এক—তাতে আছে গাম্ভীর্য, বাঁকা চোখের ভাষা ভিন্ন—তাতে থাকে চটুলতা।
বাংলায় যে-সব বিদেশি শব্দ ঢুকেছে তার ভিতরে আরবি, ফার্সি এবং ইংরেজিই প্রধান। সংস্কৃত শব্দ বিদেশি নয়, এবং পাের্তুগিজ, ফরাসি, স্প্যানিশ শব্দ এতই কম যে, সেগুলাে নিয়ে অত্যধিক দুশ্চিন্তা করার কোনাে কারণ নেই।
বাংলা ভিন্ন অন্য যে-কোনাে ভাষার চর্চা আমরা করি না কেন, সে ভাষার শব্দ বাংলাতে ঢুকবেই। সংস্কৃত চর্চা এদেশে ছিল বলে বিস্তর সংস্কৃত শব্দ বাংলায় ঢুকেছে, এখনও আছে বলে অল্পবিস্তর ঢুকছে, যতদিন থাকবে ততদিন আরও ঢুকবে বলে আশা করতে পারি। স্কুল-কলেজ থেকে যে আমরা সংস্কৃত চর্চা উঠিয়ে দিতে চাই না তার অন্যতম প্রধান কারণ বাংলাতে এখনও আমাদের বহু সংস্কৃত শব্দের প্রয়ােজন, সংস্কৃত চর্চা উঠিয়ে দিলে আমরা অন্যতম প্রধান খাদ্য থেকে বঞ্চিত হব।
ইংরেজির বেলাতেও তাই।বিশেষ করে দর্শন, নন্দনশা, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা ইত্যাদি জ্ঞান এবং ততােধিক প্রয়ােজনীয় বিজ্ঞানের শব্দ আমরা চাই। রেলের ইঞ্জিন কী করে চালাতে হয়, সে সম্বন্ধে বাংলাতে কোনাে বই আছে বলে জানি নে, তাই এসব টেকনিক্যাল শব্দের প্রয়ােজন যে আরও কত বেশি সে সম্বন্ধে কোনাে সুস্পষ্ট ধারণা এখনও আমাদের মনের মধ্যে নেই। সুতরাং ইংরেজি চর্চা বন্ধ করার সময় এখনও আসেনি।
একমাত্র আরবি-ফার্সি শব্দের বেলা অনায়াসে বলা যেতে পারে যে, এই দুই ভাষা থেকে ব্যাপকভাবে আর নূতন শব্দ বাংলাতে ঢুকবে না। পশ্চিম বাংলাতে আরবি-ফার্সি চর্চা যাবাে যাবাে করছে, পূর্ব বাংলায়ও এ-সৰ ভাষার প্রতি তরুণ সম্প্রদায়ের কৌতুহল অতিশয় ক্ষণ বলে তার আয়ু দীর্ঘ হবে বলে মনে হয় না এবং শেষ কথা, আরব-ইরানে অদূর ভবিষ্যতে যে হঠাৎ কোনাে অভূতপূর্ব জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা আরম্ভ হয়ে বাংলাকে প্রভাবিত করবে তার সম্ভাবনাও নেই।
কিন্তু যে-সব আরবি-ফার্সি শব্দ বাংলাতে ঢুকে গিয়েছে তার অনেকগুলাে যে আমাদের ভাষাতে আরও বহুকাল ধরে চালু থাকবে, সে বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই এবং দ্বিতীয়ত কোনাে কোনাে লেখক নূতন বিদেশি শব্দের সন্ধান বর্জন করে পুরােনাে বাংলার—‘চণ্ডী’ থেকে আরম্ভ করে হুতােম পর্যন্ত—অচলিত আরবি-ফার্সি শব্দ তুলে নিয়ে সেগুলাে কাজে লাগাবার চেষ্টা করছেন। কিছুদিন পূর্বেও এই এক্সপেরিমেন্ট করা অতিশয় কঠিন ছিল, কিন্তু অধুনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে বাধ্য হয়ে পুরােনাে বাংলা পড়তে হয় তারা এই সব শব্দের অনেকগুলাে অনায়াসে বুঝতে পারবে বলে অচলিত অনেক আরবি-ফার্সি শব্দ নুতন মেয়াদ পাবে। এই পরিস্থিতির সামনে জীবন্ত এসব শব্দের একটা নূতন খতেন নিলে ভালাে হয়।
ভারতীয় মক্তব-মাদ্রাসায় যদিও প্রচুর পরিমাণে আরবি ভাষা পড়ানাে হয়েছিল, তবু কার্যত দেখা গেল ভারতীয় আর্যগণ ইরানি আর্য সাহিত্য অর্থাৎ ফার্সির সৌন্দর্যে অভিভূত হলেন বেশি। উর্দু সাহিত্যের মুল সুর তাই ফার্সির সঙ্গে বাঁধা—আরবির সঙ্গে নয়। হিন্দি গদ্যের উপরও বাইরে যে প্রভাব পড়েছে সেটা ফার্সি-আরবি নয়।
একদা ইরানে যে রকম আর্য ইরানি ভাষা ও সেমিতি আরবি ভাষার সংঘর্ষে নবীন ফার্সি জন্মগ্রহণ করেছিল, ভারতবর্ষে সেই সংঘর্ষের ফলে সিন্ধি, উর্দু ও কাশ্মীরি সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। কিন্তু আরবির এই সংঘর্ষ ফার্সির মাধ্যমে ঘটেছিল বলে কিংবা অন্য যে-কোনাে কারণেই হােক, 'ভারতবর্ষীয় এ তিন ভাষা ফার্সির মতাে নব নব সৃষ্টি দিয়ে ঐশ্বর্যশালী সাহিত্যসৃষ্টি করতে পারল না। উর্দুতে কবি ইকবালই এ তত্ত্ব সম্যক হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন ও নুতন সৃষ্টির চেষ্টা করে উর্দুকে ফার্সির অনুকরণ থেকে কিঞিৎ নিষ্কৃতি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যসৃষ্টি তার পদাবলি কীর্তনে। এ সাহিত্যের প্রাণ এবং দেহ উভয়ই খাঁটি বাঙালি। এ সাহিত্যে শুধু যে মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণ বাংলায় খাঁটি কানুরূপ ধারণ করেছেন তাই নয়, শ্রীমতী শ্রীরাধাও যে একেবারে খাটি বাঙালি মেয়ে সে-বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই। ভাটিয়ালির নায়িকা, বাউলের ভক্ত, মুরশিদিয়ার আশিক ও পদাবলির শ্রীরাধা একই চরিত্র একই রূপে প্রকাশ পেয়েছেন।
বাঙালির চরিত্রে বিদ্রোহ বিদ্যমান। তার অর্থ এই যে, কী রাজনীতি, কী ধর্ম, কী সাহিত্য, যখনই যেখানে সে সত্য শিব সুন্দরের সন্ধান পেয়েছে তখনই সেটা গ্রহণ করতে চেয়েছে; এবং তখন কেউ ‘গতানুগতিক পন্য’ ‘প্রাচীন ঐতিহ্য’ এর দোহাই দিয়ে সে প্রচেষ্টায় বাধা দিতে গেলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। এবং তার চেয়েও বড় কথা,যখন সে বিদ্রোহ উজ্জ্বলতায় পরিণত হতে চেয়েছে, তখন তার বিরুদ্ধে আবার বিদ্রোহ করেছে।
এ বিদ্রোহ বাঙালি হিন্দুর ভিতরই সীমাবদ্ধ নয়। বাঙালি মুসলমানও এ কর্মে পরম তৎপর। ধর্ম বদলালেই জাতির চরিত্র বদলায় না।
(সংক্ষেপিত ও সম্পাদিত)

পথে প্রবাসে - অন্নদাশংকর রায়


পথে প্রবাসে
অন্নদাশংকর রায়


ভারতবর্ষের মাটির ওপর থেকে শেষবারের মতো পা তুলে নিলুম আর সদ্যোজাত শিশুর মতো মায়ের সঙ্গে আমার যোগসুত্র এক মুহুর্তে ছিন্ন হয়ে গেল। একটি পদক্ষেপে যখন সমগ্র ভারতবর্ষের কক্ষচ্যুত হয়ে অনন্ত শুন্যে পা বাড়ালুম তখন যেখান থেকে পা তুলে নিলুম সেই পদ-পরিমাণ ভূমি যেন আমাকে গোটা ভারতবর্ষেরই স্পর্শ-বিরহ অনুভব করিয়ে দিচ্ছিল; প্রিয়জনের আঙুলের ডগাটুকুর স্পর্শ যেমন প্রিয়জনের সকল দেহের সম্পূর্ণ স্পর্শ অনুভব করিয়ে দেয়, এও যেন তেমনি।
জাহাজে উঠে বম্বে দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি করুণ। এত বড়ো ভারতবর্ষ এসে এতটুকু নগরপ্রান্তে ঠেকেছে, আর কয়েক মুহূর্তে ওটুকুও স্বপ্ন হবে, তখন মনে হবে আরব্য উপন্যাসের প্রদীপটা যেমন বিরাটাকার দৈত্য হয়ে আলাদিনের দৃষ্টি জুড়েছিল, ভারতবর্ষের মানচিত্রখানা তেমনি মাটি জল ফুল পাখি মানুষ হয়ে আজন্ম আমার চেতনা হয়েছিল, এতদিনে আবার যেন মানচিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে।
আর মানচিত্রে যাকে ভারতবর্ষ ও আফ্রিকার মাঝখানে গোস্পদের মটো দেখাত সেই এখন হয়েছে পায়ের তলার আরব সাগর, পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ কোনো দিকে চক্ষু তার অবধি পায় না। ঢেউগুলো তার অনুচর হয়ে আমাদের জাহাজখানাকে যেন গলাধাক্কা দিতে দিতে তার চৌকাঠ পার করে দিতে চলেছে। ঋতুটার নাম বর্ষা কতু, মনসুনের প্রভঞ্জনাহুতি পেয়ে সমুদ্র তার শত সহস্র জিহ্বা লকলক করছে, জাহাজখানাকে একবার এদিকে কাৎ করে একবার ওদিক কাৎ করে যেন ফুটন্ত তেলে পাঁপরের মতো উল্টে পাল্টে ভাজছে।
জাহাজ টলতে টলতে চলল, আর জাহাজের অধিকাংশ যাত্রি-ত্রিণী ডেক ছেড়ে শ্যা আশ্রয় করলেন। অসহ্য সমুদ্রপীড়ায় প্রথম তিন দিন আচ্ছন্নের মতো কাটল, কারুর সঙ্গে দেখা হবার জো ছিল না, প্রত্যেকেই নিজের নিজের ক্যাবিনে শয্যাশায়ী। মাঝে মাঝে দু'একজন সৌভাগ্যবান দেখা দিয়ে আশ্বসন করেন, ডেকের খবর দিয়ে যান। আর ক্যাবিন স্টুয়ার্ড খাবার দিয়ে যায়। বলা বাহুল্য জিহবা তা গ্রহণ করতে আপত্তি না করলেও উদর তা রক্ষণ করতে অস্বীকার করে।
ক্যাবিনে পড়ে পড়ে মনে ও উপবাসে দিনের পর রাত রাতের পর দিন এমন দুঃখে কাটে যে, কেউবা ভাবে যে মরণ হলেই বাঁচি, কেউ-বা ভাবে যে মরতে আর দেরি নেই। জানিনে হরবল্লভের মতাে কেউ ভাবে কি না যে, মরে তো গেছি দুর্গানাম করে কী হবে। সমুদ্রপীড়া যে কী দুঃসহ তা ভুক্তভােগী ছাড়া অপর কেউ ধারণা করতে পারবে না। হাতের কাছে রবীন্দ্রনাথের 'চয়নিকা’, মাথার যন্ত্রণায় অমন লোভনীয় বইও পড়তে ইচ্ছা করে না। ইচ্ছা করে কেবল চুপ করে পড়ে থাকতে, পড়ে পড়ে আকাশ পাতাল ভবতে।।
সদ্য-দুঃখার্ত কেউ সংকল্প করে ফেললেন যে, এডেনে নেমেই দেশে ফিরে যাবেন, সমুদ্রযাত্রার দুর্ভোগ আর সইতে পারবেন না। তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলো এডেন থেকে দেশে ফিরে যেতে চাইলেও উঠের পিঠে চড়ে মরুভূমি পেরিয়ে পারস্যের ভিতর দিয়ে ফেরবার যখন উপায় নেই তখন ফিরতে হবে সেই সমুদ্রপথেই। আমরা অনেকেই কিন্তু ঠিক করে ফেললুম মার্সেসে নেমে প্যারিসের পথে লন্ডন যাব।
আরব সাগরের পরে যখন লোহিত সাগরে পড়লুম তখন সমুদ্রপীড়া বাসি হয়ে গেছে। আফ্রিকা-আরবের মধ্যবর্তী এই হ্রদতুল্য সমুদ্রটি দুর্দান্ত নয়, জাহাজে থেকে থেকে জাহাজটার ওপর মায়াও পড়ে গেছে; তখন না মনে পড়ছে দেশকে, না ধারণা করতে পারা যাচ্ছে বিদেশকে; কোথা থেকে এসেছি ভুলে গেছি, কোথায় যাচ্ছি বুঝতে পারছিনে; তখন গতি আনন্দে কেবল ভেসে চলতেই ইচ্ছা করে, কোথাও থামবার বা নামবার সংকল্প দূর হয়ে যায়।
বিগত ও আগতের ভাবনা না ভেবে উপস্থিতের উপর দৃষ্টি ফেললুম—আপাতত আমাদের এই ভাসমান পান্থশালাটায় মন ন্যস্ত করলুম। খাওয়া -শোওয়া-খেলা-পড়া-গজ করার যেমন বন্দোবস্ত যে-কোনো ড়ো হােটেলে থাকে এখানেও তেমনি, কেবল কাবিনগুলো যা যথেষ্ট বড়ো নয়। ক্যাবিনে শুয়ে থেকে সিন্ধু-জননীর দোল খেয়ে মনে হয় খোকাদের মতো দোলনায় শুয়ে দুলছি। সমুদ্রপীড়া যেই সারল ক্যাবিনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অমনি কমলোশোবার সময়টা ছাড়া বাকি সময়টা আমরা ডেকে কিংবা বসবার ঘরে কাটাতুম। ডেকেচেয়ার ফেলে বসে কিংবা পায়চারি করতে করতে সমুদ্র দেখে দেখে চোখ শ্রান্ত হয়ে যায়; চারিদিকে জল আর জল, তাও নিস্তরঙ্গ, কেবল জাহাজের আশে পাশে ছাড়া ঢেউয়ের অস্তিত্ব নেই, যা আছে তা বাতাসের সোহাগ-চুম্বনে জলের হৃদয়-স্পন্দন। বসবার ঘরে অর্ধশায়িত থেকে খােশ গল্প করতে এর চেয়ে অনেক ভালো লাগে।
লােহিত সাগরের পরে ভূমধ্য সাগর, দুয়ের মাঝখানে যেন একটি সেতু ছিল, নাম সুয়েজ যােজক। এই যোজকের ঘটকালিতে এশিয়া এসে আফ্রিকার হাত ধরেছিল। সম্প্রতি হাতের জোড় খুলে দুই মহাদেশের মাঝখানে বিয়োগ ঘটিয়ে দেওয়া হয়েছে। যার দ্বারা তা ঘটল তার নাম সুয়েজ কেনাল। সুয়েজ কেনাল একদিকে বিচ্ছেদ ঘটাল বটে, কিন্তু অন্যদিকে মিলন ঘটাল—লোহিতের সঙ্গে ভূমধ্যের মিলন যেন ভারতের সঙ্গে ইউরােপের মিলন। কলম্বাস যা পারেননি, লেসেপস তা পারলেন। ভূমধ্য ও লোহিতের মধ্যে কয়েক শত মাইলের ব্যবধান, ঐটুকুর জন্যে ভূমধ্যের জাহাজকে লােহিতে আসতে বহু সহস্র মাইল ঘুরে আসতে হতো। মিশরের রাজারা কোন্ যুগ থেকে এর প্রতিকারের উপায় খুঁজছিলেন। উপায়টা দেখতে গেলে সুবোধ্য। ভূমধ্য ও লোহিতের মধ্যবর্তী ভুখণ্ডটাতে গোটাকয়েক হ্রদ চিরকালই আছে, এই হ্রদগুলোকে দুই সমুদ্রের সঙ্গে ও পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিলেই সেই জলপথ দিয়ে এক সমুদ্রের জাহাজ অন্য সমুদ্রে যেতে পায়। কল্পনাটা অনেক কাল আগের, কিন্তু সেটা কার্যে পরিণত হতে হতে গত শতাব্দীর দুই তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হয়ে গেল। কেনালটিতে কলাকুশলতা কী পরিমাণ আছে তা স্থপতিরাই জানেন, কিন্তু অব্যবসায়ী আমরা জানি-খার প্রতিভার স্পর্শমণি লেগে একটা বিরাট কল্পনা একটা বিরাট কীর্তিতে রূপান্তরিত হলো সেই ফরাসি স্থপতি লেসে একজন বিশ্বকর্মাতার সৃষ্টি দূরকে নিকটে এনে মানুষের সঙ্গে মানুষের পরিচয় ঘনিষ্ঠতর করেছে। যান্ত্রিক সভ্যতার শত অপরাধ যাঁরা নিত্য স্মরণ করেন, এই ভেবে তারা একটি অপরাধ মার্জনা করুন।
সুয়েজ কেনাল আমাদের দেশের যে-কোনো ছোটো নদীর মতোই অপ্রশস্ত, এত বড় জোর দুখানা জাহাজ পাশাপাশি আসা যাওয়া করতে পারে, কিন্তু কেনল যেখানে হ্রদে পড়েছে সেখানে এমন সংকীর্ণতা নেই। কেনালটির সুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি দিকে নানান রকমের গাছ, যত্ন করে লাগানো, যত্ন করে রক্ষিত, অন্যদিকে ধু-ধু করা মাঠ, শ্যামলতার আভাসটুকুও নেই। কেনালের দুই দিকেই পাথরের পাহাড়, যেদিকে মিশর সেই দিকেই বেশি। এই পাহাড়গুলিতে যেন জাদু আছে, দেখলে মনে হয় যেন কোনো কিউবিস্ট এদের আপন খেয়ালমতো জ্যামিতিক আকার দিয়েছে আর এক-একটা পাহাড়কে এক-একটা পাথর কুঁদে গড়েছে। কেনালটি যেখানে ভূমধ্যসাগরে পড়েছে সেখানে একটি শহর দাঁড়িয়ে গেছে, নাম পোর্ট সৈয়দ। জাহাজ থেকে নেমে শহরটায় বেরিয়ে আসা গেল। শহরটার বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট ফরাসি প্রভাবের সাক্ষ্য দেয়। কাফেতে খাবার সময় ফুটপাথের ওপর বসে খেতে হয়, রাস্তায় চলবার সময় ডানদিক ধরে চলতে হয়। পোর্ট সৈয়দ হলো নানা জাতের নানা দেশের মোসাফেরদের তীর্থস্থল-কাজেই সেখানে তীর্থের কাকের সংখ্যা নেই, ফাক পেলে একজনের ট্র্যাকের টাকা আর একজনের টাকে ওঠে।
পোর্ট সৈয়দ মিশরের অঙ্গ। মিশর প্রায় স্বাধীন দেশ। ইউরোপের এত কাছে বলে ও নানা জাতের পথিক-কেন্দ্র বলে মিশরীরা ইউরোপীয়দের সঙ্গে বেশি মিশতে পেরেছে, তাদের বেশি অনুকরণ করতে শিখেছে, তাদের দেশে অনায়াসে যাওয়া আসা করতে পারছে। ফলে ইউরোপীয়দের প্রতি তাদের অপরিচয়ের ভীতি বা অতিপরিচয়ের অবজ্ঞা নেই, ইউরোপের স্বাধীন মনোবৃত্তি তাদের সমাজে ও রাষ্ট্রে সারিত হয়েছে।
পোর্ট সৈয়দ ছেড়ে আমরা ভূমধ্যসাগরে পড়লুম। শান্তশিষ্টবলে ভূমধ্যসাগরের সুনাম আছে। প্রথম দিন-কতক চতুর ব্যবসাদারের মতো ভূমধ্যসাগর Honesty is the best policy’ করলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভদ্রতা রক্ষা করলে না। আর একবার করে কেউ কেউ শয্যাশায়ী হলেন। অধিকাংশকেই মার্সেলসে নামতেই হলোপোর্ট সৈয়দ থেকে মার্সে পর্যন্ত জল ছাড়া ও দুটি দৃশ্য ছাড়া দেখবার আর কিছু নেই। প্রথমটি ইটালি ও সিসিলির মাঝখানে মেসিনা প্রণালী দিয়ে যাবার সময় দুই ধারের পাহাড়ের সারি। দ্বিতীয়, স্ট্রম্বোলি আগ্নেয়গিরি কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় পাহাড়ের বুকে রাবণের চিতা।
মার্সেলসভূমধ্যসাগরের সেরা বন্দর ও ফরাসিদের দ্বিতীয় বড়ো শহর। ইতিহাসে এর নাম আছে, ফরাসিদের বন্দে মাতরম্ 'La Marseillaise'-এর এই নগরেই জন্ম। কাব্যে এ অঞ্চলের নাম আছে, ফরাসি সহজিয়া কবিদের (troubadour) প্রিয়ভূমি এই সেই Provence-বসন্ত যেখানে দীর্ঘস্থায়ী ও জ্যোৎস্না যেখানে স্বচ্ছ। এর পূর্ব দিকে সমুদ্রের কূলে কূলে ছোটো ছোটো অসংখ্য প্রাম, সেই সব গ্রামে গ্রীষ্মযাপন করতে পৃথিবীর সব দেশের লোক আসে। Bandol নামক তেমনি একটি গ্রামে আমরা একটি দুপুর কাটালুম। মোটরেকরে পাহাড়ের পর পাহাড় পেরিয়ে সেখানে যেতে হয়। পাহাড়ের ওপর থেকে মার্সেলকে দেখলে মনে হয় যেন সমুদ্র তাকে সাপের মতো সাতপাক জড়িয়ে বেঁধেছে। মার্সে শহরটাও পাহাড় কেটে তৈরি, ওর একটা রাস্তার সঙ্গে আরেকটা রাস্তা সমতল নয়, কোনো রাস্তায় ট্রামে করে যেতে যেতে ডানদিকে মোড় ফিরলে একেবারে রসাতল, কোনো রাস্তায় চলতে চলতে বাঁদিকে বেঁকে গেলে সামনে যেন স্বর্গের সিড়ি। মার্সেসের অনেক রাস্তার দুধারে গাছের সারি ও তার ওপারে ফুটপাথ।
মার্সেল থেকে প্যারিসের রেলপথে রাত কাটল। প্যারিস থেকে রেলপথে ক্যালে, ক্যালে থেকে জলপথে ডোভার এবং ডোভার থেকে রেলপথে লন্ডন।


(নির্বাচিত অংশ)