সংক্ষিপ্ত আলোচনা - লোকটা জানলই না


সংক্ষিপ্ত আলোচনা - লোকটা জানলই না

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা 'লোকটা জানলোই না' কবিতায় একজন অর্থ সর্বস্ব ধনবান লোকের কথা বলা হয়েছে। সেই লোকটা অর্থের পিছনে সারা জীবন ছুটে গেছে।আর সে বাঁদিকের বুক পকেটটা সামলাতে সারাজীবন । কিন্তু তার বুকপকেটের নিচে ছিল তার হৃদয়।অর্থাৎ তার মন,  ইচ্ছা ।যে মনকে সে  কখনোই প্রাধান্য দেয়নি। কেবল অর্থের পিছনে ছুটে গেছে বারবার। যে হৃদয়ের ঐশ্বর্য অর্থ দিয়ে পরিমাপ কর যায়না। এটা সে কখনই বোঝনি। অর্থময় জীবনকে গড়তে গিয়ে নিজের ভালোলাগাকে খোঁজেনি কখনো। সে যন্ত্রের মতো নিজেকে তৈরি করে অর্থ রোজগার করে গেছে প্রতিনিয়ত।
একসময় সে তার লক্ষ্যে পৌঁছেছে।অর্জন করেছে বিপুল পরিমাণ সম্পদ। কিন্তু তার মধ্যে তো কোনও জীবন নেই ।তাই তার বিয়ের পর ঘরে লক্ষ্মী এলেও সে এবং তার স্ত্রীর ভালোলাগা ভালবাসাকে কখনো বুঝতে পারেনি। অর্থাৎ জীবনকে অনুভব করতে পারেনি । কিন্তু যখন বৃদ্ধ বয়সে এসে তার গোটা জীবনকে দেখতে চেয়েছে বারবার, যখন সে অনুভব করতে চেয়েছে ,  তখন তার সামনে নেমে এসেছে কেবল শূন্যতা আর হতাশা। অর্থ রোজগার করতে গিয়ে জীবনের আসল সময় কখন সে চলে গেছে সে জানতেই পারেনি । তাই লেখক বলেছেন-
একদিন গোগ্রাসে গিলতে গিলতে 
দু আঙুলের ফাঁক দিয়ে  
কখন খসে পরল তার জীবন 
লোকটা জানলোই না।

সংক্ষিপ্ত আলোচনা - মহুয়ার দেশ


[ বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ ebanglaschools এর সমস্ত আলোচনা কোনো পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গের জন্য নয়। সাধারণ এবং অতি সাধারণ পিছিয়ে পড়া ছাত্র ছাত্রীদের জন্যই এই উদ্যোগ। তাদের কথা ভবেই এই আলোচনার প্রচেষ্টা। বিশিষ্টরা দূরে থাকুন । আমাদের একান্ত অনুরোধ যদি ছাত্র ছাত্রীরা এই আলোচনা থেকে উপকৃত হও তাহলে নীচের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে ভূলে যেও না। ]    



সংক্ষিপ্ত আলোচনা - মহুয়ার দেশ



'মহুয়ার দেশ' এই কবিতাটি সমর সেনের লেখা ‘কয়েকটি কবিতা’ কাব্য গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। সমর সেনের এই কবিতাটি মূলত ভাব ভিত্তিক একটি কবিতা, যেখানে কবিমনের প্রকাশ ঘটেছে। আমাদের প্রত্যেকের মনেই একটি আকাঙ্ক্ষার জায়গা থাকে যে একঘেয়েমি জীবন থেকে ক্ষণিকের মুক্তি কীভাবে লাভ করা যায়। কবি মন ও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রতিনিয়ত একঘেয়েমি অভ্যাসে তিনিও ক্লান্তি অনুভব করেছেন এবং কীভাবে এই ক্লান্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তারই পথ খুঁজেছেন বার বার। নগর জীবনের ইট কাঠ পাথরের মাঝে যন্ত্র সভ্যতার অবাধ বিচরণ মানুষের মনের ভাব ভালোবাসাকে একেবারেই মুছে দিয়ে ক্রমাগত যন্ত্রে পরিনত করেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে শহরের বুকে ছুটে চলা দম দেওয়া পুতুল গুলিও মানুষ। সেও রক্ত মাংসে গড়া এক নিস্পাপ প্রাণ। তারও নিজস্ব চাহিদা আছে, কিন্তু আধুনিক সভ্যতা তাকে কোনো ভাবেই প্রকাশ হতে দিচ্ছে না। কবি এই জীবনের সমর্থক নন। সেকারনেই কবি বলেন “ধোঁয়ার বঙ্কিম নিঃশ্বাস ঘুরে ফিরে ঘরে আসে , শীতের দুঃস্বপ্নের মতো”। কারণ কবি মনে করেন, শহরের বুক চিঁড়ে যে সূর্যের আলো সন্ধ্যার আকাশে দেখা দেয় এই সৌন্দর্য চিরায়ত নয়। কবি মন তাই দূর থেকে অনুভব করেন গ্রাম বাংলার সৌন্দর্যকে। যেখানের প্রাকৃতিক পরিবেশ কবিকে মহুয়ার রস পানের মন মোহিত করবে। যেখানে থাকবে না ক্রমাগত ছুটে চলার অভিপ্রায় , থাকবে না কোনো ক্লান্তি। শুধু পথের দুধারে থাকা দেবদারু ও মহুয়ার গাছের ছায়া কবিকে আচ্ছাদিত করবে , নিঃসঙ্গতাময় জীবনকে আলোড়িত করবে। এমন এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশেই কবি ছুটে চলে যেতে চান।
কবিতার দ্বিতীয় অংশটি একটি গ্রামের চিত্র। কবি অনুভব করেন সেই আকাঙ্ক্ষিত গ্রাম কবিকে সেই অনুভূতি আর দিতে পারে না। সেখানেও কোনো স্নিগ্ধতা নেই আছে কয়লা খনির গভীর বিশাল শব্দ। শহুরে জীবনের থেকেও কয়লা খনির জীবন আরো ভয়াবহ। সেখানে প্রবল উত্তাপের মাঝে সারি সারি শ্রমিকেরা কেবল যন্ত্রের মত জীবিকার জন্য একমুঠো ভাতের জন্য লড়ে যান। তাদের কোনো ক্লান্তি নেই। এমন এক পরিবেশ কখনই কবিকে স্নিগ্ধতার রসে ভেজাতে পারেন না। বরং ব্যথা দেয় বারবার। শিশির মাখা সবুজ সকালেও ধুলোর কলঙ্ক গায়ে মেখে কবিকে বেঁচে থাকতে হয়, আর ঘুমহীন ক্লান্ত চোখে দুঃস্বপ্নরা হানা দিয়ে যায়। মহুয়ার গন্ধের বদলে মহুয়ার রস পান করেই ভূলে থাকতে হয় তাকে। আর তখন মনে হয় এই শহরও অতখানি যন্ত্রে পরিনত হয়নি। এখানেই গ্রাম ও শহর জীবন এক হয়ে যায় আর কবিমন রিয়েলিটি থেকে মুখ ফিরিয়ে কল্পনার জগতে আশ্রয় নেন বারবার।  













copywrite ebanglaschools
পুনর্মুদ্রণযোগ্য নয়।

জননী - বিমল কর




জননী

বিমল কর


আমরা ভাইবোন মিলে মায়ের পাঁচটি সন্তান। বাবা বলত, মায়ের হাতের পাঁচটি আঙুল। সবার বড় ছিল বড়দা, মায়ের ১৯ বছর বয়সের ফল। প্রথম বলে বড়দা মায়ের সেই বয়সের রূপ যতটা পেয়েছিল পুঁটলি বেঁধে নিয়ে জগতে এসেছিল। শুনেছি, ঠাকুরমা বলত, অত রং অমন চোখ নিয়ে যদি এলি, তবে দাদু, মেয়ে হয়ে এলি না কেন?
ঠাকুরমার ক্ষোভ বছর দুয়েক পরে মা মিটিয়ে দিল। এবার এলো বড়দি। বড়দা পুরুষ মানুষ বলে ওপর-ওপর থেকে মায়ের রূপ চুরি করেছিল, বড়দি মেয়ে বলে আমাদের মায়ের অন্তর থেকে সব যেন শুষে নিয়ে ঠাকুরমার কোলে এসে পড়ল। নয়নের মণির মতন করে ঠাকুরমা বুড়ি বড়দিকে তিনটি বছর আগলে রেখে, লালনপালন করে, ঝুলন পূর্ণিমাতে মারা গেল। বুড়ি মারা যাওয়ার সময় আমাদের তিন বছরের বড়দিকে মরণের ঘোরে রাধাকৃষ্ণর গল্প শোনাচ্ছিল। শোনাতে শোনাতেই স্বর থেমে গেল।
আমরা এসব গল্প মা-বাবার কাছে শুনেছি। বাবাই বেশি বলত। বাবারই অতীতমোহ অতিরিক্ত ছিল।
বড়দির পর আমাদের মেজদা। সেজদা বাবার মতন। অবিকল বাবার মুখের আদল তার। সেই রকম লম্বা লম্বা হাত। গায়ের রং একটু তামাটে। ছোট আর আমি মাত্র দেড় বছরের এদিকে-ওদিকে জন্মেছি। ছোটকে আমি দিদি বলিনি কোনোকালে, আজও বলি না। ছোট আমাকে ছেলেবেলায় ‘কড়ে’ বলত, মানে কনিষ্ঠ; তার খেপানো ডাক থেকেই আমার ডাকনাম কড়ি হয়ে গিয়েছিল।
আমাদের সংসারে প্রথম শোক এলো বড়দির বিয়ের পর। তার স্বামী খারাপ রোগে ভুগছিল। বড়দির প্রথম ছেলেটা হলো নাক ভাঙা, বিকলাঙ্গ। মরে গেল। পরে আরো একটা পেটে এসেই নষ্ট হয়ে গেল। স্বামীর রক্তে কোন রোগের পোকা বংশবৃদ্ধি করেছে, তত দিনে বুঝতে পেরে গিয়েছে বড়দি। নিজেও ভুগছিল। একদিন স্বামীকে ঘরের মধ্যে পুরে বাইরে থেকে ছিটকিনি তুলে দিয়ে বড়দি চলে এলো, আর স্বামীগৃহে যায়নি।
বড়দির পর দ্বিতীয় শোক, মেজদার অন্ধ হওয়া। মেজদা দানাপুর যাচ্ছিল কাজে। ট্রেনে বড় ভিড়। যাত্রীরা ঢোকার দরজা বন্ধ করে রেখেছিল। মেজদা পান কেনার জন্য জানালা খুলে পানওয়ালাকে ডাকছিল। এক দঙ্গল বেহারিকে আসতে দেখে গোলমালের ভয়ে কাচের জানালা নামিয়ে চুপ করে বসে থাকল। তারা প্রথমে দরজার কাছে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি করল, পরে জানালার কাছে এসে ক্ষিপ্তভাবে কী বলছিল। কামরার লোক মেজদাকে জানালা খুলতে বারণ করল। তখন খুব আচমকা বাইরে থেকে একটা লোক তার টিনের সুটকেস জানালায় ছুড়ে মারল। কাচ ভেঙে তার ধারালো ফলা মেজদার চোখে-মুখে ঢুকে গেল। রক্তে সর্বাঙ্গ লাল হলো।… হাসপাতালে একটানা ছয় মাস কাটিয়ে বেচারা ফিরে এলো বাড়িতে। তার দুই চোখ সেই নির্বোধ সুটকেসওয়ালা অন্ধ করে দিয়ে ভিড়েই মিশে থাকল।
আমাদের তৃতীয় শোক, বাবার মৃত্যু। বাবা সন্ন্যাস রোগে মারা গেল। মায়ের কাছে বাবা স্নান করছিল। অল্প অল্প জ্বর ছিল গায়ে। মা ঈষদুষ্ণ জলে বাবার গা ধুইয়ে তোয়ালে দিয়ে মুছে দিচ্ছিল; বাবা মায়ের কোলের ওপর হঠাৎ শুয়ে পড়ে কী বলতে গেল, পারল না; মৃত্যু এসে বাবার মুখে হাত চাপা দিয়ে কথা থামিয়ে দিয়েছিল। বাবা তৈরি ছিল, চলে গেল।
বাবার মৃত্যুর বছর দুই পরে আমাদের চতুর্থ শোকও এলো। ছোট বড় জেদি। চিরকালই সে যখন যা ঝোঁক ধরেছে, করতে গেছে। আমি তাকে কত বলেছি, ওভাবে জেদ ধরে কাজ করতে যাস না। তুই সব পারবি এমন কোনো কথা নেই।…আমার কথা ছোট গ্রাহ্য করত না। তার ধারণা ছিল, সে চেষ্টা করলে সব পারবে। ছোট এসব বুঝত না। বুঝতে চাইতও না। অকারণে সে মেতে থাকত। তার কাজের অন্ত ছিল না, খাওয়া-দাওয়া বিশ্রামের বালাই ছিল না। সকালে মিশনারিদের অনাথালয়ে গৃহিণীপনা করত, দুপুরে বড়দির সঙ্গে শখের চাকরি করতে যেত স্কুলে, বিকেল আর সন্ধেবেলায় ফুলবাজারের সেই ঝুপড়ি ঘরটায় লণ্ঠনের টিমটিমে বাতির আলোয় বসে ওর দলের ছেলে-ছোকরাদের সঙ্গে রাজনীতির কাজ করত।…একদিন ছোট বুঝতে পারল, তার বয়সে যতখানি জীবনীশক্তি স্বাভাবিক, তার অনেক বেশি সে অত্যন্ত হঠকারীর মতো ব্যয় করেছে। এখন তার জীবনের কলসি প্রায় ফাঁকা! ডাক্তারবাবু স্পষ্টই বলে দিল আর ওঠা-চলা নয়, বেশি কথা বলাও না। বিছানায় শুয়ে থাকা। ইনজেকশন, ওষুধ, ভালো ভালো খাওয়া আর চুপ করে পড়ে থাকা। ছোট বলল, তাহলে আমি মরে যাব। জবাবে ডাক্তারবাবু বলল, দেখা যাক…।
সেই থেকে ছোট বিছানায়। বছর পুরো হয়ে গেছে। আরো কিছুদিন থাকতে হবে।
আমাদের সংসারে পঞ্চম শোক এসেছে সদ্য। মা মারা যাওয়ার পর। এই ফাল্গুনের গোড়ায় মা চলে গেল। মায়ের মাথার চুল সাদা হয়েছিল, গালের চামড়া দুধের জুড়ানো সরের মতো কুঁচকে এসেছিল। কপালভরা দাগ আর আধপাকা ছানি চোখ নিয়ে মা বিদায় নিল। যাওয়ার সময় দেখে গেল তার হাতের পাঁচটি আঙুলই একে অন্যের পাশে রয়েছে।
তখনো সকালে হিম পড়ে। আমাদের দোতলায় বড় বারান্দা শিশিরে ভিজে রয়েছে। সূর্য ওঠেনি, রং ধরেছে সবে। মায়ের বিছানার চারপাশে আমরা পাঁচজনে দাঁড়িয়ে, মা চলে গেল।
বড়দা আগেই বলেছিল, আমরা বারোয়ারি শ্মশানে মাকে নিয়ে যাব না, আমাদের বাড়ির বাগানে দাহ করব, পরে সেখানে একটা বেদি করে রাখব।
বিঘেখানেকের ওপর জমি নিয়ে আমাদের দোতলা বাড়ি। পাঁচ বিঘের বাগান। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা!
উত্তর দিকে, যেখানে করবীর ঝোপ, স্থলপদ্মর রাশিকৃত গাছ, ঘাসের জঙ্গল সেই দিকটা মাকে দাহ করার জন্য আমরা বেছে নিয়েছিলাম। ঘাস-জঙ্গল পরিষ্কার করে কদমগাছটাকে মাথার কাছে রেখে মায়ের চিতা তৈরি হলো, পাশের বুড়ো কাঠচাপা দাঁড়িয়ে থাকল আমাদের বাবার মতন দেখাচ্ছিল তাকে। তারপর মায়ের দাহ হলো। যখন আগুন তার অকলুষ শিখা বিস্তার করে মায়ের শরীর আগলে রেখেছিল, তখন আমি আমাদের পাঁচজনকে দেখছিলাম। বড়দা খানিক রোদ খানিক ছায়ায় দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে চিতার দিকে তাকিয়েছিল, মাঝেমধ্যে কী বলছিল; বড়দি কদমতলায় মাটিতে গালে হাত দিয়ে বসেছিল; মেজদা বড়দির পাশে আসন পা করে বসে দুই হাত বুকের কাছে—তার অন্ধ চোখ চিতার দিকে; কাঠচাপার গুঁড়িতে হেলান দিয়ে ছোট ফোলা ফোলা মুখ করে বসে; আমি ছোটর কাছে চুপ করে দাঁড়িয়েছিলাম।
ছোট একসময় বলল, ‘এখন কি জল খেতে আছে রে, আমার বড় তেষ্টা পেয়েছে।’ আমি কিছু জানতুম না। বললাম, ‘এখন না। আর খানিকটা পরে খাস।’
এখন চৈত্র মাস। চৈত্রের শুরু সবে। মার শ্রাদ্ধশান্তি চুকে গেছে। যে জায়গায় আমরা আমাদের মাকে দাহ করেছিলাম, সেই জায়গা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। চারপাশটা যেন নিকনো। শ্রাদ্ধর পরপরই আমরা ওখানে সুন্দর করে বেদি করেছি। কাশির সাদা পাথর দিয়ে বেদিটা মোড়া। এখনো যেন কাঁচা গন্ধ লেগে আছে ওর গায়ে। হাত রাখলে মনে হয় ঠাণ্ডা লাগছে, নরম মসৃণ স্পর্শ।
মাসান্তে আমরা এই বেদিতে বসেছিলাম। বেদির মাথার দিকে ছোট কুলঙ্গির মতন বড়দি সেখানে প্রদীপ এবং ধূপ জ্বেলে দিয়েছিল। বাতাসে ঝাপটা লাগছিল না বলে দীপের শিখাটি জ্বলছিল, অগুরুচন্দনের ধূপ পুড়ে খুব ফিকে একটা গন্ধ বাতাসে ভাসছিল। আর চৈত্রের পূর্ণিমা বলে চাঁদের আলোয় সাদা বেদিটা ধবধব করছিল। আমরা পাঁচজনে বেদির ওপর বসে।
বড়দা বলল, ‘আমরা যত দিন বেঁচে আছি, মাসের এদিনটিতে সবাই একসঙ্গে এখানে এসে বসব।’ বলে একটু থামল বড়দা, বড়দির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল আবার, ‘এই পরিবারের নিয়ম হলো। কী বলিস, অনু।’
অনু বড়দির ডাকনাম। পুরো করে অনুপমা। ছোটর নাম নিরুপমা, বড়দির সঙ্গে মিল রেখে রাখা। বড়দি মাথা নেড়ে বড়দার কথায় সায় দিল; বলল, ‘বাবার বেদিটাও যদি আমরা করে রাখতাম।’ বড়দির গলায় আক্ষেপের সুর।
বড়দির আক্ষেপ খুবই সংগত। কিন্তু তখন তো আমাদের মাথায় এ বুদ্ধি আসেনি। মাও কিছু বলেনি।
বড়দা কয়েক দণ্ড আকাশের দিকে চেয়ে থাকল, তারপর নিঃশ্বাস ফেলল মুখ নামিয়ে। বলল, ‘খুবই ভালো হতো। তবে মা রাজি হতো কি না কে জানে!’
‘রাজি হতো না!’ বড়দি বেশ অবাক হয়েছিল যেন, ‘কেন? মা কেন রাজি হতো না?’
‘হতো না হয়তো।’ বড়দা সন্দেহের গলায় বলল। ‘সবাই এসব পছন্দ করে না। সংস্কার। আমরা বোধ হয় অনেক কিছু পুরোপুরি অগোচরে রাখতে চাই।’
মেজদা হঠাৎ কথা বলল। আমরা তাকালাম। তার অন্ধ চোখ একদিকে স্থির রেখে মেজদা বলল, ‘শ্মশানে পুড়িয়ে আসার সময় আমরা কী ভাবি জানো, দিদি?’
‘কী?’
‘অনেকের মধ্যে দিয়ে এলাম। যেন সঙ্গী-সাথির মধ্যে।’
‘মরার পর আবার সঙ্গী-সাথি কী?’ ছোট বলল।
‘কিছু না। মানুষ তবু ভাবে।’ মেজদা উদাস গলায় বলল। ‘তুই জানিস না ছোট, কত মানুষ মৃত্যুর পর আত্মার অবস্থাকে তীর্থযাত্রা কল্পনা করে নেয়।’
আমরা সবাই মেজদার দিকে তাকিয়ে বসেছিলাম। মেজদার গলার স্বর গোল ও নিটোল। বাঁশের আড় বাঁশির মতন মোটা। এই স্বর শুনলে অনুভব করা যায়, মেজদার গলার সবটুকু অন্তর থেকে এসেছে। মেজদার কথাবার্তাও অন্য রকম। আমরা মনে মনে অহরহ কথা বলি, মুখে নয়। মনের সেই শব্দহীন বাক্যস্রোত যদি শব্দময় হয়ে ওঠে এ রকম শোনাবে হয়তো, মেজদার কথার মতন।
বড়দি বলল, ‘তুই স্বর্গের কথা বলছিস, দীনু।’
মেজদার নাম দীনেন্দ্র, ছোট করে দীনু। বড়দির কথায় মেজদা আলগা করে মাথা নাড়ল। বলল, ‘না দিদি, স্বর্গ তো শেষ কল্পনা। আমি এই মর্ত্যের পর স্বর্গের আগে যে পথ তার কথা বলছি।’
‘সেটা আবার কী?’ ছোট বলল অবাক হয়ে, ‘মাঝপথের কথাও মানুষ ভাবে?’ ‘ভাবে। যত ভালো করে ভেবে নিতে পারা যায় ততই ভালো রে, ছোট।…আমি রাঁচির দিকে মুণ্ডা না মুঙরিদের গ্রামে এক বাড়িতে ছবি দেখেছিলাম একটা।’
‘ওদের কথা বাদ দাও।’ ছোট বলল।
‘বাদ কেন, শোনো না।’ মেজদা যেন অন্ধ চোখে জ্যোৎস্না মেখে সামান্য মুখ ফেরাল।
বলল, ‘মাটির বাড়ি বাইরের দেয়ালে রং গুলে একটা বাচ্চা ছেলে ছবি আঁকা ঘোড়ার পিঠে চড়ে বাচ্চাটা চলেছে, এক হাতে লাঠি, অন্য হাতে লাগাম, কাঁধে খাবারের পুঁটলি, মাথায় তেষ্টা মেটানোর জন্য জলের ঘটি রাখা। ওই ছবির মানে বলে দিল ফরেস্টবাবু। ও-বাড়ির ছেলে মারা গেছে, তাই ওই ছবি।’
‘আ-হা-’ দুঃখ পেল।
মেজদা বলল, ‘মানেটা তুমি শোনো দিদি। বড় অদ্ভুত লাগে। ভাবো তো ওরা বিশ্বাস করে নিয়েছে মৃত্যুর পর তাদের ছোট ছেলেটিকে একা একা অনেক দূর যেতে হবে।’
তাই তাকে বসিয়ে দিয়েছে ঘোড়ায়, হাতে দিয়েছে লাঠি, পুঁটলিতে বোধ হয় চিঁড়ে-গুড়, আর মাথায় তেষ্টা মেটানোর জল।’ স্নেহ, মমতা, ইহলোকের মায়া ও দুঃখ, পরলোকের দুর্ভাবনা—সব যেন এ ছবিতে মহৎ ও সুন্দর হয়ে কল্পিত ছিল। আমি অভিভূত হলাম। জ্যোৎস্নার দারার মতন আমার কল্পনা সেই ছবির গায়ে আলো বর্ষণ করছিল।
অনেকক্ষণ বুঝি কেউ কোনো কথা বলল না আর। চৈত্রের চঞ্চল বাতাস বাগানের তৃণ এনে আমাদের গায়ে-মাথায় ফেলে দিচ্ছিল। বেদিতে আমাদের পাঁচজনের ছায়া; পরস্পরকে স্পর্শ করে যেন ছায়ার একটি আশ্চর্য রকম জাফরি তৈরি হয়েছে। চাঁদটা সমুদ্রের জলের মতনই নীল অনেকটা। পর্যাপ্ত জ্যোৎস্না। মায়ের বেদির মাথার কাছে সেই বৃন্দাবনের কদম্বগাছ। মায়ের পাশে বুড়ো কাঠচাপা।
কদম্বগাছটার বয়স আমার সমান। বৃন্দাবন থেকে এনেছিল বাবা। এখনো বর্ষায় ফুল ফোটে।
বড়দি প্রথমে নিঃশ্বাস ফেলল। বড়দার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আমার গাটা একটু দেখ তো, দাদা।’
‘কেন রে, কী হলো?’ বড়দা উদ্বেগের গলায় বলল।
‘আমায় যদি কেউ মায়ের হাতে কিছু দিতে বলে কী দেব রে!’ বড়দি আমাদের প্রত্যেকের মুখে একে একে তাকাল, তারপর কেমন করে যেন মাথা নাড়ল, বলল, ‘জানি না। কী দেব মায়ের হাতে কে জানে!’
কথাটা আমাদের কানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ যেন ঘুরে দাঁড়াল। আমাদের মনোযোগ আকৃষ্ট হলো। সহসা অনুভব করলাম বিহ্বল হয়েছি।
‘মায়ের হাতে কী দেব’—এই প্রশ্ন আচমকা বড়দি আমাদের সামনে যবনিকার মতন নিক্ষেপ করল। আমরা অসংবিত ও বিমূঢ় হয়ে বসে থাকলাম। তারপর ক্রমে বড়দির কথার পরিপূর্ণ মর্ম আমাদের হৃদয়ে অনুভব করতে পারলাম।
সমূলে সচকিত হওয়ার মতন আমরা শিহরিত ও কম্পিত হয়ে দেখলাম, এই প্রশ্ন যেন আমাদের সব বোধ অধিকার করেছে। আমরা কী দেব, কী দিতে পারি মাকে?…মনে হলো, এই অদ্ভুত প্রশ্নে আমরা, সম্মিলিত বোধ থেকে পৃথক হয়ে গেছি। যেন কোনো ভয়ংকর পর্বতচূড়ায় এনে কেউ আমাদের পরস্পরের দেহের সঙ্গে বাঁধা দড়ি কেটে দিয়েছে, আমরা সবাই চূড়ার অন্তিম প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি।
স্তব্ধ নিঃসাড় হয়ে আমরা বসে থাকলাম। চাঁদের আলো কদমগাছের ছায়াটিকে বেদির সামনে শুইয়ে রেখেছে। করবী ঝোপে বাতাস যেন ডুব দিয়ে সাঁতার কেটে কেটে যাচ্ছিল, শব্দ হচ্ছিল পাতার। আমরা আমাদের ছায়ার নকশা থেকে চোখ তুলে কখন যে শূন্যে দৃষ্টি রেখেছি, কেউ জানি না।
বড়দাই প্রথমে কথা বলল। মায়ের কোলে বড়দাই প্রথম এসেছিল, বড়দাকে দিয়েই মায়ের মাতৃত্ব শুরু, হয়তো তাই বড়দা এই নীরবতা এবং অপেক্ষা প্রথমে ভাঙল, যেমন করে মায়ের সন্তান-কামনার অপেক্ষা ভেঙেছিল।
‘অনু কিন্তু কথাটা মন্দ বলেনি।’ বড়দা ধীরেসুস্থে নরম গলায় থেমে থেমে বলতে লাগল, ‘আমরা কেউ মৃত্যুর পরটর বিশ্বাস করি না, তবু ভাবতে ভালো লাগছে, আমাদের মা দীনুর গল্পের মতন দীর্ঘ পথ হেঁটে যাবে। আমরা মায়ের জন্য কে কী দিতে পারি?’
আমরা প্রকৃতপক্ষে ওই একই চিন্তা করছিলাম। মায়ের সেই দীর্ঘ অন্তহীন পথযাত্রায় আমরা মাকে কী সম্পদ দিতে পারি?
বড়দা দীর্ঘ করে নিঃশ্বাস ফেলল, কদমছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকল কয়েক দণ্ড, তারপর মুখ তুলে বলল, ‘কী যে দেব, আমিও ভেবে পাচ্ছি না।’ বড়দার গলার স্বর বিষণ্ন উদাস। বড়দিকে দেখল বড়দা, কাঠচাপার বুড়ো গাছটাকে অন্যমনস্কভাবে লক্ষ করল। ‘মায়ের অনেক দুঃখ ছিল, অনেক। আমি সব দুঃখের কথা জানি না। একটা দুঃখ জানি, আমায় নিয়ে।’
আমার মনে হলো, বড়দা ঠিক আমার মতন করেই ভাবছে। এ সংসারে মা কী পায়নি, কী অভাব তার ছিল, কী পেলে মায়ের সে অভাব থাকত না, আমরা এখন তা-ই ভাবছিলাম। মায়ের এই পরবর্তী যাত্রায় আমরা বোধ হয় মাকে সেই জিনিস দিতে চাইছিলাম, যা এখানে দিতে পারিনি।
‘সে রকম দুঃখ তো আমার জন্যও মায়ের ছিল।’ ছোট বলল বড়দাকে লক্ষ করে। ‘আমাদের সবাইর জন্য ছিল।’ বড়দা জবাব দিল।
‘তাহলে কি আমরা মায়ের হাতে সেই দুঃখগুলো আর দিতে চাই না?’ ছোট অসহায়ের মতন শুধাল।
‘তা ছাড়া আমরা আর কী দিতে পারি’…বড়দা ছোটর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চাল কলা জল আমাদের মায়ের দরকার নেই। মাকে যদি আমরা সেই মনের জিনিসগুলো দিতে পারি, এখানে যা পারিনি। মায়ের কাজে লাগবে।’ ‘কাজ’ শব্দটা বড়দা টেনে বড় করে উচ্চারণ করল।
আমি মনে মনে বড়দার কথায় সায় দিলাম। মাকে আমরা অন্য কিছু দিতে পারি না।
‘তুই তো জানিস অনু—’ বড়দা বড়দিকে লক্ষ করে কথা শুরু করল, ‘আমি বিয়ে করিনি বলে মায়ের মনে বড় দুঃখ ছিল। অভিমানও। মায়ের কী সাধ ছিল আমি জানি। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল না।…আমার জন্য মা মেয়ে পছন্দ করে রেখেছিল, বাবা সেই মেয়েকে আশীর্বাদ করতে যাবে বলে ঠিক করেছিল, আমি অমত করায় আর ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত গড়ায়নি।’
‘তুমি অমত করলে কেন?’ আমি বড়দার ওপর যেন অপ্রসন্ন হয়ে বললাম। ‘কেন করলাম!’ বড়দা আমার দিকে তাকাল। তাকিয়ে থাকল। পলক ফেলল না। এরপর অতিশয় স্নিগ্ধ হয়ে বলল, ‘আমার বন্ধু অবনীর সঙ্গে সেই মেয়েটির ভাব ছিল।’
‘তাহলে সন্দেহ?’ ছোট যেন বিরক্ত হলো।
‘না রে সন্দেহ নয়। মেয়েটিকে অবনী ভালোবাসত।’ বড়দা শান্ত গলায় বলল, ‘মাকে আমি বলেছিলাম। মা বলেছিল, কিন্তু কনক যে অপরূপ সুন্দরী। এ মেয়ে এলে আমার বংশধররা কত সুন্দর হবে ভেবে দেখ।’ কয়েক দণ্ড থেমে বড়দা যেন মায়ের সঙ্গে তার সেই কথোপকথন স্মরণ করল, তারপর বলল, ‘আমি সৌন্দর্য ভালোবাসি, কিন্তু ভালোবাসা আরো বেশি ভালোবাসি।’ অনেকক্ষণ আর কথা বলল না। বেদির দিকে তাকিয়ে থাকল। ‘মা এই কথাটা কেন যে বুঝল না!’ বড়দা আক্ষেপের গলায় বলল, মনে হচ্ছিল তার কোনো পুরনো প্রদাহ সে আজ অত্যন্ত ব্যথার সঙ্গে আবার অনুভব করছে। অনেকটা সময় চুপ করে থেকে বড়দা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল, মৃদু গলায় টেনে টেনে বলল, ‘আমি মাকে আমার সেই ভালোবাসার মন দিতে পারি।’
বড়দা নীরব হলে সাদা বেদিটার গায়ে চাঁদের আলো ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে মলিন হলো সামান্য।
আমরা নির্বাক বসে থাকলাম। চৈত্রের বাতাস করবী ঝোপের তলা থেকে ধুলোর গুঁড়া এনে মাখিয়ে গেল। রাস্তা দিয়ে একটা টাঙা যাচ্ছে, টাঙাওয়ালার পায়েটেপা ঘণ্টি বাজছিল। কদমগাছের ছায়া একটু যেন হেলে গেছে।
‘তাহলে আমিও বলি—’ বড়দি বলল। বড়দার পর বড়দিরই বলার কথা। আগে বড়দি দিশেহারা হয়ে বলেছিল, সে কী দেবে জানে না; এখন বড়দার কথার পর বড়দি মন স্থির করতে পেরেছে।
বড়দি কী দেয় শোনার জন্য আমরা সবাই মুখ তুলে তার দিকে তাকালাম। জ্যোৎস্না আবার স্পষ্ট হয়েছে। চন্দ্রকিরণে বড়দিকে রেশমের মতন নরম মসৃণ দেখাচ্ছিল। হাঁটু ভেঙে একপাশে হেলে বসেছিল বড়দি, তার হাতে সরু দুই গাছা করে সোনার চুড়ি। সাদা হাতে মিনের কাজের মতন চুড়ি দুটো চকচক করছিল।
অল্প সময় ইতস্তত করে বড়দি বলল, ‘আমি অমন করে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি বলে মা কোনো দিন খুশি হয়নি। তুই তো জানিস দাদা, মা তোকে কতবার সেই লোকটার কাছে যেতে বলেছে। কেন বল তো? বলত যাতে তুই তাকে ভুলিয়ে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আনতে পারিস। সোজা হয়ে বসে নিল বড়দি, বাঁ হাত গলার কাছে নিয়ে গিয়ে তার মটর হারে আঙুল রাখল। বাবাকেও মা বুঝিয়েছিল, আমি ওখান থেকে চলে এসে ভুল করেছি, অন্যায় করেছি। বরং চেপে বসে থাকলে তাদের জামাইকে শুধরে নিতে পারতাম।…মা আমায় বলত, এই তেজ দেখিয়ে তুমি তোমার ক্ষতি করলে। সারা জীবন পুড়বে।’
‘তুমি তো আজও মাঝেমধ্যে কাঁদো, বড়দি।’ ছোট আচমকা বলল।
বড়দি ছোটর দিকে তাকাল। ভাবল যেন। বলল, ‘কাঁদি—’ আস্তে মাথা নাড়ল বড়দি, ‘কাঁদি মা কেন আমায় আবার বিয়ে করতে বলল না।’
‘তোমার কি আবার বিয়ে করার সাধ ছিল?’ আমি অবাক হয়ে বড়দিকে দেখছিলাম।
‘হ্যাঁ, মা-বাবা যদি বলত, আমি আবার বিয়ে করতাম।…চামড়ার ব্যবসাদার সেই লোকটাকে ত্যাগ করে এসে আমি শুধু নিজেকে বাঁচিয়েছিলাম, কিন্তু আমার দরকারটুকু তো পাইনি।’
‘তোমার আবার বিয়ে করা খুব সহজ ছিল না, বড়দি।’ ছোট বলল। ‘না হয় কঠিনই ছিল। তাতে কী!…বড়দি যেন দ্বিধা রোধ করে থামল, তারপর বলল, ‘সংসারে এমন মানুষ ছিল যে আমায় বিয়ে করত। …মায়ের সাহস হলো না।… একদিন আমি মাকে বলেছিলাম, রোগ, নোংরামি, কষ্ট সব সহ্য করি তাতে তোমার আপত্তি নেই; আপত্তি সুখ পাওয়ার ব্যবস্থা করতে। মা খুব অসন্তষ্ট হয়েছিল, বলেছিল—এ বাড়ির মর্যাদা নষ্ট হোক এমন কিছু করতে আমি দেব না!…মা মর্যাদা চাইত, আমি সাহস চাইতাম।’ বড়দি সামান্য থামল, তার সব শরীর রেশম দিয়ে মোড়া সাজানো পুতুলের মতন দেখাচ্ছিল, ভাঙা হাঁটু, মাটির ওপর ভর করা হাত : নিঃশ্বাস ফেলে বড়দি বলল, ‘মাকে আমি মানুষের উচিত সাহস দিতে পারিনি। মা যেন সেই সাহস পায়।’
কথা শেষ করে বড়দি আকাশের দিকে চোখ তুলল। আমরা স্তব্ধ। চৈত্রের বাতাস এসে কদমের কয়েকটি শুকনো পাতা ফেলে গেল, চাঁদের আলোয় একটা কাঠবিড়ালি কাঠচাপার ডাল বেয়ে এগিয়ে এসে আবার ছুটে পালাল।
বেদির কুলঙ্গির মধ্যে প্রদীপটা অকম্পিত জ্বলছে। ধূপধুনো ফুরিয়ে গেছে, আমরা আর গন্ধ পাচ্ছিলাম না।
এবার মেজদার পালা। আমরা মেজদার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। মেজদা কিছু বলছিল না।
ছোট মেজদার গায়ে হাত দিল। ‘মেজদা—তুমি?’
মেজদা মাথা নাড়ল! ‘এখনো কিছু ভেবে পাইনি। তোরা বল। তুই বল, ছোট।’ ছোটর স্বভাবই আলাদা। তার অত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভাবনা নেই। ছোট একবার প্রদীপের দিকে তাকাল, এবার আকাশের দিকে। খুক খুক করে কাশল কবার, তারপর বলল, ‘এত অল্প বয়সে আমার এমন একটা বিশ্রী অসুখ করল বলে মা বেচারি বড় কষ্ট পেয়েছিল। ভাবত, আমি আর বাঁচব না। আমিও প্রথম প্রথম সেই রকম ভেবেছি। মা বলত, তুই নিজে ইচ্ছে করে এই অসুখ বাধালি। কী বোকার মতন কথা বলত, বড়দি। অসুখ কি কেউ ইচ্ছে করে বাধায়! না অসুখে সুখ আছে!’ এক দমকে কথা বলছিল ছোট, বলতে বলতে থামল। মনে হলো, সে কোনো কিছু না ভেবেই কথা শুরু করছিল, তারপর খেই হারিয়ে ফেলেছে, কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। আমরা চুপ করে থাকলাম। ছোট একটু যেন অপ্রস্তুত হলো। মাথার বেণি বুকের কাছে টেনে আঙুলে জড়িয়ে দু-চারবার দোলাল। ছোটর গায়ে হালকা রঙের একটা শাড়ি, গায়ে অর্ধেকহাত জামা। ছোটর কপাল ছোট; দুই পাশের চুল তার প্রায় সবটুকু কপালই ঢেকে ফেলেছে। নাকটি লম্বা; চোখ দুটি খুব কালো, ছোটর হঠাৎ থেমে যাওয়া, হঠাৎ অপ্রস্তুত বোধ করা এবং এই আপাতত চাঞ্চল্য থেকে মনে হলো ছোট যেন খেই খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
আরো একটু সময় নিল ছোট। সে তার কথা খুঁজে পেল। বলল, ‘অসুখ কেউ ইচ্ছে করে বাধায় না, অসুখে সুখ নেই, তাও ঠিক। তবু আমি এই অসুখে পড়ে একটা সুখ পাচ্ছিলাম।…তুমি তো জানো বড়দি, অসুখের সময় আমার বন্ধুটন্ধুরা খোঁজখবর নিতে আসত। বেশি আসত সুশান্ত, প্রায় রোজই। অনেকক্ষণ থাকত। আমায় ভোলানোর চেষ্টা করত, বলত, এ অসুখ কিছুই না।…মা কেন জানি এটা পছন্দ করত না, একেবারেই নয়।’ ছোট তার দীর্ঘ বেণি কাঁধের ডান পাশে রাখল, আকাশের দিকে তাকাল আবার, তাকিয়ে থাকল, বলল, ‘একদিন মা আমার সামনে সুশান্তকে বলল, তুমি তো ডাক্তার নও; কেন অযথা ওসব কথা বলো। ওকে বকিয়ো না, বিরক্ত কোরো না।’…সুশান্ত তারপর থেকে আর আসত না। আমি মাকে বলেছিলাম, অকারণে তুমি ওকে অপদস্থ করলে। মা বলেছিল, ‘ওরা আমার অনেক করেছে, তোমায় মাতিয়ে এই অসুখ দিয়েছে। তা দিক, আর আমার সুখ দরকার নেই।’ ছোট আকাশ থেকে চোখ নামাল, তার গলা পাতলা, কাঁপছিল, চোখ যেন একটু চিকচিক করছে। ও বলল, ‘মা আমার অসুখটাই দেখেছিল, সুখ দেখেনি। মা জানত না, জগতে সব রোগ কেবল ডাক্তার দিয়ে সারানো যায় না। আশা পাওয়া অনেক; ভরসা পাওয়ার কত শক্তি…’ ছোট আমার দিকে তাকাল, ‘আমি মাকে আর কিছু দিতে পারি না, মন ছাড়া, আশা ছাড়া, ভরসা ছাড়া। মা যেন তার মনে ভরসা পায়।’
ছোট নীরব হলো। মায়ের বেদিতে কদমছায়া উঠে এসেছে। বড়দার পাশ দিয়ে ছায়াটা বড়দির কোলে গিয়ে বসেছে। বাতাবি লেবুর গাছটা অনেক দূরে। তার মাথার ওপর দিয়ে ভাঙা দেয়ালের ফাঁকে রেললাইনের বাতি চোখে পড়েছিল আমার। দশরথ ধোপার কুঠিতে ওরা গান গাইছে। গত সপ্তাহে দশরথের ছেলের বিয়ে হয়েছে, আজও থেকে থেকে সেই আনন্দের লহরী তোলে তারা।
খুব যেন ক্লান্ত হয়ে ছোট তার মাথা আমার কাঁধে রাখল। বলল, ‘কড়ি, এবার তোর পালা—’
বড়দা, বড়দি আমার দিকে তাকাল। মেজদা তার অন্ধ চোখ অনুমানে আমার দিকে ফিরিয়ে রাখল। সহসা অনুভব করলাম, ওরা আমার হৃদয়ে লুকানো মায়ের ছবি দেখার জন্য সতৃষ্ণ চোখে চেয়ে আছে। আমার ভয় করছিল। কাঠগড়ায় দাঁড়ানো কোনো সাক্ষীর বোধ হয় জবানবন্দি দেওয়ার সময় এ রকম ভয় হয়।
এই মুহূর্তে সবাই স্তব্ধ। চৈত্রের বাতাসও শান্ত হয়ে আছে। দুধের ফেনার মতন জ্যোৎস্নায় আমার চারটি উৎকর্ণ আত্মীয় নিষ্পলকে আমায় দেখছে। বড়দার দিকে তাকিয়ে আমি কথা বলার আয়োজন করছিলাম। বড়দার পাশ দিয়ে বেদির কুলঙ্গিতে প্রদীপ চোখে পড়ছিল। শিখাটি স্থির। মায়ের চোখের মতন শিখাটি যেন আমায় লক্ষ করছিল।
‘ভেবে পাচ্ছি না—’ আমি বললাম। আমার মন স্থির নয়, নিঃসংশয় নয়। দ্বিধাগলায় জড়িয়ে জড়িয়ে আমি বললাম, ‘কখনো মনে হচ্ছে অনেক কিছু যেন দেওয়ার আছে, আবার মনে হচ্ছে কিছু নেই। আমি সবচেয়ে ছোট বলেই মা আমার তার শেষ গচ্ছিত ধনের মতন করে সরিয়ে রেখেছিল। মানুষ যেমন করে সিন্দুকে অবশিষ্ট অলংকার তুলে রাখে, অনেকটা সেই রকম। ব্যবহার করত না, দেখত না।’ কথা বলার সময় ক্রমে আমার মনে হচ্ছিল আমি ভয় কাটিয়ে উঠতে পারছি। গলা কাঁপছিল তখনো, তবু আমার স্বর স্পষ্ট হয়ে এসেছে অনেকটা। ‘তোমরা মাকে যত পেয়েছ, যেমন করে পেয়েছ, আমি তা পাইনি। আমার মা আমাদের সংসারকে তেমন করে বুঝতে দেয়নি। ভাবত, আমার এসবে দরকার নেই।…কিন্তু আমি মাকে দেখেছি। একবার মায়ের সঙ্গে আমায় কাশী যেতে হয়েছিল। তোর মনে আছে ছোট, বাবা মারা যাওয়ার পর মা একবার আমায় নিয়ে কাশী গিয়েছিল পনেরো-বিশ দিনের জন্য। তোরা ভেবেছিলি মার মন ভালো নয়, বাবার অভাবে মন বড় কাতর—তাই মা কটা দিন তীর্থর জায়গায় মন জুড়িয়ে আসতে গেছে। হয়তো খানিকটা সেই উদ্দেশ্যেই মা গিয়েছিল, কিন্তু সবটা নয়।…’ আমার গলা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, আমি আর ভীত হচ্ছিলাম না; আমার মনের সামনে সব স্থির হয়ে গিয়েছিল, যা খোঁজার আমি যেন তা পেয়ে গিয়েছিলাম। প্রদীপ শিখাটি শেষবারের মতন দেখে আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মেজদাকে দেখছিলাম। কাশীতে বাবার এক বন্ধু থাকত। আমি কখনো তার নাম শুনিনি—
‘শচীন-জেঠামশাই!’ বড়দা বলল অবাক হয়ে।
‘হ্যাঁ। তুমি তাহলে জানো?’
‘জানি বৈকি। শচীন জেঠাকে আমি কতবার দেখেছি। তুইও দেখেছিস অনু।’
‘দেখেছি।’ বড়দি মাথা নাড়ল।
‘বাবার সঙ্গে ব্যবসা করত। তারপর কী হয়, আলাদা হয়ে গেল। পরে আর আমি শচীন জেঠার কথা শুনিনি। নানা জায়গায় ঘুরে শেষে সে কাশীতে গিয়েই শেষ জীবন কাটাচ্ছিল।’
আমি বললাম। বলার সময় শচীন-জেঠামশাইয়ের কাশীর সংসার আমার চোখে ভাসছিল, স্পষ্ট অনাবৃত। ‘বাঙালিটোলার অন্ধকার গলিতে নরকের মতন ছোট ছোট খুপরি ঘরে ওঁরা থাকেন; উনি স্থবির হয়ে পড়েছেন, স্ত্রী শ্বাসরোগে শয্যাশায়ী, বড় ছেলে হোটেলের গাইডগিরি করে। দুটি মেয়ে—একটির পা খোঁড়া হয়ে গেছে টাঙা থেকে পড়ে, অন্যটি কোন বাড়িতে যেন রান্নাবান্নার কাজ করে দেয়। ছেলের বউ মারা গেছে দুটি বাচ্চা-কাচ্চা রেখে।…কাশীর সেই অন্ধকার সরু নোংরা পাতকুয়োয় একটি অসহায় পরিবার গলা পর্যন্ত ডুবে। মা গিয়েছিল সেখানে বাবার পুরনো কোনো ব্যবসায় শচীন জেঠা কবে কাগজপত্রে বাবার অংশীদার ছিল, সেটা নাকচ করিয়ে আনতে। উনি সে কথা মনেও রাখেননি, মনে রাখার কথাও নয়। তবু মা আইনের ফাঁক রাখতে রাজি নয়। কে জানে কবে এই গর্ত খুঁড়ে সাপ বেরুবে না। এক শ টাকার দুইখানা মাত্র নোট মা শচীন জেঠার হাতে দিয়ে সেই পুরনো অংশীদারি বাতিল করিয়ে নিল। আমি মাকে বলেছিলাম, তুমি তো অনেক আগেই এটা ওদের ছেড়ে দিতে পারতে মা। বাবাও তো কাঠের ব্যবসাটা আর করত না।… জবাবে মা বলেছিল, ‘তুমি ছেলেমানুষ, বিষয়-আশয়ের কিছু বোঝ না। ওই ব্যবসা অন্যের তদারকিতে দেওয়া আছে, বছরে হাজার দুয়েক টাকা বাড়িতে আসে। টাকাটা আমি অকারণে খোয়াব! অত স্বার্থত্যাগ আমি শিখিনি।’ আমার গলার শিরা যেন কেউ আঙুল জড়িয়ে জড়িয়ে টানছিল, সেই যন্ত্রণায় আমি কিছুক্ষণ আর কথা বলতে পারলাম না; আমার সামনে শচীন জেঠার পিচুটিভরা চোখ দুটি ভাসছিল। কী দুর্গতি তার! মা স্বার্থত্যাগ জানত না।’ আমি চাপা গলায় বললাম, ‘মা দীন ছিল, আর মন কৃপণ ছিল।…আমায় যদি কিছু দিতে হয় আমি মাকে স্বার্থত্যাগ দেব। আর কিছু না।’ আমি নীরব হলে বৃন্দাবনের কদমগাছ তার ছায়া আরো দীর্ঘ করল। বড়দির বুকে সেই ছায়া দেখলাম। কয়েকটি খড়কুটো এলো দমকা বাতাসে। দশরথ ধোপাদের বস্তিতে গানের সুর থেমে গেছে। একটি রাত্রিগামী ট্রেন সাঁকোর ও প্রান্তে দাঁড়িয়ে হুইসেল দিচ্ছে পথের জন্য। ধ্বনিটা ক্ষীণ হয়ে এখানে ভেসে আসছিল। মেজদা কিছু বলেনি। এবার বলবে। মেজদার পালা ফুরোলে আমাদের পাঁচটি আঙুলই গুটিয়ে যাবে।
আমরা কেউ কোনো কথা না বলে মেজদার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
মেজদা কিছু বলছিল না। মেজদা শূন্যপানে মুখ তুলে রেখেছিল। আমরা অপেক্ষা করছিলাম। অধির উৎকণ্ঠিত সেই অপেক্ষা দীর্ঘ মনে হচ্ছিল।
‘দীনু’ বড়দা মেজদাকে ডাকল।
মেজদা স্থির শান্ত। যেন আকাশের দিকে তার অন্ধ চোখ মেলে সে হৃদয় দিয়ে মাকে দেখছে।
‘দীনু’—এবার বড়দি হাত বাড়িয়ে মেজদার গা স্পর্শ করল।
মেজদা তবু পাথরের মতন বসে। তার নিঃশ্বাস পড়ছে কি পড়ছে না বোঝা যাচ্ছিল না।
ছোট ডাকল, ‘মেজদা’।
হাত দিয়ে মেজদাকে স্পর্শ করে বললাম, ‘মেজদা, এবার তোমার পালা।’
মেজদা সামান্য নড়ল। আকাশের দিকেই তার মুখটি তোলা, অমল জ্যোৎস্না তার সব মুখ লেপে রেখেছে, তার দুই অন্ধ নয়ন নিবিড় করে সেই আলো মাখছিল।
মেজদা তার সাদামাটা মেঠো সুরেলা গলায় বলল, ‘সৎকার শেষ হয়ে গেলে মানুষ আর কী দিতে পারে। তোমরা মায়ের সৎকার শেষ করেছ। আমার কিছু দেওয়ার নেই।’ কয়েক দণ্ড থামল মেজদা, তারপর বলল, ‘আমাকে যেমন একটা নির্বোধ সুটকেসওয়ালা অন্ধ করে দিয়ে গেল, তেমনি মাকে এই সংসারের শনিতে অন্ধ করেছিল। মা যে কত অন্ধ আমি জানতাম।…এই অন্ধ চোখ মাকে আর দিতে ইচ্ছে করে না। মা আমার হৃদয়ের চক্ষু পাক।’
মেজদা আর কিছু বলল না। কাশীর সাদা পাথরে বাঁধানো মায়ের বেদির ওপর আমরা পাঁচটি সন্তান বসে থাকলাম। শব্দহীন সেই চরাচরে বসে অনুভব করলাম, আমাদের মায়ের সৎকার যেন এইমাত্র সমাধা হলো।
সর্বগ্রাস এই দুঃখেও আমরা মায়ের নির্বিঘ্ন যাত্রা কামনা করছিলাম। আমাদের যা দেওয়ার সাধ্যমতো দিয়েছি। মা সেই অন্তহীন পথ অতিক্রম করুক।

স্বাধীনতা - ল্যাংস্টন হিউজ


স্বাধীনতা
ল্যাংস্টন হিউজ

স্বাধীনতা কোনোদিনই আসবে না,
না,
আজ নয়
কোনোদিনই নয়
ভয় অথবা সমঝোতার মধ্যে,
তার কারন
আমাদেরও তো অন্য সকলের মতন
                        অধিকার রয়েছে,
দুপায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকার
দুকাঠা জমির মালিকানার,

শুনে শুনে কান পচে গেল,
‘সময়ে
সবই হবে, কাল একটা নতুন দিন’-


মৃত্যুর পরে তো আমার কোনো
স্বাধীনতার প্রয়োজন হবে না,
আগামীকালের রুটি
দিয়ে কি আজ বাঁচা যায়,
স্বাধীনতা একটা শক্তিশালী বীজপ্রবাহ,
বাঁচার জন্য,
একটা বড় প্রয়োজনের জন্য,
আমিও তো সেখানেই বাস করি,
তুমি যেখানে,

তাই
স্বাধীনতা আমার প্রয়োজন
তোমার যেমন।
















বৈষ্ণব পদাবলী



বৈষ্ণব পদাবলী
বৈষ্ণব পদাবলীর বিশেষত "পাঠ্য" ও উল্লেখযোগ্য কবি ও তাদের কিছু পদ এখানে দেওয়া হল।


বিদ্যাপতি
গোবিন্দদাস









কাজ চলছে...

বৈষ্ণব পদাবলী - চণ্ডীদাস



বৈষ্ণব পদাবলীর বিশেষত "পাঠ্য" ও উল্লেখযোগ্য কিছু পদ এখানে দেওয়া হল।




কেনা বাঁশী বা বড়ায়ি কালিনী নই কুলে
( "বড়ু" চণ্ডীদাস )

কেনা বাঁশী বা বড়ায়ি কালিনী নই কুলে।
কেনা বাঁশী বা বড়ায়ি এ গোঠ-গোকূলে ।
আকুল শরীর মোর বেআকুল মন।
বাঁশীর শবদে মো আউলাইল রান্ধন         ১
কেনা বাঁশী বাএ বড়ায়ি সেনা কোন জনা।
দাসী হআঁ তার পাএ নিশিবো আপনা       ধ্রু
কেনা বাঁশী বাএ বড়ায়ি চিত্তের হরিষে।
তার পাত্র বড়ায়ি মো কৈলোঁ কোন দোষে ।
আঝর ঝরএ মোর নয়নের পানী।
বাঁশীর শবদে বড়ায়ি হারায়িল পরানী।      ২
আকুল করিতে কিবা আহ্মার মন।
বাজাএ সুসর বাঁশী নান্দের নন্দন
পাখি নহোঁ তার ঠাই উড়ী পড়ি জাওঁ।
মেদিনী বিদার দেউ পসি লুকাওঁ            ৩
বন পোড়ে আগ বড়ায়ি জগজনে জানী।
মোর মন পোড়ে যে কুম্ভারের পানী
আস্তর সুখ মোর কাহ্ন-আভিলাসে।
বাসলী শিরে বন্দী গাইল চণ্ডীদাসে ।        ৪






কি মোহিনী জান বঁধু কি মোহিনী জান
( “দ্বিজ” চণ্ডীদাস )


কি মোহিনী জান বঁধু কি মোহিনী জান।
অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা হেন
রাতি কৈলু দিবস দিবস কৈলু রাতি।
বুঝিতে নারি বন্ধু তোমার পিরীতি
ঘর কৈলু বাহির বাহির কৈলু ঘর।
পর কৈলু আপন আপন কৈলু পর।
বন্ধু তুমি মোরে যদি নিদারুণ হও।
মরিব তোমার আগে দাঁড়াইয়া রও
বাশুলী-আদেশে দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়।

পরের লাগিয়া কি আপন পর হয় ।








সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম
( “দ্বিজ” চণ্ডীদাস )


সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম।
কানের ভিতর দিয়া          মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ
না জানি কতেক মধু         শ্যাম-নামে আছে গো
বদন ছাড়িতে নাহি পারে।
জপিতে জপিতে নাম         অবশ করিল গো
কেমনে পাইব সই তারে ।
নাম-পরতাপে যার           ঐছন করিল গো
অঙ্গের পরশে কিবা হয়।
যেখানে বসতি তার          নয়নে দেখিয়া গো
যুবতী-ধরম কৈছি রয় ।
পাসরিতে করি মনে         পাসরা না যায় গো
কি করিব কি হবে উপায়।
কহে দ্বিজ চণ্ডীদাসে          কুলবতী কুল নাশে
আপনার যৌবন যাচায় ।



বঁধূ কি আর বলিব আমি
( চণ্ডীদাস )


বঁধূ কি আর বলিব আমি।
জীবনে মরণে        জনমে জনমে
প্রাণনাথ হৈও তুমি ।
তোমার চরণে        আমার পরানে
লাগিল প্রেমের ফাঁসি।
সব সমর্পিয়া         একমন হৈয়া
নিশ্চয় হইলুঁ দাসী ।
ভাবিয়া দেখিলুঁ        এ তিন ভুবনে
আর কে আমার আছে।
রাধা বলি কেহ              শুধাইতে নাই
দাঁড়াইব কার কাছে।
এ-কুলে ও-কুলে      দু-কুলে গোকুলে
আপনা বলিব কায়।
শীতল বলিয়া         শরণ লইলুঁ
ও-দুটি কমল পায় ।
না ঠেলহ ছলে        অবলা অখলে
যে হয় উচিত তোর।
ভাবিয়া দেখিলুঁ       প্রাণনাথ বিনে
গতি যে নাহিক মোর ।
আঁখির নিমিখে       যদি নাহি হেরি
তবে সে পরাণে মরি।
চণ্ডীদাস কয়         পরশ-রতন
গলায় গাঁথিয়া পরি ।


বৈষ্ণব পদাবলী - জ্ঞানদাস


বৈষ্ণব পদাবলীর বিশেষত "পাঠ্য" ও উল্লেখযোগ্য কিছু পদ এখানে দেওয়া হল।



আলো মুঞি কেন গেলু কালিন্দীর কূলে
( জ্ঞানদাস )

আলো মুঞি কেন গেলু কালিন্দীর কূলে।
চিত হরি কালিয়া নাগর নিল চলে
রূপের পাথারে আঁখি ডুবি সে রহিল।
যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল
ঘরে যাইতে পথ মোর হৈল অফুরান।
অন্তরে বিদরে হিরা ফুকরে পরান !
চন্দন চাঁদের মাঝে মৃগমদ-ধাঁধা।
তার মাঝে হিয়ার পুতলী রৈল বাঁধা
কটি পীতবসন রশন তাহে জড়া।
বিধি নিরমিল কুলকলঙ্কের কোঁড়া
জাতি কুল শীল সব হেন বুঝি গেল।
ভুবন ভরিয়া মোর কলঙ্ক রহিল
কুলবর্তী সতী হৈয়া দুকুলে দিলু দুখ।
জ্ঞানদাস কহে দড় করি বাঁধ বুক।

অনুবাদ সাহিত্য



অনুবাদ সাহিত্য

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে যে বেশকিছু সাহিত্য রচিত হয়েছিল তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলা যেতে পারে অনুবাদ সাহিত্য। আমরা জানি, ১২০৬ খ্রীঃ যে তুর্কি আক্রমণ হয়েছিল তার ফলে বাংলাদেশের সমাজ এক বৃহৎ সংকটের মুখে পড়ে। অর্থাৎ, হিন্দু শাসনতন্ত্রের অবসান ও ইসলামীয় শাসনতন্ত্রের শুরু। এই সময় বিশেষত নীম্নবর্গীয় যে সকল হিন্দু জনজাতি ছিল তারা ক্রমশ ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে থাকে। কাজেই হিন্দুদের কাছে তাদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখা ছিল একমাত্র উপায়। আর সেই কারনেই একদল মানুষ অবক্ষয়িত হিন্দু সমাজকে পুনরুজ্জীবিত করতে ভারতীয় পুরানের অনুবাদ করতে থাকেন। তার-ই ফলে জন্ম নেয় অনুবাদ সাহিত্য।

         অনেকের মতে, বাংলায় ইসলামি শাসন শুরু হলে পাঠান সুলতানরা সভাকবিদের কাছ থেকে রামায়ন মহাভারতের গল্প শুনতে আগ্রহী হন, এবং অনুবাদ রচনায় উদ্বুদ্ধ করেন । যার ফলশ্রুতি মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্য। এর প্রমাণ স্বরূপ বলা যেতে পারে- রুকনুদ্দিন বরবক শাহ মালাধর বসুকে ভাগবতের অনুবাদ রচনার জন্য ‘গুণরাজখান’ উপাধি দেন। আবার পরাগল খা তার সভাকবিদের দিয়ে মহাভারত অনুবাদ করিয়ে নেন। ফলত, অনুবাদ সাহিত্য রচনার পিছনে যে ইসলামীয় রাজাদের প্রভাব ছিল না , সেটা অস্বীকার করা যায় না।

বাংলা সাহিত্যে অনুবাদ সাহিত্য মূলত তিনটি-
 রামায়ণ
মহাভারত
ভাগবত

        অনুবাদ সাহিত্য এ ক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য  রামায়ণ রচয়িতা  কৃত্তিবাস ওঝা বড়ু চন্ডীদাসের পরে তিনিই বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবি তাঁর রচিত রামায়ণ বাংলা ভাষায় প্রথম ও সর্বাধিক জনপ্রিয় কাব্য বর্ণনার হৃদয়গ্রাহিতা এবং ভাষার প্রাঞ্জলতাই এর জনপ্রিয়তার কারণকৃত্তিবাসী রামায়ণ হিসাবে পরিচিত গ্রন্থটি  ১৮০২ - ০৩ খ্রিস্টাব্দে  শ্রীরামপুর মিশন থেকে মুদ্রিত হয় মুদ্রণের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বঙ্গদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে

           রামায়ণেরকয়েকজন উল্লেখযোগ্য অনুবাদক ও কাব্যের নাম দেওয়া হলঃ


সময়কাল
কবি
কাব্যের নাম
পঞ্চদশ শতাব্দী
কৃত্তিবাস ওঝা
শ্রীরাম পাঁচালি
মাধব কন্দলি
শ্রীরাম পাঁচালি।
ষোড়শ শতাব্দী
শঙ্কর দেব
শ্রীরাম পাঁচালি (উত্তর কাণ্ড)
সপ্তদশ শতাব্দী
নিত্যানন্দ আচার্য
অদ্ভুত আচার্যের রামায়ণ
রামশঙ্কর দত্ত
রাম কথা
চন্দ্রাবতী
রামায়ণ
অষ্টাদশ শতাব্দী
রামচন্দ্র
বিভীষণের রায়বার
কাশীরাম
কালনেমির রায়বার
জগন্নাথ দাস
লঙ্কাকাণ্ড
উৎসবানন্দ
সীতার বনবাস
জগতরাম রায়
অদ্ভুত রামায়ণ



       মহাভারতের প্রথম বাংলা অনুবাদ হচ্ছে কবীন্দ্র মহাভারত  । আনুমানিক ১৫১৫ - ১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে  কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের বাংলা অনুবাদ করেন লস্কর পরাগল খাঁর নির্দেশে রচিত বলে এটি পরাগলী মহাভারত নামেও পরিচিত কবীন্দ্র মহাভারতে  অশ্বমেধপর্ব সংক্ষিপ্ত ছিল বলে ছুটি খাঁর নির্দেশে শ্রীকর নন্দী জৈমিনিসংহিতার অশ্বমেধপর্ব অবলম্বনে বিস্তৃত আকারে সেটি রচনা করেন, যাকে পৃথক গ্রন্থ না বলে বরং কবীন্দ্র মহাভারতের পরিশিষ্ট বলা চলে তবে বাংলা মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কাশীরাম দাস আনুমানিক ১৬০২ - ১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তাঁর কাব্য রচনা করেন । তিনি মহাভারতের কটি পর্ব অনুবাদ করেছিলেন তা জানা না গেলেও শ্রীরামপুর প্রেস থেকে ১৮০১-৩ খ্রিস্টাব্দে কাব্যটির চারটি পর্ব মুদ্রিত হয় পরবর্তী কালে জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের সম্পাদনায় ১৮৩৬ খ্রীঃ সম্পূর্ণ অংশ মুদ্রিত হয়। মধুর শব্দ , উপমা, অলংকার ছন্দের নৈপুন্যে তাঁর কাব্যশৈলী শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখে। কাশীরাম দাসের মহাভারত ‘ভারত পাঁচালি’ নামেও পরিচিত ছিল সকল বাংলা মহাভারতের অনুবাদের মধ্যে এটিই সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে


           মহাভারতের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য অনুবাদক ও কাব্যের নাম দেওয়া হলঃ

সময়কাল
কবি
কাব্যের নাম
ষোড়শ শতাব্দী
কবিন্দ্র পরমেশ্বর
পাণ্ডব বিজয়
শ্রীকর নন্দী
অশ্বমেধ কথা
রামচন্দ্র খান
অশ্বমেধ পর্ব
সপ্তদশ শতাব্দী
কাশীরাম দাস
মহাভারত
নিত্যানন্দ ঘোষ
মহাভারত
অষ্টাদশ শতাব্দী
দুর্লভ সিংহ
ভারত পাঁচালি
পুরুষোত্তম দাস
পাণ্ডব পাঁচালি


            সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ’সাধারণভাবে ভাগবত’নামে পরিচিতবেদব্যাস-প্রণীত অষ্টাদশ পুরাণের অন্যতম এবং তাঁর ব্রহ্মসুত্রের বারোটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত অকৃত্রিম ভাষ্য হল ‘ভাগবত’এর বিষয়বস্তু হল শ্রীকৃষ্ণেরর জীবনকথাবাংলায় 'ভাগবতচর্চার শুরু চৈতন্য-পূর্ব যুগে হলেও এর বিস্তার ঘটেছে চৈতন্য পরবর্তী যুগে ।  সংস্কৃত ভাগবত পুরাণ অবলম্বনে বাংলায় প্রথম কাব্য রচনা করেন বর্ধমান জেলার কুলীন গ্রাম নিবাসী মালাধর বসু বা গুণরাজ খান।  তিনি চৈতন্যপূর্ব যুগের কবি ছিলেনমালাধর বসুই ভাগবতের প্রথম অনুবাদকতার আগে অন্য কোনো ভাষায় ভাগবত অনূদিত হয়তাঁর কাব্যের নাম “শ্রীকৃষ্ণুবিজয়।  কাব্যটি ১৪৭৩-১৪৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত হয়েছিল।  শ্রীকৃষ্ণবিজয় রচনা করে তিনি গৌড়ের সুলতানের কাছ থেকে গুণরাজ খাঁ উপাধি পানশ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যের অপর নাম ছিল গোবিন্দমঙ্গল। এটিই সন-তারিখযুক্ত প্রথম বাংলা কাব্য। বিষ্ণুপুরাণ, হরিবংশ, বৈষুবীয় তন্ত্র গ্রন্থের অনুসরণে কবি তার কাব্য রচনা করেছেন।তাঁর কবিত্বের সঙ্গে ভক্তিপ্রাণতার মিশেল ও ঐশ্বর্যভাবের সঙ্গে মধুর কান্তাভাবের সমন্বয় শ্রী চৈতন্যও আস্বাদন করেন। রাধাভাবের উন্মেষ তার কাব্যেই প্রথম লক্ষ করা যায়, যা বৈষব পদাবলির পূর্বাভাসকে সূচিত করেছে। কাব্যে শ্রীকৃষ্ণুের ঐশ্বর্যভাবের চেয়ে মধুর ও কান্তা ভাবটিই বেশি প্রকাশ পেয়েছে। 

            ভাগবতের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য অনুবাদক ও কাব্যের নাম দেওয়া হলঃ
সময়কাল
কবি
কাব্যের নাম
পঞ্চদশ শতাব্দী
মালাধর বসু
শ্রীকৃষ্ণবিজয়
ষোড়শ শতাব্দী
গোবিন্দ আচার্য
কৃষ্ণমঙ্গল
দ্বিজ মাধব
শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল
সপ্তদশ শতাব্দী
যশশ্চন্দ্র
গোবিন্দবিলাস
অষ্টাদশ শতাব্দী
অভিরাম দাস
কৃষ্ণমঙ্গল
ঘনশ্যাম দাস
শ্রীকৃষ্ণবিলাস

-