বাংলা শব্দ ভান্ডার

 


বাংলা শব্দ ভান্ডার

 

যে কোনো ভাষার প্রধান অবলম্বন তার শব্দ ভান্ডার। বাংলা ভাষা সংস্কৃত বা গ্রিক-এর মতো কোনো স্বাধীন স্বতন্ত্র ভাষা নয়। ভারতীয় ভাষার বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এই ভাষার জন্ম। সুতরাং বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডারে বিভিন্ন ভাষার মিশ্রন আমরা দেখতে পাই। সেই সূত্র ধরেই বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডারকে আমরা তিনটি ভাগে ভাগ করে নিতে পারি। ১. মৌলিক শব্দ ২. আগন্তুক  শব্দ  ৩. নব্যগঠিত শব্দ

 

প্রশ্নঃ মৌলিক শব্দ বলতে কী বোঝায়?

সংস্কৃত শব্দ থেকে যে শব্দ গুলি অবিকৃত বা বিকৃত হয়ে সরাসরি বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে সেই শব্দগুলি হল মৌলিক শব্দ। এই মৌলিক শব্দ আবার তিন প্রকার। ১. তৎসম শব্দ -  ২. অর্ধ তৎসম শব্দ -  ৩. তদ্ভব শব্দ।  

তৎসম শব্দঃ সংস্কৃত শব্দ থেকে যে শব্দ গুলি অবিকৃত বা অপরিবর্তিত হয়ে সরাসরি বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে সেই শব্দগুলি হল তৎসম শব্দ। যেমনঃ সূর্য , চন্দ্র , গ্রহ, লতা , গিরি , কর্ম , কীর্তন , বৈদ্য , বিষ্ণু প্রভৃতি।

অর্ধ তৎসম শব্দঃ সংস্কৃত শব্দ থেকে যে শব্দ গুলি ঈষৎ বা সামান্য পরিবর্তিত হয়ে সরাসরি বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে সেই শব্দগুলি হল অর্ধ তৎসম শব্দ। যেমনঃ

ক। বৃহস্পতি > বেস্পতি

খ। প্রসন্ন > পেসন্ন

গ। পুত্র > পুত্তুর

ঘ। বৈদ্য > বদ্যি

ঙ । রাত্রি > রাত্তির

তদ্ভব শব্দঃ সংস্কৃত শব্দ থেকে যে শব্দ গুলি ধবনি পরিবরতনের নিয়ম মেনে পুরোপুরি পরিবর্তিত হয়ে সরাসরি বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে সেই শব্দগুলি হল তদ্ভব শব্দ। যেমনঃ মাটি , হাত , ওঝা , কানাই , কাঠ , সাঁঝ , কাজ প্রভৃতি শব্দ।

ক। মৃত্তিকা > মাটি

খ। হস্ত > হাত

গ। সন্ধ্যা > সাঁঝ

ঘ। বধু > বৌ

ঙ। কর্ম > কাজ

 

 

 

 

প্রশ্নঃ আগন্তুক শব্দ বলতে কী বোঝায়?

যে সব দেশি বা বিদেশি শব্দ সরাসরি বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে সেই শব্দ গুলোকেই আগন্তুক শব্দ বলে। আগন্তুক শব্দ তিন প্রকার – ১. দেশি শব্দ  ২. বিদেশি শব্দ  ৩. প্রাদেশিক শব্দ

দেশি শব্দঃ দ্রাবিড় কিংবা অস্ট্রিক বা বাংলার প্রাচীন গোষ্ঠী সাঁওতাল শব্দ থেকে যে শব্দ সরাসরি বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে সেই শব্দ গুলোকেই দেশি শব্দ বলে। যেমনঃ কালো , কুলো , খড় , ঢেঁকি , ডিঙি , নৌকা , পাঁঠা ইত্যাদি শব্দ।

বিদেশি শব্দঃ ভারতীয় শব্দ বাদে পাশ্চাত্যের যে সব শব্দ সরাসরি বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে সেই শব্দ গুলোকেই বিদেশি শব্দ বলে। যেমনঃ আজান , আদাব , হসপিটাল , স্কুল , কলেজ , চেয়ার ইত্যাদি,।

ইংরেজি শব্দঃ

স্কুল , কলেজ , কফি , টেবিল , চেয়ার , বুরুশ ইত্যাদি।

আরবি শব্দঃ

আক্কেল , আদাব , মর্জি , আল্লা, আসবাব, খতম, কাবাব, আসল , দাবি প্রভৃতি।

ফারসি শব্দঃ

আন্দাজ , কোমর , সাবাস , সিন্দুক , তাজা , দম প্রভৃতি।

তুর্কি শব্দঃ

কাঁচি , কাবু , চাকু , দারোগা , বাবা, বারুদ , প্রভৃতি।

পর্তুগিজ শব্দঃ

আলমারি , আনারস, চাবি , জানালা, সাবান , বোতাম প্রভৃতি শব্দ।

ফরাসি শব্দঃ

গ্যরাজ , কুপোন, রেস্তরাঁ , কাফে প্রভৃতি শব্দ।

ওলন্দাজ শব্দঃ

রুইতন , চিড়েতন ,  তুরুপ , তাস প্রভৃতি শব্দ।

প্রাদেশিক শব্দঃ ভারতের অন্য প্রদেশ থেকে যে শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে। যেমনঃ রুটি পুরি মিঠাই চুরুট  হরতাল প্রভৃতি শব্দ।

 

 

 

প্রশ্নঃ নব্য গঠিত শব্দ বা মিশ্র শব্দ বলতে কী বোঝায়?

দুটি ভিন্ন শ্রেণির শব্দ যখন মিশিয়ে জোড় শব্দ করে উচ্চারণ করা হয় তাকেই নব্য গঠিত শব্দ বা মিশ্র শব্দ বলে। যেমনঃ

ক। মাস্টার(ইং) + মশাই(তদ্ভব) = মাস্টার মশাই

খ। শাক(তৎসম) + সবজি(ফারসি) = শাকসবজি

গ। আইন(আরবি) + জীবি(তৎসম) = আইনজীবী






কপিরাইট ebanglaschools

পুনর্মুদ্রণ যোগ্য নয়। 

উপসর্গ

 


উপসর্গ

উপসর্গ কাকে বলে?

যে সকল ধ্বনিগুচ্ছ বা অব্যয় বাক্যে একা বসতে পারে না, কোনো শব্দের আগে বসে উচ্চারিত হয় সেই সকল ধবনিগুচ্ছ বা অব্যয়কে উপসর্গ বলে।

উপসর্গ সাধারণত তিন প্রকার-

১. সংস্কৃত উপসর্গ।  

২. বাংলা উপসর্গ।  

৩. বিদেশি উপসর্গ।



সংস্কৃত উপসর্গ

প্র

প্রমান , প্রগতি

পরা

পরাগত , পরাজয়

সম্

সম্মুখ , সম্মেলন

অনু

অনুমান , অনুচর

অব

অবরোধ , অবগাহন

নির্

নির্বাহ , নির্ণয়

দুর্

দুর্নীতি , দুঃসহ

অভি

অভিনয় , অভিকর্ষ

অধি

অধিবেশন , অধিপতি

সু

সুলভ , সুগঠিত

উদ্

উদিত , উদ্বৃত্ত

অতি

অতিক্রম , অতিরঞ্জন

নি

নিধান , নিগুঢ়

প্রতি

প্রতিপক্ষ , প্রতিবন্ধ

পরি

পরিক্রমা , পরিবেষণ

অপি

অপিনিহিতি

উপ

উপস্থিত , উপহার

আক্ষেপ , আগামী

বাংলা উপসর্গ

অকাজ , অজানা

অনা

অনামুখো , অনাবৃষ্টি

আকাল , আলুনি

কু

কুকাজ , কুকথা

নি

নিঝুম , নিখরচা

পাতি

পাতিলেবু , পাতিহাঁস

সঠিক , সজরে

হা

হাভাতে , হাপিত্যেস

আট

আটচালা , আটপৌঢ়ে

আড়

আড়চোখ , আড়কাঠি

ছিচ

ছিঁচকাঁদুনে 

পাশ

পাশবালিশ , পাশদুয়ার

মগ

মগডাল

নিত

নিতবর

রাম

রামছাগল , রামধোলাই

বিদেশি উপসর্গ

গর

গরহাজির , গরমিল

না

নাবালক , নাহোক

নিম

নিমরাজি , নিমগোছ

ফি

ফি বছর , ফি হপ্তা

বদ

বদলোক , বদমেজাজি

হর

হরতাল , হরতোন

হেড

হেডপণ্ডিত , হেডঅফিস

ডবল

ডবল পরোটা , ডবল মাসুল

হাফ

হাফহাতা , হাফশার্ট

দর

দরপত্তনি , দরদালান




আকাশের সাতটি তারা - জীবনানন্দ দাশ ( সংক্ষিপ্ত আলোচনা )



[ বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ ebanglaschools এর সমস্ত আলোচনা কোনো পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গের জন্য নয়। সাধারণ এবং অতি সাধারণ পিছিয়ে পড়া ছাত্র ছাত্রীদের জন্যই এই উদ্যোগ। তাদের কথা ভবেই এই আলোচনার প্রচেষ্টা। বিশিষ্টরা দূরে থাকুন । আমাদের একান্ত অনুরোধ যদি ছাত্র ছাত্রীরা এই আলোচনা থেকে উপকৃত হও তাহলে নীচের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে ভুলে যেও না। ]    


আকাশের সাতটি তারা

জীবনানন্দ দাশ


বাংলা কাব্য কবিতার জগতে রবীন্দ্র ঘরানার বাইরে এসে যিনি প্রথম কলম ধরলেন তিনি জীবনানন্দ দাশ। তিনি মূলত প্রকৃতির মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়কে কেন্দ্র করে তার মধ্যে  কোনো না কোনো মহৎ বিষয়কে রূপায়িত করেছেন। 'আকশের সাতটি তারা' কবিতাটি রূপসী বাংলা কাব্য গ্রন্থের ৭৩ টি কবিতার মধ্যে একটি অন্যতম কবিতা। কবির মৃত্যুর পর তার ভাই ৬২ টি কবিতা নিয়ে একটি কাব্য সংকলন প্রকাশ করেন। এবং নাম দেন রূপসী বাংলা।

কাব্য গ্রন্থের নাম থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় এই কবিতার সহজ বিষয় রূপে উঠে আসবে বাংলার পল্লী প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের কথা। এই কবিতাটিও তার ব্যতিক্রমী নয়। কোনো এক গোধূলি সন্ধ্যার আকাশে সাতটি তারার সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করে তার কবিতার নির্মাণ।

কবিতায় তিনি বলছেন এই বাংলার কোনো এক উন্মুক্ত প্রান্তরে বসে আকাশে সাতটি তারা প্রত্যক্ষ করছেন, সেই সাথে আকাশের বুকে লাল মেঘের উপস্থিতি দেখছেন। তারপরই কল্পনা করছেন গঙ্গাসাগরের ঢেউ, কেশবতী কন্যা, চুল, হিজল কাঠালবন, ধানের গন্ধ, কলমীর ঘ্রান, ঘাস, বট ফল ইত্যাদির মত ছোটছোট টুকরো টুকরো বিষয়। প্রাথমিক ভাবে পড়লে আমরা কোনো কিছুর সাথে কোনো কিছুরই মিল খুঁজে পাব না। আসলে কবি এই টুকরো টুকরো উপমা-চিত্রকল্পের মধ্য দিয়ে কোনো এক গভীর অনুভবে পৌঁছাতে চাইছেন।

আসলে এই কবিতায় অন্তর্নিহিত অর্থটি একমাত্র প্রধান বিষয়। তিনি কবিতার নামে যে সাতটি তারার কথা বললেন সেটি আসলে সাতজন পৌরানিক ঋষির নাম- পুলহ, ক্রতু, পুলস্ত্য, বশিষ্ট, অত্রি, অঙ্গিরা ও মরিচী। এই সাতজন ঋষি আসলে প্রজাপতি ব্রহ্মার অংশ। তাঁদের স্মরণে এই সপ্তর্ষি মন্ডল। মহাকাশে এর যেমন শোভা আছে তেমনই মৃত্যুর সাথে তারার সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। কবিতার ছত্রে ছত্রে তার বিন্যাস আমরা লক্ষ্য করব।

তিনি সাতটি তারার সাথে দেখছেন মেঘের রং কামরাঙার মত লাল এবং মৃত মনিয়া পাখি গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে।এখানে মনিয়া হল চঞ্চলতার প্রতীক যা কিনা আজ শান্ত। এবং আকাশের বুক চিড়ে কামরাঙার মত লাল আগুনে তার দহন হচ্ছে আর গঙ্গাসাগরের শান্ত স্নিগ্ধতায় তা মলিন হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ একটি কর্মজ্জ্বল একটি দিনের শেষ হচ্ছে। অন্ধকার মৃত্যু ক্রমশ নেমে আসছে চারদিকে। ঠিক তার পরেই কবি বলছেন নীল সন্ধ্যা কেশবতী কন্যা যেন আকাশে এসেছে,আমার চোখের 'পরে আমার মুখের 'পরে চুল তার ভাসে অর্থাৎ কবি অন্ধকার - প্রিয়জনের মৃত্যুকে অনুভব করছেন বারবার। তিনি বলছেন এই প্রকৃতিকে প্রিয়ার মতো এত কামনা দিয়ে এত মায়া ভরে আর কেউ কখনও দেখেনি। হিজল কাঠাল জামের মধ্যে দিয়ে তিনি প্রকৃতির প্রতিটি অভিব্যক্তি তিনি প্রাণ দিয়ে অনুভব করতে চাইছেন, যা কোনো ব্যক্তির প্রতিরূপ হিসাবে আমরা ভাবে নিতে পারি।

কবিতার দ্বিতীয় পঙতিতে এসে এই ভাবনা আরো জোরালো হয়। নরম ধানের মায়া গন্ধ, কলমীর তীক্ষ্ণ গন্ধ, হাঁসের পালকের কোমল ছোঁয়া, পুকুরের জলের স্নিগ্ধতা, মাছে দের আষ্টে গন্ধ, কিশোরীর চাল ধোয়া হাতের কোমল স্পর্শ সবই যেন কবিকে কামনার রসে জারিত করে যা তিনি প্রকৃতির ছোঁয়ায় খুঁজে পেতে চান বারবার। এর ঠিক পরেই অন্ধকার - মৃত্যুকে অনুভব করেছেন। লাল লাল বট ফলের মধ্যে ক্লান্ত নীরবতার শব্দকে তিনি শুনেছেন। নীরবে চলে যাওয়ার প্রতিটি মুহূর্তকে তিনি ভুলে থাকতে পারেন না বরং আরো আরো জড়িয়ে ধরতে চান বারবার। এই ঝরে যাওয়া পাতার মাঝেই নিজেকে খুঁজে পান। প্রকৃতির প্রতিটি অনুষঙ্গে তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়কে মিলিয়ে দিতে চান। কামনায় শিক্ত হয়ে প্রকৃতির মাঝেই এক সময় বিলীন হয়ে যেতে চান। আর তাই বলেন আকাশের সাতটি তারা যখন ওঠে আমি পাই টের। অর্থাৎ তিনি প্রতি মুহূর্তে ভূত ভবিষ্যতে বিলীন হয়ে যেতে চান, এই প্রকৃতির মাঝেই যেন তার স্থান হয় সেই বাসনাই উঠে এসেছে কবিতার মধ্যে দিয়ে।


COPYRIGHTS পুনর্মুদ্রণ যোগ্য নয়।

সংক্ষিপ্ত আলোচনা - খেয়াঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



[ বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ ebanglaschools এর সমস্ত আলোচনা কোনো পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গের জন্য নয়। সাধারণ এবং অতি সাধারণ পিছিয়ে পড়া ছাত্র ছাত্রীদের জন্যই এই উদ্যোগ। তাদের কথা ভবেই এই আলোচনার প্রচেষ্টা। বিশিষ্টরা দূরে থাকুন । আমাদের একান্ত অনুরোধ যদি ছাত্র ছাত্রীরা এই আলোচনা থেকে উপকৃত হও তাহলে নীচের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে ভুলে যেও না। ]    



খেয়া - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সংক্ষিপ্ত আলোচনা


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চৈতালি(১৮৯৬) কাব্যগ্রন্থের একটি অন্যতম কবিতা খেয়া। জমিদারী সূত্রে দীর্ঘদীন বাংলাদেশের সাজাদপুর - পাতিসরে থাকাকালীন তিনি নৌকা ভ্রমণ করতেন এবং সেখানেই দুপাশের গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা দুচোখ ভরে উপভোগ করেছিলেন। সেই রকমই এক সময়ে ১৩০৬ বঙ্গাব্দের চৈত্র থেকে শ্রাবণ মাসের মধ্যেই একটি কবিতা রচনা করলেন, যার নাম ‘খেয়া’, এটি এই কাব্যের ১৯ সংখ্যক একটি কবিতা। যেকোনো কবিতারই সাধারনত দুটি অর্থ থাকে – বাইরের অর্থ ও ভেতরের অর্থ। ‘খেয়া’ কবিতাটি পড়লে সাধারন পাঠকের কাছে উঠে আসে নিটোল এক গ্রামবাংলার মানুষের জীবনযাত্রার সাধারন ছবি। যেখান কবি আঁকেন দুই পাশে দুই জনপদ। একদিকে গ্রাম্যসভ্যতা ও অন্যদিক মফস্বল এবং মাঝখান থেকে বয়ে যাওয়া একটি নদী। এই নদী দুপাশের প্রান্তরকে আলাদা করলেও খেয়া বা নৌকা সেই দুই গ্রামের মানুষকে এক সূত্রে বেঁধে রেখেছে। এই খেয়াকে কেন্দ্র করেই বেঁচে আছে দুটি সভ্যতার মানুষজন। সাধারণ ভাবে আমরা জানি, গ্রামের মানুষের উপার্জিত আয় নির্ভর করে কৃষিজ ফসল বেচাকেনার মধ্য দিয়ে। সেকারনেই উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে নদী পেরিয়ে অন্য প্রান্তে তাদের নিত্য দিন পৌঁছাতে হয়। সেই সূত্র ধরেই তাদের পথ-ঘাট, মানুষ জন, তাদের কাঙ্ক্ষিত বিষয়গুলো পরস্পর পরস্পরকে চিনে নিয়েছে। আর সেখান থেকে অর্জিত অর্থ, সম্পদ তাদের জীবনকে সুন্দর ভাবে বাঁচতে সাহায্য করে। কারো কোনো দিন উপার্জন বেশি হলে যেমন স্মৃতি হয়ে থেকে যায়, তেমনি স্বল্প রোজগারে মনের মধ্যে তৈরি হয় দ্বন্দ্ব, আর উপার্জন না হলে খালি হাতে তাদের ফিরে আসতে হয়। এই সভ্যতা কোনো মানুষকে সহজে কিছু দেয়না, অর্জন করে নিতে হয়। গ্রামবাংলার এই ছবি কোনো নতুন কথা নয়। স্বল্প আয়ের মধ্য দিয়েই তারা ভালো থাকতে চায়, খুঁজে নিতে চায় তাদের আকাঙ্ক্ষা। প্রতিদিনের এই নিত্য যাপনে তাদের জীবন নিষ্পেষিত হয় প্রতিনিয়ত। তবু তারা হেরে যায় না। হয়ত তাদের ও জীবনে স্বচ্ছন্দ আসবে, রাজার মত তারাও সুখী হবে এই প্রত্যাশা নিয়ে বেঁচে থাকে প্রতিটা দিন, আর বেলার শেষে স্বপ্ন ভঙ্গ হলে বিমর্ষ হয়ে তারা ঘরে ফেরে। আশা আকাঙ্ক্ষার এই দোলাচলে এভাবেই কেটে যায় প্রতিটা দিন, প্রতিটা সময়। তাদের মনের দুঃখ কষ্ট কেউ জানতে চায় না। জানতে চায় না তাদের ভাললাগার খুঁটিনাটি। জমিদার আসে , সময় যায় তাদের জীবনের ইতিহাস বদলায় না। স্বাভাবিক ভাবে তাদের জীবনের কথাও কেও জানতে পারে না। শুধু মাত্র খেয়াকে সাথে করে ঈশ্বরের উপরে বিশ্বাস আর দুইজনপদের উপর আশা রেখে একটু সুখী জীবনের প্রত্যাশা করে প্রতি মুহূর্তে। কবি বলেন, এই জীর্ণ খেয়াই তাদের জীবনের একমাত্র ভরসা, যা তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ গ্রামের মানুষের সেই আর্ত কথাকেই তিনি তুলে ধরেছেন এই কবিতায়।  

COPYRIGHTS পুনর্মুদ্রণ যোগ্য নয়।

হাওয়ার গানঃ বুদ্ধদেব বসু ( সংক্ষিপ্ত আলোচনা )


হাওয়ার গানঃ বুদ্ধদেব বসু


“পার্কের বেঞ্চিতে ঝরা পাতা ঝর্ঝর / শার্সিতে কেঁপে ওঠা দেয়ালের পঞ্জর/ চিমনির নিস্বনে কাননের ক্রন্দনে তার কথা কেবলই শুধাইরে” – কার কথা? উক্তিটির তাৎপর্য বিচার কর।

 

বুদ্ধদেব বসু “হাওয়ার গান” কবিতায় ‘তার কথা’ বলতে হাওয়া রূপ মনের কথা বোঝাতে চেয়েছেন।

          আলোচ্য কবিতার সমগ্র পংতি জুড়ে তিনি মনের আবাসস্থলের সন্ধান করেছেন। কোথাও তিনি তা খুঁজে পাননি, তা স্বত্বেও সন্ধান থেকে কখনও বিরত হননি। একসময় তার অনুভব হাওয়ার বেগ যেখানে প্রবল সেই জায়গা গুলিতেই সন্ধান করলে হয়ত হাওয়ার আবাসস্থল দেখা যাবে,লাভ করা যাবে। সেকারনেই পার্কের বেঞ্চিতে ঝরা পাতার কাছে , কখনও বা প্রবল ঝড়ে কেঁপে ওঠা জানালার কাঁচ, চিমনির কাছে ছুটে গেছেন বারবার। যদি তারা তার ঠিকানার সন্ধান দিতে পারে, তার বাসস্থান সম্পর্কে যদি কিছু জানা যায়। কিন্তু প্রতিবারই তিনি ব্যর্থ হয়ে ঘরে ফিরেছেন বারবার। কেননা, হাওয়ার কোনো বাড়ি নেই, তাকে ছুঁতে পারলেও ধরে রাখা যায় না।

কবির কাছে মানুষের মনও হাওয়ারই প্রতিবিম্ব। হওয়ার যেমন কোনো বাসস্থান নেই মনেরও নেই। মনকেও জীবনের চরমতম দুঃখ প্রতিকুলতায় সময়িক ভাবে অনুভব করা গেলেও দীর্ঘক্ষণ তাকে বেঁধে রাখা যায় না। অথচ কবি তাকে বেঁধে রাখতে চান, মন যে আসলে কী তা তিনি ষড়রিপু দিয়ে প্রত্যক্ষ করতে চান। তাই তার মনও কাতর হয়ে চারিদিক ঘুরে বেড়ায়, যদি কারো কাছে কোথাও হাওয়া রূপ মনের বাড়ির সন্ধান পাওয়া যায়। আলোচ্য কবিতায় কবি সেই কথাকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন।


“সময় অন্তহীন অফুরান সন্ধান”- অফুরান সন্ধান বলতে কী বুঝিয়েছেন?

 

হাওয়ার গান কবিতায় বুদ্ধদেব বসু মনের আবাস্থলের সন্ধান করেছেন প্রতিনিয়ত। তার অনুভূতি সকলের যদি বাসস্থান থাকতে পারে তবে হাওয়া রূপ মনের নেই কেন? কেন তাদের কে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়? কবি এর উত্তরে বলেছেন, হাওয়া বা মন এমন একটি বিষয় যা ক্রমশ সঞ্চারিত হয়। হাওয়া যেমন এদেশ থেকে অন্য দেশে তেমনই মনও এক দেহ থেকে অন্য দেহে। কারন, মানুষ তার মনকে নিজের কাছে ধরে রাখতে চাইলেও মন চঞ্চল। চঞ্চলতাই তার ধর্ম। তাই তার স্থায়ী কোনো বাসস্থান নেই।

তবে এক সময় যখন চারিদিক শান্ত হয়ে আসে, সব কিছু থেমে যাওয়ার উপক্রম হয় তখনই মন তার বাসস্থানকে অনুভব করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর সেখানে থাকা হয়ে ওঠে না। মানুষের মৃত্যু ঘটলে সে আবার বিদেহী হয়ে পড়ে। চিরকাল এমন ভাবেই সে সঞ্চারিত হতে থাকে, নির্দিষ্ট ঠিকানা আর খুঁজে পাওয়া হয়ে ওঠে না।  অবশেষে তাদের শুধুই হন্যে হয়ে কেঁদে মরতে হয়। আর এই হাওয়া রূপ মনের আশ্রয়ের খোঁজ আজকের নয় চিরকালীন। কোনো সময় দিয়ে তাকে মাপা যায় না। হাওয়ার রূপ মনের তো মৃত্যু নেই তাই আজন্ম কাল সে সন্ধান করে বেড়ায়। সেকারনেই কবি বলেন হাওয়ার এই গান-“অফুরান সন্ধান”।


ত্যাগ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


 ত্যাগ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


প্রথম পরিচ্ছেদ

 

ফাল্গুনের প্রথম পূর্ণিমায় আম্রমুকুলের গন্ধ লইয়া নব বসন্তের বাতাস বহিতেছে। পুষ্করিণীতীরের একটি পুরাতন লিচু গাছের ঘন পল্লবের মধ্য হইতে একটি নিদ্রাহীন অশ্রান্ত পাপিয়ার গান মুখুজ্জেদের বাড়ির একটি নিদ্রাহীন শয়নগৃহের মধ্যে গিয়া প্রবেশ করিতেছে। হেমন্ত কিছু চঞ্চলভাবে কখনো তার স্ত্রীর একগুচ্ছ চুল খোঁপা হইতে বিশ্লিষ্ট করিয়া লইয়া আঙুলে জড়াইতেছে, কখনো তাহার বালাতে চুড়িতে সংঘাত করিয়া ঠুং ঠুং শব্দ করিতেছে, কখনো তাহার মাথার ফুলের মালাটা টানিয়া স্বস্থানচ্যুত করিয়া তাহার মুখের উপর আনিয়া ফেলিতেছে। সন্ধ্যাবেলাকার নিস্তব্ধ ফুলের গাছটিকে সচেতন করিয়া তুলিবার জন্য বাতাস যেমন একবার এ পাশ হইতে একবার ও পাশ হইতে একটু-আধটু নাড়াচাড়া করিতে থাকে, হেমন্তের কতকটা সেই ভাব।

কিন্তু কুসুম সম্মুখের চন্দ্রালোকপ্লাবিত অসীম শূন্যের মধ্যে দুই নেত্রকে নিমগ্ন করিয়া দিয়া স্থির হইয়া বসিয়া আছে। স্বামীর চাঞ্চল্য তাহাকে স্পর্শ করিয়া প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া যাইতেছে। অবশেষে হেমন্ত কিছু অধীরভাবে কুসুমের দুই হাত নাড়া দিয়া বলিল, “কুসুম, তুমি আছ কোথায়। তোমাকে যেন একটা মস্ত দূরবীন কষিয়া বিস্তর ঠাহর করিয়া বিন্দুমাত্র দেখা যাইবে, এমনি দূরে গিয়া পড়িয়াছ। আমার ইচ্ছা তুমি আজ একটু কাছাকাছি এসো। দেখো দেখি, কেমন চমৎকার রাত্রি।

কুসুম শূন্য হইতে মুখ ফিরাইয়া লইয়া স্বামীর মুখের দিকে রাখিয়া কহিল, “এই জ্যোৎস্নারাত্রি, এই বসন্তকাল, সমস্ত এই মুহূর্তে মিথ্যা হইয়া ভাঙিয়া যাইতে পারে এমন একটা মন্ত্র আমি জানি।

হেমন্ত বলিল, “যদি জান তো সেটা উচ্চারণ করিয়া কাজ নাই। বরং এমন যদি কোনো মন্ত্র জানা থাকে যাহাতে সপ্তাহের মধ্যে তিনটে চারটে রবিবার আসে কিংবা রাত্রিটা বিকাল পাঁচটা সাড়ে-পাঁচটা পর্যন্ত টিকিয়া যায় তো তাহা শুনিতে রাজি আছি। বলিয়া কুসুমকে আর-একটু টানিয়া লইতে চেষ্টা করিল। কুসুম সে আলিঙ্গনপাশে ধরা না দিয়া কহিল, “আমার মৃত্যুকালে তোমাকে যে কথাটা বলিব মনে করিয়াছিলাম, আজ তাহা বলিতে ইচ্ছা করিতেছে। আজ মনে হইতেছে, তুমি আমাকে যত শাস্তি দাও-না কেন, আমি বহন করিতে পারিব।

শাস্তি সম্বন্ধে জয়দেব হইতে শ্লোক আওড়াইয়া হেমন্ত একটা রসিকতা করিবার উদ্যোগ করিতেছিল। এমন সময়ে শোনা গেল একটা ক্রুদ্ধ চটিজুতার চটাচট্ শব্দ নিকটবতী হইতেছে। হেমন্তের পিতা হরিহর মুখুজ্জের পরিচিত পদশব্দ। হেমন্ত শশব্যস্ত হইয়া উঠিল।

হরিহর দ্বারের নিকটে আসিয়া ক্রুদ্ধ গর্জনে কহিল, “হেমন্ত, বউকে এখনি বাড়ি হইতে দূর করিয়া দাও।

হেমন্ত স্ত্রীর মুখের দিকে চাহিল; স্ত্রী কিছুই বিস্ময় প্রকাশ করিল না, কেবল দুই হাতের মধ্যে কাতরে মুখ লুকাইয়া আপনার সমস্ত বল এবং ইচ্ছা দিয়া আপনাকে যেন লুপ্ত করিয়া দিতে চেষ্টা করিল। দক্ষিণে বাতাসে পাপিয়ার স্বর ঘরে প্রবেশ করিতে লাগিল, কাহারও কানে গেল না। পৃথিবী এমন অসীম সুন্দর, অথচ এত সহজেই সমস্ত বিকল হইয়া যায়।

 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

 

হেমন্ত বাহির হইতে ফিরিয়া আসিয়া স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিল, “সত্য কি।

স্ত্রী কহিল, “সত্য।

এতদিন বল নাই কেন।

অনেকবার বলিতে চেষ্টা করিয়াছি, বলিতে পারি নাই। আমি বড়ো পাপিষ্ঠা।

তবে আজ সমস্ত খুলিয়া বলো।

 

কুসুম গম্ভীর দৃঢ় স্বরে সমস্ত বলিয়া গেল – যেন অটলচরণে ধীরগতিতে আগুনের মধ্যে দিয়া চলিয়া গেল, কতখানি দগ্ধ হইতেছিল কেহ বুঝিতে পারিল না। সমস্ত শুনিয়া হেমন্ত উঠিয়া গেল।

কুসুম বুঝিল, যে স্বামী চলিয়া গেল সে স্বামীকে আর ফিরিয়া পাইবে না। কিছু আশ্চর্য মনে হইল না; এ ঘটনাও যেন অন্যান্য দৈনিক ঘটনার মতো অত্যন্ত সহজভাবে উপস্থিত হইল, মনের মধ্যে এমন একটা শুষ্ক অসাড়তার সঞ্চার হইয়াছে। কেবল, পৃথিবীকে এবং ভালোবাসাকে আগাগোড়া মিথ্যা এবং শূন্য বলিয়া মনে হইল। এমন-কি, হেমন্তের সমস্ত অতীত ভালোবাসার কথা স্মরণ করিয়া অত্যন্ত নীরস কঠিন নিরানন্দ হাসি একটা খরধার নিষ্ঠুর ছুরির মতো তাহার মনের এক ধার হইতে আর-এক ধার পর্যন্ত একটি দাগ রাখিয়া দিয়া গেল। বোধ করি সে ভাবিল, যে ভালোবাসাকে এতখানি বলিয়া মনে হয়, এত আদর, এত গাঢ়তা – যাহার তিলমাত্র বিচ্ছেদ এমন মর্মান্তিক, যাহার মুহূর্তমাত্র মিলন এমন নিবিড়ানন্দময়, যাহাকে অসীম অনন্ত বলিয়া মনে হয়, জন্মজন্মান্তরেও যাহার অবসান কল্পনা করা যায় না – সেই ভালোবাসা এই! এইটুকুর উপর নির্ভর! সমাজ যেমনি একটু আঘাত করিল অমনি অসীম ভালোবাসা চূর্ণ হইয়া একমুষ্টি ধূলি হইয়া গেল! হেমন্ত কম্পিতস্বরে এই কিছু পূর্বে কানের কাছে বলিতেছিল, “চমৎকার রাত্রি!” সে রাত্রি তো এখনো শেষ হয় নাই ; এখনো সেই পাপিয়া ডাকিতেছে, দক্ষিণে বাতাস মশারি কাঁপাইয়া যাইতেছে, এবং জ্যোৎস্না সুখশ্রান্ত সুপ্ত সুন্দরীর মতো বাতায়নবর্তী পালঙ্কের এক প্রান্তে নিলীন হইয়া পড়িয়া আছে। সমস্তই মিথ্যা। ‘ভালোবাসা আমার অপেক্ষাও মিথ্যাবাদিনী, মিথ্যাচারিণী।

 

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

 

পরদিন প্রভাতেই অনিদ্রাশুষ্ক হেমন্ত পাগলের মতো হইয়া প্যারিশংকর ঘোষালের বাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইল। প্যারিশংকর জিজ্ঞাসা করিল, “কী হে বাপু, কী খবর।

হেমন্ত মস্ত একটা আগুনের মতো যেন দাউদাউ করিয়া জ্বলিতে জ্বলিতে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল, “তুমি আমাদের জাতি নষ্ট করিয়াছ, সর্বনাশ করিয়াছ – তোমাকে ইহার শাস্তি ভোগ করিতে হইবে – বলিতে বলিতে তাহার কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসিল।

প্যারিশংকর ঈষৎ হাসিয়া কহিল, “আর, তোমরা আমার জাতি রক্ষা করিয়াছ, আমার সমাজ রক্ষা করিয়াছ, আমার পিঠে হাত বুলাইয়া দিয়াছ! আমার প্রতি তোমাদের বড়ো যত্ন, বড়ো ভালোবাসা!”

হেমন্তের ইচ্ছা হইল সেই মুহূর্তেই প্যারিশংকরকে ব্রহ্মতেজে ভস্ম করিয়া দিতে, কিন্তু সেই তেজে সে নিজেই জ্বলিতে লাগিল, প্যারিশংকর দিব্য সুস্থ নিরাময় ভাবে বসিয়া রহিল।

হেমন্ত ভগ্নকণ্ঠে বলিল, “আমি তোমার কী করিয়াছিলাম।

প্যারিশংকর কহিল, “আমি জিজ্ঞাসা করি আমার একটিমাত্র কন্যা ছাড়া আর সন্তান নাই, আমার সেই কন্যা তোমার বাপের কাছে কী অপরাধ করিয়াছিল। তুমি তখন ছোটো ছিলে, তুমি হয়তো জান না – ঘটনাটা তবে মন দিয়া শোনো। ব্যস্ত হইয়ো না বাপু, ইহার মধ্যে অনেক কৌতুক আছে।

আমার জামাতা নবকান্ত আমার কন্যার গহনা চুরি করিয়া যখন পলাইয়া বিলাতে গেল, তখন তুমি শিশু ছিলে। তাহার পর পাঁচ বৎসর বাদে সে যখন বারিস্টার হইয়া দেশে ফিরিয়া আসিল তখন পাড়ায় যে একটা গোলমাল বাধিল তোমার বোধ করি কিছু কিছু মনে থাকিতে পারে। কিংবা তুমি না জানিতেও পার, তুমি তখন কলিকাতার স্কুলে পড়িতে। তোমার বাপ গ্রামের দলপতি হইয়া বলিলেন, ‘মেয়েকে যদি স্বামীগৃহে পাঠানো অভিপ্রায় থাকে তবে সে মেয়েকে আর ঘরে লইতে পারিবে না। আমি তাঁহাকে হাতে পায়ে ধরিয়া বলিলাম, ‘দাদা, এ যাত্রা তুমি আমাকে ক্ষমা করো। আমি ছেলেটিকে গোবর খাওয়াইয়া প্রায়শ্চিত্ত করাইতেছি, তোমরা তাহাকে জাতে তুলিয়া লও। তোমার বাপ কিছুতেই রাজি হইলেন না, আমিও আমার একমাত্র মেয়েকে ত্যাগ করিতে পারিলাম না। জাত ছাড়িয়া, দেশ ছাড়িয়া, কলিকাতায় আসিয়া ঘর করিলাম। এখানে আসিয়াও আপদ মিটিল না। আমার ভ্রাতুষ্পুত্রের যখন বিবাহের সমস্ত আয়োজন করিয়াছি, তোমার বাপ কন্যাকর্তাদের উত্তেজিত করিয়া সে বিবাহ ভাঙিয়া দিলেন। আমি প্রতিজ্ঞা করিলাম, যদি ইহার প্রতিশোধ না লই তবে আমি ব্রাহ্মণের ছেলে নহি। – এইবার কতকটা বুঝিতে পারিয়াছ – কিন্তু আর-একটু সবুর করো – সমস্ত ঘটনাটি শুনিলে খুশি হইবে – ইহার মধ্যে একটু রস আছে।

তুমি যখন কালেজে পড়িতে তোমার বাসার পাশেই বিপ্রদাস চাটুজ্জের বাড়ি ছিল। বেচারা এখন মারা গিয়াছে। চাটুজ্জেমহাশয়ের বাড়িতে কুসুম নামে একটি শৈশববিধবা অনাথা কায়স্থকন্যা আশ্রিতভাবে থাকিত। মেয়েটি বড়ো সুন্দরী – বুড়ো ব্রাহ্মণ কালেজের ছেলেদের দৃষ্টিপথ হইতে তাহাকে সংবরণ করিয়া রাখিবার জন্য কিছু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছিল। কিন্তু, বুড়োমানুষকে ফাঁকি দেওয়া একটি মেয়ের পক্ষে কিছুই শক্ত নহে। মেয়েটি প্রায়ই কাপড় শুকাইতে দিতে ছাতে উঠিত এবং তোমারও বোধ করি ছাতে না উঠিলে পড়া মুখস্থ হইত না। পরস্পরের ছাত হইতে তোমাদের কোনোরূপ কথাবার্তা হইত কি না সে তোমরাই জান, কিন্তু মেয়েটির ভাব-গতিক দেখিয়া বুড়ার মনেও সন্দেহ হইল। কারণ কাজকর্মে তাহার ক্রমিক ভুল হইতে দেখা গেল এবং তপস্বিনী গৌরীর মতো দিন দিন সে আহারনিদ্রা ত্যাগ করিতে লাগিল। এক-একদিন সন্ধ্যাবেলায় সে বুড়ার সম্মুখেই অকারণে অশ্রু সংবরণ করিতে পারিত না।

অবশেষে বুড়া আবিষ্কার করিল, ছাতে তোমাদের মধ্যে সময়ে অসময়ে নীরব দেখাসাক্ষাৎ চলিয়া থাকে – এমন কি, কালেজ কামাই করিয়াও মধ্যাহ্নে চিলের ঘরের ছায়ায় ছাতের কোণে তুমি বই হাতে করিয়া বসিয়া থাকিতে; নির্জন অধ্যয়নে সহসা তোমার এত উৎসাহ জন্মিয়াছিল। বিপ্রদাস যখন আমার কাছে পরামর্শ জানিতে আসিল আমি কহিলাম, ‘খুড়ো, তুমি তো অনেক দিন হইতে কাশী যাইবার মানস করিয়াছ – মেয়েটিকে আমার কাছে রাখিয়া তীর্থবাস করিতে যাও, আমি তাহার ভার লইতেছি।

বিপ্রদাস তীর্থে গেল। আমি মেয়েটিকে শ্রীপতি চাটুজ্জের বাসায় রাখিয়া তাহাকেই মেয়ের বাপ বলিয়া চালাইলাম। তাহার পর যাহা হইল তোমার জানা আছে। তোমার কাছে আগাগোড়া সব কথা খোলসা করিয়া বলিয়া বড়ো আনন্দ লাভ করিলাম। এ যেন একটি গল্পের মতো। ইচ্ছা আছে, সমস্ত লিখিয়া একটি বই করিয়া ছাপাইব। আমার লেখা আসে না। আমার ভাইপোটা শুনিতেছি একটু-আধটু লেখে – তাহাকে দিয়া লেখাইবার মানস আছে। কিন্তু, তোমাতে তাহাতে মিলিয়া লিখিলে সব চেয়ে ভালো হয়, কারণ গল্পের উপসংহারটি আমার ভালো করিয়া জানা নাই।

হেমন্ত প্যারিশংকরের এই শেষ কথাগুলিতে বড়ো-একটা কান না দিয়া কহিল, “কুসুম এই বিবাহে কোনো আপত্তি করে নাই ?”

প্যারিশংকর কহিল, “আপত্তি ছিল কি না বোঝা ভারি শক্ত। জান তো বাপু, মেয়েমানুষের মন-যখন ‘না বলে তখন ‘হাঁ বুঝিতে হয়। প্রথমে তো দিনকতক নূতন বাড়িতে আসিয়া তোমাকে না দেখিতে পাইয়া কেমন পাগলের মতো হইয়া গেল। তুমিও দেখিলাম, কোথা হইতে সন্ধান পাইয়াছ ; প্রায়ই বই হাতে করিয়া কালেজে যাত্রা করিয়া তোমার পথ ভুল হইত – এবং শ্রীপতির বাসার সম্মুখে আসিয়া কী যেন খুঁজিয়া বেড়াইতে ; ঠিক যে প্রেসিডেন্সি কালেজের রাস্তা খুঁজিতে তাহা বোধ হইত না, কারণ, ভদ্রলোকের বাড়ির জানালার ভিতর দিয়া কেবল পতঙ্গ এবং উন্মাদ যুবকদের হৃদয়ের পথ ছিল মাত্র। দেখিয়া শুনিয়া আমার বড়ো দুঃখ হইল। দেখিলাম, তোমার পড়ার বড়োই ব্যাঘাত হইতেছে এবং মেয়েটির অবস্থাও সংকটাপন্ন।

একদিন কুসুমকে ডাকিয়া লইয়া কহিলাম, ‘বাছা, আমি বুড়ামানুষ, আমার কাছে লজ্জা করিবার আবশ্যক নাই – তুমি যাহাকে মনে মনে প্রার্থনা কর আমি জানি। ছেলেটিও মাটি হইবার জো হইয়াছে। আমার ইচ্ছা, তোমাদের মিলন হয়। শুনিবামাত্র কুসুম একেবারে বুক ফাটিয়া কাঁদিয়া উঠিল এবং ছুটিয়া পালাইয়া গেল। এমনি করিয়া প্রায় মাঝে মাঝে সন্ধ্যাবেলায় শ্রীপতির বাড়ি গিয়া কুসুমকে ডাকিয়া, তোমার কথা পাড়িয়া, ক্রমে তাহার লজ্জা ভাঙিলাম। অবশেষে প্রতিদিন ক্রমিক আলোচনা করিয়া তাহাকে বুঝাইলাম যে, বিবাহ ব্যতীত পথ দেখি না। তাহা ছাড়া মিলনের আর-কোনো উপায় নাই। কুসুম কহিল, কেমন করিয়া হইবে। আমি কহিলাম, ‘তোমাকে কুলীনের মেয়ে বলিয়া চালাইয়া দিব। অনেক তর্কের পর সে এ বিষয়ে তোমার মত জানিতে কহিল। আমি কহিলাম, ছেলেটা একে খেপিয়া যাইবার জো হইয়াছে, তাহাকে আবার এ-সকল গোলমালের কথা বলিবার আবশ্যক কী। কাজটা বেশ নিরাপত্তে নিশ্চিন্তে নিষ্পন্ন হইয়া গেলেই সকল দিকে সুখের হইবে। বিশেষত, এ কথা যখন কখনো প্রকাশ হইবার কোনো সম্ভাবনা নাই তখন বেচারাকে কেন গায়ে পড়িয়া চিরজীবনের মতো অসুখী করা।

কুসুম বুঝিল কি বুঝিল না, আমি বুঝিতে পারিলাম না। কখনো কাঁদে, কখনো চুপ করিয়া থাকে। অবশেষে আমি যখন বলি ‘তবে কাজ নাই তখন আবার সে অস্থির হইয়া উঠে। এইরূপ অবস্থায় শ্রীপতিকে দিয়া তোমাকে বিবাহের প্রস্তাব পাঠাই। দেখিলাম, সম্মতি দিতে তোমার তিলমাত্র বিলম্ব হইল না। তখন বিবাহের সমস্ত ঠিক হইল।

 

বিবাহের অনতিপূর্বে কুসুম এমনি বাঁকিয়া দাঁড়াইল, তাহাকে আর কিছুতেই বাগাইতে পারি না। সে আমার হাতে পায়ে ধরে ; বলে, ‘ইহাতে কাজ নাই, জ্যাঠামশায়। আমি বলিলাম, ‘কী সর্বনাশ। সমস্ত স্থির হইয়া গেছে, এখন কী বলিয়া ফিরাইব। কুসুম বলে, ‘তুমি রাষ্ট্র করিয়া দাও আমার হঠাৎ মৃত্যু হইয়াছে-আমাকে এখান হইতে কোথাও পাঠাইয়া দাও। আমি বলিলাম, ‘তাহা হইলে ছেলেটির দশা কী হইবে। তাহার বহুদিনের আশা কাল পূর্ণ হইবে বলিয়া সে স্বর্গে চড়িয়া বসিয়াছে, আজ আমি হঠাৎ তাহাকে তোমার মৃত্যুসংবাদ পাঠাইব! আবার তাহার পর দিন তোমাকে তাহার মৃত্যুসংবাদ পাঠাইতে হইবে, এবং সেইদিন সন্ধ্যাবেলায় আমার কাছে তোমার মৃত্যুসংবাদ আসিবে। আমি কি এই বুড়াবয়সে স্ত্রীহত্যা ব্রহ্মহত্যা করিতে বসিয়াছি।

তাহার পর শুভলগ্নে শুভ বিবাহ সম্পন্ন হইল-আমি আমার একটা কর্তব্যদায় হইতে অব্যাহতি পাইয়া বাঁচিলাম। তাহার পর কী হইল তুমি জান।

হেমন্ত কহিল, “আমাদের যাহা করিবার তাহা তো করিলেন, আবার কথাটা প্রকাশ করিলেন কেন।

প্যারিশংকর কহিলেন, “দেখিলাম, তোমার ছোটো ভগ্নীর বিবাহের সমস্ত স্থির হইয়া গেছে। তখন মনে মনে ভাবিলাম, একটা ব্রাহ্মণের জাত মারিয়াছি, কিন্তু সে কেবল কর্তব্যবোধে। আবার আর-একটা ব্রাহ্মণের জাত মারা পড়ে, আমার কর্তব্য এটা নিবারণ করা। তাই তাহাদের চিঠি লিখিয়া দিলাম, বলিলাম, হেমন্ত যে শূদ্রের কন্যা বিবাহ করিয়াছে তাহার প্রমাণ আছে।

হেমন্ত বহুকষ্টে ধৈর্য সংবরণ করিয়া কহিল, “এই-যে মেয়েটিকে আমি পরিত্যাগ করিব, ইহার দশা কী হইবে। আপনি ইহাকে আশ্রয় দিবেন ?”

প্যারিশংকর কহিলেন, “আমার যাহা কাজ তাহা আমি করিয়াছি, এখন পরের পরিত্যক্ত স্ত্রীকে পোষণ করা আমার কর্ম নহে।- ওরে, হেমন্তবাবুর জন্য বরফ দিয়া একগ্লাস ডাবের জল লইয়া আয়, আর পান আনিস।

হেমন্ত এই সুশীতল আতিথ্যের জন্য অপেক্ষা না করিয়া চলিয়া গেল।

 

 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

 

কৃষ্ণপরে পঞ্চমী। অন্ধকার রাত্রি। পাখি ডাকিতেছে না। পুষ্করিণীর ধারের লিচু গাছটি কালো চিত্রপটের উপর গাঢ়তর দাগের মতো লেপিয়া গেছে। কেবল দক্ষিণের বাতাস এই অন্ধকারে অন্ধভাবে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, যেন তাহাকে নিশিতে পাইয়াছে। আর আকাশের তারা নির্নিমেষ সতর্ক নেত্রে প্রাণপণে অন্ধকার ভেদ করিয়া কী-একটা রহস্য আবিষ্কার করিতে প্রবৃত্ত আছে।

শয়নগৃহে দীপ জ্বালা নাই। হেমন্ত বাতায়নের কাছে খাটের উপরে বসিয়া সম্মুখের অন্ধকারের দিকে চাহিয়া আছে। কুসুম ভূমিতলে দুই হাতে তাহার পা জড়াইয়া পায়ের উপর মুখ রাখিয়া পড়িয়া আছে। সময় যেন স্তম্ভিত সমুদ্রের মতো স্থির হইয়া আছে। যেন অনন্তনিশীথিনীর উপর অদৃষ্ট চিত্রকর এই একটি চিরস্থায়ী ছবি আঁকিয়া রাখিয়াছে – চারি দিকে প্রলয়, মাঝখানে একটি বিচারক এবং তাহার পায়ের কাছে একটি অপরাধিনী।

আবার চটিজুতার শব্দ হইল। হরিহর মুখুজ্জে দ্বারের কাছে আসিয়া বলিলেন, “অনেকক্ষণ হইয়া গিয়াছে, আর সময় দিতে পারি না। মেয়েটাকে ঘর হইতে দূর করিয়া দাও।

কুসুম এই স্বর শুনিবামাত্র একবার মুহূর্তের মতো চিরজীবনের সাধ মিটাইয়া হেমন্তের দুই পা দ্বিগুণতর আবেগে চাপিয়া ধরিল, চরণ চুম্বন করিয়া পায়ের ধুলা মাথায় লইয়া পা ছাড়িয়া দিল।

হেমন্ত উঠিয়া গিয়া পিতাকে বলিল, “আমি স্ত্রীকে ত্যাগ করিব না।

হরিহর গর্জিয়া উঠিয়া কহিল, “জাত খোয়াইবি ?”

হেমন্ত কহিল, “আমি জাত মানি না।

তবে তুইসুদ্ধ দূর হইয়া যা।

 

(বৈশাখ, ১২৯৯)