চোখের-বালি (11 - 20)


১১

আশার পক্ষে সঙ্গিনীর বড়ো দরকার হইয়াছিল। ভালোবাসার উৎসবও কেবলমাত্র দুটি লোকের দ্বারা সম্পন্ন হয় না–সুখালাপের মিষ্টান্ন বিতরণের জন্য বাজে লোকের দরকার হয়।
ক্ষুধিতহৃদয়া বিনোদিনীও নববধূর নবপ্রেমের ইতিহাস মাতালের জ্বালাময় মদের মতো কান পাতিয়া পান করিতে লাগিল। তাহার মস্তিষ্ক মাতিয়া শরীরের রক্ত জ্বলিয়া উঠিল।
নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে মা যখন ঘুমাইতেছেন, দাসদাসীরা একতলার বিশ্রামশালায় অদৃশ্য, মহেন্দ্র বিহারীর তাড়নায় ক্ষণকালের জন্য কলেজে গেছে এবং রৌদ্রতপ্ত নীলিমার শেষ প্রান্ত হইতে চিলের তীব্র কণ্ঠ অতিক্ষীণ স্বরে কদাচিৎ শুনা যাইতেছে, তখন নির্জন শয়নগৃহে নীচের বিছানায় বালিশের উপর আশা তাহার খোলা চুল ছড়াইয়া শুইত এবং বিনোদিনী বুকের নীচে বালিশ টানিয়া উপুড় হইয়া শুইয়া গুনগুন-গুঞ্জরিত কাহিনীর মধ্যে আবিষ্ট হইয়া রহিত, তাহার কর্ণমূল আরক্ত হইয়া উঠিত, নিশ্বাস বেগে প্রবাহিত হইতে থাকিত।




বিনোদিনী প্রশ্নকরিয়া করিয়া তুচ্ছতম কথাটি পর্যন্ত বাহির করিত, এক কথা বার বার করিয়া শুনিত, ঘটনা নিঃশেষ হইয়া গেলে কল্পনার অবতারণা করিত–কহিত, “আচ্ছা ভাই, যদি এমন হইত তো কী হইত, যদি অমন হইত তো কী করিতে।” সেই-সকল অসম্ভাবিত কল্পনার পথে সুখালোচনাকে সুদীর্ঘ করিয়া টানিয়া লইয়া চলিতে আশারও ভালো লাগিত।
বিনোদিনী কহিত, “আচ্ছা ভাই চোখের বালি, তোর সঙ্গে যদি বিহারীবাবুর বিবাহ হইত।”
আশা। না ভাই, ও কথা তুমি বলিয়ো না–ছি ছি, আমার বড়ো লজ্জা করে। কিন্তু তোমার সঙ্গে হইলে বেশ হইত, তোমার সঙ্গেও তো কথা হইয়াছিল।
বিনোদিনী। আমার সঙ্গে তো ঢের লোকের ঢের কথা হইয়াছিল। না হইয়াছে, বেশ হইয়াছে–আমি যা আছি, বেশ আছি।




আশা তাহার প্রতিবাদ করে। বিনোদিনীর অবস্থা যে তাহার অবস্থার চেয়ে ভালো, এ কথা সে কেমন করিয়া স্বীকার করিবে। “একবার মনে করিয়া দেখো দেখি ভাই বালি, যদি আমার স্বামীর সঙ্গে তোমার বিবাহ হইয়া যাইত। আর একটু হলেই তো হইত।”
তা তো হইতই। না হইল কেন। আশার এই বিছানা, এই খাট তো একদিন তাহারই জন্য অপেক্ষা করিয়া ছিল। বিনোদিনী এই সুসজ্জিত শয়নঘরের দিকে চায়, আর সে কথা কিছুতেই ভুলিতে পারে না। এ ঘরে আজ সে অতিথিমাত্র–আজ স্থান পাইয়াছে, কাল আবার উঠিয়া যাইতে হইবে।




অপরাহ্নে বিনোদিনী নিজে উদ্‌যোগী হইয়া অপরূপ নৈপুণ্যের সহিত আশার চুল বাঁধিয়া সাজাইয়া তাহাকে স্বামীসম্মিলনে পাঠাইয়া দিত। তাহার কল্পনা যেন অবগুণ্ঠিতা হইয়া এই সজ্জিতা বধূর পশ্চাৎ পশ্চাৎ মুগ্ধ যুবকের অভিসারে জনহীন কক্ষে গমন করিত। আবার এক-এক দিন কিছুতেই আশাকে ছাড়িয়া দিত না। বলিত, “আঃ, আর-একটু বসোই-না। তোমার স্বামী তো পালাইতেছেন না। তিনি তো বনের মায়ামৃগ নন, তিনি অঞ্চলের পোষা হরিণ।” এই বলিয়া নানা ছলে ধরিয়া রাখিয়া দেরি করাইবার চেষ্টা করিত।
মহেন্দ্র অত্যন্ত রাগ করিয়া বলিত, “তোমার সখী যে নড়িবার নাম করেন না–তিনি বাড়ি ফিরিবেন কবে।”
আশা ব্যগ্র হইয়া বলিত, “না, তুমি আমার চোখের বালির উপর রাগ করিয়ো না। তুমি জান না, সে তোমার কথা শুনিতে কত ভালোবাসে–কত যত্ন করিয়া সাজাইয়া আমাকে তোমার কাছে পাঠাইয়া দেয়।”
রাজলক্ষ্মী আশাকে কাজ করিতে দিতেন না। বিনোদিনী বধূর পক্ষ লইয়া তাহাকে কাজে প্রবৃত্ত করাইল। প্রায় সমস্ত দিনই বিনোদিনীর কাজে আলস্য নাই, সেই সঙ্গে আশাকেও সে আর ছুটি দিতে চায় না। বিনোদিনী পরে-পরে এমনি কাজের শৃঙ্খল বানাইতেছিল যে, তাহার মধ্যে ফাঁক পাওয়া আশার পক্ষে ভারি কঠিন হইয়া উঠিল। আশার স্বামী ছাদের উপরকার শূন্য ঘরের কোণে বসিয়া আক্রোশে ছটফট করিতেছে, ইহা কল্পনা করিয়া বিনোদিনী মনে মনে তীব্র কঠিন হাসি হাসিত। আশা উদ্বিগ্ন হইয়া বলিত, “এবার যাই ভাই চোখের বালি, তিনি আবার রাগ করিবেন।”




বিনোদিনী তাড়াতাড়ি বলিত, “রোসো, এইটুকু শেষ করিয়া যাও। আর বেশি দেরি হইবে না।”
খানিক বাদে আশা আবার ছটফট করিয়া বলিয়া উঠিত, “না ভাই, এবার তিনি সত্যসত্যই রাগ করিবেন-আমাকে ছাড়ো, আমি যাই।”
বিনোদিনী বলিত, “আহা, একটু রাগ করিলই বা। সোহাগের সঙ্গে রাগ না মিশিলে ভালোবাসার স্বাদ থাকে না–তরকারিতে লঙ্কামরিচের মতো।”
কিন্তু লঙ্কামরিচের স্বাদটা যে কী, তাহা বিনোদিনীই বুঝিতেছিল–কেবল সঙ্গে তাহার তরকারি ছিল না। তাহার শিরায় শিরায় যেন আগুন ধরিয়া গেল। সে যে দিকে চায়, তাহার চোখে যেন স্ফুলিঙ্গবর্ষণ হইতে থাকে। “এমন সুখের ঘরকন্না–এমন সোহাগের স্বামী। এ ঘরকে যে আমি রাজার রাজত্ব, এ স্বামীকে যে আমি পায়ের দাস করিয়া রাখিতে পারিতাম। তখন কি এ ঘরের এই দশা, এ মানুষের এই ছিরি থাকিত। আমার জায়গায় কিনা এই কচি খুকি, এই খেলার পুতুল!” (আশার গলা জড়াইয়া) “ভাই চোখের বালি, বলো-না ভাই, কাল তোমাদের কী কথা হইল ভাই। আমি তোমাকে যাহা শিখাইয়া দিয়াছিলাম তাহা বলিয়াছিলে? তোমাদের ভালোবাসার কথা শুনিলে আমার ক্ষুধাতৃষ্ণা থাকে না ভাই।”









১২

মহেন্দ্র একদিন বিরক্ত হইয়া তাহার মাকে ডাকিয়া কহিল, “এ কি ভালো হইতেছে? পরের ঘরের যুবতী বিধবাকে আনিয়া একটা দায় ঘাড়ে করিবার দরকার কী। আমার তো ইহাতে মত নাই–কী জানি কখন কী সংকট ঘটিতে পারে।”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “ও যে আমাদের বিপিনের বউ, উহাকে আমি তো পর মনে করি না।”
মহেন্দ্র কহিল, “না মা, ভালো হইতেছে না। আমার মতে উঁহাকে রাখা উচিত হয় না।”
রাজলক্ষ্মী বেশ জানিতেন, মহেন্দ্রের মত অগ্রাহ্য করা সহজ নহে। তিনি বিহারীকে ডাকিয়া কহিলেন, “ও বেহারি, তুই একবার মহিনকে বুঝাইয়া বল্‌। বিপিনের বউ আছে বলিয়াই এই বৃদ্ধবয়সে আমি একটু বিশ্রাম করিতে পাই। পর হউক, যা হউক, আপন লোকের কাছ হইতে এমন সেবা তো কখনো পাই নাই।”


বিহারী রাজলক্ষ্মীকে কোনো উত্তর না করিয়া মহেন্দ্রের কাছে গেল–কহিল, “মহিনদা, বিনোদিনীর কথা কিছু ভাবিতেছে?”

মহেন্দ্র হাসিয়া কহিল, “ভাবিয়া রাত্রে ঘুম হয় না। তোমার বোঠানকে জিজ্ঞাসা করো না, আজকাল বিনোদিনীর ধ্যানে আমার আর-সকল ধ্যানই ভঙ্গ হইয়াছে।”
আশা ঘোমটার ভিতর হইতে মহেন্দ্রকে নীরবে তর্জন করিল।
বিহারী কহিল, “বল কী। দ্বিতীয় বিষবৃক্ষ!”
মহেন্দ্র। ঠিক তাই। এখন উহাকে বিদায় করিবার জন্য চুনি ছটফট করিতেছে।
ঘোমটার ভিতর হইতে আশার দুই চক্ষু আবার ভর্ৎসনা বর্ষণ করিল।




বিহারী কহিল, “বিদায় করিলেও ফিরিতে কতক্ষণ। বিধবার বিবাহ দিয়া দাও–বিষদাঁত একেবারে
ভাঙিবে।”
মহেন্দ্র। কুন্দরও তো বিবাহ দেওয়া হইয়াছিল।
বিহারী কহিল, “থাক্‌, ও উপমাটা এখন রাখো। বিনোদিনীর কথা আমি মাঝে মাঝে ভাবি। তোমার এখানে উনি তো চিরদিন থাকিতে পারেন না। তাহার পরে, যে বন দেখিয়া আসিয়াছি সেখানে উঁহাকে যাবজ্জীবন বনবাসে পাঠানো, সেও বড়ো কঠিন দণ্ড।”
মহেন্দ্রের সম্মুখে এ পর্যন্ত বিনোদিনী বাহির হয় নাই, কিন্তু বিহারী তাহাকে দেখিয়াছে। বিহারী এটুকু বুঝিয়াছে, এ নারী জঙ্গলে ফেলিয়া রাখিবার নহে। কিন্তু শিখা এক ভাবে ঘরের প্রদীপরূপে জ্বলে, আর-এক ভাবে ঘরে আগুন ধরাইয়া দেয়–সে আশঙ্কাও বিহারীর মনে ছিল।




মহেন্দ্র বিহারীকে এই কথা লইয়া অনেক পরিহাস করিল। বিহারীও তাহার জবাব দিল। কিন্তু তাহার মন বুঝিয়াছিল, এ নারী খেলা করিবার নহে, ইহাকে উপেক্ষা করাও যায় না।
রাজলক্ষ্মী বিনোদিনীকে সাবধান করিয়া দিলেন। কহিলেন, “দেখো বাছা, বউকে লইয়া তুমি অত টানাটানি করিয়ো না। তুমি পাড়াগাঁয়ের গৃহস্থ-ঘরে ছিলে–আজকালকার চালচলন জান না। তুমি বুদ্ধিমতী, ভালো করিয়া বুঝিয়া চলিয়ো।”-
ইহার পর বিনোদিনী অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্বক আশাকে দূরে দূরে রাখিল। কহিল, “আমি ভাই কে। আমার মতো অবস্থার লোক আপন মান বাঁচাইয়া চলিতে না জানিলে, কোন্‌ দিন কী ঘটে বলা যায় কি।”
আশা সাধাসাধি কান্নাকাটি করিয়া মরে–বিনোদিনী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মনের কথায় আশা আকণ্ঠ পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল, কিন্তু বিনোদিনী আমল দিল না।
এ দিকে মহেন্দ্রের বাহুপাশ শিথিল এবং তাহার মুগ্ধদৃষ্টি যেন ক্লান্তিতে আবৃত হইয়া আসিয়াছে। পূর্বে যেসেকল অনিয়ম-উচ্ছৃঙ্খলা তাহার কাছে কৌতুকজনক বোধ হইত, এখন তাহা অল্পে অল্পে তাহাকে পীড়ন করিতে আরম্ভ করিয়াছে। আশার সাংসারিক অপটুতায় সে ক্ষণে ক্ষণে বিরক্ত হয়, কিন্তু প্রকাশ করিয়া বলে না। প্রকাশ না করিলেও আশা অন্তরে অন্তরে অনুভব করিয়াছে, নিরবচ্ছিন্ন মিলনে প্রেমের মর্যাদা মলান হইয়া যাইতেছে। মহেন্দ্রের সোহাগের মধ্যে বেসুর লাগিতেছিল–কতকটা মিথ্যা বাড়াবাড়ি, কতকটা আত্মপ্রতারণা।
এ সময়ে পলায়ন ছাড়া পরিত্রাণ নাই, বিচ্ছেদ ছাড়া ঔষধ নাই। স্ত্রীলোকের স্বভাবসিদ্ধ সংস্কারবশে আশা আজকাল মহেন্দ্রকে ফেলিয়া যাইবার চেষ্টা করিত। কিন্তু বিনোদিনী ছাড়া তাহার যাইবার স্থান কোথায়।




মহেন্দ্র প্রণয়ের উত্তপ্ত বাসরশয্যার মধ্যে চক্ষু উন্মীলন করিয়া ধীরে ধীরে সংসারের কাজকর্ম, পড়াশুনার প্রতি একটু সজাগ হইয়া পাশ ফিরিল। ডাক্তারি বইগুলাকে নানা অসম্ভব স্থান হইতে উদ্ধার করিয়া ধুলা ঝাড়িতে লাগিল এবং চাপকান-প্যাণ্টলুন কয়টা রৌদ্রে দিবার উপক্রম করিল।







১৩

বিনোদিনী যখন নিতান্তই ধরা দিল না তখন আশার মাথায় একটা ফন্দি আসিল। সে বিনোদিনীকে কহিল, “ভাই বালি, তুমি আমার স্বামীর সম্মুখে বাহির হও না কেন। পলাইয়া বেড়াও কী জন্য।”
বিনোদিনী অতি সংক্ষেপে এবং সতেজে উত্তর করিল, “ছি ছি।”
আশা কহিল, “কেন। মার কাছে শুনিয়াছি, তুমি তো আমাদের পর নও।”
বিনোদিনী গম্ভীরমুখে কহিল, “সংসারে আপন-পর কেহই নাই। যে আপন মনে করে সেই আপন–যে পর বলিয়া জানে, সে আপন হইলেও পর।”
আশা মনে মনে ভাবিল, এ কথার আর উত্তর নাই। বাস্তবিকই তাহার স্বামী বিনোদিনীর প্রতি অন্যায় করেন, বাস্তবিকই তাহাকে পর ভাবেন এবং তাহার প্রতি অকারণে বিরক্ত হন।


সেদিন সন্ধ্যাবেলায় আশা স্বামীকে অত্যন্ত আবদার করিয়া ধরিল, “আমার চোখের বালির সঙ্গে তোমাকে আলাপ করিতে হইবে।”

মহেন্দ্র হাসিয়া কহিল, “তোমার সাহস তো কম নয়।”
আশা জিজ্ঞাসা করিল, “কেন, ভয় কিসের।”
মহেন্দ্র। তোমার সখীর যেরকম রূপের বর্ণনা কর, সে তো বড়ো নিরাপদ জায়গা নয়!
আশা কহিল, “আচ্ছা, সে আমি সামলাইতে পারিব। তুমি ঠাট্টা রাখিয়া দাও–তার সঙ্গে আলাপ করিবে কি না বলো।”
বিনোদিনীকে দেখিবে বলিয়া মহেন্দ্রের যে কৌতূহল ছিল না, তাহা নহে। এমনকি, আজকাল তাহাকে দেখিবার জন্য মাঝে মাঝে আগ্রহও জন্মে। সেই অনাবশ্যক আগ্রহটা তাহার নিজের কাছে উচিত বলিয়া ঠেকে নাই।




হৃদয়ের সম্পর্ক সম্বন্ধে মহেন্দ্রের উচিত-অনুচিতের আদর্শ সাধারণের অপেক্ষা কিছু কড়া। পাছে মাতার অধিকার লেশমাত্র ক্ষুণ্ন হয়, এইজন্য ইতিপূর্বে সে বিবাহের প্রসঙ্গমাত্র কানে আনিত না। আজকাল, আশার সহিত সম্বন্ধকে সে এমনভাবে রক্ষা করিতে চায় যে, অন্য স্ত্রীলোকের প্রতি সামান্য কৌতূহলকেও সে মনে স্থান দিতে চায় না। প্রেমের বিষয়ে সে যে বড়ো খুঁতখুঁতে এবং অত্যন্ত খাঁটি, এই লইয়া তাহার মনে একটা গর্ব ছিল। এমন কি, বিহারীকে সে বন্ধু বলিত বলিয়া অন্য কাহাকেও বন্ধু বলিয়া স্বীকার করিতেই চাহিত না। অন্য কেহ যদি তাহার নিকট আকৃষ্ট হইয়া আসিত, তবে মহেন্দ্র যেন তাহাকে গায়ে পড়িয়া উপেক্ষা দেখাইত, এবং বিহারীর নিকটে সেই হতভাগ্য সম্বন্ধে উপহাসতীব্র অবজ্ঞা প্রকাশ করিয়া ইতরসাধারণের প্রতি নিজের একান্ত ঔদাসীন্য ঘোষণা করিত। বিহারী ইহাতে আপত্তি করিলে মহেন্দ্র বলিত, “তুমি পার বিহারী, যেখানে যাও তোমার বন্ধুর অভাব হয় না; আমি কিন্তু যাকে-তাকে বন্ধু বলিয়া টানাটানি করিতে পারি না।”




সেই মহেন্দ্রের মন আজকাল যখন মাঝে মাঝে অনিবার্য ব্যগ্রতা ও কৌতূহলের সহিত এই অপরিচিতার প্রতি আপনি ধাবিত হইতে থাকিত তখন সে নিজের আদর্শের কাছে যেন খাটো হইয়া পড়িত। অবশেষে বিরক্ত হইয়া বিনোদিনীকে বাটী হইতে বিদায় করিয়া দিবার জন্য সে তাহার মাকে পীড়াপীড়ি করিতে আরম্ভ করিল।
মহেন্দ্র কহিল, “থাক্‌ চুনি। তোমার চোখের বালির সঙ্গে আলাপ করিবার সময় কই। পড়িবার সময় ডাক্তারি বই পড়িব, অবকাশের সময় তুমি আছ, ইহার মধ্যে সখীকে কোথায় আনিবে।”
আশা কহিল, “আচ্ছা, তোমার ডাক্তারিতে ভাগ বসাইব না, আমারই অংশ আমি বালিকে দিব।”
মহেন্দ্র কহিল, “তুমি তো দিবে, আমি দিতে দিব কেন।”
আশা যে বিনোদিনীকে ভালোবাসিতে পারে, মহেন্দ্র বলে, ইহাতে তাহার স্বামীর প্রতি প্রেমের খর্বতা প্রতিপন্ন হয়। মহেন্দ্র অহংকার করিয়া বলিত, “আমার মতো অনন্যনিষ্ঠ প্রেম তোমার নহে।” আশা তাহা কিছুতেই মানিত না–ইহা লইয়া ঝগড়া করিত, কাঁদিত, কিন্তু তর্কে জিতিতে পারিত না।
মহেন্দ্র তাহাদের দুজনের মাঝখানে বিনোদিনীকে সূচ্যগ্র স্থান ছাড়িয়া দিতে চায় না, ইহাই তাহার গর্বের বিষয় হইয়া উঠিল। মহেন্দ্রের এই গর্ব আশার সহ্য হইত না, কিন্তু আজ সে পরাভব স্বীকার করিয়া কহিল, “আচ্ছা, বেশ, আমার খাতিরেই তুমি আমার বালির সঙ্গে আলাপ করো।”
আশায় নিকট মহেন্দ্র নিজের ভালোবাসার দৃঢ়তা ও শ্রেষ্ঠতা প্রমাণ করিয়া অবশেষে বিনোদিনীর সঙ্গে আলাপ করিবার জন্য অনুগ্রহপূর্বক রাজি হইল। বলিয়া রাখিল, “কিন্তু তাই বলিয়া যখন-তখন উৎপাত করিলে বাঁচিব না।”




পরদিন প্রত্যুষে বিনোদিনীকে আশা তাহার বিছানায় গিয়া জড়াইয়া ধরিল। বিনোদিনী কহিল, “এ কী আশ্চর্য। চকোরী যে আজ চাঁদকে ছাড়িয়া মেঘের দরবারে!”
আশা কহিল, “তোমাদের ও-সব কবিতার কথা আমার আসে না ভাই, কেন বেনাবনে মুক্ত ছড়ানো। যে তোমার কথার জবাব দিতে পারিবে, একবার তাহার কাছে কথা শোনাও এসে।”
বিনোদিনী কহিল, “সে রসিক লোকটি কে।”
আশা কহিল, “তোমার দেবর, আমার স্বামী। না ভাই, ঠাট্টা নয়–তিনি তোমার সঙ্গে আলাপ করিবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতেছেন।”
বিনোদিনী মনে মনে কহিল, “স্ত্রীর হুকুমে আমার প্রতি তলব পড়িয়াছে, আমি অমনি ছুটিয়া যাইব, আমাকে তেমন পাও নাই।”
বিনোদিনী কোনোমতেই রাজি হইল না। আশা তখন স্বামীর কাছে বড়ো অপ্রতিভ হইল।
মহেন্দ্র মনে মনে বড়ো রাগ করিল। তাহার কাছে বাহির হইতে আপত্তি! তাহাকে অন্য সাধারণ পুরুষের মতো জ্ঞান করা! আর কেহ হইলে তো এতদিনে অগ্রসর হইয়া নানা কৌশলে বিনোদিনীর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ আলাপ-পরিচয় করিত। মহেন্দ্র যে তাহার চেষ্টামাত্রও করে নাই, ইহাতেই কি বিনোদিনী তাহার পরিচয় পায় নাই। বিনোদিনী যদি একবার ভালো করিয়া জানে, তবে অন্য পুরুষ এবং মহেন্দ্রের প্রভেদ বুঝিতে পারে।




বিনোদিনীও দুদিন পূর্বে আক্রোশের সহিত মনে মনে বলিয়াছিল, “এতকাল বাড়িতে আছি, মহেন্দ্র যে একবার আমাকে দেখিবার চেষ্টাও করে না। যখন পিসিমার ঘরে থাকি তখন কোনো ছুতা করিয়াও যে মার ঘরে আসে না। এত ঔদাসীন্য কিসের। আমি কি জড়পদার্থ। আমি কি মানুষ না। আমি কি স্ত্রীলোক নই। একবার যদি আমার পরিচয় পাইত, তবে আদরের চুনির সঙ্গে বিনোদিনীর প্রভেদ বুঝিতে পারিত।”
আশা স্বামীর কাছে প্রস্তাব করিল, “তুমি কালেজে গেছ বলিয়া চোখের বালিকে আমাদের ঘরে আনিব, তাহার পরে বাহির হইতে তুমি হঠাৎ আসিয়া পড়িবে–তা হইলেই সে জব্দ হইবে।”
মহেন্দ্র কহিল, “কী অপরাধে তাহাকে এতবড়ো কঠিন শাসনের আয়োজন।”
আশা কহিল, “না সত্যই আমার ভারি রাগ হইয়াছে। তোমার সঙ্গে দেখা করিতেও তার আপত্তি! প্রতিজ্ঞা ভাঙিব তবে ছাড়িব।”
মহেন্দ্র কহিল, “তোমার প্রিয়সখীর দর্শনাভাবে আমি মরিয়া যাইতেছি না। আমি অমন চুরি করিয়া দেখা করিতে চাই না।”
আশা সানুনয়ে মহেন্দ্রের হাত ধরিয়া কহিল, “মাথা খাও, একটিবার তোমাকে এ কাজ করিতেই হইবে। একবার যে করিয়া হোক তাহার গুমর ভাঙিতে চাই, তার পর তোমাদের যেমন ইচ্ছা তাই করিয়ো।”
মহেন্দ্র নিরুত্তর হইয়া রহিল। আশা কহিল, “লক্ষ্মীটি, আমার অনুরোধ রাখো।”
মহেন্দ্রের আগ্রহ প্রবল হইয়া উঠিতেছিল–সেইজন্য অতিরিক্ত মাত্রায় ঔদাসীন্য প্রকাশ করিয়া সম্মতি দিল।
শরৎকালের স্বচ্ছ নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে বিনোদিনী মহেন্দ্রের নির্জন শয়নগৃহে বসিয়া আশাকে কার্পেটের জুতা বুনিতে শিখাইতেছিল। আশা অন্যমনস্ক হইয়া ঘন ঘন দ্বারের দিকে চাহিয়া গণনায় ভুল করিয়া বিনোদিনীর নিকট নিজের অসাধ্য অপটুত্ব প্রকাশ করিতেছিল।




অবশেষে বিনোদিনী বিরক্ত হইয়া তাহার হাত হইতে কার্পেট টান মারিয়া ফেলিয়া দিয়া কহিল, “ও তোমার হইবে না, আমার কাজ আছে আমি যাই।”
আশা কহিল, “আর একটু বোসো, এবার দেখো, আমি ভুল করিব না।” বলিয়া আবার সেলাই লইয়া পড়িল।
ইতিমধ্যে নিঃশব্দপদে বিনোদিনীর পশ্চাতে দ্বারের নিকট মহেন্দ্র আসিয়া দাঁড়াইল। আশা সেলাই হইতে মুখ না তুলিয়া আস্তে আস্তে হাসিতে লাগিল।
বিনোদিনী কহিল, “হঠাৎ হাসির কথা কী মনে পড়িল।” আশা আর থাকিতে পারিল না। উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিয়া কার্পেট বিনোদিনীর গায়ের উপরে ফেলিয়া দিয়া কহিল, “না ভাই, ঠিক বলিয়াছ–ও আমার হইবে না”–বলিয়া বিনোদিনীর গলা জড়াইয়া দ্বিগুণ হাসিতে লাগিল।
প্রথম হইতেই বিনোদিনী সব বুঝিয়াছিল। আশার চাঞ্চল্যে এবং ভাবভঙ্গিতে তাহার নিকট কিছুই গোপন ছিল না। কখন মহেন্দ্র পশ্চাতে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে তাহাও সে বেশ জানিতে পারিয়াছিল। নিতান্ত সরল নিরীহের মতো সে আশার এই অত্যন্ত ক্ষীণ ফাঁদের মধ্যে ধরা দিল।




মহেন্দ্র ঘরে ঢুকিয়া কহিল, “হাসির কারণ হইতে আমি হতভাগ্য কেন বঞ্চিত হই।”
বিনোদিনী চমকিয়া মাথায় কাপড় টানিয়া উঠিবার উপক্রম করিল। আশা তাহার হাত চাপিয়া ধরিল।
মহেন্দ্র হাসিয়া কহিল, “হয় আপনি বসুন আমি যাই, নয় আপনিও বসুন আমিও বসি।”
বিনোদিনী সাধারণ মেয়ের মতো আশার সহিত হাত-কাড়াকাড়ি করিয়া মহাকোলাহলে লজ্জায় ধুম বাধাইয়া দিল না। সহজ সুরেই বলিল, “কেবল আপনার অনুরোধেই বসিলাম, কিন্তু মনে মনে অভিশাপ দিবেন না।”
মহেন্দ্র কহিল, “এই বলিয়া অভিশাপ দিব, আপনার যেন অনেকক্ষণ চলৎশক্তি না থাকে।”
বিনোদিনী কহিল, “সে অভিশাপকে আমি ভয় করি না। কেননা, আপনার অনেকক্ষণ খুব বেশিক্ষণ হইবে না। বোধ হয়, সময় উত্তীর্ণ হইয়া আসিল।”
বলিয়া আবার সে উঠিবার চেষ্টা করিল। আশা তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল, “মাথা খাও আর একটু বোসো।”







১৪

আশা জিজ্ঞাসা করিল, “সত্য করিয়া বলো, আমার চোখের বালিকে কেমন লাগিল।” মহেন্দ্র কহিল, “মন্দ নয়।” আশা অত্যন্ত ক্ষুণ্ন হইয়া কহিল, “তোমার কাউকে আর পছন্দই হয় না।” মহেন্দ্র। কেবল একটি লোক ছাড়া। আশা কহিল, “আচ্ছা, ওর সঙ্গে আর-একটু ভালো করিয়া আলাপ হউক, তার পরে বুঝিব, পছন্দ হয় কি না।” মহেন্দ্র কহিল, “আবার আলাপ! এখন বুঝি বরাবরই এমনি চলিবে।”
আশা কহিল, “ভদ্রতার খাতিরেও তো মানুষের সঙ্গে আলাপ করিতে হয়। একদিন পরিচয়ের পরেই যদি দেখাশুনা বন্ধ কর, তবে চোখের বালি কী মনে করিবে বলো দেখি। তোমার কিন্তু সকলই আশ্চর্য। আর কেউ হইলে অমন মেয়ের সঙ্গে আলাপ করিবার জন্য সাধিয়া বেড়াইত, তোমার যেন একটা মস্ত বিপদ উপস্থিত হইল।”
অন্য লোকের সঙ্গে তাহার এই প্রভেদের কথা শুনিয়া মহেন্দ্র ভারি খুশি হইল। কহিল, “আচ্ছা, বেশ তো। ব্যস্ত হইবার দরকার কী। আমার তো পালাইবারস্থান নাই, তোমার সখীরও পালাইবার তাড়া দেখি না-সেুতরাং দেখা মাঝে মাঝে হইবেই, এবং দেখা হইলে ভদ্রতা রক্ষা করিবে, তোমার স্বামীর সেটুকু শিক্ষা আছে।”


মহেন্দ্র মনে স্থির করিয়া রাখিয়াছিল, বিনোদিনী এখন হইতে কোনো-না-কোনো ছুতায় দেখা দিবেই। ভুল বুঝিয়াছিল। বিনোদিনী কাছ দিয়াও যায় না–দৈবাৎ যাতায়াতের পথেও দেখা হয় না।

পাছে কিছুমাত্র ব্যগ্রতা প্রকাশ হয় বলিয়া মহেন্দ্র বিনোদিনীর প্রসঙ্গ স্ত্রীর কাছে উত্থাপন করিতে পারে না। মাঝে মাঝে বিনোদিনীর সঙ্গলাভের জন্য স্বাভাবিক সামান্য ইচ্ছাকেও গোপন ও দমন করিতে গিয়া মহেন্দ্রের ব্যগ্রতা আরো যেন বাড়িয়া উঠিতে থাকে। তাহার পরে বিনোদিনীর ঔদাস্যে তাহাকে আরো উত্তেজিত করিতে থাকিল।
বিনোদিনীর সঙ্গে দেখা হইবার পরদিনে মহেন্দ্র নিতান্তই যেন প্রসঙ্গক্রমে হাস্যচ্ছলে আশাকে জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা, তোমার অযোগ্য এই স্বামীটিকে চোখের বালির কেমন লাগিল।”
প্রশ্ন করিবার পূর্বেই আশার কাছ হইতে এ সম্বন্ধে উচ্ছ্বাসপূর্ণ বিস্তারিত রিপোর্ট পাইবে, মহেন্দ্রের এরূপ দৃঢ় প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সেজন্য সবুর করিয়া যখন ফল পাইল না, তখন লীলাচ্ছলে প্রশ্নটা উত্থাপন করিল।




আশা মুশকিলে পড়িল। চোখের বালি কোনো কথাই বলে নাই। তাহাতে আশা সখীর উপর অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইয়াছিল।
স্বামীকে বলিল, “রোসো, দু-চারি দিন আগে আলাপ হউক, তার পরে তো বলিবে। কাল কতক্ষণেরই বা দেখা, ক’টা কথাই বা হইয়াছিল।”
ইহাতেও মহেন্দ্র কিছু নিরাশ হইল এবং বিনোদিনী সম্বন্ধে নিশ্চেষ্টতা দেখানো তাহার পক্ষে আরো দুরূহ হইল।




এই-সকল আলোচনার মধ্যে বিহারী আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কী মহিনদা, আজ তোমাদের তর্কটা কী লইয়া।”
মহেন্দ্র কহিল, “দেখো তো ভাই, কুমুদিনী না প্রমোদিনী না কার সঙ্গে তোমার বোঠান চুলের দড়ি না মাছের কাঁটা না কী একটা পাতাইয়াছেন, কিন্তু আমাকেও তাই বলিয়া তাঁর সঙ্গে চুরোটের ছাই কিংবা দেশালাইয়ের কাঠি পাতাইতে হইবে, এ হইলে তো বাঁচা যায় না।”
আশার ঘোমটার মধ্যে নীরবে তুমুল কলহ ঘনাইয়া উঠিল। বিহারী ক্ষণকাল নিরুত্তরে মহেন্দ্রের মুখের
দিকে চাহিয়া হাসিল–কহিল, “বোঠান, লক্ষণ ভালো নয়। এ-সব ভোলাইবার কথা। তোমার চোখের বালিকে আমি দেখিয়াছি। আরো যদি ঘন ঘন দেখিতে পাই, তবে সেটাকে দুর্ঘটনা বলিয়া মনে করিব না, সে আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি। কিন্তু মহিনদা যখন এত করিয়া বেকবুল যাইতেছেন তখন বড়ো সন্দেহের কথা।”
মহেন্দ্রের সঙ্গে বিহারীর যে অনেক প্রভেদ, আশা তাহার আর-একটি প্রমাণ পাইল।
হঠাৎ মহেন্দ্রের ফোটোগ্রাফ-অভ্যাসের শখ চাপিল। পূর্বে সে একবার ফোটোগ্রাফি শিখিতে আরম্ভ করিয়া ছাড়িয়া দিয়াছিল। এখন আবার ক্যামেরা মেরামত করিয়া আরক কিনিয়া ছবি তুলিতে শুরু করিল। বাড়ির চাকর-বেহারাদের পর্যন্ত ছবি তুলিতে লাগিল।
আশা ধরিয়া পড়িল, চোখের বালির একটা ছবি লইতেই হইবে।
মহেন্দ্র অত্যন্ত সংক্ষেপে বলিল, “আচ্ছা।”
চোখের বালি তদপেক্ষা সংক্ষেপে বলিল, “না।”
আশাকে আবার একটা কৌশল করিতে হইল এবং সে কৌশল গোড়া হইতেই বিনোদিনীর অগোচর রহিল না।
মতলব এই হইল, মধ্যাহ্নে আশা তাহাকে নিজের শোবার ঘরে আনিয়া কোনোমতে ঘুম পাড়াইবে এবং মহেন্দ্র সেই অবস্থায় ছবি তুলিয়া অবাধ্য সখীকে উপযুক্তরূপ জব্দ করিবে।




আশ্চর্য এই, বিনোদিনী কোনোদিন দিনের বেলায় ঘুমায় না। কিন্তু আশার ঘরে আসিয়া সেদিন তাহার চোখ ঢুলিয়া পড়িল। গায়ে একখানি লাল শাল দিয়া খোলা জানালার দিকে মুখ করিয়া হাতে মাথা রাখিয়া এমনই সুন্দর ভঙ্গিতে ঘুমাইয়া পড়িল যে মহেন্দ্র কহিল, “ঠিক মনে হইতেছে, যেন ছবি লইবার জন্য ইচ্ছা করিয়াই প্রস্তুত হইয়াছে।”
মহেন্দ্র পা টিপিয়া টিপিয়া ক্যামেরা আনিল। কোন্‌ দিক হইতে ছবি লইলে ভালো হইবে, তাহা স্থির করিবার জন্য বিনোদিনীকে অনেকক্ষণ ধরিয়া নানাদিক হইতে বেশ করিয়া দেখিয়া লইতে হইল। এমন-কি, আর্টের খাতিরে অতি সন্তর্পণে শিয়রের কাছে তাহার খোলা চুল এক জায়গায় একটু সরাইয়া দিতে হইল-পেছন্দ না হওয়ায় পুনরায় তাহা সংশোধন করিয়া লইতে হইল। আশাকে কানে কানে কহিল, “পায়ের কাছে শালটা একটুখানি বাঁ দিকে সরাইয়া দাও।”
অপটু আশা কানে কানে কহিল, “আমি ঠিক পারিব না, ঘুম ভাঙাইয়া দিব–তুমি সরাইয়া দাও।”
মহেন্দ্র সরাইয়া দিল।
অবশেষে যেই ছবি লইবার জন্য ক্যামেরার মধ্যে কাচ পুরিয়া দিল, অমনি যেন কিসের শব্দে বিনোদিনী নড়িয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া বসিল। আশা উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল। বিনোদিনী বড়োই রাগ করিল–তাহার জ্যোতির্ময় চক্ষু দুইটি হইতে মহেন্দ্রের প্রতি অগ্নিবাণ বর্ষণ করিয়া কহিল, “ভারি অন্যায়।”
মহেন্দ্র কহিল, “অন্যায়, তাহার আর সন্দেহ নাই। কিন্তু চুরিও করিলাম, অথচ চোরাই মাল ঘরে আসিল না, ইহাতে যে আমার ইহকাল পরকাল দুই গেল! অন্যায়টাকে শেষ করিতে দিয়া তাহার পরে দণ্ড দিবেন।”




আশাও বিনোদিনীকে অত্যন্ত ধরিয়া পড়িল। ছবি লওয়া হইল। কিন্তু প্রথম ছবিটা খারাপ হইয়া গেল। সুতরাং পরের দিন আর-একটা ছবি না লইয়া চিত্রকর ছাড়িল না। তার পরে আবার দুই সখীকে একত্র করিয়া বন্ধুত্বের চিরনিদর্শনস্বরূপ একখানি ছবি তোলার প্রস্তাবে বিনোদিনী “না” বলিতে পারিল না। কহিল, “কিন্তু এইটেই শেষ ছবি।”
শুনিয়া মহেন্দ্র সে ছবিটাকে নষ্ট করিয়া ফেলিল। এমনি করিয়া ছবি তুলিতে তুলিতে আলাপ পরিচয় বহুদূর অগ্রসর হইয়া গেল।







১৫

বাহির হইতে নাড়া পাইলে ছাই-চাপা আগুন আবার জ্বলিয়া উঠে। নবদম্পতির প্রেমের উৎসাহ যেটুকু মলান হইতেছিল, তৃতীয়ক্ষপের ঘা খাইয়া সেটুকু আবার জাগিয়া উঠিল।
আশার হাস্যালাপ করিবার শক্তি ছিল না, কিন্তু বিনোদিনী তাহা অজস্র জোগাইতে পারিত; এইজন্য বিনোদিনীর অন্তরালে আশা ভারি একটা আশ্রয় পাইল। মহেন্দ্রকে সর্বদাই আমোদের উত্তেজনায় রাখিতে তাহাকে আর অসাধ্যসাধন করিতে হইত না।
বিবাহের অল্পকালের মধ্যেই মহেন্দ্র এবং আশা পরস্পরের কাছে নিজেকে নিঃশেষ করিবার উপক্রম করিয়াছিল–প্রেমের সংগীত একেবারেই তারস্বরের নিখাদ হইতেই শুরু হইয়াছিল–সুদ ভাঙিয়া না খাইয়া তাহারা একেবারে মূলধন উজাড় করিবারচেষ্টায় ছিল। এই খেপামির বন্যাকে তাহারা প্রাত্যহিক সংসারের সহজ স্রোতে কেমন করিয়া পরিণত করিবে। নেশার পরেই মাঝখানে যে অবসাদ আসে, সেটা দূর করিতে মানুষ আবার যে-নেশা চায় সে-নেশা আশা কোথা হইতে জোগাইবে। এমন সময় বিনোদিনী নবীন রঙিন পাত্র ভরিয়া আশার হাতে আনিয়া দিল। আশা স্বামীকে প্রফুল্ল দেখিয়া আরাম পাইল।




এখন আর তাহার নিজের চেষ্টা রহিল না। মহেন্দ্র-বিনোদিনী যখন উপহাস-পরিহাস করিত, তখন সে কেবল প্রাণ খুলিয়া হাসিতে যোগ দিত। তাসখেলায় মহেন্দ্র যখন আশাকে অন্যায় ফাঁকি দিত তখন সে বিনোদিনীকে বিচারক মানিয়া সকরুণ অভিযোগের অবতারণা করিত। মহেন্দ্র তাহাকে ঠাট্টা করিলে বা কোনো অসংগত কথা বলিলে সে প্রত্যাশা করিত, বিনোদিনী তাহার হইয়া উপযুক্ত জবাব দিয়া দিবে।
এইরূপে তিনজনের সভা জমিয়া উঠিল।
কিন্তু তাই বলিয়া বিনোদিনীর কাজে শৈথিল্য ছিল না। রাঁধাবাড়া, ঘরকন্না দেখা, রাজলক্ষ্মীর সেবা করা, সমস্ত সে নিঃশেষপূর্বক সমাধা করিয়া তবে আমোদে যোগ দিত। মহেন্দ্র অস্থির হইয়া বলিত, “চাকর-দাসীগুলাকে না কাজ করিতে দিয়া তুমি মাটি করিবে দেখিতেছি।” বিনোদিনী বলিত, “নিজে কাজ না করিয়া মাটি হওয়ার চেয়ে সে ভালো। যাও, তুমি কালেজে যাও।”
মহেন্দ্র। আজ বাদলার দিনটাতে-
বিনোদিনী । না সে হইবে না–তোমার গাড়ি তৈরি হইয়া আছে–কালেজে যাইতে হইবে।
মহেন্দ্র। আমি তো গাড়ি বারণ করিয়া দিয়াছিলাম।
বিনোদিনী। আমি বলিয়া দিয়াছি। –বলিয়া মহেন্দ্রের কালেজে যাইবার কাপড় আনিয়া সম্মুখে উপস্থিত করিল।
মহেন্দ্র। তোমার রাজপুতের ঘরে জন্মানো উচিত ছিল, যুদ্ধকালে আত্মীয়কে বর্ম পরাইয়া দিতে।




আমোদের প্রলোভনে ছুটি লওয়া, পড়া ফাঁকি দেওয়া, বিনোদিনী কোনোমতেই প্রশ্রয় দিত না। তাহার কঠিন শাসনে দিনে দুপুরে অনিয়ত আমোদ একেবারে উঠিয়া গেল, এবং এইরূপে সায়াহ্নের অবকাশ মহেন্দ্রের কাছে অত্যন্ত রমণীয় লোভনীয় হইয়া উঠিল। তাহার দিনটা নিজের অবসানের জন্য যেন প্রতীক্ষা করিয়া থাকিত।
পূর্বে মাঝে মাঝে ঠিক সময়মত আহার প্রস্তুত হইত না এবং সেই ছুতা করিয়া মহেন্দ্র আনন্দে কালেজ কামাই করিত। এখন বিনোদিনী স্বয়ং বন্দোবস্ত করিয়া মহেন্দ্রের কালেজের খাওয়া সকাল-সকাল ঠিক করিয়া দেয় এবং খাওয়া হইলেই মহেন্দ্র খবর পায়–গাড়ি তৈয়ার। পূর্বে কাপড়গুলি প্রতিদিন এমন ভাঁজ-করা পরিপাটি অবস্থায় পাওয়া দূরে থাক্‌, ধোপার বাড়ি গেছে কি আলমারির কোনো-একটা অনির্দেশ্য স্থানে আগোচরে পড়িয়া আছে, তাহা দীর্ঘকাল সন্ধান ব্যতীত জানা যাইত না।
প্রথম-প্রথম বিনোদিনী এই-সকল বিশৃঙ্খলা লইয়া মহেন্দ্রের সম্মুখে আশাকে সহাস্য ভর্ৎসনা করিত-মেহেন্দ্রও আশার নিরুপায় নৈপুণ্যহীনতায় সস্নেহে হাসিত। অবশেষে সখিবাৎসল্যবশে আশার হাত হইতে




তাহার কর্তব্যভার বিনোদিনী নিজের হাতে কাড়িয়া লইল। ঘরের শ্রী ফিরিয়া গেল।
চাপকানের বোতাম ছিঁড়িয়া গেছে, আশা আশু তাহার কোনো উপায় করিতে পারিতেছে না–বিনোদিনী দ্রুত আসিয়া হতবুদ্ধি আশার হাত হইতে চাপকান কাড়িয়া লইয়া চটপট সেলাই করিয়া দেয়। একদিন মহেন্দ্রের প্রস্তুত অন্নে বিড়ালে মুখ দিল–আশা ভাবিয়া অস্থির; বিনোদিনী তখনই রান্নাঘরে গিয়া কোথা হইতে কী সংগ্রহ করিয়া গুছাইয়া কাজ চালাইয়া দিল; আশা আশ্চর্য হইয়া গেল।
মহেন্দ্র এইরূপে আহারে ও আচ্ছাদনে, কর্মে ও বিশ্রামে, সর্বত্রই নানা আকারে বিনোদিনীর সেবাহস্ত অনুভব করিতে লাগিল। বিনোদিনীর রচিত পশমের জুতা তাহার পায়ে এবং বিনোদিনীর বোনা পশমের গলাবন্ধ তাহার কণ্ঠদেশে একটা যেন কোমল মানসিক সংস্পর্শের মতো বেষ্টন করিল। আশা আজকাল সখিহস্তের প্রসাধনে পরিপাটি-পরিচ্ছন্ন হইয়া সুন্দরবেশে সুগন্ধ-মাখিয়া মহেন্দ্রের নিকট উপস্থিত হয়, তাহার মধ্যে যেন কতকটা আশার নিজের, কতকটা আর-একজনের–তাহার সাজসজ্জা-সৌন্দর্যে আনন্দে সে যেন গঙ্গাযমুনার মতো তাহার সখীর সঙ্গে মিলিয়া গেছে।
বিহারীর আজকাল পূর্বের মতো আদর নাই–তাহার ডাক পড়ে না। বিহারী মহেন্দ্রকে লিখিয়া পাঠাইয়াছিল, কাল রবিবার আছে, দুপুরবেলা আসিয়া সে মহেন্দ্রের মার রান্না খাইবে। মহেন্দ্র দেখিল রবিবারটা নিতান্ত মাটি হয়, তাড়াতাড়ি লিখিয়া পাঠাইল, রবিবারে বিশেষ কাজে তাহাকে বাহিরে যাইতে হইবে।
তবু বিহারী আহারান্তে একবার মহেন্দ্রের বাড়ির খোঁজ লইতে আসিল। বেহারার কাছে শুনিল, মহেন্দ্র বাড়ি হইতে বাহিরে যায় নাই। “মহিনদা” বলিয়া সিঁড়ি হইতে হাঁকিয়া বিহারী মহেন্দ্রের ঘরে গেল। মহেন্দ্র অপ্রস্তুত হইয়া কহিল,”ভারি মাথা ধরিয়াছে।” বলিয়া তাকিয়ায় ঠেস দিয়া পড়িল।
মহেন্দ্র বলিল, “থাক্‌, দরকার নাই।”
বিনোদিনী শুনিল না, দ্রুতপদে ওডিকলোন বরফজলে মিশাইয়া উপস্থিত করিল। আশার হাতে ভিজা রুমাল দিয়া কহিল, “মহেন্দ্রবাবুর মাথায় বাঁধিয়া দাও।”
মহেন্দ্র বারবার বলিতে লাগিল, “থাক্‌-না।” বিহারী অবরুদ্ধহাস্যে নীরবে অভিনয় দেখিতে লাগিল। মহেন্দ্র সগর্বে ভাবিল, “বিহারীটা দেখুক, আমার কত আদর।”




আশা বিহারীর সম্মুখে লজ্জাকম্পিত হস্তে ভালো করিয়া বাঁধিতে পারিল না–ফোঁটাখানেক ওডিকলোন গড়াইয়া মহেন্দ্রের চোখে পড়িল। বিনোদিনী আশার হাত হইতে রুমাল লইয়া সুনিপুণ করিয়া বাঁধিল এবং আর-একটি বস্ত্রখণ্ডে ওডিকলোন ভিজাইয়া অল্প অল্প করিয়া নিংড়াইয়া দিল–আশা মাথায় ঘোমটা টানিয়া পাখা করিতে লাগিল।
বিনোদিনী স্নিগ্ধস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “মহেন্দ্রবাবু, আরাম পাচ্ছেন কি।”
এইরূপে কণ্ঠস্বরে মধু ঢালিয়া দিয়া বিনোদিনী দ্রুতকটাক্ষে একবার বিহারীর মুখের দিকে চাহিয়া লইল। দেখিল, বিহারীর চক্ষু কৌতুকে হাসিতেছে। সমস্ত ব্যাপারটা তাহার কাছে প্রহসন। বিনোদিনী বুঝিয়া লইল, এ লোকটিকে ভোলানো সহজ ব্যাপার নহে–কিছুই ইহার নজর এড়ায় না।
বিহারী হাসিয়া কহিল, “বিনোদ-বোঠান, এমনতরো শুশ্রুষা পাইলে রোগ সারিবে না, বাড়িয়া যাইবে।”
বিনোদিনী। তা কেমন করিয়া জানিব, আমরা মূর্খ মেয়েমানুষ। আপনাদের ডাক্তারিশাসেত্র বুঝি এইমতো লেখা আছে।




বিহারী। আছেই তো। সেবা দেখিয়া আমারও কপাল ধরিয়া উঠিতেছে। কিন্তু পোড়াকপালকে বিনাচিকিৎসাতেই চটপট সারিয়া উঠিতে হয়। মহিনদার কপালের জোর বেশি।
বিনোদিনী ভিজা বস্ত্রখণ্ড রাখিয়া দিয়া কহিল, “কাজ নাই, বন্ধুর চিকিৎসা বন্ধুতেই করুন।”
বিহারী সমস্ত ব্যাপার দেখিয়া ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। এ কয়দিন সে অধ্যয়নে ব্যস্ত ছিল, ইতিমধ্যে মহেন্দ্র বিনোদিনী ও আশায় মিলিয়া আপনা আপনি যে এতখানি তাল পাকাইয়া তুলিয়াছে তাহা সে জানিত না। আজ সে বিনোদিনীকে বিশেষ করিয়া দেখিল, বিনোদিনীও তাহাকে দেখিয়া লইল।
বিহারী কিছু তীক্ষ্ণস্বরে কহিল, “ঠিক কথা। বন্ধুর চিকিৎসা বন্ধুই করিবে। আমিই মাথাধরা আনিয়াছিলাম, আমি তাহা সঙ্গে লইয়া চলিলাম। ওডিকলোন আর বাজে খরচ করিবেন না।” আশার দিকে চাহিয়া কহিল, “বোঠান, চিকিৎসা করিয়া রোগ সারানোর চেয়ে রোগ না হইতে দেওয়াই ভালো।”







১৬

বিহারী ভাবিল, “আর দূরে থাকিলে চলিবে না, যেমন করিয়া হউক, ইহাদের মাঝখানে আমাকেও একটা স্থান লইতে হইবে। ইহাদের কেহই আমাকে চাহিবে না, তবু আমাকে থাকিতে হইবে।”
বিহারী আহ্বান-অভ্যর্থনার অপেক্ষা না রাখিয়াই মহেন্দ্রের ব্যুহের মধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিল। বিনোদিনীকে কহিল, “বিনোদ-বোঠান, এই ছেলেটিকে ইহার মা মাটি করিয়াছে, বন্ধু মাটি করিয়াছে, স্ত্রী মাটি করিতেছে–তুমিও সেই দলে না ভিড়িয়া একটা নূতন পথ দেখাও–দোহাই তোমার।”
মহেন্দ্র। অর্থাৎ-
বিহারী । অর্থাৎ আমার মতো লোক, যাহাকে কেহ কোনোকালে পোঁছে না-
মেহেন্দ্র। তাহাকে মাটি করো। মাটি হইবার উমেদারি সহজ নয় হে বিহারী, দরখাস্ত পেশ করিলেই হয় না।
বিনোদিনী হাসিয়া কহিল, “মাটি হইবার ক্ষমতা থাকা চাই, বিহারীবাবু।”


বিহারী কহিল, “নিজগুণ না থাকিলেও হাতের গুণে হইতে পারে। একবার প্রশ্রয় দিয়া দেখোই-না।”

বিনোদিনী। আগে হইতে প্রস্তুত হইয়া আসিলে কিছু হয় না, অসাবধান থাকিতে হয়। কী বল, ভাই চোখের বালি। তোমার এই দেওরের ভার তুমিই লও-না, ভাই। আশা তাহাকে দুই অঙ্গুলি দিয়া ঠেলিয়া দিল। বিহারীও এ ঠাট্টায় যোগ দিল না।
আশার সম্বন্ধে বিহারী কোনো ঠাট্টা সহিবে না, এটুকু বিনোদিনীর কাছে এড়াইতে পারে নাই। বিহারী আশাকে শ্রদ্ধা করে এবং বিনোদিনীকে হালকা করিতে চায়, ইহা বিনোদিনীকে বিঁধিল।
সে পুনরায় আশাকে কহিল, “তোমার এই ভিক্ষুক দেওরটি আমাকে উপলক্ষ করিয়া তোমারই কাছে আদর ভিক্ষা করিতে আসিয়াছে–কিছু দে, ভাই।”




আশা অত্যন্ত বিরক্ত হইল। ক্ষণকালের জন্য বিহারীর মুখ লাল হইল, পরক্ষণেই হাসিয়া কহিল, “আমার বেলাতেই কি পরের উপর বরাত চালাইবে, আর মহিনদার সঙ্গেই নগদ কারবার!”
বিহারী সমস্ত মাটি করিতে আসিয়াছে, বিনোদিনীর ইহা বুঝিতে বাকি রহিল না। বুঝিল, বিহারীর সম্মুখে সশস্ত্রে থাকিতে হইবে। মহেন্দ্র বিরক্ত হইল। খোলসা কথায় কবিত্বের মাধুর্য নষ্ট হয়। সে ঈষৎ তীব্র স্বরেই কহিল, “বিহারী, তোমার মহিনদা কোনো কারবারে যান না–হাতে যা আছে, তাতেই তিনি সন্তুষ্ট।”
বিহারী। তিনি না যেতে পারেন, কিন্তু ভাগ্যে লেখা থাকিলে কারবারের ঢেউ বাহির হইতে আসিয়াও লাগে।




বিনোদিনী। আপনার উপস্থিত হাতে কিছুই নাই, কিন্তু আপনার ঢেউটা কোন্‌ দিক হইতে আসিতেছে!-
বলিয়া সে সকটাক্ষহাস্যে আশাকে টিপিল। আশা বিরক্ত হইয়া উঠিয়া গেল। বিহারী পরাভূত হইয়া ক্রোধে নীরব হইল; উঠিবার উপক্রম করিতেই বিনোদিনী কহিল, “হতাশ হইয়া যাবেন না, বিহারীবাবু। আমি চোখের বালিকে পাঠাইয়া দিতেছি।”
বিনোদিনী চলিয়া যাইতেই সভাভঙ্গে মহেন্দ্র মনে মনে রাগিল। মহেন্দ্রের অপ্রসন্ন মুখ দেখিয়া বিহারীর রুদ্ধ আবেগ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। কহিল, “মহিনদা, নিজের সর্বনাশ করিতে চাও, করো–বরাবর তোমার সেই অভ্যাস হইয়া আসিয়াছে। কিন্তু যে সরলহৃদয়া সাধ্বী তোমাকে একান্ত বিশ্বাসে আশ্রয় করিয়া আছে, তাহার সর্বনাশ করিয়ো না। এখনো বলিতেছি, তাহার সর্বনাশ করিয়ো না।”
বলিতে বলিতে বিহারীর কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসিল।
মহেন্দ্র রুদ্ধরোষে কহিল, “বিহারী, তোমার কথা আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। হেঁয়ালি ছাড়িয়া স্পষ্ট কথা কও।”
বিহারী কহিল, “স্পষ্টই কহিব। বিনোদিনী তোমাকে ইচ্ছা করিয়া অধর্মের দিকে টানিতেছে এবং তুমি না জানিয়া মূঢ়ের মতো অপথে পা বাড়াইতেছ।”
মহেন্দ্র গর্জন করিয়া উঠিয়া কহিল, “মিথ্যা কথা। তুমি যদি ভদ্রলোকের মেয়েকে এমন অন্যায় সন্দেহের
চোখে দেখ, তবে অন্তঃপুরে তোমার আসা উচিত নয়।”
এমন সময় একটি থালায় মিষ্টান্ন সাজাইয়া বিনোদিনী হাস্যমুখে তাহা বিহারীর সম্মুখে রাখিল। বিহারী
কহিল, “এ কী ব্যাপার। আমার তো ক্ষুধা নাই।”
বিনোদিনী কহিল, “সে কি হয়। একটু মিষ্টমুখ করিয়া আপনাকে যাইতেই হইবে।”
বিহারী হাসিয়া কহিল, “আমার দরখাস্ত মজ্ঞুর হইল বুঝি। সমাদর আরম্ভ হইল।”




বিনোদিনী অত্যন্ত টিপিয়া হাসিল; কহিল, “আপনি যখন দেওর তখন সম্পর্কের যে জোর আছে। যেখানে দাবি করা চলে সেখানে ভিক্ষা করা কেন। আদর যে কাড়িয়া লইতে পারেন। কী বলেন মহেন্দ্রবাবু।”
মহেন্দ্রবাবুর তখন বাক্যস্ফূর্তি হইতেছিল না।
বিনোদিনী। বিহারীবাবু, লজ্জা করিয়া খাইতেছেন না, না রাগ করিয়া? আর-কাহাকেও ডাকিয়া আনিতে
হইবে?
বিহারী। কোনো দরকার নাই। যাহা পাইলাম তাহাই প্রচুর।
বিনোদিনী। ঠাট্টা? আপনার সঙ্গে পারিবার জো নাই। মিষ্টান্ন দিলেও মুখ বন্ধ হয় না।
রাত্রে আশা মহেন্দ্রের নিকটে বিহারী সম্বন্ধে রাগ প্রকাশ করিল–মহেন্দ্র অন্য দিনের মতো হাসিয়া
উড়াইয়া দিল না–সম্পূর্ণ যোগ দিল।
প্রাতঃকালে উঠিয়াই মহেন্দ্র বিহারীর বাড়ি গেল। কহিল, “বিহারী, বিনোদিনী হাজার হউক ঠিক বাড়ির
মেয়ে নয়–তুমি সামনে আসিলে সে যেন কিছু বিরক্ত হয়।”
বিহারী কহিল, “তাই না কি। তবে কাজটা ভালো হয় না। তিনি যদি আপত্তি করেন, তাঁর সামনে নাই
গেলাম।”
মহেন্দ্র নিশ্চিন্ত হইল। এত সহজে এই অপ্রিয় কার্য শেষ হইবে, তাহা সে মনে করে নাই। বিহারীকে মহেন্দ্র ভয় করে।
সেইদিনই বিহারী মহেন্দ্রের অন্তঃপুরে গিয়া কহিল, “বিনোদ-বোঠান, মাপ করিতে হইবে।”
বিনোদিনী। কেন, বিহারীবাবু।
বিহারী। মহেন্দ্রের কাছে শুনিলাম, আমি অন্তঃপুরে আপনার সামনে বাহির হই বলিয়া আপনি বিরক্ত
হইয়াছেন। তাই ক্ষমা চাহিয়া বিদায় হইব।
বিনোদিনী। সে কি হয়, বিহারীবাবু। আমি আজ আছি কাল নাই, আপনি আমার জন্যে কেন যাইবেন। এত গোল হইবে জানিলে আমি এখানে আসিতাম না।
এই বলিয়া বিনোদিনী মুখ মলান করিয়া যেন অশ্রুসংবরণ করিতে দ্রুতপদে চলিয়া গেল।




বিহারী ক্ষণকালের জন্যে মনে করিল, “মিথ্যা সন্দেহ করিয়া আমি বিনোদিনীকে অন্যায় আঘাত করিয়াছি।”
সেদিন সন্ধ্যাবেলায় রাজলক্ষ্মী বিপন্নভাবে আসিয়া কহিলেন, “মহিন, বিপিনের বউ যে বাড়ি যাইবে বলিয়া ধরিয়া বসিয়াছে।”
মহেন্দ্র কহিল, “কেন মা, এখানে তাঁর কি অসুবিধা হইতেছে।”
রাজলক্ষ্মী। অসুবিধা না। বউ বলিতেছে, তাহার মতো সমর্থবয়সের বিধবা মেয়ে পরের বাড়ি বেশি দিন
থাকিলে লোকে নিন্দা করিবে।
মহেন্দ্র ক্ষুদ্ধভাবে কহিল, “এ বুঝি পরের বাড়ি হইল?”
বিহারী বসিয়া ছিল–মহেন্দ্র তাহার প্রতি ভর্ৎসনাদৃষ্টি নিক্ষেপ করিল।
অনুতপ্ত বিহারী ভাবিল, “কাল আমার কথাবার্তায় একটু যেন নিন্দার আভাস ছিল; বিনোদিনী বোধ হয়
তাহাতেই বেদনা পাইয়াছে।”
স্বামী স্ত্রী উভয়ে মিলিয়া বিনোদিনীর উপর অভিমান করিয়া বসিল।
ইনি বলিলেন, “আমাদের পর মনে কর, ভাই!” উনি বলিলেন, “এতদিন পরে আমরা পর হইলাম!”
বিনোদিনী কহিল, “আমাকে কি তোমরা চিরকাল ধরিয়া রাখিবে, ভাই।”
মহেন্দ্র কহিল, “এত কি আমাদের স্পর্ধা।”
আশা কহিল, “তবে কেন এমন করিয়া আমাদের মন কাড়িয়া লইলে।”
সেদিন কিছুই স্থির হইল না। বিনোদিনী কহিল, “না ভাই, কাজ নাই, দুদিনের জন্য মায়া না বাড়ানোই
ভালো।” বলিয়া ব্যাকুলচক্ষে একবার মহেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিল।
পরদিন বিহারী আসিয়া কহিল, “বিনোদ-বোঠান, যাবার কথা কেন বলিতেছেন। কিছু দোষ করিয়াছি কি-তাহারই শাস্তি?”




বিনোদিনী একটু মুখ ফিরাইয়া কহিল, “দোষ আপনি কেন করিবেন, আমার অদৃষ্টের দোষ।”
বিহারী। আপনি যদি চলিয়া যান তো আমার কেবলই মনে হইবে, আমারই উপর রাগ করিয়া গেলেন।
বিনোদিনী করুণচক্ষে মিনতি প্রকাশ করিয়া বিহারীর মুখের দিকে চাহিল–কহিল, “আমার কি থাকা উচিত হয়, আপনিই বলুন-না।”
বিহারী মুশকিলে পড়িল। থাকা উচিত, এ কথা সে কেমন করিয়া বলিবে। কহিল, “অবশ্য আপনাকে তো যাইতেই হইবে, না-হয় আর দু-চার দিন থাকিয়া গেলেন, তাহাতে ক্ষতি কী।”
বিনোদিনী দুই চক্ষু নত করিয়া কহিল,”আপনারা সকলেই আমাকে থাকিবার জন্য অনুরোধ করিতেছেন-আপনাদের কথা এড়াইয়া যাওয়া আমার পক্ষে কঠিন–কিন্তু আপনারা বড়ো অন্যায় করিতেছেন।”
বলিতে বলিতে তাহার ঘনদীর্ঘ চক্ষুপল্লবের মধ্য দিয়া মোটা মোটা অশ্রুর ফোঁটা দ্রুতবেগে গড়াইয়া পড়িতে লাগিল।
বিহারী এই নীরব অজস্র অশ্রুজলে ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিল, “কয়দিনমাত্র আসিয়া আপনার গুণে আপনি সকলকে বশ করিয়া লইয়াছেন, সেইজন্যই আপনাকে কেহ ছাড়িতে চান না–কিছু মনে করিবেন না বিনোদ-বোঠান, এমন লক্ষ্মীকে কে ইচ্ছা করিয়া বিদায় দেয়!”




আশা এক কোণে ঘোমটা দিয়া বসিয়া ছিল, সে আঁচল তুলিয়া ঘনঘন চোখ মুছিতে লাগিল। ইহার পরে বিনোদিনী আর যাইবার কথা উত্থাপন করিল না।






১৭

মাঝখানের এই গোলমালটা একেবারে মুছিয়া ফেলিবার জন্য মহেন্দ্র প্রস্তাব করিল, “আসছে রবিবারে দমদমের বাগানে চড়িভাতি করিয়া আসা যাক।”
আশা অত্যন্ত উৎসাহিত হইয়া উঠিল। বিনোদিনী কিছুতেই রাজি হইল না। মহেন্দ্র ও আশা বিনোদিনীর আপত্তিতে ভারি মুষড়িয়া গেল। তাহারা মনে করিল, আজকাল বিনোদিনী কেমন যেন দূরে সরিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছে।
বিকালবেলায় বিহারী আসিবামাত্র বিনোদিনী কহিল, “দেখুন তো বিহারীবাবু, মহিনবাবু দমদমের বাগানে চড়িভাতি করিতে যাইবেন, আমি সঙ্গে যাইতে চাহি নাই বলিয়া আজ সকাল হইতে দুইজনে মিলিয়া রাগ করিয়া বসিয়াছেন।”
বিহারী কহিল, “অন্যায় রাগ করেন নাই। আপনি না গেলে ইঁহাদের চড়িভাতিতে যে কাণ্ডটা হইবে, অতিবড়ো শত্রুরও যেন তেমন না হয়।”


বিনোদিনী। চলুন-না বিহারীবাবু। আপনি যদি যান, তবে আমি যাইতে রাজি আছি।

বিহারী। উত্তম কথা। কিন্তু কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, কর্তা কী বলেন।
বিহারীর প্রতি বিনোদিনীর এই বিশেষ পক্ষপাতে কর্তা গৃহিণী উভয়েই মনে মনে ক্ষুণ্ন হইল। বিহারীকে সঙ্গে লইবার প্রস্তাবে মহেন্দ্রের অর্ধেক উৎসাহ উড়িয়া গেল। বিহারীর উপস্থিতি বিনোদিনীর পক্ষে সকল সময়েই অপ্রিয়, এই কথাটাই বন্ধুর মনে মুদ্রিত করিয়া দিবার জন্য মহেন্দ্র ব্যস্ত–কিন্তু অতঃপর বিহারীকে আটক করিয়া রাখা অসাধ্য হইবে।
মহেন্দ্র কহিল, “তা বেশ তো, ভালোই তো। কিন্তু বিহারী, তুমি যেখানে যাও একটা হাঙ্গামা না করিয়া ছাড় না। হয়তো সেখানে পাড়া হইতে রাজ্যের ছেলে জোটাইয়া বসিবে, নয় তো কোন্‌ গোরার সঙ্গে মারামারি বাধাইয়া দিবে–কিছু বলা যায় না।”




বিহারী মহেন্দ্রর আন্তরিক অনিচ্ছা বুঝিয়া মনে মনে হাসিল–কহিল, “সেই তো সংসারের মজা, কিসে কী হয়, কোথায় কী ফেসাদ ঘটে, আগে হইতে কিছুই বলিবার জো নাই। বিনোদ-বোঠান, ভোরের বেলায় ছাড়িতে হইবে, আমি ঠিক সময়ে আসিয়া হাজির হইব।”
রবিবার ভোরে জিনিসপত্র ও চাকরদের জন্য একখানি থার্ড ক্লাস ও মনিবদের জন্য একখানি সেকেণ্ড ক্লাস গাড়ি ভাড়া করিয়া আনা হইয়াছে। বিহারী মস্ত-একটা প্যাকবাক্স সঙ্গে করিয়া যথাসময়ে আসিয়া উপস্থিত। মহেন্দ্র কহিল, “ওটা আবার কী আনিলে। চাকরদের গাড়িতে তো আর ধরিবে না।”




বিহারী কহিল, “ব্যস্ত হইয়ো না দাদা, সমস্ত ঠিক করিয়া দিতেছি।”
বিনোদিনী ও আশা গাড়িতে প্রবেশ করিল। বিহারীকে লইয়া কী করিবে, মহেন্দ্র তাই ভাবিয়া একটু ইতস্তত করিতে লাগিল। বিহারী বোঝাটা গাড়ির মাথায় তুলিয়া দিয়া চট করিয়া কোচবাক্সে চড়িয়া বসিল।
মহেন্দ্র হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল। সে ভাবিতেছিল, “বিহারী ভিতরেই বসে কি কী করে, তাহার ঠিক নাই।”
বিনোদিনী ব্যস্ত হইয়া বলিতে লাগিল, “বিহারীবাবু, পড়িয়া যাবেন না তো?”
বিহারী শুনিতে পাইয়া কহিল, “ভয় করিবেন না, পতন ও মূর্ছা–ওটা আমার পার্টের মধ্যে নাই।”
গাড়ি চলিতেই মহেন্দ্র কহিল, “আমিই না-হয় উপরে গিয়া বসি, বিহারীকে ভিতরে পাঠাইয়া দিই।”
আশা ব্যস্ত হইয়া তাহার চাদর চাপিয়া কহিল, “না, তুমি যাইতে পারিবে না।”
বিনোদিনী কহিল, “আপনার অভ্যাস নাই, কাজ কী যদি পড়িয়া যান।”




মহেন্দ্র উত্তেজিত হইয়া কহিল, “পড়িয়া যাব? কখনো না।” বলিয়া তখনই বাহির হইতে উদ্যত হইল।
বিনোদিনী কহিল, “আপনি বিহারীবাবুকে দোষ দেন, কিন্তু আপনিই তো হাঙ্গাম বাধাইতে অদ্বিতীয়।”
মহেন্দ্র মুখ ভার করিয়া কহিল, “আচ্ছা, এক কাজ করা যাক। আমি একটা আলাদা গাড়ি ভাড়া করিয়া
যাই, বিহারী ভিতরে আসিয়া বসুক।”
আশা কহিল, “তা যদি হয়, তবে আমিও তোমার সঙ্গে যাইব।”
বিনোদিনী কহিল, “আর আমি বুঝি গাড়ি হইতে লাফাইয়া পড়িব?” এমনি গোলমাল করিয়া কথাটা
থামিয়া গেল।
মহেন্দ্র সমস্ত পথ মুখ অত্যন্ত গম্ভীর করিয়া রহিল।
দমদমের বাগানে গাড়ি পৌঁছিল। চাকরদের গাড়ি অনেক আগে ছাড়িয়াছিল, কিন্তু এখনো তাহার খোঁজ নাই।
শরৎকালের প্রাতঃকাল অতি মধুর। রৌদ্র উঠিয়া শিশির মরিয়া গেছে, কিন্তু গাছপালা নির্মল আলোকে




ঝলমল করিতেছে। প্রাচীরের গায়ে শেফালি-গাছের সারি রহিয়াছে, তলদেশ ফুলে আচ্ছন্ন এবং গন্ধে আমোদিত।
আশা কলিকাতার ইষ্টকবন্ধন হইতে বাগানের মধ্যে ছাড়া পাইয়া বন্যমৃগীর মতো উল্লসিত হইয়া উঠিল। সে বিনোদিনীকে লইয়া রাশীকৃত ফুল কুড়াইল, গাছ হইতে পাকা আতা পাড়িয়া আতাগাছের তলায় বসিয়া খাইল, দুই সখীতে দিঘির জলে পড়িয়া দীর্ঘকাল ধরিয়া স্নান করিল। এই দুই নারীতে মিলিয়া একটি নিরর্থক আনন্দে-গাছের ছায়া এবং শাখাচ্যুত আলোক, দিঘির জল এবং নিকুজ্ঞের পুষ্পপল্লবকে পুলকিত সচেতন করিয়া তুলিল।
স্নানের পর দুই সখী আসিয়া দেখিল, চাকরদের গাড়ি তখনো আসিয়া পৌঁছে নাই। মহেন্দ্র বাড়ির বারান্দায় চৌকি লইয়া অত্যন্ত শুষ্কমুখে একটা বিলাতি দোকানের বিজ্ঞাপন পড়িতেছে।
বিনোদিনী জিজ্ঞাসা করিল, “বিহারীবাবু কোথায়!”
মহেন্দ্র সংক্ষেপে উত্তর করিল, “জানি না।”
বিনোদিনী। চলুন, তাঁহাকে খুঁজিয়া বাহির করি গে।
মহেন্দ্র। তাহাকে কেহ চুরি করিয়া লইবে, এমন আশঙ্কা নাই। না খুঁজিলেও পাওয়া যাইবে।
বিনোদিনী। কিন্তু তিনি হয়তো আপনার জন্য ভাবিয়া মরিতেছেন, পাছে দুর্লভ রত্ন খোওয়া যায়। তাঁহাকে সান্ত্বনা দিয়া আসা যাক।
জলাশয়ের ধারে প্রকাণ্ড একটা বাঁধানো বটগাছ আছে, সেইখানে বিহারী তাহার প্যাকবাক্স খুলিয়া একটি কেরোসিন-চুলা বাহির করিয়া জল গরম করিতেছে। সকলে আসিবামাত্র আতিথ্য করিয়া বাঁধা বেদির উপর বসাইয়া এক এক পেয়ালা গরম চা এবং ছোটো রেকাবিতে দুই একটি মিষ্টান্ন ধরিয়া দিল। বিনোদিনী বারবার বলিতে লাগিল, “ভাগ্যে বিহারীবাবু সমস্ত উদ্‌যোগ করিয়া আনিয়াছিলেন, তাই তো রক্ষা, নহিলে চা না পাইলে মহেন্দ্রবাবুর কী দশা হইত।”




চা পাইয়া মহেন্দ্র বাঁচিয়া গেল, তবু বলিল, “বিহারীর সমস্ত বাড়াবাড়ি। চড়িভাতি করিতে আসিয়াছি, এখানেও সমস্ত দস্তুরমত আয়োজন করিয়া আসিয়াছে। ইহাতে মজা থাকে না।”
বিহারী কহিল, “তবে দাও ভাই তোমার চায়ের পেয়ালা, তুমি না খাইয়া মজা করো গে–বাধা দিব না।”
বেলা হয়, চাকররা আসিল না। বিহারীর বাক্স হইতে আহারাদির সর্বপ্রকার সরজ্ঞাম বাহির হইতে লাগিল। চাল-ডাল, তরি-তরকারি এবং ছোটো ছোটো বোতলে পেষা মশলা আবিষ্কৃত হইল। বিনোদিনী আশ্চর্য হইয়া বলিতে লাগিল, “বিহারীবাবু, আপনি যে আমাদেরও ছাড়াইয়াছেন। ঘরে তো গৃহিনী নাই, তবে শিখিলেন কোথা হইতে।”
বিহারী কহিল, “প্রাণের দায়ে শিখিয়াছি, নিজের যত্ন নিজেকেই করিতে হয়।”
বিহারী নিতান্ত পরিহাস করিয়া কহিল, কিন্তু বিনোদিনী গম্ভীর হইয়া বিহারীর মুখে করুণচক্ষের কৃপা বর্ষণ করিল।
বিহারী ও বিনোদিনীতে মিলিয়া রাঁধাবাড়ায় প্রবৃত্ত হইল। আশা ক্ষীণ সংকুচিত ভাবে হস্তক্ষেপ করিতে আসিলে, বিহারী তাহাতে বাধা দিল। অপটু মহেন্দ্র সাহায্য করিবার কোনো চেষ্টাও করিল না। সে গুঁড়ির উপরে হেলান দিয়া একটা পায়ের উপরে আর একটা পা তুলিয়া কম্পিত বটপত্রের উপরে রৌদ্রকিরণের নৃত্য দেখিতে লাগিল।




রন্ধন প্রায় শেষ হইলে পর বিনোদিনী কহিল, “মহিনবাবু, আপনি ঐ বটের পাতা গনিয়া শেষ করিতে পারিবেন না, এবারে স্নান করিতে যান।”
ভৃত্যের দল এতক্ষণে জিনিসপত্র লইয়া উপস্থিত হইল। তাহাদের গাড়ি পথের মধ্যে ভাঙিয়া গিয়াছিল। তখন বেলা দুপুর হইয়া গেছে।
আহারান্তে সেই বটগাছের তলায় তাস খেলিবার প্রস্তাব হইল–মহেন্দ্র কোনোমতেই গা দিল না এবং দেখিতে দেখিতে ছায়াতলে ঘুমাইয়া পড়িল। আশা বাড়ির মধ্যে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া বিশ্রামের উদ্‌যোগ করিল।
বিনোদিনী মাথার উপরে একটুখানি কাপড় তুলিয়া দিয়া কহিল, “আমি তবে ঘরে যাই।”
বিহারী কহিল, “কোথায় যাইবেন, একটু গল্প করুন। আপনাদের দেশের কথা বলুন।”
ক্ষণে ক্ষণে উষ্ণ মধ্যাহ্নের বাতাস তরুপল্লব মর্মরিত করিয়া চলিয়া গেল, ক্ষণে ক্ষণে দিঘির পাড়ে জামগাছের ঘনপত্রের মধ্য হইতে কোকিল ডাকিয়া উঠিল। বিনোদিনী তাহার ছেলেবেলাকার কথা বলিতে লাগিল, তাহার বাপমায়ের কথা, তাহার বাল্যসখির কথা। বলিতে বলিতে তাহার মাথা হইতে কাপড়টুকু খসিয়া পড়িল; বিনোদিনীর মুখে খরযৌবনের যে একটি দীপ্তি সর্বদাই বিরাজ করিত, বাল্যসমৃতির ছায়া আসিয়া তাহাকে স্নিগ্ধ করিয়া দিল। বিনোদিনীর চক্ষে যে কৌতুকতীব্র কটাক্ষ দেখিয়া তীক্ষ্ণদৃষ্টি বিহারীর মনে এ পর্যন্ত নানাপ্রকার সংশয় উপস্থিত হইয়াছিল, সেই উজ্জ্বলকৃষ্ণ জ্যোতি যখন একটি শান্তসজল রেখায় মলান হইয়া আসিল তখন বিহারী যেন আর-একটি মানুষ দেখিতে পাইল। এই দীপ্তিমণ্ডলের কেন্দ্রস্থলে কোমল হৃদয়টুকু এখনো সুধাধারায় সরস হইয়া আছে, অপরিতৃপ্ত রঙ্গরস কৌতুকবিলাসের দহনজ্বালায় এখনো নারীপ্রকৃতি শুষ্ক হইয়া যায় নাই। বিনোদিনী সলজ্জ সতীস্ত্রীভাবে একান্ত-ভক্তিভরে পতিসেবা করিতেছে, কল্যাণপরিপূর্ণা জননীর মতো সন্তানকে কোলে ধরিয়া আছে, এ ছবি ইতিপূর্বে মুহূর্তের জন্যও বিহারীর মনে উদিত হয় নাই–আজ যেন রঙ্গমঞ্চের পটখানা ক্ষণকালের জন্য উড়িয়া গিয়া ঘরের ভিতরকার একটি মঙ্গলদৃশ্য তাহার চোখে পড়িল। বিহারী ভাবিল, বিনোদিনী বাহিরে বিলাসিনী যুবতী বটে, কিন্তু তাহার অন্তরে একটি পূজারতা নারী নিরশনে তপস্যা করিতেছে।
বিহারী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মনে মনে কহিল, “প্রকৃত আপনাকে মানুষ আপনিও জানিতে পারে না, অন্তর্যামীই জানেন; অবস্থাবিপাকে যেটা বাহিরে গড়িয়া উঠে সংসারের কাছে সেইটেই সত্য।” বিহারী কথাটাকে থামিতে দিল না–প্রশ্ন করিয়াকরিয়া জাগাইয়া রাখিতে লাগিল; বিনোদিনী এ-সকল কথা এ পর্যন্ত এমন করিয়া শোনাইবার লোক পায় নাই–বিশেষত, কোনো পুরুষের কাছে সে এমন আত্মবিসমৃত স্বাভাবিক ভাবে কথা কহে নাই–আজ অজস্র কলকণ্ঠে নিতান্ত সহজ হৃদয়ের কথা বলিয়া তাহার সমস্ত প্রকৃতি যেন নববারিধারায় স্নাত, স্নিগ্ধ এবং পরিতৃপ্ত হইয়া গেল।
ভোরে উঠিবার উপদ্রবে ক্লান্ত, মহেন্দ্রের পাঁচটার সময় ঘুম ভাঙিল। বিরক্ত হইয়া কহিল, “এবার ফিরিবার উদ্‌যোগ করা যাক।”
বিনোদিনী কহিল, “আর-একটু সন্ধ্যা করিয়া গেলে কি ক্ষতি আছে।”
মহেন্দ্র কহিল, “না, শেষকালে মাতাল গোরার হাতে পড়িতে হইবে?”
জিনিসপত্র গুছাইয়া তুলিতে অন্ধকার হইয়া আসিল। এমন সময় চাকর আসিয়া খবর দিল, “ঠিকা গাড়ি কোথায় গেছে, খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না। গাড়ি বাগানের বাহিরে অপেক্ষা করিতেছিল, দুইজন গোরা গাড়োয়ানের প্রতি বল প্রকাশ করিয়া স্টেশনে লইয়া গেছে।”
আর-একটা গাড়ি ভাড়া করিতে চাকরকে পাঠাইয়া দেওয়া হইল। বিরক্ত মহেন্দ্র কেবলই মনে মনে কহিতে লাগিল, “আজ দিনটা মিথ্যা মাটি হইয়াছে।” অধৈর্য সে আর কিছুতেই গোপন করিতে পারে না, এমনি হইল।
শুক্লপক্ষের চাঁদ ক্রমে শাখাজালজড়িত দিক্‌প্রান্ত হইতে মুক্ত আকাশে আরোহণ করিল। নিস্তব্ধ নিষ্কম্প বাগান ছায়ালোকে খচিত হইয়া উঠিল। আজ এই মায়ামণ্ডিত পৃথিবীর মধ্যে বিনোদিনী আপনাকে কী একটা অপূর্বভাবে অনুভব করিল। আজ সে যখন তরুবীথিকার মধ্যে আশাকে জড়াইয়া ধরিল, তাহার মধ্যে প্রণয়ের কৃত্রিমতা কিছুই ছিল না। আশা দেখিল, বিনোদিনীর দুই চক্ষু দিয়া জল ঝরিয়া পড়িতেছে। আশা ব্যথিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কী ভাই চোখের বালি, তুমি কাঁদিতেছ কেন?”
বিনোদিনী কহিল, “কিছুই নয় ভাই, আমি বেশ আছি। আজ দিনটা আমার বড়ো ভালো লাগিল।”
আশা জিজ্ঞাসা করিল, “কিসে তোমার এত ভালো লাগিল, ভাই।”
বিনোদিনী কহিল, “আমার মনে হইতেছে, আমি যেন মরিয়া গেছি, যেন পরলোকে আসিয়াছি, এখানে যেন আমার সমস্তই মিলিতে পারে।”
বিস্মিত আশা এ-সব কথা কিছুই বুঝিতে পারিল না। সে মৃত্যুর কথা শুনিয়া দুঃখিত হইয়া কহিল, “ছি ভাই চোখের বালি, অমন কথা বলিতে নাই।”
গাড়ি পাওয়া গেল। বিহারী পুনরায় কোচবাক্সে চড়িয়া বসিল। বিনোদিনী কোনো কথা না বলিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া রহিল, জ্যোৎস্নায় স্তম্ভিত তরুশ্রেণী ধাবমান নিবিড় ছায়াস্রোতের মতো তাহার চোখের উপর দিয়া চলিয়া যাইতে লাগিল। আশা গাড়ির কোণে ঘুমাইয়া পড়িল। মহেন্দ্র সুদীর্ঘ পথ নিতান্ত বিমর্ষ হইয়া বসিয়া থাকিল।






১৮

চড়িভাতির দুর্দিনের পরে মহেন্দ্র বিনোদিনীকে আর-এক বার ভালো করিয়া আয়ত্ত করিয়া লইতে উৎসুক ছিল। কিন্তু তাহার পরদিনেই রাজলক্ষ্মী ইনফ্লুয়েজ্ঞা-জ্বরে পড়িলেন। রোগ গুরুতর নহে, তবু তাহার অসুখ ও দুর্বলতা যথেষ্ট। বিনোদিনী দিনরাত্রি তাঁহার সেবায় নিযুক্ত হইল।
মহেন্দ্র কহিল, “দিনরাত এমন করিয়া খাটিলে শেষকালে তুমিই যে অসুখে পড়িবে। মার সেবার জন্যে আমি লোক ঠিক করিয়া দিতেছি।”
বিহারী কহিল, “মহিনদা, তুমি অত ব্যস্ত হইয়ো না। উনি সেবা করিতেছেন, করিতে দাও। এমন করিয়া কি আর কেহ করিতে পারিবে।”
মহেন্দ্র রোগীর ঘরে ঘনঘন যাতায়াত আরম্ভ করিল। একটা লোক কোনো কাজ করিতেছে না, অথচ কাজের সময় সর্বদাই সঙ্গে লাগিয়া আছে, ইহা কর্মিষ্ঠা বিনোদিনীর পক্ষে অসহ্য। সে বিরক্ত হইয়া দুই-তিনবার কহিল, “মহিনবাবু, আপনি এখানে বসিয়া থাকিয়া কী সুবিধা করিতেছেন। আপনি যান–অনর্থক কালেজ কামাই করিবেন না।”


মহেন্দ্র তাহাকে অনুসরণ করে, ইহাতে বিনোদিনীর গর্ব এবং সুখ ছিল, কিন্তু তাই বলিয়া এমনতরো কাঙালপনা, রুগ্‌না মাতার শয্যাপার্শ্বেও লুব্ধহৃদয়ে বসিয়া থাকা–ইহাতে তাহার ধৈর্য থাকিত না, ঘৃণাবোধ হইত। কোনো কাজ যখন বিনোদিনীর উপর নির্ভর করে, তখন সে আর-কিছুই মনে রাখে না। যতক্ষণ খাওয়ানো-দাওয়ানো, রোগীর সেবা, ঘরের কাজ প্রয়োজন, ততক্ষণ বিনোদিনীকে কেহ অনবধান দেখে নাই-সেও প্রয়োজনের সময় কোনোপ্রকার অপ্রয়োজনীয় ব্যাপার দেখিতে পারে না।

বিহারী অল্পক্ষণের জন্য মাঝে মাঝে রাজলক্ষ্মীর সংবাদ লইতে আসে। ঘরে ঢুকিয়াই কী দরকার, তাহা সে তখনই বুঝিতে পারে–কোথায় একটা-কিছুর অভাব আছে, তাহা তাহার চোখে পড়ে–মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত ঠিক করিয়া দিয়া সে বাহির হইয়া যায়। বিনোদিনী মনে বুঝিতে পারিত, বিহারী তাহার শুশ্রূষাকে শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিতেছে। সেইজন্য বিহারীর আগমনে সে যেন বিশেষ পুরষ্কার লাভ করিত।




মহেন্দ্র নিতান্ত ধিক্‌কারবেগে অত্যন্ত কড়া নিয়মে কালেজে বাহির হইতে লগিল। একে তাহার মেজাজ অত্যন্ত রুক্ষ হইয়া রহিল, তাহার পরে এ কী পরিবর্তন। খাবার ঠিক সময়ে হয় না, সইসটা নিরুদ্দেশ হয়, মোজাজোড়ার ছিদ্র ক্রমেই অগ্রসর হইতে থাকে। এখন এই-সমস্ত বিশৃঙ্খলায় মহেন্দ্রের পূর্বের ন্যায় আমোদ বোধ হয় না। যখন যেটি দরকার, তখনি সেটি হাতের কাছে সুসজ্জিত পাইবার আরাম কাহাকে বলে, তাহা সে কয়দিন জানিতে পারিয়াছে। এক্ষণে তাহার অভাবে, আশার অশিক্ষিত অপটুতায় মহেন্দ্রের আর কৌতুকবোধ হয় না।
“চুনি, আমি তোমাকে কতদিন বলিয়াছি, স্নানের আগেই আমার জামায় বোতাম পরাইয়া প্রস্তুত রাখিবে, আর আমার চাপকান-প্যাণ্টলুন ঠিক করিয়া রাখিয়া দিবে–একদিনও তাহা হয় না। স্নানের পর বোতাম পরাইতে আর কাপড় খুঁজিয়া বেড়াইতে আমার দু ঘণ্টা যায়।”




অনুতপ্ত আশা লজ্জায় মলান হইয়া বলে, “আমি বেহারাকে বলিয়া দিয়াছিলাম।”
“বেহারাকে বলিয়া দিয়াছিলে! নিজের হাতে করিতে দোষ কী। তোমার দ্বারা যদি কোনো কাজ পাওয়া যায়!”
ইহা আশার পক্ষে বজ্রাঘাত। এমন ভর্ৎসনা সে কখনো পায় নাই। এ জবাব তাহার মুখে বা মনে আসিল না যে, “তুমিই তো আমার কর্মশিক্ষার ব্যাঘাত করিয়াছ।” এই ধারণাই তাহার ছিল না যে, গৃহকর্মশিক্ষা নিয়ত অভ্যাস ও অভিজ্ঞতাসাপেক্ষ। সে মনে করিত, “আমার স্বাভাবিক অক্ষমতা ও নির্বুদ্ধিতাবশতই কোনো কাজ ঠিকমতো করিয়া উঠিতে পারি না।” মহেন্দ্র যখন আত্মবিসমৃত হইয়া বিনোদিনীর সহিত তুলনা দিয়া আশাকে ধিক্‌কার দিয়াছে, তখন সে তাহা বিনয়ে ও বিনা বিদ্বেষে গ্রহণ করিয়াছে।
আশা এক-একবার তাহার রুগ্‌ণা শাশুড়ির ঘরের আশেপাশে ঘুরিয়া বেড়ায়–এক-একবার লজ্জিতভাবে ঘরের দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়ায়। সে নিজেকে সংসারের পক্ষে আবশ্যক করিয়া তুলিতে ইচ্ছা করে, সে কাজ দেখাইতে চায়, কিন্তু কেহ তাহার কাজ চাহে না। সে জানে না কেমন করিয়া কাজের মধ্যে প্রবেশ করা যায়, কেমন করিয়া সংসারের মধ্যে স্থান করিয়া লইতে হয়। সে নিজের অক্ষমতার সংকোচে বাহিরে বাহিরে ফিরে। তাহার কী-একটা মনোবেদনার কথা অন্তরে প্রতিদিন বাড়িতেছে, কিন্তু তাহার সেই অপরিস্ফুট বেদনা, সেই অব্যক্ত আশঙ্কাকে সে স্পষ্ট করিয়া বুঝিতে পারে না। সে অনুভব করে, তাহার চারি দিকের সমস্তই সে যেন নষ্ট করিতেছে–কিন্তু কেমন করিয়াই যে তাহা গড়িয়া উঠিয়াছিল এবং কেমন করিয়াই যে তাহা নষ্ট হইতেছে, এবং কেমন করিলে যে তাহার প্রতিকার হইতে পারে তাহা সে জানে না। থাকিয়া থাকিয়া কেবল গলা ছাড়িয়া কাঁদিয়া বলিতে ইচ্ছা করে, “আমি অত্যন্ত অযোগ্য, নিতান্ত অক্ষম, আমার মূঢ়তার কোথাও তুলনা নাই।”




পূর্বে তো আশা ও মহেন্দ্র সুদীর্ঘকালে দুইজনে এক গৃহকোণে বসিয়া কখনো কথা কহিয়া, কখনো কথা না কহিয়া, পরিপূর্ণ সুখে সময় কাটাইয়াছে। আজকাল বিনোদিনীর অভাবে আশার সঙ্গে একলা বসিয়া মহেন্দ্রের মুখে কিছুতেই যেন সহজে কথা জোগায় না–এবং কিছু না কহিয়া চুপ করিয়া থাকিতেও তাহার বাধো-বাধো ঠেকে।
মহেন্দ্র বেহারাকে জিজ্ঞাসা করিল, “ও চিঠি কাহার।”
“বিহারীবাবুর।”
“কে দিল।”
“বহু ঠাকুরাণী।” (বিনোদিনী)
“দেখি” বলিয়া চিঠিখানা লইল। ইচ্ছা হইল ছিঁড়িয়া পড়ে। দু-চারিবার উল্‌টাপাল্‌টা করিয়া নাড়িয়া-চাড়িয়া বেহারার হাতে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল। যদি চিঠি খুলিত, তবে দেখিত, তাহাতে লেখা আছে, “পিসিমা কোনোমতেই সাগু-বার্লি খাইতে চান না, আজ কি তাঁহাকে ডালের ঝোল খাইতে দেওয়া হইবে।” ঔষধপথ্য লইয়া বিনোদিনী মহেন্দ্রকে কখনো কোনো কথা জিজ্ঞাসা করিত না, সে-সম্বন্ধে বিহারীর প্রতিই তাহার নির্ভর।
মহেন্দ্র বারান্দায় খানিকক্ষণ পায়চারি করিয়া ঘরে ঢুকিয়া দেখিল, দেয়ালে টাঙানো একটা ছবির দড়ি ছিন্নপ্রায় হওয়াতে ছবিটা বাঁকা হইয়া আছে। আশাকে অত্যন্ত ধমক দিয়া কহিল, “তোমার চোখে কিছুই পড়ে না, এমনি করিয়া সমস্ত জিনিস নষ্ট হইয়া যায়।” দমদমের বাগান হইতে ফুল সংগ্রহ করিয়া যে-তোড়া বিনোদিনী পিতলের ফুলদানিতে সাজাইয়া রাখিয়াছিল, আজও তাহা শুষ্ক অবস্থায় তেমনিভাবে আছে; অন্যদিন মহেন্দ্র এ-সমস্ত লক্ষ্যই করে না–আজ তাহা চোখে পড়িল। কহিল, “বিনোদিনী আসিয়া না ফেলিয়া দিলে, ও আর ফেলাই হইবে না।” বলিয়া ফুলসুদ্ধ ফুলদানি বাহিরে ছুঁড়িয়া ফেলিল, তাহা ঠংঠং শব্দে সিঁড়ি দিয়া গড়াইয়া চলিল। “কেন আশা আমার মনের মতো হইতেছে না, কেন সে আমার মনের মতো কাজ করিতেছে না, কেন তাহার স্বভাবগত শৈথিল্য ও দুর্বলতায় সে আমাকে দাম্পত্যের পথে দৃঢ়ভাবে ধরিয়া রাখিতেছে না, সর্বদা আমাকে বিক্ষিপ্ত করিয়া দিতেছে।”–এই কথা মহেন্দ্র মনে মনে আন্দোলন করিতে করিতে হঠাৎ দেখিল, আশার মুখ পাংশুবর্ণ হইয়া গেছে, সে খাটের থাম ধরিয়া আছে, তাহার ঠোঁট দুটি কাঁপিতেছে–কাঁপিতে কাঁপিতে সে হঠাৎ বেগে পাশের ঘর দিয়া চলিয়া গেল।




মহেন্দ্র তখন ধীরে ধীরে গিয়া ফুলদানিটা কুড়াইয়া আনিয়া রাখিল। ঘরের কোণে তাহার পড়িবার টেবিল ছিল–চৌকিতে বসিয়া এই টেবিলটার উপর হাতের মধ্যে মাথা রাখিয়া অনেকক্ষণ পড়িয়া রহিল।
সন্ধ্যার পর ঘরে আলো দিয়া গেল, কিন্তু, আশা আসিল না। মহেন্দ্র দ্রুতপদে ছাদের উপর পায়চারি করিয়া বেড়াইতে লাগিল। রাত্রি নটা বাজিল, মহেন্দ্রদের লোকবিরল গৃহ রাত-দুপুরের মতো নিস্তব্ধ হইয়া গেল–তবু আশা আসিল না। মহেন্দ্র তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইল। আশা সংকুচিতপদে আসিয়া ছাদের প্রবেশদ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল। মহেন্দ্র কাছে আসিয়া তাহাকে বুকে টানিয়া লইল–মুহূর্তের মধ্যে স্বামীর বুকের উপর আশার কান্না ফাটিয়া পড়িল–সে আর থামিতে পারে না, তাহার চোখের জল আর ফুরায় না, কান্নার শব্দ গলা ছাড়িয়া বাহির হইতে চায়, সে আর চাপা থাকে না। মহেন্দ্র তাহাকে বক্ষে বদ্ধ করিয়া কেশচুম্বন করিল–নিঃশব্দ আকাশে তারাগুলি নিস্তব্ধ হইয়া চাহিয়া রহিল।
রাত্রে বিছানায় বসিয়া মহেন্দ্র কহিল, “কালেজে আমাদের নাইট-ডিউটি অধিক পড়িয়াছে, অতএব এখন কিছুকাল আমাকে কালেজের কাছেই বাসা করিয়া থাকিতে হইবে।”
আশা ভাবিল, “এখনো কি রাগ আছে। আমার উপর বিরক্ত হইয়া চলিয়া যাইতেছেন? নিজের নির্গুণতায় আমি স্বামীকে ঘর হইতে বিদায় করিয়া দিলাম? আমার তো মরা ভালো ছিল।”
কিন্তু মহেন্দ্রের ব্যবহারে রাগের লক্ষণ কিছুই দেখা গেল না। সে অনেকক্ষণ কিছু না বলিয়া আশার মুখ বুকের উপর রাখিল এবং বারংবার অঙ্গুলি দিয়া তাহার চুল চিরিতে চিরিতে তাহার খোঁপা শিথিল করিয়া দিল। পূর্বে আদরের দিনে মহেন্দ্র এমন করিয়া আশার বাঁধা চুল খুলিয়া দিত–আশা তাহাতে আপত্তি করিত। আজ আর সে তাহাতে কোনো আপত্তি না করিয়া পুলকে বিহ্বল হইয়া চুপ করিয়া রহিল। হঠাৎ এক সময় তাহার ললাটের উপর অশ্রুবিন্দু পড়িল, এবং মহেন্দ্র তাহার মুখ তুলিয়া ধরিয়া স্নেহরুদ্ধ স্বরে ডাকিল, “চুনি।” আশা কথায় তাহার কোনো উত্তর না দিয়া দুই কোমল হস্তে মহেন্দ্রকে চাপিয়া ধরিল। মহেন্দ্র কহিল, “অপরাধ করিয়াছি, আমাকে মাপ করো।”
আশা তাহার কুসুম-সুকুমার করপল্লব মহেন্দ্রের মুখের উপর চাপা দিয়া কহিল,”না, না, অমন কথা বলিয়ো না। তুমি কোনো অপরাধ কর নাই। সকল দোষ আমার। আমাকে তোমার দাসীর মতো শাসন করো। আমাকে তোমার চরণাশ্রয়ের যোগ্য করিয়া লও।”




বিদায়ের প্রভাতে শয্যাত্যাগ করিবার সময় মহেন্দ্র কহিল, “চুনি, আমার রত্ন, তোমাকে আমার হৃদয়ে সকলের উপরে ধারণ করিয়া রাখিব, সেখানে কেহ তোমাকে ছাড়াইয়া যাইতে পারিবে না।”
তখন আশা দৃঢ়চিত্তে সর্বপ্রকার ত্যাগস্বীকারে প্রস্তুত হইয়া স্বামীর নিকট নিজের একটিমাত্র ক্ষুদ্র দাবি
দাখিল করিল। কহিল, “তুমি আমাকে রোজ একখানি করিয়া চিঠি দিবে?”
মহেন্দ্র কহিল, “তুমিও দিবে?” আশা কহিল, “আমি কি লিখিতে জানি।”
মহেন্দ্র তাহার কানের কাছে অলকগুচ্ছ টানিয়া দিয়া কহিল, “তুমি অক্ষয়কুমার দত্তের চেয়ে ভালো
লিখিতে পার-চারুপাঠ যাহাকে বলে।”
আশা কহিল, “যাও, আমাকে আর ঠাট্টা করিয়ো না।”
যাইবার পূর্বে আশা যথাসাধ্য নিজের হাতে মহেন্দ্রের পোর্টম্যাণ্টো সাজাইতে বসিল। মহেন্দ্রের মোটা মোটা শীতের কাপড় ঠিকমতো ভাঁজ করা কঠিন, বাক্সে ধরানো শক্ত–উভয়ে মিলিয়া কোনোমতে চাপাচাপি ঠাসাঠুসি করিয়া, যাহা এক বাক্সে ধরিত, তাহাতে দুই বাক্স বোঝাই করিয়া তুলিল। তবু যাহা ভুলক্রমে বাকি রহিল, তাহাতে আরো অনেকগুলি স্বতন্ত্র পুঁটুলির সৃষ্টি হইল। ইহা লইয়া আশা যদিও বার বার লজ্জাবোধ করিল, তবু তাহাদের কাড়াকাড়ি, কৌতুক ও পরস্পরের প্রতি সহাস্য দোষারোপে পূর্বেকার আনন্দের দিন ফিরিয়া আসিল। এ যে বিদায়ের আয়োজন হইতেছে, তাহা আশা ক্ষণকালের জন্য ভুলিয়া গেল। সহিস দশবার গাড়ি তৈয়ারির কথা মহেন্দ্রকে স্মরণ করাইয়া দিল, মহেন্দ্র কানে তুলিল না–অবশেষে বিরক্ত হইয়া বলিল, “ঘোড়া খুলিয়া দাও।”
সকাল ক্রমে বিকাল হইয়া গেল, বিকাল সন্ধ্যা হয়। তখন স্বাসথ্যপালন করিতে পরস্পরকে সতর্ক করিয়া দিয়া এবং নিয়মিত চিঠি লেখা সম্বন্ধে বারংবার প্রতিশ্রুত করাইয়া লইয়া ভারাক্রান্ত হৃদয়ে পরস্পরের বিচ্ছেদ হইল।




রাজলক্ষ্মী আজ দুইদিন হইল উঠিয়া বসিয়াছেন। সন্ধ্যাবেলায় গায়ে মোটা কাপড় মুড়ি দিয়া বিনোদিনীর সঙ্গে তাস খেলিতেছেন। আজ তাঁহার শরীরে কোনো গ্লানি নাই। মহেন্দ্র ঘরে প্রবেশ করিয়া বিনোদিনীর দিকে একেবারেই চাহিল না–মাকে কহিল, “মা, কালেজে আমার রাত্রের কাজ পড়িয়াছে, এখানে থাকিয়া সুবিধা হয় না–কালেজের কাছে বাসা লইয়াছি। সেখানে আজ হইতে থাকিব।”
রাজলক্ষ্মী মনে মনে অভিমান করিয়া কহিলেন, “তা যাও। পড়ার ক্ষতি হইলে কেমন করিয়া থাকিবে।”
যদিও তাঁহার রোগ সারিয়াছে, তবু মহেন্দ্র যাইবে শুনিয়া তখনি তিনি নিজেকে অত্যন্ত রুগ্‌ণ ও দুর্বল বলিয়া কল্পনা করিলেন; বিনোদিনীকে বলিলেন, “দাও তো বাছা, বালিশটা আগাইয়া দাও।” বলিয়া বালিশ
অবলম্বন করিয়া শুইলেন, বিনোদিনী আস্তে আস্তে তাঁহার গায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল।
মহেন্দ্র একবার মার কপালে হাত দিয়া দেখিল, তাঁহার নাড়ী পরীক্ষা করিল। রাজলক্ষ্মী হাত ছাড়াইয়া লইয়া কহিলেন, “নাড়ী দেখিয়া তো ভারি বোঝা যায়। তোর আর ভাবিতে হইবে না, আমি বেশ আছি।” বলিয়া অত্যন্ত দুর্বলভাবে পাশ ফিরিয়া শুইলেন।
মহেন্দ্র বিনোদিনীকে কোনোপ্রকার বিদায়সম্ভাষণ না করিয়া রাজলক্ষ্মীকে প্রণাম করিয়া চলিয়া গেল।






১৯

বিনোদিনী মনে মনে ভাবিতে লাগিল, “ব্যাপারখানা কী! অভিমান, না রাগ, না ভয়? আমাকে দেখাইতে চান, আমাকে কেয়ার করেন না? বাসায় গিয়া থাকিবেন? দেখি কত দিন থাকিতে পারেন?”
কিন্তু বিনোদিনীরও মনে মনে একটা অশান্ত ভাব উপস্থিত হইল।
মহেন্দ্রকে সে প্রতিদিন নানা পাশে বদ্ধ ও নানা বাণে বিদ্ধ করিতেছিল, সে-কাজ গিয়া বিনোদিনী যেন এ-পাশ ও-পাশ করিতে লাগিল। বাড়ি হইতে তাহার সমস্ত নেশা চলিয়া গেল। মহেন্দ্রবর্জিত আশা তাহার কাছে নিতান্তই স্বাদহীন। আশার প্রতি মহেন্দ্রের সোহাগ-যত্ন বিনোদিনীর প্রণয়বঞ্চিত চিত্তকে সর্বদাই আলোড়িত করিয়া তুলিত–তাহাতে বিনোদিনীর বিরহিণী কল্পনাকে যে বেদনায় জাগরূক করিয়া রাখিত তাহার মধ্যে উগ্র উত্তেজনা ছিল। যে-মহেন্দ্র তাহাকে তাহার সমস্ত জীবনের সার্থকতা হইতে ষ্টি করিয়াছে, যে-মহেন্দ্র তাহার মতো স্ত্রীরত্নকে উপেক্ষা করিয়া আশার মতো ক্ষীণবুদ্ধি দীনপ্রকৃতি বালিকাকে বরণ করিয়াছে, তাহাকে বিনোদিনী ভালোবাসে কি বিদ্বেষ করে, তাহাকে কঠিন শাস্তি দিবে না তাহাকে হৃদয়সমর্পণ করিবে, তাহা বিনোদিনী ঠিক করিয়া বুঝিতে পারে নাই। একটা জ্বালা মহেন্দ্র তাহারঅন্তরে জ্বালাইয়াছে, তাহা হিংসার না প্রেমের, না দুয়েরই মিশ্রণ, বিনোদিনী তাহা ভাবিয়া পায় না; মনে মনে তীব্র হাসি হাসিয়া বলে, “কোনো নারীর কি আমার মতো এমন দশা হইয়াছে। আমি মরিতে চাই কি মারিতে চাই, তাহা বুঝিতেই পারিলাম না।” কিন্তু যে কারণেই বল, দগ্ধ হইতেই হউক বা দগ্ধ করিতেই হউক, মহেন্দ্রকে তাহার একান্ত প্রয়োজন। সে তাহার বিষদিগ্ধ অগ্নিবাণ জগতে কোথায় মোচন করিবে। ঘন নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে বিনোদিনী কহিল, “সে যাইবে কোথায়। সে ফিরিবেই। সে আমার।”




আশা ঘর পরিষ্কার করিবার ছুতা করিয়া সন্ধ্যার সময় মহেন্দ্রের বাহিরের ঘরে, মাথার-তেলে-দাগ-পড়া মহেন্দ্রের বসিবার কেদারা, কাগজপত্র-ছড়ানো ডেসক্‌, তাহার বই, তাহার ছবি প্রভৃতি জিনিসপত্র বার বার নাড়াচাড়া এবং অঞ্চল দিয়া ঝাড়-পোঁচ করিতেছিল। এইরূপে মহেন্দ্রের সকল জিনিস নানা রূপে স্পর্শ করিয়া, একবার রাখিয়া, একবার তুলিয়া, আশার বিরহসন্ধ্যা কাটিতেছিল। বিনোদিনী ধীরে ধীরে তাহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল; আশা ঈষৎ লজ্জিত হইয়া তাহার নাড়াচাড়ার কাজ রাখিয়া দিয়া, কী যেন খুঁজিতেছে এমনিতরো ভান করিল। বিনোদিনী গম্ভীরমুখে জিজ্ঞাসা করিল, “কী হচ্ছে তোর, ভাই!”
আশা মুখে একটুখানি হাসি জাগাইয়া কহিল, “কিছুই না, ভাই।”
বিনোদিনী তখন আশার গলা জড়াইয়া কহিল, “কেন ভাই বালি, ঠাকুরপো এমন করিয়া চলিয়া গেলেন কেন।”




আশা বিনোদিনীর এই প্রশ্নমাত্রেই সংশয়ান্বিত সশঙ্কিত হইয়া উত্তর করিল, “তুমি তো জানই, ভাই-কোলেজে তাঁহার বিশেষ কাজ পড়িয়াছে বলিয়া গেছেন।”
বিনোদিনী ডান হাতে আশার চিবুক তুলিয়া ধরিয়া যেন করুণায় বিগলিত হইয়া স্তব্ধভাবে একবার তাহার মুখ নিরীক্ষণ করিয়া দেখিল এবং দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।
আশার বুক দমিয়া গেল। নিজেকে সে নির্বোধ এবং বিনোদিনীকে বুদ্ধিমতী বলিয়া জানিত। বিনোদিনীর ভাবখানা দেখিয়া হঠাৎ তাহার বিশ্বসংসার অন্ধকার হইয়া উঠিল। সে বিনোদিনীকে স্পষ্ট করিয়া কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে সাহস করিল না। দেয়ালের কাছে একটা সোফার উপরে বসিল। বিনোদিনীও তাহার পাশে বসিয়া দৃঢ় বাহু দিয়া আশাকে বুকের কাছে বাঁধিয়া ধরিল। সখীর সেই আলিঙ্গনে আশা আর আত্মসংবরণ করিতে পারিল না, তাহার দুই চক্ষু দিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। দ্বারের কাছে অন্ধ ভিখারি খঞ্জনি বাজাইয়া গাহিতেছিল, “চরণতরণী দে মা, তারিণী তারা।”




বিহারী মহেন্দ্রের সন্ধানে আসিয়া দ্বারের কাছে পৌঁছিতেই দেখিল–আশা কাঁদিতেছে, এবং বিনোদিনী তাহাকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়া ধীরে ধীরে তাহার চোখ মুছাইয়া দিতেছে। দেখিয়াই বিহারী সেখান হইতে সরিয়া দাঁড়াইল। পাশের শূন্য ঘরে গিয়া অন্ধকারে বসিল। দুই করতলে মাথা চাপিয়া ধরিয়া ভাবিতে লাগিল, আশা কেন কাঁদিবে। যে মেয়ে স্বভাবতই কাহারো কাছে লেশমাত্র অপরাধ করিতে অক্ষম, তাহাকেও কাঁদাইতে পারে এমন পাষণ্ড জগতে কে আছে! তার পরে বিনোদিনী যেমন করিয়া সান্ত্বনা করিতেছিল, তাহা মনে আনিয়া মনে মনে কহিল, “বিনোদিনীকে ভারি ভুল বুঝিয়াছিলাম। সেবায় সান্ত্বনায়, নিঃস্বার্থ সখীপ্রেমে সে মর্তবাসিনী দেবী।”
বিহারী অনেকক্ষণ অন্ধকারে বসিয়া রহিল। অন্ধের গান থামিয়া গেলে বিহারী সশব্দে পা ফেলিয়া, কাশিয়া, মহেন্দ্রের ঘরের দিকে চলিল। দ্বারের কাছে না যাইতেই ঘোমটা টানিয়া আশা দ্রুতপদে অন্তঃপুরের দিকে ছুটিয়া গেল।
ঘরে ঢুকিতেই বিনোদিনী বলিয়া উঠিল, “এ কী বিহারীবাবু! আপনার কি অসুখ করিয়াছে।”
বিহারী। কিছু না।
বিনোদিনী। চোখ দুটো অমন লাল কেন।
বিহারী তাহার উত্তর না দিয়া কহিল, “বিনোদ-বোঠান, মহেন্দ্র কোথায় গেল।”
বিনোদিনী মুখ গম্ভীর করিয়া কহিল, “শুনিলাম, হাসপাতালে তাঁহার কাজ পড়িয়াছে বলিয়া কালেজের কাছে তিনি বাসা করিয়া আছেন। বিহারীবাবু একটু সরুন, আমি তবে আসি।”




অন্যমনস্ক বিহারী দ্বারের কাছে বিনোদিনীর পথরোধ করিয়া দাঁড়াইয়াছিল। চকিত হইয়া তাড়াতাড়ি পথ ছাড়িয়া দিল। সন্ধ্যার সময় একলা বাহিরের ঘরে বিনোদিনীর সঙ্গে কথাবার্তা লোকের চক্ষে সুদৃশ্য নয়, সে কথা হঠাৎ মনে পড়িল। বিনোদিনীর চলিয়া যাইবার সময় বিহারী তাড়াতাড়ি বলিয়া লইল, “বিনোদ-বোঠান, আশাকে তুমি দেখিয়ো। সে সরলা, কাহাকেও আঘাত করিতেও জানে না, নিজেকে আঘাত হইতে বাঁচাইতেও পারে না।”
বিহারী অন্ধকারে বিনোদিনীর মুখ দেখিতে পাইল না, সে মুখে হিংসার বিদ্যুৎ খেলিতে লাগিল। আজ বিহারীকে দেখিয়াই সে বুঝিয়াছিল যে, আশার জন্য করুণায় তাহার হৃদয় ব্যথিত। বিনোদিনী নিজে কেহই নহে! আশাকে ঢাকিয়া রাখিবার জন্য, আশার পথের কাঁটা তুলিয়া দিবার জন্য, আশার সমস্ত সুখ সম্পূর্ণ করিবার জন্যই তাহার জন্ম! শ্রীযুক্ত মহেন্দ্রবাবু আশাকে বিবাহ করিবেন, সেইজন্য অদৃষ্টের তাড়নায় বিনোদিনীকে বারাসতের বর্বর বানরের সহিত বনবাসিনী হইতে হইবে। শ্রীযুক্ত বিহারীবাবু সরলা আশার চোখের জল দেখিতে পারেন না, সেইজন্য বিনোদিনীকে তাহার আঁচলের প্রান্ত তুলিয়া সর্বদা প্রস্তুত হইয়া থাকিতে হইবে। একবার এই মহেন্দ্রকে, এই বিহারীকে, বিনোদিনী তাহার পশ্চাতের ছায়ার সহিত ধুলায় লুণ্ঠিত করিয়া বুঝাইতে চায়, আশাই বা কে আর বিনোদিনীই বা কে! দুজনের মধ্যে কত প্রভেদ! প্রতিকূল ভাগ্য-বশত বিনোদিনী আপন প্রতিভাকে কোনো পুরুষের চিত্তক্ষেত্রে অব্যাহতভাবে জয়ী করিতে না পারিয়া জ্বলন্ত শক্তিশেল উদ্যত করিয়া সংহারমূর্তি ধরিল।
অত্যন্ত মিষ্টস্বরে বিনোদিনী বিহারীকে বলিয়া গেল, “আপনি নিশ্চিন্ত থাকিবেন, বিহারীবাবু। আমার চোখের বালির জন্য ভাবিয়া ভাবিয়া নিজেকে বেশি কষ্ট দিবেন না।”






২০

অনতিকাল পরেই মহেন্দ্র তাহার ছাত্রাবাসে চেনা হাতের অক্ষরে একখানি চিঠি পাইল। দিনের বেলা গোলমালের মধ্যে খুলিল না–বুকের কাছে পকেটের মধ্যে পুরিয়া রাখিল। কালেজে লেকচার শুনিতে শুনিতে, হাসপাতাল ঘুরিতে ঘুরিতে, হঠাৎ এক-একবার মনে হইতে লাগিল, ভালোবাসার একটা পাখি তাহার বুকের নীড়ে বাসা করিয়া ঘুমাইয়া আছে। তাহাকে জাগাইয়া তুলিলেই তাহার সমস্ত কোমল কূজন কানে ধ্বনিত হইয়া উঠিবে।
সন্ধ্যায় এক সময় মহেন্দ্র নির্জন ঘরে ল্যাম্পের আলোকে চৌকিতে বেশ করিয়া হেলান দিয়া আরাম করিয়া বসিল। পকেট হইতে তাহার দেহতাপতপ্ত চিঠিখানি বাহির করিয়া লইল। অনেকক্ষণ চিঠি না খুলিয়া লেফাফার উপরকার শিরোনামা নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতে লাগিল। মহেন্দ্র জানিত, চিঠির মধ্যে বেশি কিছু কথা নাই। আশা নিজের মনের ভাব ঠিকমতো ব্যক্ত করিয়া লিখিতে পারিবে, এমন সম্ভাবনা ছিল না। কেবল তাহার কাঁচা অক্ষরে বাঁকা লাইনে তাহার মনের কোমল কথাগুলি কল্পনা করিয়া লইতে হইবে। আশার কাঁচা হাতে বহুযত্নে লেখা নিজের নামটি পড়িয়া মহেন্দ্র নিজের নামের সঙ্গে যেন একটা রাগিনী শুনিতে পাইল–তাহা সাধ্বী নারীহেৃদয়ের অতি নিভৃত বৈকুণ্ঠলোক হইতে একটি নির্মল প্রেমের সংগীত।
এই দুই-একদিনের বিচ্ছেদে মহেন্দ্রের মন হইতে দীর্ঘ-মিলনের সমস্ত অবসাদ দূরহইয়া সরলা বধূর নবপ্রেমে উদ্‌ভাসিত সুখস্মৃতি আবার উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে। শেষাশেষি প্রাত্যহিক ঘরকন্নার খুঁটিনাটি অসুবিধা তাহাকে উত্ত্যক্ত করিতে আরম্ভ করিয়াছিল, সে-সমস্ত অপসারিত হইয়া কেবলমাত্র কর্মহীন কারণহীন একটি বিশুদ্ধ প্রেমানন্দের আলোকে আশার মানসীমূর্তি তাহার মনের মধ্যে প্রাণ পাইয়া উঠিয়াছে।
মহেন্দ্র অতি ধীরে ধীরে লেফাফা ছিঁড়িয়া চিঠিখানা বাহির করিয়া নিজের ললাটে কপোলে বুলাইয়া লইল। একদিন মহেন্দ্র যে-এসেন্স আশাকে উপহার দিয়াছিল, সেই এসেন্সের গন্ধ চিঠির কাগজ হইতে উতলা দীর্ঘনিশ্বাসের মতো মহেন্দ্রের হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করিল।


ভাঁজ খুলিয়া মহেন্দ্র চিঠি পড়িল। কিন্তু এ কী। যেমন বাঁকাচোরা লাইন, তেমন সাদাসিধা ভাষা নয় তো। কাঁচা-কাঁচা অক্ষর, কিন্তু কথাগুলি তো তাহার সঙ্গে মিলিল না। লেখা আছে-

“প্রিয়তম, যাহাকে ভুলিবার জন্য চলিয়া গেছ,এ লেখায় তাহাকে স্মরণ করাইয়া দিব কেন। যে লতাকে ছিঁড়িয়া মাটিতে ফেলিয়া দিলে, সে আবার কোন্‌ লজ্জায় জড়াইয়া উপরে উঠিতে চেষ্টা করে। সে কেন মাটির সঙ্গে মাটি হইয়া মিশিয়া গেল না!
“কিন্তু এটুকুতে তোমার কী ক্ষতি হইবে, নাথ। নাহয় ক্ষণকালের জন্য মনে পড়িলই বা। মনে তাহাতে কতটুকুই বা বাজিবে। আর, তোমার অবহেলা যে কাঁটার মতো আমার পাঁজরের ভিতরে প্রবেশ করিয়া রহিল। সকল দিন, সকল রাত, সকল কাজ, সকল চিন্তার মধ্যে যে দিকে ফিরি, সেই দিকেই যে আমাকে বিঁধিতে লাগিল। তুমি যেমন করিয়া ভুলিলে, আমাকে তেমনি করিয়া ভুলিবার একটা উপায় বলিয়া দাও।




“নাথ, তুমি যে আমাকে ভালোবাসিয়াছিলে, সে কি আমারই অপরাধ। আমি কি স্বপ্নেও এত সৌভাগ্য প্রত্যাশা করিয়াছিলাম। আমি কোথা হইতে আসিলাম, আমাকে কে জানিত। আমাকে যদি না চাহিয়া দেখিতে, আমাকে যদি তোমার ঘরে বিনা-বেতনের দাসী হইয়া থাকিতে হইত, আমি কি তোমাকে কোনো দোষ দিতে পারিতাম। তুমি নিজেই আমার কোন্‌ গুণে ভুলিলে প্রিয়তম, কী দেখিয়া আমার এত আদর বাড়াইলে। আর, আজ বিনা-মেঘে যদি বজ্রপাতই হইল, তবে সে বজ্র কেবল দগ্ধ করিল কেন। একেবারে দেহমন কেন ছাই করিয়া দিল না।
“এই দুটো দিনে অনেক সহ্য করিলাম, অনেক ভাবিলাম, কিন্তু, একটা কথা বুঝিতে পারিলাম না-ঘরে থাকিয়াও কি তুমি আমাকে ফেলিতে পারিতে না। আমার জন্যও কি তোমার ঘর ছাড়িয়া যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল। আমি কি তোমারএতখানি জুড়িয়া আছি। আমাকে তোমার ঘরের কোণে, তোমার দ্বারের বাহিরে ফেলিয়া রাখিলেও কি আমি তোমার চোখে পড়িতাম। তাই যদি হয়, তুমি কেন গেলে, আমার কি কোথাও যাইবার পথ ছিল না। ভাসিয়া আসিয়াছি, ভাসিয়া যাইতাম।”




এ কী চিঠি। এ ভাষা কাহার, তাহা মহেন্দ্রের বুঝিতে বাকি রহিল না। অকস্মাৎ আহত মূর্ছিতের মতো মহেন্দ্র সে-চিঠিখানি লইয়া স্তম্ভিত হইয়া রহিল। যে-লাইনে রেলগাড়ির মতো তাহার মন পূর্ণবেগে ছুটিয়াছিল, সেই লাইনেই বিপরীত দিক হইতে একটা ধাক্কা খাইয়া লাইনের বাহিরে তাহার মনটা যেন উল্‌টাপাল্‌টা স্তূপাকার বিকল হইয়া পড়িয়া থাকিল।
অনেকক্ষণ চিন্তা করিয়া আবার সে দুইবার তিনবার করিয়া পড়িল। কিছুকাল যাহা সুদূর আভাসের মতো ছিল, আজ তাহা যেন ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। তাহার জীবনাকাশের এক কোণে যে ধূমকেতুটা ছায়ার মতো দেখাইতেছিল, আজ তাহার উদ্যত বিশাল পুচ্ছ অগ্নিরেখায় দীপ্যমান হইয়া দেখা দিল।
এ চিঠি বিনোদিনীরই। সরলা আশা নিজের মনে করিয়া তাহা লিখিয়াছে। পূর্বে যে কথা সে কখনো ভাবে নাই, বিনোদিনীর রচনামত চিঠি লিখিতে গিয়া সেই-সব কথা তাহার মনে জাগিয়া উঠিতে লাগিল।নকল-করা কথা বাহির হইতে বদ্ধমূল হইয়া তাহার আন্তরিক হইয়া গেল; যে-নূতন বেদনার সৃষ্টি হইল, এমন সুন্দর করিয়া তাহা ব্যক্ত করিতে আশা কখনোই পারিত না। সে ভাবিতে লাগিল, “সখী আমার মনের কথা এমন ঠিকটি বুঝিল কী করিয়া। কেমন করিয়া এমন ঠিকটি প্রকাশ করিয়া বলিল।” অন্তরঙ্গ সখীকে আশা আরো যেন বেশি আগ্রহের সঙ্গে আশ্রয় করিয়া ধরিল, কারণ, যে-ব্যথাটা তাহার মনের মধ্যে, তাহার ভাষাটি তাহার সখীর কাছে–সে এতই নিরুপায়।
মহেন্দ্র চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া ূি কুঞ্চিত করিয়া বিনোদিনীর উপর রাগ করিতে অনেক চেষ্টা করিল, মাঝে থেকে রাগ হইল আশার উপর। “দেখো দেখি, আশার এ কী মূঢ়তা, স্বামীর প্রতি এ কী অত্যাচার।” বলিয়া চৌকিতে বসিয়া পড়িয়া প্রমাণস্বরূপ চিঠিখানা আবার পড়িল। পড়িয়া ভিতরে ভিতরে একটা হর্ষসঞ্চার হইতে লাগিল। চিঠিখানাকে সে আশারই চিঠি মনে করিয়া পড়িবার অনেক চেষ্টা করিল। কিন্তু এ ভাষায় কেনোমতেই সরলা আশাকে মনে করাইয়া দেয় না। দু-চার লাইন পড়িবামাত্র একটা সুখোন্মাদকর সন্দেহ ফেনিল মদের মতো মনকে চারি দিকে ছাপাইয়া উঠিতে থাকে। এই প্রচ্ছন্ন অথচ ব্যক্ত, নিষিদ্ধ অথচ নিকটাগত, বিষাক্ত অথচ মধুর, একই কালে উপহৃত অথচ প্রত্যাহৃত প্রেমের আভাস মহেন্দ্রকে মাতাল করিয়া তুলিল। তাহার ইচ্ছা করিতে লাগিল, নিজের হাতে-পায়ে কোথাও এক জায়গায় ছুরি বসাইয়া বা আর কিছু করিয়া নেশা ছুটাইয়া মনটাকে আর-কোনো দিকে বিক্ষিপ্ত করিয়া দেয়। টেবিলে সজোরে মুষ্টি বসাইয়া চৌকি হইতে লাফাইয়া উঠিয়া কহিল, “দূর করো, চিঠিখানা পুড়াইয়া ফেলি।” বলিয়া চিঠিখানি ল্যাম্পের কাছাকাছি লইয়া গেল। পুড়াইল না, আর-একবার পড়িয়া ফেলিল। পরদিন ভৃত্য টেবিল হইতে কাগজপোড়া ছাই অনেক ঝাড়িয়া ফেলিয়াছিল। কিন্তু তাহা আশার চিঠির ছাই নহে, চিঠির উত্তর দিবার অনেকগুলো অসম্পূর্ণ চেষ্টাকে মহেন্দ্র পুড়াইয়া ছাই করিয়াছে।

0 comments:

Post a Comment