পথে প্রবাসে
অন্নদাশংকর রায়
ভারতবর্ষের মাটির ওপর থেকে শেষবারের মতো পা তুলে নিলুম আর সদ্যোজাত শিশুর মতো মায়ের সঙ্গে আমার যোগসুত্র এক মুহুর্তে
ছিন্ন হয়ে গেল। একটি পদক্ষেপে যখন সমগ্র ভারতবর্ষের কক্ষচ্যুত হয়ে অনন্ত শুন্যে পা
বাড়ালুম তখন যেখান থেকে পা তুলে নিলুম সেই পদ-পরিমাণ ভূমি যেন আমাকে গোটা ভারতবর্ষেরই স্পর্শ-বিরহ অনুভব করিয়ে দিচ্ছিল; প্রিয়জনের
আঙুলের ডগাটুকুর স্পর্শ যেমন প্রিয়জনের সকল দেহের সম্পূর্ণ স্পর্শ অনুভব করিয়ে দেয়,
এও যেন তেমনি।
জাহাজে উঠে বম্বে দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি
করুণ। এত বড়ো ভারতবর্ষ এসে এতটুকু
নগরপ্রান্তে ঠেকেছে, আর কয়েক মুহূর্তে ওটুকুও স্বপ্ন হবে, তখন মনে হবে আরব্য উপন্যাসের
প্রদীপটা যেমন বিরাটাকার দৈত্য হয়ে আলাদিনের দৃষ্টি জুড়েছিল, ভারতবর্ষের মানচিত্রখানা
তেমনি মাটি জল ফুল পাখি মানুষ হয়ে আজন্ম আমার চেতনা হয়েছিল, এতদিনে আবার যেন মানচিত্রে
রূপান্তরিত হয়েছে।
আর মানচিত্রে যাকে ভারতবর্ষ ও আফ্রিকার মাঝখানে
গোস্পদের মটো দেখাত সেই এখন হয়েছে
পায়ের তলার আরব সাগর, পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ কোনো দিকে চক্ষু তার অবধি পায় না। ঢেউগুলো তার অনুচর হয়ে আমাদের জাহাজখানাকে যেন গলাধাক্কা দিতে দিতে তার চৌকাঠ পার
করে দিতে চলেছে। ঋতুটার নাম বর্ষা কতু, মনসুনের প্রভঞ্জনাহুতি পেয়ে সমুদ্র তার শত
সহস্র জিহ্বা লকলক করছে, জাহাজখানাকে একবার এদিকে কাৎ করে একবার ওদিক কাৎ করে যেন ফুটন্ত
তেলে পাঁপরের মতো উল্টে পাল্টে ভাজছে।
জাহাজ টলতে টলতে চলল, আর জাহাজের অধিকাংশ
যাত্রি-ত্রিণী ডেক ছেড়ে শ্যা আশ্রয় করলেন। অসহ্য সমুদ্রপীড়ায় প্রথম তিন দিন আচ্ছন্নের
মতো কাটল, কারুর সঙ্গে দেখা হবার জো ছিল না, প্রত্যেকেই
নিজের নিজের ক্যাবিনে শয্যাশায়ী। মাঝে মাঝে দু'একজন সৌভাগ্যবান দেখা দিয়ে আশ্বসন
করেন, ডেকের খবর দিয়ে যান। আর ক্যাবিন স্টুয়ার্ড খাবার দিয়ে যায়। বলা বাহুল্য জিহবা
তা গ্রহণ করতে আপত্তি না করলেও উদর তা রক্ষণ করতে অস্বীকার করে।
ক্যাবিনে পড়ে পড়ে মনে ও উপবাসে দিনের পর
রাত রাতের পর দিন এমন দুঃখে কাটে যে, কেউবা ভাবে যে মরণ হলেই বাঁচি, কেউ-বা ভাবে যে
মরতে আর দেরি নেই। জানিনে হরবল্লভের মতাে কেউ ভাবে কি না যে, মরে তো গেছি দুর্গানাম করে কী হবে। সমুদ্রপীড়া যে
কী দুঃসহ তা ভুক্তভােগী ছাড়া অপর কেউ ধারণা করতে পারবে না। হাতের কাছে রবীন্দ্রনাথের
'চয়নিকা’, মাথার যন্ত্রণায় অমন লোভনীয় বইও পড়তে
ইচ্ছা করে না। ইচ্ছা করে কেবল চুপ করে পড়ে থাকতে,
পড়ে পড়ে আকাশ পাতাল ভবতে।।
সদ্য-দুঃখার্ত কেউ সংকল্প করে ফেললেন যে,
এডেনে নেমেই দেশে ফিরে যাবেন, সমুদ্রযাত্রার দুর্ভোগ আর সইতে পারবেন না। তাকে স্মরণ
করিয়ে দেওয়া হলো এডেন থেকে দেশে ফিরে
যেতে চাইলেও উঠের পিঠে চড়ে মরুভূমি পেরিয়ে পারস্যের ভিতর দিয়ে ফেরবার যখন উপায়
নেই তখন ফিরতে হবে সেই সমুদ্রপথেই। আমরা অনেকেই কিন্তু ঠিক করে ফেললুম মার্সেসে নেমে
প্যারিসের পথে লন্ডন যাব।
আরব সাগরের পরে যখন লোহিত সাগরে পড়লুম তখন সমুদ্রপীড়া বাসি হয়ে গেছে। আফ্রিকা-আরবের
মধ্যবর্তী এই হ্রদতুল্য সমুদ্রটি দুর্দান্ত নয়, জাহাজে থেকে থেকে জাহাজটার ওপর মায়াও
পড়ে গেছে; তখন না মনে পড়ছে দেশকে, না ধারণা করতে পারা যাচ্ছে বিদেশকে; কোথা থেকে
এসেছি ভুলে গেছি, কোথায় যাচ্ছি বুঝতে পারছিনে; তখন গতি আনন্দে কেবল ভেসে চলতেই ইচ্ছা
করে, কোথাও থামবার বা নামবার সংকল্প দূর হয়ে যায়।
বিগত ও আগতের ভাবনা না ভেবে উপস্থিতের উপর
দৃষ্টি ফেললুম—আপাতত আমাদের এই ভাসমান পান্থশালাটায় মন ন্যস্ত করলুম। খাওয়া -শোওয়া-খেলা-পড়া-গজ করার যেমন বন্দোবস্ত যে-কোনো বড়ো হােটেলে থাকে এখানেও
তেমনি, কেবল কাবিনগুলো যা যথেষ্ট বড়ো নয়। ক্যাবিনে শুয়ে থেকে সিন্ধু-জননীর দোল
খেয়ে মনে হয় খোকাদের মতো দোলনায় শুয়ে দুলছি। সমুদ্রপীড়া যেই সারল ক্যাবিনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক
অমনি কমলো। শোবার
সময়টা ছাড়া বাকি সময়টা আমরা ডেকে কিংবা বসবার ঘরে কাটাতুম। ডেকেচেয়ার ফেলে বসে
কিংবা পায়চারি করতে করতে সমুদ্র দেখে দেখে চোখ শ্রান্ত হয়ে যায়; চারিদিকে জল আর
জল, তাও নিস্তরঙ্গ, কেবল জাহাজের আশে পাশে ছাড়া ঢেউয়ের অস্তিত্ব নেই, যা আছে তা বাতাসের
সোহাগ-চুম্বনে জলের হৃদয়-স্পন্দন। বসবার ঘরে অর্ধশায়িত থেকে
খােশ গল্প করতে এর চেয়ে অনেক ভালো লাগে।
লােহিত সাগরের পরে ভূমধ্য সাগর, দুয়ের মাঝখানে
যেন একটি সেতু ছিল, নাম সুয়েজ যােজক। এই যোজকের ঘটকালিতে এশিয়া
এসে আফ্রিকার হাত ধরেছিল। সম্প্রতি হাতের জোড় খুলে দুই মহাদেশের মাঝখানে বিয়োগ ঘটিয়ে দেওয়া হয়েছে। যার দ্বারা তা ঘটল তার নাম সুয়েজ
কেনাল। সুয়েজ কেনাল একদিকে বিচ্ছেদ ঘটাল বটে, কিন্তু অন্যদিকে মিলন ঘটাল—লোহিতের সঙ্গে ভূমধ্যের মিলন যেন ভারতের সঙ্গে ইউরােপের মিলন।
কলম্বাস যা পারেননি, লেসেপস তা পারলেন। ভূমধ্য ও লোহিতের
মধ্যে কয়েক শত মাইলের ব্যবধান, ঐটুকুর জন্যে ভূমধ্যের জাহাজকে লােহিতে আসতে বহু সহস্র
মাইল ঘুরে আসতে হতো। মিশরের রাজারা কোন্ যুগ থেকে এর
প্রতিকারের উপায় খুঁজছিলেন। উপায়টা দেখতে গেলে সুবোধ্য।
ভূমধ্য ও লোহিতের মধ্যবর্তী ভুখণ্ডটাতে গোটাকয়েক হ্রদ চিরকালই আছে, এই হ্রদগুলোকে
দুই সমুদ্রের সঙ্গে ও পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিলেই সেই জলপথ দিয়ে এক সমুদ্রের
জাহাজ অন্য সমুদ্রে যেতে পায়। কল্পনাটা অনেক কাল আগের, কিন্তু সেটা কার্যে পরিণত হতে
হতে গত শতাব্দীর দুই তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হয়ে গেল। কেনালটিতে কলাকুশলতা কী পরিমাণ আছে
তা স্থপতিরাই জানেন, কিন্তু অব্যবসায়ী আমরা জানি-খার প্রতিভার স্পর্শমণি লেগে একটা
বিরাট কল্পনা একটা বিরাট কীর্তিতে রূপান্তরিত হলো সেই ফরাসি স্থপতি লেসে একজন বিশ্বকর্মাতার সৃষ্টি দূরকে নিকটে এনে মানুষের
সঙ্গে মানুষের পরিচয় ঘনিষ্ঠতর করেছে। যান্ত্রিক সভ্যতার শত অপরাধ যাঁরা নিত্য স্মরণ
করেন, এই ভেবে তারা একটি অপরাধ মার্জনা করুন।
সুয়েজ কেনাল আমাদের দেশের যে-কোনো ছোটো নদীর মতোই অপ্রশস্ত, এত বড় জোর দুখানা জাহাজ পাশাপাশি আসা যাওয়া করতে
পারে, কিন্তু কেনল যেখানে হ্রদে পড়েছে সেখানে এমন সংকীর্ণতা নেই। কেনালটির সুরু থেকে
শেষ পর্যন্ত একটি দিকে নানান রকমের গাছ, যত্ন করে লাগানো,
যত্ন করে রক্ষিত, অন্যদিকে ধু-ধু করা মাঠ, শ্যামলতার আভাসটুকুও নেই। কেনালের দুই দিকেই
পাথরের পাহাড়, যেদিকে মিশর সেই দিকেই বেশি। এই পাহাড়গুলিতে যেন জাদু আছে, দেখলে মনে
হয় যেন কোনো কিউবিস্ট এদের আপন
খেয়ালমতো জ্যামিতিক আকার দিয়েছে
আর এক-একটা পাহাড়কে এক-একটা পাথর কুঁদে গড়েছে। কেনালটি যেখানে ভূমধ্যসাগরে পড়েছে
সেখানে একটি শহর দাঁড়িয়ে গেছে, নাম পোর্ট সৈয়দ। জাহাজ
থেকে নেমে শহরটায় বেরিয়ে আসা গেল। শহরটার বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট ফরাসি প্রভাবের সাক্ষ্য
দেয়। কাফেতে খাবার সময় ফুটপাথের ওপর বসে খেতে হয়, রাস্তায় চলবার সময় ডানদিক ধরে
চলতে হয়। পোর্ট সৈয়দ হলো নানা জাতের নানা দেশের মোসাফেরদের তীর্থস্থল-কাজেই
সেখানে তীর্থের কাকের সংখ্যা নেই, ফাক পেলে একজনের ট্র্যাকের টাকা আর একজনের টাকে ওঠে।
পোর্ট সৈয়দ মিশরের
অঙ্গ। মিশর প্রায় স্বাধীন দেশ। ইউরোপের এত কাছে বলে
ও নানা জাতের পথিক-কেন্দ্র বলে মিশরীরা ইউরোপীয়দের সঙ্গে বেশি
মিশতে পেরেছে, তাদের বেশি অনুকরণ করতে শিখেছে, তাদের দেশে অনায়াসে যাওয়া আসা করতে
পারছে। ফলে ইউরোপীয়দের প্রতি তাদের অপরিচয়ের ভীতি
বা অতিপরিচয়ের অবজ্ঞা নেই, ইউরোপের স্বাধীন মনোবৃত্তি তাদের সমাজে ও রাষ্ট্রে সারিত হয়েছে।
পোর্ট সৈয়দ ছেড়ে
আমরা ভূমধ্যসাগরে পড়লুম। শান্তশিষ্টবলে ভূমধ্যসাগরের সুনাম আছে। প্রথম দিন-কতক চতুর
ব্যবসাদারের মতো ভূমধ্যসাগর
Honesty is the best policy’ করলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভদ্রতা রক্ষা করলে না। আর একবার
করে কেউ কেউ শয্যাশায়ী হলেন। অধিকাংশকেই মার্সেলসে নামতেই হলো।
পোর্ট সৈয়দ থেকে মার্সে পর্যন্ত জল ছাড়া ও দুটি দৃশ্য ছাড়া
দেখবার আর কিছু নেই। প্রথমটি ইটালি ও সিসিলির মাঝখানে মেসিনা প্রণালী দিয়ে যাবার সময়
দুই ধারের পাহাড়ের সারি। দ্বিতীয়, স্ট্রম্বোলি আগ্নেয়গিরি কাছ
দিয়ে যাওয়ার সময় পাহাড়ের বুকে রাবণের চিতা।
মার্সেলসভূমধ্যসাগরের সেরা বন্দর ও ফরাসিদের
দ্বিতীয় বড়ো শহর। ইতিহাসে এর
নাম আছে, ফরাসিদের বন্দে মাতরম্ 'La Marseillaise'-এর এই নগরেই জন্ম। কাব্যে এ অঞ্চলের
নাম আছে, ফরাসি সহজিয়া কবিদের (troubadour) প্রিয়ভূমি এই সেই Provence-বসন্ত যেখানে
দীর্ঘস্থায়ী ও জ্যোৎস্না যেখানে স্বচ্ছ। এর পূর্ব দিকে সমুদ্রের কূলে কূলে ছোটো ছোটো অসংখ্য প্রাম,
সেই সব গ্রামে গ্রীষ্মযাপন করতে পৃথিবীর সব দেশের লোক
আসে। Bandol নামক তেমনি একটি গ্রামে আমরা একটি দুপুর কাটালুম। মোটরেকরে পাহাড়ের পর পাহাড় পেরিয়ে সেখানে যেতে হয়। পাহাড়ের
ওপর থেকে মার্সেলকে দেখলে মনে হয় যেন সমুদ্র তাকে সাপের মতো সাতপাক
জড়িয়ে বেঁধেছে। মার্সে শহরটাও পাহাড় কেটে তৈরি, ওর একটা রাস্তার সঙ্গে আরেকটা রাস্তা
সমতল নয়, কোনো রাস্তায় ট্রামে
করে যেতে যেতে ডানদিকে মোড় ফিরলে একেবারে রসাতল, কোনো রাস্তায় চলতে চলতে বাঁদিকে বেঁকে গেলে সামনে যেন স্বর্গের সিড়ি। মার্সেসের
অনেক রাস্তার দুধারে গাছের সারি ও তার ওপারে ফুটপাথ।
মার্সেল থেকে প্যারিসের রেলপথে রাত কাটল।
প্যারিস থেকে রেলপথে ক্যালে, ক্যালে থেকে জলপথে ডোভার
এবং ডোভার থেকে রেলপথে লন্ডন।
(নির্বাচিত অংশ)