পথে প্রবাসে - অন্নদাশংকর রায়


পথে প্রবাসে
অন্নদাশংকর রায়


ভারতবর্ষের মাটির ওপর থেকে শেষবারের মতো পা তুলে নিলুম আর সদ্যোজাত শিশুর মতো মায়ের সঙ্গে আমার যোগসুত্র এক মুহুর্তে ছিন্ন হয়ে গেল। একটি পদক্ষেপে যখন সমগ্র ভারতবর্ষের কক্ষচ্যুত হয়ে অনন্ত শুন্যে পা বাড়ালুম তখন যেখান থেকে পা তুলে নিলুম সেই পদ-পরিমাণ ভূমি যেন আমাকে গোটা ভারতবর্ষেরই স্পর্শ-বিরহ অনুভব করিয়ে দিচ্ছিল; প্রিয়জনের আঙুলের ডগাটুকুর স্পর্শ যেমন প্রিয়জনের সকল দেহের সম্পূর্ণ স্পর্শ অনুভব করিয়ে দেয়, এও যেন তেমনি।
জাহাজে উঠে বম্বে দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি করুণ। এত বড়ো ভারতবর্ষ এসে এতটুকু নগরপ্রান্তে ঠেকেছে, আর কয়েক মুহূর্তে ওটুকুও স্বপ্ন হবে, তখন মনে হবে আরব্য উপন্যাসের প্রদীপটা যেমন বিরাটাকার দৈত্য হয়ে আলাদিনের দৃষ্টি জুড়েছিল, ভারতবর্ষের মানচিত্রখানা তেমনি মাটি জল ফুল পাখি মানুষ হয়ে আজন্ম আমার চেতনা হয়েছিল, এতদিনে আবার যেন মানচিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে।
আর মানচিত্রে যাকে ভারতবর্ষ ও আফ্রিকার মাঝখানে গোস্পদের মটো দেখাত সেই এখন হয়েছে পায়ের তলার আরব সাগর, পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ কোনো দিকে চক্ষু তার অবধি পায় না। ঢেউগুলো তার অনুচর হয়ে আমাদের জাহাজখানাকে যেন গলাধাক্কা দিতে দিতে তার চৌকাঠ পার করে দিতে চলেছে। ঋতুটার নাম বর্ষা কতু, মনসুনের প্রভঞ্জনাহুতি পেয়ে সমুদ্র তার শত সহস্র জিহ্বা লকলক করছে, জাহাজখানাকে একবার এদিকে কাৎ করে একবার ওদিক কাৎ করে যেন ফুটন্ত তেলে পাঁপরের মতো উল্টে পাল্টে ভাজছে।
জাহাজ টলতে টলতে চলল, আর জাহাজের অধিকাংশ যাত্রি-ত্রিণী ডেক ছেড়ে শ্যা আশ্রয় করলেন। অসহ্য সমুদ্রপীড়ায় প্রথম তিন দিন আচ্ছন্নের মতো কাটল, কারুর সঙ্গে দেখা হবার জো ছিল না, প্রত্যেকেই নিজের নিজের ক্যাবিনে শয্যাশায়ী। মাঝে মাঝে দু'একজন সৌভাগ্যবান দেখা দিয়ে আশ্বসন করেন, ডেকের খবর দিয়ে যান। আর ক্যাবিন স্টুয়ার্ড খাবার দিয়ে যায়। বলা বাহুল্য জিহবা তা গ্রহণ করতে আপত্তি না করলেও উদর তা রক্ষণ করতে অস্বীকার করে।
ক্যাবিনে পড়ে পড়ে মনে ও উপবাসে দিনের পর রাত রাতের পর দিন এমন দুঃখে কাটে যে, কেউবা ভাবে যে মরণ হলেই বাঁচি, কেউ-বা ভাবে যে মরতে আর দেরি নেই। জানিনে হরবল্লভের মতাে কেউ ভাবে কি না যে, মরে তো গেছি দুর্গানাম করে কী হবে। সমুদ্রপীড়া যে কী দুঃসহ তা ভুক্তভােগী ছাড়া অপর কেউ ধারণা করতে পারবে না। হাতের কাছে রবীন্দ্রনাথের 'চয়নিকা’, মাথার যন্ত্রণায় অমন লোভনীয় বইও পড়তে ইচ্ছা করে না। ইচ্ছা করে কেবল চুপ করে পড়ে থাকতে, পড়ে পড়ে আকাশ পাতাল ভবতে।।
সদ্য-দুঃখার্ত কেউ সংকল্প করে ফেললেন যে, এডেনে নেমেই দেশে ফিরে যাবেন, সমুদ্রযাত্রার দুর্ভোগ আর সইতে পারবেন না। তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলো এডেন থেকে দেশে ফিরে যেতে চাইলেও উঠের পিঠে চড়ে মরুভূমি পেরিয়ে পারস্যের ভিতর দিয়ে ফেরবার যখন উপায় নেই তখন ফিরতে হবে সেই সমুদ্রপথেই। আমরা অনেকেই কিন্তু ঠিক করে ফেললুম মার্সেসে নেমে প্যারিসের পথে লন্ডন যাব।
আরব সাগরের পরে যখন লোহিত সাগরে পড়লুম তখন সমুদ্রপীড়া বাসি হয়ে গেছে। আফ্রিকা-আরবের মধ্যবর্তী এই হ্রদতুল্য সমুদ্রটি দুর্দান্ত নয়, জাহাজে থেকে থেকে জাহাজটার ওপর মায়াও পড়ে গেছে; তখন না মনে পড়ছে দেশকে, না ধারণা করতে পারা যাচ্ছে বিদেশকে; কোথা থেকে এসেছি ভুলে গেছি, কোথায় যাচ্ছি বুঝতে পারছিনে; তখন গতি আনন্দে কেবল ভেসে চলতেই ইচ্ছা করে, কোথাও থামবার বা নামবার সংকল্প দূর হয়ে যায়।
বিগত ও আগতের ভাবনা না ভেবে উপস্থিতের উপর দৃষ্টি ফেললুম—আপাতত আমাদের এই ভাসমান পান্থশালাটায় মন ন্যস্ত করলুম। খাওয়া -শোওয়া-খেলা-পড়া-গজ করার যেমন বন্দোবস্ত যে-কোনো ড়ো হােটেলে থাকে এখানেও তেমনি, কেবল কাবিনগুলো যা যথেষ্ট বড়ো নয়। ক্যাবিনে শুয়ে থেকে সিন্ধু-জননীর দোল খেয়ে মনে হয় খোকাদের মতো দোলনায় শুয়ে দুলছি। সমুদ্রপীড়া যেই সারল ক্যাবিনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অমনি কমলোশোবার সময়টা ছাড়া বাকি সময়টা আমরা ডেকে কিংবা বসবার ঘরে কাটাতুম। ডেকেচেয়ার ফেলে বসে কিংবা পায়চারি করতে করতে সমুদ্র দেখে দেখে চোখ শ্রান্ত হয়ে যায়; চারিদিকে জল আর জল, তাও নিস্তরঙ্গ, কেবল জাহাজের আশে পাশে ছাড়া ঢেউয়ের অস্তিত্ব নেই, যা আছে তা বাতাসের সোহাগ-চুম্বনে জলের হৃদয়-স্পন্দন। বসবার ঘরে অর্ধশায়িত থেকে খােশ গল্প করতে এর চেয়ে অনেক ভালো লাগে।
লােহিত সাগরের পরে ভূমধ্য সাগর, দুয়ের মাঝখানে যেন একটি সেতু ছিল, নাম সুয়েজ যােজক। এই যোজকের ঘটকালিতে এশিয়া এসে আফ্রিকার হাত ধরেছিল। সম্প্রতি হাতের জোড় খুলে দুই মহাদেশের মাঝখানে বিয়োগ ঘটিয়ে দেওয়া হয়েছে। যার দ্বারা তা ঘটল তার নাম সুয়েজ কেনাল। সুয়েজ কেনাল একদিকে বিচ্ছেদ ঘটাল বটে, কিন্তু অন্যদিকে মিলন ঘটাল—লোহিতের সঙ্গে ভূমধ্যের মিলন যেন ভারতের সঙ্গে ইউরােপের মিলন। কলম্বাস যা পারেননি, লেসেপস তা পারলেন। ভূমধ্য ও লোহিতের মধ্যে কয়েক শত মাইলের ব্যবধান, ঐটুকুর জন্যে ভূমধ্যের জাহাজকে লােহিতে আসতে বহু সহস্র মাইল ঘুরে আসতে হতো। মিশরের রাজারা কোন্ যুগ থেকে এর প্রতিকারের উপায় খুঁজছিলেন। উপায়টা দেখতে গেলে সুবোধ্য। ভূমধ্য ও লোহিতের মধ্যবর্তী ভুখণ্ডটাতে গোটাকয়েক হ্রদ চিরকালই আছে, এই হ্রদগুলোকে দুই সমুদ্রের সঙ্গে ও পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিলেই সেই জলপথ দিয়ে এক সমুদ্রের জাহাজ অন্য সমুদ্রে যেতে পায়। কল্পনাটা অনেক কাল আগের, কিন্তু সেটা কার্যে পরিণত হতে হতে গত শতাব্দীর দুই তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হয়ে গেল। কেনালটিতে কলাকুশলতা কী পরিমাণ আছে তা স্থপতিরাই জানেন, কিন্তু অব্যবসায়ী আমরা জানি-খার প্রতিভার স্পর্শমণি লেগে একটা বিরাট কল্পনা একটা বিরাট কীর্তিতে রূপান্তরিত হলো সেই ফরাসি স্থপতি লেসে একজন বিশ্বকর্মাতার সৃষ্টি দূরকে নিকটে এনে মানুষের সঙ্গে মানুষের পরিচয় ঘনিষ্ঠতর করেছে। যান্ত্রিক সভ্যতার শত অপরাধ যাঁরা নিত্য স্মরণ করেন, এই ভেবে তারা একটি অপরাধ মার্জনা করুন।
সুয়েজ কেনাল আমাদের দেশের যে-কোনো ছোটো নদীর মতোই অপ্রশস্ত, এত বড় জোর দুখানা জাহাজ পাশাপাশি আসা যাওয়া করতে পারে, কিন্তু কেনল যেখানে হ্রদে পড়েছে সেখানে এমন সংকীর্ণতা নেই। কেনালটির সুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি দিকে নানান রকমের গাছ, যত্ন করে লাগানো, যত্ন করে রক্ষিত, অন্যদিকে ধু-ধু করা মাঠ, শ্যামলতার আভাসটুকুও নেই। কেনালের দুই দিকেই পাথরের পাহাড়, যেদিকে মিশর সেই দিকেই বেশি। এই পাহাড়গুলিতে যেন জাদু আছে, দেখলে মনে হয় যেন কোনো কিউবিস্ট এদের আপন খেয়ালমতো জ্যামিতিক আকার দিয়েছে আর এক-একটা পাহাড়কে এক-একটা পাথর কুঁদে গড়েছে। কেনালটি যেখানে ভূমধ্যসাগরে পড়েছে সেখানে একটি শহর দাঁড়িয়ে গেছে, নাম পোর্ট সৈয়দ। জাহাজ থেকে নেমে শহরটায় বেরিয়ে আসা গেল। শহরটার বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট ফরাসি প্রভাবের সাক্ষ্য দেয়। কাফেতে খাবার সময় ফুটপাথের ওপর বসে খেতে হয়, রাস্তায় চলবার সময় ডানদিক ধরে চলতে হয়। পোর্ট সৈয়দ হলো নানা জাতের নানা দেশের মোসাফেরদের তীর্থস্থল-কাজেই সেখানে তীর্থের কাকের সংখ্যা নেই, ফাক পেলে একজনের ট্র্যাকের টাকা আর একজনের টাকে ওঠে।
পোর্ট সৈয়দ মিশরের অঙ্গ। মিশর প্রায় স্বাধীন দেশ। ইউরোপের এত কাছে বলে ও নানা জাতের পথিক-কেন্দ্র বলে মিশরীরা ইউরোপীয়দের সঙ্গে বেশি মিশতে পেরেছে, তাদের বেশি অনুকরণ করতে শিখেছে, তাদের দেশে অনায়াসে যাওয়া আসা করতে পারছে। ফলে ইউরোপীয়দের প্রতি তাদের অপরিচয়ের ভীতি বা অতিপরিচয়ের অবজ্ঞা নেই, ইউরোপের স্বাধীন মনোবৃত্তি তাদের সমাজে ও রাষ্ট্রে সারিত হয়েছে।
পোর্ট সৈয়দ ছেড়ে আমরা ভূমধ্যসাগরে পড়লুম। শান্তশিষ্টবলে ভূমধ্যসাগরের সুনাম আছে। প্রথম দিন-কতক চতুর ব্যবসাদারের মতো ভূমধ্যসাগর Honesty is the best policy’ করলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভদ্রতা রক্ষা করলে না। আর একবার করে কেউ কেউ শয্যাশায়ী হলেন। অধিকাংশকেই মার্সেলসে নামতেই হলোপোর্ট সৈয়দ থেকে মার্সে পর্যন্ত জল ছাড়া ও দুটি দৃশ্য ছাড়া দেখবার আর কিছু নেই। প্রথমটি ইটালি ও সিসিলির মাঝখানে মেসিনা প্রণালী দিয়ে যাবার সময় দুই ধারের পাহাড়ের সারি। দ্বিতীয়, স্ট্রম্বোলি আগ্নেয়গিরি কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় পাহাড়ের বুকে রাবণের চিতা।
মার্সেলসভূমধ্যসাগরের সেরা বন্দর ও ফরাসিদের দ্বিতীয় বড়ো শহর। ইতিহাসে এর নাম আছে, ফরাসিদের বন্দে মাতরম্ 'La Marseillaise'-এর এই নগরেই জন্ম। কাব্যে এ অঞ্চলের নাম আছে, ফরাসি সহজিয়া কবিদের (troubadour) প্রিয়ভূমি এই সেই Provence-বসন্ত যেখানে দীর্ঘস্থায়ী ও জ্যোৎস্না যেখানে স্বচ্ছ। এর পূর্ব দিকে সমুদ্রের কূলে কূলে ছোটো ছোটো অসংখ্য প্রাম, সেই সব গ্রামে গ্রীষ্মযাপন করতে পৃথিবীর সব দেশের লোক আসে। Bandol নামক তেমনি একটি গ্রামে আমরা একটি দুপুর কাটালুম। মোটরেকরে পাহাড়ের পর পাহাড় পেরিয়ে সেখানে যেতে হয়। পাহাড়ের ওপর থেকে মার্সেলকে দেখলে মনে হয় যেন সমুদ্র তাকে সাপের মতো সাতপাক জড়িয়ে বেঁধেছে। মার্সে শহরটাও পাহাড় কেটে তৈরি, ওর একটা রাস্তার সঙ্গে আরেকটা রাস্তা সমতল নয়, কোনো রাস্তায় ট্রামে করে যেতে যেতে ডানদিকে মোড় ফিরলে একেবারে রসাতল, কোনো রাস্তায় চলতে চলতে বাঁদিকে বেঁকে গেলে সামনে যেন স্বর্গের সিড়ি। মার্সেসের অনেক রাস্তার দুধারে গাছের সারি ও তার ওপারে ফুটপাথ।
মার্সেল থেকে প্যারিসের রেলপথে রাত কাটল। প্যারিস থেকে রেলপথে ক্যালে, ক্যালে থেকে জলপথে ডোভার এবং ডোভার থেকে রেলপথে লন্ডন।


(নির্বাচিত অংশ)


বঙ্গানুবাদ

বঙ্গানুবাদ


Once on a summer day a poor cap-seller was going to a fair for selling caps. Being tired he sat under the shade of a tree leaving behind him his basket containing caps. The gentle breeze made him drowsy and soon he fell asleep. After a while he suddenly woke up and was surprised to find that there was not a single cap left in the basket. Then he began to cry.


উত্তর : কোনাে এক গ্রামের দিনে এক দরিদ্র টুপি-বিক্রেতা টুপি বিক্রি করবার জন্য মেলায় যাচ্ছিল। ক্লান্ত হয়ে, টুপি ভর্তি ঝড়িটি পেছনে রেখে সে একটা গাছের ছায়ায় বসল। মৃদুমন্দ বাতাস তাকে তন্দ্রালু (বা তন্দ্রাচ্ছন্ন) করল। এবং শিগগিরই সে ঘমিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে সে হঠাৎ জেগে উঠল এবং অবাক হয়ে দেখল যে তার ঝুড়িতে। একটিও টুপি নেই। তখন সে কাঁদতে লাগল।



Once morning a monk went out to beg for food. He met a farmer and asked for some alms. But the farmer refused to help him saying, "I plough my field sow the seeds and gather the grain. Thus it is only by working hard that I get my livelihood. But how can you obtain yours, since you neither plough nro sow?

উত্তর : একদিন সকালে এক সন্ন্যাসী খাদ্য ভিক্ষা করতে বেরিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হ’ল এক কৃষকের। তিনি তার কাছ থেকে কিছ ভিক্ষা চাইলেন। কিন্তু কৃষক তাকে এই বলে সাহায্য করতে অস্বীকার করল “আমি আমার জমি চাষ করি বীজ বপন করি এবং শস্য সংগ্রহ করি। এইভাবে একমাত্র কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আমি আমার জীবিকা নির্বাহ করি। কিন্তু, যেহেতু আপনি চাষও করেন না বা বীজও বপন করেন না, আপনি কীভাবে। আপনার জীবিকানির্বাহ করতে পারেন?”


Man is social animal. He cannot live alone. No person can be happy without having sincere friends. But selfish persons fail to make real friendship. Because to get love, you must give love in return. 

উত্তর : মানুষ সামাজিক জীব। সে একা বাঁচতে পারে না। অন্তরঙ্গ বন্ধু ছাড়া কোনাে মানুষ সুখী হতে পারে নাকিন্তু স্বার্থপর মানুষরা প্রকৃত বন্ধুত্ব করতে পারে না। কারণ ভালােবাসা পেতে হলে প্রত্যুত্তরে ভালােবাসা দিতে হয়।


Once two friends started on a travel. Their way lay through a forest. As they came half way through the forest, a bear was seen slowly approaching them. One of them climbed up a tree. The other did not know how to climb a tree and lay flat on his face without breathing.

উত্তর : একদা দুই বন্ধু ভুমণে বের হয়েছিল। তাদের চলবার পথ বনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। যখন তারা বনের মধ্য দিয়ে অর্ধেক পথ এসেছে, তখন একটা ভালুককে তাদের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে দেখল। তাদের মধ্যে একজন একটা গাছে উঠে পড়ল। অপরজন গাছে উঠতে জানত না, তাই সে নিশ্বাস বন্ধ করে মাটিতে মুখ রেখে শুয়ে পড়ল।

সাত ভাই চম্পা - বিষ্ণু দে

সাত ভাই চম্পা
বিষ্ণু দে

চম্পা! তােমার মায়ার অন্ত নেই, 
কত-না পারুল-রাঙানাে রাজকুমার 
কত সমুদ্র কত নদী হয় পার! 
বিরাট বাংলা দেশের কত-না ছেলে
অবহেলে সয় সকল যন্ত্রণাই
চম্পা কখন জাগিবে নয়ন মেলে।

চম্পা, তােমার প্রেমেই বাংলা দেশ 
কত-না শাঙন রজনী পােহাল বলাে। 
গৌরীশৃঙ্গ মাথা হেঁট টলােমলাে, 
নিষিদ্ধ দেশে দীপঙ্করের শিখা 
চিনে জ্বলে, হয় মঙ্গোলিয়ায় লেখা, 
চম্পা, তােমায় চিনেছিল সিংহলও।

তােমাকে খুঁজেছে জানাে কি কৃষকে নৃপে 
অশ্বের খুরে, লাঙলের ফলা টেনে, 
হাতুড়ির ঘায়ে, কান্তের বাঁকা শানে, 
ভাটিয়ালি গানে, কপিলমুনির দ্বীপে; 
কলিঙ্গে আর কঙ্কণে গুর্জরে 
চম্পা, তােমার সাত ভাই গান করে।

শ্যাম-কাম্বােজে তারা বুঝি টানে দাঁড়,
নীল-কমলের দেশে রেখে আসে হাড় 
বহু চাঁদ বহু শ্ৰীমন্ত সদাগর, 
চম্পা, তােমারই পারুল মায়ার লােভে 
বাহিরকে ঘর আপনকে করে পর,

 বলী হাসে, আসে যবদ্বীপের সাড়।

তােমার বাহুর নির্দেশ দেখে ক্ষোভে 
কত প্রাণ গেল, কতজনা নিশি ডেকে 
অন্ধ আবেগে বৈতরণীতে ডােবে। 
চম্পা, তােমার অবিনশ্বর প্রাণ। 
এ কোন হিরণমায়ায় রেখেছ ঢেকে, 
খুলে দাও মুখ, রৌদ্রে জ্বলুক গান।।

কড়ির পাহাড়ে চম্পা, তুমি তাে নেই; 
কাঞ্চনমালা জানে না তােমার খেই; 
তবুও তােমায় খুঁজে মরে সারা দেশ
ঘােচাও চম্পা, দুস্থ হন্নবেশ, 

এ মাহ ভাদরে ভরা বাদরের শেষে 
চকিতে দেখাও জনগণমনে মুখ
মুক্তি! মুক্তি! চিনি সে তীব্র সুখ, 
সাত ভাই জাগে, নন্দিত দেশ-দেশ।।


দাম - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

দাম
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

স্কুলে কী বিভীষিকাই যে ছিলেন ভদ্রলোক!
আমাদের অঙ্ক কষাতেন। আশ্চর্য পরিষ্কার ছিল মাথা। যেসব জটিল অঙ্ক নিয়ে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা পণ্ডশ্রম করেছি, একবার মাত্র তাকিয়ে দেখতেন তার দিকে, তারপরেই এগিয়ে যেতেন ব্ল্যাক বোর্ডে, খসখস করে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলতে খড়ি। হঠাৎ খড়ি ভেঙে গেলে বিরক্ত হয়ে টুকরো দুটো আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে তৎক্ষণাৎ আর একটা তুলে নিতেন, একটু পরেই আমরা রোমাঞ্চিত হয়ে দেখতুম ছবির মতো অঙ্কটা সাজিয়ে দিয়েছেন।
পৃথিবীতে যত অঙ্ক ছিল, সব যেন ওঁর মুখস্থ। কিংবা মুখস্থ বললেও ঠিক হয় না, মনে হতো, আমাদের অদৃশ্য অক্ষরে বোর্ডে আগে থেকেই কষা রয়েছে, অথচ উনি দেখতে পাচ্ছেন ঠিক, আর সঙ্গে সঙ্গে তার উপরে খড়ি বুলিয়ে চলেছেন।
অকে যারা একশোর মধ্যে একশো পায়, ওঁর ভয়ে তারাই তটস্থ হয়ে থাকত। আর আমাদের মতো যেসব অঙ্ক-বিশারদের টেনেটুনে কুড়িও উঠতে চাইত না, তাদের অবস্থা সহজেই কল্পনা করা যেতে পারে। প্রকাণ্ড হাতের প্রচণ্ড চড় খেয়ে মাথা ঘুরে যেত, কিন্তু কাঁদবার জো ছিল না। চোখে এক ফোঁটা জল দেখলেই ক্লাস। ফাটিয়ে হুঙ্কার ছাড়তেন; পুরুষ মানুষ হয়ে অঙ্ক পারিসনেতার উপরে কাদতে লজ্জা করে না? এখনি পা ধরে স্কুলের পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে দেবো।
তা উনি পারতেন। ওঁর চড়ের জোর থেকেই আমরা তা আন্দাজ করে নিয়েছিলুম।
পুরুষমানুষ হয়ে অঙ্ক পারে নাএমন অঘটন কল্পনাও করতে পারতেন না মাস্টার মশাই। বলতেন, প্লেটোর দোরগোড়ায় কী লেখা ছিল, জানিস? যে অঙ্ক জানে না এখানে তার প্রবেশ নিষেধ। স্বর্গের দরজাতেও ঠিক ওই কথাই লেখা রয়েছেযদি সেখানে যেতে চাস, তা হলেস্বর্গের খবরটা মাস্টারমশাই কোত্থেকে জোগাড় করলেন তিনিই জানেন। প্লেটো কে, তার দরজা দিয়ে ঢুকতে না পারলে কী ক্ষতি হবে, এ নিয়ে আমরা কোনোদিন মাথা ঘামাইনি। তাছাড়া যে স্বর্গে পা দিয়েই জ্যামিতির এক্সট্রা ক্যতে হবে কিংবা স্কোয়ার মেজারের অঙ্ক নিয়ে বসতে হবে, সে স্বর্গের চাইতে লক্ষ যোজন দূরে থাকাই আমরা নিরাপদ বোধ করতুম।
ম্যাট্রিকুলেশনের গণ্ডী পার হয়ে অঙ্কের হাত থেকে রেহাই পেলুম, মাস্টারমশাইয়ের হাত থেকেও। কিন্তু অঙ্কের সেই বিভীষিকা মন থেকে গেল না। এমএ পাশ করবার পরেও স্বপ্ন দেখেছি, পরীক্ষার লাস্ট বেল পড়ো-পড়ো, অথচ একটা অঙ্কও আমার মিলছে না। মাস্টারমশাই গার্ড হয়ে একবার আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন, দু-চোখ দিয়ে তার আগুন ঝরছে। দাঁতে দাঁতে ঘষে বলছেন মাথার উপর ঘুরন্ত পাখা সত্ত্বেও ঘামে নেয়ে আমি জেগে উঠেছি। মৃদু নীল আলোয় দেখেছি চেনা ঘরটাকে, চোখে পড়েছে সামনে আমার পড়ার টেবিল, আমার বইপত্রের স্তুপ। গভীর তৃপ্তির সঙ্গে ভেবেছি, এখন আর আমাকে স্কুলে অঙ্ক কষতে হয় না, আমি কলেজে বাংলা পড়াই।
একদিন একটি পত্রিকার পক্ষ থেকে ফরমাশ এল, আমার ছেলেবেলার গল্প শোনাতে হবে। আমি জানালুম, লেখক হিসেবে আমি নিতান্ত সামান্য ব্যক্তি, আমার ছেলেবেলার গল্পে কারো কোনো কৌতূহল নেই। তাছাড়া এমন কোনো স্মরণীয় ঘটনা ঘটেনি যে আসর করে তা লোককে শোনাতে পারি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ ছাড়লেন না, তাঁরা জানালেন, সাহিত্যের ইন্দ্র চন্দ্র মিত্র বরুণেরা কেউ তাদের বিশেষ পাত্তা দেননি, অতএব  অতএব আমি ভাবলুম, তা হলে নির্ভয়ে লিখতে পারি। এঁরা নিজেরা ছাড়া ওঁদের কাগজের বিশেষ পাঠক নেই, সুতরাং আমার আত্মকথা কারো কাছে স্পর্ধার মতো মনে হবে না। কয়েকটি ঘরোয়া মানুষের কাছে ঘরোয়া গল্প বলবওটা প্রীতির ব্যাপার, পদমর্যাদার নয়। কাগজ কলম নিয়ে বসে গেলরর
মনে এল মাস্টারমশাইয়ের কথা। লিখলুম তাঁকে নিয়েই। ছবিটা যা ফুটল, তা খুব উজ্জ্বল নয়। লেখবার সময় কল্পনার খাদ কিছু মিশিয়ে নিলুম সেটা বলাই বাহুল্য। সেই সঙ্গে সদুপদেশও একটু বর্ষণ করেছিলুম। মূল কথাটা এই ছিল, অহেতুক তাড়না করে কাউকে শিক্ষা দেওয়া যায় না, গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করতে গেলে গাধাটাই পঞ্চত্ব পায়। তার প্রমাণ আমি নিজেই। মাস্টার। মশাই আমাকে এত প্রহার করেও অঙ্ক শেখাতে পারেননি, বরং যা শিখেছিলুম তা-ও ভুলেছি। এখন দুই আর দুইয়ে চার না পাঁচ হয়, তাই নিজের মধ্যে সন্দেহ জাগে।
পত্রিকার কর্তৃপক্ষ খুশি হয়ে আমাকে দশ টাকা দক্ষিণা দিয়ে গেছেন। মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে এইটুকুই আমার নগদ লাভ।
তারপরে আরো অনেকদিন পার হয়ে গেল। সেই লেখার কথা ভুলে গেলুম, ভুলে গেলুম মাস্টারমশাইকেও। বয়স বেড়েছে, বিনিদ্র রাত্রিযাপনের মতো অনেক সমস্যা এসে দেখা দিয়েছে জীবনে। বর্তমানের দাবিটা এত বেশি জোরালো যে স্মৃতির দিকে তাকাবার অবসর পর্যন্ত মেলে না।।
এমনি সময় বাংলাদেশের এক প্রান্তের একটি কলেজ থেকে ডাক এল। ওঁদের বার্ষিক উৎসব, অতএব আতিথ্য নিতে যেতে হবে ওখানে। এবং বক্তৃতা দিতে হবে।
এই সব উপলক্ষেই বিনাপয়সায় বেড়ানো যায়। তাছাড়া কলকাতা থেকে কেউ বাইরে গেলেই তার রাজোচিত সম্বর্ধনা মেলেএখানকার চড়ুই পাখিও সেখানে রাজহংসের সম্মান পায়। কলকাতা থেকে দূরত্বটা যত বেশি হয়, আমাদের মতো নগণ্যের পক্ষে ততই সুখাবহ।
আমি সুযোগটা ছাড়তে পারলুম না।
গিয়ে পৌঁছতে চা-খাবার-আতিথেয়তার উচ্ছ্বাস। ছেলেরা তো এলই, দুচারজন সম্ভ্রান্ত লোক এসেও বিনীতভাবে আলাপ করে গেলেন। এমন কি খানকয়েক অটোগ্রাফের খাতা পর্যন্ত এগিয়ে এল। রোমাঞ্চিত কলেবরে আমি স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে বাণী বিতরণ করতে লাগলুম, ব্যক্তি হিসেবে আমি যে এত মূল্যবান এর আগে কে ভেবেছিল সে-কথা।
সভায় জাঁকিয়ে বক্তৃতা করা গেল। রবীন্দ্রনাথ থেকে বারােটা উদ্ধৃতি দিলুম, কার একটা ইংরেজি কোটেশন চালিয়ে দিলুম বার্নার্ড শ'র নামে, শেষে দেশের তরুণদের নিদারুণভাবে জাগ্রত হতে বলে যখন টেবিলে একটা প্রকাণ্ড কিল মেরে বক্তৃতা শেষ করলুম, তখন অল্পের জন্যে ফুলদানিটা রক্ষা পেলাে। আর হল-ফাটানো হাততালিতে কান বন্ধ হওয়ার জো।।
বুড়ো প্রিন্সিপ্যাল পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে আমাকে বললেন, ভারী চমৎকার বলেছেন আপনি, যেমন সারগর্ভ, তেমনি সুমধুর।

আমি বিনীত হাসিতে বললুম, আজ শরীরটা তেমন ভালয় নেই, তাই মনের মতো করে বলতে পারলুম না। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেরা বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলল। শরীর ভালো নেই, তাতেই এরকম বললেন স্যার। শরীর ভালো থাকলে তো অর্থাৎ প্রলয় হয়ে যেত। আমি উদার হাসি হাসলুম। যদিও মনে মনে জানি, এই একটি সর্বার্থসাধক বক্তৃতাই আমার সম্বল, রবীন্দ্র জন্মােৎসব থেকে বনমহোৎসব পর্যন্ত এটাকেই এদিক ওদিক করে চালিয়ে দিই।
স্তুতিতে স্ফীত মনে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়েছি, এমন সময় একটি ছেলে এসে খবর দিলে এক ড়ো ভদ্রলােক আমার সঙ্গে দেখা করতে চান।
প্রিন্সিপ্যাল বললেন, বেশ তো, ডেকে আনো এখানে। ছেলেটি বললে, তিনি আসতে চাইছেন নাবাইরে মাঠে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
আমার বক্তৃতায় নিশ্চয় কেউ অভিভূত হয়েছেন, আমাকে অভিনন্দন জানাবেন। এ অভিজ্ঞতা আগেও হয়েছে। সুতরাং দাক্ষিণ্য-পুলকিত চিত্তে আমি বললুম, আচ্ছা চলো, আমি যাচ্ছি।
হলের বাইরে ছােটো একটা মাঠ তরল অন্ধকারে ঢাকা। অত আলো থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমে ভালো করে কিছু দেখতে পেলুম না। তারপর চোখে পড়ল মানুষটিকে। কুঁজো লম্বা চেহারা, মাথার সাদা চুলগুলি চিকমিক করছে।
ডাকলেন, সুকুমার!
আমি চমকে উঠলুম। এখানে কেউ আমার নাম ধরে ডাকতে পারে সেটা যেমন আশ্চর্য, তারও চেয়ে। আশ্চর্য ওই গলার স্বর। আমার মনটাকে অদ্ভুতভাবে দুলিয়ে দিল। স্মৃতির অন্ধকার থেকে একটা ভয়ের মৃদু শিহরণ আমার বুকের ভিতর দিয়ে বয়ে গেল।
আমাকে চিনতে পারছ না সুকুমার? আমি
-চিনেছি। ভয় পাওয়ার অর্থটা বুঝতেও আর বাকি নেই। এই ডাক শুনে ছেলেবেলায় বহুদিন আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে এসেছেজানি এখনই একটা ভয়ংকর চড় আমার পিঠের উপর নেমে আসবে। সেই ভয়টার কঙ্কাল লুকিয়ে ছিল মনের চোরাকুঠুরিতেওই স্বর বিদ্যুতের আলোর মতো তাকে উদ্ভাসিত করে তুলেছে।
আমার মাথা তখনই ওঁর পায়ে নেমে এল। মাস্টারমশাই, আপনি!
মাস্টারমশাই বললেন, বেঁচে থাকো বাবা, যশস্বী হও। রিটায়ার করার পর এখানে এসেই মাথা খুঁজেছি। বাড়ি থেকে বেরুই না, আজ তুমি বক্তৃতা করবে শুনে ছুটে এসেছি। খুব ভালাে বলেছ সুকুমার, খুব খুশি হয়েছি।
কিন্তু আমি খুশি হতে পারলুম না। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন মাস্টারমশাই, বুদ্ধিতে ছুরির ফলার মতো ঝক্ করত চোখ। আজ আমার বক্তৃতার ফাঁপা ফানুস দিয়ে যদি ওঁকে ভােলাতে পেরে থাকি, তাহলে সেটা। আমার কৃতিত্বে নয়, ওঁর মনেরও বয়স বেড়েছে বলে।
অপরাধীদের মতো চাইলুম, না স্যার, আপনার সামনে মাস্টারমশাই আমাকে বলতে দিলেন না।
তোমরাই তো আমাদের গর্ব, আমাদের পরিচয়। কিছুই দিতে পারিনি, খালি শাসন করেছি, পীড়ন করেছি।বলতে বলতে জামার পকেট থেকে বের করলেন শতচ্ছিন্ন এক জীর্ণ পত্রিকা: একদিন আমার ছেলে এইটে এনে আমাকে দেখালে। পড়ে আনন্দে আমার চোখে জল এল। কতকাল হয়ে গেল, তবু সুকুমার 'আমাকে মনে রেখেছে, আমাকে নিয়ে গল্প লিখেছে। সকলকে এই লেখা আমি দেখাই, বলি দেখো, আমার ছাত্র আমাকে অমর করে দিয়েছে।
মুহূর্তে আমার জিভ শুকিয়ে গেল, লজ্জায় আত্মগ্লানিতে আমার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করল। একটা কিছু বলতে চেষ্টা করলুম, কিন্তু মুখে কথা ফুটল না।
মাস্টারমশাইয়ের গলা ধরে এসেছিল। একটু চুপ করে থেকে বললেন, কী যে আমার আনন্দ হয়েছে। সুকুমার, কী বলব! তোমার এই লেখাটা সব সময়ে আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। দু-একজন বলে, যেমন ধরে ধরে মারতেন, তেমনি বেশ শুনিয়ে দিয়েছে আপনাকে। আমি বলি, শোনাবে কেনকত শ্রদ্ধা নিয়ে লিখেছে। আর সত্যিই তো অন্যায় যদি করেই থাকি, ওরা ছাত্রওরা সন্তান-বড়ো হলে সে অন্যায় আমার শুধরে। দেবে বই কি। জানো সুকুমার, আনন্দে তোমাকে আমি একটা চিঠিও লিখেছিলুম। কিন্তু পাঠাতে সাহস হয়নি। তোমরা এখন বড়ো হয়ে গেছএখনআর বলতে পারলেন না। আবছা আলোটায় এখন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলুম, দেখলুম, মাস্টারমশাইয়ের চোখ দিয়ে জল পড়ছে।
মনে হলো, স্নেহ-মমতা-ক্ষমার এক মহাসমুদ্রের ধারে এসে দাঁড়িয়েছি। সেই স্নেহকোটি মণি-মাণিক্য দিয়ে যার পরিমাপ হয় না; সেই মমতাযার দাম সংসারের সব ঐশ্বর্যের চাইতে বেশি; সেই ক্ষমাকুবেরের ভাণ্ডারকে ধরে দিয়েও যা পাওয়া যায় না।
আমি তাকে দশ টাকায় বিক্রি করেছিলুম। এ অপরাধ আমি বইব কী করে, এ লজ্জা আমি কোথায় রাখব!


দাঁড়াও - শক্তি চট্টোপাধ্যায়



দাঁড়াও
শক্তি চট্টোপাধ্যায়

মানুষ বড়াে কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও
 মানুষই ফাঁদ পাতছে, তুমি পাখির মতাে পাশে দাঁড়াও 
মানুষ বড়াে একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।

তােমাকে সেই সকাল থেকে তােমার মতাে মনে পড়ছে
 সন্ধে হলে মনে পড়ছে, রাতের বেলা মনে পড়ছে। 
মানুষ বড়াে একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।

এসে দাঁড়াও ভেসে দাঁড়াও এবং ভালােবেসে দাঁড়াও
 মানুষ বড়াে কাদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও 
মানুষ বড়াে একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।

মাসিপিসি - জয় গােস্বামী



মাসিপিসি
জয় গােস্বামী

ফুল ছুঁয়ে যায় চোখের পাতায়, জল ছুঁয়ে যায় ঠোঁটে
ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি রাত থাকতে ওঠে

শুকতারাটি ছাদের ধারে, চাঁদ থামে তালগাছে 
ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি ছাড়া কাপড় কাচে

দু এক ফোঁটা শিশির তাকায় ঘাসের থেকে ঘাসে 
ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি ট্রেন ধরতে আসে

ঘুমপাড়ানি মাসিপিসির মস্ত পরিবার
 অনেকগুলাে পেট বাড়িতে, একমুঠো রােজগার

ঘুমপাড়ানি মাসিপিসির পোঁটলা পুঁটলি কোথায় ? 
রেল বাজারের হােমগার্ডরা সাত ঝামেলা জোটায়

সাল মাহিনার হিসেব তাে নেই, জষ্টি কি বৈশাখ
 মাসিপিসির কোলে-কঁখে চালের বস্তা থাক

শতবর্য এগিয়ে আসে – শতবর্য যায়

চাল তােলাে গাে মাসিপিসি লালগােলা বনগাঁয়

অদ্ভুত আতিথিয়তা - ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর



অদ্ভুত আতিথিয়তা
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর


একদা আরব জাতির সহিত মুরদিগের সংগ্রাম হইয়াছিল। আরবসেনা বহুদূর পর্যন্ত এক মুরসেনাপতির অনুসরণ করে। তিনি অশ্বারােহণে ছিলেন, প্রাণভয়ে দ্রুতবেগে পলায়ন করিতে লাগিলেন। আরবেরা তাহার অনুসরণে বিরত হইলে, তিনি স্বপক্ষীয় শিবিরের উদ্দেশে গমন করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাঁহার দিকভ্রম জন্মিয়াছিল, এজন্য, দিকনির্ণয় করিতে না পারিয়া, তিনি বিপক্ষের শিবিরসন্নিবেশস্থানে উপস্থিত হইলেন। সে সময়ে তিনি এরূপ ক্লান্ত হইয়াছিলেন যে, আর কোনাে ক্রমেই অশ্বপৃষ্ঠে গমন করিতে পারেন না।

কিয়ৎক্ষণ পরে, তিনি, এক আরবসেনাপতির পটমণ্ডপদ্বারে উপস্থিত হইয়া, আশ্রয়-প্রার্থনা করিলেন। আতিথেয়তা বিষয়ে পৃথিবীতে কোনাে জাতিই আরবদিগের তুল্য নহে। কেহ অতিথিভাবে আরবদিগের আলয়ে উপস্থিত হইলে, তাঁহারা সাধ্যানুসারে তাহার পরিচর্যা করেন; সে ব্যক্তি শত্রু হইলেও, অণুমাত্র অনাদর, বিদ্বেষপ্রদর্শন বা বিপক্ষতাচরণ করেন না।
আরবসেনাপতি তৎক্ষণাৎ প্রার্থিত আশ্রয় প্রদান করিলেন এবং তাহাকে নিতান্ত ক্লান্ত ও ক্ষুৎপিপাসায় একান্ত অভিভূত দেখিয়া, আহারাদির উদ্যোগ করিয়া দিলেন।.

মুরসেনাপতি ক্ষুন্নিবৃত্তি পিপাসাশান্তি ও ক্লান্তি পরিহার করিয়া উপবিষ্ট হইলে, বন্ধুভাবে উভয় সেনাপতির কথােপকথন হইতে লাগিল। তাহারা, পরস্পর স্বীয় ও স্বীয় পূর্বপুরুষদিগের সাহস, পরাক্রম, সংগ্রামকৌশল প্রভৃতির পরিচয় প্রদান করিতে লাগিলেন। এই সময়ে, সহসা আরবসেনাপতির মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। তিনি তৎক্ষণাৎ গাত্রোত্থান ও তথা হইতে প্রস্থান করিলেন, এবং কিঞ্চিৎ পরেই মুরসেনাপতিকে বলিয়া পাঠাইলেন আমার অতিশয় অসুখবােধ হইয়াছে, এজন্য আমি উপস্থিত থাকিয়া, আপনকার পরিচর্যা করিতে পারিলাম না; আহারসামগ্রী ও শয্যা প্রস্তুত হইয়াছে, আপনি আহার করিয়া শয়ন করুন। আর, আমি দেখিলাম, আপনকার অশ্ব যেরূপ ক্লান্ত ও হতবীর্য হইয়াছে, তাহাতে আপনি কোনােক্রমেই নিবৃদবেগে ও নিরুপদ্রবে স্বীয় শিবিরে পঁহুছিতে পারিবেন না। অতি প্রত্যুষে, এক দ্রুতগামী তেজস্বী অশ্ব, সজ্জিত হইয়া, পটমণ্ডপের দ্বারদেশে দণ্ডায়মান থাকিবেক; আমিও সেই সময়ে আপনকার সহিত সাক্ষাৎ করিব এবং যাহাতে আপনি সত্বর প্রস্থান করিতে পারেন, তদবিষয়ে যথােপযুক্ত আনুকুল্য করিব।

কী কারণে আরবসেনাপতি এরূপ বলিয়া পাঠাইলেন, তাহার মর্মগ্ৰহ করিতে না পারিয়া, মুরসেনাপতি, আহার করিয়া, সন্দিহানচিত্তে শয়ন করিলেন। রজনীশেষে, আরব সেনাপতির লােক তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ করাইল, এবং কহিল, আপনার প্রস্থানের সময় উপস্থিত, গাত্রোত্থান ও মুখপ্রক্ষালনাদি করুন, আহার প্রস্তুত। সেনাপতি শয্যা পরিত্যাগ পূর্বক, মুখপ্রক্ষালনাদি সমাপন করিয়া, আহারস্থানে উপস্থিত হইলেন, কিন্তু সেখানে আরবসেনাপতিকে দেখিতে পাইলেন না; পরে, দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, তিনি সজ্জিত অশ্বের মুখরশ্মি ধারণ করিয়া দণ্ডায়মান আছেন।

আরবসেনাপতি দর্শনমাত্র, সাদর সম্ভাষণ করিয়া, মুরসেনাপতিকে অশ্বপৃষ্ঠে আরােহণ করাইলেন, এবং কহিলেন, আপনি সত্বর প্রস্থান করুন; এই বিপক্ষশিবির-মধ্যে, আমা অপেক্ষা আপনকার ঘােরতর বিপক্ষ আর নাই। গত রজনীতে, যৎকালে, আমরা উভয়ে, একাসনে আসীন হইয়া, অশেষবিধ কথােপকথন করিতেছিলাম, আপনি, স্বীয় ও স্বীয় পূর্বপুরুষদিগের বৃত্তান্তবর্ণন করিতে করিতে, আমার পিতার প্রাণহত্যার নির্দেশ করিয়াছিলেন। আমি শ্রবণমাত্র, বৈরসাধন বাসনার বশবর্তী হইয়া, বারংবার এই শপথ ও প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, সূর্যোদয় হইলেই প্রাণপণে পিতৃহন্তার প্রাণবধসাধনে প্রবৃত্ত হইব। এখন পর্যন্ত সূর্যের উদয় হয় নাই, কিন্তু উদয়েরও অধিক বিলম্ব নাই; আপনি সত্বর প্রস্থান করুন। আমাদের জাতীয় ধর্ম এই, প্রাণান্ত ও সর্বস্বান্ত হইলেও, অতিথির অনিষ্টচিন্তা করি না। কিন্তু আমার পটমণ্ডপ হইতে বহির্গত হইলেই, আপনকার অতিথিভাব অপগত হইবে এবং সেই মুহূর্ত অবধি, আপনি স্থির জানিবেন, আমি আপনকার প্রাণসংহারের নিমিত্ত প্রাণপণে যত্ন ও অশেষ প্রকারে চেষ্টা পাইব। এই যে অপর অশ্ব সজ্জিত হইয়া দণ্ডায়মান আছে দেখিতেছেন, সূর্যোদয় হইবামাত্র, আমি উহাতে আরােহণ করিয়া, বিপক্ষভাবে আপনকার অনুসরণে প্রবৃত্ত হইব। কিন্তু আমি আপনাকে যে অশ্ব দিয়াছি, উহা আমার অশ্ব অপেক্ষা কোনাে অংশেই হীন নহে; যদি উহা দ্রুতবেগে গমন করিতে পারে, তাহা হইলে আমাদের উভয়ের প্রাণরক্ষার সম্ভাবনা।

এই বলিয়া, আরবসেনাপতি, সাদর সম্ভাষণ ও করমর্দন পূর্বক, তাহাকে বিদায় দিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করিলেন। আরবসেনাপতিও, সূর্যোদয়দর্শনমাত্র, অশ্বে আরােহণ করিয়া, তদীয় অনুসরণে প্রবৃত্ত হইলেন। মুরসেনাপতি কতিপয় মুহূর্ত পূর্বে প্রস্থান করিয়াছিলেন, এবং তদীয় অশ্বও বিলক্ষণ সবল ও দ্রুতগামী। এজন্য, তিনি নির্বিঘ্নে স্বপক্ষীয় শিবিরসন্নিবেশস্থানে উপস্থিত হইলেন। আরবসেনাপতি, সবিশেষ যত্ন ও নিরতিশয় আগ্রহ সহকারে, তাহার অনুসরণ করিতেছিলেন; কিন্তু তাহাকে স্বপক্ষশিবিরে প্রবিষ্ট হইতে দেখিয়া, এবং অতঃপর আর বৈরসাধন সংকল্প সফল হইবার সম্ভাবনা নাই বুঝিতে পারিয়া, স্বীয় শিবিরে প্রতিগমন করিলেন।