বাড়ির কাছে আরশিনগর - লালন ফকির



বাড়ির কাছে আরশিনগর

লালন ফকির


আমি একদিনও না দেখিলাম তারে 
আমার বাড়ির কাছে আরশিনগর 
ও এক পড়শি বসত করে। 
গ্রাম বেড়িয়ে অগাধ পানি 
ও তার নাই কিনারা নাই তরণী পারে – 
আমি বাঙ্ করি দেখব তারি
আমি কেমনে সে গাঁয় যাই রে।। 
বলব কি সেই পড়শির কথা 
ও তার হস্ত-পদ-স্কন্ধ-মাথা নাই রে। 
ও সে ক্ষণেক থাকে শূন্যের উপর। 
আবার ক্ষণেক ভাসে নীরে। 
পড়শি যদি আমায় ছুঁত 
আমার যম-যাতনা যেত দূরে। 
আবার সে আর লালন একখানে রয় 

তবু লক্ষ যােজন ফাঁক রে।

নুন - জয় গােস্বামী

নুন
জয় গােস্বামী

আমরা তাে অল্পে খুশি; কী হবে দুঃখ করে?
আমাদের দিন চলে যায় সাধারণ ভাতকাপড়ে।


চলে যায় দিন আমাদের অসুখে ধারদেনাতে
রাত্তিরে দু-ভাই মিলে টান দিই গঞ্জিকাতে 


সব দিন হয় না বাজার; হলে, হয় মাত্রাছাড়া 
বাড়িতে ফেরার পথে কিনে আনি গােলাপচারা


কিন্তু পুঁতব কোথায়? ফুল কি হবেই তাতে? 
সে অনেক পরের কথা। টান দিই গঞ্জিকাতে।


আমরা তাে এতেই খুশি; বলাে আর অধিক কে চায়? 
হেসে খেলে, কষ্ট করে, আমাদের দিন চলে যায় 


মাঝে মাঝে চলেও না দিন, বাড়ি ফিরি দুপুররাতে 
খেতে বসে রাগ চড়ে যায়, নুন নেই ঠান্ডা ভাতে 


রাগ চড়ে মাথায় আমার, আমি তার মাথায় চড়ি 
বাপব্যাটা দু-ভাই মিলে সারাপাড়া মাথায় করি


করি তাে কার তাতে কী? আমরা তাে সামান্য লােক 
আমাদের শুকনাে ভাতে লবণের ব্যবস্থা হােক।

শিক্ষার সার্কাস- আইয়াপ্পা পানিকর

শিক্ষার সার্কাস
আইয়াপ্পা পানিক্কর


তুমি যদি প্রথম শ্রেণিতে পাস করাে?
আমি দ্বিতীয় শ্রেণিতে যেতে পারি। 
তুমি যদি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাস করাে?
যদি আমি দ্বিতীয় শ্রেণি পাস করি,
বেশ, আমি সােজা তৃতীয় শ্রেণিতে যেতে পারি। 
তুমি যদি তৃতীয় শ্রেণিও পাস করাে?


বেশ, আমি তৃতীয় শ্রেণি পাস করি, বেশ তাহলে, 
এক, দুই, তিন..... চার ! 
তাহলে আমি চতুর্থ শ্রেণিতে বসতে পারি।

তুমি যদি এই সবগুলাে শ্রেণি পাস করাে?
যদি সব শ্রেণি শেষ হয়ে যায়, 
আমি তবু পরের শ্রেণিতে যাব।


সব শিক্ষা একটি সার্কাস 
যার সাহায্যে আমরা পরের শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হই। 
জ্ঞান কোথায় গেল? 

সে যেখানে গেছে, সেটা ধোঁকা!

পরবাসী - বিষ্ণু দে


পরবাসী
বিষ্ণু দে


দুই দিকে বন, মাঝে ঝিকিমিকি পথ ;
এঁকে বেঁকে চলে প্রকৃতির তালে-তালে।।
রাতের আলােয় থেকে-থেকে জ্বলে চোখ,
নেচে লাফ দেয় কচি-কচি খরগােশ। 


নিটোল টিলার পলাশের ঝােপে দেখেছি ? 
হঠাৎ পুলকে বনময়ূরের কথক, 
তাঁবুর ছায়ায় নদীর সােনালি সেতারে। 
মিলিয়েছি তার সুষমা। 


চুপি-চুপি আসে নদীর কিনারে, জল খায় 
শুনেছি সিন্ধুমুনির হরিণ-আহ্বান।
চিতা চলে গেল লুব্ধ হিংস্র ছন্দে । 
বন্য প্রাণের কথাকলি বেগ জাগিয়ে। 


কোথায় সে বন, বসতিও কৈ বসেনি, 
শুধু প্রান্তর শুকনাে হাওয়ার হাহাকার। 
জঙ্গল সাফ, গ্রাম মরে গেছে, শহরের 
পত্তন নেই, ময়ূর মরেছে পণ্যে। 


কেন এই দেশে মানুষ মৌন অসহায় ? 
কেন নদী গাছ পাহাড় এমন গৌণ? 
সারাদেশময় তঁাবু ব’য়ে কত ঘুরব ? 

পরবাসী কবে নিজবাসভূমি গড়বে?

বনভােজনের ব্যাপার - নারায়ণ গঙ্গােপাধ্যায়।



বনভােজনের ব্যাপার
নারায়ণ গঙ্গােপাধ্যায়

হবুল সেন বলে যাচ্ছিল—পপালাও, ডিমের ডালনা, রুই মাছের কালিয়া, মাংসের কোর্মা—
উস-উস শব্দে নােলার জল টানল টেনিদা :বলে যা—থামলি কেন? মুগ মুসল্লম, বিরিয়ানি পােলাও, মশলদা দোসে, চাউ-চাউ, সামি কাবাব
এবার আমাকে কিছু বলতে হয়। আমি জুড়ে দিলাম : আলু ভাজা, শুক্তো, বাটিচচ্চড়ি, কুমড়াের ছােকা—
টেনিদা আর বলতে দিলে না ! গাঁক গাঁক করে চেঁচিয়ে উঠল ; থাম প্যালা, থাম বলছি। শুক্তো, বাটিচচ্চড়ি। দাঁত খিচিয়ে বললে, তার চেয়ে বল-না হিঞ্চে সেদ্ধ, গাঁদাল আর শিঙিমাছের ঝােল! পালা-জ্বরে ভুগিস আর বাসক পাতার রস খাস, এর চাইতে বেশি বুদ্ধি আর কী হবে তাের! দিব্যি অ্যায়সা অ্যায়সা মােগলাই খানার কথা হচ্ছিল, তার মধ্যে ধাঁ করে নিয়ে এল বাটি চচ্চড়ি আর বিউলির ডাল! ধ্যাত্তোর।
ক্যাবলা বললে, পশ্চিমে কুঁরুর তরকারি দিয়ে ঠেকুয়া খায়। বেশ লাগে!
—বেশ লাগে ?—টেনিদা তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল : কঁচা লঙ্কা আর ছােলার ছাতু আরও ভালাে। লাগে না? তবে তাই আগে যা। তাদের মতাে উল্লুকের সঙ্গে পিকনিকের আলােচনাও ঝকমারি !

হাবুল সেন বললেন, আহা-হা চৈইত্যা যাইত্যাছ কেন? পােলাপানে কয়—
– পােলাপান! এই গাড়লগুলােকে জলপান করলে তবে রাগ যায়! তাও কি খাওয়া যাবে এগুলােকে? নিম-নিসিলের চেয়েও অখাদ্য। এই রইল তােদের পিকনিক—আমি চললাম! তােরা ছােলার ছাতু আর কাচা লঙ্কার পিণ্ডি গেল গেয়ে—আমি ওসবের মধ্যে নেই!
সত্যিই চলে যায় দেখছি! আর দলপতি চলে যাওয়া মানেই আমরা একেবারে অনাথ! আমি টেনিদার হাত চেপে ধরলাম : আহা, বােসাে-না। একটা প্ল্যান-ট্যান হােক। ঠাট্টাও বােঝে না।
টেনিদা গজগজ করতে লাগল : ঠাট্টা! কুমড়াের ছেকা আর কুঁদর তরকারি নিয়ে ওসব বিচ্ছিরি ঠাট্টা আমার ভালাে লাগে না।
-না,-না, ওসব কথার কথা—হাবুল সেন ঢাকাই ভাষায় বােঝাতে লাগল । মােগলাই খানা না হইলে আর পিকনিক হইল কী?
—তবে লিস্টি কর—টেনিদা নড়ে চড়ে বসল। প্রথমে যে লিস্টটা হলাে তা এইরকম :
বিরিয়ানি 
পােলাও
কোর্মা
কোপ্তা 
কাবাব (দু-রকম)।
মাছের চপ 
মাঝখানে বেরসিকের মতাে বাধা দিলে ক্যাবলা ; তাহলে বাবুর্চি ঢাই, একটা ঢাকর, একটা মােটর লরি, দুশাে টাকা
—দ্যাখ ক্যাবলা—টেনিদা ঘুসি বাগাতে চাইল। আমি বললাম, চটলে কী হবে? চারজনে মিলে চাদা উঠেছে দশ টাকা দু-আনা।
টেনিদা নাক চুলকে বললে, 'তাহলে একটু কমসম করেই করা যাক। ট্র্যাক-খালির জমিদার সব—তােদের নিয়ে ভদ্দরলােকে পিকনিক করে!
আমি বলতে যাচ্ছিলাম, তুমি দিয়েছ দু-আনা, বাকি দশ টাকা গেছে আমাদের তিনজনের পকেট থেকে। কিন্তু বললেই গাঁট্টা। আর সে গাঁট্টা ঠাট্রার জিনিস নয়—জুতসই লাগলে স্রেফ গালপাট্টা উড়ে যাবে।
রফা করতে করতে শেষপর্যন্ত লিস্টটা যা দাঁড়াল তা এই : খিচুড়ি (প্যালা রাজহাঁসের ডিম আনিবে বলিয়াছে) আলু ভাজা (ক্যাবলা ভাজিবে)। পােনা মাছের কালিয়া (প্যালা রীধিবে) আমের আচার (হাবুল দিদিমার ঘর হইতে হাতসাফাই করিবে) রসগােল্লা, লেডিকেনি (ধারে 'ম্যানেজ' করিতে হইবে)।
লিস্টি শুনে আমি হাঁড়িমুখ করে বললাম, ওর সঙ্গে আর-একটা আইটেম জুড়ে দে হাবুল। টেনিলা খাবে।
-হে-হেঁ—প্যালার মগজে শুধু গােবর নেই, ছটাকখানেক ঘিলুও আছে দেখছি। বলেই টেনিদা আদর করে আমার পিঠ চাপড়ে দিলে। “গেছি গেছি’ বলে লাফিয়ে উঠলাম আমি।
আমরা পটলডাঙার ছেলে—কিছুতেই ঘাবড়াই না। চাটুজ্জেদের রােয়াকে বসে রােজ দু-বেলা আমরা গন্ডায়গন্ডায় হাতি-গন্ডার সাবাড় করে থাকি। তাই বেশ ভাঁটের মাথায় বলেছিলাম, দূর-দূর। হাঁসের ডিম খায় ভদ্দরলােক! খেতে হলে রাজহাঁসের ডিম। রীতিমতাে রাজকীয় খাওয়া!
—কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে শুনি? খুব যে চালিয়াতি করছিস, তুই ডিম পাড়বি নাকি?—টেনিদা জানতে চেয়েছিল।
-আমি পাড়তে যাব কোন দুঃখে?কী দায় আমার ?—আমি মুখ ব্যাজার করে বলেছিলাম : হাঁসে পাড়বে।
তাহলে সেই হাঁসের কাছ থেকে ডিম তােকেই আনতে হবে। যদি না আনিস, তাহলে তাহলে কী হবে বলবার দরকার ছিল না। কিন্তু কী গেরাে বলাে দেখি। কাল রবিবার ভােরের গাড়িতেই আমরা বেরুব পিকনিকে। আজকের মধ্যেই রাজহাঁসের ডিম জোগাড় করতে না পারলে তাে গেছি। পাড়ায় ভন্টাদের বাড়ি রাজহাঁস আছে গােটাকয়েক। ডিম-টিমও তারা নিশ্চয় পাড়ে। আমি ভন্টাকেই পাকড়ালাম। কিন্তু কী খলিফা ছেলে ভন্টা! দু-আনার পাঁঠার ঘুগনি আর ডজনখানেক ফুলুরি সাবড়ে তবে মুখ খুলল!
ড্রিম দিতে পারি, তবে, নিজের হাতে বার করে নিতে হবে বাক্স থেকে।
—তুই দে না ভাই এনে। একটা আইসক্রিম খাওয়াব। ভন্টা ঠোট বেঁকিয়ে বললে, নিজেরা পােলাও-মাংস সাঁটাবেন স্নার আমার বেলায় আইসক্রিম! ওতে চলবে না। ইচেছ হয় নিজে বের করে নাও—ক্সামি বাবা ময়লা ঘাঁটতে পারব না। কী করি, রাজি হতে হলাে।
ভন্টা বললে, দুপুরবেলায় আসিস। বাবা-মেজদা অফিসে যাওয়ার পরে। মা তখন ভোস-ভোস করে ঘুমােয়। সেইসময় ডিম বের করে দেবাে!
গেলাম দুপুরে। উঠোনের একপাশে কাঠের বাক্স—তার ভিতরে সার-সার খুপরি। গােটা দুই হাঁস ভিতরে বসে ডিমে তা দিচ্ছে। ভন্টা বললে, যা নিয়ে আয়। | কিন্তু কাছে যেতেই বিতিকিচ্ছিরিভাবে লিফ্যাল করে উঠল হল দুটো। ফোস ফোস করছে যে!
ভণ্টা উৎসাহ দিলে : ডিম নিতে এসেছিস—একটু আপত্তি করবে না ? তাের কোনাে ভয় নেই প্যালা—দে হাত ঢুকিয়ে।
হাত ঢুকিয়ে দেবাে? কিন্তু কী বিচ্ছিরি ময়লা!—ময়লা আর কী বদখত গন্ধ! একেবারে নাড়ি উলটে আসে। তার ওপরে যে-রকম ঠোঁট ফাঁক করে ভয় দেখাচ্ছে
ভন্টা বললে, চিয়ার আপ প্যালা। লেগে যায়।
যা থাকে কপালে বলে যেই হাত ঢুকিয়েছিসঙ্গে সঙ্গো—ওরে বাপরে! খটাং করে হাঁসটা হাত কামড়ে ধরল। সে কী কামড়! হাই-মাই করে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।
-কী হয়েছে রে ভণ্টা, নীচে এত গােলমাল কীসের?—ভন্টার মার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল।
আমি আর নেই। হ্যাচকা টানে হাঁসের ঠোট থেকে হাত ছাড়িয়ে চোচা দৌড় লাগালাম। দরদর করে রক্ত পড়ছে তখন।
রাজহাঁস এমন রাজকীয় কামড় বসাতে পারে কে জানত। কিন্তু কী ফেরেববাজ ভন্টটি। জেনে-শুনে ব্রাত্মণের রক্তপাত ঘটাল। আচ্ছা—পিকনিকটা চুকে যাক—দেখে নেব তারপর। ওই পাঁঠার ঘুগনি আর ফুলুরির শােধ তুলে হাড়ব।
কী করা যায়—গাঁটের পয়সা দিয়ে মাদ্রাজি ডিমই কিনতে হলাে গােটাকয়েক।
পরদিন সকালে শ্যামবাজার ইস্টিশানে পৌছে দেখি, টেনিদা, ক্যাবলা আর হাবুল এর মধ্যেই মার্টিনের রেলগাড়িতে চেপে বসে আছে। সঙ্গে একরাশ হাঁড়ি-কলশি, চালের পটুলি, তেলের ভাড়। গাড়িতে গিয়ে উঠতে টেনিদা হাঁক ছাড়ল : এনেছিস রাজহাঁসের ডিম?
দুর্গা নাম করতে করতে পুটলি খুলে দেখালাম। –এর নাম রাজহাঁসের ডিম। ইয়ার্কি পেয়েছিস?—টেনিদা গাঁট্টা বাগাল। আমি গাড়ির খােলা দরজার দিকে সরে গেলাম : মানে ইয়ে, ছােটো রাজহাঁস কিনা। —ছােটো রাজহাঁস! কী পেয়েছিস আমাকে শুনি? পাগল না পেটখারাপ? হাবুল সেন বললে, ছাড়ান দাও—হাড়ান দাও। ডিম তাে আনছে!
টেনিদা গর্জন করে বললে, ডিম এনেছে না কচু। এই তােকে বলে রাখছি প্যালা—ডিমের ডালনা থেকে তাের নাম কেটে দিলাম। এক টুকরাে আলু পর্যন্ত নয়, একটু ঝােলও নয়!
মন খারাপ করে আমি বসে রইলাম। ডিমের ভুলনা আমি ভীষণ ভালােবাসি, তাই থেকেই আমাকে বাদ দেওয়া। আচ্ছা বেশ, খেয়াে তােমরা। এমন নজর দেবাে পেট ফুলে ঢােল হয়ে যাবে তােমাদের।
ৰ্পি করে বাঁশি বাজল-নড়ে উঠল মার্টিনের রেল। তারপর ধ্বস-ধ্বস ভেস-ভোস করে এর রানাঘর, ওর ভাড়ারঘরের পাশ দিয়ে গাড়ি চলল।
টেনিদা বললে, বাগুইআটি ছাড়িয়ে আরও চারটে ইস্টিশান। তার মানে প্রায় এক ঘণ্টার মামলা। লেডিকেনির হাঁড়িটা বের কর, ক্যাবলা।
ক্যাবলা বললে, এখুনি! তাহলে পেঁৗছােবার আগেই যে সাফ হয়ে যাবে?
টেনিদা বললে, সাফ হবে কেন, দুটো-একটা চেখে দেখব শুধু। আমার বাবা ট্রেনে চাপলেই খিদে পায়। এই একঘণ্টা ধরে শুধু শুধু বাল থাকতে পারব না। বের কর হাঁড়িচটপট—
হাঁড়ি চটপটই বেরুল—মানে, বেরুতেই হলাে তাকে। তারপর মার্টিনের রেলের চলার তালে তালে ঝটপট করে সাবাড় হয়ে চলল। আমি, ক্যাবলা আর হাবুল সেন জুলজুল করে শুধু তাকিয়েই রইলাম। একটা লেডিকেনি। চেখে দেখতে আমরাও যে ভালােবাসি, সেকথা আর মুখ ফুটে বলাই গেল না।
ইস্টিশান থেকে নেমে প্রায় মাইলখানেক হাঁটবার পরে ক্যাবলার মামার বাড়ি। কাঁচা রাস্তা, এঁটেল মাটি, তার ওপর কাল রাতে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে আবার। আগে থেকেই রসগােল্লার হাঁড়িটা বাগিয়ে নিলে টেনিদা।।
—এটা আমি নিচ্ছি। বাকি মােটঘাটগুলাে তােরা নে।
রসগােল্লা বরং আমি নিচ্ছি, তুমি চালের পোঁটলাটা নাও টেনিদা। লেডিকেনির পরিণামটা ভেবে আমি বলতে চেষ্টা করলাম।
টেনিদা চোখ পাকাল : খবরদার প্যালা, ওসব মতলব ছেড়ে দে। টুপটাপ করে দু-চারটে গালে ফেলবার বুদ্ধি, তাই নয় ? বাবা–চালাকি ন চলিষ্যতি।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাঁটরি-বোঁচকা কাধে ফেলে আমরা তিনজনেই এগােলাম। কিন্তু তিন পাও যেতে হলাে না। তার আগেই ধহধপাস। টেনে একখানা রাম-আছাড় খেলাে হাবুল। -এই খেয়েছে কচুপােড়া।—টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল।
সারা গায়ে কাদা মেখে হাবুল উঠে দাঁড়াল। হাতের ডিমের পুটলিটা তখন কুঁকড়ে এতটুকু—হলদে রস গড়াচ্ছে তা থেকে।
ক্যাবলা বললে, ডিমের ডালনার বারােটা বেজে গেল।
তা গেল। করুণ চোখে 'আমরা তাকিয়ে রইলাম সেইদিকে। ইন্স—এত কষ্টের ডিম। ওরই জন্যে রাজহাঁসের কামড় পর্যন্ত খেতে হয়েছে।
টেনিদা হুংকার দিয়ে উঠল : দিলে সব পণ্ড করে। এই ঢাকাই বাঙালটাকে সঙ্গে এনেই ভুল হয়েছে। পিটিয়ে ঢাকাই পরােটা করলে তবে রাগ যায়।।
আমি বলতে যাচ্ছিলাম, হাবুল চার টাকা চাঁদা দিয়েছে—তার আগেই কী যেন একটা হয়ে গেল! হঠাৎ মনে হলাে আমার পা দুটো মাটি ছেড়ে শোঁ করে শূন্যে উড়ে গেল, আর তারপরেই
কাল থেকে যখন উঠে দাঁড়ালাম, তখন আমার মাথা-মুখ বেয়ে আচারের তেল গড়াচ্ছে। ওই অবস্থাতেই চেটে দেখলাম একটুখানি। বেশ ঝাল-ঝাল টক-টক—বেড়ে আচারটা করেছিল হাবুলের দিদিমা!
ক্যাবলা আবার ঘােষণা করলে, আমের আচারের একটা বেজে গেল।
টেনিদা খেপে বললে, চুপ কর বলছি ক্যাবলা—এক চড়ে গালের বােম্বা উড়িয়ে দেবাে।
কিন্তু তার আগেই টেনিদার বােদা উড়ল—মানে স্রেফ লম্বা হলাে কাদায়। সাত হাত দূরে ছিটকে গেল রসগােল্লার হাঁড়ি—ধবধবে সাদা রসগােল্লাগুলাে পাশের কাদাভরা খানায় গিয়ে পড়ে একেবারে নেবুর আচার।
ক্যাবলা বললে, রসগােল্লার দুটো বেজে গেল!
এবার আর টেনিদা একটা কথাও বললে না। বলবার ছিলই বা কী! রসগােল্লার শােকে বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে চারজনে পথ চলতে লাগলাম আমরা। টেনিদা তবু লেডিকেনিগুলাে সাবাড় করেছে, কিন্তু আমাদেব সান্ত্বনা কোথায়। অমন স্পঞ্জ রসগোল্লাগুলাে।
পাঁচ মিনিট পরে টেনিদাই কথা কইল।
—তবু পােনা মাছগুলাে আছে কী বলিস! খিচুড়ির সঙ্গে মাছের কালিয়া আর আলুভাজা-নেহাত মন্দ হবে না—আঁা?
হাবুল বললে, হ-হ, সেই ভালাে। বেশি খাইলে প্যাট গরম হইব। গুরুপাক না খাওয়াই ভালাে।
ক্যাবলা মিটমিট করে হাসল: শেয়াল বলেছিল, দ্রাক্ষাফল অতিশয় খাট্টা।—ক্যাবলা ছেলেবেলায় পশ্চিমে ছিল, তাই দুই-একটা হিন্দি শব্দ বেরিয়ে পড়ে মুখ দিয়ে।
টেনিদা বলে খাট্টা! বেশি পাঁঠামি করবি তাে চাঁট্টা বসিয়ে দেবাে।
ক্যাবলা ভয়ে স্পিকটি নট। আমি তখনও নাকের পাশ দিয়ে ঝাল-ঝাল টক-টক তেল চাটছি। হঠাৎ বুক পকেটটা কেমন ভিজে ভিজে মনে হলাে। হাত দিয়ে দেখি, বেশ বড়ােসড়াে এক-টুকরাে আমের আচার তার ভেতরে কায়েমি হয়ে আছে।।
-জয়গুরু। এদিক-ওদিক তাকিয়ে টপ করে সেটা তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিলাম। সত্যি—হাবুলের দিদিমা বেড়ে আচার করেছিল! আরাে গােটাকয়েক যদি ঢুক! | বাগানবাড়িতে পৌঁছােলাম আরাে পনেরাে মিনিট পর।
চারিদিকে সুপুরি আর নারকেলের বাগান—একটা পানা-ভরতি পুকুর, মাঝখানে, একতলা বাড়িটা। কিন্তু ঘরে চাবিবন্ধ। মালিটা কোথায় কেটে পড়েছে, কে জানে!
টেনিদা বললে, কুছ পরােয়া নেই। চুলােয় যাক মালি। বলং বলং বাহুবলং—নিজেরা উনুন খুঁড়ব-খড়ি কুড়ুৰ, রান্না কৰ—মালি ব্যাটা থাকলেই তাে ভাগ দিতে হতাে। যা হাবুল ইট কুড়িয়ে আনউনুন করতে হবে। প্যালা, কাঠ কুড়িয়ে নিয়ে আয়,-ক্যাবলাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যা।
—আর তুমি?—আমি ফস করে জিজ্ঞেস করে ফেললাম।
—আমি একটা নারকেল গাছে হেলান দিয়ে টেনিদা হাই তুলল : আমি এগুলাে সব পাহারা দিচ্ছি। সবচাইতে কঠিন কাজটাই নিলাম আমি। শেয়াল কুকুর এলে তাড়াতে হবে তাে।যা তােরাহাতে হাতে বাকি কাজগুলাে চটপট সেরে আয়।
কঠিন কাজই বটে! ইস্কুলের পরীক্ষার গার্ডদেরও অমনি কঠিন কাজ করতে হয়। ত্রৈরাশিল্পে অঙ্ক কষতে গিয়ে যখন ‘ঘােড়া-ঘােড়া ঘাস-ঘাস’ নিয়ে আমাদের দম আটকাবার জো, তখন গার্ড মােহিনীবাবুকে টেবিলে পা তুলে দিয়ে ফোরর-ফো’ শব্দে নাক ডাকাতে দেখছি।


টেনিদা বললে, যা—যা সব—দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কী করে রান্নাটা করে ফ্যাল-বড় খিদে পেয়েছে।
তা পেয়েছে বইকি। পুরাে এক হাঁড়ি লেডিকেনি এখনও গজগজ করছে পেটের ভিতর। আমাদের বরাতেই শুধু অষ্টরম্ভা। প্যাচার মতাে মুখ করে আমরা কাঠ খড়ি সব কুড়িয়ে আনলাম।
টেনিদা লিস্টি বার করে বললে, মাছের কালিয়া–প্যালা রাঁধিবে। আমাকে দিয়েই শুরু। আমি মাথা চুলকে বললাম, খিচুড়ি-টিচুড়ি আগে হয়ে যাক—তবে তাে? —খিচুড়ি লাস্ট আইটেম—গরম গরম খেতে হবে। কালিয়া সকলের আগে। নে প্যালালেগে যা—
ক্যাবলার মা মাছ কেটে নুন-টুন মাখিয়ে দিয়েছিলেন, তাই রক্ষা। কড়াইতে তেল চাপিয়ে আমি মাছ ঢেলে দিলাম তাতে।
| আরে—এ কী কাণ্ড! মাছ দেবার সঙ্গে সঙ্গে কড়াই-ভরতি ফেনা। তারপরেই আর কথা নেই—অতগুলাে মাছ তালগােল পাকিয়ে গেল একসঙ্গে। মাছের কালিয়া নয়—মাছের হালুয়া।। ক্যাবলা আদালতের পেয়ালার মতাে ঘােষণা করল : মাছের কালিয়ার তিনটে বেজে গেল।
—তবে রে ইস্টুপিড। টেনিদা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল : কঁচা তেলে মাছ দিয়ে তুই কালিয়া রাঁধছিস ? এবার তাের পালাজ্বরের পিলেরই একদিন কি আমারই একদিন।
এ তাে মার্টিনের রেল নয়—সােজা মাঠের রাস্তা। আমার কান পাকড়াবার জন্যে টেনিদার হাতটা এগিয়ে আসবার আগেই আমি হাওয়া। একেবারে পাব মেলের স্পিডে।
টেনিদা চেঁচিয়ে বললে, খিচুড়ির লিস্ট থেকে পালার নাম কাটা গেল। তা যাক। কপালে আজ হরিমটর আছে সে তাে গােড়াতেই বুঝতে পেরেছি। গােমড়া মুখে একটা।
আমড়া-গাছতলায় এসে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম।
বসেবসে কাঠপিপড়ে দেখছি, হঠাৎ গুটি গুটি হাবুল আর ক্যাবল এসে হাজির।
—কী রে, তােরাও ? ক্যাবলা ব্যাজার মুখে বললে, খিচুড়ি টেনিদা নিজেই রাঁধবে। আমাদের আরও খড়ি আনতে পাঠাল।
সেই মুহূর্তেই হাবুল সেনের আবিষ্কার! একেবারে কলম্বাসের আবিষ্কার যাকে বলে।
—এই প্যালা—দ্যাখছস? ওই গাছটায় কীরকম জলপাই পাকছে!
আর বলতে হলাে না। আমাদের তিনজনের | পেটেই তখন খিদেয় ইদুর লাফাচ্ছে।
জলপাই—জলপাই-ই সই। সঙ্গে সঙ্গে আমরা গাছে উঠে। পলাম—আহা টকটক মিঠেমিঠে জলপাই—যেন অমৃত।
হাবুলের খেয়াল হলাে প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে।
-এই, টেনিদার খিচুড়ি কী হইল? ঠিক কথা—খিচুড়ি তাে এতক্ষণে হয়ে যাওয়া উচিত। তড়াক করে গাছ থেকে নেমে পড়ল ওরা। হাতের কাছে পাতা-টাতা যা পেলে, তাই নিয়ে ছুটল উদ্ধশ্বাসে। আমিও গেলাম পেছনে পেছনে, আশায় আশায়। মুখে যাই বলুক—এক হাতা খিচুড়িও কি আমায় দেবে না? প্রাণ কি এত পাষাণ হবে টেনিদার?
কিন্তু খানিক দূরে এগিয়ে আমরা তিনজনেই থমকে দাঁড়ালাম। একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ! | টেনিদা সেই নারকেল গাছটায় হেলান দিয়ে ঘুমুচ্ছে। আর মাঝে মাঝে বলছে, দে—দে ক্যাবলা, পিঠটা আর একটু ভালাে করে চুলকে দে।
পিঠ চুলকে দিচ্ছে—সন্দেহ কী। কিন্তু সে ক্যাবলা নয়—একটা গােদা বানর। আর চার-পাঁচটা গােল হয়ে বসেছে টেনিদার চারিদিকে। কয়েকটা তাে মুঠো মুঠো চাল ভাল মুখে পুরছে, একটা আলুগুলাে সাবাড় করছে আর আস্তে আস্তে টেনিদার পিঠ চুলকে দিচ্ছে। আরামে হাঁ করে ঘুমুচ্ছে টেনিদা, থেকে থেকে বলছে, দে ক্যাবলা, আর একটু ভালাে করে চুলকে দে!
এবার আমরা তিনজনেই গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম। টেনিদা-বাঁদর-বাঁদর।। —কী! আমি বাঁদর!—বলেই টেনিদা হাঁ করে সােজা হয়ে বসল—সঙ্গে সঙ্গেই বাপ বাপ বলে চিৎকার। -ই-ই-ক্লি-ক্লিচ। কিচকিচ!
চোখের পলকে বানরগুলাে কাঁঠাল গাছের মাথায়। চাল-ডাল-আলুর পুটলিও সেইসঙ্গে। আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে তরিবত করে খেতে লাগল—সেইসঙ্গে কী বিচ্ছিরি ভেংচি। ওই ভেংচি দেখেই না লঙ্কার রাক্ষসগুলাে ভয় পেয়ে যুদ্ধে হেরে গিয়েছিল।
পুকুরের ঘাটলায় চারজনে আমরা পাশাপাশি চুপ করে বসে রইলাম। যেন শােকসভা। খানিক পরে ক্যাবলাই স্তব্দতা ভাঙল।
- বনভােজনের চারটে বাজল।।
– তা বাজল।—টেনিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলল । কিন্তু কী করা যায় বলতে প্যালা? সেই লেডিকেনিগুলাে কখন হজম হয়ে গেছে—পেট চুই-ছুঁই করছে খিদেয়।
অগত্যা আমি বললাম বাগানে একটি গাছে জলপাই পেকেছে, টেনিদা—
জলপাই! ইউরেকা! বনে ফলভােজন— সেইটেই তাে আসল বনভােজন। চল চল, শিগগির চল। লাফিয়ে উঠে টেনিদা বাগানের দিকে ছুটল।

আকাশে সাতটি তারা - জীবনানন্দ দাশ





আকাশে সাতটি তারা
জীবনানন্দ দাশ

আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে।
বসে থাকি; কামরাঙা-লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতাে 
গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে—আসিয়াছে শান্ত অনুগত 
বাংলার নীল সন্ধ্যা—কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে; 
আমার চোখের পরে আমার মুখের 'পরে চুল তার ভাসে; 
পৃথিবীর কোনাে পথ এ কন্যারে দেখে নি কো—দেখি নাই অত 
অজস্র চুলের চুমা হিজলে কাঁঠালে জামে ঝরে অবিরত, 
জানি নাই এত স্নিগ্ধ গন্ধ ঝরে রূপসীর চুলের বিন্যাসে


পৃথিবীর কোনাে পথে : নরম ধানের গন্ধ—কলমীর ঘ্রাণ, 
হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদ-সরপুঁটিদের
মৃদু ঘ্রাণ, কিশােরীর চালধােয়া ভিজে হাত—শীত হাতখান,
কিশােরের পায়ে- দলা মুথাঘাস—লাল লাল বটের ফলের 
ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতা—এরই মাঝে বাংলার প্রাণ; 
আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি পাই টের।

হিমালয় দর্শন - বেগম রােকেয়া


হিমালয় দর্শন
বেগম রােকেয়া

যথা সময় যাত্রা করিয়া শিলিগুড়ি স্টেশনে আসিয়া পঁহুছিলাম। শিলিগুড়ি হইতে হিমালয় রেল রােড আরম্ভ হইয়াছে। ইস্ট ইন্ডিয়ান গাড়ির অপেক্ষা ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলগাড়ি ছােটো, হিমালয়ান রেলগাড়ি আবার তাহার অপেক্ষাও ছােটো, ক্ষুদ্র গাড়িগুলি খেলনা গাড়ির মতাে বেশ সুন্দর দেখায়। আর গাড়িগুলি খুব নীচু।-যাত্রীগণ ইচ্ছা করিলে চলিবার সময়ও অনায়াসে উঠিতে নামিতে পারেন।
আমাদের ট্রেন অনেক আঁকাবাঁকা পথ অতিক্রম করিয়া ধীরে ধীরে উপরে উঠিতে লাগিলগাড়িগুলি ‘কটাটটা’-শব্দ করিতে করিতে কখনও দক্ষিণে কখনও উত্তরে আঁকিয়া বাঁকিয়া চলিল। পথের দুই ধারে মনােরম দৃশ্য—কোথাও অতি উচ্চ (step) চূড়া, কোথাও নিবিড় অরণ্য।
ক্রমে আমরা সমুদ্র (sea level) হইতে তিন হাজার ফিট উচ্চে উঠিয়াছি, এখনও শীত বােধ হয় না, কিন্তু মেঘের ভেতর দিয়া চলিয়াছি। নিম্ন উপত্যকায় নির্মল শ্বেত কুজঝটিকা দেখিয়া সহসা নদী বলিয়া ভ্রম জন্মে। তরু, লতা, ঘাস, পাতা-সকলই মনােহর। এত বড়াে বড়াে ঘাস আমি পূর্বে দেখি নাই। হরিদ্বর্ণ চায়ের ক্ষেত্রগুলি প্রাকৃতিক শােভা আরও শতগুণ বৃদ্ধি করিয়াছে। দূর হইতে সারি সারি চারাগুলি বড়াে সুন্দর বােধ হয়। মাঝে মাঝে মানুষের চলিবার সংকীর্ণ পথগুলি ধরণীর সীমন্তের ন্যায় দেখায়! নিবিড় শ্যামল বন বসুমতীর ঘন কেশপাশ, আর পথগুলি আঁকা বাঁকা সিথি!
রেলপথে অনেকগুলি জলপ্রপাত বা নিঝর দৃষ্টিগােচর হইল—ইহার সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। কোথা হইতে আসিয়া ভীমবেগে হিমাদ্রির পাষাণ হৃদয় বিদীর্ণ করিতে করিতে ইহারা কোথায় চলিয়াছে। ইহাদেরই কোন একটি বিশালকায় জাহ্নবীর উৎস, একথা সহসা বিশ্বাস হয় কি? একটি বড়াে ঝরনার নিকট ট্রেন থামিল, আমরা ভাবিলাম, যাহাতে আমরা প্রাণ ভরিয়া জলপ্রবাহ দেখিতে পাই, সেই জন্য বােধহয় গাড়ি থামিয়াছে। (বাস্তবিক সেজন্য কিন্তু ট্রেন থামে নাই—অন্য কারণ ছিল। সেইখানে জল পরিবর্তন করা হইতেছিল।) যে কারণেই ট্রেন থামুক-আমাদের মনােরথ পূর্ণ হইল।
এখন আমরা চারি হাজার ফিট উর্ধ্বে উঠিয়াছি, বুশীত অনুভব করি না, কিন্তু গরমের জ্বালায় যে এতক্ষণ প্রাণ কষ্ঠাগত ছিল-সে জুলুম হইতে রক্ষা পাইলাম। অল্প অল্প বাতাস মৃদু গতিতে বহিতেছে।
অবশেষে কারসিয়ং স্টেশনে উপস্থিত হইলাম, এখানকার উচ্চতা ৪৮৬৪ ফিট। স্টেশন হইতে আমাদের বাসা অধিক দূর নহে, শীঘ্রই আসিয়া পঁহুছিলাম। আমাদের ট্রাঙ্ক কয়টা প্রমক্রমে দার্জিলিঙের ঠিকানায় book করা হইয়াছিল। জিনিসপত্রের অভাবে বাসায় আসিয়াও (সন্ধ্যার পূর্বে) গৃহসুখ (at home) অনুভব করিতে পারি নাই! সন্ধ্যার ট্রেনে আমাদের ট্রাঙ্কগুলি ফিরিয়া আসিল। আমাদের দার্জিলিং যাইবার পূর্বে আমাদের জিনিসপত্র থাকার বায়ু সেবন করিয়া চরিতার্থ হইল! পরদিন হইতে আমরা সম্পূর্ণ গৃহসুখে আছি। তাই বলি, কেবল আশ্রয় পাইলে সুখে গৃহে থাকা হয় না, আবশ্যকীয় আসবাব সরঞ্জামও চাই।
এখানে এখনও শীতের বৃদ্ধি হয় নাই, গ্রীষ্মও নাই। এ সময়কে পার্বত্য বসন্তকাল বলিলে কেমন হয় ? সুর্যকিরণ প্রখর বােধ হয়। আমাদের আসিবার পর একদিন মাত্র সামান্য বৃষ্টি হইয়াছিল। বায়ু ততখুবই স্বাস্থ্যকর, জল নাকি খুব ভালাে নহে। আমরা পানীয় জল ফিলটারে ছাঁকিয়া ব্যবহার করি। জল কিন্তু দেখিতে খুব পরিষ্কার স্বচ্ছ। কূপ নাই, নদী পুষ্করিণীও নাই—সবে ধন নিঝরের জল। ঝরনার সুবিমল, সুশীতল জলদর্শনে চক্ষু জুড়ায়, স্পর্শনে হস্ত জুড়ায় এবং ইহার চতুস্পার্ঘস্থিত শীতল বাতাসে, না, ঘন কুয়াশায় প্রাণ জুড়ায়!
এখানকার বায়ু পরিস্কার ও হালকা। বায়ু এবং মেদের লুকোচুরি খেলা দেখিতে চমৎকার ! এই মেঘ এদিকে আছে, ওদিক হইতে বাতাস আসিল,মেঘখণ্ডকে তাড়াইয়া লইয়া চলিল। প্রতিদিন অস্তমান রবি বায়ু এবং মেঘ লইয়া মনােহর সৌন্দর্যের রাজ্য রচনা করে। পশ্চিম গগনে পাহাড়ের গায়ে তরল স্বর্ণ ঢালিয়া দেওয়া হয়। অতঃপর খণ্ড খণ্ড সুকুমার মেঘগুলি সুকোমল অঙ্গে সুবর্ণ মাখিয়া বায়ুভরে ইতস্তত ছুটাছুটি করিতে থাকে। ইহাদের এই তামাশা দেখিতেই আমার সময় অতিবাহিত হয়, আত্মহারা হইয়া থাকি, আমি কোনাে কাজ করিতে পারি না।
মনে পড়ে একবার মহিলায় টেকির শাকের কথা পাঠ করিয়াছি। টেকি শাককে আমি ক্ষুদ্র গুল্ম বলিয়াই জানিতাম। কেবল ভূ-তত্ত্ব (Geology) গ্রন্থে পাঠ করিয়াছিলাম যে, কারনিফেরাস যুগে বড় বড় ঢেকিন্তু ছিল। এখন সেই টেকিতবু স্বচক্ষে দেখিলাম—ভারী আনন্দ হইল। তরুবর ২০/২৫ ফিট উচ্চ হইবে।
কোনাে কোনাে স্থানে খুব নিবিড় বন। সুখের বিষয় বাঘ নাই, তাই নির্ভয়ে বেড়াইতে পারি, আমরা নির্জন বন্য পথেই বেড়াইতে ভালােবাসি। সর্প এবং ছিনে জোঁক আছে। এ পর্যন্ত সর্পের সহিত আমাদের সাক্ষাৎ হয় নাই। কেবল দুই তিন বার জোঁকে রক্ত শােষণ করিয়াছে।
এদেশের স্ত্রীলােকেরা জোঁক দেখিলে ভয় পায় না। আমাদের ভুটিয়া চাকরানি ‘ভালু' বলে, ‘জেকে কি ক্ষতি করে ? রক্ত শােষণ শেষ হইলে আপনিই চলিয়া যায়। ভুটিয়ানিরা সাত গজ লম্বা কাপড় ঘাঘরার মতাে করিয়াপরে, কোমরে একখণ্ড কাপড় জড়ানাে থাকে, গায়ে জ্যাকেট এবং বিলাতি শাল দ্বারা মাথা ঢাকে, পৃষ্ঠে দুই এক মন বােঝা লইয়া অনায়াসে প্রস্তর-সল আবুড়াখাবুড়া পথ বহিয়া উচ্চে উঠে; ঐরুপ নীচেও যায়। যে পথ দেখিয়াই আমাদের সাহস গায়েব হয়—সেই পথে উহারা বােঝা লইয়া অবলীলাক্রমে উঠে।

মহিলার সম্পাদক মহাশয় আমাদের সম্বন্ধে একবার লিখিয়াছিলেন যে, রমণীজাতি দুর্বল বলিয়া তাঁহাদের নাম অবলা। জিজ্ঞাসা করি, এই ভূটিয়ানিরাও ঐ অবলা জাতির অন্তর্গত না কি? ইহারা উদরান্নের জন্য পুরুষদের প্রত্যাশী নহে; সমভাবে উপার্জন করে। বরং অধিকাংশ স্ত্রীলােকদিগকেই পাথর বহিতে দেখি-পুরুষেরা বেশি বােঝা বহন করে না। অবলারা প্রস্তর বহিয়া লইয়া যায়। সবলেরা পথে পাথর বিছাইয়া রাস্তা প্রস্তুত করে, সে কাজে বালক বালিকরাও যােগদান করে। এখানে সবলেরা বালক বালিকার দলভুক্ত বলিয়া বােধ হয়। | ভূটিয়ানিরা পাহাড়নি” বলিয়া আপন পরিচয় দেয়, এবং আমাদিগকে নীচেকা আমি’ বলে! যেন ইহাদের মতে নীচেকা আদমি'-ই অসভ্য! স্বভাবত ইহারা শ্রমশীলা, কার্যপ্রিয়, সাহসী ও সত্যবাদী। কিন্তু নীচেকা আদমি'র সংস্রবে থাকিয়া ইহারা ক্রমশ সশ্যাণরাজি হারাইতেছে। বাজারের পয়সা অল্পস্বল্প চুরি করা, দুধে জল মিশানাে ইত্যাদি দোষ শিখিতেছে। আবার ‘নীচেকা আদমি'র সঙ্গে বিবাহও হয়! ঐরূপে উহারা অন্যান্য জাতির সহিত মিশিতেছে। | আমাদের বাসা হইতে প্রায় এক মাইল দূরে বড়াে একটা ঝরনা বহিতেছে; এখান হইতে ঐ দুগ্ধফেননিভ জলের স্রোত দেখা যায়। দিবানিশি তাহার কল্লোল গীতি শুনিয়া ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির উচ্ছাস দ্বিগুণ ত্রিগুণ বেগে প্রবাহিত হয়। বলি, প্রাণটাও কেন ঐ নিঝরের ন্যায় বহিয়া গিয়া পরমেশ্বরের চরণপ্রান্তে লুটাইয়া পড়ে না?
অধিক কী বলিব, আমি পাহাড়ে আসিয়া অত্যন্ত সুখী এবং ঈশ্বরের নিকট কৃতজ্ঞ হইয়াছি। সমুদ্রের সামান্য নমুনা, অর্থাৎ বঙ্গোপসাগর দেখিয়াছি, বাকি ছিল পর্বতের একটি নমুনা দেখা। এখন সে সাধও পূর্ণ হইল। | না, সাধ তাে মিটে নাই! যত দেখি, ততই দর্শন পিপাসা শতগুণ বাড়ে! কিন্তু কেবল দুইটি চক্ষু দিয়াছেন, তাহা দ্বারা কত দেখিব? প্রভু অনেকগুলি চক্ষু দেন নাই কেন? যত দেখি, যত ভাবি, তাহা ভাষায় ব্যক্ত করিবার ক্ষমতা নাই। প্রত্যেকটি উচ্চশৃশ, প্রত্যেকটি ঝরনা প্রথমে যেন বলে, আমায় দেখ! আমায় দেখ! যখন তাহাকে বিস্ময়-বিস্ফারিত নয়নে দেখি, তখন তাহারা ঈষৎ হাস্যে ভূকুটি করিয়া বলে, আমাকে কী দেখ? আমার স্রষ্টাকে স্মরণ করাে! ঠিক কথা। চিত্র দেখিয়া চিত্রকরের নৈপুণ্য বুঝা যায়। নতুবা নাম শুনিয়া কে কাহাকে চিনে? আমাদের জন্য হিমালয়ের এই পাদদেশটুকু কত বৃহৎ, কত বিস্তৃত-কী মহান! আর সেই মহাশিল্পীর সৃষ্ট জগতে হিমালয় কত ক্ষুদ্র! বালুকাকণা বলিলেও বড়াে বলা হয়!
আমাদের এমন সুন্দর চক্ষু, কর্ণ, মন লইয়া যদি আমরা স্রষ্টার গুণকীর্তন না করি, তবে কি কৃতগ্নতা হয় না? মন, মস্তিষ্ক, প্রাণ সৰ লইয়া উপাসনা করিলে, তবে তৃপ্তি হয়। কেবল টিয়াপাখির মতাে কণ্ঠস্থ কতকগুলি শব্দ উচ্চারণ করিলে (অন্তত আমার মতে) উপাসনা হয় না। তদ্রুপ উপাসনায় প্রাণের আবেগ থাকে কই? প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দর্শনকালে মন প্রাণ স্বতঃই সমস্বরে বলিয়া উঠে, “ঈশ্বরই প্রশংসার যােগ্য। তিনিই ধন্য। তখন এসব কথা মুখে উচ্চারণের প্রয়ােজনও হয় না।
(সংক্ষেপিত ও সম্পাদিত)