অনুবাদ সাহিত্য
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে যে বেশকিছু সাহিত্য রচিত হয়েছিল
তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলা যেতে পারে অনুবাদ সাহিত্য। আমরা জানি, ১২০৬
খ্রীঃ যে তুর্কি আক্রমণ হয়েছিল তার ফলে বাংলাদেশের সমাজ এক বৃহৎ সংকটের মুখে পড়ে। অর্থাৎ,
হিন্দু শাসনতন্ত্রের অবসান ও ইসলামীয় শাসনতন্ত্রের শুরু। এই সময় বিশেষত নীম্নবর্গীয়
যে সকল হিন্দু জনজাতি ছিল তারা ক্রমশ ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে থাকে। কাজেই হিন্দুদের
কাছে তাদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখা ছিল একমাত্র উপায়। আর সেই কারনেই একদল মানুষ
অবক্ষয়িত হিন্দু সমাজকে পুনরুজ্জীবিত করতে ভারতীয় পুরানের অনুবাদ করতে থাকেন। তার-ই
ফলে জন্ম নেয় অনুবাদ সাহিত্য।
অনেকের মতে, বাংলায় ইসলামি শাসন শুরু হলে পাঠান সুলতানরা
সভাকবিদের কাছ থেকে রামায়ন মহাভারতের গল্প শুনতে আগ্রহী হন, এবং অনুবাদ রচনায়
উদ্বুদ্ধ করেন । যার ফলশ্রুতি মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্য। এর প্রমাণ স্বরূপ বলা
যেতে পারে- রুকনুদ্দিন বরবক শাহ মালাধর বসুকে ভাগবতের অনুবাদ রচনার জন্য ‘গুণরাজখান’
উপাধি দেন। আবার পরাগল খা তার সভাকবিদের দিয়ে মহাভারত অনুবাদ করিয়ে নেন। ফলত, অনুবাদ
সাহিত্য রচনার পিছনে যে ইসলামীয় রাজাদের প্রভাব ছিল না , সেটা অস্বীকার করা যায়
না।
বাংলা সাহিত্যে অনুবাদ সাহিত্য মূলত তিনটি-
রামায়ণ
মহাভারত
ভাগবত
অনুবাদ সাহিত্য এ ক্ষেত্রে
প্রথমেই উল্লেখযোগ্য রামায়ণ রচয়িতা কৃত্তিবাস ওঝা । বড়ু চন্ডীদাসের পরে তিনিই বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবি। তাঁর রচিত রামায়ণ বাংলা ভাষায় প্রথম ও সর্বাধিক জনপ্রিয় কাব্য। বর্ণনার হৃদয়গ্রাহিতা এবং ভাষার প্রাঞ্জলতাই এর জনপ্রিয়তার
কারণ। কৃত্তিবাসী রামায়ণ হিসাবে পরিচিত গ্রন্থটি ১৮০২ - ০৩ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশন থেকে মুদ্রিত হয় । মুদ্রণের সঙ্গে সঙ্গে
সমগ্র বঙ্গদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে ।
রামায়ণেরকয়েকজন উল্লেখযোগ্য অনুবাদক ও কাব্যের নাম দেওয়া হলঃ
সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ’সাধারণভাবে ভাগবত’নামে পরিচিত। বেদব্যাস-প্রণীত অষ্টাদশ পুরাণের অন্যতম এবং তাঁর ব্রহ্মসুত্রের বারোটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত অকৃত্রিম ভাষ্য হল ‘ভাগবত’। এর বিষয়বস্তু হল শ্রীকৃষ্ণেরর জীবনকথা। বাংলায় 'ভাগবতচর্চার শুরু চৈতন্য-পূর্ব যুগে হলেও এর বিস্তার ঘটেছে চৈতন্য পরবর্তী যুগে । সংস্কৃত ভাগবত পুরাণ অবলম্বনে বাংলায় প্রথম কাব্য রচনা করেন বর্ধমান জেলার কুলীন গ্রাম নিবাসী মালাধর বসু বা গুণরাজ খান। তিনি চৈতন্যপূর্ব যুগের কবি ছিলেন। মালাধর বসুই ভাগবতের প্রথম অনুবাদক। তার আগে অন্য কোনো ভাষায় ভাগবত অনূদিত হয়। তাঁর কাব্যের নাম “শ্রীকৃষ্ণুবিজয়। কাব্যটি ১৪৭৩-১৪৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত হয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণবিজয় রচনা করে তিনি গৌড়ের সুলতানের কাছ থেকে গুণরাজ খাঁ উপাধি পান।শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যের অপর নাম ছিল গোবিন্দমঙ্গল। এটিই সন-তারিখযুক্ত প্রথম বাংলা কাব্য। বিষ্ণুপুরাণ, হরিবংশ, বৈষুবীয় তন্ত্র গ্রন্থের অনুসরণে কবি তার কাব্য রচনা করেছেন।তাঁর কবিত্বের সঙ্গে ভক্তিপ্রাণতার মিশেল ও ঐশ্বর্যভাবের সঙ্গে মধুর কান্তাভাবের সমন্বয় শ্রী চৈতন্যও আস্বাদন করেন। রাধাভাবের উন্মেষ তার কাব্যেই প্রথম লক্ষ করা যায়, যা বৈষব পদাবলির পূর্বাভাসকে সূচিত করেছে। কাব্যে শ্রীকৃষ্ণুের ঐশ্বর্যভাবের চেয়ে মধুর ও কান্তা ভাবটিই বেশি প্রকাশ পেয়েছে।
ভাগবতের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য অনুবাদক ও কাব্যের নাম দেওয়া হলঃ
-
রামায়ণেরকয়েকজন উল্লেখযোগ্য অনুবাদক ও কাব্যের নাম দেওয়া হলঃ
সময়কাল
|
কবি
|
কাব্যের নাম
|
পঞ্চদশ শতাব্দী
|
কৃত্তিবাস ওঝা
|
শ্রীরাম পাঁচালি
|
মাধব কন্দলি
|
শ্রীরাম পাঁচালি।
|
|
ষোড়শ শতাব্দী
|
শঙ্কর দেব
|
শ্রীরাম পাঁচালি (উত্তর কাণ্ড)
|
সপ্তদশ শতাব্দী
|
নিত্যানন্দ আচার্য
|
অদ্ভুত আচার্যের রামায়ণ
|
রামশঙ্কর দত্ত
|
রাম কথা
|
|
চন্দ্রাবতী
|
রামায়ণ
|
|
অষ্টাদশ শতাব্দী
|
রামচন্দ্র
|
বিভীষণের রায়বার
|
কাশীরাম
|
কালনেমির রায়বার
|
|
জগন্নাথ দাস
|
লঙ্কাকাণ্ড
|
|
উৎসবানন্দ
|
সীতার বনবাস
|
|
জগতরাম রায়
|
অদ্ভুত রামায়ণ
|
মহাভারতের প্রথম বাংলা
অনুবাদ হচ্ছে কবীন্দ্র মহাভারত । আনুমানিক ১৫১৫ - ১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কবীন্দ্র
পরমেশ্বর মহাভারতের বাংলা অনুবাদ করেন । লস্কর পরাগল খাঁর নির্দেশে রচিত বলে এটি পরাগলী মহাভারত নামেও পরিচিত । কবীন্দ্র মহাভারতে অশ্বমেধপর্ব
সংক্ষিপ্ত ছিল বলে ছুটি খাঁর নির্দেশে শ্রীকর নন্দী জৈমিনিসংহিতার অশ্বমেধপর্ব অবলম্বনে
বিস্তৃত আকারে সেটি রচনা করেন, যাকে পৃথক গ্রন্থ না বলে বরং কবীন্দ্র মহাভারতের পরিশিষ্ট
বলা চলে । তবে বাংলা মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক
কাশীরাম দাস । আনুমানিক ১৬০২ - ১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তাঁর কাব্য রচনা করেন । তিনি মহাভারতের কটি পর্ব অনুবাদ
করেছিলেন তা জানা না গেলেও শ্রীরামপুর প্রেস থেকে ১৮০১-৩ খ্রিস্টাব্দে
কাব্যটির চারটি পর্ব মুদ্রিত হয় । পরবর্তী কালে জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের সম্পাদনায় ১৮৩৬ খ্রীঃ সম্পূর্ণ অংশ মুদ্রিত হয়।
মধুর শব্দ , উপমা, অলংকার ছন্দের নৈপুন্যে তাঁর কাব্যশৈলী শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখে।
কাশীরাম দাসের মহাভারত ‘ভারত পাঁচালি’ নামেও পরিচিত ছিল । সকল বাংলা মহাভারতের
অনুবাদের মধ্যে এটিই সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে ।
মহাভারতের কয়েকজন
উল্লেখযোগ্য অনুবাদক ও কাব্যের নাম দেওয়া হলঃ
সময়কাল
|
কবি
|
কাব্যের নাম
|
ষোড়শ শতাব্দী
|
কবিন্দ্র পরমেশ্বর
|
পাণ্ডব বিজয়
|
শ্রীকর নন্দী
|
অশ্বমেধ কথা
|
|
রামচন্দ্র খান
|
অশ্বমেধ পর্ব
|
|
সপ্তদশ শতাব্দী
|
কাশীরাম দাস
|
মহাভারত
|
নিত্যানন্দ ঘোষ
|
মহাভারত
|
|
অষ্টাদশ শতাব্দী
|
দুর্লভ সিংহ
|
ভারত পাঁচালি
|
পুরুষোত্তম দাস
|
পাণ্ডব পাঁচালি
|
সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ’সাধারণভাবে ভাগবত’নামে পরিচিত। বেদব্যাস-প্রণীত অষ্টাদশ পুরাণের অন্যতম এবং তাঁর ব্রহ্মসুত্রের বারোটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত অকৃত্রিম ভাষ্য হল ‘ভাগবত’। এর বিষয়বস্তু হল শ্রীকৃষ্ণেরর জীবনকথা। বাংলায় 'ভাগবতচর্চার শুরু চৈতন্য-পূর্ব যুগে হলেও এর বিস্তার ঘটেছে চৈতন্য পরবর্তী যুগে । সংস্কৃত ভাগবত পুরাণ অবলম্বনে বাংলায় প্রথম কাব্য রচনা করেন বর্ধমান জেলার কুলীন গ্রাম নিবাসী মালাধর বসু বা গুণরাজ খান। তিনি চৈতন্যপূর্ব যুগের কবি ছিলেন। মালাধর বসুই ভাগবতের প্রথম অনুবাদক। তার আগে অন্য কোনো ভাষায় ভাগবত অনূদিত হয়। তাঁর কাব্যের নাম “শ্রীকৃষ্ণুবিজয়। কাব্যটি ১৪৭৩-১৪৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত হয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণবিজয় রচনা করে তিনি গৌড়ের সুলতানের কাছ থেকে গুণরাজ খাঁ উপাধি পান।শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যের অপর নাম ছিল গোবিন্দমঙ্গল। এটিই সন-তারিখযুক্ত প্রথম বাংলা কাব্য। বিষ্ণুপুরাণ, হরিবংশ, বৈষুবীয় তন্ত্র গ্রন্থের অনুসরণে কবি তার কাব্য রচনা করেছেন।তাঁর কবিত্বের সঙ্গে ভক্তিপ্রাণতার মিশেল ও ঐশ্বর্যভাবের সঙ্গে মধুর কান্তাভাবের সমন্বয় শ্রী চৈতন্যও আস্বাদন করেন। রাধাভাবের উন্মেষ তার কাব্যেই প্রথম লক্ষ করা যায়, যা বৈষব পদাবলির পূর্বাভাসকে সূচিত করেছে। কাব্যে শ্রীকৃষ্ণুের ঐশ্বর্যভাবের চেয়ে মধুর ও কান্তা ভাবটিই বেশি প্রকাশ পেয়েছে।
ভাগবতের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য অনুবাদক ও কাব্যের নাম দেওয়া হলঃ
সময়কাল
|
কবি
|
কাব্যের নাম
|
পঞ্চদশ শতাব্দী
|
মালাধর বসু
|
শ্রীকৃষ্ণবিজয়
|
ষোড়শ শতাব্দী
|
গোবিন্দ আচার্য
|
কৃষ্ণমঙ্গল
|
দ্বিজ মাধব
|
শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল
|
|
সপ্তদশ শতাব্দী
|
যশশ্চন্দ্র
|
গোবিন্দবিলাস
|
অষ্টাদশ শতাব্দী
|
অভিরাম দাস
|
কৃষ্ণমঙ্গল
|
ঘনশ্যাম দাস
|
শ্রীকৃষ্ণবিলাস
|
-