হঠাৎ মনে পড়ল, হুড়কো খুলবার আগে দশবার নিশ্বাস ফেলবার কথা। মানসিক উত্তেজনায় নিশ্বাস পড়ছেই না তা গুনবে কী।...বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করছে। বুড়ি তাড়াতাড়ি দশবার নিশ্বাস ফেলে নিয়মরক্ষা করে নিল।
দরজা খুলে সম্মুখে এক লম্বাচওড়া লােককে দেখে ডাকাতের মায়েরও গা ছমছম করে।। ‘ঘর যে একবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঢুকি কী করে? ‘কে, সৌখী। ওমা তুই। আমি ভাবি কে না কে।
বুড়ি ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছে।...এ ছেলে বুড়াে হয়েও সেই একই রকম থেকে গেল। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ফিরছে; বুক ফুলিয়ে পাড়া জাগিয়ে ঢুকতে পারত বাড়িতে অনায়াসে। কিন্তু দরজায় টোকা মেরে মা-র সঙ্গে খুনশুড়ি হচ্ছিল এতক্ষণ।...এ আনন্দ তার রাখবার জায়গা নেই।..
‘লাটসাহেব জেল দেখতে গিয়েছিল। আমার কাজ দেখে খুশি হয়ে ছেড়ে দেবার হুকুম দিয়ে দিল। খুশি আর কী। হেড জমাদার সাহেবকে টাকা খাইয়েছিলম। সেই সুপারিশ করে দিয়েছিল জেলারবাবুর কাছে। তাই বেশি রেমিশন পেয়ে গেলাম। আচ্ছা, তুই কুপিটা জ্বাল তাে আগে। তারপর সব কথা হবে।
দরকারের চাইতেও জোরে কথাগুলাে বলল সৌখী যাতে ঘরের অন্য সকলেও শুনতে পায়। তারপর মাকে কেরােসিন তেলের টেমিটাকে খুজতে সাহায্য করবার জন্য দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে তুলে ধরে।
বুড়ি এতক্ষণে আলােতে মুখ দেখতে পেল ছেলের। চুলে বেশ পাক ধরেছে এবার; তাই বাপের মুখের আদল ধরা পড়ছে ছেলের মুখে। রােগা-রােগা লাগছে যেন। সেখীটার তাে বাপের মতাে জেলে গেলে শরীর ভালাে হয়। তবে এবার এমন কেন? ছেলের চোখের চাউনি ঘরের দুর দেয়াল পর্যন্ত কী যেন খুঁজছে। কাদের খুঁজছে সে কথা আর বুড়িকে বুঝিয়ে বলে দিতে হবে না।...
‘হারে, জেলে তাের অসুখ-বিসুখ করেছিল নাকি? সৌখী এ প্রশ্ন কানে তুলতে চায় না; জিজ্ঞাসা করে, ‘এদের কাউকে দেখছি না?” প্রতি মুহুর্তে বুড়ি এই প্রশ্নের ভয়ই করছিল। জানা কথা যে, জিজ্ঞাসা করবেই; ...তবু. ‘বউ বাপের বাড়ি গিয়েছে। ‘হঠাৎ বাপের বাড়ি ?
...এতদিন পর বাড়ি ফিরেছে ছেলে। এখনই সব কথা খুলে বলে তার মেজাজ খারাপ করে দিতে চায় না। মরদের রাগ। শুনেই এখনই হয়তাে ছুটবে রাগের মাথায় দলের লােকের সঙ্গে বােঝাপড়া করতে।
...নাতি আর বউয়ের শরীর খারাপের কথাও এখনই বলে কাজ নেই। ছেলে ছেলে করে মরে সৌখী। আগের বউটার ছেলেপিলে হয়ইনি। এ বউয়ের ওই একটিই তাে টিমটিম করছে। তার শরীর খারাপের কথা শুনলে হয়তাে সৌখী এখানে আর একদিনও থাকবে না। এতদিন পর এল। একদিনও কাছে রাখতে পারব। না? খেয়ে-দেয়ে জিরিয়ে সুস্থির হয়ে থাকুক এক-আধদিন। তারপর সব কথা আস্তে আস্তে বলা যাবে।..
“কেন, মেয়েদের কী মা বাপকে দেখতে ইচ্ছে করে না একবারও?' | ‘না না, তাই কী বলছি নাকি?’ অপ্রতিভের চেয়ে হতাশ হয়েছে বেশি সৌখী। তার বাড়ি ফিরবার আনন্দ অর্ধেক হয়ে গিয়েছে মুহূর্তের মধ্যে। ছেলেটা কেমন দেখতে হয়েছে, তাই নিয়ে কত কল্পনার ছবি এঁকেছে জেলে বসে বসে। ছেলে কেমন করে গল্প করে মায়ের সঙ্গে তাই শুনবার জন্য টোকা মারবার আগে দরজায় কান ঠেকিয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। ভেবেছিল রাত নটার মধ্যে দুরন্ত ছেলেটা নিশ্চয়ই ঘুমােবে না। সে মনে মনে ঠিক করে ফেলে যে...কালই সে যাবে শ্বশুরবাড়ি বউছেলেকে নিয়ে আসতে। এ কথা এখনই মাকে বলে ফেলা ভালাে দেখায় না; নইলে মা আবার ভাববে যে নতুন বউ এসে ছেলেকে পর করে নিয়েছে। ...মা কত কী বলে চলেছে; এতক্ষণে শেষের কথাটা কানে গেল।
‘নে, হাতমুখ ধুয়ে নে। “না না। আমি খেয়ে এসেছি। এই রাত করে আর তােক রাঁধতে বসতে হবে না।' ‘না, রাঁধছে কে। খইমুড়ি আছে। খেয়েনে। তুই যে কত খেয়ে এসেছিস, সে আর আমি জানি না।
ব্যবসার পুজি খইমুড়িগুলাে শেষ করে শােয়ার সময় তার হঠাৎ নজর গেল মা-র গায়ের ছেড়া কম্বলখানার দিকে।
‘ওখান আমাকে দে।” আপত্তি ঠেলে সৌখী নিজের গায়ের নতুন কম্বলখানা মায়ের গায়ে জড়িয়ে দিল।
নতুন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েও বুড়ির ঘুম আসতে চায় না। পা কিছুতেই গরম হয় না, রাজ্যের দুশ্চিন্তায় মাথা গরম হয়ে উঠেছে। সৌখীর নাকডাকানির একঘেয়ে শব্দ কানে আসছে। এতদিন পর ছেলে বাড়ি এল; কোথায় নিশ্চিন্ত হবে, তা নয়, সৌখীকে কী খেতে দেবে কাল সকালে, সেই হয়েছে বুড়ির মস্ত ভাবনা। আজকের রাতটা না হয় বিক্রির খইমুড়ি দিয়ে কোনােরকমে চলে গেল।...যদি বলত দুটো ভাত খেতে ইচ্ছা। করছে, তাহলেই আর উপায় ছিল না, সব কথা না বলে। ...আলু-চচ্চড়ি খেতে কী ভালােই বাসে সৌখাটা! কতকাল হয়তাে জেলে খেতে পায়নি। আলু, চাল, সরষের তেল সবই কিনতে হবে। অত পয়সা পাব কোথায় ? ভােরে উঠেই কী ছেলেকে বলা যায় যে, আগে পয়সা জোগাড় করে আন, তবে বেঁধে দেব!...।
..কাছারির ঘড়িতে দুটো বাজল। ...ভেবে কূলকিনারা পাওয়া যায় না।..
মনে পড়ল যে, পেশকারসাহেবের বাড়ি রাজমিস্ত্রি লেগেছে। আজ যখন মুড়ি বেচতে গিয়েছিল তখন দেখেছে যে, পড়ে যাওয়া উত্তরের পাঁচিলটা গাঁথা হচ্ছে। বুড়ি বিছানা থেকে উঠে পা টিপে টিপে বেরােল ঘর থেকে।
...নাতি আর বউয়ের শরীর খারাপের কথাও এখনই বলে কাজ নেই। ছেলে ছেলে করে মরে সৌখী। আগের বউটার ছেলেপিলে হয়ইনি। এ বউয়ের ওই একটিই তাে টিমটিম করছে। তার শরীর খারাপের কথা শুনলে হয়তাে সৌখী এখানে আর একদিনও থাকবে না। এতদিন পর এল। একদিনও কাছে রাখতে পারব। না? খেয়ে-দেয়ে জিরিয়ে সুস্থির হয়ে থাকুক এক-আধদিন। তারপর সব কথা আস্তে আস্তে বলা যাবে।..
“কেন, মেয়েদের কী মা বাপকে দেখতে ইচ্ছে করে না একবারও?'
‘না না, তাই কী বলছি নাকি?’ অপ্রতিভের চেয়ে হতাশ হয়েছে বেশি সৌখী। তার বাড়ি ফিরবার আনন্দ অর্ধেক হয়ে গিয়েছে মুহূর্তের মধ্যে। ছেলেটা কেমন দেখতে হয়েছে, তাই নিয়ে কত কল্পনার ছবি এঁকেছে জেলে বসে বসে। ছেলে কেমন করে গল্প করে মায়ের সঙ্গে তাই শুনবার জন্য টোকা মারবার আগে দরজায় কান ঠেকিয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। ভেবেছিল রাত নটার মধ্যে দুরন্ত ছেলেটা নিশ্চয়ই ঘুমােবে না। সে মনে মনে ঠিক করে ফেলে যে...কালই সে যাবে শ্বশুরবাড়ি বউছেলেকে নিয়ে আসতে। এ কথা এখনই মাকে বলে ফেলা ভালাে দেখায় না; নইলে মা আবার ভাববে যে নতুন বউ এসে ছেলেকে পর করে নিয়েছে। ...মা কত কী বলে চলেছে; এতক্ষণে শেষের কথাটা কানে গেল।
‘নে, হাতমুখ ধুয়ে নে। “না না। আমি খেয়ে এসেছি। এই রাত করে আর তােক রাঁধতে বসতে হবে না।' ‘না, রাঁধছে কে। খইমুড়ি আছে। খেয়েনে। তুই যে কত খেয়ে এসেছিস, সে আর আমি জানি না।
ব্যবসার পুজি খইমুড়িগুলাে শেষ করে শােয়ার সময় তার হঠাৎ নজর গেল মা-র গায়ের ছেড়া কম্বলখানার দিকে।
‘ওখান আমাকে দে।” আপত্তি ঠেলে সৌখী নিজের গায়ের নতুন কম্বলখানা মায়ের গায়ে জড়িয়ে দিল।
নতুন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েও বুড়ির ঘুম আসতে চায় না। পা কিছুতেই গরম হয় না, রাজ্যের দুশ্চিন্তায় মাথা গরম হয়ে উঠেছে। সৌখীর নাকডাকানির একঘেয়ে শব্দ কানে আসছে। এতদিন পর ছেলে বাড়ি এল; কোথায় নিশ্চিন্ত হবে, তা নয়, সৌখীকে কী খেতে দেবে কাল সকালে, সেই হয়েছে বুড়ির মস্ত ভাবনা। আজকের রাতটা না হয় বিক্রির খইমুড়ি দিয়ে কোনােরকমে চলে গেল।...যদি বলত দুটো ভাত খেতে ইচ্ছা। করছে, তাহলেই আর উপায় ছিল না, সব কথা না বলে। ...আলু-চচ্চড়ি খেতে কী ভালােই বাসে সৌখাটা! কতকাল হয়তাে জেলে খেতে পায়নি। আলু, চাল, সরষের তেল সবই কিনতে হবে। অত পয়সা পাব কোথায় ? ভােরে উঠেই কী ছেলেকে বলা যায় যে, আগে পয়সা জোগাড় করে আন, তবে বেঁধে দেব!...।
..কাছারির ঘড়িতে দুটো বাজল। ...ভেবে কূলকিনারা পাওয়া যায় না।..
মনে পড়ল যে, পেশকারসাহেবের বাড়ি রাজমিস্ত্রি লেগেছে। আজ যখন মুড়ি বেচতে গিয়েছিল তখন দেখেছে যে, পড়ে যাওয়া উত্তরের পাঁচিলটা গাঁথা হচ্ছে। বুড়ি বিছানা থেকে উঠে পা টিপে টিপে বেরােল ঘর থেকে।
মাতাদিন পেশকারের বাড়ি বেশি দূরে নয়। পাঁচিল সেদিন হাত দুই-আড়াই উঁচু পর্যন্ত গাঁথা হয়েছে। মাটি আর ভাঙা ইটের পাহাড় নীচে পড়ে থাকায়, সে পাঁচিল ভাঙতে বুড়ির বিশেষ অসুবিধা হল না।.. বাড়ি নিশুতি!
অন্ধকারে কী কোথায় আছে ঠাহর করা শক্ত। বারান্দায় দোরগােড়ায় গুছিয়ে রাখা রয়েছে পেশকার সাহেবের খড়মজোড়া, আর জলভরা ঘটি—ভােরে উঠেই দরকার লাগবে বলে।
ভয়ে বুড়ি উঠোনের আর কোথায় কী আছে, হাতড়ে হাতড়ে খুঁজবার চেষ্টা করল না। ঘটিটি তুলে নিয়ে পাঁচিল টপকে বাইরে বেরিয়ে এল নিঃশব্দে। জলটুকু পর্যন্ত ফেলেনি। এখন রাতদুপুরে লােটা হাতে যেতে দেখলেও কেউ সন্দেহ করবে না।
এদেশে লােটা বিনা সংসার অচল। দিনে বারকয়েক লােটা না মাজলে মাতাদিন পেশকারের হাত নিশপিশ করে। সেইজন্য হুলস্থুল পড়ে গেল তার বাড়িতে সকালবেলায়।
খােকার মা নাকে কেঁদে স্বামীকে মনে করিয়ে দিলেন যে, লােটা হল বাড়ির লক্ষ্মী; ...এখনই আর একটি কিনে আনা দরকার বাড়ির লক্ষ্মীশ্রী ফিরিয়ে আনতে হলে। কর্তার মেজাজ তখন তিরিক্ষি হয়ে আছে চোরের উপর রাগে।‘বাজে বক্ কোরাে না। তােমাদের তাে কেবল এই আইনের ধারায় স্পষ্ট লেখা আছে যে, চুরির খবর পুলিশকে না দিলে জেল পর্যন্ত হতে পারে; সে খবর রাখাে?
আইনচ মাতাদিন আরও অনেক ঝাঝালাে কথা খােকার মাকে শােনাতে শােনাতে বাড়ি থেকে বার হয়ে গেলেন থানায় খবর দেবার জন্য।
ফিরতিমুখে তিনি এলেন বাসনের দোকানে। নানা রকম ঘটি দেখাল দোকানদার; কিন্তু পছন্দসই কিছুতেই পাওয়া গেল না। পেশকারসাহেব বড়াে খুঁতখুতে লােটা সম্বন্ধে। তিনি চান খুরাে-দেওয়া লােটা—বুঝলেন কিনা—এই এত বড়াে সাইজের—মুখ হওয়া চাই বেশ ফাদালাে—যাতে বেশ হৃষ্টপুষ্ট মেয়েমানুষের এতখানি মােটা রুপাের কাকনসুস্থ হাত অনায়াসে ঢোকানাে যায়, ভিতরটা মাজবার জন্য। ...দোকানদার শেষকালে হাল ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করে—পুরােনাে হলে চলবে? নামেই পুরােনাে। সস্তায় পাবেন। আড়াই টাকায়।
পুরােনাে বাসনও বিক্রি হয় নাকি এখানে? দেখি।
ঘটি দেখেই তার খটকা লাগল। পকেট থেকে চশমা জোড়া বার করে নাকের ডগায় বসালেন। ...খুরাের নীচে ঠিক সেই তারা আঁকা! আর সন্দেহ নেই !..
মাতাদিন পেশকার আইনের ধারা ভুলে গিয়ে দোকানদারের টুটি চেপে ধরেন।—'বল! এ লােটা কোখেকে পেলি? দিনে করিস দোকানদারি—আর রাতে বার হস সিঁধকাঠি নিয়ে!
একেবারে হই-হই-রইরই কাণ্ড। দোকানে লােক জড় হয়ে গেল। দোকানদার বলে যে, সে কিনেছে এই ঘটি নগদ চোদ্দো আনা পয়সা গুনে, সৌখীর মায়ের কাছ থেকে—এই কিছুক্ষণ মাত্র আগে।
‘চোদ্দো আনায় এই ঘটি পাওয়া যায় ? চোরাই মাল জেনেই কিনেছিস! চোরাই মাল রাখবার ফৌজদারি ধারা জানিস ?”
পেশকারসাহেব থানায় পাঠিয়ে দিলেন একজন ছােকরাকে, দারােগাকে ডেকে আনবার জন্য। চোর ধরা পড়বার পর দারােগাসাহেবের কাজে আর ঢিলেমি নেই। তখনই সাইকেলে এসে হাজির। সব ব্যাপার
শুনে তিনি সদলবলে সৌখীর বাড়িতে গিয়ে ঠেলে উঠলেন। সৌখীর মা আলুর তরকারি চড়িয়েছে উনােনে। ছেলে তখনও ওঠেনি বিছানা ছেড়ে।